সাম্প্রতিককালে জহির রায়হান নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে নতুন তথ্য শোনা গেছে। বলা হয়েছে–পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের একটি অংশই জহির রায়হানকে খুন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অংশটির লক্ষ্য ছিল–বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী বুদ্ধিজীবীসহ সামগ্রিকভাবে বামপন্থী শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়া। এরা নাকি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটা তালিকা প্রণয়ন করেছিল। এদের ধারণা এ তালিকাটি জহির রায়হানের হাতে পড়েছিল। জহির রায়হানও জানত তার জীবন নিরাপদ নয়। তবুও সে ছিল ভাইয়ের শোকে মূহ্যমান। তাই শহীদুল্লাহ কায়সারের নাম শুনেই সে ছুটে গিয়েছিল মিরপুরে। তারপর আর ফিরে আসেনি। এ মহলই তাকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে। তাহলে কোনটি সত্য? জহির রায়হানকে কারা গুম করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা, আল বদর, আলশামস, না রাজাকার? নাকি মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ? স্পষ্ট করে বললে বলা যায়–মুক্তিবাহিনীর এ অংশটি মুজিববাহিনী। ১৯৭১ সালে প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের অজান্তে গড়ে ওঠা মুজিববাহিনী সম্পর্কে অনেক পরস্পরবিরোধী তথ্য আছে। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে, এ বাহিনী গড়ে উঠেছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে। এ বাহিনী নাকি মিজোরামে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে মিজোদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। এদের নাকি দায়িত্ব ছিল-রাজাকার, শান্তি কমিটিসহ বাংলাদেশের সকল বামপন্থীদের নিঃশেষ করে ফেলা। মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এ কথাগুলো বারবার লেখা হচ্ছে। কোনো মহল থেকেই এ বক্তব্যের প্রতিবাদ আসেনি। অথচ দেশে মুজিববাহিনীর অনেক নেতা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আছেন। তারা কোনো ব্যাপারেই উচ্চবাচ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যই প্রতিষ্ঠিত করছে এবং সর্বশেষ জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার ব্যাপারেও মুজিব বাহিনীকেই দায়ী করা হচ্ছে।
১৯৭২ সালে এত কথা ভাবিনি। দুঃখ পেয়েছি জহির নিখোঁজ হওয়ায়। বেশি কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিছুদিন পরে আমিই বিব্রত হয়ে গেলাম। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম গুলি হলো আমাদের সংগঠন হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের মিছিলে।
মুজিব বাহিনী নিয়ে এ বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখিতে আমি আবেদন জানিয়েছিলাম যে মুজিববাহিনী সম্পর্কে যারা জানেন তাদের মুখ খোলা উচিত। কারণ তাদের সম্পর্কে নানা কথা বলা হচ্ছে। আমার এক লেখায় এই দাবিরই পুনরুক্তি করেছিলাম। তবে মুজিববাহিনীর জীবিত নেতাদের মধ্যে কেউই এ প্রসঙ্গে কথা বলেননি। কথা বলেছেন মুজিব বাহিনীর স্রষ্টা, ভারতের অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এসএস উবান। তিনি একটি স্মৃতিচারণমূলক বই লিখেছেন। বইয়ের নাম ‘ফ্যাক্টস অব বাংলাদেশ’–‘দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ’। ক’দিন আগে ঢাকার একটি দৈনিকে এই বইয়ে মুজিববাহিনী সংক্রান্ত অধ্যায়টির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি এই বইয়ে মুজিববাহিনী গঠন প্রক্রিয়া ও রাজনীতি সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। এই বিবরণে সেকালের চারজন যুব নেতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই চারজন তরুণ নেতা হচ্ছেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমেদ এবং আব্দুর রাজ্জাক। জেনারেল উবান বলেছেন, চার নেতা এসে তার কাছে একটি সমস্যা তুলে ধরেন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে–মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে বিভিন্ন ধরনের যুবক আসছে। এর মধ্যে দুষ্কৃতকারীরা আছে, তেমন ভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীরাও আছে। চার নেতার মতে, এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অস্ত্র হাতে দিলে এসব অস্ত্র পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না বরং স্বাধীনতার পর নকশাল আন্দোলনের অনুরূপ কিছু করার জন্যে বাংলাদেশে লুকিয়ে রাখা হবে। তারা আরো অভিযোগ করেন, মুক্তিবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশের কিছু সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্কিত চীনাপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের নাম তারা উল্লেখ করেন। এই নেতাদের মতে, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের, অনুমোদনক্রমে বিপুল সংখ্যক কমিউনিস্ট ক্যাডারকে রিক্রুট করে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অন্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিযোগ করেও ফলাফল কিছুই হয়নি বলে যুবকরা জানান। এই তরুণ নেতাদের মতে, এ কারণেই একটি নতুন বাহিনীর গঠন প্রয়োজন। যে বাহিনী এ সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে। জেনারেল উবানের মতে, এই নেতারা ছিল সাহসী, বিচক্ষণ, দেশপ্রেমিক এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন। এ নেতারা আরো অভিযোগ করেছিলেন, ভারতের অভিজাত হোটেলে ভারতের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের নকশালপন্থী নেতাদের গল্প-গুজব করতে দেখা যায়। যুব নেতাদের মতে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন আমলে এরাই ছিল তাদের নিকৃষ্টতম শত্রু। তাদের সন্দেহ বাংলাদেশে শক্ত ভিত্তির ওপর একটি কমিউনিস্ট পার্টি দাঁড় করানোই ভারত সরকারের উদ্দেশ্য। তারা এ খবরও পেয়েছে, মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের আলাদা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়া হচ্ছে। নেতাদের মতে, বাংলাদেশে সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্টদের উত্থান তারা মানতে পারে। কিন্তু চীনাপন্থী কমিউনিস্টরা কেন!
জেনারেল উবানের ভাষায়, এই নেতারা ছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের চরম বিরোধী। তারা তাজউদ্দীনকে সহ্য করতে পারত না। তাদের অভিযোগ তাজউদ্দীন আহমেদ মিথ্যাচার করে ক্ষমতায় বসেছেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী হবার কথা ছিল না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল নজরুল ইসলামের। ভারতের বিভিন্ন মহলে এ খবর কারো অজানা ছিল না। কিন্তু ভারত সরকার ওই সময় তাজউদ্দীনকে পরিবর্তন করার পক্ষপাতী ছিলেন না। তারা মনে করত, এ ধরনের কোনো মতানৈক্য মুক্তিযুদ্ধে ফাটল ধরাবে। পাকিস্তান তার সুযোগ নেবে। আর এ পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের এ তরুণ নেতাদের পক্ষ থেকে একটি নতুন বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এ তরুণদের দাবি হচ্ছে এ বাহিনী হবে একান্তই স্বতন্ত্র, স্বাধীন এবং মুক্তিবাহিনীর বাইরে। এদের কর্মকাণ্ড বা গতিবিধি মুক্তিবাহিনী জানতে পারবে না।
কিন্তু এ ধরনের বাহিনী গঠনে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আদৌ একমত ছিলেন না। একমত ছিলেন না ভারতের সেনাপ্রধান মানেকশ। এ প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করেছেন জেনারেল আরোরা। তিনি ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার এবং ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর প্রধান। সেনা কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল যুদ্ধে দুই বাহিনী হতে পারে না। যে কোনো বাহিনী হোক না কেন সকল বাহিনীকেই একই কমান্ডের অধীনে থাকতে হবে। একই যুদ্ধে দুই কমান্ড থাকতে পারে না।
কিন্তু যুব নেতারা অনড়। শুধুমাত্র ভিন্নবাহিনী গঠনের ক্ষেত্রে নয়, এ বাহিনীর নামকরণ সম্পর্কেও তাদের সুনির্দিষ্ট মতামত ছিল। সকল মহলের প্রতিবাদ সত্তেও তারা মুজিববাহিনী নামে একটি বাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। এ বাহিনীর নামের ব্যাপারে জেনারেল উবানও আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু যুব নেতাদের বক্তব্য ছিল কারো কথায় কিছু আসে যায় না। এ বাহিনীর নাম মুজিববাহিনীই হবে এবং শেষ পর্যন্ত ৭১-এর যুদ্ধে মুজিববাহিনী একটি ভিন্ন বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে।
মুজিববাহিনীর ভূমিকা বর্ণনা করতে গিয়ে জেনারেল উবান তার স্মৃতিচারণে বলেছেন-শেখ ফজলুল হক মনি তার কাছে অভিযোগ করেছেন, তাজউদ্দিনের ইচ্ছা হচ্ছে ক্ষমতায় থেকে যাওয়া এবং একটি বামপন্থী বাহিনী গঠন করা। এমনকি শেখ ফজলুল হক মনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের চতুরে জেনারেল উবানকে মাথায় কালো কাপড় বাঁধা সশস্ত্র কমিউনিস্ট যুবকদের দেখান।
জেনারেল উবানের স্মৃতিচারণের এক জায়গায় বলা হয়, অস্ত্র সমর্পণের ব্যাপারে শ্রী ডিপি ধর এবং শেখ মনির মধ্যকার এক তপ্ত বাদানুবাদের সাক্ষী হই। মনি শ্ৰী ধরকে বলেন, তারা অস্ত্র সমর্পণ করবেন না। প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হবেন। মনির সাহস ছিল প্রশংসনীয়। শ্রী ধর দৃশ্যত বিচলিত হলেন। মনি আমাকে পরে বলেন, তার আগেকার পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করেছে, শ্রী ধর তার দেশের চরম শত্রু। এটা পরবর্তীকালে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর প্রতিক্রিয়া ফেলে। শেখ মুজিব ক্ষমতা দখলের পর তাঁর সরকারের কাছে ডিপি ধর অবাঞ্ছিত ব্যক্তিতে পরিণত হন।
জেনারেল উবানের এই তথ্য কতদূর সত্য সে কথা মুজিববাহিনীর নেতারাই বলতে পারেন। তবে সবকিছুর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় এই জেনারেল উবান কে? তাঁর স্মৃতিচারণে প্রমাণিত হয়েছে যে তিনিই মুজিব বাহিনীর স্রষ্টা। সবকিছুই তাঁর একক কৃতিত্ব। সকলের বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি চার যুবনেতার পরামর্শে মুজিববাহিনী গঠন করলেন কোন সাহসে? তিনি লিখেছেন তাজউদ্দীন ও কর্নেল ওসমানী এই বাহিনী গঠনের বিরুদ্ধে ছিলেন। জেনারেল মানেকশ, অরোরা এই বাহিনী গঠনের চরম বিরোধিতা করেছেন। তারপরেও জেনরেল উবান ওই বাহিনী গঠন করলেন কীভাবে! তার পেছনে কারা ছিল? তাহলে কি সেকালের ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সমান্তরাল দুটি স্রোত বা দুটি কেন্দ্র ছিল? নইলে একই যুদ্ধে দুই নেতৃত্ব এবং দুই কেন্দ্র সৃষ্টি হলো কীভাবে? জানি না জেনারেল উবানের বইতে এর কোনো ব্যাখ্যা আছে কিনা। কারণ পুরো বইটা আমার পড়া হয়নি।
আমি আগেও লিখেছি, কলকাতায় থাকতে মুজিব বাহিনীর কথা শুনেছি। তাদের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আর মুজিব বাহিনী গঠনের পর প্রমাণ হয়েছে, ৭১-র সংগ্রামে আদৌ কোনো সাংগঠনিক বা মানসিক প্রস্তুতি কোনো মহলের ছিল না। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলের একই ধারণা। লজ্জাজনকভাবে তাই সঠিক নেতৃত্ব দেয়ার দাবিদার চার যুব নেতাকে ভারতে এক জেনারেলের কাছে গিয়ে হাত পাততে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে একটি বাহিনী গঠনের। অথচ উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং প্রস্তুতি থাকলে বিদেশে গিয়ে উচ্চবৃত্তি করতে হতো না। দেশের স্বাধীনতা নয়, কমিউনিস্ট দমনের জন্যে এ ধরনের ন্যক্কারজনক উদ্যোগ নিতে হতো না। তাহলে কি এ সংগ্রাম ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধেও। মুজিববাহিনীর জীবিত নেতারা এ প্রশ্নের জবাব দিলে খুশি হব।
তবে ১৯৭২ সালে বিস্তারিতভাবে অনেক কথাই জানতাম না। হঠাৎ একদিন রাজপথে ছাত্রলীগের মিছিলের একটি শ্লোগান শুনলাম। শ্লোগানটি হলো-বিশ্বে এল নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ এবং প্রথম আঘাত আমাদের ওপরই এল। বই খুঁজতে থাকলাম এ বাদ-এর আদিপর্ব জানার জন্যে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের সাথে আমাদের অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের বিরোধ অনিবার্য হয়ে উঠল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এককভাবে বিশেষ করে চটকল এলাকায় আমাদের আধিপত্য ছিল। আমাদের সংগঠিত সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। ফেডারেশনের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে সামরিক শাসনামলে পরপর তিনবার চটকল শ্রমিকেরা ধর্মঘট করে। আমাদের সাফল্য অন্যান্য শিল্প এলাকায় আমাদের সংগঠনের বিস্তার ঘটায়। ঢাকা শহরের সমস্ত হোটেল শ্রমিক মোটামুটিভাবে আমাদের নেতৃত্বে আন্দোলন করত। এ পরিস্থিতি অনিবার্য কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছে সহনীয় ছিল না। আমাদের দল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল তখন গঠিত হয়নি। আমরা অর্থাৎ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল অর্থাৎ আরএসপি মনে করতাম-লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ভুল পথ অনুসরণ করছে। কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প হিসেবেই আরএসপি গঠিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর অকিাংশ আরএসপি কর্মী ও নেতা দেশান্তরী হয়। যারা পাকিস্তানে ছিলেন তাদেরও নির্যাতনের মুখে প্রকাশ্যে কাজ করা সম্ভব ছিল না। ষাটের দশকে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রমিক এলাকায় কাজ শুরু করে এবং গঠন করে পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। কিন্তু তখনো আওয়ামী লীগের কোনো শ্রমিক সংগঠন ছিল না। আওয়ামী লীগের একটি অংশ (যারা পরবর্তীকালে জাসদ গঠন করে। তারা আমাদের সংগঠন দখলের প্রয়াস পায়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমানের তরফ থেকে শিল্প এলাকায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়া হয়। আমরা প্রত্যাখ্যান করি এবং সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন নামে একটি নতুন শ্রমিক সংগঠন গঠন করি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ গঠন করে জাতীয় শ্রমিক লীগ। আমাদের কিছু কিছু নেতা শ্রমিক লীগে চলে যায়। এ ঘটনা ঘটে ছ’দফা ভিত্তিক আন্দোলন শুরু হওয়ার পর। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে ১৯৭১ সালের সংগ্রামের পূর্ব পর্যন্ত।
৭১-এর সংগ্রামে পূর্বে আর একটি আকস্মিক ঘটনা ঘটে। একটি মহল থেকে সিদ্ধান্ত করা হয় যে হোটেল শাহবাগকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হবে। নাম হবে পোস্টগ্রাজুয়েট হাসপাতাল অর্থাৎ পিজি হাসপাতাল। হোটেল শাহবাগে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। এ সময় ‘৭১-এর সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। সাময়িককালের জন্যে হলেও হোটেল শ্রমিকদের আন্দোলন স্তিমিত হয়। তৎকালীন পিজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছিল জেনারেল টিক্কা খানের একান্ত বংশধর। আমাদের শ্রমিক নেতাদের কাছে গেলে তাদের জানানো হয় যে তোমরা প্রয়োজনে তোমাদের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান বা মাতা শ্রীমতি গান্ধীর কাছে যেতে পার। আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। হোটেল শাহবাগ হাসপাতালে পরিণত হবেই। এ পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু লক্ষণীয় যে পিজি হাসপাতালের কর্মকর্তারা যেমন ছিলেন তেমনই থাকেন। তাঁরা পোশাক বদলে একেবারে বাঙালি হয়ে যান একটি কৌশল অবলম্বন করে। বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মেডিকেল চেকআপের নামে হাসপাতালে ভর্তি করান। তকালে চার খলিফা নামে পরিচিত আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদুস মাখনও মেডিকেল চেকআপের নামে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং তারা সবাই শাহবাগ হোটেলকে পিজি হাসপাতালে পরিণত করার পক্ষে বিবৃতি দিতে থাকেন। এ পরিস্থিতিতে হোটেল শ্রমিকরা মিছিলের সিদ্ধান্ত নেয়। ওই মিছিল পিজি হাসপাতাল ও আজকের শেরাটন হোটেলের মাঝামাঝি পৌঁছলে শেরাটন হোটেল থেকে মিছিলে গুলি করা হয়। গুলিতে আহতদের সংখ্যা জানা গেলেও নিহতদের সংখ্যা কোনোদিন জানা যায়নি। তৎকালে নতুন প্রকাশিত দৈনিক গণবাংলায় বিস্তারিতভাবে হতাহতদের সংবাদ পরিবেশন করা হয়। মিছিলে গুলিবর্ষণ আমাদের হতচকিত করে দেয় এবং একই সময় অপর একটি ঘটনা ঘটে।
আমাদের সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন আদমজীর শ্রমিক নেতা মাওলানা সাইদুর রহমান। ঢাকায় শ্রমিক দফতরে যাওয়া পথে তাকে কিডন্যাপ করে আওয়ামী লীগ অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে বাধ্য করা হয় সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করতে। তিনি সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন থেকে পদত্যাগ করলে সাথে সাথে শ্রমিক লীগ সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। ওই সাথে শ্রমিক লীগের সভাপতি নোয়াখালীর নূরুল হক সাহেবও পদত্যাগ করেন।
আমাদের তখন ছিল অবাক হওয়ার পালা। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা গণতান্ত্রিক অধিকারই ফিরে পাব। সকলের আকাক্ষা দেশে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু তার পরিবর্তে আমাদের সভাপতি কিডন্যাপ হয়ে গেল। পরবর্তীকালে একের পর এক আমাদের ইউনিয়নগুলো হাইজ্যাক করা হতে লাগল। এক সময় নরসিংদী, কাঞ্চন, ঘোড়াশাল, মুড়াপাড়া, আদমজী, মদনগঞ্জ এলাকার সকল চটকলের শ্রমিক ইউনিয়ন আমাদের দখলে ছিল। কিন্তু একের পর এক সবই হাতছাড়া হতে থাকল। শ্রমিক ইউনিয়ন করা দুঃসাধ্য হয়ে গেল।
এমন সময় আঘাত আসল ভিন্নদিক থেকে। আমাদের নেতা রুহুল আমিন কায়সার এবং সিদ্দিকুর রহমান রায়েরবাজার এলাকায় থাকতেন। ওই এলাকার বিভিন্ন শিল্পকারখানায় আমাদের ইউনিয়ন ছিল। আমাদের ইউনিয়ন ছিল একটি ওষুধ শিল্প কারখানায়। এ কারখানা কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের বিরোধ চলছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে। মনে হলো মালিক দীর্ঘদিন থেকে আমাদের ঘায়েল করার পাঁয়তারা করছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তীকালে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী সন্ধ্যা রাতে রুহুল আমিন কায়সারের বাড়িতে হামলা চালাল। তিনি বাসায় ছিলেন না। তাকে বাসায় না পেয়ে তাঁর কমরেড সিদ্দিকুর রহমানের বাসায় যান এবং তাকে গুলিবিদ্ধ করেন। অনেক কষ্টে সিদ্দিকুর রহমান বেঁচে যান। এখনো সেই সন্ত্রাসীর গুলি তাঁর শরীরে। সেদিন আমরা কোনো থানারই সহযোগিতা পাইনি।
দলের এ অবস্থায় সাংবাদিক ইউনিয়ন নিয়ে আমার সাথেও সরকারের বিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ সময় শেখ সাহেব কলকাতায় গিয়েছিলেন কলকাতায় তাকে বিরাট সংবর্ধনা দেয়া হয়। কলকাতার জনসভার ভাষণে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি ঘোষণা করেন। এ চারনীতি হচ্ছে-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। তার এ ঘোষণার পূর্বে দেশবাসী তিনটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির কথাই জানত। সে তিনটি মূলনীতি ছিল গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। শেখ সাহেবের এ ঘোষণার পর আমি এক জনসভায় ভিন্ন মন্তব্য করি। আমার বক্তব্য ছিল–ভাঙা বাংলার কোনো জাতীয়তাবাদ হয় না। জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হলে তার প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। উপমহাদেশে কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাঙালি জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদ এদের বাদ দিয়ে হতে পারে না। তবে কথাবার্তা, আচার আচরণ, সভ্যতা সংস্কৃতিতে এবং উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আমরা বাঙালি। সে প্রশ্নে দ্বিমতের অবকাশ নেই। তাই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি খুব সতর্কভাবেই বিবেচনা করতে হবে। নইলে ষড়যন্ত্রকারীরা এদের খতম করতে পারে।
আমার বক্তৃতা পড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে ডেকে পাঠালেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁর সাথে আলাপ হলো। শুধু বলতে পারি যে গভীর মনোযোগ দিয়ে তিনি আমার কথা শুনছিলেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এই একটি মানুষের আমলেই লিখে বা কথা বলে সাড়া পাওয়া যেত। পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের লেখা বা বক্তব্য মনে হয় তিনি খুটে খুটে পড়তেন। আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের আমলে আমার প্রতিটি লেখা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল। সে লেখার ভিত্তিতে নির্দেশ গিয়েছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। একথা ঠিক, তাঁর আমলে শেষের দিকে তিনিই নির্দেশ দিয়ে আমার লেখা বন্ধ করেছিলেন। তবুও বলব তাঁর আমলে লেখায় সুখ ছিল। লিখলে ফল হতো। তারপর অনেকেই ক্ষমতায় এসেছেন। আজকেও ক্ষমতায় আছেন। আমার মনে হয় কেউ যেন আর আমাদের লেখা বিশ্বাস করতে চান না। একটা অবিশ্বাস নিয়ে আমাদের লেখা পড়তে শুরু করেন অথবা আদৌ পড়েন না। তাই আজ লক্ষ করা যায় সাংবাদিকদের লেখার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করে সাংবাদিকদের বক্তব্য সঠিক নয় বলে প্রমাণ করার চেষ্টাও এখন মুখ্য।
তবে আমি বলব না, সাংবাদিক মাত্রেই সং বা সত্যনিষ্ঠ। আমি বলব না সকল খবরই সত্য বা তথ্যভিত্তিক। সমাজের আর পাঁচটি পেশার মতো আমাদের পেশায়ও দুর্নীতি ঢুকেছে। আমরা নিশ্চয় নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা নই। কিন্তু আমাদের লেখা অসত্য বা শুধুমাত্র মিথ্যাচার বলে উড়িয়ে দিলে কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। আমার জীবনে ওই একটি মানুষের কালেই একটি ভরসা অন্তত ছিল যে কোনো কিছু লিখলে তা তাঁর চোখে পড়বে। তিনি পড়বেন এবং এ ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত দেবেন। আমার এ ধারণার একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট আছে। সে প্রেক্ষাপটের কথা পরে বলব।
১৯৭২ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি-মার্চ–এ তিন মাসেই যেন সমস্ত পরস্থিতি আমার কাছে ঘোলাটে হয়ে উঠল। নিজের মনে প্রশ্ন দেখা দিল–এ কোন স্বাধীনতা। সেকালের কতগুলো তারিখ আজো আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। সে তারিখ হচ্ছে–৮ জানুয়ারি, ১০ জানুয়ারি, ১২ জানুয়ারি, ১৭ মার্চ, ১৯ মার্চ ও ২৬ মার্চ।
৮ জানুয়ারি বেতারে শুনলাম–পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়েছেন। সে দিন ঢাকার আকাশে বাতাসে রাজপথে এক অকৃত্রিম উল্লাস দেখলাম। রাজধানী ঢাকা এসএলআর, স্টেনগান এবং বন্দুকের গুলিতে কাঁপছে। গুলিতে গুলিতে আকাশ প্রকম্পিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। ১০ জানুয়ারি শেখ সাহেব ঢাকায় পৌঁছালেন। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ঢাকা রেসকোর্স (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে পৌঁছাতে তার সময় লেগেছিল দু’ঘণ্টার বেশি। সেদিন বোকার মতো ভেবেছিলাম উচ্ছ্বাসের এ অভিব্যক্তি ৯ মাস যুদ্ধকালের অনেক বিভ্রান্তির অবসান ঘটাবে। বিভ্রান্তি সরকারি দল এবং ভারতকে নিয়ে।
১২ জানুয়ারি শেখ সাহেব প্রধানমন্ত্রী হলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ সরে গেলেন। প্রেসিডেন্ট হলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। সকলেই ভাবল এটা অনিবার্য ছিল। ঠুটো জগন্নাথ প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতায় থাকার লোক শেখ মুজিবুর রহমান নন। সে ক্ষেত্রে সংঘর্ষ অনিবার্য। এ সংঘর্ষ এড়াতেই নাকি তাজউদ্দিন আহমেদ সরে গিয়েছিলেন। আবার অনেকের কথা হচ্ছে-তাজউদ্দিন আহমদের প্রধানমন্ত্রী থাকার কোনো উপায় ছিল না। অপর একটি মহলের মতে, শেখ সাহেব জাতির পিতা হিসেবে প্রেসিডেন্ট থাকলে ভালো করতেন। তিনি সবাইকে শাসন করতে পারতেন। কিন্তু নিজে শাসনকর্তা হয়ে অন্যকে শাসন করা যায় না। তাতে সংশয় এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
আর আমার মনে হলো ভিন্ন কথা। কথাটি হচ্ছে বাংলাদেশের চলার পথ সংকটপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। আমাদের সংগ্রাম পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র সাধারণভাবে সমর্থন করেনি। আমাদের চাওয়া-পাওয়া এবং আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়নের জন্যে পৃথিবীর কোনো সরকারই আমাদের বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির মুক্তি আন্দোলনে নির্ভেজাল সাহায্য দেয়নি। দেয়ার কথাও নয়। সব দলের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে।
আর কিছুদিন যেতেই আমার মনে হলো স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের সমাজ জীবনে বিভাজন বড় গভীর। আমাদের স্বাধীনতা চাওয়া সকলের কাছে নির্ভেজাল ছিল না। তেইশ বছর আমরা পাকিস্তানে ছিলাম। পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে হাজার মাইল ব্যবধান থাকলেও একটি সংযোগসূত্রও ছিল। তেইশ বছরের জীবনে ব্যবসা-বাণিজ্য আত্মীয় এবং চাকরির সুবাদে অনেক নৈকট্য গড়ে উঠেছিল। সে নৈকট্য বিশেষ করে ছিল উপরের মহলে। আমরা বঞ্চিত বলে আমাদের ক্ষোভ ছিল। আমাদের মতোই বঞ্চিত ছিল সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানের লোক। আমরা বামপন্থীরা একথাগুলো সামনে এনেছি। আমরা কখনো বলিনি–পাকিস্তানের কোনো একটি অঙ্গ স্বাধীন হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। আমার অভিজ্ঞতা বলে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পর্যন্ত আমরা বড্ড বেশি পাকিস্তানি ছিলাম। এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমাদের শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন। সাহিত্যিকরা গল্প লিখেছেন। কবিরা কবিতা লিখেছেন। প্রতিদিন রচিত নতুন নতুন গান বেতারে পরিবেশিত হয়েছে। আমি নিজে অনুভব করেছি আমার অকৃত্রিম অনুগত ছাত্রটি পর্যন্ত
১৯৬৫ সালের ওইদিনগুলোতে আমাকেও বিশ্বাস করেনি। জাত-পাতের ভিত্তিতে আমাকে ভারতীয় চরই ভেবেছে। আমার সেই ছাত্ররা নির্বিয়ে আমাকে একথা বলেছে। আমি দুঃখ পাইনি। কারণ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানের এটাই উত্তরাধিকার। আমার একান্ত অনুগত ছাত্রটি হঠাৎ করে এ ধরনের চিন্তার অধিকারী হয়নি। সে তার পরিবারের সূত্রে এ চিন্তার অধিকারী হয়েছে। মানুষকে চিনেছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে।
লক্ষণীয় যে, আজকে যারা ১৯৪৮ বা ১৯৫২ সালে স্বাধীনতা বাংলা গঠনের স্বপ্নের কথা বলেন, তাদের এ স্বপ্নের স্বাক্ষর কিন্তু সাহিত্যের পাতায় নেই। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে আমাদের আজকের বাঘা বাঘা কবি সাহিত্যিক এবং গল্পকাররা ১৯৬৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়-এ লক্ষ্য নিয়ে কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। আমাদের প্রথম সারির আজকের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে লেখকের মধ্যে অনেকেই সেদিন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। ১৪ আগস্ট উপলক্ষে রচনা লিখেছেন। আদমজী ও দাউদ পুরস্কার পাবার জন্যে আকাশ পাতাল তদ্বির করেছেন। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র সম্পর্কে পুস্তক রচনা করেছেন। কেউ আবার আইয়ুব খানের প্রভু নয় ভৃত্য’ এ বইয়ের অনুবাদ করে সরকারের কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করেছেন।
অর্থাৎ খুব স্পষ্ট করে বলা যায়–আমাদের ষাটের দশকের সাহিত্যেও আমাদের স্বাধীনতার তেমন ছাপ নেই। এখানটায়ই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে ৭১-এর সংগ্রামের মৌলিক পার্থক্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একটি দীর্ঘ সাহিত্য ছিল। সে সাহিত্য প্রেরণা যুগিয়েছে। একটি বিরাট ভূমিকা পালন করেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। সাহিত্যের এ ইতিহাসটি কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেই। অনেক হয়তো বলবে–১৯৫২ সালের পর থেকে আমাদের সাহিত্যের একটি অংশ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভূমিকা আছে। আমাদের সাহিত্যে বাঙালি আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের একটি জোরালো দাবি আছে। আর আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে–সে সাহিত্যে স্বাধীনতার প্রশ্নটি আদৌ সোচ্চার ছিল না। সোচ্চার থাকলে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের নামে আমরা একটি আন্তর্জাতিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার সাহিত্য রচনা করতাম না।
তবে এ কথা ঠিক, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ যুদ্ধে প্রমাণিত হয় যে–পাকিস্তানের অঙ্গ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত। আমরা আক্রান্ত হলে আমাদেরই আক্রমণ প্রতিরোধ করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেউ আমাদের বক্ষা করতে আসবে না এবং আমাদের রক্ষা করতে গেলে আমাদের নিজস্ব শক্তি থাকতে হবে। এ নিজস্ব শক্তির জন্যে চাই স্বাধীনতা। এ প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। আমাদের সামরিক বাহিনী এবং আমলাদের একটি অংশ আগরতলা ষড়যন্ত্র বলে কথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করেন। অর্থাৎ আমি বলতে চাই যে-সাহিত্যে কবিতায় প্রবন্ধে জীবনাচরণে বা আকাঙ্ক্ষায় আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বা মুক্তিযুদ্ধের চিত্র ফুটে ওঠে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর। তারপর মাত্র ছ’টি বছর। এ ছ’টি বছরে একটি জাতিকে একটি দেশের স্বাধীনতার জন্যে সামগ্রিকভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। এছাড়া এ প্রশ্নের কোনো সহজ প্রকাশ ছিল না। বাস্তব কারণে ছয় দফার নেতারা ছয় দফাঁকে স্বাধীনতার দলিল বলে ব্যাখ্যা করতে রাজি ছিলেন না। ছয় দফা সম্পর্কে আজকে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে কথিত শিবিরেও বিভ্রান্তি এবং মতানৈক্য কম ছিল না। ছয় দফা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাই ছ’দফার সম্প্রসারিত রূপ হয় এগারো দফা। একটি বিরাট সংগ্রামের প্রস্তুতি না নিয়েই ছয় দফা ও এগারো দফাঁকে সামনে নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার বারবারই বলেছে–ছ’দফা বিচ্ছিন্নতার দলিল। এরা দেশদ্রোহী। এরা পাকিস্তান ভাঙতে চায়। এরা বাংলাদেশ স্বাধীন করতে চায়। অপরদিকে, একমাত্র ছাত্রলীগের একটি অংশ এবং বিচ্ছিন্নভাবে কতিপয় বামপন্থী গ্রুপ অবিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে থাকে।
কিন্তু তাও প্রকাশ্যে নয়। এরপরে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে সংশয় আরো গভীর করে তোলে। সাধারণ গ্রাম-গ্রামান্তরের মানুষের কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই একটি ভয়াবহ সংঘর্ষের দিকে দেশ এগিয়ে যায়। এ বিভ্রান্তি এবং সংশয়ের জন্যেই ৭১-এর সংগ্রামের নাম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, হিড়িকের বছর বা গণ্ডগোলের বছর। কোনো কারণ না থাকলে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এমন নাম বিভ্রাট হয় না।
এ বিভ্রান্তির কারণ খুঁজতে গিয়ে ৭১ এবং ৭২ এ দু’টি পরস্পরবিরোধী চিত্র আমাদের পীড়িত করেছে। ভয় পেয়েছি স্বাধীনতাযুদ্ধের পরে। আমি লক্ষ্য করেছি কেউ সঠিকভাবে সব কিছু বুঝে-শুনে এ যুদ্ধ সমর্থন করছে না। তাদের সমর্থন সাময়িক, স্বতঃস্ফূর্ত এবং আবেগের। অপরপক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি অত্যন্ত সচেতন, ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের এ অবিচল শক্তি থেকে তারা খুব সচেতনভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দেখেছি অসম্ভব বিভ্রান্তি।
১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে আগস্টের মধ্যে আমি পাঁচবার ঢাকা শহরে ঢুকেছি। মাঝখানে প্রতিটি এলাকায় একই কথা শুনেছি। সকলেররই এক প্রশ্ন ‘ভারতীয় বাহিনী কবে আসবে? ইন্দিরা গান্ধী কবে সৈন্য পাঠাবেন। ইন্দিরা গান্ধী সৈন্য পাঠাচ্ছেন না কেন? তিনি কি আমাদের মেরে ফেলতে চান?
ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার এমএলএদের হোস্টেলে দেখা হয়েছিল আমাদের একজন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের সঙ্গে। আমার ছাত্রলীগের বন্ধুর নাম আব্দুল আউয়াল। চাঁদপুরের কচুয়া থেকে পরিষদ সদস্য। আউয়াল জন্ডিসে ভুগছিল। আমাকে দেখে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘নির্মল, শ্রীমতী গান্ধী আমাদের মেরে ফেলবেন। তিনি কি পাকিস্তান আক্রমণ করবেন না? আমি আউয়ালের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা। মনে হয় সে প্রেক্ষাপটেই ত্রিপুরার পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী সুখময় সেনগুপ্ত আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকলে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হবে না তো? কী প্রতিক্রিয়া হবে সে কথা কি আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন?
আমি তার এ প্রশ্নের জবাব দিতে সময় নিয়েছিলাম। বলেছিলাম-এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ ভারতীয় বাহিনীকে বুকে টেনে নেবে। ভবিষ্যতে কী হবে তা আমি জানি না। তবে সেদিন যে প্রশ্নের আম জবাব দিতে পারিনি সে প্রশ্নের জবাব দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের মাটিতে পা ফেলেই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মাসের সংগ্রামে দীর্ঘদিনের ক্লেদ, সংশয় এবং ভয় দূর করা আদৌ সম্ভব নয়। ঢাকায় ফিরে যে কথাগুলো প্রথম শুনলাম তার মর্মার্থ হচ্ছে–চরম ভারত বিরোধিতা। কোনো কৃতজ্ঞতা নয়। কোনো মুক্তিযুদ্ধের গল্প নয়। সর্বত্রই শুধু লুটপাটের কাহিনী। একদিকে লুটপাটকারী মুক্তিবাহিনী। সে পরিপ্রেক্ষিতেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ১৭ মার্চ। ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ সফরে আসেন। আর ২৬ মার্চ দেশের কলকারখানা রাষ্ট্রায়াত্ত করা হয়।
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঢাকা সফরে আসেন। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখ লাখ লোক তাঁকে সংবর্ধনা জানায়। ১৯ মার্চ ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদী বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি নিয়ে পরবর্তীকালে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বেই ভারত বিরোধী মানসিকতা দানা বাঁধতে থাকে। সর্বত্রই আলোচিত হতে থাকে, ১৯ মার্চের পূর্বেও জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত সরকারের সঙ্গে সাত দফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। ২৫ বছরের চুক্তি তারই বর্ধিত রূপ।
জনাব অলি আহাদ তার ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৫’ নামক গ্রন্থের ৪৪০ পাতায় জনাব তাজউদ্দিনের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিবরণ দিয়েছেন। সে চুক্তি হচ্ছে নিম্নরূপ—
১. ভারতীয় সমরবিদদের তত্ত্বাবধানে আধা সামরিক বাহিনী গঠন করা হবে। গুরুত্বের দিক থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং সংখ্যায় বাংলাদেশের মূল সামরিক বাহিনী থেকে বড় ও তাৎপর্যপূর্ণ হবে।
২. ভারত থেকে সমর উপকরণ ও অস্ত্রশস্ত্র কিনতে হবে। এ ব্যাপারে ভারতীয় সব বিশারদদের পরামর্শ নিতে হবে।
৩. ভারতের পরামর্শেই বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে।
৪. বাংলাদেশের বার্ষিক ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ভারতের পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
৫. বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ হতে হবে।
৬. ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিগুলো ভারতীয় সম্মতি ব্যতীত বাতিল করা যাবে না।
৭. ডিসেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ভারত যে কোনো সময় যে কোনো সংখ্যায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে এবং বাধাদানকারী শক্তিকে চুরমার করে অগ্রসর হতে পারবে।
জনাব অলি আহমেদের পুস্তকে উল্লিখিত ৭ দফা চুক্তি সম্পর্কে প্রকাশ্যে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি। একটি মহল হতে প্রথম থেকেই এমন একটি চুক্তির কথা বলা হচ্ছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্চ্য করেননি। অপরদিকে সেকালের বিরোধী দলগুলো এ চুক্তির কথা উল্লেখ করলেও প্রকাশ্যে লিখিতভাবে এ চুক্তির কথা কেউ বলেনি। তবে প্রচারণার ফলে একটি বিশ্বাস জন্মেছিল, এমন একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও হতে পারে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মহল এ চুক্তির প্রশ্নে সংশয় সৃষ্টির প্রয়াস পায়। বলা হতে থাকে, তাজউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এ সময় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি ঘোষণা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
পাকিস্তান আমলে ভারতের তুলনায় আমাদের মুদ্রার মূল্য বেশি ছিল। ৭১-এর যুদ্ধের সময় আমরা কলকাতায় ১০০ টাকা নিয়ে গেলে ১৩০ টাকা পেতাম। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দু’দেশের মুদ্রার মান সমান বলে ঘোষণা করা হয়। কোন প্রেক্ষিতে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছিল সাধারণ মানুষ তা জানতে চায়। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মেই আমাদের মুদ্রার মান হ্রাস হওয়ায়ই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। এ ঘটনা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছিল। আর এ পটভূমিতেই ১৯ মার্চ ২৫ বছর মেয়াদী ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, ফলে জনমনে সংশয় এবং বিভ্রান্তি আরো গম্ভীর হয়।
কিন্তু এ চুক্তি কেন করা হয়েছিল? মজার কথা হচ্ছে, কেউ চাক বা না চাক ১৯৭২ সাল থেকে ২৫ বছর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ১৮ মার্চ পর্যন্ত চুক্তি বহাল ছিল। চুক্তির বিরুদ্ধে জিয়াউর রহমান থেকে বেগম জিয়া পর্যন্ত সকলেই কথা বলেছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকতে সকলেই এ চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে কেউ এ চুক্তি বাতিল করেননি। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে বড় দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খুব জোরেশোরে এ চুক্তি নবায়ন না করার ঘোষণা দিয়ে হাস্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। কারণ সকলেরই জানা ছিল ১৯৯৭ সালের ১৮ মার্চ এ চুক্তির স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ চুক্তি নবায়নের কোনো অবকাশ নেই। চুক্তি নবায়ন না করার প্রতিশ্রুতি এক ধরনের শূন্য কুম্ভের ঢক্কা নিনাদের মতোই মনে হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ওই ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে কী ছিল। কেন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং কেনই বা আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ প্রতিটি দল এ চুক্তির বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতে বাতিল করতে পারেনি। তাহলে কি সকলেই ভারতের ভয়ে ভীত ছিল। জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে বেগম জিয়া পর্যন্ত ফেস্ট এ চুক্তি বাতিল করলেন না কেন? আজও তাঁরা এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল প্রথম দিকে এ চুক্তিটি পড়বার। এ চুক্তিটি বাংলায় অনুবাদ হওয়ার পূর্বে আমার হাতে পড়েছিল। আমি লক্ষ করেছিলাম চুক্তিটি যেন ৭১-এর যুদ্ধের সময় ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চুক্তির কার্বন কপি। ভারতের এককালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেএন দীক্ষিত বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগেই এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। জেএন দীক্ষিত ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন। তিনি একাধিকবার বলেছেন, চুক্তি ভারত চাপিয়ে দেয়নি। বাংলাদেশের অনুরোধে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দীক্ষিতের এ মন্তব্য সম্পর্কে সরকারিভাবে আওয়ামী লীগ মহল থেকে কোনো উচ্চবাচ্চ্য করা হয়নি। তবে বলা হয়েছে, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের চুক্তির উদ্যোগ নিয়েছিল। কারণ তখনো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্ধুর সংখ্যা তেমন ছিল না। গণচীন এবং মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। চীনের ভেটোর ফলে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় মেনে নিতে পারেনি। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিশেষ করে কিউবার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করার উদ্যোগ নেয়।
তবে একথা সত্য, আজকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একথা বলা হলেও বাংলাদেশ-ভারত চুক্তির স্বপক্ষে আওয়ামী লীগ কোনোদিনই জোরালো যুক্তি দিতে পারেনি। তাদের এই অক্ষমতা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে নিয়ে সংশয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। প্রতিপক্ষ প্রচার করেছে, সব কিছুই ভারত চাপিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয়েছে প্রথম থেকেই তকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রতিপক্ষের শক্তি খাটো করে দেখতে চেষ্টা করেছেন। কেউই বুঝতে চেষ্টা করেননি, ৭১ সালেও বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে মতানৈক্য ছিল। এক ভাই স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধ করেছে, আর এক ভাই রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা কম ছিল না। আর আমাদের এক শ্রেণির নেতা ব্যক্তিস্বার্থে প্রথম থেকেই এই রাজাকারদের আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিয়েছেন। ফলে প্রথম থেকেই ভারত বিরোধী প্রচারণা হালে পানি পেয়েছে। কেউই বুঝতে চাননি, সেকালের ভারত বিরোধী মুখ্যত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী ছিল এবং এ পরিস্থিতিতে বুঝবার অক্ষমতার জন্যে সেকালের একটি ঘটনা আজো স্বাধীনতার চেতনার দাবিদার একটি মহল গর্বভরে উচ্চারণ করে।
ঘটনাটি হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যাহার। একটি কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে এলে প্রথমে সবাই খুশি হলেও পরবর্তীকালে কী ঘটবে তা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কারণ প্রথম থেকে আমার সন্দেহ ছিল, যুদ্ধের কারণে আমরা ভারতীয় অনুরাগী হলেও ঐতিহ্য এবং ১৯৪৭ সালের উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা ভারত বিরোধী। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ৭১ সাল পর্যন্ত ২৩ বছর আমাদের বোঝানো এবং শেখানো হয়েছে, আমাদের দুঃখ-কষ্ট এবং দারিদ্রের জন্যে দায়ী হিন্দুরা এবং হিন্দুস্তান অর্থাৎ ভারত।
ন’মাসের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের সে চিন্তা ও চেতনা মুছে ফেলতে পারার কথা নয়। ফলে ভারত এবং ভারতীয় বাহিনী তাদের আচরণে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলে আমরা রাতারাতি ভারত বিরোধী হয়ে যাই। ভারতীয় বাহিনী আমাদের মুক্তিদাতা বাহিনী না হয়ে দখলদার বাহিনী হয়ে যাবে এবং দেশের মানুষ এ বাহিনীকে সহ্য করবে না। দীর্ঘদিন ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে অবস্থান করলে স্বাধীনতার বিরোধীতা এ বাহিনীকে দখলদার বাহিনী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাবে এবং সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাস করবে।
আর কেউ বুঝতে না পারলেও এই অপ্রিয় সত্যটি প্রথমে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাই পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন থেকে ফেরার পথে নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সামনে ভারতীয় বাহিনীর বাংলাদেশে অবস্থান সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ সাহেব বলেছিলেন, বাংলাদেশ চাইলেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে।
একথা বলে শেখ সাহেব জিজ্ঞাসু চোখে শ্রীমতি গান্ধীর দিকে তাকিয়েছিলেন। শ্রীমতি গান্ধী উচ্চবাচ্য করেননি। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার করায় মানুষ ভাবতে থাকে শেখ মুজিব বাপের বেটার মতো কথা বলেছেন। তাঁর এক ধমকেই ভারতীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের এ মন্তব্য তখন আমার কাছেও খারাপ লাগেনি। কিন্তু সাথে সাথে নিজের মনেই প্রশ্ন জেগেছে–ভারতীয় বাহিনী নিয়ে এ মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে কেন? তাহলে কি ভারতীয় বাহিনীকে আমরা দখলদার বাহিনী হিসেবেই দেখেছি। নইলে শেখ মুজিবের ধমকে তাদের যেতে হয় কেন? তারা কেন সাধারণভাবে তাদের দায়িত্ব শেষ করে? তাহলে কি তখনই আমাদের ধারণা ছিল, ভারতীয় বাহিনী দখলদার বাহিনী হিসেবে থেকে যাবার চেষ্টা করতে পারে? নইলে স্বাধীনতার দু’মাসের মধ্যেই আমরা এমনভাবে ভাবতে শুরু করলাম কেন?
এ সময় সকলের অলক্ষ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়। তৎকালীন বাংলাদেশে অধিকাংশ কলকারখানার মালিক ছিল অবাঙালি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা দেশ ত্যাগ করে। সমস্যা দেখা দেয় তাদের ফেলে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সম্পত্তি নিয়ে।
ইতোমধ্যে একটি চক্র এই সম্পত্তি গ্রাস করতে চেষ্টা করে। অবাঙালিদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ও দোকানের বাঙালি কর্মচারিরা রাতারাতি সকল কিছুর মালিক হয়ে যায়।
সে ছিল এক লজ্জাজনক পরিস্থিতি। কিছুদিন পরে দেখা গেল ঢাকা শহরে সমস্ত অবাঙালিদের ব্যবসা আবার চালু হয়েছে। মালিক হয়ে বসেছে বাঙালিরা। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া ভবনে দলীয় অফিস স্থানান্তর করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, টঙ্গী, খুলনা শিল্প এলাকায় অবাঙালিদের ছোটখাটো কারখানা দখল করেছে বাঙালিরা। রাজধানী ঢাকায় রাতের অন্ধকারে এক শ্রেণির বাঙালি তাদের ভবন ও সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এ লুটপাটের নেতৃত্ব দিয়েছিল এক শ্রেণির তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা। এদের বলা হতো ষোড়শ বাহিনী। প্রকৃতপক্ষে এরা মুক্তিযোদ্ধা ছিল না। অনেকে একাত্তরে যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগিতা করেছে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা বোল পাল্টিয়েছে। বন্দুক কাঁধে নিয়ে পরের সম্পত্তি দখলে নেমেছে। আমি আগেই বলেছি স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দ কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই এই যুদ্ধে নেমেছিলেন। তাঁদের চোখের সামনে কোনো সামগ্রিক চিত্র ছিল না। তারা বুঝতে চেষ্টা করেননি, একটি অসংগঠিত রাজনৈতিক প্রশিক্ষণহীন বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধ করলে তার ফলাফল কী হতে পারে। তাদের চোখের সামনে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা ছাড়া কোনো আদর্শ ছিল না। যুদ্ধের পর তারা দেশে ফিরে দেখেছে তাদের যুদ্ধকালীন নেতারা প্রতিপক্ষের গাড়ি-বাড়িসহ সবকিছুই দখল করেছে। ফলে তারাও নির্দ্বিধায় তাদের নেতাদের অনুসরণ করেছে এবং এমনি করে বেদখল হয়েছে অবাঙালিদের সকল সহায় সম্পত্তি। আমি হলফ করে বলতে পারি বাংলাদেশের নব্য পুঁজিপতিদের প্রাথমিক মূলধন এসেছে এই লুটপাট থেকে। এখনো নিরপেক্ষ জরিপ হলে দেখা যাবে, আমাদের অধিকাংশ কোটিপতিদের এই ধনসম্পদের মালিক হওয়ার উৎস সেকালের লুণ্ঠন। হিন্দু আর অবাঙালিদের সম্পত্তি।
কিন্তু এই লুটপাটেরও একটা সীমা ছিল। এ লুটপাটকারীরা অবাঙালিদের ছোটখাটো শিল্প কারখানা বাড়ি গাড়ি জবর-দখল করলেও বড় বড় শিল্প কলকারখানায় স্বাভাবিক কারণে তারা হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ এই কারখানাগুলো দখল করা গেলেও এই কারখানা চালাবার শক্তি বা সামর্থ্য তাদের ছিল না। এই বড় কারখানার মধ্যে ছিল পাটকল ও বস্ত্ৰকল। এই পাটকল ও বস্ত্ৰকলের মালিক ছিল আদমজী, বাওয়ানী ও ইস্পাহানী গোষ্ঠী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেখা গেল এই কারখানার মালিক দেশান্তরী হওয়ায় এগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ সকল কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো খবরদারি করার চেষ্টা করলেও তাদের পক্ষে কারখানা সচল রাখা সম্ভব ছিল না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়–পরিত্যক্ত কারখানা সম্বন্ধে। ইতোমধ্যে এই কারখানা সম্বন্ধে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন সুপারিশ করা হচ্ছিলো। অনেক মহল থেকে বলা হলো-বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রনীতি সমাজতন্ত্র। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা থেকেই এই শিল্প কারখানাগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হোক। কোনো ব্যক্তি মালিককে এই কারখানা দেয়া সঠিক হবে না। শুধু পাটকল, বস্ত্রকল নয়, এ সমস্যা দেখা দিলো ব্যাংক ও বীমা নিয়ে এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পাটকল, বস্ত্রকল এবং ব্যাংক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত করার ঘোষণা দেয়া হলো। বাঙালি ও অবাঙালি মালিকদের চা বাগানও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলো। রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলো না বিদেশি মালিকদের ব্যাংক, বীমা ও চা বাগান।
আমাদের আওয়ামী লীগের বন্ধুরা চিৎকার শুরু করল। দেশে সমাজতন্ত্র এসে যাচ্ছে এবং সেই লক্ষ্যে সমস্ত শিল্প কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হচ্ছে। আমাদের দল অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল থেকে বলা হলো এটা পরিত্যক্ত সম্পত্তির সমাজতন্ত্র (Abandoned Properties Socialism) অর্থাৎ আমরা বলতে চেয়েছি প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ কোনো সমাজতন্ত্রের দল নয়। আবার কোনো দেশে সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করলেই দেশটি সমাজতন্ত্রী হয় না। ব্রিটেনের শ্রমিক দল ক্ষমতায় এসে মূল ও ভারি শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করে। তার ফলে কোনোদিনই ব্রিটেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়নি। শ্রমিক দলের পরে রক্ষণশীল দল ক্ষমতায় এসে আবার এই সম্পত্তি বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়। ফলে ব্রিটেনের সমাজে কোনো মৌলিক রূপান্তর হয় না। সমাজতন্ত্র একটি আদর্শগত বিশ্বাস। আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয় একটি রাষ্ট্র। ওই আদর্শে বিশ্বাস না থাকলে সমাজতন্ত্রের ভিত রচনা করা যায় না। অথচ সমাজতন্ত্রের বিশ্বাস থেকে নয়, একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সরকারকে অনেক সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করতে হয়েছিল। এই সম্পত্তির আবার তিনটি ভাগ ছিল।
১. পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি, ২. পাকিস্তানের বাঙালি দালালদের সম্পত্তি, ৩. রুগ্ন শিল্প কারখানা। একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে এই তিন ধরনের শিল্প মালিকানা সরকারকে নিতে হয়। এতে সমাজতন্ত্রের নাম গন্ধ ছিল না।
তবে এই শিল্প কারখানাগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করার সময় এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। প্রশ্ন দেখা দেয় অন্তর্বর্তীকালের জন্যে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোর তত্ত্বাবধায়ক কে হবে। বিস্ময়ের সাথে দেখা গেল, তৎকালীন সরকার বাঘের কাছে গরু রাখালি দিলেন। অবাঙালি শিল্প কারখানায় দলীয় আত্মীয়-স্বজনদের প্রশাসক করা হলো। আর বাঙালি বস্ত্রকল ও পাটকলের মালিকদেরই দায়িত্ব দেয়া হলো তাদের কল কারখানা দেখাশুনার। স্বাভাবিক নিয়মে আত্মীয়-স্বজন ও দলের লোকেরা রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা লুটপাট করে ছাড়লেন। আর বাঙালি মালিকরা তাঁদের মালিকানায় কারখানার সবকিছু আত্মসাত করে ব্যাংক ঋণসহ বাজারে কোটি কোটি টাকার ঋণ সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। এই লুটপাটের খাতের নাম হলো রাষ্ট্রায়ত্ত খাত। একদল উৎসাহী বুদ্ধিজীবী ও ষড়যন্ত্রকারী এই খাতকে সমাজতন্ত্রের পক্ষে বিরাট পদক্ষেপ বলে সমাজতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে উঠে-পড়ে লাগলেন।
সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলেছি ১৯৭২ সালে ২৬ মার্চ একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল জাতীয় জীবনে। সমাজতন্ত্রকে চিরতরে নির্বাসন দেয়ার জন্যে সেদিন পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে রাষ্ট্রায়ত্ত করে নাম দেয়া হলো সমাজতন্ত্র। এক শ্রেণির সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী এ রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে সমাজতন্ত্রের সাথে সমার্থক করে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিষ উদগীরণ শুরু করল। সেই ষড়যন্ত্র মাজো চলছে। আজো তারা সেদিনের রাষ্ট্রায়ত্ত করাকে সমাজতন্ত্রের সমার্থক বলে প্রচার করার চেষ্টা করছে। এ সুবাদে পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিরুদ্ধে দিনের পর দিন লেখালেখি করে যাচ্ছে। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় লেখা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে দুর্নীতি ও লোকসানের কথা। বেসরকারি খাত নিয়ে এ মহাটির কোনো মাথাব্যথা নেই। বেসরকারি খাতের মালিকেরা যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এ ব্যাংকগুলোকে পথে বসিয়েছে, সে ব্যাপারে ঋণ গ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধেই কথা বলা হচ্ছে বেশি। লুটপাট করছে। পৃথিবীর দেশে দেশে বেসরকারি খাতের এটাই যে চিরায়ত চিত্র, সে নিয়ে এরা আদৌ উদ্বিগ্ন নয়। সমাজতন্ত্রকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে লুটপাটের সমস্ত দায়িত্ব সমাজতন্ত্রের উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ থেকে এ পর্বের শুরু। সমাজতন্ত্রের নামে ধাপ্পাবাজি শুরু হয় তথাকথিত রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তি লুটপাটের মধ্য দিয়ে। সেই লুটপাটের সকল দায়িত্ব শুধু সেকালের সরকারের নয়। সেকালের সরকার সমাজতন্ত্রের নামে লুটপাট কায়েম করেছিল। পরবর্তীকালে জিয়া, এরশাদ, বেগম জিয়া এবং আজকের শেখ হাসিনা সেই রাষ্ট্রায়ত্ত খাত নিয়ে একই খেলা খেলছেন।
কেউ বলছে না যে, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ এমনি বিশেষ কারণে বস্ত্রকল, পাটকল, ব্যাংক, বীমা রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানি ব্যতীত অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়নি। এ পদক্ষেপ সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে হলে প্রথমেই রাষ্ট্রায়ত্ত করা হতো বিদেশিদের কারখানা। এর কারণ নিহিত ছিল ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্রে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও দেশের উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাঙালি অবাঙালি অধিকাংশ শিল্পপতি ছিল মুসলিম লীগ পন্থী। সুতরাং আওয়ামী লীগ সদস্যেদের শিল্প কারখানা সম্পর্কে কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। ওই শিল্প কারখানা কেনার মতো মূলধনও তখন আওয়ামী লীগ সদস্যদের ছিল না। ফলে এ শিল্পগুলো বেসরকারি খাতে বিক্রি করে দেয়ার প্রশ্ন আদৌ আসেনি। নিজেদের পকেটে বিনিয়োগ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় তল্কালীন সরকার পুঁজি বিনিয়োগের অংক বেঁধে দেন। এক শ্রেণির জ্ঞানপাপী স্বল্পমূল্যে এই কলকারখানার মালিক হতে না পেরে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করে। আর এক শ্রেণির আওয়ামী লীগের ভাই-ব্রাদারও পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক মোক্তার হয়ে সবকিছু আত্মসাৎ করে এবং এটাকেই সমাজতন্ত্র বলে প্রচার করে নিজেদের লুটপাট জায়েজ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীকালে বাকশাল কায়েম করে সবকিছু সমাজতন্ত্রের জন্যে করা হচ্ছে, এ বক্তব্যকে আর এক দফা যৌক্তিকতার ভিত্তি দেয়া হয়। আর প্রতিপক্ষকে সুযোগ দেয়া হয় সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে জঘন্য প্রচারণার।
আমার কাছে রাজনীতিটা গোলমেলে মনে হচ্ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা শুরু করেছিল। এই হামলার কথা সকলের জানা থাকলেও সংগঠিত প্রতিরোধের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। ব্যক্তি বা সমষ্টিগতভাবে কেউই জানত না এ যুদ্ধ কী রূপ নেবে। এ ব্যাপারে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগেরও কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। ছাত্রলীগের সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছিল না। একটি মাত্র দল এবং সেই দলের একমাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হওয়ায় কারো কিছু করার বা বলার ছিল না।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হামলার আগে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাজউদ্দিনের দেখা হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা শেখ সাহেব বলেছিলেন, তাজউদ্দিন সাহেব তা কোনোদিনই বলেননি। অর্থাৎ সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রতি শেখ সাহেবের কোনো নির্দেশ ছিল না। সাম্প্রতিককালে সে কালের কিছু ছাত্রলীগ নেতা শেখ সাহেবের কিছু নির্দেশের কথা উল্লেখ করেছেন। এমনকি পত্রিকায় এমনো লেখা হচ্ছে যে, শেখ সাহেব নাকি জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্যে লন্ডন গিয়ে লন্ডনের ভারতীয় হাইকমিশনার থেকে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কথা বলেছিলেন। তখন তিনি নাকি মুক্তিবাহিনী গঠনের কথাও বলেছিলেন। অথচ সাংগঠনিকভাবে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ সম্পর্কে আওয়ামী লীগ যে একেবারেই অন্ধকারে ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এর ছাপ আছে পরবর্তী ঘটনায়। পরবর্তীকালে তাজউদ্দিন আহমেদের প্রধানমন্ত্রী হওয়া, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় মুজিবনগর স্থাপন, স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন–সব কিছুই ছিল স্থান কাল পাত্র হিসেবে নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফল। সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের সঙ্গে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সব কিছু করা হয়েছিল সে কথা যেমন সত্য নয়, তেমন একথাও সত্য যে তখন সবকিছু গুছিয়ে করা সম্ভব ছিল না।
এ অবস্থা চলছিল যুদ্ধের নমাস। যুদ্ধ শেষে প্রশ্ন দেখা দিল–স্বাধীন বাংলার নেতৃত্ব কে করবে? কেউই তখন নিশ্চিত নয় যে-পাকিস্তান জেল থেকে শেখ সাহেব আদৌ ফিরবেন কিনা। এমন একটি কথা যুদ্ধকালে খন্দকার মোশতাক চাউর করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, শেখ মুজিব আর স্বাধীনতা দুটো পাওয়া যাবে না। শেখ মুজিবকে জীবিত চাইলে অধিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে পাকিস্তানেই থাকতে হবে। আর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শেখ সাহেবকে জীবিত পাওয়া যাবে না। খন্দকার মোশতাক আহমদের এ ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং শেখ সাহেব তখনো জীবিত। তবুও সন্দেহ সংশয় আছে যে, শেখ সাহেব আদৌ ফিরবেন কিনা, আর আদৌ ফিরলে কিভাবে ফিরবেন। একটি মহলের বক্তব্য হচ্ছে, এ সমস্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল ভারতের মাটিতেই। এবারে ভারত সরকারও শঙ্কিত ছিল। সেকালের একটি ঘটনা এ ব্যাপারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনি একটি কথাই বলেন যে, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হোক। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হোক। ভারতের পক্ষে লাখ লাখ শরণার্থীর বোঝা বহন করা আদৌ সম্ভব নয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে শরণার্থীদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
শ্রীমতী গান্ধীর কথা খুব পরিষ্কার। সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল শেখ সাহেবের ফিরে না আসার প্রশ্নটি এবং শঙ্কিত হয়েছিল ভারত সরকার। সকলেরই প্রশ্ন ছিল–শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রূপ কী হবে? ভারত সরকারের একটি মহলের মতে, তাজউদ্দিন আহমেদ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসারী। তাঁর নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ সরকার একটি বামপন্থী সরকার হবে। উপমহাদেশে ভারসাম্য বিপর্যস্ত করবে। অনেকেরই ধারণা, এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যেই ভারতের সেনাবাহিনী মুজিববাহিনী গঠন করেছিল। মুজিববাহিনী স্পষ্টতই কমিউনিস্ট বিরোধী ছিল। মুজিববাহিনী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরে অস্ত্র সমর্পণ করতে রাজি হয়নি। তারা বলেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা অস্ত্র সমর্পণ করব না। মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা শেখ ফজলুল হক মনি মুজিব বাহিনীর স্রষ্টা জেনারেল ওবানকে বলেছিলেন–ভারত সরকারের মস্কোপন্থী আমলা ডিপি ধর বাংলাদেশে একটি কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের চেষ্টা করছে (উল্লেখ্য যে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল)। ৭১ এর সগ্রামের সময় ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কার্যক্রম শুরু করে।
প্রসঙ্গত আর একটি সমস্যাও ছিল। সত্যি সত্যি শেখ মুজিব ফিরে না এলে মুজিববাহিনীর পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবেলা কি আদৌ সম্ভব হবে? আমার মনে হয় সে প্রেক্ষিতেই ভারত সরকার আর একটি পদক্ষেপ নিয়েছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত বাংলাদেশে যে কূটনীতিকদের পাঠিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ছিল এককালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং শুভানুধ্যায়ী। রাজনৈতিক দিক থেকে সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। অর্থাৎ শেখ সাহেব যদি ফিরে না আসেন, যদি বামপন্থীরাই ক্ষমতায় যায় সে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতিও ভারত সরকারের ছিল। এটা হচ্ছে একান্তই আমার মত। তবে এসময় স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকল মহলই বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি। কেউ বুঝতে চাইলেন না, বাংলাদেশ ভিয়েতনাম জার্মানি কিংবা কোরিয়া নয়। ওই তিনটি দেশ ভাগ হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক কারণে নয়। এখানে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আকাঙ্ক্ষার একটি জাতিগত দিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভাগ হয়েছিল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে। একটি সংশয়, বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসার পরিবেশ। পাকিস্তানের পর ২৩ বছর সেই বিভক্তিকে যৌক্তিক বলে বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। অপরদিকে অমুসলমানের ধন-সম্পদ জমিজমা দখল করে একটি নতুন শ্রেণি গড়ে উঠেছে। মোটামুটিভাবে তারাই সমাজের নেতা। ১৯৭১ সালের ঘটনা এই মহলেরও একটি প্রতিক্রিয়া ঘটায়। স্বাভাবিকভাবেই এ মহলটি ভীত এবং সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাদের আশঙ্কা দেশ স্বাধীন হলে দেশত্যাগী হিন্দুরা ফিরে আসবে। তাদের পৈত্রিক জমি ফেরত দিতে হবে। পরের সম্পদ লুণ্ঠন করে গড়ে ভোলা তাদের সাধের সংসার ছারখার হয়ে যাবে। এ আশঙ্কা অস্বাভাবিক নয় এবং বাস্তবে এমন ঘটনা না ঘটলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসংখ্য মানুষ বাংলাদেশে ফিরল আসাম, পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা থেকে। কেউ এল স্বপ্নের জন্মভূমি দেখতে। আবার কেউ এল ফেলে যাওয়া সহায় সম্পদ ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। গ্রাম-গ্রামান্তরে একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। ওপারে বাঙালিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেও কোথায় যেন একটা ক্ষত ছিল। এ ক্ষত নিরাময় করার কোনো চেষ্টা কোনো মহল থেকে হলো না। ফিসফিস করে বলা হতে থাকল, ভারত বাংলাদেশকে গ্রাস করবে। এ পটভূমিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি। পরবর্তীকালে ২৬ মার্চ জাতীয়করণ করা হলো পাটকল, বস্ত্রকল। একটি মহল থেকে প্রচার করা হলো–আমাদের পাটকল, বস্ত্রকল শেষ করা হচ্ছে ভারতীয় বেনিয়াদের স্বার্থে। এমনো বলা হলো যেন পাটকল ও বস্ত্ৰকলের যন্ত্রপাতি মেশিন সবই ভারতে পাচার করা হচ্ছে। আমি আগেই বলেছি–দেশ স্বাধীন করার প্রশ্নটি শুধুমাত্র শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার না করে তার গতি-প্রকৃতি এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা বা প্রস্তুতি থাকলে এ ঘটনা ঘটত না। তখন এ ঘটনা আমাকে পীড়িত করত। কিন্তু করার কিছু ছিল না। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের সহযোগী বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে ন্যাপ যেন তাদের ৭১-এর সংগ্রামের স্বপ্নেই বিভোর। সবার মনে একই চেতনা এবং চিন্তা যে আমরা বিরাট একটা কাজ করেছি। কেউ ভাবলাম না যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের শত্রু অনেক শক্তিশালী। প্রস্তুতি ছাড়া একটি সংগ্রামকে লক্ষ্যে পৌঁছানো খুব কঠিন। কেউই বুঝতে চাইলাম না যে আমাদের নিজস্ব শক্তি থাকলে আমরা ভারতের উপর নির্ভর করতাম না, ভারতের ওপর নির্ভরতা প্রমাণ করে যে, আমাদের দেশি ও বিদেশি শক্তি আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী, তাই আমাদের স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে সঙ্কট মোকাবেলা করাই ছিল একমাত্র কাজ। কিন্তু সে কাজটি কেউ করলাম না। তিনটি দল দাবি করতে শুরু করল যে তারাই একমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী। আর এ সময় শুরু হলো–আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অন্তর্দ্বন্দ্ব। আর আমার মনে হচ্ছিল-এবার আর এক বিস্ফোরণের দিকে এগুচ্ছে। সবাই বড় গোলমেলে। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এ সমস্যা বিবেচনায় না নিলেও প্রতিপক্ষ এর সুযোগ নিল। একাত্তরের যুদ্ধের পরাজিত শক্তি ভারত বিরোধী প্রচারণা শুরু করল। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যে কোনো আন্দোলন এই পরাজিত শক্তির সাহায্য ও সহযোগিতা পেতে থাকল।
পাকিস্তান আমলের শেষ দিক থেকেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব সম্পর্কে আমার মনে নানা প্রশ্ন ছিল। আমি এক সময় ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক ছিলাম। সভাপতি ছিলেন আব্দুল মোমিন তালুকদার। সম্পাদক ছিলেন আব্দুল আউয়াল। আমাদের কালে ছাত্রলীগের স্বতন্ত্র নেতৃত্ব ছিল–যাহা আওয়ামী লীগ তাহাই ছাত্রলীগ নয়। ১৯৫৬ সালে নীতিগত প্রশ্নে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের বিপরীত একটি অংশের সঙ্গে আমাদের মতানৈক্য হয়। তখন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি সুয়েজ খাল সংঘর্ষের সময় মিশরের বিরুদ্ধ ব্রিটেন ও ফরাসির পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর আমলে একের পর এক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। প্রতিটি চুক্তি ছাত্রলীগ সমর্থন করতে থাকে। প্রতিবাদে ছাত্রলীগের নেতৃত্বের একটি বড় অংশ ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে। এ পদত্যাগকারীদের মধ্যে আমি ব্যতীত ছিলেন এনায়েতুল্লাহ খান, আবদুল হালিম, জহিরুল ইসলাম, আহমদ হুমায়ুন, ময়মনসিংহের কাজী আব্দুল বারী, নোয়াখালীর নুরুল হক চৌধুরী (মেহেদী) প্রমুখ। আমাদের পদত্যাগের পর ছাত্রলীগ একেবারেই আওয়ামী লীগের লেজুড়ে পরিণত হয়।
কিন্তু এর একটি পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো ষাটের দশকে। আমাদের দল অর্থাৎ শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল তখন গঠিত হয়নি। আমরা আরএসপি বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের নামেই গোপনে কাজ করতাম। আমাদের কাজ ছিল শিল্প এলাকায়, শ্রমিক সংগঠনের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। আমাদের আমলেই আইয়ুব খানের সামরিক শাসন লজ্জন করে সারা পূর্ব পাকিস্তানে তিনবার চটকল ধর্মঘট হয়। আমাদের প্রভাব ছিল খুলনা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত।
এ সময় ছাত্রলীগের নেতারা আমাদের সঙ্গে বারবার বৈঠকে বসে। তাদের বক্তব্য ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন করতে হবে এবং এ জন্য আপনাদের সহযোগিতা চাই। আমাদের বক্তব্যও ছিল স্পষ্ট। আমরা বলতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা আছি, কিন্তু আগেই জানা প্রয়োজন বাংলাদেশ নামে আমরা কোনো রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে চাচ্ছি। একবার ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান হয়েছে। আমরা আর একটা পাকিস্তান করতে চাই না। ছাত্রলীগ নেতাদের বক্তব্য ছিল, সে প্রশ্ন এখন নয়। সে প্রশ্ন পরবর্তীকালে বিবেচনা করা যাবে। এ মুহূর্তের প্রশ্ন বাংলাদেশ স্বাধীন করা।
এ আলোচনায় আমি খুব বিশেষ অংশগ্রহণ করতাম না। এ আলোচনা নিয়ে আমার সংশয় ও বিভ্রান্তি ছিল। আমি দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে চিনি। এই নেতারা বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে চায়, এ বিশ্বাস আমার আদৌ ছিল না। তাহলে এরা কী চায়? এদের পেছনে কারা আছে? আওয়ামী লীগের কোন অংশ এদের সমর্থক? আমার কাছে কোনো কিছু স্পষ্ট ছিল না। শুধু এটুকু বুঝতাম যে শেখ মুজিবুর রহমানের সায় না থাকলে কারো এ ব্যাপারে কথা বলা সম্ভব না। পরবর্তীকালের আর একটি ঘটনা আমাকে বিভ্রান্ত করল। ঘটনাটি ছিল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবি করে প্রস্তাব উত্থাপন নিয়ে। এ প্রস্তাব নিয়ে মতান্তর হয়। একদিকে আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ এবং অপরদিকে নূরে আলম সিদ্দিকী ও আব্দুল কুদুস মাখন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন চট্টগ্রামের স্বপন চৌধুরী। এ প্রস্তাব উত্থাপনের পর স্বপন চৌধুরী ছুরিকাহত হয়।
আমার মনে গভীর সংশয় দেখা দেয়। তাহলে সত্যি সত্যি শেখ সাহেব কোন দিকে? আমি যতদূর শুনেছি শেখ ফজলুল হক মনি, নূরে আলম সিদ্দিকী ও মাখনের পক্ষে। তাহলে শেখ সাহেবের ভূমিকা কী? আবার একথাও শুনেছি যে সকলেই স্বাধীনতার পক্ষে হলেও এই সময় স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণ সময়োচিত ছিল না। ছিল না বলেই এই প্রস্তাব নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। তবুও আমার মনে হয়েছে–ছাত্রলীগের একটি অংশ অন্তত আমাদের কালের মতোই স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে কথা বলার চেষ্টা করেছে।
এ পরিস্থিতিতে ১৯৭১ সালের সংগ্রাম শুরু হয়। সংগ্রামের সময় দেখেছি ছাত্রলীগের যৌথ নেতৃত্ব। যৌথভাবেই তারা তাজউদ্দিন আহমেদের বিরোধিতা করেছে। মুজিববাহিনী গঠন করেছে। ৭১-এর সংগ্রামে নিজস্ব নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছাত্রলীগের কোনো অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কথা শোনা যায়নি। কিন্তু পুরনো কোন্দল দেখা দিল মার্চ মাসের পর থেকে। সেই কোন্দলে বিভক্ত হলো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। পরবর্তীকালে গঠিত হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। কিন্তু কেন?
আজ স্বাধীনতার ২৭ বছর পর কল্পনাকাহিনী বা গল্প লেখার অবকাশ নেই। অথচ এটাই সত্য, সাম্প্রতিককালে ৭১-এর যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে গিয়ে সকলেই রণাঙ্গণের ইতিহাস লিখছেন। লিখছেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখালেখি হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সেকালের যুদ্ধের কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হচ্ছে না। কেন সেই যুদ্ধ হয়েছিল? কারা এর উদ্যোক্তা? কারাই বা সহযোগী? সে প্রশ্ন সকলেই এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সে প্রশ্নের জবাব একদিন দিতেই হবে।
একটি মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে, এ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব বামপন্থীরা নিল না কেন? তাদের কথা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়েছে। সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত সমাজকে ১৯৭১ সালে জাতীয়তাবাদের কথা বলেই ঐক্যবদ্ধ করা হলো। অথচ বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদের কথা বলল না। তারা প্রথমেই সমাজতন্ত্রের শ্লোগান দিল। অবৈজ্ঞানিকভাবে তারা জাতীয়তাবাদের পর্বটি এড়িয়ে যেতে চাইল। কিন্তু পারল না। সেই জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম হলো, কিন্তু বামপন্থীদের নেতৃত্বে নয়। নেতৃত্ব দিল বুর্জোয়া শ্রেণি। তারা ধ্বনি তুলল জয় বাংলা। বামপন্থীরা বলল–জয় সর্বহারা। কিন্তু জয় সর্বহারার ধ্বনি জয় বাংলা স্লোগানের আবেগে তলিয়ে গেল। কেন এমন হলো?
প্রশ্নটি প্রণিধানযোগ্য। কিন্তু সাদামাটা কথায় ব্যাখা করা অতো সহজ নয়। কারণ বামপন্থীরা কথা বলতে গেলে বামপন্থীদের মধ্যকার বিভাজন মেনে নিতে হবে। বামপন্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ববাংলায় বৃহৎ দল হচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টি। এ কথা সকলেরই জানা যে লেনিনের মৃত্যুর পর যে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছে। তখন স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক দুনিয়া কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত। একই কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্দেশ অনুযায়ী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রণনীতি ও কৌশল নির্ধারিত হতো। লক্ষ করলে দেখা যাবে মস্কোনীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ১৯৪৬ সালের আগে জন্মের পর থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শরিক হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর বা গদর পার্টির সদস্য হিসেবে অনেক নেতাই জেল খেটেছেন, ব্রিটিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয়ার পর বড় ধরনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে তাঁরা দুরে থেকেছেন। ত্রিশের দশকে কংগ্রেসের নেতৃত্বে আইন অমান্য আন্দোলন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সমর্থন করেনি। কারণ তৃতীয় আন্তর্জাতিকের পক্ষ থেকে কংগ্রেসকে বুর্জোয়া নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠান বলে তাদের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিতে বারণ করা হয়। পরবর্তীকালে ফ্যাসিবাদের উত্থানের পর আবার কংগ্রেস নেতৃত্বকে মেনে নেয়ার নির্দেশ দেয় তৃতীয় আন্তর্জাতিক। আবার তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকে জনযুদ্ধ বলে ঘোষণা করে। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরোধিতা করে। নেতাজী সুভাষ বসু ও তাঁর নেতৃত্বে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজকে ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যায়িত করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ সমর্থন করে। অর্থাৎ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মূলনীতি নির্ধারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত পূর্ব বাংলা সম্পর্কে তাদের কোনো ভিন্ন কর্মসূচি ছিল না।
এর মাঝখানে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে আর একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৪৮ সালে কোলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেসে বিডি রণদিভে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে বলা হয়, ব্রিটিশ চলে গেলেও ভারত বা পাকিস্তান স্বাধীন হয়নি। এ আজাদী ঝুটা। লাখ লাখ মানুষ অনাহারে আছে। সুতরাং আঘাতের পর আঘাত করে ক্ষমতাসীন সরকারের উচ্ছেদ ঘটাতে হবে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের এ সিদ্ধান্ত শুধু ভারত নয়, পাকিস্তানের জন্যেও প্রযোজ্য ছিল। প্রযোজ্য ছিল বলেই পূর্ব বাংলায়ও একই ধরনের আন্দোলন হয় এবং এ আন্দোলন করতে গিয়েই ইলা মিত্র নির্যাতিত এবং গ্রেফতার হয়েছিলেন। অর্থাৎ ইলা মিত্র শুধু তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন না। এ ইতিহাস থেকে আমি বোঝাতে চাচ্ছি, লেনিনের মৃত্যুর পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে ধারা রচিত হয়েছিল সেই ধারায়ই পরিচালিত হয়েছে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি। তাই তাদের আন্দোলনের কথা বরাবরই উপেক্ষিত হয়েছে। সুতরাং তাত্ত্বিক দিক দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোনো চিন্তা ভাবনা ছিল না। প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে অন্য বামপন্থীরাই বা কী করেছিল?
তৎকালীন পূর্ব বাংলায় আরো দুটি বামপন্থী দল ছিল–বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক। ফরোয়ার্ড ব্লক গঠিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে। নেতাজী দেশান্তরী হলে ফরোয়ার্ড ব্লক সুভাষপন্থী ও মার্কসবাদী নামে বিভক্ত হয়ে যায়। অপরদিকে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল গঠিত হয় ১৯৪০ সালের ১৯ মার্চ। এ দলটির সকল নেতারা ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে গ্রেফতার হয়ে যান। সকল নেতাদের মুক্তি পেতে পেতে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়। এ দলটির লক্ষ্য ছিল সমাজতন্ত্র। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বিকল্প হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিল। এদের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল-লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ভুল পথে চলেছে। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্যে নতুন দল দরকার। এ দলের নেতৃত্বে ছিলেন অনুশীলন সমিতির অগ্নিযুগের নেতারা। কিন্তু এ দলের গঠন পর্বেই নেতাদের জেলে যেতে হয় এবং ভারত বিভক্ত হয়। তবুও ফরোয়ার্ড ব্লক ও আরএসপি দেশ ভাগের চরম বিরোধিতা করেছিল। শেষ পর্যন্ত শরিক হয়েছিল-সার্বভৌম বাংলা গঠনের আন্দোলনে।
মোটামুটিভাবে এটাই ছিল বামপন্থী দলগুলোর ইতিহাস। যদি আমি ধরে নিই যে কমিউনিস্ট পার্টি, আরএসপি এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের তৎকালীন দায়িত্ব ছিল সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলা। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় তাদের পক্ষে এ আন্দোলন করা আদৌ স্বাভাবিক ছিল কি? অনেকে বলেন, ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়, এ আন্দোলনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্রুণ ছিল। তবে এ ব্যাপারে আমার কিছুটা দ্বিমত আছে।
একথা মনে রাখতে হবে যে-প্রথম দিকে ভাষা আন্দোলনের প্রবক্তা কোনো বামপন্থী দল ছিল না। প্রবক্তা ছিল তমুদ্দিন মজলিশ। যারা খোলাফায়ে রাশেদিন-এর সমাজ কায়েমের প্রবক্তা ছিল। তারাই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি প্রথম জানিয়েছিল। আমার মতে, তাদের এ দাবির সাথে পাকিস্তান গঠনের দাবি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। পাকিস্তান না হলে মুসলমানের উন্নতি হবে না। হিন্দুদের সাথে সহযোগিতায় টিকে থাকা যাবে না। ঠিক সেই যুক্তিতেই তারা বলেছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হলে বাঙালি মুসলমানরা চাকরি পাবে না।
প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে অবাঙালিদের কাছে। পাকিস্তান সৃষ্টি হবে অর্থহীন। তাই লক্ষ করা যায়, প্রথম বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দাবি করা হয়। পরে বলা হয়, বাংলা হবে উর্দুর সঙ্গে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা। সারা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন নাগরিক বাঙালি হলেও কেউ কিন্তু বাংলাকে একক রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করল না। পাকিস্তানের কোনো অঞ্চলেই ভাষা নয় এমন একটি ভাষা অর্থাৎ উর্দুকে বাংলার সাথে স্থান দেয়া হলো! এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছিল বাংলা ভাষাভাষীদের সুযোগ সুবিধার প্রশ্ন।
তবে এ প্রশ্ন আমি বাদ দিতে রাজি আছি। বলা যেতে পারে, সবকিছু বাদ দিয়ে বামপন্থীদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করাই ছিল শ্রেয়। কিন্তু সম্ভব ছিল কি? যারা এ ব্যাপারে তত্ত্ব দিচ্ছেন তারা কি কোনোদিন সেকালের বাস্তব পরিস্থিতি ভেবে দেখেছেন? আমি সেকালের তিনটি বামপন্থী দলের কথা উল্লেখ করেছি। লক্ষ্যণীয় যে, এ তিনটি দলের নেতৃত্ব এসেছে মধ্যবিত্ত হিন্দু সম্প্রদায় থেকে। এ দলগুলোর শতকরা ৯৫ থেকে ৯৯ জন সদস্য হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। দেশভাগের পরে তাদের পারিবারিক জীবন বিপর্যস্ত। তারা দেশান্তরী হবে কিনা সে সমস্যার সমাধান হয়নি। অনেক পরিবারে সদস্যই ইতোমধ্যে দেশান্তরী হয়েছে। তাদের ভারতভিত্তিক মূল রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কখনো মুসলমান কমরেডদের ভারত থেকে পাকিস্তানে আসতে বলা হচ্ছে। হিন্দু কমরেডদের বলা হচ্ছে পাকিস্তান থেকে ভারত যেতে–অর্থাৎ সিদ্ধান্তই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে।
এ পরিস্থিতিতে সমাজেও সংশয় ও বিভ্রান্তি দেখা দিচ্ছে। একজন মুসলমান কমরেড জানে না তার পাশের হিন্দু কমরেডটি তার পাশে থাকবে কিনা। কোনো দাঙ্গা দেখা দিলে তাকে রক্ষা করা যাবে কিনা এবং এ পরিস্থিতি চরমে উঠল ১৯৫০ সালে। ভয়াবহ দাঙ্গা হলো পূর্ব ও পশ্চিম বাংলায়। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী। এ দু’প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এক অভূতপূর্ব চুক্তি হলো। এ চুক্তির ফলে ভারতের দাঙ্গা দুর্গত মুসলমানদের পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের দাঙ্গা দুর্গত হিন্দুদের ভারতে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো। পরিবহনের ব্যবস্থা করল উভয় সরকার। দু’টি দেশের মানুষ দেশান্তরী হলো শুধুমাত্র তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যে।
আজকে ৪৮ বছর পরে লেখালেখি করে এ পরিস্থিতি কাউকে বোঝানো যাবে না সেদিনের হিন্দু কমরেডদের পক্ষে সেদিনের পূর্ব বাংলায় ইচ্ছে না থাকলেও জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করা সহজ ছিল না। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছাড়াও ছিল সরকারি নির্যাতন। কথাগুলো ছিল এমন–কমিউনিস্ট মানে হিন্দ, কমিউনিস্ট মানে নাস্তিক আর হিন্দু মানে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সুতরাং এদের জেলে পাঠাতে হবে। সম্ভব হলে জেলে পাঠাবার আগেই তাদের শেষ করতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যেনো জন্ম নিয়েছিল কমিউনিস্ট ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার জন্যে। এর এই বাস্তব পরিস্থিতিতে হিন্দুদের নেতৃত্বে যতটুকু সম্ভব চালু ছিল বামপন্থী কর্মকাণ্ড। আত্মগোপনের জন্যে প্রত্যেক নেতাকেই একটি আরবি নাম দিতে হয়েছিল। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই আমার ধারণা সেকালে বামপন্থী কর্মসূচিতে জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হতো না।
এ পটভূমি সামগ্রিক বিচার বিবেচনা করলে অনেক কথাই বেরিয়ে আসবে। এবং বোঝা যাবে যে, আমরা যারা সে আমলের স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার কথা বলি তাদের অনেক স্বপ্নই বোধ হয় সঠিক ছিল না। সে স্বপ্ন ছিল একান্তইভাবেই মনগড়া। এখানে উল্লেখযোগ্য যারা ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত তীব্র ভারতবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী ছিল তাদেরই দেখা গেলো ষাটের দশকে এসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতা হিসেবে। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যে অংশটি এতদিন পর্যন্ত কমিউনিস্টদের পি করে শ্লোগান দিত–হো হো মাও চীনে যাও ব্যাঙ খাও, তারাই যেন আন্তর্জাতিক হয়ে গেলো। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা তুলছে খুব কঠোর এবং কঠিনভাবে। ছাত্রদের এ অংশটির আন্দোলনে বিপর্যস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবুর রহমান এমনকি মওলানা ভাসানী পর্যন্ত। আমার লেখায় অনেকে হয়তো ক্ষুব্ধ হবেন। আমি লিখেছি পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির আন্দোলনের সাথে বাঙালিত্বের কোনো সম্পর্ক ছিল না। ছিল পাকিস্তান দাবির মতোই একটি দাবি। এই দাবির পেছনে যুক্তি ছিল–আমরা বাঙালিরা উর্দু জানি না। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে আমরা চাকরি পাব না। অখণ্ড ভারতে আমরা প্রতিযোগিতায় হিন্দুদের সঙ্গে পারিনি। সুতরাং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা হচ্ছে ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বাঙালিয়ানার দাবি তেমন তীব্র ছিল না। এই প্রসঙ্গে আমি বারবার একটি গানের কথা উল্লেখ করেছি।
এ গানটি রচিত হয়েছিল ১৯৫২ সালে। এ গানের প্রথম চরণ ছিল– ওরে বাঙালি, ঢাকা শহর রক্তে রাঙালি। পরবর্তী চরণে বলা হয়েছিল–যারা হইত পূর্ব বাংলার জিন্নাহ লিয়াকত/বেছে বেছে মারা হইল জাতির ভবিষ্যত। এই গান গেয়েই ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল। আমার ধারণা ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন করার কোনো স্বপ্নের অবকাশ ছিল না। তখনো স্বপ্ন ছিল স্বপ্নের পাকিস্তান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। প্রথমবারের জন্যে ধাক্কা খায় পাকিস্তানি চেতনা। পরবর্তীকালে পূর্ববাংলার বাঙালি সবিস্ময়ে দেখল–নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ক্ষমতা পাওয়া যায় না। কেন্দ্রে মুসলিম লীগ সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলায় যুজফ্রন্ট সরকারকে টিকতে দিল না। মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিল। শুরু হলো নতুন করে বাঙালিদের বঞ্চিত করার একের পর এক ষড়যন্ত্র। সীমিত ক্ষেত্রে হলেও এক নতুন চেতনার উন্মেষ হলো। সে চেতনা হচ্ছে–আমরা বাঙালি বলে নির্যাতিত, বাঙালি বলেই বঞ্চিত। পাকিস্তানে নিজেদের গঠনের চেতনা গম্ভীর হয়নি। তবে এর আগে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আর একটি প্রসঙ্গ আলোচনা করা দরকার। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে। ১৯৪৬ সালে জুন মাসে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত-পাকিস্তান দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হচ্ছে। সাথে সাথে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হচ্ছে। বাংলার এই বিভক্তি মুসলিম লীগের একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এই অংশের নেতা ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম। এঁরা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুললেন। এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর মেজো ভাই শরৎচন্দ্র বসু। এছাড়া বাংলা বিভাগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক ছিল বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দল (আরএসপি) এবং ফরোয়ার্ড ব্লক।
এই সার্বভৌম বাংলার আন্দোলন নিয়ে প্রথম থেকেই আমার মনে বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল। নানা যৌক্তিক কারণেই বলা হয় যে, শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সেই সোহরাওয়ার্দী হঠাৎ করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের বাইরে সার্বভৌম বাংলা কেন চাইলেন? তিনি তো বলতেন হিন্দু-মুসলিম দুটি স্বতন্ত্র জাতি। এদের আলাদা সংস্কৃতি। এরা পাশাপাশি বাস করতে পারে না। এই যুক্তিতেই তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এখন তিনি ভিন্ন কথা বলছেন কেন? তার কথিত সার্বভৌম বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায় থাকে। তাহলে সারা ভারতবর্ষে থাকতে পারবে না কেন? হঠাৎ করে তিনি বাঙালি হলেন কেন? এ ব্যাপারে অনেক ব্যাখ্যা আছে। অনেকে বলেন, আজকের স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন সেদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সার্বভৌম বাংলার মধ্যেই দেখেছিলেন। আমি এই ব্যাখ্যার সাথে একমত নই। আমি মনে করি পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক। হিন্দু বেনিয়াদের সাথে প্রতিযোগিতায় পারা যাবে না। তারা অনেক আগে চলে গেছে। সুতরাং মুসলমান বেনিয়াদের জন্যে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাই। সেই রাষ্ট্রে তারা কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে। নিজের মতো করে বাঁচবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরাজিত মুসলিম মধ্যবিত্তকে এই বক্তব্য নতুন আশার আলো দেখিয়েছিল। কিন্তু বাংলা বিভাগের প্রস্তাবে সুস্পষ্টভাবে বোঝা গেলো যে, বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলিম বেনিয়ারা কলকাতা পাচ্ছে না। কলকাতা না পেলে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য বিপর্যস্ত হবে এবং এই পটভূমিতেই কলকাতাবাসী মুসলিম বেনিয়াদের প্রতিনিধি হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার দাবি তুলেছিলেন। যে বাংলার রাজধানী হবে কলকাতায়। আবার একই যুক্তিতে কলকাতাবাসী হিন্দু বেনিয়াদের প্রতিনিধি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সার্বভৌম বাংলার দাবি প্রত্যাখ্যান করে। যে কংগ্রেস ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। বলেছিল-মায়ের অঙ্গচ্ছেদ চাই না। সেই কংগ্রেসই ১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ করার জন্যে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করল। অর্থাৎ প্রমাণিত হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী মুসলমানদের জন্যে পাকিস্তান চাননি। চেয়েছিলেন মুসলমান বেনিয়াদের জন্যে। আর প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ কখনো কারো মা ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল দখলে রাখার। তাই ভাগ করে হলেও বাংলাদেশের কিছুটা অংশ দখলে রেখেছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। অর্থাৎ আমার বক্তব্য হচ্ছে বাঙালিয়ানা নয়, একশ্রেণির হিন্দু-মুসলিম বেনিয়াদের স্বার্থেই ১৯৪৬ ৪৭ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার দাবি উঠেছিল।
প্রসঙ্গত বিচার করে দেখা প্রয়োজন, পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌম বাংলার প্রস্তাবের সাথে ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবে বাংলা ও বৃহত্তর আসাম নিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সার্বভৌম বাংলায় কিন্তু আসামের কোনো স্থান ছিল না। শুধুমাত্র বাংলাদেশই ছিল তার সার্বভৌম বাংলার মানচিত্রে। সুতরাং পাকিস্তান প্রস্তাবের সাথে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সার্বভৌম বাংলার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
আজকে অনেকে বলতে চেষ্টা করেন, আজকের বাংলাদেশ মুসিলম লীগের ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবেরই পরিণতি। ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাবে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার কথা ছিল। এর একটি অংশ হবে সিন্দু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে গঠিত। অপরটি হবে-বাংলা ও বৃহত্তর আসাম নিয়ে গঠিত। সকলেরই জানা, ১৯৪৬ সালে এ প্রস্তাব সংশোধিত হয়েছিল। মুসলিম লীগের সাংসদের বিশেষ অধিবেশনে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন শহীদ সোহরাওয়াদী। অর্থাৎ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবের ফলেই মূল পাকিস্তান প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমবায়ে পাকিস্তান গঠনের পরিবর্তে এককেন্দ্রিক পাকিস্তান গড়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপরেও আজকে একজন লেখক বলতে চান, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্বপ্নে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার চিত্র ছিল। সে স্বপ্নের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সার্বভৌম বাংলা গঠনের দাবি তুলেছিলেন ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৭১ সালে সেই ভিত্তিতেই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে। সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, যারা বাংলাদেশ চাননি, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের চরম বিরোধীতা করেছেন, তাঁরাই আজকে আগ বাড়িয়ে বলতে চাচ্ছেন–পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশ হতো না এবং লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে। অর্থাৎ তারা কেউ আর স্বীকার করতে চান না, মূল লাহোর প্রস্তাবের আদৌ অস্তিত্ব ছিল না পাকিস্তান গঠনকালে। পাকিস্তান লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। সুতরাং লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গঠনের কোনো প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা এবং লাহোর প্রস্তাবের নতুন মূল্যায়ন করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তাহলে কি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সাথে পাকিস্তান প্রস্তাবের কোনো সম্পর্ক ছিল না? লাহোর প্রস্তাব কি বাংলাদেশের আন্দোলনে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি? এ পশ্নের জবাব ইতিবাচক। আমি ইতিপূর্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটি অংশের অগ্রণী ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছি। আমি একথাও বলার চেষ্টা করেছি, এ অংশের অনমনীয় ভূমিকা শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা ভাসানীকে বিপর্যস্ত করেছিল। এই দুই নেতা পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলন তাদের জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তারা পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে বেড়ে উঠেছিলেন। এ আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। সেই পাকিস্তানকে এক তুড়িতে না করে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের এ অংশের নেতৃত্বের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনের সম্পর্ক ছিল পাঠ্যপুস্তকের পাঠ্যক্রমে। আর পাকিস্তান ছিল তাদের কাছে। শোষণ ও বঞ্চনার প্রতীক। তাই পাকিস্তান ভাঙার প্রশ্নে তাদের আত্মার আত্মীয়তার কোনো সংযোগ ছিল না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরনো নেতৃত্বের সাথে নতুন নেতৃত্বের এ দ্বন্দ্ব পরবর্তীকালে প্রতি পদে পদে ফুটে উঠেছে এবং বারবার মনে হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান এবং মওলানা ভাসানী হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চাননি। অনেকের কাছে মনে হতে পারে আমার লেখায় এ প্রশ্নগুলো প্রাসঙ্গিক নয়। আমার জবানবন্দির প্রথম পর্বেই একথা আলোচিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি ইচ্ছা করেই এ কথাগুলো পরে লিখছি। কারণ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন কোনো ধরাবাঁধা ছকে হয়নি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে মতানৈক্য ছিল। সে মতানৈক্যের ফলেই আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পর্কে নেতৃত্ব নিয়ে এখন প্রশ্ন ওঠে। এখনো বিতর্ক হয়। বিতর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়, অনেক সময় মনে হয় যে, ৭১-এর সংগ্রামটাই বোধ হয় সঠিক ছিল না। এ মনে হওয়ার কারণ খুঁজে বের করতে না পারলে অনেক প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যাবে। বোঝা যাবে না–কেন মওলানা ভাসানী ২৫ মার্চের পূর্বরাত পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের কথা না বলে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলেছিলেন। কেন শেখ সাহেব ৭ মার্চের ভাষণে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পূর্বে এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বলেছিলেন। আমার মতে, কোনো কিছুই হঠাৎ করে ঘটেনি। ঘটেনি বলেই সেদিনের ঘটনার প্রেক্ষাপট জানা দরকার।
একটা প্রশ্ন বিভিন্ন পত্রিকায় বারবার আলোচিত হয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে–মওলানা ভাসানী কেন স্বাধীন বাংলাদেশের কথা না বলে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলেছিলেন। ১৯৬৮ সালে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা গঠনের দাবি জানানো হয়। ছাত্রদের এ গ্রুপটি তার অনুগত হলেও তিনি দাবি মেনে নেননি। তিনি বলেছেন, আমার লাশের ওপর দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হবে।
শেখ সাহেব ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন–এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। কেন তিনি শুধু স্বাধীনতার সগ্রামের কথা বলেন না! সে প্রশ্নে আমি পরে আসছি।
স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলার ব্যাপারে আমার একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে, জানি এ ব্যাখ্যায় অনেকে আমার সঙ্গে একমত হবেন না। আমার এ ব্যাখ্যা একান্তভাবেই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা প্রসূত। আমি ভিন্ন প্রসঙ্গ থেকে আমার এ ব্যাখ্যায় আসব।
ষাটের দশকের কথা। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম শতবার্ষিকী ছিল। এ বার্ষিকী পালন নিয়ে অনেক অঘটন ঘটে। তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে। সরকার কিছুতেই শতবার্ষিকী পালিত হতে দেবে না। কিন্তু যুবকরা এ ব্যাপারে একাট্টা। শতবার্ষিকী পালন নিয়ে অনেকে গ্রেফতার হলো। অনেককে আত্মগোপন করতে হলো। শতবার্ষিকী পালন তাই একটা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হলো। তবুও শতবার্ষিকী পালিত হলো। পরিস্থিতি চরমে উঠল ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর। তখন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন। তিনি এক নির্দেশ দিয়ে বেতার টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করলেন। চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। বুদ্ধিজীবীরা বিভক্ত হয়ে গেলেন। এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়ে দাবি করলেন–রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। আমরা তাঁর উত্তরাধিকার বহন করছি। অপরদিকে চল্লিশজন বুদ্ধিজীবী ভিন্ন সুরে বিবৃতি দিলেন। তাঁরা বললেন-রবীন্দ্রনাথ আদৌ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। এ চল্লিশজন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে একজনের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি সাংবাদিক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছিলেন। তার বাসায়ও আমার যাতায়াত ছিল। তার নাম মোহাম্মদ মোদাব্বের। মোদাব্বের সাহেব আমাকে একদিন ডেকে বললেন–তুমি আমার সংসারে ভাঙন ধরিয়েছ। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমার সাথে আমার পরিবারের কেউ-ই একমত নয়। এ জন্যে তুমিই দায়ী। এরপর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন, বললেন তোমার সাথে হয়তো আমি ভিন্নমত হব না। তুবও ধৈর্য ধরে তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। আমি মুসলিম লীগ করলেও রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে রায়পন্থী অর্থাৎ মানবেন্দ্র রায়ের অনুসারী। মানবেন্দ্র রায় ছিলেন কমিউনিস্ট জগতের প্রথম শ্রেণির চিন্তানায়ক। তাঁর লেখায় তিনি পাকিস্তান আন্দোলনকে মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। তাই রায় পন্থী হয়েও আমরা মুসলিম লীগ করেছি এবং পাকিস্তান চেয়েছি। তবে ব্যক্তিগত জীবনে আমি বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথ আমাদের সংস্কৃতির তঙ্গ। আমরা তাঁর উত্তরাধিকারী। কিন্তু এ বৃদ্ধ বয়সে আর পেছনে তাকাতে ইচ্ছা করছে না। সত্য জেনেও অতীতের ভুল স্বীকার করার মতো মানসিকতা আজ নেই। খুব অন্তর দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলাম। কিন্তু আজ দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছি।
অথচ ১৯৭১ সালে আমি এই মোদাবের সাহেবের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব দেখিনি। ১৯৭১ সালের জুন মাসে আমি ভারত থেকে ঢাকায় ফিরে আসি মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থ সংগ্রহের জন্যে। আমি একরাতে মোদাব্বের সাহেবের বাসায় ছিলাম। মোদাব্বের সাহেব তখন জুনিয়র রেডক্রসের কর্মকর্তা। আমি লক্ষ করলাম–তাঁর বাসা থেকে জুনিয়র রেডক্রসের সমস্ত কিছু মুক্তিযুদ্ধের এলাকায় পাঠানো হচ্ছে। এমনকি মানিকগঞ্জে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী যে স্পিডবোটটি ব্যবহার করতেন সে স্পিডবোটটিও জুনিয়র রেডক্রসের। মোদাব্বের সাহেব ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে এ স্পিডবোটটি দিয়েছেন। আমি ১৯৭১ সালের জুন-জুলাই মাসে মোদাব্বের সাহেবের মনে কোনো দ্বন্দ্ব দেখিনি। যে দ্বন্দে তিনি বিব্রত ছিলেন মাত্র বছর দু’তিন আগে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। আমার মনে হয় এরকম দ্বন্দ্ব শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানীর জীবনেও ছিল। এক সময় পাকিস্তান তাঁদের অস্তিত্ব ছিল। পাকিস্তান অর্জনে তারা শরিক ছিলেন। পাকিস্তান তাদের স্বপ্ন ছিল। সেই পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলা বা এ এলাকা থেকে সেই পাকিস্তানের নামটি একেবারে মুছে ফেলা তাঁদের পক্ষে সহজ বা সরল ছিল না। যে কথাটি সেকালের তরুণরা স্পষ্ট করে বলতে পেরেছে, সে কথাটি তাদের পক্ষে বলা আদৌ সহজ ছিল কি? এ প্রশ্ন তুলে আমি তাদের বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রশ্নে ভিন্নমত পোষণ আর কথা বলছি না। আমি বলছি যে, ঐতিহাসিক কারণে তাদের কিছুটা সীমাবদ্ধতা ছিল। কিছুটা পিছুটান ছিল।
মওলানা ভাসানী কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের কথা কোনদিনই বলেননি। বলেছেন, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা। আর সে সময় শেখ সাহেব ছিলেন এই আসোলামু আলাইকুম বলার বিরুদ্ধে এবং এ প্রশ্নে সেই সময় ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রলীগ মারামারি হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। ইত্তেফাকের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে মওলানা ভাসানী ভারতের এজেন্ট। সুতরাং স্বাধীন বাংলাদেশ দাবি করার মানসিক প্রস্তুতিই তখন ছিল না। চিন্তা ছিল পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে সবকিছু সমাধান করে মিলেমিশে থাকা। কিন্তু ষাটের দশকে এসে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। ১৯৪৭ সালে যে তরুণ পাকিস্তানের জন্যে শ্লোগান দিয়েছে, ১৯৫২ সালে সে দেখেছে ভাষার দাবিতে বাঙালি ছেলেকে গুলি খেতে। ১৯৫৪ সালে অভিজ্ঞতা হয়েছে, নির্বাচনে জিতলেও ক্ষমতা পাওয়া যাবে না। এ উঠতি বয়সের তরুণদের তেমন পাকিস্তান প্রীতি ছিল না। জিন্নাহ-লিয়াকত অনেক আগেই রাজনীতির মঞ্চ থেকে চলে গিয়েছেন। বাঙালি যুবকের কাছে তারা কোনো উচ্চ ধারণা রেখে যেতে পারেননি। এছাড়া তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে বাঙালি সামরিক এবং বেসামরিক আমলাদের মধ্যে। তারা তিক্ত অভিজ্ঞতায় বুঝেছে–বাঙালি বলেই তারা বঞ্চিত এবং শোষিত। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বেঁচে থাকলে তাদের পদোন্নতি বন্ধ। চাকরিতে তারা কোনো সুযোগ সুবিধা পাবে না। এ পরিবেশেই সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক জীবনে বাঙালিয়ানার জন্ম হয়। এ নতুন প্রজন্মের কাছে পাকিস্তান একটি অভিশাপ। এ অভিশাপের কবল থেকে বাঁচতে হলে স্বাধীন হতে হবে। বাঙালির রাজত্ব কায়েম করতে হবে। লক্ষণীয়, পাকিস্তানে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে কথিত বিদ্রোহের চেষ্টায় নেতৃত্বে ছিল সামরিক ও বেসামরিক আমলা। কোনো রাজনীতিক নয়। এ বিদ্রোহকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার জন্যে সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা শেখ সাহেবকে নেতৃত্বে বসিয়েছিল। আওয়ামী লীগের কোনো সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে অভিহিত বিদ্রোহের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার, রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায় নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমলারা অনেক বেশি পাকিস্তানবিরোধী হয়েছিল। তারা একটি পরিবর্তন চেয়েছিল, যে পরিবর্তন পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে সম্ভব নয়। তবে সেই পরিবর্তনের চিন্তাধারার মধ্যে সমাজ বদলের কোনো কথা ছিল না। মুখ্য কথা ছিল সমাজের রূপান্তর হোক বা না হোক বাঙালিরাই বাঙালিকে শাসন করবে। আমাদের সংগ্রাম অবাঙালিদের বিরুদ্ধে। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাথমিকভাবে মূল নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে আসেনি। সেখানে একটি প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব এবং দ্বিধা ছিল। কারণ স্বাধীনতার প্রশ্নটি কোনো দলীয় স্তরেই সামগ্রিকভাবে উত্থাপিত হয়নি। ফলে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান বা স্বাধীন বাংলাদেশ হবে, এ প্রশ্নের বিতর্কও শেষ পর্যন্ত ছিল এবং সেক্ষেত্রে আমার সুস্পষ্ট ধারণা হচ্ছে-পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সম্পর্কের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান বা মওলানা ভাসানী কোনোদিনই একটি স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। আমার ধারণা শেষ পর্যন্ত তাঁরা ছিলেন পরিস্থিতির শিকার। তারা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রসঙ্গত ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর একটি ভাষণ এখনো আমার কানে বাজছে। তখন মওলানা ভাসানীকে কৃষকের নয়নমণি বলা হতো। শেখ সাহেবকে বলা হতো বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা। মওলানা ভাসানী তাঁর পল্টনের ভাষণে বললেন, বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা আর কৃষকের নয়নের মনি ভাসানী, কোনো কিছুই কাজে আসবে না। মুজিব তোমাকে পষ্ট করেই বলি-পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন না হলে তোমার বা আমার গায়ের চামড়া থাকবে না। অর্থাৎ মওলানা সাহেবের সুর একান্তই পরিষ্কার-পরিস্থিতি তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। অপরদিকে শেষ কথাও বলতে পারছেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে, কৌশল হিসেবেই মওলানা সাহেব স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিশ্চয়ই জবাব দিতে পারেন। যে–১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়েই পাকিস্তান গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই মূল প্রস্তাব গ্রাহ্য না করে পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল এবং সেই পটভূমিতেই স্বাধীন সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান দাবি করা যায়। কারণ এ দাবি যুক্তিসঙ্গত এবং আইনসঙ্গত।
কথার পিঠে কথা হিসেবে এ যুক্তি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি তা ছিল না। তাই মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান এই দুই নেতাকে পাকিস্তান শব্দটির প্রশ্নে বারবার ইতস্তত করতে দেখা গেছে। ৭১-এর মার্চের আলোচনার শেষ মুহূর্তে পাকিস্তান সরকার বারবার অভিযোগ করেছে-শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ওয়ালী খান ও এয়ার মার্শাল আজগর খান বারবার তার প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ভাঙছেন না। তাঁদের বর্ণনায় শেখ সাহেবের কথা ছিল–আমি মুসলিম লীগের কর্মী ছিলাম। আমি পাকিস্তান আন্দোলন করেছি। আমি পাকিস্তান ভাঙতে পারি না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী একই ধরনের কথা বলেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পাবার পর লন্ডনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ সাহেব বলেছেন–আমি নই, ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তান ভাঙার জন্যে দায়ী। ঢাকায় মওলানা ভাসানী বলেছেন–পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তান ভাঙেনি। পাকিস্তান ভেঙেছে পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদার, জোতদার ও শোষক গোষ্ঠী। তাঁদের এ দু’জনের বক্তব্য ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়–পাকিস্তান শাসকেরা সঠিক আচরণ করলে পাকিস্তান ভাঙত না এবং সেক্ষেত্রে আমার ধারণায় বাংলাদেশের জন্ম ঐতিহাসিকভাবে সত্য বলে ধরে নেয়া যেত না। তবে আমি বলব–বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় লাহোর প্রস্তাবের দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়ে পাকিস্তান গঠনের কথা কাজে লেগেছে। লাহোর প্রস্তাবের কাঠামোয় এ কথাগুলো বলা হলে কারো দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা যায়নি। ১৯৪৭ সালের ভুল শোধরাবার নাম করে অত্যন্ত সন্তর্পণে স্বাধীনতার কথা বলে গেছে। এদিক থেকে লাহোর প্রস্তাব কাজে এসেছে নিঃসন্দেহে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ লাহোর প্রস্তাবের অনিবার্য পরিণতি, এ তত্ত্ব মানতে হলে বাংলাদেশ থাকে না। আর পাকিস্তান আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারণে শেখ সাহেব ও মওলানা সাহেব একটি ভিন্নতর মানসিকতার শিকার হয়েছিলেন, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এ মানসিকতা থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা শুনেছি পাকিস্তান হচ্ছে একটি মসজিদ। ইমাম খারাপ বলে মসজিদ তো ভাঙা যায় না। অর্থাৎ শাসনকর্তাদের তাড়াও। কিন্তু পাকিস্তান ভেঙো না।
কিন্তু পাকিস্তান শব্দটি প্রবীণদের মনে যত দাগ কাটুক না কেন নতুন প্রজন্মকে তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি। যার ফলে ষাটের দশকে সামরিক ও বেসামরিক আমলার পাশাপাশি ছাত্রদের মনেও স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে। এর সাথে জড়িত হন বিদেশ প্রত্যাগত একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী। তাঁরা বিদেশে গিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের অযৌক্তিকতা ও অবাস্তবতা। তবে তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজনের জন্যে এ আন্দোলন দানা বাঁধতে সময় লাগে। আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক বিদ্রোহের প্রস্তুতি তরুণদের এই আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে। আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে বিদ্রোহই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে। এ গণঅভ্যুত্থানের নায়ক হিসেবে ছাত্রদের চিহ্নিত করা হলেও বা এ অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অবশ্যম্ভাবী করে তুললেও অস্বীকার করা যাবে না, আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক বিদ্রোহ না হলে বা এর সাথে শেখ সাহেবকে জড়ানো না হলে পরিস্থিতি এত শিগগিরই বিস্ফোরণোন্মুখ হতো না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে এ পর্যন্ত আমার লেখা ছিল সামরিক বেসামরিক আমলা ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে কেন্দ্র করে। তাই প্রশ্ন উঠতে পারে, এ আন্দোলনে কি বামপন্থীদের কোনো ভূমিকা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে বামপন্থীদের প্রকাশ্যে কাজ করার কোনো সুবিধা ছিল না। তবুও ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ব্যাপারে বাস্তব ক্ষেত্রে তাদের কোনো অবদান ছিল, এ ধরনের ইতিহাস খুঁজে বের করা কঠিন। কিন্তু কেন এমন হলো?
বাংলাদেশের বামপন্থী বলতে তখন শুধুমাত্র কমিউনিস্ট পার্টিকেই বোঝাত। আমরা যারা আরএসপি অর্থাৎ বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য হিসেবে কাজ করতাম তারা ছিলাম ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। জেলে যেতে যেতেই অনেকের জীবন ফুরিয়ে গেছে। নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ষাটের দশকে একেবারেই আমাদের রাজনীতি শিল্প এলাকাকেন্দ্রিক হয়ে যায়। আমরা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বেছে নিই। সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার কথা তখনো আমাদের মনে আসেনি। এমনিতেই হিন্দু, নাস্তিক এবং ভারতীয় এজেন্ট বলে আমরা নানা আখ্যায় ভূষিত। চাল-চলন কথাবার্তা সব ব্যাপারেই আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। আত্মগোপন করলে আরবিতে নাম নিতে হয়। রাজনৈতিক কোনো পরিবর্তন হলে আমরা নিশ্চিতভাবে জানতাম–জেলে যেতে হবে। তবে এ সময় শুনেছিলাম মস্কোতে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্টদের আশি জাতি সম্মেলনে নাকি বাংলাদেশের দলিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রস্তাব উধাপিত হয়েছিল। তবে সে প্রস্তারে ভিত্তিতে কোনো কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে বলে শুনিনি।
তখনো কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়নি। তখনো বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি মাত্র কেন্দ্র এবং সে কেন্দ্রটি হচ্ছে মস্কো। তাত্ত্বিক জগতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান শত্রু ছিলাম আমরা। কারণ আমরা বলতাম-লেনিনের পর স্ট্যালিন ভুল নীতি অনুসরণ করেছেন। আমরা বলতাম, কোনো একটি দেশে সমাজতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় হতে পারে না। অথচ ত্রিশের দশকে স্ট্যালিন বলেছিলেন-সোভিয়েত ইউনিয়ন সাম্যবাদের পথে এগুচ্ছে। আমরা বলতামরুজভেল্ট ও চার্চিলের চাপের ফলে ১৯৪৩ সালে স্ট্যালিন তৃতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে দেন। আমাদের মতে স্ট্যালিনের আমলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সূত্রপাত হয়। আমাদের কমিউনিস্ট বন্ধুরা বলতেন আমরা ট্রটস্কি অনুসারী। আমাদের রাজনীতি ও ট্রটস্কির বক্তব্য সম্পর্কে আমার বন্ধুদের সম্যক ধারণা থাকলে এ বক্তব্য তারা দিতেন না। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক এ পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা তাত্ত্বিক দিক থেকে আমাদের চরম বিরোধিতা করতেন। তকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের জন্মের সময় থেকে এ প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমরা থাকলেও শেষ পর্যন্ত ছাত্রলীগে আমাদের টিকে থাকতে কষ্ট হয়েছে। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছেড়ে আমি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার যোগদানের প্রশ্নেই ছাত্র ইউনিয়নের কাউন্সিলে ভোটাভুটি হয়। তবে ওই বিরাট কাউন্সিলে আমার বিপক্ষে ভোট পড়ে ২টি। এরপরেও আমার ছাত্র ইউনিয়নে থাকা হয়নি। ১৯৫৯ সালের সামরিক শাসনামলে আমি জেলে চলে যাই। ১৯৬২ সালে আমি মুক্তি লাভ করি। একদিন শুনলাম রাজধানী ঢাকার স্বামীবাগে ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন হচ্ছে ফরহাদ সাহেবের নেতৃত্বে। সেই সম্মেলনে আমাকে ডাকা হয়নি। সম্মেলনে প্রশ্ন উঠেছিল আমাকে না ডাকা সম্পর্কে। সম্মেলন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়ন নামে তাঁরা নাকি একটি নতুন প্রতিষ্ঠান করেছেন। এ প্রতিষ্ঠান পুরনো ছাত্র ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী নয়।
তবে আমাদের সাথে কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধ চরমে উঠল ১৯৬৪ সালে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের চটকল শ্রমিকদের নেতৃত্ব আমাদের হাতে। আমাদের সংগঠনের নাম পূর্ব পাকিস্তান চটকল শ্রমিক ফেডারেশন। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছে। ওই সামরিক শাসনের মধ্যেই ১৯৬৪ সালের ২ জুলাই আমরা চটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট আহ্বান করি। তখন কমিউনিস্ট পার্টির শ্রমিক সংগঠন ছিল পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক পরিষদ। সভাপতি ছিলেন তোয়াহা। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সিরাজুল হোসেন খান। আমাদের সহযোগিতার নামে তাঁরা আমাদের প্রচণ্ড অসহযোগিতা করলেন। তবুও ২১ দিন ধর্মঘটের পর আমরা জয়লাভ করি।
চটকল মালিকদের সাথে আমাদের চুক্তি হয়। মালিকরা চুক্তি লঙ্ঘন করলে ১৯৬৫ সালে আমরা পুনরায় ধর্মঘট আহ্বান করি। এবার আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। তাদের তখন রাজনৈতিক তত্ত্ব হচ্ছে–জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব স্তরে জাতীয় বুর্জোয়াদের সহযোগিতা করা যায়। তাদের ব্যাখ্যায় জাতীয় বুর্জোয়া হচ্ছে চটকল মালিক ইস্পাহানি এবং ইয়াহিয়া বাওয়ানী। অথচ তাদের বিরুদ্ধে আমরা ধর্মঘট করছি। কমিউনিস্ট পার্টির চটকল নেতা হচ্ছেন–মোহাম্মদ তোয়াহা এবং আবুল বাশার। চট্টগ্রামও চটকল ধর্মঘটের অন্তর্ভুক্ত। তখন চট্টগ্রামের ডিসি ছিলেন রাশেদ খান মেননের মেজ ভাই আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তোয়াহা এবং আবুল বাশার আবু জাফর ওবায়দুর বাসায় মালিকদের সাথে বৈঠক করে এক চুক্তি সম্পন্ন করেন এবং চটকল ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন। কিন্তু সে প্রত্যাহার কোনো কাজে আসেনি। এ চুক্তির হাস্যকর দিক হচ্ছে, ধর্মঘট ডেকেছিলাম আমরা আর সে ধর্মঘট প্রত্যাহার করলেন তোয়াহা এবং আবুল বাশার। আমরা সে চুক্তি মানলাম না। কোনো চুক্তি না করেই আমরা কাজে যোগ দিলাম। এ হচ্ছে সে কালের বাম ঐক্যের একটি চিত্র। তবে চটকল শ্রমিকদের মধ্যে আমাদের প্রভাবের জন্যেই পরবর্তীকালে যশোরের কমিউনিস্ট নেতা ড, মারুফ হোসেনের সহযোগিতায় আমাদের সাথে এক সময় বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্পর্কে আলোচনা করতে আসেন। এ ধরনের আলোচনায় মূল কমিউনিস্ট পার্টির কাউকে আমি অংশগ্রহণ করতে দেখিনি। প্রসঙ্গত বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটি অংশ এবং বামপন্থীদের এ অংশটি ছাড়া আমরা কাউকে বাংলাদেশ স্বাধীন করা নিয়ে আলোচনা করতে শুনিনি।
এই পরিবেশে কমিউনিস্ট শিবিরের সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছে মস্কো পিকিং দ্বন্দ্ব। ১৯৪৯ সালে চীনে বিপ্লব হয়। ১৯৫৩ সালে স্ট্যালিনের মৃত্যু হয়। ক্ষমতায় আসেন ক্রুশ্চেভ। ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২০ কংগ্রেসে স্ট্যালিনের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উত্থাপন করেন। ক্রুশ্চেভ বলেন, স্ট্যালিনের ব্যক্তিগত কারণে লাখ লাখ কমিউনিস্ট কর্মী নিহত হয়েছে। স্ট্যালিনের আমলে কারো স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার ছিল না। ক্রুশ্চেভের অভিযোগে সমগ্র বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। বাম মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। ক্রুশ্চেভ তার বর্ণনায় স্ট্যালিনকে ভয়ঙ্কর দানব হিসেবে চিত্রিত করেন। আর তারই সাথে তিনি এক নির্ভেজাল তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। এ নির্ভেজাল তত্ত্ব হচ্ছে পুঁজিবাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পুঁজিবাদী বিশ্বকে পরাজিত করা।
স্ট্যালিন সম্পর্কে ক্রুশ্চেভের মূল্যায়ন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের তত্ত্ব সমগ্র পৃথিবীকে মুখ্যত সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। চীনের এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কুশ্চেভের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করে আর শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি মস্কোপন্থী অপরটি পিকিংপন্থী।
সেকালের পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ে। এককালে সবাই মিলে যারা মস্কোপন্থী বলে অভিহিত হতো তারা মস্কো ও পিকিং এ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে যে অপবাদ ছিল যে–তারা দেশীয় রাজনীতির ভিত্তিতে কোনো কিছু নির্ণয় করে না। আন্তর্জাতিক নীতিই তাদের সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক শক্তি। সেই অপবাদই আবার প্রমাণিত হলো। দেশের সমস্যার নিরিখে নয়, বিদেশের নির্দেশে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলো। এককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের নিরিখে দেশীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিজস্ব সরকার সম্পর্কে নীতি নির্ধারণ করত। এবার সে রূপ পাল্টে গেল। পাকিস্তানের শাসন কর্তা আইয়ুব খানের সঙ্গে সমর্থন জানাল। মস্কো সরকারের সাথে আইয়ুব খানের সম্পর্ক ভালো নয় তাই মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি আইয়ুব বিরোধী হয়ে গেল।
তবে এ ক্ষেত্রে ভারতও একটি ফ্যাক্টর। ভারত সরকার তার জন্মলগ্ন থেকে রাজনৈতিক কারণে নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এ নিরপেক্ষ থাকার অর্থ হচ্ছে–সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে থাকা। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই ভারতের বিরোধিতা করত। আর ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু বলে নিশ্চয়ই চীনের বন্ধু নয় এবং পাকিস্তানেরও বন্ধু নয়। আর এ তত্ত্ব অনুসারে বাংলাদেশের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কিছুটা ভারতপন্থী আর পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কিছুটা ভারত বিরোধী। এ পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন ষাটের দশকের প্রথম দিকে মস্কোপন্থী কোনো কোনো মহলে হালে পানি পেলেও পিকিংপন্থীরা মনে করতে বাংলাদেশ স্বাধীন করার আন্দোলন হচ্ছে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র ষড়যন্ত্র। তাই ছয় দফা সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া ছিল বামপন্থী মহলে।
তবে সেকালের প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষ বা পাকিস্তান ভাঙার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল না তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে আমাদের বামপন্থীদের অসুবিধা হচ্ছে–আমরা কোনোদিনই কোনো ঘটনাকে নিজস্ব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে চাই না। আমরা বুঝতে চেষ্টা করি না যে কোনো ষড়যন্ত্রই উর্বর ভূমি না থাকলে সবল হয় না। পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে আমরা বলতাম-এটা ব্রিটিশ ষড়ষন্ত্র। অথচ কেউ ব্যাখ্যা করিনি, আপামর মুসলিম জনসাধারণ কেন পাকিস্তানের পক্ষে চলে গেল। কেন আমাদের পক্ষে এল না। এ সত্যটি অনুসন্ধান করে জানতে পারলে এ উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্নরকম হতো।
একই ধরনের মনোভাব আমরা ছয় দফা নিয়ে দেখিয়েছি। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দিলেন। আমরা বললাম সিআইএ’র দলিল। অথচ সাধারণ মানুষ তাঁর কথা গ্রহণ করল। কেন গ্রহণ করল এ সত্যটি বুঝবার চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই এ আন্দোলনে আমরা নেতৃত্ব দিতে পারতাম। আমার ধারণা এ প্রশ্নে আমার কমিউনিস্ট বন্ধুরা আন্তর্জাতিক তত্ত্বের শিকার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় শত্রু-মিত্র নিরূপণের চেষ্টা হয়েছে। কখনো জাতীয় সমস্যা চোখের সামনে আসেনি। জাতীয় সমস্যা দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক সমস্যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তাই প্রতিটি সমস্যার কালে ইংরেজিতে বলা যায়–আমরা ইর্ড করিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও বামপন্থীদের তেমন ভূমিকা ছিল না। ছিটেফোঁটা উপদল ছাড়া কেউ ১৯৭১ সালের ১ মার্চের আগে এ প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেয়নি।
তবে এর পরেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নটি হচ্ছে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ বাংলাদেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নিলেও আওয়ামী লীগ তার ছয় দফা দাবি পেশ করতে আরো চার বছর কেন দেরি করল? ছাত্রলীগের এ চিন্তা-ভাবনায় কি ছিল? লক্ষণীয়, ছাত্রলীগের এ অংশটি ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তেমন ভূমিকা নেয়নি। আবার এরাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ গঠন করে। তাহলে কি জাসদ গঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে? আমি এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করব পরবর্তী লেখায়।
সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে চীন আবির্ভূত হওয়ার পরে কমিউনিস্ট মহলে একটি নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমরা অর্থাৎ আরএসপির সদস্যরা ব্যতীত এক সময় সকলেই ছিল মস্কোর অনুসারী। কমিউনিস্ট। গণতান্ত্রিক সমাজবাদ অর্থাৎ সোশ্যাল ডেমোক্রেসি পৃথিবীর এ অংশে তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সম্পর্কে আমাদের এই এলাকায় ধ্যান-ধারণা তখন তেমন স্বচ্ছ ছিল না। মনে করা হতে কমিউনিস্ট মাত্রই মস্কোপন্থী। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসারী। অজ্ঞতা ছিল একান্তই গভীর। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালে বরিশালে মে দিবস পালনের জন্যে পুলিশের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করা হয়েছিল। পুলিশ লিখে দিয়েছিল, দিবসটি রাশিয়ার। সুতরাং এ দিবস পালনের অনুমতি দেয়া যাবে না। ১৯৫০ সালে আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক পুলিন দে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ ছিল তাঁর হাতে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ বইটি ছিল! পুলিশের কাছে ম্যাক্সিম অর্থ মার্কসিজম অর্থাৎ কমিউনিজম। সুতরাং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে এ পুস্তক বহনকারীকে গ্রেফতার করা একান্তই কর্তব্য।
জেলখানায় আবার উল্টো গল্পও শুনেছি। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন ঢাকার কমরেড গোপাল বসাক। ১৯৪৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি আগে কোনোদিন গ্রেফতার হয়েছিলেন কি? অর্থাৎ সে এক অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারের যুগ। আর এ সুবাদে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে কমিউনিস্ট বা সমাজতন্ত্রী অর্থে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুদেরই বোঝাত। তবে এ সুযোগ আমার কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরাও নিয়েছেন। তাঁরা বলতেন, তারাই একমাত্র সাচ্চা কমিউনিস্ট। আর সবাই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে বলা মানে সমাজতন্ত্রের বিপক্ষে বলা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে যাঁরা বলেন, তাঁরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট। সে অর্থে কমিউনিস্ট বন্ধুদের ভাষায় আমরা ছিলাম সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট। আমরা যেমন লেনিন পরবর্তী স্ট্যালিনের নীতি ভুল বলতাম। যেমন বলতাম যে পূর্ব ইউরোপে আদৌ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের জয়ের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল ফৌজ দেশে ফিরে যাবার পথে পূর্ব জার্মানি পোল্যান্ড, চেকোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া এবং আলবেনিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিকে উপর থেকে ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে গেছে। শুধুমাত্র রুমানিয়া যুগোশ্লাভিয়ায় বিপ্লবের পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু লাল ফৌজের হস্তক্ষেপে সেখানে বিপ্লব হওয়ার পরিবর্তে তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাই আমরা বলতাম, পূর্ব ইউরোপে কোনো বিপ্লব হয়নি এবং প্রতিবিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। কমিউনিস্ট বন্ধুরা বলতেন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে এ সকল রাষ্ট্রে। তবে তকালীন কোনো তাত্ত্বিকই বলতে পারেননি যে সেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব উত্তরণের পথ কী। আমাদের এ সমালোচনার জবাব দিতে না পেরে আমাদের নির্ভেজাল মার্কিন দালাল বলে অভিহিত করা হয়।
চীনের বিপ্লব সম্পর্কেও আমাদের ভিন্ন বক্তব্য ছিল। চীন কখনো দাবি করেনি যে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়েছে। এ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে জাতীয় বুর্জোয়ারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আমাদের সমালোচনা ছিল এই বিপ্লবও বিপদে পড়বে। বিপ্লবের সহযোগী বলে কথিত জাতীয় বুর্জোয়ারা ষড়যন্ত্র করবে। দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগিতায় প্রতি বিপ্লব ঘটাতে চাইবে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। শ্রেণি সমন্বয়কারী জোটের নেতৃত্বে শ্রেণিসংগ্রাম করা যায় না।
আমরা এখনো বিশ্বাস করি পূর্ব ইউরোপ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য সঠিক ছিল। চীন সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য যে সঠিক ছিল তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন প্রয়াত কমরেড মাও সে তুং। শ্রেণি সমন্বয়ের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেছিলেন। কিন্তু সফল হননি। সেকালে আমাদের এ সমালোচনার জন্যেও আমরা মার্কিন দালাল বলে অভিহিত হতাম।
তবে আগেই বলেছি সব কিছুর একটা পরিবর্তন আসে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব শুরু হলে। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের কাছে তাদের বিরোধী সকলের ছিল সাম্রাজ্যবাদের দালাল। তারাই ছিল একমাত্র সাচ্চা বিপ্লবী। তাদের বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে বলা হতো নিশ্চয়ই এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ পেয়েছে।
চীন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব শুরু হলে এ চিত্রের পরিবর্তন হয়। কমিউনিস্ট আন্দোলন মুখ্যত মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী হিসেবে ভাগ হয়ে যায়। তাদের নিজেদের মধ্যকার গালিগালাজ মুখ্য হয়ে ওঠে। কতটুকু সাচা বিপ্লবী সে তত্ত্ব প্রমাণেই সকলে গলদঘর্ম এবং আমাদের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেয়া মন্তব্যগুলোই তাদের ঝগড়ার হাতিয়ার হয়ে দাঁড়াল। একটি বড় ধরনের সর্বনাশ হয়ে গেল পৃথিবীর কমিউনিস্ট আন্দোলনে। দল ভাগাভাগির নামে যে কেউ এখন দলের সদস্য পদ পেতে শুরু করল। নতুন নেতৃত্ব এল যাদের জ্ঞানের পরিধি একান্তই সীমিত। রাতারাতি মস্কোপন্থী পিকিংপন্থীতে পরিণত হল। আবার অনেক পিকিংপন্থী পরিণত হলো মস্কোপন্থীতে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। নেতৃত্ব রক্ষাই বড় হয়ে উঠল।
সেকালের সে সর্বনাশা চিত্রের একটি আবছা আদল আজকের জাতীয় রাজনীতিতে আছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে সেকালে যারা পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট বলে পরিচিত ছিল তাদের মধ্যে অনেকে এখন বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলের সদস্য। মস্কোপন্থী বলে পরিচিত অনেকে আওয়ামী লীগের সদস্য।
লক্ষণীয় যে আজকের এ পরিণতির ইতিহাস শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। ষাটের দশকেই মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বে কমিউনিস্ট পার্টি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আর এ ষাটের দশকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন বাহ্যত দানা বাঁধতে শুরু করে। তাই আমার নিজের ধারণা ব্যক্তি বা উপদল হিসেবে বামপন্থীদের কিছু নেতা ও কর্মী বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে ভাবলেও মস্কোপন্থী বা পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট বলে পরিচিত দলগুলোর পক্ষে তখন বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্পর্কে স্থির কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল না।
এছাড়া মনে রাখতে হবে যে আমি যে ধরনের পিকিংপন্থী বা মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির কথা বলেছি সে ধরনের কোনো পার্টি তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করত না। দুটি দলকেই ভাসানী, ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপ নামে কাজ করতে হতো। ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ন্যাপকে বলা হতো পিকিংপন্থী। অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাপকে মস্কোপন্থী বলা হতো। এ দুটি দল কোন অর্থেই কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না। এ দুটি দলে বিভিন্ন মত শ্রেণি ও পেশার লোক ছিল। ফলে এ দুটি দলের সাধারণভাবে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও আন্দোলন পরিচালনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। এ দুটি দলের পেছনের শক্তি ছিল আত্মগোপনকারী মস্কোর অনুসারী কমিউনিস্ট পার্টি আর পিকিং অনুসারী বহুধা বিভক্ত কমিউনিস্ট দল ও উপদল। এই উপদলের মধ্যে একমাত্র মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নে পক্ষ থেকেই ১৯৬৮ সালে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের আহ্বান জানানো হয় প্রকাশ্যে। এর কিছুদিন পর থেকে অথবা একই সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের আহ্বান জানিয়েছে সিরাজ সিকদারের পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি। তবে দল হিসেবে এরা কোনোদিনই প্রকাশ্যে আসেনি। তাই প্রথমেই আমি বলতে চেয়েছি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বয়স যতই হোক না কেন, এ আন্দোলন প্রথম দিকে কোনো রাজনৈতিক দলই সুসংগঠিতভাবে শুরু করেনি। প্রথম নেতৃত্ব এসেছিল বিক্ষুব্ধ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পক্ষ থেকে। তারাই আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক বিদ্রোহের নেতা। আর প্রায় একই সময় ষাটের দশকের প্রথম দিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটি অংশ গোপনে হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে শুরু করে।
তবে সে আন্দোলনও তখন তেমন জোরদার ছিল না। কারো মনে তেমন রেখাপাত করেনি। এবং সে আন্দোলন যে কত ঠুনকো তা প্রমাণিত হয় ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। আমি তখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলন কিভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। পরবর্তীকালে যারা দারুণ বাঙালি হয়েছে স্বাধীনতার পর অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছে বা এখনো পাচ্ছে, আমি তাদের দেখেছি পাকিস্তান বেতারে যেতে। দেখেছি গান লিখতে। গানে সুর দিতে। নিজেরা গান করতে। ঢাকা শহরে মিছিল করতে। গাড়িতে ‘ক্রাশ ইভিয়া স্টিকার লাগিয়ে শহরময় ঘুরে বেড়াতে। যারা স্টিকার লাগাইনি তারা হয়েছি তাণ্ডবের শিকার। আমাদের এককালের সকলের পরিচিত বন্ধু খালেকদাদ চৌধুরী এর মধ্যে একদিন প্রেস ক্লাবে এসে বললেন, নির্মল বাবু, এক আন্তর্জাতিক রায়টের ছবি দেখছি প্রতিদিন। আমরা দুটি রাষ্ট্রের মানুষ সকলে হিন্দু-মুসলমান হয়ে গেছি। আমরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলছি। বিহার থেকে আসা শরণার্থী বিমানবাহিনীর আলম এখন আমাদের জাতীয় নেতা। কারণ সে ভারতের ১১টি বিমান ধ্বংস করেছে। অর্থাৎ সমগ্র দেশে ১৯৪৭ সালের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সে যেন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর পরিবেশ।
আমি কিন্তু খুব অবাক হইনি। আমি নিজেও তখন আশ্রয় খোঁজার জন্যে অস্থির। পাক-ভারত যুদ্ধ হচ্ছে। আমার বাবার নাম বাংলায়। আমি রাজনীতি করি। তাই আমাকে তো জেলে যেতেই হবে। পরদিন খবরের কাগজে দেখলাম কমিউনিস্ট, অ-কমিউনিস্ট সকল হিন্দু নেতাকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমি প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরকে ফোন করলাম। বললাম, দেখুন ছাত্ররাজনীতি করে দীর্ঘদিন জেল খেটেছি। হিন্দু হিসেবে জেল খাটতে রাজি নই। আমি তখন দৈনিক পাকিস্তানের সহসম্পাদক। আমি তাকে বললাম, আমি যাতে গ্রেফতার না হই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিভিন্ন কারণে মোদাব্বের সাহেব তখন সকল মহলে বিশেষ প্রভাবশালী। তিনি জানালেন, তুমি এ সময় ঢাকা ছেড়ে কোথাও যাবে না। দেৰি কী করা যায়। তখন দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক তোয়াব খান। আমি তাকে বললাম, আমি রাতের শিফটে কাজ করব প্রতিদিন। তখন রাতে যখন তখন সাইরেন বাজত। রাতে কেউই কাজ করতে চাইত না। সুতরাং আমি রাতের শিফটে বহাল হয়ে গেলাম।
কিন্তু দেখলাম, আমার এই রাতের শিফটের কাজও আমাকে বিপদে ফেলে দিবে। আমি সাংবাদিকতা ছাড়াও বিভিন্ন বাড়িতে তখন শিক্ষকতা করতাম। উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার থেকে বিশ্ববিদ্যালস্ত্রের অধ্যাপকদের বাড়ি পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবে আমার অবাধ যাওয়া-আসা ছিল। আমি দেখলাম, আমার রাতে চাকরি করা নিয়ে সর্বত্রই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আমার এক তরুণ ছাত্র একদিন বলেই বসল, স্যার, আপনাকে সত্যি সত্যি কেউ বিশ্বাস করে না। সবাই বলে রাতে দৈনিক পাকিস্তান থেকে আপনি ভারতে খবর পাঠিয়ে দেন। তাদের অজ্ঞতা আমার হাসি যোগাত। আমার এক প্রিয় ছাত্রী, যে বেতারে গান গেয়ে পাকিস্তানকে বাঁচাবার জন্যে সকাল-সন্ধ্যা পরিশ্রম করত, যুদ্ধের পর সেও একদিন আমাকে বলে বসল, স্যার যুদ্ধের সময় আপনাকে কখনো বিশ্বাস করিনি। আর এখন মনে হচ্ছে আপনার কথাই ঠিক। পৃথিবীতে একটি অনন্য যুদ্ধ হলো। যে যুদ্ধে দুই দেশই দাবি করে বসল যে, উভয়ই জিতেছে এবং বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হলো। এ ভাওতাবাজির তুলনা নেই।
আমি তখন এ সকল বিতর্কে যোগ দিতাম না। আমার কাছে ছিল সে এক বিরাট অভিজ্ঞতা। ছাত্র-যুবক রাজনৈতিক দলের সেকালের ভাষণ বিবৃতি আমার আজকেও মনে আছে। আমরা তখন নিখাদ পাকিস্তানি। মস্কোপন্থী কমিউনিস্টরা বিভ্রান্ত। সাহস করে কথা বলতে চাচ্ছে না। পিকিংপন্থীদের মুসলিম লীগের সাথে পৃথক করে দেয়া অসম্ভব হয়ে উঠত। অনেকের কাছে বিতর্কিত হলেও মওলানা ভাসানীকেই তখন আমার কিছুটা মনে হয়েছে তিনি জনগণের মন বুঝতেন। তিনি চেষ্টা করেছেন ওই সঙ্কটের সময়ও কিছুটা নেতৃত্ব দিতে। আমার কথা হচ্ছে–এর পরের ইতিহাস কি খুব চমকপ্রদ নয়? ১৯৬৫ সালে আমরা ভারতের সাথে যুদ্ধ করলাম। ভারতকে ধ্বংস করার শ্লোগান দিলাম। একটা নতুন পাকিস্তানি পরিবেশ সৃষ্টি করলাম। আবার বছর যেতেই ছয় দফা দাবি পেশ করা হলো। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে এটা কি ভোজবাজি? ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ রাতারাতি কি পাকিস্তানবিরোধী হয়ে গেল। পাকিস্তান রক্ষার জন্যে জান কোরবান করে আবার বছর না ঘুরতেই পাকিস্তান ভাঙতে চাইল।
আমার এ লেখা একান্তভাবে আমার অভিজ্ঞতাপ্রসূত। আমি সমসাময়িক খবরাখবরের ওপর ভিত্তি করে আমার বক্তব্য বলার চেষ্টা করেছি। আমার বিবেচনায় পাকিস্তানের জন্মের পর একাত্তর সালের সংগ্রাম পর্যন্ত আমাদের দেশের রাজনীতি অনেক বাঁক ও মোড় নিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নটি পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে আসেনি। এমনকি আমার ধারণা হচ্ছে–১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালিদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাকিস্তান আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এ আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। আমি শুনেছি, পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বেই মুসলিম ছাত্রলীগের একটি অংশ কলকাতা থাকতেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার চিন্তা করছিল। তবে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পূর্ব বাংলায় এ দাবি প্রথম তুলেছিল তমুদ্দিন মজলিশ, যারা শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল। আমার এ ধরনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে বহু কথায় আমি ইতোপূর্বে লিখেছি। সেই সকল ব্যাখ্যা একের পর এক সাজালে নিম্নরূপ দাঁড়ায়। আমার মতে–
১. ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে বাঙালিয়ানার কোনো সম্পর্ক ছিল না।
২. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ভাষাভিত্তিক মানসিকতার একটি প্রাথমিক স্তর সৃষ্টি হয়।
৩. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেও ক্ষমতা না পাওয়ায় বাঙালিদের মনে একটা স্বতন্ত্র ধারণা সৃষ্টি হয় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ২১ দফায় স্বায়ত্তশাসনের কথা প্রথম উচ্চারিত হয়।
৪. ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পরে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের ফলে স্বতন্ত্র দেশ গড়ার আন্দোলন পিছিয়ে যায়। ১৯৫৬ সালের সমঝোতার মাধ্যমে একটি সংবিধান তৈরি হয়। সেই সংবিধানে দুই ইউনিটের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে ভাগ করা হয়। দুই ইউনিট অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সব ব্যাপারে সমান সুযোগ দেয়ার বিধান রাখা হয়। অথচ পাকিস্তানের জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন ছিল বাঙালি। সংবিধানে এ ধারার বিরুদ্ধে জনমনে বিক্ষোভ ছিল। ধারণা করা হয়েছিল ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচন হবে এবং এ নির্বাচনের পর হয়তো সমস্যার একটা সমাধান হবে। কিন্তু সে নির্বাচন এল না। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলো। গণতন্ত্র নির্বাসিত হলো সমগ্র পাকিস্তান থেকে এবং তার প্রথম শিকার হলো নতুন গড়ে ওঠা বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত এলো। একটি সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, বাঙালি হিসেবে বেঁচে থাকতে হলে একটা কিছু করতে হবে। কিন্তু তখনো রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের চিন্তা দানা বেঁধে ওঠেনি।
৫. সামরিক শাসনামলে বাঙালি সরকারি বেসরকারি আমলারা অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে শিখল যে, পাকিস্তানের কাঠামোয় তাদের জীবনের কোনো নতুন কিছু ঘটবে না। কর্মজীবনে কোনো উন্নতি করতে হলে বাঙালির শাসন প্রয়োজন।
৬. এই মানসিক পরিস্থিতিতে ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের। যুদ্ধ হলো। এ যুদ্ধ চলেছিল ১৭ দিন। এ যুদ্ধের সময় প্রমাণিত হলো যে, ভৌগোলিক অর্থে আমরা পাকিস্তানের অঙ্গ নয়। আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছিলাম একান্তই অরক্ষিত। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমাদের রক্ষা করা সম্ভব নয় এবং সম্ভব ছিলও না। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় যে কোনো মুহূর্তে আমাদের ধ্বংস্তূপে পরিণত করতে ভারতের কোনো অসুবিধা ছিল না। সবচেয়ে মজার হচ্ছে-১৯৬৫ সালের যুদ্ধ সকলকে কট্টর পাকিস্তানিতে পরিণত করেছিল। সে যুদ্ধে ভারতকে ধ্বংস করো’ এটাই ছিল আমাদের একমাত্র শ্লোগান। সে যুদ্ধের পরপরই সব কিছু পাল্টে গেল। যুদ্ধে প্রমাণিত হলো আমরা অরক্ষিত এবং সকলের মনে অনিবার্য সিদ্ধান্ত হলো যে, আমাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমাদের কেউ বাঁচাতে আসবে না। অর্থাৎ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চাই। আর এই পরিবেশেই যৌক্তিক হয়ে দেখা দিল ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবে বলা হয়েছিল দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হবে। দু’টি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হলে তার নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকে। অথচ ১৯৪৭ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়নি। দুটি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে পাকিস্তান নয়, পাকিস্তান একটি এককেন্দ্রিক সরকারে গঠিত হয়েছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার আদৌ প্রশ্ন ছিল না। সেই প্রশ্নই বাস্তব হয়ে দেখা দিল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর এবং আমার ধারণা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ধারণা পূর্ণতা লাভ করে। কারণ রাষ্ট্র স্বাধীন না হলে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও স্বাধীন হয় না।
