৭. বদরুল আলম ভাগ্নেকে দেখতে এসেছেন

বদরুল আলম ভাগ্নেকে দেখতে এসেছেন

বদরুল আলম ভাগ্নেকে দেখতে এসেছেন।

শুধু হাতে আসেন নি। দু ডজন কমলা, এক ডজন কলা এবং চারটা ডাব এনেছেন। একটা হরলিক্সের কোটাও সঙ্গে আছে। তিনি বিছানার পাশে বসতে বসতে বললেন, তুই আছিস কেমন?

মনজুর বলল, ভালো।

ভালো সেটা বুঝতেই পারছি। ভালো না হলে এইভাবে বিছানায় বসে কেউ চা খায়? তোকে চা খেতে দিচ্ছে?

হ্যাঁ দিচ্ছে। শুধু তাই না–ডাক্তার বলেছে ইচ্ছা করলে আমি বাসায় চলে যেতে পারি।

বলিস কি!

গতকাল ডায়ালিসিস হলো। তারপর থেকে শরীর ইমপ্ৰক্ষাভ করছে। এখন বেশ ভালো। যে কিডনিটা কাজ করছিল না সেটাও কাজ করা শুরু করেছে বলে আমার ধারণা।

তোর কিডনি প্রবলেম তাহলে সলভড্‌। বাঁচলাম। আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম প্রয়োজনে একটা তোকে দেব।

মনজুর দরাজ গলায় বলল, সেই সুযোগ থেকে তোমাকে বঞ্চিত করব না মামা। সুযোগ এখনো আছে। একশ ভাগ আছে। কিডনি বদলাতে হবে।

বদরুল আলম চুপ করে গেলেন।

মনজুর বলল, শুনে মনে হচ্ছে চুপসে গেলে!

বদরুল আলম বললেন, চুপসে যাব না তো কী? এই বয়সে কিডনি দিলে কি আর বাঁচব? অপারেশনের ধকলই সইবে না। তুই ঠিকই বেঁচে থাকবি, মাঝখান থেকে আমি শেষ।

তোমার আর বাঁচার দরকার কী? অনেক দিন তো বাঁচলে।

এই বাঁচা কি কোনো বাঁচা? পরিশ্রম করতে করতে জীবন গেল। সুখের মুখ দেখলাম না–এখন একটু দেখতে শুরু করেছি, এখন যদি মরে যাই তাহলে লাভটা কী?

তাও ঠিক।

বদরুল আলম বললেন, নে কলা খা।

কলা খাব না মামা, তুমি খাও।

কলা হলো ফ্রুটসের রাজা। একটা কলায় কতটুকু আয়রন থাকে জানিস?

কতটুক থাকে?

অনেক–বলতে গেলে পুরোটাই আয়রন।

তুমি বসে বসে আয়রন খাও। আমার ইচ্ছা করছে না। আর কিডনি নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এমনি বললাম

কিডনি লাগবে না?

লাগবে হয়তো। লাগলেও তোমারটা না।

বদরুল আলম বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। দুটা কলা এবং একটা কমলা খেলেন। হৃষ্ট গলায় বললেন, তোর এখানে কোনো লোকটােক নেই? একটা দা পেলে ডাব কেটে খাওয়া যেত।

এখানে কোনো লোক নেই মামা। ডাব সঙ্গে করে নিয়ে যাও। তোমার অফিসের লোকজন কেটে দেবে।

ডাবের শাঁসেও কিন্তু আয়রন আছে।

মনজুর বিরক্ত গলায় বলল, তুমি আয়রনের এত খোঁজ কোথায় পেলে বল তো

কাঠের মিস্ত্রি বলে তুই আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?

বিশ্বাস করছি। বিশ্বাস করছি।

বদরুল আলম বললেন, এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হত না।

মনজুর বলল, এখানের চা মুখে দিতে পারবে না মামা। ভয়াবহ চা। প্রচুর চিনি, প্রচুর দুধ এবং প্রচুর জীবাণু।

প্রচুর জীবাণু মানে?

হাসপাতাল হচ্ছে অসুখের গুদাম। এখানকার চায়ে জীবাণু থাকবে না তো কোথায় থাকবে? কিলবিল করছে জীবাণু। তুমি বরং চলে যাও।

তুই আমাকে বিদায় করে দিতে চাচ্ছিস কেন?

বিদায় করতে চাচ্ছি। কারণ তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগছে না। তোমার গা থেকে তার্পিন তেলের গন্ধ আসছে— গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে।

বদরুল আলম দুঃখিত গলায় বললেন, তুই কি কোনো কারণে আমার উপর রেগে আছিস? রেগে থাকলে সেটা খোলাখুলি বল। খামাখা তার্পিন তেলের কথা আনলি কেন? আমি কি গায়ে তাৰ্পিন তেল মাখি, নাকি আমি একটা ফার্নিচার যে আমার গায়ে দুবেলা তার্পিন তেল দিয়ে বার্নিশ করা হয়? তোর রাগটা কী জন্যে, শুনি?

আমার কোনো রাগ নেই।

অবশ্যই আছে। এবং কারণটাও জানি। কাঠমিস্ত্রি হয়েছি বলেই কি আমার বুদ্ধিশুদ্ধি থাকবে না?

ঠিক আছে, কী কারণ তুমি বল।

আমি তোকে বলেছিলাম তোর বিয়েতে একটা খাট বানিয়ে দেব। এমন খাট যে যেই দেখবে ট্যারা হয়ে যাবে। সেই খাট দেয়া হয় নি–তোর রাগটা এই কারণে। কাঠ এখন কেনা হয়েছে। বাৰ্মা টিক খুঁজেছিলাম, পাইনি। চিটাগাং টিক কিনেছি। সিজন করা কাঠ। খুব ভালো জিনিস। ছমাসের মধ্যে তোর খাট আমি দেব–যা কথা দিলাম।

ছমাস আমি টিকব না মামা।

পাগলের মতো কথা বলিস না।

সত্যি বলছি ছমাস টিকব না।

ডাক্তার বলছে এই কথা?

ডাক্তাররা কি আর সরাসরি এই কথা বলে?

তাহলে কি স্বপ্ন দেখেছিস?

হ্যাঁ।

কী স্বপ্ন?

মনজুর হাসল, কিছু বলল না। বদরুল আলম উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, স্বপ্নটা কখন দেখেছিস? মাঝরাতে, না শেষরাতে? মাঝরাতের স্বপ্নের কোনো গুরুত্ব নেই। শেষরাতের স্বপ্ন হলে চিন্তার কথা। শেষরাতেই দেখেছি। ঘুম ভেঙে দেখি সকাল।

বদরুল আলম আরো উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, পেট ঠিক ছিল তো? বদহজম অবস্থায় স্বপ্ন দেখলে–লে যা।

বদহজম-টজম কিছু না। পেট ঠিকই ছিল।

স্বপ্নে কী দেখলি?

দেখলাম আমি এই বিছানায় শুয়ে আছি। একটা ধবধবে চাদরে আমার সারা শরীর ঢাকা। আমি বুঝতে পারছি আমি মারা গেছি। একজন ডাক্তার এসে বললেন, ডেডবডি এখনো সরানো হয় নি? কোনো মানে হয়? খামাখা একটা বেড দখল করে আছে। সবাই তখন ধরাধরি করে আমাকে নিচে নামিয়ে দিল। আমার বিছানায় নতুন একজন রোগী চলে এল। তার কিছুক্ষণ পর জাহানারা হাসপাতালে ঢুকল। সে অবাক হয়ে সবাইকে জুম করছে, সার কােথায়? কেউ বলতে পারছে না। অথচ আমি মেঝেতেই পড়ে আছি।

জাহানারাটা কে?

আমাদের অফিসে কাজ করে।

স্বপ্নটা এখানেই শেষ, না আরো আছে?

আর নেই। তার পরপরই আমার ঘুম ভেঙে যায়।

এই স্বপ্ন দেখে তোর ধারণা হলো তুই আর ছমাস বাঁচবি?

হুঁ।

তুই তো দেখছি বিরাট গাধা। তোকে আমি খাবনামা বই দিয়ে যাব। পড়ে দেখিসপরিষ্কার লেখা আছে— স্বপ্নে নিজের মৃত্যু দেখলে দীর্ঘায়ু হয়। তুই বাঁচবি অনেক দিন।

বাঁচলে তো ভালোই। তুমি কি এখন যাবে; না বসবে। আরো খানিকক্ষণ?

বসি কিছুক্ষণ। আমার তো আর অফিস না যে ঘড়ির কাটা ধরে যেতে হবে। আমার হলো স্বাধীন ব্যবসা। ইচ্ছা হলে যাব, ইচ্ছা না হলে যাব না। সারাদিন তোর সঙ্গে বসে থাকতে পারি। কোনো সমস্যা না।

মনজুর আঁতকে উঠে বলল, তুমি কি সারাদিন থাকার প্ল্যান করছ?

বদরুল আলম বললেন, কোন প্ল্যান-ট্যান নেই। এককাপ চা খেতে পারলে হত।

তোমার চায়ের ব্যবস্থা করছি। দয়া করে চা খাও। চা খেয়ে বিদেয় হও।

মনজুর বিছানা থেকে নামল। শরীর বেশ ভালো লাগছে। মাথা ঘুরছে না বা দুর্বলদুর্বল লাগছে না। বাসায় চলে গেলে কেমন হয়? গরম পানিতে ভালো করে গোসল করে একটা লম্বা ঘুম দিলে শরীর অনেকখানি ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে হয়।

মনজুর গেল চায়ের খোঁজে।

আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঢুকল জাহানারা। অবিকল স্বপ্নদৃশ্যের মতো একটা ব্যাপার হল। সে চোখ বড় বড় করে বলল, স্যার কোথায়? স্যার?

বদরুল আলম মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মেয়েটা সুন্দর। শুধু সুন্দর না, বেশ সুন্দর। সবচে’ সুন্দর তার গলার স্বর। কানে এসে গানের মতো বাজে।

জাহানারা আবার বলল, স্যার কোথায়? স্যার?

বদরুল আলম বললেন, তোমার নাম কি জাহানারা?

জাহানারা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে প্রায় কাঁদোকাদো গলায় পাশের বেডের রোগীকে বলল, স্যার কোথায়?

জাহানারা আজ অফিসে যায় নি। বাসা থেকে সরাসরি চলে এসেছে। ঘর থেকে বের হবার সময় ধাক্কা লেগে পানির একটা গ্লাস ভেঙেছে। তখনই তার বুক ছ্যাৎ করে উঠেছে। নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে।

যে বাসে আসছিল মাঝপথে সেই বাসের চাকা বসে গেল। খারাপ সংবাদ, খারাপ সংবাদ, নিশ্চয়ই কোনো খারাপ সংবাদ। কখনো বাসের চাকা বসে না–আজ বসল কেন?

বদরুল আলম আবার বললেন, মা, তোমার নাম কি জাহানারা?

জাহানারা বলল, এই বিছানায় যে রোগী ছিলেন উনি কোথায়?

মনজুর আমার জন্যে চা আনতে গেছে। তুমি বস এখানে। আমি মনজুরের মামা হই। জাহানারা তোমার নাম তাই না?

জ্বি।

কী করে বললাম বল তো?

জাহানারা তাকিয়ে রইল। সে সত্যি বুঝতে পারছে না।

কলা খাবে? খেয়ে দেখ। মনজুর খাবে বলে মনে হয় না। নাও একটা খাও। প্রচুর আয়রন আছে।

ফরিদও জাহানারার সঙ্গে এসেছে। সে দরজার ওপাশ থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। তার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার।

 

মনজুর চা নিয়ে ফিরে এল। তার হাতে ছোট্ট একটা ফ্লাঙ্ক, সঙ্গে দশ-বার বছরের একটি ছেলে যার এক হাতে দুটা খালি কাপ, অন্য হাতে কয়েকটা নোনতা বিস্কিট। সে বিস্কিটগুলো বদরুল আলমের দিকে বাড়িয়ে ধরল।

তিনি বললেন, মারব এক থাপ্নড়, হাতে করে বিস্কিট নিয়ে আসছে!

ছেলেটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ইচ্ছা হইলে খাইবেন, ইচ্ছা না হইলে নাই। থাপ্পড় মারমারি ক্যান?

মনজুর বলল, খেয়ে ফেলেন মামা। হাত যেমন নোংরা প্লেটও সেরকম নোংরা। বরং হাতে দেয়ার মধ্যে এক ধরনের আন্তরিকতা আছে।

জাহানারা হাসছে। তার খুব ভালো লাগছে। যে মানুষটা মর-মর হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল তাকে এমন সুস্থ স্বাভাবিক দেখবে সে ভাবেই নি। চোখের নিচের কালিও অনেক কম। গালের খোচা খোঁচা দাড়িগুলো কেটে ফেললেই কেউ বুঝবে না। এই মানুষটা বড় ধরনের অসুখে ভুগছে।

জাহানারা, কখন এসেছ?

কিছুক্ষণ আগে।

চা-বিস্কিট কিছু খাবে?

জ্বি না।

কলা খেতে পাের। প্রচুর আয়রন আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মামাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পার।

বদরুল আলম চা খাচ্ছেন। নোনতা বিস্কিটও খাচ্ছেন। দোকানের ছেলেটি কাপ ফেরত নিয়ে যাবার জন্যে অপেক্ষা করছে। তার হাতে এখনো দুটা বিস্কিট ধরা আছে।

জাহানারা বলল, আপনার শরীর তো সেরে গেছে বলে মনে হয়।

মনজুর বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। দশটার দিকে ডাক্তার এসে দেখবে। তাকে বলব, আমাকে রিলিজ করে দিতে। আবার যখন শরীর খারাপ হবে, ভর্তি হব। ইতিমধ্যে কিডনি জোগাড়ের চেষ্টা চালাব। পাওয়া গেল তো ভালোই। না পাওয়া গেলে নাই।

জাহানারা বলল, স্যার আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। আপনার কিছুই লাগবে না।

না লাগলে তোই ভালোই।

বদরুল আলম বললেন, আমি তোকে একজন পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যাব। অত্যন্ত পাওয়ারফুল পীর। ক্ষমতা অসাধারণ। পান-বিড়ির একটা দোকান চালায়। বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নাই। গভীর রাতে, মিনিস্টার, সেক্রেটারি, এরা আসে।

মনজুর বলল, দিনে আসে না কেন?

দিনে আসলে তাে লাভ নাই। দিনের বেলা পীর সাহেব হচ্ছে দােকানদার। রাতে পীর।

সাহেবকে গিয়ে আমার অসুখের কথা বলবে?

হুঁ। এরা ইচ্ছা করলে কী না করতে পারে? আজ যাবি?

না।

তোকে যদি রিলিজ করে দেয় তাহলে চল না। আমার সাথে। ক্ষতি তো কিছু নাই।

জাহানারা বলল, স্যার যান না। পীর ফকির সাধু সন্ন্যাসী এদের অনেক রকম ক্ষমতা থাকে।

মনজুর বলল, এদের একমাত্র ক্ষমতা হচ্ছে লোকজনদের ধোঁকা দেয়া। এর বাইরে এদের কোনো ক্ষমতা নেই।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা না বলেই তুই বুঝে ফেললি? আগে কথা বল–তারপর ডিসিশান নে। পীর সাহেবের তাবিজ যে গলায় বাধতেই হবে, এমন তো কথা নেই।

উনি কি তাবিজও দেন নাকি?

না। মাঝে মাঝে গলায় হাত বুলিয়ে দেন।

গলায় কেন?

আমি কী করে বলব কেন! তুই যাবি কিনা বল! আমি ফল পেয়েছি। হাতে হাতে ফল পেয়েছি।

আচ্ছা যাও যাব। তোমাকে খুশি করবার জন্যে যােব। যদি হাসপাতাল থেকে ছাড়ে তাহলে সরাসরি চলে যাব তোমার ওখানে। এখন দয়া করে তুমি বিদায় হও। জাহানার তুমিও যাও। আমি এখন খানিকক্ষণ ঘুমােব। ঘুম পাচ্ছে।

জাহানারা বলল, স্যার আপনি ঘুমান। আমি এই চেয়ারে বসে থাকি। আমি স্যার তিন দিনের ছুটি নিয়েছি।

তিনদিনেরর ছুটি নেয়ার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেই কাল অফিসে জয়েন করছি।

স্যার এই শরীরে আপনি অফিসে জয়েন করবেন?

হুঁ।

যে দুটি বিস্কিট নিয়ে ছেলেটি বসে ছিল, বদরুল আলম সেই দুটিও নিয়ে নিলেন এবং নিচু গলায় বললেন, বাবা চট করে আরেক কাপ চা আনতে পারবি?

 

গলির ভেতর গলি, তার ভেতর আরেক গলি।

মনজুর বলল, তোমার পীর সাহেব তো মামা ভালো আস্তানা বের করেছেন!

বদরুল আলম বললেন, পীর-ফকির মানুষ, এরা কি ধানমণ্ডি গুলশান এলাকায় থাকবে? এরা থাকবে চিপা গলিতে বস্তিতে।

তুমি একে খুঁজে বের করলে কীভাবে?

