বিটকেল আওয়াজে সেদিন সকালের ঘুম ভাঙল। আওয়াজটা পিছনের বাগান থেকে লাফিয়ে উঠে শোবার ঘরের জানালা ভেদ করে বর্শার মত আমার কর্ণমূলে এসে বিঁধল। কল্পনার তারস্বর তাতে ভুল নেই, কিন্তু কতটা বীরত্বঘটিত হলে তা তীরস্বরে পরিণত হতে তার কল্পনাতেও কোনদিন ছিল না। সেই মুহূর্তে স্বকর্ণে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা গেল।
এবং শুধু কাল্পনিক কণ্ঠই নয়, সেই সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে আরেক কেকা-ধ্বনি! আনকোরা অচেনা গলার কক কক। সঙ্গে সঙ্গে নীচের ঘরে সশব্দে দরজা বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেল। তারপর সব চুপ।
তীরস্বর শুনেই, কল্পনা ধনুর্ধারের মত কিছু একটা করছে টের পেয়েছিলাম। জানালা খুলে মাথা বাড়িয়ে খোঁজ নিলাম।
কার সঙ্গে আলাপ করছিলে গা?
একটা পাখি ধরেছি। কল্পনা ব্যক্ত করল।
পাখি? কী পাখি?
দেখে যাও এসে। পুরে রেখেছি আমাদের বোটুকখানায়। নামলাম নীচে। কল্পনা খুব সাবধানে বৈঠকখানার দরজা দেড় ইঞ্জিটাক ফাঁক করল। সাহস বুকে বাঁধতে হলো আমায়। কে জানে,একটা ঈগল কি উটপাখিই হবে হয়ত; তাড়া করে আসে যদি? যতদূর সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে সেই দেড় ইঞ্চি যকের ভেতর দিয়ে আধ ইঞ্চি দৃষ্টি চালিয়ে দিলাম। বহু চেষ্টার পর, টেবিলের আড়ালে, আমার গদি আঁটা স্মোরে উপবিষ্ট পাখির মত চেহারার একজন আমার চগোচর হলো।
পাখির মত হাবভাব, কিন্তু পাখি কিনা নিশ্চয় করে বলা শক্ত। পাখির মত চেহারা, পাটকেলের মত রঙ (হঁটের মতও বলা যায়), হাতলের তলা দিয়ে প্যাট প্যাটু করে আমার দিকে চাইছে। ভারী বিরক্ত চাউনি। আর জলের কলের দম বন্ধ হলে যে রকম বকুনি বেরয় অনেকটা সেই জাতীয় ব-ব-নিনাদ!
কী পাখি? জিজ্ঞেস করল কল্পনা।
সূক্ষ্মদৃষ্টির সাহায্যে যতটা পারা যায়, পক্ষী-আকারকে আমি মনে মনে পরীক্ষা করলাম। পাখি বলেই তো বোধ হচ্ছে। আমি বল্লাম। উড়ে এসেছিল, না কি?
প্রায় উড়েই এল বইকি। জবাব দিল কল্পনা : কিংবা কেউ ছুঁড়ে দিল যেন। বোকেন বাবুদের বাগানের দিকটা থেকে এল?
দ্যাখো, এখানে আমরা ফেরারী হয়ে এসেছি। আমার প্রখরদৃষ্টির খানিকটা পাখির থেকে টেনে কল্পনার মুখে নিক্ষেপ করি। এখনো এখানকার সকলের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়নি। এস্থলের ইতরভদ্র প্রাণীদের কে কী ধরনের কিছুই জানিনে। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়া কি ঠিক হবে? চোখ কান ঠুকরে নেয় যদি?
বাস্তবিক, ইভ্যাকুয়েশনে আসা আর খুন করে পালানো আসামীতে কোনো প্রভেদ নেই। কারো তারা প্রতিভাজন না। সবাই তাদের বিষ নজরে দ্যাখে। স্থানীয় বাজার-দর বাড়ানোর কারণ বলে বাজারের কারো কাছে তাদের আদর নেই। এমনকি, ওই পাখিটা পর্যন্ত দ্যাখো না, দুই চোখে বিদ্বেষ উদগীরণ করছে! ভেবে দেখলে, বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে শেষে এই বিভঁয়ে এসে বুননা পশুপক্ষীর গর্ভে যাওয়া কোনো কাজের কথা বলে আমার বোধ হয় না। অপরের জিতে নিজের স্বাদ গ্রহণ খুব উপাদেয় নয়,
অন্ততঃ নিজের জিভে অপরকে আস্বাদ করার মত ততটা নয় বলেই আমার আন্দাজ।
ধরো যদি কোনো রকমের বুনো হাঁস টাস হয়? ডিম পাড়ে যদি? কল্পনা নিজের পরিসীমা বাড়ায়। এখানে তো কিছুই মেলে না। খাদ্য-সমস্যাটা কিছুটা তো মিটতে পারে তাহলে?
বলতে কি এই জন্যেই ওকে আমি এত ভালবাসি। আমার বুদ্ধির অভাবের কিছুটা ওর দ্বারা মোচন হয়। আমার বোকামির ও ক্ষতিপূরক। আমার অনেকখানি প্রতিষেধক, বলতে কি!
আমার যেসব বন্ধু নামজাদা মেয়েদের বিয়ে করেছিল, যারা সান্ত্বনা, মেহ, সুষমা বা লাবণ্যলাভ করেছিল, তৎকালে মনটা একটু, খুঁতখুঁত করলেও এখন আর সে বিষয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেই সব স্নেহধন্যরা সুখে থাকুন। তাঁদের নিজেদের সুরম্য উপত্যকায় বিরাজ করুন আনন্দে। সেই সান্ত্বনাদাতাকেও (যিনি মুখেই খালি সান্ত্বনা দিতেন, সত্যিকার সান্ত্বনা যাঁর কাছ থেকে কোনোদিন পাইনি) অকাতরে আমি এখন মার্জনা করতে পারি। এমনকি, আমার যে-বন্ধুটি কেবল বিয়ের দৌলতেই প্রতিভাবান বলে বিখ্যাত হয়েছেন (হতে বাধ্য) তাঁর প্রতিও আমার আর ঈর্ষা নাই। কল্পনাপ্রবণ হয়েই বেশ আমি আরামে আছি।
কল্পনার তারিফ করতে হয়। ডিমের দিকটা আমার একদম খেয়াল হয়নি। ভাবনার দিকটাই ভেবেছি। সম্ভাবনার দিকটা ঠাওর হয়নি। কি হবে, ওর মত অমন মর্মভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আমার কই?
থাজ তাহলে। কিছু পাড়ে কিনা, দেখা যাক। আমি বল্লামঃ ওই বোটুকখানাতেই বসবাস করুক। আমাদের বোটুকখানায় এইতো প্রথম এখানকার সামাজিক পায়ের ধূলা পড়লো!
বিকেলে স্টেশনে বেড়াতে গিয়ে বোকেনের সঙ্গে দেখা। (মফঃস্বলে স্টেশনই হচ্ছে একমাত্র গম্যহল—ঠিক রম্যস্থল না হলেও—ওছাড়া আর চড়বার জায়গা কই? সেখানে ঢাকুরিয়ার মত লেক নাস্তি, অন্ততঃ বর্ষাকাল না এলে দেখা যায় না, কাজেই সুন্দর মুখ দেখতে হলে রেলগাড়িরই শুধু ভরসা। তাছাড়া, থিয়েটার যাত্রা সিনেমাও দুর্লভ রেলগাড়ির প্রবেশ ও প্রস্থানেই যা কিছু যাত্রা ইত্যাদি নজরে পড়ে।)
বোকেন আমার দিকে কুটিকুটিল হয়ে তাকিয়ে থাকল খানিক। তারপর মুখভার যারপরনাই কঠোর করে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল যেন আমার বন্য কুকুট কোথায়?
বন্য কুকুট? আমি বোকা সাজলামঃ বন্য কুকুট আবার কী হে?
ন্যাকা! ওসব ইয়ার্কি চলবে না। আমার বালিহাঁসটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ বলো।
যখন এইভাবে আমার প্রতি লালবাজার-সুলভ-জেরা চলছে ঠিক সেই মুখে যতীন এসে হাজির। তার মুখেও কেমন একটা সন্দিগ্ধ ভাব।
তোমাদের বালিহাঁসের কথায় মনে পড়ল। তোমরা কেউ আমার সখের পারাবতটিকে দেখে? বল্ল সে।
পারাবত? তার মানে? পারাবত তো পায়রা। আমিও না বলে পারি না? মোটেই পায়রার মতো দেখতে নয়।
যতীন আর বোকেন—দুজনেই চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকায়।
নয়ই তো। যতীন একমুখ হাসি এনে ফ্যালে : উড়ে এসে জুড়ে বসলে হয় পায়রা; আর গৃহপালিত হলে হয় কপোত। গৃহকপোত বলা হয়ে থাকে শোনোনি! সেই বস্তুই বাইরে পাওয়া গেলে পারাবত। এই বেড়ালই বনে গেলে বনবিড়াল হয় যেমন হে!
কক্ষনো তা নয়। তোমার বন্যকুকুটও না…আর…আর তোমার বুনো পায়রাও নয়। সারস পাখি আমি কখনো চোখে দেখিনি, যদি হয় তাহলে তাই।
ধরা পড়ে যাবার পর আর পিছিয়ে আসা যায় না। সাফাই দিতেই হয়। তবে যদি বন্য সারস হয় তো বলতে পারি নে। সেই সঙ্গে এটুকুও অনুযোগ করি—বুননদের, সঙ্গে তো এইখানেই আমার আলাপ।।
ওদের গোয়েন্দা-মার্কা চাউনি তখন পরস্পরের ওপরে পড়েছিল। পরস্পরকে সন্দেহ করছিল ওরা। উভয় পক্ষ থেকেই বিপক্ষতার কোনো ত্রুটি হোততা না, মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াত কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা ট্রেন এসে পড়ে বাধা দেয়ায় লড়াইটা থেমে গেল।
কুরুক্ষেত্র থেকে আমরা ধর্মক্ষেত্রে চড়াও হলাম। সন্ধি করে ফেলাম। সকলের জবানবন্দী জোড়াতালি দিয়ে জানা গেল, যতীন ঐ পাখিটকে কাল, সন্ধ্যায় তার বাগানে উকি মারতে দেখেছিল। তার ধারণায়, পাখিটাও আমাদের মতই পলাতক, তবে ধারে কাছের নয়, সুদূর থেকে আসা, বৰ্মা মুলুকের আমদানি হওয়াই সম্ভব। আর বোকেন আজ সকালে পা টিপে টিপে তার বাগানের সীমান্তে পৌঁছে পাখিটাকে প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি, সেই সময়ে পাখিটা কেমন করে তার হাত ফসকে (পাখোয়াজির কোথাও গলদ ছিল নিশ্চম) বেড়া টপকে আমাদের এধারে এসে পড়ে।
একজনের প্রথম দর্শন, অন্যজন থি-ফোর্থ ধরে ফেলেছিল, আরেক জনের কাছে ধরা দিয়েছে—অধিকারসূত্রের এরকম ঘোরপ্যাচে—পাখিটা আপাতত আমার আস্তানাতেই বাস করবে স্থির হলো।
বাড়ি ফিরে জানলাম কল্পনা ইতিমধ্যেই ওর নামকরণ কবে ফেলেছে। মীনাক্ষি। নামটা খুব অযথা হয়নি। প্রথম দেখা থেকেই ওর চাউনিতে, বিশেষ করে আমার প্রতি ওর হাবভাবে বিজাতীয় একটা মীনে আমি লক্ষ্য করেছি। মিনেসিং সামথিং, ভাষায় ঠিক তার প্রকাশ হয় না। মীনাক্ষি বললেই ঠিক হয়।
ওকে আমাদের খাবার ঘরে এনে রেখেছি। কল্পনা বল্ল : বোটুকখানায় ভারী একা একা বোধ করছিল বেচারা।
তা; বাগানে কেন ছেড়ে দিলে না? নিজের মনে বেড়িয়ে বেড়াতো।
বাগানে? আমার সাহস হয় না বাপু। কেউ যদি নিয়ে পালায়?
সে কথা ঠিক। এ যা কগান! বাড়ি ভাড়া করেই একটা বাগানবাড়ি পেয়ে গেছি বটে বাগানটা ফাউয়ের মধ্যেই—তবে এ-অঞ্চলে বাড়িমাত্রই বাগানবাডি। চারধাবে ঘেরা বেড়া দেয়া থাকলেও, এসব বাগান তৈরি করা না স্বয়ংসৃষ্ট বলা কঠিন। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে এক একটা মনুষ্যাবাস। তার ভেতরে কোনোটা বাংলোপ্যাটার্ণ কোনোটা একতালা, কোনোটা বা আটচালা, কদাচিৎ একখানা দোতালাও। কিন্তু এগুলো যে কিসের বাগানবাগানের কোষ্টা যে-কী গাছ তার ঠিকুজি ঠিক করা আমার পক্ষে বাতুলতা। পত্র-পাঠ গাছ চেনা আমার অসাধ্য (প্রকৃতিরসিক আমাদের বিভূতি বাড়জ্যে মশাই-ই শুধুতা পারেন)—গাই আমার কাছে ওষুধের মতোই—সেই রকম ত্যাজ্য এবং কেবল ফলেন পরিচয়তে। গাহের কর্মফল না দেখে এবং স্বয়ং ফলভোগ করে কিছুতেই গাছ-চিনতে পারি না। কিন্তু এসব গাছের ফল দেখব তার যো কি?। তলায় পড়া দূরে থাক, গাছেই ভালো করে ধরতে পায় না—পাড়ার ছেলেরা এসে দেখতে না দেখতে ফাঁক করে দেয়। গাছে গাহেই তাদের ফলা, এসব বাগান হচ্ছে মা ফলেষু কদাচন। একমাত্র গীতার কর্মযোগী ছাড়া আর কেউ যে অস্মিন্ দেশে বাগান করার উদ্যোগ করে না তা নিশ্চয়। এখানে হচ্ছে একজনের বাগান এবং আর-সবার বাগাননা। এ বাগানে যদি পাড়ার ছেলেরা এসে এই বেপাড়ার পারাবতকে একলাটি ঘুর ঘুর করতে দেখে তাহলে যে এক মুহূর্ত ছেড়ে কথা কইবে না সে কথা খাঁটি।
খাবার সময়ে দেখা গেল মীনাক্ষি অতিশয় অবজ্ঞাভয়ে রেডিয়োর ওপরে বসে রয়েছে। আক্রমণাত্মক কোনো লক্ষণ ওর দেখা গেল না। যতুটা মারাত্মক ভাবা গেছল তা নয়; নিতান্তই নিরীহ একটি বন্য পারাবত! (পারাবত বা যাই হোক!) ক্রমেই দেখি মীনাক্ষি এগিয়ে এসে আমাদের থালার থেকে খাবার খুঁটে নিতে লাগল।
দেখতে দেখতে আমরাও মীনাক্ষির আসক্ত হয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিনেই অদ্বিতীয় পাখিরূপে আমাদের জীবনে কায়েম হলো। একটা বুনো সারস (অথবা বালিহাঁস যাই হোক)–যদিও কিঞ্চিৎ মনমরা—তবু গার্হস্থ্য জীব হিসাবে নেহাত মন্দ না। আর যাই হোক, যখন তখন ঘেউ ঘেউ বা ম্যাও ম্যাও নেই, কাউকে ধরে কামড়াবে না, কিংবা পাড়াপড়শীর বাড়ি গিয়ে চুরি করে দুধ মেরে আসবে না। পাড়াতুত গণ্ডগোল ল্যাজে বেঁধে আনবে না। একটা কক্ষকে আওয়াজ আছে বটে কিন্তু বকবক কম করে। তেমন বক্তা নয়, গানের আপদ নেই, শ্লোগানের বালাইও না।
পাখিটার আমরা প্রেমেই পড়ে গেলাম, বলতে কি! আমাদের পোষ্যকন্যারূপে ওকে গ্রহণ করারও প্রায় মনস্থ করে বসেছি এমন সময়ে বোকেন আর যতীনেব তরফ থেকে বাধা এল।
বোকেন এসে বললে : বাঃ বাবা! খাসা চালাচ্ছো! দিব্যি একটা খরচ বাঁচিয়ে ফেল্লে! বেশ বেশ বেশ!
ডিমের ভাবনা রইলো না। মন্দ কি। যতীন যোগ দিল সেই সঙ্গে।
তুখোর ছেলে! তবে একটু চশমখোর, এই যা! বোকেনের বক্র কটাক্ষ।
তোমরা বল কী? আমি আকাশ থেকে পড়ি।
বলব আর কী! ভাগ্যবানের ডিম ভগবানে যোগায়। তবে কথাটা এই, অপরের সম্পত্তি থেকে যোগানটা আসছে এই যা!
ডিম? আমার চমক লাগে : তোমাদের কি ধারণা যে–
আরে না না! বোকেনের ঠাট্টার সুর : তুমি কি আর ডিমের লোভে-কে বলে! তোমার দাতব্য অতিথশালায় গৃহহীন বন্য কুক্কুটরা এলে অমনিই আশ্রয় পায়।
গার্হস্থ চিড়িয়াখানা বলো। বলল যতীন। এদের দুজনকেই বা বাদ দিচ্ছ কেন?
এই রকম দিনের পর দিন ওদের কচকচি শুনতে হয়, অথচ মীনাক্ষি এদিকে একদিনও একটা ডিম পাড়েনি। ডিম তো পাড়েনি, তার ওপরে কদিন থেকে এমন মেজাজ দেখাতে আরম্ভ করেছে যে আমরা আর ওকে তালা দিয়ে রাখতে চাই না বরং তালাক দিতে পারলেই বাঁচি। এমন স্বার্থপর আত্মসর্বস্ব একগুয়ে পাখি এর আগে আর আমার নজরে পড়েনি—মনুষ্যত্ব দূরে থাক, পক্ষীত্বের লেশমাত্রও ওর নেই।
আজকেও ডিম পেড়েছে তো? এই প্রশ্ন মুখেকরে একদা প্রভাতে যেইনা বোকেনের প্রাদুর্ভাব, অমনি না আমি অম্লানবদনে মীনাক্ষিকে ওর করকমলে সম্প্রদান করে দিয়েছি। যতীনকে সাক্ষী করে।
এবং গদগদ কণ্ঠে বলতেও দ্বিধা করিনিঃ তোমাকে ঘরজামাই করতে পারলুম না, দুঃখ থাকল কিন্তু এই আমার অনুরোধ, আমাদের মীনাক্ষিকে তুমি সুখে রেখো। আর মীনাক্ষি মাকেও বলি, ও তোমার জন্য নিত্য নিয়মিত ডিম পাডুক।
ডিমের ওর বাড়-বাড়ন্ত হোক, সর্বান্তঃকরণে সেই প্রার্থনা করে মীনাক্ষিকে ওর সমভিব্যাহারে দিলাম। এবার ওর সুর বদলায় কিনা দেখা যাক। দিনকয়েক গেল, বোকেনের কোনো বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। তবে কি মীনাক্ষিই তার সুর বদলালো না কি?
কি হে, কিরকম ডিম্বলাভ চলছে? কৌতূহলী হতে হলে আমায়।
প্রত্যেকদিন একটি করে ফাঁক নেই। বোকেন সহাস্যবদন, বন্যকুক্কুট হলে কি হবে, সভ্যতায় অভ্রভেদী!
বলো কী! আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না।
তুমি একটা অপদার্থ! কী করে ওদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় জানো না। রাত দিন রেডিয়োর বাত্ময় বসিয়ে রাখলে কি আর ডিম পাড়ে? গানের দিকে কান থাকলে ডিমের দিকে মন দিতে পারে কখনো? বাগানে দুবেলা দৌড় করাতে হয়। একসারসাইজ দরকার—যেমন আমাদের তেমনি ওদেরও। দুবেলা আমরা ওকে নিয়ে সারা বাগান চষছি——আমি একবেলা, গিন্নী আরেক বেলা। তবে তো ফলছে ডিম!
বোকেন ওদের ঘোড়দৌড় দেখবার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ করল, কিন্তু বন্য পশুপক্ষীর কীর্তিকলাপ আর কী দেখব? তাছাড়া মীনাক্ষির আচরণে প্রাণে বড় ব্যথা পেলাম। ও যে এতটা বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারাম হবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আর অমন পাখির মুখ দ্যাখে?
সমস্ত শুনে যতীন তো খাপ্পা। বাঃ, মীনাক্ষি ওর একলার না কি? ওতো এজমালি সম্পত্তি। কেন, আমাদের কি বাগান নেই, না, আমরা ঘোড়দৌড় করাতে জানিনে? আমাকে যদি ও মীনাক্ষির ভাগ না দেয় তো আমি সোজা আদালতে যাব। আমার সাফ কথা আমি বলে রাখলাম।
ঘোড়দৌড়টা আদালতের দিকে গড়ালে নেহাত মন্দ হয় না, এবং দৌড়বাজিতে ঘোড়ার সংখ্যা যত বাড়ে দৃশ্য হিসাবে ততই আরো দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভাবনাটা বোকেনের কাছে গিয়ে ব্যক্ত করতে চেহারা ও নামের মধ্যে যতটা আশ্বাস ছিল আসলে বোকেন তত বোকা নয় দেখা গেল—সে বলে ওঠে-ঠিক কথাই তো! কালকেই মীনাক্ষি ওর বাগানে যাবে, আসছে হপ্তাটা ওর পালা! মীনাক্ষি এই ভাবে আমাদের সবার হাত ঘুরবে, সেই তো ন্যায্য!
বোকেন তার কথা রাখল। রাত্রি প্রভাত হওয়া মাত্র, মীনাক্ষিকে স্বহস্তে যতীনের হাতে সঁপে দিয়ে এল।
বিকেলের দিকে স্টেশনে আমাদের দেখা হতেই, বোকেন আমাকে আড়ালে ডেকে বললে: ওহে শোননা, তোমার সঙ্গে আর হলনা করতে চাইনে। তুমি ঠিকই বলেছিলে। মীনাক্ষি একদম বাঁজা।
তবে এই যে বলে সেদিন, তোমার প্রক্রিয়ায় বেশ সুফল দেখা দিয়েছে।
কাঁচকলা! তোমাকে যা বলেছিলাম তা স্রেফ প্রচার কার্য! সিনেমা কোম্পানিতে পাবলিসিটি অফিসারের চাকরি করতাম সেটা কেন ভুলে যাচ্ছ? আর, কথাটা রটিয়েছি ওই যতনেটার জন্যেই। মীনাক্ষি ডিম পাড়ছে জানলে ও নগদ টাকায় আমাদের অংশগুলো কিনে নিতে রাজি হবে। ওর যা ডিমের লোভ! দেখো, ঠিক ও মীনাক্ষিকে একচেটে করে নিয়েছে, তুমি দেখে নিয়ে।
কিন্তু মীনাক্ষি যদি ডিমই না পাড়ে—আমি হতবুদ্ধি হই।
তোমাকে কি আর সাধে বোকা বলি! বোকেন বলল আরে না পেড়ে যাবে কোথায়? ওরা কতগিন্নীতে দুবেলা মীনাক্ষির সঙ্গে হানড্রেড ইয়ার্ডস দেবে তো সারা দিন বাগানেই ছাড়া থাকবে মীনাক্ষি। সেইসময়ে কোনো ফাঁকে বাগানের কোথাও একটা ডিম ফেলে দিয়ে আসার মামলা। সে ভার আমার উপর থাকলো। বুঝলে এবার?
বুঝলাম বই কি! নাঃ, বোকেন তার নামের দারুণ অমর্যাদা করছে—ওইসূত্রে সেই কথাটাও আরো বেশি বুঝলাম। সেই সঙ্গে, ওর তুলনায় নিজেকেও নিখুঁতরূপে টের পেলাম এতদিনে।
সপ্তাহ ফুরুতেই যতীনের ওপরে আমাদের নোটিশ পড়ে গেল। মীনাক্ষির পালা তার খতম।
তা—তাতে কী হয়েছে? ও ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল : কাল সন্ধ্যেয় আমার বাড়ি তোমাদের নেমন্তন্ন। সেই সময়ে সবাই মিলে ভদ্রভাবে মীনাক্ষির বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
ওষুধ ধরেছে তাহলে। ও একাই মীনাক্ষির অভিভাবক হতে ইচ্ছুক। শুধু মুখরোচক খাদ্যের সঙ্গে সামাজিক ভদ্র মিশিয়ে মীনাক্ষির দরটা একট নামাতে চায় মাত্র—ভেবে এমন হাসি পেল! হায় কাল বাদ পরশু সকাল থেকে ডিম পাড়া যখন বন্ধ হবে, তখন মীনাক্ষি প্লাস আমাদের প্রতি তার এই আদরের পরিণতি কী দাঁড়াবে তাই ভাবি। যাই হোক, সাক্ষ্য ভোজে তো গেলাম আমরা। বোকেন এবং শ্রীমতী বোকেন; আমি আর আমার বুদ্ধিমতী।
সন্ধ্যেটা কাটলো বেশ। ভারতীয় চায়ের সঙ্গে স্বদেশী মাংসের পিঠে—খারাপ কি?
টেবিল থেকে পেয়ালা পিরিচ সরে যেতেই বোকেন খুকখুক করে কাশল। ব্যাস কাশি নয়, ভদ্র কাশি, ভদ্রভাবে আলোচনা শুরু করার পূর্বাভাস।
আচ্ছা, এইবার আমরা মীনাক্ষির ভবিষ্যৎ নিয়ে—আরম্ভ করল বোকেন।
শুনে যতীনের শ্রীমতী তো হেসেই কুটোপাটি। যতীনও একটু হাসল, যৎসামান্য, সচরাচর বুদ্ধমূর্তির আননে যে ধরনের রহস্যময় হাসি দেখা যায়।
তোমাদের বলতে দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু না জানিয়েও উপায় নেই। বলল যতীন: বেচারী মীনাক্ষির কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
য়্যাঁ?–বোকেনের চোয়াল ঝুলে পড়ে।
আমাদের ঈষৎ ভুল হয়েছিল—এমন কিছু না—এই লাক্ষণিক ভুল। যতীন তেমনি অমায়িক : কিন্তু মীনাক্ষি যেদিন আমার হাতে এল, সেইদিনই কলকাতা থেকে আমার শ্যালক এলেন–তিনি ভেটারনারি ডাক্তার। দেখবামাত্রই মীনাক্ষির অবস্থা তিনি ধরতে পারলেন। তখনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
কী পরিষ্কার হলো, শুনি? শুনে আমিও একটু গরম হই। আসল কথার পাশ কাটাবার এই চাল আমার ভালো লাগে না।
জানা গেল যে—বলতে দ্বিধা করল না যতীন মীনাক্ষি আসলে হচ্ছে মীনাক্ষ। এই তথ্যের গুঢ়তা গাঢ় হয়ে যতই আমাদের মর্মে প্রবেশ করে ততই তার মর্মান্তিক তীক্ষতা আমরা টের পাই।
ডিম পাড়া তার ক্ষমতার বাইরে। যতীন-গিন্নি কোন রকমে একটুখানির জন্য হাস্যসম্বরণ করে আমাদের আলোচনায় এই মন্তব্যটুকু যোগ করতে পারলেন। এবং তার পরেই আরেক প্রস্থ হাসি আঁকে পেয়ে বসল আবার!
আমরা আর কোনো কথাটি না বলে নিজের গৃহিণীদের সংগ্রহ করে উঠে পড়লাম। নিঃশব্দেই।
অমায়িক যতীন আর আহ্লাদে আটখানা ওর বৌদরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল আমাদের।
বাগানে পা দিয়ে বোকেন বললে? যাই হোক মীনাক্ষি কোথায়? তাকে দেখছিনে কেন?
মীনাক্ষি শ্ৰীমতী যতীন থেমে থেমে জানালেন : সেই পিঠের মধ্যে ছিল।
সেও অতীতের কথা। এখন পেটের মধ্যে, সেই কথাই বলো! বলল যতীনতোমার বন্য সারসটা বেশ সরস হিল হে। বলে কটাক্ষ করল আমার দিকে।
আমরা আর দাঁড়ালুম না। উদরস্থ মীনাক্ষিকে ধরে আমরা পাঁচ জন আমাদের সোজা পথ ধরলুম।
হ্যাঁ, ভালো কথা। পেছন থেকে হেঁকে বলল যতীন : কদিন ধরে তোমরা যে ডিমগুলো পাঠিয়েছ তার জন্যে ধন্যবাদ। সবগুলো মুরগির ছিল না, কয়েকটা হাঁসের ছোট ডিম ভেজাল দিয়েছিলে; তার মধ্যে, এটা আবার গিন্নী বলছিলেন, একটু পচাই। নাকি! যাকগে, যা বাজার, আর যেরকম মাগ্যি গণ্ডা, আর যেমন দিনকাল পড়েছে তাতে ওই নিয়ে আমরা কোনো বচসা করতে চাইনে।