৭. বরুণার বিয়ে

০৭.

বরুণার বিয়ে।

বিয়েবাড়ির আনন্দটা ঠিক কানায় কানায় ভরে ওঠে নি। অবশ্য আমন্ত্রিত অভ্যাগতজনেরা কেউ কিছু অনুভব করেন নি। বিজন আর ননিমাধবের সাড়ম্বর ব্যবস্থায় কোন ত্রুটি নেই। সেদিক থেকে বিয়ে-বাড়ি সরগরম। আদর-অভ্যর্থনা, হাসি-খুশ, মাঙ্গলিক, উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনির ছড়াছড়ি।

এরই তলায় তলায় শুধু বাড়ির মানুষ ক’টির মনে একটা চাপা অস্বস্তি ক্রমশ থিতিয়ে উঠেছে। এমন কি ঘর্মাক্তকলেবর দাশু পর্যন্ত সহস্র কাজের ফাঁকে গাছকোমর শাড়ি-জড়ানো কর্মব্যস্ত বড় দিদিমণিকে দেখে বিমনা একটু। ও সামনাসামনি হলে বিজনের মুখে গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ছে, মিসেস বাসু কলমুখর ব্যস্ততার মধ্যেও স্পষ্টই কিছু বলার ফাঁক খুঁজেছেন, আর ডক্টর বাসুও ওর দিকে চেয়েই অন্যমনস্ক হয়েছেন।

বিয়ে-বাড়িতে এখনো একজনের দেখা নেই।

সকলের সংশয়, হয়তো এর পর আর আসবেও না।

অর্চনাই শুধু এখনো ভাবছে না যে আসবে না। ভাবতে পারছে না।

পিসিমা যাবার পর থেকে এ পর্যন্ত একটা রাতও সে বাপের বাড়িতে থাকে নি। মায়ের ক্ষোভ, দাদা-বউদির অনুরোধ, বরুণার অভিমান, এমন কি বাবার অনুরোধ সত্ত্বেও না। শেষের এই কটা দিনও খুব সকালে এসেছে আর যত রাতই হোক ফিরে গেছে। আর সেই কারণে ঘরের মানুষটাকে ভিতরে ভিতরে সদয়ও মনে হয়েছে একটু। ওর এত পরিশ্রম আর ছোটাছুটি দেখে দিনতিনেক আগেও সে ওকে বলেছে, এই কটা দিন তুমি সেখানে থাকতে পার, আমার কোন অসুবিধে হবে না।

অর্চনা নিরুত্তাপ জবাব দিয়েছে, আমার হবে।

প্রগলভ সান্নিধ্যে এসে অর্চনা হয়তো অন্য কিছু বলতে পারত। আরো নরম, আরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে আসার মতই কিছু। কিন্তু ইতিমধ্যে পিসিমার কাছে চিঠি লেখা, পিসিমাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা বা ওর নিজের হরিদ্বারে যাওয়া নিয়ে আরো একাধিক রাত্রি নিঃশব্দে ওকে চোখের জল ফেলতে হয়েছে। সবকটা আবেদনের বিকৃত প্রতিফলনে রূঢ় আঘাত পেয়েই ফিরে আসতে হয়েছে। সে-আঘাত আজও থেকে থেকে টনটনিয়ে ওঠে।

দিনসাতেক আগে বাবা নিজে এসেছিলেন বড় জামাইয়ের কাছে। বলেছেন, সব দেখে-শুনে করে-কর্মে দিতে হবে, বলেছেন বাড়ির সকলেরই তো মাথা গরম কাজের কাজ কারো দ্বারা হবে না।

সব দেখে-শুনে করে-কর্মে দেবার জন্য যাবে, সুখেন্দু এমন কথা মুখে অবশ্য বলে নি। যায়ও নি। যাক, অর্চনাও মনে মনে চায় নি সেটা। মায়ের ভাবগতিক আর দাদার বড়লোকী কাণ্ডকারখানা জানে। এই লোকের এই মানসিক অবস্থায় আগের থেকে যাওয়া মানেই গোলযোগের সম্ভাবনায় পা বাড়ানো।

তা বলে বিয়ের রাতেও আসবে না এমন সংশয় অর্চনার মনে রেখাপাতও করে নি। কিন্তু যতই সময় যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে দমেই যাচ্ছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লোকজনের আনাগোনার দিকে সচকিত দৃষ্টিনিক্ষেপ করছে।

কাঁচা ক্ষতর ওপর অতি নরম পালক বুলেলেও অসহ্য লাগে অনেক সময়। বড় জামাইয়ের খোঁজে ঘনিষ্ঠ অভ্যাগতদের স্বাভাবিক জিজ্ঞাসাবাদও বাড়ির মানুষদের সেই রকমই লেগেছে। ছোটখাটো উৎসব-অনুষ্ঠানে বা সামাজিক যোগাযোগে বড় জামাইটির সাক্ষাৎ কেউ বড় পায় নি বললেই চলে। অর্চনার বিয়ের পর অনেকেই হয়তো আর চোখেও দেখে নি তাকে। কাজেই এক বিয়েতে এসে ছোট জামাইয়ের প্রসঙ্গ থেকে বড় জামাইয়ের তত্ত্ব-তালাসটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনেকে হয়তো কথায় কথায় নিছক সৌজন্যের খাতিরেই জিজ্ঞাসা করেছেন, বড় জামাই কোথায় বা বড় জামাইকে দেখলাম না! কিন্তু সেটুকুই বক্ত কৌতূহলের মত লেগেছে বাড়ির লোকেদের। বিজনের চাপ রোষ, মায়ের তার দ্বিগুণ, এমন কি বাবাও বিব্রত একটু।

সুস্থির বোধ করে নি অর্চনা নিজেও। একটু আগেই এক বান্ধবী সামনাসামনি চড়াও করেছিল ওকে, কি রে অর্চনা, তোর বরকে দেখছি না…কই?

অর্চনা হাসতে চেষ্টা করে ভ্রূকুটি করেছে–কেন, নিজেরটাতে পোষাচ্ছে না?

 বান্ধবী অনুযোগ করেছে–থাক খুব হয়েছে, দু-বছর ধরে তো এমন আগলে আছিস যে একটা দিনও দেখলাম না ভদ্রলোককে।

অর্চনা বলেছে, তাহলে আর একটু ধৈর্য ধরে থা–এলেই দেখতে পাবি।

তখনো ধারণা, আসবে।

তার পর ইলা-মাসি জিজ্ঞাসা করেছে, ইলা-মাসির ছেলে মিন্টু খোঁজ করেছে, মাস্টার মশাই কোথায়?

নিচে এসেছিল বরুণার জন্যে এক গেলাস সরবত নিতে। বউদি এসে চুপি চুপি জানাল, এ বড় বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে…সবাই সুখেনবাবুর খোঁজ করছে, তোমার দাদা তোমাকে একবার টেলিফোন করতে বলছিল।

অর্চনা সরবত নিয়ে পাশ কাটাল। গম্ভীর মুখে বলে গেল, ইচ্ছে হয় তুমি কর গে–

বর এসেছে শুনে দোতলার মেয়েরা সব হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। হাতের গেলাস বাঁচিয়ে অর্চনার উপরে উঠতেও কম সময় লাগল না। তাদের বর দেখার হিড়িকে কনে-সাজে বরুণা ঘরে একা বসে। দিদির মুখের ওপর চোখ রেখে সরবতের গেলাস হাতে নিল। তার পর ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল দিদি, জামাইবাবু এলো না রে?

অর্চনা থমকে তাকাল একটু। তার পর অনুশাসনের সুরে বলল, তোমার নিজের ভাবনা ভাব এখন–ওদিকে এসে গেছে।

দাঁড়াবার সময় নেই যেন, তাড়াতাড়ি বাইরে এলো। নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় বাবার ঘরের কাছাকাছি এসেছিল, সেইখানেও এই একজনের অনুপস্থিতির কারণে বাবা মায়ের বচসা কানে এলো… অর্চনা চুপচাপ সরে গেল। ডক্টর বাসু ঘরে এসেছিলেন আর একবার টেলিফোন করতে। টের পেয়ে মিসেস বাই সেই নিরিবিলিতে এসে চড়াও হয়েছেন।

তিনবার তো টেলিফোন করলাম, সাড়া না পেলে কি করব?–ডক্টর বাসু বিরক্ত।

সাড়া না দিলে সাড়া পাবে কি করে!–রাগে অপমানে মিসেস বাসু ক্ষিপ্ত। –আমাদের মুখে চুনকালি দেবার জন্যেই এ বিয়েতে সে আসছে না জেনে রাখো। কি লজ্জা, কি লজ্জা! যার সঙ্গে দেখা হয় সে-ই জিজ্ঞাসা করে বড় জামাই কোথায়? আমি আগেই জানতুম সে আসবে না–ওরা আজকাল একঘরে থাকে না পর্যন্ত সে খবর রাখো?

খবরটা ডক্টর বাসু স্ত্রীর মুখেই আজ পর্যন্ত অনেকবার শুনেছেন। বললেন, এ সব কথা থাক এখন, ওদিকে ডাকাডাকি পড়ে গেছে।

বিয়ের লগ্নও উপস্থিত একসময়। ছাদে বিয়ে। বাড়িসুদ্ধ লোক সেখানে ভি করেছে। এদিকটা ফাঁকা। অর্চনা পায়ে পায়ে বাবার ঘরে চলে এলো। আন্তে আস্তে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিল। নম্বর ডায়েল করল।

টেলিফোন বেজে চলেছে। অর্চনার শান্ত প্রতীক্ষা। ওদিক থেকে রিসিভার তোলার শব্দ এলো কানে। কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায় সাতে করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরল।

কণ্ঠস্বর নয়, ওদিকে রিসিভারটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে রাখার শব্দ একটা। অর্চনা ফ্যাল ফ্যাল করে নিজের হাতের রিসিভারের দিকে চেয়ে রইল খানিক, আবারও কানে লাগাল ওটা। আর কোন সাড়াশব্দ নেই।

রিসিভার যথাস্থানে নামিয়ে রেখে বাবার বিছানায় এসে বসল সে।

কিছু একটা কাজেই হয়তো মিসেস বাসু ব্যস্তমুখে ঘরে ঢুকেছিলেন। মেয়েকে ও-ভাবে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। নীরব দৃষ্টি-বিনিময়। রুদ্ধ আক্রোশে যেন হিসহিসিয়ে উঠলেন তিনি, জামাই বলে তাকে আমি ছেড়ে দেব না, এ অপমানের কৈফিয়ত আমি নিয়ে ছাড়ব।

অর্চনা চেয়েই আছে।

মিসেস বাসু কটুক্তি করে উঠলেন, আগে যদি জানতুম এত ছোট, এত নীচ–

মা!

মা থতমত খেয়ে থেমে গেলেন। অর্চনা তাঁর পাশ কাটিয়ে সবেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অসহিষ্ণু প্রতীক্ষা। বিয়ে হয়ে গেছে। বরকনেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হালফ্যাশানের বিয়ে, রাত দশটা সাড়ে দশটার মধ্যে বিয়েবাড়ি অনেকটা হালকা। অর্চনা চুপচাপ নিচে নেমে এলো। ড্রাইভারকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গাড়িতে উঠল। এত গাড়ি আসছে যাচ্ছে তখন–কেউ লক্ষ্য করল না।

.

দরজা খুলে সাবি বিস্ময় প্রকাশ করার আগেই অর্চনা সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

বারান্দার দিকের দুটো ঘরের দরজাই আবজানো। দুই-এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে অর্চনা নিজের ঘরের দরজা ঠেলে ভিতরে এসে দাঁড়াল। ঘরে আলো জ্বলছে। পাশের ঘরেও। টেবিলের ওপর চোখ পড়তেই স্তব্ধ রোষে সমস্ত মুখ কাগজের মত সাদা।

টেলিফোনের রিসিভারটা টেবিলের ওপর পড়ে আছে তখনো। মাঝের দরজার দিকে এক ঝলক আগুন ছড়িয়ে রিসিভার তুলে রাখল। তার পর এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে বসে বই পড়ছে।

অর্চনার শিরায় শিরায় রক্তের বদলে আগুনের স্রোত। এক ঝটকায় তার হাত থেকে বইটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রায় চীৎকার করে উঠল, আমি জানতে চাই এর অর্থ কি?

সুখেন্দু চমকেই উঠেছিল। চুপচাপ তার মুখের দিকে খানিক চেয়ে থেকে উঠে মেঝে থেকে বইটা কুড়িয়ে নিয়ে আবার এসে বসল।-কিসের অর্থ?

আমাকে এভাবে অপমান করার অর্থ কি?

