বছরখানেক ধরে আমার মানবতাবাদী জনদশেক বন্ধু বেশ বিব্রতভাবে একটি মানবতাবাদী ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পেশ করে আসছেন আমার কাছে;–বেশি জনকে তারা এ-মুহূর্তে বলতে পারছেন না, খুব চুপচাপ কাজটি তাদের করতে হচ্ছে, আমাকে তারা বলার মতো বলে মনে করছেন, তাঁদের সাথে আমি সর্বাংশে একমত, কিন্তু তবু তাঁদের প্রস্তাবে আমার ভেতরে আমি হাসতে থাকি। তারা বুঝতে পারছেন বা মনে করছেন তাদের আর বেশি দিন নেই,-আমার থেকে তারা পনেরো বছরের মতো এগিয়ে, তাঁরা মৃত্যুকে উদারভাবে গ্রহণ করেছেন, তবে দেহগুলো কীভাবে রেখে যাবেন, তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। দেহ মানুষের চিরকালের উদ্বেগের সম্পদ। তারা চান না তাদের দেহগুলো নিয়ে আনুষ্ঠানিকতায় মেতে উঠুক তাদের সন্তানেরা, দেহগুলো সামনে রেখে আবৃত্তি করা হোক বিভিন্ন অবান্তর শ্লোক, ওই শ্লোকে তারা বিশ্বাস করেন না, যেমন আমিও করি না; তারা বিশ্বাস করেন মানুষের কল্যাণে। কল্যাণ নিয়েই তাদের সাথে মিল হচ্ছে না আমার। তারা শ্লোকে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু কল্যাণে বিশ্বাস করেন; আর আমি শ্লোক আর কল্যাণ কোনোটিতেই বিশ্বাস করি না। তারা চান তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মানুষের কল্যাণে দান করে যেতে-অক্ষি, অস্থি, বৃক্ক, হৃৎপিণ্ড সর্বাঙ্গ; শুধু তারা হয়তো দান করতে পারবেন না তাঁদের সেই সংরক্ত প্রত্যঙ্গগুলো যা তাদের পাগল করে রাখতে। ওগুলো হয়তো এখনো কারো দরকার পড়ছে না। কিন্তু দেশে এমন বিধান নেই, দেহ দান করা যায় না–যদিও ‘দেহদান’ করা যায়; তারা তাই একটি ট্রাস্টিবোর্ড গঠন করতে চান, যার কাজ হবে মৃত্যুর সাথে সাথে তাদের দেহগুলো ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়া, যাতে শল্যরা ঠিক সময়ে খুলে নিতে পারেন তাঁদের প্রত্যঙ্গগুলো। আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো দেয়ার জন্যে তাঁরা চাপ দিচ্ছেন না, তারা আমাকে চাচ্ছেন ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য হিশেবে, যাতে আমি–আশা করা যাচ্ছে আমার প্রত্যঙ্গগুলো তাদেরগুলোর থেকে পনেরো বছর বেশি টিকবো, আমারগুলো পনেরো বছর পর কাজ শুরু করেছে–তাঁদের দেহগুলো ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারি। এখানেই তাদের সাথে আমার মিলছে না; ঠিক জায়গা কোনটি তা ঠিক করে উঠতে পারছি না আমরা। তারা বলছেন ঠিক জায়গা হচ্ছে সে-প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা তাদের চোখ, অস্থি, বৃক্ক খুলে নেবে; তারপর মানুষের কল্যাণে লাগাবে; আর আমি বলছি ওগুলো ঠিক জায়গা নয়, আমার কাছে ওগুলো ঠিক জায়গা মনে হয় না।
আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আমার মৃত্যুর পর মানুষের কল্যাণে লাগবে-শুনে আমার দীর্ঘ নিঃশব্দ হাসি পায়। কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ, কল্যাণ; ঘেন্না ধরে গেছে আমার কল্যাণের নির্ঘুম সংরক্ত রুগ্ন উন্মাদনায়। আমার প্রত্যঙ্গগুলোর জন্যে আমার মায়া হয়; ওগুলোকে আরো খাটতে হবে; গিয়ে লাগতে হবে কারো চোখের কোটরে, বৃক্কের শূন্যস্থানে; উপস্থিত থাকতে হবে শ্রেণীকক্ষে; মানুষের অনন্ত কল্যাণের জন্যে সক্রিয় হয়ে থাকতে হবে ওগুলোকে। কেনো? কী অপরাধ করেছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো? আমার প্রত্যঙ্গগুলো কোনো অবান্তর ঐশ্বরিক শ্লোকের জন্যে হাহাকার করছে না, কোনো শ্লোকই ওগুলোর দরকার নেই; আমার মনে হয় ওগুলো নিষ্ক্রিয়তা। চায়, নামপরিচয়হীন হয়ে যেতে চায়। আমার প্রত্যঙ্গগুলো কোনো খালের বা নদীর ঘোলাটে জলে পড়ে আছে, ওগুলোর কোনো কাজ নেই, ওগুলোর দিকে কারো দৃষ্টি নেই, বা ওগুলো পড়ে আছে পতূপ আবর্জনার নিচে, মলের স্রোতের নিচে, ওগুলো। কোনো কাজ করছে না, কোনো কল্যাণ করছে না, এমন ভাবতে আমার ভালো লাগে। কাজকাম করে ক্লান্ত হয়ে গেছে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো, ওগুলো ভুলে যেতে চায় জীবন আর কল্যাণ, জীবন আর কল্যাণও ওগুলোকে ভুলে যাক। যার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, যার মণিতে কোনো আলো ঢোকে না, সে শিখুক না একটু অন্ধত্বকে মেনে নিতে। যার বৃক্ক নষ্ট, সে একটু ভালোবাসুক না তার নষ্ট বৃক্ককে। কেনো শুধু বেঁচে থাকতে হবে? বেঁচে থাকাকে পেশা করে তুলতে হবে?
