০৭.
ভোরবেলা রেবেকা লক্ষ্য করল নুহাশের চোখ লাল। গা গরম। রেবেকা চিন্তিত হয়ে বলল, চোখ লাল কেন নুহাশ?
নুহাশ বলল, এম্নি।
রাতে ঘুম হয় নি?
হয়েছে।
গা গরম লাগছে। চিন্তার ব্যাপার হল তো। জ্বর সারছে না কেন?
মুনার-মা বলল, জ্বীন-ভূতের বাতাস লাগলে জ্বর সারে না।
তুমি চুপ কর মুনার-মা– জ্বীন ভূতের বাতাস বলে কিছু নেই।
না থাকলে নাই। আমার উপরে রাগ হল ক্যান। জ্বীন-ভূতের উপরে রাগ হইলে ভিন্ন কথা।
তোমার উপরে রাগ করি কারণ সুযোগ পেলেই তুমি নুহাশের সঙ্গে জ্বীন-ভূতের গল্প কর। গল্প করে করে ওর সাহস দিয়েছ কমিয়ে। ভীতুর একশেষ হয়েছে।
সাহস কমে নাই আম্মা। মাশাআল্লাহ্ সাহস বাড়ছে। কাইল রাইত একলা একলা ঘুমাইছে।
মুনার-মা!
জ্বি!
মুখে মুখে কথা বলতে হবে না।
জ্বি-আইচ্ছা।
আজ নুহাশকে স্কুলে নেবার দরকার নেই।
জ্বি-আইচ্ছা।
বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। ওর রিপোর্টগুলি সব আজ দেবে। রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখাব। আর শোন, সদর দরজা সারাক্ষণ বন্ধ রাখবে। যেই আসুক দরজা খুলবে না।
আইচ্ছা।
মনে থাকবে তো?
থাকব।
নুহাশের বাবা এলেও খুলবে না।
এইটা কেমন কথা কন আম্মা?
তোমাকে যা করতে বলেছি করবে। নুহাশের বাবা এলেও দরজা খুলবে না। আমার অনুপস্থিতিতে এ বাড়ির দরজা খোলা হোক, তা আমি চাই না।
এইটা তো আম্মা সম্ভব না।
সম্ভব না কেন?
নুহাশ আফার আব্বা আসব, আর আমি দরজা বন্ধ কইরা থুমু। এইটা সম্ভব না।
সম্ভব না হলে তুমি চলে যাও। তোমাকে রাখাও আমার পক্ষে সম্ভব না।
জ্বি আইচ্ছা।
তুমি তোমার বিছানা-বালিশ নিয়ে আজ সন্ধ্যাবেলা চলে যাবে। আমি অন্য মানুষ রাখব।
আইচ্ছা। আমি নিজেও ঠিক করছিলাম যামু গিয়া। যে বাড়িতে শান্তি নাই হেই বাড়িত কামে আরাম নাই। ভালই হইছে।
রেবেকা অফিসে চলে যাবার পরপরই নুহাশ তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। চিকন গলায় ডাকল–আপনি কি এখনো ঘুমুচ্ছেন?
দৈত্য বলল, ঘুমুচ্ছিলাম। তোমার মার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙেছে। মহিলা বিদেয় হয়েছেন?
হ্যাঁ।
দৈত্য খাটের নিচ থেকে বের হয়ে এল। তার মাথার চুল এখন সবুজ। ঝকঝকে সবুজ। নুহাশ অবাক হয়ে বলল, আপনার চুল সবুজ কেন?
কাল রাতে সবুজ রঙের সবজি খেয়ে এই অবস্থা। আমরা যখন যে রঙের খাবার খাই-মাথার চুলের রঙ হয় তাই। কাল রাতের সবজি হজমও হয় নি। পেটের ভেতর ভুটভুট শব্দ হচ্ছে মনে হচ্ছে ডাইরিয়া হয়ে যাবে।
ডাইরিয়া হলে অসুবিধা নেই–ওরস্যালাইন বানিয়ে আপনাকে খাওয়াব। কিভাবে বানাতে হয় আমি টিভি থেকে শিখেছি। এক মুঠ গুড় লাগে আর এক চিমটি লবণ। তারপর খুঁটা দিতে হয়। মুখে বলতে হয়, দিলাম টা–দিলাম গ্লুটা।
দৈত্য হেসে ফেলল। প্রথমে নিচু গলায়, তারপর শব্দ করে-হি হি হি। হো হো হো। হিহো হিহো হিহো।
রান্নাঘর থেকে মুনার-মা চেঁচিয়ে বলল, কে কে, হাসে কে?
নুহাশ বলল, আমি হাসছি আমি।
ছিঃ ছিঃ কেমন কইরা হাসেন। বুকের মধ্যে ধক কইরা উঠছে। মনে হইছে জ্বীন-ভূতে হাসে।
দৈত্য বিরক্ত হয়ে বলল-তোমাদের এই কাজের মেয়েটাকে বোকার হদ্দ বলে মনে হচ্ছে। জ্বীন-ভূতের হাসি আর দৈত্যের হাসি এক হল? কোথায় জ্বীন-ভূত আর কোথায় দৈত্য। কোথায় চড়ুই পাখি আর কোথায় উটপাখি। ঐ মহিলাকে একটা আছাড় দিতে ইচ্ছে করছে।
নুহাশ বলল, বুয়ার উপর আপনি রাগ করবেন না। বুয়া খুব ভাল।
আমি সহজে রাগ হই না। কিন্তু দৈত্যদের অপমান আমার পক্ষে সহ্য করা মুশকিল। যাক, বাদ দাও। তোমার সমস্যার সমাধান কি করে করা যায় তাই এখন জরুরী। অন্য কিছু তেমন জরুরী নয়। তোমার সমস্যার সমাধান হোক, তারপর ঐ মেয়ের কানের কাছে এমন হাসি দেব যে সে বুঝবে দৈত্যের হাসি কত প্রকার ও কি কি। আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু দৈত্য সমাজের অপমান সহ্য করি না।
নুহাশ বলল, আপনি এক গ্লাস পানি খান, তাহলে রাগ কমবে।
দাও, পানি দাও।
এক গ্লাস না, দৈত্য পুরো দু বোতল পানি শেষ করল। তার রাগ অনেকটা কমল। সে নিচু গলায় বলল, নুহাশ!
জ্বি।
তোমার সমস্যার সমাধান বের করেছি। তোমার মা যখন সকালবেলা তোমার অসুখ নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করলেন তখনি সমস্যার সমাধান পেয়ে গেলাম।
কি সমাধান?
খুব সহজ সমাধান। তেমার মা তোমার রিপোর্টগুলি নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন। ডাক্তার সেই রিপোর্ট দেখে আঁৎকে উঠবেন।
আঁৎকে উঠবেন কেন?
আঁৎকে উঠবেন কারণ রিপোর্ট খুব খারাপ। রিপোর্ট দেখে মনে হবে তোমার ভয়ংকর এক অসুখ হয়েছে। এমন ভয়ংকর যে তুমি দুমাসের বেশি বাঁচবে না।
আমি কি দুমাসের বেশি বাঁচব না?
আরে না। তুমি বাঁচবে অনেক দিন। রিপোর্টগুলি বদলে দিতে হবে। খুব কঠিন কাজ। করতে হবে, উপায় কি?
তারপর কি হবে?
ডাক্তার সাহেব তোমার রিপোর্ট দেখে ভিরমি খেয়ে যাবেন। তোমার মাকে বলবেন। তোমার মা ভিরমি খাবে। পাগলের মত খুঁজে বার করবে তোমার বাবাকে। যাকে বলে মধুর মিলন।
আমার রিপোর্টগুলি আপনি কিভাবে বদলাবেন?
আছে, উপায় আছে। খুবই কঠিন কাজ, কিন্তু করা সম্ভব। লেখা বদলে দিতে হবে।
মুনার-মা বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, কার সাথে কথা কও আফা?
কারো সাথে না।
তুমি এমুন বিশ্রী কইরা হাসতাছিলা ক্যান?
আর হাসব না।
দৈত্য চাপা গলায় বলল, বিশ্রী হাসি কত প্রকার ও কি কি তোমাকে আমি বুঝিয়ে ছাড়ব। বদ মেয়েছেলে কোথাকার। দৈত্যের হাসিকে সে বলে, জ্বীন-ভূতের হাসি। কত বড় আস্পর্ধা।
নুহাশ বলল, আচ্ছা, আপনাকে আমি কি ডাকব? আপনার নাম কি?
দৈত্যদের কোন নাম হয় না। রাম দৈত্য, রহিম দৈত্য বলে কিছু নেই। দৈত্য হচ্ছে দৈত্য। মানুষদের মধ্যেও এই নিয়ম চালু হওয়া দরকার। মানুষ হচ্ছে মানুষ। নাম আবার কি? রহিমও যা করিমও তা।
নুহাশ বলল, আপনাকে ভাইয়া ডাকলে আপনি রাগ করবেন?
অবশ্যই রাগ করব। ন্যাকামি ধরনের ডাক আমার অসহ্য। ভাইয়া, আপুমণি … ছিঃ ছিঃ!
আপনি এমন রেগে রেগে কথা বলছেন কেন?
দৈত্যদের রাগ ভয়ংকর জিনিস। একবার উঠে গেলে নামতে সময় লাগে।
উল্টা দিক থেকে গুনলে রাগ কমে যায়। আমি একটা নাটকে দেখেছি–১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭ এইরকম …
দৈত্য সঙ্গে সঙ্গে বলা শুরু করল– ১০০, ৯৯, ৯৮, ৯৭, ৯৬, ৯৫, ৯৪…
নুহাশ বলল, রাগ একটু কমেছে?
দৈত্য হাসিমুখে বলল, একটু কম কম লাগছে। বুদ্ধি তো মন্দ না। রাগ বাড়ানোর উপায়টা কি? ঠিকমত গুনা– ১০০, ১০১, ১০২, ১০৩ এ রকম?
রাগ বাড়ানোর কোন নিয়ম নাটকে দেখায় নি।
দৈত্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, প্রয়োজনীয় জিনিস কিছুই নাটকে থাকে না। অপ্রয়োজনীয় জিনিস থাকে। এই জন্যেই টিভি দেখা ছেড়ে দিয়েছি। রাগ কমানোর নিয়ম জানার কোন দরকার নেই। রাগ বাড়ানোর নিয়ম জানাটা অনেক বেশি দরকার।
আপনি যা রেগে আছেন। আপনার সঙ্গে কথা বলতেই ভয় ভয় লাগছে। আপনি বরং কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকুন।
এটা মন্দ না। বিশ্রাম দরকার, অনেক কাজ বাকি। বিকেলে তোমার মা তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার আগে সব কাজ সেরে রাখতে হবে। ঘণ্টাখানিক ঘুমিয়ে নিলে উত্তম হবে।
দৈত্য নুহাশের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।