সে বিস্তর ইতিহাস। তোকে একদিন বলব। হাঁটতে পারছিস?

হুঁ।

শরীরটা ঠিক আছে তো?

এখনো আছে। চোখে এখন কিছুই দেখছি না, নর্দমায়-টর্দমায় পড়ব না তো?

তুই আমার হাত ধরে ধরে আয়।

তুমি কি এখানে প্রায়ই আস?

সপ্তাহে একদিন আসি। উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।

যেরকম নির্জন রাস্তা, আমার তো মনে হচ্ছে ফেরার পথে হাইজ্যাক হয়ে যাব। তোমার কাছে টাকা-পয়সা বিশেষ নাই তো?

কিছু আছে, অসুবিধা নাই-বাবার কাছে যারা আসে তারা কখনো হাইজ্যাকড় হয় না।

উনাকে বাবা ডাক নাকি?

বদরুল আলম কিছু বললেন না। মনজুর বলল, তুমি বাবা ডাকলে তো আমাকে দাদাজান বলতে হয়।

বদরুল আলম বিরক্ত গলায় বললেন, উনার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশা করিস না। এরা ঠাট্টা-তামাশা পছন্দ করে না।

 

বাবা, দোকানের ঝাঁপ ফেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

ধাক্কাধাক্কির পর উঠে বসলেন। মধ্য বয়েসী একজন ভদ্রলোক–যাকে বাবা ডাকা বেশ কঠিন। স্বাস্থ্যবান মানুষ। গায়ে হলুদ রঙের গলাবন্ধ, নোংরা সুয়েটার। মাথার চুল লম্বা, চোখ লাল। ঘুমাবার আগে বাবা হয়তো মুখ ভর্তি করে পান খেয়েছিলেন। পানের রসে কালো ঠোঁট লালচে হয়ে আছে। ঘুম ভাঙানোয় বাবাকে বেশ বিরক্ত মনে হলো। কঠিন গলায় বললেন, কী চাই?

আমাকে চিনেছেন? আমি উড কিং-এর মালিক। বদরুল আলম। আর এ আমার ভাগ্নে। এর নাম মনজুর।

কী চাই?

কিছু চাই না। একে একটু দোয়া করে দেন–এর শরীরটা ভালো না।

নিজের দোয়া নিজের করা লাগে। অন্যে কী দোয়া করব। এখন যান বাড়িতে গিয়া ঘুমান।

একটু গলায় হাত দিয়ে দেয়া করে দেন।

বললাম তো বাড়িতে গিয়া ঘুমান। ঘুমের মধ্যেও দোয়া আছে। ঘুমের সময় শাইল আরাম পায়। শইল দোয়া করে। হেই দোয়া কামে লাগে।

মনজুর হাই তুলে বলল, মামা চলুন যাই। আমার সত্যি সত্যি ঘুম পাচ্ছে।

বদরুল আলম যেতে চাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে দেয়া না করিয়ে তিনি যাবেন না।

আমার ভাগ্লের শরীরটা খুবই খারাপ। একটু যদি দেয়া করেন।

বাবার মন মনে হয় গলল, বাঁ হাত উঠিয়ে আচমকা মনজুরের কণ্ঠার উপর রাখলেন। মনজুরের মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চিৎকার করে ওঠার ঠিক আগে আগে হাত সরিয়ে নেয়া হলো। তখনো মনজুরের নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয় নি।

শইল তো খারাপ, খুবই খারাপ।

বদরুল আলম বললেন, আপনি কি দোয়া করেছেন?

না। দোয়ায় কিছু হওনের নাই। আইচ্ছা শুনেন, আফনের কি কোনো সন্তান মারা গেছে?

কয়েক মুহূর্ত হ’কচকিত থেকে মনজুর বলল, জ্বি।

কন্যা সন্তান?

জ্বি। কীভাবে বললেন?

অনুমানে বলছি। অনুমান। আইচ্ছা অখন যান। পরে একদিন আইস্যেন। দেখি কিছু করা গেলে করমু।

বাবা দোকানের ভিতর ঢুকে ঝাঁপ ফেলে দিলেন। উৎকট বিড়ির গন্ধ পাওয়া গেল। বাবা সম্ভবত ঘুমাবার আগে বিড়ি খান।

বদরুল আলম বললেন, উনার পাওয়ার দেখলি? কীভাবে বলে দিল!

মনজুর হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি এসে আগে বলে গেছ। খুব অন্যায় কাজ করেছ মামা।

বদরুল আলম হতভম্ব গলায় বললেন, আমি আগে এসে বলে গেছি?

হুঁ।

আমার স্বার্থ কী?

আমাকে চমকে দিবে। আমি হতভম্ব হয়ে ভাবব–পীরবাবার কী ক্ষমতা! ভাগ্যিস মামা আমাকে ইনার কাছে এনেছেন। তোমার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হব। তুমি তা দেখে খুশি হবে–এটাই তোমার স্বাৰ্থ। চল যাই।

দুজনে হাঁটছে।

মনজুর খুবই ক্লান্ত বোধ করছে। মামার সঙ্গে তার আসাই ঠিক হয় নি। উচিত ছিল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা। ডাক্তাররা তাকে ছাড়তে রাজি হয় নি। মনজুর যখন বলল, আমি তো এখানে শুয়ে থাকি, বাসায় গিয়েও শুয়েই থাকব। নিজের পরিষ্কার বিছানায় আরাম করে ঘুমােব। আর আপনাদেরও তো খালি বেড দরকার। দরকার না?

এতেই ডাক্তাররা রাজি হলেন। ডাক্তারদের একজন বললেন, প্রিয় মানুষের সঙ্গে থাকলে মন ভালো থাকবে। মন ভালো থাকলে তার প্রভাব পড়বে শরীরে–ঠিক আছে যান।

মনজুর চলে এসেছে–এবং তার একজন প্রিয় মানুষ মেজো মামার সঙ্গে ঘুরছে। উচিত হয় নি; একেবারেই উচিত হয় নি।

মনজুর।

জ্বি।

তুই কি আমার উপর রাগ করলি নাকি?

রাগ করব কেন?

পীর সাহেবকে তোর বাচ্চা মারা যাবার খবরটা আগে দেয়া ঠিক হয় নি।

তুমি তাহলে আগে-ভাগে খবর দিয়ে রেখেছ?

বদরুল আলম কিছু বললেন না। মাফলার দিয়ে কান ঢেকে দিলেন। ভাবটা এরকম যেন কিছু শুনতে পাচ্ছেন না। কাজে ব্যস্ত।

বমি বমি লাগছে মামা।

বলিস কী, শরীর কি আবার খারাপ করেছে?

মনে হচ্ছে সে রকম।

মনজুর রাস্তার পাশে বসে হড়হড় করে বমি করতে লাগল। বদরুল আলম দোয়া কুনুত পড়ে মনজুরের মাথায় ফুঁ দিতে লাগলেন।

এত বমি করছিস–ব্যাপারটা কী? তুই দেখি নাড়িভুঁড়ি সব বের করে ফেলবি।

মনজুর এক সময় উঠে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ আগেই তার চােখ স্বাভাবিক ছিল। এখন টকটকে লাল। যদিও অন্ধকারে তা দেখা যাচ্ছে না।

মামা, হাত ধরে ধরে তুমি আমাকে একটা রিকশায় নিয়ে তোল তো।

মনজুর তুই কি, আমার উপর খুব বেশি রাগ করেছিস?

হুঁ করেছি–আমার বাচ্চার মৃত্যুর খবর আমি কাউকে বলি না। তুমি সেটা তৃতীয় শ্রেণীর এক ভণ্ডকে বলেছ। উচিত হয় নি।

তৃতীয় শ্রেণীর বলছিস কেন? উনি খুব কামেল মানুষ। মানুষের চেহারা ছবি দিয়ে তো সব কিছু বিচার করা ঠিক না।

আমি চেহারা-ছবি দিয়ে কাউকে বিচার করি না। এই লোকটা ভণ্ড। তুমি প্রতি সপ্তাহে এক বার তার কাছে আসা। তোমাকে সে খুব ভালো করেই চেনে। অথচ আজ না। চেনার ভান করল। না চেনার ভান করলে তার জন্যে সুবিধা।

সুবিধা কী?

সে যখন আমার অতীত বলল, তখন আমি আর সন্দেহ করলাম না যে তুমি আগেই সব বলে বসে আছ। আর কী কী বলেছ? ডিভোর্সের কথাটা বল নি?

বদরুল আলম কিছু বলার আগেই মনজুর আবার বসে পড়ল। হড়হড় করে দ্বিতীয় দফায় বমি করল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *