৭ মার্চ, রবিবার ১৯৭১
আজ বিকেলে রমনা রেসের মাঠে গণজমায়েত। গত কদিন থেকে শহরের সবখানে, সবার মধ্যে এই জনসভা নিয়ে তুমুল জল্পনা-কল্পনা, বাকবিতণ্ডা, তর্ক-বিতর্ক। সবাই উত্তেজনায়, আগ্রহে, উৎকণ্ঠায়, আশঙ্কায় টগবগ করছে। আমি যদিও মিটিংয়ে যাব না, বাসায় বসে রেডিওতে বক্তৃতার রিলে শুনব, তবু আমাকেও এই উত্তেজনার জ্বরে ধরেছে।
এর মধ্যে সুবহান আমাকে জ্বালিয়ে মারল। আজ তাড়াতাড়ি রান্না সারতে বলেছিলাম। শরীফ বলেছে বারোটার মধ্যে খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নেবে। ঠিক দেড়টাতে রওনা দেবে, নইলে কাছাকাছি দাঁড়াবারও জায়গা পাবে না। আর সুবহান হতচ্ছাড়াটা এগারোটার সময় গোশত পুড়িয়ে ফেলল। বারেককে দিয়েছিলাম রুমী জামীদের সার্ট ইস্ত্রি করতে। সুবহান চুলোয় গোশত রেখে বারেকের সঙ্গে ইস্ত্রি করাতে মেতেছে। তিনিও আজ শেখের বক্তৃতা শুনতে যাবেন, তাই তাঁর নিজের প্যান্ট সার্ট ইস্ত্রি তদারকিতে যখন মগ্ন, তখন গোশত গেছে পুড়ে। কি যে করি ওকে নিয়ে। তাড়াতাড়ি ডিমের অমলেট করে ডাল–ভাজিসহ ভাত দিলাম শরীফদের।
এতবড় কাণ্ড করে, এত বকা খেয়েও সুবহানের কোনো হৃক্ষেপ নেই। রান্নাঘরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে প্যান্ট-সার্ট পরে তিনি শরীফদের সঙ্গে চললেন শেখের বক্তৃতা শুনতে।
আজ বারেকও গেছে ওদের সঙ্গে। এর আগে কোনো মিটিংয়ে যেতে দিইনি ওকে। আজকে না দিলে বড় অন্যায় হবে।
কিটির ঘরে গিয়ে ওর বারো ব্যাতের দামী রেডিওটা চেয়ে নিয়ে উপরে গেলাম। ওকেও আসতে বললাম আমার ঘরে। বাবা দুপুরের খাওয়ার পরে শুয়ে ঘুমোচ্ছন। আমি রেডিওটা নিয়ে আয়েশ করে বিছানায় শুলাম। একটু পরে কিটিও এল। রেডিও অন করে রেখেই দুজনে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে লাগলাম।
রেডিওতে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি গানটা শোনা গেল। আমরা কথা বন্ধ করে উত্তর্ণ হয়ে রইলাম। ওমা! তারপর আর শব্দ নেই। কি ব্যাপার?
শব্দ নেই তো নেই-ই। কারেন্ট গেল? বাতির সুইচ টিপে দেখলাম কারেন্ট আছে। রেডিওটা খারাপ হল? নব ঘুরিয়ে দেখলাম অন্য স্টেশন ধরছে। তাহলে?
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, চল ছাদে যাই তো।
দুজনে ছাদে গেলাম। পুবদিকে সোজাসুজি মাপলে মাত্র আধ মাইল দূরে রেসের ময়দান। নানা রকম শ্লোগানের অস্পষ্ট আওয়াজ আসছে। আকাশে চক্কর দিচ্ছে হেলিকপ্টার। হেলিকপ্টার কেন? কি ব্যাপার?
ব্যাপার সব জানা গেল শরীফরা মিটিং থেকে ফেরার পর।
কলিং বেলের শব্দ শুনে ছুটে গিয়ে দরজা খুলতেই রুমী দুই হাত তুলে নাটকীয় ভঙ্গিতে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বলতে বলতে ঘরে ঢুকল। দেখি, ফখরুদ্দিনও এসেছেন। ফখরুদ্দিন–সংক্ষেপে ফকির, শরীফের স্কুল জীবনের বন্ধু। তার পেশা ব্যবসা আর নেশা রাজনীতি, যদিও কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য তিনি নন। তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের খবরাখবরে তার চেয়ে ওয়াকিবহাল আমাদের জানার মধ্যে আর নেই।
সোফায় ধপ করে বসে পড়ে ফকির বললেন, ভাবী, চা খাওয়ান। এক সঙ্গে তিন কাপ-গলা শুকিয়ে কাঠ।
চেহারাও তো শুকিয়ে কাঠি। কি করে বেড়ান আজকাল? খান না নাকি?
শরীফ মুচকি হেসে বলল, নেতাদের লেজ ধরে দৌড়োদৌড়ির চোটে ওর নাওয়া খাওয়ার ফুরসত নেই। সুযোগ পেয়েই শরীফ ফকিরের পেছনে লাগে। আমি সুবহানকে চায়ের হুকুম দিয়ে সোফায় বসলাম, ওসব লেগ-পুলিং এখন রাখ। মিটিংয়ের কথা বল। রেডিও বন্ধ হয়ে রয়েছে কেন? আকাশে হেলিকপ্টার দেখলাম যেন।
রুমী বলল, হেলিকপ্টার তো পয়লা তারিখের পল্টন জনসভাতেও ছিল। ওরা বোধহয় গার্ড অব অনার দেওয়ার রেওয়াজ করেছে।
সবাই হেসে উঠল। কিটি রেডিও হাতে গুটিগুটি এসে দাঁড়াল, মৃদুকণ্ঠে বলল, রেডিও এখনো চুপ।
আমি বললাম, কিটি, এখানে এসে বস। আজ তোমার বাংলা বোঝার পরীক্ষা নেব। এখানে বসে আমাদের বাংলায় কথাবার্তা শোন, তারপর পুরোটা বলতে হবে। রেডিওটা খোলাই থাক।
কিটি হেসে সহজ হল, সোফায় এসে বসল। আমরা বাঁচলাম–এখন কলকল করে মাতৃভাষায় আলাপ না করলে প্রাণে শান্তি হবে না।
রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ লাখের মতো। কত দূর দূরান্তর থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে-তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা–এসব জায়গা থেকে তো বটেই, চব্বিশ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।
কিন্তু শেখ নিরাশ করেছেন সবাইকে। রুমীর একথায় সবচেয়ে প্রতিবাদ করে উঠলেন ফকির, তোমার মাথা গরম, চ্যাংড়া ছেলেরা কি যে বল না-ভেবেচিন্তে শেখ যা করেছেন, একদম ঠিক করেছেন।
সেটি পুরনো বাকবিতণ্ডা–যা গত কয়েকদিন ধরে সর্বত্রই শুনছি। একদল চায় শেখ স্বাধীনতার ঘোষণা দিন–আরেক দল বলছে তাহলে সেটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হবে।
রুমী তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু গলাতেই দৃঢ়তা এনে প্রতিবাদ করল, আপনারা দেয়ালের লিখন পড়তে অপারগ। দেখেন নি আজ মিটিংয়ে কত লাখ লোক স্বাধীন বাংলার পতাকা হাতে নিয়ে এসেছিল? জনগণ এখন স্বাধীনতাই চায়, এটা তাদের প্রাণের কথা। নইলে মাত্র এই ছদিনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সবাই সবখানে স্বাধীন বাংলার ঐরকম ম্যাপ লাগানো পতাকা সেলাই করার মত একটা জটিল কাজ, অন্যসব কাজ ফেলে, করে, সেটা আবার বাতাসে নাড়াতে নাড়াতে প্রকাশ্য দিবালোকে মিছিল করে যায়?
তর্কের গন্ধ পেলে তর্কবাগীশ ফকির সর্বদাই চাঙ্গা, তিনি বললেন, তুমিও দেখছি চার খলিফার দলের।
রুমী বলল, আমি কোনো দলভুক্ত নই, কোনো রাজনৈতিক দলের শ্লোগান বয়ে বেড়াই না। কিন্তু আমি সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন, মান-অপমান জ্ঞানসম্পন্ন একজন সচেতন মানুষ। আমার মনে হচ্ছে শেখ আজ অনায়াসে ঢাকা দখল করার মস্ত সুযোগ হারালেন।
আমি বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, এই সুদূরপ্রসারী তর্ক শুরু করার আগে আমি তোমাদের কাছ থেকে শুনতে চাই ছোট্ট একটা খবর। শেখের বক্তৃতা রিলে করা হবে বলে সারা দিন রেডিওতে অ্যানাউন্স করেও শেষ পর্যন্ত রিলে করা হল না কেন? কেনই বা রেডিও একদম ডেডস্টপ? এইটে শোনার পর আমি রান্নাঘরে চলে যাব। তখন তোমরা মনের সুখে সারারাত কচকচ কোরো।
শেখের বক্তৃতা রিলে করার জন্য বেতার-কর্মীরা তো তৈরিই ছিল। শেষ মুহূর্তে মার্শাল ল অথরিটি বক্তৃতা রিলে করতে দিল না। ব্যস, অমনি রেডিও স্টেশনের সমস্ত কর্মীরা হাত গুটিয়ে বসল। শেখের বক্তৃতা রিলে করতে না দিলে অন্য কোনো প্রোগ্রামই যাবে না। তাই রেডিও এরকম চুপ।
জামী এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, এখন হঠাৎ বলে উঠল, জান মা, আজ বিকেলের প্লেনে টিক্কা খান ঢাকায় এসেছে গভর্নর হিসাবে।
এক সপ্তাহ, দুইবার গভর্নর বদল। এক তারিখে ভাইস এডমিরাল এস, এম. আহসানকে বদলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে দেওয়া হয়েছিল, এখন আবার ছদিনের মাথায় তাকে সরিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে আনা হল। কি এর আলামত?
আজ রাতে রেডিও আর গলাই খুলল না।