দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। যেখানে দেশের গভীর ব্যথা, মার্শাল সাহেবের গোমড়ামুখো সৈন্যেরা সেখানেই কাঁটা বসানো বুট জুতোর লাথি মারে। প্রথম প্রথম গোটা দেশ আঘাতের বেদনায় গুঙিয়ে উঠত। ক্ষত থেকে রক্ত বের হতো। আওয়াজে যন্ত্রণা ফুটে থাকত। প্রায় এক যুগ ধরে লাথি খেয়ে ব্যথা-জর্জর অংশ আঁটো হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিবাদ করার জন্য মুখিয়ে উঠছে। যন্ত্রণা, বেদনা এবং দুঃখের কারখানা থেকেই প্রতিরোধের শাসানো আওয়াজ ফেটে ফেটে পড়ছে। তার ধার যেমন তীক্ষ্ণ, ভারও তেমনি প্রচণ্ড। সারাদেশে স্লোগানের ঢল নেমেছে। পথে-ঘাটে মানুষ- কেবল মানুষ। চন্দ্রকোটলের জোয়ারের জলের মতো বইছে মানুষ। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো নদী হয়ে গেছে। তাদের চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কণ্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে স্লোগানের ধ্বনি বাংলাদেশের আকাশমণ্ডলের কোটি কোটি বর্শাফলার মতো ঝিকিমিকি খেলা করে।
শেখ মুজিব জেলে। আগরতলা মামলার বিচার চলছে। এখানে ওখানে বোমা ফুটছে, মিটিং চলছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মিছিল বেরিয়ে আসে। গুলি চলে। লাল তাজা খুনে শহরের রাজপথ রঞ্জিত হয়। সরকারী পত্রিকার অফিসগুলোতে হুতাশনের মতো প্রলয়করী অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। প্রতিটি সকালেই খবরের কাগজের পাতা উল্টোলেই টের পাওয়া যায় ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গতিকটি সুবিধের নয় বলে মনে হলো। আইয়ুব খানের সিংহাসন ঝড়ে পাওয়া নায়ের মতো টলছে। শক্ত মানুষ ফিল্ড মার্শালের জন্য চিন্তিত হলাম। মার্শাল যদি যান আমার শ্বশুরও তো চিৎপটাং হবেন। যাদের করুণার বদৌলতে আমি পাড়া-গাঁয়ের ধূলিশয্যা থেকে এই বড় কর্তার আসনে উঠে এসেছি, তাঁরা সকলে যাবেন অথচ আমি একা থাকব সে কেমন করে হয়। শ্বশুরের জন্যে চিন্তিত হলাম। কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। আসলে আমার মনেই দুশ্চিন্তা শত শত হুল ফোঁটাচ্ছিল।
যুগের হাওয়ার প্রচণ্ড একটা অস্থিরতা। কোথাও শান্তি নেই। বাতাসে বাতাসে মোচড় খেয়ে ঘূর্ণি হাওয়া যেমন বেগ সঞ্চয় করে, তেমনি মানুষের ক্ষোভ রুদ্ধ আক্রোশে ফুলে ফুলে একটা সৃষ্টিনাশা ঝড়ের আকার ধারণ করছিল। যেখানেই যাই- দেখি তোলপাড় লণ্ডভণ্ড অবস্থা। বিপদ ঘনিয়ে এলেই আমি কোনো বিষয়ে স্থিরভাবে চিন্তা করতে পারিনে। বলির পাঁঠার মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে সর্বনাশের প্রতীক্ষা করি। বাইরের দিক থেকে আমার মানসিক অবস্থা অনুমান করার উপায় নেই। আমার চিন্তা চাঞ্চল্যহীন নির্বিকারত্বকেই লোকে ক্লাসিক স্থিরতা বলে মনে করে। এত বেশি শুনেছি যে কথাটা নিজেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।
চুপচাপ বসে থাকি। অফিসে যাওয়া আসার পথে পারতপক্ষে ডাইনে বাঁয়ে তাকাইনে। রাতের অন্ধকারে বেবাক রাস্তায় কারা সব ভয়ংকর পোস্টার সেঁটে রাখে। পোস্টারের বুকে সর্বনাশের লাল সংকেত জ্বলজ্বল করে। তাই ভাবুকের মতো আকাশের দিকে তাকাই। সেখানেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই, মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বিজলীর বাঁকা ছুরি ঝলসে উঠে। বজ্র ফেটে পড়ে। প্রকৃতির রাজ্যের নিটোল শান্তি ভাঙ্গার অপরাধে আকাশের দেবতাকে অভিযুক্ত করি। পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। পত্রিকাঅলাদের আমি বিশ্বাস করিনে। কি করে করব। আমার শ্বশুর সাহেব যে পত্রিকাটিকে তার প্রভাব খাঁটিয়ে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, দেখলাম সে ব্যাটাই আমার শ্বশুরের দলের বিরুদ্ধে তেজালো লেখা লিখছে। বাজারের কসবীকে বিশ্বেস করা যায়, কিন্তু পত্রিকাঅলাদের নয়।
আগে অল্পস্বল্প এটাসেটা পড়াশোনা করতাম। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। উসকোখুসকো লাগলে নবযুগ ডাইরেকটরী পঞ্জিকার পাতা উল্টাই। রাশি বর্ষ ফল দেখি। মেহ-প্রমেহ ইত্যাদি যৌন রোগের বিজ্ঞাপনে চোখ বুলোই। তাছাড়া আর কি। করার ছিল আমার। দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে সব দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনের গহনে তখনো একটা নিশ্চিন্তি বোধ নোঙরের মতো অটুট ছিল।
আমি জানতাম আমার একটা বৌ আছে। ছায়াময় উদ্যানকুঞ্জের মতো সে বৌয়ের একখানা স্নেহপ্রবণ মন আছে। এই বিশ্বসংসারে একমাত্র আমিই সে মনের খবর জানি। সে তো বোবা। মানুষের জয়-পরাজয় উত্থান-পতনে তার কিছু যায় আসে না। সুতরাং মানুষও সে মনের কোনো খবর জানত না। সময়ে অসময়ে জাগতিক অশান্তি অস্থিরতা আমাতে ভর করলে, মরুভূমির পথিক যেমন পান্থপাদপের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তেমনি ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াব ভেবেছিলাম। আমার সুখ-দুঃখ সব কিছুর ওপর তার মনের অনাবিল শান্তি প্রসন্ন মাধুর্যে ভরিয়ে দেবে। কল্পনা করে সুখ, আমিও কল্পনা করেছিলাম।