৭. দুপুরবেলা চুপি চুপি

০৭.

দুপুরবেলা চুপি চুপি নীচে নেমে এল বন্দনা। একতলার পশ্চিমের ঘরটাই সবচেয়ে অন্ধকার আর ড্যাম্প। এই ঘরেই আশ্রয় নিয়েছে রমা মাসি। কিছুতেই ওপরের ঘরে যেতে রাজি হয়নি। প্রথমদিন এসে শুধু মাকে একটা প্রণাম করে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। মা ধমক দিয়েছিল, চুপ কর!

ধমক খেয়ে চুপও করেছিল রমা মাসি। তারপর সেই যে এই ঘরে ছেলে নিয়ে ঢুকল, আর বেরোয় না। কাউকে মুখ দেখায় না।

দরজায় টোকা দিল বন্দনা।

 রমা মাসির ভীত গলা বলে উঠল, কে?

আমি মাসি। দরজা খোলো।

দরজা খুলে বিহ্বল মাসি হাসবে না কাঁদবে ঠিক করে উঠতে পারছিল না। দুটো বিপরীত ভাব মানুষের মুখে আর কখনও এরকম খেলা করতে দেখেনি বন্দনা। সে মাসিকে দুহাতে ধরে বলল, কেঁদো না, তোমার ছেলেটাকে চলো তো দেখি। আমি ভীষণ বাচ্চা ভালবাসি।

আয়।

 রোগা বাচ্চাটা শুয়ে ঘুমোচ্ছ মশারির মধ্যে।

 খুব শীত পড়েছে মাসি, ওকে রোদে নিয়ে তেল মাখাও না?

ঘরেই মাখাই।

কেন মাসি? ঘরের বাইরে যেতে ভয় পাও কেন?

রমা মৃদু গলায় বলল, কত ক্ষতি করে দিলাম তোদের। আমার জন্যই তো এত সব হয়ে গেল! মুখ দেখাতে লজ্জা করে।

ওসব ভুলে যাও।

রমা হঠাৎ তার দুটো হাত ধরে বলল, তোর জন্যই আমরা এখানে ফের আসতে পারলাম। রেণুদিকে তুই-ই রাজি করিয়েছিস। তুই এত ভাল কী বলব তোকে? যদি এখানে না আসতাম তা হলে আমরা আর বেঁচেই থাকতে পারতাম না। তোর জন্যই

ওসব বলতে নেই মাসি। আমার মা একটু রাগী ঠিকই, কিন্তু মা ভীষণ ভালও তো!

খুব ভাল রে! কিন্তু রেণুদির কী সর্বনাশটাই না আমি করলাম!

শোনো মাসি, একটু ওপরে টোপরে যেও, ঘোরাফেরা কোরো, নইলে সম্পর্কটা সহজ হবে না।

 সাহস পাই না যে রে!

মা তোমাদের ওপর রেগে নেই কিন্তু।

কী করে বুঝলি?

 মাকে আমি খুব বুঝি। বাইরের রাগ একটু আছে হয়তো, কিন্তু ভিতরে রাগ নেই।

আমার বড্ড ভয় করে রেণুদিকে।

রাত্রিবেলা মায়ের পাশে শুয়ে বন্দনা হঠাৎ বলল, মা, তুমি জন্মান্তরে বিশ্বাস করো?

হঠাৎ ওকথা কেন?

এমনি। বলো না করে কি না?

করব না কেন? চিরকাল শুনে আসছি মানুষ মরে আবার জন্মায়।

বন্দনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি রমা মাসির ছেলেটাকে দেখেছ মা?

মা একটা বিরক্তির শব্দ করে বলল, প্রবৃত্তি হয়নি।

বন্দনা আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক দাদার মতো দেখতে।

মা হঠাৎ নিথর হয়ে গেল। তারপর বলল, কে বলেছে?

 কে বলবে মা! আমারই মনে হয়েছে।

তুই ওই বয়সের প্রদীপকে তো দেখিসনি!

না তো। কিন্তু একটা আদল আসে।

 বাজে কথা। ঘুমো।

বন্দনা ঘুমোল। কিন্তু পরদিন ভারী অন্যমনস্ক রইল মা। তার পরদিন গিয়ে হানা দিল রমার ঘরে।

দু দিন বাদে ছেলেটা মায়ের কোলে কোলে ঘুরতে লাগল।

এই ছলনাটুকু করতে খারাপ লাগল না বন্দনার। এই ফাঁকা ভূতুড়ে বাড়িটায় একটু জনসমাগম হয়েছে। একটু প্রাণের স্পর্শ লেগেছে। এক নষ্ট হোক, সে চায়নি।

বাবা বড় বুড়িয়ে গেছে। মুখে কেবল মরার কথা। আমি আর বেশি দিন নয় রে। আমার হয়ে এসেছে।

বাঁচতও না বাবা। সেদিন দুপুরে এসে চলে যাওয়ার সময় বন্দনা গিয়ে যদি না আটকাত তা হলে বাবা বোধহয় পথেই পড়ে মারা যেত সেদিন। বন্দনা জোর করে ধরে নিয়ে এল। স্নান করতে পাঠাল, ভাত খাওয়াল। যেতে দিল না সেদিন। আর রাতে মায়ের কাছে কেঁদে পড়ল সে, ও মা, বাবাকে এখানে আসতে দাও।

মা বলল, আসুক না। আসতে তো বলছি। আমি থাকব না।

কেন মা? আমরাও কেন থাকি না এখানে?

তা কি হয়? আমার আত্মসম্মান নেই?

রমা মাসি তো খারাপ মানুষ নয় মা, সে তো কখনও তোমার অবাধ্যতা করেনি। এক ধারে এক কোণে পড়ে থাকবে। এত বড় বাড়ি, তুমি টেরও পাবে না।

শুনে মা খুব রাগ করল। বলল, এত কাণ্ডের পরও একথা বলতে পারলি তুই? ওদের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকব! কেন, আমার কি ভিক্ষেও জুটবে না?

বন্দনা মায়ের পা ধরেছিল, ওরকম বোলো না মা। বাবার কী অবস্থা দেখছ না। এ অবস্থায় ফেলে তুমি কোথায় যাবে?

আমাকে ফেলে যায়নি তোর বাবা?

তার শাস্তি তো পেয়েছে মা।

 সারা রাত মায়ের সঙ্গে তার টানাপোড়েন চলল। ভোর রাতের দিকে মা ধীরে ধীরে নরম হয়ে এল। কাঁদল। তারপর বলল, তোদের মুখ চেয়ে না হয় সেই ব্যবস্থা মেনে নিলাম। কিন্তু লোকে তো হবে।

এখন লোকে হাসে না মা। লোকের তত সময় নেই।

কিন্তু রমা নীচের তলা থেকে ওপরে উঠতে পারবে না কখনও। মনে রাখিস।

কথাটা মা নিজেই মনে রাখেনি। দশ দিনের মাথায় রমা মাসিকে দিব্যি দোতলায় ডেকে আনল মা। বলল, আমি ছেলেটাকে দেখছি, তুই রান্নার দিকটা সামলে নে।

চমকে উঠে রমা মাসি যেন কৃতজ্ঞতায় গলে পড়ে বলল, যাচ্ছি রেণুদি।

শাওলরাম মাড়োয়ারি এই সেদিনও এসে বাবার কাছে খানিকক্ষণ বসে থেকে গেছে। তার একটাই কথা, চৌধুরী সাহেব, বিশ লাখ দর তুলে বসে আছি। কিছু একটা বলুন।

বাবা হয়তো রাজি হয়ে যেত। বিষয়বুদ্ধি বলতে বাবার তো কিছু নেই। বন্দনা বাবাকে বলে রেখেছে, এ বাড়ি ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না বাবা। এ বাড়ি তুমি কিছুতেই বিক্রি করতে পারবে না।

বাবা তার দিকে চেয়ে হেসে বলেছে, আমারও তাই ইচ্ছে। শেষ কটা দিন এ বাড়িতেই কাটাই।

তুমি একটা কাজ করবে বাবা? বস্তির দিককার খানিকটা জমি বিক্রি করে দাও। বাকিটা আমাদের থাক।

পরদিনই মদনকাকা আর বাহাদুর মিলে ফিতে টেনে পিছনের দিককার জমিটা মাপজোক করল। মদনকাকা বাবাকে এসে বলল, বিঘে দুই হেসে খেলে বের করা যাবে। দু বিঘের অনেক দাম। পিছনের জমি বলে দাম কিছু কম হবে। তাও ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লাখ ধরে রাখুন। শাওলরাম দিনে দুপুরে ডাকাতির চেষ্টা করছে।

তাদের বাড়ির ভোল পাল্টাচ্ছে আস্তে আস্তে। মরা বাড়িটা জেগে উঠছে। একটু প্রাণের স্পর্শ লাগছে ক্রমে ক্রমে। কিন্তু বন্দনার বুকের মধ্যে মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইশলের মতো দীর্ঘ টানা বাঁশির মতো কী যেন বেজে যায়। একমাস পার হয়ে গেছে। অতীশ কলকাতায় চলে গেল বোধহয়! কবে গেল? বলেও গেল না?

মা! ও মা! ছেলে ফিরে পেয়ে সব ভুলে গেলে যে। বাবা ফিরে এল, এবার নারায়ণপুজো দেবে না?

 তাই তো। কত দিন পুজোপাঠ নেই। বাহাদুরকে দিয়ে ভট্টচামশাইকে খবর পাঠা তো।

বাহাদুরকে ভটচামশাইয়ের কাছে পাঠাল বন্দনা। কিন্তু মনে মনে বলল, হে ঠাকুর, ভটচামশাইয়ের যেন কাল জ্বর হয়। যেন অতীশ আসে। তার যেন কলকাতায় যাওয়া না হয়ে থাকে ….

এক মাসের জায়গায় দেড় মাস পেরিয়ে গেছে, অতীশের থাকার কথা নয়। এই ভেবে বন্দনার বুকটা ধুক ধুক করতে লাগল অনিশ্চয়তায়।

পরদিন সন্ধেবেলা সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল বন্দনা। কে আসবে? কে আসবে? কে আসবে? হে ঠাকুর …

গায়ে নামাবলি জড়ানো পুরুত ঠাকুর যখন তার লাজুক মুখটা নামিয়ে নম্র পায়ে উঠে আসছিল সিঁড়ি বেয়ে তখন যে কেন আনন্দে হার্টফেল হল না বন্দনার কে বলবে? তার খুব হাততালি দিয়ে হো হো করে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল। ইচ্ছে হল ছাদে গিয়ে নীচে লাফিয়ে পড়তে। ইচ্ছে হল আজ ঘুমের মধ্যে মরে যেতে।

যতক্ষণ পুজো করল অতীশ, বন্দনার দুটো চোখের পলক পড়ল না। ঠাকুর আজ তার দুটো চোখ ভরে দিচ্ছেন। আর কিছু চায় না বন্দনা। আর কিছু নয়। শুধু মাঝে মাঝে যেন দু চোখ ভরে দেখতে পায়।

জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল পিছনের বাগান। কুয়াশায় মাখামাখি। নতমুখে বাগানটা পেরোচ্ছিল অতীশ। আতা গাছটার তলায় কে যেন বসে আছে! অতীশ থমকে দাঁড়াল।

কলকাতায় কবে যাচ্ছ?

অতীশ একটু হাসল, এখানে বসে থাকতে হয় বুঝি খুকি? ঠাণ্ডা লাগবে না?

কথার জবাব দাওনি।

যাচ্ছি না। তিনটে ডাইনি যেতে দিচ্ছে না।

 ডাইনি! সে আবার কী?

আছে। তুমি বুঝবে না। ঘরে যাও ঠাণ্ডা লাগবে।

আমি মরব।

ওরকম বলতে নেই।

আমি মরলে তোমার কী?

সে কি বোঝাতে পারি?

তুমি একটা বিচ্ছিরি লোক।

জানি খুকি, জানি।

 শোনো, আমাদের পিছনের দু বিঘে জমি বিক্রি হবে। বাবার তো একটুও বুদ্ধি নেই। কে আমাদের এত সব কাজ করে দেবে বলো? তুমি ভার নেবে? বাবা বলেছে টেন পারসেন্ট কমিশন।

অতীশ একটু হাসল। বলল, আমি বড় লোভী, না খুকি?

 বন্দনা ভ্রু কুঁচকে বলল, লোভীই তো!

তারা আর কোনও কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মুখোমুখি। তারা বলল না, কিন্তু তাদের হয়ে আজ রাতের জ্যোৎস্না, একটু কুয়াশা আর পুরনো এই বাড়ির প্রাচীন এক হাওয়া কত কথা কয়ে গেল। কত কথা উঠে এল মাটির গভীর থেকে, আকাশ থেকে ঝরে পড়ল। তাদের চারদিকে সেইসব কথা উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগল। গুনগুন, গুনগুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *