পিরচোলে
ন’বাবু, সেজোবাবু
তখন আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি চলেছে। একদিন দুপুরবেলাকার কথা। ঘরের বাইরে তাপমাত্রা প্রায় একশো চার ডিগ্রির কাছাকাছি। আর্দ্রতাও তেমনি মানানসই। সারা আকাশটা যেন সদ্য-ধোয়া একটি বিরাট সাদা চাদর রোদে শুকোচ্ছে মা-র পুজোর ঘরের বাইরে তুলসী গাছটার পাতাগুলো এই প্রচণ্ড রোদে নিরস হয়ে কুঁকড়ে আছে। বাড়ির পেছনে মস্ত কাঁটালি কলাগাছের পাতাগুলো ফ্যাকাশে রঙ ধ’রে, অসার হয়ে ভিজে ন্যাকড়ার মতো নেতিয়ে পড়েছে। মনে হয়, যেন আর কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। তারই সংলগ্ন কাঁঠাল গাছটার শ্যাওলা-সবুজ মসৃণ পাতাগুলো সুর্যের পারদ-সাদা আলোয় চুম্কির মতো ঝঝক্ করে। গাছের মর্মস্থানে, পাতার আড়ালে, কয়েকটি শালিক এবং কাক তাদের নরম বুকের পালকে মাথা গুঁজে গা-ঢাকা দিয়ে আছে। পশ্চিমের ঘরের ছাদের সরু কার্নিসে একফালি ছায়া। সেখানে সাদা-কালো ছোপ দেওয়া একটা বেড়াল কাত হয়ে শুয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন। মধ্যাহ্নভোজন সেরে আমি, এ-সময় রোজই তেতলা ঘরটিতে ব’সে একা-একা ছবি আঁকি। আমর আনাড়ি হাতে সেদিন বিদ্যাসাগর মশায়ের একটি প্রতিকৃতি আঁকছিলাম। এমনসময় দোতলায় মা-র কান্না শুনে দৌড়ে নিচে নেমে এসে দেখি এক হুলস্থুল কাণ্ড। মা এবং সেজদার মধ্যে রীতিমতো একটা ধস্তাধস্তি চলছে। দাদার হাত থেকে মা কী একটা যেন কেড়ে নিতে চাইছেন। দাদা সে- জিনিসটি মুখের সামনে ধ’রে বলছে, ‘এক্ষুনি, এক্ষুনি আমাকে দাও। তা না-হলে আমি এটি খেলাম ব’লে।’ দাদার হাতের ছোট্ট জিনিসটি দেখতে অবিকল একটা কালো মার্বেলের মতো, জানালার আলোয় চক্চক্ করছে। মা-র কাঁধের আঁচলটি খসে গিয়ে মেঝেতে লুটোচ্ছে। তাঁর দু-চোখ থেকে দুটি জলের স্রোত তরতর ক’রে গাল বেয়ে সেমিজের মধ্যে প্রবেশ করছে। সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে আমার কনিষ্ঠ তিনটি ভাইবোন আতঙ্কে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে। জোড়-হাতে, অনুনয় ক’রে মা, ছেলের দাবি মেটাবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন তুই থাম! এক্ষুনি দিচ্ছি। বাবার-দেয়া কালো ক্যাশ বাক্সটির থেকে মা, পাসবই বের করলেন। পোস্ট অফিস থেকে তক্ষুনি পাঁচ হাজার টাকা তুলে আনবার ব্যবস্থা ক’রে দিলেন। কালো মার্বেলটি যে একটি আফিমের গুলি ছিল তা বুঝতে আর বেশি দরি হ’ল না। এ-ধরনের নাটকীয় ঘটনা শুধু যাত্রা-থিয়েটারে ঘটে বলেই জানতাম।
কোনো পরিবারের শীর্ষে অত্যধিক ক্ষমতাবান পিতার দীর্ঘকাল উপস্থিতি অনেকটা একটি সূর্যেরই সামিল, যার চারদিকে একটি গোটা সংসার সৌরজগতের মতো ঘুরে বেড়ায়। যেদিন এ কেন্দ্রের আলো দপ ক’রে নিভে যায়, সেদিন সে সংসারে ঘোরতর অন্ধকার নেমে আসে। তাই বাবার মৃত্যুর পর আমাদের বিরাট একান্নবর্তী পরিবারে মস্ত চিড় দেখা দিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের সর্বপ্রকার স্বার্থপরতা, হীনতা, বিদ্বেষ, ডিমের চাক্ থেকে জাত সাপের বাচ্চার মতো, একের পর এক, ফুটে বেরুতে থাকল। মানুষ যে কী আন্দাজ ইতর হতে পারে, নানা রকম তুচ্ছ খুঁটিনাটির মাধ্যমে, তার অকৃত্রিম প্রকাশ দেখে সে বয়সে, আমি স্তম্ভিত হয়েছিলাম। একসঙ্গে খেতে বসিয়ে, অন্যের সন্তানদের ছোটোগাদার মাছটি এবং ডালের জলটা এবং নিজের সন্তানকে বড়ো কোলের মাছটি এবং ডালের ঘন অংশটুকু নির্লজ্জভাবে পরিবেশন করাটাই যেন সংসারের স্বাভাবিক নিয়ম।
বাবার জীবিতকালে মা-র স্থান ছিল স্বভাবতই তাঁর নিচে। তাঁর অন্তর্ধানের পর বৈমাত্র বড়ো ভাইদের ব্যবস্থায় মা-র এ-স্থান গড়িয়ে চ’লে গেল অনেক তলায়। মা- র পক্ষে এ-পদমর্যাদার হানি মেনে নেয়া কঠিন হ’লেও তাঁর চাপা স্বভাব এবং দুর্বলচিত্তের দরুন, প্রতিবাদে তিনি ছিলেন নিতান্তই অক্ষম। তাই একদিন আমাদের বারোটি বাইবোন এবং তাঁকে যখন পৃথক ক’রে দেওয়া হ’ল তখন, একদিকে তাঁর অন্তরে যেমনি বিক্ষোভের একটি পাহাড় জমে উঠল, অন্য দিকে তেমনি তিনি হলেন অসহায়। তাঁর সাতটি ছেলের মধ্যে একটিও তখন উপার্জনক্ষম হয়নি তদুপরি ছিল তিনটি কন্যার গুরুভার। তাছাড়াও, এতগুলো সন্তানকে মানুষ করবার মতো তাঁর শিক্ষা এবং ব্যক্তিত্ব–এ-দুয়েরই গুরুতর অভাব ছিল।
আমার বড়ো ভাইদের তখন উঠতি বয়েস। ধানের ক্ষেতে একই সারে, একই বীজে, মোটামুটি একই জাতের এবং একই উচ্চতার চারাগাছ হয়। কিন্তু একই বাপ- মায়ের সন্তানদের স্বভাব, বৃত্তি এবং গুণের যে কী পরিমাণ পার্থক্য হতে পারে এবং তার পরিণতি যে কী সাংঘাতিক হয়, এ-ব্যাপারে আমাদের পরিবারের তুলনা মেলা দায়।
আমাদের বাড়ির সংলগ্ন ছয়টি ছেলের এবং চারটি মেয়ের আরেকটি পরিবার বাস করে। তাদেরও উঠতি বয়েস। স্বল্প আয় হ’লেও শিক্ষাদীক্ষায়, আচারে ব্যবহারে, এ-পরিবারটি ছিল বস্তুতই একটি সুখী পরিবার। পাশাপাশি দুই পরিবারের মধ্যে এই বৈষম্য দেখে, থেকে-থেকে নিজের অদৃষ্টকেই মা ধিক্কার দিতেন।
গর্ভাবস্থায় সন্তান প্রত্যেক মায়ের চোখেই নিখিল জগতের মর্মস্থান অধিকার ক’রে থাকে। একটি অখণ্ড আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। প্রাণের সংগীতসভায় তাঁদের সন্তানের অস্তিত্ব, সন্তানের নিঃশব্দ কানাকানি, একটি প্রভাতী রাগের মতোই প্রাণের বাণীকে আকাশে উচ্ছ্বসিত ক’রে তোলে। এই সন্তানের মাধ্যমে মায়েরা একই বাণী আপনার রক্তের মধ্যে শুনতে পান। তাঁদের কল্পলোকের কল্পলতার অঙ্কুরটি রবির কিরণে একদিন একটি বহুপুস্পিত শিমুল গাছের মতোই ডালপালা মেলে আকাশে- বাতাসে ঘন রঙের আলো ছড়িয়ে দেবে, বহুবর্ণে রঞ্জিত আমার মায়ের এই সুখস্বপ্নটি যেদিন এক দুঃস্বপ্নে রূপান্তরিত হ’ল সেদিন মাতৃত্বের গৌরব-দীপ্ত তাঁর মুখটি অদৃষ্টের গোপন হাতে, কালিমার প্রলেপ, ঢাকা পড়ে গেল। তাঁর স্নিগ্ধ, স্নেহশীল মুখটি ঘন কৃষ্ণবর্ণ, ধিক্কার এবং বিষাদের স্থূল রেখায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠল।
তখন আমার বয়েস বারো কি তেরো হবে। প্রতিদিন ভোরে কাক ডাকার সঙ্গে- সঙ্গেই প্রায় সাড়ে-ছয় ফুট লম্বা, দৈত্যের মতো দেখতে, মস্ত লাঠি হাতে এক কাবুলিওয়ালাকে আমাদের বাড়ির রোয়াকে ব’সে থাকতে দেখি। আমাদের সঙ্গে অকস্মাৎ চোখাচোখি হ’লে, সেজোবাবু বাড়ি আছেন কিনা জিজ্ঞেস করে। সেজোবাবু সারা রাত মদ আর জুয়ার আড্ডায় কাটিয়ে সবেমাত্র শয্যা নিয়েছেন। এই জুয়ার আড্ডা প্রায়ই আমাদের বৈঠকখানায় বসত। কখনো-কখনো সারা রাত এবং পরের দিন দুপুরবেলা অব্দি চলত। একটি কি দুটি জানালা সামান্য খোলা। বাকি সব দরজা-জানালা, ছিট্কিনি দেয়া। সিগারেটের ধোঁয়া সারা ঘরটিতে প্রভাতের কুয়াশার মতো থাকে-থাকে জ’মে আছে। আচমকা হাওয়ার প্রবেশের সঙ্গে-সঙ্গে এই ধোঁয়া চরকির মতো পাক খেতে থাকে। তার ভেতর দিয়ে জুয়াড়িদের আংশিক স্পষ্ট মুখগুলো মুহূর্তের জন্যে দেখা দিয়ে আবার ধোঁয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়। সিগারেট, চা কিংবা জলের প্রয়োজন হ’লে অনেকসময়ই আমাদের ডাক পড়ে। কয়েকশত, কিংবা কয়েক হাজার টাকার যে হাতবদল হয়েছে আমাদের বুঝতে দেরি হয় না। আমাদের বৈঠকখানা ছাড়াও, এ-আড্ডা জমাবার, সেজদা এবং তার বন্ধুদের, একটি স্থায়ী ক্লাবঘরও ছিল। শনিবার এই আড্ডার বিরতির দিন কারণ, সেদিন সারা দুপুর এবং বিকেল, ঘোড়দৌড়ের মাঠের প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাটিয়ে, বোধ করি, রাতের আসর জমাতে তাদের কর্মশক্তির অভাব হ’ত।
একদিন স্কুলে যেতেই দীর্ঘ পাঁয়ষট্টি দিন অনশনের পর বিপ্লবী যতীন দাসের মৃত্যুর প্রতিবাদে ছুটি ঘোষণা হ’ল। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। দেখি মা-র রান্নাঘরের মেঝেতে আমার ন’দা যন্ত্রণায় একটি কাটা মুরগীর মতো ছট্ফট্ ক’রে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মা তার গলা দিয়ে গেলাসে-গেলাসে নুনজল ঢেলে দিচ্ছেন। সঙ্গে- সঙ্গেই তার হাত-পাগুলো উন্মত্ত ঢাক-বাজিয়ের কাঠির মতো মেঝেতে দাপাদাপি ক’রে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার পেটের ভেতর থেকে, ঘোলের মতো মস্থিত হয়ে রাশি-রাশি তরল পদার্থ বেরুতে থাকল। তার থেকে মেথিলেটেড স্পিরিটের দুর্গন্ধ উঠে এক চিলতে রান্নাঘরটির নিচু টিনের চালাটিতে ধাক্কা খেয়ে, সারা ঘরটির বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। ছোটো ভাইবোনদের জিজ্ঞেস করার সঙ্গে-সঙ্গেই জানা গেল যে, মা-র কাছে অন্যায় অর্থের দাবি অগ্রাহ্য হওয়ায় পুরো এক বোতল স্পিরিট খেয়ে ন’দা এই তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছে। তখন পৌষ মাস। সংক্রান্তির আর কয়েকদিন মাত্র বাকি। এ-সময় গোটা ঢাকা শহরের আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই ঘুড়ি ওড়ানোয় মেতে ওঠে। প্রত্যেক বাড়ির ছাদে, দুপুরবেলায়, স্ত্রী পুরুষদের ভিড় জমে। এমন- কি আমাদের পাড়ার সংলগ্ন বারবনিতাদের ছাদেও।
একদিন ন’দা আমাকে আহ্লাদ ক’রে আমার হাত ধ’রে এই সংলগ্ন পাড়ার দিকে টেনে নিয়ে গেল। লাল ইটের তেতলা একটি পুরোনো বাড়িতে প্রবেশ করলাম। উঠোনে, বারান্দায়, ছাদে, নানা বয়েসের মেয়েদের ভিড়। চেহারায় কেউ সরস, আবার কেউ চলনসই। সাদর সম্ভাষণ এবং মুচকি হাসির বিনিময় দেখে ন’দার সঙ্গে যে এ-বাড়ির বাসিন্দাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে, এ-তথ্যটি আমার মতো বালকের চোখেও স্পষ্ট হয়ে উঠল। সোজাসুজি তেতলার ছাদে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ছাদের কার্নিশে ব’সে ফুটফুটে একটি যুবতী গোল ফ্রেমে একটি সাদা রুমাল এঁটে, ‘ভালোবাসাই পরম সুখ’ এ-কথাটি রঙিন সুতোর ফোঁড়ে তুলছে। কথাটির দু’পাশে ফুল এবং লতাপাতার গুচ্ছ পেন্সিলে আঁকা। একটি ফুলে ডানামেলা প্ৰজাপতি বসেছে। মেয়েটির ডাগর চোখদুটি কাজল দিয়ে ঘেরা। নিঃশব্দ একটি মধুর হাসিতে আমাকে মুগ্ধ ক’রে দিল। তার ভাই ধীরা, অর্থাৎ ধীরেন, গোলাপী মাঞ্জার সুতোয় ভরা একটি মস্ত বড়ো লক্ষ্ণৌই লাটাই হাতে সাদাকালো ‘মুখপোড়া’ একটি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। ধীরা ন’দারই সমবয়সী এবং ইয়ার। তার হাত থেকে লাটাইটি তুলে নিয়ে আমার হাতে তুলে দিল। আমার উত্তেজনা দেখে কে! এ-রকম লাটাই আর সুতো শুধু নবাববাড়ির লোকদের হাতেই দেখেছি।
ঘুড়ি ওড়াবার এবং প্যাঁচ লড়বার সবরকম কারিগরি ন’দার নখদর্পণে ছিল। একটি ঘুড়ির সাহায্যে কুড়ি-পঁচিশটি ঘুড়ি কেটে দিয়ে অপরাজিত থাকা তার পক্ষে একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। একেকদিন আশেপাশে প্যাঁচ লড়বার মতো ঘুড়ির অভাবে নিজের ঘুড়িটি নামিয়ে নবাববাড়ির গুম্বুজে উপবিষ্ট পায়রাদের উড়িয়ে দিত। আকাশের এক কোণ থেকে আরেক কোণ অব্দি তাদের তাড়া ক’রে নিয়ে যেত। আবার সেদিক থেকে তাড়া ক’রে অন্যদিক ভাগিয়ে দিয়ে পায়রাদের অযথা বিশ্রীরকম হেনস্তা করত। কোনো-কোনো দিন অলস দুপুরে, চিল-শকুনেরাও তার এইধরনের শয়তানী বুদ্ধির শিকার হত।
সেদিন রবিবার। পৌষের বাতাস ঠিক ধীরাদের ছাদের দিকেই বইছে। আগের দিনের মতোই তাদের ছাদের কার্নিশে সেই মেয়েটি সেলাই নিয়ে মগ্ন। গায়ে লাল টকটকে একটি শাড়ি। তার কালোজাম-রঙের চুলগুলো ওপরের দিকে তুলে নিয়ে খুব আঁট ক’রে মাথায় মস্ত একটি খোঁপা বেঁধেছে। তার নিটোল লম্বা গলাটি পৌষের মোলায়েম রোদে অবিকল একটি সোনার গেলাসের মতো ঝকঝক করছে। ন’দা তার ঘুড়িটি এক গোত্তায় ধীরাদের ছাদের কাছে নামিয়ে আনল। মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি। তার উদ্দেশ্য কী আমি কিছুই তার হদিশ পাই না। দেখি ন’দা সুতো ছেড়ে দিয়ে মেয়েটির মাথা ছাপিয়ে ঘুড়িটাকে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেল। কুচকুচে কালো ঘুড়িটি সিঁদুরে-রঙের শাড়িটির কাছাকাছি আসতেই লাল পোশাকটি জলজল করে উঠল। ঘুড়িটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চক্রাকারে ঘুরছে। প্রায় ছাদের সঙ্গে লাগে আর-কী। মেয়েটি মাথা নিচু ক’রে সেলাইয়ে মশগুল। ঠিক এমনসময় ন’দা তড়িত বেগে পেছনে হটতে হটতে লাটাইয়ে ঘন-ঘন চাটি মার সঙ্গে-সঙ্গেই সুতোর টানে সুন্দরী মেয়েটির খোঁপা খুলে গিয়ে তার রাশি-রাশি ঘন চুল একটি নীল ঝর্নার মতো পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। হকচকিয়ে উঠে, এদিক-ওদিক তাকাতেই যেই-না ন’দার সঙ্গে চোখাচোখি হ’ল এক অফুরন্ত হাসির কলধ্বনিতে আমাদের পাড়াটি মুখর হয়ে উঠল। ‘ভালোবাসাই পরম সুখ’ এই কথাটি ন’দার ঘুড়ির মতোই আমাদের জিন্দাবাহার গলির সংকীর্ণ আকাশটিতে অনেকক্ষণ ধরে পাক খেতে থাকল।
এখন বেলা প্রায় একটা। স্নানাদি সেরে সেজদা ভেজা গামছা পরে পুর্বের দেয়ালের তাকে রাখা দক্ষিণেশ্বরের শ্রীশ্রীকালী মায়ের ছবিটির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখ অর্ধনিমীলিত। হাতে পুষ্পাঞ্জলি। ভক্তির এই প্রতিমূর্তি কৃপাময়ীর কাছে বিড়বিড় ক’রে কত প্রার্থনাই- যে করে তার ইয়ত্তা নেই।
একদিন মহামায়া তার শক্তির পরীক্ষা নিলেন। আমার এ-জ্যেষ্ঠভ্রাতাটি মাঝে- মাজে অর্শের যন্ত্রণায় ভোগে। একবার সেই যন্ত্রণা অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গিয়ে তাকে শয্যাশায়ী হতে হ’ল। যার ক্রোধ এবং প্রহারের ভয়ে আমরা সবাই সন্ত্ৰস্ত থাকতাম, তাকেই একটি অসহায় শিশুর মতো হাউহাউ ক’রে কাঁদতে দেখা গেল। চাঁদসী, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবিরাজি, হাকিমি–কোনো দাওয়াই আর বাকি রইল না। অগত্যা আমাদের বাড়ির সংলগ্ন কালীবাড়িতে সন্দেশের ভোগ পাঠিয়ে, তাড়াতাড়ি ব্যথার উপশমের জন্যে প্রার্থনা জানানো হ’ল। মায়ের শ্রীচরণামৃত খেয়ে আশীর্বাদের রক্তজবা ফুলটি অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঠেকিয়ে রাখল। তাতেও কোনো আরামের লক্ষণ দেখা গেল না। তাক থেকে দক্ষিণেশ্বরীর ছবিটি নামিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক নাগাদ তার শিয়রে রাখা হ’ল। দাদা থেকে-থেকে সে-ছবিটিতে মাথা ঠুকছে। কিন্তু যন্ত্রণা ক্রমশই বাড়তির দিকে গেল। এই কারণে তার চিৎকার-চেঁচামেচিও একই অনুপাতে বাড়তে থাকল। এভাবে একটি পুরো রাত এবং একটি পুরো দিন কাটল। তার হুকুম তামিল করায় এবং তার সেবায়, আমরা সবাই অস্তির। বাড়িশুদ্ধ লোক তটস্থ।
রাত তখন দশটা কি এগারোটা হবে। রাস্তাঘাটে গাড়ি-ঘোড়ার চলাচল এবং লোকজনের যাতায়াত প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু মির্জাসাহেবের আস্তা-বলের একটা ঘোড়া মাঝে-মাঝে চিঁ-হি-হি ক’রে উঠছে। দর্জি হাফিজ মিঞার খ্যাকর- খ্যাকর আওয়াজও দু-একবার কানে আসে। আমাদের গলির ল্যাম্পপোস্টের কেরোসিনের আলোগুলো প্রায় নিষ্প্রভ। সেজদার গোঙানি এবং ছট্ফটানিতে মা-র রান্নাবান্না শিকেয় উঠেছে। আমরা সবাই দাদার বিছানার চারপাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ সেজদার বোজা চোখদুটি খুলে গেল। নিশ্বাস ঘন। এক অস্বাভাবিক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে ব’সে বালিশ এবং পাশবালিশগুলো একের পর এক আমাদের দিকে ছুঁড়ে মারল। বিছানার থেকে তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠে যে-ছবিটি এতক্ষণ তার মাথার কাছে ছিল, সেটিকে দু-হাত দিয়ে তুলে উঁচিয়ে ধরল। গালিগালাজের বন্যায় মহামায়াও তখন ভেসে গেছেন। সিঁদুর এবং চন্দন-মাখা সে ছবিটি আছাড় খেয়ে ভেঙেচুরে, গুঁড়িয়ে, অণুপরমাণুতে পরিণত হয়ে, গোটা মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল। আমাদের সবাইকে, এমন-কি মাকেও ঘর থেকে বের ক’রে দিল।
আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতাদের মধ্যে আত্মবিনাশের একটা অস্বাভাবিক প্রবণতা দেখেছি। এই প্রবণতার ফলে, তাদের হৃদয় হয়ে উঠল যেন আসুরী বৃত্তিসমূহের একটি গুদামঘর। কুরঙ্গ, মাতঙ্গ, মীন, ভূঙ্গ–প্রত্যেকের একটি ইন্দ্ৰিয় প্রবল ব’লে এরা অকালেই প্রাণ হারায়। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতারাও একের পর এক, তাদের ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তির জন্যে ভোগ-বিলাসময় জীবন-যাপনে, অকালে তাদের চরম পরিণতির দিকে ক্রমশই এগিয়ে যেতে থাকল।
যে-মায়ের অদৃষ্টে, পর-পর তিন-চারটি জ্যেষ্ঠপুত্রদের এই মর্মান্তিক পরিণতির নীরব দর্শক হওয়া লেখা থাকে, সে-মায়ের হৃদয়ের সংবেদনশীলতা এবং আবেগান্বিত হবার শক্তি ক্রমশ শুকিয়ে পাথর চাপা পড়ে যায়।
সেজদা অল্পবয়সেই একটি আফিমের দোকানের মালিকানা পেয়েছিলেন। সেকালের ঢাকায় আবগারি দোকানের মালিকদের মধ্যে আমার এই দাদা ছিল, খুব সম্ভবত, একমাত্র ব্যতিক্রম। এ-ধরনের দোকানদারিতে হিন্দু মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ মোটেই সায় দিত না। তার এই মালিকানার পেছনে একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ছিল ব’লে শুনেছি।
বাবার মৃত্যুর অল্পকালের মধ্যেই মদ এবং জুয়ার নেশা একটি ভূতের মতো এমনই তাকে আঁকড়ে ধরেছিল যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সে-ভূত তার ঘাড় থেকে আর নামেনি। যেখানে এই দুই ভূতের সহ-অবস্থান সেখানে এদের স্বাভাবিক তৃতীয় সঙ্গী, কামের মিলন অনিবার্য। এ-তিনটির পরিতৃপ্তির জন্যে অবিরাম যে- পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সে-পরিমাণ কেন, তার এক-শতাংশ উপার্জন করবার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে, তার ছিল না। এ-ধরনের লোকেরা, এই অর্থ জোগাড় করবার জন্যে, যে কোনো উপায়ই অবলম্বন করতে মরিয়া হয়ে ওঠে I
উনিশশো বত্রিশ-তেত্রিশ সালের কথা। ঢাকা জেলা তথা সারা পূর্ববঙ্গে সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির জোয়ার বইছে। পাড়ায়-পাড়ায় ছাত্রদের বিপ্লবী দল গ’ড়ে উঠেছে। সে-সময় এমন হিন্দু মধ্যবিত্ত খুব কম পরিবারই ছিল, যে-পরিবারের কোনো-না-কোনো ছেলে, এই রাজনীতির সংক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে ছিল। আমার সেজদাও তার ছাত্রাবস্থায় স্বামী বিবেকানন্দের দেশাত্মবোধে এবং নৈতিক দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। পরনে তার খদ্দরের ধুতি-চাদর এবং খালি পা। নিয়মিত গীতাপাঠ, ব্যায়াম, স্পোর্টস, খেলাধুলো এবং পড়াশুনা ছিল তার দৈনন্দিন কর্মসূচী। এসব ব্যাপার পরিচালনায়, তার নেতৃত্বের যোগ্যতাও নেহাৎ কম ছিল না। তাছাড়া, গানবাজনার দিকেও তার বেশ ঝোঁক ছিল। মেয়েদের দিকে তার মনোভাব ছিল অত্যন্ত সংযমশীল। সিগারেট পান বিড়ি এ-সবই ছিল তার কাছে অস্পৃশ্য।
একদিন সেজদা আমাকে তেতলার ঘরের একান্তে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করল যে, সন্ত্রাসবাদী দলের কোনো ছেলেদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে কিনা। এ ঘটনার অল্প কিছুদিন আগে পাড়ায় গুজব শুনেছি যে পুলিশের সঙ্গে দাদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। এমন- কি আমার স্কুলের দু একজন সহপাঠীও আমাকে এ সম্বন্ধে প্রশ্ন ক’রে অত্যন্ত লজ্জায় ফেলেছিল। পরে শুনেছি যে, তখনকার বাংলার লাট অ্যাণ্ডারসন সাহেবকে দার্জিলিং-এ হত্যা করবার বিফল চেষ্টায় আমার চতুর্থ ভ্রাতা এবং তার দলের কয়েকটি ছেলের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে সেজদা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিল। এ চতুর্থ ভ্রাতার পরবর্তীকালে রাজসাক্ষী হওয়া, জেল থেকে তার মুক্তি এবং দুটি আবগারি লাইসেন্সের সরকারি পুরস্কার পাবার ব্যাপারে, সেজদার ভূমিকাও কম ছিল না। এ-ধরনের সরকারি সেবায় সেজদা নাকি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই নিযুক্ত ছিল। তাই সরকার নিতান্তই খুশি হয়ে, তাকে আফিমের দোকানটি বিনামূল্যে উপহার দিয়েছিল।
সরকারি বিধি অনুসারে সেজদাকে প্রত্যেক সপ্তাহে নগদ টাকায় কয়েক সের আফিমের মজুত কিনতে হয়। এ-টাকা তার দোকানের বিক্রির টাকা থেকেই সঞ্চয় করবার কথা। শুনেছি বিনা পরিশ্রমে, বিনা ঝুঁকিতে আবগারি ব্যাবসার জুড়ি নেই। কিন্তু তিন-তাসের আড্ডায়, ঘোড়দৌড়ের মাঠে এবং যাবতীয় আনুষঙ্গিকের ব্যয়ে, এ-টাকার প্রায়ই ঘাটতি পড়ত। ধারে কর্জে সে নাক অব্দি ডুবেছিল। কাবুলিওয়ালা ছাড়াও আরো অন্য পাওনাদারেরা এসে আমাদের বাড়ির সুমুখে ভিড় জমাত। তারা বিশ্রী গালিগালাজ করতে এতটুকুও কসুর করত না।
একিদন বিকেলে খেলাধুলো ক’রে বাড়ি ফিরে দেখি সেজদা আরেক তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়েছে। মা খাটে ব’সে আছেন। দাদা তার দু-পা ধরে সজল নয়নে অনুনয়-বিনয় করছে। মুক্তিপণ না-মেটানো পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের মাকে এভাবে বন্দী রাখতে আমরা, কনিষ্ঠরা, এতবার দেখেছি যে, এ ধরনের নাটকীয় ঘটনা আমাদের পারিবারিক দৈনন্দিন জীবনধারার একটা স্বাভাবিক অঙ্গ ব’লেই ধ’রে নিতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম। তাহলেও এ-অভিজ্ঞতা, মায়ের পক্ষে তো বটেই, আমাদের পক্ষেও কোনো বিচারেই সুখপ্রদ ব’লে ধরে নেওয়া যায় না। সেজদার দাবি যে, মাকে তাঁর গহনা বিক্রি ক’রে অবিলম্বে দু-হাজার টাকার ব্যবস্থা ক’রে দিতে হবে। সে-টাকায় তাকে তক্ষুনি দোকানের জন্যে, ‘মালের’ মজুত কিনে না- রাখলে তার আবগারি লাইসেন্স নাকি বাতিল হয়ে যাবে। মা একটি পাথরের মূর্তির মতো নীরব এবং নিশ্চল। চোখ ঈষৎ ঘোলাটে। অপলক ভাবশূন্যে দৃষ্টি সামনের দেওয়ালের দিকে সম্বদ্ধ! মায়ের পায়ে লুটিয়ে, তীব্র নিষাদে, সকরুণ সুরে, তেইশ-চব্বিশ বছরের তরতাজা একটি মরদ এমনই বিশ্রী কান্না জুড়ে দিল, অন্তত আমার কানে সে-সংগীত সুষুপ্ত মধ্যরাতের কুকুরের কান্নার চাইতেও বিকট লাগল। যে-মানুষ তার ইন্দ্রিয়লালসার তৃপ্তির জন্যে তার মাকে থেকে-থেকেই নির্দয় এবং নির্লজ্জভাবে লাঞ্ছনা দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিতবোধ করে না, সে-মানুষের প্রতি সহানুভূতি তো দূরের কথা, রাগে এবং দুঃখে বুক খণ্ড-খণ্ড হয়ে যায়। মাতৃত্বের গৌরব, তাঁর অন্তরের সঞ্চিত গভীর বিষাদ এবং তিক্ততার গরলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এভাবে কয়েক মিনিট কাটাবার পর সেজোবাবু, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পাঁড় জুয়াড়ির মতো, তার তুরুপের তাসটি বের করল। বুক-পকেট থেকে অয়েল পেপারের একটি ছোট্ট মোড়ক বের ক’রে তার থেকে সেই কালো মার্বেলটির মতো একটি গুলি বের করবার সঙ্গে-সঙ্গে মা, অর্ধ-অচৈতন্য অবস্থায় একটি যন্ত্রচালিত পুতুলের মতো খাট থেকে উঠে, বড়ো আলমারিটির দিকে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলেন। পা যেন আর নড়ছে না। তাঁর গায়ে বিধবার শুভ্র পোশাকটি ধিক্কার এবং কলঙ্কের কালো পোশাক হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকল। আলমারি থেকে গয়নার বাক্সটি বের ক’রে মা খাটের ওপর রেখে দিলেন। তারপর, সিঁড়ির দেয়াল ধ’রে, তেতলায় তাঁর পুজোর ঘরের দিকে আস্তে- আস্তে নিজেকে টেনে নিয়ে গেলেন।
আমার ন’দাকে কয়েকদিন থেকেই বেশ সেজেগুজে, সকাল-সকাল রোয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। ব্যাপারখানা কী জানবার জন্যে আমার মন আঁকুপাঁকু করে। যে-লোক রাতের অন্ধকার ঘন হবার সঙ্গে-সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে, তার সাত-সকালে উঠে এখানে দাঁড়াবার নিশ্চয়ই একটি বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
ফাল্গুনের সকাল। নিশি মোক্তারের বাড়ির ছাদের রেলিঙের ভেতর দিয়ে রোদ চুঁইয়ে এসে আমাদের রোয়াকে আলোছায়ার চমৎকার একটি নক্সা কেটেছে। সংলগ্ন কালীবাড়ির ছাদের রুদ্ধ নর্দামাটির মুখে বর্ষার যে লাউ গাছটি প্রকৃতির ধ্বজা তুলে দাঁড়িয়েছিল, বুড়িগঙ্গার বুক থেকে ওঠা হাল্কা বাতাসে, তার ডগাগুলো ঈষৎ দুলে উঠল। হরিমতি বাঈজির ঘরটি আমাদের বারান্দা থেকে পরিষ্কারই দেখা যায়। প্রতিদিনের অভ্যেসমতো ভৈরবী রাগে গান ধরেছেন, রসিয়া তোরি আঁখিয়ারে, জিয়া লালচায়। ঠুংরি ঠাটের গানের এ-কলিটির সুরের মাধুর্যে আমাদের জিন্দাবাহার গলিটি কানায়-কানায় ভ’রে উঠেছে। হাফিজ মিঞার কয়েকটি মরদ পায়রা বুক ফুলিয়ে বাকবাকুম্-কুম, বাকুবাকুম-কুম আওয়াজে তার ছাদটি গগম্ ক’রে তুলছে। ন’দা থেকে-থেকেই গলা বাড়িয়ে গলির মুখের দিকে কী যেন দেখবার চেষ্টা করে। গায়ে তার সদ্য ইস্ত্রি-করা প্রিয় সিল্কের সার্ট। সার্টের কলারটি অর্ধচন্দ্রকারে উঠে, ঘাড় থেকে নেমে, উড়ন্ত বকের ডানার মতো কাঁধ অব্দি নেমে এসেছে। একটু পর-পরই রুমাল দিয়ে মুছে মুখটি পালিশ ক’রে নিচ্ছে।
আমাদের পাড়ার বারবানিতারা প্রতিদিন সকালে দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে যায়। তাদের স্নানে যাবার পথটি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই। ভেজা কাপড়ে ফেরবার পথে কালীমন্দিরের দরজায় প্রণাম করে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা দেয়। সকালবেলার এই মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দেয়। তাদের মন-মেজাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো কাটে।
তাদের আগমনের সঙ্গে ন’দাকে অসম্ভব চঞ্চল হয়ে উঠতে দেখা গেল। তার দৃষ্টি সদ্যোস্নাত তরুণীদের প্রথম সারির মাঝখানে। সেখানে ষোলো-সতেরো বছরের একটি মেয়ে। এটিকে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বাই বলা যায়। মুখটি অবিকল একটি লিচুর মতো গোল। থুতনিটি ঈষৎ তীক্ষ্ণ। ঠোঁটদুটি যেন রসালো দুটি কমলালেবুর কোয়া। তার নাকের ছোট্ট পাটাদুটি প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে ফুলে-ফুলে উঠছে। গোটা শরীরটি যেন মুর্শিদাবাদী রেশম দিয়ে মোড়া। এমনই মসৃণ এবং চক্চকে তার ত্বক। পাকা পাতিলেবুর গায়ে, হাল্কা গোলাপী রঙের পোঁচে যে রঙের মিশ্রণ হয়, ঠিক তেমনি তার গায়ের রঙটি তার নীল-কালো চোখদুটি যেন স্তম্ভিত মেঘ– মুখের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে। শাস্ত্রে বলে, ‘বিহঙ্গের সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগ আছে বলিয়াই তো বিহঙ্গী সুন্দর হইয়াছে। ময়ুরও সেই সৌন্দর্যের প্রতি অনুরাগী বলিয়াই তো প্রকৃতি ময়ূরীকে সুন্দর করিয়েছেন। চম্পক অঙ্গুলি ও খঞ্জন নয়নের অধিকারিণী হইয়াছেন।’
ভেজা কাপড় মেয়েটির গায়ে লেপ্টে থাকার দরুন তার শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ যেন একটি ফুলের বিভিন্ন পাপড়ির মতো আলাদা সত্তা নিয়ে সরল বৃন্তটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একেকটি পাপড়িই যেন একেকটি ফুল। বাকি মেয়ে-ক’টির মতো তার কাঁখেও বুড়িগঙ্গার জলে ভরা পেতলের কলসী। এই কলসী এবং নিতম্ব, দুই- ই মিশে একাকার হয়ে আছে। দুই-ই টলমল। এমনই সুন্দর সাবলীল এবং বেপরোয়া তার চলার ভঙ্গি যে মনে হয় কোনো নিঃশব্দ সংগীতের সঙ্গে তাল রেখে পা ফেলছে বা এ-পা-ফেলার ঢং যে কোনো ওস্তাদ নর্তক-নর্তকীর ঈর্ষার বস্তু হতে পারে তাতে আর সন্দেহ কী। এই চালে দুটি সোনার বাটির মতো তার বক্ষস্থল ঈষৎ নেচে উঠছে । আরেকটু নাচলেই হয়তো, করতালের মতো বেজে উঠবে। যে-মেয়ের উদ্ভাসিত রূপ পৃথিবীর তাবৎ পুরুষদের সমস্ত সুর্য-কিরণকে সজীব ক’রে তোলে, তার কোথা থেকেই-বা শুরু করি, আর কোথায়ই-বা শেষ করি। একই দেহে একই সঙ্গে এত রূপ দেখবার পক্ষে বিধাতা পুরুষদের দুটিমাত্র চোখ দিয়ে যেন বিশেষ অবিচার করেছেন কারণ, একদিক দেখতে গিয়ে যে আরেকদিক বাদ পড়ে যায়। তাই এক কথায় বলি, এ-যুগের রাধা। পরে শুনেছিলাম যে, তার মা নাকি তাকে সত্যি-সত্যিই হরিদাসী ব’লে ডাকত। জমিদারপুত্র, বিশ্ববিখ্যাত সাঁতারু থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান আছে, এমন লেখক এবং কবিদেরও হরিদাসীর দাস হতে দেখেছি।
হরিদাসীর নাকে একটি নথ্। সেটিতে দুটি ছোট্ট মুক্তো বসানো। ফাল্গুনের সকালের আলোয় এ-মুক্তো ঠিক দুটি বেদানার দানার মতো ঝক্ঝক্ ক’রে উঠেছে। বারবনিতাদের ভাষায় ষোলো-সতেরো বছরের মেয়ের নাকে এই নথ্ নাকি অক্ষতযোনির পরিচায়ক।
হরিদাসীদের দল ইতিমধ্যে আমাদের বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। ন’দার ছট্-ফটানিও বেশ বাড়ছে। সার্টের কলারটি আরেকবার উঁচিয়ে দিয়ে পকেট থেকে চিরুনি বের ক’রে চুলটা ব্যাকব্রাশ করে নিল। হরিদাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করবার উদ্দেশ্যে দু-তিন বার চাপা কাশি দেয়। তারপর, পকেট থেকে একটি সিকি বের করে। হরিদাসী প্রায় আমাদের বাড়ির সুমুখে এসে পৌঁচেছে, ঠিক এমনসময় সিকিটি ন’দার হাত থেকে ফস্কে গিয়ে গড়াতে-গড়াতে হরিদাসীর পায়ের কাছে গিয়ে থামল। ন’দার হাতের সাফাই দেখে আমি হতভম্ব। তাড়াতাড়ি রোয়াক থেকে নেমে সিকিটি তুলতে গিয়ে হরিদাসীর সঙ্গে চোখা চোখি হ’ল।
এই ঘটনার কয়েকদিন পরেকার কথা। সেদিন অমাবস্যা। শালপাতার একটি ঠোঙায় সাদা বাতাসা এবং ছানার মুড়কি সাজিয়ে মা আমাকে কালীবাড়ি পাঠিয়ে দিলেন মন্দিরের দরজায় বারবনিতাদের ভিড়। তাদের মধ্যে একটি মেয়ে প্রবেশপথের চৌকাঠে মাথা ছুঁয়ে সামনের দিকে মুখ ফেরাল। দেখি সেই পাকা লিচুর মতো মুখটি। নাকে নথ্ নেই।
সেদিন শনিবার। বিকেল প্রায় সাড়ে-পাঁচটা বাজে। একটা ঘোড়ার গাড়ি এসে আমাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়াল। সেজদা গাড়ি থেকে নেমে কোচোয়ানকে ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে, অতিরিক্ত একটাকা বক্শিশ দিল। সেজোবাবুর চোখেমুখে খুশি যেন আর ধরছে না। আমার বুঝতে কোনোই অসুবিধে হ’ল না যে, ঘোড়দৌড়ের মাঠে আজ বেশ মোটারকম একটি অঙ্কের আয় হয়েছে। জামা-কাপড় ছেড়ে স্নানের ঘরে ঢুকে ‘ও আমার বাদল মঞ্জরী’ গানের কলিটি গুনগুনিয়ে গাইতে থাকল। বেরিয়ে এসে করিম খানসামার দোকান থেকে মাটন্ কাটলেট আর পরোটা আনবার জন্যে আমাকে পাঠিয়ে দিল। জলখাবার খেয়ে পাটকরা ধুতি, সাদা সার্ট আর গ্রীসিয়ান্ কাটের সাদা জুতো প’রে গানের কলিটি ভাঁজতে-ভাঁজতে সেজোবাবু তাদের ক্লাবের দিকে রওনা দিল। ন’বাবুও তার জামাকাপড় ইস্ত্রি মেরে স্নান সারল। তারও মুখখানিতে আজ বেশ খুশি-খুশি ভাব। আয়নার সামনে অনেকক্ষণ ধরে পাউডার- ক্রীমের প্রসাধন সেরে হাতে একটি বেলফুলের মালা ঝুলিয়ে, হরিদাসীদের পাড়ার দিকে চ’লে গেল।
সেন-পরিবারের সবার মধ্যে ক্রোধের বৃত্তিটি একটু বেশিই প্রবল ছিল বলা যায়। ব্যক্তিবিশেষে, শুধু ডিগ্রির এবং বাহ্যিক প্রকাশভঙ্গির যা তফাৎ। কিন্তু এ-ব্যাপারে সেজোবাবুর জুড়ি মেলা মুস্কিল। বিধাতা যেন মুক্তহস্তে তাকে এ-বৃত্তির একটি কালো মুকুট পরিয়ে দিয়েছিলেন।
রাত্রি তখন দুটো কি তিনটে। ঢাকা শহরের নিস্তদ্ধ শব্দসমুদ্রে বিরাট ঢেউ তুলে দিয়ে একটি বিকট চিৎকার আমাদের বাড়ির একতলা থেকে উঠে তেতলায় আমাদের শোবার ঘরে প্রবেশ করল। ভাগ্যক্রমে মা তখন বাড়ি ছিলেন না। তাঁর কনিষ্ঠ তিনটি সন্তানকে নিয়ে মাদারিপুরে তাঁর একমাত্র জীবিতা ভগ্নীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। আমি এবং আমার অগ্রজ, দু-জন এক বিছানায় ঘুমোচ্ছিলাম। সেই কানফাটা চিৎকারে আমরা দু-জনেই ধড়ফড় ক’রে উঠে বসলাম। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনতেই বোঝা গেল সেজোবাবু ন’বাবুকে ধরে পেটাচ্ছে। আমরা দু-ভাই আতঙ্কে জড়সড়। রাত দুপুরে এ-মারপিট কিসের, জানবার কৌতূহলে আমরা এক- পা, দু-পা ক’রে তিনতলায় সিঁড়িটির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। একতলায় তখন কুরুক্ষেত্র চলেছে। সেজোবাবুর তুলনায়, ন’বাবুর শরীরটিতে মাংসপেশীর বেশ অভাব ছিল। তাই হয়তো সেজোবাবুর হাতের লাঠিটি ন’বাবুর পিঠে একটি ঢিলে চামড়ার ঢাকের মতো ধপ্ আওয়াজ করছে। ভ্যাপসা গরমে একটি বিশ্রী গন্ধ, এ কতলার স্যাঁতসেঁতে হাওয়ার সঙ্গে মিশে আমাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠল। একটু মনোযোগ দিতেই বুঝতে আর বাকি রইল না যে, এ-দুর্গন্ধ সেজোবাবুর মুখ থকে বেরুচ্ছে। গীতায় বলে যে, ‘কাম, মদ্য ইত্যাদির সহচর ক্রোধ। ইহা অতি উগ্ৰ। ইহার উদর কিছুতেই পূর্ণ হয় না। ইহা মানুষের পরম শত্রু।’ বৈশাখের এই রাত্রে তার চরম রূপায়ণ দেখে অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়েছিলাম।
একদিকে সেজোবাবুর ক্রোধের চিৎকার, অন্যদিকে ন’বাবুর কান্নার চিৎকার, এ-দুই মিলে আমাদের দু-ভাইয়ের কাছে সে-রাত্রিটি একটি নরকসুলভ বিভীষিকা হয়ে উঠল, যার কথা মনে এলে আজও আমি সন্ত্রস্ত বোধ করি। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে বৈমাত্র দাদারাও বাড়ির উত্তর খণ্ডের থেকে ছুটে এলেন। এল দু-জন পাড়াপড়শিও। সেজোবাবুর ক্রোধের মূর্তি দেখে কেউই তার দিকে এগুতে সাহস পেল না। প্রত্যেকটি লাঠির আঘাতের সঙ্গে ন’বাবু চিৎকার করে বলছে, ‘আমি নিইনি, আমি নিইনি’। এ-ঘটনার কয়েকদিনের পর শুনেছিলাম যে ন’বাবু সেজোবাবুর পকেট থেকে ঘোড়দৌড়ের মাঠে লাভ করা আয়ের একটি অংশ সরিয়ে ফেলেছিল। মার খেয়ে ছোটোভাই যখন আধমরা অবস্থায় নির্বাক হয়ে গেল, বড়োভাই তখন হাতের লাঠিটি দিয়ে দরজা, জানালা, টেবিল, চেয়ার, বাসন- কোসন্, সব লণ্ডভণ্ড ক’রে ফেলল। দোতলায় উঠে এসে ঠিক তেমনি এক তাণ্ডব করল। আমরা দু-ভাই তখন তেতলার ঘরে ঢুকে, দরজায় খিল্ মেরে এক কোণে কুঁকড়ে আছি। দোতলায় কাউকে না-দেখতে পেয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে তেতলায় উঠে, আমাদের দরজায় লাথি মারল। চিৎকার ক’রে আমাদের ডাকল। সাড়া না- পেয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল। অন্ধকার ঘরটিতে আমরা দু-জন তখন মা-কে স্মরণ করছি। আবার কখনো ভগবানের কাছে আকুল প্রার্থনা জানাচ্ছি। অন্ধকারে তার হাতের লাঠিটি দিয়ে আমাদের পড়ার টেবিলে বাড়ি দিতেই লাঠিটি দু-খণ্ড হয়ে গেল। স্বয়ং ভগবানেরই হোক, আর মা-র অদৃশ্য আশীর্বাদেই হোক, সে-রাত্রি, সেজোবাবু আমাদের ওপর গালিগালাজের শিলাবৃষ্টি বর্ষণ ক’রেই ক্ষান্ত হ’ল ।
পতনোন্মুখী মানুষ যে একদিন ঊর্ধ্বমুখী হ’তে পারে তার কথা বলতে গিয়ে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব একটি অপার্থিব পাখির কথা বলতেন। যে-পাখি মহাশূন্যে উড়ে বেড়ায় এবং সেখানেই ডিম পাড়ে। সে-ডিম পৃথিবীর চুম্বক টানে বিদ্যুৎবেগে নিচের দিকে পড়তে থাকে। পৃথিবীর সংঘাতে টুকরো-টুকরো হবার ঠিক আগেই ডিম থেকে পক্ষীশাবক ফুটে বেরিয়ে ডানা মেলে মহাকাশের দিকে ছুট্ দেয়। আমার এই ভায়েরা অন্ধকার পাতালের এমনই অতলে নেমে গিয়েছিল যে, আকাশের দিকে আর কোনোদিন মুখ তুলতে পারেনি।