পার্টনার, এজেন্ট
১৬৫০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে যেসব ভারতীয়দের সঙ্গে কোম্পানির অফিসার ও ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের লেনদেন চলে, তাদের পাঁচটা শ্রেণিতে ভাগ করা যায়— বড় ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান বা পরিবার, ব্যবসায়ী ও জাহাজের মালিক, এজেন্ট বা ঠিকাদার, কারিগর, ও ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের ভারতীয় পার্টনার। এ ছাড়াও হাজার হাজার মালবাহক, যেমন ক্যারাভান চালক বা নদীতে যারা নৌকায় মাল নিয়ে যেত, আরও অনেকে ইউরোপীয়দের সঙ্গে কারবার করত। কিন্তু এদের সম্বন্ধে বিশদ তথ্য পাওয়া যায় না। এই পাঁচটা শ্রেণির কারবারিদের কথা আমরা কতটা জানি?
ব্যাঙ্কার
শহুরে ক্যাপিটালিস্টদের মধ্যে সবথেকে ধনী ও মুখ্য ছিল ব্যাঙ্কাররা, বিশেষ করে যারা বিভিন্ন কারেন্সি বিনিময়ের ব্যাবসা চালাত। শ্রফ, কোঠিওয়াল, মহাজন, পেধি ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত এই ব্যাঙ্কাররা টাকা জমা রাখত না। এদের কাজ ছিল প্রধানত পণ্য ব্যাবসায় ধার দেওয়া, কখনও কখনও জমিদার ও সামন্ত রাজাদের হয়ে রাজস্ব জমা করা। টাকা ভারতের সর্বত্রই দুষ্প্রাপ্য ছিল, কাজেই ব্যাঙ্কাররা যে রমরমা ব্যাবসা চালাবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
কোম্পানিকে এদের দ্বারস্থ হতে হত নানান কারণে। যে রুপো দিয়ে কোম্পানি কাপড় কিনবে, সেই রুপো ভারতে আমদানি হত স্প্যানিশ রৌপ্যমুদ্রার আকারে। ভারতীয় ব্যাঙ্কাররা এই মুদ্রা ভাল বাট্টা নিয়ে ভারতীয় টাকায় বদলে দিত। রুপোর আমদানি কোনও কারণে আটকে গেলে কোম্পানিকে আবার এদের কাছ থেকেই ধার নিতে হয়। টাকা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পাঠাতে গেলেও এদের সাহায্য চাই। কারণ এরা শুধু দুই রাজ্যের টাকার বিনিময় মূল্য জানে তাই নয়, ব্যাঙ্কার্স ড্রাফ্ট, বা হুন্ডি ব্যবহার করে দূর দেশে নিশ্চিন্তে টাকা পাঠাবার ব্যবস্থাও করে দিতে পারে। আঠারো শতকে হুন্ডির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার রাজস্বের এক অংশ নিয়মিত বম্বে বা সুরাটে পাঠাত।
ব্রিটিশ রাজত্বের গোড়ার দিকে ব্যাঙ্কারদের অবস্থা পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন দুই দিকেই। আঞ্চলিক আর্থিক ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটার কারণে টাকা- বিনিময় জাতীয় কারবার উঠে যেতে থাকে। এই কাজের জন্যে কোম্পানির কাছে দেশি ব্যাঙ্কারদের প্রয়োজন ছিল না। এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রতিষ্ঠান, জগৎশেঠ, মূলত এই কারণেই প্রথমে অপ্রাসঙ্গিক ও পরে দেউলে হয়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে, নতুন এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আওতায় এলে বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে টাকাপয়সার লেনদেন বাড়তে থাকে। যেমন ১৭৭৫ সালে বেনারস অধিগ্রহণের পরে এই শহরের বাণিজ্যিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে মাল নিয়ে যাওয়ার প্রধান রাস্তার উপরে অবস্থিত এই শহরের শুধু যে কলকাতার সঙ্গে ব্যাবসা বাড়ে তাই নয়, পশ্চিমে রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে দিল্লি, আগ্রা, মথুরা থেকে অনেক প্রমুখ মহাজনরা এখানে চলে আসে। মহাজনি কারবারের উপর সাম্রাজ্য বিস্তারের সুফল আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায় বম্বে-কলকাতা- মাদ্রাজ শহরে।
বণিক
ইন্দো-ইউরোপীয় বাণিজ্যের জন্যে ভারতীয় বণিকদের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি, বরং উলটোটাই হয়েছে। যে বন্দরগুলি ইন্দো-ইউরোপীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল সেগুলি একে অন্যের থেকে অনেকটা দূরে, ফলে কোম্পানির নিজের জাহাজ এই বন্দরগুলির মধ্যে যাতায়াতের জন্যে, বা বড় বন্দরের সঙ্গে ছোট ছোট উপকূলের বাজারগুলির যোগাযোগ করার জন্যে যথেষ্ট ছিল না। উপকূলের এই শাখা বাণিজ্যে, যাকে বলা হত কান্ট্রি ট্রেড, প্রচুর ভারতীয় এবং ইউরোপিয়ান টাকা খাটাত। কোম্পানির নিজের বাণিজ্যের যখন পড়তি অবস্থা, তখন এই কান্ট্রি ট্রেডার্সরা উপকূল ছেড়ে ভারত-চিন, ভারত-দক্ষিণ-পূর্ব-এশিয়া বা ভারত-আফ্রিকা ব্যাবসায় ঢোকে।
যারা কান্ট্রি ট্রেডে পয়সা করে এ রকম ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও জাহাজিদের মধ্যে প্রথমেই নাম করতে হয় পার্সিদের। পার্সিরা ১৬০০ সালের আগেই দক্ষিণ গুজরাটের উপকূল অঞ্চলে বাস করতে আসে। শুরুতে তারা ছিল চাষি, পরে ছুতোর মিস্তিরি, আরও পরে কাঠের কারবারি, জাহাজ নির্মাতা, জাহাজের মালিক। ইন্দো-ইউরোপীয় বাণিজ্য শুরু হলে কিছু পার্সি পরিবার সুরাটে চলে আসে। বম্বে শহরের উত্থানের পরে সুরাটের পার্সি আবার অনেকে বম্বে চলে আসে। ব্যবসায়ী হিসেবে যে ক’জন পার্সি বিশেষ সাফল্য পান তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফ্রামজি কাওয়াসজি বানাজি এবং রুস্তমজি কাওয়াসজি— দু’জনেই উনিশ শতকে বম্বে ও কলকাতার বিখ্যাত জাহাজি। নাসেরওয়ানজি কাওয়াসজি বোমানজি ছিলেন উনিশ শতকের কাপড় কলের মালিক দিনশ পেতিত সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। রুস্তমজি কামা উনিশ শতকের প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও ব্যবসায়ী খার্শেৎজি কামা (যাঁর নামে বম্বের কে আর কামা ইন্সটিটিউট তৈরি হয়)-র বাবা।
পার্সি কান্ট্রি ট্রেডের স্বর্ণযুগ শুরু হয় আঠারো শতকের শেষে, এবং চলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। চিন ও বর্মায় যুদ্ধ বাধলে (যথাক্রমে ১৮৩৯-৪২, ও ১৮২৪, ১৮৫২-৩) পার্সিরা সেনাবাহিনীর রসদ জোগান দেয়। ইউরোপে জঙ্গল সাবাড় হলে ওক কাঠের দাম বাড়তে থাকে, আর সেইসঙ্গে জাহাজ নির্মাণের জন্যে বর্মা ও মালাবারের সেগুন কাঠের চাহিদাও বাড়ে। পার্সিদের এই কাঠের ব্যাবসা ভাল জানা ছিল। ১৮৩৩-এ কোম্পানির চিনে একচেটিয়া ব্যাবসা করার চার্টার শেষ হলে অনেকগুলি বড় জাহাজ সস্তায় বিক্রি হয়, কেনে প্রধানত পার্সিরা। সবথেকে বড় কথা, পার্সিরা জাহাজ তৈরি ও মেরামতির কাজে আগে থেকেই যুক্ত ছিল, যার ফলে অন্যান্য অনেক কান্ট্রি ট্রেডারদেরও এদের উপর নির্ভর করতে হত বা পার্সিদের সঙ্গে পার্টনারশিপ করে ব্যাবসায় নামতে হত। পার্সিদের তৈরি জাহাজগুলি আয়তনে ছোট হত, কিন্তু মজবুত বলে সুনাম ছিল।
বম্বের সঙ্গে তুলনায় মাদ্রাজ ও কলকাতায় জাহাজ ব্যাবসা খুব একটা বাড়েনি। কিন্তু এই বন্দরগুলিও কান্ট্রি ট্রেডারদের ঘাঁটি হয়ে ওঠে। করমণ্ডল উপকূলে প্রধান ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ছিল তেলুগু বণিকরা, যাদের অনেকে দাক্ষিণাত্যে যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালীন মাদ্রাজ ও পণ্ডিচেরিতে চলে আসে। একই সঙ্গে অনেক তেলুগু তাঁতিও এইসব শহরে এসে ইন্দো-ইউরোপিয়ান বাণিজ্যে যোগ দেয়। মাদ্রাজের চিন্তাদ্রিপেট এলাকা এককালে তাঁতিদের পাড়া ছিল। এদের মধ্যে সম্পদশালী যারা তারা কেউ কেউ কান্ট্রি ট্রেডে যোগ দেয়। অনেকে ইউরোপিয়ানদের হয়ে ঠিকাদারি করত।
পার্সিদের মতোই আর এক আধা-বিদেশি সম্প্রদায়, আর্মেনিয়ানরা, ইন্দো-ইউরোপের ব্যবসায় বড় ভূমিকা নেয়। ইস্ফাহানের জুলফা এলাকায় আদি নিবাস, আর্মেনিয়ান বণিকরা ভারতে আসে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে। ব্যবসায়ী হিসেবে এদের খ্যাতি ছিল, তাই মাদ্রাজের মতো বাণিজ্যপ্রধান শহরে এরা সম্মানের সঙ্গে বাস করতে থাকে। মাদ্রাজে প্রথম আর্মেনিয়ান উপনিবেশের পত্তন ১৭০০-র কাছাকাছি। আঠারো শতকে এরা ইরানের আর্মেনিয়ান নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আরব সাগরে ব্যাবসা করে চলে ও পূর্বদিকে ম্যানিলা থেকে মাদ্রাজ স্প্যানিশ রুপো নিয়ে আসার কাজও করে।
দেশীয় বণিকদের ঘাঁটি হিসেবে কলকাতার উত্থান সতেরো শতকের মাঝামাঝি। এই সময়ের কিছু পরে বাঙালি, পার্সি, গুজরাটি ও উত্তর ভারতীয়রা, প্রধানত মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা কলকাতায় বিনিয়োগ করে। ১৭৫০ নাগাদ অনেক সম্পন্ন বাঙালির কলকাতায় চলে আসার কারণ বাংলার পশ্চিম সীমানায় মারাঠা সৈন্যদের উৎপাত। কলকাতার আরও পুরনো বাসিন্দাদের মধ্যে প্রধান কাপড়ের ব্যবসায়ী শেঠ ও বসাক সম্প্রদায়। এদের বেশ কয়েকটা পরিবার মধ্যযুগের প্রধান বন্দর সপ্তগ্রাম থেকে বেরিয়ে আসে ১৫০০-র শেষদিকে, যখন সপ্তগ্রামের কাছে সরস্বতী নদীর নাব্যতা কমে যেতে শুরু করে। কলকাতায় এদের পরিচিতি ছিল ‘জঙ্গলকাটা’ নামে। কলকাতার প্রাচীনতম পাড়া, বাজার ও ঘাট এদের কয়েক জনের স্মৃতি বহন করে চলেছে, যেমন শোভাবাজার, বৈষ্ণবঘাটা ও বড়বাজার।
আঠারো শতকের শেষে কয়েক জন সুবর্ণবণিক কলকাতায় আফিম ও নুনের ব্যাবসা করে বড়লোক হন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম নিমাইচরণ দে মল্লিক, রামকৃষ্ণ মল্লিক ও গঙ্গাবিষ্ণু মল্লিক। এঁদের ব্যাবসার পরিধি পার্সিদের মতো বড় ছিল না। ১৮০০-র কাছাকাছি কলকাতার বণিকসমাজের বেশ কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন প্রাণকৃষ্ণ লাহা বা মতিলাল শীল, খুব সামান্য অবস্থা থেকে বড়লোক হয়েছিলেন। সুবর্ণবণিকদের মতো এঁদের পারিবারিক পেশা ব্যাবসা ছিল না।
এ রকমই একটি সংস্থায় এক ছোকরা কেরানি ছিলেন রামদুলাল দে, যাঁর বড়লোক হওয়ার কাহিনি বেশ রোমাঞ্চকর। বর্গি হাঙ্গামায় সর্বস্বান্ত হয়ে তাঁর বাবা-মা কলকাতায় চলে আসেন ও বড়লোক আত্মীয়দের আশ্রয়ে বাস করতে থাকেন। কিশোর রামদুলাল কেরানি হয়ে যোগ দেন একটি ঠিকাদারি সংস্থায়। বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে তাঁর এতটাই সুনাম হয় যে ব্যাবসার অনেক কাঁচা টাকা তাঁর হাত দিয়েই এদিক ওদিক পাঠানো হত। কিছু দিন আগে পর্যন্ত বাঙালি স্কুলপড়ুয়াদের কাছে এই নিয়ে একটা গল্প খুব চেনা হয়ে ছিল। একবার রামদুলাল দমদমের কাছাকাছি কোনও দেনাদারের কাছ থেকে অনেক টাকা আদায় করে হেঁটে কলকাতায় ফিরছিলেন। পথে ঘন জঙ্গল, সেখানে ডাকাতের আড্ডা। ডাকাতদের সঙ্গে মোলাকাত আসন্ন টের পেয়ে রামদুলাল টাকাগুলো পুঁটলি করে গাছে বেঁধে গায়ে ধুলোকাদা মেখে এক আধপাগলা ভবঘুরের চরিত্রে এমন চমৎকার অভিনয় করেন যে ডাকাতরা অনেক আমোদ করার পর খুশি মনে নিজেদের আড্ডায় চলে যায়। পরিণত বয়সে রামদুলাল নিজে ঠিকাদারি করতেন আমেরিকান ব্যবসায়ীদের হয়ে এবং এই কাজ স্বভাবসুলভ বিশ্বাস ও দায়িত্বের সঙ্গে পালন করে কোটিপতি হয়ে যান। কৃতজ্ঞ ফিলাডেলফিয়ার ব্যবসায়ীরা তাঁকে সম্মান জানাতে একটি জাহাজের নাম রাখে রামদুলাল। রামদুলাল সমকালীন অনেক প্রতিষ্ঠানে দান করেছেন, যেমন হিন্দু কলেজ, পরবর্তী কালে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
দু’-একটা ব্যতিক্রম বাদ দিলে বাঙালি ব্যবসায়ীরা সবাই লাভের টাকা দিয়ে জমিদারি কিনেছেন। জমিগুলি ছিল বলেই হয়তো ১৮৪০-এর মন্দায় কান্ট্রি ট্রেড জাতীয় ব্যাবসা বন্ধ হতে থাকলে এঁদের অনেকে ব্যাবসার চিন্তা ছেড়েছুড়ে জমিদারিতে মন দিলেন।
এজেন্ট
কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে কয়েক জন ভারতীয় পাওয়া যেত যাদের বলা যেতে পারে সংবাদদাতা বা কখনও কখনও গুপ্তচর। এরা স্থানীয় রাজ্যগুলির ভিতরকার খবর নিয়ে এসে অফিসারদের জানাত। বাক্যনবিশ, হরকরা বা ভকিল নামে পরিচিত এইসব লোকেদের কাজটা যদিও জটিল, কোম্পানি অফিসারদের কাছে এদের গুরুত্ব নির্ভর করত রাজনৈতিক হাওয়া কতটা গরম তার উপরে। মারাঠা যুদ্ধ সমাপ্ত হওয়ার পরে (১৮১৮) এই ধরনের কাজের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে। পরোক্ষ শাসনের যুগে স্থানীয় রাজ্যগুলির রাজধানীতে কী চক্রান্ত হয়ে চলেছে এ বিষয়ে ব্রিটিশ রেসিডেন্টই যথেষ্ট অবহিত থাকত।
মাইনে-করা বা মোটা কমিশনধারী ভারতীয় কর্মচারীদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিল চিফ এজেন্ট, মুখ্য ঠিকাদার। কোম্পানি ব্যাবসার প্রথম যুগের এজেন্টরা হত সামন্ত বা সর্দার স্থানীয় লোক, যাদের হাতে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আছে, যাদের স্থানীয় দরবারে প্রতিপত্তি আছে। নিজেদের বাহিনী ব্যবহার করে এরা বায়না নেওয়া তাঁতিদের দিয়ে কাজ আদায় করাত। মাদ্রাজ, বম্বে ও কলকাতা প্রতিষ্ঠার পরে মুখ্য ঠিকাদারদের চরিত্র বদলে যায়। প্রধান ঠিকাদাররা আসত স্থানীয় বাজারের ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে থেকে। কলকাতায় কোম্পানি শেঠ- বসাক সম্প্রদায় থেকে ঠিকাদার খুঁজত, মুর্শিদাবাদে উত্তর ভারতীয় ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে, মাদ্রাজে তেলুগু বণিকদের মধ্যে, ও সুরাটে পার্সিদের মধ্যে।
অনেক রকম এজেন্টের মধ্যে দুটো টাইপ উল্লেখযোগ্য। একজন ছিল ইউরোপীয় বণিক সংস্থার সেক্রেটারি গোছের। করমণ্ডলে নাম দুবাশ অর্থাৎ দোভাষী, বাংলায় বেনিয়ান। আর দ্বিতীয় প্রধান ঠিকাদার বা ব্রোকার, যে মাল জোগানের সার্বিক দায়িত্বে থাকত। কখনও কখনও অবশ্য এই দুটো দায়িত্বই এক লোকই পালন করত। ভারতীয়দের সঙ্গে ব্যাবসাপাতি করতে গেলে ইউরোপিয়ানরা প্রথমেই একজন সর্দার খুঁজত। এই পদ্ধতিতে কনট্র্যাক্ট বলবৎ করতে সুবিধে হয়। অসুবিধে হল, যারা সর্দার হতে পারল না বা যারা সর্দার পদে মনোনীত লোকটিকে পছন্দ করত না, তারা নানাভাবে কনট্র্যাক্টে বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কনসালটেশন বুকগুলি এই খটাখটির বিবরণে ভরা।
ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসায় সবথেকে বিখ্যাত দুবাশ আনন্দরঙ্গ পিল্লাই। ইনি অবশ্য কাজ করেছেন ফরাসিদের সঙ্গে, ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে নয়। আনন্দরঙ্গ-র খ্যাতির কারণ তিনি ডায়েরি লিখতেন। ১৭৪০-এর কাছাকাছি সময়ে দক্ষিণ ভারতের ব্যাবসা ও রাজনীতি বোঝার জন্যে এই ডায়েরির মূল্য অপরিসীম। ডায়েরির বেশিটাই পরিবার-পরিজনজনিত নানান খুঁটিনাটি ঝামেলার বিরক্তিকর ফিরিস্তি। তবে এই ক্লান্তিকর বর্ণনার মধ্যে মধ্যে চমকপ্রদ কিছু কথাবার্তা খুঁজে পাওয়া যায়। পিল্লাই জানাচ্ছেন যে ফরাসি কোম্পানির অর্ধেক বাণিজ্য, তদুপরি প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের অনেক মাল, তাঁর হাত দিয়েই যেত। আর এই বিশাল সাম্রাজ্য রক্ষা করতে তাঁকে এত বেশি সংখ্যায় এজেন্ট-দালাল মোতায়েন করতে হয়েছে যে তাঁর নিজের লাভ কমই। তা সত্ত্বেও, ফরাসি গভর্নর দুপ্লে পিল্লাইকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘কেপ কমোরিন থেকে বাংলা, গোলকোন্ডা ও মাইসোর পর্যন্ত এলাকায় এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে আপনার বন্ধু নয় এবং আপনার সই করা হুন্ডি সসম্মানে ভাঙিয়ে দিতে রাজি হবে না।’ পিল্লাইয়ের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝি যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বিরাট সংস্থার পার্টনার হওয়া ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ছিল অত্যন্ত সম্মানজনক, লাভের পরিমাণ যাই হোক না কেন।
কোম্পানি ও এজেন্টদের সম্পর্ক একেবারেই সুখকর ছিল না। একে অপরের উপর নির্ভরশীল হলেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। সম্পর্ক খারাপ হওয়ার পিছনে একটা কারণ পিল্লাইয়ের ডায়েরি থেকে জানতে পারি— এজেন্টকে তার কনট্র্যাক্টর-সাম্রাজ্য চালাতে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে হত। করেও সবসময়ে কনট্র্যাক্টরদের হাতে রাখা সম্ভব হত না। কোম্পানির এসব সমস্যা ও অর্থব্যয় নিয়ে বিশেষ ধারণাও ছিল না, বেশি জানবার আগ্রহও ছিল না। অথচ কাজ ঠিকভাবে না হলে এজেন্টদের কড়া কথা তো শুনতে হতই, এজেন্টরা ডাচ বা প্রাইভেট বণিকদের চর কি না সেই সন্দেহও উঠতে পারে। বচসার আরেকটা কারণ কোম্পানির কাছে মৃত কনট্র্যাক্টরদের অপরিশোধিত ধার। ভারতীয় আইনে মৃত ব্যক্তির ধার তার ছেলের উপর বর্তায় কি না তা নিয়ে তর্ক সম্ভব! ইউরোপীয় আইনে দায় পরের প্রজন্মের উপর চাপে। এই নিয়ে গন্ডগোল লেগেই থাকত।
তৃতীয় সমস্যা স্বার্থের সংঘাত। হুগলিতে বা মসুলিপতনমে স্থানীয় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের দু’মুখো চাপের মধ্যে কাজ করতে হত, একদিকে কোম্পানি, অন্যদিকে নবাবের প্রতিনিধি। কোম্পানির সঙ্গে নবাবের গন্ডগোল বাধলে এদের উভয়সংকট। ১৬৭৮-৭৯ সালে গোপনে গোলকোন্ডার রাজার সঙ্গে আলাপ- আলোচনা করার অপরাধে মসুলিপতনমের দুবাশ কোলা ভেনকাদ্রিকে কোম্পানি জেলে পুরে দেয়। আবার একাধিক প্রমুখ এজেন্ট যদি ভিন্ন জাতির লোক হয়, তা হলে আরেক গোলমাল, এরা কোম্পানি-আহরিত ক্ষমতা ব্যবহার করে সামাজিক দাঙ্গা শুরু করে দেবে। সুরাট শহরে কোম্পানি পার্সি-হিন্দু প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে যায়। ১৭৩০-এর কাছাকাছি পার্সি বণিকরা হিন্দু এজেন্ট জগন্নাথ লালদাসের বিরুদ্ধে কোম্পানির কান ভাঙাতে এতটাই সফল হয়েছিল যে লালদাসকে প্রাণের ভয়ে সুরাট ছেড়ে পালিয়ে পেশোয়ার দরবারে আশ্রয় নিতে হয়। সমসাময়িক পার্সি এজেন্ট রুস্তম মানোক, তাঁর তিন ছেলে ও প্রধান হিন্দু এজেন্ট লালদাসের মধ্যে ঝগড়ার জের লন্ডনের কোর্ট অফ ডিরেক্টরস অবধি গড়ায়।
গন্ডগোল বাধবার কোনও নির্দিষ্ট কারণ না থাকলেও এজেন্টের উপর কোম্পানিকে এত বেশি নির্ভর করতে হত যে তার থেকেই অফিসাররা উদ্বেগে কাঁটা হয়ে থাকত। এজেন্ট একদিকে তার কনট্র্যাক্টরদের ও তাঁতিদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, অন্যদিকে কোম্পানি অফিসারদের নানাভাবে ঠকানোর চেষ্টা করছে। লন্ডন অফিস ব্যাপারটা বুঝত, কিন্তু সাবধানবাণী এবং ব্যাপার বেশিদূর গড়ালে গালাগালি দেওয়া ছাড়া আর কোনও অস্ত্র তাদের জানা ছিল না। ভারতগামী নতুন অফিসারদের বলা হত, ‘এজেন্ট যদিও মোটামুটি দায়িত্বের সঙ্গেই কাজ করে, তবু কোনও অবস্থাতেই তাকে মাথায় তুলবে না।’ এর বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না, এজেন্ট যে শুধু অপরিহার্য তাই নয়, তার পিছনে জোর ছিল সেইসব অফিসারদের যাদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে এজেন্ট সাহায্য করে। কখনও গন্ডগোল বাড়লে এজেন্টের স্বজাতির লোকেরাও অফিসারদের ভয় দেখাত।
অনেক সময়ে সাবধানবাণীতে কাজ না হলে এজেন্টের উপর রাগ বেরিয়ে আসত জাতিবিদ্বেষের চেহারায়। ১৬৬০ সালে সুরাটের একজন অফিসার লিখলেন, ‘এই লোকগুলো ধনী, ধূর্ত, হিংসুটে এবং ক্ষমতাশালী— এরা ঘুষ দিয়ে, ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, নানারকম অসৎ উপায়ে শত্রুদের শেষ করে দিতে পারে; এরা নির্লজ্জ এবং বিবেক বলে এদের কিছু নেই।” দুবাশ শব্দটার আক্ষরিক অর্থ দুভাষী, কিন্তু দুবাশের ইংরেজ বন্ধুরা কথাটা ব্যবহার করত দু’মুখো, অর্থাৎ মিথ্যেবাদী অর্থে।
দু’-একটা উদাহরণ দিলে এই সম্পর্কের জটিলতা বোঝানো যায়। ১৬৬১- ৯০ সালের মধ্যে করমণ্ডল উপকূলে কাশি ভিরান্না ছিলেন কোম্পানির মুখ্য দুবাশ, কনসালটেশনস বইয়ে এঁর নাম ভেরোনা। ভিরান্নার সাহায্য ছাড়া কোম্পানির কোনও কাজই সম্পন্ন করার উপায় ছিল না, হিসেব রক্ষা থেকে শুরু করে মাল নিয়ে যাওয়া, নৌকা জোগাড় করা, পলাতক মাঝিদের ধরে আনা, তাঁতিদের সঙ্গে দরদস্তুর করা, এমনকী মাদ্রাজে কর সংগ্রহ পর্যন্ত। বলাই বাহুল্য ভিরান্না ক্ষমতাশালী লোক ছিলেন। তাঁর জাহাজ মাদ্রাজ ও বাংলার মধ্যে যাতায়াত করত, ফলে মাল সংগ্রহের কাজে বা খাদ্যশস্য জোগানে ভিরান্না অপরিহার্য ছিলেন। কোম্পানির লন্ডন অফিস করমণ্ডলের নতুন অধ্যক্ষ স্ট্রেইনসহ্যাম মাস্টারকে যে নিয়োগপত্র দিল তাতে লেখা ছিল, ‘ভেরোনাকে ঠিকাদারির কাজে সর্বেসর্বা হয়ে উঠতে দেবেন না, এর ফলে অনেক দুর্ভোগের সৃষ্টি হতে পারে।’
১৬৭০ সালে বালেশ্বরে গন্ডগোল লাগে কোম্পানি অফিসারদের সঙ্গে মুখ্য এজেন্ট খেমচাঁদ শাহের, যাকে ইংরেজরা ভারতীয় নামের উচ্চারণে স্বভাবসিদ্ধ সতর্কতা রক্ষা করে চিমচ্যামশা নামে ডাকত। খেমচাঁদ যে সৎ ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কিন্তু মোগল নবাব ভদ্রলোককে টাকার জন্যে এত চাপ দিতেন যে তাঁর আসল মালিক কে তাই নিয়ে কোম্পানির কাছেও বারবার জবাবদিহি করতে হয়।
তাঁতিদের সঙ্গে চুক্তিও গন্ডগোলে ভরা। তাঁতের কাপড় কিনবার পদ্ধতি ১৬২০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে চারটে পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমে কোম্পানি ইন্দোনেশিয়ায় গোলমরিচ কেনার মতোই স্থানীয় বাজার ঘুরে ঘুরে কাপড় কিনত। ১৬৮০ নাগাদ কনট্র্যাক্ট ব্যবস্থা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, কিন্তু কনট্র্যাক্টররা তখন ছিল স্থানীয় কাপড়ের ব্যবসায়ীরা। এরাই কারখানায় স্যাম্পল দেখিয়ে বহু টাকার বায়না নিয়ে তাঁতিদের গ্রামে চলে যেত। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে মসুলিপতনম কনসালটেশনস বইয়ে যে কনট্র্যাক্টের উল্লেখ আছে সেটা এই ধরনের। আঠারো শতকের প্রথম দিকে কোম্পানি কাপড়ের বায়না ও মাল ডেলিভারির পুরো দায়িত্ব দু’-একজন মুখ্য এজেন্ট বা ঠিকাদারদের উপরে দিত। সবশেষে, বাংলায় রাজত্ব শুরু করার পরে একটা চতুর্থ পর্যায় শুরু হয়, যখন কোম্পানি স্বাধীন এজেন্টদের সরিয়ে মাইনে-করা গোমস্তাদের মাধ্যমে ব্যাবসা চালাত।
অন্তত প্রথম তিনটি পর্যায়েই কনট্র্যাক্ট বলবৎ করতে কোম্পানি অফিসারদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। ডেলিভারির তারিখ কখনই রক্ষা হয় না। তাঁতিরা নির্ভয়ে একই মালের বায়না করত ইংরেজ-ডাচ-ডেনিশ ইত্যাদি অনেকগুলো ক্রেতার সঙ্গে। দাম ভাল পেলে কনট্র্যাক্টের মাল গোপনে পাচার হয়ে যাবে প্রাইভেট ব্যবসায়ীদের কাছে। বাংলায় চেষ্টা চলছে নবাবের লোকেদের কাছে নালিশ করে কোম্পানিগুলির মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দিতে। মোট কথা, কনট্র্যাক্ট সই হলেই তো চুক্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়, তার জন্যে যে আদালত ও আইন দরকার তার একান্ত অভাব। এই অবস্থায় চুক্তি রক্ষার একমাত্র মাধ্যম এজেন্ট। এজেন্ট সেই নির্ভরতার সুযোগ নিত দুই তরফেই, তাঁতিদের উপর চোখ রাঙিয়ে আর কোম্পানি অফিসারদের চোখে ধুলো দিয়ে।
নিজস্ব ব্যাবসা
ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীরা অনেকটা কোম্পানির ধাঁচেই ব্যাবসা চালাত অর্থাৎ এরাও এজেন্টদের উপরে নির্ভর করত। তবে তাদের ব্যাবসার পরিধি ছিল ছোট এবং সেই কারণে ভারতীয় এজেন্টের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পার্টনারশিপের চেহারা নিত। কলকাতায় পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই হবু প্রাইভেট ব্যবসায়ীরা বন্ধুস্থানীয় লোকেদের খবর পাঠাত একজন রাইটার (হেড কেরানি) আর একজন বেনিয়ান (এজেন্ট) দরকার। যারা যথেষ্ট পয়সাকড়ি সঙ্গে নিয়ে আসত তাদের উমেদাররা ছেঁকে ধরত। মাদ্রাজের এক ব্যবসায়ী জানালেন, ‘মৃতদেহর উপর বসে শকুনিরা যেমন তারস্বরে চিৎকার করে ঝগড়া করে’ সেই রকম ঝগড়া করতে করতে বেনিয়ান পদপ্রার্থীদের আগমন হল।
আঠারো শতকের শেষের দিকে হেড কেরানি পদে সাধারণত ইন্দো- ইউরোপিয়ান ও বেনিয়ান পদে বাঙালিরা বহাল হত। ডাচ অফিসার স্টাভোরিনাসের লেখায় জানতে পারি যে ‘বেনিয়ানের কাজ হল সব আদায় ও খরচ লিখে রাখা।’ এর হাত দিয়েই ‘যাবতীয় টাকাপয়সার লেনদেন এবং কেনাবেচার কাজ হতে থাকে।’ বেনিয়ানরা অনেক সময়ে মাইনে পেত না। ‘কিন্তু ওরা ভাল করেই জানে এক টাকার কেনাবেচায় কতটা বাড়িয়ে হিসেব লিখতে হবে।’ অর্থাৎ পার্টনারশিপ হলে কী হয়। এ ক্ষেত্রেও পারস্পরিক সন্দেহ ও ঠকে যাবার সম্ভাবনা সব সময়েই উপস্থিত।
কনট্র্যাক্ট
কোম্পানির খাতাপত্রে কেনাবেচা বা বায়নার ক্ষেত্রে ‘কনট্র্যাক্ট’, বা কখনও কখনও ‘কম্প্যাক্ট’, কথাটা খুব ব্যবহার হত। চুক্তিভঙ্গ নিয়ে বিবাদ উপস্থিত হলে তাকে বলা হত ‘ব্রিচ অফ কনট্র্যাক্ট’। দুটোই আইনি পরিভাষা, কিন্তু ভারতীয় আইনের ভাষা নয়। যতদূর জানা যায়, ভারতীয় আইনকানুনে জিনিস বিক্রি নিয়ে কথা দেওয়া বা কথার খেলাপ করা এ বিষয়ে এমন কিছু নেই যা তখনকার দেশি আদালত বা পঞ্চায়েতে গ্রাহ্য হতে পারত। ইউরোপিয়ানরা প্রায় একতরফা ভাবেই এই কথাগুলির ব্যবহার ঢুকিয়েছে। ঢুকিয়েছে যে তার বাহ্য কারণ হল জিনিস কেনাবেচায় আগাম চুক্তি ও বায়নার ব্যবহার এত বেশি পরিমাণে আগে হয়নি। ভারতে কনট্র্যাক্টের ব্যবহার হয়তো একেবারে অজানা ছিল না, কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় রপ্তানি ব্যাবসা অভাবনীয় রকমে কনট্র্যাক্টের প্রসার ঘটায়। সম্পর্কটা নতুন বলেই নতুন শব্দ প্রয়োগের দরকার ছিল।
কাপড়ের অর্ডার দেওয়া ও ডেলিভারি নেওয়ার চুক্তি লেখা হয় বম্বে, মাদ্রাজ ও কলকাতার কারখানার প্রধান আর ব্যবসায়ী বা হেড-তাঁতিদের মধ্যে, সেই কাগজে বলা থাকবে মালের পরিমাণ, দর, মাপ, সুতোর পরিমাণ ও সুতোর সূক্ষ্মতা, অগ্রিম বায়নার অর্থ, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি। মাল ডেলিভারি হলে অফিসাররা এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবে চুক্তির সঙ্গে ডেলিভারি মাল মিলছে কি না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কনট্র্যাক্ট কথাটার ব্যবহার আরও ছড়ায়, উদাহরণ, যুদ্ধ চলাকালীন সৈন্যদের রসদ জোগান নিয়ে বানজারা ক্যারাভান সর্দারদের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তি।
সব কেনাবেচায় কনট্র্যাক্ট সই করানো নিয়ে কোম্পানি অফিসারদের এমন একগুঁয়ে মনোভাব আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে। চুক্তি ভাঙলে যদি আদালতে যাওয়ার রাস্তা না থাকে তা হলে চুক্তিতে সই করিয়ে লাভটা কী হল? চুক্তির একটা ভাল দিক ছিল, হিসেব রাখতে সুবিধে হত। তা ছাড়া লন্ডন অফিস ভারতে কর্মরত অফিসারদের বিশ্বাস করত না। ফলে প্রত্যেক বার কেনাবেচায় গাদা গাদা কাগজপত্র তৈরি করে লন্ডনে পাঠাতে হত। আর সেইসব কাগজে বিক্রেতার সই থাকলে হিসেবটা বিশ্বাসযোগ্য হয়। তা ছাড়া মনে হয় এমন একটা ধারণা অনেকে মনে মনে পোষণ করত যে আইনের চোখে কনট্র্যাক্টের গুরুত্ব না থাকলেও স্থানীয় শাসক বা আদালত হয়তো চুক্তিভঙ্গ ব্যাপারটাকে অন্যায় সাব্যস্ত করবে।
এই ভাবে কোম্পানি ভারতে তাদের বন্দর-শহরগুলিকে কেন্দ্র করে এমন একটা জগৎ তৈরি করেছিল যা তৎকালীন ব্যাবসার পটভূমিতে অনেক দিক দিয়েই খুব স্বতন্ত্র। ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসে ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যবসার দীর্ঘপ্রসারী প্রভাব কনট্র্যাক্ট, কনট্র্যাক্ট আইন, আর প্রচলিত নিয়মের বাইরে গড়ে ওঠা অনেক রকমের পার্টনারশিপ। যে সব উদ্যোগী ব্যক্তির পারিবারিক পেশা ব্যাবসা নয়, এমন অনেকেও পার্টনারশিপের সুযোগ নিয়ে ব্যাবসা শুরু করে বড়লোক হয়ে যায়। ভারতীয়রা ইউরোপিয়ানদের সঙ্গে মিলে ব্যাবসা করে। পরবর্তী যুগে এই নজিরহীন পার্টনারশিপ থেকেই জন্ম নেয় আধুনিক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান। শিল্পে বিনিয়োগের অর্থ আসে এমনই সব উদ্যোগীদের পকেট থেকে যাদের পূর্বপুরুষরা ইন্দো-ইউরোপীয় ব্যাবসায় যোগ দিয়ে পয়সা করেছিল।
অবশ্যই এটাও মানতে হবে যে নজিরহীন পার্টনারশিপে ঝুঁকি ছিল প্রচুর। সবথেকে সমস্যার এবং সর্বব্যাপী ঝুঁকি পারস্পরিক সন্দেহ থেকে পার্টনারদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগে যাওয়ার। এই সমস্যার সমাধান করতেই কোম্পানি রাজ্যচালনা নিজের হাতে তুলে নিল এ রকম বললে বাড়াবাড়ি করা হবে। তবে রাজ্যচালনা নিজের হাতে নিয়ে নিতে যে সমস্যার সমাধানে আইন প্রবর্তন করা আরও সহজ হয়ে গেল তাতে সন্দেহ নেই।
রাজত্ব স্থাপনের পিছনে তাৎক্ষণিক প্রেরণা অবশ্য ছিল আঠারো শতকের যুদ্ধবিগ্রহে জড়িয়ে পড়া