আমার চোখ দুটি যদি অন্ধকার হয়ে যায়, পচে যায় যদি আমার বৃক্ক? নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে চায় যদি আমার হৃৎপিণ্ড? আমি অন্য কারো চোখ ধার করবো? ডলির বৃক্ক নিয়ে বেঁচে থাকবো? ডলি কি আমাকে দেবে তার বৃক্ক? আমার কোনো ইচ্ছে নেই, আমি ওভাবে বেঁচে থাকতে চাই না। আমাকে কোনো খালে ফেলে দেয়া হোক, বা কোনো নদীতে ফেলে দেয়া হোক কোনো জঙ্গলে, যেখানে জলে আর বৃষ্টিতে পচবো আমি; ওগুলো পড়ে থাকুক আবর্জনা আর মলস্রোতের নিচে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক; আমি চাই না। আজ থেকে দশ হাজার বছর পর কেউ খুঁজে পাক আমার অস্থি। আমি সম্পূর্ণরূপে মিশে যেতে চাই, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে চাই। মিশে যাওয়া, গলে যাওয়া, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। আমার ভালো লাগে। ছোটোবেলায় একটি ঝামাপাথর কোথায় যেনো পেয়েছিলাম; সেটি দিয়ে আমি আমার পায়ের গোড়ালি ঘষতাম। কে যেন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিলো ঝামাপাথর দিয়ে গোড়ালি ঘষলে গোড়ালি সুন্দর দেখায়, পেছন দিক থেকে দেখতে ধবধবে চাঁদের মতো লাগে; আমি গোশলের সময় পায়ের গোড়ালি ঘষতাম। পাথরটি দিয়ে; এবং একদিন দেখি যে ওই শক্ত পাথরটি অনেকখানি ক্ষয় হয়ে গেছে; মসৃণ হাড়ের মতো লাগছে ওটিকে। যেদিন পাথরটি সম্পূর্ণ ক্ষয় হয়ে যায়, সেদিন ওটিকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। ধীরেধীরে ক্ষয় হয়ে যাওয়া আমি অনেক দেখেছি, যা কিছু ক্ষয় হয়েছে সে-সবকেই আমি গোপনে ভালোবেসে ফেলেছি। ক্ষয় হয়ে যাওয়া আমার প্রতিটি পেন্সিলকে আমি আজো ভালোবাসি, ইরেজারকে আজো ভালোবাসি, মোমকে ভালোবাসি; এবং চোখ বুজেই দেখতে পাই। যা কিছু ক্ষয় হয় না, তার জন্যে আমার কোনো মায়া হয় নি; সেগুলোকে মাঝেমাঝেই আমি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, এবং ভুলে গেছি। আমার একটি সুন্দর পেপারওয়েট ছিলো, সেটি কখনো ক্ষয় হয় নি; আমি মনে মনে চাইতাম পেপারওয়েটটি ক্ষয় হয়ে যাক, কিন্তু সেটির ক্ষয় হয়ে যাওয়ার শক্তি ছিলো না; আমি একদিন সেটিকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। আমিও ক্ষয় হয়ে যেতে চাই; অবিনশ্বর হতে চাই না।
দুপুরে বাসায় ফিরে বারান্দায় হেমন্তের রোদ দেখে আমার ঘুম পায়; আমি চাদর বিছিয়ে বারান্দায়, রোদে, শুয়ে পড়ি, এবং ঘুমিয়ে পড়ি। আগে আমি রোদে আর মেঝের ওপর এমনভাবে ঘুমোই নি, এতো সুখও পাই নি। ঘুম ভেঙে আমি কাজের লোকটিকে ডাকি–তার নাম আমি মনে রাখতে পারি না, একেকবার একেক নামে ডাকি, সব। নামেই সে সাড়া দেয়, এটা আমার সুখের মতো লাগে; সে প্রথমেই জানায় তিনজন অধস্তন আমার জন্যে দু-ঘণ্টা ধরে বসে আছে। আমি তাদের বারান্দায় নিয়ে আসতে বলি; তারা এমনভাবে আসে যেনো শোকে ভেঙে পড়েছে, আর কষ্টে কাতর হয়ে আছে; তাদের নিজেদের কষ্টে নয়, আমার জন্যে কষ্টে-পরের জন্যে কষ্ট বোধ করতে হচ্ছে। বলেই তাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। আমি মেঝের ওপর তাদের বসতে বলি; তারা খুব বিস্মিত হয়; এবং আমি যে মেঝের ওপর হেমন্তের রোদে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তাদের কাছে এটা আপত্তিকর মনে হয়, তাদের চোখমুখ দেখে আমি তা বুঝতে পারি। হয়তো তারা ঘুমন্ত অবস্থায় একবার উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে গেছে; মেঝে শুয়ে থাকা আমাদের পেশাসম্মত হচ্ছে না বলে তাদের মনে আপত্তি জেগেছে, তাদের বুক কষ্টে ভরে গেছে। তারা আমার সামনে মেঝের ওপর শোকগ্রস্ত মানুষের মতো বসে।
আমি বলি, আপনাদের কোনো আত্মীয়স্বজন কি মারা গেছেন?
তারা একসাথে বলে, না, স্যার, না, স্যার।
আমি বলি, আপনাদের তাহলে এমন শোকগ্রস্ত মনে হচ্ছে কেনো?
তারা বলে, স্যার, আপনাকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে আমাদের খুব কষ্ট লেগেছে।
আমি জানতে চাই, কেনো?
তারা বলে, স্যার, আপনি মেঝের ওপর ঘুমোবেন, আমরা কখনো ভাবতে পারি নি।
একজন বলে, স্যার, আমাদের মনে হচ্ছে আপনি ভালো নেই।
আরেকজন বলে, ভাবীর অভাবে আপনি হয়তো ভালো নেই।
আমি বলি, আমি খুব ভালো আছি, ভালো আছি বলেই মেঝেতে ঘুমিয়েছি।
একজন বলে, আপনার মতো মানুষ মেঝের ওপর ঘুমোচ্ছ, আমরা ভাবতে পারি না; আপনার মতো মানুষ ভালো থাকলে কখনো মেঝের ওপর ঘুমোয় না।
আমি বলি, মানুষকে কেনো সব সময় ভালো থাকতে হবে?
তারা বিব্রত হয়, এবং বলে, মানুষকে ভালো রাখার জন্যেই তো রাষ্ট্র, সমাজ, সভ্যতা; আমরা তারই জন্যে কাজ করছি।
আমি বলি, আসলে আপনারা ভালো নেই।
তারা বলে, কেনো স্যার?
আমি বলি, আপনারা ভালো নেই বলে মেঝেতে ঘুমোনোর সুখ বুঝতে পারছেন না।
তারা খুব অবাক হয়।
আমি বলি, আপনাদের আমি একটি অনুরোধ করতে চাই।
তারা বলে, অনুরোধ কেনো স্যার, আদেশ করুন, স্যার।
আমি বলি, আমি ভালো আছি, নিঃসঙ্গতার সুখের মধ্যে আছি, আপনারা এসে আমাকে বিরক্ত না করলে আমি খুশি হবো।
তারা ভয় পায়, বলে, জি, স্যার, জি, স্যার।
আমি একলা থাকার সুখের মধ্যে আছি-অবশ্য ধ্যানট্যান করছি না, কোনো বটগাছের নিচে বা গুহার ভেতরে কোনো সত্য লাভের কোনো বাসনাই আমার নেই, আমি শুধু একলা থাকার সুখে আছি; অফিসে গিয়েই আমার ইচ্ছে করে বাসায় ফিরে যেতে, একলা থাকার মধ্যে ফিরে যেতে। আমার বাসা কখনো খুব কোলাহলমুখর ছিলো না, এখন সম্পূর্ণ নিঃশব্দ হয়ে গেছে; বাসায় দুটি লোক থাকলেও দু-ধরনের শব্দ হয়; ভলি শব্দ একটু বেশিই করতো বলে আমার মনে হতো। ডলির বিচিত্র রকম স্যান্ডলের শব্দ উচ্চই ছিলো, টেলিফোনেও সে উচ্চস্বরেই কথা বলতো;–এখন ওগুলো নেই, আমি বাড়িটিতে সম্পূর্ণ নিঃশব্দতা অনুভব করতে পারছি। আমার কাজের লোকটি, কী যেনো ওর নাম, দেয়ালের পাশে একটি ছোটো ঘরে থাকে; ওকে দরকার হলে আমি একটি কলিংবেল বাজাই; ও বুঝে গেছে আমি নিঃশব্দতা চাই, তাই নিঃশব্দেই আসে, আর নিঃশব্দেই কথা বলে। ওকে আমার চড়ুইটির থেকেও ভালো লাগে; চড়ুইটিও মাঝেমাঝে চিৎকার করে আমাকে রাগিয়ে দেয়। আমি কি ওই লোকটি হতে পারতাম না, আর ওই লোকটি কি আমি হতে পারতো না? কারো আদেশ শুনে খুব বিনীত হয়ে কাজ করতে কেমন লাগে? আমি যখন কলিংবেল বাজাই, তখন তার কি নিজের কোনো কাজ থাকে না? থাকলে তা ফেলে সে এতো তাড়াতাড়ি কী করে আসে? ওই লোকটিকে দেখে কি কখনো কেউ ভয় পায়? কেউ কি তার আদেশ শুনে পালনের জন্যে ভীত হয়ে ওঠে? ওই লোকটির কি নিজের কাজ করানোর জন্যে অন্য কাউকে আদেশ দিতে ইচ্ছে করে না? মিসেস হামিদউল্লাহ প্রত্যেক দিন ফোন করছেন; মোহাম্মদ হামিদউল্লাহ শহীদ হওয়ার পর দেবরকে বিয়ে করেছিলেন বা দেবরই তাকে বিয়ে করেছিলো;–স্বামীভাগ্যটা তার ভালো নয়, দেবরটিও দুর্ঘটনায় চলে গেছে। তাকে দেখে মনেই হয় না তিনি দুটি স্বামী দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। তিনি জানতে পেরেছেন আমি একলা একলা থেকে থেকে তিনি একলা মানুষের দুঃখগুলো বুঝতে পেরেছেন বলে মনে করছেন। তাঁর ফোন পেতে আমার খারাপ লাগছে না–তাঁর কণ্ঠস্বরটি কোমল শান্ত বলেই হয়তো, আর তিনি জানিয়েছেন ঘুমোনোর আগেই আমাকে ফোন করতে তাঁর ভালো লাগে। আমারও অনেকটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে তার ফোন পেয়ে ঘুমোনোর; কিন্তু আমি তাকে নিয়ে কোনো কিছু ভাবছি না। তার কণ্ঠস্বরটি এমন যে তা আমাকে কিছু ভাবাচ্ছে না, ঘুম পাড়াচ্ছে।
আমি কেনো শুধু আমাকেই দেখতে পাচ্ছি? এই-আমাকে নয়, ছোটো আমাকে। বারবার কেনো মনে হচ্ছে ছোটো আমিই আমি, এই-আমি আমি নই? আমি ছোটো আমাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, এতে আমার কষ্ট লাগছে; হঠাৎ সে ঝিলিক দিয়ে উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে; আমি তাকে পরিপূর্ণ দেখতে চাচ্ছি, কিন্তু তার একপাশ দেখছি, তার এক মুহূর্ত দেখছি; সে মিলিয়ে যাচ্ছে, আমার কষ্ট লাগছে। দেখছি সে শাওয়ারের নিচে নগ্ন দাঁড়িয়ে আছে, ঝরনা খুলে দিয়েছে, শাওয়ারের নিচে সে লাফাচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে পানি ছিটিয়ে দেয়াল ভিজিয়ে ফেলছে, সব কিছু ভিজিয়ে ফেলতে তার সুখ লাগছে। সাবান মাখতে গিয়ে তার হাত থেকে সাবান পিছলে পড়ছে; সাবান ক্ষয় হচ্ছে দেখে তার সুখ লাগছে। তার মাথায় শাওয়ার থেকে বৃষ্টি পড়ছে, সে চোখ বুজে লাফাচ্ছে। হঠাৎ দরোজা ঠেলে স্নানাগারে মা ঢুকছে, আর সে দু-হাত দিয়ে তার সোনা ঢেকে বসে পড়ছে; ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেছে, মাকেও সে তার লজ্জা দেখতে দেবে না। মা তাকে দেখে খিলখিল করে হাসছে। শাওয়ারের নিচে লজ্জা পেয়ে নগ্ন বসে পড়া আমিটিকেই আমি বেশি দেখি। আমি কি ওই আমিটি হয়ে থাকতে চেয়েছিলাম? এখন যদি আমি ওই আমিটি হয়ে যাই, আমি কি সহ্য করতে পারবো? আমি তার সব কিছু দেখতে চাচ্ছি, সব কিছু মনে করতে চাচ্ছি; কিন্তু পারছি না। হঠাৎ একটুকু রক্ত চোখে পড়ছে। ব্লেড দিয়ে পেন্সিল কাটছে সে, মা তাকে বারবার নিষেধ করেছে, তবুও সে কাটছে; হঠাৎ আঙুলে ব্লেড লেগে গেছে; সে আঙুল চেপে ধরে রক্ত থামাতে পারছে না, চুষতে শুরু করেছে। তার জিভে রক্তের স্বাদ বিচ্ছিরি লাগছে, রক্তের সাথে সে লড়াই করছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। তাকে দেখতে আমার সুখ লাগছে;–এখন যদি আমি তাজমহল বা হিমালয় বা নায়াগ্রা বা কোনো নীল লেগুন দেখতাম, বা ঈশ্বর আমার সামনে দেখা। দিতো, তাহলেও এতোটা সুখ লাগতো না। কিন্তু আমি তাকে সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছি না, যদিও সম্পূর্ণ দেখতে চাচ্ছি; আমি তার প্রত্যেকটি দিন আর প্রত্যেকটি মুহূর্তকে দেখতে চাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি না; সব কিছু অন্ধকারে ঢেকে গেছে। আমার স্মৃতি কেনো এতো কম? সে কি কখনো জোনাকি দেখেছিলো? কখনো দেখেছিলো দিগন্তের এপার থেকে ওপার ছড়ানো সরষে ফুলের প্রচণ্ড হলুদ পেয়েছিলো তার সুগন্ধ? না, চোখ বুজে আমি কোনো জোনাকি দেখি না, হলুদ দেখি না; কোনো সুগন্ধ পাই না।
ডলি ফোন করেছে। আমি ভয়ে ছিলাম ডলি ফোন করবে, কিন্তু যাওয়ার এক মাসের মধ্যে ফোন করে নি বলে আমার ভয় কিছুটা কেটে গিয়েছিলো; সে ফোন করে আমাকে ভীত করে তুলেছে। আমি ভয়ই পাচ্ছি; তার ফোন পেতে আমার ভয় লাগছে। ডলি দেখতে কেমন? আমি মনে করতে পারছি না। ডলি আমার স্ত্রী ছিলো? তার আগে দেলোয়ারের স্ত্রী ছিলো? ডলি চমৎকার মেয়ে ছিলো? কিন্তু তার ফোন পেতে আমার ভয় লাগছিলো। সে ফোন না করলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকতাম, আমাকে ভুলে গেলেই আমার ভালো লাগতো।
ডলি বলছে, ভেবেছিলাম তুমি ফোন করবে, এক মাসেও তুমি আমাকে ফোন করতে পারলে না?
আমি বলি, ফোন করতে আমার ইচ্ছে করে নি।
ডলি বলছে, আমাকে ফোন করতে তোমার ইচ্ছে করবে কেনো, আমি তো তোমার শত্রু।
আমি বলি, শত্রু বলে নয়, কাউকেই আমার ফোন করতে ইচ্ছে করে না।
ডলি বলছে, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছে।
আমি বলি, আমাকে ক্ষমা কোরো।
ডলি বলছে, তোমার এইসব মহত্ত্ব রাখো, তোমাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না।
আমি বলি, তুমি নিশ্চয়ই এখন ভালো আছো।
ডলি বলছে, তা তোমার জানার দরকার নেই, জেনে রাখো তোমাকে আমি রেহাই দেবো না।
ডলি ফোন রেখে দেয়। এই ভোরবেলা ডলির আক্রমণে আমার খারাপ লাগে না; আমি বারান্দায় হেঁটে হেঁটে গালে শেভার চালাতে থাকি। ডলি নিশ্চয়ই ভাবছে তার কথা শুনে আমি বিষে ভরে গেছি, আমার রক্তে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে; যদি জানতে পারে আমার খারাপ লাগে নি, ডলি খুব রেগে উঠবে। এখন ডলির ওখানে গভীর রাত, ডলি ঘুমোয় নি কেন? ডলি কি ঘুমোত পারছে না? কোনো উৎসব থেকে ফিরে তার ইচ্ছে হয়েছে আক্রমণের; এবং আক্রমণ করে সুখে ঘুমোতে যাবে? শেভারের শব্দ আমার ভালো লাগছে, এক ধরনের নিঃশব্দতার শব্দ ওঠে শেভারটি থেকে, আমার ভালো লাগছে। দূরে আমগাছের পাতায় রোদ ঝিকঝিক করছে, আমার মুঠোতে শেভার থেকে কিছুটা কালোর সাথে মেশানো শাদা ঝরে পড়লো, দেখে আমার ভালো লাগলো। কোনো কিছুই আমার আজকাল খারাপ লাগছে না? কিছুই কি আমাকে উত্তেজিত করতে পারছে না? একটি বালক-মন্ত্রী আমার ওপর চেপে আছে, আমার রক্তে জ্বালা ধরার কথা ছিলো, কিন্তু আমার জ্বালা ধরছে না। একটি পাতা ঝরে পড়লো দেখে আমার ভালো লাগলো।
সবাই, আমার কাজের লোকটি পর্যন্ত, ভাবছে আমি কষ্টে আছি, গোপনে একটু করুণাও করছে; আমি কষ্টে নেই;–এবং আমি যে কষ্টে নেই এটা যে কাউকে আমার জানাতে ইচ্ছে করছে না, এতেও আমার সুখ লাগছে। অনেক দিন ধরেই সিগারেট ছেড়ে দেবো ভাবছিলাম, এখন ছেড়ে দেয়ার কথা মনে হচ্ছে না; সিগারেট হাতে নিয়ে খেলতে ইচ্ছে করছে, আগুন না ধরিয়ে তামাকের গন্ধ নিতে, নাকের সামনে ধরে রাখতে, আশ্চর্য সুখ পাচ্ছি। গরম পানিতে হুইস্কি খেতে ভালো লাগছে। আমি কখনো রান্নাঘরে আগে যাই নি, চুলো কখনো ধরাই নি; আজকাল গরম পানির দরকার হলে আমিই চুলো ধরাই, ধরাতে আমার ভালো লাগে। চুলো ধরাতে ধরাতে মনে হয় আমি কখনো কাদামাটিতে লাঙ্গল চালাই নি; লাঙ্গল চালাতেও আমার ভালো লাগবে। পানি গরম করে আমি গ্লাশে ঢালি, গ্লাশটি গোপনে ঝিলিক দিয়ে গরম হয়ে ওঠে, গরম আমার আঙুলের ভেতর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ে; আমি গ্লাশের শূন্যতাটুকু হুইস্কি দিয়ে পূরণ করি, এবং চুমুক দিতে থাকি। আমার সুখ লাগে। আমার মনে পড়ে আমি গ্রামে কখনো ঘুমোই নি, কখনো টিনের ঘরে ঘুমোই নি; পুকুরে কখনো সাঁতার কাটি নি, আমি সাঁতার কাটতেই জানি না; একবার শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখন আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, সে-সাঁতার আমি মনে রাখতে পারি নি। আমি যে-বালকটিকে শাওয়ারের নিচে ন্যাংটো দেখতে পাই, সে কি ন্যাংটো সঁতার কাটতে পারতো না। কোনো পুকুরে? যখন জোয়ার আসতো, যখন পানিতে টান ধরতো? লাফিয়ে পড়তে পারতো না পুকুরের পাড় থেকে টলটলে জলে? সাঁতার কাটতে কাটতে শাপলা তুলতে পারতো না কোনো বিলে? আচ্ছা, শাপলা দেখতে ঠিক কেমন? আমার শাপলা দেখতে ইচ্ছে করছে।
অনেক দিন ধরে আমি কোনো নারীশরীরের সঙ্গে মিলিত হই নি। হুইস্কি খেতে খেতে নারীশরীরের কথাও মনে পড়ছে; আমি উত্তেজিত বোধ করছি না, অভাব বোধ করছি না, কাম বোধ করছি না। কামকে আমি ঘেন্না করি না, কখনোই করবো না; কামকে আমার মানুষের শ্রেষ্ঠ আর নিকৃষ্ট অভিজ্ঞতা মনে হয়, আমি সেই শ্রেষ্ঠ আর নিকৃষ্টকে বোধ করছি না। ডলিকে আমার মনে পড়ছে না, মিসেস হামিদউল্লাহকে মনে পড়ছে না, সুজাতাকে মনে পড়ছে না, রেহনুমাকে মনে পড়ছে না, দিলশাদকে মনে পড়ছে না; আমার মনে পড়ছে অঘ্রানের নদীপারের কাশগুচ্ছকে। এ-কাশগুচ্ছ যদি আমি ছেলেবেলায় দেখতাম, হয়তো আমার জীবনটিই বদলে যেতো, আমি অন্য কেউ হয়ে উঠতাম; সেই আমাকে আমার অনেক বেশি ভালো লাগতো। এক অঘ্রানে আমাকে এক নদীপারে যেতে হয়েছিলো, নদীটি দেখার আগে আমি নদীপারের শাদা, নিরাসক্ত, নৈর্ব্যক্তিক কাশের মেঘ দেখে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। সব ধরনের ফুলের মধ্যেই রয়েছে আসক্তি, কামনা, ইন্দ্রিয়ভারাতুরতা-গোলাপ দগদগ করে কামনায়, শিউলি ঝরে পড়ে ক্লান্তিতে; একমাত্র কাশফুলই নিরাসক্ত, নৈর্ব্যক্তিক, নিরিন্দ্রিয়, নিষ্কাম। ওই মেঘ দেখামাত্রই আমার ইচ্ছে হয়েছিলো হেঁটে হেঁটে দূর থেকে আরো দূরে চলে যেতে। সে-কাশগুচ্ছকে আমার মনে পড়ছে; ডলিকে মনে পড়ছে না, মিসেস হামিদউল্লাহকে মনে পড়ছে না, সুজাতাকে মনে পড়ছে না, রেহনুমাকে মনে পড়ছে না, দিলশাদকে মনে পড়ছে না। এই যে আমি এখন গরম পানিতে হুইস্কি খাচ্ছি, এখন যদি ডলি পাশে থাকতো, আমি কি সুখী হতাম? না। যদি মিসেস হামিদউল্লাহ থাকতেন? না। সুজাতা, দিলশাদ, রেহনুমা থাকতো? না। কাশফুল দেখতে পাচ্ছি বলে আমি সুখ পাচ্ছি।
একটি অশ্লীল বই পড়তে ইচ্ছে করছে আমার, কাশের গুচ্ছের সঙ্গে মিশিয়ে একটি অশ্লীল বই পড়তে আর অজস্র অশ্লীল ছবি দেখতে ইচ্ছে করছে, মানুষ দেখতে ইচ্ছে করছে না। অশ্লীল? কাকে বলে অশ্লীল? ধর্মসচিবের যা ভালো লাগে না? অশ্লীল? মাদ্রাসার গালভগ্নদের যা ভালো লাগে না? রবীন্দ্রনাথের কোনো অশ্লীল বই আছে? নেই? কবিতা? রবীন্দ্রনাথ কেনো কোনো ভয়ঙ্কর অশ্লীল বই লেখেন নি? ভয় করেছিলো? তার মহাপুরুষ হওয়ার সাধ ছিলো? বইগুলোর মধ্যে ভয়ঙ্কর অশ্লীল সুন্দর সেই বইটি খুঁজছি আমি, পাচ্ছি না; মেয়েটি গিয়ে শুচ্ছে তার চাকরের ঘরে, পাচ্ছি না। প্রত্যেক বড়ো লেখকের অন্তত একটি করে অশ্লীল বই লেখা উচিত, আমার মনে হচ্ছে, শ্লীলতায় বড়ো বেশি নোংরা হয়ে যাচ্ছে গ্রহ। আমি পুরোনো প্লেবয়গুলো খুঁজছি, খুলতেই একটি মেয়ের রৌদ্রভরা স্তনজোড়া দেখে আমার ভেতর ভোরের রৌদ্র ঢুকে গেলো, আমার ভালো লাগলো। আচ্ছা, আমাকেই যদি ধর্মমন্ত্রণালয়ে বদলি করে দেয়া হয়? তখন ওই বইটি আর এ-ছবিগুলো অশ্লীল হয়ে উঠবে আমার কাছে? বেশ চমৎকার সময় আসবে জীবনে, আমি দিনরাত নামাজরোজা করতে পারবো। ক-বার হজে যেতে হবে বছরে? পুণ্যে দশদিক ভরে উঠবে আমার। আমি এখনই ধর্মমন্ত্রণালয়ে বদলি হচ্ছি না; এখন আমি সেই উপন্যাসটি খুঁজতে পারি, সেই পাতাগুলো পড়তে পারি; এবং প্লেবয়ের পাতার রৌদ্রভরা স্তনজোড়া দেখতে পারি। ওই কাশের গুচ্ছ আর এই রৌদ্রভরা স্তনযুগল আর সেই অশ্লীল বইটি আমাকে সমানভাবে টানছে, কোনোটিকেই আমার পবিত্র-অপবিত্র মনে হচ্ছে না, কোনোটিকেই শ্লীল-অশ্লীল মনে হচ্ছে না; প্রত্যেকটিই আমাকে মুগ্ধ করছে, আমার ভেতরটাকে ভ’রে তুলছে। নদীপারে কাশফুল দেখে হেঁটে হেঁটে আমার খুব দূরে চলে যেতে ইচ্ছে করেছিলো, কিন্তু আমি দূরে যাই নি; আর এই রোদভরা স্তনজোড়া দেখেও মাথা ঘুরছে না; আমার ভেতরটা সুখী হচ্ছে।
ডলি টেলিফোন করেছে; সে প্রথমেই বলে, তোমাকে না কি বরখাস্ত করা হচ্ছে?
আমি বলি, তুমি কোথায় শুনলে?
ডলি বলে, দূরে থাকতে পারি, কিন্তু তোমার সব খবরই আমি রাখি।
আমি বলি, আমাকে বরখাস্ত করা হচ্ছে এমন গুজব তো আমি শুনি নি।
ডলি বলে, মন্ত্রীর সাথে তোমার হাতাহাতি হয়েছে, শুনলাম।
আমি বলি, আমি কি হাতাহাতি করার মতো লোক?
ডলি বলে, তুমি হাতাহাতি না করতে পারো, তবে তোমার যা স্বভাব তাতে অন্যরা তোমার সাথে হাতাহাতি করতে পারে।
আমি বলি, অর্থাৎ দোষটা আমারই?
ডলি বলে, হ্যাঁ।
আমি বলি, তবে আমার সাথে কারো হাতাহাতি হয় নি, মন্ত্রীটির সাথে একটু তর্কাতর্কি হয়েছে।
ডলি বলে, নিজে তো মন্ত্রী হতে পারবে না, তাই মন্ত্রীদের সাথে তো তর্কাতর্কি করবেই; চাকর হয়ে মনিবের সাথে তর্কাতর্কি করা ঠিক না। এই যে এখন বরখাস্ত হতে যাচ্ছো।
আমি বলি, বরখাস্ত হতে আমার আপত্তি নেই।
ডলি বলে, তোমার তো কিছুতেই আপত্তি নেই, এই যে আমি ছ-মাস ধরে বিদেশে পড়ে আছি, তাতেও তো তোমার আপত্তি নেই।
আমি বলি, না, আমার কোনো আপত্তি নেই।
ডলি বলে, তুমি আমাকে নিজের বউ বলেই কোনোদিন মনে করো নি, আজকাল আমি বুঝতে পারছি।
আমি বলি, তুমি কি ফিরতে চাও?
ডলি বলে, তোমার কথা মনে হলে আমার আর ফিরতে ইচ্ছে করে না।
আমি বলি, তাহলে ওখানেই থাকো।
ডলি বলে, আমি কোথায় থাকবো, তা তোমাকে বলে দিতে হবে না।
আমি বলি, কেনো টেলিফোন করো?
ডলি বলে, আমি তোমাকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব, তুমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছে।
আমি বলি, জীবন নিয়ে তুমি বড়ো বেশি ভাবো।
ডলি বলে, ভাববো না? তোমার জন্যেই আমি একা। আমার কোনো সংসার হলো না। একটা ছেলে বা মেয়ে থাকলেও আমার এমন কষ্ট হতো না।
আমি বলি, ছেলেমেয়ের জন্যে আমার তো কষ্ট হয় না।
ডলি বলে, তুমি তো অমানুষ।
আমি কি সত্যিই বরখাস্ত হতে যাচ্ছি? ডলির কাছে এ-সংবাদ পৌঁছে গেছে, অথচ আমি কিছু জানি না,-তার নিশ্চয়ই কোনো একান্ত সংবাদদাতা রয়েছে। বালক-মন্ত্রীটিকে আমি স্যারই বলে আসছিলাম, যদিও নিজের নামের বানানটিও সে সব সময় ঠিকমতো লিখতে পারে না; আমি আমার পেশার রীতি অনুসারে তাকে যথারীতি মান্যগণ্যই করে আসছিলাম; কিন্তু তাকে আমি একবারে একশো কোটি টাকা কী করে বানাতে দিই? আমি কী করে ওই আদেশে সই করি? আমি তাকে পাঁচ কোটি বানাতে বলেছিলাম; জানিয়েছিলাম সুযোগ সব সময়ই আসবে, তখন আরো বানাতে পারবেন, কিন্তু তার এখনই একশো কোটি দরকার, আমি তাতে রাজি হই নি। আমিও দশ কোটি পেতাম, আমার অতো দরকার নেই। আমি যে কিছু বানাই নি, বানাই না, তা নয়; মাঝেমাঝে বানাতে আমার ভালো লাগে, বানানোর জন্যেই বানাতে আমার ভালো লাগে। বেলার নামে আমি ওই হিশেবগুলো খুলেছি, বেলাকে এখনো বলি নি। বালক-মন্ত্রীটি লাল টেলিফোনে কয়েকবারই আমাকে আদেশ দিয়েছিলো, আমি রাজি হই নি বলে তার বাহিনী নিয়ে আমার ঘরে হামলাই করতে এসেছিলো; শালার আমলা, তোকে দেখিয়ে দেবো বলে চিৎকারও করছিলো, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম আমার দিকে তাকিয়ে সে ভয়ও পাচ্ছিলো; আমি শুধু তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলাম একজন মন্ত্রীর জন্যে ওই আচরণ শোভন নয়। আমাকে সে বরখাস্ত করাতে পারবে? করানোর চেষ্টা করছে? আমার অবশ্য আপত্তি নেই; আমার নিজেরই বছরখানেক ধরে মনে হচ্ছে চাকুরিটা ছেড়ে দিই। তবে এখন আমি ছাড়বো না, এবং আমি দেখবো–একশো কেনো পাঁচ কোটিও সে কীভাবে বানায়।
প্রভুর একাদশতমা উপপত্নীটিকে আমার মনে পড়ে। আমারই উপপত্নী সে হতে পারতো, যদি আমি চাইতাম, যদি একটি উপপত্নীর আমার দরকার পড়তো; সে শক্তিমান কারো উপপত্নী হওয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছিলো, আমিই তাকে, জেনারেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। এখন সে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বিদেশি ব্যাংকে কয়েক মিলিয়ন ডলারও জমিয়েছে, আমি সে-সংবাদ রাখি; সে-ই আমাকে মাঝেমাঝে জানিয়ে রাখে। তাকে আমার ভালো লাগে, কেননা সে উপপত্নীত্বকে একটি খেলা হিশেবে নিয়েছে, পেশা হিশেবে নেয় নি। তাকে আমার দরকার, তাকে আমি টেলিফোন করি।
আমি বলি, ম্যাডাম, আপনার সাথে একটু দেখা করতে চাই, যদি আপনার সময় হয়।
একাদশতমা বলে, আনিস? অনেক দিন আমার খবর নাও নি, এখন নিলে তাতে সুখ পাচ্ছি।
একাদশতমা আমার থেকে অন্তত বিশ বছরের ছোটো। যে-দিন প্রথম দেখা করতে এসেছিলো, তার পা কাঁপছিলো, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলো না; ‘স্যার, স্যার’ করে নিচে পড়ে যাচ্ছিলো, এখন সে আমাকে অবলীলায় নাম ধরে ডাকে, আমার খারাপ লাগে না; আমি কোনো অবস্থানকেই ধ্রুব মনে করি না। আমার সাথে তার সম্পর্কটিকে মধুর বলেই আমার মনে হয়; আমি তাকে পছন্দই করি, সেও আমাকে।
একাদশতমা আরো বলে, তোমার কথা মাঝেমাঝে আমার মনে পড়ে।
আমি বলি, ম্যাডাম, কেনো আমার কথা মনে পড়ে জানালে ধন্য হতাম।
একাদশতমা বলে, তোমাকে আমি পছন্দ করি।
আমি বলি, তা আমার পরম সৌভাগ্য।
একাদশতমা বলে, আমি তোমারই হতে পারতাম।
আমি বলি, তাহলে ওই মিলিয়নগুলো জমতো না, ম্যাডাম।
একাদশতমা হাসে, হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে বলে, কিন্তু পেটে একটি দুটো বাচ্চা তো জমতো!
আমি বলি, পেটে বাচ্চা জমায় কী সুখ?
একাদশতমা বলে, তা আমি জানি না, তবে চারপাশে শুনি বাচ্চা জমায় মারাত্মক সুখ, তাই আমিও ওই কথা ভাবি।
আমি বলি, আপনার মা বলেন?
একাদশতমা বলে, মা কেনো, জেনারেলও দিনরাত বলে।
আমি বলি, প্রভু খুব পীড়নে আছেন।
একাদশতমা বলে, সে তো সঙ্গম করে না, একটা কিছু জন্ম দেয়ার জন্যে যুদ্ধ করে, তুমি যদি দেখতে!
আমি বলি, শুনেছি আপনিই এখন তার প্রথমা?
একাদশতমা বলে, বলো, আনিস, তোমার কি চাই?
আমি বলি, একটু মুক্তি পেতে চাই।
একাদশতমা বলে, কার কবল থেকে?
আমি বলি, আমার মাথার ওপরের বালকটির থেকে।
একাদশতমা বলে, হারামজাদা তোমাকেও জ্বালাচ্ছে? আমি ওর মন্ত্রীগিরি দেখাচ্ছি।
আমি বলি, একটু তাড়াতাড়ি দেখতে চাই।
একাদশতমা বলে, শুক্রবার আসার আগেই।
বুধবার বালক-মন্ত্রীটি তার গ্রামে ফিরে যায়, যাওয়ার আগে ‘শালার আমলা, তোরে দেইখ্যা লমু’ বলে সে আমার সাথে একবার টেলিফোনে যোগাযোগ করে। আমি একাদশতমাকে ধন্যবাদ জানাই।
আমি বলি, আপনার পদতল চুম্বন করে আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
একাদশতমা বলে, পদতল কেনো তুমি ওই চুম্বন করতে পারতে, আনিস।
আমি বলি, যেখানে প্রভু স্পর্শ করেন, সেখানে দাসের স্পর্শের স্পর্ধা কখনো হবে না।
একাদশতমা বলে, আনিস, তুমি উত্তম আমলা।
আমি বলি, আপনার কৃপা যেনো চিরকাল পাই।
দেখতে পাই আমার মর্যাদা বেশ বেড়ে গেছে; আমার অধীন আর পরিচিতরা আমার দিকে এমনভাবে তাকায় যেনো তারা কোনো শক্তিমানকে দেখছে; হঠাৎ তাদের চোখে আমি শক্তিমান হয়ে উঠেছি। বালকটি যে গ্রামে ফিরে গেছে, এর পেছনে যে আমার শক্ত হাত রয়েছে, এ-সম্পর্কে তারা নিশ্চিত; এবং আমিও অত্যন্ত বিনীতভাবে তাদের শক্তিপুজো উপভোগ করি। যে-কেরানিদের ঘরে আমি কখনো যাই নি, একবার আমি তাদের ঘরে ঢুকে পড়ি; তারা আমাকে তাদের ঘরে দেখে পাগলের মতো হয়ে ওঠে। আমি কেরানিদের সামনের একটি ভাঙা চেয়ারে বসি, তারা মূৰ্ছিত হয়ে পড়ার উপক্রম করে। আমি তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই তারা বাসায় ফিরে ছেলে, মেয়ে, পাড়াপড়শিকে ডেকে আমার কথা বলছে; বাজারে গিয়ে আমার কথা বলছে; শ্বশুরবাড়ি গিয়ে আমার কথা বলছে; আর স্ত্রীসহবাসের সময় অন্যমনস্ক হয়ে আমার কথা বলছে।
ডলি, কয়েক দিনের মধ্যেই, টেলিফোন করে প্রথমেই বলে, তোমরা আমলারা যে কী না পারো!
আমি বলি, তুমি কেমন আছো?
ডলি বলে, আমি কেমন আছি তোমার জানার দরকার নেই; আমি বলছিলাম তোমরা আমলারা যে কী না পারো! ওইটাকে তুমি শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত করিয়ে ছাড়লে।
আমি বলি, আমি এক সামান্য চাকর, আমার কি মনিবকে বরখাস্ত করানোর শক্তি আছে?
ডলি বলে, লন্ডনের সব বাঙালিই জানে তুমিই ওটাকে বরখাস্ত করিয়েছে।
আমি বলি, আমার ওপর বাঙালিদের শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে না?
ডলি বলে, তাই তো মনে হয়।
আমি বলি, বাঙালিরা সব সময়ই শক্তিমান আর কল্পিত শক্তিমানদের পুজো করতে পছন্দ করে।
ডলি বলে, আমিও তোমাকে শ্রদ্ধা করছি, বরখাস্ত হলে তোমাকে ঘেন্না করতাম।
আমি বলি, খুশিও হতে।
ডলি বলে, হতাম, তবে তোমাকে এখন শ্রদ্ধা করছি; লন্ডনের বাঙালিরা আমাকেও শ্রদ্ধা করছে, কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটে আজই আমি বাঙলাদেশি কাঁথা উৎসব উদ্বোধন করেছি।
আমি বলি, আরো অনেক কিছু তুমি এখন উদ্বোধন করতে পারবে।
ডলি বলে, ওই মেলিটারি আর তাদের দালালগুলিরে এখন কেউ দেখতে পারে না। হাই কমিশনার প্রত্যেক দিন আমার খবর নেয়।
আমি বলি, আমলাদের বেশি বিশ্বাস কোরো না।
ডলি বলে, তা আমার মনে আছে, একটাকে বিশ্বাস করেই আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে।
আমি বলি, জীবন নিয়ে যারা বেশি ভাবে তাদের এমনই মনে হয়, নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ভেবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ডলি বলে, তাহলে কি মনে করবো যে আমার জীবন সোনায় রুপোয় ফলেফুলে ভরে আছে?
আমি বলি, দেলোয়ার হয়তো তোমাকে ভরে তুলতে পারতো।
ডলি বলে, দেলোয়ারের কথা তুমি কখনো বলবে না। তার কথা মনে করেই তুমি কখনো আমাকে নিজের স্ত্রী মনে করতে পারলে না। তুমি আজো আমাকে দেলোয়ারের স্ত্রী মনে করো।
ডলি ফোন রেখে দেয়; কিন্তু আমার আজ ডলির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো, আমি একবার তার নম্বরে রিং করি; সে রিসিভার তুলতেই আমি ফোন রেখে দিই, কথা বলতে ইচ্ছে করে না।