৭. মিহিরবাবু মানুষটি

০৭.

মিহিরবাবু মানুষটিকে দেখলে খোলামেলাই মনে হয়। চেহারাটি ভালই, কিন্তু মাথায় সামান্য খাটো, একটু নধর গোছের। মাথার চুল পাকেনি। সামান্য টাক পড়তে শুরু হয়েছে। গোলগাল মুখ। চোখে চশমা। পান-জদা-সিগারেট–কোনোটাই বাদ যায় না। কথা বলেন অনর্গল। তবে তারই মধ্যে যা নজর করার করে নিতে পারেন। বাইরে বোঝা যায় না; ভেতরে তিনি কিন্তু বুদ্ধিমান এবং চতুর। গায়ে পাতলা একটা চাদর মতন থাকে। কাটা হাতটাকে ঢেকে রাখেন।

কিকিরা আর তারাপদকে তিনি খানিকটা বাজিয়ে নিলেন প্রথমে। কিকিরাও কম যান না। কথা বলার ভঙ্গিতে তিনি মিহিরবাবুকে হাসিয়ে ছাড়লেন। দু-একটা খুচরো ম্যাজিক দেখিয়ে দিলেন সামনে বসে। লাইটার উড়িয়ে দিলেন টেবিল থেকে, আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন। মিহিরবাবুর লাইটারের শখ রয়েছে। দু-দুটো লাইটার সামনেই পড়ে ছিল। সিগারেটের প্যাকেটও।

মিহিরবাবু যে-ঘরে বসে ছিলেন, সেটি তাঁর নিজস্ব বৈঠকখানা। সাজানো-গোছানো। দেওয়ালে ‘ইভনিং ক্লাবে’র নাটকের ফোটো, একপাশে দুটো কাপ। শিশির ভাদুড়ীর বড় ছবি একটা। বইয়ের আলমারিতে ঠাসা বই আর বাঁধানো মাসিক পত্রিকা। আইনের বই একটাও নেই।

চা খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। মিহিরবাবু পান বিলি করলেন কিকিরাদের। নিজেও পান-জদা মুখে পুরে এবার কাজের কথা পাড়লেন। বললেন, “তা মশাই, আপনি তো ম্যাজিক-মাস্টার। হঠাৎ এই গোয়েন্দাগিরিতে নামলেন কেন?”

কিকিরা অমায়িক হাসি হেসে বললেন, “ইচ্ছে করে নামিনি, স্যার। এই যে আমার লেজুড়টিকে দেখছেন, এর পাল্লায় পড়ে হেভেন থেকে ফল করতে হয়েছে।”

“ফল?”

“আজ্ঞে, ফ্রম ম্যাজিক টু গোয়েন্দা। জাদুবিদ্যা থেকে পাতি গোয়েন্দাগিরিতে পড়ে যেতে হল।”

মিহিরবাবু হেসে উঠলেন। “আচ্ছা। ফল ফ্রম ম্যাজিক। ..তা আমাদের ক্লাবের যে শো হচ্ছে–পুজোর পর। কালীপুজোতে। তাতে একটু খেলা দেখান না। ক্লাসিকাল ম্যাজিক। ধরুন ঘন্টাখানেক। বেশ জমে যাবে।”

কিকিরা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আমি আর খেলা দেখাই না। বাঁ হাতটা কমজোরি হয়ে গেছে। সুইফটনেস নেই। অন্য কাউকে ব্যবস্থা করে দেব, আপনি ভাববেন না।“

নিজেদের ক্লাবের খানিকটা গুণগান গেয়ে মিহিরবাবু বললেন, “আসবেন একদিন ক্লাবে। সোমবার বাদে। কাছেই আমাদের ইভনিং ক্লাব, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গায়েই।”

মিহিরবাবু এবার আসল কথা পাড়লেন। বললেন, “কাজের কথা শুরু করা যাক কিঙ্করবাবু। বলুন, আমি কী করতে পারি?”

কিকিরা হেসে বললেন, “স্যার, আমায় বাবুটাবু বলবেন না। স্রেফ কিকিরা।”

“অতি উত্তম। তাই হবে।”

“আপনার কাছে আমি কেন এসেছি, আগেই আপনাকে জানিয়েছি। লোচনবাবুর নোটিস, তিরিশ হাজার টাকা পুরস্কার–সবই বলেছি…।”

“হ্যাঁ, কাগজে আমি দেখেছি।”

“নোটিসের বয়ানটা কি আপনি করে দিয়েছিলেন?”

“না। মনে হয় অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছে, নিজেও করতে পারে।”

“লোচনবাবু আপনার কাছে এর মধ্যে ক’বার এসেছেন?”

মিহিরবাবু পান চিবোতে-চিবোতে বললেন, “নিজে একবারও নয়ন আমিই ওকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, তখনই এসেছিল; তারপর আর নয়।

“মোহনের কথা বলতে ডেকে পাঠিয়েছিলে?”

“হ্যাঁ। চিঠি দেখালাম।”

তারাপদ চুপ করে বসে কথা শুনছিল। হঠাৎ বলল, “মোহনবাবু কেমন লোক?”

মিহিরবাবু পিঠ সামান্য সোজা করে বসলেন। বললেন, “খাসা ছেলে। চমৎকার। অতি চমৎকার। ভদ্র, বিনয়ী, হাসিখুশি। আমার ইভনিং ক্লাবের একজন ইম্পট্যান্ট মেম্বার। আমার এক চেলা। আমাদের রিলেশানটা ছিল বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মতন; যদিও সম্পর্কে খুড়ো-ভাইপো। ও আমাদের অনেক কাজ করত। থিয়েটারের আগে স্টেজ ভাড়া, সেট সেটিংয়ের ব্যবস্থা, সুভেনির ছাপা–অনেক কাজ রে ভাই। জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ।”

“নিজে কি অভিনয় করত?”

“না। একবার মাত্র করেছে,” বলে দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখালেন। বললেন, “আমরা জুবিলি ইয়ারে একটা ড্রামা করেছিলাম। ডিটেকশান স্টোরি। গোয়েন্দা গল্পের নাটক। ইংরিজি নাটক থেকে গল্পটা নিয়েছিলাম। আমিই লিখেছিলাম নাটকটা। নাম ছিল “বিষের ধোঁয়া’। শরদিন্দু বাঁড়জ্যের একটা নভেল আছে ওই নামে। সেটা নয়। নামেই যা মিল। নাথিং এলস।…ইয়ে, কী বলছিলাম–সেই নাটকে মোহনকে দিয়ে জোর করে একটা পার্ট করিয়ে দিলাম। সামান্য পার্ট। যাও না ভাই, দেওয়ালে টাঙানো ছবিটা দেখো। গ্রুপ ফোটো।”

তারাপদ উঠে গেল ফোটো দেখতে। কিকিরার কাছে সে মোহনের ফোটো দেখেছে। সামান্য কৌতূহল হচ্ছিল অভিনেতা মোহনকে দেখতে।

কিকিরা কথা বলছিলেন মিহিরবাবুর সঙ্গে। বললেন, “ঘটনাটা সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”

মিহিরবাবু চুপ করে থাকলেন প্রথমে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন খানিকটা। পরে বললেন, “দেখুন কিকিরামশাই, দত্ত-ফ্যামিলি আমাদের প্রতিবেশী। তিন-চারপুরুষ ধরে একই পাড়ায় আছি। খানিকটা তো ওদের কথা জানি। একসময় দত্তরা বেশ ধনী ছিল। পরে অবস্থা খানিকটা পড়ে যায়। রামকৃষ্ণদা আর শ্যামকৃষ্ণদা ছাপাখানার ব্যবসাটাকে বাড়িয়ে আবার দাঁড়াবার চেষ্টা করেছিল। একেবারে যে আনসাকসেসফুল, হয়েছিল তাও নয়। পরে যে কী হয়েছিল আমি বলতে পারব না, তবে রামদা শ্যামদা মারা যাওয়ার পর থেকেই ব্যবসা পড়ে যাচ্ছিল। শুনেছি, লোচন বিস্তর দেনা করেছে। ছাপাখানার মেশিনপত্রও সে বেচে দিয়েছে দু-একটা। …ওদের ভেতরকার ব্যাপারে আমি মাথা গলাতে যাইনি। আমার এক পুরনো মক্কেলের কাছে জানতে পারলাম, লোচন বেনামে জমি কিনেছে বেহালায়, সেখানে নাকি একটা সিনেমা হাউসও করতে গিয়ে ফেঁসে গেছে।”

“লোচনবাবুর কি অনেক দেনা?”

“বলতে পারব না। খানিকটা দেনা তো আছেই।”

“সম্পত্তির ভাগীদার কি দুই ভাই?”

“হ্যাঁ। সমান-সমান।”

“মোহন তো পোষ্যপুত্র?”

“তা হোক। রামকৃষ্ণদা তাঁর স্বােপার্জিত সমস্ত কিছু মোহনকে দিয়ে গিয়েছেন।”

“আপনি জানেন?”

“জানি। …আরও জানি, লোচন তাদের পৈতৃক বাড়ির সামনের জমিটুকু বেচে দেওয়ার জন্যে হালাল লাগিয়েছে।”

“কবে থেকে?”

“হালে।”

 কিকিরা বললেন, “মোহনের মৃত্যু সম্পর্কে আপনার কী মনে হয়?”

মিহিরবাবু মাথা নাড়লেন। যেন বলতে চাইলেন, তিনি আর কী বলবেন?

 “মোহন মারা গিয়েছে?” কিকিরা বললেন।

“তাই শুনেছি।”

“আপনি কি নিশ্চিত?”

“অফিসিয়ালি মৃত বলতে পারেন।”

“তবে এই লোকটা কে? এই যে ফোন করছে, চিঠি লিখছে, তুলসীবাবুর সঙ্গে দেখা করছে, এ কে?”

মিহিরবাবু কিছু বললেন না।

তারাপদ ডাকল, “একবার এদিকে আসবেন, স্যার?”

কিকিরা উঠে গেলেন।

তারাপদ বলল, “বিষের ধোঁয়া’ নাটকের গ্রুপ ফোটো। মোহনকে চিনতে পারেন? আমি তো পারলাম না।”

কিকিরা দেখলেন। নাটক শেষ হওয়ার পর পাত্রপাত্রীরা যে-যেমন সাজ পরেছিল, মেক-আপ নিয়েছিল–সেই পোশাক আর বেশবাস নিয়েই ফোটোটা তোলা। কিকিরা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখলেন। চিনতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এক দাড়িওয়ালা বুড়োটে গোছের লোক দেখে তাঁর সন্দেহ হল। কাঁধে কাপড়ের মস্ত ঝোলা নিয়ে যারা পাড়ায় পাড়ায় পুরনো খবরের কাগজ কিনে বেড়ায়–অবিকল সেই বেশ। মাথায় গামছা বাঁধা। অর্ধেকটা কপাল ঢাকা পড়েছে গামছায়।

কিকিরা বললেন, “এই কাগজঅলা।” বলে মিহিরবাবুর দিকে তাকালেন ঘুরে গিয়ে। “এই কাগজঅলা মোহন? বেশ মেক-আপ নিয়েছে তো?

মিহিরবাবু হাসছিলেন। মাথা নাড়লেন। বললেন, “না।আপনি ভুল করলেন। ম্যাজিক চলল না মশাই। ওই ফোটোর মধ্যে একজনকে দেখুন-ক্লাউন সেজে দাঁড়িয়ে আছে। ও-ই মোহন। …ওকে দিয়ে সার্কাসের ক্লাউনের ছোট্ট পার্ট করিয়েছিলাম।”

কিকিরা আবার ছবি দেখলেন, বাঃ বললেন। “চেনা যায় না। ঠকে গেলাম।” বলে নিজের জায়গায় ফিরে এলেন। বসলেন। বললেন, “এই জাল মোহনের আবিভাব কেন স্যার বলতে পারেন?”

মিহিরবাবু হেসে বললেন, “গোয়েন্দা আপনি। আমি কী বলব?”

কিকিরা একদৃষ্টে মিহিরবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, বোধ হয় লক্ষ করছিলেন কিছু। শেষে বললেন, “আমারও ধারণা মোহন মারা গিয়েছে। কিন্তু সে বোধ হয় পা পিছলে পড়ে যায়নি, তাকে পাহাড়ের বিশ্রী জায়গা থেকে ঝরনার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জলের স্রোতের সঙ্গে মোহন নিচে গড়িয়ে গিয়েছে।”

মিহিরবাবু কোনো কথা বললেন না। শুনলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল।

কিকিরা নিজেই বললেন, “এ কাজ লোচন ছাড়া অন্য কেউ করতে পারে না।

“কেন?”

“মোহন যখন পড়ে যায় তখন তার পাশে লোচন ছাড়া কেউ ছিল না। অন্য দু’জন–লোচনের মেজো শ্যালক আর মোহনের বন্ধু খানিকটা পেছনে ছিল। ঝোঁপঝাড় পাথরের আড়ালও থাকতে পারে। তারা কিছু দেখতে পায়নি।”

কিকিরার কথা শেষ হওয়ার আগেই মিহিরবাবু বললেন, “আপনার অনুমান ঠিক হতে পারে। তবে আইন অনুমানকে প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য করে না। প্রমাণ কী যে, লোচন তার ছোট ভাইকে ঝরনার মধ্যে ঠেলে ফেলে দিয়েছে।”

কিকিরা স্বীকার করে নিলেন, প্রমাণ কিন্তু নেই।

মিহিরবাবু বললেন, “প্রমাণ ছাড়া কাউকে খুনি হিসাবে ধরা যায় না। প্রমাণটাই আসল। লোচন যে খুনি একথা আপনি প্রমাণ করবেন কেমন করে?” বলে একটু থেমে আবার বললেন, “নিজের সব কাজ লোচন পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়েছে। দেহাতি ডাক্তারের সার্টিফিকেট, আইডেনটিফিকেশন, থানা–সবই সে গুছিয়ে সেরে রেখেছে। এখন আপনি কেমন করে লোচনকে খুনি বলে সাবাস্ত করবেন?”

কিকিরা মাথার চুল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বললেন, “পারছি কোথায়? পারছি না স্যার। এই জিনিসটাও আমার খুব অবাক লাগছে। চার-পাঁচ বছর পরে হঠাৎ জাল মোহনের আবিভাবই কেন ঘটল। কে ঘটাল? লোচন এত ভয়ই বা পেয়ে গেল কেন যে, ত্রিশ হাজার টাকা ঘর থেকে বের করে দিতে রাজি হল?”

মিহিরবাবু বললেন, “লোচন ভেবেচিন্তে কাজ করে, বোকা নয়।”

“সেটা বোঝা যাচ্ছে। আসলে লোচন চাইছে এই জাল মোহনের রহস্যটা উদ্ধার করতে।

“মানে সে বুঝতে পেরেছে, এমন কেউ তার সঙ্গে শত্রুতা করছে, যে আসল ঘটনাটা জানে। এই লোকটাকে সে ধরতে চায়।”

“আসল ঘটনা জানতে পারে মাত্র দু’জন। লোচনের মেজো শ্যালক, আর মোহনের বন্ধু। তাদের কাউকেই তো পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে লোচনের মেজো শ্যালক ভগ্নীপতির দলে বলে মনে হয়। আর মোহনের বন্ধুর তো কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।”

“আপনি খোঁজ করেছেন?”

“অনেক। নামটা জানতে পেরেছি। তার দেশ গ্রামের কথাও জানতে পেরেছি। সে দিল্লিতে ছিল তাও ঠিক। তারপর আর কিছু পারিনি।”

মিহিরবাবুর সামনে জলের গ্লাস ছিল। গ্লাসের ঢাকা সরিয়ে জল খেলেন। বললেন পরে, “কী নাম তার?”

“অমলেন্দু..”

“তার কোনো ফোটো দেখেছেন?”

“না।”

“দেখতে চান?…ওই গ্রুপ ফোটোটার কাছেই যান, আবার বিষের ধোঁয়া। মাঝখানে একজনকে দেখবেন, শিকারির পোশাক পরা, হাতে বন্দুক। ভাল চেহারা। ওই হল অমল–অমলেন্দু। মোহনের বন্ধু।”

কিকিরা অবাক হয়ে বললেন, “মোহনের বন্ধুও নাটক করত?”

“করত কী মশাই! ভাল করত। গুড অ্যাক্টর। গলা ভাল, ভয়েস পালটাতে পারত অদ্ভুতভাবে। ওকে যে-কোনো মেক-আপে মানিয়ে যেত।:যান, গিয়ে দেখে আসুন ছবিটা।”

কিকিরা উঠলেন। তারাপদ তখনও ফিরে এসে বসেনি। ছবি দেখছে, ঘর দেখছিল।

দু’জনেই যখন দেওয়ালে টাঙানো বিষের ধোঁয়ার গ্রুপ ফোটো দেখছে, মিহিরবাবু আচমকা বললেন, “আপনারা ওই ফোটোর মানুষটাকে দেখে নিন। তারপর আসল মানুষটাকে যদি একদিন দেখতে পান, অবাক হবেন না।”  কিকিরা আর তারাপদ ঘাড় ঘোরাল। দেখল, মিহিরবাবু চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন। মুখের সেই হাসি নেই, সহজ ভাবটাও দেখা যাচ্ছে না। কেমন যেন গম্ভীর, শক্ত মুখ।