সাত
পরের দিন সকালেও তারাপদ নিজেকে সামলে নিতে পারল না। চোখমুখ বসে গিয়েছে, শুকনো চেহারা। পর পর দু’ রাত্রিই ঘুম হল না বেচারির; আগের দিন কেটেছে ট্রেনে; আর কাল সারা রাত বিছানায় শুয়ে ভয়ে আতঙ্কে মরেছে । চন্দন ডাক্তার-মানুষ, তার অনেক সাহস, মড়া কাটা থেকে শুরু করে সে কত কী করেছে, সহজে ঘাবড়ে যাবার ছেলে চন্দন নয়; তবু চন্দনও কেমন বোকা হয়ে গেছে। ভয়ও পেয়েছে খানিকটা। দুজনে আলোচনা করেও বুঝতে পারছে না–এরকম ঘটনা কেমন করে ঘটে? ছোট ফুটবল সাইজের, একটা বল কেমন করে হাওয়ার মধ্যে নেচে বেড়ায়? ভৌতিক ব্যাপার? না ম্যাজিক?
যদি বিশ্বাস করে নেওয়া যায় ম্যাজিক, তবে ভয়-ভাবনার কিছু থাকে না। কিন্তু ম্যাজিক বলে ঠিক বিশ্বাস করতেও মন চাইছে না।
সকাল বেলায় মুখটুক ধুয়ে কোনো রকমে চা খেয়ে দুজনে বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়াল। বাগানে।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, কিকিরার কাছে যেতেই হবে।”
চন্দন বলল, “আমিও তাই ভাবছি। কখন যাবি।”
‘বিকেলে যাওয়া যাবে না। ভুজঙ্গ আবার আজ বিকেলের পর আমাদের সঙ্গে দেখা করবে বলেছে। যেতে হলে এখনই যাওয়া দরকার।”
চন্দন বলল, “চল, আমরা ঘুরে আসি।”
“কাউকে কিছু বলতে হবে না?”
“কী দরকার । নতুন জায়গা, কেমন সুন্দর দেখতে, আমরা একটু বেড়িয়ে বেড়াচ্ছি–এইভাবে যেতে হবে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলব, বেড়াচ্ছি। তারপরও যদি খোঁচায়, বলব–স্টেশনে যাচ্ছি ব্লেড কিনতে কিংবা সিগারেট কিনতে। “
তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, চল।”
বাগানের মধ্যে সামান্য সময় দুজনে বেড়ানোর ভাব করে ঘুরে বেড়াল। বাড়ির চার পাশ না হলেও অন্তত তিনটে পাশ দেখে নিল । ভুজঙ্গভূষণের এই পুরী যতই দুর্গ হোক, কেউ যদি পালাতে চায় নিশ্চয় পালাতে পারে । সব দিক সর্বক্ষণ আটকে রাখা সম্ভব নয়। মানুষ জেলখানা থেকেও পালায়–এখান থেকে পালানো নিশ্চয়ই তার চেয়ে কঠিন নয়।
বাগানে বেড়াতে বেড়াতেই মৃত্যুঞ্জয়কে দেখা গেল।
চন্দন বলল, “তারা, তোকে এবার একটু খেলতে হবে।”
তারাপদ অবাক চোখে বন্ধুর দিকে তাকাল।
চন্দন বলল,”তুই ওই মৃত্যুঞ্জয়টাকে ডাক। ডেকে বল, ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে। বলবি, আমরা বেড়াতে যাব। শোন, মিনমিন করে কথা বলবি না ওর সঙ্গে, হুকুমের গলায় বলবি।”
“এখানকার ছোট মহারাজাকে হুকুম? তুই বলছিস কী?” তারাপদ ঘাবড়ে গিয়ে বলল।
চন্দন বলল, “আমি ঠিকই বলছি। তুই ভুজঙ্গভূষণের সম্পত্তির মালিক হতে যাচ্ছিস। ও বেটার কোনো রাইট নেই এখানে; তোর আছে। তুই এখন থেকেই এটা দেখিয়ে যা।”
“তারপর যদি–”
“যদি-টদি বাদ দে; নো রিস্ক নো গেই।…তুই চালা না–তারপর আমি আছি।” বলে চন্দন মাতব্বরের মতন মৃত্যুঞ্জয়কে ডাকল।
মৃত্যুঞ্জয় কাছে এলে তারাপদ ছোট ফটকের তালা খুলে দিতে বলল। ঠিক হুকুমের গলায় অবশ্য বলতে পারল না।
“খুবই আশ্চর্য যে, মৃত্যুঞ্জয় সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করল, তারাপদরা কোথায় যাবে? তারপর চাকরকে ডেকে তালা খুলে দিতে বলল।
ফটকের বাইরে এসে তারাপদরা হাঁটতে লাগল। মাঠ ময়দান, গাছপালা, দূরের জঙ্গল–যেদিকে চোখ যায়–সব যেন রোদে ভেসে যাচ্ছে। শীতের রোদ, তবু কী গাঢ়, কত উষ্ণ। আকাশ নীল, রোদ যেন উপচে পড়ছে আকাশ থেকে; মাঠঘাটের ভেজা ভাব শুকিয়ে এসেছ, শিশির আর চোখে পড়ছে না। এখনো শীতের সেই শনশন হাওয়া দেয়নি, অল্পস্বল্প যা আছে তাতে ভালই লাগে।
কাল রাত্রের সেই অন্ধকার রহস্যময় ঘর, সেই আত্মার ব্যাপার-স্যাপার, বলের নাচ যেন অন্য একটা জগৎ। আর এখানকার এই রোদ, মাঠ, কুলঝোঁপ, আতাগাছের ডালে বসে পাখির ডাক–এ আর-এক জগৎ। এই জগৎ তারাপদরা বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে, কিন্তু কালকের ওই রহস্যময় ঘটনার কিছুই বুঝতে পারে না। মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন।
হেঁটে আসতে আসতে দুজনেই গল্প করছিল।
তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “চাঁদু, তুই তো ডাক্তার । আত্মা-টাত্মা কখনো দেখেছিস?”
“না ভাই, আমি মর্গও দেখেছি, বাট নো আত্মা।”
“আমি প্ল্যানচেট দেখেছি,” তারাপদ বলল, “পরলোক-টরলোক নিয়ে একবার একটা বইও পড়েছিলাম। কিছু বুঝিনি।”
“এ-সব গাঁজাখুরি…।”
“কিন্তু কাল আমরা নিজের চোখে যা দেখলাম–?”
“তাই তো ভাবছি। পি সি সরকারের ম্যাজিক যেন!”
এমন সময় একটা দেহাতী গোছের লোককে সাইকেলে করে আসতে দেখা গেল দূরে। ভুজঙ্গভবনের দিক থেকে আসছে। চন্দনের চোখে পড়েছিল।
চন্দন বলল, “তারা, ওই লোকটা এদিকে কেন আসছে?”
তারাপদ দেখল। বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি দেখতে আসছে বোধ হয়।”
“তার মানে ভুজঙ্গ আমাদের ওপর চোখ রাখতে চায়? না, মৃত্যুঞ্জয়?”
“বুঝতে পারছি না।”
দুজনেই হাঁটতে লাগল, দাঁড়াল না। চন্দন হঠাৎ বেয়াড়া গলায় গান গাইতে শুরু করল, যেন খুব খুশ মেজাজে রয়েছে।
লোকটা কাছাকাছি এল। পুরোনো সাইকেল, মাঝ বয়েসী লোক; বাঙালি বলে মনে হয় না। তারাপদদের কাছাকাছি এসেও দাঁড়াল না। একবার শুধু দেখল, খাতিরের ভঙ্গিতে মাথা নোয়ালো, তারপর চলে গেল।
সাইকেল খানিকটা এগিয়ে যেতে চন্দন বলল, “তারা, আমার মনে হচ্ছে লোকটা নজর রাখার জন্যে এসেছে। কিন্তু কেন? ভুজঙ্গ না মৃত্যুঞ্জয়, কার হুকুমে ও নজর রাখছে? আমরা পালিয়ে যাব ভাবছে নাকি?”
তারাপদ বলল, “চাঁদু, সম্পত্তির নিকুচি করেছে, চল, আমরা এই ভূতের বাড়ি থেকে পালাই।”
মাথা নেড়ে চন্দন বলল, “এত সহজে পালাব কেন রে? আরও দু-একটা দিন দেখি । অন্তত তোর পিসেমশাইয়ের অরিজিন্যাল মুখটা একটু দেখি। পালাবার জন্যে তুই ভাবিস না। ওটা আমার হাতে ছেড়ে দে। সে ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি। পালাবার জায়গা দেখে রেখেছি ভাই।
আরও একটু এগিয়ে আসতেই আচমকা পাখির ডাকের মতন শোনা গেল । ডাকটার একটা আলাদা সুর ছিল, কানে লাগে। চন্দন দাঁড়িয়ে পড়ল, তার দেখাদেখি তারাপদও দু-চার পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। চন্দন আশেপাশে তাকাল । ডানদিকে খানিকটা উঁচু জমি, মস্ত মস্ত দুই পাথর, আশেপাশে ছোট ছোট পাথর-টুকরো পড়ে আছে। রুক্ষ জায়গা, কাঁকরভরা মাটি। কোনো গাছপালা চোখে পড়ছে না। কাঁটা গাছের ছোট্ট একটু ঝোঁপ পাথরের পাশে। কোথাও কোনো পাখির চিহ্ন নেই।
চন্দন কিছু বোঝবার আগেই একটা ছোট ঢিল এসে পায়ের কাছে পড়ল । তারপরেই পাথরের আড়াল থেকে কিকিরার মুখ উঁকি মারল।
“আরে, আপনি?” চন্দন অবাক । তারাপদকে বলল, “কিকিরা।”
হাতছানি দিয়ে কিকিরা ডাকলেন।
তারাপদরা এগিয়ে গেল ।
কিকিরা বললেন, “এখানে আসুন স্যার, গুঁড়ি মেরে চলে আসুন।”
তারাপদরা পাথরের আড়ালে গেল। কিকিরা বললেন, “একটু আগেই এক চেলা গেল, দেখেছি। দেখেই শেলটার নিয়েছি।”
“আমরা আপনার কাছেই যাচ্ছিলুম।”
“আমিও আপনাদের খোঁজে আসছিলাম। মনে হচ্ছিল, দেখা হয়ে যেতেও পারে।”
“ওই লোকটাকে আপনি চেনেন?”
“না। তবে আন্দাজ করতে পারি।”
“ও কি আমাদের ওপর নজর রাখছে?”
“মনে তো হয়, স্যার। তবে ও বেটা অনেকটা চলে গেছে। দেখতে পাবে আর। যদি দেখি ফিরে আসছে, আপনাদের বলব। আপনারা সোজা ভুজঙ্গ ভয়ালের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করবেন।”
চন্দনরাও একবার দেখে নিল। লোকটা বেশ দূরে চলে গেছে। সেখান থেকে পাথরের আড়ালে তাদের দেখতে পাবে না। না গেলে কী ভাববে বলা মুশকিল। মাঠের মধ্যে দুটো লোক নিশ্চয় ভ্যানিশ হয়ে যেতে পারে না। কিন্তু অন্য সন্দেহই বা কী করবে? ভাববে, এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কিকিরা বলল, “খবর বলুন, স্যার।”
তারাপদ বলল, “খবর অনেক। কিন্তু এখানে বলব?”
“এখানেই স্যার নিরাপদ। যদি লোকটা এখনি না ফিরে আসে,তা হলে এই হল বেস্ট জায়গা।”
“যদি আসে?”
“সামনে গিয়ে মনের সুখে নিজেরা গল্প করবেন, লাফাবেন, নাচানাচি করবেন, যেন ওর মনে হয় আপনারা কলকাতার লোক, ছেলেমানুষ, বাইরে বেড়াতে এসে বেজায় খুশি হয়েছেন। “
“আপনাকে যদি দেখতে পায়?”
“পাবে না স্যার, পাবে না। আমি মিলিটারির পজিসন নিয়েছি।”
চন্দন একটা সিগারেট ধরাল।
কিকিরা বললেন, “দিন স্যার, একটা ধোঁয়া দিন। টানি।”
কিকিরা সিগারেট নিয়ে ধরালেন।
তারাপদ খুব সংক্ষেপে গতকালের ঘটনা বলল। বলে ভুজঙ্গভূষণের সঙ্গে সাক্ষাতের বিবরণটা দিল। তার গলার স্বর থেকে বোঝা যাচ্ছিল, তারাপদ উত্তেজনা, ভয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বিধার মধ্যে রয়েছে।
কিকিরা মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। আজ তাঁর বেশবাস খানিকটা অন্যরকম। পরনে পাজামা, গায়ে কেমন এক আলখাল্লা ধরনের জামা। মাথায় গরম হনুমান-টুপি। টুপির তলার দিকটা গুটোনো। পায়ে খাকি কেডস্ জুতো।
চন্দন বলল, “মশাই, ভুজঙ্গ আত্মা নামায়; আপনি জানেন?”
কিকিরা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। “জানি।”
“ব্যাপারটা কী?”
“ব্যাপারটা আপনারা এমনিতে বুঝবেন না। একে বিদেশিরা পেঁয়াস। বলে।”
“সেঁয়াস? সেটা আবার কী?”
“সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার, আত্মাটাত্মা নামানো হয়, আত্মাদের দিয়ে নানারকম ভেলকি দেখানো হয়।”
“আপনি আত্মা মানেন?”
“আমার মানামানির কথা জিজ্ঞেস করবেন না। আত্মা মানি কিনা আমি জানি না। তবে ভুজঙ্গর আত্মাটাত্মা মানি না।”
তারাপদ বলল, “তা হলে ও কেমন করে ওই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটাল?
কিকিরা চুপ করে থেকে কিছু ভাবলেন, তারপর বললেন, “কেমন করে ঘটল তা আমি বলতে পারব না। নিজের চোখে দেখলে বলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু স্যার, আমি বলছি, এ হল ভেলকি। বড় রকমের ম্যাজিক। বিশ্বাস করবেন না। ভুজঙ্গ এই ভেলকি দেখিয়েই তার প্রতিপত্তি করেছে, বহু লোকের সর্বনাশও করেছে সেই সঙ্গে। কেউ কেউ শেষ পর্যন্ত পাগলের মতন হয়ে গেছে, কারও কারও যথাসর্বস্ব গিয়েছে। আপনারা ওই পিশাচের ধোঁকায় ভুলবেন না।”
চন্দন বলল, “আপনি আমাদের কী করতে বলছেন তা হলে?”
“আমি বলছি, আপনারা রয়ে সয়ে থাকুন। ভয় পাবেন না। চোখ খুলে ভুজঙ্গর বাড়ির সবকিছু লক্ষ করার চেষ্টা করুন। আপনাদের ও প্রাণে মারার সাহস করবে না।…শুনুন স্যার, এই মানুষটা–কিকিরা দি গ্রেট–একেবারে অপদার্থ নয়, যশিডিতে আমার অনেক মক্কেল আছে,তার মধ্যে একজন রয়েছে পুলিসের লোক–তেওয়ারিসাহেব। আমি তাঁকে বলে এসেছি। ভুজঙ্গ যদি বেশি চালাকি করার চেষ্টা করে, এবার আমি ওকে ছাড়ব না।”
তারাপদ কিকিরার মুখ দেখতে লাগল। মানুষটির চোখ দেখলে বোঝা যায়–কিসের যেন এক জ্বালা তার চোখে ঝকঝক করে উঠেছে।
মাথার টুপিটা খুলে নিলেন কিকিরা, রোদে মাথা তেতে উঠেছে। বললেন, “ভুজঙ্গ এখনো তার আসল চাল চালেনি, স্যার। কাল সে আপনাদের ভেলকি দেখিয়ে ঘাবড়ে দেবার চেষ্টা করেছে। ধরুন আজ কিংবা আগামী কাল সে আসল চাল চালবে।”
“কী চাল?” তারাপদ জিজ্ঞেস করল ।
কিকিরা বললেন, “আমার মনে হচ্ছে–চালটা আপনাকে নিয়ে। ভুজঙ্গ হয়ত আপনাকেই সব দিয়ে যেতে চায়, কিন্তু দিয়ে যাবার আগে সে আপনার সঙ্গে শর্ত করতে চাইবে। কিসের শর্ত আমি বুঝতে পারছি না! ভুজঙ্গ এত শঠ আর শয়তান যে তার চাল আগে থেকে বোঝা যায় না। তাই বলছি–আপনারা ধৈর্য ধরে থাকুন। দেখুন। ভয় পাবেন না। আমি এখানেই থাকব। আপনাদের খোঁজখবর করব। যদি কোনো বিপদে পড়েন ভুজঙ্গর আস্তাবলে রামবিলাস বলে যে কোচোয়ান আছে তাকে বলবেন। রামবিলাস আমার লোক। বুঝলেন? আমি কোথায় থাকব সে জানে?”
তারাপদরা অবাক হয়ে কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। চন্দন বলল, “ভুজঙ্গের বাড়িতে আপনার লোক কে কে আছে?”
কিকিরা যেন কতই লজ্জা পেয়েছেন, এমনভাবে হাসলেন। বললেন, “স্যার, আমার ধাতটাই হল ম্যাজিশিয়ানের, সব খেলাই ধীরেসুস্থে দেখাতে হয়, ঝট করে দেখাতে নেই। যথাসময়ে সবইদেখতে পাবেন।”
তারাপদ বলল, “কিকিরাবাবু, আপনি সাধুমামাকে চেনেন?
কিকিরা কেমন একটু হেসে বললেন, “চিনি।”
“কেমন চেনেন?”
“ভাল করেই চিনি। দয়া করে আমায় এখন আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনারাও আর দেরি করবেন না। এবার ফিরতে শুরু করুন। ওই লোকটার ফেরার সময় হয়ে গেছে।…শুনুন, আর-একটা কথা বলে দিই। বাড়িতে এমনভাবে থাকবেন যেন ভুজঙ্গর ভেলকি দেখে আপনারা একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছেন। কাউকে বুঝতে দেবেন না, আপনারা ব্যাপারটা সন্দেহ করেছেন।…আর হ্যাঁ, কাল আমি আপনাদের জন্যে একটা জিনিস নিয়ে আসব। আজকের রাত্রের খেলাটা আগে দেখে নিন, দেখুন ভুজঙ্গ কী করে।”
তারাপদরা উঠতে লাগল। “কাল কোথায় দেখা হবে?”
“কাল আপনারা ওই জঙ্গলের দিকে বেড়াতে যাবেন। আমি থাকব । একটা ভাঙা সাঁকো আছে, নালার মতো নদী, শুকনো; ওখানে থাকব।”
উঠে দাঁড়িয়ে চন্দন হেসে বলল, “স্যার, আজ আপনার একটা ইংলিশ শুনলাম না।”
কিকিরা হেসে বললেন, “শুনবেন, ঠিক সময়ে শুনবেন। এখন ভুজঙ্গ আমার ইংলিশ স্টিম করে দিচ্ছে। পেটে কিছু থাকছে না, স্যার। পেটে না থাকলে কি করে ইংলিশ হবে? ইংলিশ হল পেট্যারন্যাল ব্যাপার, পেট প্লাস ইন্টারন্যাল সন্ধি করুন…”
চন্দন হো হো করে হেসে উঠল।
পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে দুজনেই রাস্তায় নেমে এল। হাত নাড়ল। কিকিরাও হাত তুললেন।
ফিরতে লাগল দুজনেই।
তারাপদ বলল, “চাঁদু, আমার মনে হচ্ছে–ভুজঙ্গর বেশ কিছু শত্রু আছে। তারা একটা দল করেছে। সেই দলে সাধুমামা, কিকিরা, রামবিলাস না কি নাম বললেন কিকিরা–ওরা আছে। আর ভুজঙ্গর দলে আছে তার চেলারা।”
চন্দন বলল, “তাই মনে হয়।”
আরও খানিকটা এগিয়ে চন্দন ঘাড় ঘোরাল পিছনে। সাইকেলে-চড়া লোকটিকে দেখতে পেল না; কিকিরাকেও চোখে পড়ল না।
দুপুরটা ভালই কাটল। ভুজঙ্গভূষণের লোকজন আতিথ্যের ব্যাপারে কোনো কৃপণতা করল না। খাওয়া, শোওয়া, বাগানে ঘুরে বেড়ানো–কোনো দিকেই কারও কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারাপদদের কেমন মনে হচ্ছিল, তারা যেন কাদের নজরে নজরে রয়েছে। সাধুমামার সঙ্গে বার দুই চোখাচুখি হয়েছে, হওয়া মাত্র সাধুমামা সরে গেছেন।
বিকেল পড়তে না পড়তে ফুরিয়ে গেল। তারপর সন্ধে। ৪ ।
তারাপদর তৈরি । আজ আবার সেই রহস্যময় ঘরেগিয়ে বসতে হবে। ভুজঙ্গ গতকালই জানিয়ে দিয়েছিলেন। আজ আবার কী দেখতে হবে কে জানে?
তারাপদ বরাবরই ভিতু ধরনের। বড় বেশি নিরীহ। কিকিরা যতই সাহস দিন, ভূত, প্রেত, আত্মা বিশ্বাস করুক আর না করুক তারাপদ, তবু বিকেল থেকেই বেশ বিচলিত বোধ করতে লাগল। সন্ধের মুখে তার মুখ কেমন শুকিয়ে এল। তারাপদ চন্দনকে বলল, “চাঁদু, আমার এ-সব ভাল লাগে না। মিস্ট্রিই বল আর অলৌকিক ব্যাপারই বল–কোনোটাই আমি সহ্য করতে পারি না। “ চন্দন বলল, “উপায় নেই ভাই, ভুজঙ্গর সব রকম খেলা দেখতেই হবে। লোকটার মনে কী আছে এখনো বোঝা যায়নি।”
তারাপদ বলল, “আজ আমি স্পষ্টই বলব, ভুজঙ্গকে বলে দেব–আত্মাটাত্মা। আমি দেখতে চাই না। আপনার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে চাই। আপনার মুখ দেখতে চাই। হয় সাফসুফ কথা বলুন মশাই, না হয় ছেড়ে দিন, বাড়ি চলে যাই–আপনার সম্পত্তি আমি চাই না।”
দুই বন্ধুর কথাবার্তার মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় এসে তাদের ডাকল। “এসো।”
.
সেই একই ঘর । কালকের মতনই অন্ধকার । বাতি যেটুকু জ্বলছে তাতে পাশের মানুষকেও আবছা দেখায়। ধূপধুনো গুগগুলের সেই রকম গন্ধ । তফাতের মধ্যে আজ একটা ছোট টেবিল রয়েছে গোল ধরনের, তার তিন দিকে চেয়ার।
তারাপদরা বসল।
ওরা বসার পর আচমকা কোথা থেকে ভারী গলায় স্তোত্র পাঠের মতন গানের সুর ভেসে এল । তারপর সেটা স্পষ্ট হল, যাকে বলে। জলদগম্ভীর–সেই স্বরে কে যেন স্তোত্র পাঠ করতে লাগল। সংস্কৃত স্তোত্র । কে কোথায় গান করছে বোঝবার আগেই সেই গম্ভীর স্বর যেন কেমন অন্যমনস্ক করে ফেলল তারাপদকে ।
স্তোত্রের মধ্যেই ভুজঙ্গভূষণ এলেন। কখন এলেন বোঝা গেল না। তাঁর বসার আসনেই বসলেন। মাথার ওপর সেই লাল আলো জ্বলে উঠল। ভুজঙ্গভূষণের পরনে রক্ত-গৈরিক বসন। একটা বড় রুদ্রাক্ষ ঝুলছে গলায় । মুখের ওপর সেই আবরণ।
স্তোত্র পাঠ বন্ধ হয়ে গেল।
ভুজঙ্গভূষণই কথা বললেন প্রথমে। বললেন, “তারাপদ, কাল তুমি ভয়, পেয়ে গিয়েছিলে। তোমার বন্ধুও ভয় পেয়েছিল। আজ ভয় পেয়ো না যাঁরা তোমার আত্মীয়–মা, বাবা, বোন–”
“মা, বাবা, বোন-” তারাপদ চমকে উঠে বলল, গলার স্বর যেন বুজে আসছে।
“হ্যাঁ, তোমারই নিজের লোক। এঁদের আত্মা যখন আসেন তখন তোমার ভয় কী? এঁরা কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবেন না। অনেক দূর থেকে তারা আসেন, আসতে তাঁদের কষ্টও হয়। এই মর্ত্যলোকে তাঁরা আসতে চান না, তবুও আমরা যখন ডাকি, না এসে পারেন না। আজ আমি তোমার মাকে প্রথমে তাকব।”
“মা?”
“তোমার মা আমার আত্মীয়া। আমরা তাকে ছেলেবেলায় বেণু বলে ডাকতাম। বলতে গেলে আমার বোনেরই মতো। আমি বেণুকে ডাকব।”
তারাপদর গায়ে কাঁটা দিল। মা! মা আসবে? কোন্ ছেলেবেলায় বাবাকে সে হারিয়েছে, স্কুলে পড়ার সময়, তারপর মা-ই ছিল তার সব । কত কষ্ট করে তাকে মানুষ করেছে, সেই মা আজ আসবে? তার কাছে? মা তা হলে আজও আছে, এ-জগতে নয়, অন্য জগতে, হয়ত স্বর্গে। মা কি তাকে দেখতে পায়?
তারাপদর বুকের মধ্যে কত দুঃখ যেন টনটন করে উঠল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার মা আসবে। এই ঘরেই আসবে। কিন্তু তুমি তাকে দেখতে পাবে না। আত্মা অদৃশ্য। ছায়ারূপে তাঁরা আসেন, চলে যান। মানুষের চোখ তাঁদের দেখতে পায় না। কোনো কোনো চিহ্ন তাঁরা রেখে যান, স্পর্শও দিয়ে যান–কিন্তু সব সময় নয়, কখনো কখনো, এসব কাজ করতে তাঁদের কষ্ট হয়।”
কথা শেষ করে ভুজঙ্গভূষণ পায়ের কাছে পড়ে থাকা ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজালেন।
ঘণ্টা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ভুজঙ্গভূষণের পিঠের দিক থেকে ভেলভেটের পরদা সরিয়ে একটি মেয়ে এল। ভাল করে দেখা যায় না মেয়েটিকে। তবু যেটুকু দেখা গেল তাতে মনে হল, কিশোরী মেয়ে, বছর পনেরো হয়ত হবে বয়স, রোগা দেখতে, ধবধবে ফরসা রঙ, লম্বাটে মুখ, মাথার চুল এলো করা, পুনে ঘন কালো শাড়ি জামা। মেয়েটি এল। কিন্তু কিছুই দেখল না । কোনো দিকেই তাকাচ্ছিল না। ভুজঙ্গভূষণের পায়ের দিকে রাখা ঘণ্টাটা তুলে লি। নিয়ে তারাপদদের কাছে এসে বসল। ঘণ্টাটা নিচে টেবিলের তলায় নামিয়ে রাখল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তারাপদ, এই মেয়েটির মধ্যে দিয়ে তোমার মা হনবেন। ও হল আধার, ওর মধ্যে দিয়ে তোমার মাকে আসতে হবে। তোমরা দুজনে ওর হাতে হাত ছুঁয়ে বসো। পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখবে। ও তোমাদের দেখিয়ে দেবে।”
তারাপদ কিছু ভাবতে পারছিল না। বিহ্বল বোধ করছিল।
চন্দনের মনে হল, এই হয়ত সেই মেয়ে–গতকাল যাকে সে এক লহমার জন্যে দোতলায় দেখেছিল।
ছোট গোল টেবিলের তিন দিকে চেয়ার। মেয়েটি একটি চেয়ারে বসল। ইশারায় তারাপদদের চেয়ার সামান্য সরিয়ে নিতে বলল। চেয়ার সাজিয়ে নেবার পর দেখা গেল, টেবিলের ওপর হাত ছড়ালে তারাপদর একটা হাত মেয়েটির হাত ছোঁয়, অন্য হাত চন্দনের হাত ছোঁয়। চন্দনেরও সেই একই অবস্থা, তার বাঁ হাত তারাপদর হাত ছুঁয়ে রয়েছে, ডান হাত মেয়েটির হাত ছুঁয়েছে। এ যেন বাচ্চা বয়েসে সেই গোল হয়ে হাতে হাত ধরে খেলার মতন।
মেয়েটি তার পা দু পাশে বাড়িয়ে দিল। ইশারায় তারাপদদের বলল, ওদের এক একটা পা দিয়ে তার পা ছুঁয়ে থাকতে।
সামান্য বিব্রত বোধ করলেও তারাপদরা পা বাড়াল ।
মেয়েটির পা বড় শক্ত শক্ত লাগল তারাপদর। অবশ্য বুড়ো আঙুলের কাছটায় আলগা করে ছুঁয়ে থাকল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তুমি এবার মনে মনে তোমার মাকে ডাকো, তারাপদ। চোখ বন্ধ করে। একমনে। আমিও তাকে ডাকছি।” বলে ভুজঙ্গভূষণ তাঁর গম্ভীর গলায় কিসের যেন একটা মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন।
ঘরের সমস্ত আলো নিবে গেল। ঘুটঘুট করছে অন্ধকার।
তারাপদ চোখ বন্ধ করে মার কথা ভাবতে লাগল। তার ভয় হচ্ছিল; তবু সে মা-র কথা না ভেবে থাকতে পারল না। চন্দন প্রথমটায় চোখের পাতা খুলে রেখেছিল। কিন্তু চোখ খুলে রাখা না রাখা সমান; দু চোখই যেন অন্ধ । কিছু দেখা যায় না; শুধু কালো আর কালো। চন্দনও চোখের পাতা বুজে ফেলল। তারাপদর মাকে সে দেখেছে, ভালো করেই জানত তাঁকে। চন্দনও তারাপদর মার কথা ভাবতে লাগল। আর মাঝে মাঝে অনুভব করছিল, তার একটা হাতের আঙুল মেয়েটির হাতের ওপর রাখা, অন্য হাতটি তারাপদর হাতের ওপর রয়েছে।
কতক্ষণ সময় যেন চলে গেল। কোনো শব্দ নেই। শেষে ভুজঙ্গভূষণ চাপা গলায় বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? তুমি কি এসেছ?”
কোনো সাড়াশব্দ নেই। আবার চুপচাপ। আরও কিছু সময় গেল।
ভুজঙ্গভূষণ এবার আবার বললেন, “বেণু, তুমি এসেছ? আমরা তোমায় ডাকছি, তুমি এসেছ?”
হঠাৎ টেবিলের তলার দিকে মৃদু করে ঘণ্টা বেজে উঠল ।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “বেণু, তুমি যদি সত্যি সত্যি নিজে এসে থাকো—ঘণ্টাটা একবার বাজাও, বাজিয়ে থামিয়ে দাও, আবার বাজাও।”
ঘণ্টা সেইভাবেই বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে দেখতে পাচ্ছ? যদি পাও অন্যভাবে ঘণ্টা বাজাও। একটানা।”
এবারও সেই রকম বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার ছেলেকে আমি এখানে এনেছি। তুমি তাকে বলল আমার ইচ্ছা মতন সে যেন চলে। আমি তার ভাল চাই।”
ঘন্টাটা আস্তে আস্তে বাজল।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “তোমার সঙ্গে আর কেউ এসেছে বেণু? কে এসেছে?”
ঘণ্টা বাজল না।
ভুজঙ্গভূষণ কেমন আকুল স্বরে বললেন, “কে এসেছে বেণু? তোমার স্বামী?”
ঘণ্টা এবার জোরে বেজে উঠল। তারাপদ সমস্ত কিছু ভুলে চিৎকার করে উঠল, বাবা!”
বলার সঙ্গে সঙ্গে সে হাত টেনে নিয়েছিল। মেয়েটি কেমন শব্দ করে উঠল । যেন ঘুমের ঘোর থেকে চমকে উঠে শব্দ করেছে।
ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “কী হল? কী হল?”
বাতি জ্বলে উঠল। সেই মৃদু আলো। মেয়েটি টেবিলের ওপর মুখ রেখে। পড়ে আছে। হাত ছড়ানো। থরথর করে কাঁপছে।
ভুজঙ্গভূষণ তারাপদকে বললেন, “কী করেছিলে তোমরা? বেণু চলে গেছে।”
তারাপদ ভয়ে ভয়ে বলল, “কিছু করিনি । হাত ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
কঠিন গলায় ভুজঙ্গভূষণ বললেন, “মূর্খ!…সমস্ত বৃথা গেল।..যাও, তোমরা চলে যাও। ওকে ছুঁয়ো না। ধীরে ধীরে ও সুস্থ হয়ে উঠবে।”
তারাপদরা অপরাধীর মতন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।