৭. মওলানা ইস্কান্দর

০৭.

মওলানা ইস্কান্দর শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার। এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে এসেছে। এই সময় বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। শরীর খারাপ থাকলে একটা কথা ছিল। তার শরীর খারাপ না। মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। এটাও বড় কিছু না। যারা পাক কোরান মজিদ মুখস্থ করার চেষ্টা করে তাদের কারো কারো মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণার মত হয়। এই যন্ত্রণা কখনো যায় না। কখনো বাড়ে কখনো কমে। এখন এই যন্ত্রণা সামান্য বেড়েছে।

মওলানা উঠে বসলেন। বারান্দায় গিয়ে অজু করলেন। এশার আজান দেয়া দরকার। অবশ্যি আজান দিয়ে লাভ নেই। আজান হচ্ছে নামাজের জন্যে আহ্বান। মসজিদই নেই, নামাজের জন্যে আসবে কে? তাছাড়া গ্রামে আজ বিরাট উৎসব। শুধু এই গ্রামের না, আশেপাশের গ্রাম থেকে লোকজন চলে এসেছে। টিপু সুলতান প্লে হবে। ভুজঙ্গ নামের একজন টিপু সুলতানের পাট করবেন। খুবই নামি লোক। তিনি না-কি মানুষকে জাদু করে ফেলেন। অভিনয় শুরু করলে মানুষ নিশ্বাস ফেলতে ভুলে যায়। দুধের শিশু মায়ের কোল থেকে টপ করে পড়ে যায়, মা বুঝতে পারে না। মা হা করে তাকিয়ে থাকে ভুজঙ্গের দিকে।

ইস্কান্দর আলি এশার নামাজে দাঁড়ালেন। রুকুতে যাবার সয় হঠাৎ তাঁর মনে হল তিনি যদি ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখতে যান তাহলে আল্লাহপাক কি তার উপর খুব নারাজ হবেন? চিন্তাটা মনে আসতেই ইস্কান্দর লজ্জা এবং দুঃখে কুঁকড়ে গেলেন। ছিঃ ছিঃ কি ভয়ংকর কথা। এরকম একটা চিন্তা নামাজে দাঁড়িয়ে তার মনে এল? নামাজে দাঁড়ানো মানে আল্লাহপাকের সামনে দাঁড়ানো। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি কি করে ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখার কথা ভাবতে পারলেন? এক বালতি টাটকা দুধে এক ফোঁটা গো-মূত্র পড়লে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। সারাজীবনের সুকর্মও এক মুহূর্তের অসৎ চিন্তায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ইস্কান্দার আলির চোখে পানি এসে গেল। তিনি নামাজ শেষ করলেন। কিছুক্ষণ বারান্দায় চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর মন বলছে আল্লাহপাক এই অপরাধের জন্যে তাঁকে ক্ষমা করবেন না। কঠিন শাস্তি দেবেন। তিনি বারান্দা ছেড়ে ঘরে ঢুকে কোরাণ শরীফ নিয়ে বসলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি কোরাণ পাঠ করবেন। রেলের উপর কোরাণ শরীফ থাকবে। কোথাও আটকে গেলে পাতা উল্টে দেখে নেবেন। তার ধারণা তিনি আটকে যাবেন। তাঁর মত নিচ প্রকৃতির মানুষকে আল্লাহপাক এত দয়া করেন না। যে দয়ার যোগ্য আল্লাহ পাক তাকেই দয়া করেন।

মওলানা ইস্কান্দার আলি কোরাণ পাঠ শুরু করলেন।

.

ছদরুল বেপারীর হঠাৎ মনে হল, কোথায় একটা সমস্যা হয়েছে। খুব ছোট্ট সমস্যা, তিলের মতই ছোট তবে এই ছোট্ট তিল তাল হয়ে উঠতে পারে। সেই সম্ভাবনা আছে। সমস্যাটা ছদরুল বেপারী ধরতে পারছেন না। কিন্তু অনুভব করতে পারছেন। কেউ তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে। সেই কেউটা কে? মানুষের ভেতর কি আরো কোন মানুষ বাস করে? যার প্রধান কাজ সতর্ক করে দেয়া? তার উচিত এই মুহূর্তে এই অঞ্চল ছেড়ে নিজের নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়া। সেটা করতেও ইচ্ছা করছে না। ভুজঙ্গ বাবুর পাট দেখে যেতে ইচ্ছা করছে। ছদরুল বেপারীর পাঞ্জাবীর পকেটে সোনার মেডেল। সোনার মেডেলটা তিনি নিজেই ভুজঙ্গ বাবুর গলায় পরিয়ে দেবেন।

রাত নটা বাজে। এগারটার আগে নাটক শুরু হবে না। এর মধ্যেই মানুষের সমুদ্র হয়ে গেছে। এখনো স্রোতের মত লোক আসছে। এই ছোট্ট গ্রামের কি এত মানুষের জায়গা দেবার মত অবস্থা আছে? বিশৃঙ্খলা শুরু হলে সামলাবার ব্যবস্থা কি আছে? অল্প কিছু মানুষের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে সেই বিশৃঙ্খলা সামলানো যায়। যেখানে অসংখ্য মানুষ সেখানে বিশৃঙ্খলা ডালপালা ছড়াতে থাকে।

ছদরুল বেপারী তার সঙ্গীদের দিকে তাকালেন। সবাই আশেপাশেই আছে। শুধু একজন নেই। তাকে স্যাকরার দোকান থেকে আরেকটা মেডেল কিনতে পাঠানো হয়েছে। সেই মেডেলটা দেয়া হবে চিতা নামের মেয়েকে। না চিতা না চিত্রা। মেডেল নিয়ে এখনো ফিরছে না। ফিরলে ভাল হত। রাতটা ভাল মনে হচ্ছে না। আজ রাতে সবারই আশেপাশে থাকা দরকার।

ছদরুল বেপারী বললেন, মাহফুজ কই। মাহফুজকে ডেকে আন। তারে দুটা কথা বলব। তারে কিছু পরামর্শ দিব। ছদরুলের এক সঙ্গি মুসলেম মিয়া কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, উনার শরীর খুবই খারাপ। বাড়িতে শুয়ে আছেন। মাথায় পানি ঢালা হইতেছে।

কস কি?

বিছানায় উঠে বসার ক্ষমতা নাই।

বিছানায় উঠে না বসলে চলবে কি ভাবে? তোমাদের মধ্যে একজন যাও। ডাক্তার নিয়ে আস। ডাক্তাররে বলবা যেভাবেই হোক সে যেন মাহফুজকে উঠে বসাবার ব্যবস্থা করে। আইজ রাইতে তাকে প্রয়োজন হবে।

ছদরুল বেপারী সিগারেট ধরালেন। মুসলেম মিয়া চলে গেল। তাঁর মন বলছে কাজটা ঠিক হয় নাই। কাজটা ভুল হয়েছে। তার দলের সবাইকে আশে পাশে থাকা দরকার। রাতটা ভাল না।

ছদরুল বেপারী ক্লাবঘর থেকে বের হলেন। এখন শুক্লপক্ষ। আকাশে চাঁদের আলো আছে। আশ্বিনমাসের চাঁদের আলোয় অস্পষ্টতা থাকে। তবে আজকের আকাশ পরিষ্কার। কুয়াশাও নেই। চাঁদের আলোয় চারদিক দেখা যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্রামে ভয়ংকর ব্যাপারগুলো অমাবশ্যাতেও হয় না, আবার পূর্ণিমাতেও হয় না। এরকম সময়ে হয়। তাঁকে প্রথমবার খুন করার চেষ্টা করা হয় আশ্বিন মাসে। চাঁদের কত তারিখ তা মনে নাই। আকাশে চাঁদ ছিল এটা মনে আছে। তার পেট থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। তিনি চিৎ হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছেন চাঁদের দিকে। তার পরিষ্কার মনে আছে। ছদরুল বেপারীর সঙ্গীরা তার পেছনে পেছনে আসছে। তারা হাঁটছে খানিকটা দূরত্ব রেখে। একজনের গায়ে চাদর। তার বগলে কালো চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগভর্তি পাঁচশ টাকার নোট। এই খবরটাও নিশ্চয়ই এরমধ্যে কেউ কেউ জেনে গেছে। টাকার জন্যেও সমস্যা হতে পারে। এতগুলো টাকা কখনোই সঙ্গে রাখা উচিত না। কিন্তু ছদরুল বেপারী বেছে বেছে অনুচিত কাজগুলোই করেন। তার ভাল লাগে।

তিনি নিজের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছেন। এই ধরণের উত্তেজনার মুখোমুখি হওয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে।

কুদ্দুস!

কুদ্দুস তাঁর দিকে দৌড়ে এল। সামান্য পথ দৌড়েই সে হাঁপাচ্ছে। এই হাঁপানোটা কি ইচ্ছাকৃত?

পান খেতে ইচ্ছা করতেছে। কাঁচা-সুপারি দিয়া পান।

 কুদ্দুস বিস্মিত হয়ে বলল, আমি যাব?

হ্যাঁ। তুমি যাবে। তোমার যেতে কোন অসুবিধা আছে?

 দুএকটা আজেবাজে লোক ঘুরাফিরা করতেছে।

হু।

কানা রফিকরে দেখলাম। চাদ্দর দিয়া শইল ঢাইক্যা আসছে। তার সাথে লোকজন আছে।

টিপু সুলতান দেখতে আসছে। আমি যদি আসতে পারি তার আসতে দোষ কি? আমরা নাটক দেখব দুই চউখে। কানা রফিক দেখব এক চউখে।

মনে হয় আপনার দিকে নজর আছে।

থাকুক নজর। তোমাকে পান আনতে বলছি তুমি পান আন।

কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে রওনা হল। পিস্তলটা তার কাছে থাকে। বড় সাহেবের উচিত তাকেই সবসময় পাশে রাখা। কিন্তু তিনি তা করেন না। যে কোন কাজে তাকে পাঠিয়ে দেন। পান আনার মত তুচ্ছ কাজে যেতে তার খুবই খারাপ লাগছে।

ছদরুল বেপারী স্কুল ঘরের দিকে রওনা হলেন। তার পেছনে এখন শুধু একজনই আছে। সে কালো চামড়ার ব্যাগ বগলে নিয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটছে। ছদরুল বেপারী হাত ইশারায় তাকে ডাকলেন। মৃদু গলায় বললেন, আমার পিছে পিছে আসার দরকার নাই তুমি ক্লাবঘরে থাক। একা একা হাঁটতে আমার ভাল লাগতাছে। মাঝেমধ্যে একা থাকা ভাল। চান্নিটাও উঠছে ভাল। বহুত দিন চান্নি দেখি না।

.

মাহফুজ ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে চিত্রার খুবই মায়া লাগছে। যদিও মায়া লাগার কিছু নেই। ছোট বাচ্চারা যখন কুণ্ডুলি পাকিয়ে ঘুমায় তখন দেখতে ভাল লাগে। ছোট বাচ্চারা ঘুমের মধ্যেই হাসে। ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট বাঁকিয়ে কান্নার ভঙ্গি করে। তাদের জন্যে মায়া হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষ ঘুমুচ্ছে তার জন্যে মায়া হবে কেন? চিত্রার হচ্ছে। শুধু যে হচ্ছে তাই না খুব বেশি হচ্ছে।

মানুষটা এতক্ষণ ছটফট করছিল। এখন সেই ছটফটানি নেই। কেমন শান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার ঘুমের মধ্যে ছোট বাচ্চাদের মত ঠোঁট বাকাচ্ছে। মানুষটা ঘামছে। তার মানে জ্বর কমে যাচ্ছে। চিত্রা নিশ্চিত, কিছুক্ষণ আরাম করে ঘুমানোর পর মানুষটা সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে বসবে। গম্ভীর গলায় বলবে- চল প্লে শুরু করা যাক। তখন আর তার আগের কথা কিছু মনে থাকবে না।

মাহফুজের ব্যাপারটা চিত্রা পুরোপুরি ধরতে পারছে না। মানুষটার মাথায় রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ এই সব ঘুরছে কেন? নিজের কোন কাজ-কর্ম নেই বলে? চিত্রার মা বলতেন– কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম নেয় ভূতের কিল খাওনের জন্যে। সারাজীবন এরা ভূতের কিল খায়। ভূতের কিল কি জিনিস? ভূতের কিল হইল দশভূতের জন্যে কাম করা। নিজের জন্যে কাঁচকলা। এরা ভূতের কাম করবে। ভূতের কিল খাইবে। এইটাই এরার কপাল।

চিত্রার ধারণা এই মানুষটাও জন্মেছে ভূতের কিল খাবার জন্যে। তার খুব কাছের কেউ নেই যে তাকে বলে দেবে ভূতের কিল খাওয়াটা এমন জরুরি কিছু না। আগে নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে তারপর ভূত- প্রেতের কিল খেতে চাইলে খাওয়া।

এই মানুষটার নিজের মনে হচ্ছে কিছুই নেই। ঘর-বাড়ির খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তার নিজের ধানী জমির সবটাই সে স্কুল ফান্ডে দিয়েছে। তার যুক্তি আমি নিজে যদি না দেই, অন্যরা আমারে দিব কেন? ভূতের কিল খাওয়ার জন্যে যাদের জন্য তাদের জন্যে এই যুক্তি খুবই ভাল। কিন্তু চিত্রার কাছে এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য না। চিত্রা ঠিক করেছে চলে যাবার আগে সে মানুষটাকে কয়েকটা জরুরি কথা বলে যাবে।

এক. আপনি একটা বিয়ে করুন। এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করুন যে আপনাকে দেখবে এবং আপনি দেখবেন আপনার গ্রাম, রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ।

দুই. আপনি আপনার অসুখটার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। আপনি যেমন রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছেন– আপনার অসুখটাও আপনার মাথার ভেতর বসে রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ বানাচ্ছে।

তিন. আমি অভিনেত্রী মানুষ তো। অভিনয় করে নানান সময়ে নানান কথা বলি। আপনি যেমন সবসময় সত্যি কথা বলেন আমিও তেমন সবসময় মিথ্যা কথা বলি। সত্যি কথা বলে বলে আপনার হয়ে গেছে। অভ্যাস তেমনি মিথ্যা কথা বলে বলে আমার হয়ে গেছে অভ্যাস। আপনাকে বলেছিলাম না ছদরুল বেপারীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি নাটকের পর তার সঙ্গে চলে যাব। দশ হাজার টাকা পাব। কথাটা মিথ্যা। কেন বলেছি জানেন? আমার কথাটা শুনে আপনি মনে কষ্ট পান কি-না দেখার জন্যে। আমি জানতাম আপনি কষ্ট পাবেন। কিন্তু এতটা কষ্ট পাবেন ভাবি নি।

চার. আমি তো আগেই বলেছি আমি মিথ্যা কথা বলি। এবং সুযোগ পেলেই একটু অভিনয় করে ফেলি। বলেছিলাম না আমার পায়ে কাঁটা ফুটেছে? আসলে মিথ্যা। আমি কাঁটা ফুটার অভিনয় করেছি। তবে অভিনয়টা জোরাল করার জন্যে সেফটিপিন দিয়ে খোঁচাখুচি করাটা খুব ভুল। তখন সত্যিকারই ব্যথা পেয়েছি। এটা করা ঠিক হয় নি। কাটার ফুটার অভিনয় কেন করলাম? আপনি বুদ্ধিমান হলে নিজেই বুঝতেন কেন করেছি। যেহেতু আপনি বুদ্ধিমান না, আমি বলে দিচ্ছি। কাঁটা ফুটার। অভিনয় করলাম যাতে আমি আপনার হাত ধরে কিছুক্ষণ হাঁটতে পারি। রাগ করবেন না। সত্যি কথাটা বললাম। আমি খুবই খারাপ মেয়ে। অভিনয়ের বাইরেও আমাকে অনেক কিছু করতে হয়। নষ্ট মেয়েদেরও তো মাঝেমধ্যে মন কেমন করে। কারোর হাত ধরতে ইচ্ছা করে। করে না?

পাঁচ. আপনি ভুলেও ভাববেন না যে আপনাকে ভুলাবার জন্যে এইসব কথা বলছি। পুরুষ মানুষকে আমি মিষ্টি কথা দিয়ে ভুলাই না, শরীর দিয়ে ভুলাই। এরকম আঁৎকে উঠবেন না। আঁৎকে উঠার মত কিছু বলি নি।

চিত্রা মাহফুজের গলা পর্যন্ত চাদর টেনে দিল। তখনি ঘরে ঢুকল সামছু। সামছু খানিকটা উত্তেজিত এবং ভয়ংকর চিন্তিত। কারণ ভুজঙ্গ বাবু আসেন নি। শেষ মুহূর্তে খবর দিয়েছেন আসতে পারবেন না। সামছু মাহফুজকে ডেকে তুলতে গেল। চিত্রা চাপা গলায় বলল, খবর্দার উনাকে ডাকবেন না। ঘুমুচ্ছে ঘুমুতে দিন। যা বলার ঘুম ভাঙ্গার পর বলবেন।

মাহফুজ ভাইরে এখন দরকার।

দরকার হলেও উনাকে ডাকা যাবে না। আপনি বাইরে আসুন। উঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।

তারা উঠানে দাঁড়াল। সামুছ বলল, খুবই ভয় লাগতাছে। মনে হইতেছে বিরাট ঝামেলা হইব। মাহফুজ ভাইকে এক্ষণ দরকার। কানা রফিক তার দলবল নিয়া আসছে। কেন আসছে বুঝতেছি না।

চিত্রা বলল, যার ইচ্ছা সে আসুক। কানা রফিকটা কে?

টেকা নিয়া মানুষ খুন করে।

মানুষ খুন করতে কত টাকা নেয়?

মানুষ বুইজ্যা দাম। পাঁচশ টাকার মানুষ আছে। আবার ধরেন লাখ টেকার মানুষও আছে।

চিত্রা বলল, আপনি, স্কুল ঘরে থাকেন। উনার ঘুম ভাঙলেই আমি উনাকে নিয়ে চলে আসব। ভুজঙ্গ বাবু নেই তো কি হয়েছে? প্রমোটারকে টিপু সুলতানের ড্রেস পরে দাঁড় করিয়ে দেব। মফঃস্বলের নাটকে এরকম প্রায়ই হয়। এটা কোন ব্যাপার না।

.

চিত্রার খুব ক্লান্তি লাগছে। আজ নাটক না হলে ভালই হয়। তার ঘুম পাচ্ছে। নাটকের ঝামেলা না থাকলে সে শুয়ে একটা লম্বা ঘুম দেবে। সুন্দর চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় হাঁটতে ভাল লাগছে। নাটক নিয়ে তার মাথায় কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। নাটক হবে কি হবে না এই দায়িত্ব তার না। সে তৈরী হয়েই আছে। যখন তার ডাক পড়বে সে মঞ্চে উঠে যাবে। সে তার অংশটা শুধু যে ভাল করবে তা না খুবই ভাল করবে। টিপু সুলতানের ডায়লগ শেষ হবার আগেই তার প্রবেশ। টিপু একা একা কথা বলছেন

টিপু : পলাশীর বিষবৃক্ষ। মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগৎশেঠের দল স্বহস্তে রোপন করেছিল যে বিষবৃক্ষ- মীরমদন, মোহনলালের বক্ষ-রক্তে তো ভেসে গেল তবু সে বিষবৃক্ষের মূল শিথিল হল না।

এই সময় সোফিয়া ঢুকবে। টিপু সুলতানকে চমকে দিয়ে বলবে—

 সোফিয়া : হায়দার আলি খাঁ বাহাদুর এবং ফতে আলি টিপুও বুকের রক্ত ঢেলে সে বিষবৃক্ষকে উৎপাটিত করতে পারবেন না।

টিপু : কে! কে কথা কইলে! কে তুমি?

 সোফিয়া : বাদির নাম সোফিয়া

টিপু : সোফিয়া বালিকা তুমি কি করে জানলে ইংরেজ বিজয়ে আমরা অক্ষম!

সোফিয়া : ও জ্যোতিষীর গণনা। হাঃ হাঃ হাঃ

জোছনা-ভরা উঠানে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা স্পষ্ট শুনল মহিশূরের মহাপরাক্রমশালী টিপু সুলতান হাসছেন। হাসির শব্দে চিত্রার শরীর ঝনঝন করতে লাগল। আর ঠিক তখনি স্কুলঘরের দিক থেকে হৈ চৈ এর শব্দ আসতে লাগল। মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাচ্ছে। আগুন আগুন বলে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিত্রা যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।

মাহফুজ বিছানায় বসে আছে। সে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, কি হয়েছে?

চিত্রা বলল, কিছু হয় নি। আপনার শরীর এখন কেমন?

মাহফুজ বলল, ভাল। চিৎকার কিসের?

চিত্রা বলল, আমি কি করে জানব কিসের চিৎকার। আপনার গ্রামের চিৎকার আপনি জানবেন।

.

সুলতান সাহেব ইজিচেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখলেন– ট্রেনে করে তিনি যাচ্ছেন। কামরায় তিনি এবং রানু। রানু জানালার পাশে বসে গল্পের বই পড়ছে। বইটা মজার। রানু একটু পর পর খিল-খিল করে হেসে উঠছে। তিনি বইটার নাম পড়তে চেষ্টা করছেন পারছেন না। রানু আড়াল করে রেখেছে। তিনি বললেন, বইটা উঁচু করে ধর তো মা। রানু কঠিন গলায় বলল, না। রানুর চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিন বিস্মিত। রাগ করার মত কথা তো বলেন নি। রানু এমন রাগ করছে কেন? এই সময় কিছু একটা ঘটল। ট্রেন থেমে গেল। ট্রেনের সমস্ত যাত্রিরা হৈ চৈ করতে শুরু করল। হৈ চৈ চিৎকার এবং কান্নাকাটি। তিনি জানালা দিয়ে গলা বের করে কি হয়েছে দেখতে চেষ্টা করছেন। শুধু তাদের কামরায় বাতি আছে। তাদের কামরা ছাড়া পুরো ট্রেন অন্ধকার। তিনি চিন্তিত গলায় বললেন, রানু কি হয়েছে জানিস? রানু তাঁর কথার জবাব দিচ্ছে না। সে খিল-খিল করে হাসছে এই সময় তার ঘুম ভাঙল। তিনি দেখলেন সত্যি সত্যি হৈ চৈ হচ্ছে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে। ঘরে তিনি একা– রানু নেই। তিনি ডাকলেন- রমিজ রমিজ। কেউ সাড়া দিল না। সাড়া দেবার কথা না। রমিজ রানুকে নিয়ে নাটক দেখতে গিয়েছে। হৈ চৈ কি সেখানেই হচ্ছে?

সুলতান সাহেব একতলায় নামলেন। একতলা থেকে বাড়ির সামনের বাগানে গেলেন। হৈচৈ এবং চিৎকার স্পষ্ট হল। উত্তর দিকের আকাশ লাল হয়ে আছে। কোথাও আগুন লেগেছে। তিনি গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালেন। সামনের রাস্তা দিয়ে কে যেন ছুটে গেল। একটা ক্রাইসিস তৈরী হয়েছে। ক্রাইসিসের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। উত্তেজিত হওয়া যাবে না। তার অসুস্থ মেয়েটা সেখানে আছে। বড় ক্রাইসিস সুস্থ মানুষ একভাবে দেখে অসুস্থ মানুষ একভাবে দেখে। তাকে এখন যা করতে হবে তা 2602- Taking notes is not the most intellectual job in the world. But during crises only thing you can do is taking notes.

এটা কার কথা? মার্ক টোয়েনের? কে যেন ছুটে আসছে। পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। তিনি গেট খুলে বাইরে এলেন। যে আসছে তাকে থামাতে হবে। তিনি কড়া গলায় বললেন, কে? কে?

পায়ের শব্দ থেমে গেল। যে এগিয়ে এল তাকে তিনি চেনেন না। তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি না চিনলেও সে নিশ্চয়ই তাঁকে চেনে।

তোমার নাম কি?

আমার নাম বিষ্ণু।

হৈচৈ কিসের?

 একটা মাডার হয়েছে।

কে মার্ডার হয়েছে?

বলতে পারব না।

আগুন কিসের?

ইস্কুল ঘরে আগুন লাগাইয়া দিছে।

গণ্ডগোলটা কি নাটকের মাঝখানে শুরু হয়েছে?

 নাটক হয় নাই।

আমার মেয়েটাকে দেখেছ? রানু নাম?

উনারে চিনি। জ্বে না উনারে দেখি নাই।

 তুমি দৌড়ে যাচ্ছ কোথায়?

 শুনতাছি রায়ট হইব। সব হিন্দুবাড়ি জ্বালায়ে দিব।

 রায়ট হবার কি আছে? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।

বিষ্ণু ছুটে যাচ্ছে রায়ট হবার সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। পৃথিবীর সব দেশেই সংখ্যালঘুরা অকারণে নির্যাতিত হয়। যে কোন সমস্যার প্রথম বলি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।

পূর্বদিকের আকাশ আরো লাল হয়েছে। মনে হয় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। সুলতান সাহেব বিড়বিড় করে বললেন– Taking notes is not the most intellectual job in the world… :

একদল মানুষ দৌড়ে আসছে। তাদের হাতে মশাল না-কি? মশাল মিছিল শহুরে ব্যাপার। গ্রামের মানুষ মশাল পাবে কোথায়? গ্রামের মানুষদের হাতে থাকে টর্চলাইট। সুলতান সাহেব এক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। গুলির শব্দ হল। একবার, দুবার, তিনবার। গাছপালার যত পাখি সব এক সঙ্গে ডেকে উঠল। সুলতান সাহেব চাপা গলায় ডাকলেন রানু, রানু, ও রানু। তিনি দৌড়াতে শুরু করেছেন। তিনি ভুলে গেছেন তার পায়ে স্যান্ডেল নেই। তিনি খালি পায়ে দৌড়াচ্ছেন।

.

মওলানা ইস্কান্দার আলি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ আগে তাঁর কোরাণ শরীফ পাঠ শেষ হয়েছে। তিনি পুরোটা মুখস্থ বলতে পেরেছেন। তাঁকে রেলের উপর রাখা কোরাণ শরীফের পাতায় চোখ বুলাতে হয় নি। তাঁর কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘাম পড়ছে। উত্তেজনায় তাঁর বুক উঠানামা করছে। তার উচিত এই মুহূর্তে শোকরানা নামাজে দাঁড়ানো। কিন্তু তিনি উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। মনে হচ্ছে শরীরে কোন জোর নেই। ইস্কান্দার আলি বিড়বিড় করে কি যেন বলছেন। তাঁর চোখ শুকনো কিন্তু তিনি কাঁধে রাখা গামছায় একটু পর পর চোখ মুছছেন। বাইরে প্রচণ্ড হৈ চৈ হচ্ছে, সেই হৈ চৈ-এর কিছুই তার কানে ঢুকছে না। তাঁর মনে প্রচণ্ড ভয় ঢুকে গেছে কোরাণ মজিদ পুরোটা মুখস্থ তিনি বলেছেন, কিন্তু পরে যদি তিনি আর না পারেন। যদি এমন হয় যে নামাজে দাঁড়িয়ে সূরার মাঝামাঝি জায়গায় সব ভুলে যান। তখন কি হবে? হাফেজ নুরুদ্দিন সাহেবের জীবনে এই ঘটনা ঘটেছিল। হাফেজ সাহেবের বাড়ি কুমিল্লার গুণবতী গ্রামে। তিনি ছিলেন হাফেজ ও ক্বারি। অতি সুকণ্ঠ। কোরাণ মজিদ পুরোটা ছিল কণ্ঠস্থ। শুধু নামাজে দাঁড়ালে সব গণ্ডগোল হয়ে যেত। এমনও হয়েছে সূরা ফাতেহার মাঝামাঝি এসে তিনি আটকে গেছেন। এমন ভয়ংকর কিছু তার জন্যে অপেক্ষা করছে না তো? ইস্কান্দর আলির পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু উঠে গিয়ে পানি আনার মত শক্তি তাঁর নেই। অবসাদ, উত্তেজনা আনন্দ এবং ভয়ে তার শরীর যেন কেমন করছে…

.

ছদরুল বেপারী একটা গাছের আড়ালে আছেন। পুরানো জামগাছ। এই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব। তিনি তার গায়ের শাদা চাদরটা ফেলে দিয়েছেন। অন্ধকারে শাদা রঙ চোখে পড়ে। নিজেকে লুকিয়ে ফেলা এখন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন গণ্ডগোলটা হচ্ছে তাঁর জন্যে। কানা রফিকের দল আসলে তাঁকে খুঁজছে। কাজ উদ্ধারের জন্যে হঠাৎ একটা ঝামেলা তৈরী হয়েছে। নিরীহ একজন মানুষ মারা পড়েছে। ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্ট। গণ্ডগোলটা শুরু হয়েছে এইভাবে- কানা রফিক ভুজঙ্গ বাবুর অ্যাসিসটেন্টকে শার্টের কলার ধরে স্কুলের মাঠ থেকে একটু দূরে এনে বলেছে- তোর ওস্তাদ আসল না ক্যান।

অল্প বয়স্ক ছোকরা অ্যাসিসটেন্ট হয়ত এর উত্তরে অপমানসূচক কিছু বলেছে। কানা রফিককে সুযোগ করে দিয়েছে। কানা রফিক থমথম গলায় বলেছে- শুওরের বাচ্চা দেহি আমারে বাপ তুইল্যা গাইল দেয়। শুওরের বাচ্চারে একটু টিপা দিয়ে দেও দেহি। এই বলে নিতান্ত অবহেলার সঙ্গে তাকে অন্যদের হাতে দিয়ে উঠে এসেছে। তারপরই স্কুলঘরে আগুন লেগে গেছে। স্কুলঘরে আগুন লাগানোর একটা উদ্দেশ্য ঝামেলা ছড়িয়ে দেয়া। ছদরুল বেপারী পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন গ্রামের চারদিকে পাহারা বসেছে। তিনি তখনই নিজের গা থেকে শাদা চাদর খুলে ফেললেন। আর সময় নেই লুকিয়ে পড়তে হবে। প্রথম থেকেই অস্পষ্টভাবে তাঁর মনে হচ্ছিল তাঁর নিজের দল এই ঝামেলার সঙ্গে যুক্ত। যতই সময় যাচ্ছে তার ধারণা ততই স্পষ্ট হচ্ছে। তাঁর দলের লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কখনোই এক সঙ্গে নেই। কানা রফিকের সঙ্গে কুদ্দুসকে আলাপ করতেও দেখলেন। দুজন একসঙ্গে সিগারেট ধরাল। দাবার খেলা শুরু হয়েছে। খুবই জটিল খেলা। তিনি নিজেই রাজা নিজেই মন্ত্রী। তবে রাজা মন্ত্রী ছাড়া আর কেউ নেই। তাঁর হাতী-ঘোড়া তার দিকেই ছুটে আসছে। এটা খারাপ না। খেলতে হলে এরকম খেলাই খেলা উচিত।

ছদরুল বেপারী পাঞ্জাবীর পকেট থেকে পান বের করে মুখে দিলেন। কুদুসের এনে দেয়া কাঁচাসুপারির পানগুলো কাজে লাগছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পান চিবুতে মজা লাগছে। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেট খাওয়া যাবে না। সিগারেটের আগুন দূর থেকে দেখা যাবে।

শুকনো পাতায় মড় মড় শব্দ করে কে যেন আসছে। অন্য সময় হলে ছদরুল বেপারী বলতেন– কে আসে? আজ কিছু বললেন না তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। না ভয় পাবার কিছু নেই। যে আসছে সেই বরং ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বার বার থেমে পড়ছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। মেয়েটাকে এখন চেনা যাচ্ছে। সুলতান সাহেবের মেয়ে। ভয়ে মেয়েটার মুখ ছোট হয়ে গেছে। মেয়েটা এখন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটা একটু পর পর আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। আকাশে সে কি দেখার চেষ্টা করছে? চাঁদ?

ছদরুল বেপারী গলা খাকারি দিলেন। রানু কান্না কান্না গলায় বলল, কে? গাছের ওপাশে কে?

ছদরুল বেপারী গাছের আড়াল থেকে বের হতে হতে বললেন, আমারে তুমি চিনবা না। আমার নাম ছদরু।

রানু বলল, আমি আপনাকে চিনব না কেন? আমি আপনাকে খুব ভাল করে চিনি। আপনার নাম ছদরুল বেপারী। শুনুন আপনি আমাকে আমার বাবার কাছে দিয়ে আসুন।

ছদরুল বেপারী বললেন, আমি এইখানে থেকে বের হতে পারব না। লোকজন আমারে খুঁজতাছে।

আপনাকে খুঁজছে কেন?

খুন করার জন্যে খুঁজতেছে।

 কি আশ্চর্য! কেন?

ছদরুল বেপারী হেসে ফেললেন। এগিয়ে এলেন রানুর কাছে। মেয়েটা বোকার মত খোলা জায়গায় দাঁড়িয়েছে আছে। চাঁদের আলো পড়েছে তার গায়ে। অনেক দূর থেকে দেখা যাবে।

তোমার নাম কি?

আমার নাম রানু।

একটু আগায়ে অন্ধকারে দাঁড়াও।

কেন?

 এত কেন কেন করবা না। যা বলতেছি কর।

আপনি এরকম করে কথা বলছেন কেন?

কি রকম করে কথা বলতেছি?

কেমন যেন অন্যরকম করে কথা বলছেন। তবে আপনাকে দেখে আমার ভয় কেটে গেছে। আমি আসলে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি। আপনি কি জানেন চার-পাঁচটা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

জানি।

পুলিশ কখন আসবে? গণ্ডগোল থামবে না?

আমারে যদি মারতে পারে তাহলে গণ্ডগোল থামবে। তবে আমাকে মারা সহজ না। আমি বিরাট খেলোয়াড়।

ছদরুল বেপারী ভুরু কুঁচকে ফেলল। মেয়েটা না থাকলে তার কোন সমস্যা ছিল না। মেয়েটা তাঁকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছে। মেয়েটাকে ফেলে তিনি চলে যেতে পারছেন না। এই সময় আগুনের মত রূপবতী একটা মেয়ের সঙ্গে থাকা খুবই বিপদজনক ব্যাপার।

রানু কিছু বলতে যাচ্ছিল ছদরুল বেপারী হঠাৎ তার মুখ চেপে ধরলেন। মশাল জ্বালিয়ে চার-পাঁচ জন লোক আসছে। এদের দুজনের হাতে বর্শা। রানুর ভয় কেটে গিয়েছিল। হঠাৎ প্রবল ভয় তাকে অভিভূত করে ফেলল। তার কাছে মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছে।

ছদরুল বেপারী ফিসফিস করে বলল, ভয় নাই আমি জীবিত থাকতে তোমার কিছু হবে না। জীবিত কতক্ষণ থাকব এইটা হইল কথা। এরা আমারে খুঁজতেছে। এদের একজন আমার খুব আপন লোক। নাম কুদ্দুস।

রানু বলল, আপনি আমাদের বাড়িতে চলুন। আমি আপনাকে লুকিয়ে রাখব।

তোমারে তোমার বাড়িতে নিয়া যাব। তবে তোমার বাবা সুলতান সাহেব আমারে জায়গা দিবে না।

অবশ্যই দেবেন। কি বলছেন আপনি?

ছদরুল বেপারী ক্লান্ত গলায় বললেন, দিলে তো ভালই। চল জঙ্গলের ভিতর দিয়া হাঁটি। আস্তে পা ফেলবা যেন শব্দ না হয়।

রানু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে নিয়ে যান। আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে।

ছদরুল বেপারী তার দীর্ঘ জীবনে কোন তরুণীকে মা ডাকেন নি হঠাৎ তার কি মনে হল, তিনি বললেন, মা হাতটা ধর। বললাম না আমি জীবিত থাকতে তোমার কোন ভয় নাই। মরে গেলে ভিন্ন কথা। মরে গেলে তুমি চলবা তোমার নিজের দিশায়।

বেশিদূর যাওয়া গেল না। মশাল হাতে দলটা আবার ফিরে আসছে। ছদরুল বেপারী মওলানা ইস্কান্দার আলির বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। মেয়েটাকে মওলানার হাতে তুলে দিয়ে তাকে দ্রুত সরে পড়তে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।

.

মাহফুজ তার বাড়ির উঠোনের জলচৌকিতে বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ। সে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। তার সামনে চিত্রা এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ মনে হচ্ছে সে চিত্রাকে দেখতে পাচ্ছে না। চিত্রা বলল, অবস্থা খুবই খারাপ। একের পর এক বাড়িতে আগুন লাগানো হচ্ছে। আপনি বসে থাকলে তো হবে না। মাহফুজ বলল, আমি কি করব? আমার এখন কি করার আছে?

আপনি বাড়ি থেকে বের হবেন। আপনার নিজের লোক জোগাড় করবেন। আপনি আগাবেন আপনার দল নিয়ে।

দল কোথায় আমার?

একেকটা বাড়ির সামনে দাঁড়াবেন। তাদের ডাকবেন। অবশ্যই তারা বের হবে। আপনাকে এই গ্রামের মানুষ অসম্ভব পছন্দ করে। আপনার ডাক তারা শুনবে।

আমার মাথা ঘুরছে চিত্রা। আমি উঠে দাঁড়িতে পারছি না।

আপনি আপানকে হাত ধরে নিয়ে যাব।

 মাহফুজের মাথার ভেতর তার দাদী কথা বলে উঠলেন– ও আবু এই মেয়েটা যেন তোরে ছাইড়া না যায়। অতি অবশ্যই এরে তুই বিবাহ করবি। ঝামেলা মিটলে আইজ রাইতেই। ইস্কান্দার মওলানারে ডাক দিয়া আইন্যা বিবাহ করবি। এইটা তোর উপর আমার হুকুম। ঐ বেকুব আমার কথা শুনতেছস?

মাহফুজ বিড়বিড় করে বলল, চুপ কর।

আমার কথা না শুনলে নাই। মেয়েটা কি বলতাছে শোন। হে কোন ভুল কথা বলতাছে না।

মাহফুজ ঘর থেকে বের হল। তার হাতে একগাদা পাটখড়ি। পাটখড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে মশাল নিয়ে বের হয়েছে। মাহফুজ ঘর থেকে বের হয়েই চিৎকার করে বলল, কে কোথায় আছেন। আসেন দেখি আমার সাথে। আমি মাহফুজ।

চিত্রা লক্ষ্য করল একজন দুজন করে আসছে। মাহফুজ আবারও চিৎকার করে ডাকল- কই আসেন। ঘরে বসে থেকে লাভ নাই। বের হন।

.

রানু ফিসফিস করে বলল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে।

ছদরুল বেপারী জবাব দিলেন না। হাসলেন। তাঁর চোখ-কান খোলা, হাঁটছেন কুঁজো হয়ে। তার মন বলছে দূর থেকে তাঁকে কেউ লক্ষ্য করছে। যে লক্ষ্য করছে সে একা বলেই কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। সে যাচ্ছে তার দল নিয়ে আসতে। রানু মেয়েটাকে অতি দ্রুত মওলানা ইস্কান্দার আলির হাতে তুলে দিয়ে তাকে অন্ধকারে মিশে যেতে হবে। সবচে ভাল হয় পাঞ্জাবী খুলে খালি গা হয়ে গেলে। নগ্ন-গাত্রের মানুষ অন্ধকারে চোখে পড়ে না।

ছদরুল বেপারী বললেন, তুমি দৌড়াতে পারবা?

রানু বলল, আমি হাঁটতেই পারছি না, দৌড়াব কিভাবে?

আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যেভাবে যাইতেছ সেভাবেই যাও। ছদরুল বেপারী একটা ব্যাপার ভেবে সামান্য আনন্দ পাচ্ছেন তার হাতে যেমন সময় নেই, যারা তাঁকে খুঁজছে তাদের হাতেও সময় নেই। ঝড়ের প্রথম ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সাধারণত প্রথম ধাক্কায় কিছু না হলে পরে আর হয় না। তিনি নিশ্চিত এর মধ্যে তাঁর নিজের জায়গায় খবর চলে গেছে। তার লোকজন ছুটে আসছে। মাহফুজ বের হয়েছে। তিনি তার গলা শুনতে পেয়েছেন। সে লোকজন সংগ্রহ করছে।

তাঁকে দাবা খেলায় আর কিছুক্ষণ টিকে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ টিকতে পারলেই হাতি-ঘোড়া, সৈন্য-সামন্ত চলে আসবে। তখন তিনি হাতীর চাল দেবেন না, সৈন্যও এগিয়ে দেবেন না। তিনি দেবেন ঘোড়ার চাল। ছদরুল বেপারীর ঘোড়ার চাল কি লোকজন দেখবে। ভুজঙ্গ বাবুর পাটের চেয়ে সেটা খারাপ হবে না। ভাল কথা, তিনি ভুজঙ্গ ব্যাটাকেও ধরে আনাবেন। স্কুলের মাঠে নাটক হবে। ভুজঙ্গকে টিপু সুলতানের পাট করতে হবে। তিনি নিজের হাতে ভুজঙ্গকে সোনার মেডেল পরিয়ে দেবেন। তবে তার আগে ভুজঙ্গকে একশ বার কানে ধরে উঠ-বস করাবেন। ভুজঙ্গ সোনার মেডেলের কথা সবাইকে বলে বেড়াবে কিন্তু কানে ধরে উঠ-বসের কথা কাউকে বলতে পারবে না।

মানুষ তার জীবনের সব ঘটনা বলতে পারে না। কিছু কিছু ঘটনা চেপে যায়। তিনি বলতে পারেন। কারণ তিনি ঠিক মানুষ শ্রেণির না, পশু শ্রেণির। এক সময় তার মা দেওয়ানগঞ্জে ঘর নিয়ে নটি-বেটি হয়েছিলেন এই কথা বলতে তার মুখে আটকায় না। তবে মায়ের উপর তার কোন রাগ নাই। স্বামীর মৃত্যুর পর এই মহিলা দুধের শিশু নিয়ে মরতে বসেছিলেন। কেউ তাকে খাওয়া দেয় নাই। সে শিশু-সন্তান নিয়ে পথে পথে ঘুরেছে। দেওয়ান গঞ্জের লোকজন তাঁর কাছে এসেছিল একটা মাদ্রাসা হবে, গার্লস স্কুল হবে তার জন্যে সাহায্য। তিনি সাহায্য করেছেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল বলেন আমার মাকে তোমরা বাজারের নটি-বেটি বানিয়েছিলে। তার শাস্তি হিসেবে দেওয়ানগঞ্জের সবাই মিলে দশ বার কান ধরে উঠ-বোস কর। আমি মাদ্রাসা বানিয়ে দিব, মসজিদ বানায়ে দিব, স্কুল-কলেজ করে দিব। পাকা রাস্তা বানিয়ে দিব। তিনি তা বলেন নাই। তিনি ক্ষমা করেছেন। মাঝে-মধ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও মানুষকে ক্ষমা করতে হয়।

রানু বলল, আর কতদূর?

ছদরুল বেপারী বললেন, ঐ তো দেখা যায়। বারান্দায় ইস্কান্দার মওলানা বসে আছে। তুমি কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে যাবে। ঘরের ভিতর কুপী জ্বলতেছে। ফুঁ দিয়ে কুপী নিভায়ে দিবে। ইস্কান্দার মওলানার সঙ্গে কথা যা বলার আমি বলব।

.

মওলানা ইস্কান্দার আলি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। ছদরুল বেপারী বললেন, মেয়েটাকে রেখে গেলাম। ঝামেলা মিটলে তাকে পৌঁছায়ে দিবেন। বুঝতে পারতেছেন কি বললাম?

মওলানা ইস্কান্দার বিড়বিড় করে বললেন, জনাব আমার একটা খবর ছিল। আনন্দের খবর।

ছদরুল বেপারী বললেন, খবর শোনার সময় নাই। যা বললাম করবেন।

খুবই বড় একটা সংবাদ জনাব। আমি পাক কোরাণ মুখস্থ করেছি। আমার নাম এখন হাফেজ ইস্কান্দার আলি।

যাই হাফেজ সাহেব।

চাইরদিকে আগুন লাইগা গেছে ব্যাপারটা কি জনাব?

ছদরুল বেপারী ব্যাপার বলার সুযোগ পেলেন না। মওলানা ইস্কান্দারের উঠানে তিনজন এসে দাঁড়াল। তিনজনের একজনের নাম কুদ্দুস। কুদুসের হাতে খোলা পিস্তল। কুদুসের পাশেই কানা রফিক। কানা রফিকের গায়ে হলুদ রঙের চাদর! চাদরে সে মাথা ঢেকে রেখেছে। তার চোখ জ্বল জ্বল করছে। কানা রফিক একদলা থুথু ফেলল। ছদরুল বেপারী শান্ত গলায় বললেন, কুদ্দুস তুমি কি চাও?

কুদ্দুস গলা খাকারি দিল।

কানা রফিক চাপা গলায় বলল, কুদ্দুস দেরী করতেছ কেন? হাতে সময় সংক্ষেপ।

কুদ্দুস পিস্তল উঁচু করে এক পা এগিয়ে আসতেই মওলানা ইস্কান্দার আলি তার সামনে দুহাত তুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আর্তনাদের মত চেঁচিয়ে উঠলেন– কি করতেছ? কি সর্বনাশ! তোমরা কি করতেছ?

তাঁর চিৎকার ছাপিয়ে পরপর দুবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হল। দূর থেকে হৈচৈ চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মাহফুজ তার বিশাল দল নিয়ে এদিকেই আসছে। তারা গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছে।

.

হাফেজ মওলানা ইস্কান্দার আলির উঠান ফাঁকা। তিনি উঠানে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর বুক থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। মওলানার পাশেই ছদরুল বেপারী। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ধরালেন। মওলানার ঘরের দরজা ধরে রানু দাঁড়িয়ে আছে। সে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, উনার কি হয়েছে?

ছদরুল বেপারী দুটা টান দিয়ে সিগারেট ফেলে দিয়ে ইস্কান্দার আলির পাশে বসলেন। চাপা গলায় বললেন, মওলানা সাহেব মনে সাহস রাখেন। আমাকে কয়েক ঘন্টা সময় দেন। কয়েক ঘন্টা সময় যদি পাই আমি আপনাকে বাঁচায়ে ফেলব। আমার সমস্ত টাকা-পয়সা একদিকে আর আপনে একদিকে।

মওলানা ইস্কান্দার আলি ফিসফিস করে বললেন, হায়াত-মউতের মালিক আল্লাহপাক। সব কিছুতেই উনি নির্ধারণ করে রেখেছেন। আপনার আমার করার কিছু নাই।

খুব কষ্ট হইতেছে, পানি খাবেন?

মওলানা না-সূচক মাথা নাড়লেন। কিছুটা সময় তিনিও আল্লাহপাকের কাছে চাচ্ছেন। আরেকবার যেন কোরাণ মজিদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে পারেন। সেই সময় কি তাঁর মত পাপী-বান্দাকে আল্লাহপাক দেবেন? এত দয়া কি তিনি দেখাবেন? হাফেজ ইস্কান্দার আলি বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলেন। সময় নেই, অতি দ্রুত আবৃত্তি করতে হবে। তাঁর সুরমা দেয়া দুই চোখে অশ্রু। চাঁদের আলোয় সেই অশ্রু চিকচিক করছে।

2 Comments
Collapse Comments
সিয়াম বিন রাজ March 8, 2021 at 5:12 pm

এই উপন্যাসটি পুরোটা পড়ে আমার প্রচন্ড ভালো লেগেছে কিন্তু (চাদের আলোয় সেই অশ্রু চিকচিক করছে) এখানেই উপন্যাস শেষ? এরপরে আর নাই?

Incredible. Or maybe more than that

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *