পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে শৈলেনদার শ্রাদ্ধের কার্ডটা হাতে পেয়েই আজ আমার ওঁর কথা মনে পড়ল। উনি বহুকাল আগেই রিটায়ার করেছিলেন এবং সব রিটায়ার্ড লোকজনদের মতই উনিও রিটায়ার করার পরই অফিসের গল্প বেশি করতেন।
বৌদি সারাজীবন ধরে ঐসব গল্প শুনেছেন বলে অনেক সময়ই বিরক্ত হয়ে ওঁকে বলতেন, ঐ অফিসের গল্প ছাড়া কি আর কোন বিষয়ে কথা বলতে পার না?
শৈলেনদা হাসতে হাসতে জবাব দিতেন, ওহে সুন্দরী, এই চিঠি পত্রের মানুষগুলোকে নিয়েই তো জীবন কাটালাম। ওদের নিয়ে ছাড়া আর কাদের নিয়ে গল্প করব?
সারা জীবন ওদের নিয়েই গল্প করে। বৌদি দু পেয়ালা চা আমাদের সামনে রেখে ফিরে যাবার সময় একবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, এমন শ্রোতা বহুকাল পাও না, তাই বলে যাও।
শৈলেনদার সামনে বৌদি যাই বলুন, আমাকে একলা পেলেই উনি বলতেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, তোমার দাদার কাছে এইসব ঘটনা না শুনলে ভাবতেই পারতাম না, সংসারে এত ঘটনা ঘটে।
তা তো বটেই।
এ সব অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তারপর এই বিশ্বসংসারে কত কি দেখলাম, শুনলাম! তবু শৈলেনদার কাছে শোনা সব কাহিনী মনে না থাকলেও অনেক কাহিনীই ভুলিনি। বোধহয় কোনদিনই ভুলব না।
জানো বাচ্চু, হঠাৎ একদিন এক অত্যন্ত সৌখীন ভদ্রলোক আমাদের অফিসে এসে এক কুখ্যাত বেশ্যাপল্লীর একটা ঠিকানা বলে খোঁজ করলেন, প্রমোদ রায়চৌধুরীর নামের কোন চিঠি ফেরত এসেছে কি?
চিঠিপত্রের খোঁজে লোকজনও কি আপনাদের অফিসে হাজির হয়?
এখনকার কথা বলতে পারি না কিন্তু তখন মাঝে মাঝে কিছু লোক আসতেন।
আচ্ছা তারপর কি হল?
ও নাম-ধাম, কোথা থেকে চিঠি আসবে ইত্যাদি জানার পর জিজ্ঞেস করা হল, আপনি যখন ঐখানেই আছেন, তখন চিঠি ফেরত এল কেন?
উনি জবাব দিলেন?
উনি একটু মুচকি হেসে বললেন, ও-পাড়ার সবাই আমাকে মেজ কর্তাবাবু বলে জানে। আসল নাম কেউই জানে না। তাই বোধহয় কেউ বলেছে, আমি ওখানে নেই।
যাই হোক দু তিনদিন খোঁজাখুঁজির পর প্রমোদ রায়চৌধুরীর নামের একটা চিঠি পাওয়া গেল ও উনি আবার এলে ওর হাতে দেওয়া হল। চিঠিটা পড়েই উনি পাগলের মত চিৎকার করে উঠলেন, আপনারা সবাই জেনে রাখুন, আমি মলিনার ছেলে, অঘোর রায়চৌধুরীর বিবাহিতা স্ত্রীর ছেলে না!
শৈলেনদা ও তার সহকর্মীরা সবাই ওর কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আপনি পাগলের মত চিৎকার করছেন কেন?
আমি চিৎকার করব না? পাটনা হাইকোর্ট জাজমেন্ট দিয়েছে, আমি মলিনার ছেলে!
আর মানে?
তাহলে শুনুন!
অতীত দিনের বিহারের বিখ্যাত জমিদার কুমুদকান্তি রায়চৌধুরীর ছেলে জমিদার হবার পর পরই সরকার জমিদারী তুলে দিলেন কিন্তু কুমুদকান্তির নাতি অঘোরকান্তি রায়চৌধুরী চাষবাস ব্যবসা-বাণিজ্য করে আবার কোটিপতি হয়েছেন। এই অঘোরকান্তির তিন পুত্র। প্রমোদবাবুই বড় ছেলে। প্রমোদবাবুর জন্মের প্রায় পনের বছর পর ওর মেজভাইয়ের জন্ম। এর বছর তিনেক পরে ছোট ভাইয়ের জন্ম। বহু ধনদৌলত ভূ-সম্পত্তি রেখে অঘোরবাবু পরিণত বয়সেই মারা গেলেন এবং ওর মৃত্যুর পরই শুরু ভ্রাতৃবিরোধ। তারপর যথারীতি কোর্ট-কাছারি। শেষ পর্যন্ত পাটনা হাইকোর্ট।
দুজন মহামান্য বিচারপতি এক মত হয়ে রায় দিয়েছেন, সন্দেহা তীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে মলিনা শুধু দাসী ছিল না, সে একজন বারবনিতাও ছিল এবং অর্থ বা অলঙ্কারের বিনিময়ে সে বহুজনকেই নিজের দেহ দান করত। এই কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে মলিনার সঙ্গে কোন পুরুষের কোনদিনই আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি। তবে সেই সঙ্গে আমরা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে, প্রমোদের জন্ম মলিনার গর্ভে ও অঘোরকান্তিই তার জন্মদাতা।…
আর?
প্রমোদ নাবালক হলে তার ভরণপোষণ ও শিক্ষাদীক্ষার জন্য নিশ্চয়ই অর্থের ব্যবস্থা করা হতো কিন্তু তিনি শুধু সাবালকই না বেশ বয়স্কও হয়েছেন। তাই অঘোরকান্তির ব্যবসা-বাণিজ্য বা পারিবারিক সম্পত্তির আয় থেকে তাকে কিছুই দেবার প্রয়োজন নেই। তবে তিনি জীবিতকালে রায়চৌধুরী পরিবারের মূল বসত-বাড়িতে থাকতে পারবেন ও তার জন্য তাকে কোন ভাড়া বা ট্যাক্স দিতে হবে না।
গুড বাই জেন্টলমেন! গুড বাই!
আগের মতই চিৎকার করে প্রমোদবাবু নাটকীয় ভঙ্গীতে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডালহৌসীর ভিড়ে মিশে গেলেন।
পরের দিন সকালে কলকাতায় সব খবরের কাগজেই ছোট্ট একটি খবর বেরুল
শুক্রবার সন্ধ্যায় জনৈক প্রমোদ রায়চৌধুরী (৪৮) হাওড়া পুলের উপর থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
পুলিস সূত্রে বলা হয় যে, মৃত ব্যক্তির পকেটের একটি চিঠি ও হাতের আংটি থেকে জানা যায় যে উনি বিহারবাসী। চেহারা ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হয়, উনি কোন ধনী পরিবারের লোক।
পুলিস আরও জানায় যে মৃত ব্যক্তির স্বহস্ত লিখিত একটি কাগজ ওর পকেটে পাওয়া যায় এবং তার থেকে জানা গেছে সোনাগাছির এক বারবনিতার কাছেই উনি থাকতেন। ঐ বারবনিতার ঘরে ওর যেসব টাকাকড়ি-ঘড়ি-আংটি ইত্যাদি আছে তা ওর ছোট ভাইদের কাছে পাঠিয়ে দিতে পুলিসকে অনুরোধ করা হয়েছে।
মৃতদেহটি ময়না তদন্তের জন্য পাঠান হয়েছে।