অধ্যায় ৩১
নুরে ছফা বুঝতে পারছে না আতর আলী গেলো কোথায়।
চিন্তিত মুখে রবীন্দ্রনাথের উল্টোদিকে রহমান মিয়ার দোকানে এসে বসলো সে। একটু আগে কেএস খানের সাথে কথা বলেই সে আতরকে ফোন দিয়ে বলেছিলো সে যেনো ফালুর অ্যাডভান্স কবর খোরার ব্যাপারে কিছু তথ্য জোগাড় করে দেয়। কিন্তু এখন তার ফোনটা বন্ধ পাচ্ছে। অথচ থানা থেকে এসপির অফিসে যাবার আগে সে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলো আতর যেনো তার ফোনটা চালু রাখে।
“চা খাইবেন?”
দোকানির প্রশ্নে মাথা নেড়ে সায় দিলো। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে দেখলো কোনো সিগারেট নেই। “একটা সিগারেটও দিয়েন।”
“একটা দিমু? নাকি এক প্যাকেট?”
উদাস হয়ে দোকানির দিকে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বললো, “এক প্যাকেটই দেন তাহলে।”
রহমান মিয়ার মুখে খুশির ঝলক দেখা গেলো। মাথার মধ্যে লাভের হিসেবটা আপনা-আপনি শুরু হয়ে গেলো আবার। ঝটপট সিগারেটের প্যাকেটটা কাস্টমারকে দিয়েই গুড়ের চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।
“আচ্ছা, আতর আলীকে দেখেছেন?”
চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো লোকটি, “হেরে তো এটু আগে জোড়পুকুরের দিকে যাইতে দেখলাম।”
চায়ের কাপটা না ধরেই অবাক চোখে তাকালো সে।
“কখন?”
“এই তো, এটটু আগেই।”
সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো ছফা। আতর জোড়পুকুরে গেছে! অতিরিক্ত কৌতূহল দেখাতে গিয়ে আবার জমিদার বাড়িতে গেলে না তো? অজানা। আশংকা জেঁকে বসলো তার মধ্যে।
“আমার কতো হয়েছে?” তাড়াহূড়া করে জানতে চাইলো।
“চা খাইবেন না?”
“চা-সহ কতো হয়েছে, বলুন?”
“একশ ষাইট ট্যাকা…” অঙ্কটা তার একদম হিসেব করাই ছিলো।
ঝটপট টাকাটা দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে গেলো নুরে ছফা, রিক্সার জন্য অপেক্ষা করলো না। এই কাঁচা রাস্তায় রিক্সা যতো দ্রুত যাবে তারচেয়ে পায়ে হেঁটে আরো বেশি গতিতে ছোটা সম্ভব।
মাটির রাস্তা দিয়ে দ্রুতপায়ে ছুটতে লাগলো সে। বুঝতে পারছে না, আতর কেন হ্রট করে জমিদার বাড়ির দিকে গেলো। তার মোবাইলফোনটাও বন্ধ! ইনফর্মারের কি খারাপ কিছু হয়েছে? মাথা ঝাঁকিয়ে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলো। এসব ভাবতে ভাবতে জমিদার বাড়ির একেবারে কাছে চলে এলো সে। মেইনগেটের সামনে দিয়ে চলে যাবার সময় থমকে দাঁড়ালো।
শ্বেতশুভ্র চুলের এক বৃদ্ধ মেইনগেটের মধ্যে মানুষজনের ব্যবহারের জন্য যে ছোটো গেটটা আছে সেটা দিয়ে বের হয়ে আসছে।
রমাকান্তকামার!? বিস্মিত ছফা চেয়ে রইলো ভদ্রলোকের দিকে। মাস্টার এই বাড়ি থেকে বের হচ্ছে। তার ধারণা ছিলো মুশকান জুবেরির সাথে মাস্টারের কোনো যোগাযোগ নেই।
বৃদ্ধমাস্টার ধীরপায়ে এগিয়ে আসতেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছফাকে দেখতে পেয়ে কেমন বিব্রত হলেন।
“আপনি?” মাস্টার কাছে আসতেই বলে উঠলো ছফা।
মুখ তুলে তাকালেন বৃদ্ধ। “ঐদিন রাতে আপনিই তো আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তাই না?”
“হ্যাঁ,” কাটাকাটাভাবে জবাব দিলো সে।
“তো এখন কি পাত্রির বাড়িতে যাচ্ছেন?”
মাস্টারের কথার খোঁচায় মুচকি হাসলো ছফা। “আমি কোথায় যাচ্ছি। সেটা সময় হলেই জানতে পারবেন, কিন্তু আপনি কেন এখানে এসেছেন। সেটাই বুঝতে পারছি না।”
– “ও..তাহলে আমার উপরেও নজর রাখছিলেন?” মাস্টারের চেহারা কঠিন হয়ে গেলো, “ওই টাউটটাকে দিয়ে?”
“কার কথা বলছেন?” ভুরু কুচকে ফেললো ছফা।
এবার মুচকি হাসলেন রমাকান্তকামার। “আতর…” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। “একটু আগে ও আমাকে দেখেছে এখানে ঢুকতে চাইলে আমি ওকে ধোঁকা দিতে পারতাম কিন্তু আমি সেটা কেন করবো? এ জীবনে আমি কখনও কাউকে ধোঁকা দেইনি।”
নড়েচড়ে উঠলো সে। “আতরকে দেখেছে? কখন? কোথায়?”
এবার মাস্টার অবাক হলেন। “এই যে, একটু আগে…আমি যখন বোসবাবুর বাড়িতে আসছিলাম।”
“আতর তাহলে কোথায় যাচ্ছিলো?”
ভুরু কোচকালেন রমাকান্তমাস্টার। “ঐ যে ওখানে,” একটু দূরে পুবদিকের বিস্তৃর্ণ ক্ষেতের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।
“ওখানে?” চট করে সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধের দিকে ফিরলো। “ওখানে কোথায়?”
“আমি কি জানি,” কথাটা বলেই আবার হাঁটতে শুরু করলেন।
এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো ছফা। ওই দিক দিয়ে আতর কোথায় গেছে? ভাবনাটা তার মাথায় আসতেই চমকে উঠলো।
কবরস্তান! গোরখোদক! ফালু!
সঙ্গে সঙ্গে বিসতৃর্ণ ক্ষেতের উপর দিয়ে দৌড়ে গেলো ছফা। রমাকান্ত মাস্টার ভড়কে গিয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে। ভদ্রলোকের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। কিন্তু সেই অভিব্যক্তি দেখার ফুরসত নেই নুরে ছফার। প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা প্রার্থনাই করলো মনে মনে : আতরের যেনো খারাপ কিছু না-হয়।
চারপাশের ক্ষেতি জমি থেকে বেশ উঁচু কবরস্তানটির কাছে আসতেই ছফা দেখতে পেলো একগুচ্ছ সাদা-পিপড়ার মতো মানুষ জড়ো হয়ে আছে! ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ালো সে। চোখ কুচকে দেখার চেষ্টা করলো, তারপর আবারো পা বাড়ালো কবরস্তানের দিকে। এবার না দেীড়ে, জোরে জোরে হেঁটে।
একটা লাশ ঘিরে আছে জনাবিশেক মানুষ। বেশিরভাগেরই পরনে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা নয়তো লুঙ্গি। সবার মাথায় টুপি। তাদেরই একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো তার। মাঝবয়সি লোকটা অচেনা একজনকে কবরস্তানে ঢুকতে দেখে ভুরু কুচকালো। এরকম সময় প্যান্ট শার্ট, জ্যাকেট আর জুতো পরা কাউকে দেখে অবাক মনে হলো তাকে।
“আপনে?” ছফাকে দেখে বললো সেই লোক। “কারে খুঁজতে আইছেন?”
ছফা প্রথমে ভাবলো আতরের কথা বলবে, কিনতু সেটা বাতিল করে দিলো। “ফালুকে।” অবশেষে গোরখোদকের নামটাই বললো সে।
“ফালুরে খুঁজতাছেন?” অবাক হলো মাঝবয়সি লোকটা। “ওরে তো আমরাও খুঁজতাছি, কই যে গেছে কে জানে! কাইল রাইতে খুঁজতে আইলাম দেখি ফালু ঘরে নাই…আইজ সকালে আইসা যহন কইলাম, কয় সে নাকি ঘরেই আছিলো…এহন আবার লাপাত্তা। পোলাটার কী হইছে কে জানে।”
ছফা ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো লোকটার দিকে।
“জানাযা পড়ন শ্যাষ.. মুরদা লইয়া বইসা আছি.ফালুর কুনো খবর নাই..কব্বরটা খুইদা আবার মাটি দিয়া ভইরা রাখছে…ক তো দেহি কী কারবার।”
কবর! সতর্ক হয়ে উঠলো ছফা। মাটি দিয়ে ভরাট করে রেখেছে। নড়েচড়ে উঠলো সে। “আতরকে দেখেছেন? আতর আলী..ইনফর্মার?”
লোকটা বেশ অবাক হলো। “আতর এইহানে কেন আইবো? আজব কথা কইলেন।”
“ও এখানে নেই?”
এবার বিরক্তই হলো মাঝবয়সি লোকটি। “পুরো! আমরা খুঁইজা মরতাছি। ফালুরে আর আপনে আইছেন…” বিরক্ত হয়ে লোকটা পা বাড়ালো একটু দুরে লাশকে ঘিরে থাকা লোকজনের দিকে। “কইথেকা এইসব মানুষ আইছে আল্লায়ই জানে…” বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে গেলো সে।
ছফার মাথা দ্রুত হিসেব করে চললো। আর এখানে এসেছে অথচ সে নেই। ফালুও নেই। কি হতে পারে? “ভাই, শোনেন?” চট করে পেছন থেকে ডেকে উঠলো সে।
লোকটা দ্বিগুন বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকালো। “আবার কি হইছে?”
“যে কবরটা ভরাট করে ফেলেছে সেটা কোথায়?”
লোকটা একটু রুষ্টই হলো প্রশ্নটা শুনে। “ঐ-দিকে৷” আঙুল তুলে কবরস্তানের একটি জায়গা দেখিয়ে দিলো সে।
ছফা কিছু না বলে পা বাড়ালো সেদিকে। কবরটার পাশে এখনও বেশ কিছু আলগা মাটির স্তূপ রয়ে গেছে। একটা কোদাল আর বেতের টুকরি পড়ে আছে সেই স্তূপের কাছে। কবরের সামনে এসে ভালো করে দেখলো। অর্ধেকেরও বেশি ভরাট করে ফেলা হয়েছে আলগা মাটি দিয়ে। কাজটা যে খুব তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কবরের উপরে আলগা মাটির স্তূপের দিকে তাকালো। অনেকগুলো নগ্ন পায়ের ছাপ রয়েছে। নিশ্চয়ই গোরখোদকেরই হবে। কিন্তু এখানে এটাই একমাত্র পদচিহ্ন নয়। আরেকটা ছাপ চোখে পড়লো তার। স্যান্ডেলের ছাপ। তারপরই একটা জিনিস চোখে পড়লো।
কবরের ঠিক পাশেই আলগা মাটির মধ্যে সস্তা একটি মোবাইলফোন নরম মাটিতে দেবে আছে। দেখামাত্রই চিনতে পারলো সে।
আতর!
সঙ্গে সঙ্গে কবরে নেমে পড়লো সে। তাকে এটা করতে দেখে লাশের সঙ্গে আসা ক্ষুব্ধ মানুষগুলো বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। উদভ্রান্তের মতো আলগা মাটিগুলো হাত দিয়ে সরাতে শুরু করলো ছফা।
“কি হইছে, ভাই?” লাশের সঙ্গে আসা এক লোক জিজ্ঞেস করলো, বিস্ফারিত চোখে ছফার কাজ দেখছে সে। তার পেছনে জড়ো হয়ে গেলো আরো পাঁচ-ছয়জন।
ছফা জবা দেবার আগেই আতরের একটা হাত বেরিয়ে এলো মাটি সরাতে। “ভাই! আমাকে একটু হেল্প করেন! জলদি!” চিৎকার করে বললো
এরইমধ্যে কবরের পাশে যে জটলা তৈরি হয়েছে সেখান থেকে দু-জন তরুণ নেমে পড়লো কবরে। তিনজনের প্রচেষ্টায় অল্প সময়ের মধ্যেই আতর আলীর নিথর দেহটা মাটির নীচ থেকে টেনে বের করতে পারলো।
লাশের খাটোলা ঘিরে যে জটলা ছিলো সেটা মুহূর্তে সরে গেলো কবরের দিকে। একাকী হয়ে গেলো গোর দিতে আনা শবটি! কবর থেকে আতরের নিথর দেহটা উপরে তুলে আনা হলো। ইনফর্মারের সারা গায়ে মাটি লেগে একাকার, তারপরও থেতলে যাওয়া মাথাটা যে রক্তে একাকার বোঝা গেলো। প্রথমেই আতরের পালস দেখতে চাইলে ছফা। ঘাড়ে, হাতে আঙুল রেখে বোঝার চেষ্টা করলো সে এখনও বেঁচে আছে কিনা। পালস খুঁজে পেতে একটু বেগ পেতে হলো। তার কাছে মনে হচ্ছে বড় দেরি হয়ে গেছে। হাল ছেড়ে দিয়ে অসহায়ের মতো আশেপাশে তাকালো সে। লোকটার এমন পরিণতির জন্য নিজেকেই দায়ি করলো।
“বাইচা আছে!” হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো একজন। “এহনও বাঁইচা আছে!”
.
অধ্যায় ৩২
বিকেলের মধ্যেই সুন্দরপুরে একটা কথা চাউড় হয়ে গেলো : গোরখোদক ফালু আতরকে খুন করে পালিয়েছে, তবে কেউ তাকে পালাতে দেখে নি! খুনোখুনির চেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে কেন এবং কি কারণে এমনটা ঘটলো। এ প্রশ্নের জবাব কারো কাছে নেই। সবাই যার যার মতো করে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করছে।
স্বস্তির ব্যাপার হলো আতর এখনও মরে নি। সদরের সরকারী হাসপাতালে আছে সে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছে তার মাথার আঘাত গুরুতর হলেও ভাগ্যক্রমে বিপদমুক্ত হয়ে গেছে। জ্ঞান ফিরে এসেছে ইনফর্মারের। তবে আবোল-তাবোল বকছে বলে ডাক্তার কড়া ডোজের প্যাথেড্রিন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে।
সন্ধ্যা পর্যন্ত ছফা হাসপাতালেই ছিলো, তারপর সোজা চলে আসে এসপির বাংলোতে। মনোয়ার হোসেন এতে খুশিই হয়েছে। ছফাকে কাছে। পেয়ে সম্পর্কটা একটু গাঢ় করা যাবে। যা হয়েছে তা ভুলিয়ে দেয়া যাবে। বাংলোতে এসপি সপরিবারে থাকে না, তার পরিবার থাকে ঢাকায়। ছফাও ভেবে দেখেছে, তার পরিচয় জানাজানি হবার পর হোটেলে থাকার কোনো মানেই হয় না। তাছাড়া সে আর বেশি দিন থাকছে না এখানে। এ কয়টা দিন সানমুনের মতো নিম্নমানের হোটেলে থাকাই যেতো, ওটার বাথরুমগুলোর দুর্গন্ধ নাক চেপে সহ্য করাও সমস্যা হতো না কিন্তু অন্য একটা কারণে সে এসপির বাংলোতে উঠেছে-ঢাকার সাথে অনায়াসে যোগাযোগ করা যাবে এখান থেকে। ফ্যাক্স মেশিন আর ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা আছে এসপির বাংলোতে।
হাসপাতালে যখন ছিলো তখন তার সহকারী ফোন করে জানিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছে সে। ছফা তাকে বলেছে মেইল না করে কিছুক্ষণ পর সুন্দরপুরের এসপির ফ্যাক্স-এ রিপোর্টটা পাঠিয়ে দিতে। তার সহকারী তাকে কিছুটা ধারণাও দিয়েছে তবে সেটা এসপির সাথে শেয়ার করে নি। আগাম সতর্কতা হিসেবে এসপিকে দিয়ে একটা কাজ করিয়েছে। মুশকান জুবেরির বাড়ির বাইরে সাদা পোশাকের দু-জন পুলিশ নিয়োজিত করা হয়েছে বিকেলের পর থেকে। ঐ মহিলা যেনো কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে যেতে না পারে। সেই সাথে ঐ দু-জনকে এটাও বলে দিয়েছে, কাজটা করতে হবে সতর্কতার সাথে, মহিলা যেনো কোনো কিছু আঁচ করতে না পারে। ছফা জানে এসপি মনোয়ার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কাজটা করেছে। এ মুহূর্তে তাকে সহযোগীতা করা ছাড়া ভদ্রলোকের আর কোনো উপায় নেই।
এসপির বাংলোয় এসেই গোসল করে নিয়েছে। সারাদিনে এ কাজটি করার সুযোগ পায় নি। গোসল করার পর এক কাপ চা নিয়ে বসলো বাংলোর ড্রইংরুমে। এসপি মনোয়ার হোসেনও আছে তার সাথে, তবে ভদ্রলোক আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না।
ড্রইংরুমে রাখা ফ্যাক্স মেশিনটা বিপ্ করে উঠলে ছফা চেক করে দেখলো। এসপি মনোয়ার কিছু বলতে গিয়েও বললো না।
চায়ের কাপে দ্রুত কয়েকবার চুমুক দিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো ছফা। তার সহকারী রিপোর্ট পাঠাতে শুরু করেছে। এরপর পাঁচ মিনিট ধরে ফ্যাক্স থেকে বের হয়ে এলে পুরো রিপোর্টটি। কাগজগুলো নিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত রুমে ঢুকে পড়লে এসপি কোনো প্রশ্ন না করে চুপচাপ চা খেতে লাগলো। বুঝতে পারছে ঢাকা থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য এসেছে। মনে মনে সে এখনও মুশকান জুবেরির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। তার ধারণা তদন্তে আসল সত্য বের হয়ে এলে হয়তো দেখা যাবে মুশকান নয়, অন্য কোনো চক্র এসবের সাথে জড়িত, তাদের কারণেই মুশকানকে সন্দেহ করছে ছফা। তদন্তকাজে এরকম ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন সময় এসপি মনোয়ারের মোবাইলফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ডিসপ্লে দেখে কপাল কুচকালো সে। এটা আগেই আন্দাজ করেছিলো। লোকাল এমপি আসাদুল্লাহ ফোন দিয়েছে, সম্ভবত মুশকান জুবেরির ব্যাপারে কথা বলার জন্য। একটু ভেবে ফোনটার রিংটোন বন্ধ করে রেখে দিলো পাশের টেবিলে। এ মুহূর্তে কি না কি বলে ঐ নুরে ছফার রোষানলে পড়তে চাইছে না সে।
*
চারপাশে অন্ধকার নেমে এসেছে, যদিও রাত নামে নি এখনও। সময়ের হিসেবে সন্ধ্যা তবে ঘড়িতে এখনও ছয়টা বাজে নি। শীতকাল বলে দ্রুত সূর্য ডুবে গেছে।
জমিদার বাড়ির মেইনগেট থেকে একটু দূরে, বড় একটা গাছের নীচে দু-জন মানুষ দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকে যাচ্ছে। বোবা দারোয়ান তাদের দেখতে পায় নি। বেশ সতর্কভাবেই দারোয়ানের দৃষ্টি এড়িয়ে চলছে তারা।
অলোকনাথ বসুর বিশাল বাড়িটি আর সব দিনের মতোই সুনসান। কোনো মানুষ বের হয় নি, ভেতরেও যায় নি কেউ। যে দু-জন লোক নজর রাখছে তারা নিজেদের মধ্যে খোশগল্প করেই সময় পার করে দিচ্ছে। মুশকান জুবেরির মতো একজন মহিলাকে কেন এভাবে নজরদারি করা হচ্ছে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে রসালো আলাপ করছে তারা।
দেড়ঘণ্টা ধরে ডিউটিতে আছে, এখন পর্যন্ত কাউকে আসা-যাওয়া করতে দেখে নি। এই সময়ের মধ্যে একটা টু শব্দও শোনে নি তারা। যেনো মৃতপূরীর মতো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। নীচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় হঠাৎ দূর থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলে দু-জনেই শুনতে পেলো সেটা।
একটা নারীকণ্ঠ!
একে অপরের দিকে তাকালো। এটা কি রিপোর্ট করার মতো কিছু? তারা একমত হতে পারলো না। তাদেরকে শুধু বলা হয়েছে ওই বাড়ি থেকে যেনো কেউ বাইরে বের হতে না পারে সেটা দেখতে। বাড়ির ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। তাছাড়া চিৎকারটা মাত্র দু-বার হতেই থেমে গেছে। আর কোনো সাড়াশব্দ হলো না বলে দু-জনে আবার ফিরে গেলো নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায়।
*
বোবা ইয়াকুব মেইনগেটের পেছনে বসে থাকলেও তার কোনো ধারণাই নেই বাইরে দু দু-জন লোক এই বাড়ির দিকে নজর রাখছে। বোবা বলে দোতলা থেকে যে নারীকন্ঠের চিৎকার ভেসে এসেছে সেটা শুনতে পায় নি। ছোট্ট একটা টুলের উপর বসে আসন্ন অভিসারের চিন্তায় মশগুল সে। বিকেলের আগে একটা কাজে রবীন্দ্রনাথে গেছিলো, ফেরার পথে এক প্যাকেট নিয়ে এসেছে। সাফিনা তাকে ইশারা দিয়েছে, আজ হবে। সেই হবে’র আশায়। ভেতরটা ছটফট করছে। তবে সে জানে, বেশি ছটফট করে লাভ নেই। রাত নামুক, গাঢ় হোক, সবাই ঘুমিয়ে পড়ুক, তারপর…
বাড়িটার দিকে তাকালো। দোতলার একটি রুমে আলো জ্বলছে। নীচতলার একটি রুমেও এইমাত্র আলো জ্বলে উঠলো। এখন জানালার সামনে এসে ইচ্ছে করে বার বার বুকের আঁচল ফেলে ঠিক করছে না, তাকে ক্ষেপিয়ে তুলছে না। মেয়েটা এভাবেই তাকে পাগল করে তোলে সব সময়। জংলি বানিয়ে দেয় তাকে। কিন্তু বোবা অবাক হয়ে দেখতে পেলো সাফিনা আজ জানালার সামনে আসছে না। অধীর আগ্রহে সে চেয়ে রইলো।
*
ওদিকে সাফিনা এখন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে। একটু আগে উপর থেকে অদভুত এক চিৎকার শুনতে পেয়েছে সে। নিজের ঘরের খাটে একটু চোখ বন্ধ করে আধোঘুমে চলে গেছিলো। হঠাৎ এই চিৎকারটাই তার কাঁচা ঘুম ভেঙে দিয়েছে। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে কিছু বোঝার চেষ্টা করলেও আর কোনো আওয়াজ শুনতে পায় নি।
তবে এটা নিশ্চিত, উপরতলা থেকে চিৎকারটা এসেছে। আর সেটা কে দিয়েছে সে ভালো করেই জানে। সঙ্গে সঙ্গে দোতলায় ছুটে যাবার জন্য সিঁড়ির দিয়ে উঠতে লাগে, ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছাতেই মনে পড়ে যায়, পনেরো বিশ মিনিট আগে মুশকান ম্যাডাম তাকে বলেছিলো, খুব জরুরি কিছু কাজ করবে আজ, সে যেন উপরতলায় না আসে। যা-ই ঘটুক না কেন, উনি না। ডাকলে উপরতলায় যাওয়া যাবে না। সে-কারনে সাফিনা ল্যান্ডিংয়েই জমে গেলো। তার পা আর চললো না। ম্যাডামের কথার অবাধ্য হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি যখন বলেছেন, যা-ই ঘটুক না কেন তখন আর কোনো যুক্তিই খাটে না। দোতলায় যদি বোমাও ফাঁটে তাতেও কিছু করার নেই। বড়জোর সে ম্যাডামের কাছ থেকে ডাকের অপেক্ষায় থাকতে পারে। তাছাড়া এই ব্যাপারটা তো আর নতুন নয় যে সে উতলা হয়ে উঠবে। এর আগেও কয়েকবার দোতলা থেকে অদ্ভুত গোঙানি শুনতে পেয়েছিলো। খুব বেশি নয়। মৃদু। চাপা। এবং অল্প সময়ের জন্য। ওইসব ঘটনার আগেও ম্যাডাম তাকে বলতো, যা-ই ঘটুক না কেন। তখন অবশ্য ওর ঘর থেকেও বের হতে নিষেধ করতো। দরকার পড়লে উনি নিজেই ডাকবেন।
আজ দুপুরের পর থেকে ম্যাডামের আচরণ কেমনজানি মনে হচ্ছে তার কাছে। একটু অস্থিরতাও দেখেছে। ব্যাপারটা খুবই বিরল। এখানে আসার পর কোনোদিনই এক মুহূর্তের জন্যেও ম্যাডামকে অস্থির দেখে নি। যেনো অস্থির হবার দোষটা নিয়ে জন্মায়ই নি এই মহিলা। যা-ই ঘটুক, তিনি অটল, অবিচল। কোনো কিছুই তাকে ঘাবড়ে দিতে পারে না। দু-বছর আগে। একরাতে রবীন্দ্রনাথে আগুন লাগলো। ম্যানেজার আর ওখানে যারা থাকে তারা সবাই ছুটে এলো ম্যাডামের কাছে, উনি আগুনের কথা শুনে একটুও বিচলিত হলেন না। ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, ফায়ার সার্ভিসে খবর দিলে অনেক সময় লাগবে। দূরের জেলাসদর থেকে আসতে আসতে রবীন্দ্রনাথ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ততোক্ষণে। তারচেয়ে ভালো নিজেরাই আগুন নেভানোর চেষ্টা করা ভালো। গরু আর মুরগির খামার থেকে কিছু কর্মচারিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে পাঠিয়ে দিলেন রবীন্দ্রনাথে। ওরা সবাই মিলে আগুন নেভাতে পারলেও বেশ ক্ষতি হয়ে গেছিলো, সেই ক্ষতির হিসেব যখন দিলো। ম্যানেজার, ম্যাডামের চোখে-মুখে কোনো বিকার ছিলো না। যেনো কিছুই হয় নি। সেই মুশকান ম্যাডাম আজ শুধু বিচলিতই নয়, একটু বিষণ্ণও বটে। বিকেলের পর থেকে তার মধ্যে একটু অস্থিরতা আর রাগও দেখেছে৷ এটাও বিরল ব্যাপার। এখন পর্যন্ত এই মহিলাকে কখনও রাগতে দেখে নি। এমনকি, ইয়াকুবের সাথে তার গোপন কাজ-কারবার দেখে ফেলার পরও রেগে যায়। নি। শুধুমাত্র সাবধান করে দিয়েছিলো কোনোভাবেই যেনো দুর্ঘটনা না ঘটে। এরপর থেকে সাফিনা সত্যি সত্যি সাবধানী হয়ে ওঠে। বোবাকে বাধ্য করে ওষুধের দোকানে যেতে। ওসব জিনিস ছাড়া কোনোভাবেই সে রাজি হয় না।
সাফিনা নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে। তার দৃষ্টি বেশ ঝাপসা হয়ে আসছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে, আর সেটাকে ছাপিয়ে গেলো অন্য একটি আশংকা। কেনজানি মনে হচ্ছে, আজকের রাতে তাদের অভিসারটি পণ্ড হয়ে যাবে।
.
অধ্যায় ৩৩
এসপি মনোয়ারের বাংলোয় নির্জন একটি ঘরে দরজা বন্ধ করে একঘণ্টা ধরে ফ্যাক্স করা রিপোর্টটি পড়ে গেলো ছফা। তার সহকারী জাওয়াদ নবীন হলেও দারুণ কাজ করেছে। ছেলেটার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে সে। এই ছেলে হাতেগোণা স্বল্প কিছু মানুষের মধ্যে পড়ে যাদেরকে যা বলা হবে। শুধু তা-ই করবে না, বরং যা বলতে ভুলে যাওয়া হয়েছে কিংবা যা বলা দরকার ছিলো তাও করবে। ছফাও কিছু কিছু বিষয় বলে নি, কিছু তার মনেও ছিলো না কিন্তু ছেলেটা সবই জোগাড় করেছে। তার রিপোর্টটাও বেশ গোছানো। ভাষা খুব সহজ আর স্পষ্ট। অনিশ্চয়তা তৈরি করে এমন কোনো শব্দ-বাক্য ব্যবহার করে নি।
রিপোর্টটা একবার নয় দুবার নয়, বেশ কয়েকবার পড়েছে সে। আর প্রতিবারই পড়েছে ধীরে ধীরে, সব কিছু বোধগম্য করার জন্য। পড়া শেষে কাগজগুলো বিছানার তোষকের নীচে রেখে দিলো। এই ঘরে কোনো ড্রয়ার নেই, ওয়াড্রবে যে ড্রয়ার আছে ওগুলোতে কোনো লক নেই।
দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পেলো এসপি মনোয়ার ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে বিরসমুখে। ইফাঁকে দেখে মুখ তুলে তাকালো। ভদ্রলোক।
“এমপিসাহেব ফোন দিয়েছিলেন।”
“কখন?”
“আপনি ঘরে ঢোকার পর পরই।”
“কি বললেন?”
“আমি কলটা রিসিভ করি নি।”
“ও,” একটু থেমে আবার বললো, “মাত্র একবারই কল করেছিলেন?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো এসপি।
“মনে হয় আর কল করবেন না।”
মনোয়ার হোসেন হিরচোখে চেয়ে রইলো।
ছফা ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন অনুভব করলো না। ঘরে ঢুকে রিপোর্টটা পড়ার আগেই সে ঢাকায় ফোন দিয়েছিলো এখানকার এমপিকে নিরস্ত করার অনুরোধ জানিয়ে। সম্ভবত সেটা করা হয়েছে। ওসি আর এসপি’কে যেভাবে মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ঠিক সেইমতো এমপিকেও মুখ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
“এরপর যদি আবার করে?” মনোয়ারসাহেব একটু ভেবে অবশেষে জানতে চাইলেন।
কাঁধ তুললো ছফা। “তাহলে আর কি, ধরবেন না। জাস্ট ইগনোর হিম ফর অ্যা হোয়াইল।” কথাটা বলেই পা বাড়ালো দরজার দিকে।
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“হোটেলের রুম ছেড়ে দিয়ে লাগেজটা নিয়ে আসি৷” মনোয়ার সাহেব আর কিছু বললো না।
এসপির বাংলো থেকে বের হতেই তার ফোনটা বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইলফোনটা বের করে দেখলো একটা অপরিচিত নাম্বার। হাঁটতে হাঁটতেই কলটা রিসিভ করলো।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা গেলো। তারপরই ভেসে এলো একটা নারীকণ্ঠ।
“আমি কি নুরে ছফার সাথে কথা বলছি?”
ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটরের গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। কে
“হ্যা..আপনি কে বলছেন?”
“মুশকান জুবেরি।”
হাটা থামিয়ে দিলো সে। এই মহিলা তার নাম্বার পেলো কোত্থেকে? ওসি দিয়েছে? নাকি এসপি? যদি দিয়েও থাকে নিশ্চয় তার পরিচয় ফাঁস হবার আগে হবে সেটা।
“আশা করি চিনতে পেরেছেন।”
মুচকি হাসলো সে। “মুশকান জুবেরি নামের কারোর সাথে আমার কখনও কথা হয় নি.. পরিচয়ও হয় নি। সুতরাং ফোনে কণ্ঠ শুনে কিভাবে বুঝবো আপনি মিসেস জুবেরি?”
“সেজন্যেই ফোন দিয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি আপনি আমার ব্যাপারে আগ্রহী। জানি না কেন…তবে বেশ আগ্রহী সেটা বোঝা যাচ্ছে। আমি চাই, কেউ যদি আমার ব্যাপারে জানতে চায়..কারোর যদি আমার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে সরাসরি আমাকেই সেটা বলুক। এতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না।” এক নাগারে বলে গেলো মিসেস জুবেরি।
ছফা কী বলবে বুঝতে পারলো না।
“আপনি চাইলে আরো অনেক আগেই আমার সাথে দেখা করতে পারতেন। ওভাবে চোরের মতো আমার বাড়িতে ঢোকার কোনো দরকারই ছিলো না।”
ছফা এবারও কিছু বললো না। সে খুব অবাক হয়েছে মহিলা তাকে ফোন করেছে বলে। এরকমটি ঘুণাক্ষরেও আশা করে নি।
“বুঝতে পেরেছি, আমাকে নিয়ে আপনার মনে অনেক প্রশ্ন জমে আছে…সেগুলোর উত্তর দিতে আমি প্রস্তুত
“আপনি কি বুঝতে পেরেছেন, আমি কেন আপনার ব্যাপারে আগ্রহী?” অবশেষে মুখ খুললো ছফা।
“না। আর সেটা বুঝতে চাই বলেই ফোন দিয়েছি। আপনি আমার বাসায় এসে এককাপ কফি খেয়ে যেতে পারেন। আমি চেষ্টা করবো আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে।”
আমাকে কফির নেমন্ত্রণ দিচ্ছে! নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারলো নয়া সে।
“আমার বিরুদ্ধে যদি আপনার কোনো অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে নিশ্চয় সেটা জানার অধিকার আমার আছে?”
“আপনি কি এখনই আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন?”
“হ্যাঁ। আমি এখন ফ্রি আছি। চাইলে আসতে পারেন।”
ছফা একটু দ্বিধায় পড়ে গেলো।
“আমি দারোয়ানকে বলে দিচ্ছি…ঠিক আছে?”
ছফার জবাবের অপেক্ষা না করেই কলটা কেটে দিলো মুশকান জুবেরি। কিছু বুঝতে না পেরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সে।
“এনিথিং রং?”
সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখতে পেলো বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এসপি। তার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ।
“একটা ফোনকল এসেছিলো। তারপর একটু ভেবে আবার বললো সে, “আপনি কি আমার ফোন নাম্বারটা জানেন?”
“না,” মনোয়ারসাহেব বললো।
“থানার ওসিকে ফোর্স রেডি রাখতে বলবেন। আমি বলামাত্রই যেনো মুভ করতে পারে।” আর কিছু না বলে ছফা পা বাড়ালো মেইনগেটের দিকে।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে চুপচাপ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো সুন্দরপুরের এসপি।
.
অধ্যায় ৩৪
দুর থেকে একজন মানুষকে আসতে দেখে নড়েচড়ে উঠলো সাদা পোশাকের দু-জন পুলিশ। জমিদার বাড়ির মেইনগেট থেকে একটু দূরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে তারা।
এই বাড়ির ভেতরে যে-ইটুকুক না কেন তাকে কোনো রকম বাঁধা দেবে নয়া, তবে বের হলেই চেক করা হবে-এমনটাই বলা হয়েছে ওদেরকে। ফলে দু-জন পুলিশ আস্তে করে গাছটার আড়ালে চলে গেলো। কেউ ওদের দেখে ফেলুক সেটা যেনো না-হয়। খুবই সতর্কতার সাথে কাজটা করতে বলেছে। ওদের। নজর রাখা হচ্ছে কিন্তু কারোর নজরে পড়া চলবে না। এক জায়গায় এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কারোর নজরে না পড়াটা অসম্ভব। কিন্তু ডিউটিতে আসার পর বাড়ি থেকে কেউ বের হয় নি, ঢোকেও নি। সে-কারণে কাজটা খুব সহজেই করা গেছে এতোক্ষণ ধরে।
আবছায়া অবয়বটি কাছে আসতেই বড় গাছটার দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। আড়ালে থাকা দু-জন ভড়কে গেলো একটু। তারা যে এখানে আছে এটা ঐ আগন্তুক কিভাবে টের পেলো?
“তোমরা কি আছো?” আস্তে করে বললো আবছায়া অবয়বটি।
গাছের আড়ালে থাকা দু-জন পুলিশ বুঝতে পারলো না কী করবে। তাদের মধ্যে একজন নীচু কণ্ঠে বললো তার সঙ্গিকে, “আমাগো ঐ স্যার মনে হইতাছে!”
প্রথমে সে-ই বেরিয়ে এলো গাছের আড়াল থেকে, তাকে অনুসরণ করলো তার সঙ্গি।
“স্লামালেকুম, স্যার,” প্রথমজন এগিয়ে এসে বললো। দ্বিতীয়জনও একই কায়দায় সালাম ঠুকলো।
“কি অবস্থা?” একটু সামনে এগিয়ে এলো অবয়বটি।
এ হলো সেই নুরে ছফা। ঢাকা থেকে এসেছে। ওসিসাহেব যার ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে এখন।
“কেউ বার হয় নাই,” প্রথমজন জবাব দিলো। “ঢুকেও নাই।”
“গুড
“তয় সন্ধ্যার দিকে একটা চিৎকারের আওয়াজ পাইছিলাম, স্যার।”
ভুরু কচকে ফেললো ছফা। “চিৎকার?”
“হ। একটা মহিলার চিৎকার।”
“কি বলো? তারপর?”
“তারপর আর কুনো আওয়াজ পাই নাই। বাড়ি থেইকাও কেউ বাইর হয় নাই।”
নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো ছফা। একটু ভেবে দু-জনের উদ্দেশে বললো, “আমি ঐ বাড়িতে যাচ্ছি। তোমরা নজর রেখো। আমি ভেতরে ঢোকার পর কাউকে ঐ বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। আর তোমাদেরও লুকিয়ে থাকার দরকার নেই। গেটের সামনেই থেকো।”
“ঠিক আছে, স্যার,” প্রথমজন বললো।
“তোমাদের সাথে আমস আছে তো?”
“জি, স্যার।” দুজনে একসাথে জবাব দিলো।
“গুড৷” কথাটা বলেই মেইনগেটের দিকে পা বাড়ালো সে।
বন্ধ গেটটার সামনে আসতেই ছোটো গেটটা খুলে দিলো দারোয়ান। সম্ভবত ফুটো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো সে। তাকে দেখে নিঃশব্দে সালাম ঠুকলো ইয়াকুব। কিছু না বলে মাথা নীচু করে ঢুকে পড়লো ছফা। দরজাটা বন্ধ করেই বোবা দারোয়ান তাকে নিয়ে রওনা দিলো বাড়ির দিকে। চারপাশে চকিতে চোখ বুলালো। গতকালের মতোই সুনসান পুরো বাড়িটা। মূল বাড়ির সদর-দরজাটা খোলাই আছে। ভবনের ডানপাশে গাড়ি রাখার যে গ্যারাজটা আছে তার বাইরে পার্ক করে রাখা আছে একটি প্রাইভেটকার। ছফা বুঝতে পারলো, এটাই মুশকান জুবেরি ব্যবহার করে।
বোবাকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। একটা মাঝারি গোছের হলওয়ে। দু-পাশে কতোগুলো দরজা, সবগুলোই বন্ধ। ভেতরটা মৃদু লালচে বাল্বের আলোয় কিছুটা আলোকিত। এই স্বল্প-আলো মনে করিয়ে দিচ্ছে বাড়িটার অতীত সময়কে।
হলওয়ের ডান দিকে একটা কাঠের সিঁড়ি। বোবা সেই সিঁড়ির সামনে এসে থেমে গেলো, হাত তুলে ইশারা করলো সোজা উপরে চলে যেতে। ছফা। কিছু বলতে গিয়েও বললো না। গভীর করে দম নিয়ে পা বাড়ালো সিঁড়ির দিকে।
কাঠের সিঁড়ি হলেও পুরোটাই কার্পেটে মোড়ানো। রেলিংটা চমৎকার নক্সা করা, কালচে বার্নিশ। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে আরেকটা লালচে বাতি জ্বলছে। দোতলায় উঠতেই থমকে দাঁড়ালো সে। তার থেকে কয়েক গজ দুরে বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে মুশকান জুবেরি। মহিলা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে মাথার উপরে একটা ছোটো ঝারবাতি জ্বলছে। খুবই মৃদু আলো আসছে সেটা থেকে। সেই আলোতে মুশকান জুবেরিকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে।
যথারীতি শাড়ি পরে আছে মহিলা। গায়ে একটা শাল, তবে গতরাতের মতো লাল নয়, ঘিয়েরঙ। শাড়িটাও জামদানি নয়, সাদারঙের সাধারণ সুতির। চোখে টানা করে কাজল দেয়া। চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে খোঁপা করে রেখেছে। কপালে লালটিপ। শালের সাথে ম্যাচ করে ঠোঁটে হালকা ঘিয়েরঙা লিপস্টিক। তার চোখের দৃষ্টি অন্তর্ভেদী, কিন্তু মোহনীয়। সত্যি বলতে দুর্দমনীয়!
ছফার ধারণা মহিলা তাকে প্রলুব্ধ করে বাগে আনার চেষ্টা করবে। মনে মনে মুচকি হাসলো সে। যদি ওরকম কিছু ভেবে থাকে তাহলে মিসেস জুবেরি বিরাট বড় ভুল করেছে। সব পুরুষমানুষ ঐ এমপি আর এসপির মতো নয়!
“আসুন,” বললো মুশকান।
সম্বিত ফিরে পেলো ছফা। এতোক্ষণ ধরে যে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতেই পারে নি।
মুশকান জুবেরি ঘুরে গেলো। তার পদক্ষেপ খুবই ছোটো; শান্ত; আর অভিজাত। ছফা তার পেছন পেছন গিয়ে ঢুকলো বড় একটা ঘরে। একেবারেই পুরনো আভিজাত্য নিয়ে সাজানো হয়েছে ঘরটা। কাঠের ফ্লোরটার বেশিরভাগ মোটা কার্পেটে মোড়ানো। উত্তর দিকের দেয়ালে দু দুটো বিশাল বুকশেলফ। সেই শেলফ দুটোর উপরে একটি হরিণ আর ভালুকের মাথা স্টাফ করা। পুরনো দিনের কলের গান গ্রামোফোন রয়েছে শেলফের পাশেই। ওটার পাশে ছোট্ট একটা র্যাকে প্রচুর লং-প্লে, যা আজকাল আর দেখা যায় না। একসেট পুরনো ধাঁচের সোফা রয়েছে ঘরে, আরো আছে মোড়া জাতীয় কিছু আসন। ঘরের এককোণে একটা ইজিচেয়ারও দেখতে পেলো। বড় আর আয়তক্ষেত্রের নীচু টেবিল, কিছু মাঝারিগোছের আসবাব, কফি টেবিল আর অসংখ্য অ্যান্টিকে সাজানো। ঘরটা দেখে ছফা বুঝতে পারলো এটা মুশকান জুবেরির স্টাডিরুম। এখানেই বাইরের মানুষজনের সাথে দেখা করে মহিলা, আবার বাকি সময়ে এটাই তার স্টাডিরুম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
“বসুন,” একটা সিঙ্গেল সোফা দেখিয়ে বললো বাড়ির মালিক। নিজে বসলো একটু দূরে মোড়ার মতো আসনে।
ছফা ঘরটার চারপাশে আরেকবার তাকিয়ে বসে পড়লো। হাতাওয়ালা পুরনো দিনের সোফাটা বেশ আরামদায়ক।
“চা নাকি কফি, কোনটা নেবেন?” বেশ আন্তরিকভাবেই জানতে চাইলো মুশকান।
“কোনোটাই না,” মাথা দুলিয়ে বললো ছফা।
মুচকি হাসলো মিসেস জুবেরি। আমার বাসায় এসে কোনো কিছু খেতে ভয় পাচ্ছেন?”
“না,” জোর দিয়ে বললো ডিবির ইনভেস্টিগেটর। যদিও কথাটা একদিক থেকে সত্যি। অতি সতর্কতা তো এক ধরণের ভয়-ই! “আমি আসলে দরকারি কথা শোনার জন্য এসেছি।”
মুশকান স্থিরচোখে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “তার মানে, আপনার হাতে সময় খুব কম?”
“কার সময় কম সেটা সময় এলেই বোঝা যাবে।”
একটু ভেবে বললো মুশকান, “ঠিক আছে, তাহলে শুরু করুন।”
“এখানে আসার আমন্ত্রণটা কিন্তু আপনিই দিয়েছেন…আপনিই শুরু করুন।”
আবারো মুচকি হাসি দেখা গেলো মুশকানের ঠোঁটে। “আমি কিভাবে শুরু করবো? আমি তো জানিই না একজন পুলিশ কেন আমার পেছনে লেগেছে।”
ভুরু তুললো ছফা। “আপনি তাহলে জেনে গেছেন আমি পুলিশের লোক?”
“এটা জানা এমন আর কি।”
“কিন্তু আমার ফোন নাম্বারটা কিভাবে পেলেন?”
“এটা কি কঠিন কাজ?” মাথা দোলালো মিসেস জুবেরি। “ফোনের ব্যালান্স রিচার্জ করার জন্য এখানে খুব বেশি দোকান নেই।”
ভুরু কুচকে ফেললো ছফা। আতর আলী যেভাবে তার নাম্বার জোগাড় করেছিলো ঠিক একইভাবে মুশকান জুবেরিও হয়তো কাজের লোকজন কিংবা হোটেলের কর্মচারিদের দিয়ে তার নাম্বার বাগিয়ে নিয়েছে।
“আর আমি যে পুলিশ এটা নিশ্চয় এসপি কিংবা ওসি বলেছে? নাকি ঐ এমপি?”
মাথা দোলালো মুশকান। “ওরা কেউ আমাকে বলে নি আপনি পুলিশ। ইনফ্যাক্ট, ওরা হঠাৎ করে আমার ফোনই ধরছে না। বলতে পারেন, সে কারণেই আমি ধরে নিয়েছি আপনি পুলিশই হবেন।”
“বাহ্, প্রশংসা না করে পারছি না।”
“কিসের?”
কথাটা বলার সময় মুশকান জুবেরির চাহনিটা ছফাকে মুগ্ধ করলো। “আপনার লজিক-সেন্সের।”
“ও।” একটু থেমে আবার বললো, “এখন বলুন, আমার বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগটা কি? এটা জানার অধিকার নিশ্চয় আমার রয়েছে?”
“অবশ্যই,” বললো ছফা। “তবে তার আগে আমাকে বলুন আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন।”
এবার মুশকান ভুরু কুচকালো, তবে সামান্য সময়ের জন্য। “আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই এখানে চলে এসেছেন?”
“কিছু জানি না তা তো বলি নি…অনেক কিছুই জানি।”
“তাই?” মুচকি হাসলো মহিলা।
“শুনি তো, কি জানেন।”
ছফা গভীর করে দম নিয়ে নিলো। তার সহকারী যে তথ্য পাঠিয়েছে সেগুলো বলতে গেলে অকাট্য। “আমাকে পরীক্ষা করবেন না, ডাক্তার মুশকান সোহেলী!”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো মিসেস জুবেরি। তার চোখেমুখে কপট মুগ্ধতা।
“রাশেদ জুবেরিকে বিয়ে করার আগে তা-ই ছিলেন,” ছফা আয়েশ করে হেলান দিলো সোফায়। “সপরিবারে আমেরিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন। তারপর হুট করেই দেশে চলে এলেন। ঢাকার অরিয়েন্ট হাসপাতালে যোগ দিলেন এক সময়।”
মুশকান কিছু বললো না। তার অভিব্যক্তি দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই সে কি ভাবছে।
“সেখানে রোগি হিসেবে পেয়ে গেলেন রাশেদ জুবেরিকে। উনি প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। একেবারে টার্মিনাল স্টেজে ছিলেন। আপনাদের হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছে ভদ্রলোক। অবিবাহিত বলে তাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিলো না। বাবা-মা একাত্তরে মারা গেছে। বাবার দিক থেকে কিছু আত্মীয়-স্বজন থাকলেও মায়ের দিকে নিকট কোনো নিকটাত্মীয় বলতে গেলে এখন আর নেই।” একটু থামলো মহিলার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য, কিন্তু হতাশ হলো। মুখটা যেনো তৈলচিত্রের মতো স্থির হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। পলক প্রায় ফেলছেই না।
“রাশেদ জুবেরি প্রায় তিনমাস ছিলেন অরিয়েন্ট হাসপাতালে…তখনই আপনার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় কিন্তু সেটা ডাক্তার-রোগির সম্পর্কের বাইরে কিছু ছিলো না…যতোটা আমি জেনেছি।” আবারো থামলো তবে এবার কথা গুছিয়ে নেবার জন্য। “রাশেদ জুবেরি বুঝে গেছিলেন উনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। কয়েক মাসের ব্যাপার। বেশ খাদ্যরসিক ছিলেন ভদ্রলোক, এটা-ওটা খেতে চাইতেন। কিন্তু তার সেই আব্দার পূরণ করার মতো কেউ ছিলো না…আপনি ছাড়া।”
মুশকনি এবার আলুতো করে হেসে বুকের কাছে দু-হাত ভাঁজ করলো।
“আপনি নিজের হাতে রান্না করে উনাকে খাওয়াতে শুরু করলেন। উনি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সম্ভবত আপনার অসাধারণ রান্নায় সম্মোহিত হয়ে গেলেন পুরোপুরি। এজন্যে আমি ভদ্রলোককে অবশ্য দোষও দেই না। আপনার রান্না সতিই অতুলনীয়।”।
মুচকি হেসে ভুরু তুললো মুশকান জুবেরি। “এটা কি আপনার নিজস্ব মতামত?”
“বলতে পারেন..কারণ আমিও রবীন্দ্রনাথে খেয়েছি, অসাধারণ না বলে উপায় নেই।”
“ধন্যবাদ।”
“একটি প্রবাদ আছে…কারোর মন জয় করতে চাইলে আগে তার পাকস্থলী জয় করো। সেভাবেই আপনি রাশেদ জুবেরির মন জয় করতে সক্ষম হলেন…খুব দ্রুত।”
“আপনি কি শিওর, চা-কফি কিছু নেবেন না?” অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলে উঠলো মিসেস জুবেরি।
“নো থ্যাঙ্কস।”
“আমি যদি একটু কফি নেই তাহলে কিছু মনে করবেন? শীতকালে আমার ঘন ঘন চা-কফির তেষ্টা পায়…ওসব না-হলে মাথা ধরে আসে।”
“এটা আপনারই বাড়ি..জিজ্ঞেস করার কোনো দরকার নেই,” মুচকি হেসে বললো ছফা।
“থ্যাঙ্কস,” বলেই উঠে দাঁড়ালো মুশকান। বইয়ের শেলফের পাশে বাক্সের মতোন আসবাবের ভেতর থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে আনলো, সেইসাথে একটা কাপ। ফ্লাস্ক থেকে কফি ঢেলে নিলো। “একটু বেশি করেই বানিয়েছিলাম…ভেবেছিলাম আপনি হয়তো খাবেন…কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এ বাড়িতে কিছু খাবেন না বলে আগে থেকেই ঠিক করে এসেছেন।”
ছফা কিছু বললো না।
“কোমরে পিস্তল, বাইরে দু-জন পুলিশ, তারপরও কোনো পুরুষ মানুষ একজন নিরস্ত্র মহিলাকে ভয় পেলে অবাক হতেই হয়।” ফ্লাস্কটা রেখে চলে এলো আগের জায়গায়।
ছফা খুবই অবাক হলো কথাটা শুনে। পুলিশ হিসেবে তার কাছে পিস্তল থাকাটা স্বাভাবিক, এটা কাণ্ডজ্ঞান বলে ধরে নেয়া যায়, কিন্তু বাইরে যে দু-জন আছে সেটা কিভাবে জানতে পারলো এই মহিলা। “মনে হচ্ছে আপনার চোখ সবদিকেই থাকে,” আস্তে করে বললো সে। “অনেক কিছুই দেখতে পান?”
কফিতে চুমুক দিয়ে মাথা দোলালো মুশকান। “ব্যাপারটা অতো রহস্যময় নয়, যেমনটা আপনি আমার সবকিছুর বেলায় ভাবছেন,” একটু থেমে ইজিচেয়ারের পাশে একটা আবাবের দিকে ইশারা করলো। “ওখানে। একটা মনিটর আছে…তিন-চারটা সাভিল্যান্স ক্যামেরার ফিড দেখা যায়।”
তথ্যটা ছফাকে চমকে দিলো, সেইসাথে পেয়ে গেলো অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব।
“কি হলো, বলুন?” কফির কাপটা ঠোঁটের কাছে এনে অভেদী দৃষ্টি হেনে বললো মুশকান জুবেরি।
“তারপর রাশেদ জুবেরি হাসপাতাল ছেড়ে বনানীতে নিজের বাড়িতে উঠলেন. আপনিও তার সঙ্গি হলেন।”
কফির কাপে নিঃশব্দে চুমুক দিলো মুশকান।
“উনার সার্বক্ষণিক দেখভালের দায়িত্ব নিলেন। ভদ্রলোক যতোদিন বেঁচে ছিলেন আপনি তার পাশেই ছিলেন। ধরে নিচ্ছি, রোজ রোজ উনাকে মনভোলানো খাবার রান্না করে খাওয়াতেন।”
“মনভোলানো?” স্মিতহাসি দিলো মুশকান। “আমি ধরে নিচ্ছি এটা। কম্প্রিমেন্ট…যদিও আপনি কী অর্থে ব্যবহার করেছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।” নির্বিকার থাকার চেষ্টা করলো ছফা। “রাশেদ জুবেরি হাসপাতাল ছাড়ার পর খুব বেশিদিন বাঁচেন নি..সম্ভবত চার মাস?”
“পাঁচমাস সতেরো দিন,” শুধরে দিলো মিসেস জুবেরি। “আপনাদের বিয়েটা কবে হয়েছিলো?”
“এতোকিছু জানেন আর এটা জানতে পারেন নি?” কফির কাপটা পাশের কফি টেবিলে রেখে দিলো। “মনে হচ্ছে আপনার সোর্স অব ইনফর্মেশন ঐ হাসপাতালটাই।”
কথাটা সত্যি। ছফার সহকারী প্রায় সব তথ্যই ওখান থেকে জোগাড় করেছে। “রাশেদ জুবেরির সাথে আপনার বিয়ের খবরটা খুব কম মানুষই জানে।”
“ছুম। আমরা তো আর ঘটা করে বিয়ে করি নি.. আবার টিনএজারদের মতো পালিয়েও সেটা করা হয় নি।” একটু থেমে গভীর করে দম নিয়ে নিলো। সে। “বিয়ের আইডিয়াটা একদমই ওর নিজের ছিলো। আমি প্রথমে রাজি ছিলাম না। পরে ভেবে দেখলাম একজন মৃত্যুপথযাত্রি…যে কিনা অল্প কিছুদিন বাঁচবে, তার একটা ইচ্ছে পূরণ করে তাকে দু-দণ্ড শান্তি দিতে পারলে মন্দ কী।”
“আর তাই আপনি উনাকে দু-দণ্ড শান্তি দেবার জন্য বনলতা সেন হয়ে গেলেন?”
ছফার টিপ্পনীটা মুশকান শুধুমাত্র হালকা বাঁকাহাসি দিয়ে জবাব দিলো। “কী হয়েছিলাম জানি না…তবে কাগজে-কলমে মিসেস জুবেরি হয়ে গেলাম। মুশকান জুবেরি।”।
“তারপর উনার সমস্ত সম্পত্তি আপনি আপনার নামে লিখিয়ে নিলেন?
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো ডাক্তার। “আপনি আপনার নামের মতো ব্যতিক্রমী চরিত্র নন, মি. ছফা। সাধারণ মানুষ যেভাবে ভাবে আপনিও ঠিক সেভাবেই ভাবেন।” একটু থেমে আবার বলতে লাগলো সে, “আজ বাদে কাল যে মারা যাবে তাকে কোনো মেয়ে বিয়ে করলে সেটা অবশ্যই সম্পত্তির লোভে করবে-খুবই সাধারণ মানের চিন্তা-ভাবনা। আপনার এমন চিন্তা ভাবনায় আমি কিছুটা হতাশ। শিক্ষিত লোকজনদের আরো একটু উদার মনমানসিকতা থাকা দরকার।”
নুরে ছফা কিছু বললো না।
এবার নিঃশব্দে হাসলো মুশকান। “বিয়ের আগে আমি জানতামই না ওর নামে বিরাট সম্পত্তি রয়েছে…ওগুলো বেদখল হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। যখন জানতে পারলাম তখন বিশ্বাসই করতে পারি নি সম্পত্তিগুলো কোনোদিন উদ্ধার করা যাবে। ও নিজেও এসব সম্পত্তির আশা ছেড়ে দিয়েছিলো।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো ছফা।
“বলছি, এতো অধৈর্য হবার দরকার নেই। আপনার সমস্ত প্রশ্নের জবাবই আমি দেবো।” গায়ের শালটা খুলে ঠিকঠাক করে আবারও শরীরে জড়িয়ে নিলো।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ছফা মুগ্ধ হয়ে দেখলো তার সামনে বসা মহিলার দেহসৌষ্ঠব। যেকোনো তরুণীর চেয়েও দেহের গড়ন ভালো। নির্মেদ। রোগাও নয় আবার প্রয়োজনের তুলনায় বেশিও নেই কোনো কিছু। যেটা যেরকম থাকার কথা সেরকমই আছে। মহিলার বয়স আন্দাজ করতে পারলো না। কতো হবে? এসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে কাজে মনোযোগ দিলো।
“২০০৭ সাল, এক-এগারো হিসেবে যেটা পরিচিত, সেই সময়টাতে ছুট করেই একটা দারুণ সুযোগ চলে এলো। রাশেদ তখন খুবই অসুস্থ। ওর এক ঘনিষ্ঠ বনধু ইকবাল ছিলো সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেনাসমর্থিত ঐ সরকারে ইকবালের খুব প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিলো। ওর মাধ্যমেই বেদখল হওয়া সম্পত্তিগুলো রাতারাতি ফিরে পাই আমরা।”
এই তথ্যটা ছফা আতরের কাছ থেকে জেনেছিলো। ঐ সময়ে রাজনীতিবিদেরা ছিলো দৌড়ের উপরে, সেই সুযোগে বেদখল সম্পত্তিগুলো খুব দ্রুত ফিরে পাওয়াটা স্বাভাবিকই। তবে সে অবাক হচ্ছে, মহিলা অকপটে সত্যি কথা বলছে বলে।
“তবে দু-বছর পর নির্বাচন হলে.ইকবালরা চলে যায়, আসে নতুন সরকার…তখন আবার সম্পত্তিগুলো বেদখল হতে শুরু করে।”
“এখানকার স্থানীয় এমপি আসাদুলাহ?”
ছফার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো মুশকান। “ইকবাল থাকতেই জমির কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক করে নিয়েছিলাম কিন্তু ঢাকায়। বসে সুন্দরপুরের বিশাল সম্পত্তি দখলে রাখাটা কঠিনই ছিলো।”
“পরে এমপির সাথে একটা রফা করে নিলেন? ফিফটি-ফিফটি? নাকি ফরটি-সিক্সটি?”
মুচকি হাসলো মুশকান। “এরকম কিছু করা হয় নি। জুবেরি আমার নামে যে অংশগুলো লিখে দিয়েছিলো সেগুলোর সবটাই ফিরে পাই তবে বিনিময়ে একটা আপোষ করতে হয়েছিলো আমাকে।”
“কি রকম?”
“অলোকনাথ বসু তার সম্পত্তির প্রায় ষাটভাগ দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দান করে গেছিলেন…ঐ সম্পত্তিগুলো এমপির পকেটে চলে যায়। আর এটা করতে আমি তাকে সাহায্য করেছি। বলতে পারেন, সাহায্য করতে বাধ্য হয়েছি।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “তারপর চলে এলেন এখানে?”
“কিন্তু আপনার চাকরি? ওটা ছাড়লেন কেন?”
মুশকান চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “ভালো লাগছিলো না। আমি আসলে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম। সেই সুযোগটা এসে যায় এই সম্পত্তিগুলো পাবার পর। তখন ঠিক করলাম, আর চাকরি নয়…সব ছেড়েছুঁড়ে বহু দূরে গিয়ে থাকবো। তাছাড়া মৃত্যুর আগে রাশেদ আমাকে একটা রেসটুরেন্ট করার জন্য অনুরোধ করেছিলো। সে বলেছিলো, আমার জাদুকরি রান্নার স্বাদ থেকে মানুষজনকে বঞ্চিত করা ঠিক হচ্ছে না।” মুচকি হাসলো মুশকান। “এমনকি মৃত্যুর আগেও আমার হাত ধরে এ কথাটা বলেছিলো। বলতে পারেন, তার কথা রাখার জন্যই রবীন্দ্রনাথ করেছি। অবশ্য, ও ভাবে নি আমি এই সুন্দরপুরে এসে এটা করবো।”
ছফা অনেক কষ্টে কথা বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখলো। সে চাইছে, আগে মুশকান জুবেরি নিজের মুখে সব বলুক।
“তাকা আমার কাছে অসহ্য ঠেকছিলো…তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে রকম পরিকল্পনা আমার ছিলো সেটা ঢাকায় কিংবা আশেপাশে করা সম্ভব ছিলো না।”
“কেন?”
“ঢাকায় কোনো কিছু বিশুদ্ধ, কেমিক্যালফ্রি..ফরমালিনমুক্ত পাওয়া যায় না। ডাক্তার হিসেবে অন্য অনেকের চেয়ে এটা আমি ভালো করেই জানতাম। তরিতরকারি, ফলমূল থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, কোনো কিছুই এসব থেকে মুক্ত নয়। এমনকি, দুধ পর্যন্ত বিষে ভরা। আমি চাই নি। রবীন্দ্রনাথে এসব জিনিস দিয়ে রান্না করা হোক। তাছাড়া ওসব ভেজাল জিনিস ব্যবহার করে আমার মনমতো রেসিপি তৈরি করাও সম্ভব ছিলো না। স্বাদের ব্যাপারটা খুবই সূক্ষম। সামান্য হেরফের হলেও বদলে যায়।”
“আচ্ছা,” আস্তে করে বললো নুরে ছফা।
“কিন্তু এখানে প্রচুর আবাদি জমি আছে…থাকার মতো সুন্দর একটি বাডিও আছে, আমি ইচ্ছে করলে সবকিছুই ফলাতে পারি, চাষবাস করতে পারি, তাই ঠিক করলাম এখানেই চলে আসবো।”
“আপনি কি কুমীরের মাংস দিয়েও রেসিপি করেন নাকি?”
মুচকি হেসে মাথা দোলালো মুশকান। “না। ওগুলো মাত্র তিন-চার মাস ধরে ব্রিডিং করছি। অনেকটা শখে। তবে ভবিষ্যতে বিদেশে রপ্তানী করার পরিকল্পনা আছে আমার।”
“আপনার এই শখটা কিন্তু সিকিউরিটি পারপাসও সার্ভ করছে দারুণ আইডিয়া।”
এবার চোখ দিয়ে হাসলো মুশকান জুবেরি। “গতকাল রাতের আগে অবশ্য এটা বুঝতে পারি নি। এখন মনে হচ্ছে আইডিয়াটা আসলেই দারুণ।”
ভুরু কুচকালো ছফা। “আর গতরাতে ফালুকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে কি পুঁতে ফেললেন? সেটাও কি কোনো শখ?”
এবার বেশ কিছুটা সময় ধরে মুশকান জুবেরি হাসলো, তবে একদম নিঃশব্দে। “দেখে ভয় পেয়েছিলেন নাকি?”
প্রশ্নটা ছফার পৌরুষে লাগলেও হজম করলে চুপচাপ।
“আমি স্প্যানিশ কুইজিন খুব পছন্দ করি। ওদের কিছু ধরণ আমি দেশীয় খাবারের সাথে ব্লেন্ডিং করে রেসিপি বানিয়েছি। এটাকে এক ধরণের ফিউশন বলতে পারেন। খাবারগুলো লোকে পছন্দও করেছে। আপনিও সেগুলো খেয়েছেন। সম্ভবত পছন্দও করেছেন।”
“রেস্টুরেন্টেও কি আপনার চোখ সবকিছু লক্ষ্য করে?” শেষ পর্যন্ত না বলে পারলো না। “আই মিন, সার্ভিল্যান্স করেন?”
“হোটেল-রেসটুরেন্টে সার্ভিল্যান্স ক্যামেরা থাকাটা তো খুবই সাধারণ ব্যাপার, তাই না?” একটু থেমে আবার বললো, “নাকি সুন্দরপুরের মতো গ্রামীণ এলাকায় ওসব থাকাটা বেমানান?”
এবার ছফা বুঝতে পারলো মুশকান জুবেরি কেন তার দিকে ওভাবে তাকিয়েছিলো। আগেভাগে কিছু টের পাওয়াটা আসলে কোনো রহস্যময় ব্যাপার নয়, এটা নিছকই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের বাড়তি সুবিধা। রবীন্দ্রনাথের প্রাইভেট রুমে বসে কাস্টমারদের মনিটর করার সুবিধা রয়েছে। আর সেই সুবিধা ব্যবহার করেই মুশকান জুবেরি দেখেছে তার গতিবিধি, চাহনি। অন্যসব কাস্টমার থেকে খুব সহজেই তাকে আলাদা করতে পেরেছে।
“গতরাতে গর্ত করে কি মাটিচাপা দিলেন, সেটা কিন্তু বললেন না?” প্রসঙ্গে ফিরে এলো নুরে ছফা।
“বলছি। স্প্যানিশ কুইজিন…ওসবে প্রচর রেডওয়াইন ব্যবহার করা হয়…বলতে পারেন পানির বদলে রেডওয়াইন দেয় ওরা। ওখানে রেডওয়াইন খুবই অ্যাভেলেবেইল। সস্তাও বটে। বিশেষ করে খাবারে ব্যবহার করা হয়। যেগুলো।”
রেডওয়াইন! ছফার মাথায় নানান হিসেব জট পাকাতে লাগলো।
“এখানে…এই দেশে রেডওয়াইন খুব কমই পাওয়া যায়…ঢাকা থেকে আপনি কয়েক বোতল আনতে পারবেন কিন্তু দাম পড়বে অনেক..আর জিসিটা পুরোপুরি লিগ্যালও হবে না।” একটু থেমে আবার বললো, “ওভাবে রেডওয়াইন এনে রান্না করলে খাবারের দাম হবে আকাশছোঁয়া…তাছাড়া, সব সময় ওয়াইনের সরবরাহও থাকবে না।”
“তাই আপনি নিজেই রেডওয়াইন বানাতে শুরু করলেন?”
“হুম। এটা বানানো এমন কোনো কঠিন কাজ নয়। খুব সহজ।” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “লাল আঙ্গুরের রস গেজানোর জন্য মাটির নীচে রাখার দরকার পড়ে…বুঝতে পেরেছেন?”
হতাশ এবং অসহায় বোধ করলো ছফা। মাটির নীচে তাহলে ওয়াইন রাখা হচ্ছিলো।
“বিশ্বাস না-হলে গতরাতে যেখানে ওয়াইনগুলো রেখেছি সেটা খুঁড়ে দেখতে পারেন।”
নিজের অভিব্যক্তি লুকানোর চেষ্টা করলো সে। বোঝাই যাচ্ছে তার সামনে যে বসে আছে সে থট-রিডিং করতে পারে। “আপনি নিশ্চয়ই সার্ভিল্যান্স ক্যামেরায় দেখেছিলেন আমি আপনার বাড়িতে ঢুকেছি?” আবারো প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো।
“অবশ্যই।”
“তারপরও আমাকে ধরলেন না কেন? মানে, ধরার কোনো চেষ্টাই করেন নি…কেন?”
“আপনার জায়গায় সত্যিকারের কোনো চোর ঢুকলেও আমি ধরার চেষ্টা করতাম না…ওসব করে লাভ কি? আমি তো এখানে এমন কিছু করি না যে, খুব তটস্থ থাকতে হবে। কিংবা এমন কিছু রাখি না চুরির ভয়ে রাতে ঘুম হবে না।” একটু থেমে আবার বললো, “এর আগেও এরকমভাবে অনেকে এই বাড়িতে ঢুকেছে…তাদের কেউ কেউ চোর ছিলো…সবাই না। অনেকে আগ্রহ আর কৌতূহল থেকেও টু মেরেছে৷ একজন মহিলা শহর থেকে এসে এখানে থাকে…আগ্রহ হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
“তাহলে ওদেরকে আপনি এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছেন? কিছুই করেন। নি?”
কপালের উপর থেকে একগাছি চুল সরিয়ে দিলো মুশকান। “একেবারে এমনি এমনি ছেড়ে দেই নি। একটু ভয় পাইয়ে দিয়েছি, যাতে এই বাড়ির ত্রি সীমানার মধ্যে কেউ না আসতে পারে।”
ছফা ভুরু কুচকে তাকালো। আতরের বলা জ্বলজ্বলে চোখের ব্যাখ্যা কি তাহলে এই? “কিভাবে ভয় দেখাতেন?” আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো সে।
“খুব সহজেই…” বলেই মুচকি হাসলো। প্রথমে যখন এখানে আসি। তখন থেকেই টের পেলাম আশেপাশের মানুষজন আমার ব্যাপারে খুব আগ্রহী। রাত-বিরাতে দেয়াল টপকে বাড়ির ভেতরেও ঢু মারে কেউ কেউ। তো, হ্রট করে মনে হলো একটা কাজ করা যেতে পারে আমার এক বান্ধবী আছে…ও নাটক-সিনেমায় অভিনয় করে। ওকে একবার ডাইনির চরিত্রে অভিনয় করতে দেখেছিলাম…এটা দেখে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ওর মাধ্যমে একজোড়া কসমেটিক কন্ট্যাক্ট লেন্স জোগাড় করলাম। ওই লেন্সটা রাতের বেলায় জ্বলজ্বল করে। রেডিয়াম আর কি।”
ছফা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে সে এই ব্যাখ্যাটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিলো। এছাড়া আর কীই-বা হতে পারে?
“বলতে পারেন, ওই লেন্স দুটো দারুণ কাজে দিয়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। বুঝতে পারছে, সার্ভিল্যান্স ক্যামেরায় আতরকে দেয়াল টপকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে মুশকান জুবেরি রেডিয়াম কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে বসেছিলো বেলকনিতে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, ঐ ইনফর্মারকে ঘাবড়ে দেয়া। তখন মহিলা ইচ্ছে করেই রেডওয়াইন পান করছিলো আতরের কাছে ওটা যেনো রক্ত বলে মনে হয়।
“কিন্তু এরফলে গ্রামের লোকজন যে আপনাকে ডাইনি বলে সন্দেহ করতে শুরু করেছে তা কি আপনি জানেন?”
মুচকি হাসলো মিসেস জুবেরি। “সমস্যা কি? ওরা যা খুশি ভাবুক আমার উদ্দেশ্য তো খুব সহজ, কেউ যেনো আমার ত্রি-সীমানায় না আসে। সেটা ভয় থেকে হোক কিংবা অন্য কিছু, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
“বুঝেছি,” বললো ছফা। “একজন ডাইনি, যার সাথে এমপি, ডিসি, এসপি’র দারুণ খাতির…তাকে কেউ ঘাঁটাতে যাবে না। দূর থেকে শুধু ডাইনি বলে দুটো মন্দ কথা বলবে।”
“ঠিক,” মাথা নেড়ে সায় দিলো মুশকান জুবেরি।
“কিনতু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আপনার বাড়িতে এক মেয়ে। আছে, সে আমাকে সামনাসামনি দেখেও কিছু বলে নি। মানে, একটু ভয় পাওয়া…চিৎকার দেয়া..এসব কিছুই করে নি।”
প্রচ্ছন্ন হাসি দেখা গেলো মুশকানের ঠোঁটে। ছফার প্রশ্নগুলো যেনো খুব উপভোগ করছে। “আসলে ওই মেয়েটা আপনাকে দেখতেই পায় নি…দেখতে পেলে অবশ্যই চিৎকার দিতো।”
“কি বলেন…মেয়েটা আমাকে অবশ্যই দেখেছে!” জোর দিয়ে বললো।
“ওই মেয়েটা আমার সাথেই থাকে। আপনাদের ভাষায় কাজের মেয়ে…আমি অবশ্য বলি, হোম-অ্যাসিসটেন্ট।” একটু থেমে কানের পাশে চুলগুলো সরিয়ে দিলো এবার। “সাফিনা ছোটোবেলা থেকেই রাতকানা রোগে ভুগছে। খুব গরীব ঘরের মেয়ে..অপুষ্টি থেকে এটা হয়ে গেছে। দিনের বেলায় সব দেখতে পেলেও রাতে তেমন দেখে না বললেই চলে।”
ছফা হা-করে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
দারোয়ান বোবা, কাজের মেয়ে রাতকানা, জ্বলজ্বলে চোখের আসল কারণ রেডিয়াম কন্ট্যাক্ট লেন্স, মাটিচাপা দেয়া হয়েছে ঘরে বানানো রেডওয়াইন, সার্ভিল্যান্স ক্যামেরার সাহায্যে অনেক কিছুই দেখতে পায় মহিলা, শখের কুমীর চাষ শুরু করেছে ইদানিং।
মাথার মধ্যে এসব কিছু ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে তার সমস্ত সন্দেহ, প্রশ্ন বিশাল এক গহবরে মুখ থুবরে পড়তে যাচ্ছে। সে কি তাহলে ভুল মানুষের পেছনে ছুটছে?
“আর কিছু জানতে চান না?”
মুশকানের কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। “আপনি কি জানেন, আজ দুপুরে একটা ঘটনা ঘটেছে সুন্দরপুরের বড় কবরস্তানে?” প্রসঙ্গটা মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করলো সে। “ঐ যে ফালু..সে একজনকে মেরে জীবন্ত কবর দেবার চেষ্টা করেছিলো, ভাগ্য ভালো, লোকটা প্রাণে বেচে গেছে।”
কপালে ভাঁজ পড়লো মুশকান জুবেরির। “তাই নাকি?”
“হুম। ঘটনার পর থেকে ফালুকে পাওয়া যাচ্ছে না। কবরস্তানে তার ঘর তল্লাশী করেছে পুলিশ.. কিছুই পায় নি।”
“ওর ঘর থেকে কী পাবার আশা করেছিলেন, আপনি? মানে পুলিশ?” স্থিরচোখে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো ছফা। “লাশ।”
মুশকানের কপালের ভাঁজ আরো প্রকট হলো। চোখে তার বিস্ময় মাখানো প্রশ্ন। মাথাটা ডানপাশে একট কাত হয়ে গেলো।
“আমাদের কাছে ইনফর্মেশন ছিলো, ওর ঘরের খাটের নীচে কঙ্কাল আছে।”
“কঙ্কাল দিয়ে ও কি করে?”
“জানি না কি করে, তদন্ত হলে সব বেরিয়ে আসবে।”
নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো মুশকান জুবেরি, তবে সেটা ক্ষণিকের জন্যে। “আপনি কি ওর ঘটনার সাথে আমাকেও সন্দেহ করছেন?”
কাঁধ তুললো সে। “আমি আপাতত আপনার ব্যাপারেই মনোযোগ দিচ্ছি..ফালুর ঘটনাটা পরে দেখা যাবে। ওটা স্থানীয় পুলিশ-”।
“আমার কি ব্যাপার?” কথার মাঝখানে বলে উঠলো মুশকান। “একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিলে নুরে ছফা। “বলছি।” কথাগুলো গুছিয়ে নেবার জন্য একটু সময় নিলো সে। মিসেস জুবেরি এখনও তার দিকে স্থিরচোখে চেয়ে আছে। “আমি আসলে একজন মানুষের নিখোঁজ হবার কেস তদন্ত করছি আর সেটা করতে গিয়েই আপনার সন্ধান পেয়েছি।”
মুশকান অভিব্যক্তিহীন চোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। “আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না?”
“হাসিব আহমেদ নামের এক ভদ্রলোক তিনমাস আগে নিখোঁজ হয় ঢাকা থেকে। তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় নি এখন পর্যন্ত। ঐ কেসটা পুলিশ, সিআইডি ঘুরে ডিবির কাছে আসে..বর্তমানে ওটার তদন্ত করছি আমি।”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো মিসেস জুবেরি, কিছু বলতে গিয়েও যেনো বললো না।
“হাসিবের মামা খুবই প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত আগ্রহে কেসটা আমাকে দেয়া হয়েছে। প্রথমে আমি তদন্ত করে কিছুই পাই নি। কেসটা একেবারে কানাগলির মতোই একটা জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। সেখান থেকে এক পা-ও এগোতে পারি নি। অবশেষে একটা সূত্র পেয়ে যাই। হাসিব যে ট্যাক্সিখ্যাবে করে এখানে এসছে সেটা ট্রেস করতে পারি। ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, হাসিব ঢাকা থেকে এখানে, আপনার ঐ রবীন্দ্রনাথে এসেছিলো। তারপর থেকে সে নিখোঁজ।”
“এর মানে কি?” মুশকান জুবেরিকে বিস্মিত দেখালো। “রবীন্দ্রনাথে প্রতিদিন শত শত লোক আসে..খাওয়া-দাওয়া করে আবার চলে যায়…তারা কোথায় যায়…কি করে…সেখান থেকে নিখোঁজ হয় নাকি গুম হয় তা আমি কিভাবে জানবো? এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। “ঐ ড্রাইভার বলেছে, কাকতালীয়ভাবে সে হাসিবের ঘটনার দু-মাস আগে আরেকজনকে নিয়ে এখানে এসেছিলো।”
“বাহ্” বাঁকাহাসি দিলো মিসেস জুবেরি। “দু-জন লোক দু-তিনমাসের ব্যবধানে এখানে চলে এলো…তারপর তাদের আর খোঁজ পাওয়া গেলো না…এ থেকে আপনি কি করে আমাকে জড়ালেন? এখানে আমার কি ভূমিকা?”
ছফা বাঁকাহাসি দিলো, অন্তর্ভেদী দৃষ্টি হেনে চেয়ে থেকে বললো, “মিসেস জুবেরি, আমি কিন্তু বলি নি দ্বিতীয়জন নিখোঁজ হয়েছে। বলেছি, ঐ লোকটাও এখানে এসেছিলো।”
এই প্রথম মুশকান একটু ভড়কে গেলো, তবে সেটা খুবই সামান্য সময়ের জন্য, তারপর গভীর করে দম নিয়ে বললো, “আমি ভেবেছি আপনি দু-জন নিখোঁজ হবার কথা বলছেন।”
“যাহোক, শুধু দু-জন হলেও ব্যাপারটা কাকতালীয় বলে ধরে নিতাম,” আস্তে করে বললো ছফা। “কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে এরকম আরো তিনটি ঘটনা পেয়েছি…ওরা সবাই একদিন হ্রট করে নিখোঁজ হয়ে গেছে।”
অবিশ্বাসে তাকালো মুশকান জুবেরি। “ওরা সবাই এখানে এসে নিখোঁজ হয়েছে আর সেই কাজটার সাথে আমি জড়িত…এর কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে?”
পাঁচজনের মধ্যে দু-জন ভিক্টিম যে এখানে এসেছিলো সেটা ঐ ট্যাক্সিক্যাব ড্রাইভারই সাক্ষী।”
“আর বাকিদের ব্যাপারটা?”
“ওটা আমার অনুমান।”
“শুধুই অনুমান? কোনো প্রমাণ নেই?”
ছফা হাসলো। আশা করছি সেটা খুব জলদিই পেয়ে যাবো। ঢাকায় আমার এক সিনিয়র কলিগ ওটা দেখছেন।” একটু থেমে আবার বললো সে, “অরিয়েন্ট হাসপাতালের সিনিয়র ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদকে নিশ্চয় আপনি চেনেন?” মুশকানের জবাবের অপেক্ষা না করেই আবার বললো, “উনাকে আমার ঐ কলিগ জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।”
মুশকান জুবেরি স্থিরচোখে চেয়ে রইলো, সেই চোখে কি খেলা করছে। তা অবশ্য বোঝা গেলো না। শুধু চোখের মণিগুলো মৃদু নড়ছে।
“আমার ঐ কলিগ কিন্তু খুব বিখ্যাত..জীবনে কোনো কেসে ব্যর্থ হন। নি…”।
“আর আপনি? আপনি কি কখনও ব্যর্থ হয়েছেন?”
মাথা দোলালো ছফা। “এখন পর্যন্ত হই নি। মনে হচ্ছে না খুব শীঘ্রই হবো।”
মুচকি হাসলো মিসেস জুবেরি। “মনে হচ্ছে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আপনাকে উন্নাসিক বানিয়ে ফেলেছে। কিংবা ব্যর্থ হবার ভয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছেন!”
কথাটা আমলে না নিয়ে বললো নুরে ছফা, “অবশ্য আমার কলিগ আমার চেয়ে এককাঠি উপরে, আপনি হয়তো উনার নাম পত্রিকায়। দেখেছেন…ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খান।”
মূর্তির মতো স্থির হয়ে রইলো মুশকান। নির্বিকার মুখেই বললো, “আমি পত্রিকা পড়ি না। ওগুলো পড়ার জিনিস বলে মনে করি না। অরুচিকর আর মুল জিনিস আমার ধাতে সয় না।” বাঁকাহাসি হেসে প্রসঙ্গে ফিরে এলো ছফা, “আমি নিশ্চিত, ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ যতো শক্তিশালী নার্ভের অধিকারীই হয়ে থাকুন না কেন, মি. খানের সামনে টিকতে পারবেন না।”
মাথার চুলে হাত বুলিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালো মুশকান। “আমি ঐসব লোকজনকে নিয়ে কি করেছি বলে মনে করেন? মানে, আপনি বলছেন, পাঁচজন লোককে এখানে এনে উধাও করে দিয়েছি..তাদেরকে আমি কেন উধাও করবো? আপনার কি ধারণা, আমি তাদেরকে জবাই করে রবীন্দ্রনাথের রেসিপি বানিয়ে ভোজনরসিকদের প্লেটে তুলে দিয়েছি?” বাঁকাহাসি দিলো সাবেক ডাক্তার।
“না,” ছফাও পাল্টা হাসি দিয়ে বললো, “আমি অতোটা ফ্যান্টাসি করি নি এখনও।”
“ও,” কৃত্রিম অবাক হবার ভান করলে ডাক্তার মুশকান। “তাহলে কি ধারণা করেছেন, শুনি?”
“আপনি অনেক কথা বললেও একটা কথা এড়িয়ে গেছেন…” মুশকান জুবেরি অপেক্ষা করলো কথাটা শোনার জন্য।
“…অরিয়েন্ট হাসপাতালের ভালো চাকরিটা কেন ছেড়েছেন?”
“আপনার কি মনে হয়?”
“আমি জানতে পেরেছি, আপনি যখন চাকরিটা ছাড়েন তার আগে অরিয়েন্ট হাসপাতালে একটা কেলেংকারি ঘটে গেছিলো। পত্রপত্রিকায়ও সেটা এসেছিলো। খুবই বাজে ঘটনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনেক চেষ্টা করেও ধামাচাপা দিতে পারে নি।”
নীচের ঠোঁট দুটো কামড়ে চেয়ে রইলো মুশকান।
“গরীব মানুষকে অল্প টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে লিভার-কিডনি বিক্রি করাতেন আপনারা…মানে অরিয়েন্ট হাসপাতালের কিছু ডাক্তার আর কর্মচারি। সেইসব লিভার-কিডনি ধনী ক্লায়েন্টদের বাঁচাতে ট্রান্সপ্রান্ট করতে আপনার হাসপাতাল। এক সাংবাদিক এটার পেছনে লাগলে সবটা ফাঁস হয়ে যায়। কর্তৃপক্ষ দারুণ বিপাকে পড়ে।”
“তদন্ত করে এটাই পেলেন?” আবারো বাঁকাহাসি দেখা গেলো মুশকানের ঠোঁটে। “এটা পত্রপত্রিকায় তো ডিটেইল এসেছিলো।”
“কিন্তু যেটা ডিটেইল আসে নি সেটা হলো কে কে এর সাথে জড়িত ছিলো।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো সাবেক ডাক্তার। “আজ এতোদিন পর আপনি কি সেটা উদঘাটন করতে পেরেছেন?”
“ঘুম,” মাথা নেড়ে জোর দিয়ে বললো ছফা।
“আমি কিন্তু খুব আগ্রহ বোধ করছি এটা শোনার জন্য
“অরিয়েন্ট হাসপাতালের চার-পাঁচজন সার্জনকে সন্দেহ করা। হচ্ছিলো।”
“এটাও পত্রিকার খবর। ওরা আমাদের প্রায় সব সার্জনকেই সন্দেহ করে খবর ছাপিয়েছিলো। আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতো ব্যাপার আর কি।”
“ওখানে কিন্তু আপনার নামও ছিলো?”
“অবশ্যই ছিলো। সেইসাথে আরো চারজনের নাম। কিনতু কেউ প্রমাণ করতে পারে নি আমরা এ-কাজে জড়িত ছিলাম। এ দেশের প্রায় সব প্রাইভেট হাসপাতাল এভাবেই অর্গ্যান কালেক্ট করে দালালদের মাধ্যমে। এর সঙ্গে ডাক্তাররা জড়িত থাকে না। একটু থেমে আবার বললো, “মনে রাখবেন, একটা অভিযোগ উঠেছিলো, আর সেটা কেউ প্রমাণ করতে পারে নি।”
“করার চেষ্টাই করে নি,” চট করে বলে উঠলো ছফা, “ঘটনাটা ওখানেই ধামাচাপা দেয়া হয়।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুশকান জুবেরি। “এটা আপনার নিজস্ব মতামত…এ ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই।”
কথাটা গায়ে না মেখেই বললো ছফা, “ওই ঘটনার পরই আপনি হ্রট করে একদিন চাকরি ছেড়ে দেন। সম্ভবত, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনাকে সেফ-এক্সিট করে দেবার জন্য চাকরি ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলো, কারণ ওখানকার সবচাইতে প্রভাবশালী ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের সাথে আপনার বেশ ভালো সম্পর্ক।”
“এটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। আমরা অসম্ভব ভালো বন্ধু।”
ছফা গালে হাত বুলাতে লাগলো।
“তবে আমার চাকরি ছাড়ার সাথে উনার কিংবা ঐ ঘটনার কোনো সম্পর্কই নেই। ওটা ছিলো একেবারেই আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। তাছাড়া আপনি হয়তো জানেন না, অর্গ্যান ডোনেটের কেলেঙ্কারির কয়েক মাস পর আমি চাকরি ছাড়ি। ততোদিনে ঐ ঘটনার কথা সবাই ভুলে গেছিলো।”
“আচ্ছা, তাহলে আমি কি জানতে পারি, চাকরিটা কেন ছেড়েছিলেন?”
“আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তারি করতে আর ভালো লাগছিলো না। নিত্য-নতুন রান্না করা, রেসিপি বানানো, ভিন্ন ভিন্ন কুইজিন নিয়ে এক্সপেরিয়েমেন্ট করা…এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। অবশ্য এরজন্য রাশেদ অনেকাংশে দায়ি। তাকে প্রতিদিন মজার মজার সব রেসিপি খাইয়ে মুগ্ধ করে দিতাম। আমার হাতের রান্না খেয়ে একজন মানুষ এমনভাবে তৃপ্ত হচ্ছে দেখে খুব ভালো লাগতো। প্রচণ্ড উৎসাহি হয়ে পড়েছিলাম। টাকা পয়সার তেমন অভাব ছিলো না, সুতরাং চাকরিটা বোঝা মনে হতে লাগলো, তাই ছেড়ে দিলাম।”
ছফা নির্বাক হয়ে চেয়ে রইলো মুশকানের দিকে।
“আপনি আমাকে ঠিক কি নিয়ে সন্দেহ করছেন, স্পষ্ট করে বলবেন। কি?”
মিসেস জুবেরির প্রশ্নে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো সে।
“কিছু মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া..হাসপাতালের অর্গান কেলেংকারি…আমার চাকরি ছেড়ে দেয়া…এসব একসূত্রে গেঁথে আপনি আসলে কি প্রমাণ করতে চাইছেন?”
ছফা গভীর করে দম নিয়ে নিলো। “আমি নিশ্চিত, আপনি ঐ নিখোঁজ মানুষগুলোর মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের সাথে জড়িত
মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগলো মুশকান, যেনো হাস্যকর কোনো জোক শুনেছে সে। “আমি অর্গ্যান পাচার করি?”
“হ্যাঁ,” বেশ জোর দিয়ে বললো ছফা।
“তারপর ওই মানুষগুলোকে মেরে গুম করে ফেলি, তাই না?”
ছফা কোনো জবাব দিলো না।
“এ কাজে নিশ্চয় ঐ কবর খোরার ছেলেটা..ফালুও জড়িত…কী বলেন?”
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো নুরে ছফা। তার সামনে যে মহিলা বসে আছে। তার কথা আর ভাবভঙ্গি দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সবটা কেমনজনি প্রহেলিকাময় বলে মনে হচ্ছে।
“আমার চাকরি ছাড়ার সত্যি কারণটা জানতে চান?”
ছফা নিশচুপ রইলো।
“লিভার-কিডনির কেলেংকারির আগেই ডাক্তারি পেশার প্রতি মন উঠে গেছিলো। একটা কারণ তো আগেই বলেছি, আরেকটা কারণ হলো, এদেশের মানুষ ডাক্তারদের সম্মান করে না। কোনো রোগি মারা গেলেই তারা ডাক্তারকে দোষি মনে করে। তাদের ধারণা ডাক্তারের অবহেলাই রোগির মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ডাক্তার যেনো মর্তের ঈশ্বর…সে চাইলেই যেকোনো রোগিকে বাঁচাতে পারে।” একটু থামলো মুশকান। “শুধু অভিযোগ, গালাগালি আর অসম্মান করলেও হয়তো সহ্য করে এই পেশায় থাকতাম কিন্তু তা তো হয় না। ডাক্তারকে রীতিমতো মারতে আসে। চোখের সামনে অনেক ডাক্তারকে মৃতরোগির বিক্ষুব্ধ আত্মীয়দের হাতে লাঞ্ছিত হতে দেখেছি। এই ভয়ে সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকতাম। বিশেষ করে আমি সার্জন হওয়ায় প্রচুর। অপারেশন করতে হতো…রোগির মৃত্যু হতো অনেক ক্ষেত্রে…প্রতিটি অপারেশনের সময় তাই নার্ভাস হয়ে পড়তাম। অবশেষে এই নরকযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই চাকরিটা ছেড়ে দেই
সব শুনে ছফা মুচকি হাসলো। মুশকানের এই ব্যাখ্যাটা আমলে না। নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলো সে। “আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছিলাম… যে পাঁচজন ভিক্টিম, আই মিন মিসিং-পারসনের কথা বলছি তারা সবাই অন্য অনেকের মতো ফেসবুক ব্যবহার করতো। মজার ব্যাপার কি জানেন? তারা নিখোঁজ হবার পর পরই অ্যাকাউন্টগুলো ডি-অ্যাক্টিভ হয়ে। গেছে সবার!”
মুশকান জুবেরি চেষ্টা করলো নির্বিকার থাকার কিন্তু ছফার দৃষ্টিতে সেটা এড়ালো না।
“এটা অবশ্যই খুনির কাজ। সে খুব সতর্ক। শিকারকে বাগে পেয়ে তাকে হত্যা করার আগেই যেভাবে হোক তার কাছ থেকে পাসওয়ার্ডটা নিয়ে নিয়েছে, কিন্তু একজনের বেলায় সে এটা করতে পারে নি।”
মুশকান তারপরও চুপ রইলো।
“ঐ একজন হলো শেষেরজন। যার কেসটা আমি তদন্ত করছি। এরইমধ্যে পুলিশের একটা নতুন ডিপার্টমেন্ট হয়েছে…টেলিকমিউনিকেশন্স মনিটরিং সেল…ওরা খুবই আধুনিক টেকনোলজি ব্যবহার করে। আমি ওদের সাহায্য নিয়েছিলাম…অবশেষে ওরা হাসিবের অ্যাকাউন্টটার পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করতে পেরেছে। অ্যাকাউন্টটা চেক করে দেখা গেছে ওখানে চারুলতা নামের একটি আইডির সাথে হাসিবের নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো।”
মুশকান বাঁকাহাসি দেবার চেষ্টা করলেও সেটা কেমন মলিন দেখালো।
“চারুলতা আইডিটির লোকেশন ট্র্যাকডাউন করা হয়েছে..ওটা এখানকার…এই সুন্দরপুরের।”
“সুন্দরপুর হয়তো একটি মফশ্বল শহর কিন্তু বর্তমানে এখানে অনেকেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে।”
“তা করে। তবে তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত ক-জন আছে যে তার রেসটুরেন্ট নাম রাখবে উনার নামে? ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম দেবে উনার সষ্ট চরিত্রের নামে?” মাথা দুলিয়ে আরার বললো সে, “সম্ভবত খুব কম। আরতাদের মধ্যে নারী আছে ক-জন?”
ছফার দিকে তাকিয়ে হাসলো মিসেস জুবেরি। “তাহলে এখন আমাকে গ্রেফতার করছেন না কেন? আপনি খুবই নিশ্চিত। শক্ত প্রমাণও আছে আপনার কাছে।”
“হুম। তবে একটু অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই আমার সিনিয়র কলিগ মি, খান আপনার ঐ বন্ধু ডাক্তার আসকারের কাছ থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের করে আনতে পারবে।”
মুশকান চুপ থেকে নিজের ঘরের চারপাশটা দেখে নিলো একবার। “আপনি কি আমার সম্পর্কে সত্যিটা জানতে চান?”
ছফা বাঁকাহাসি দিলো। “আমি তো জানতাম সেটা জানার জন্যই এখানে এসেছি।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মুশকান। “আপনি যখন আমার সব সত্যি জানতে পারবেন তখন বুঝতে পারবেন কতোটা ভুল ধারণা করেছিলেন আমার সম্পর্কে। আপনার সবগুলো অনুমানই মিথ্যে প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনার তখন মনে হবে আমার পেছনে লেগে খামোখাই সময় নষ্ট করেছেন। তদন্তকারী হিসেবে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটি করে ফেলেছেন?”
ভুরু তুললো ছফা। “বেশ। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সবটা শোনার জন্য।”
“আপনি অনেক কিছু জানলেও আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটার কথা জানেন না। ওরকম কঠিন পরিস্থিতিতে খুব কম মানুষই পড়েছে। আর তারচেয়েও অনেক কম মানুষ টিকে থেকে বেঁচে আসতে পেরেছে সভ্য দুনিয়ায়। আমিও অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছিলাম কিন্তু ঘটনাটি আমাকে সারাজীবনের জন্য বদলে দিয়েছে।”
. “ঘটনাটা কি?” কৌতূহলী হয়ে উঠলো ছফা। সে এসব কথার মাথামুণডু কিছুই বুঝতে পারছে না।
উঠে দাঁড়ালো মিসেস জুবেরি। “আমি দশ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে যাই বাবা-মায়ের সাথে…” সারি সারি বইয়ের শেলফের কাছে গিয়ে থামলো সে। “হাইস্কুল শেষে ওখানকার এক মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই…” একটা বড় আকৃতির চারকোণা অ্যালবাম বের করে আনলো বুকশেলফ থেকে। “…ফাইনাল ইয়ারের সামার ভ্যাকেশনে আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে যাবার প্ল্যান করি।” অ্যালবামটা নিয়ে এসে আগের জায়গায়। বসলো। “আমাদের গন্তব্য ছিলো লাতিন-আমেরিকা। মাচুপিচু..ইনকা সভ্যতা…মেক্সিকান পিরামিড…এসব দেখবো…” অ্যালবামটা ছফার দিকে বাড়িয়ে দিলো এবার। “..এটা দেখুন। ওই ভয়ঙ্কর কাহিনীটা বলতে ভালো লাগে না। দুঃসহস্মৃতি রোমন্থন করা আনন্দের কোনো বিষয় নয়।”
ছফা অ্যালবামটা হাতে নিয়ে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো মুশকান জুবেরির দিকে।
“আপনি এটা দেখলেই সব বুঝতে পারবেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে অ্যালবামটা খুললো সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো। প্রথম পৃষ্ঠায় ইংরেজিতে বোল্ড ফন্টে লেখা : অ্যালাইভ।
দ্বিতীয় পৃষ্ঠা ফাঁকা, তৃতীয় পৃষ্ঠায় চার-পাঁচটা পারিবারিক ছবি। একটি সুখি পরিবার। মা-বাবা, ভাই-বোন।
“আমার ফ্যামিলির ছবি…” আস্তে করে বললো মুশকান।
ছফা লক্ষ্য করলো ছবিতে কোনো সন-তারিখ দেয়া নেই। পোশাক আশাক দেখেও নিশ্চিত হতে পারলো না ছবিগুলো কোন দশকের। চতুর্থ পৃষ্ঠা ওল্টাতে গিয়ে দেখলো পৃষ্ঠাগুলো একটার সাথে আরেকটা লেগে আছে। বোঝা যাচ্ছে খুব একটা খুলে দেখা হয় না, একান্তই ব্যক্তিগত একটি অ্যালবাম। নিশ্চয় বাইরের খুব কম মানুষই এটা দেখেছে। হয়তো অনেকদিন কেউ ধরেও দেখে নি। চতুর্থ পৃষ্ঠায় যেতে ছফাকে রীতিমতো আঙুলে থুতু মেখে ওল্টাতে হলো। এই পৃষ্ঠায় আছে আরো ছয়-সাতটি ছবি। সবগুলোই স্কুলের। কিশোরি মুশকান আর তার সাদা-কালো-বাদামি বন্ধুরা। তাদের অঙ্গভঙ্গি খুব মজার। কেউ ভেংচি কাটছে তো কেউ চোখ ট্যারা করে আছে। কেউ বা মুখ ঢেকে রেখেছে।
“আমি স্কুল ভীষণ পছন্দ করতাম…বলতে গেলে স্কুলে যাবার জন্য মুখিয়ে থাকতাম প্রতিদিন।”
চকিতে মুশকান জুবেরির দিকে তাকালো ছফা। পঞ্চম পৃষ্ঠায় চোখ বুলালো সে। সম্ভবত কলেজের ছবি।
“স্কুলের মতোই কলেজও খুব ভালোবাসতাম। কলেজেই আমার সব বেস্ট ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় হয়।”
ছষ্ঠ পৃষ্ঠায় যেতে আবরো বেগ পেলো, পরের পাতার সাথে লেগে আছে। ষষ্ঠ আর সপ্তম পৃষ্ঠায় মেডিকেল কলেজের প্রচুর ছবিতে ভরতি। কোনোটাতে মুশকানের গায়ে অ্যাপ্রোন, কোনোটাতে সাধারণ টি-শার্ট আর জিন্স প্যান্ট। ছফা মনে মনে মুশকান জুবেরির সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে পারলো না।
যৌবনে এই মহিলা চোখ ধাঁধানো সুন্দরি ছিলো।
না, এখনও আছে।
নিজেকে শুধরে দিলো সে। চোখ তুলে তাকালো মহিলার দিকে। বয়স বাড়লেও খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। শরীরের গড়ন প্রায় আগের মতোই আছে।
“মেডিকেল কলেজের মতো ভালো সময় আমার জীবনে খুব কমই এসেছে। পড়াশোনার চাপ থাকলেও আমি খুব এনজয় করেছি সময়টা।”
অষ্টম পৃষ্ঠাটিও পরের পৃষ্ঠার সাথে লেগে আছে। ছফা বিরক্ত হয়ে পাতাটি ওল্টালো। পাতাগুলো একটার সাথে একটা শুধু লেগেই নেই, কেমন। পুরনো গন্ধ আর চটচটে হয়ে আছে। ছফা দেখতে পেলো কতোগুলো ছবি। প্রায় সবগুলোতেই একদল তরুণ-তরুণী এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পেছনে সারি সারি দাঁড় করানো প্লেন। ক্যামেরার দিকে থাম্ব-আপ দেখাচ্ছে। সবাই। একজন ছেলের হাতে প্ল্যাকার্ড বন ভয়েজ! একটা ছবিতে তরুণী মুশকান ভেংচি কাটছে ক্যামেরাম্যানকে। তার পেছনে বন্ধুবান্ধবের দল। সেখানে চিনা-জাপানি, লাতিন-কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের সন্নিবেশ। মুচকি হাসলো সে। তারুণ্য এমনই। সব কিছুতে ফুর্তি। মজা।
“টুরে যাবার আগের ছবি…” আস্তে করে বললো মুশকান।
পরের পাতা উল্টিয়ে ছফা স্থিরচোখে চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। এখানে কোনো ছবি নেই। আস্ত একটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রায় অর্ধেকটা পেপারক্লিপিংস রাখা হয়েছে। ডানদিকের পৃষ্ঠায় আরেকটি পত্রিকা আরেকটি পেপার-ক্লিপিংস। আমেরিকার বিখ্যাত দুটো পত্রিকা-ওয়াশিংটন পোস্ট আর বাল্টিমোর ট্রিবিউন। দুটো পত্রিকাই একটি নিউজ ব্যানার হেডলাইন করেছে: মর্মান্তিক এক প্লেন ক্র্যাশ।
ছফা মুখ তুলে তাকালো মুশকানের দিকে।
“মাচুপিচু দেখে ফেরার পথে আমাদের প্লেনটা খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে ক্র্যাশ করে…” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “…আন্দিজের অনেক উপরে…বরফে ঢাকা একটি উপত্যকায়…”।
পত্রিকার রিপোর্টের দিকে নজর দিলো ছফা। ওখানে বিস্তারিত বলা আছে। প্লেনটা আন্দিজ পর্বতমালার উপর দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করে হারিয়ে গেছে। সবাই ধারণা করছে প্লেনটা বরফে ঢাকা পার্বত্য-অঞ্চলের কোথাও বিধ্বস্ত হয়েছে। যাত্রিদের কারোর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। অন্য একটি ছোট্ট পেপার-ক্লিপিংসে আছে, তিনদিন ধরে রেসকিউ টিম চেষ্টা করেও প্লেনের কোনো ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায় নি। কর্তৃপক্ষ আশংকা করছে। প্লেনের কোনো যাত্রি বেঁচে নেই!
ছফা আবারো মুখ তুলে তাকালো মুশকানের দিকে। মহিলাকে কেমনজানি অশরীরি বলে মনে হচ্ছে এখন। তারপর একটা ভাবনা মাথায় আসতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো। সবাই যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে সামনে যে বসে আছে সে কে?!
.
অধ্যায় ৩৫
কেএস খান বুঝতে পারছে তাকে কেন এই কাজটা করতে বলেছে নুরে ছফা। যদিও এটা ডিবির লোকজনের করার কথা কিন্তু ও চাইছে দ্রুত ফলাফল বের করে আনতে। আর যে লোককে ইন্টেরোগেট করা হবে তিনি অনেক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি-দেশের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক। বয়সে প্রবীণ এই ভদ্রলোকের সাথে ক্ষমতার উচ্চপর্যায়ের অনেকেরই সু-সম্পর্ক রয়েছে। তাকে সাধারণ লোকজনের মতো হূমকি-ধামকি দিয়ে জেরা করা যাবে না, ভদ্রভাবে কথা আদায় করতে হবে। এদিকে ডিবিতে এমন কেউ নেই যে এ কাজটা ঠিকঠাকমতো করতে পারবে। তবে এক সময় ডিপার্টমেন্টে কর্মরত অবস্থায় কেএস খান কারোর পেট থেকে কথা আদায় করার বেলায় বেশ দক্ষ হিসেবেই পরিচিত ছিলো। সুতরাং ছফার এই চাওয়াটা একদিক থেকে ঠিকই আছে।
ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ নিজের ফ্ল্যাটের স্টাডিরুমে বসে থাকলেও একটু অস্বস্তিতে আছেন বলে মনে হলো। তার অভিজাত ভঙ্গিটি বেশ ভালোভাবেই ধাক্কা খেয়েছে। এক ধরণের উদ্বেগও দেখা যাচ্ছে ভদ্রলোকের মধ্যে। কেএসকের কাছে এটা খটকা বলেই মনে হলো। একজন অভিজ্ঞ সার্জন কেন এতো সহজে ঘাবড়ে যাবে? তার নার্ভ তো বেশ শক্ত হবার কথা।
জাওয়াদ নামের ছফার সহকারী ছেলেটা ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে আছে। সে অপেক্ষা করছে কেএস খানের পদ্ধতি দেখার জন্য। এই লোকের এতো সুনাম শুনেছে যে, রীতিমতো কিংবদন্তী চরিত্র বলে মনে করে তাকে। এখন কিংবদন্তীর কীর্তি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
আজ সকাল থেকে কেএস খানের শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছিলো। বিকেলের দিকে আবার বাজে সর্দির আগমন ঘটেছে। রুমালটা দিয়ে নাক মুছে নিলো সে। “সরি,” বিব্রত হয়ে বললো এক সময়কার ডিবির তুখোড় ইভেস্টিগেটর।
“ইটস ওকে,” ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ বললেন। “আপনার উচিত অ্যালার্জির ওষুধ খাওয়া, নইলে সর্দিটা বেশ ভোগাবে।”
রুমালটা পকেটে রেখে মুচকি হাসলো কেএস খান। “ওষুধ আমি সবই…কোনোটাই বাদ দেই না কিন্তু কম হয় না। আমি হইলাম ওষুধের ব্ল্যাকহোল…যেটাই খাই সব ভ্যানিশ হইয়া যায়।” তারপর হেহে করে হেসে ফেললো।
ডাক্তারের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আর সবার মতো তিনিও মি. খানকে চলভাষায় কথা বলতে দেখে অবাক হয়েছেন। “আপনার কি ক্রনিকল ডিজিজ রয়েছে?” ডাক্তারের মতো আচরণ করার চেষ্টা করলেন। মি. সায়িদ।
“আমারটা একটু ক্রিটিক্যাল,” তীর্যক হাসি দিলো কেএস খান। “কোনো পার্টিকুলার রোগ আমারে ভোগায় না…বলতে পারেন, সব রোগই পালা কইরা আমারে ভোগায়। একটা যায় তো আরেকটা আইসা হাজির।” আবারো হাসলো সে তবে নিঃশব্দে।
ভুরু তুললেন ডাক্তার। “মানে?”
“মানে খুব সোজা,” গাল চুলকালো সাবেক ডিবি অফিসার, “আমি প্রতিদিনই কোন না কোনো রোগে ভুগি…তয় কোনোটাই বড় কিছু না…সবই। সামান্য…এই ধরেন সর্দি, জ্বর, মাথাব্যথা, ঘাড় ব্যথা…”
“আপনার উচিত থরো চেকআপ করা।”
“আমার পারসোনাল ডাক্তার আছে…রেগুলার চেক-আপ করি।”
“উনি আপনার সমস্যাটা ধরতে পারছেন না?”
“উনি কেন…কেউই আমার সমস্যা ধরতে পারে না। সবাই কয়, আমার নাকি সব ঠিকঠাকই চলে…কিন্তু…”
“কি কি?”
“বাদ দেন আমার কথা, আপনের কথা বলেন।”
“আমি কি বলবো? আপনারা আমার কাছে কি চান তা-ই তো বুঝতে পারছি না।”
খোদাদাদ শাহবাজ খান কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে কথাগুলো গুছিয়ে নিলো। “আসল কথায় যাওনের আগে আপনেরে একটু ক্লিয়ার কইরা নেই, নাকটা এবার হাত দিয়ে চুলকে নিলো সে, “আমি কইলাম মিসেস জুবেরির কেসটা নিয়া তদন্ত করতাছি না। ঐটা করতাছে ডিবির সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর নুরে ছফা।”
ডাক্তার একটু অবাকই হলেন কথাটা শুনে কিনতু নিজেকে সংযত রাখলেন বাড়তি আগ্রহ দেখানো থেকে।
“আমি রিটায়ার্ড মানুষ নতুন ইনভেস্টিগেটরগো ক্রিমিনোলজি পড়াই” একটু থেমে আবার বললো সাবেক ডিবি কর্মকর্তা, “নুরে ছফা আমারে বললো, আপনের ইন্টারভিউটা যে আমি নেই। বিষয়টা একটু ক্রিটিক্যাল তো, তাই।”
“ক্রিটিক্যাল কেন?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলেন ডাক্তার।
“ছফা একটা কেস নিয়া তদন্ত করতাছে, তদন্ত করতে গিয়া মুশকান। জুবেরিরে প্রাইম সাসপেক্ট হিসাবে পাইছে সে। মহিলারে অলরেডি ইন্টেরোগেট করছে..উনার কাছ থেইকা অনেক কিছুই জানবার পারছে, মহিলা কিছু কথা স্বীকারও করছে…” একটু থেমে সামনে বসা ডাক্তারের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করলো। “এখনও তার ইন্টেরোগেশন চলতাছে…কিছু ইনফর্মেশন ডাবল চেক করবার চাইতাছে ছফা। এই কাজটা ইনভেস্টিগেশনে খুবই ইম্পোটেন্ট। এইজন্য আপনের কাছে আসছি আমরা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাক্তার আসকার। “মুশকানকে কি কেসে সন্দেহ করা হচ্ছে?”
কপাল চুলকালো কেএসকে। “এইটা তো এখন ডিটেইল বলা যাইবো না। …সংক্ষেপে মুশকানের বিরুদ্ধে অভিযোগটা বলি আপনেরে…তাইলে হয়তো সিচুয়েশনের গ্র্যাভিটিটা ধরবার পারবেন।” ডাক্তারকে দৃষ্টির তীরে বিদ্ধ করে রেখেছে সে। “পাঁচজন মানুষ হত্যার অভিযোগ আছে ওই ভদ্রমহিলার বিরুদ্ধে। লোকগুলারে নিয়া সে কি করছে সেইটা শুনলে আপনের পিলা চমকাইয়া যাইবো।”
ডাক্তার আসকার একটু চমকে উঠলেন। “মানে?”
“সেইটা আপনেরে পরে বলবো। তার আগে আপনের বোঝা উচিত আমাদের কাছে মিথ্যা বললে কি হইতে পারে। নুরে ছফা একটু ঘাড়ত্যাড়া মানুষ…এই পাঁচজন মানুষের হত্যা মামলায় আপনেরেও জড়াইয়া ফেলবো। সে, অভিযোগ আনবো আপনে ইচ্ছা কইরা সত্য লুকাইছেন। এমনও হইতে পারে, সে দাবি কইরা বসলো, আপনেও ঐ মুশকানের সাথে জড়িত
ডাক্তার ভয় না পাবার চেষ্টা করলেন।
“মুশকানের শেষ ভিক্টিমটা আবার প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক ক্ষমতাবান লোকের আপন ভাগিনা। মনে হইতাছে সে তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা অ্যাপ্লাই করবো।”
এবার ঢোক গিললেন ডাক্তার। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভড়কে গেছেন কথাটা শুনে।
“আদালতে আপনের অ্যাগেইনস্টে অভিযোগ প্রমাণ হইবো কি হইবো না তা তো জানি না…তয় আপনার রেপুটেশন যে নষ্ট হইবো তা বুঝবার পারছি।”
মাথা দোলালেন আসকার ইবনে সায়িদ। কথাটার সাথে দ্বিমত পোষন করে নাকি আক্ষেপে বোঝা গেলো না। আস্তে করে মাথা নীচু করে রাখলেন তিনি।
“তাছাড়া আপনের হাসপাতালের অনেকরে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অনেক কিছু জানা যাইবো কিন্তু এইটা আমি চাই না। এইটা করলে ব্যাপারটা সবাই জাইনা যাইবো। আমি জানি আপনে সবই জানেন। তাই ভাবলাম, আপনেরে একটা চান্স দেয়া দরকার। কী বলেন?”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলেন ডাক্তার আসকার, যেনো কী বলবেন সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
“এইসব ব্যাপারে যারে-তারে জিজ্ঞাসাবাদ করলে খালি আপনেই না, আপনের ঐ হাসপাতালেরও রেপুটেশন নষ্ট হইবো। যতোদূর জানি, আপনে আবার হাসপাতালের একজন পার্টনারও।” একটু থেমে ভদ্রলোককে আবারো দেখে নিলো সে। “কিন্তু আমি চাই আপনে এই জঘন্য কেসটা থেইকা নিজেরে দূরে রাখেন।”
গভীর করে নিঃশ্বাস নিলেন ডাক্তার। “মুশকান কি বলেছে?” অনেকটা অসহায়ের মতো জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো কেএস খান। “সরি। এইটা বলা যাইবো না, টেকনিক্যাল সমস্যা আছে।”
কপালের বামপাশটা হাত দিয়ে ঘষতে লাগলেন ভদ্রলোক। কেএস খান বুঝতে পারলো ডাক্তার এখন চৌরঙ্গির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে একটা পথ বেছে নিতে সাহায্য করা দরকার। আর সেই পথটা অবশ্যই সঠিক পথ।
“সহমরণে যায়েন না, ডাক্তার…” আস্তে করে বললো কেএসকে। “যে মারা যায় তার লগে কেউ সহমরণে গেলেও মৃতব্যক্তির কইলাম কোনো লাভ হয় না। সহমরণে যে যায় তারই ক্ষতি হয়।”
ডাক্তার আসকার ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলেন। “আপনের জন্য কাজটা কিন্তু খুব সহজ…”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন ভদ্রলোক।
“এই বিরাট ঝামেলা থেইকা নিজেরে পুরাপুরি দূরে রাখতে চাইলে খুব সহজেই সেইটা আপনে করতে পারেন। সত্যিটা বইলা দেন। আলটিমেটলি এইটা আপনে লুকায়া রাখতে পারবেন না…ঘটনাটা অনেকেই জানে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডাক্তার। জাওয়াদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সেও বুঝতে পারছে ডাক্তার পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। মনে মনে কেএস খানের প্রশংসা না করে পারলো না।
“কোন সত্যটা জানতে চান?”
“মুশকান জুবেরি চাকরিটা ছাড়লো কেন?”
একটু চুপ থেকে বললেন ডাক্তার, “ও কেন চাকরিটা ছেড়েছে সেটা এক কথায় বলা যাবে না। একটু ব্যাখ্যা করতে হবে ব্যাপারটা।”
“করেন…কোনো সমস্যা নাই,” অভয় দিলো মি. খান।
“আপনারা হয়তো জানেন না মুশকান সপরিবারে আমেরিকায় থাকতো…ওখান থেকেই পড়াশোনা কমপ্লিট করেছে।”
আগ্রহভরে চেয়ে রইলো কেএস খান।
“পাঁচ-ছয় বছর আগে আমেরিকা থেকে আমাদের হাসপাতালে এক ডাক্তার এসে জয়েন করে। ঐ ডাক্তার মুশকানকে চিনতো। ওরা পড়াশোনা করেছে একই মেডিকেল কলেজে…মুশকানের কয়েক বছরের জুনিয়র সে…” ডাক্তার একটু থেমে কথা গুছিয়ে নিলেন। “ও জয়েন করার পর মুশকানের ব্যাপারে খুবই অদ্ভুত আর গা শিউরে ওঠার মতো একটি কথা ভেসে বেড়াতে লাগলো। হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট অবশেষে এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললো। আমি মুশকানকে আমেরিকায় থাকতেই চিনি। ওর সব কিছু জানি।”
অবাক হলো কেএস খান। “বলেন কি?”
ডাক্তার চুপ মেরে রইলেন।
“কিন্তু কথাটা কি ছিলো?” মি. খান উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
“ফাইনাল ইয়ারে মুশকান তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সাউথ আমেরিকা টুরে গিয়ে মারাত্মক এক প্লেন ক্রাশের শিকার হয়েছিলো। ওদের প্লেনটা ক্র্যাশ করে আন্দিজের দূর্গম এক পাহাড়ি অঞ্চলে।”
“আন্দিজে?”
“হুম। ঘটনাটা পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হয়েছে, ইনফ্যাক্ট ঘটনাটা নিয়ে অনেক প্রবন্ধ, বই, এমনকি সিনেমাও তৈরি হয়েছে।” একটু থেমে আবার বললেন ভদ্রলোক, “কিন্তু ও যেভাবে বেঁচেছে সেটা শুনলে যে কারোর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে।”
“কি সেইটা?”
একটু থেমে গুছিয়ে নিলেন ডাক্তার। “শুধু ও নয়…ওই প্লেনের একশ’রও বেশি যাত্রির মধ্যে মাত্র আঠারোজন বেঁচে গিয়েছিলো। অবশেষে কয়েক মাস পর তাদেরকে উদ্ধার করা হয়। পুরো ব্যাপারটাকে আন্দিজের মিরাকল বলেই জানে সবাই। বিস্ময়কর একটি ঘটনা। ওরকম জায়গায় ওদের বেঁচে থাকার কথা নয়।”
“তাইলে ওরা অ্যাতোদিন বাঁচলো কেমনে?”
কেএস খানের প্রশ্নে গম্ভীর হয়ে গেলেন ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদ। “মানুষ খেয়ে!”