কাউন্সিলার ইফতেখার হোসেনের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন ছিলো সাতটায়। আকাশ এক ঘন্টা আগেই এসে হাজির হল। এমন একটা আনন্দের সংবাদ ওর থলেতে জমা ছিলো যে, বাংলাদেশের কাউন্সিলারকে না বলে স্বস্তি পাচ্ছিলো না। গতবার যখন ও বুখারেষ্টে এসেছিলো তখনই ইফতেখার হোসেনের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। সামান্য পরিচয়ে তিনি বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ঘরের ছেলের মতো যত্ন করে নানা পদের দেশী খাবার খাইয়েছেন। সবই বিশেষভাবে ওরই জন্য তৈরি করা হয়েছিলো। আমেরিকায় অনাত্মীয় পরিবেশে বড় হলেও ওর ভেতর যে একটা বাঙালি মন আছে, এটা ইফতেখার হোসেন ঠিকই বুঝেছিলেন।
ডোরবেল টিপতেই কবিতা এসে দরজা খুলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো–আরে আকাশ ভাই যে, ভেতরে এসো। এই বলে গলা তুলে ডাকলো–বাবা, আকাশ ভাই এসে গেছে।
ভেতরে বসার ঘরে সুজন আর ইফতেখার হোসেন বসে টেলিভিশন দেখছিলেন। কবিতার গলা শুনে তিনি বেরিয়ে এলেন। হাতে ধরা নানা রঙের কারনেশান ফুলের গোছাটা কবিতার হাতে দিয়ে আকাশ একটু লাজুক হাসলোআগেই চলে এলাম। আপনাকে একটা দারুণ খবর দেবো।
কী খবর আকাশ? ওকে নিয়ে বসার ঘরে যেতে যেতে জানতে চাইলেন ইফতেখার হোসেন।
চসেস্কুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। পঁচিশ মিনিটের ইন্টারভিউর জন্য সময় দিয়েছেন। উত্তেজনায় সুজনকে লক্ষ্য না করেই ওর পাশে বসে পড়লো আকাশ।
সুজন আকাশের উত্তেজনা দেখে কিছুটা অবাক হলো। চসেস্কুর সাক্ষাৎকার নেয়ার ভেতরে উত্তেজিত হওয়ার কি আছে–ভাবতে গিয়ে হোঁচট খেলো ইফতি চাচার কথায়–আরে, বলো কি আকাশ। এত বছর রুমানিয়ায় আছি। চসেস্কু কোনো বিদেশী সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শুনিনি তো! কীভাবে পেলে বলো তো?
হোম মিনিস্টারকে পটিয়ে।
কি ভাবে পটালে?
দামি মদ আর সিগারেট দিয়ে।
হা হা করে গলা খুলে হাসলেন ইফতেখার হোসেন–অল্পদিনেই তুমি রুমানিয়ার নেতাদের চরিত্র বুঝে ফেলেছে।
উপহার পেলে সবাই খুশি হয়।
সুজন চুপচাপ বসে ওদের দুজনের কথা শুনছিলো। আকাশের বাংলা বলার ধরন ইংরেজির মতোই, শুনতে মজাই লাগছিলো ওর। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা, দেখলেই ভালো লাগে। সুজনের উপস্থিতির কথা ইফতি চাচার খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আরে, তোমাদের যে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। নি। নিশ্চয় বুঝতে পারছো এ হচ্ছে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি আকাশ, ওর কথা আগে তোমাকে বলেছি। আর আকাশ, এ হল আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ছেলে সুজন। ইয়ং পাইওনিয়ার্স ক্যাম্পে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে এসেছিলো। আমি আটকে রেখেছি।
সুজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মৃদু হেসে আকাশ বললো, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
ইফতি চাচা বললেন, ওকে আপনি করে বলছো কেন আকাশ, ওর বয়স এখনো আঠার হয় নি।
সুজনও হেসে বললো, আমাকে তুমি বলবেন আকাশ ভাই। ঠিক আছে সুজন, তুমিই বলব। রুমানিয়া কেমন লাগছে?