অপমান কিসের…তোমাদের ও-বাড়িতে যে আমি যাব না এ তুমি জানতে না?

কেন? কেন যাবে না?–অর্চনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল আবারও।

হাতের বইটা টেবিলে রেখে সুখেন্দু জবাব দিল, যাব না তার কারণ সেখানে গেলে তোমার মা যে-ভাব দেখান, যে-ব্যবহার করেন আর যে-উপদেশ দেন তাতে আমিও খানিকটা অপমান বোধ করি।

আমার মা উপদেশ দেবে না তো উপদেশ দেবে বাইরের লোক এসে?

উপদেশ হলে কিছু বলতাম না, তিনি অপমান করেন–তোমাদের ও-বাড়ি আমি বরদাস্ত করতে পারি নে।

তা পারবে কেন?…রাগে কাঁপছে অর্চনা, নিজের নেই বলে যাদের আছে হিংসেয় তাদের কাছেও ঘেঁষতে চাও না, কেমন?

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সুখেন্দু রূঢ় কঠিন জবাব দিল, হিংসে করার মত তোমাদের কিছু নেই, সেটা জানলে এ কথা বলতে না। আমার বরদাস্ত করার থেকেও, তুমি আমার মত একজনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারবে কি না সে কথাটাই তোমার আর তোমার বাবা-মায়ের আগে ভাবা উচিত ছিল।

কোন্ কথায় কোন কথা আসছে কারো হুঁশ নেই। আত্মসংবরণের চেষ্টায় অর্চনা টেবিলে একটা হাত রাখতে সেই বইটাই হাতে ঠেকল আবার। উষ্ণ ঠেলায় টেবিল থেকে পাঁচ হাত দূরে মাটিতে ছিটকে পড়ল ওটা। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, বাবা-মার কথা থাক, আমি নিজে সব দিক ভেবেই এ-বাড়িতে এসেছিলাম সেটা তুমি টের পাও নি? কিন্তু তুমি? আজ এত বড় অপমানের মধ্যে আমাকে ঠেলে দিতেও তোমার মায়া হয় নি। মানিয়ে চলার দায়িত্ব শুধু আমারই, তোমার নয়?

স্থির নেত্রে খানিক চেয়ে থেকে সুখেন্দু জবাব দিল, না। পিসিমাকে যেদিন তাড়াতে গেছে সে দায়িত্ব সেদিনই গেছে।

কি বললে।… অর্চনা অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল প্রায়।

উত্তেজনা দমন করার জন্য সুখেন্দু উঠে মেঝে থেকে বইটাই কুড়িয়ে আনল আবার।

অর্চনার দুই চোখে সাদা আগুন। অনুচ্চ স্বরে বলল, তুমি অতি ছোট অতি নীচ…

আর দাঁড়ানো সম্ভব হল না, এক ঝটকায় ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে।

.

ভাঙার পর্ব শেষ।

 সকল সংগতির মাঝখান দিয়ে ভবিতব্যের ছুরি চালানো শেষ।

যে-কোন তুচ্ছ উপলক্ষে শান্ত বিচ্ছিন্নতা সম্ভব এখন।

এর পরের তিন মাসে, একটা নয়, এমনি অনেকগুলো উপলক্ষের সূচনা। পাশা পাশি দুটি ধরের দিনাবসানের মাঝে নির্বাক চিত্রের মতই সেগুলির আনাগোনা। অর্চনা নির্বাক দ্রষ্টা।

… চা নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছে, আর একজন বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নামছে। চায়ের সরঞ্জাম হাতে অর্চনা দেওয়ালের দিকে একটু ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সুখে নেমে চলে গেছে। অর্চনা দাঁড়িয়ে দেখেছে। তারপর আস্তে আস্তে দোতলার বারান্দায় এসে দেয়ালের ধারে চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে বসেছে। ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে বুকের জামা ধরে ছদ্ম অনুশাসনে এই একজনকেই ওপরে টেনে নিয়ে এসেছিল। এই সেদিনের কথা, দু-বছরও নয়। কিন্তু বহুদিন যেন-বহু-দুরের কোন এক দিন।

…রাতে নিচের খাবারের টেবিলে দুজনের মুখোমুখি বসে আহারের যোগ টুকুও বিচ্ছিন্ন। অর্চনা যথাসময়ে টেবিলে প্রতীক্ষা করেছে। সাবি এসে টেবিল থেকে সুখেন্দুর খালাবাটি সব তুলে নিয়ে গেছে।–দাদাবাবু ওপরে খাবেন, দিয়ে আসতে বলেছেন–নিয়ে গেছে। অর্চনা চেয়ে চেয়ে দেখেছে। সে-দিন অন্তত ওর খাওয়া আর হয় নি। উঠে চুপচাপ নিজের ঘরের পাটের কোণে এসে বসেছে। ও-ঘরের আহার সমাধা হল টের পেয়েছে–তারপর ঈজিচেয়ারে বসে রাতের পাঠে মগ্ন। আলো নিবেছে এক সময়।…গাত্রোখান, শয্যালয়, ঘুম। এ-ঘরের আলো জ্বলছে। মাঝের দরজা দিয়ে সেই আলোর খানিকটা ও-ঘরে গিয়ে পড়েছে। সেই আলোর ওপর ছায়া পড়েছে একটা। মাঝের দরজায় অর্চনা এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই আছে। ও-ঘরে সুপ্তির ব্যাঘাত ঘটে নি।

…খাটে অর্চনা বসে নিষ্প্রাণ মূর্তির মত, তার সামনেই একটা চেয়ারে বিজন বসে। সে-ও বিস্মিত, কিছুটা বিভ্রান্ত। কলেজ থেকে সুখেন টেলিফোনে বিজনকে জানিয়েছে, শিগগিরই সে এক মাসের জন্য বাইরে যাচ্ছে, কেউ এসে যেন অর্চনাকে নিয়ে যায়। বিজন নিতে এসেছে। অথবা অর্চনা কিছুই জানে না। তাই বিস্ময়, সেই সঙ্গে অস্বস্তি। এ-বাড়ির বাতাসের গতি তারাও উপলব্ধি করতে পারে। মা হাল ছাড়তে বাবা নিজেই হাল ধরতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু অর্চনাই জামাইয়ের সঙ্গে কোন যোগাযোগ ঘটতে দেয় নি তার। নীরবে মাথা নেড়ে বাধা দিয়েছে। অস্বস্তি চেপে বিজন বসে থাকতে পারে নি বেশিক্ষণ, বলে গেছে, সুখেন্দু চলে গেলেই না হয় এসে তাকে নিয়ে যাবে। অর্চনা জবাব দেয় নি। কখন উঠে চলে গেছে তাও হুঁশ নেই।

উপলক্ষগুলি এই রকমের।

এমনি আরো দুটি ঘটনার পর উপলক্ষেরও প্রয়োজন থাকল না আর। একটা রাতের ঘটনা, অন্যটা দিনের।

ঘরের আলো নিবিয়ে সুখেন্দু শুয়ে পড়তেই মাঝের দরজা দিয়ে ও-ঘরে আলোর ঝলক তার অন্ধকার শয্যার কাছাকাছি এসে থেমে আছে। বিছানায় গা ঠেকালেই ঘুম হয়, তবু কি জানি কেন সেদিন ওই আলোটুকুই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে লাগল এবং বিরক্তির কারণ হয়ে উঠল। শেষে একসময় উঠে এসে সরাসরি দরজাটা বন্ধ করে দিল।

অর্চনা জানালার কাছে রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। কিছুই দেখছিল না, এমনিই দাঁড়িয়েছিল। শব্দ শুনে ফিরে তাকিয়ে দেবে, মাঝে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। নিজের অগোচরে দুই-এক পা সরে এলো। নিল র পর।. পাকাপাকি ব্যবধান রচনা, পাকাপোক্ত জবাব। দরজা বন্ধ হতে ঘরের আলোটা জোরালো লাগছে, হলদে, দরজাটা চকচক করছে। একটা অশুভ ইজিত চকচকিয়ে উঠছে যেন।

অর্চনা আলোটা নিবিয়ে দিল।

পরদিন।

অর্চনা তখন নিচে স্নানের ঘরে।

মেঝেতে উবুড় হয়ে সুখেন্দু মায়ের সাবেকী আমলের বড় ট্রাঙ্কটা খুলে বসেছিল। ট্রাঙ্কটা তার এই ঘরেই। গরম জামা-কাপড় সব ওতেই থাকে। বাইরে বেরুতে হলে যা-যা নেবে বার করে রোদে দিয়ে ঠিকঠাক করে রাখা দরকার। তাছাড়া কি আছে না আছে তাও স্মরণ নেই।

তার পিছনে সাবি দাঁড়িয়েছিল। একটু অপেক্ষা করে সে যে চলে গেছে সুখেন্দুর খেয়াল নেই। মেঝের চাবির গোছাটা একটু জোরেই পিছন দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, এটা রেখে এসো।

চাবিটা সড়সড় করে টেবিলের নিচে গিয়ে থামল। যা-যা বার করেছিল একবার পরীক্ষা কবে সুখেন্দু সেগুলো নিয়ে ছাতে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁটা হাতে হরিয়া ঘরে ঢুকেছে। দাদাবাবু দু-দশ মিনিটের জন্যে ঘর থেকে না বেরুলে ঘর ঝাঁট দেবার অবকাশ হয় না। এই কাজটুকু সারবার জন্য সকালের মধ্যে অনেকবারই ফিরে যেতে হয় আর সুযোগের প্রতীক্ষা করতে হয়।

টেবিলের নিচে চাবিটা চোখে পড়ল। হরিয়া ওটা তুলে সামনের দোলকের কোণে রেখে দিয়ে গেল।

অর্চনার সেই চাবির খোঁজ পড়ল দুপুরে খেতে নামার আগে। মোজই খেতে যাবার আগে চাবি নিয়ে নামে। আসার সময় ভাড়ার রামার সব বন্ধ করে আসে।

বিছানা উল্টে-পাল্টে অর্চনা চাবি খুজছে। অবাক একটু।

এদিকে দেরি দেখে সাবি তাড়া দিতে এসে জিজ্ঞাসা করল কি খুঁজছ, চাবি?

কিছু না বলে অর্চনা শুধু তাকাল তার দিকে।

সাবি জানাল, বউদিমণি ধরে ছিল না বলে দাদাবাবু বিছানার নিচে থেকে চাৰিটা তাকেই এনে দিতে বলেছিল। চাবি দাদাবাবুর কাছেই।

অর্চনার মুখের দিকে চেয়ে সাবি যে-জন্যে এসেছিল তা আর বলা হল না, পায়ে পায়ে প্রানি করল। অর্চনা খাটের বাহু ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় বসে পড়ল। নির্বাক, অনুভূতিশূন্য।…শুধু এটুকুই বাকি ছিল। এইটুকুই শুধু বাকি ছিল। মাঝের দরজার দিকে চোখ গেল।

দরজা বন্ধ।

বিকেল থেকেই আকাশের রঙ অন্যরকম। সূর্যাস্তসীমার ওধারে কালো মেঘের ভিড়। একটার সঙ্গে আব একটা জুড়েছে, আর একটার সঙ্গে আর একটা। ছেঁড়া ত্বকের মত মেঘের গা-ছেঁড়া দগদগে লাল আলো। বিকেল শেষ হতে না হতে পাটকিলে রঙের অন্ধকারে ঘর ছেয়ে গেল।

অর্চনা উঠল এক সময়। আলো জ্বালল।

ও-ঘরের আলো জ্বলতে সে এসেছে টের পেল। আবার বেরুলো, তাও। ঘণ্টা দুই বাদে ফিরে আসাটাও। সাবি যথারীতি রাতের খাবার রেখে এ-ঘরে এলে তাগিদ দিতে। দুপুরেও খাওয়া হয় নি বউদিমণির, তাই রাত্রিতে আর ভাত ঢেকে রেখে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সে। অর্চনা জানালার কাছ থেকে একবার ফিরে তাকিয়েছে শুধু। একটা অজ্ঞাত অস্বস্তি চেপে সাবি ফিরে গেছে।

দূরে দূরে ক্ষীণদ্যুতি তারাগুলোর অসময়ে ঘরে ফেরার তাড়া। টুপটুপ করে একটার পর একটা নিবেছে। মেঘের পায়তাড়া চলছে সেই থেকে। টিপটিপ দুই এক ফোঁটা পড়ছে কখনো-সখনো। বর্ষণের নাম নেই, ভ্রুকুটি বেশি।

রাস্তার লোক-চলাচল কমে আসছে।

টেবিলের টাইমপীস ঘড়িটায় রাত দশটা বাজে।

সুখেন্দু ঈজিচেয়ারে শুয়ে নিবিষ্ট মনে বই পড়ছে। শান্ত মুখে অর্চনা বারান্দা দিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। বাইরে থেকেই দু-চার মুহূর্ত দেখল। তারপর ঘরে ঢুকে পায়ে পায়ে সামনে এসে দাঁড়াল।

বই নামাও। কথা আছে!

 সুখেন্দু বই নামাল, তাকাল।

খুব শান্ত কণ্ঠে অর্চনা বলল, বিয়ের পর থেকে আমাদের বনিবনা হল না, সেটা বোধ হয় আর বলে দিতে হবে না?

একটু থেমে নিস্পৃহ জবাব দিল, সে তো দেখতেই পাচ্ছি।

অৰ্চনার দুই চোখ তার মুখের ওপর সংবদ্ধ।–তাহলে চিরকার এভাবে চলতে পারে না বোধ হয়?

সুখেন্দু নিরুত্তর। চেয়ে আছে।

অর্চনার মুখের একটা শিরাও কাঁপছে না। কণ্ঠস্বর আরো ঠাণ্ডা, আরো নরম। বলল, আমাদের তাহলে ছাড়াছাড়ি হওয়াই ভাল, কেমন?

সুখের মুখে চকিত রুক্ষ ছায়া পড়ল একটা। তার পর স্থির সে-ও।– কি করে?

অর্চনা তেমনি শান্তমুখে বলল, আইনে যেমন করে হয়।

আত্মস্ত হবার জন্য সুখেন্দু হাতের বইখানা টেবিলে রাখল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরে পায়চারি করল একবার। আবার বসল। ভাবল কিছুক্ষণ।

অর্চনা জবাবের প্রতীক্ষা করছে।

সুখেন্দু জবাব দিল। বলল, যদি তাই চাও আমার দিক থেকে কোন বাধা আসবে না।

আর একটুও অপেক্ষা না করে ধীর শিথিল পায়ে অর্চনা এ-ঘরে চলে এলো। টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে বসল। ভাবলেশহীন পাথরের মূর্তি।

বেশিক্ষণ বসে থাকা গেল না। উঠল। আস্তে আস্তে আবার ওই জানালার কাছেই দাঁড়াল।

দাঁড়িয়ে আছে।

রাত বাড়ছে। নিচের রাস্তাটা নিঝুম। অবসানের মুহূর্তগুলি শূন্যতার মন্ত্রে নিটোল ভরাট হয়ে উঠছে ক্রমশ।

স্তব্ধতায় ছেদ পড়তে লাগল। বাতাস দিয়েছে। বিকেল থেকে আকাশের যে সাজ-সরঞ্জাম শুরু হয়েছিল সেখানে তাড়া পড়েছে। অনার হুঁশ নেই। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে তেমনি। খোলা চুল উড়ছে। শাড়ির আঁচলের অর্ধেক মাটিতে লুটিয়েছে।

বাতাসের জোর বাড়তে লাগল। মেঘে মেঘে বিদ্যুতের চলাফেরা, বাতাসে ঝড়ের সংকেত। অদূরে গাছ দুটোর সসড় মাতামাতি। লাইট পোস্টের আলোগুলো কবলিত মেয়ের মত বিড়ম্বিত, নিষ্প্রভ।

ঝোড়ো বাতাসে আর বৃষ্টির ঝাপটায় অর্চনার সম্বিৎ ফিরল।

জানালা বন্ধ করে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়াল। দু চোখ মাঝের বন্ধ দরজা থেকে ফিরে এলো। টেবিলের টাইমপীস ঘড়িতে রাত্রি একটা। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলো সে। সুখের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল আবার। ঘরে আলো জ্বলছে।

বই-কোলে ঈজিচেয়ারে শুয়ে সুখেন্দু অধোরে ঘুমুচ্ছে। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে ঝড়জলের ঝাপটা আসছে। অর্চনা ঘরে ঢুকে জানালা বন্ধ করল। ফিরে আসার মুখে ঈজিচেয়ারের সামনে দাঁড়াল একটু। দেখল চেয়ে চেয়ে। তারপর বিছানা থেকে পাতলা চাদরটা তুলে নিয়ে তার গায়ে ঢেকে দিয়ে আস্তে আছে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *