৭. দুর্গের গভীরের কারাগার

দুর্গের গভীরের কারাগারে নড়েচড়ে উঠলো সারাহ কোর্টনী। উঠে বসতেই লোহার কড়াগুলোয় টান পড়ে ব্যথা করে উঠলো হাতে। সামনের অন্ধকারে তাকিয়ে রইলো ও। ঘড়ির কাটার শব্দের মতো টুপটাপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে; অন্য বন্দিরা কেউ ফোঁপাচ্ছে, কেউ বিলাপ করছে। ও কোনো কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে পাথরের ভিতর দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলো। আশা করছে ব্যাপারটা যেনো একটা দুঃস্বপ্ন হয়।

ওর শরীর জুড়ে একটা কাঁপুনি বয়ে গেলো, ঠিক কোনো মোমবাতির পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে ওটার শিখার ভিতরে যেরকম কাপন হয়, সেরকম।

“কি হলো?” জিজ্ঞেস করলো অ্যাগনেস। বোনের দিকে সবসময় নজর ওর। বমি আপাতত আর হচ্ছে না; আর ওদেরকে যে সামান্য খেতে দেওয়া হচ্ছে তাতেও সারাহের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বরঞ্চ ওর ওজন আরো বেড়েছে। কিন্তু এখন নতুন আর এক দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছে, “জ্বর এসেছে আবার?”

সারাহ মাথা নাড়লো। “মনে হলো টমের গলা শুনতে পেলাম যেনো। স্বপ্নে দেখলাম যে ও আমাদেরকে উদ্ধার করতে এসেছে। নেপচুন তরবারিটা হাতে দরজা দিয়ে দৌড়ে এসে আমাদের বাঁধন কেটে দিলো।” বল দীর্ঘশ্বাস ফেললো সারাহ। তারপর হাতটা পেটের উপর রেখে বললো। “এই স্বপ্ন আর সত্যি হবে না। তরবারিটাই তো হারিয়ে গিয়েছে।”

এই কয়েদখানায় ওরা ঠিক কতোদিন ধরে আছে সেই সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই নেই। কয়েক সপ্তাহ তো হয়েছেই। এতো নিচে দিনের আলো পৌঁছায় না, দেয়ালে কোনো ফাটল ও নেই যা দিয়ে দিনের হিসাব রাখতে পারবে। ওরা আছে। একটা গুহার ভেতর, শৈল অন্তরীপটার একদম পেটের ভিটর গুহাটা। সারাহ মাঝে মাঝে বাইরে পাথরের গায়ে ঢেউয়ের বাড়ির শব্দ শুনতে পায়। কারাগারের দেয়ালগুলো পাথর কেটে বানানো হয়েছে। বৃষ্টি পড়লেই ওটার ধার বেয়ে পানি পড়ে, পুরো ঘরটা স্যাঁতসেতে হয়ে আছে তাতে। আর আলো বলতে আছে একমাত্র পাশের গুহার একটা কুপির সামান্য আলো সেটাতে তেল ফুরিয়ে গেলে মাঝমাঝে কয়েক দিন পার করে, তারপর প্রহরীরা তেল ভরে দিয়ে যায়।

“ও আসবেই,” অ্যাগনেস বললো। “যদি ও বাতাসে ভেসে পৃথিবীর উল্টো পাশেও চলে যায়, এমনকি যদি তোমার আর ওর মাঝে শ্রেষ্ঠ মুঘল সেনারাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবুও ও তোমাকে উদ্ধার করতে আসবে।”

“যদি ও বেঁচে-ই না থাকে? আমি জানিও না যে ও চিত্তিত্তিঙ্কারা থেকে। পালিয়ে আসতে পেরেছিলো কিনা।”

অ্যাগনেস সারাহের হৃৎপিণ্ডের উপর হাত দিলো। “ওর যদি কিছু হতো, তাহলে এখানে টের পেতে।” টম আর সারাহের সাথে ব্রিঞ্জোয়ানে মাত্র কয়েকদিন ছিলো অ্যাগনেস, কিন্তু তাতেই খেয়াল করেছে যে ওরা দুজন দুজনকে কতোটা ভালোবাসে। ও জানে যে টম ওদেরকে উদ্ধার করবেই।

 গুহার অন্য প্রান্ত থেকে খনখনে গলায় উপহাস করে উঠলো কেউ।

“স্বামীর উপর ভরসা করে লাভ নেই। যদি বেঁচে-ও থাকে, তবে এতে দিনে ভুলেই গিয়েছে যে সে বিবাহিত ছিলো।”

“আমি ওকে পুরো ভরসা করি।”

“আমিও মিস্টার কাইফেনের উপর ভরসা করেছিলাম,” খেঁকিয়ে উঠলো লিডিয়া। “কিন্তু কাপুরুষটা সঁতরে ডাঙায় চলে গেলো। কে জানতো একজন ভদ্রলোক, তিনজন মহিলা আর সব সম্পত্তি ওই দস্যুদের হাতে ফেলে পালিয়ে যাবে?”

“টম ওরকম না,” নরম গলায় বললো সারাহ। ও সারাক্ষণই টমের কথা ভাবে, কিন্তু খুব বেশি আলোচনা করে না। কারণ অ্যাগনেস সদ্য বিধাব হয়েছে, সেখানে সারাহের নিজের স্বামীকে নিয়ে জাবর কাটাটা নিষ্ঠুর হয়ে যায়।

“আমাদেরকে বাঁচাতে পারেন একমাত্র গাই কোর্টনী, লিডিয়া বললো। “আমার আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।” বলে ও অ্যাগনেসের দিকে তাকালো। “আপনি তো ওনার শ্যালিকা। উনি এখনো আমাদের মুক্তিপণের টাকা দিচ্ছেন না কেনো?”

“আপনি যদি ভেবে থাকেন আমার টানে গাই আমাদেরকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করবে, তাহলে ভুল করছেন,” অ্যাগনেস বললো। “তার চোখে পৃথিবীর সবচে বড় দুষ্কর্মটা করেছি আমি। তার ব্যক্তিগত লাভ হতে পারতো এমন একটা কাজে আমি সায় দেইনি। উনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক উচ্চ পদস্থ লোকের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলেন আমার। কিন্তু আমি বিয়ে করি ক্যাপ্টেন হিকসকে। হিকস ছিলেন দীনহীন এক সৈনিক। গাই আমাকে এই অপরাধে কখনোই ক্ষমা করেনি। আর সেজন্যেই আমাদেরকে ব্রিঞ্জোয়ানে নির্বাসন দিয়েছিলো।”

অ্যাগনেস ঠাণ্ডা দেয়ালে হেলান দিলো আবার। এসব কথা আজ প্রথম না। দস্যুরা ধরে অ্যানার পর থেকেই বেশ কয়েকবার এসব নিয়ে তর্ক বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু আজ লিডিয়া এখানেই কথা শেষ করতে দিলো না। ও সোজা উঠে বসে হাতটা টেনে কড়াগুলো ঠিকঠাক করলো। তারপর সারাহ আর অ্যাগনেসের দিকে কুটিল একটা চাহনি দিয়ে বললো, “আপনার যে আপন বোন না, এই ভাব ধরে থাকেন কেন?”

ওদের হতভম্ব চেহারা দেখে লিডিয়া শব্দ করে হেসে দিলো। “আপনারা ভেবেছিলেন আমার কাছে থেকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন? আমি তো আর অন্ধ না। আমি সবই দেখেই, সবই শুনি। ব্রিঞ্জোয়ান থেকে আসার আগেই আমার সন্দেহ হচ্ছিলো। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তো এটা লুকিয়ে রাখা সম্ভবই না। আপনার দুজনের এতো যত্ন নেন; আমি ঘুমিয়ে আছে মনে করে ফিসফিস করে কতো কথা বলেন। আমি আপনাদের গোপন খবরটা জানি-আর যে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করতে চান না, সেটাও আমার জানা আছে।”

 লিডিয়া মাথা তুললো। ফলে ওর চোখা থুতনিটা ওদের দিকে তাক হয়ে থাকলো। “অস্বীকার করতে পারেন?”

যদিও এটা কোনো ব্যাপার না, তবুও অ্যাগনেসের কেনো যেনো মনে হলো ওর খুব দামি কোনো সম্পদ হাতছাড়া হয়ে গেলো। এই কয়েদখানায় নিজেদের বলতে ছিলো শুধু এই গোপন কথাগুলো। এখন সেটাও আর থাকলো না। আর ও লিডিয়াকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না।

“হ্যাঁ, এটা সত্য,” নির্বিকারভাবে বললো সারাহ। “অ্যাগনেস আর আমি বোন। ঘটনাক্রমে ব্রিঞ্জোয়ানে নামার আগে প্রায় বিশ বছর ওকে দেখিনি আমি।”

 “তার মানে আপনিও গভর্নরের স্ত্রী ক্যারোলিন কোর্টনীর বোন?”

সারাহ মাথা ঝাঁকালো।

লিডিয়া হাতকড়াসমেত ওর হাত দুটো উপরে তুললো। “তাহলে আমাদের বন্দিকারীকে বলে দিন যে আপনারা আসলে কারা। যদি গাই কোর্টনী জানতে পারেন যে এরা তার স্ত্রীর দুই বোনকেই আটকে রেখেছে-সেই সাথে তার পরম বিশ্বস্ত বন্ধু মিস্টার ফয়-এর বিধাব স্ত্রীও আছেন-তাহলে যতো টাকাই চাক না কেন উনি দিয়ে দেবেন।”

“আপনার ধারণা ভুল,” সারাহ বললো। “গাই যদি আমার আসল পরিচয় জানতে পারে, তাহলে. ও আংরিয়াকে টাকা দিয়ে বলবে আমাদেরকে মরার আগ পর্যন্ত এখানে রেখে দিতে। আর যদি ও আমাকে মুক্ত করে নেয়, তাহলে তা করবে আংরিয়ার চাইতেও ভয়ংকর কোনো শাস্তি দেওয়ার জন্যে।”

 লিডিয়া সামনে ঝুঁকে এলো? যেনো কোনো ব্লাডহাউন্ড কুকুর রক্তের ঘ্রাণ পেয়েছে। “কেন?”

 দেরিতে হলেও সারাহ টের পেলো যে ও অনেক বেশি বলে ফেলেছে। দুর্বলতা আর হতাশা ওর সতর্কতা কমিয়ে দিয়েছে। সেটা তেমন কিছু না।”

“যদি এই কারণেই আমাকে এই কয়েদখানায় পচে মরতে হয়, তাহলে সেটা অবশ্যই তেমন কিছু,” লিডিয়া চার হাত পায়ে ভর দিয়ে আরো সামনে এগিয়ে এলো। “কেনো গাই আপনাকে এতো অপছন্দ করে?”

“কোনো কারণ নেই।”

 “আপনাকে ভালোবাসতো নাকি?”

সারাহ শিউরে উঠলো। “কোনোদিনও না।”

লিডিয়া ভাবতে লাগলো। “উনি অ্যাগনেসকে তার পছন্দ ছাড়া বিয়ে করায় ক্ষমা করতে পারেননি। সম্ভবত আপনিও একই কাজ করেছিলেন, তাই না?”

সারাহ আর কিছু বলার সাহস করলো না।

 “কিন্তু তাতে তো তার আপনাকে এভোটা ঘৃণা করার কথা না,” লিডিয়া জোরে জোরে ভাবতে লাগলো। তার মানে কাহিনি আরো আছে। আপনার স্বামীকে নিয়ে সম্ভবত। আপনার স্বামী আর গভর্নর কোর্টনীর মাঝে শক্রতা আছে নাকি?”

লিডিয়ার নাক কুঁচকে গেলো। “কিন্তু কেন উনি এতোটা রাগ করবেন? আপনার স্বামী কি করেছিলেন? ইন্টারলোপার নাকি? নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী?”।

“ইন্টারলোপার,” অ্যাগনেস বললো। “আপনিতো জানেনই যারা কোম্পানির ব্যবসা মেরে খায় গাই তাদেরকে কতোটা ঘেন্না করে। এটাই কারণ।”

কিন্তু অ্যাগনেসের হড়বড় করে বলা কথার কারণে লিডিয়া মিথ্যেটা ধরে ফেললো। “না! সেটা আসল কারণ বলে মনে হচ্ছে না। একটা বিজয়ীর হাসিতে ওর দুই ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেলো। আমরা যখন ব্রিঞ্জোয়ানে নৌকায় মালামাল ভরছিলাম, তখন একটা লোক আপনাকে মিসেস কোর্টনী” বলে ডাক দিয়েছিলো। এরকম কেনো করবে? আর যে ছেলেটা আপনাদের সাথে ছিলো, সে হচ্ছে গাইয়ের ভাতিজা-ফ্রান্সিস কোর্টনী। সবকিছু খুব বেশি কাকতালীয়, তাই না?”

“ভুল শুনেছেন,” সারাহ বললো।

“আমার মনে হয় না। আর আপনি যদি মিসেস কোর্টনী হন, তাহলে আপনার স্বামী নিশ্চয়ই…” এক মুহূর্ত ভাবলো লিডিয়া! “টম কোর্টনী।”

সারাহ আর অ্যাগনেসের বজ্রাহত চেহারা খেয়াল হলো লিডিয়ার। ও হেসে দিলো আবার। “আপনি হচ্ছেন মিসেস টম কোর্টনী। শুধুমাত্র গাই-এর শ্যালিকা না, তার ভাইয়ের স্ত্রী-ও। এখন বুঝতে পারছি সব। বোম্বে থাকার সময় আমি টম কোর্টনীর কথা শুনেছিলাম। সবাই বলতো যে ওরা এমন শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে যে একজন আর একজনকে খুন করতে গিয়েছিলো। একবার নাকি শুধু টমের নামটা বলার অপরাধে, গাই তার বাড়ির ছাদ থেকে কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলো।”

“আমি এসব গুজবে কান দেই না,” অ্যাগনেস বললো।

কিন্তু লিডিয়ার কথা তখনও শেষ হয়নি। “আরো একটা কাহিনি মনে পড়ছে। এখন। এক বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম। ক্যারোলিন কোর্টনীর চাকরানি তাকে বলেছিলো ঘটনাটা। এই চাকরানি ইংল্যান্ড থেকেই ক্যারোলিনের সাথে এসেছিলো। সে বলেছিলো যে গাই-এর সাথে বিয়ে হওয়ার আগেই নাকি ক্যারোলিন নিজের কুমারীত্ব হারিয়েছিলো-এমনকি ওর পেটে তখন নাকি বাচ্চাও ছিলো।”

এই অন্ধকারেও মনে হলো লিডিয়ার চেহারা জ্বলজ্বল করে উঠলো। গত কয়েক সপ্তাহের কায়ক্লেশে ওর চৌকো চেহারাটা আরো বেশি ধারালো হয়েছে, এখন ওকে দেখতে ভয়ংকর লাগে।

“সবাই বলাবলি করে যে বাচ্চাটা-মানে ক্রিস্টোফার কোর্টনী নাকি গাই এর সন্তান না। ক্যারোলিন নাকি ইংল্যান্ড থেকে আসার পথে জাহাজে ইচ্ছে মতো যার তার সাথে শুয়েছে। আর যদিও বিয়ের দিনের ওয়াইন গাই-ই খেয়েছেন, কিন্তু বোতলের মুখ প্রথম খোলার সুযোগ নাকি ওনার হয়নি। সেই সৌভাগ্য হয়েছিলো ওনার ভাই টমের।”

এই অন্ধকারেও লিডিয়ার চোখ বিজয়ানন্দে চকচক করতে লাগলো। “এ কারণেই গাই আপনাকে ঘৃণা করে।” তারপর সারাহের দিকে চেয়ে উপহাসের সুরে বললো, “তবে আমি ভেবে পাই না, নিজের বোনের সাথে এরকম করার পরেও আপনি ওর প্রতি এতো বিশ্বস্ত। আমি হলে কোনোদিন কারো শেষ পাতের খাবার হয়ে খুশি থাকতাম না।”

“এখনতো আপনি বুঝলেন যে কেনো গাইকে সারাহের আসল পরিচয় জানানো যাবে না,” অনুনয়ের সুরে বললো অ্যাগনেস। “কথাটা আর কাউকে বলবেন না।”

 লিডিয়া আবার নিজের কোনায় ফিরে গেলো। সদ্য বিজয়ের শিহরণে ওর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে আছে।

“আমার উপর ভরসা করতে পারেন,” বললো লিডিয়া। “আমি কাউকে বলবো না। আর একটা ব্যাপার, যেটার কথা আপনি কাউকে বলছেন না।”

“মানে?” নিস্তেজ কণ্ঠে বললো সারাহ।

“আপনার পেটে বাচ্চা। আপনি কখনো বলছেন না, কিন্তু আপনার পেটের ফোলাটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে সেটার। নৌকায় আপনি খাবার পেটে রাখতে পারতেন না। আর এখন এতো কম খাবার খেয়েও আপনি মোটা হচ্ছেন। আরো অনেকগুলো লক্ষণ আছে। যে কোনো মহিলাই সেগুলো ধরতে পারবে।”

সারাহ ওর হাত মুঠো করে ফেললো।

“আপনি দস্যুদেরকে বললেন না কেনো?” লিডিয়া জিজ্ঞেস করলো।

“গত পনেরো বছর ধরে আমি আর টম বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করছি,” ব্যথিত কণ্ঠে বললো সারাহ। “এর মাঝে একবার মাত্র পেটে বাচ্চা এসেছিলো আমার। কিন্তু সেটাও নষ্ট হয়ে যায়। আর এখন এই অবস্থায়…” সারাহের কথা মিলিয়ে গেলো।

“দস্যুরা জানতে পারলে নিশ্চিত ওর এই দুরবস্থার ফায়দা ওঠানোর চেষ্টা করবে,” অ্যাগনেস বললো। “সেজন্যেই আমরা এটা নিয়ে কথা বলি না, আর মিসেস ফয়, আপনাকেও অনুরোধ করছি দস্যুদেরকে কিছু না জানানোর জন্যে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে,” লিডিয়া বললো। তারপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। যদিও আলোর ঘাটতি থাকার কারণে কেউ তা দেখতে পেলো না। আর আমি বলবোই বা কাকে?”

*

কয়েদখানার অনেক উপরে-দুর্গের যে অংশটা পাথরের তৈরি সেখানে-নিজের দরবারে বসে আছে দস্যু আংরিয়া। গায়ে গতরে ও বেশি তাগড়া না, কিন্তু ওর চোখের তীক্ষ্ণতা একবার যে দেখেছে সে কখনো ভুলতে পারবে না। গিট পাকানো একটা পাগড়ি মাথায় ওর, নাকের নিচে একটা জাদরেলি গোফ, সেটা প্রায় জুলফিতে গিয়ে ঠেকেছে।

 ওর জন্ম আসলে নাবিক-এর ঘরে না। ওর বাবা ছিলেন একজন দেশমুখ, মানে ছোট জমিদার। ওনার দায়িত্বে ছিলো প্রায় একশোটার মতো গ্রাম। কাজের মধ্যে ছিলো কৃষকদের মধ্যকার বিবাদ মেটানো, আর চোর ডাকাতের হাত থেকে গ্রামবাসীকে রক্ষা করা। কিন্তু আংরিয়ার এই গ্রামীণ জীবনের গবাধা জীবন ভালো লাগতো না। কৃষকেরা ওর বাবার পা চাটতো, ওর বাবা আবার তার উপরওয়ালার পা চাটতো। আর তাদের জীবনের একমাত্র ধ্যান ধারণা ছিলো পরের বছরের ফসল ঘরে তোলা। এসবে কোনো গৌরব ছিলো না। জীবনে প্রথম যেবার আংরিয়া একটা জাহাজ দেখতে পায়, তখনি ও নিজের ভবিতব্য বুঝে ফেলে। জাহাজটা ছিলো একটা পর্তুগিজ বাণিজ্য জাহাজ। সবগুলো পাল তুলে উপসাগর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলো সেটা। ওটার মতো করে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো ওর। আগে থেকেই এই সমাজ সংসারের নানান রীতিনীতির বেড়াজাল ভালো লাগতো না; কারো নিষেধ নামহীন একটা জীবন ছিলো ওর স্বপ্ন। পঁচিশ বছর পর ও ঠিকই স্বপ্নটা পূরণ করেছে, তবে সেই সাথে কুখ্যাতিও কুড়িয়েছে প্রচুর।

 এই দরবার ঘরটা ওর সাফল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন জাহাজ থেকে সংগ্রহ করা স্মারক ঝোলানো-ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগীজ পতাকা, জাহাজের ঘণ্টা, বাতি, এমনকি নগ্নবক্ষা মৎস্যকুমারীর কাঠের মূর্তিও আছে। মেঝেতে পুরু কম্বল পাতা, কোথাও কোথাও তিনটা পর্যন্ত ফেলে রাখা হয়েছে। ওর লোকেরা ওটার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকে বা অবসর সময়ে পাশা খেলে, আরক পান করে আর আরব থেকে আনা হুক্কা থেকে ধূমপান করে। এখন অবশ্য সবাই চুপচাপ বসে আছে। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ আংরিয়ার সামনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।

আজ বিকেলে এসে পৌঁছেছে লোকটা। যে ঘোড়াটায় চড়ে দুর্গে উঠে এসেছে সেটা একসময় দুর্দান্ত একটা বাহন ছিলো বোঝা যায়, কিন্তু টানা কয়েক সপ্তাহ দুর্গম পাহাড়ি পথ চলায় এখন খোঁড়াচ্ছে। লোকটার লম্বা কালো দাড়ি, তবে মাথার চুল পুড়ে টাক হয়ে গিয়েছে। ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটা আস্তাবলের চাকরটার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার পরে যখন ও সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তখন দেখা গেলো সে দুর্গের বাকি সবার চাইতে লম্বা। আংরিয়ার সাথে কথা বলতে চাইলে ও। প্রহরীরা বিনা বাক্যব্যয়েই ঢুকতে দিলো ওকে। কোমরে এরকম জবরদস্ত একটা তরবারি ঝোলানো থাকলে, তাকে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে পারা যায় না।

আংরিয়া একদৃষ্টিতে ক্রিস্টোফারকে জরিপ করলো কিছুক্ষণ। মুখভর্তি দাড়ি, আর গোলাপি হয়ে ফুটে থাকা চামড়ার তাজা কাটা দাগগুলোর পরেও আগন্তুককে একটা বালক বলে মনে হচ্ছে। এখনো বিশ হয়নি বয়স, কিন্তু যুদ্ধ করে পাকা হয়ে গিয়েছে। সন্দেহাতীত ভাবে একজন যোদ্ধা এ। তবে বয়স খেয়াল করার আগে আংরিয়া প্রশংসার দৃষ্টিতে ওর দৈহিক গড়ন আর শক্তিমত্তা খেয়াল করলো।

“কি নাম?” জিজ্ঞেস করলো আংরিয়া।

“রুদ্র,” জবাব দিলো আগন্তুক। রুদ্র হচ্ছে ভগবান শিব-এর একজন অবতার। শিব হচ্ছেন ধ্বংসের দেবতা। ছেলেটার তারুণ্য আর চোখের খুনে দৃষ্টি দেখে। আংরিয়া যেনো শিবঠাকুরেরই এক টুকরো প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো।

“এখানে কি চাই?”

 “আপনার হয়ে কাজ করতে চাই?”

 “কি কাজ পারিস তুই?”

“আমি টুপিওয়ালাদের কায়দা কানুন সব শিখেছি,” ক্রিস্টোফার বললো। “আমি ওদের সাথে জাহাজ চালিয়েছি। আমি আপনার লোককে ওদের মতো করে যুদ্ধ করা শেখাতে পারবো-আরো বেশি সুশৃঙ্খল আর দক্ষতার সাথে?”

আংরিয়া মাথা নাড়লো। “তোর বয়স যতোদিন, তার চাইতে বেশিদিন ধরে আমি টুপিওয়ালাদের সাথে লড়ছি। আমার লোকদের ওদের মতো করে যুদ্ধ করতে না জানলেও চলবে। আমার এমন লোক দরকার যে নিজের মতো করে, সাহসের সাথে যুদ্ধ করবে। একটা বাঘকে কখনো কোবরার মতো ছোবল মারা শেখানো সম্ভব না।

“কালারি-তে যুদ্ধ শিখেছি আমি। আমি বাঘ বা কোবরা, দু’ভাবেই লড়াই করতে জানি।” ক্রিস্টোফার নিজের তরবারি বের করলো। “সেটা প্রমাণ করার জন্যে আমি এখানকার যে কারো সাথে লড়তে প্রস্তুত।”

কথাটা শোনামাত্র অর্ধেক লোক দাঁড়িয়ে গেলো। হতচ্ছাড়াটাকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে সবাই প্রস্তুত। কয়েকজন অবশ্য জায়গাতেই বসে রইলো। এরা সবাই বয়স্ক আর অভিজ্ঞ। এরা ঠিকই আগন্তুকের সামর্থ্যের আন্দাজ করতে পেরেছে, তাই আগ বাড়িয়ে ঝামেলায় যাওয়ার চিন্তা করেনি।

আংরিয়া উঠে দাঁড়িয়ে চুপ করালো সবাইকে। তারপর বেদি থেকে নেমে এসে ক্রিস্টোফারের চারপাশে এমনভাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো যেনো গ্রামের মেলায় সদাই করতে এসেছে।

“দারুণ তরবারি তো,” বললল ও। দরবারের আলোয় নীলাটা ঝিকিয়ে উঠছে। “তোর সাহস আসলেই অনেক বেশি, নইলে এরকম একটা তরবারি হাতে এরকম সম্পূর্ণ অচেনা একদল মানুষের মাঝে আসার সাহস করতি না।”

“আপনার উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে,” ক্রিস্টোফার বললো।

আংরিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশংসাটা গ্রহণ করলো।

“তবে যদি কেউ এটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সে সাথে সাথে তার হাতটা হারাবে।”

আবার চাপা গর্জন শোনা গেলো ঘরের ভেতর। যদিও কেউ এগিয়ে এসে চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলো না। আংরিয়া আবার ওদের চুপ করতে বললো।

“তোর পরিচয় যে সত্যি সেটা কিভাবে বুঝবো আমি? আমার শত্রুর অভাব নেই। তুইতো রাজা শাহুজি-র চর হতে পারিস। বা যে টুপিওয়ালাদের জাহাজটা লুট করেছিলাম তাদেরও পাঠানো কেউ হতে পারিস।”

ক্রিস্টোফার ওর চোখে চোখ রেখে বললো, “আপনার কোন লোকটা সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন?”

আবার কয়েকজন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলো, হাতে ছুরি বেরিয়ে এসেছে।

আংরিয়া হাসলো। “আসল কথা হচ্ছে, একজন চর হলে তুই এসে আমার লোকদের না ক্ষেপিয়ে তেল মারার চেষ্টা করতি। তবে এটাও হতে পারে যে, তুই ইচ্ছে করে এরকম করছিস যাতে আমি উল্টোটা ভাবি।”

আংরিয়া হাত দিয়ে ইশারা করতেই পাশের একটা দরজা খুলে গেলো। চারজন প্রহরী একজন অস্থিচর্মসার লোককে টানতে টানতে নিয়ে এলো। লোকটার মাথায় চুল নেই বললেই চলে, কিন্তু মুখ ভরা দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। গায়ে কাপড় নেই, শুধু কোমরের নিচে একটা ফালি ঝোলানো। গায়ের অসংখ্য কাটাকুটির দাগ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে কি পরিমাণ অত্যাচার সহ্য করা লাগে লোকটার। প্রহরীরা ওকে আংরিয়া আর ক্রিস্টোফারের মাঝে ছুঁড়ে দিলো।

“এই লোকটা আমার টাকা চুরি করার চেষ্টা করেছিলো,” আংরিয়া বললো। “এর শাস্তি কি হওয়া উচিত?”

বন্দী কোঁ কোঁ করে উঠলো। ক্রিস্টোফারের বিরক্ত লাগলো খুব। “যদি আপনার ভাড়ার থেকে চুরি করে তো ওর অবশ্যই মরা উচিত।” বলে ও নিজের তরবারি বের করলো। তরবারির ফলাটার নিখুঁত চেহারা আর স্বর্ণালী ধারটা দেখে ঘর জুড়ে সবাই এবার বিস্ময় ধ্বনি করে উঠলো। “আমি কি আপনার হয়ে কাজটা করে দেবো?”

 “তরবারি নামা,” আংরিয়া বললো। “এতো খুবই সহজ সাজা। আমি এরকম লোকের জন্যে একটা বিশেষ জায়গা বানিয়েছি। পানির ধারে, দুর্গের পাদদেশে। আমি ওখানে একটা লোহার গলবন্ধ ওখানকার পাথরে লাগিয়ে রেখেছি। ঠিক জোয়ারের পানি যতোটা ওঠে সেই জায়গায়। তুই না বললি তুই নাবিক ছিলি?”

প্রশ্নটায় ঘাবড়ে গেলো ক্রিস্টোফার, “একবার মাত্র।”

 “বসন্তকালের জোয়ার কেমন হয় জানিস তো?”

“এক মাসে দুইবার, অমাবস্যা আর পূর্ণিমার সময়। জোয়ারের সময় স্বাভাবিকের চাইতে বেশি পানি উঠে যায়, ভাটার সময় নামেও বেশি দূর।”

আংরিয়া মাথা ঝাঁকালো। “গলবন্ধটা কারো মাথা এমন জায়গায় আটকে রাখে যেখানে বসন্তকালের জোয়ার ছাড়া পানি পৌঁছায় না। যে বাধা থাকবে সে প্রতিদিন একটু একটু করে পানিতে তলিয়ে যেতে থাকবে। আর ওখানকার পাথর ঝিনুক আর শামুকে ভরা। ঢেউয়ের ধাক্কায় ওগুলোর উপর ঘষা খাবে সে। ওগুলোর ধারালো কিনারে লেগে চামড়া ফালাফালা হয়ে যাবে। যখন পানি নেমে যাবে, তখন সূর্যের তাপে ওর গায়ের চামড়া কুঁচকে গিয়ে, পানি শুকিয়ে কাটা জায়গায় শুধু লবণ লেগে থাকবে। লবণ পানি ঢুকবে তার মুখে প্রচণ্ড পিপাসায় কাতর হয়ে থাকবে সে, কিন্তু একটা ফোঁটা খেতে পারবে না। খেলে পেট মোড় দিয়ে উঠবে। যদি পূর্ণিমার মাঝামাঝি একে ওখানে ঝুলিয়ে দেই, তাহলে দুই সপ্তাহের মতো লাগবে পানি এসে একে ডোবাতে। আর যখন ডুবে মরবে, তখন ওকে মরার সুযোগ দেওয়ার জন্যে উল্টো ধন্যবাদ দেবে আমাকে।”

বন্দী লোকটা করুণ সুরে ক্ষমা চাইতে শুরু করলো। একজন প্রহরী এগিয়ে এসে ওর গালে সপাটে একটা চড় বসিয়ে থামিয়ে দিলো। আংরিয়া আর ক্রিস্টোফার একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। দস্যুর চোখের দিকে তাকিয়ে ক্রিস্টোফার শুধু একটা জিনিসই দেখতে পেলো, সেটা হচ্ছে ক্ষমতার অসীম ক্ষুধা। ও জানে না যে আংরিয়াও ওর চোখের আড়ালে একই জিনিস দেখতে পেয়েছে।

“আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাই,” আংরিয়া বললো। “তুই এখানে নিজে থেকেই এসেছিস, আমি আবার তোকে এভাবেই চলে যেতে দেবো। কোনো বাধা ছাড়াই আমার দুর্গ থেকে চলে যেতে পারবি। আর যদি এখানে থেকে আমাকে খুশি করতে পারিস, তাহলে অচিরেই প্রচুর টাকা কামাতে পারবি। কিন্তু যদি আমার সাথে বেঈমানি করিস, তাহলে এমন মূল্য দিতে হবে যে হাঙ্গরেরাও তোর গা থেকে খাওয়ার মতো কিছু খুঁজে পাবে না।”

 ক্রিস্টোফার ইতস্তত করতে লাগলো। আংরিয়া ভাবলো ও বোধহয় ভয় পেয়েছে।

“যদি তোর মনে ভয়ের লেশমাত্র থেকে থাকে তাহলে এখানে কোনো জায়গা হবে না।”

 ক্রিস্টোফারের ওসবের বালাই নেই। ঘরের ভিতরের ধন সম্পদ আর দেয়াল ঝোলানো জিনিসগুলো দেখেই ও বুঝে গিয়েছে যে এটাই ওর জায়গা। ও আংরিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। একজন চাকর এসে ওর সামনে এক বাটি দুধ আর এক থালা ভাত রাখলো। ও ভাতের সাথে দুধ মেখে চেটে পুটে খেয়ে নিয়ে আংরিয়ার শিখিয়ে দেওয়া শপথ বাক্যটা পাঠ করলো।

“আজ থেকে আমি আপনার অন্ন খাবো, আর সবসময় আপনার পায়ের কাছেই থাকবো।”

*

কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই বোষেতে পৌঁছালো টমরা। বন্দরের ঢোকার সময় থেকেই টম তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সব পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। জাহাজের মাস্টার মালাবার পয়েন্টের সাতটা গাছের সোজাসুজি জাহাজ চালাতে লাগলেন। এখানকার প্রবাল প্রাচীর আর চড়াগুলোড় ফাঁক দিয়ে আগানোর জন্যে এটাই সবচে নিরাপদ গতিপথ। টম এর আগে এসব শুধু মানচিত্রেই দেখেছে সাঙ্কেন রক, দ্য ওয়েস্টার, মিডল গ্রাউন্ড। ওগুলো পেরিয়ে ওরা বোম্বের পানিতে চলে এলো। ডুঙ্গারি পাহাড়ের উপরের বিশাল দুৰ্গটার নিচে গিয়ে থেমেছে উপসাগরটা।

 টম ওর জামা, পায়জামা এমনকি মোজাও খুলে ছোট পায়জামা পরে নিলো, যাতে ওকে একজন নাবিকের মতো লাগে। ডাঙায় যাওয়ার সময়, বাকিদের মতো ও-ও দাঁড় বাইলো। অ্যানা আর ফ্রান্সিস পিছনের দিকে মাস্টারের সাথে বসে রইলো। টমের এখানে কেমন যেনো নিজেকে বেপর্দা মনে হতে লাগলো, এমনকি ব্রিঞ্জোয়ানের চাইতেও এখানে ওর নিজেকে বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। এটা গাই-এর এলাকা। কে জানে গভর্নরের বাড়ি থেকে কেউ হয়তো লুকিয়ে লুকিয়ে নজর রাখছে সবদিকে।

আশপাশের ডোবা আর পচা মাছের গন্ধে টমের নাক সুড়সুড় করতে লাগলো। নৌকা পাড়ে ঠেকতেই ও দ্রুত নিজের চেহারা ঢেকে ফেললো। বিকেল বেলা, তাই পানির ধারে তেমন কেউ নেই। কুলি আর খালাসীরা ঘাটের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। জাহাজ ভেড়ার পরেও ওদের মালপত্র নামানোয় খুব বেশি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেলো না।

ফ্রান্সিস, অ্যানা আর মাস্টার কয়েকজন কোম্পানির কর্মচারীর সাথে কথা বলতে লাগলো। গাই কোর্টনীর ভাতিজা আচমকা এখানে এসে উপস্থিত হওয়ায় ওরা যারপরনাই অবাক। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে নিজেদের মধ্যে চিন্তিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি বিনিময় করতে লাগলো ওরা। সবাই ভাবছে যে এই নতুন আগমনে দুর্গের ক্ষমতার ভাগ কিভাবে কোনোদিকে হেলে পড়বে এখন। মুঘল সম্রাটেরা দিল্লিতে যেভাবে রাজ্য চালাতেন, গাই-ও এখানে ঠিক সেভাবেই নিজের সাম্রাজ্য বানিয়ে বসেছে। ওর অধস্তনেরাও তাই সবসময় ওর মেজাজ মর্জি বুঝে চলার চেষ্টা করে।

 কোম্পানির লোকেরা ফ্রান্সিসকে গভর্নরের বাড়িতে নিয়ে গেলো। যখন টম নিশ্চিত হলো যে কেউ খেয়াল করছে না, তখন ও দুর্গের দেয়ালের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সরাইখানাগুলোর দিকে আগালো। ভিতরে লোকজন গিজগিজ করছে। এক কোনায় একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে বসে পড়লো টম। কয়েক মুহূর্ত পরেই মেরিডিউ নামের এক নাবিক এসে উপস্থিত হলো ওখানে। মেরিডিউ হলো কেস্ট্রেল-এর ডুবে যাওয়া আর ব্রিঞ্জোয়ানের অবরোধ দুটোই পার করে বেঁচে যাওয়া মুষ্টিমেয়দের একজন।

“কেউ আপনার পিছু নেয়নি, হুজুর। আমি দুর্গের বাইরে মাস্টার ফ্রান্সিসের জন্যে অপেক্ষা করছি গিয়ে।”

টম মাথা ঝাঁকালো। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই।

*

ফ্রান্সিস দুর্গের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। পিছনে সশব্দে ফটকটা বন্ধ হয়ে যেতেই নিজেকে ফাঁদে আটকা পড়া পশুর মতো মনে হতে লাগলো ওর। সামনের চত্বর, প্রহরীদের থাকার জায়গা, ভাড়ার ঘরে পেরিয়ে গভর্নরের বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়ি বেয়ে যতোই উঠতে লাগলো, ততোই দুশ্চিন্তা আরো ঘনীভূত হতে লাগলো। গভর্নরের বাড়িটা দুর্গের দক্ষিণ পাশে। সোজা বন্দরের দিকে মুখ করা।

আগেই ওর আগমনের খবর পৌঁছে গিয়েছে। ওকে সরাসরি তাই উপরের তলার গভর্নরের অফিসে নিয়ে যাওয়া হলো।

 ফ্রান্সিসের সাথে ওর চাচা গাই-এর আগে কখনোই দেখা হয়নি। হাই উইন্ডের দেয়ালে অবশ্য তার একটা ছবি ঝোলানো ছিলো। কিন্তু সেটা তার বাচ্চাকালের। একটা গোলগাল বাচ্চা একটা কুকুরের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ছেলেটার সাথে এখন বিশাল জানালাগুলোর সামনে বসে থাকা লোকটার কোনো মিলই নেই। লোকটা লম্বা আর একহারা, পরনে সবুজ কোট। এতো নিখুঁতভাবে সেলাই করা যে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। বসা অবস্থাতেও তার চেহারায় গৌরব আর ধূর্ততা দুটোই ফুটে উঠছে। যেনো কোনো বিড়াল ঘুমের ভান করছে। গাই কোর্টনী দেখতে সুপুরুষ, সুঠাম দেহ, মাথা ভর্তি চুল। কিন্তু তবুও চোখের দিকে তাকালে কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছে হবে না। ফ্রান্সিস, গাই-এর চেহারায় তার যমজ ভাই টমের প্রতিচ্ছায়া খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু পেলো না।

 “আলোয় এসে দাঁড়াও, যাতে ভালোমতো দেখতে পারি,” গমগমে গলায় বলে উঠলো গাই। তারপর ও ফ্রান্সিসকে এমন দৃষ্টিতে জরিপ করতে লাগলো যে ফ্রান্সিসের মনে হতে লাগলো ও যেনো বিক্রির জন্যে হাটে ভোলা কোনো পশু। “হুম, তুমি আসলেই বিলির ছেলে। সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আমি তোমার বিরুদ্ধে এ ব্যাপারে কোনো অভিযোগ করবো না।”

ফ্রান্সিসের কিছু বলার সাহস হলো না। বলতে চাইলেও গলা দিয়ে বের হতো কিনা সন্দেহ। ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবির দিকে নজর গেলো ওর। ছবিটা স্যার হাল কোর্টনীর, রাজা চার্লসের আমলের পোশাক গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় পরচুলা, তার উপর পালক লাগানো টুপি। এক হাত অলসভাবে একটা দুর্দান্ত সুন্দর তরবারির হাতলের উপর রাখা। চিত্রকর অসম্ভব দক্ষ হাতে ছবিটা এঁকেছেন। হাতলের নীলাটার প্রতিটা খাঁজ পর্যন্ত স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

গাই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করলো। “ছবিটা পছন্দ হয়েছে?”

“হাই উইন্ডে যখন ছিলো তখন আরো বেশি পছন্দ ছিলো,” ফ্রান্সিস বললো। কোথায় আছে ভুলে গিয়েছে যেন।

 গাই একটা বাঁকা হাসি হাসলো। “চিনতে পেরেছো তাহলে। তোমার সৎ বাবার কাছে থেকে কিনেছিলাম এটা। সে তো আমাকে এটা দিতে পেরেই খুব খুশি। কারণ নগদ টাকার খুবই দরকার ছিলো তার।”

 গাই হাতের পালকের কলমটা নামিয়ে রাখলো। এতোক্ষণ কিছু একটা লিখছিলো সে। “স্বীকার করছি যে আমি বিগত কয়েকমাস ধরে তোমার আসার অপেক্ষা করছি। বর্ষার আগেই আমি তোমাকে কোম্পানির কাজে নিয়োেগ দেওয়া সংক্রান্ত একটা চিঠি পেয়েছি।”

“কেপ টাউনে আটকে পড়েছিলাম আমি।”

গাই ফ্রান্সিসকে জরিপ করলো আবার। ছেলেটা লন্ডন ছাড়ার আগেই চিল্ডস গোপনে ওকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন সব। এটাও জানিয়েছেন যে টম এখনো বহাল তবিয়তে কেপ টাউনে অবস্থান করছে। আর উনি ফ্রান্সিসকে পাঠিয়েছেন টমকে মারতে। খবরটা শোনার পর থেকেই গাই-এর মেজাজ চড়ে আছে। আশা নিরাশার দোলাচালে দুলতে দুলতে বিগত কয়েক মাস পরবর্তী খবরের অপেক্ষায় বসে আছে সে।

“লর্ড চিল্ডস কেপ টাউনে তোমাকে একটা কাজ করতে দিয়েছিলেন বলে শুনেছি,” গাই বললো।

নিজের যমজ ভাইয়ের খুনের কথা কেউ এভাবে সহজভাবে করতে পারে বলে ফ্রান্সিসের ধারণা ছিলো না। দুই ভাইয়ে কি এমন হয়েছিলো সেই চিন্তাটা আবার ফিরে এলো ওর মাথায়।

“জী।”

“তা সেটা কি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে?”

ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকালো।

 “আমি সেরকম কোনো খবর পাইনি।”

“আমরা লাশটা পাহাড়ে লুকিয়ে রেখেছিলাম। শিয়াল আর হায়েনা থাকে ওখানে। ওদেরকে যে আর কেউ চিনতে পারবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পরে আমি এক কান্ট্রি ট্রেডারের জাহাজে উঠি, কিন্তু সেটা ব্রিঞ্জোয়ানের কাছে ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। আমি ওখানকার কুঠিতে আশ্রয় নেই। এরপর কি কি হয়েছে তা তো আপনার জানা।”

“তা তো অবশ্যই।”

“আপনি নিশ্চয়ই জানতেন যে অ্যাগনেস আন্টি, আর তার স্বামী ক্যাপ্টেন হিকস ব্রিঞ্জোয়ানে ছিলেন।”

 “ক্যাপ্টেনের হিকসের মৃত্যু আসলেই বড় একটা আঘাত,” নির্বিকার কণ্ঠে বললো গাই।

“আর-আমি জানিনা আপনি খবরটা পেয়েছেন কিনা-অ্যাগনেস আন্টিকে দস্যু আংরিয়া ধরে নিয়ে গিয়েছে।”

গাই ওর কলমের প্রান্ত দিয়ে নিজের থুতনিতে আঘাত করতে লাগলো। “হ্যাঁ, অনেক আগেই শুনেছি। কয়েক সপ্তাহ আগে আংরিয়ার কাছ থেকে মুক্তিপণের দাবিতে চিঠি পেয়েছি। অ্যাগনেসের সাথে সে ফয়ের বৌ এবং আর একজন মহিলাকেও আটকে রেখেছে। ইনি নাকি ক্যাপ্টেন হিকসের বোন।” গাই-এর ভ্রু কুঁচকে গেলো। “ক্যাপ্টেন হিকসের যে বোন আছে সেটাই জানতাম না আমি।”

“কেপ টাউন থেকে আমি যে জাহাজে আসছিলাম, উনিও সেই জাহাজেই ছিলেন,” ফ্রান্সিস বলে উঠলো তাড়াতাড়ি। গাই-এর সন্দেহ দূর করতে চাইছে। “ডরসেটে থাকতেন উনি। কিন্তু কিছুদিন আগে বিধাব হয়েছেন। তাই ভাইয়ের কাছে সাহায্য নিতে আসছিলেন।”

মিথ্যেয় কাজ হলো। গাই আগ্রহ হারিয়ে ফেললো।

“কিছু মনে না করলে, আংরিয়া মহিলা তিনজনের জন্যে কতো টাকা চেয়েছে, সেটা কি একটু বলা যাবে?” ফ্রান্সিস জানতে চাইলো।

“তিরিশ হাজার রুপি।”

 ফ্রান্সিস হাঁ হয়ে গেলো। “তার মানে পাঁচ হাজার পাউন্ডেরও বেশি।

 “প্রায় ছয় হাজার পাউন্ড,” গাই শুধরে দিলো।

গাই-এর সুস্থির দশা দেখে ফ্রান্সিস আর এক দফা অবাক হলো। “কিভাবে টাকা দেবেন? ওদের সাথে কোনো বন্দোবস্ত হয়েছে?”

“বন্দোবস্ত?” গাই এতো জোরে হেসে উঠলো যেনো বিগত কয়েক মাসে এতো মজার কিছু শোনেনি। “আমি আংরিয়াকে বলে পাঠিয়েছি যে ও আমার কাছে থেকে শুধু মাত্র সীসা পাবে, স্বর্ণ না। কামানের মুখ থেকে ছোঁড়া হবে সেটা।”

“তার মানে আপনি ওর দুর্গ আক্রমণ করতে চাচ্ছেন?”

“আরে নাহ। টিরাকোলা দুর্ভেদ্য একটা দুর্গ। আমরা যদি আক্রমণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই, তাহলে সারা দুনিয়ার সামনে মাথা হেট হয়ে যাবে। বানটাম থেকে জাঞ্জিবার পর্যন্ত সবকয়টা জলদস্যু তখন আর আমাদের এক ফোঁটা ভয় পাবে না। তাতে ব্যবসার যা ক্ষতি হবে তা কোনোদিন আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।”

“তাহলে কি করবেন?”

গাই কিছু না বলে কলমটা এলোমেলো নাড়তে লাগলো। একসময় ফ্রান্সিস এর অর্থ বুঝতে পারলো। “কিন্তু এভাবে ওনাদেরকে ছেড়ে দেবেন? অ্যাগনেস হিকস আমার আন্টি-আপনার শ্যালিকা।”

 গাই ওর দিকে শীতল চোখে তাকালো। “আমাকে আবেগতাড়িত করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমার বৌ গত একমাস ধরে প্রতি রাতে আমার কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে কিছু একটা করার জন্যে। হাত পায়ে ধরতে পর্যন্ত বাদ রাখেনি। শেষে পিটিয়ে ভূত ছাড়িয়েছি। একজন মহিলার পক্ষে ব্যবসার এতো মারপ্যাঁচ বোঝা সম্ভব না, কিন্তু তুমি…” সরু চোখে ফ্রান্সিসকে দেখতে লাগলো গাই। “তুমি এখানে এসেছে আমার আশ্রয়ে থাকতে, কোম্পানির হয়ে কাজ করতে। আমি আশা করবো তুমি অন্তত পরিস্থিতির নাজুকতা বুঝতে পারবে। লর্ড চিল্ডসকে যদি লিখে পাঠাতে হয় যে, তোমার জন্যে আমার এখানে কোনো পদ খালি নেই, তাহলে সেটা আমার জন্যেও সম্মানহানীকর।”

 ফ্রান্সিস উথলে ওঠা রাগটাকে সামলালো। এতে করে ওর কোনো লাভ হবে না। “দুঃখিত, চাচা। আমি আর আপনার উপরে কখনো কিছু বলবো না। আমি এদেশে আসলাম-ই তো কয়েক মাস। তাই এখনো আসলে এখানকার পরিস্থিতির কিছুই ভালোমতো জানি না।”

 “আর এ কয়মাসেই যথেষ্ট ঝড় ঝাঁপটা গেলো তোমার উপর দিয়ে।” গাই নিজের চেয়ারে হেলান দিলো। চোখ অর্ধেক মুদে রেখেছে। “ব্রিঞ্জোয়ানে যে লোকটা একাই দুৰ্গটাকে বাঁচিয়ে দিলো তার সম্পর্কে বলো দেখি। আমি অনেকের কাছ থেকেই খবর পেয়েছি। কিন্তু লোকটা যে আসলে কে সেটা কেউ বলতে পারলো না।”

ফ্রান্সিস জমে গেলো। ঝড় বইতে লাগলো মাথার ভিতর। টমের পরিচয় ফাস না করে গাইকে কি কি বলা যায় সেটা ভাবছে।

“ওনার নাম হচ্ছে টম উইল্ড। কেপ টাউন থেকে যে জাহাজটায় আসছিলাম ওটার মাস্টার ছিলেন উনি। সত্যি কথা হচ্ছে, আমিও খুব বেশি কিছু জানি না ওনার সম্পর্কে। উনি কথাবার্তা খুব কম বলতেন।”

“দুর্গে এতোগুলো মাস আটকে থাকার পরেও? আমিতো ভেবেছিলাম যারা এতোদিন একসাথে একটা অবরোধ কাটিয়ে দিয়েছে, তারা তাদের একান্ত গোপনীয় সব খবরও জেনে ফেলবে।” গাই দুই হাতের আঙুল একসাথে ভাজ করে থুতনি রাখলো তার উপর। “আমি যাদের কাছ থেকে খবর নিয়েছি তারা তো বললো তোমরা নাকি খুব ঘনিষ্ট ছিলে? তুমি বাদে আর কারো উপর নাকি সে অতোটা ভরসা করতো না।”

“সবাই-ই সবার কাজ করেছে।”

 “তুমি নাকি তাকে চাচা ডাকতে?”

“ভুল করেছে ওরা। আমি ক্যাপ্টেন হিকসকে চাচা ডাকতাম। যে বলেছে সে গুলিয়ে ফেলেছে।”

ফ্রান্সিস জোর করে গাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আশা করছে চেহারায় ওর মিথ্যাগুলো ধরা পড়বে না।

“তা এই মিস্টার উইল্ড কি তোমার সাথে বোম্বেতে এসেছেন?”

মিথ্যে বলে লাভ নেই। গাই নিশ্চয়ই এততক্ষণে জাহাজের লোকজনের তালিকাটা দেখেছে। “জ্বী, এসেছেন।”

 “উনি কোথায় থাকবেন সেটা কি বলেছেন তোমাকে?”

“না।”

“সমস্যা নেই,” সন্তুষ্ট দেখালো গাই-কে। “বোষে ছোট একটা জায়গা। তাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। এনার সাথে দেখা করতে পারলে খুব খুশি হবো আমি। একেবারে সমুদ্র থেকে উঠে এসে কোম্পানির ব্যবসা আর সম্মান দুটোই রক্ষ করেছেন। অনেক গল্প করা যাবে ওনার সাথে।”

“ওনার সাথে দেখা হলে, আপনার কথা বলবো তাহলে,” ফ্রান্সিস চলে যাওয়ার ছুতো খুঁজতে লাগলো। “মাফ করবেন চাচা, অনেক লম্বা ভ্রমণ সেরে এসেছি। আমি শহরে থাকার জন্যে জায়গা খুঁজে নেবো।”

গাই এমন ভাব করলো যেনো কষ্ট পেয়েছে খুব। “এসব কি বলো। আমার ভাতিজা তুমি-তাছাড়া যুদ্ধজয়ী বীর। আমার সম্মানিত মেহমান হিসেবে এই বাড়িতেই থাকবে তুমি। আমি নিজে তোমার জন্যে পরে বাসা খুঁজে দেবে। আমার পরিবারের কোনো সদস্যুতো আর যেন তেন জায়গায় থাকতে পারে না

 ফ্রান্সিস ওর আতংক লুকানোর চেষ্টা করলো। “অনেক ধন্যবাদ চাচা,” সংকোচের সাথে বললো ও। “কিন্তু আমি এখানে আসার আগেই একটা সরাইখানায় ঘর নিয়ে নিয়েছি। আমি ওখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে এখুনি চলে আসছি তাহলে।”

“আমি একজনকে পাঠিয়ে তোমার জিনিসপত্র আনানোর ব্যবস্থা করছি,” গাই বললো। তারপর আবার কি ভেবে বললো, “তবে তোমার বয়স কম। আর দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় খুব বিরক্ত নিশ্চয়ই। বোম্বের পথঘাটে একটু ঘোরা ফেরা করে খোলা হাওয়া খেলে খারাপ লাগবে না তোমার।” বলে গাই ফ্রান্সিসের দিকে চোখ টিপলো। ওর ইংগিত ধরতে পেরে শিউরে উঠলো ফ্রান্সিস। “ঠিক আছে, যাও তাহলে। ছয়টায় রাতের খাবার খাই আমরা।”

“তখন আবার দেখা হবে। আসি, চাচা।”

ফ্রান্সিস বিদায় হতেই গাই বেল বাজিয়ে তার একজন কেরানিকে ডাকলো। নীল পোশাক পরা কমবয়সী এক ছেলে উপস্থিত হলো একটু পর। ছেলেটা একেবার তালপাতার সেপাই। মাথায় তেল চপচপ করছে। চেহারায় বসন্তের দাগ। নাম পিটার পিটার্স। গাই জানে যে নিজের পদোন্নতির জন্যে ছেলেটা যে কোনো কিছু করতে রাজি।

“ফ্রান্সিসের পিছু পিছু যাও, আর দেখো ও কোথায় কোথায় যায়,” গাই আদেশ দিলো ওকে। “কার কার সাথে কথা বলে সেটা দেখে এসে জানাবে আমাকে।”

পিটার্স জামার হাতার পিছন দিয়ে মুখ মুছে কুর্নিশ করলো। “অবশ্যই, স্যার।”

“বিশেষ করে ও টম উইল্ড নামের কারো সাথে কথা বলে কিনা সেটা খেয়াল করবে। যদি এই উইল্ড ব্যাটাকে খুঁজে পাও, তাহলে আর ওকে অনুসরণ করার দরকার নেই। সাথ সাথে ও কোথায় আছে সেটা আমাকে এসে জানাবে।”

 পিটার যাওয়ার পর, গাই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বন্দরের জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। একটা মাছি এসে বসলো জানালার আড়কাঠে। ব্রিঞ্জোয়ানের রহস্যময় রক্ষাকর্তার কথা শোনার পর থেকেই গাই-এর মনের ভিতর ভয়ানক একটা চিন্তা ডালপালা ছড়াচ্ছে। আর এখন লোকটা ফ্রান্সিসকে সাথে করে বোম্বেতে চলে আসায় ওর সন্দেহের গোড়ায় জল ঢালা হয়েছে। আরো।

 এতো বছর পর, ওর এতো সাহস হবে এখানে আসার? গাই বেঁচে থাকতে ও কি বোম্বেতে এসে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবে?

হ্যাঁ, বেজার মুখে ভাবলো ও। টম একাধিকবার প্রমাণ করেছে যে গাই এর জিনিস কেড়ে নিতে ওর কোনো লজ্জাবোধ নেই। আর সেজন্যে ওকে যদি দুনিয়া ফুড়ে অন্যপাশেও চলে যেতে হয়, তো ও সেটাই করবে।

আচমকা গাই প্রচন্ত ক্ষিপ্রতায় হাত চালালো। জানালার কাঁচের গায়ে মাছিটা ভর্তা হতে গেলো আঘাতে। হাত ঘুরিয়ে দেখে, সেখানে রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা।

এবার আর তুই পালাতে পারবি না।

*

ফ্রান্সিস বেরিয়ে এসে দেখে মেরিডিউ দুর্গের বাইরে ঘুরঘুর করছে। দুজন মিলে টম যে সরাইটায় বসে ছিলো সেখানে গেলো। ফ্রান্সিসের কাছে থেকে গাই এর সাথে দেখা হওয়ার সব ঘটনা শুনে টমের চেহারায় আধার ঘনিয়ে এলো।

“সারাহের জন্য ও কিছু করবে, সেটা অবশ্য আমি আশাও করিনি,” টম বললো। “কিন্তু অ্যাগনেসের জন্যেও কিছু করবে না? ওর স্বামী কোম্পানির কুঠি বাঁচাতে লড়াই করে মারা গিয়েছে!” অতীতে বহুবারের মতো আরো একবার ওর মনে হলো ও আর গাই কি আসলেই একই সাথে একই মায়ের গর্ভে ছিলো? তাহলে এতো আলাদা হলো কিভাবে ওরা?

 “কিন্তু আমাদের এখানে দেরি করা সম্ভব না,” ফ্রান্সিস বললো। “গাই আপনার সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন করেছে আমাকে আমার মনে হয় উনি সন্দেহ করছেন যে এই টম উইল্ড লোকটা আসলে নিজের আসল পরিচয় দিচ্ছে না।”

 টম হতাশার শব্দ করলো মুখ দিয়ে। “আমার ভালো দেখে একটা ছদ্মনাম নেওয়া উচিত ছিলো। একটা বাচ্চা ছেলেও ধরে ফেলবে ফাঁকটা।”

“আপনি তো আর জানতেন না যে ভাগ্যের ফেরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়াবেন।”

 “কিন্তু এটা তো জানতাম যে গাইয়ের এলাকায় প্রবেশ করছি। ও আমার খবর পাবে না এটা ভেবে নেওয়াটা গাধামি হয়েছে।”

“আমার মনে হয় উনি এখনো এ ব্যাপারে নিশ্চিত না। আমি ওনাকে বলেছি যে আমি আপনাকে কেপ টাউনে খুন করেছি, তবে আমার কথা বিশ্বাস করছেন কিনা জানিনা। উনি কিন্তু ব্রিঞ্জোয়ানের লোকজন আর যে জাহাজে করে এখানে এসেছি সেটার লোকজনের সাথে কথা বলবেন। আর তখন দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে দেরি হবে না।” ফ্রান্সিস ওর পানীয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। “কি করবো এখন আমরা?”

 টম উত্তর দেওয়ার আগেই অ্যানা ঢুকলো ঘরে। পিছনে ঢ্যাঙা এক লোক। কুজো হয়ে হাটছে লোকটা, নাকটা টকটকে লাল হয়ে আছে। অ্যানা টেবিলের পাশে আরো দুটো টুল টেনে আনলো।

 “আমি বাজারে গিয়ে কয়েকজন পরিচিত ব্যবসায়ীর সাথে কথা বললাম,” কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলতে শুরু করলো অ্যানা। “ওরাই আমাকে মিস্টার ব্যারির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।”

ঢ্যাঙা লোকটা সামান্য মাথা ঝোঁকালো। টমের ইশারা পেয়ে ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে আরো দুটো পানীয় নিয়ে এলো।

“অনেক ধন্যবাদ, ব্যারি বললো। তারপর ঢকঢক করে গ্লাসের অর্ধেকটা গলায় ঢেলে দিলো। “এতোক্ষণে শান্তি পেলাম।”

“মিস্টার ব্যারি গভর্নর কোর্টনীর হয়ে কাজ করেন,” ব্যাখ্যা করলো– অ্যানা।

বাকিরা শক্ত হয়ে গেলো। “এনাকে বিশ্বাস করা যায়?” টম জিজ্ঞেস করলো।

 ব্যারি কথাটা গায়ে মাখলো না। “গভর্নর কোর্টনীর জন্য আমার কোনো দরদ নেই। তবে তার টাকা সম্পর্কে দুয়েকটা কথা আমার জানা আছে।”

“সেটা দিয়ে আমাদের কি?” তিক্ত কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস। “আমি আমার চাচাকে দেখেছি। অ্যাগনেস আন্টি বা বাকিদের উদ্ধারের জন্যে আংরিয়াকে একটা শিলিং-ও দেবেন না উনি। স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে দস্যুদের সাথে কোনো মীমাংসায় যাবেন না।”

ব্যারি ওর পানীয় থেকে মুখ তুলে চাইলো। “হাহ, থুতু ফেললো ও একদলা। “গভর্নর কোর্টনী মুখে বলেন যে দস্যুদের সাথে ওনার কোনো লেনদেন নেই। কিন্তু ওনার মুক্তিপণ না দিতে চাওয়ার আসল কারণ এটা।”

“মানে?” জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

ব্যারি ওর গ্লাসের ভিতরে তাকিয়ে রইলো। ওটা ততোক্ষণে খালি হয়ে গিয়েছে। টম ব্যাপারটা ধরতে পেরে নিজের পানীয়টা ওর দিকে ঠেলে দিলো। ব্যারি চোখ টিপলো।

“আমি জেটির পাশে কোম্পানির গুদামের হিসাবরক্ষক ছিলাম। ভালোই কাজ করতাম। ফলে পদোন্নতি হতে দেরি হয়নি। একবার হিসাবের খাতায় আমি কিছু গড়মিল খুঁজে পাই। কিছু জিনিসের দাম মেটানো হয়েছে কিন্তু সেগুলো এসে পৌঁছায়নি। কিছু জিনিসের পাশে ‘হারানো মাল হিসেবে চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমি নিজের চোখে সেগুলোকে দেখেছি। আর একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসেবে আমি তখনি গভর্নর কোর্টনীকে বিষয়টা দেখাই।”

“নিশ্চয়ই সেজন্যে আপনাকে কোনো ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি,” ফ্রান্সিস বললো।

“আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হয়,” ব্যারি টেবিলের সবার দিকে তাকালো। ওদের সহানুভূতি আশা করছে। আমাকে হুমকি দেন যে তিনমাসের মাঝে আমাকে শেষ করে ছাড়বে।”

 “হুম, একেবারে গাই-এর মতই,” টম বললো। “কিন্তু আংরিয়ার সাথে এর সম্পর্ক কি?”

ব্যারি আবার ওর গ্লাসটা তুলে ধরে দেখালো যে ওটা খালি হয়ে গিয়েছে। টম ওখানকার মেয়েটাকে ইশারা করলো। সে এগিয়ে এসে আর এক গ্লাস দিয়ে গেলো। ব্যারি ওটা নিতে গেলো, কিন্তু তার আগেই টম সেটা কেড়ে নিয়ে ব্যারির নাগালের বাইরে সরিয়ে নিয়ে গেলো।

“আগে গাই আর আংরিয়ার ব্যাপারটা বলুন। তারপর চাইলে এতো মদ। কিনে দেবো যে তাতে ডুবে মরতে পারবেন।”

ব্যারি ওর টুলে নড়েচড়ে বসলো। পড়ে যাচ্ছে মনে করে টম একটা হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু ব্যারি তার আগেই আবার সোজা হয়ে গেলো। চেহারায় ধূর্ত একটা ভাব ফুটে উঠেছে।

“আংরিয়া কত চাচ্ছে?” জিজ্ঞেস করলো ব্যারি।

 “তিরিশ হাজার রুপি,” বললো ফ্রান্সিস।

“হাহ!” ব্যারির থুতুর সাথে সাথে টেবিল জুড়ে অ্যালকোহলের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়লো। “তিরিশ হাজার রুপি গাই কোর্টনীর হাতের ময়লা। গভর্নরের বাড়ির নিচে, মানে দুর্গের মাটির নিচের প্রকোষ্ঠে ওনার একটা আলাদা ঘর আছে। ওখানে অনেকগুলো কাঠের সিন্দুক রাখা। প্রতিটাতে কমপক্ষে এক লাখ রুপি করে আছে। এক লাখ বোঝেন তো?” ও সামনে ঝুঁকে এলো। তারপর প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারণ করে বললো, “একশো হাজার রুপি।”

“তাহলে গাই মুক্তিপণ দিচ্ছে না কেন,” হতাশ কণ্ঠে বললো ফ্রান্সিস। “এই কয়টা টাকা ওনার গায়েও লাগবে না।”

 “ওনার হাত থেকে যদি একটা পয়সাও কোথাও পড়ে যায়, সেটার জন্যেও গাই কোর্টনী সাতদিন আফসোস করেন। তবে এখানে ব্যাপার সেটা না। ব্যাপারটা হচ্ছে উনি দস্যুদের বিরুদ্ধে কিছু করেন না, কারণ ওনার যে পরিকল্পনা তাতে আংরিয়া থাকলেই লাভ। এতে করে সাগর পথে ত্রাসের সৃষ্টি

“এটা কোনো কথা হলো। দস্যুরা তো ওদের ব্যবসার জন্যেও হুমকি,” ফ্রান্সিস প্রতিবাদ করলো।

“ইন্ডিয়াম্যানগুলো হচ্ছে সাগরের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে বেশি অস্ত্রসস্ত্র সজ্জিত জাহাজ। আংরিয়া ওগুলোকে ঘাটায় না। তার বদলে ও ইন্টারলোপার বা কান্ট্রি ট্রেডারদের লুট করে।”

 “এভাবে গাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী কমে যায়, আর মালপত্রের দামও যায় বেড়ে?” টম শিষ দিয়ে উঠলো। যদিও ও জানে যে ওর অবাক হওয়া উচিত না। জাহাজ নিয়ে প্রথম যেদিন সমুদ্রে নেমেছিলো, সেদিন থেকেই ও জানে যে ভারত মহাসাগর হচ্ছে পৃথিবীর সবচে দুর্ধর্ষ দস্যুদের বিচরণক্ষেত্র। কয়েক বছর আগেই, হেনরি এভারি নামের এক ইংরেজ, মুঘলদের একটা জাহাজ উদ্ধার করে। জাহাজটা মক্কায় যাচ্ছিলো হজ্ব করতে। প্রচুর সম্পদ ছিলো ওটায়। দস্যুরা তিনদিন ধরে লুট করে জাহাজটা। লুটের মাল আর কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, গাই নিজেও ঐ দস্যুগুলোর চাইতে কোনো অংশেই কম নির্মম না।

 ব্যারি টেবিলে আঙুল দিয়ে তবলা বাজাতে বাজাতে বললো, “এ-তো ঘটনার অর্ধেক। শাহুজি-র কথা শুনেছেন?”

টমার ফ্রান্সিস মাথা নাড়লো।

“শাহুজি হচ্ছে সাতারা-র রাজা। মারাঠাদের রাজা আরকি,” অ্যানা বললো। “বিগত তিরিশ বছর ধরে ওরা মুঘলদের বিরুদ্ধে স্বাধীন হবার জন্যে যুদ্ধ করছে। নিজেদের আলাদা সাম্রাজ্য গড়তে চায় ওরা।”

“কিন্তু তাতে গাই চাচার কি?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“মালাবার উপকূলের বেশিরভাগ বন্দর শাহুজির নিয়ন্ত্রণে,” ব্যারি বলল। “আর বন্দর থেকে যে রাস্তাগুলো বেরিয়েছে সেগুলোও ওনার দখলে বলে কোর্টনী ওনার সাথে একটা মধ্যস্ততায় আসতে চান। মানে ওনার মালামালের জন্যে নিরাপত্তা আর বন্দরে যে রাজস্ব দেওয়া লাগে সেটা একটু যাতে রাখেন সে ব্যাপারে একটা চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। আর শাহুজির জন্য হচ্ছে আংরিয়া। গাই ভেবেছিলেন যে শাহুজির সাথে করা চুক্তির খাতিরে আংরিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, কিন্তু যেহেতু কোনো চুক্তি হয়নি, আংরিয়ার দস্যুতার কারণে শাহুজি আরো দুর্বল হচ্ছেন আর গাইয়ের শক্তি বাড়ছে।”

টম এই এলাকার গোলকধাঁধাতুল্য রাজনীতির কিছুটা অবস্থা টের গেলেন সন্দেহ নেই গাই একজন সুদক্ষ খেলোয়াড়। সারা উপমহাদেশ জুড়ে ওরা বিস্তৃত করে রেখেছে। এখন সুতোর টানে একজনের বিরুদ্ধে আর একজন খেলিয়ে খেলিয়ে নিজের আখের গোছাচ্ছে। কিন্তু টমের কাছে এসব ব্যাখ্যা কোনো গুরুত্ব নেই।

“এসব ফরমান, রাজা, মুঘলদের ব্যাপার স্যাপারে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই,” ও বললো। “আমাদের মাথা ব্যথা শুধু সারাহ আর অ্যাগনেসকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় সেটা নিয়ে।”

 “কিন্তু কিভাবে?” ব্যারি বললো। “আপনারা তো মাদ্রাজ থেকে এসেছেন। দুৰ্গটা দেখেছেন না? ওটা একেবারে দুর্ভেদ্য।”

“আমি ওটাকে দখল করতে চাই না। আংরিয়া ব্যবসায়ী লোক। তিরিশ হাজার রুপি মুক্তিপণ দিয়েই ওদেরকে ছাড়িয়ে আনবো।”

ফ্রান্সিস হতাশায় টেবিলের উপর ঘুষি বসালো একটা। ওটার উপরের থালাবাটিও সব ঝনঝনিয়ে উঠলো। “কিন্তু আমাদেরতো অতো টাকা নেই। এতো কথা বলেও আমরা ঘুরে ফিরে সেই বটের তলাতেই ফিরে এলাম।

 টম দাঁত বের করে হাসলো। রক্তের মধ্যে পরিচিত এক শয়তান হাতছানি শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখন জানি গাই কোথায় টাকা রাখে।

বাকিরা ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। “মানে আপনি ওনার সিন্দুক ড করতে চাচ্ছেন?” ধীরে ধীরে বললো অ্যানা।

 “আংরিয়ার দুর্গে ঢোকার চাইতে গাই-এর সিন্দুক ঘরে ঢোকা কিন্তু হবে না,” ব্যারি সতর্ক করলো। “ওখানের চাবি মাত্র একটা। আর সেটাকে নিজের অফিসে লুকিয়ে রাখে।”

“কিন্তু আমরা আংরিয়ার দুর্গটা না চিনলেও গাই-এর দুর্গে ঢুকতে পারবে একজন আমাদের সাথে আছে,” টম ফ্রান্সিসের দিকে ফিরলো। “বাকি লোকজন যারা আছে তাদের সবাইকে ঘাটের কাছে জড়ো করো। গাইকে এবার নিজের পরিবারকে সহায়তা করার শিক্ষা দিতে হবে।”

ওর আত্মবিশ্বাস সবার মাঝেই সঞ্চারিত হলো। খুশি মনে সরাই থেকে বেরিয়ে গেলো সবাই। করার মতো একটা কাজ পেয়েছে অনেকদিন পর। ফ্রান্সিস আর মেরিডীউ বাকিদের খুঁজতে চলে গেলো। কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া আরও চারজন লোক ওদের সাথে বোম্বে এসেছে। ব্যারি, অ্যানা আর টমকে অস্ত্রপাতি আর অন্যান্য দরকারি জিনিসপত্র জোগাড় করে দিতে পারবে এমন একজনের কাছে নিয়ে গেলো। ভালোয় ভালোয় হয়তো ওরা সিন্দুক ঘরে ঢুকতে পারবে কিন্তু কোনো ঝামেলা ছাড়াই বেরিয়ে আসতে পেরবে তেমনটা মনে করে না টম।

 এতো খুশির মাঝে কেউ খেয়ালই করলো না যে মুখে বসন্তের দাগওয়ালা একটা ছেলে সরাইখানার এক কোনায় অনেকক্ষণ যাবত বসে আছে। সে ওদেরকে বেরিয়ে যেতে দেখলো। তারপর নিজেও ত্রস্ত গতিতে বেরিয়ে গেলো।

*

ছয়টা বাজার কিছু আগে ফ্রান্সিস ধীর পায়ে দুর্গে এসে ঢুকলো। রাত নামতে শুরু করেছে। ফটকের প্রহরীরা খটাশ করে স্যলুট ঠুকলো ওকে। ওদের চোখে ভয় দেখতে পেলো ফ্রান্সিস। এর মাঝেই সবাই জেনে গিয়েছে যে ও গাই-এর ভাতিজা।

ও আগাতেই পিছনে ফটক বন্ধ হয়ে গেলো। চত্বরের অর্ধেকটা পেরিয়ে, ফ্রান্সিস আচমকা দিক বদলে পাশের একটা ছোট ভাড়ার ঘরে ঢুকে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরে সেখান থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে আবার ফটকের দিকে এগিয়ে গেলো।

“ভুলে পানশালায় আমার টাকার ব্যাগটা ফেলে এসেছি,” হড়বড় করে বললো ও। বিব্রত হওয়ার ভান করছে। “গাই চাচা জানতে পারলে খুব রাগ করবেন।”

সিপাহীরা আবার দরজা খুলে দিলো। ওটা পুরোপুরি খুলতেই ফ্রান্সিস অর্ধেক ঘুরে কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিলো।

“আরে আরে একি,” আর্তনাদ করে উঠলো ফ্রান্সিস।

চমকে উঠে ফিরে তাকালো সিপাহীরা। ভাড়ার ঘরটা থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করেছে। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছে আগুনের লকলকে জিভ।

“আগুন!” চেঁচিয়ে উঠলো ফ্রান্সিস। বাকিরাও এবার খেয়াল করলো সেটা। এর মধ্যেই চতুরের ওদিক থেকে আতংকিত চিৎকার ভেসে আসতে শুরু করেছে। পানির বালতি আনতে ছোটাছুটি শুরু করেছে লোকজন।

এই হৈ হট্টগোলের মাঝে খোলা ফটক দিয়ে চুপিসারে ঢুকে পড়া লোক তিনজনের দিকে খেয়াল করলো না কেউ। টম, ব্যারি আর মেরিডিউ ফ্রান্সিসের পিছু পিছু গভর্নরের বাড়ির ভিতরে চলে এলো। কেউ আটকালো না ওদের। বারান্দা থেকেই ফ্রান্সিস খেয়াল করলো চাকরেরা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশংকায় খাবার ঘরের রূপার বাসনপত্রসহ দামী সব জিনিসপত্র সরানোর কাজে ব্যস্ত।

ফ্রান্সিস পথ দেখিয়ে বিশাল সিঁড়িটা ধরে তিনতলায় নিয়ে এলো সবাইকে। তারপর স্বল্প আলোকিত বারান্দা ধরে গাই-এর অফিসে এসে উপস্থিত হলো। ফ্রান্সিস ভেবেছিলো যে ভবনের সবাই আগুন দেখতে চলে যাবে। কিন্তু ওকে হতাশ হতে হলো। একজন সিপাহী মাস্কেট কাঁধে অফিসের দরজায় পাহারা দিচ্ছে।

“হচ্ছেটা কি?” প্রহরী জানতে চাইলোর ও বাইরে থেকে চেঁচামেচি শুনতে পেয়েছে কিন্তু জায়গা ছেড়ে নড়ে কি হয়েছে দেখতে যাওয়ার সাহস হয়নি।

 ‘আগুন,” সংক্ষেপে বললো ফ্রান্সিস। “গভর্নর কোর্টনী আমাকে পাঠিয়েছেন তার অফিসের কাগজপত্র ঠিক আছে কিনা দেখতে।” বলে নিজের চেহারা দেখাতে আলোয় এসে দাঁড়ালো ও। “আমি ওনার ভাতিজা ফ্রান্সিস কোর্টনী।”

 ওদের পারিবারিক নামটা আবারও জাদুমন্ত্রের মতো কাজ করলো। প্রহরী একদিকে সরে যেতে গিয়েও থেমে গেলো আবার।

 “এনারা কারা?” টম আর মেরিডিউ-এর দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলো লোকটা। “আমিতো এদেরকে চিনলাম না।”

“টম উইল্ড। ব্রিঞ্জোয়ান বিজয়ের নায়ক।”

প্রহরী নড়লো না। “গভর্নর কোর্টনীতে আমাকে ওনার কথা কিছু বলেননি।” ও ব্যারির দিকে এক ঝলক তাকালো। নিজেকে অন্যদের আড়ালে লুকানোর চেষ্টা করছে সে। তারপর মাস্কেটের নল ফ্রান্সিসের দিকে সোজা করে বললো। “আমি আপনাকে ঢুকতে দিতে পারবো না।”

ফ্রান্সিস নড়লো না। আমার কাছে চাচার পাঠানো চিরকুট আছে। এটা দেখলেই সব বুঝবেন।” বলে ও নিজের কোট খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিলো। প্রহরী দেখার জন্যে ঝুঁকে এলো সামনে।

কোটের আড়ালে ফ্রান্সিসের হাত ঢাকা ছিলো, তাই ঘুষিটা দেখতে পেলো না প্রহরী। চোয়ালে ঘুষিটা লাগতেই ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে গেলো সে। আবার উঠে দাঁড়ানোর আগেই টম এগিয়ে এসে আর একটা প্রচণ্ড আঘাতে ওকে মেঝেতে শুইয়ে দিলো।

 “ভালো বুদ্ধি দেখিয়েছো,” টম অজ্ঞান প্রহরীটাকে পেরিয়ে এসে দরজার উপর হাত রাখলো। নিচে চাকরদের ইতস্তত ছোটাছুটির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। গাই-এর দামি জিনিসপত্র সরানোতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মাঝে সত্যি সত্যি কারো অফিসটা দেখে যাওয়ার কথা খেয়াল হবে।

কিন্তু তবুও টম ইতস্তত করতে লাগলো। যদি গাই এখনো অফিসে থেকে থাকে? হয়তো মরিয়া হয়ে ওর দরকারি কাগজপত্র গোছাচ্ছে। ওরা মুখোমুখি হয়ে গেলে ও কি করবে?

একটা পুরনো স্মৃতি ওর মনে দোলা দিয়ে গেলো। গত যে দুই বার তোমাদের দেখা হয়েছে, ও তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। তৃতীয়বার দেখা হলে নিশ্চিত থাকতে পারো যে তোমাদের কেউ একজন মারা পড়বে।

ও হাতলটা চেপে ধরে দরজায় ঠেলা দিলো।

ঘরটা খালি। টম এতো খুশি হলো যে বলার না, কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় নেই।

“গাই ওর সিন্দুকের ঘরের চাবি এখানেই কোথাও রাখে। তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করতে হবে সেটা।”

ওরা বিশাল ঘরটার একেক দিকে ছড়িয়ে পড়লো। টম গাই-এর ডেস্কের দিকে আগাতে গিয়ে থেমে গেলো। দেয়ালে স্যার হাল কোর্টনীর ছবি দেখে যেনো সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে।

“বাবা,” বিড়বিড় করলো ও। হাল প্রায় বিশ বছর আগে মারা গিয়েছেন। কিন্তু এখানে এভাবে আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে দেখে টমের মাঝে আবারও হারানোর বেদনাটা ফিরে এলো। “এটা তো ছিলো…”

“হাই উইন্ডে, ফ্রান্সিস বললো।

টম ছবিটার নেপচুন তরবারিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আঁকা ছবি থেকেও নীলাটার দ্যুতি বের হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। হতাশা দলা পাকিয়ে উঠলো ওর ভিতর। ওর উত্তরাধিকার ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। সারাহকে উদ্ধার করেই ও আবার ব্রিঞ্জোয়ানে ফিরে যাবে। তারপর যে তরবারিটা চুরি করেছে তাকে খুঁজে বের করবে।

কিন্তু সেসব নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। চিন্তাটাকে সরিয়ে রাখলো ও ফ্রান্সিস ততোক্ষণে গাই-এর ডেস্ক খুঁজে দেখা শুরু করেছে। নিজের ছুরিটা দিয়ে চাড় দিয়ে ডেস্কের ড্রয়ারগুলো খুলে দেখছে। ভিতরের কাগজপত্র ছিটিয়ে পড়ছে মেঝেতে। “চাবিটা এখানেই কোথাও আছে।”

ব্যারি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। “আর বেশি সময় নাই। আগুন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে ওরা।”

 টম শুনতে পেলো কথাটা। ও জানে দ্রুত করতে হবে সব। কিন্তু ছবিটা যেনো সম্মোহিত করে রেখেছে ওকে। গাই-এর অফিসে তরবারি সমেত ওর বাবার ছবিটা এতো এতো স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে যে ওর মাথা ঘুরতে শুরু করলো।

কিন্তু দেরি করার সুযোগ নেই। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ও ছবিটা থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। তাতেই একটা জিনিস চোখে পড়লো। ও ছবিটার দিকে এগিয়ে সোনার পাত বসানো ফ্রেমটার চারপাশে হাত বুলাতে লাগলো। একটু পরেই কাঠের উপরে দুটো শক্ত স্ফীতি হাতে বাধলো ওর।

“কবজা,” অবাক হলো টম। ও ছবির পিছনে নিজের ছুরিটা ঢুকিয়ে দিলো। দেয়াল বরাবর খানিকটা উঠতেই, কিছু একটায় আটকে গেলো ছুরির ফলাটা।

 “এখানে নিশ্চিত কোনো ধরনের তালা আছে।” টম ছুরিটা ঝাঁকি দিয়ে, মুচড়িয়ে ফলাটা ছোটানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

কট করে শব্দ করে খুলে গেলে কিছু একটা। ছুরির ফলাটা ঝনাৎ করে মেঝেতে গিয়ে পড়লো সাথে সাথে। ওর পা থেকে মাত্র এক ইঞ্চি দূরে।

ফ্রান্সিস ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো। “খোলে না?” জিজ্ঞেস করলো ও।

টম ওকে ওর ছুরির ভাঙ্গা ফলাটা দেখালো। “তালাটা খুবই শক্ত।”

 ফাঁকটায় নিজের আঙুল ঢোকানোর চেষ্টা করলো ফ্রান্সিস। কিন্তু ঢুকলো না। একটু পিছিয়ে আবার ফ্রেমটা পরীক্ষা করে দেখলো ও।

 “পেন-নাইফ বা লেটার ওপেনারের মতো কিছু পেয়েছো?” মেরিডিউকে জিজ্ঞেস করলো টম।

কিন্তু জবাব পাওয়ার আগেই ফ্রান্সিস সামনে এগিয়ে, ফ্রেমের স্বর্ণের বাধাইয়ের একটা অংশ জোরে চেপে ধরে অর্ধ বৃত্তাকারে মোচড় দিলো। শোনা যায় না এমন একটা শব্দ করে ফ্রেমটা নিচের দিকে খুলে গেলো।

টম প্রশংসার চোখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকালো। “সাবাস।”

ওরা সবাই জড়ো হলো ওখানে। ছবিটার পেছনে দেওয়ালে একটা খুপরি দেখা যাচ্ছে। হিসাবের খাতাপত্র আর কাগজে ঠাসা। টম ওগুলো বের করে ‘ ব্যারি আর ফ্রান্সিসের হাতে দিলো।

ব্যারি একটা খাতার পাতা উল্টালো। “এগুল সব গাই-এর গোপন আয়ের হিসাবপত্র,” অবাক হয়ে বললো ও। “লেডেনহল স্ট্রিটের চোখ এড়িয়ে শুধু নিজের লাভের জন্যে যেসব লেনদেন করেছেন তার সবই আছে এখানে।”

 “আরে রাখো ওগুলো,” উত্তেজিত স্বরে বললো টম। “যা খুঁজছি সেটা সম্ভবত পেয়ে গিয়েছি।” একটা পিতলের চাবি তুলে ধরলো ও। অনেকগুলো দাঁত ওটায়, নিশ্চিত কোনো জটিল তালার চাৰি। “এখন গোপন ঘরটা খুঁজে বের করতে হবে।”

“আমি পারবো সেটা,” ব্যারি বললো। “শুধু একবার প্রহরীগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে পার হতে পারলেই হবে।”

বাইরের লোকজনের আওয়াজ শুনেই টম বুঝলো আগুন নিভে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রহরীরা যার যার জায়গায় ফিরে যাবে। টম কোমরে হাত দিয়ে পিস্তলটা স্পর্শ করলো। আশা করছে এটা ব্যবহার করতে হবে না।

“আমাদেরকে হয়তো-”।

কথা শেষ করার আগেই অফিসের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেলো। বোম্বে আর্মির লাল কোট আর সবুজ বেল্ট পরা প্রায় এক ডজন সৈন্য প্রবেশ করলো ঘরের ভেতর। কেউ কিছু করার আগেই সৈন্যরা দরজার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে হাতের মাস্কেট টম আর ওর সঙ্গীদের দিকে তাক করে ধরলো।

“এক চুল নড়বে না কেউ,” দলের সার্জেন্ট আদেশ করলো। “গভর্নর কোর্টনী আসার আগ পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।”

চারজনের কেউই জায়গা থেকে নড়লো না। সিপাহীদের দিকে তাকিয়ে টম বুঝলো যে এরা আগুন নেভাতে যায়নি। পোশাক বা ঝকঝকে সাদা বুকের বেল্ট-এ কোমো কালি ঝুলি লেগে নেই বা চেহারায় তাড়াহুড়া করে আসার চিহ্ন নেই, এমনকি ওদেরকে দেখে অবাকও হয়নি। যেনো ওরা ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলো।

টমের মেরুদণ্ড বেয়ে হতাশা ছড়িয়ে পড়লো। ব্যারির দিকে তাকালো ও।

“আপনি কি আমাদের সাথে বেঈমানি করেছেন?”

কিন্তু ব্যারির ভীতসন্ত্রস্ত চেহারাটা দেখেই বুঝলো যে কথাটা সত্যি না। ব্যারিও বাকিদের মতোই প্রচণ্ড অবাক হয়েছে। বরং ওকে দেখেই মনে হচ্ছে। সবচে বেশি ভয় পাচ্ছে।

 এখন অবশ্য এসব কোনো ব্যাপার না। গাই যেভাবেই খবর পাক না। কেনো, ওরা ওর ফাঁদে আটকে গিয়েছে। আর গাই আসছে।

 টম পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। কোমরের পিছনে হাতটা নিতেই পায়জামার ফাঁকে গুঁজে রাখা পিস্তলটার স্পর্শ পেলো।

“নড়বে না,” ধমকে উঠলো সার্জেন্ট। তার প্রর উপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। গাই আসার আগে একান্ত বাধ্য না হলে ও গুলি করার সাহস করবে না। টম আরো এক পা পিছিয়ে গেলো।

 বাকিরাও ওর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে পিছিয়ে গেলো এক পা। সার্জেন্ট অগ্নি দৃষ্টিতে ওদের সবার দিকে তাকাতে লাগলো। “আর এক ইঞ্চিও যদি পিছন তাহলে কিন্তু আমি গুলি করার আদেশ দেবো। গভর্নর কোর্টনীর কথা মানার দরকার মনে করবো না।”

টম সার্জেন্টের চোখে চোখে চেয়ে রইলো। তারপর আরও এক পা পিছিয়ে গেলো। গাই-এর ডেস্কের পেছনে চলে এসেছে ও। একদম পিছনের জানালার সামনে। সার্জেন্ট ব্যাপারটা দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলো, কারণ পিছনে আর যাওয়ার জায়গা নেই।

“গভর্নর কোর্টনী আপনাদের মতো লোকের জন্যে কয়েদখানায় আলাদা একটা ঘর বানিয়েছেন,” টমকে বললো সার্জেন্ট। “আর ওখানে একবার গেলে এমন অবস্থা হবে যে গভর্নর গাই আদেশ দিলে নিজের গু-ও চেটে পরিষ্কার করবেন।”

দরজার বাইরে সিঁড়িতে একটা ভারী পদশব্দ পাওয়া গেলো। সিপাহীরা সোজা হয়ে হাতের মাস্কেট আরো সোজা করে তাক করে ধরলো।

“ওরা আর এক মুহূর্ত পরেই গুলি করবে,” টম ওর সঙ্গীদের বললো। “প্রস্তুত হও।”

“শয়তানের চেহারা আজ দেখবেন,” খেঁকিয়ে উঠলো সার্জেন্ট। “এতো আরামের মৃত্যু আপনাদের কপালে নেই।”

পদশব্দ সিঁড়ির উপরে এসে পৌঁছালো।

টম বাকিদের দিকে তাকালো। ও যা করতে যাচ্ছে তা পাগলামি ছাড়া কিছু না। কিন্তু এটাই ওদের একমাত্র আশা। যদি গাই-এর হাতে ধরা পড়ে, তাহলে গাই সারাজীবন ধরে বয়ে বেড়ানো ঘৃণার শোধ তুলবে। বিশেষ করে টমের উপরে। আর সবচে খারাপ হলো, সারাহ আর অ্যাগনেসকে উদ্ধারের আর কোনো আশা-ই থাকবে না। তবে যদি গাই টের পায় ওরা আসলে কারা, তাহলে হয়তো মুক্তিপণ দিয়ে ওদেরকে ছাড়িয়ে আনবে, তবে সেটা সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র টমের উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানোর জন্যে।

গাইকে খুন করবো না আমি, টম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো। বিলির সাথে যে ভুল করেছি সেটা এবার করবো না।

দরজার কাছে চলে এলো পদশব্দ। একজন ওজনদার লোকের টানা পদক্ষেপ। বোঝাই যাচ্ছে যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। নিজের বিজয় তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে ও, মনে মনে ভাবলো টম। ও কোমর থেকে পিস্তলটা ছুটিয়ে আনলো, চেষ্টা করছে সেটা যাতে কারো চোখে না পড়ে। একটা মাত্র গুলি করার সুযোগ পাবে সে।

“ওরা সবাই-ই আছে এখানে?” বারান্দা ধরে গাই-এর গমগমে গলাটা শোনা গেলো। “অনেকদিন ধরে এই দিনটার অপেক্ষে করছি আমি।”

গাই-এর গলা শুনে টমের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠলো। শেষবার যখন গলাটা শুনেছিলো, তখন ও সারাহকে নিয়ে একটা ছোট ফেলুক্কা নৌকার করে জাঞ্জিবার থেকে পালাচ্ছিলো। গাই-এর প্রায় একশো লোক ওদের দিকে গুলিবর্ষণ করছিলো তখন। গাই-এর শেষ কথাগুলো এখনো ওর মাথায় গেঁথে আছে।

একদিন না একদিন সুদে আসলে সব মেটাতে হবে দেখিস। সব আদায় করে ছাড়বো আমি। কসম।

“আমি দুঃখিত,” টম বললো। বলেই কেউ কিছু বোঝার আগে ও পিস্তল তুলে সার্জেন্টের হৃৎপিণ্ড বরাবর গুলি করলো।

এর প্রতিক্রিয়াও হলো সাথে সাথেই। সিপাহীরা এমনিতেই টানটান অবস্থায় ছিলো। গুলির শব্দ কানে যাওয়া মাত্র চিন্তা ভাবনা ছাড়াই সবগুলো মাস্কেট গর্জে উঠলো একসাথে।

টম এরকমটাই আশা করেছিলো। গুলি করতে করতেই তাই ডেস্কের পেছনে বসে পড়লো ও। সাথে সাথেই মাথার উপর দিয়ে মাস্কেটের গুলিগুলো উড়ে গেলো। কান ফাটানো গুলির শব্দের সাথে যোগ হলো কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। উপসাগরের দিকে মুখ করে থাকা সবগুলো জানালার কাঁচ ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছে।

ঘরটা ধোঁয়ায় ভরে গেলো। টম চিৎকার করে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে ডাকলো। কিন্তু গুলির শব্দে কানে তালা লেগে থাকায় নিজের আওয়াজ নিজের কানেই পৌঁছালো না ওর। ধোয়া ভেদ করে একটা অবয়ব এগিয়ে এলো–ফ্রান্সিস–চেহারায় একটা কাঁচ ছিটকে লেগে কেটে রক্ত বের হচ্ছে, এর বেশি কিছু হয়নি। মেরিডিউকেও দেখা গেলো পেছনে।

 টম জানালার দিকে দেখালো। তারপর ওটার দিকে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিলো নিচে। জানালা দিয়ে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে শরীরকে ঘুরিয়ে নিলো যাতে পিঠ থাকে বাইরের দিকে। ভেঙে থাকা কাঁচের টুকরোয় টান লেগে ওর জামা ছিঁড়ে গেলো। তবে সেটা মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যেই। জড়তার কারণে সহজেই জানালা পেরিয়ে বাইরের বাতাসে গিয়ে পড়লো টম।

সেদিন সকালে যখন ওদের জাহাজটা বন্দরে ভিড়ছিলো, তখনই টম দুর্গের চারপাশটা খুব ভালো করে খুটিয়ে দেখে নিয়েছিলো। সেই পর্যবেক্ষণ কাজে দিয়েছে। ও তখনই বন্দরের দিকে মুখ করে থাকা জানালাগুলো খেয়াল করেছিলো। আর ধরেই নিয়েছিলো যে গাইয়ের অফিসটাও নিশ্চয়ই এমন কোথাও হবে যেখান থেকে ও বন্দরের জাহাজের দিকে চোখ রাখতে পারবে। জানালা আর বন্দরের মাঝে আছে দুর্গের দেয়াল। গাইয়ের দৃষ্টি যাতে বাধা না পড়ে তাই দেয়ালটা উচ্চতায় তিনতলার চাইতে ছোট। আর সেটা এই জানালাগুলোর কড়িকাঠের ঠিক নিচেই এসে শেষ হয়েছে।

 দেয়ালের উপর গিয়ে পড়তেই একরাশ ভাঙা কাঁচের টুকরো ঝরে পড়লো টমের উপর। ও উঠে দাঁড়াতে গেলো, কিন্তু সাথে সাথেই ফ্রান্সিস উপর থেকে ওর গায়ে এসে পড়ায় আবার পড়ে গেলো। মেরিডিউ পড়লো ওদের পাশে।

“ব্যারি?” টম ঠোঁট নেড়ে জিজ্ঞেস করলো। ফ্রান্সিস গলা বরাবর বুড়ো আঙুল দিয়ে টান দিলো। ব্যারি মাথা নামাতে এক মুহূর্ত দেরি করে ফেলেছিলো। ফলে চড়া মূল্যই দিতে হয়েছে।

টম উপরে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে ধোয়া কেটে গিয়েছে; সেখান থেকে প্রথমে চিৎকার শুনতে পেলো। তারপর গুলির আওয়াজ। আদেশ দেওয়ার জন্যে সার্জেন্ট না থাকায় সিপাহীরা সম্ভবত এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়ছে, আধারে নিজেদেরকেই মারছে কিনা কে জানে। তবে বেশিক্ষণ এই দশা থাকবে না। টম দেয়ালের গায়ে একটা সিঁড়ি বা মইয়ের আশায় এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো।

ওরা ফাঁদে আটকে পড়েছে। নিজের গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে, জানালার নিচ থেকে কোনো প্রহরী ওর কথা শুনে ফেলার ভয়ে গাই দুই দিকের দেয়ালেই কোনো ফাঁক রাখেনি। এখান থেকে নামার কোনো রাস্তা নেই।

উপর থেকে গাই-এর গলা ভেসে এলো। আদেশ করছে কিছু একটা। সিপাহীরা জানালার ধারে এসে নিচে তাকালেই দেখতে পাবে টম আর ওর সঙ্গীরা একটা ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতোই অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“পানিতে ঝাঁপ দাও,” আদেশ দিলো টম। “আর কোনো উপায় নেই।”

টম দেয়ালের কামান বসানোর ছিদ্র পথে নেমে পড়লো। নিচেই দুর্গ আর সাগরের মিলনস্থলে সাদা ফেনায়িত ঢেউ আছড়ে পড়ছে পাথরে। ও জানে না পানির নিচে কি আছে। কতো দ্রুত-ইবা ওরা নিচে পড়বে?

“থামো বলছি,” জানালা থেকে চিৎকার করে বললো কেউ। টম তাকিয়েও দেখলো না। জানে লোকটা কে। ও গুঁড়ি মেরে গর্তটায় বসে দু পাশের দেয়াল আঁকড়ে ধরলো, তারপর পুরো শরীর টানটান করে দিলো লাফ। দেয়াল থেকে যতো দূরে সম্ভব সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

যেনো অনন্তকাল পর নিচে পড়লো ও। পানিতে পড়া মাত্র লাথি মেরে আর হাত ছুঁড়ে উপর ওঠার চেষ্টা করতে লাগলো। কোনো ডুবো পাথরে লেগে হাত পা ভেঙে যায় কিনা সেই ভয় করছে। অক্ষত অবস্থাতেই পানির উপরে ভেসে উঠলো ও। মাথা তুলতেই ফ্রান্সিস এসে পড়লো পাশে।

মেরিডিউ এলে এরপর। ভাগ্যক্রমে ও খুব দক্ষ সাঁতারু। তারপর তিনজনই দ্রুত পা ছুঁড়ে সাগরের গভীরের দিকে এগিয়ে গেলো। খুব দ্রুত নেমে এসেছে রাত, এখনই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ফলে উপরের প্রহরীরা ওদেরকে আর দেখতে পেলো না। থেকে থেকে মাস্কেটের গুলির শব্দ শোনা যেতে লাগলো, কিন্তুওদের ধারে কাছেও এলো না কোনোটাই।

টম সামনে কোথাও নৌকায় বাধা দাড়ের ক্যাচকোচ শব্দ শুনতে পেলো। যতোটা সম্ভব পানি থেকে মাথা তুলে স্প্যানিশ লেডিস’ গানটার সুরে শিষ বাজালো ও।

অন্ধকার ফুড়ে আনার গলা শোনা গেলো। “কি হয়েছে? আহত হয়েছেন নাকি?”

ওর কণ্ঠ টমের কানে মধু বর্ষণ করলো। পরিকল্পনা মোতাবেক, অ্যানা আর কেস্ট্রেল-এর বেঁচে যাওয়া বাকিদের একটা নৌকা নিয়ে বন্দরে অপেক্ষা করার কথা ছিলো। টমরা সিন্দুকের ঘর থেকে স্বর্ণ চুরি করে সংকেত দিলেই নৌকা নিয়ে ওরা দুর্গের দেয়ালের সমুদ্রমুখী দরজাটায় চলে আসতো। তারপর পালিয়ে যেতো। কিন্তু গুলির শব্দ শুনতে পেয়ে অ্যানা নৌকা এগিয়ে নিয়ে। এসেছে।

অ্যানা নৌকাটা ওদের দিকে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে এলো। আগে ফ্রান্সিস আর মেরিডিউকে উঠে যেতে দিলো টম, তারপর নিজেকে টেনে তুললো। “গাই জানতো যে আমরা আসবো।”

“ব্যারি কি বেঈমানি করেছে নাকি?” অ্যানা জিজ্ঞেস করলো।

“যদি করেও থাকে তাহলে জীবন দিয়ে তার দাম চুকিয়েছে।” টম মাথা ঝাঁকিয়ে কানে ঢোকা পানি বের করে দিলো। “তবে আমার সেরকম মনে হয় না। আসলে আমাদের এটা ভাবাই গাধামি হয়েছে যে আমরা বোম্বেতে এসে গাই-এর নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াবো আর ও কিছুই টের পাবে না।”

 টম ফিরে তাকালো। দুর্গের কারণে জেটি দেখা যাচ্ছে না। তবে ও নিশ্চিত ওখানে ধুন্ধুমার লেগে গিয়েছে। “গাই জানে যে আমরা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছি। ও আমাদেরকে খুঁজতে নৌকা পাঠাবে। আমাদের লাশটাও খুঁজে পেলে খুব খুশি হবে ও। সময় থাকতেই পালিয়ে যেতে হবে।”

“স্বর্ণের কি হবে?” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“অন্য কোনো দিন…” টম বললো। তবে ও ভালোমতোই জানে যে সেটা আর সম্ভব হবে না। গাই এই আশাতেই থাকবে, আর বোম্বের প্রতিটা লোক টম আর ফ্রান্সিসের খোঁজে ঘুরবে। আর যদি ওরা দুর্গে আবার ঢুকতেও পারে, তাহলেও এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে গিয়ে দেখবে কয়েকশো প্রহরী সিন্দুকগুলো পাহারা দিছে।

নৌকাটার একটা ছোট পাল আছে। মেরিডিউ আর বাকিরা মিলে সেটা খাঁটিয়ে দিলো। সন্ধ্যার হালকা বাতাসে ওটা ফুলে উঠে সমুদ্রের দিকে টেনে নিয়ে চললো নৌকাকে।

 “ডোরিয়ান আর আবোলির সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে কেমন হয়?” অ্যানা বললো। “ওরা যদি মোটামুটি লাভ করে ফিরতে পারে, তাহলে হয়তো সেই টাকা দিয়েই আংরিয়ার মুক্তিপণ মেটানো যাবে।”

“কয়েক মাস লেগে যাবে তাতে,” টম বললো। তাছাড়া লাকুইডিভায় পৌঁছানোর মতো কোনো জাহাজ নেই আমাদের। আর যদি সেটাও জোগাড় করা যায়, তাহলেও যেতে যেতে নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবে। ডোরিয়ান আমাদের আশা ছেড়ে কেপ টাউনে রওনা দিয়ে দেবে ততোদিনে।”

“তাহলে করবো কি আমরা?” ঝট করে বললো ফ্রান্সিস।

 টম সামনের দিকে তাকালো। এখনো দুর্গের আগুনটা পুরোপুরি নেভেনি। ধিকিধিকি জ্বলছে চত্বর জুড়ে। উপরের আকাশও লাল হয়ে আছে ওটার আভায়। আর তাতে নিচের গভর্নরের বাসাটাকে একটা আবছায়ার মতো লাগছে। সামনের খালটা পার হলেই জলাভূমি, তার পরেই ভারতের মূল ভূখণ্ডের খোলা সৈকত। এই উপকূল জুড়েই কোথাও সারাহ আর অ্যাগনেস ওদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। ও ওদের আশাকে মিথ্যে হতে দিতে পারবে না।

“আমরা ওদের মুক্তিপণ দিতে পারবো না, আনমনে বললো টম। “তার মানে বিকল্প উপায় একটাই।”

“জোর করে মুক্ত করে আনা?” কথাটা যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না ফ্রান্সিস। “কিন্তু আংরিয়ার দুর্গ তো নাকি দুর্ভেদ্য।”

টম নৌকার সাথে আড়াআড়ি বসে আছে। তাই সবাই সেটা বলে, কিন্তু নিশ্চিত হচ্ছো কি করে? গুজব শোনা যায় যে এটা দুর্ভেদ্য, তাই আর কেউ কখনো ওটা জয় করার চেষ্টাও করে না। আর যেহেতু কেউ কখনো জয় করতে পারেনি, তাই ওটার দুর্ভেদ্য হিসেবে সুনাম আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি কখনো এমন কোনো দুর্গের কথা শুনিনি যেটা জয় করা সম্ভব না।”

“কিন্তু সে জন্যে আমাদের একটা সৈন্যদল লাগবে,” দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো ফ্রান্সিস।

টম ওর কাঁধে চাপড় দিলো। “সেটাই।”

টম অ্যানার কাছ থেকে হালটা নিজের হাতে নিয়ে নৌকাটা সোজা অন্ধকার উপকূলের দিকে চালাতে লাগলো। ফ্রান্সিস চেয়ে রইলো ওর দিকে।

“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”

 “আমাদের জন্যে একটা সৈন্যবাহিনি খুঁজতে।”

*

টিরাকোলা দুর্গের নিচের গুহাগুলোয় সবসময়েই রাতের অন্ধকার। এর মাঝেও লিডিয়া ফয় তার তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তির সাহায্যে কানে আসা নানা শব্দ মিলিয়ে, সময় আর দিন রাতের আগমন অনুমান করতে শিখে ফেলেছে। এই বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইগুলোর ভিতর দিয়েও ও ভাটার টান আর জোয়ারের স্রোত আলাদা করতে পারে, রাতের বেলার অব্যাহত নিস্তব্ধতা আর দিনের কর্মব্যস্ততার আভাস পায়।

এখন দুর্গ ঘুমিয়ে আছে। দূরের বাতিটা থেকে যে সামান্য আলো আসছে তার আলোয় লিডিয়া দেখতে পেলো দুই বোন একসাথে শুয়ে আছে। সারাহের মাথা অ্যাগনেসের বুকের উপর রাখা। সারাহের পেট এখন খুব ভালোমতোই ফুলে উঠেছে। এই আলো আধারিতেও বোঝা যায়। ব্যাপারটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও আর পারবে না। দুজনেই ঘুমাচ্ছে, খুব আস্তে আস্তে পড়ছে শ্বাস।

 যা করার এখনি করতে হবে লিডিয়াকে। ও নিজের স্কার্টটা তুলে হাতের বেড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিলো যাতে নাড়াচাড়ায় শেকলে কোনো শব্দ না হয়। তারপর পা টিপে টিপে কয়েদখানার দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। সারাহ বা অ্যাগনেস কেউই টের পেলো না কিছু। গরাদ আটা দরজার উল্টো পাশে একটা বাতি জ্বলছে। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখা গেলো প্রহরী সিঁড়ির উপর বসে বসে নাক ডাকছে।

 লিডিয়া মেঝে থেকে একটা ছোট নুড়ি কুড়িয়ে নিয়ে সৈন্যটার দিকে ছুঁড়ে দিলো। নুড়িটা সোজা কপালে গিয়ে লাগলো তার, ঘুম ভেঙে ঘোত ঘোত করে উঠলো লোকটা। হাত চলে গেলো দেয়ালে ঝোলানো মাস্কেটের দিকে। মাস্কেটটা নামিয়ে লিডিয়ার দিকে তাক করে, ভয় দেখিয়ে ওকে ফিরে যেতে বললো সে। অন্য হাত দিয়ে কপাল ডলছে তখনও। লিডিয়া এক পা-ও নড়লো না।

 “ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই আমি,” ভাঙা ভাঙা পর্তুগিজে বললো লিডিয়া।

প্রহরী ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের আঙুলের মাথায় রক্ত লেগেছে কিনা সেটা পরীক্ষা করতে লাগলো। লিডিয়া তাই বুঝলো না যে লোকটা ওর কথা বুঝেছে কিনা। যে কয়টা ভারতীয় শব্দ ও জানে সেগুলো দিয়ে চেষ্টা করলো আর একবার। “সুবাদার? জাগিরদার? হাবালদার?”

প্রহরী মাথা ঝাঁকিয়ে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে।

লিডিয়া ওর স্কার্টের নিচের দিকে হাত বাড়ালো। গার্ডের চেহারায় আগ্রহ দেখা গেলো এবার। লিডিয়া ওর দুই পায়ের ফাঁকে হাত ঘষতে লাগলো। প্রহরী ঠোঁট চেটে উঠে দাঁড়ালো। তারপর এসে দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো যাতে ভালো করে দেখতে পায়।

 লিডিয়া কাপড়ের নিচ থেকে হাত বের করে আনতেই দেখা গেলো আঙুলের ফাঁকে একটা স্বর্ণালি প্যাগোডা খচিত মুদ্রা। যখন দস্যুদের হাতে ধরা পড়া নিশ্চিত হয়ে গেলো, তখন ও এটা নিজের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলো। নিজের স্কার্টে মুদ্রাটা মুছে প্রহরীর দিকে বাড়িয়ে ধরলো ও। প্রহরী ওটা নিতে হাত বাড়ালো কিন্তু লিডিয়া গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত টেনে নিলো। প্রহরী হতাশ চোখে চেয়ে রইলো ওর দিকে।

 “হাবালদার, “ আবার বললো লিডিয়া। তারপর পর্তুগিজে বললো, “আমার ওনাকে জরুরি একটা খবর দেওয়ার আছে।”

 প্রহরী ইতস্তত করতে লাগলো, কিন্তু লিডিয়ার হাতের মুদ্রাটার অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারছে না। ও দেয়াল থেকে একটা চাবির গোছে নিয়ে দরজা খুলে, মুদ্রাটার জন্যে হাত পেতে দিলো।

 “হাবালদার,” আবার বললো লিডিয়া। মুদ্রাটা মুঠো করে শরীরের পিছনে নিয়ে রেখেছে।

 প্রহরী আর কথা বাড়ালো না। লিডিয়াকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে নিয়ে যেতে লাগলো। উপর দিকে, ভবনের কাঠামো একদম অন্যরকম। নিচের অংশটা নিরেট পাথর কেটে বানানো। আর উপরে অংশটা মাপ মতো কাটা পাথরের ইট দিয়ে গড়া। একটু পর পরই বাতি ঝোলানো দেয়ালে। আরো উপর উঠতেই দেয়ালে পর্দা আর নানান অলঙ্করণ দেখা যেতে লাগলো। এতো সুন্দর যে, বোঝাই যাচ্ছে ওগুলো লুটের মাল। এই পরিস্থিতিতেও লিডিয়া ওগুলোর দামদর করতে লাগলো মনে মনে।

অবশেষে ওরা প্রহরীদের কক্ষে পৌঁছালো। আধা ডজনের মতো প্রহরী পাশা খেলছিলো ওখানে। লিডিয়াকে দেখা মাত্র ওদের ক্যাপ্টেন সাথের প্রহরীটাকে ধমকাতে শুরু করলো। কিন্তু লিডিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সোজা ক্যাপ্টেনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

 “আমার কথা কি বুঝতে পারছেন?” পর্তুগিজে বললো ও। “আমি আপনাদের ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলতে চাই।”

ক্যাপ্টেন কাঁধ ঝাঁকালো। একটা বর্ণও বোঝনি সে। আর তাতে ওর কিছু যায় আসে-ও না। ও লোকদেরকে কিছু একটা বলতেই সবাই অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে উঠলো। ক্যাপ্টেন নিজের উরুসন্ধিতে হাত বুলালো। লিডিয়া নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে এক পা আগে বাড়লো।

“এখানে কেউ ইংরেজি পারে?” রাগের অভিনয় করে বললো ও। “আমার কাছে একটা গোপন খবর আছে।” লিডিয়া জানে যে ওরা ওর কথা বুঝবে না, কিন্তু আশা করছে যে অন্তত ওর কথার গুরুত্বটা ধরতে পারবে।

ক্যাপ্টেন ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো। তারপর ওর অধস্তন কাউকে কিছু একটা আদেশ দিলো।

 দুজন লোক ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে লিডিয়ার দুই হাত চেপে ধরলো। লিডিয়া চিৎকার দিতে গেলো কিন্তু তৃতীয় আর একজন পিছন থেকে এগিয়ে এসে ওর মুখ চেপে ধরলো। ক্যাপ্টেন কোমর থেকে একটা ধারালো ছুরি বের করে ওর গলায় ঠেকালো।

ছুরির ডগা লিডিয়ার কাপড়ের গলা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো লোকটা। ছুরির শীতল স্পর্শ চামড়ায় লাগতেই লিডিয়া স্থির হয়ে গেলো। তারপর আচমকা ঘ্যাচ করে একটানে ছুরিটা নামিয়ে আনলো ক্যাপ্টেন। কোমর পর্যন্ত দুই ভাগ হয়ে গেলো লিডিয়ার পোশাক। ওর বিশাল স্তন বেরিয়ে এসে দুলতে লাগলো। ওর বাহু দুটো পিছনে টেনে আটকে রাখা হয়েছে। ফলে ওগুলো ঢাকার সুযোগ নেই। লিডিয়া ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেনো দৃষ্টি দিয়ে লজ্জা দিতে চাচ্ছে।

ক্যাপ্টেন হেসে ছুরিটা আবার খুঁজে রাখলো বেল্টে। তারপর হাত বাড়িয়ে দুই হাতে দুটো স্তন চেপে ধরে, এমনভাবে ওজন করতে লাগলো যেনো ওগুলো পাকা পেঁপে। ক্যাপ্টেন আবার নিজের উরুসন্ধিতে হাত দিয়ে মালিশ করতে শুরু করলো। লিডিয়াও চোখ নামিয়ে তাকালো সেদিকে। ধুতির নিচে তার পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ফুলে উঠেছে।

লিডিয়া পিঠ দিয়ে পিছনের লোকগুলোকে ধাক্কা দিলো। ওরাও সহজাতভাবেই আবার ওকে ঠেলে সোজা করতে সামনের দিকে দিলো টান। লিডিয়া সেই জড়তাকে কাজে লাগিয়ে ওর ডান হাঁটুটা ক্যাপ্টেনের উরুসন্ধি বরারবর ঠেলে দিলো। এতোক্ষণের জমা রাগ আর আক্রোশের পুরোটা ঝাড়লো লাথিটা দিয়ে।

ক্যাপ্টেন একজন মহিলার মতো চিৎকার করতে করতে পিছিয়ে দেয়ালের গায়ে গিয়ে পিঠ ঠেকালো। দুই হাত দিয়ে উরুসন্ধি চেপে ধরে আছে। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই ব্যথাটা সামলে নিয়ে আবার লিডিয়ার দিকে আগালো সে। চেহারা জুড়ে তখনো যন্ত্রণা। ডান হাতে ছুরিটা তুলে নিয়েছে আবার। লিডিয়াকে গেঁথে ফেলবে বোঝাই যাচ্ছে।

 “থামো।” রাশভারি একটা কণ্ঠ হুকুম করলো। “ওকে ছেড়ে দাও এখুনি।”

প্রহরীরা সাথে সাথে আজ্ঞা পালন করলো। ওরা লিডিয়াকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে সরে হাত পিঠের পিছনে নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। সবার চেহারায় ভীতি। এমনকি ক্যাপ্টেন পর্যন্ত হাতের ছুরিটা ফেলে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা নিচু করে রইলো।

ওদের সবার নজর প্রহরী কক্ষের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে।

একজন প্রহরী বিনয়ের সাথে কপাল সামান্য ঝুঁকিয়ে বিড়বিড় করে একটা নাম বললো, “রুদ্র”। রুদ্র দুর্গে আসার পর থেকে সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুব দ্রুত আংরিয়ার খুব কাছের লোক হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে ওকে একটা গ্রামে পাঠানো হয়। ওখানকার লোকজন আংরিয়াকে চাদা দিতে চাইছিলো না। ও দুই বছরের চাদা একসাথে নিয়ে ফিরে আসে। পরের বার ওকে আংরিয়ার এক ক্যাপ্টেনের সাথে সমুদ্র অভিযানে পাঠানো হয়। এবার ও প্রায় পাঁচটা জাহাজ আর একশো হাজার রুপি লুট করে নিয়ে আসে। আংরিয়ার ক্যাপ্টেন অবশ্য মারা গিয়েছিলো। যুদ্ধের ডামাডোলে কেউ বলতে পারবে না যে কিভাবে সে মারা গিয়েছে, তবে লোকজন ভিতরে ভিতরে রুদ্রকেই সন্দেহ করে। যদিও ওর সামনে কিছু বলার সাহস করে না। আংরিয়া গুজবটা শুনে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। “সাপের গর্তে নামলে সবাইকেই নিজেকে নিজে রক্ষা করতে জানতে হয়।” ও রুদ্রকে মৃত ক্যাপ্টেনের জায়গায় পদোন্নতি দিয়ে দেয়। এরপর থেকে আর এসব গুজব ডালপালা মেলতে পারেনি। বিশেষ করে এক মুখ পাতলা লোককে যখন থেকে দুর্গের নিচের পানিতে ভাসতে দেখা গেলো, তখন থেকেই এই সংক্রান্ত ব্যাপারে সবার মুখে তালা পড়ে যায়।

রুদ্র লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। “কে তুই?” এতো নিখুঁত উচ্চারণে জিজ্ঞেস করলো যে লিডিয়া চমকে গেলো। লোকটা লম্বা, কাঁধ চওড়া। মাথায় একটা তাজা পোড়া ক্ষত, ফলে তালুতে টাক হয়ে আছে খানিকটা। তবে দাড়ি আর ভ্রু ঘন আর কুঁচকুচে কালো। শুধু একটা চামড়ার আড়াআড়ি বেল্ট ছাড়া কোমর পর্যন্ত গায়ে কাপড় নেই তার। লিডিয়া বুঝতে পারলো বয়সের দিক দিয়ে যতোটা মনে হয়, লোকটা তার চাইতে কম বয়সী হলেও, ভয়ঙ্করত্বের দিকে দিয়ে অনেক অনেক বেশি।

“আমার নাম লিডিয়া ফয়,” হাত দিয়ে পেঁচিয়ে বুক ঢাকতে ঢাকতে বললো ও। তারপর রুদ্রের আগ্রহ কমে যাওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বললো, “আমার কাছে আপনাদের মালিককে দেওয়ার মতো একটা জরুরি খবর আছে।”

 “কি খবর?” জানতে চাইলো রুদ্র।

“আমি শুধু আপনাকেই বলতে চাই সেটা,” ও অর্থপূর্ণভাবে বাকি লোকগুলোর দিকে তাকালো। “একাকী কোথাও কথা বলা যাবে না?”

*

ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকিয়ে লিডিয়াকে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণে ওর ঘরটা। ওর আগে এখানে কেউ থাকতো না। দস্যুদের স্বভাব নেকড়েদের মতোই-লুট করুক, খাক বা ঘুমাক সব একসাথে করে। স্বভাবতই তাই এরকম নির্জন জায়গা এড়িয়ে গিয়েছে বাকিরা। কিন্তু ক্রিস্টোফারের জন্যে এই নীরব জায়গাটাই ছিলো সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত।

তাছাড়া এটা ওকে ওর গোপনীয়তা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ও নিজেকে বুঝিয়েছে যে লিডিয়াকে এখানে নিয়ে এসেছে শুধু নিরিবিলি ওর কাহিনি শোনার জন্যে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সত্যি না। গার্ডরুমে পা দিয়েই যা দেখতে পেয়েছিলো সেটা ভুলতে পারছে না কোনোমতেই কোমর পর্যন্ত চেরা জামার ভিতর থেকে বেরিয়ে থাকা লিডিয়ার ভরাট স্তন। এখন অবশ্য লিডিয়া ওর ছেঁড়া জামার দুটো অংশ কোনো মতে গিট দিয়ে নিজের আব্রম্ন রক্ষা করছে। কিন্তু তবুও গিটের ফাঁক দিয়ে নগ্ন চামড়া দেখা যাচ্ছে।

পুলার হাতে ও আর তামান্না ধরা পড়ার পর থেকে আর কোনো মেয়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়নি ক্রিস্টোফারের। এমন না যে সুযোগ হয়নি-এই দুর্গে প্রচুর বেশ্যা বা এমনি আগ্রহী মেয়েমানুষ আসে-কিন্তু ও কখনো তাদের প্রতি কোনো আকর্ষণ অনুভব করেনি। কিন্তু এই মেয়েটার প্রতি করছে এখন।

“কি বলবেন বলুন,” ক্রিস্টোফার জানতে চাইলো।

লিডিয়া আবারও নিজের পরিস্থিতি ভুলে অন্য বিষয়ে নাক গলানো শুরু করলো। “একজন ভারতীয় জলদস্যু হয়ে কিভাবে এতো নিখুঁত ইংরেজি শিখলেন?” জিজ্ঞেস করলো ও।

“ওদের সাথে কাজ করেছি অনেকদিন,” ব্যাখ্যা করলো ক্রিস্টোফার।

“বোম্বেতে গিয়েছিলেন কখনো?”

 ক্রিস্টোফার কি বলবে ভেবে পেলো না। এ কি ওকে চিনতে পারবে? কিন্তু সেটা অসম্ভব। আজ সকালেও এক বালতি পানিতে ও নিজের প্রতিচ্ছবি দেখেছে। ওর মা পর্যন্ত ওকে চিনতে পারবে না।

“গিয়েছি দুয়েকবার,” ক্রিস্টোফার বললো।

“তাহলে নিশ্চয়ই গভর্নর গাই কোর্টনীর নাম শুনেছেন?”

 “হ্যাঁ,” সংক্ষেপে বললো। “তা শুনেছি।”

 “আপনি কি এটা জানেন, যে তার স্ত্রীর দুই বোন এই দুর্গে বন্দী?”

ক্রিস্টোফার হতবাক হয়ে লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। লিডিয়া ওর শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে ক্রিস্টোফারের এই বিহ্বল অবস্থাটা খেয়াল করলো কিন্তু কারণটা ধরতে পারলো না।

“ওনাদের নাম হচ্ছে সারাহ আর অ্যাগনেস। কিন্তু সারাই ওনার আসল পরিচয় লুকিয়ে রেখেছেন। কারণ…” সারাহ যে গাই-এর জন্যে নিজের পরিচয় গোপন রাখছে সেটা ও বলে দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু কি মনে করে শেষ মুহূর্তে চেপে গেলো। “কারণ ওনার ধারণ আংরিয়া এই সম্পর্কের ফায়দা ওঠাতে চাইবে। আর মুক্তিপণের টাকা বাড়িয়ে দেবে।” শেষে মিথ্যে বললো ও।

 “আপনি তার গোপন খবর ফাঁস করে দিচ্ছেন,” ক্রিস্টোফার মন্তব্য করলো। তবে গলা শুনে বোঝা গেলো ও লিডিয়াকে দোষ দিচ্ছে না।

লিডিয়া ওর কাছে ঘেঁষে এলো, এতো কাছে যে ওর উন্নত স্তন প্রায় ক্রিস্টোফারের খোলা বুকে স্পর্শ লেগে গেলো। লিডিয়া ক্রিস্টোফারের শরীরের উত্তাপ টের পেলো।

“আসলে,” মিনতি করলো লিডিয়া। “চিত্তিত্তিঙ্কারাতে এক গণহত্যায় আমার স্বামী মারা যায়। এর পর থেকেই আমি একা। আমি কারো করুণা চাই না; শুধু নিজের মুক্তি আদায় করে নিতে চাই।”

 লিডিয়া নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তারপর ছোট একটা মেয়ের মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো ক্রিস্টোফারের দিকে। কি মনে করে ক্রিস্টোফারের বাহু স্পর্শ করলো লিডিয়া। ওর শক্ত মাংসপেশি অনুভব করলো। “আমি জানি না আপনি কিভাবে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে ভাগ্যই আমাদেরকে এক করেছে। আমাকে রক্ষা করতে পারবে এরকম একজন লোকের আমার খুব দরকার।”

ক্রিস্টোফার লিডিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কথাটা শুনে মনের ভিতর ঝড় বইছে ওর। সমগ্র সত্তা চাচ্ছে লিডিয়াকে ভোগ করতে। কিন্তু এটাও পরিষ্কার যে মেয়েটা ওর এই আকর্ষণকে নিজের সুবিধার জন্যে কাজে লাগাতে চাইছে।

ক্রিস্টোফার হাত বাড়িয়ে লিডিয়ার ছেঁড়া জামাটার গিটু খুলে আবার টেনে খুলে দিলো। লিডিয়া বাধা দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করলো না। লিডিয়ার কব্জিতে তখনও হাতকড়া পরানো। ও দুই হাত একসাথে উপরে তুলে হাতকড়া সমেত হাতটা ক্রিস্টোফারের ঘাড়ের পিছনে নিয়ে এলো। তারপর পিছিয়ে যেতে শুরু করলো। ওর টানে ক্রিস্টোফারও আগাতে লাগলো সামনে বিছানায় নিজের হাটুর পিছন দিকটার স্পর্শ পেতে তারপর থামলো লিডিয়া।

“ব্যথা দেবেন না যেন,” বিড়বিড় করে বললো ও, কিন্তু ক্রিস্টোফারের কানে কথাটা গেলো বলে মনে হলো না। ও হামলে পড়লো লিডিয়ার উপর। ধাক্কায় লিডিয়া ধপ করে পিছন দিকে বিছানার উপর পড়ে গেলো। হাতকড়ার টানে ক্রিস্টোফারও ঝুঁকে এলো ওর উপর।

লিডিয়া একই সাথে ব্যথা আর আবেশ দুটোতেই শীকার করে উঠলো। জীবনে প্রথমবারের মতো ওর মনে হলো স্বর্গসুখ লাভ করলো যেনো। উন্মত্ত কামনার সামনে এতোদিনের কষ্ট করে গড়ে তোলা শঠতা আর ধুর্ততার বাঁধ ভেসে গেলো খড়কুটোর মতো।

লিডিয়ার আবেশী ক্রন্দনের সাথে ক্রিস্টোফারের জান্তব গর্জন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেলো। উত্তেজনা থিতিয়ে আসার পর, ওভাবে ক্রিস্টোফারের গলায় হাতকড়া বাধিয়ে রেখেই মরার মতো ঘুমিয়ে পড়লো লিডিয়া।

ক্রিস্টোফারের ঘুম এলো না। পাশে শুয়ে লিডিয়ার লম্বা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে, ওর বলা কথাগুলোর মর্মার্থ অনুধাবন করার চেষ্টা করতে লাগলো।

যদিও ওর অ্যাগনেস খালার কথা খুব বেশি মনে নেই। ও ছোট থাকতেই বোম্বে ছেড়ে চলে এসেছিলেন উনি। উনি কিভাবে টিরাকোলা দুর্গে এসে আটকা পড়েছেন সেটা অনুমান করতে পারছে ক্রিস্টোফার। কিন্তু সারাহ কোটনী?

ওর মা ক্যারোলিন তার মেঝো বোন সম্পর্কে কোনো কথাই বলতেন না; ক্রিস্টোফার বারো বছর বয়সে প্রথম তার কথা জানতে পারে। ওর জিজ্ঞাসার জবাবে ওর মা জানিয়েছিলেন যে সারাহ বহু বছর আগেই ওনার স্বামী, মানে ক্রিস্টোফারের চাচা টমের সাথে আফ্রিকায় মারা গিয়েছেন।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উনি আসলে মারা যাননি। আর উনি যদি জীবিত থাকেন, তার মানে কি টমও জীবিত না?

কেল্লার জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে উল্টোপাশের দেয়ালে ঝোলানো নেপচুন তরবারিটায় লেগে প্রতিফলিত হতে লাগলো। স্বর্নালি ধারটা চাঁদের আলোয় রূপালি লাগছে। টম-ই কি তরবারিটা ভারতে নিয়ে এসেছেন? আর তাই যদি হয়, তাহলে সেটা ক্রিস্টোফারের জন্যে ভালো না খারাপ?

 গাই, টম চাচাকে দুই চোখে দেখতে পারতো না। ক্রিস্টোফার গাইকে দেখতে পারে না। তার মানে কি ও আর ওর চাচা জোট বেঁধে ওর বাবার বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে পারবে? ও কি সারাহকে ব্যবহার করে টম চাচাকে নিজের পক্ষে কোনোভাবে আনতে পারবে? নাকি লিডিয়ার কথাটা আংরিয়ার কানে পৌঁছে দেব? এতে মুক্তিপণের পরিমাণ বাড়বে। আর তাতে ও আংরিয়ার আরো বেশি আস্থাভাজন হতে পারবে।

চাঁদ হেলে পড়লো, তারা ডুবে গেলো আর ক্রিস্টোফারের জানালার পাশের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করলো। ক্রিস্টোফার লিডিয়ার হাতকড়ার বন্ধন থেকে সন্তর্পণে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালো। লিডিয়ার দিকে তাকালো ও। ওর চামড়া নিখুঁত ফর্সা আর মসৃণ। আবার ওর নাভীর নিচে শিরশির করে উঠলো। পরে হবে, দুনিয়ার সমস্ত সময় পড়ে আছে; নিজেকে বললো ও।

ক্রিস্টোফার আবার লিডিয়ার পাশে শুয়ে, হাত বাড়িয়ে ওর নরম স্তনে চাপ দিলো। অস্ফুটে গুঙিয়ে উঠলো লিডিয়া।

ঠিক তখনি, বজ্রপাতের মতো স্পষ্ট কিন্তু চাপা একটা আওয়াজ ভেসে এলো জানালা দিয়ে। মুহূর্তে দাঁড়িয়ে গেলো ক্রিস্টোফার। অনেক দূর থেকে এসেছে, কিন্তু শব্দটা নিজের নিঃশ্বাসের শব্দের মতোই চেনা ওর কাছে। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা কামানের গোলা ছোঁড়ার আওয়াজ ওটা।

জানালার কাছে এগিয়ে মাথা বের করলো ক্রিস্টোফার। দুর্গের দেয়ালের পেছনে, যে সরু শৈল অন্তরীপটা দুর্গের সাথে মূল ভূ-খণ্ডের সংযোগ দিয়েছে সেটার পিছন দিয়ে একটা ছোট পাহাড়ের গা বেয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে। আর সেই পাহাড়ের গা বেয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েক হাজার বল্লমের মাথায় বাধা পতাকা। সকালের মৃদু বাতাসে উড়ছে সেগুলো। আর ওগুলো বহন করছে যে ঘোড়সওয়ারেরা, তারা ঘোড়া থামিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে টিরাকোলা দুর্গের দিকে।

দুর্গ আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে এক বিশাল সেনাবাহিনি।

*

পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। রাস্তা এতো সরু যে এক পাশপাশি দুজনেরও হাঁটার উপায় নেই। সামনের আলো আধারিতে মস্ত একটা অবয়ব আবছা দেখা যাচ্ছে, ওটাই পাহাড়ের উপরের বিশাল দুৰ্গটা।

দলটার সবার সামনে আছে টম কোর্টনী। অ্যানা আর ফ্রান্সিস আছে ওর পেছনেই। মেরিডিউ আর কেস্ট্রেল থেকে বেঁচে যাওয়া আরও চারজন আছে ওদের পেছনে। অনেকদিন হয় বোম্বে ছেড়েছে ওরা। নৌকা নিয়ে সোজা উপকূল বরাবর আগাতে আগাতে শেষে একটা পাহাড়ের গোড়ায় এই রাস্তাটা খুঁজে পেয়েছে। এটা দিয়ে পশ্চিমদিকের পর্বতশ্রেণীর চূড়ায় পৌঁছানো যায়।

“এটা পুরো একটা রূপকথার দেশ। সব জায়গা যেনো কোনো অভিশাপে মুড়ে আছে,” ফ্রান্সিস বললো। ছোট বেলায় হাই উইন্ডের লাইব্রেরিতে যেসব আর্থারিয়ান নাইটদের গল্প কথা ছিলো সেসব ও গোগ্রাসে গিলতে। এখানে আসার পথে ওরা যেসব জায়গা পেরিয়ে এসেছে, সেসব ওকে রাজা ফিশারের থাকার জায়গা-সেই অভিশপ্ত গ্রেইল দুর্গের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সদ্য বর্ষা গত হয়েছে, রাস্তার দু-ধারের সবকিছু সবুজ আর সতেজ হয়ে থাকার কথা; কিন্তু মাঠঘাট সব বিরান হয়ে পড়ে আছে। বেশিরভাগ গ্রামই জনশূন্য। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে যে তিন চার দিনেও ওরা কোনো জনমানবের দেখা পায়নি। রাতের বেলাতেও আশেপাশে তেমন কোনো আগুন বা বাতি দেখা যায় না। যাদের দেখা পেলো তারাও সবাই-ই প্রায় উলঙ্গ আর ক্ষুধার্ত। ওদের পদশব্দ পেয়ে এমনভাবে নিজেদের মাটির তৈরি ছোট ছোট বাসা থেকে বের হয়ে আসছিলো যেনো কোনো পশু নিজের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসছে। সভ্যতার একমাত্র চিহ্ন ছিলো প্রতিটা প্রান্তরের শেষ মাথায় থাকা দুর্গগুলো। পাহাড়ের মাথায় ওগুলো দেখতে ঈগল পাখির বাসার মতো লাগে।

“এখানে এই অবস্থা কেন?” ওদের যাত্রার দ্বিতীয় দিন সকালে জিজ্ঞেস করেছিলো ফ্রান্সিস।

“যুদ্ধ,” জানিয়েছিলো অ্যানা। “এটা হচ্ছে মারাঠাদের এলাকা। গত তিরিশ বছর ধরে স্বাধীনতার দাবিতে ওরা মুঘলদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। সেজন্যে যথেষ্ট ভুগতে হয়েছে ওদেরকে। আর এখন নিজেদের রাজ্য উদ্ধার হলেও কে সেটা শাসন করবে সেটা নিয়ে শুরু হয়েছে গণ্ডগোল। গৃহযুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশটা।”

এতোদিন পরে এসে ওরা সাতারা-র দুর্গের কাছে পৌঁছেছে। রাস্তাটা প্রায় খাড়াভাবে উঠে গিয়েছে পাহাড়ের চূড়ায়। প্রধান ফটকে প্রহরী আটকালো ওদেরকে। টম এগিয়ে গেলো কথা বলতে। আর ওর পরিচয় লুকানোর কিছু নেই। ধীরে সুস্থে স্পষ্টভাবে সব বললো ও। অ্যানা পাশ থেকে অনুবাদ করে দিলো।

“আমি টমাস কোর্টনী। বোম্বের গভর্নর গাই কোর্টনীর ভাই। আমি রাজা শাহুজির সাথে কথা বলতে চাই।”

ওর পরিচয় শুনে প্রহরীদের চোখ কপালে উঠে গেলো, টম বুঝলো না সেটা কি ভালো নাকি খারাপ। তবে ঢুকতে দেওয়া হলো ওদেরকে। একজন চাকর পথ দেখিয়ে ওদেরকে একটা বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে এলো। তারপর ওদেরকে বসতে বলে সে দুর্গের মূল ভবনের ভিতরে ঢুকে গেলো।

“এই রাজা সম্পর্কে কিছু জানো তুমি?” অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো টম। “তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, ওনার কি এখন আর নতুন যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ আছে?”

“রাজাকে হালকা ভাবে নেবেন না,” সতর্ক করলো অ্যানা। “একবার মুঘল সৈন্যরা এই দুর্গ দখল করে নিয়েছিলো। ওরা যে থাকতেই এসেছে সেটা প্রমাণ করতে মুঘল সেনাপতি নিজের স্ত্রী আর বাচ্চাদেরকে এখানে নিয়ে আসেন। শাহুজি দুৰ্গটা অবরোধ করে, মুঘল সেনাপতির স্ত্রী আর মেয়েদের ধরে নিয়ে আসেন। তারপর তাদেরকে দেয়ালের নিচে কামানের নলের উপর বেঁধে, কামানে পাউডার ভরে, পাশে আগুন হাতে ওনার লোকদের দাঁড় করিয়ে রাখেন।”

“তারপর কি হলো,” ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করলো।

“মুঘল সেনাপতি আত্মসমর্পণ করেন। শাহুজি ওনার রাজধানী পুনরুদ্ধার করেন আর সেই থেকে এখানেই আছেন।” বলে অ্যানা হাতের উপর বসা একটা মাছি ঝাঁকি মেরে তাড়ালো। “শুনেছি যে উনি নাকি একেকজনের কাছে একেকরকম রূপে নিজেকে উপস্থাপন করেন। মানে যাকে ওনার চরিত্রের যেটুকু দেখাতে ইচ্ছে হয় সেটুকুই দেখান। তাই আপনার সামনে যে ভান-ই করুক না কেন, প্রতারিত হবেন না।”

চাকরটা ফিরে আসতেই অ্যানা থেমে গেলো। গাই কোর্টনীর নামটা সাথে সাথেই কাজে দিয়েছে দেখা যাচ্ছে। মেরিডিউ আর বাকিদেরকে রেখে টম, অ্যানা আর ফ্রান্সিস আরও বেশ কয়েকটা করিডোর আর ঘর পেরিয়ে দুর্গের একেবারে মাঝখানে এসে উপস্থিত হলো।

“এর মানে কি?” ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো ফ্রান্সিস।

“এটা হচ্ছে শাহুজির আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ, টম জবাব দিলো। “একজন ফালতু লোক হলে সে আমাদেরকে খামাখা বসিয়ে রেখে নিজের ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করতো।”

বিশাল সিঁড়িটার একদম মাথায় উঠে চমৎকার কারুকার্যময় এক জোড়া দরজা পেরিয়ে দরবার কক্ষে এসে হাজির হলো ওরা। ভারতীয় হিসেবে দরবারটা নিতান্তই অনাড়ম্বর বলা চলে। কিন্তু এর পরেও যে কোনো ইউরোপিয়ান রাজদরবার এটার জৌলুসতার কাছে একদম একটা মঠের মতো মনে হবে। ঘরের একদম মাঝে একটা বেদীর উপর একটা সিংহাসন। তার চারপাশ ঘিরে আছে সভাসদ আর প্রহরীরা। সিংহাসনটা দেখে মনে হচ্ছে খাঁটি স্বর্ণের তৈরি। তার উপর বাঘ আর সিংহের ছাল বিছানো। ওটায় যে লোকটা বসে আছে তার পরনেও দামী পোশাক। তাতে রূপার সুতো দিয়ে হাতীর দাঁতের নকশা সেলাই করা। আর সেই সাথে মণি-মুক্তা এসব তো আছেই।

টম যতোটা ভেবেছিলো তার চাইতে কম বয়স রাজার। এখনো তিরিশ হয়নি। নিখুঁতভাবে কামানো গাল তার যৌবনকে আরো উদ্ভাসিত করছে। সোজা হয়ে বসে আছেন রাজা, নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন, নিজের যা আছে তা নিয়ে গর্বিত। তিন আগন্তুককে ভালো ভাবে দেখলেন তিনি। তার চোখের দৃষ্টি রহস্যময়। সারা দরবার জুড়ে কোনো শব্দ নেই। শুধুমাত্র শাহুজি যখন নিজের গলায় ঝুলানো মুক্তার মালাগুলো নাড়ছেন তখন টক টক শব্দ হচ্ছে।

“আপনি গভর্নর কোর্টনীর ভাই,” অবশেষে নীরবতা ভাঙলেন উনি। কথাটা একটা মন্তব্য ছিলো, প্রশ্ন না। উনি কথা বলছেন পর্তুগিজে। আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে মোজাম্বিক আর সোফালাতে ব্যবসা করার সময় টম ওখানকার পর্তুগিজ বসতকারীদের কাছে থেকে কিছুটা পর্তুগিজ শিখেছিলো। কিন্তু তবুও অ্যানাকেই কাজে লাগালো। কারণ ভুল বোঝাবুঝি হলে সমস্যা।

“আমি গাই কোর্টনীর যমজ ভাই।”

“উনি কি আমার কাছে যে ফরমানটা দাবী করেছিলেন সেটা নিতে আপনাকে পাঠিয়েছেন?” শাহুজি জানতে চাইলেন।

 “আমি এখানে আমার ভাইয়ের পক্ষ থেকে আসিনি,” টম স্বীকার করলো। “আমি এখানে এসেছি আপনি কিভাবে তার কাছে থেকে একটা সুবিধা আদায় করতে পারেন, সে ব্যাপারে একটা পরামর্শ দিতে।”

রাজা চোখ পিটপিট করে তাকালেন ওর দিকে। আপনি যদি গাই কোর্টনীর ভাই হয়ে থাকেন, তাহলে তার সাথে বেঈমানি করতে চাচ্ছেন কেন?” টমের মনে পড়লো আনা ওদেরকে মারাঠাদের গৃহযুদ্ধের কারণটা বলেছিলো। শাহুজির ফুফু ওনার কাছে থেকে রাজ্যটা ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছেন।

“আমার ধারণা আপনি ব্যাপারটা অন্য যে কারো চাইতে ভালো বুঝবেন, মহামান্য। সবসময় একই পরিবারের সদস্যুদের একই উদ্দেশ্যে কাজ করা সম্ভব হয় না।

অ্যানা অনুবাদ করে দেওয়ার পর টম ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো। একবার ভাবলো যে বাড়িয়ে বলে ফেললো কিনা। রাজা যদি অপমানবোধ করেন তাহলে ঝামেলা। রাজার চোখ সরু হয়ে থাকায় তার মনোভাব কিছুই বোঝ গেলো না। শহুজি চোখ খুলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর সামান্য একটু ঝুঁকে এলেন সামনে। “তা ঠিক কিসের জন্য আমার কাছে এসেছেন?”

“আমি একটু আপনার সাথে একাকী কথা বলতে চাই,” সোজাসুজি বলে দিলো ইম। ও খুব ভালোমতোই জানে যে দরবার হচ্ছে রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ, এখানে বসে রাজাকে পটানো যাবে না।

শাহুজি ঠোঁট গোল করে তাকালেন টমের দিকে। তারপর কোনো কথা না বলে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিচে নেমে এলেন। সভাসদরা সরে দাঁড়ালো; দূরের দেয়ালে একটা দরজা খুলে দিলো কেউ। টম আর বাকিরা রাজার পিছু নিয়ে আগালো সেদিকে। দরজাটা দিয়ে ওরা বাইরের প্রান্তরের দিকে মুখ করে থাকা একটা পাথরের ব্যালকনিতে এসে উপস্থিত হলো। অ্যানার বলা মুঘল সেনাপতির পরিবারের কথা মনে পড়লো টমের। এখানে দাঁড়িয়েই কি সেনাপতি দেখতে পেয়েছিলেন যে তার স্ত্রী আর মেয়ে নিচে কামানের মুখে বাধা? ওদের কান্না কি ওখান থেকে ওনার কানে এসে পৌঁছাচ্ছিলো?

 প্রহরীরা ওদেরকে ওখানে রেখে দরবারে ফিরে গেলো আবার। যাওয়ার পথে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলো। এখানেও সব কিছু নীরব, শুধু রাজার গলার মালার টুকটাক আর পাহাড়ে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

“কেন আপনি আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে যেতে চান?” শাহুজি একরকম নির্বিকার ভাবে প্রশ্নটা করলেন। যেনো টমের শরীর স্বাস্থ্যের খবর নিচ্ছেন।

“আমার ধারণা আমাদের দুজনেরই একজনের বিরুদ্ধে শত্রুতা আছে।”

“গভর্নর কোর্টনী আমার শক্র না।”

“আমি দস্যু আংরিয়ার কথা বলছিলাম। সে আপনার জাহাজ লুট করে উপকূলে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে। আর সে আপনার বিরুদ্ধে আপনার ফুফুর পক্ষ হয়ে কাজ করছে।”

শাহুজি এতো সামান্য মাথা ঝোঁকালেন যে বোঝাই গেলো না।

“আংরিয়া আমার স্ত্রী আর তার বোনকে ধরে নিয়ে গিয়েছে,” টম বলে চললো। “তারপর টিরাকোলার দুর্গে ওদেরকে আটকে রেখেছে।”

শাহুজির চেহারায় সামান্য বিরক্তি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেলো আবার, এই প্রথম তার চেহারায় কোনো অনুভূতি দেখা গেলো। “টিরাকোলা আমার দুর্গ,” শাহুজী বললেন।

 “আর সেজন্যেই আমরা আপনার কাছে এসেছি,” তাড়াতাড়ি বললো টম। “আপনি আপনার দুর্গ ফেরত চান, আমি আমার পরিবার ফেরত চাই।”

 শাহুজি কি ওর কথায় উৎসাহিত হলেন নাকি অপমানিত হলেন সেটা টম বুঝতে পারলো না।

“আমার ভাই গাই আপনার সাথে একটা চুক্তি করতে চায়,” টম বললো। “ও আংরিয়াকে ওর শয়তানি চালিয়ে যেতে দিচ্ছে, যাতে করে আপনি ওর সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হন। কিন্তু আমরা যদি আংরিয়াকে ওর দুর্গ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওর আস্তানা গুঁড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে আপনি কিন্তু। গাইয়ের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন। আর তাছাড়া উপরি হিসেবে নিজের দুৰ্গটা তো ফেরত পাচ্ছেন-ই।”

“তা আমাকে এসব কেন বলছেন?” শাহুজি জিজ্ঞেস করলেন।

 “কারণ আংরিয়া বন্দীদের জন্যে মুক্তিপণ দাবী করেছে, আর গাই সেই টাকাটা দিতে সম্মত হচ্ছে না,” ফ্রান্সিস মাঝখান থেকে বলে উঠলো। “একমাত্র আপনার পক্ষেই টিরাকোলা দুর্গ আংরিয়ার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাদের পরিবারকে মুক্ত করা সম্ভব।”

 টম ফ্রান্সিসের দিকে নিষেধের দৃষ্টিতে তাকালো, তবে শাহুজিকে দেখে মনে হলো না যে উনি কিছু মনে করেছেন। শুধু ওনার টা কিছুটা উঁচু হলো।

 “আপনাদের কেন মনে হচ্ছে যে আমার টিরাকোলা দখলের সামর্থ্য থাকার পরেও, আমি সেটা দখল না করেই বসে আছি?” বলে উনি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এখনো পুরো প্রান্তর জুড়ে হালকা কুয়াশার আস্তরণ। “আমার রাজ্যের অবস্থা আপনাকে বলছি শুনুন, শাহুজি বলে চললেন। “আপনারা আসার পথে জমিগুলোতে কোনো ফসল দেখেছেন?”

টম আর ফ্রান্সিস মাঠ নাড়লো।

আবার বলা শুরু করলেন শাহুজি, “আপনার রাজা যদি আপনার গ্রামকে রক্ষাই করতে না পারে, তাহলে ফসল ফলিয়ে লাভটা কি? একসময় দেশটা প্রাচুর্যে ভরপূর ছিলো। এখন কৃষকেরা শুধুমাত্র সেসব ফসল বোনে যেগুলো তারা জঙ্গলে পালানোর সময় সাথে নিয়ে যেতে পারবে। তিরিশ বছর ধরে আমার ঠাকুরদা ছত্রপতি শিবাজি মুঘলদের সাথে এই সাম্রাজ্যের জন্য লড়েছেন। উনি মারা যাওয়ার পরে আমার ফুফু দাবি করলেন তার ছেলে নাকি এখানকার সম্রাট হবেন, কিন্তু আদতে সিংহাসনের দাবি আসলে আমার। মুঘলেরা মারা গিয়েছে। তাদের সাম্রাজ্যও খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা শান্তি খুঁজে পাচ্ছি না, কারণ আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করছি। আমরা এটাকে বলি ভালেরাই-মানে বল্লমের শাসন। প্রতিটা গ্রামের মাতবর মনে করে যে সে একজন সেনাপতি। তারা তাদের নিজেদের লোকজন জড়ো করে সামান্য কারণেই মারামারি করতে লেগে যায়। কোথাও কোথাও তো আমাকে গ্রামের চৌকিদারের চাইতেও কম দাম দেওয়া হয়।

রাজা দেয়াল থেকে খুলে আসা একটা ছোট পাথর তুলে নিয়ে নিচে ফেলে দিলেন।

“ঠাকুরদা যুদ্ধ শুরু করার পর থেকেই মুঘলেরা আমাদেরকে ডাকাত হিসেবে ঘোষণা করে। গোয়ালঘরের দুর’ বলে ডাকতো ওরা আমাদেরকে। আমি দেখেছি ইঁদুরের যখন খাওয়ার কিছু পায় না, তখন ওরা কিভাবে একে অপরকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়। মুঘলদের কথাই আসলে ঠিক ছিলো, আমরা আসলেই তাই।” রাজা এতোগুলো কথা বললেন কিন্তু একবারের জন্যেও তার কষ্ঠ উঁচু হলো না বা কোনো অনুভূতি খেলা করলো না।

“আপনারা পৃথিবীর সবচে শক্তিধর সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছেন,” টম মনে করিয়ে দিলো।

 “আপনি কখনো কোনো মুঘল ঘোড়সওয়ারকে দেখেছেন?” প্রশ্নটা করে শাহুজি উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন, “ওদের ঘোড়াগুলো দুনিয়ার সবচে বড় আর সবার চাইতে শক্তিশালী। ঘোড়াগুলোকে ওভাবেই বড় করা হয়। কারণ অস্ত্র আর বর্মসহ একজন ঘোড়সওয়ারের ওজন হয় অনেক। আমাদের ঘোড়াগুলো ছোট। ছোট ছোট পায়ের জানোয়ার। পাহাড়ে চড়তে বা দ্রুত পালাতে কাজে লাগে। আমরা কখনোই মুঘলদের সাথে সামনা সামনি লড়াই করার সাহস করিনি। ওরা যখন আমাদের বিরুদ্ধে লড়তে আসতো, তখন আমরা ওদেরকে পার হয়ে যেতে দিতাম। তারপর ওদের রসদপত্র আনা নেওয়ার রাস্তা দিতাম বন্ধ করে। ওরা যখন আমাদের দুর্গ অবরোধ করতো, আমরা ওদেরকে দখল ছেড়ে দিয়ে আমাদের নিজেদের ফসলের ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দিতাম আর সব গবাদি পশু জবাই করে ফেলতাম, যাতে দখলকারীরা না খেয়ে থাকে। এভাবেই আমরা যুদ্ধ চালিয়েছি। টিরাকোলার মতো একটা দুর্গের সামনে আমরা খড়কুটোর মতোই উড়ে যাবে।”

“আপনাদের মনে কোনো দয়ামায়া নেই?” রেগেমেগে বললো ফ্রান্সিস। “কতোদিন হচ্ছে আমার খালা দস্যুগুলোর হাতে বন্দী। আপনি ওনাদেরকে ঐ কয়েদখানায় ওভাবে পচে মরতে দেবেন?”

নির্বিকার চোখে ওর দিকে তাকালেন শাহুজি। “ছোট থাকতে আমাকে বন্দী করে মুঘল দরবারে পাঠানো হয়েছিলো। আমি আমার পুরো শৈশব ওখানে কাটিয়েছি। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভাবতাম আজ কি প্রহরীরা আমার গর্দান উড়িয়ে দেবে কিনা; আর প্রতি সন্ধ্যায় শুতে যাওয়ার আগে আমি জানতাম না যে পরের সকালটা দেখতে পাবো কিনা।”

“আমি জানতাম না সেটা,” ফ্রান্সিস চোখ নামিয়ে নিলো। লজ্জা পেয়েছে।

“আমার বয়স যখন এগারো, মুঘলেরা আমার বাবাকে আটক করে। আমার বাবা আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। মুঘলরা তাই তাকে শিকারি কুকুরের মুখে ছেড়ে দেয়। ওরা বাবার একটা একটা করে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে ফেলে। আমাকে জোর করে পুরো দৃশ্যটা দেখানো হয়। তারপর এই বিজয়ের উৎসবে আমাকে বসানো হয় ঠিক মুঘল সম্রাটের পাশে। তাহলে বুঝতেই পারছেন, বন্দী হিসেবে কেমন লাগে সেটা জানা আছে আমার।”

ফ্রান্সিস নিচু গলায় ক্ষমা চাইলো। টমও মাথা নিচু করে সহমর্মিতা জানালো। এখন ও বুঝতে পারছে যে কিভাবে শাহুজি এতো নিরুত্তাপ কণ্ঠে নিজের সাম্রাজ্যের ধংসের কথা আলাপ করতে পারছেন। একজন বন্দী হিসেবে, সবসময় গলার সামনে একটা তরবারি নিয়ে বড় হয়েছেন উনি। ফলে ওনার আবেগ অনুভূতিকে এতো গভীরে কবর দিতে শিখেছেন যে ওগুলো হয়তো আর কোনোদিনও আলোর মুখ দেখবে না।

“আমি আসলে করুণা ভিক্ষার জন্যে আসিনি,” টম বলতে শুরু করলো।

শাহুজি কিছুই বললেন না, কিন্তু তার চোখে অধৈর্য ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

 “কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের দুজনেরই লক্ষ্য উদ্দেশ্য একই।”

অ্যানা যোগ দিলো আলোচনায়। “দস্যু আংরিয়া এই গৃহযুদ্ধে আপনার ফুফু আর তার ছেলেকে সমর্থন দিচ্ছে। আপনি যদি আপনার রাজ্যকে আবার জোড়া দিতে চান, তাহলে সবার আগে আংরিয়াকে সরাতে হবে।”

 “আমার বাবা মুঘলদেরকে তিলে তিলে পরাজিত করেছিলেন। আমিও আংরিয়াকে সেভাবেই পরাজিত করবো-সময় নিয়ে। আর তাছাড়া টিরাকোলা দুর্গ অজেয়।”

টম বিরক্তিসূচক শব্দ করে উঠলো। “যার সাথেই দেখা হয়, সে-ই একথা বলে। কেউ কখনো ওটাকে আক্রমণ করে দেখেছে?”

“যারা করেছে তারা সেই কাহিনি বলার জন্যে আর বেঁচে নেই,” শাহুজির মুখে একটা হাসি ফুটে উঠতে উঠতেও উঠলো না।

“আমাকে একদল সৈন্য দিন। আমি ওই দুর্গের ফটক খুলে আপনার হাতে তুলে দেবো,” নিষ্কল্প কণ্ঠে বললো টম।

 “আমি শুনেছি যে আপনি নাকি অবরোধ ঠেকানোর ব্যাপারে ভালোই পারদর্শী। তা সেভাবে কি অবরোধ করতেও পারবেন?”

 টম শাহুজির তাকানোর ভঙ্গিটা খেয়াল করলো। লোকটার জ্ঞান সম্পর্কে একটা আন্দাজ করতে পারলো ও। ব্রিঞ্জোয়ানের দুর্গ অবরোধ এখান থেকে কয়েকশো মাইল দূরে সংগঠিত হয়েছে। অন্য আর একটা সাম্রাজ্য, অন্য আর একটা নামে, কিন্তু তবুও শাহজি সেটা জানেন। এটাও ধরে ফেলেছেন যে টম ওখানে ছিলো। অথচ ও আজ সকালেই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে। টম ভিতরে ভিতরে মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।

“আপনি কি দস্যু আল-আউফ এর নাম শুনেছেন?” টম জিজ্ঞেস করলো।

“অশুভ?” শাহুজি সহজেই আরবি নামটার বাঙলা করে ফেললেন। মুঘল দরবারে বড় হওয়ায় আরবি ভাষাটা সম্ভবত ভালোই জানেন উনি। “দুঃখি শুনিনি।”

“কারণ সে বহু আগেই মারা গিয়ছে। মরার আগ পর্যন্ত সে ছিলো ভারত মহাসাগরের সবচে ভয়ংকর জলদস্যু। এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এতো সুরক্ষিত জাহাজগুলো পর্যন্ত ওর হাত থেকে রক্ষা পেতো না। ফ্লোর-ডি-লা মার নামের একটা দ্বীপে বিশাল একটা দুর্গ ছিলো তার। ওখান থেকেই সবকিছু পরিচালনা করতো সে। দুর্গের প্রতিরক্ষায় ছিলো অস্ত্র-গোলাবারুদ আর কামানসহ প্রায় এক হাজার জলদস্যুর বিশাল বাহিনি। লোকজন ঐ দুৰ্গটাকেও দুর্ভেদ্য বলতো। আমি আর আমার বাবা মিলে ওদের জাহাজের বহর জ্বালিয়ে দিয়ে, দুর্গের দরজা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজে আল-আউফের মাথা ওর ধড় থেকে আলাদা করেছিলাম।”

ওটাই ছিলো হাল কোর্টনীর জীবনের শেষ যুদ্ধ। যে বিস্ফোরণে দুর্গের দেয়াল উড়িয়ে দেওয়া হয়, সেটার আঘাতেই উনি পা হারান। কয়দিন পরেই গ্যাংগ্রিনে তার জীবনাবসান হয়। কিন্তু টম সেটার কথা উল্লেখ করলো না।

 শাহুজির পিছনে, সূর্যের আলো মেঘ ভেদ করে নেমে এসে কুয়াশাকে রাঙ্গিয়ে দিলো। ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে ধোঁয়ার মাঝে কামানের গোলার আগুনের মতো। টম রাজার দিকে তাকালো, কিন্তু তার ভাবলেশহীন চেহারা দেখে কিছুই বোঝা গেলো না।

তবে বোঝা গেলো যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। উনি সোজা হয়ে টমের কাঁধের উপর দিয়ে কিছু একটা বললেন। ঘুরতেই টম দেখলো কমপক্ষে আধা ডজন চাকর দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। যদিও ও নিশ্চিত যে এরা এখানে একটু আগেও ছিলো না। চাকরেরা কুর্নিশ করে টম আর তার সাথীদেরকে ওদের পিছু নিতে ইশারা করলো। তার মানে ওদের আলাপ শেষ।

“উনি কি বললেন?” আবার প্রাসাদের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে ফ্রান্সিস অ্যানাকে জিজ্ঞেস করলো।

“ঘোষণা দিলেন যে উনি শিকারে যাবেন।”

ফ্রান্সিস করিডোরের মুখে ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেলো। “আমরা এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি, শিকার না, প্রতিবাদ করলো ও।

“তুমি বোঝোনি,” অ্যানা বললো। “একটা হচ্ছে অন্যটার প্রস্তুতি। রাজা আমাদের প্রস্তাব বিবেচনা করছেন, কিন্তু উনি আরো কয়েকটা বিকল্পও ভেবে দেখছেন। যখন উনি ওনার সামন্তদেরকে শিকারের জন্য আহ্বান করবেন, তখন তারা তাদের সাথে তাদের চাকর বাকর, সৈন্যদল আর অস্ত্রপাতিও নিয়ে আসবে। উনি ওনার সৈন্যদেরকে জড়ো করছেন কিন্তু যুদ্ধে যাবেন কি যাবেন সেই সিদ্ধান্ত ভোলা রয়েছে। আর তাছাড়া শিকার সফল হলে সেটা যুদ্ধে সাফল্যের জন্যেও বড় একটা লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে।”

“যদি শিকার ভালো না হয়?”

অ্যানা কাঁধ ঝাঁকালো, “প্রার্থনা করো যেনো তেমনটা না হয়।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *