৭. পরিশিষ্ট : দুই সপ্তাহ পর

৭. পরিশিষ্ট : দুই সপ্তাহ পর

টেবিলের উপর একটা ফুলদানি, সেটা ভরে উপচে রয়েছে ফুলে। ঘরের ভিতরে সাধারণত ফুল থাকে না, ফুল থাকবে বাগানে, তবুও কীভাবে জানি একটা মৌমাছি খবর পেয়ে চলে এসেছে ভিতরে। একটা একটা করে ফুল পরীক্ষা করে দেখছে মৌমাছিটা, মনে হচ্ছে না খুব খুঁতখুঁতে স্বভাবের কোনো ফুলই পছন্দ হচ্ছে। না, আবার চলেও যাচ্ছে না বিরক্ত হয়ে।

রাজু বিছানায় আধশোয়া হয়ে মৌমাছিটাকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। পৃথিবীতে কত ছোট ছোট জিনিসই-না আছে যেগুলি সে কোনোদিন চোখ খুলে দেখেনি, অথচ আর একটু হলে তার কিছুই আর দেখা হত না। গুলিটা যদি আর এক সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যেত তার হৃৎপিণ্ড ফুটো হয়ে যেত। ফুসফুঁসে গুলি লেগে সেটা বুজে গিয়েছিল, বেঁচে যে গিয়েছে সেটা নাকি একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বড় বিপদটা কেটে গিয়েছে, এখন শুধু ধীরে ধীরে সুস্থ হওয়া। ডাক্তার বলেছে কম করে হলেও তিন মাস সময় লাগবে। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে, কিন্তু কিছু করার নেই। রাজু একটা নিঃশ্বাস ফেলে একটু সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল সাথে সাথে বুকের ভিতরে টনটন করে ওঠে যন্ত্রণায়। রাজু দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা সহ্য করে, বেঁচে থাকা বড় মধুর ব্যাপার–তার জন্যে যেটুকু কষ্ট করা দরকার সে করবে।

দরজায় টুকটুক করে একটা শব্দ হল। আম্মা উঠে গেলেন দেখতে। দরজাটা একটু ফাঁক করতেই প্রথম শাওন এবং শাওনের পিছুপিছু তার মা এসে ঢুকলেন। শাওন কেমন করে এত সুন্দর হল সেটা তার মাকে দেখলে খানিকটা বোঝ যায়–দেখতে ঠিক শাওনের মতো সুন্দরী, দেখে বোঝাই যায় না শাওনের মা, মনে হয় বুঝি বড় বোন। শাওন আম্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রাজু কেমন আছে খালাম্মা?”

“ভালো মা, অনেক ভালো। কালকে একটু হেঁটেছে।”

“সত্যি।”

“সত্যি।”

“ওর সাথে কথা বলা যাবে?”

“হ্যাঁ মা, কথা বলা যাবে। ডাক্তার বলেছে এখন শুধু সুস্থ হওয়া বাকি। যত মন ভালো থাকবে তত তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে। শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন ইনফেকশান না হয়ে যায়।”

“আমরা বাইরে জুতো খুলে রেখে এসেছি খালাম্মা।”

“সেটাই ভালো।”

শাওন আর তার আম্মা রাজুর কাছে এগিয়ে গেলেন, শাওনের মা রাজুর মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু আদর করে দিলেন–যেন সে পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা। রাজুর একটু লজ্জা লাগছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। শাওনের আম্মা রাজুর সাথে একটা-দুটো কথা বলে খোঁজখবর নিয়ে রাজুর আম্মার সাথে কথা বলতে লাগলেন।

শাওন তার আম্মা সরে যাবার পর বুকের কাছে ধরে রাখা প্যাকেকটা বিছানায় রেখে রাজুর উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, “কেমন আছ রাজু?”

“ভালো।”

“দেখি তোমার ব্যান্ডেজটা!”

রাজু ব্যন্ডেজটা দেখাল। ব্যান্ডেজ দেখে সে কী বোঝে কে জানে, কিন্তু তবু সে খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি না থাকলে আমি গিয়েছিলাম। এই গুলিটা তা হলে আমার মাথার মাঝে দিয়ে যেত।”

রাজু কিছু না বলে একটু হাসল। শাওন প্যাকেটটা খুলে ভিতরে থেকে কয়েকটা ডিটেকটিভ আর অ্যাডভেঞ্চার বই, দুটা ইংরেজি গানের ক্যাসেট আর একটা চকলেটের বাক্স বের করল। রাজু দেখে বলল, “সব আমার জন্য এনেছ?”

“হ্যাঁ, চকলেট অবিশ্যি আমিও কিছু খেতে পারি।”

“খাও।”

শাওন যখন খুব মনোযোগ দিয়ে চকলেটের বাক্স খুলছে ঠিক তখন হঠাৎ দড়াম করে দরজা খুলে গেল এবং সাগর মাথা ঢুকিয়ে বলল, “ভাইয়া, বলো দেখি কে এসেছে?”

সাগরের উত্তেজনা দেখে অবিশ্যি বুঝতে বাকি রইল না, মানুষটি কে হতে পারে, কিন্তু রাজু ইচ্ছে করে না-বোঝার ভান করল, জিজ্ঞেস করল, “কে?”

“আজগর মামা আর আগুনালি!”

“সত্যি?”

“সত্যি। এই দ্যাখো!” সে দরজা খুলে দিতেই আজগর মামা এবং তার পিছুপিছু আগুনালি এসে ঢুকল। আজগর মামাকে চেনা যাচ্ছে, কিন্তু আগুনালিকে চেনার কোনো উপায় নেই। তার চুল তেলে ভিজিয়ে পাট করে আঁচড়ানো, পরনে নতুন চকচকে শার্ট আর প্যান্ট, পায়ে কালো জুতো এবং মোজা। সাগর যদি বলে দিত, রাজু তাকে হঠাৎ করে দেখে চিনতে পারত না।

আগুনালি সবাইকে দেখে একটু লজ্জা-লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু তার মাঝেই দাঁত বের করে হেসে রাজুর কাছে এসে তার হাত ছুঁয়ে বলল, “রাজু তুমি তো শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছ!”

রাজু কিছু না বলে আগুনালির দিকে তাকিয়ে হাসল। আগুনালি বলল, “তোমাকে দেখতে ম্যাচের কাঠির মতো লাগছে। শুকনো একটা শরীর–তার মাঝে বড় একটা মাথা! বেশি করে খাচ্ছ তো?”

“খাচ্ছি।”

“হ্যাঁ, বেশি করে খাও।”

“খাব। তুমি ভালো আছ?”

“ভালো আছি।”

“তোমার আগুনের কাজকারবার কেমন চলছে?”

“ভালো।” আগুনালি হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, “নতুন একটা বোমা আবিষ্কার করেছি, তুমি যদি দেখ–”

আজগর মামা হঠাৎ তাদের গলা নামিয়ে কথা বলতে দেখে চিৎকার করে বললেন, “এদের আলাদা করে রাখো। এক্ষুনি আলাদা করে রাখো, নাহয় আবার কিছু-একটা কেলেঙ্কারি করে ফেলবে!”

মামার কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল আর আজগর মামা তখন আরও রেগে ওঠার ভান করে বললেন, “তোরা ভাবছিস আমি ঠাট্টা করছি? মোটেও ঠাট্টা করছি না। সত্যি কথা বলছি।”

মামা রাজুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “গুলি খেয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছিস বলে ভেবেছিস তোকে আমি ছেড়ে দেব? কক্ষনো না। নেভার। শাস্তি তোকে পেতেই হবে!”

“কিসের শাস্তি?”

“এখনও জানিস না কিসের শাস্তি? ঠিক আছে বলছি। আমার নতুন মোটর সাইকেলটার একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিস! ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো তোর নানার আমলের বন্দুকটা যত্ন করে রেখেছিলাম, সেটাকেও শেষ করেছিস। ব্যারেল বাকা, পিন ভাঙা! বন্দুকটা বের করার জন্যে আলমারিটা ভেঙেছিস। বাসার দরজা-জানালা খোলা রেখে পালিয়েছিস, চোর এসে বাসার সব জিনিস নিয়ে পালিয়েছে। যেসব নেয়নি বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপচুপে।”

সাগর হি হি করে হেসে বলল, “সব তোমার দোষ মামা!”

“আমার দোষ?”

”হ্যাঁ মামা। তুমি যদি না যেতে, তুমি যদি থেকে যেতে, তা হলে কিছু হত। যদি চান মিয়াও আসত।–”

মামা মাথা চুলকে বললেন, “হ্যাঁ, চান মিয়ার ব্যাপারটায় অবিশ্যি কারওই হাত নেই। আমি নিজে তাকে পাঠিয়েছি, কিন্তু আমি কেমন করে জানব ফেরিঘাটে সে ঝগড়া মারপিট করবে, আর পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে হাজতে ভরে রাখবে? সেটা আমি কেমন করে জানব?”

সাগর মাথা নেড়ে বলল, “সেটা আমি জানি না! সব দোষ তোমার মামা।”

শাওন বলল, “না মামা, আপনারা সবাই ভুল বলছেন। আসলে কারও কোনো দোষ নেই। আপনি যদি চলে না যেতেন তা হলে রাজুর সাথে আগুনালির দেখা হত না। আর আগুনালির সাথে যদি রাজুর দেখা না হত তা হলে আগুনালি তাকে ভূত দেখাতে নিয়ে যেত না। আর ভূতের জায়গায় যদি আমাকে না দেখত তা হলে এতদিনে আমি সত্যি সত্যি মরে ভূত হয়ে যেতাম।”

সাগর হি-হি করে হেসে বলল, “সত্যিকারের ভূত?”

“হ্যাঁ, সত্যিকারের ভূত।”

আজগর মামা নরম চোখে শাওনের দিকে তাকিয়ে তার পিঠে হাত রেখে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ মা। খোদা তোমাকে বাঁচানোর জন্যেই আমাকে গ্রামে পাঠিয়েছিলেন। গ্রামে গিয়ে আমি স্কুলটাকেও বাঁচিয়েছি। মোটর-সাইকেল বন্দুক আলমারি বাসার জিনিসপত্র সবকিছু নষ্ট হয়েছে খোদার ইচ্ছায়। আমি সবকিছু মেনে নিচ্ছি। কিন্তু একটা জিনিস আমি কিছুতেই মানতে রাজি না। সেই অপরাধের শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।”

“সেটা কোন অপরাধ মামা?”

“বিশাল একটা ডেকচিতে তোরা যে বিশ কে, জি, খিচুড়ি বেঁধে বাইরে ফেলে রাখলি, একবারও তোদের মনে হল না সেটা পচে গলে নষ্ট হয়ে পোকা হয়ে যেতে পারে?”

“তাই হয়েছে মামা?” সাগর চোখ বড় করে বলল, “তাই হয়েছে?”

“হ্যাঁ। মামা মাথা নাড়লেন, তাই হয়েছ। যেই মুহূর্তে রাজু ভালো হবে তখন সবাই মিলে আমার বাসায় গিয়ে আমার সেই ডেকচি তোদের পরিষ্কার করে দিতে হবে।”

রাজু খিকখিক করে হেসে বলল, “দেব মামা, দেব।”

“আর যখন আমার বাসায় যাবি, আমার মোটরসাইকেল আর বন্দুক থেকে একশো হাত দূরে থাকবি। কমপক্ষে একশো হাত!”

“থাকব মামা।”

আজগর মামা হঠাৎ করে রাজুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, তোরা যে হৈ চৈ করে মান্ধাতা আমলের একটা গাদাবন্দুক নিয়ে গেলি, একবারও কি ভেবেছিলি যে বন্দুক ব্যবহার করতে গুলি লাগে?”

“গুলি?”

“হ্যাঁ, তোরা কি জানিস ওটাতে গুলি ছিল না? ঐ বন্দুকটা একটা লাঠি হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসত না?”

শাওন খিলখিল করে হেসে বলল, “গুলি ছাড়াই ওটা চমৎকার কাজ করেছে, মামা। আমার বাবাকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। পরের বার”

মামা চোখ পাকিয়ে বললেন, “দাঁড়াও তোমাদের পরের বার আমি বের করছি!”

মামার রাগ দেখে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে, হাসতে হাসতে রাজুর বুকের ব্যান্ডেজটাতে হঠাৎ টনটন করে ওঠে–তবু সে হাসি থামাতে পারে না। রাত্রে ডাক্তার রাজুর বুকের ব্যান্ডেজটা পালটে দিচ্ছিলেন। ভেতরের ঘা শুকিয়ে আসছে, খানিকক্ষণ লক্ষ করে কী-একটা ওষুধ দিয়ে নতুন করে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বললেন, “ইয়ংম্যান, তুমি খুব লাকি, তাই বেঁচে গিয়েছ। কিন্তু একটা দাগ থেকে যাবে সারাজীবনের জন্যে। যখন বড় হবে, বিয়ে করবে–তোমার বউকে এই দাগটা নিয়ে কী বলবে এখন থেকে সেটা ঠিক করে রেখো!”

রাজু ডাক্তারের চোখের দিকে তাকাল, তারপর ফিসফিস করে বলল, “যদি এমন হয় যে সে আগে থেকে জানে?”

ডাক্তার রাজুর কথা ঠিক শুনতে পেলেন না, জিজ্ঞেস করলেন, “কী বললে ইয়ংম্যান?”

রাজু হঠাৎ টমেটোর মতো লাল হয়ে বলল, “না, কিছু না।”

1 Comment
Collapse Comments

বাচ্চাদের বইয়ে বড়দের রোমান্টিকতা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *