৭. ধ্রুবকুমারকে কোলে তুলে

সুরপতি তক্ষুনি সব কিছু ভুলে ধ্রুবকুমারকে কোলে তুলে যাচ্ছিল, কিন্তু তা আর হল না।

বালকটি নিজেই দৌড়ে এল এ-দিকে। সুরপতির দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। ক্ষৌরকারের সামনে এসে দাঁড়াল।

সুরপতির নিজেকে সংযত করে রাখল কোনওক্রমে। তার এই বিশাল দাড়িগোঁফ সমন্বিত চেহারা দেখে চিনতে পারবে না ধ্রুবকুমার। হঠাৎ ভয় পেয়ে যাবে।

ধ্রুবকুমার ক্ষৌরকারকে সম্বোধন করে বলল, আপনাকে একবার বাবা ডেকেছেন।

সুরপতির মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল। বাবা? ধ্রুবকুমারের আবার বাবা কে?

ক্ষৌরকার বলল, ডেকেছেন? কেন, সকালেই যে তোমার বাবার ক্ষৌরি করে দিয়ে এলাম?

ধ্রুবকুমার বলল, আমার ভাইয়ের হাতে বড় বড় নখ হয়েছে। সে নিজেই নিজের গাল আঁচড়ে ফেলেছে। তাই বাবা বললেন, আপনাকে ডেকে ওর নখ কেটে দিতে।

সুরপতি আবার আঘাত পেল। ভাই? ধ্রুবকুমারের আবার ভাই কোথা থেকে এল? তবে কি এই বালকটি ধ্রুবকুমার নয়? কিন্তু সেইমুখ, সেই চোখ! এ কখনও ভুল করা যায়?

ক্ষৌরকার একটু পরে যাবে শুনে বালকটি আবার দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে সরাইখানায় ঢুকে গেল। সুরপতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

তারপর মুখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ভাই ক্ষৌরকার, এই বালকটির নাম কী?

ক্ষৌরকার বলল, সকলে তো ওকে ধ্রুব বলেই ডাকে।

সুরপতি আবার জিজ্ঞেস করল, এই সরাইখানার মালিক কে?

ক্ষৌরকার বলল, তুমি নতুন লোক বুঝি? এইসরাইখানার মালিক বলভদ্রকে কে না চেনে?

সুরপতি আর কোনও বাক্য উচ্চারণ করতে পারল না। সেখানেই মূৰ্জিত হয়ে পড়ে গেল। একটা পাথরে মাথা ঠুকে রক্ত বেরুতে লাগল তার কপাল থেকে।

ক্ষৌরকার লোকটি বৃদ্ধ। সামান্য একটা চালাঘরে সে বহুকাল ধরে এখানে বাস করে আসছে। ত্রি-সংসারে তার কেউ নেই। এই নগরীর খানিকটা অংশ ব্যতীত বাইরের পৃথিবীর কোনও সংবাদই সে রাখে না। এবং তারই চালাঘরের দরজার কাছে এক জন অচেনা বলশালী লোকের হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা তার জীবনে বেশি ঘটে না।

প্রথমে সে ভাবল, সুরপতি মারা গেছে। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু। মানুষ জন্মায় ও মরে, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এক জন অচেনা লোক মারা গেছে বলে সে তো তার কাজ বন্ধ রাখতে পারে না। সে তার ক্ষুরে শান দিচ্ছিল, আবার তেমনিই শান দিতে লাগল।

খানিকটা বাদে সে আবার চোখ তুলে দেখল, সুরপতিরকপাল থেকে তখনও তাজা রক্ত গড়াচ্ছে।

ক্ষৌরকার শুধু এইটুকু জানে যে, কোনও মরা মানুষের শরীর থেকে তাজা রক্ত বেরোয় না। রক্ত জিনিসটা জীবিত মানুষেরই সম্পদ। এই রক্ত বন্ধও করা যায়।

সে সুরপতির কপালে খানিকটা জল ঢেলে দিয়ে সেখানে ফিটকিরি ঘষতে লাগল। তাতেও রক্ত বন্ধ হয় না। তখন সে খানিকটা ঘাস ছিঁড়ে এনে ক্ষতস্থানে চেপে ধরল।

যন্ত্রণায় সুরপতির জ্ঞান ফিরে এল। সে অস্ফুট গলায় বলল, মা!

ক্ষৌরকার বলল, হায় রে মাতৃহীন! এই নিঃস্বের ঘরে তুমি মাকে খুঁজতে এসেছ? বরং কোনও দেবালয় গেলে না কেন?

সুরপতি বলল, আমি কোথায়?

ক্ষৌরকার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে হে বাপু? কোথা থেকে এসেছ? তোমার মুখভর্তি দাড়িগোঁফের জঙ্গল। তুমি যদি আমার কাছে ক্ষৌরকার্যের জন্য এসে থাকো, তাহলে বলল, আমি তা এখনই করে দিচ্ছি।

সুরপতি চোখ মেলে দেখল, ক্ষৌরকারের বার্ধক্য কুঞ্চিত মুখ তার মুখের কাছে ঝুঁকে আছে। তার এক হাতে তখনও ক্ষুর ধরা।

সুরপতি বলল, আমার দাড়ি কাটবার দরকার নেই। তুমি আমার গলাটা এক পোঁচে কেটে দাও। বাঁচার সাধ আমার মিটে গেছে।

ক্ষৌরকার বলল, এ-রকম অদ্ভুত কথা আমি কখনও শুনিনি! এ-জন্য তুমি আমার কাছে এসেছ কেন? রাজপথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, কোনও সৈনিকপুরুষ দেখলে রাজার নামে কিছু নিন্দা উচ্চারণ করো, তারা আরও অনেক সহজে তোমার মুণ্ডু উড়িয়ে দেবে। তুমি যন্ত্রণাও টের পাবে না।

সুরপতি উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, রাজার নামে কী নিন্দা উচ্চারণ করব বলো তো?

ক্ষৌরকার বলল, অনেক অনেক রকম কথা বলে। তবে আমার কাছে রাজার একটাই দোষ। আমাদের রাজা মাকুন্দ, তার দাড়িগোঁফ নেই। সুতরাং আমার কাছে এমন রাজা থাকা না-থাকা সমান।

সুরপতি বিস্মিত হয়ে গেল। এমন সরল কথা সে বহু দিন শোনেনি।

ক্ষৌরকার বিড় বিড় করে আপন মনে বলতেই লাগল, এই রাজা আমার কোন উপকারে লাগছে? তবে একথা আমি প্রকাশ্যে জানাতে পারি না, কারণ আমি এখনও আমার এই বৃদ্ধ মুণ্ডুটিকে ভালবাসি। তুমি ভালবাসোনা?

সুরপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, না। জীবনের আনন্দ আমার শেষ হয়ে গেছে।

ক্ষৌরকার বলল, মৃত্যু অতি সহজ। বেঁচে থাকাই বড় শক্ত কাজ, এই বয়েসে আমি এখনও সেই শক্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।

সুরপতি বলল, আমি আর পারছি না।

ক্ষৌরকার বলল, আর একটু পরেই রাজপথ দিয়ে সৈনিকেরা টহলে বেরুবে। তুমি যাও, আর দেরি কোরো না।

সুরপতি বলল, আমি উঠে দাঁড়াতে পারছি না। আমার পায়ে জোর নেই। চোখেও ঝাঁপসা লাগছে। একটু বিশ্রাম করি আগে।

সামনেই সরাইখানা। সেখানে যাও, আরামের শয্যা পাবে। সুন্দর বিশ্রাম হবে।

তার বদলে আমি তোমার শয্যায় যদি একটু শুয়ে থাকি? তুমি শুতে দেবে একটু?

তুমি হঠাৎ এ-রকম অজ্ঞান হয়ে পড়লে কেন? তোমার কি মৃগী ব্যাধি আছে?

আগে তো ছিল না। তবে একবার আমার মাথায় একটা সাংঘাতিক চোট লাগার পর এ-রকম হয়েছে। আমার বড় কষ্ট হচ্ছে এখন। একটু শুয়ে থাকতে দেবে তোমার শয্যায়?

ক্ষৌরকার একটুক্ষণ চিন্তা করল। তার শয্যা বলতে এক টুকরো চট ও একটা মলিন বালিশ। সেখানে আর একটা লোক এসে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলে কী আর এমন ক্ষতি? তবু একটা লোক এ-রকম বিচিত্র প্রস্তাবই-বা দেয় কেন? সব জিনিসেরই তো মাথা-মুণ্ডুথাকবে।

সে বলল, কিন্তু ভাই, তোমাকে আমি শুতে দেব কোন সুবাদে? তুমি আমার কে?

সুরপতি তার কুর্তার জেল থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা বাব করে ক্ষৌরকারের হাতে দিয়ে বলল, এটা তুমি রাখো। এক দিন না এক দিন আমি ঠিক তোমাকে দিয়ে ক্ষৌরকার্য করাব। এটা তার আগাম দক্ষিণা। সুতরাং এখন আমি তোমার ভাবী খরিদ্দার হয়ে গেলাম।

ক্ষৌরকার এই যুক্তিটা বুঝল। স্বর্ণমুদ্রাটি সে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখল। বিড় বিড় করে বলতে লাগল, জীবনে কেউ আমাকে কখনও স্বর্ণমুদ্রা দেয়নি। এটা আমি গলায় ঝুলিয়ে রাখব। ওহে বিদেশি, তুমি এসো, ভিতরে এসো।

সেই দিন থেকে সুরপতি সেই ক্ষৌরকারের জিনিসপত্র ধুয়ে দেয়, তার রান্না করে দেয়, নদী থেকে জল আনে। আর একটু অবসর পেলেই সে সরাইখানার দিকে তাকিয়ে থাকে।

সরাইখানার সামনে একটা গোল চত্বর। সেখানে কয়েকটি কাঠের চৌকি পাতা। বাইরের লোক এসে ওখানেই প্রথমে বসে। অনেকে ওখান থেকেই খাবার-দাবার খেয়ে নিয়ে চলে যায়। আবার যারা ভেতরে কক্ষ ভাড়া নিয়েছে, তারাও সন্ধ্যার দিকে ওখানে বসে মজলিশ জমায়। সরাইখানাব মূল বাড়িটি পাথরের। বলভদ্র বেছে বেছেই এই সরাইখানাটি কিনেছে, যাতে সহজে আর আগুন না লাগে। দ্বি-তলের একটি ঘরের জানলা সব সময় বন্ধ থাকে। সুরপতি জেনেছে ওই ঘরেই থাকে সুভদ্রা। তাকে কখনও দেখা যায় না।

এর মধ্যে ধ্রুবকুমারের সঙ্গে একটু একটু ভাব হয়েছে সুরপতির। ধ্রুবকুমার তাকে চিনতে পারেনি। ধ্রুবকুমারের ছোট ভাইটিকেও সে দেখেছে। তার মুখখানি অবিকল বুধনাথের মতো। সেই শিশুটির বয়েস হিসেবকরেও সুরপতি বুঝেছে যে, এ সেই বুধনাথেরই বলাৎকারের সন্তান। এক-এক সময় সুরপতির এমন অসহ্য রাগ হয় যে তার ইচ্ছে হয়, আদর করার ছলে সে শিশুটিকে ঘাড় মুচড়ে মেরে ফেলে। সুভদ্রার গর্ভে বুধনাথের সন্তান, এ যে তার চোখের বিষ!

পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নেয়। অবোধ কোমল শিশু, এর তো কোনও দোষ নেই! এর জন্মের জন্য তো এ নিজে দায়ী নয়!

তবে সে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে ধ্রুবকুমারকে। তার জন্য সে পাখি ধরে দেয়, গাছের ডাল ভেঙে খেলনা তৈরি করে। সুরপতি এ জায়গা ছেড়ে চলে যেতে পারছে না শুধু ধ্রুবকুমারের টানে। এ যে রক্তের টান।

সুভদ্রার কথা সে অনেক বার ভেবেছে। এখন যদি সে বলভদ্রের কাছে গিয়ে সুভদ্রার স্বামী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে বলভদ্র কি ফিরিয়ে দেবে না সুভদ্রাকে? বলভদ্র এমনি মানুষটা খারাপ নয়। এই কদিনে তার ব্যবহার দেখে, কথাবার্তা শুনে সুরপতি বুঝেছে, মানুষটার মধ্যে মায়া দয়া আছে। দুটি সন্তান সমেত সে সুভদ্রাকে আশ্রয় দিয়েছে, এটাও কম কথা নয়।

কিন্তু সুভদ্রাকে নিয়ে সুরপতি যাবে কোথায়? তার সহায় সম্বল নেই, আর এক কপর্দকও সঞ্চয় নেই, সে তো কোথাও নতুন করে সংসার পাততে পারবে না। এক হয়, যদি তমলুকে আবার ফিরে যাওয়া যায়। সেখানে রোগের উপদ্রব নিশ্চয়ই এত দিনে থেমে গেছে। কোনও রকমে খুব কষ্ট করেও সেখানে একবার পৌঁছতে পারলে কিছু একটা গতি হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে এই কুলটা রমণীকে নিয়ে সে সমাজে বাস করবে কী করে? সুভদ্রা একবার দস্যুদ্বারা ধর্ষিতা হয়েছে, সে তো না হয় নিজের অনিচ্ছায়, কিন্তু তারপর তো সে এতগুলো বছর পরপুরুষের ঘর করেছে! কথাটা মনে পড়লেই যেন সুরপতির বুকটা একেবারে পুড়ে যায়। সেই সুভদ্রা–যার ধ্যান জ্ঞান সব কিছুই ছিল সুরপতিকে কেন্দ্র করে, কোনও দিন অপর পুরুষের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত।

সুভদ্রার কথা চিন্তা করে এত কষ্ট করেও জীবনধারণ করেছে সুরপতি। কারাগার থেকে পলায়ন করেছে কত ঝুঁকি নিয়ে। তার পরও কত রকম বিপদ আসে, তবু সে এখনও বেঁচে আছে, সে নিছক মনের জোরে। সবই সুভদ্রার জন্য। সেই সুভদ্রা তার জন্য অপেক্ষা করতে পারল না?

সুরপতি তো অন্য কোথাও থেকেও যেতে পারত। রেশমি বিবির মতো রমণীর আহ্বানও সে পেয়েছিল। আর কিছু না হোক, সে তত সন্ন্যাসী হয়ে পাহাড়ে যেতে পারত। কিন্তু সুভদ্রার কথা এক মুহূর্তের জন্যও সে ভোলেনি। এখন এত কষ্ট করে ফিরে এসেও সে দেখল, সুভদ্রা আর তার নয়। তার নিজের পুত্র তাকে বাবা বলে চিনতে পারে না।

তবু সুভদ্রার ওপর ঠিক রাগ করতে পারে না সুরপতি! মনটা আবার কোমল হয়ে যায়। সুভদ্রার মতো নারী নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় এমন হয়নি। সুভদ্রার ওপর রাগ করলে তো সুরপতি এখনও যে-কোনও দিন এখান থেকে চলে যেতে পারে। কিন্তু তা সে পারে না।

প্রথম দিন সরাইখানায় ঘুম থেকে জেগে সুভদ্রা নিশ্চয়ই ভেবেছিল যে, সুরপতি তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেছে। সুরপতি আর ফিরে আসেনি বলে সেই ধারণাটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারপর পুত্রসন্তান নিয়ে সুভদ্রা চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েছিল, নিশ্চয়ই খুব সহজে সে আত্মসমর্পণ করেনি বলভদ্রের কাছে। ক্ষুধার জ্বালায়, বিশেষ করে শিশুপুত্রের মুখ চেয়েই বোধহয় সে শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছে এই কলঙ্কের জীবন।

সুভদ্রা, ধ্রুবকুমারকে এখানে ফেলে রেখে অন্য কোনও জায়গায় চলে যেতেও তার মন চায় না। অথচ নিজের স্ত্রী-সন্তানকে ফিরিয়ে নেবারও কোনও উপায় নেই। অন্তত সুভদ্রাকে সে যদি একবার চোখের দেখাও দেখতে পেত।

সুরপতি ধ্রুবকুমারের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করে, বাছা, তোমার মা কি কখনও বাইরে বেরোন না?

ধ্রুবকুমার বলে, না। মা বাইরে আসতে চান না। যদি দুষ্ট লোকেরা মাকে ধরে নিয়ে যায়?

সুরপতি আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার মা বুঝি খুব সুন্দর?

ধ্রুবকুমার বলে, আমার মা পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর মা!

আচ্ছা ধ্রুবকুমার, লোকে নাকি বলে, তোমার মা বোবা! উনি কথা বলতে পারেন না।

ধ্রুবকুমার রেগে গিয়ে উত্তর দেয়, কে বলেছে? দুষ্ট লোকেরা এ-কথা বলে।

তোমার মা তাহলে কথা বলতে পারেন?

হ্যাঁ, মা তো রোজ আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে শুধু আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলেন না।

তোমার বাবার সঙ্গেও কথা বলেন না?

না।

তারপর একটু থেমে ফিস ফিস করে ধ্রুবকুমার বলে, উনি তো আমার বাবা নন। আমার বাবা তো দূরে বিদেশে চলে গেছেন।

সুরপতি আর চোখের জল সামলাতে পারে না। কান্নায় তার বুক ভিজে যায়। কোনও রকমে মুখটা অন্য দিকে সরিয়ে রাখে যাতে ধ্রুবকুমার দেখতে না পায়। তার সন্তান অন্তত তাকে মনে রেখেছে। সে আর কখনও অন্য লোককে বাবা বলবে না। তবু সে সন্তানের কাছে নিজের পরিচয় দিতে পারছে না! ধ্রুবকুমারকে একলা সে এখান থেকে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু সুভদ্রা? সুভদ্রাকে সে এত দিন পরে কী করে ফিরিয়ে নেবে? তাছাড়া লজ্জায়, পাপের ভয়ে সুভদ্রা হয়তো এখন আর তার কাছে ফিরে আসতেও চাইবেনা।

একটুক্ষণ পরে সে আবার ধ্রুবকুমারকে জিজ্ঞেস করে, তোমার বাবাকে তোমার মনে আছে?

ধ্রুবকুমার সুর করে টেনে উত্তর দেয়, হ্যাঁ–।

তোমার বাবা তোমাদের ফেলে কেন দূর বিদেশে গেছেন?

তা আমি জানি না। মা জানেন।

মা কিছু বলেন না তোমাদের?

না, বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেই মা কাঁদতে থাকেন। তাই আর জিজ্ঞেস করি না।

আমার কি মনে হয় জানো? তোমার বাবা বোধহয় কোনও রাজার কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন, তাই তোমাদের খোঁজ নিতে আসতে পারেননি। তোমার মাকে একটা কথা জিজ্ঞেস কোরো তো। তোমরা যদি খবর পাও, কোনও রাজার কারাগারে তোমার বাবা বন্দি হয়ে আছেন, তাহলে তোমরা কি তাকে উদ্ধার করতে যাবে?

ধ্রুবকুমার দর্পের সঙ্গে বলল, নিশ্চয়ই যাব। আমি যাব।

যদি তোমাদের এই বাবা, মানে সরাইখানার মালিক বলভদ্র যেতে না দেন?

আমি তবু একা যাব। তলোয়ার নিয়ে লড়াই করব।

তবু কথাটা তোমার মাকে একবার জিজ্ঞেস কোরো। আমার কথা কিছু বোলোনা, এমনি জিজ্ঞেস কোরো, কেমন?

সুরপতি আবার অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের জল লুকোয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *