০৭.
দিন দুই-তিন তারাপদর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই।
রবিবার বিকেলে তারাপদ এল; সঙ্গে চন্দন।
কিকিরা বললেন, “ছিলে কোথায়? তোমাদের দিয়ে কুটোটিও নড়ানো যাবে না। এজেন্সি তুলে দাও।”
তারাপদ আর চন্দন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বুঝল না কিছু! তারাপদ বলল, “কিসের এজেন্সি কিকিরা?”
“কুটুস এজেন্সি।”
“সেটা কী?”
“কিকিরা-তারাপদ-চন্দন ডিটেকটিভ এজেন্সি। কে. টি. সি। মিষ্টি করে বলতে পারো ‘কুটুস’।”
তারাপদরা হেসে উঠল।
চন্দন হাসতে হাসতে বলল, “এটা আপনি মন্দ বলেননি, কিকিরা। ভাল আইডিয়া। কলকাতায় আজকাল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেশনের অনেকগুলো কোম্পানি হয়েছে। আমরাও একটা লাগিয়ে দিতে রাজি। কুটুস এজেন্সি।”
তারাপদ হেসে বলল, “আপনি হবেন ব্যুরো চিফ। ম্যাজিশিয়ান ডিটেকটিভ। ভাবা যায় না, স্যার। জগতে এমন জিনিস দুটি নেই।”
কিকিরা রাগের ভান করে বললেন, “তোমরা তো আমাকে ওই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছ! ছিলাম ভাল; বাজাচ্ছিলাম বাঁশি, হয়ে গেল ফাঁসি।”
তিনজনেই হেসে উঠল।
শেষে তারাপদ বলল, “আমি স্যার, আপনার হুকুমের নফর। যেমন যেমন হুকুম করেছিলেন তেমনটি করছি। জগুদার পেছনে লেগে আছি। ওর বাড়িতে যাচ্ছি-আসছি। আমায় আপনি দোষ দিতে পারবেন না।”
চন্দন বলল, “আমাকে চাকরিতেই মেরে দিয়েছে, কিকিরা। তবু তারার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছি।”
কিকিরা তারাপদকে বললেন, “তোমার জগুদা অন্তর্ধান করে গেল গো!”
“আজ আসবে,” তারাপদ বলল, “সন্ধের আগেই। বলে দিয়েছে “
কিকিরা তারাপদর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খবরটবর জোগাড় করতে পারলে?”
“অল্পস্বল্প।“
“বলো, শুনি।”
কিকিরার এই জাদুঘরে তারাপদ নিজের একটি বসার জায়গা করে নিয়েছে, সেখানেই সে বসে। চন্দনও বরাবর জানলার দিকে এক ছোট সোফাতেই বসে সাধারণত। ঘরে জায়গা কম। ওরই মধ্যে বসার ব্যবস্থা করে রেখেছেন কিকিরা।
ঘরে দু-চারটে মশা উড়ছিল। এবার যেন শীতের আগেই মশার উৎপাত শুরু হয়েছে। এক মশা-মারা ধূপ জ্বলছিল। খুব হালকা একটু গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
তারাপদ বলল, “জগুদাকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে যা জানতে পারলাম, তাতে মনে হল, ওর বাবা যে কিছু রেখে গেছেন সেটা ও বিশ্বাস করে। কেননা, মায়ের কথা থেকে মাঝে-মাঝে মনে হয়েছে, বোনের জন্যে অত ভেবে মরার কারণ। নেই। মা এর বেশি কিছু বলতেন না। আর-একটা কথা মা বলতেন, বাবার কোনো পুরনো বন্ধুবান্ধব যদি গায়ে পড়ে মেলামেশা করতে চায় বা সাহায্য করতে চায়, জগুদা যেন কখনোই তা না নেয়। বাবার পুরনো বন্ধুরা বাড়িতে কোনো কাজেকর্মে নেমন্তন্ন করলেও জগুদার মা ছেলেকে বলে দিতেন–কোন বাড়িতে সে যাবে, কোন বাড়িতে যাবে না।”
কিকিরা শুনতে শুনতে মাথা নাড়লেন। “আচ্ছা! মায়ের কথামতনই চলতে হত জগন্নাথকে।”
“হ্যাঁ।”
“ওর বাবা কোন-কোন বড় দোকানে আসা-যাওয়া করতেন, খোঁজ নিয়েছ?”
“নিয়েছি।” বলে তারাপদ পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে কিকিরাকে দিল। বলল, “প্রথম দু-তিনটে নাম নজর করবেন। বাকি দু-তিনটে তেমন নয়। তবে ছোটখাটো দু-চারজন জুয়েলারও ছিল যারা জগুদার বাবার কাছে। আসত। তাদের কথা জগুদার মনে নেই বড়।”
কিকিরা কাগজটা নিয়ে দেখলেন। চন্দন বলল, “কিকিরা, তারাপদ ওর জগুদার বাড়ির এক বুড়োকে ক্যাচ করেছে। তার কথা শুনুন।”
কিকিরা তারাপদকে বললেন, “কী কথা?”
তারাপদ বলল, “জগুদার এক জেঠা আছে। বছর-পঁচাত্তর বয়েস। সম্পর্কে জেঠা। ওই বাড়ির নিচের তলায় একটা ঘরে থাকেন। ঘরটা বোধ হয় কোনো সময়ে আস্তাবল ছিল। কী বিশ্রী দেখতে। ঘরের সামনে চৌবাচ্চা, শ্যাওলা-পড়া উঠোন, গোটা-দুই ডালিম গাছের ঝোঁপ, গোবর, খুঁটে–সে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। জেঠা ভদ্রলোক, একাই থাকেন; নিজের ঘরেই তাঁর কেরোসিন স্টোভে রান্না হয়। কতকগুলো ছোট-ছোট হাঁড়ি, কড়াই, মালা। পাশে একটা সরু তাপোশে চিট-বিছানা। জেঠামশাই করেন না কিছুই। সকাল-বিকেল তাঁকে বাড়ির সামনে দেখা যায়। সকালে পাড়ার চায়ের দোকান থেকে চা আনিয়ে টিনের চেয়ার টেনে বসে থাকেন আর বিড়ি ফোঁকেন। সন্ধেবেলায় খান আফিং।”
“বা-বা, বেশ মানুষটি তো। ওঁর চলে কেমন করে?”
“চলে আর কই? কোনোরকমে দুটো জুটে যায়। উনি কয়েকটা দৈব ওষুধ জানেন। পোড়া, অম্লশূল, একজিমা, হাঁপানি–এই সব। এগুলো তৈরি করে দেন। তাতেই যা পান। তা ছাড়া দু’-দশ টাকা পাড়ার লোকও দেয়।”
“কী নাম?”
“মণিবাবু।”
“ওঁর সঙ্গে তুমি আলাপ করেছ?”
“উনি নিজেই একদিন ডেকে আলাপ করলেন। জগুদার কাছে। যাচ্ছি-আসছি দেখে।”
“কী বললেন?”
“বুড়ো মানুষ–সাত কাসুন্দি শোনালেন দত্তবাড়ির।”
“জগন্নাথের বাবা-মা সম্পর্কে কী বললেন?”
“বললেন, আজকাল সংসারে ধর্মও নেই, ধর্মের কলও নেই, বাতাসে আর কিছুই নড়ে না। তবে হ্যাঁ, ওই ওপরে একজন আছেন, তাঁর চোখে সবই পড়ে।
“তুমি জগন্নাথের বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে না?”
“করেছি।”
“কী বললেন?”
“বললেন, কুকুরের পেটে কি ঘি সয় গো? যেমন ছিলি, তেমন থাকলে তো খেয়ে-পরে থাকতে পারতিস। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। সংসারটাকে ভাসিয়ে গেল।”
কিকিরার কান ছিল কথায়, বললেন, “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু!”
“তাই তো বললেন।”
“তুমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলে না?”
“অ্যাকসিডেন্টের কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ওপর থেকে প্রথমে অতটা বোঝা যায়নি, পরে দেখা গেল কোমরের কাছে জোর জখম হয়েছিল জগুদার বাবা। ভেতরে ভীষণ লেগেছিল। দু-চার ঘণ্টার পর আর হুঁশও ছিল না।”
কিকিরা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় জগন্নাথ এসেছে বোঝা গেল। ফ্ল্যাটের সদরে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল বগলার সঙ্গে।
জগন্নাথ ঘরে এল একটু পরেই।
কিকিরা বললেন, “এসো হে জগন্নাথ! আছ কেমন?”
জগন্নাথ বলল, “ভাল নয়।”
“তোমায় বেশ শুকনো-শুকনো দেখাচ্ছে। বসো!”
বসল জগন্নাথ।
বগলার চা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। চা আর কচুরি এনে দিয়ে গেল।
চা খেতে-খেতে কিকিরা জগন্নাথকে বললেন, “নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?”
“আজ্ঞে, নতুন বলতে কাল বাড়ি ফিরে গিয়ে আবার একটা চিঠি পেলাম।“
“প্রেতসিদ্ধর?”
“হ্যাঁ। কাল শনিবার ছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে একবার আমার এক মামার কাছে গিয়েছিলাম। জেলেপাড়ায়। নিজের মামা নয়। মায়ের মাসতুতো দাদা। হাত ভেঙে পড়ে আছেন বুড়ো বয়েসে। মামাকে দেখে বাড়ি ফিরে চিঠিটা পেলাম।”
“বয়ান কী? সেই আগের মতন? এনেছ চিঠিটা?”
জগন্নাথ পকেট থেকে চিঠি বার করে কিকিরাকে দিল।
তারাপদ ইশারায় কচুরি তুলে চা নিতে বলল জগন্নাথকে। এই চিঠির কথা সে জানে না। জগুদা সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে গিয়ে চিঠিটা পেয়েছে, কাল ছিল শনিবার, আজ রবি, জগুদার সঙ্গে তার দেখা হয়নি।
কিকিরা চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, “চিঠি তো একই। এবার তাড়া বেশি। তোমার মায়ের আত্মার সঙ্গে শুদ্ধানন্দর বড় ঘন ঘন দেখা হয়ে যাচ্ছে। তাই না?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“তা তুমি চুপ করে বসে আছ কেন? জানিয়ে দাও, তুমি শুদ্ধানন্দর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।”
“যাব?”
“অবশ্যই যাবে।”
জগন্নাথ ভয়ে-ভয়ে বলল, “যদি কিছু হয়?”
“কী আর হবে। হবে না কিছু।”
“আমার কিন্তু ভয় করছে।”
“ভয় পাবার ব্যাপার নেই জগন্নাথ! তুমি জানিয়ে দাও, তুমি যাবে। কবে যাবে তাও আমি বলে দিচ্ছি।” বলে কিকিরা কিসের হিসেব করলেন মনে-মনে। শেষে বললেন, “আগামী শনিবার। …না, শনিবার থাক, রবিবার। আগামী রবিবার।”
জগন্নাথ তাকিয়ে থাকল।
কিকিরা হেসে বললেন, “ভয় করার কারণ নেই। আমি থাকব। কিন্তু একথা যেন কেউ না জানতে পারে। তোমার সঙ্গে থাকব আমি। প্রেতসিদ্ধর খাস ঘরে। যেখানে তিনি আত্মাদের আনেন-টানেন। আর বাইরে থাকবে এরা, তারাপদ আর চন্দন। দু-চারজন বাইরের লোক আরও থাকতে পারে। সে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”
জগন্নাথ ঘাড় নাড়ল। কিকিরা বললেন, “তুমি শুধু চিঠিতে লিখে দিও প্রণামী’ সম্বন্ধে আপনি চিন্তা করিবেন না। আমি যথাযোগ্য পুস্পাঞ্জলি দিব। তবে সামান্য নিরিবিলিতে কথাবার্তা বলিতে চাহি।”