‘মেরে ঝাঁসী নেহী দেওঙ্গী’
বুন্দেলখণ্ডের মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র মারাঠা সর্দারের রাজ্য হলো ঝাঁসী। পেশবার সময়ে এ সুবা প্রদেশ বলে পরিচিতি ছিলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সরকার প্রদেশটিকে আলাদা একটি রাজ্যের গৌরবে উন্নীত করেন। বুন্দেল রাজা ছত্রশাল মুসলমানদের বিরুদ্ধে সময় মতো সাহায্য করার জন্য প্রথম বাজীরাওকে তাঁর রাজ্যের তিন ভাগের এক ভাগ দিয়ে দেন। পেশবা তার শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বুন্দেলখণ্ডকে তিনটি ভাগে ভাগ করলেন। প্রথম অংশের শাসনভার গোবিন্দ পান্থ খেরের হাতে অর্পণ করেন। তার সদর দফতর ছিলো সাগার। দ্বিতীয় অংশে ছিলো বান্দা এবং কল্পি। অবৈধ সন্তান শমসের বাহাদুরকে এ অংশের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। তৃতীয় অংশ ঝাঁসীর শাসনকতার পদ রঘুনাথ হরি নাভালকরের পরিবারে চিরস্থায়ী হয়ে যায়। তিনি তাঁর ভ্রাতা শিবরাম ভাওকে শাসনভার ছেড়ে দিয়ে ১৮০৪ সালে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮১৭ সালে শিবরাম ভাওয়ের উত্তরাধিকারী এবং দৌহিত্র রামচন্দ্র রাওয়ের মধ্যে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সে অনুসারে রামচন্দ্র রাওকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করা হয়। ১৮৩৫ সালে তাঁকে মহারাজাধিরাজ ফিদভী বাদশাহ্ জমিয়া ইংলিশস্থান উপাধি দেয়া হয়। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিলো না। তাঁর বিধবা পত্নী কৃষ্ণরাও নামে তার এক বোনের ছেলেকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। যেহেতু প্রচলিত প্রথা অনুসারে অন্য পরিবারের সন্তানকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করা চলে না, সেহেতু রামচন্দ্র রাওয়ের কাকা রঘুনাথ রাওয়ের সিংহাসনে আরোহণের স্বপক্ষে ব্রিটিশ সরকার মত দিলেন। রঘুনাথ রাও ছিলেন একেবারে হঠকারী প্রকৃতির লোক। তাঁর কুশাসনে রাজ্য রসাতলে যাবার উপক্রম হয়েছে। ব্রিটিশ সরকার এ অজুহাতে রাজ্যভার পরিচালনা নিয়ে নিলেন। রঘুনাথ রাও আইনতঃ কোনো উত্তরাধিকারী না রেখেই মারা গেলেন। তাঁর অবৈধ সন্তানত্রয় কৃষ্ণরাও, রামচন্দ্র রাও এবং রাজার ভ্রাতা গঙ্গাধর রাওয়ের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার গঙ্গাধর রাওকেই সমর্থন করেন। কিন্তু ১৮৪৩ সালের আগে তাঁর হাতেও শাসনভার দেয়া হলো না। তিনি চমৎকার একখানা গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করলেন এবং শহরের উন্নয়ন সাধন করলেন।
১৮৫৩ সালে তার কোনো পুত্রসন্তান না রেখে তিনি মারা গেলেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বের দিন তার সভাসদবৃন্দ ঝাঁসীর ব্রিটিশ রাজনৈতিক এজেন্ট মেজর এলিস, ঝাঁসী বাহিনীর সামরিক প্রধান ক্যাপটেন মার্টিনের সামনে নাভালকর পরিবারের একটি ছেলেকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করলেন। তিনি মেজর এলিসকে অনুরোধ করলেন ব্রিটিশ সরকার যেন তাঁর বিধবা পত্নী এবং পুত্রের হাতে শাসনভার অর্পণ করেন। গভর্ণর জেনারেলের কাছে যে মানচিত্র পাঠানো হয়েছিলো, তাতে রাণীমাতা দাতিয়া, ওরচা ইত্যাদি বুন্দেল রাজ্যে দত্তক পুত্রের অধিকার স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। মেজর এলিসও বিধবা রাণীকে সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু গভর্ণর জেনারেলের এজেন্ট ম্যালকম এ সম্পর্কে ভিন্নতরো ধারণা পোষণ করতেন।
গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর সময়ে লর্ড ডালহৌসী কলকাতার বাইরে ছিলেন, সুতরাং রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সে মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সে যাই হোক, লর্ড ডালহৌসী রায় দিলেন ঝাসীকে ব্রিটিশ শাসনাধীনে নিয়ে এলেই প্রজাদের সুবিধা হবে। ১৮৫৪ সালে ঝাসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজের অন্তর্ভুক্ত করা হলো। রাণীর জন্য ভাতা মঞ্জুর করা হলো যাবজ্জীবন এবং তাঁকে রাজপ্রাসাদে বাস করার অনুমতি দেয়া হলো। শুধু তাই নয়, ব্রিটিশ বিচারালয়ের আওতামুক্ত থাকার অধিকারও দেয়া হলো। এমন কি দত্তক পুত্র গ্রহণেও কোনো বাধা দেয়া হলো না। দামোদর রাওকে পারিবারিক ঐশ্বর্যের এবং তাঁর বাবার ব্যক্তিগত সম্পদের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হলো।
গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর রাজকোষ অনুসন্ধান করে দেখা গেলো ৬ লক্ষ টাকা রাজকোষে সঞ্চিত রয়েছে। এ সমস্ত টাকা ভারত সরকারের কাছে গচ্ছিত ছিলো, এ শর্তে যে সরকার অপ্রাপ্ত বয়স্ক রাজপুত্রের আমানতদারী করবেন। সচরাচর যেমন হয়ে থাকে, সরকার ভারতীয় জনসাধারণের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে বসলো। নাবালকের বংশের পারিবারিক বিগ্রহ মহালক্ষ্মীর মন্দিরের ব্যয়ভার বহনের জন্য যে সকল গ্রাম নির্দিষ্ট করে রাখা ছিলো সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে নিলো। রাণী প্রথমে ভাতা গ্রহণ করতে রাজী হননি। কিন্তু গঙ্গাধর রাওয়ের আত্মীয়-স্বজনের প্রতিপালন এবং ঋণ শোধ করার জন্য ভাতা গ্রহণ ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো পন্থা রইলো না। সরকার ঝাঁসীর মতো ব্রাহ্মণ রাজ্যে গো-হত্যার প্রবর্তন করাতে তিনি সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হলেন।
রাণীর সঞ্চিত ৬ লাখ টাকার মধ্যে এক লাখ টাকা গঙ্গাধর রাওয়ের পবিত্র শ্রাদ্ধের কাজে বরাদ্দ করে সরকারের কাছে টাকার জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু সরকার চারজন জামিনদার ছাড়া টাকা দিতে রাজী হলো না। সরকারের পক্ষে যুক্তি হলো, নাবালক রাজপুত্র যদি সাবালক হয়ে এ টাকা দাবি করে, জমিদার চারজনকেই সে টাকা পরিশোধ করতে হবে। রাণী তখনও আশা করেছিলেন, অন্যান্য রাজ্যহারা রাজপুরুষদের বেলায় যেমন হয়েছে, তেমনি যদি ডিরেকটরদের সভায় তিনি প্রতিনিধি প্রেরণ করেন, তাহলে তাঁর ছেলের উপর অবশ্যই সুবিচার করা হবে । সুতরাং তিনি বিলাতে প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। তাতে ৬০ হাজার টাকা ব্যয় হলো, কিন্তু ডিরেকটর সভা গভর্ণর জেনারেলের সিদ্ধান্তের কোনো অদল-বদল করলেন না। সে কারণে এবং ঝাঁসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্তির ফলে জনসাধারণের মনে সন্দেহ দেখা দিলো।
রাণী লক্ষ্মীবাই ছিলেন গরীব পিতামাতার মেয়ে। রাণীর পিতা মহরাপন্থ তসবে চিমনজী আপ্পার দেহরক্ষী ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে বেনারসে থাকতেন। রাণীর বাল্যনাম ছিলো মনিকর্ণিকা। স্বামীর ঘরে এসেই তিনি লক্ষ্মীবাই নামে পরিচিত হন। তাঁর বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিদ্রোহের পরে তার সম্বন্ধে নানা গল্প-কাহিনী এবং গুজব সৃষ্টি হয়। স্বামীর তুলনায় তিনি অপেক্ষাকৃত কম বয়েসী ছিলেন। প্রথম রাণীর মৃত্যুর পর গঙ্গাধর রাওয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জন লেং নামে যে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবি ঝাঁসীকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে তার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, তিনি তাঁর সম্বন্ধে কিছু বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি ছিলেন নাতিদীর্ঘ মহিলা, একটু স্কুলাঙ্গী, তবে অধিক নয়। যৌবনে নিশ্চয়ই তাঁর মুখখানা অত্যন্ত সুন্দর ছিলো। এখনো সে মুখের আকর্ষণ কম নয়। মুখাবয়বটিও সুন্দর, বুদ্ধিদীপ্ত। বিশেষ করে চোখ দুটি টানা টানা, নাকটা টিকালো। তাঁর গাত্রবর্ণ ফর্সা না হলেও কিছুতেই তাকে কৃষ্ণাঙ্গী বলা যায় না। সবচেয়ে আশ্চর্য, একজোড়া ইয়ারিং ছাড়া তার শরীরে আর কোনো অলংকার নেই। তিনি সাদাসিধে মসলিনের শাড়ি পরিধান করেছিলেন। সে শাড়ি এতো মিহি, এতো সূক্ষ্ম যে তাঁর শরীর অন্তরাল থেকে আভাসিত হয়ে উঠেছিলো। তিনি অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা ছিলেন। কিন্তু তাঁর কর্কশ কণ্ঠস্বর সৌন্দর্যকে অনেকাংশে ম্লান করে দিয়েছে। মেজর এলিস ঝাঁসীর অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘মেরে ঝাঁসী নেহি দেওঙ্গী।’ এটা সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ না কি আবেগের ক্ষণিকের প্রকাশ বলা মুশকিল। কিন্তু ঝাসীকে ভারত সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা হলো। রাণী নীরবে স্বামীর প্রাসাদ ছেড়ে তার জন্য নির্ধারিত প্রাসাদে চলে গেলেন। সেখানে তিনি হিন্দু বিধবার মতো জীবনযাপন করতে লাগলেন। তাঁর সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেয়া হলো। ১২নং বাঙালি পল্টন কেল্লার মধ্যে ছাউনি ফেললো। সবকিছুই শান্তিপূর্ণভাবে চলছিলো। নতুন শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে কোনো রকমের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়নি। ক্যাপটেন আলেকজান্ডার স্কীনকে পলিটিক্যাল অফিসার এবং ক্যাপটেন ডানলপকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করা হলো।
চর্বি মাখানো টোটার কাহিনী অন্যান্য স্থানের মতো নিশ্চিতভাবে ঝাঁসীতেও প্রধান আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ালো। মে মাসে দিল্লী এবং মীরাটের বিদ্রোহের সংবাদ ক্যাপটেন ডানলফ এবং তাঁর সহকর্মীদের কাছে এসে পৌঁছলো। তাঁরা কোনো রকম গোলযোগের আভাসও পেলেন না। আমানত খানের বর্ণনা মতে, জুন মাসে একজন সেপাইকে মৃত্যুদণ্ড দান করা হলো। স্যার রবার্ট হ্যামিলটন বলেছেন, ‘আমার রেজিমেন্টের কোনো একজন সেপাইয়ের আত্মীয় অথবা চাকর দিল্লী থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এসেছে। সে চিঠির মর্মানুসারে, ‘ঝাঁসীর ঘাঁটিতে বাংলা প্রেসিডেন্সীর যে সকল সেপাই রয়েছে তারা যদি সামগ্রিকভাবে বিদ্রোহ না করে তা হলে জাতিচ্যুত অথবা ধর্মচ্যুত হবে।’ ৫ই জুন বিশৃঙ্খলা দেখা দিলো। সৌভাগ্যবশতঃ আমরা প্রথম দিবসে বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ পেয়েছি। ঝাঁসীর ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট ক্যাপ্টেন গর্ডন ৬ তারিখে মেজর আরস্কিন এবং ওয়েস্টার্ণকে লিখেছেন, স্কীনের অনুরোধে কয়েক পংক্তি আমি আপনার কাছে লিখছি। ১২নং রেজিমেন্টের একাংশ ক্যান্টনমেন্টে প্রকাশ্য বিদ্রোহে যোগ দিয়েছে। যে দুর্গের মধ্যে অস্ত্র ও সাড়ে চার লক্ষ টাকার মতো রাজস্ব জমা ছিলো, সব দখল করে ফেলেছে। তাদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সেপাইরা এসে যোগ দিয়েছে। এখন আমাদের হাতে রয়েছে মাত্র দু’টি কামান। তারা কিভাবে এসব করতে সমর্থ হয়েছে, নিম্নে তা বলছি। গতকাল বেলা ৩টার সময় সেপাইদের মধ্যে শোরগোল উঠলো যে ডাকাতেরা অস্ত্রাগার আক্রমণ করেছে এবং তারা দ্রুত সেদিকে ধাওয়া করলো। বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত নয় এমন কতিপয় সেপাই গুলি ভর্তি বন্দুকসহ অবস্থান নিয়ে নিলো। তারপরে বিদ্রোহীরা পালিয়ে যায় কিন্তু সন্ধ্যার সময় তারা সদলবলে আবার আগমন করে। দু’টি কামান এবং ৫০ জন সেপাইয়ের সাহায্যে অস্ত্রাগার আমরা তখনো রক্ষা করে আসছিলাম। আমরা নিশ্চিত যে সেপাইদের এবং গোলন্দাজদের মধ্যে কাউকে বিশ্বাস করতে পারবো না। আমি ঠাকুরদের সাহায্যে বিদ্রোহীদের দুর্গ থেকে বের করে দিতে পারি, কিন্তু সকলে প্রথমবার গুলি ছোঁড়ার পরেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেবে। আমরা আরো জানতে পেরেছি ঠাকুরেরা বেশ হৃষ্টচিত্তেই ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্যের প্রস্তাব করেছিলো। অনেক সাহায্য তাদের কাছ থেকে নেয়াও হয়েছে। ধুলোর সাহায্য চেয়ে গোয়ালিয়র এবং কানপুরে সংবাদ পাঠানো হলো। আরস্কিন এবং ফোর্ড সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় এবং খ্রীস্টানদের পরিবার-পরিজনসহ দুর্গের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। তাঁরা ভালোভাবে জানতেন যে এখন কোনো দিক থেকে সাহায্যের আশা করতে পারেন না এবং নিজেদের যা আছে তাই দিয়েই আত্মরক্ষা করতে হবে।
ক্যাপটেন ডানলপ এবং অন্যান্য সামরিক অফিসারেরা তখনো আশা পোষণ করছেন যে তাঁরা সেপাইদের শান্ত রাখতে পারবেন এবং সেজন্য তারা তখনো সেপাই লাইনে শয়ন করেন। ৬ তারিখে জেল দারোগা সেপাই-সান্ত্রীসহ বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ক্যাপটেন ডানলপকে হত্যা করেন। যারা ব্রিটিশ পক্ষ নিয়েছিলো, সে সকল সেপাইদেরও হত্যা বা জখম করা হলো। ১৪নং গোলন্দাজ বাহিনীর লেফটেন্যান্ট ক্যাম্পবেল আহত হন। চারদিক থেকে দুর্গ ঘেরাও করে রাখা হলো। তিনজন ছদ্মবেশে দুর্গের বাইরে যেতে চেষ্টা করে ধৃত হলো এবং তাদেরকে হত্যা করা হলো। ৮ তারিখে ক্যাপটেন গর্ডন মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণত্যাগ করেন অথবা হতাশায় আত্মহত্যা করেন। লেফটেন্যান্ট পাওরিস দুর্গের অভ্যন্তরেই একজন ভারতীয় চাকরের হাতে নিহত হলেন। দ্বি-প্রহরের দিকে নিরাপত্তার শর্তে অথবা কোনো রকম শর্ত ছাড়াই দুর্গ থেকে সকলে বেরিয়ে এলেন। শিশু, মহিলাসহ দলের সমস্ত লোককে নির্বিচারে হত্যা করা হলো। মৃতদেহগুলো স্থূপাকারে জোখানবাগে রাখা হয়েছিলো এবং সকলকে একটি মাত্র গর্তে চাপা দেয়া হয়। জেল দারোগা করিম বখশ এই নৃশংস হত্যার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। দুটি সন্তানসহ একটি মহিলা মাত্র হত্যাকারীদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্যার রবার্ট হ্যামিল্টন যিনি এক বছর পরেও এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করেছিলেন, তিনিও স্পষ্টভাবে রাণীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের কোনো সংযোগ আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। আমরা আগেই ১২নং রেজিমেন্টের মত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সেপাইটির কথা উল্লেখ করেছি। তাকেই তিনি দায়ী করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, বিদ্রোহীরা যে সকল সেপাই বিদ্রোহে অংশ নিতে রাজী ছিলো না, তাদেরকে বন্দুকের মুখে বিদ্রোহে অংশ। নিতে বাধ্য করেছে। তারপরে বিদ্রোহীরা সকলে রাণীর প্রাসাদে গমন করে গুলি ভর্তি বন্দুকসহ রাণীর কাছ থেকে সাহায্য এবং রসদ দাবি করে। তিনি সেপাইদেরকে খুশী মনে রসদ, অস্ত্রশস্ত্র এবং আরো নানা প্রকারে সাহায্য করেন।
এ বর্ণনার সঙ্গে কমিশনার এবং এজেন্ট মেজর ডরু. সি. আরস্কিনের কাছে চিঠিতে বিদ্রোহের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তার সঙ্গে তুলনা করে দেখা যায়, রাণীর কাছ থেকে প্রচুর টাকা-পয়সা আদায় করে ১২ তারিখে সেপাইরা দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে। সেদিনই ডাকহরকরা আরস্কিনকে একখানা পত্র দিয়ে যায়। দু’দিন পরে ডাকহরকরা ঝাঁসীর ঘটনার আনুপূর্বিক বৃত্তান্তসহ আরেকখানা পত্র তার সাক্ষাতে উপস্থিত করে। রাণী লিখেছেন, ঘাঁটিতে যে সকল সরকারি সেপাই রয়েছে তারা ধর্মহীন, নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁসীর সমস্ত সামরিক বেসামরিক ইউরোপীয় অধিবাসীদের হত্যা করেছে। কেরাণীকূল এবং তাঁদের পরিবারবর্গ কেউই রক্ষা পায়নি। কামানের অভাববশতঃ রাণী তাঁদের কোনো রকমের সাহায্য করতে পারেননি। তাঁর মাত্র ৫০ থেকে ১০০ জন সৈন্য ছিলো। তার প্রাসাদ পাহারা দেয়ার জন্য তাদের প্রয়োজন। সে কারণে তিনি কোনো সাহায্য করতে পারেননি। এজন্য তার আফসোসের অন্ত নেই। তারপরে বিদ্রোহী সেপাইরা তাঁর বিরুদ্ধেও প্রচুর ধ্বংসাত্মক কাজ করছে, চাকর-বাকরদের উপর নির্যাতন করেছে এবং তাঁর কাছ থেকে প্রচুর অর্থ ছিনিয়ে তারা দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছে। যেহেতু রাণী শাসন করার একমাত্র দাবিদার, তাই সেপাইরা যখন সম্রাটের কাছে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করেছে, এ সময়ে শাসনকার্য তার ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। রাণীর যে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল সেপাইদের দ্বারা সংঘটিত এতো বড়ো মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর তিনি ঝাঁসীর তহশীলদারের সাহায্যে ডেপুটি কমিশনারের বিচার বিভাগীয় সেরেস্তাদার এবং সুপারিন্টেন্ডেন্টের কোর্টে সংবাদ প্রেরণ করছেন। রাণী যদি সেপাইদের অনুরোধে রাজী না হন, তাহলে তারা রাণীর প্রাসাদ উড়িয়ে দেবে। তাঁর মান-সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি সেপাইদের অনেক অনুরোধ রক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। অনেক সম্পদ এবং নগদ টাকা ছেড়ে দিতে হয়েছে। সমগ্র জেলার মধ্যে একজন ব্রিটিশ অফিসারও জীবিত নেই জেনে তিনি জেলার প্রত্যেকটি সরকারি কর্মচারির কাছে পরোয়ানা পাঠিয়েছেন, যাতে তারা কর্মস্থলে থেকে কর্তব্য কর্ম করে যায়। বার বার তাঁকে ভয় দেখানো হচ্ছে। এটা ঠিক যে এ সংবাদ সঙ্গে সঙ্গে পাঠানো উচিত ছিলো। কিন্তু ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি যে সকল লোক, তারা তাঁকে সে রকমের কোনো সুযোগ দান করেননি। সেপাইরা দিল্লীর দিকে পথ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি পত্র লিখতে বসেছেন। ১৪ই জুলাই তারিখে এ পত্র লিখেছিলেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, সমগ্র জেলাতে অরাজকতার রাজত্ব চলছে। প্রতাপশালী সামন্তেরা দুর্গগুলো অধিকার করে নিয়ে আশেপাশে নির্যাতন এবং লুণ্ঠনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। জেলার নিরাপত্তা রক্ষা করা তাঁর ক্ষমতার বাইরে। কারণ এ জন্য অর্থের প্রয়োজন। এ অবস্থায় কোনো মহাজন তাঁকে অর্থ ঋণ দিতে রাজী হবে না। বর্তমান সময় পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বিক্রয় করে প্রচুর অসুবিধার সম্মুখীন হয়েও লুটেরাদের হাত থেকে নগর রক্ষা করে আসছেন। শহর এবং মফঃস্বলের ঘাঁটির অনেক কর্মচারিকে তিনি আশ্রয়দান করেছেন, কিন্তু উপযুক্ত সরকারি শক্তি এবং অর্থের অভাবে তা দীর্ঘদিন রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সুতরাং জেলার প্রকৃত অবস্থা লিখে জানালেন, বিশ্বাস মতো তাঁর ওপর যে আদেশ জারী করা হবে সে অনুসারেই তিনি কাজ করবেন।
এ সরল সহজ পত্রের ভাষার মধ্যে কোনো রকমের ঘোরপ্যাঁচ নেই। রাণী স্পষ্টই স্বীকার করেছেন, তাঁকে বিদ্রোহীদের সামরিক তহবিলে চাঁদা দিতে হয়েছে। সেপাইদের সঙ্গে কোনো রকম ষড়যন্ত্রে যদি লিপ্ত থাকতেন, তাহলে তাদেরকে ঝাঁসীতে অবস্থান করার জন্য প্ররোচিত করতেন।
মেজর আরস্কিন রাণীর আন্তরিকতায় কোনো রকম সন্দেহ করেননি। সেজন্য মধ্যবর্তী সময়ে তার হাতে শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাকে পুলিশ নিয়োগ এবং রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দান করেছেন। ভারতের গভর্ণর জেনারেল শর্তসাপেক্ষে মেজর আরস্কিনের ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ঘোষণা করা হলো, রাণীর বিবৃতি যদি মিথ্যা হয়, তাহলে রাণীকে রেহাই দেয়া হবে না। ইংরেজরা ঝাঁসীতে ৬০জন পুরুষ, নারী ও শিশু হত্যার ব্যাপারে চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু ১৮৫৭ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকারের পক্ষে এ ব্যবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিলো না। সারা ভারত জুড়ে সেপাইরা তখন বিদ্রোহ করেছে।
রাণীর শত্রুরাও বসে ছিলো না। গঙ্গাধর রাওয়ের মৃত্যুর পর ভ্রাতুস্পুত্র সদাশিব রাও বার বার সিংহাসন দাবি করে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি মনে করলেন, সেপাইরা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলে অবশেষে তার ক্ষমতা দখলের সুযোগ এসেছে। তিনি কিছু সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে ঝাঁসী থেকে চল্লিশ মাইল দূরে কারেরা দুর্গ অধিকার করলেন। তারপর সেখান থেকে পুলিশ এবং রাজস্ব কর্মচারিদের তাড়িয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি নিকটবর্তী গ্রামসমূহে গোলযোগ করতে থাকেন এবং নিজেকে ঝাঁসীর মহারাজা বলে ঘোষণা করেন। রাণীর সৈন্যরা তাঁকে কারেরা হতে তাড়িয়ে দিলো। কিন্তু তিনি নরওয়ারের সিন্ধিয়ার রাজত্বে নিরাপদ আশ্রয় পেলেন। সেখানে কিন্তু সৈন্য সংগ্রহ করে আবার লুটতরাজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু এবারে রাণীর সৈন্যরা তাঁকে ঝাঁসীর দুর্গে বন্দী করে নিয়ে যায়।
জব্বলপুর বিভাগের কমিশনার রাণীকে নির্দেশ দিয়েছেন, ব্রিটিশ সৈন্য না আসা পর্যন্ত ঝাঁসীর শাসন এবং প্রতিরক্ষার ভার গ্রহণ করতে। তিনি অনুগতভাবে এ কর্তব্য গ্রহণ করলেন। কিন্তু পরে দেখতে পেলেন বিদ্রোহী সেপাইরা নয়, ব্রিটিশের অনুগত ধুন্দেলারাই তাঁর রাজ্য পূর্ব হতে পশ্চিমে আক্রমণ করেছে এবং দুর্গকে বিপন্ন করে তুলেছে। বারবার সাহায্যের আহ্বান করে ব্যর্থ হলেন। এ প্রতিভাময়ী রমণী কিছুতেই ওরচা এবং দাতিয়ার হাতে পরাজয় মেনে নিতে রাজী ছিলেন না। তিনি সৈন্য সংগ্রহ করলেন, কামান তৈরি করালেন। তার সৈন্যরা মুরানীপুর এবং বারওয়া সাগারে শত্রুদের দু’দুবার পরাজিত করলো। নাথে খান পরাজিত হলো বটে, কিন্তু রাণীও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর সেনাবাহিনীতে অনেক বিদ্রোহী সেপাই চাকুরি গ্রহণ করেছিলো। তার মিত্রদের মধ্যে বনপুর এবং শাহ্পুরের রাজা সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অধীন সামন্তেরা বিজয়ের স্বাদ পেয়ে অধিকতররা বড়ো যুদ্ধ করার বাসনা পোষণ করতে লাগলেন।
৮ই জানুয়ারি তারিখের একটি সংবাদে জানা যায় যে জেল দারোগা করিম বখশ রাণীর কাছে লিখে পাঠিয়েছেন, তিনি ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে রাজী আছেন কিনা? রাণী জানালেন, তিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না, ইংরেজ সেনাবাহিনী এসে পৌঁছেলে তার অধীনে যতোগুলো জেলা আছে, সবগুলোর কর্তৃত্বভার তিনি ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেবেন। ২৬শে জানুয়ারি তারিখে খবর পাওয়া গেলো, রাণী তাঁর সৈন্যবাহিনীকে মুরানীপুরে ওরচার সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছেন। তারপর তিনি কমিশনারের কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করলেন। যদি প্রতিনিধিকে সসম্মানে গ্রহণ করা হয়, তাহলে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। পক্ষান্তরে ব্রিটিশ অফিসারেরা তাঁর সঙ্গে বিরূপ ব্যবহার করলে তিনি যুদ্ধ করবেন। বন্দুক এবং বারুদ প্রস্তুত হতে লাগলো। ফেব্রুয়ারি মাসেও রাণী যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যদিও তাঁর প্রস্তুতি চলছিলো। মার্চ মাসে তার সভাসদদের মধ্যে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। কিছু সংখ্যক সভাসদ ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি করতে মত দিলেন এবং কিছু সংখ্যক সভাসদ রাণীকে যুদ্ধ করে যাওয়ার জন্য প্ররোচিত করতে লাগলেন।
আরো খবর পাওয়া গিয়েছে শাহজাদা ফিরোজ শাহ্ ঝাঁসীতে অবস্থান করছেন। আরেক সংবাদে জানা যায়, তাঁতিয়া টোপী রাণীকে ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি করতে বারণ করেছেন। কিন্তু এ সকল সংবাদের কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। জানুয়ারি মাসে তিনি ব্রিটিশ উদাসীনতার কারণে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসে পরিস্থিতি অনুসারে নিজের পথ অনুসরণ করেছেন, মার্চ মাসে তার কিছু কিছু সংবাদ মারমুখী নীতি গ্রহণের জন্য রাণীকে প্ররোচিত করেছেন। তিনি পুরনো ব্রিটিশ সেপাইদের সেনাদলে ভর্তি করলেন। তারা ছিলো যুদ্ধের জন্য। শান্তির সময়ে তারা অহেতুক অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সে যাহোক, তিনি অতি সাবধানতার সাথে ব্রিটিশ গতিবিধি নিরীক্ষণ করে আসছিলেন। জানুয়ারিতে যে প্রত্যাশা ছিলো, মার্চ মাসে তা অবসিত হয়ে এলো। স্যার হাফরোজ ঝাঁসীর দিকে পথ দিয়েছেন। তাঁর হাবভাব বন্ধুসুলভ মনে হচ্ছে না।
শুধু সামরিক বিভাগেই স্যার হাফরোজের অভিজ্ঞতা সীমাবদ্ধ নয়। তিনি কুটনীতিবিদ হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। ২০ বছর চাকুরি করে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেলের পদে উন্নীত হয়েছেন। তিনি ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৮৫৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পুনা বিভাগের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। বুন্দেলার সদারদের নিরপেক্ষ বোধ করায় তিনি সাগারে অভিযান করতে মনস্থ করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রা করলেন। বিদ্রোহীরা রাহাতগড়ে তাকে বাধা দিলো। বনপুরের বুন্দেলা রাজা মর্দান সিং সেপাইদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না। তিনি দেখলেন যে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দিলে তিনি হৃতরাজ্য উদ্ধার করতে পারবেন এবং স্থানীয় ঠাকুরদের সহায়তায় ঐতিহাসিক দুর্গ অধিকার করতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ করেও রাহাতগড়ের অবরোধ ভেদ করতে সক্ষম হলেন না। তারপর বিদ্রোহীরা বীনার ববদিয়া নামক স্থানে চলে এলো। দৃঢ়চিত্তে আফগান এবং পাঠানদের অল্পসংখ্যক সৈন্য প্রাণপণ বিক্রমে দুর্গ প্রতিরক্ষা করেন। কিন্তু তাদের দলপতি প্রাণ হারালেন, আবার এদিকে বনপুরের রাজাও আহত হয়েছেন। সে স্থান ত্যাগ করতে হলো। ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে স্যার হাফরোজ সাগার-এর কাছাকাছি এসে গেলেন। গারাকোটাকে মুক্ত করে স্যার হাফরোজ ঝাঁসীর দিকে অভিযান করা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। যানবাহনের অভাবে তাঁর যাত্রা দু’দিনের জন্য স্থগিত রাখতে হলো। তার পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করার আগে স্যার হাফরোজ সেনাবাহিনীর প্রত্যেক শাখার উন্নয়ন সাধন করলেন। স্যার হাফরোজ পেছনের দিক দিয়ে চাখারী হয়ে কল্পিতে গিয়ে সেখান থেকে ঝাঁসীতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কেননা কল্পির রাজা হলেন ব্রিটিশ সরকারের একেবারে গোড়া সমর্থক। তার সৈন্য বাহিনীর পক্ষে ঝাঁসীর দুর্গ দখল করা কষ্টসাধ্য হবে বলে তিনি মনে করলেন। কিন্তু তিনি মনে করলেন আবার পেছনে এ রকম শক্তিশালী শত্রু-দুর্গ রেখে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ২১শে মার্চ তারিখে ব্রিটিশ সৈন্য ঝাঁসীতে এসে উপনীত হলো। এ সময়ে স্যার হাফরোজের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন ব্রিগেডিয়ার স্টুয়ার্ট।
ঝাঁসী থেকে কয়েক মাইল দূরে থাকতেই স্যার হাফরোজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলো। কানপুরের পরাজয় তাতিয়া টোপীকে নিরস্ত করতে পারেনি। তিনি পেছন দিক নিয়ে ক্ষুদ্র বুন্দেলা রাজ্যের ক্ষুদ্র রাজধানী আক্রমণ করে বসলেন। রাজা অসহায়ভাবে ব্রিটিশ সেনাপতির কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানালেন। সুতরাং হাফরোজ তিলমাত্র সময় নষ্ট না করে বুন্দেলার রাজাকে রক্ষা করার কথা ভাবলেন। যাহোক সেখানে যাওয়া হলো না। অতঃপর তিনি ঝাঁসীর দিকে একাগ্র দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।
২২শে মার্চ তারিখে অবরোধ করা হলো। ২৫ তারিখে কামান থেকে গোলাবর্ষণ হতে লাগলো। নগরবাসীরা কামানের গুলী দিয়ে শত্রুদের অভ্যর্থনা করলো। মহিলারাও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সন্ধ্যাবেলা তাঁর সৈন্যদের অনুপ্রাণিত করার জন্য রাণী নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন। তিনি বাইরের সাহায্যের প্রত্যাশা করছিলেন। তাদের আসতে বেশি সময়ের দরকার হলো না। ৩১শে মার্চ তারিখে তাঁতিয়া টোপীর পরিচালনাধীন ২০ হাজার সৈন্য ঝাঁসীতে এলো। স্যার হাফরোজ কিছু সৈন্য নিয়ে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর তাঁতিয়া টোপীর সৈন্যবাহিনীকে হটিয়ে দিলেন।
তাঁতিয়া টোপীকে পরাজিত করে স্যার হাফরোজ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁসী আক্রমণ করলেন। তাঁতিয়া টোপীর সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবনের ফলে সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিলো কিনা বলা যায় না। ৩রা এপ্রিল তারিখে তারা শত্রুর ওপর প্রবল অগ্নিবৃষ্টি শুরু করলো। ঘটি, বাটি, বটি, দা, কুড়াল হাতের কাছে যা পেলো শত্রুর প্রতি ছুঁড়ে মারতে লাগলো। অবশেষে নগরীর ফটক ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো এবং ব্রিটিশ সৈন্য দ্রুতবেগে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। কিন্তু একটি বিরাট পাথরখণ্ড প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ালো। তাদের প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হলো। কিন্তু আরেকটি দল ছোট্ট একটি ফাটল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। এখন যুদ্ধ শহরের রাজপথে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিরক্ষাকারীরা প্রতিটি স্থানে বীরবিক্রমে লড়ে যাচ্ছে। বিনা যুদ্ধে এক পা অগ্রসর হবারও উপায় নেই। শত্রুরা প্রতিটি কক্ষে হামলা চালালো। কিন্তু সঙ্গিনের মুখে তাদের পালিয়ে আসতে হলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সৈন্যের দখলে চলে এলো প্রাসাদ। তখনও রাণীর ৪০জন দেহরক্ষী বীর বিক্রমে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কিছু সংখ্যক একটি কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলো। সে কক্ষে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো। তাদের কাপড়ে আগুন ধরে গেলো। অর্ধদগ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তারা সে ঘরেই রয়ে গেলো। পরের দিন প্রাসাদ সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে যুদ্ধ চললো। প্রত্যেক ভারতীয়কে যুদ্ধ করুক বা না করুক শত্রু বলে ধরে নিয়ে হত্যা করা হলো। যারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো না তারা কূয়াতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলো।
ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রবল আক্রোশ ছিলো রাণীর উপর। কিন্তু রাতের অন্ধকারে পুরুষের বেশে পালক পুত্রসহ পালিয়ে গেলেন। তাঁরা ছিলেন একদল আফগান রক্ষী। ওরচা প্রহরীদের দৃষ্টিকে তারা ফাঁকি দিয়েছিলো। কিন্তু সকাল হবার পূর্বে তারা আরেকটি ঘাঁটির সম্মুখীন হলেন। তাঁর রক্ষীবৃন্দসহ রাণী কল্পির দিকে অশ্বারোহণে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তার বাবা মামা সাহেব পথ হারিয়ে ফেলেন এবং ধৃত হন। তাঁকে ঝাঁসীতে পাঠিয়ে দেয়া হলে জোখনবাগে শূলে চড়ানো হয়। অশ্বারোহণে রাণী একরাতে ২১ মাইল পথ অতিক্রম করে গেলেন। কিন্তু তার অন্তর্ধানের সংবাদ ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে অজ্ঞাত ছিলো। সকালে ক্যাপটেন ফর্বস এবং লেফটেন্যান্ট ডকারকে ৩১নং হাল্কা অশ্বারোহী বাহিনী এবং ১৪নং পল্টনসহ পাঠিয়ে দেয়া হলো। রাণীর চল্লিশ জন দেহরক্ষী ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে লাগলো। তার মধ্যে উনচল্লিশ জন একে একে মারা গেলো। বাকী রইলো কেবল মাত্র একজন। রাণী ছিলেন সুদক্ষা অশ্বারোহী। অনুসরণকারীদের সর্বাগ্রগণ্য ব্যক্তিটি রাণীর গুলির আঘাতে ধরাশায়ী হলো।
ঝাঁসীর পতন হলো। পেশোবার সৈন্যের সদর দফতর কল্পি এখনো বিদ্রোহীদের হাতে। সেখানে বিদ্রোহী নেতাদের সভা বসলো। রাও সাহেব,, বান্দার নওয়াব এবং ঝাঁসীর রাণী এক সঙ্গে সভা বসলো। রাও সাহেব বান্দার নওয়াব এবং ঝাঁসীর রাণী একসঙ্গে করতে যুদ্ধ লাগলেন। কিন্তু ২৩ তারিখের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বাধ্য হয়ে তাদেরকে কল্পিও ছাড়তে হলো। কল্পির পতনের পর বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দ পুনরায় এক সভা আহ্বান করলেন। সেখানে সেপাইদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হলো না। তাঁর রাজ্যের অনেক জায়গা ঘুরে সিন্ধিয়া ১৭ই নভেম্বর তারিখে কোটালকী সরাই নামক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
সেদিন ব্রিগেডিয়ার স্মিথ যখন কোটালকী সরাই থেকে গোয়ালীয়রের সেপাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন তখন ঝাঁসীর রাণী বীরাঙ্গনা লক্ষ্মীবাই মৃত্যুমুখে পতিত হন। এ প্রসঙ্গে দু’টি কাহিনী প্রচলিত আছে। ম্যাকফারসান লিখেছেন, ফুলবাগ কামানের কাছে আমি দেখতে পেলাম ঝাঁসীর রাণী নিথর হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর শরীরে প্রাণ স্পন্দনের চিহ্ন নেই। তাঁর চাকর জানালা তিনি সেখানে বসে সুরা পান করছিলেন। নিকটে ছিলো চারশোর মতো অনিয়মিত সেপাই। ব্রিটিশ সৈন্য আসছে বলে যখন ডঙ্কা বাজিয়ে দেয়া হলো পনেরো জন ছাড়া আর সকলেই পালিয়ে গেলো। রাণীর ঘোড়া লাফ দিয়ে খাল অতিক্রম করতে পারলো না। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন এবং মাথায় চোট লেগেছিলো তার। তারপরে ঘোড়া থেকে ঢলে পড়ে গেলেন এবং নিকটস্থ বাগানে তাঁকে দাহ করা হয়।
কিন্তু স্যার রবার্ট হ্যামিলটন এ প্রসঙ্গে বর্ণনা দিয়েছেন তা একটু ভিন্নতর। সে যাক, যেভাইে জীবনাবসান ঘটুক না কেন, তিনি প্রকৃত বিক্রমশালী বীরাঙ্গনার মতো মৃত্যুবরণ করেছেন। ব্রিটিশ সৈন্য রাণী লক্ষ্মীবাঈয়ের মতো আর কাউকে অমন ঘৃণা করেনি। শৌর্যে-বীর্যে, ক্ষিপ্রতায় এ রকম উদ্দীপনা সঞ্চারী মহিলা পৃথিবীর ইতিহাসে অধিক দেখা যায় না।