ক্যাম্পের বাইরে কোথাও যাই নি। আজ সকালে ইফতি চাচা কাউন্ট ড্রাকুলার ক্যাসেলে নিয়ে গিয়েছিলেন।
নিশ্চয় অনেক ভ্যাম্পায়ার দেখেছে ওখানে?
মোটেও না। সুজন হেসে বললো, উপন্যাস পড়ে আমিও তাই ভেবেছিলাম । ইফতি চাচা বললেন, ড্রাকুলা একজন দেশপ্রেমিক রাজা ছিলেন। গির্জার পাদ্রীদের খবরদারী পছন্দ করতেন না। তাই ওরা ওকে ভ্যাম্পায়ার বানিয়ে দিয়েছে।
এখানকার লোকজনের সঙ্গে মিশেছো?
ক্যাম্পে আমার দোভাষী ছিলো মারিয়া। চমৎকার মেয়ে। লোকজন যাদের সঙ্গে মিশেছি খুবই ভালো লেগেছে।
সরকারি অতিথি হয়ে যখন এসেছে তখন ভালো ভালো লোকের সঙ্গেই দেখা হবে। বলবে তারা খুব সুখে আছে, এত সুন্দর দেশ পৃথিবীতে দুটো নেই।
এখন আর আমি সরকারি অতিথি নই। আশা করি আসল মানুষের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবো।
ওর আরেকটা পরিচয় তোমাকে দেয়া হয় নি। আকাশের দিকে তাকিয়ে ইফতি চাচা বললেন, সুজন হচ্ছে বিখ্যাত সাংবাদিক জাফর চৌধুরীর ছেলে, মুক্তিযুদ্ধে যিনি শহীদ হয়েছেন।
কি বললেন? ইফতি চাচার কথা শুনে অসম্ভব রকম চমকে উঠলো আকাশ–সুজন কার ছেলে?
জাফর চৌধুরী, সংবাদের এক্সিকিউটিভ এডিটর ছিলেন। নামটা কি তোমার পরিচিত?
সুজনের দিকে ঘুরে তাকিয়ে আকাশ উত্তেজিত গলায় বললো, আমেরিকায় তোমার যে এক ফুপু থাকেন জানো?
জানবো না কেন? আমার তো ফুপু একটাই। আপনি তাঁকে চেনেন?
আমি তার ছেলে। তোমাদের বাড়িতে কখনো আমার নাম শোন নি?
আমাকে কেউ কখনো বলে নি। আপনি আমার ভাই?
সুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে আকাশ বললো, হ্যাঁ, আমি তোমার ভাই।
ইফতি চাচা এতক্ষণ অবাক হয়ে ওদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, কবিতা, আসমা, শিগগির শুনে যাও। আমাদের সুজন আকাশের ভাই।
মাকে নিয়ে রান্না ঘরে ব্যস্ত ছিলো কবিতা। বাবার কথা শুনে ছুটে এলো মার সঙ্গে। বললো, কেমন ভাই বাবা?
আকাশ উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, আমার আপন মামার ছেলে সুজন। মামের কাছে। জাফর মামার অনেক গল্প শুনেছি। তবে মনে পড়ছে না সুজনের নাম শুনেছি কিনা।
ইফতি চাচা বললেন, জাফরের কাছে আমি ওর আমেরিকায় থাকা বোনের কথা কম শুনি নি। তুমি তাহলে জাফরের সেই বোনের ছেলে। আর কোনো কথা শুনছি না আকাশ। আমি লক্ষ্য করেছি আমাকে তুমি কি ডাকবে ঠিক করে উঠতে পারছিলে না। এবার হলো তো! আমি হলাম তোমার ইফতি মামা। একশ বার আপনি ইফতি মামা। ইশ, মাম আর ড্যাড শুনলে যে কি খুশি হবে! আমি হোটেলে গিয়েই ফোন করবো!
হোটেলে গিয়ে কেন আকাশ ভাই? কবিতা আদুরে গলায় বললো, এখান থেকে ফোন করো না। তোমাদের দুই ভাইয়ের প্রথম দেখা হওয়াটা আমরাও সেলিব্রেট করি।
ইফতি চাচা বললেন, কবিতা ঠিকই বলেছে আকাশ। নম্বর বলো। হোটেলের চেয়ে এখান থেকে তাড়াতাড়ি লাইন পাবে।
আকাশের কাছ থেকে ওর মায়ের ফোন নম্বর নিয়ে তিনি আর্জেন্ট ট্রাঙ্ককল বুক করলেন। তারপর খুশি ভরা গলায় বললেন, আসমা শ্যাম্পেনের বোতল বের করো। বাইরের গেস্ট আসার আগেই সেলিব্রেশনটা হয়ে যাক।
তুমি বসো মা, আমি আনছি। এই বলে কবিতা ছুটে গিয়ে শ্যাম্পেনের বোতল আর গ্লাস বের করে টেবিলে সাজালো। ওর বাবা শব্দ করে বোতল খুলতেই পিচকিরির মতো শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটলো। পাঁচটা গ্লাসে শ্যাম্পেন ঢেলে নিজের গ্লাস উঁচ করে টোস্ট করলেন–আকাশ আর সুজন-দুই ভাইয়ের মিলনের উদ্দেশ্যে।
সবার সঙ্গে গ্লাস ঠোকাঠুকি করে সুজন শ্যাম্পেনের গ্লাসে চুমুক দিলো। জীবনে প্রথম মদ খেলো। টক, মিষ্টি, ঝঝওয়ালা শ্যাম্পেন ওর মজাই লাগলো।
ডিনারের অতিথিরা আসার আগেই সেন্ট লুইসের লাইন পাওয়া গেলো। ইফতি চাচা লাইন ধরে আকাশকে দিতেই ও উত্তেজিত গলায় মাকে বললো, তোমাকে দারুণ সারপ্রাইজ দেবো মাম। জাফর মামার ছেলে সুজন তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
রিসিভার কানে তুলে–হ্যালো ফুপু, বলতেই ওপাশ থেকে কথার ঝর্ণাধারা নেমে এলো–সুজন, তুই বুখারেস্ট কবে এলি, কোথায় আছিস ওখানে, তোর মা কেমন আছে, তুই এখন কি পড়ছিস, তোরা আমাকে চিঠি লিখিস না কেন, আমি কি তোদের পর–কি রে কথা বল?
কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি কোথায় ফুপু! এই বলে সুজন ওর বুখারেস্ট আসার উপলক্ষ্যের কথা জানালো, মা ভালো আছে বললো। নিজের পড়ার কথা বললো এখানে এখন আছে বাবার বন্ধু ইফতি চাচার বাসায়। পনেরো দিন পর দেশে ফিরে যাবে। এসব কথা বলার পর নিজের অভিমানের কথা জানাতে ভুললো না–ফুপু, গত বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে আপনাকে লিখেছিলাম আমাকে নিয়ে যান, ঢাকায় থাকলে আমার পড়াশোনা হবে না, বাড়ির সব কাজ করে পড়ার সময় হয় না। আপনি উত্তর দেন নি বলে আর চিঠি লিখি নি!
ফুপু অধৈর্য গলায় বললেন, এসব তুই কি বলছিস সুজন। আমি তোর কোনো চিঠি পাই নি। তোকে কেন বাড়ির কাজ করতে হবে? মাঝখানে অসুবিধে ছিলো বলে কমাস টাকা পাঠাতে পারি নি। এছাড়া প্রতি মাসে তোদের জন্য দুশ ডলার করে পাঠাচ্ছি।
মা আর আমি জানি আপনি মাঝে মাঝে বড় চাচাকে টাকা পাঠান বাড়ি মেরামত করা আর খাজনা ট্যাক্স এসব দেয়ার জন্য। আমাদের জন্য আলাদা টাকা পাঠান এমন কথা কখনো কেউ আমাদের বলে নি।
হায় আল্লা, বাড়ি মেরামতের টাকা তো আলাদা পাঠাই! তোদের টাকা দিয়ে বাড়ি মেরামত করতে কে বলেছে? ঠিক আছে সুজন, ওসব নিয়ে আমি বড়দার সঙ্গে বোঝাঁপড়া করবো। আগামী বছরই আমি দেশে যাবো। তুই ঢাকা ফেরার আগে আমাদের এখান থেকে ঘুরে যা। আমি টিকেট পাঠাচ্ছি।
ফুপুর কথা শুনে সুজনের সব অভিমান চলে গেলো। বললো, টিকেট পাঠালেই কি যেতে পারব? ভিসা লাগবে যে! এখান থেকে কি আমাকে ভিসা দেবে?
একশ বার দেবে। ও নিয়ে তুই ভাবিস না। তোর সঙ্গে এখনকার মতো এই কথাই থাকলো। আকাশের সঙ্গে চলে আয়। ওর দেরি হলে একা চলে আসবি। আমি এয়ারপোর্টে থাকবো। ফোনটা আকাশকে দে।
ফুপুর সঙ্গে আকাশের কি কথা হলো সুজন শুনলো একতরফা। আকাশ কয়েকবার বললো, ঠিক আছে। শেষে বললো, সুজনের জন্যে তুমি ভেবো না, আমি তো আছি।
ফোন নামিয়ে রেখে আকাশ উচ্ছ্বলিত গলায় বললো, তুমি আমার সঙ্গে যাচ্ছো সুজন। ক্রিসমাসের পরদিনই ফ্লাই করবো আমরা। তুমি নিউ ইয়ার্স করবে আমাদের সঙ্গে। ক্রিসমাসের আগে যেতে পারলে আরো মজা হতো।
এ ধরনের কথা সুজন আগে কখনো শোনে নি। নিউ ইয়ার্স করা কাকে বলে ও জানবে কোত্থেকে! ওর দিন কাটে চাচাঁদের গালমন্দ শুনে আর ফাইফরমাশ খেটে। পুরোনো বছর কখন যায়, নতুন বছর কখন আসে জানার সময়ই থাকে না ওর। আসিফের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতায় ওর মন ভরে গেলো। আসিফ উদ্যোগ না নিলে ওর রুমানিয়া আসা হতো না, দেখা হতো না জামাল ভাই, ইফতি চাচা, মারিয়া আর আকাশ ভাইর সঙ্গে। কথা হতো না ফুপুর সঙ্গে যাওয়া হতো না আমেরিকা–যেখানে ও যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে গত এক বছর ধরে।
ইফতি চাচার পার্টিতে ঠিক সাতটায় এলেন ইণ্ডিয়ান এ্যাসির কাউন্সিলার কুলভূষণ দেশপান্ডে, মিসেস দেশপান্ডে আর তাঁদের মেয়ে চিত্রা। কবিতার বয়সী হবে মেয়েটি তবে ওর চেয়ে লম্বা দেখতেও ভালো। তারপর এলেন ফরেন মিনিস্ট্রির দুজন পরিচালক। এঁরা দুজন যখন শুনলেন, আকাশ প্রেসিডেন্ট চসেস্কুর ইন্টারভিউ নিতে যাচ্ছে তখন এমনই চমকে উঠলেন যে একজনের মদের গ্লাস থেকে খানিকটা ছলকে পড়লো মিসেস দেশপান্ডের শাড়িতে। আরেকজন চিত্রার ওড়না মাড়িয়ে দিলেন। একজন ভাঙা গলায় আকাশকে প্রশ্ন করলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আপনি কখন দেখা করবেন জানতে পারি কি?
নিশ্চয় পারেন। বললো আকাশ–২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাসের দিন বিকেল তিনটায়।
আপনি অত্যন্ত ভাগ্যবান ব্যক্তি। এত অল্প সময়ে কেউ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারে না।
আকাশ মৃদু হাসলো। আজ সকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর অফিস থেকে ওকে পাঠানো হয়েছিলো চসেস্কুর গুপ্ত পুলিশের সদর দফতরে। সেখানকার এক নম্বর ব্যক্তি ঝাড়া দুঘন্টা ওকে জেরা করেছেন। আকাশের সব কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনার পর সন্তুষ্ট হয়ে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকারের তারিখ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। বলেছেন চব্বিশ তারিখে তার সঙ্গে আরেকবার দেখা করতে। কি নাকি সব প্রটোকলের ব্যাপার আছে।
দুপুরেই খবরটা ওয়াশিংটনে ফোন করে জানিয়েছে আকাশ। হেনরী পেপার্সও প্রথমে বিশ্বাস করতে চান নি। কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে তার হুঙ্কার শুনলো আকাশ-পঁচিশ তারিখে সাক্ষাৎকারটা নিয়েই পাঠিয়ে দেবে। ছাব্বিশ তারিখের ভেতর বুখারেস্ট ছাড়বে। সাতাশ তারিখ আমার অফিসে দেখতে চাই তোমাকে।
সবার কথাবার্তা শুনে আকাশের মনে হচ্ছে ও একটা দারুণ কাজ করে ফেলেছে। পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে চসেস্কুর মতামত এখন গর্বাচেভের চেয়েও বেশি দামি। কারণ গর্বাচেভের সাক্ষাৎকারে এখন আর কোনো অভিনবত্ব নেই, অনেক নেয়া হয়ে গেছে। মনে হয় পশ্চিমা সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন তিনি। গর্বাচেভের একমাত্র ভয় চসেস্কুকে নিয়ে। পূর্ব জার্মানীর হোনেকার একটু বেঁকে বসেছিলেন তাঁর লাইন মতো চলবেন না বলে। ঠিকই তাঁকে গদি ছাড়তে হয়েছে নবেম্বরে। অথচ ডিসেম্বর মাস এসে গেছে, চসেস্কুকে কিছুতেই নামানো যাচ্ছে না। উল্টো সবাইকে ধমক দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এ নিয়ে গর্বাচেভের ভাবনার শেষ নেই।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে উঠলো ইফতেখার হোসেনের বাড়ির ছোট্ট ডিনার পার্টি। বড়রা সবাই ড্রইংরুমে। সুজন, আকাশ, কবিতা আর চিত্রা বসেছে স্টাডিতে কার্পেটের ওপর। সুজন লক্ষ্য করেছে চিত্রা আর আকাশ পানির মতো মদ খাচ্ছে। ওর অভ্যাস নেই বলে কবিতা ওকে হালকা একটা ককটেল বানিয়ে দিয়েছে। গ্লাসে অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছে সুজন, দারুণ লাগছে ওর। কবিতা নিয়েছে অরেঞ্জ জুস। প্রথম থেকে কবিতা সুজনের চেয়ে বেশি আকাশের দিকে মনোযোগ দিচ্ছিলো। চিত্রাকে বরং মনে হলো ওর সঙ্গে কথা বলতে বেশি আগ্রহী। সুজনকে বাংলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করলো আকাশ–ইউরোপে তো দেখতেই পাচ্ছো, একের পর এক ডিক্টেটরদের পতন হচ্ছে। তোমাদের ঘাড়ে যে এরশাদের মতো একটা ডিক্টেটর সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছে, ওটাকে কবে হটাচ্ছো? তোমার বাবার হত্যাকারীদের ও মন্ত্রী বানিয়েছে এ খরও আমরা রাখি।
চিত্রার যাতে বুঝতে অসুবিধে না হয় সেজন্যে ওরা নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে কথা বলছিলো। সুজন বললো, পতনের আর বেশি দেরি নেই। খুব শিগগিরই খবরটা আপনারা পেয়ে যাবেন।
তোমাদের পলিটিক্যাল পার্টিগুলোকে তো তেমন সিরিয়াস মনে হচ্ছে না।
হতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্ররা একটা বড় শক্তি। ওরা পার্টিকে বাধ্য করবে সিরিয়াস হতে।
চিত্রা জানতে চাইলো, জন, তুমি কি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত?
মারিয়ার মতো চিত্রাও ওকে জন বলে ডাকছিলো। সুজন সায় জানিয়ে বললো, আমাদের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে ছাত্রদের রাজনীতি করতেই হয়।
যাই বলো সুজন–আকাশ বললো, এরশাদকে সরাতে গিয়ে তোমরা জামাতে ইসলামী আর ফাণ্ডামেন্টারিস্টদের একটু বেশি লাই দিচ্ছে। তোমাদের সঙ্গে ওরাও তো দিব্যি আন্দোলনে জুটে গেছে। কেউ কিছু বলছে না।
এখন আমাদের একটাই দাবি আকাশ ভাই। এরশাদকে হটানোর পর আমরা ওদের নিয়ে ভাববো।
ভুলে যেও না সুজন, এরাই তোমার বাবাকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশের জেনোসাইডের জন্য এরা কম দায়ী নয়। আমার মনে হয় ছাত্রদের এ ব্যাপারে আরো সচেতন হওয়া দরকার।
কবিতা বললো, আমার রাজনীতি ভালো লাগে না। এম্বাসিতে দেশের যা খবর আসে সবই তো দেখি! মারামারি আর খুনোখুনির খবর। ছাত্ররা এক দল আরেক দলকে মারছে। এটা কেমন রাজনীতি?
কবিতার কথা বলার মাঝখানেই টেলিফোন বেজেছিলো। ওর মা ধরেছেন। সুজন কিছু বলার আগেই মা ডাকলেন, আকাশ তোমার একটা জরুরি কল এসেছে।
জরুরি শুনে সবাই একটু অবাক হল। ভাবলো চসেস্কুর সাক্ষাৎকারের কোনো বিষয় নিয়ে বুঝি। আকাশ রিসিভার তুলতেই ডিকের উত্তেজিত গলা শুনলোএক্ষুণি
অফিসে চলে এসো। এলেনার মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আকাশ চমকে উঠে বললো, এলেনার কোনো বিপদ হয় নি তো?
ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর মার ধারণা গুপ্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তুমি দেরি না করে চলে এসো।
এক্ষুণি আসছি। বলে আকাশ রিসিভার রাখলো।
টেলিফোনে আকাশের কথা সবাই শুনতে পেয়েছে। ইফতি চাচা উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন, কোনো খারাপ সংবাদ কি?
আকাশ বললো, আমার দোভাষীকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে মাপ করতে হবে। এক্ষুণি অফিসে যেতে হচ্ছে।
নিশ্চয় যাবে। ইফতি চাচা বললেন, যাবে কীভাবে? আমার গাড়ি লাগবে?
আমি হোটেলের গাড়ি নিয়ে এসেছি। এই বলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আকাশ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলো।
রাত তখন বেশি হয় নি। বুখারেষ্টের রাস্তা-ঘাট সন্ধ্যের পর পরই ফাঁকা হয়ে যায়। রাস্তায় আলোও খুব কম। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়, বসে সাতটার পর। বুখারেস্টকে মনে হয় ভূতের শহর। ফাঁকা রাস্তায় আশি মাইল বেগে গাড়ি চালাতে আকাশ ভাবছিলো, চসেস্কুর সঙ্গে ওর সাক্ষাতের ব্যাপারে এলেনাকে জেরা করার জন্যে আটকে রাখে নি তো! আজ সকালেই ও ছেড়ে দিয়েছিলো এলেনাকে। ওর নাকি কি কাজ আছে ইউনিভার্সিটিতে। কথা ছিলো রাতে ফোনে কথা হবে। পরের দিন আকাশের তিমিশোয়ার যাওয়ার কথা। বলেছিলো প্রোগ্রাম যদি ঠিক থাকে এলেনা ফোনে বলবে, একদিনের জন্য কি আমি ছুটি পেতে পারি? আর প্রোগ্রাম যদি বাতিল হয় তাহলে বলবে, কাল কখন কোথায় দেখা করবো। এলেনার খোঁজ না পাওয়া গেলে তিমিশোয়রা যাওয়ার কি হবে ভেবে পেলো না আকাশ। চসেস্কুর সাক্ষাৎকার যখন মঞ্জুর হয়েছে তখন নিশ্চয় ওকেও নজরে রাখা হচ্ছে।
এলেনার মা মাঝবয়সী ছিপছিপে শরীরের সুন্দরী মহিলা। পরনে লম্বা ঝুলের গাউন, গায়ে মোটা উলের শাল জড়ানো, পায়ে গামবুটের মতো চামড়ার জুতো। ডিকের টেবিলের পাশে বসেছিলেন চুপচাপ, দূর থেকে আকাশের মনে হল মোমের মূর্তি। ওঁর কাছে এসে নরম গলায় জানতে চাইলো, এলেনার কি হয়েছে ম্যাডাম?
এলেনাদের বাড়ির লোকজনদের কাছে আকাশ অচেনা নয়। কয়েকবারই এটা সেটা উপহার নিয়ে ওদের বাড়িতে গেছে। ও গেলে এলেনার মা নতুন কিছু রান্না করে না খাইয়ে ছাড়েন না। আকাশের কথা শুনে শূন্য দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকালেন–দুপুরে খেতে আসার কথা ছিলো। আসে নি। বিকেলে আমার ওষুধ আনতে যাবে, কোনো খবর নেই। অথচ হাজারটা কাজ থাকলেও সময় মতো আমার ওষুধ আনতে কোনোদিনও ভুল করে নি এলেনা।
জরুরি কাজে বাইরে কোথাও যায় নি তো? সাবধানে প্রশ্ন করলো আকাশ।
আমার কাছে এলেনা কিছুই গোপন করে না। তুমি কাল তিমিশোয়রা যাচ্ছো এ কথাও আমাকে ও বলেছে।
আপনার কি মনে হয়?
এলেনাকে ওরা তুলে নিয়ে গেছে।
আমি কি হোম মিনিষ্টারের সঙ্গে কথা বলবো।
ওরা তুলে নিলে হোম মিনিষ্টার কিছু করতে পারবে না।
গুপ্ত পুলিশের চীফের সঙ্গে সকালে কথা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করবো।
করতে পারো। আসলে আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তুমি যা ভালো মনে করো করতে পারো। একটু থেমে এলেনার মা নিচু গলায় বললেন, তোমাকে ও বলে নি কিন্তু আমাকে বলেছে–ও তোমাকে ভালোবাসে।
এলেনা না বললেও আকাশ যে কিছু টের পায় নি তা নয়। তবে এ নিয়ে কথা বলার সময় এখন নয়। টেলিফোনের ডায়াল ঘোরাতে ঘোরাতে বললো, দেখি চীফকে পাওয়া যায় কি না।
রাত তখন প্রায় নটা। গুপ্ত পুলিশের প্রধানকে তাঁর দফতরেই পাওয়া গেলো। দ্রলোক ভালো ফরাসি জানেন এটা সকালেই জেনেছে আকাশ। ফরাসি ভাষায় কথা হল ওদের। আমার দোভাষী এলেনাকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমার কাজের খুব ক্ষতি হচ্ছে।
বাড়িতে খবর নিয়েছেন? বাড়ির কোনো কাজে আটকা পড়েনি তো?
ওর মা আমার সামনে বসে আছেন।
আমি খোঁজ নিতে বলছি। আপনি আধঘন্টা পরে ফোন করুন।
সাড়ে নটায় আবার তাকে ফোন করলো আকাশ। দ্রলোক যেন ওর ফোনের অপেক্ষায় ছিলেন। বললেন, আপনার দোভাষীর কথা বিভিন্ন এজেন্সিকে বলেছি। কেউ কোনো হদিশ দিতে পারছে না।
একটা জলজ্যান্ত মেয়ে দিনে দুপুরে বুখারেস্ট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলো–আপনাদের এ ব্যাপারে কোনোই দায়িত্ব নেই?
দায়িত্ব আমাদের নয়, যাদের দায়িত্ব তাদের বলা হয়েছে। আপনার অসুবিধে হলে আমরা অন্য দোভাষী দিতে পারি।
ধন্যবাদ, প্রয়োজন হলে জানাবো। আকাশ গম্ভীর মুখে রিসিভার নামিয়ে রাখলো। এলেনার মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।