ফোরকান আলীর হাতে একটা মোবাইল ফোনের মেমোরি কার্ড। তিনি মেমোরি কার্ডটা শামীমের সামনে রাখতে রাখতে বললেন, এতে তো হবে না শামীম সাহেব, এটা যথেষ্ট না। আপনাদের কথাবার্তা খুবই অস্পষ্ট। ঘটনার বিষয়ে বিশদভাবে কিছু বলা নেই। তার ওপর ফোনের নেটওয়ার্কে মনে হয় ঝামেলা ছিল। তার কথাও স্পষ্ট শোনা যায় না।
শামীম জড়সড় গলায় বলল, এর বেশি কীভাবে করব স্যার?
কীভাবে করবেন, সেটা আমি কীভাবে বলব? আপনার জন্য আমি এত বড় উপকার করছি, আর আপনি আমার এইটুক উপকার করবেন না?
উনি আমাকে বিশ্বাস করেন ঠিক আছে। কিন্তু স্যার, ওই খুনের বিষয়টাতে তো আমার সাথে ওনার আলাপ করার কথা না। বিষয়টা নিয়ে যে আমি কথা বলব, কোন প্রসঙ্গে তুলব? আমার সাথে তো কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না।
সেটা আপনি ঠিক করবেন। আমার একটা ভয়েস রেকর্ড দরকার, তাতে ওয়াসিমের ডিটেলস স্পষ্ট স্টেটমেন্ট দরকার, ব্যস।
কিন্তু স্যার…।
শোনেন শামীম সাহেব, আপনার স্ত্রীকে এতগুলো টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, তার বাইরেও তো আপনি টাকা-পয়সা কম সরাননি। প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলাম, আপনি সেয়ানা লোক। তো এটা কেন বোঝেন না, আপনার বড় ভাই যদি নিরাপদে ফেরত আসে আর সহি সালামতে থাকেন। তবে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন আপনি!
শামীম কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, বুঝি স্যার।
তাহলে? এই সুযোগ কী বারবার আসবে? শোনেন, আপনাকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আপনি টাকা সরান, যেখানে ইচ্ছে যান। এই নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার মাথাব্যথা আপনার বড় ভাইকে নিয়ে। এখন মাথাব্যথাটা আপনারও। সে যদি ভালোভাবে ঢাকায় ফিরে আসতে পারে, আপনার ধারণা এই যে টাকা পয়সার হিসাব, তার অবর্তমানে আরো যেসব চালাকি করেছেন সেগুলো সে ধরতে পারবে না? এরপর আপনার অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছেন? আপনার সামনে এখন সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ যেভাবেই হোক তাকে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দেয়া। যাতে সে আর উঠতে না পারে। শুধুমাত্র তাহলেই আপনি নিরাপদ। আমার দিক থেকে আপনাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।
জি স্যার। সেটা জানি বলেই তো আপনার সাথে কাজ করছি। কিন্তু স্যার উনি ওই খুনের ব্যাপার নিয়ে আমার সাথে কেন কথা বলবেন?
কারণ আপনি তাকে কথা বলতে ইনফ্লুয়েন্স করবেন।
কীভাবে?
আপনি তাকে বলবেন যে আপনাকেও আমরা সন্দেহ করছি, মানে তার সহযোগী হিসেবে। আপনাকে যে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, এটাও বলেন। এগুলো আগে থেকে বলে দেয়ার কিছু নেই। আমি একটা ক্ল দিলাম, আপনি এখন বাকিটা নিজের মতো করে করেন।
শামীম মৃদু কণ্ঠে বলল, জি স্যার।
ফোরকান আলী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, একটা কথা মনে রাখবেন শামীম সাহেব, এইটা ছাড়া কিন্তু আপনার সেফ এক্সিটের আর কোনো পথ নেই। আর এইটা না পারলে আপনাকে আমি ইয়াবা মামলায় ফাঁসিয়ে দেবো। সবার আগে। তারপর ক্রসফায়ার করে দেবো, মনে রেখেন।
.
তনু ঠিকঠাক পৌঁছেছে। কুড়িগ্রামের এই গ্রামে এসে তার মনে হচ্ছে, সে বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোথাও চলে এসেছে। কুড়িগ্রামে একইসাথে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা নদী। এই সময়টায় সেই নদী শুকিয়ে মাইলের পর মাইল ধূ ধূ বালুচর হয়ে থাকে। বিস্তীর্ণ বালুচরের মাঝেমধ্যে আবার নদী, তারপর আবার বালুচর। এখানে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়াও দুরূহ ব্যাপার। কখনো কখনো সামান্য সিগন্যাল পাওয়া গেলেও পরক্ষণেই নাই হয়ে যায়। আর থাকলেও তাতে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। শামীমের সাথে অবশ্য গত সাতদিনে একবার মাত্র কথা হয়েছে তনুর। তার শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শামীম বলেছে ডেলিভারির আগেভাগেই চলে আসবে। কিন্তু সেই চলে আসাটা যে কবে, তা জানার কোনো উপায় নেই। এদিকে সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তনু ভয় পাচ্ছে তার শরীর নিয়ে। এখানে নানা কিছুর সমস্যা। তার ওপর এবার। প্রেগন্যান্সির পর থেকেই যে মানসিক ধকলটা গিয়েছে, তা অকল্পনীয়। শরীরটাও দিনদিন অসহযোগিতা করছে। এখানে আসার পর থেকে হাফসাও খুব যন্ত্রণা করছে। সারারাত, এক ফোঁটা ঘুমায় না। আশেপাশে কোনো ডাক্তার, হাসপাতালের সুবিধাও বলতে গেলে নেই। তনু দিনরাত অপেক্ষা করতে থাকে শামীমের।
.
হাসান সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে অনুকে সে বিয়ের কথা বলবে। তার ধারণা, এখন আর এ বিষয়ে অনুর কোনো সমস্যা বা আপত্তি থাকার কথা না। আপত্তি যদি কিছু থেকেও থাকে, তবে তা হাসানের বাসায়। যদিও সেই সমস্যাও খুব একটা প্রকট হবে বলে হাসানের মনে হয় না। হাসানের মা জেসমিন জেবিন প্রগতিশীল নানান আন্দোলনের সাথে যুক্ত। নারীবাদী নেত্রী হিসেবেও তার বেশ পরিচিতি। টেলিভিশনের টক শো, পত্রিকার পাতায় তিনি নিয়মিত এসব নিয়ে কথাও বলেন। তবে সবার আগে জরুরি হচ্ছে অনুর কাছ থেকে সম্মতি নেয়া। এখানেই হাসান কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত। প্রথমত, অনুকে এই কথাটা বলার জন্য যে মানসিক শক্তি তার দরকার সেটি নিয়ে সে নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে, যদি কোনোভাবে অনু তাকে ফিরিয়ে দেয়, তখন সেই ধাক্কাটা সে সামলাতে পারবে কি-না, হাসান জানে না। বার কয়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনুকে সেই ইঙ্গিতও হাসান দিয়েছিল। কিন্তু অনু তাতে সাড়া দেয়নি। হাসান এখন সরাসরিই কথাটা বলতে চাইছে। এমনও তো হতে পারে যে অনু তার ইশারার ভাষাটা বোঝেনি।
অনুর সাথে পরেরদিন সন্ধ্যার পরে দেখা হতে হাসান বলল, আমার একটা ইচ্ছে হচ্ছে খুব।
কী ইচ্ছে?
বলতে ভয় হচ্ছে।
যে ইচ্ছে বলতে ভয় হয়, সেই ইচ্ছেয় অপরাধবোধ থাকে।
এটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়।
কোনো কিছুই সবক্ষেত্রে সত্যি না। যে ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে, আমরা সে ঘটনাগুলোকে রেফারেন্স ধরে নিয়ে বলি।
হাসান সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আমরা কিন্তু এখন আপনি আপনি করেই বলছি।
অনু হাসলো, আমি তো বয়সে বড়, বড়দের আপনি করেই বলতে হয়।
হাসান আর কথা বলল না। তারা ফাঁকা রাস্তায় রিকশায় ঘুরছে। আজ পূর্ণিমা কি-না কে জানে, তবে আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। শীতের প্রায় শেষ সময়, একটা বাসন্তী হাওয়া যেন মোলায়েম স্পর্শে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। হাসান আড়চোখে অনুর দিকে তাকালো। অনু তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। এই মেয়েটাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে। কিন্তু কেন ভালোবাসে, সেই কারণটি সে জানে না। তবে একটা বিষয়ে হাসান নিশ্চিত, এই মেয়েটা যা বলবে, যা করবে, তার সবই সে অপার মুগ্ধতা নিয়েই দেখবে। তার কাছে মনে হবে, এটি এরচেয়ে ভালো আর কোনোভাবেই করা যেত না, বলা যেত না।
সে খানিক সময় নিয়ে প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে অস্ফুটে বলল, বিয়ের পরও কী আমরা আপনি আপনি করেই কথা বলব?
অনু হাসানের দিকে তাকালো না অব্দি। যেমন ছিল, ঠিক তেমনই আকাশের দিকে মুখ করে বসে রইল। হাসান নিশ্চিত হতে পারছে না। অনু কী তার কথা শুনেছে, না-কি শোনেনি? সম্ভবত শোনেনি। শুনলে অন্তত তার চোখে মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যেত। আর শুনবেই বা কেমন করে? অত আস্তে করে বললে কেউ শোনে? হাসানের এখন কেন যেন মনে হচ্ছে, সে আসলে কিছু বলেইনি। কেবল মনে মনে ভেবেছিল যে সে বলবে!
.
পরের দিন অফিস শেষে হাসানের সাথে দেখা হলো অনুর। হাসানের মুখটা থমথমে। তারা ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে হাইকোর্টের পাশটাতে চলে এলো। অনু বলল, কি হয়েছে?
হাসান হাসার চেষ্টা করলো, কিছু না।
বলেন।
কিছু না।
আচ্ছা, আমরা যদি বিয়ে করতে চাই, কিছু সমস্যা সামনে এসে দাঁড়াবে, সমস্যাগুলো প্রাথমিকভাবে আমাকে ফেস করতে হবে না। ফেস করতে হবে আপনাকে। আপনি কী সেটার জন্য প্রস্তুত?
হাসান আচমকা বুঝতে পারল না অনু কী বলছে! সে হতভম্ব হয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে রইল। অনু ধীর-স্থির, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে যাচ্ছে। হাসান তার হাঁটার গতি সামান্য বাড়িয়ে আবার অনুর পাশাপাশি হলো। অনু বলল, কী, প্রস্তুত?
হাসান হড়বড় করে বলল, এমন তো নয় যে সিদ্ধান্তটা হুট করে নেয়া, কম করে হলেও চার বছর।
এই মুহূর্তে প্রস্তুত কি-না?
পুরোপুরি।
যদি বাসায় ঝামেলা হয়?
হবে না। আর হলেও আমি ম্যানেজ করে ফেলবো।
বিয়ের পরেও আমি চাকরি করলে কোনো সমস্যা নেই তো?
একদম না।
কোনোকিছুতেই না?
কোনোকিছুতেই না। কেবল এমন করে পাশে থাকলেই হবে। এমন একটা মানুষ পাশে থাকলে জীবনটা অনেক সহজ মনে হয়।
কঠিনও তো হতে পারে?
দুজন মিলে সামলে নেব।
অনু এই প্রথম নিজ থেকে হাত বাড়ালো। তার হাতের মুঠোয় হাসানের হাত। সে স্পষ্ট গলায় বলল, বাসায় কথা বলল।
.
হাসানের বাসায় বিষয়টা নিয়ে উচ্চবাচ্য না হলেও একটা থমথমে ভাব হয়ে রইল। হাসানের বাবা বললেন, তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত হাসান। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সারা জীবন পস্তাতে হয়।
হাসান বলল, তুমি ভেবো না বাবা, আই উইল ম্যানেজ।
হাসানের বাবা তেমন আর কিছু বললেন না। তবে হাসানের মা জেসমিন জেবিন ভার হয়ে রইলেন। সেদিন রাতেই তিনি দক্ষিণ এশীয় নারীদের অধিকার সচেতনতা বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নিতে দিল্লি যাচ্ছেন। যাওয়ার আগে তিনি শুধু বললেন, বিয়ের ক্ষেত্রে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হাসান। এটা মাথায় রেখো, বাদবাকি কথা আমি দিল্লি থেকে এসে বলছি।
.
রাতে অনুকে ফোন করলো হাসান, রাতের খাবার হলো?
হ্যাঁ, তোমার?
আমারও। কাল অফিস আছে?
আছে।
এখন কি ঘুম?
নাহ্, আরো কিছুক্ষণ জেগে থাকব।
জেগে জেগে কী?
স্বপ্ন দেখবো।
জেগে জেগে স্বপ্ন?
স্বপ্ন জেগে জেগেই দেখতে হয়। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলে ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই তা ভেঙে যায়।
তা ঠিক।
তুমি কী করবে?
আমি? জানি না। আমার ঘুম আসছে না।
কেন?
আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
বাসায় সব বলা হয়ে গেল?
হুম।
কী বলল সবাই?
সব ঠিক আছে।
সত্যি তো?
না মানে, একটু অফ মনে হলো সবাইকে। বাট ম্যানেজ হয়ে গেছে। আমার ফ্যামিলি তো আমি চিনি। ওরা সবাই অনেক ভালো। এ বাসায় আসলে মন ভালো হয়ে যাবে।
অনু মৃদু হাসলো, তাহলে তো ভালোই।
আমি রাখবো তাহলে?
রেখে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে?
উঁহু।
তাহলে?
কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
বলল তাহলে।
কিন্তু কী কথা বলব বুঝতে পারছি না।
যা ইচ্ছে বলো।
হাসান অবশ্য কিছু বলতে পারল না। সে ফোন কানে চুপচাপ বসে রইল। অনু বলল, তোমার ওই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লেগেছে।
কোন ব্যাপারটা?
যেভাবে আমাকে বিয়ের কথা বললে! আমার ধারণা পৃথিবীতে আর কেউ কাউকে এভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়নি।
কীভাবে?
এই যে দুম করে বলে বসলে, আচ্ছা, বিয়ের পরও কী আমরা আপনি আপনি করেই বলব?
হাসান কথা বলল না। অনু বলল, কী অদ্ভুত না? না আমাদের কখনো প্রেমের কথা হলো, না ভালোবাসাবাসির কথা হলো। কিন্তু তুমি সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেললে? তাও আবার এভাবে!
হাসান হাসলো, আমার খুব ভয় হচ্ছিল। পরে মনে হচ্ছিল হয়তো আমি কিছুই বলিনি, মনে ভেবেছিলাম কেবল।
কেন?
কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি যে?
কার?
হাসান কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল।
অনু বলল, বলো, বলো, কার?
হাসান এবারও চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আপ…।
অনু শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। তারপর বলল, আমি এতক্ষণ ধরে খেয়াল করছিলাম, এই পুরো কনভার্সেশনে তুমি একবারের জন্যও আমাকে আপনি বা তুমি কিছু বলেনি! কী ব্যাপার ভয় পাচ্ছ?
সেদিন যে বয়সে বড়’র অজুহাত ছিল?
তো? বয়সে বড় হলে তাকে বিয়ে করা যাবে, আর তুমি করে বলা যাবে না? আচ্ছা, ডিল ফাইনাল, আমি তোমাকে তুমি করেই বলব। কিন্তু তুমি আমাকে আপনি, ওকে?
হাসান জবাব দিলো না। অনু হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না হাসান।
কী?
আমারও কোনোদিন নিজের একটা সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ হতে পারে। একটা ঘর হতে পারে।
কেন হতে পারে না?
তা তো জানি না। তবে এই এতটা কাল নিজেকে যে কী একা, নিঃসঙ্গ লাগত, কাউকে বোঝাতে পারব না। সেই একা, নিঃসঙ্গ, শূন্য মানুষটাকে তুমি কানায় কানায় পূর্ণ করে দিচ্ছ হাসান।
পারছি তো?
অনেক বেশি। আমার কল্পনার চেয়েও বেশি। আমার খুব সিনেমার মতো করে বলতে ইচ্ছে করছে, আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে না তো? কিন্তু আমার মতো কঠিন কোনো মেয়ের মুখে কথাটা খুব উদ্ভট শোনাবে। এইজন্য বলতে পারছি না।
হাসান গাঢ় কণ্ঠে বলল, কখনো যাব না।
একটা কথা কী জানো?
কী?
তুমি যত কঠিন মানুষই হও না কেন, ভালোবাসার কাছে মানুষ খুব অসহায়। একটুখানি সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য মানুষ জীবনভর হাহাকার করে, বুকের ভেতরের কঠিন পাথরটাকেও গলিয়ে দেয়। এই ভালোবাসাটা ব্যাপারটা কেমন, জানো?
কেমন?
ধরো, তুমি কঠিন বা খুব লজিক্যাল একটা মানুষ। আশেপাশের প্রেমিক প্রেমিকাদের কাণ্ডকারখানা দেখে হাসি পায়, বা নাক সিটকায়। মনে হয়, কী সব ন্যাকামি, আদিখ্যেতা! কিন্তু সেই তুমিই যখন সত্যিকারের কারো প্রেমে পড়ে যাবে, তখন দেখবে, ওইসব আদিখ্যেতা তোমারও করতে ইচ্ছে করছে। তোমারও তাকে চুপিচুপি বলতে ইচ্ছে করছে, আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে না তো? তোমাকে ছাড়া কিন্তু আমি বাঁচব না। কী অদ্ভুত না?
হাসান হাসলো, ঠিক তাই।
বিষয়টা খুব অদ্ভুত। মানুষ এমনই বুঝেছ, খুব ভালোবাসার কাঙাল। শুধু একটু সত্যিকারের ভালোবাসার জন্য সে অপেক্ষায় জীবন কাটিয়ে দিতে পারে।
আমি জানি।
আমাকে জানো?
হু।
অনু মৃদু হেসে বলল, আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না তো, এটা জিজ্ঞেস করে, একটু অন্যভাবে জিজ্ঞেস করি?
কীভাবে?
আমরা কী বাকিটা জীবন একসাথেই থাকছি?
শেষ মুহূর্ত অব্দি।
যদি কখনো চলে যাও? কেন চলে যাব?
চলে যাওয়ার জন্য আসলে কারণ লাগে না হাসান, অজুহাত লাগে। আর অজুহাত সবারই থাকে।
হাসান গাঢ় কণ্ঠে বলল, আমরা একসাথেই থাকছি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
অনু হাসলো। তার এইটুকু জীবনে এমন আনন্দময় হাসি আর সে কখনো হাসেনি।
*
তনুর সাথে আজ কথা হয়েছে শামীমের। তাকে নিয়ে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে এসেছিল শামীমের মা। সেখান থেকেই শামীমের সাথে কথা হয়েছে। শামীমের গলা শুনে তনুর মনে হলো বহুকাল তেষ্টার পর কনকনে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পান করলো সে। শামীম বলল, তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
তনু বলল, তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
আমার গলা ঠিক আছে।
ঠিক নাই। তুমি আগে আমার সাথে কথা বলতে বাসের হেল্পারদের মতো, এখন কথা বলছ প্লেনের এয়ার হোস্টেসদের মতো।
তুমি কখনো প্লেনে চড়েছ? এয়ার হোস্টেসরা কীভাবে কথা বলে বুঝলে কী করে?
টিভিতে দেখেছি। তুমি একটা কাজ করতে পারবে?
কী কাজ?
আমার সাথে বাসের হেল্পারদের মতো কথা বলতে পারবে?
মানে কী?
মানে হলো তোমাকে আমার অচেনা লাগছে। তুমি যত খারাপভাবেই আমার সাথে কথা বলো না কেন, আমার তেমন তোমাকেই লাগবে, আগের তোমাকে।
শামীম রেগে যাওয়া গলায় বলল, ঢং করো না তো তনু, আমার ঢং ভালো লাগে না। তুমি তো আছে শান্তিতে, বুঝবে কী করে!
শামীম রাগী রাগী গলায় আরো কী সব বলে যাচ্ছিল, অদ্ভুত ব্যাপার হলো শামীমের সেই রাগী গলা শুনে তনু হাসছে। সে কিশোরী মেয়ের মতো ঝলমল করে হাসছে। শামীম ধমক দিয়ে বলল, তুমি কী পাগল হয়ে গেছ না-কি, হ্যাঁ? এ কী অভ্যাস?
তনু হাসতে হাসতেই বলল, পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, এখন সুস্থ হয়ে গেছি।
মানে কী?
মানে হলো তোমার এই গলা না শুনতে-না শুনতে, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এখন গলা শোনার পর সুস্থ লাগছে।
শামীম আরো একবার তনুকে ধমক দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী ভেবে আর ধমক দিলো না। সে বলল, তোমার শরীরের কী অবস্থা?
ভালো ছিল না, এখন ভালো।
হেঁয়ালি রেখে সত্যি কথা বলো।
এখন কি বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলব?
ডাক্তার ডেট দিয়েছে?
হুম, হাতে আর সময় বেশি নাই। অল্প কয়েক দিন।
আচ্ছা। তুমি টেনশন করো না, আমি তার আগেই চলে আসবো। এখানকার কাজ আমি প্রায় গুছিয়ে এনেছি।
তনু বলল, আচ্ছা। সে ফোন রাখার আগে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। শামীম বলল, কী হয়েছে?
তনু কান্নার দমকে কথা বলতে পারল না। শামীমের বিরক্ত লাগছে। সে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল, তুমি গাধার মতো কাঁদছ কেন?
গাধা কী কাঁদতে পারে?
কথা প্যাচাবে না। কেন কাঁদছ, সেটা আগে বলো।
তনু বলল, আনন্দে কাঁদছি।
শামীম এবার চূড়ান্ত বিরক্ত হলো। সে রীতিমত চেঁচিয়ে বলল, আমার সাথে ফাজলামো করবে না। খুব তো আরামে আছ ওখানে, আর আমি এখানে খেটে মরছি, আনন্দে থাকলে ভালো লাগে না, না?
তনু কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর শান্ত গলায় বলল, চোখ মোছো শামীম।
শামীম ফোনটা রেখে দাঁড়িয়ে রইল, তার এখুনি চোখ মুছে ফেলা উচিত। এখন যদি দোকানে কেউ আসে তাহলে সে স্পষ্ট দেখতে পাবে যে শামীম কাঁদছে। বিষয়টা তার জন্য খুবই বিব্রতকর। কিন্তু শামীমের এই মুহূর্তে চোখ মুছতে ইচ্ছে করছে না, তার ইচ্ছে করছে কাঁদতে। বিকেলের দিকে ওয়াসিমের সাথে দীর্ঘ কথোপকথন হয়েছে শামীমের। ওয়াসিম জানিয়েছে, সে এখনো নিশ্চিত নয় যে কবে কখন ঢাকায় ফিরতে পারবে। শামীম অবশ্য এক ফাঁকে জায়েদের খুন সম্পর্কিত বিষয়টাও তুললো। পুলিশ তাকেও সন্দেহ করছে শুনে ওয়াসিম রীতিমত ক্ষেপেই গেল। সে পুলিশের। উদ্দেশ্যে ইচ্ছেমতো গালাগাল করে বলল, খুন করছে একজন, আর এখন দেখি এরা জেল খাটাবে দুনিয়ার সব মানুষজনকে। এইজন্যই এই দেশের পুলিশের উপর কোনো আস্থা নেই মানুষের, বুঝলা শামীম? আসল অপরাধীর খবর নাই, নকল লোকজন নিয়ে টানটানি।
শামীম এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তার ফোনের রেকর্ডার অন করা, সে যতক্ষণ সম্ভব ধৈর্য ধরে ওয়াসিমকে দিয়ে এই বিষয়ক নানান কথাবার্তা বলিয়ে নিলো। ওয়াসিম অবশ্য এমনিতেও পুরো বিষয়টা নিয়েই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ছিল, ফলে রাগের মাথায় ঝালটা যেন শামীমের সাথেই ঝাড়লো। শামীম ফোন রেখে বার দুই লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। সে জানে না কেন, কিন্তু তার বুক কাঁপছে। দোকান বন্ধ করে বড় রাস্তায় উঠে সে ফোরকান আলীকে ফোন দিলো।
ফোরকান আলী কোথায় আছে জেনে নিয়ে তার কাছে মেমোরি কার্ডটা জমা দিয়েই স্বাধীন হয়ে যাবে সে। তারপর শুধু মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে ওড়া। তার আগে অবশ্য আজমের সাথে বসে টাকা-পয়সার একটা বন্দোবস্ত করে ফেলতে হবে। শামীমের অবশ্য অত টাকার দরকার নেই। সামান্য কিছু টাকা হলেই সে খুশি। হতে পারে তা দশ বা পনেরো লাখ। এতেই তার ভালোভাবে চলে যাবে। এই টাকায় কুড়িগ্রাম গিয়ে কিছু একটা শুরু করতে পারবে সে।
আজমের সাথে তার সবকিছু ঠিকঠাকই হয়ে আছে। ওয়াসিম ধরা পড়লে পুরো ব্যবসাটাই চলে যাবে আজমের দখলে। আর ওয়াসিম যদি একবার ধরা পড়ে, তবে তার ছাড়া পাওয়ার সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে। পুলিশের হাতেও এখন অকাট্য প্রমাণ। ওয়াসিম যদি কোনোদিন ছাড়া পায়, তবে তা কুড়ি পঁচিশ বছরের আগে নয়, ততদিনে রাজত্ব পুরোপুরি আজমের। আজমও জানতো, এই সুযোগ বারবার আসবে না। তাছাড়া এখানে কেউ কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয়ও না। তা ওয়াসিমের জন্য যেমন সত্য, সত্য আজমের জন্যও।
ফোরকান আলীর ফোন বন্ধ। বন্ধ ফোনেও বারবার চেষ্টা করলো শামীম। যত দ্রুতসম্ভব মেমোরি কার্ডটা ফোরকান আলীর হাতে পৌঁছে দিতে চাইছে সে। তারপর টাকা-পয়সা নিয়ে কাল পরশুর মধ্যেই কুড়িগ্রাম। তনুর ডেলিভারি ডেটও এর মধ্যেই। সবচেয়ে ভালো হয় তনুর ডেলিভারির আগেই পৌঁছে যেতে পারলে। শামীম আরো একবার ফোরকান আলীর নম্বরে ডায়াল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধই। একবার সরাসরি থানায় চলে যাওয়ার কথাও ভাবলো সে, তবে পরক্ষণেই আবার ভাবলো তার আগে আজমের সাথে একবার কথা বলে নিলে ভালো হয়।
বার দুই ফোন বাজার পর আজম ফোন ধরলো। কিন্তু কিছু একটার প্রচণ্ড শব্দে সে কথা বলতে পারল না। শামীম আরেকবার ফোন দিতেই আজম চেঁচিয়ে বলল, পরে ফোন দিতাছি, এইখানে গাড়ির শব্দে কিছু শোনা যায় না।
শামীম ফোন রেখে হেঁটেই থানার দিকে যাচ্ছিল। এই সময়ে রাস্তার পাশের টেলিভিশন শোরুমের সামনে ভিড় দেখে সে কৌতূহলী হয়ে দাঁড়ালো। শামীম ভেবেছিল টেলিভিশনে হয়তো বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেট খেলা দেখাচ্ছে। কিন্তু কাছে যেতেই তার ভুল ভাঙলো। টেলিভিশনে খবর দেখাচ্ছে। রাস্তা ঘাটের মানুষকে এত আগ্রহ নিয়ে খবর দেখতে দেখে শামীম ভারি অবাক হলো। খানিক কৌতূহল নিয়ে মানুষের ভিড়ে সে নিজেও দাঁড়িয়ে গেল। টেলিভিশনে তখন লাইভ সংবাদ দেখাচ্ছে, গুলশানে একটি রেস্টুরেন্টে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে একটি সশস্ত্র দল ঢুকে পড়ে দেশি বিদেশি অনেক নাগরিককে জিম্মি করে রেখেছে। তাদের কী সব দাবি-দাওয়া রয়েছে। সেই দাবি দাওয়া না মানলে, তারা সব জিম্মিকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। হাজার হাজার পুলিশ আর স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের বাইরে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত ভারি যানবাহনও ছোটাছুটি করছে। অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশের গাড়ির বিরামহীন সাইরেন। কেমন একটা যুদ্ধযুদ্ধ ব্যাপার।
.
ঘটনা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল শামীমের। ঘটনায় পুরো দেশ মুহূর্তেই থমকে গেছে। রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক আর উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে দেশের প্রতিটি মানুষ। কিন্তু শামীমের ভয় তখন অন্য জায়গায়। সে দৌড়ে থানার সামনে গেল। কিন্তু পরিচিতি পুলিশ সদস্যও তার সাথে অপরিচিত মানুষের মতো আচরণ করতে লাগল। ফোরকান আলী অবশ্য থানায় নেই। তাকে জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়েছে গুলশানের ঘটনায়। শামীম এতক্ষণে ফোরকান আলীর ফোন বন্ধ থাকার কারণ বুঝতে পারল। দেশের সকল মানুষ চরম আতঙ্ক নিয়ে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও শামীম কোনো আগ্রহ পেল না। সে বরং রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বাসার দিকে হাঁটা দিলো। এই ঘটনা কবে শেষ হয় কে জানে! যদি এমন হয় যে এই ঘটনা নিয়েই ফোরকান আলী ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর ওয়াসিমের বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়, তখন? তখন একটা বড় বিপদেই পড়তে হবে তাকে। শামীম বাসায় গিয়ে একা একা অনেক রাত অব্দি বসে রইল। আজমকে বার কয়েক ফোনও দিলো এর মধ্যে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো আজমের ফোনও বন্ধ!
দুশ্চিন্তায় সারারাত এতটুও ঘুম হলো না শামীমের। শেষ রাতের দিকে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, আর মাত্র দুটো দিন তার হাতে আছে। এর মধ্যে যদি ঘটনার কোনো সুরাহা না হয়, তবে সে ফোরকান আলীকে না জানিয়েই চলে যাবে। যাওয়ার আগে থানায় গিয়ে ফোরকান আলীর নামে মেমোরি কার্ডটা রেখে যাবে।
পরদিন দুপুরের মধ্যে অবশ্য রেস্টুরেন্টের ঘটনা স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ দিকে মোড় নিলো। জিম্মিকারীরা ঊনিশজন জিম্মিকে হত্যা করেছে। তার মধ্যে বিদেশি নাগরিকই বেশি। ঘটনা নিয়ে দেশ-বিদেশে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। শামীম স্পষ্ট বুঝে গেল, ওয়াসিমের ঘটনা নিয়ে এখন আর কারো কোনো মাথাব্যথা থাকার কারণ নেই। এই ঘটনার রেশ চলবে আগামী কয়েকবছর। ইতোমধ্যেই বিরোধী দল এটিকে ইস্যু করে যেমন রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেছে, তেমনি সরকারি দলও। এই বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্যের তোড়ে দেশে এখন ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেলেও কেউ টের পাবে বলে মনে হচ্ছে না। আর ওয়াসিমের ঘটনা তো সেখানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ!
শামীমের চলে যাওয়ার জন্যও এটি একটা সুবর্ণ সুযোগ, কেউ খেয়ালই করবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আজম। রাত থেকে তার ফোন বন্ধ। তার সাথে দেখা না হলে টাকা পাওয়া যাবে না। পুলিশের ভয়ে শামীম নিজের কাছে নগদ। বা ব্যাংক একাউন্টেও কোনো টাকা রাখেনি। এই টাকার জন্য শামীম আরো দুটো দিন আটকে রইল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় ঢাকায় এলো ওয়াসিম। অবশেষে ফিরে আসার জন্য তাকে ঢাকা থেকে সবুজ সংকেত পাঠানো হয়েছে।
পরদিন ভোর রাতে শামীমের লাশ ভেসে গেল শীতলক্ষায়। ওয়াসিম সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা চোখে সিগারেট টানছিল। শামীমের দুই চোখের মাঝ বরাবর গুলি করে তাকে মেরেছে আজম। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেও শামীমের বিশ্বাস হচ্ছিল না আজম তাকে সত্যি সত্যি গুলি করবে। সে ওয়াসিমের পা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ফোনের রেকর্ডটা তার কাছেই আছে, সে পুলিশে জমা দেয়নি। ওয়াসিম মেমোরি কার্ডটা হাতে নিতেই আজম তার কপাল বরাবর গুলি করলো। শামীম কেবল একবার ডাকলো, আমার হাফসা!
শামীম অবশ্য জেনে যেতে পারল না যে তার একটা পুত্র সন্তানও রয়েছে। তনু সেই পুত্র সন্তানের নাম রাখেনি, কাউকে রাখতেও দেয়নি। সে বলেছে, ছেলের নাম রাখবে ছেলের বাবা। ছেলের বাবা যতদিন না আসবে, ততদিন ছেলের নাম রাখা হবে না।
*
শামীমের খুনের খবর তেমন কেউ জানলো না। রেস্টুরেন্টের জঙ্গি ঘটনার তীব্রতায় চাপা পড়ে গেল আর সবকিছুই। তনুর সাথে অনেকদিন কোনো যোগাযোগও নেই অনুর। সে বার কয়েক ফোনও দিয়েছিল। কিন্তু তনুর ফোন বন্ধ। পুলিশের কথা ভেবে অতি সতর্কতায় শামীমকেও এতদিন ফোন দেয়নি অনু। কিন্তু তনুর জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তার। তনুর ডেলিভারি ডেটও এতদিনে কাছাকাছি চলে আসার কথা। উদ্বিগ্ন অনু শেষ অব্দি শামীমকে ফোন। করলো। কিন্তু শামীমের ফোন বন্ধ। প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও সন্ধ্যা নাগাদ অস্থির হয়ে উঠল সে। পরদিন হাসানের সাথে দেখা হতে ঘটনা কিছুটা বলল অনু। হাসান বলল, এক কাজ করো না কেন? পুলিশ অফিসারের সাথে কথা বলো?
সেটা কী ঠিক হবে? এমনও তো হতে পারে যে তনুকে নিয়ে ও চলে গেছে কোথাও। এমন একটা প্ল্যানও ওদের ছিল।
তাহলে তো অন্তত তোমাকে জানিয়ে যাওয়া উচিত ছিল?
হয়তো কোনো কারণে জানায়নি। পুলিশ ফোন কল ট্র্যাক করছে ভেবেও করতে পারে।
তাহলে আর কী! টেনশন করো না। কয়েকটা দিন একটু অপেক্ষা করো।
অনু অপেক্ষা করলো ঠিকই। কিন্তু কেন যেন এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি পেল না। হাসানের বাসায় বিয়ের কথা অনেকটাই এগিয়েছে। তবে বাসার ঘটনায় হাসান কিছুটা অবাক হয়েছে। সে ভাবেনি তার পছন্দ নিয়ে বাবা-মায়ের এমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে! ছোটবেলা থেকেই সে দেখে এসেছে তার বাবা-মা দুজনই প্রচণ্ড আধুনিক এবং উদারমনা। বিশেষ করে তার মা জেসমিন জেবিন। কিন্তু এই ঘটনায় দুজনের প্রতিক্রিয়াই হাসানকে বেশ খানিকটা আহত এবং বিস্মিত করেছে। যদিও শেষ অব্দি হাসানের যুক্তিতর্কের কাছে হেরে তারা বিষয়টি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু এ যেন সেই মেনে নেয়া, কিন্তু মনে নেয়া নয়।
তনুকে নিয়ে অনুর দুশ্চিন্তা যেমন হচ্ছে, তেমন আবার কিছুটা নির্ভারও লাগছে। এমনও তো হতে পারে যে ওরা নিরাপদেই কোথাও চলে গেছে। তনুও তেমনটাই চাইছিল। শেষ অব্দি হয়তো শামীমকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করে ফেলতে পেরেছিল সে।
শুক্রবার ভোরে হাসান এলো। তার পরনে কিছুটা ভারি কাজ করা অফহোয়াইট পাঞ্জাবি। অনু দুষ্টুমি করে বলল, আজই?
চাইলে আজই, শুক্রবার শুভদিন। আর কথায় আছে না, শুভস্যম শীঘ্রম?
তা আছে, কিন্তু বিয়ে যে শুভ, তার নিশ্চয়তা কী? আশেপাশে যা ঘটনা দেখি, তাতে বিয়েকে তো মনে হয় অশুভস্যম শীঘ্রম।
হাসান হাসলো, ডেটটা ফেলতে একটু সমস্যা হচ্ছে। মায়ের আর বাবার ডেট মিলছে না। এদিকে আমি চাইছি যতদ্রুত সম্ভব বিয়েটা সেরে ফেলতে।
আমাকে ওনারা দেখতে চাননি?
হুম। এর আগে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে আমরা সবাই মিলে একদিন ডিনার করব।
অনুর কেন যেন ভীষণ লজ্জা লাগছিল। এই অনুভূতিটার সাথে সে একদমই পরিচিত না। কখনো এমন অনুভূতি তাকে স্পর্শ করতে পারবে বলেও সে ভাবেনি। মেয়েলি আবেগে পরিপূর্ণ এই তীব্র, গভীর এবং ক্রমশই সর্বপ্লাবী হয়ে ওঠা অনুভূতি সে আগে কখনো টেরও পায়নি। হাসান বলল, একটা কথা, মন খারাপ করবে না তো?
একদম না।
মা-বাবা চাইছেন না বিয়েতে বড় কোনো প্রোগ্রাম হোক। একদমই ঘরোয়া।
অনু হাসলো, আমিও তাই চাই।
কিন্তু আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কী সিদ্ধান্ত?
আমরা বিয়েতে ইচ্ছে মতো কেনাকাটা করব, যত ইচ্ছে তত।
কেন?
কেন মানে? বিয়ে তো জীবনে একবারই করব, বারবার করব না-কি?
চাইলে করতে পারো।
হাসান হাসলো, শোনো যা বলছিলাম। আমাদের কিন্তু প্রতিদিনই একটু একটু শপিং করে রাখতে হবে। না হলে দেখবে পরে আবার ঝামেলা হয়ে যাবে। তখন দুজনের কেউই আর সময় করে উঠতে পারব না।
অনুও হাসলো, আচ্ছা।
চলো তাহলে, আজ থেকেই শুরু করে দেই।
আজই?
হুম, আজই। আজ শুক্রবার, শুভদিন। ছুটির দিনও।
হয়ত একটা চাপা কৌতূহল আর হাসানের তীব্র উচ্ছ্বাস অনুকে সেই সারাটা দিন আটকে রাখলো এই মার্কেট থেকে ওই মার্কেটে। এ দোকান থেকে ও দোকানে। রাতে ঘরে ফিরতে ভীষণ লজ্জা করছিল অনুর। সে তার রুমমেট নাবিলাকে অব্দি কিছু বলেনি। এখন দু’হাত ভর্তি এত এত জিনিসপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকতে তার লজ্জাই লাগছে। কিন্তু অনুর ভাগ্য ভালো, নাবিলা ঘরে নেই। সে ঘরে ঢুকে তড়িঘড়ি জিনিসপত্রগুলো আলমারিতে ঢোকালো। একটা বড় সোনালি বাসো। বাসোটা রাখার আগে আরো কিছুটা বেশি সময়ই বোধহয় সে ছুঁয়ে রাখলো। লাল টকটকে শাড়িটা এই বাসোটার ভেতর। হাসান আক্ষরিক অর্থেই পাগল। সে এই একটা শাড়ির জন্য কত পাগলামিই না করলো! শেষ পর্যন্ত তারা গেল মিরপুরের বেনারশি পল্লিতে। কিন্তু সেখানে গিয়েও অনু চুপচাপ বসেই রইল। হাসান বলল, তুমি কী এমন করেই থাকবে? বলবে তো, কোনটা তোমার পছন্দ?
অনু বলল, আমি তো একবার বলেছিই, আমি খুব একটা বুঝি না।
এটা কোনো কথা হলো? তোমার বিয়ের শাড়ি আর তুমি বুঝবে না?
অনু হাসলো, আগে তো কখনো বিয়ে করিনি, বুঝবো কী করে?
বিয়েতে গিয়েছ তো? আর আজকাল ফেসবুক ভর্তি বিয়ের ছবি…। বলেই হাসান খানিক থমকালো, ওহ্, তোমার তো আবার ফেসবুক নেই। আজই একটা খুলে দেই? দেখবে কত কত মেয়েদের বিয়ের ছবি, কত কত কী!
দরকার নেই।
কেন?
এমনি। আগে নানান ঝামেলায় কখনন করা হয়নি। আর এখন ওসব ভালোও লাগে না, সম্ভবত আমি একটু ওল্ড ফ্যাশানড।
হাসান হাত জোড় করে বলল, মানছি। লেট মি ট্রাই।
হাসান নিজেই পছন্দ করে কিনলো। অনুর কাছে দারুণ লেগেছে শাড়িটি। সে ফিরতে ফিরতে বলল, তুমি কী আগে বিয়ে-টিয়ে করেছ নাকি?
কেন?
এই যে দেখে মনে হচ্ছে বউয়ের জন্য রোজ কয়েকটা করে শাড়ি কেনার অভ্যেস আছে।
হাসান হাসলো, প্রথম প্রাকটিস ম্যাচেই তো দেখছি সিলেকশন বোর্ড হেব্বি কনভিন্সড। তো আর টেনশন কী? হয়ে যাক।
*
তনুকে নিয়ে দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছিল না অনুর। পরদিন নিজ থেকেই সে থানায় গেল। ফোরকান আলী অসম্ভব ব্যস্ত। তিনি অনুকে সময় দিতে পারলেন না। বললেন পরদিন সন্ধ্যায় আবার আসতে। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যায় হাসানের সাথে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল অনুর। অনু শেষ মুহূর্তে এসে বাইরে যাওয়ার পরিকল্পনাটা বাদ দিলো। তবে অনু বের হলো না বলে হাসানের খানিক মন খারাপই হলো। আজকের সন্ধ্যাটা তার কাছে একদমই আলাদা। আজ থেকে বছর কয়েক আগে ঠিক এই দিনটাতেই সে অনুকে প্রথম দেখেছিল। তারপর ক্রমেই বেড়েছে তার অবচেতন মুগ্ধতা। সেই দিনটির কথা ভেবেই হাসানের কিছু পরিকল্পনাও ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কিছুই হলো না।
ফোরকান আলী বললেন, আমরা খুব বাজে অবস্থায় আছি অনু। ইনফ্যাক্ট শুধু আমরা না, পুরো দেশ। সরকার দেশে-বিদেশে ভয়াবহ চাপের মুখে আছে। বুঝতেই পারছেন। ঘটনা যেটা ঘটে গেছে, সেটার ফলাফল আমাদের সবারই বহুবছর বয়ে বেড়াতে হবে।
অনু স্নান গলায় বলল, জি, বুঝতে পারছি।
না বুঝতে পারছেন না। কারণ, বিষয়টা মিডিয়াতে নেই। সরকার চাইছে না, এটা নিয়ে মিডিয়াতে হৈ চৈ হোক। সাধারণ মানুষ আলোচনা করুক, আতঙ্কিত হোক। কারণ তাহলে বিরোধী দলও সুযোগ পেয়ে যাবে। এইজন্য এটাকে একদম আড়াল করে রাখা হয়েছে। তবে ভেতরে ভেতরে আমরা জানি কী চলছে! সবগুলো সিকিউরিটি ফোর্স দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করছে। সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় তাদের রাখা হয়েছে। গুরুত্ব বিবেচনায় খুব ইম্পর্টেন্ট নয়, এমন সব এনগেজমেন্ট থেকে ফোর্সদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
বুঝতে পারছি। কিন্তু এতদিন হলো, তনু আর শামীমের জন্য খুব টেনশন হচ্ছে।
ফোরকান আলী কাগজে কলমে কী একটা নোট করছিলেন। একজনকে ডেকে কাগজটা ধরিয়ে দিয়ে সেই বিষয়ে নানান ধরনের নির্দেশনা দিলেন। তারপর অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বোন, কী যেন নাম? তনু, হ্যাঁ, তনু সম্ভবত ভালোই আছে। তবে শামীমকে নিয়ে আমি নিশ্চিত না।
ওরা এক সাথে নেই?
নাহ।
তাহলে?
আমি যতদূর জানি, তনুকে বহু আগেই শামীম ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমাদের ধারণা ছিল সে শামীমের গ্রামের বাড়িতেই যাবে। কিন্তু তনু সেখানে যায়নি।
তাহলে কোথায় গিয়েছে?
সেটা আমরা জানি না। তবে শামীমের মা ছিলেন তনুর সাথে। আমার ধারণা, তনু যেখানেই থাক, ভালোই আছে। আসলে তনুকে নিয়ে আমাদেরও তেমন কনসার্ন ছিল না। আমরা চেয়েছিলাম শামীমকে।
কিন্তু শামীম তাহলে কই?
ফোরকান আলী কিছুটা দম নিয়ে বললেন, আমার ধারণা সে খুন হয়েছে!
অনুর মনে হলো তার পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। সে আতঙ্কিত গলায় বলল, কী?।
আমার ধারণা শামীম, খুন হয়েছে। বেঁচেও থাকতে পারে, তবে তার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ ওয়াসিম যেদিন ফিরে এলো সেদিনও শামীমকে দেখা গেছে। তারপর সন্ধ্যা থেকেই সে নিখোঁজ। আর তার সাথের যে ছেলেটা, আজম, যাকে সাথে নিয়ে শামীম নানান প্ল্যান করেছিল, তাকে দেখছি ওয়াসিমের সাথে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। শামীমকে আমি একটা কাজও দিয়েছিলাম। আমার ধারণা সেটাতেও সে ধরা পড়ে গিয়েছিল।
অনু অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র শীতল জলের চোরা একটা স্রোত যেন তার বুক বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। সে কোনোমতে বলল, তাহলে ওয়াসিমের বিষয়টা?
ফোরকান আলী বললেন, দেখুন অনু, নানাসময়ে পুলিশদের নানারকম দোষ দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশের আসলে করার থাকে কতটুকু? এই যে ওয়াসিমের ঘটনাটাতেই দেখুন, আমি কী আমার চেষ্টার কমতি রেখেছিলাম? আমার উপরেও কিন্তু নানা দিক থেকে প্রেসার কম ছিল না। কিন্তু তারপরও আমি চেষ্টা কম করিনি। সমস্যা হচ্ছে জায়েদের খুনের বিষয়টি এখন আর কারো কাছেই তেমন গুরুত্ব বহন করে না। সবার সামনেই এখন এর চেয়ে বড় ইস্যু চলে এসেছে। জায়েদের ইস্যু দিয়ে তার দল সরকারকে নাড়াতে পারত না। হয়তো এলাকাভিত্তিক পলিটিকসে সামান্য একটু ঢেউ তুলতে পারত। কিন্তু তাদের সামনে এখন জাতীয় ইস্যু। এটিকে তারা ঠিকঠাক ধরতে পারলে তাদের জন্য বিশাল বড় সুযোগ। সো তারাও আর জায়েদের বিষয়টাকে গুরুত্ব দেবে না। ইনফ্যাক্ট, সেটা আর নেইও।
তাহলে শামীম? শামীমের…।
ফোরকান আলী হাত তুলে অনুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শুনুন, শামীমের বিষয়টা নিয়ে মামলা করবে কে? আপনি? কিসের মামলা করবেন, খুনের? না কি গুমের? তারপর দেখুন, সে ইনভলভ ছিল ড্রাগস বিজনেসের সাথে। আর মাদক সংক্রান্ত মামলাগুলোর মধ্যে ইয়াবা কিন্তু এইসময়ের সবচেয়ে সেনসিটিভ বিষয়। সো, এই বিষয়টাও তখন উঠে আসবে। আর এটা হলে তা বরং আপনার জন্যই সবচেয়ে খারাপ হবে। আপনি ভালো করেই জানেন, এখানে আসলে খুব একটা কিছু করার নেই।
*
পরের কয়েকটা দিন থম ধরে বসে রইল অনু। একবার মনে হলো বিষয়টা নিয়ে ছোটবোন বেনুর সাথে কথা বলে। কিন্তু বেনু তার স্বামী আরিফুলকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছে। আরিফুলের গ্রিসের সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। এরমধ্যে তাকে আর অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইলো না অনু। এদিকে হাসান বিয়ের ডেট কনফার্ম করে ফেলেছে। এই নিয়ে অনু অবশ্য কিছু বলতে পারল না।
সে জানে, এই ডেট নিয়েও হাসানকে অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এখন সে যদি আবার কিছু বলে, তবে সেটি হবে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার। অনুর পক্ষ থেকে কাকে কাকে বিয়েতে বলবে অনু? আজিজুল মিয়া আর তার পরিবার। বড় চাচা-চাচি, মামা-মামি, এদেরকে কী বলবে সে? অনু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কিংবা অদিতি আর তোহা ইকরামকে? তারা কী। আসবেন? অনুর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুনে অদিতির অবশ্য খুশিই হওয়ার কথা। তার স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে সে হয়তো মুক্তি পাবে। অনুর সত্যি সত্যিই নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল। জীবনের এই অনন্য, এই সবচেয়ে আনন্দময় মূহূর্তটিতেও স্রেফ পাশে বসে থাকার জন্যও একজন মানুষকেও সে খুঁজে পাচ্ছে না!
আজ মা থাকলে কী করতো? কিংবা অয়ন? অনু দীর্ঘসময় চুপচাপ বসে থাকল। সে বার কয়েক একা একা চোখ বন্ধ করে যেন ভাবতে চাইলো। কিন্তু কিছুই ভাবতে পারল না। বিয়ে মানে রং, রঙের ভেতর আনন্দ, সেই রং আর আনন্দে মা থাকবে না, অয়ন থাকবে না, তনু, বেনু কেউ থাকবে না! এমন কেমন নিঃসঙ্গ জীবন তার! এমন একা কেন সে!
অনু বিছানার তলা থেকে অয়নের নোটবুকটা টেনে নিলো। বুকে চেপে বসে রইল কিছুক্ষণ তারপর অয়নের উপর খুব অভিমান হতে লাগল। এই নোটবুটার কোথাও অয়ন তাকে নিয়ে কিছু লেখেনি, কিচ্ছু না! কী এক আশ্চর্য অভিমান নিয়ে অনু নোটবুকটার পাতা উল্টাতে থাকল। অয়ন কী সত্যিই তাকে নিয়ে কিছু লেখেনি?
অনু একের পর এক পাতা উল্টাতে থাকল। নুহাকে নিয়ে আরো কত কত কিছু লিখেছে অয়ন! মাকে নিয়ে লিখেছে, তনু, বেনু, হাফসা এমনকি শামীমকে নিয়েও লিখেছে। কিন্তু এই নোটবুকের কোথাও কী সে নেই?
অনু তাকে পেল। নোট বুকটার একদম শেষের বেশ কিছু পৃষ্ঠা আগে অয়ন বড় বড় করে লিখে রেখেছে কাজলা দিদি। তারপর লেখাটা আবার কেটেও দিয়েছে সে। কেটে দিয়ে নিচে লিখেছে
মা বলতো, কাজলা দিদিটা না-কি ভাইটাকে খুব আদর করতো। ছোটবেলায় বাংলা বইতে কবিতাটা ছিল, বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই? সেই থেকে কবিতাটা পড়লেই আমার বড়পুর কথা মনে হতো। আমি মনে মনে বলতাম অনুদি। মাকে বলতাম, মা, এত ডাকলেও কবিতার কাজলা দিদিটা আর আসে না কেন? মা বলতো, দিদিটা তো আর নেই। আমি বলতাম, কেন? বাঁশবাগানের ভেতর লুকিয়ে আছে? মা বলতো, না, দিদি মরে গেছে। সেই থেকে বড়পুকে আমি আর কখনো দিদি বলে ডাকিনি। মনে মনেও না। আমার খুব ভয় হতো, দিদি বলে ডাকলে যদি কবিতার কাজলা দিদির মতো বড়পুও মরে যায়!
স্কুলে একদিন বাংলা স্যার মাকে ডেকে বললেন, আপনার ছেলে এ কী করেছে? মা বলল, কী করেছে? স্যার বাংলা বই খুলে মাকে দেখালেন, আমি কাগজে আঠা লাগিয়ে বইয়ের সব দিদি শব্দগুলো ঢেকে দিয়েছি। কাজলাদিদি কবিতার নামটাও। মা আমাকে খুব বকাঝকা করলেন। বাসায় এসে বললেন, এমন করলি কেন? আমি মাকে কিছু বলিনি। আমার নিজের কথা কাউকে বলতে ভালো লাগে না। আমার সেইদিন থেকে কেবল ভয় হতো, খুব ভয়, কাজলা দিদি শব্দটা থাকলে বড়পুর সত্যি সত্যি যদি কিছু হয়ে যায়! বড়পুর কিছু হয়ে গেলে বড়’পুকে ছাড়া আমি কী করে থাকব!
সত্যিই তো, বড়পুকে ছাড়া আমি কী করে থাকব! আমার আজকাল মনে হয়, আমি আসলে মরে যেতে ভয় পাই না। আমি বড়পুকে ছাড়া থাকতে ভয় পাই। আমার আরো একটা জিনিস মনে হয়, আমার মনে হয়, আমি এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যে মানুষটাকে ভালোবাসি, সেই মানুষটা হচ্ছে বড়পু। এমনকি মা’র চেয়েও একটু বেশি।
আচ্ছা, মরে গেলে কী আমি সত্যিসত্যিই আর কখনো বড়পুকে দেখতে পাব না?
আমি মরে গেলে বড়পু কী করবে? আমার ধারণা বড়পু কিছুই করবে না। এমনকি কাঁদবেও না। একমাত্র সে-ই চুপচাপ কোথাও গিয়ে একা একা বসে থাকবে।
আমার আরো একটা ধারণা। আমার ধারণা, আমি মরে গেলে বড়পু আমাকে দেখতেও আসবে না। মৃত আমাকে দেখলে আমার লাশের ছবিটা বড়পুর মাথায় গেঁথে যাবে। সে সারাজীবন আর সেই লাশের ছবিটা মাথা থেকে তাড়াতে পারবে না। তার চেয়ে জীবিত আমার ছবিটা নিয়েই সে বেঁচে থাকতে চাইবে।
বড়’পুকে মাঝেমধ্যে আমার বড় কোনো নদীর মতো মনে হয়। না ঠিক নদী না, হিমালয়ের মতো। সত্যি সত্যি হিমালয়ের মতো। অতবড় একটা মানুষ আর ঠিক অমন ঠান্ডা। অমন শান্ত, শীতল, স্থির। এইজন্যই বড়পু ক্ষয়ে গেলেও বোঝা যায় না। অতবড় হিমালয় ক্ষয়ে গিয়ে যদি আস্ত একটা সমুদ্রও নেমে আসে, তারপরও কী তাকে দেখে বোঝা যায়? যায় না। এইজন্য বড়পুর কান্নাও বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
বড়পু যে কখনোই কাঁদে না, এটা সবাই দেখে। কিন্তু সে যে কতটা ক্ষয়ে যায়, তা কেউ দেখে না।
আমার একটা অদ্ভুত বিদ্ঘুটে ইচ্ছে হচ্ছে। আমার মৃত্যুর পর বড়পু যখন একা একা চুপচাপ বসে থাকবে, তখন আমি যদি গিয়ে একটু ওর পাশে বসে থাকতে পারতাম! ও আমাকে দেখতে পাবে না। কিন্তু আমি ঠিকঠিক ওকে দেখতে পাবো। তারপর আলতো করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেবো। ও আমার হাতের স্পর্শ টের পাবে না। কিন্তু কিছু একটা টের পাবে, সেই কিছু একটা ওকে ঝরঝর করে কাঁদিয়ে ফেলবে। আমি চাই, ও কাঁদুক, অনেক কাঁদুক। এত কান্না বুকের ভেতর চেপে রেখে বেঁচে থাকা যে কী কষ্টের! কী ভয়ানক কষ্টের!
অনু হঠাৎ আবিষ্কার করলো তার চোখে বেয়ে টুপ করে এক ফোঁটা জল পড়লো পাতাটার উপর। তারপর আরেক ফোঁটা, তারপর আরেক ফোঁটা। তারপর পড়তেই থাকল। অয়নের লেখার কালো অক্ষরগুলো ভিজে আরো কালো হয়ে যেতে থাকল, আরো বেশি স্পষ্ট। কিন্তু অনু তারপরও সেই স্পষ্ট অক্ষরগুলো আর পড়তে পারল না। সে জানে না, চোখ এমন ঝাপসা হয়ে গেলে মানুষ পড়ে কী করে?
*
সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে হাসান যেন খানিক মন খারাপই করেছিল। অনু বার কয়েক জিজ্ঞেসও করেছিল। কিন্তু কিছু হয়নি বলে প্রতিবারই এড়িয়ে গেছে সে। গতকাল সন্ধ্যায় অবশ্য একরকম চেপে ধরেই হাসানের কাছ থেকে কথাটা বের করে নিয়েছে অনু। আর সেই থেকে ভেতরে ভেতরে সূক্ষ্ম একটা অপরাধবোধও কাজ করছিল তার। এই ছেলেটা বছরের পর বছর কী নীরবে, কী গভীর নিবেদনে অপেক্ষা করে গেছে। অথচ তার বিনিময়ে কী করেছে অনু? কিছুই না। বরং এখনো যা কিছু ঝড়ঝাপ্টা আসছে, যা কিছু এলোমেলো করে দিতে চাইছে তাও সে ওই একা হাতেই সামলাচ্ছে।
অনু মনে মনে ঠিক করে ফেলল, যেভাবেই হোক হাসানকে আজ সে চমকে দিবেই। ভেতরে ভেতরে শামীম আর তনুকে নিয়ে সে যতই উদ্বিগ্ন থাকুক, যতই এলোমেলো থাকুক, হাসানকে তা আর একটুও বুঝতে দিবে না। হাসানকে সে আর মন খারাপ করে থাকতে দিবে না। অন্তত তার কারণে তো নয়ই।
পরদিন শুক্রবার। অনু সকাল সকাল হাসানকে ফোন দিয়ে বলল, একটা কাজ করতে পারবে?
কী কাজ?
তুমি এখন আমার হোস্টেলের সামনে না এসে সন্ধ্যার দিকে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বর আসতে পারবে?
কখন?
সন্ধ্যায়। বেঙ্গল আর্ট গ্যালারিটা আছে, ঠিক ওটার সামনে থাকবে। সন্ধ্যা ছটায়।
সন্ধ্যায় কেন?
একটু কাজ আছে। আমি এখন যাচ্ছি। তুমি ওখান থেকে আমাকে তুলে নিও।
হাসানের ভারি মন খারাপ হলো। আজকের দিনটা নিয়েও তার নানান রকম পরিকল্পনা ছিল। তাছাড়া হাতে সময়ও বেশি নেই, এখনো বহু কাজ বাকি। বাবা-মায়ের সাথে অনুকে একদিন দেখাও করাতে হবে।
সেই সারাটাদিন নিজের ঘরে গুম হয়ে বসে রইল হাসান। সন্ধ্যাবেলা ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে এলো সে। কিন্তু এরমধ্যে অনু তাকে একবারের জন্যও ফোন দিলো না। এমনকি বেঙ্গল আর্ট গ্যালারির গেটেও সে কাউকে দেখতে পেল না। হাসানের এবার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। সে একা একা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে শেষে অনুকে ফোন দিলো। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, অনু তার
ফোনও ধরলো না। হাসানের এবার মন খারাপের বদলে রাগ লাগতে লাগল। প্রচণ্ড রাগ। তার ইচ্ছে হচ্ছিল অনুকে রেখেই সে চলে যায়। অনু আসলে আসুক, না আসলে না আসুক।
অনু এলো তার কিছুক্ষণ বাদেই। হাসান অবশ্য অনুকে দেখে প্রথমে চিনতে পারেনি। সন্ধ্যাবেলা সাতাশ নম্বরের রাস্তাটাতে খুব ভিড়। সাইসাই করে গাড়ি চলে যাচ্ছে। সেই গাড়ির ভিড়ে এক তরুণীকে সতর্ক ভঙ্গিতে রাস্তা পার হতে দেখা গেল। তরুণীর পরনে বিয়ের লাল শাড়ি। সে রাস্তার উল্টো পাশের বড় বিউটি পার্লারটা থেকে যত্ন করে সেজে এসেছে। ল্যাম্পপোস্টের হুলুদ আলোয় তাকে লাগছে পরির মতো সুন্দর। তরুণীর হেঁটে আসার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে, সে শাড়িতে খুব একটা অভ্যস্ত নয়। এমনকি তার চারপাশ থেকে অসংখ্য চোখ যে তাকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখছে, তরুণী সেটিও বুঝতে পারছে। এই ব্যাপারটি তাকে আরো আড়ষ্ট করে ফেলছে।
হাসানের বুঝতে সময় লাগল যে মেয়েটি অনু। যতক্ষণে সে বুঝতে পারল, ততক্ষণে তার রাগ বাষ্প হয়ে কোথায় উড়ে গেল! অনু বলল, চলো, আমরা আশেপাশে কোথাও খাই।
হাসান সম্মোহিতের মতো বলল, চলো।
তারা একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দীর্ঘসময় নিয়ে খেলো। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে হতে রাত প্রায় ন’টা। হাসানের একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না। সে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে হতে বলল, চলো না, আরো কিছুক্ষণ থাকি।
কোথায় থাকবে?
হাসান খানিক ভাবলো। তারপর বলল, চলো, হাতিরঝিলের দিকটাতেই যাই। ভালো লাগবে।
অনু বলল, রাত হয়ে গেছে এমনিতেই। বেশি দেরি হলে কিন্তু হোস্টেলে ঢুকতে পারব না। যদিও আজ একটু অনুমতি নিয়েই এসেছিলাম।
সমস্যা নেই, দেরি হবে না। আর দুয়েকদিন তো একটু দেরি হতেই পারে, পারে না?
অনু হাসলো, অবশ্যই পারে।
তাদের হাতিরঝিল পৌঁছাতে সময় লেগে গেল অনেক। আজকাল শুক্রবার বিকেল থেকে কী এক অসহনীয় জ্যাম শুরু হয় রাস্তায়! অনু বলল, রাত হয়ে গেছে কিন্তু অনেক।
হাসান একটা অন্ধকার আর নির্জন জায়গা দেখে বসলো। তারপর অনুর গলার কাছটায় ঠোঁট চুঁইয়ে বলল, হোক।
অনু কেমন শিউরে উঠল। হাসান বলল, বিয়ের শাড়িটা আগেই পরে ফেললে?
ইচ্ছে হলো যে!
এখন? বিয়ের দিন কী পরবে?
আরেকটা কিনে দিও।
হাসান হাসলো। অনু আচমকা আকশের দিকে আঙুল তুলে বলল, ওই যে দেখো?
কী?
আকাশ জুড়ে কত কত তারা।
সে তো রোজ দেখি।
শুধু তারা দেখো। কিন্তু আর কিছু কী দেখো?
আর কী দেখবো?
ওই অজস্র, অসংখ্য তারার ভিড়েও প্রত্যেকটা তারা যে কী ভীষণ একা, কী ভীষণ নিঃসঙ্গ?
হাসান অবাক চোখে অনুর দিকে তাকালো। অনু বলল, আমার নিজেকে সারাটা জীবন ওই নক্ষত্রগুলোর মতো নিঃসঙ্গ মনে হতো, ভীষণ একা মনে হতো।
নক্ষত্ররা নিঃসঙ্গ হবে কেন? ওরা তো সংখ্যায় অসীম!
অনু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হাসানের কাঁধে মাথা রাখলো। তারপর বলল, কিন্তু ওই নক্ষত্রগুলো আসলেই ভীষণ নিঃসঙ্গ।
কীভাবে?
আমরা এত দূর থেকে দেখি তো, তাই বুঝতে পারি না। ওই একেকটা নক্ষত্রের মাঝে যে কী অসীম দূরত্ব, আমরা কল্পনাও করতে পারি না। অনেকটা মানুষের মতোই। আমরা একে অন্যের থেকে এত দূরে থাকি যে পরস্পরের নিঃসঙ্গতা বুঝতে পারি না।
হাসান হঠাৎ দু’হাতে শক্ত করে অনুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল, এখনো নিঃসঙ্গ মনে হয়?
উঁহু, তুমি সেই নিঃসঙ্গতাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছ।
অনু সামান্য থেমে গাঢ়, গভীর, উষ্ণ কণ্ঠে বলল, একটা কথা বলব হাসান?
হাসান তাকালো, বলো?
আমি খুব একা একটা মানুষ, আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না?
হাসান হাসলো, কক্ষনো না।
সত্যি তো?
একদম সত্যি।
হাসান তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে অনুর হাত চেপে ধরে রাখলো। অনু আচমকা হাসানের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি হাসান, আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি।
তারা বসে রইল আরো কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রাত বেড়ে গেছে। হাতিরঝিলটা ক্রমশই নির্জন হয়ে উঠছে। মাঝেমধ্যে কেবল বেপরোয়া গতিতে দুয়েকটা গাড়ি হুশহাশ ছুটে যাচ্ছে। ঠিক এমনই সময় একটা গাড়ি ধীরে এসে তাদের পেছনে থেমে দাঁড়ালো। অনু আর হাসান তখনো গাড়িটাকে লক্ষ্য করেনি!
.
রাত তখন দু’টা। ওয়াসিমের কোচিং সেন্টারের উপরতলার অসমাপ্ত ঘরগুলোর একটাতে অনু বসে আছে। তার সামনে বসে আছে ওয়াসিম। ওয়াসিম বলল, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে অনু।
অনু ওয়াসিমের কথার জবাব দিলো না। সে তাকিয়ে আছে মাথার উপরের একশ ওয়াটের হলুদ বাটার দিকে। বাল্বটা ঘিরে অসংখ্য পোকামাকড় ঘুরছে। একটা দশাসই আকৃতির টিকটিকি সেই পোকামাকড়গুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওয়াসিম বলল, তোমাকে কতটা সুন্দর লাগছে জানো?
অনু যেমন বসেছিল তেমন বসেই রইল। তাকে দেখতে লাগছে নির্বিকার, ভাবলেশহীন, চোখজুড়ে নিপ্রাণ শূন্য দৃষ্টি।
ওয়াসিম বলল, তোমাকে বিয়ে করে ফেলার মতো সুন্দর লাগছে অনু। আমার মনে হচ্ছে, আমি এখুনি কাজি ডেকে তোমাকে বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু আমার ধারণা, আমার মতো খারাপ মানুষকে তোমার বিয়ে করতে ভালো লাগবে না।
ওয়াসিম চোখ বন্ধ করে লম্বা টান দিলো সিগারেটে। তারপর মুখভর্তি গলগলে ধোয়া ছেড়ে বলল, তোমাকে আমার খুনও করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা আমি করব না। খুন করে ফেললে তো সব শেষ। আমি তোমার শেষ দেখতে চাই না। শেষের আগ পর্যন্ত দেখতে চাই।
ওয়াসিম তার হাতের সিগারেটটাতে শেষ টান দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর বলল, শামীমের এত সাহস আর বুদ্ধি কোত্থেকে হলো অনু? তোমার থেকে? এত সাহস আর বুদ্ধি তোমার? দেখি, কোথায় কোথায় আর কী কী লুকিয়ে রাখছ? আজ সব খুঁজে খুঁজে বের করব।
.
দু’দিন বাদে ঠিক ফজরের আজানের পরপর অনুকে রেখে যাওয়া হলো তার হোস্টেলের সামনে। অনু ফুটপাতে চুপচাপ বসে রইল। তার পাশেই বড় একটা ডাস্টবিন। ডাস্টবিনে অজস্র ছিন্নমূল মানুষ জিনিসপত্র খুঁজছে। একটা কুকুর অনুর গা ঘেঁষে চলে গেল। তারপর ডাস্টবিনে মুখ ডুবিয়ে খাবার খুঁজতে লাগল। কতগুলো কাক একটানা কা কা শব্দে জানান দিতে লাগল কর্মব্যস্ত ঢাকার আরেকটা দিন শুরুর। অনুর কেবল কোনো কাজ নেই। সে নীরব নিস্তব্ধ একা বসে রইল। সময় বয়ে যাচ্ছে অনন্তে। সেই অনন্ত সময়ের বুকের ভেতর থেমে আছে অনু। তার এই থেমে থাকা অন্তহীন কে না কে জানে!
তখন সূর্য উঠছে দেয়ালের ফাঁক গলে। সূর্যের রং লাল।
.
পরিশিষ্ট : কিছু গল্প এমন নয়, সেই গল্পগুলো হয়তো সুন্দর। কিছু গল্প এমন, অসুন্দর। কিছু গল্পে এরপরও হাসানরা ফিরে আসে, কিছু গল্পে আসে না। তবে ওয়াসিমদের গল্পগুলো এমনই, তারা বারবার ফিরে আসে। আর তাদের সেই ফিরে আসার গল্পে বারবার ফিরে আসে অনুরাও। সেই অনুদের কেউ কেউ কোনো একদিন হয়তো এই গল্পটাকে বদলে দেবে। বদলে দেয়া সেই অনুদের গল্পের শেষটা হবে ভীষণ সুন্দর। সেখানে অনুদের বুকের ভেতর জমে থাকা দহনের ক্ষতজুড়ে টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকবে মায়ার শিশির। সেই শিশিরের শব্দে ডুবে যাবে আর সব কোলাহল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ঠিক পাশ বালিশটাতে তাকালেই দেখা যাবে জোছনার ছায়া। সেই ছায়ার ভেতর মায়া হয়ে তাকিয়ে থাকবে একজোড়া চোখ। সেই চোখের ভেতর মন। মনের ভেতর মানুষ। সেই মানুষের নাম হবে ভালোবাসা। আর সেই ভালোবাসায় ডুবে রইবে অনুদের জীবন ও জগত।