৭. আমি বলার চেষ্টা করেছি যে, জাতীয়তাবাদী এ আন্দোলনের নেতৃত্ব বামপন্থীদের গ্রহণের কথা থাকলেও পাকিস্তানের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বামপন্থীদের এ সংগ্রামে নেতৃত্ব গ্রহণের আদৌ কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
৮. আমি আরো বলতে চেয়েছি যে, সর্বশেষ বিচারে শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইলেও পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা ও গভীর আত্মিক যোগাযোগ থাকার কারণে তাঁরা পাকিস্তানের কাঠামোতে একটি সমাধান বের করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণেই তারা সফল হননি।
৯. আমার ধারণা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের পর খুব দ্রুত গতিতে ঘটনা পাল্টাতে থাকে। বিশেষ করে বিক্ষুব্ধ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের একটি অংশ নিজেদের উদ্যোগেই একটা কিছু করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কিংবা মানসিক দিক থেকে তেমন প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক বিদ্রোহের ঘটনা সাধারণ মানুষকে যেমন স্তম্ভিত করে দেয় তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও বিপদে ফেলে দেয়। আজকে হয়তো অনেকেই স্বীকার করবেন না যে, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা প্রকাশ হওয়ার পরে জনসাধারণ কিন্তু স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রথমেই এ মামলাকে সমর্থন জানায়নি। এ মামলা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ছিল। অথচ রাজনৈতিক জীবন থেকে এ মামলাকে মুছে ফেলা যাচ্ছিল না। এ মামলার পাশাপাশি ছয় দফা ও এগারো দফা আন্দোলন ছাত্ররা গড়ে তোলে। প্রকৃতপক্ষে ছয় দফা ও এগারো দফা বাস্তবায়নের একটি ছোটোখাটো মডেল হিসেবে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আবির্ভূত হয়। অর্থাৎ সেদিন যা কল্পনায় ছিল তা যে বাস্তবায়ন করা যায় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ছিল তার একটা নজির। এ মামলা মানুষের কাছে পরিষ্কার করে দেয় যে, আমরা আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে সামরিক বাহিনীরও সমর্থন পাব। আর দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ পরিস্থিতির জন্যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব আদৌ প্রস্তুত ছিল না। ছয় দফা এগারো দফার আন্দোলন মুখ্যত ছিল আবেগ নির্ভর এবং স্বতঃস্ফূর্ত। এ ছাড়া ছয় দফা, এগারো দফা নিয়ে ডান ও বাম রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। সুতরাং ছয় দফা ও এগারো দফার আন্দোলনকে স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত করা যাবে ঠিক তার কোনো সত্যিকার ছবি কারো মাথায় ছিল না। সীমিত ক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বাধীনতার কথা চিন্তা করলেও তাদের চোখের সামনে বাধা ছিল হিমালয় পরিমাণ।
১০. প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে আমরা স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করলে আমাদের সহায়ক শক্তি কে হবে? এ প্রশ্নে কারো সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, দেশ স্বাধীন হলে কোন ধরনের বাংলাদেশ গঠিত হবে? কোন সমাজ কাঠামো আমরা পাব? আমি যতোটুক জানি, ৭১-এর সংগ্রাম শুরু করার পূর্বে এ ধরনের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ ছিল না। আবার আলোচনা হলেও মতানৈক্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। তাহলে আমরা কী সংগ্রাম করলাম? কোন যুক্তিতে সংগ্রাম করলাম? কাকে বন্ধু ভেবে সংগ্রাম করলাম? কোন সমাজের জন্যে সংগ্রাম করলাম? এ ধরনের কোনো প্রশ্নের জবাব না খুঁজেই আমরা কি ৭১-এর সংগ্রাম শুরু করেছিলাম না? এর পরিবর্তে বলা যায়, আমাদের ওপর হঠাৎ করে সগ্রাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এ • সগ্রামের জন্যে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। তাই কথাটা এভাবে বলা যায় যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের কর্ণধাররা পূর্ব পাকিস্তানকে তাদের হিসেব্বে খাতা থেকে খারিজ করে দিয়েছিল। তাদের পূর্ব পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওয়ার মতো তেমন কিছু ছিল না। তাদের শোষণে পূর্ব পাকিস্তান তখন রিক্ত। পূর্ব পাকিস্তানকে যেনতেন প্রকারে ছুঁড়ে ফেলে দেয়াই তাদের একমাত্র কাজ ছিল। হয়তো তারা ভেবেছিল ১৯৭০-এর নির্বাচনে তাদের তাঁবেদাররা জয়লাভ করবে। তাদের তাঁবেদাররা জয়লাভ করলে হয়তো আরো কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তানকে দাবিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু ১৯৭০ সালে নির্বাচনে তাদের দালালরা পরাজিত হয়। একটি নতুন শক্তির উন্মেষ ঘটে। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন বা শোষণ চলবে না। আজ হোক, কাল হোক এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তাদের বিদায় নিতে হবে। তাই তাদের সিদ্ধান্ত ছিল শেখ সাহেবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার। বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক, এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। ৭০-এর নির্বাচনের পর এ ধরনের নীতি গ্রহণ করা না হলেও কিছুতেই ইয়াহিয়া কিংবা ভুট্রোর ভূমিকা ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যাখ্যা করা যায় না গঙ্গা নামক একটি ভারতীয় বিমানকে ছিনতাই করে লাহোরে ভস্মীভূত করা। এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট যে যুদ্ধটা পাকিস্তান সরকারই এগিয়ে এনেছে। এ যুদ্ধে জড়িয়েছে ভারতকে। আমাদের বিক্ষুব্ধ করেছে প্রতিদিনের ঘটনা। আজ সেকালের ঘটনার হিসেব দিলে দেখা যাবে আমরা সকলে প্রতিদিন সমঝোতার কথা বলেছি। আপোষের কথা বলেছি। আমাদের দাবি মেনে নেয়ার কথা বলেছি। কিন্তু আমাদের কোনো দাবি মেনে নেয়া হয়নি। আজকের অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কিছু করার ছিল না। তিনি সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন। ৭১-এর নাটকে খলনায়ক ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু এ ভাষ্যকাররা কিছুতেই বলতে চায় না যে, ওটাই ছিল পাকিস্তানের রাজনীতি। ইয়াহিয়া, ভুট্টো, সেনাবাহিনী বা পাকিস্তানের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এ ব্যাপারে ঐকমত্য ছিল। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমার ধারণা ৭১-এর যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের মধ্যে অনেকে এটা আঁচ করলেও নেতৃত্ব পর্যায়ে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। জনসাধারণ ছিল একেবারে অন্ধকারে। নইলে ২৫ মার্চ রাতে লাখো লাখো মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাত না। একটি মুক্তিযুদ্ধের জন্যে যে জাতি প্রস্তুতি নেয়, তারা এভাবে কোনোকালে কোনোদিন প্রাণ দেয় না। আজকে সাহস করে বলতে হবে যে, সে রাতে হানাদার পাকিস্তানিদের হাতে লাখ লাখ সচেতন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়নি। মারা গেছে নিরীহ নির্বিরোধ সাধারণ নাগরিক। এ মৃত্যুর জন্যে রাজনীতিকদের দায়িত্ব অস্বীকার করা যাবে না।
আমার এ লেখা দেখে মনে হতে পারে ৭১-এর সংগ্রামকে আমি একটি নেতিবাচক জায়গায় দাঁড় করাচ্ছি। যেন সবকিছুর জন্যেই দায়ী ছিল পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানই যেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে বাধ্য করেছিল। আমার লেখা সম্পর্কে এ ধরনের ব্যাখ্যা সঠিক হবে না। আমি বলতে যাচ্ছি যে-তল্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের উদাত্ত কামনা ছিল পাকিস্তানের শাসন বাঙালিদের হাতে থাকতে হবে। বাঙালিরা শাসন ক্ষমতায় না গেলে সকল ক্ষেত্রে আমরা বঞ্চিত এবং শোষিত হব এবং এ লক্ষ্যেই বাঙালিরা নৌকায় ভোট দিয়েছিল। প্রার্থীর যোগ্যতা সম্পর্কে কোনো চিন্তা তারা করেনি এবং সে নির্বাচনে বাঙালিরা জয়লাভ করেছিল। কিন্তু বাঙালির হাতে ক্ষমতা এল না এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রশ্ন মুখ্য হয়ে উঠল। প্রশ্নটি হচ্ছে-বাঙালির হাতে যদি ক্ষমতা দেয়া না হয় তাহলে বাঙালিরা কী করবে? নির্বাচনের বিকল্প কী? বাঙালি কি হাতে অস্ত্র নেবে? বাঙালি কি সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করবে? মিছিলে-সমাবেশে এবং জনসাধারণ এ ধরনের স্লোগান উঠলেও সারাদেশের মানুষের কাছে সগ্রামের এ অধ্যায়টি স্পষ্ট ছিল না। এ ধরনের অভিজ্ঞতা তাদের থাকার কথা নয়। তাদের বলা হয়েছিল, নৌকায় ভোট দাও। বাঙালির প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে সব দুঃখের অবসান হবে, সকল বঞ্চনার শেষ হবে।
কিন্তু ক্ষমতায় না গেলে কী হবে? ১৯৫৪ সালের মতো বাঙালিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে কী হবে? শ্লোগানে শ্লোগানে বলা হতো ছয় দফার শেষ কথা স্বাধীনতা স্বাধীনতা। কিন্তু সেই শ্লোগানের স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কোনো রাজনীতি বা কৌশল ছিল না। তাতে মনে হচ্ছিল এ শ্লোগান ছিল শুধুমাত্র স্লোগানের জন্যে। এ শ্লোগান ছিল দর কষাকষির হাতিয়ার এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থী একটি মহলের ধারণা ছিল আপাতত সব আন্দোলনের মূল কথা ছিল আপোষ। আপাতত আপোষে ক্ষমতা দখল। আর একবার ক্ষমতা দখল করতে পারলে পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার চেষ্টা হবে। এ প্রেক্ষাপটে নিশ্চই প্রশ্ন উঠতে পারে সেকালে বামপন্থীরা সর্বশেষ পর্যায়ে এসেও কেনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারল না। সে প্রশ্নের জবাবে পরে আসছি।
৭১-এর সগ্রামে বামপন্থীদের কী ভূমিকা ছিল? এ প্রশ্ন আমি বারবার আলোচনা করেছি। তবুও প্রশ্ন উঠেছে ১৯৭০ সালে নির্বাচনের পর বামপন্থীরা কেন নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলো? কেন তারা বুঝতে পারল না, কেন্দ্রের পাকিস্তান সরকার এ নির্বাচন মেনে নেবে না। ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অবশ্যম্ভাবী।
এ ধরনের প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিক হলেও বামপন্থীদের পক্ষে তখন এ ধরনের নেতৃত্ব নেয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। আমি আগেই বলেছি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্মলগ্ন থেকেই বাপন্থী রাজনীতি ছিল নিষিদ্ধ। আইন দিয়ে নিষিদ্ধ না করে প্রতিটি বামপন্থী দলকে নির্যাতন চালিয়ে প্রায় অকেজো করে দেয়া হয়েছিল। দলের নামে কোনোদিনই তারা প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেনি। সুতরাং কমিউনিস্ট পার্টি বা আমাদের শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল মুখ্যত এককালে যারা আরএসপি করতেন তাদের পক্ষে এ ধরনের নেতৃত্ব দেয়া আদৌ সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছিল মস্কো-পিকিং দ্বন্দ্বের পর। মস্কো কেন্দ্রিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূলধারা বিভক্ত হয়ে যায়। মতানৈক্য দেখা দেয় রণনীতি ও রণকৌশল নিয়ে। আমরা আন্দোলনের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর বললেও মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের কাছে এ আন্দোলনের স্তর ছিল জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর। পিকিংপন্থীদের কাছে ছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর। আমাদের তত্ত্ব অনুযায়ী এই স্তরে জাতীয় বুর্জোয়াদের কোনো ভূমিকাই ছিল না। মস্কোপন্থীদের তত্ত্ব অনুযায়ী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে জাতীয় বুর্জোয়াদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। শ্রমিক শ্রেণির দলের সাথে তাদের নেতৃত্বের ভূমিকা থাকলেও বিপ্লবের নিয়ামক ভূমিকা পালন করে শ্রমিক শ্রেণির দল। অপরদিকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে জাতীয় বুর্জোয়াদের সহযোগী ভূমিকা থাকে গৌণ। মুখ্য ভূমিকা পালন করে শ্রমিক শ্রেণির দল।
এ তিন তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই তিন তত্ত্বের দলগুলো জাতীয় বুর্জোয়াকে আদৌ তেমন দাম দেয়নি। এছাড়া প্রকৃতপক্ষে তকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আকাঙ্ক্ষায় বুর্জোয়া থাকলেও জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল না। তাই বামপন্থীদের কাছে এই শ্রেণিৰু কোনো স্বাধীন-নির্ভর ভূমিকা ছিল না। মনে করা হতো এদের সকল নীতি এবং কৌশলই বিদেশিদের দ্বারা প্রভাবিত। তাই আওয়ামী লীগের ৬ দফাঁকে প্রথমে সিআইএর দলিল বলে সকল বামপন্থী প্রত্যাখ্যান করেছিল।
তবে এরও একটি প্রেক্ষাপট ছিল। এ পটভূমির সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি বড় শক্তিতে পরিণত হয়। ইউরোপের একটি বড় অংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বলয়ে চলে যায়। সৃষ্টি হয় সমাজতান্ত্রিক শিবির। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঔপনিবেশিক কবল থেকে স্বাধীনতা পায়। ১৯৪৯ সালে চীনের বিপ্লব হয়। এক-তৃতীয়াংশ পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক শিবিরে চলে যায়। পৃথিবী দুটি পরস্পর বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক শিবির। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের শিবির। এই দুই শিবিরের সংঘাত ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে। এই সংঘাত বড় যুদ্ধে পরিণত হয়নি। তাই এই সংঘাতের কালটাকে স্নায়ু যুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধের কাল বলে অভিহিত করা হূয়। এই ঠাণ্ডা যুদ্ধের অর্থ হচ্ছে আমরা আমরা এবং তোমরা তোমরা। অর্থাৎ আমরা যদি হই সমাজতন্ত্রী, তাহলে তোমরা সাম্রাজ্যবাদ। আমরা ছাড়া সবাই সাম্রাজ্যবাদী বা সাম্রাজ্যবাদীর এজেন্ট। মাঝখানে কেমনো কিছু নেই।
এই দুই শিবিরের তত্ত্ব শথিবীর দেশে দেশে এক সর্বনাশা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে বিভিন্ন দেশের সাম্রাজ্যবাদীর এজেন্ট বলে অভিহিত করতে থাকে। আর অবশ্যম্ভাবী প্রতিফলন হয় আমাদের দেশে। ৬ দফার মধ্যে আমাদের দেশের মানুষের আশা আকাতার কথা থাকলেও আমাদের দেশের বামপন্থীরা তাকে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর দলির বলে প্রত্যাখ্যান করে।
তবে এখানে একটি ভিন্ন প্রশ্নও ছিল এবং সে প্রশ্নে বামপন্থীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলেই আমার ধারণা। প্রশ্নটি হচ্ছে ৬ দফা আদায় নিয়ে। ৬ দফার শেষ কথা যে স্বাধীনতা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব কে দেবে? পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি বুর্জোয়াদের একটি অসংগঠিত দল আওয়ামী লীগ। এ দল স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেবে, এ বিশ্বাস কোনো বামপন্থীর থাকার কথা নয়। এটাও লক্ষণীয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কোন্দল ছিল। এই সংগঠন নিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন করা যাবে, এ বিশ্বাস কারো থাকার কথা নয়। বামপন্থীদের বিচারে এ ক্ষেত্রে আপোষ অবশ্যম্ভাবী ছিল।
সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবেশেও ভারতবর্ষের নেতারা ব্রিটিশের সাথে আপোষ করেছে। সে ক্ষেত্রে ভারতের কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের শ্রেণিস্বার্থই ছিল মুখ্য। তাদের জনসমর্থন, অভিজ্ঞতা ও আন্দোলনের ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও তারা শুধুমাত্র শ্রেণিস্বার্থে ব্রিটিশের সাথে আপোষ করেছিল। তাদের ভয় ছিল অগ্নিগর্ভ ভারত এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা আসত না, যার কারণে ব্রিটিশের সাথে আপোষ। তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কী হবে। আওয়ামী লীগ বুর্জোয়াদের সংগঠন হিসাবেও কংগ্রেস বা মুসলিম লীগের মতো শক্তিশালী নয়। আওয়ামী লীগও চাইবে না বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসুক। ফলে এই যুদ্ধে আওয়ামী লীগের সহায়ক শক্তি কে হবে? রাজনৈতিক ভুগোলের কারণে ভারত এ যুদ্ধের সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু ভারত একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। ভারত নিশ্চয়ই একটি শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের জন্যে বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতা করবে না। ভারতের সহযোগিতায় যে দেশ স্বাধীন হবে সেই দেশের কাঠামোর সাথে পাকিস্তান নামক দেশটির কাঠামোর সাথে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে এ পরিবর্তন কাদের স্বার্থে? তাহলে নিঃসন্দেহে ভারত বা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ আন্দোলনের বামপন্থীদের সহযোগিতা ভালো চোখে দেখবে না। তাদের খবরদারি কিছুতেই মানবে না।
যদিও ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সহযোগিতা সকলের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। এমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল না। অর্থাৎ সামগ্রিক বিচারে ১৯৭১ সালে পরিস্থিতির কোনো পুরো ছবি বামপন্থীদের চোখের সামনে ছিল না। এ সংগ্রাম কোথায় যাবে কেউ জানে না। কিভাবে হবে তারও কোনো প্রস্তুতি ছিল না। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সকলে পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। সংগ্রামের রূপরেখা জানা থাকলে যে কাজটি আগে করা উচিত ছিল সে কাজটি করা হলো অনেক পরে। অর্থাৎ বামপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্যে আবেদন জানাতে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে পেল অনেক পরে। তখন অনেক জল গড়িয়েছে। আমাদের সংগ্রামের নেতৃত্ব তখন ভারত সরকার তথা মুজিবনগর সরকারের হাতে।
ঐতিহাসিক কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে। সেদিক থেকে বলা যায়, তৎকালীন বামপন্থীদের এর চেয়ে বড় কোনো ভূমিকা পালন করা সম্ভব ছিল না। তবে এ কথা সত্য, যুদ্ধে সাহায্য সহযোগিতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের একটি অংশ আবছা আবছা হলেও কিছুটা ধারণা ছিল। অধুনা তাঁরা বলছেন, শেখ সাহেব নাকি ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের ভারতের সহযোগিতার কথা বলেছেন এবং সেভাবেই তারা কাজ করেছেন। তাঁদের এ ব্যাপারে কোনো সুখ-দুঃখ নেই। যারা এ কথাগুলো বলেছেন তাদের আমি অবিশ্বাস করি না। তবে তারা যেভাবে কথাগুলো বলছেন, তাতে মনে হয় তাঁরা পরিস্থিতিরই সঠিক অনুধাবন করতে পারেননি। অথবা ভেবেছিলেন ভারতের সহযোগিতা ছাড়া আপোষেই সব রফা হয়ে যাবে। নইলে সমগ্র দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে দলে মাত্র কিছু সদস্যকে গোপনে খবরাখবর দিয়ে একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে করা যায় না তা বলাই বাহুল্য। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই যে এটাই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং এ খবরাখবর যারা জানতেন স্বাধীনতার পর তাদের ভূমিকা অন্য সকলের চেয়ে ভিন্নতর ছিল। অন্য কেউ না জানলেও এ মহলটি অন্তত কিছুটা হলেও জানতেন ভবিষ্যৎ সংগ্রামের কথা।
আমার এ পর্যায়ে লেখায় প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে ৭১-এর সংগ্রাম কারা করল? আমি বলেছি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের নেতৃত্বে আগরতলা ষড়যন্ত্র নামক বিদ্রোহ হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এ বিদ্রোহে রাজনীতিকদের কোনো ভূমিকা ছিল না। এ বিদ্রোহকে রাজনৈতিক রূপ দেয়ার জন্যে শেখ সাহেবকে এ বিদ্রোহে জড়িত করেছিল।
আমি বলেছি, রাজনৈতিক স্তরে মওলানা ভাসানী ও শেখ সাহেব শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইলেও পাকিস্তানি কাঠামোতে এর একটা সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন।
আমি বলেছি, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ব্যাখ্যা এবং বাস্তব কারণে তখন বামপন্থীদের এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্বে নেবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
আমি বলেছি, ১৯৬৯-এ অভ্যুত্থানের সময় স্বাধীনতার প্রশ্নটি সামনে আসে। তবে মুখ্যত সে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একটি অংশ।
আমি বলেছি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নির্দেশে চললেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে ছাত্রলীগ যেমন দ্বিধাবিভক্ত ছিল তেমনি দ্বিধাবিভক্ত ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব। ছাত্রলীগের একটি অংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাইলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বাধীনতার দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপন নিয়ে মতানৈক্য হয়। তবুও স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এই স্বাধীনতার ব্যাপারে বারবার শেখ সাহেবের দ্বৈত ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, শেখ সাহেব ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থীদের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে স্বাধীনতার পক্ষে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ যুক্তিযুক্ত মনে করেননি।
উপরের বর্ণিত আমার কথা থেকে আমিই অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়েছি। তাহলে দেশে কী হলো বা কী হতে যাচ্ছে? একটি দেশকে স্বাধীন করা সহজ নয়। একটি দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব হতে পারে। ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম হতে পারে। কিন্তু নতুন মুক্তি সংগ্রাম না করে একটি দেশ ভাগ করে স্বাধীন হওয়ার প্রশ্নটি একান্তই ভিন্নতর। মুক্তি সংগ্রামের শ্রেণি সমন্বয় ও নেতৃত্বের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামের শ্রেণি সমন্বয় নেতৃত্বের ফারাক আসমান-জমিনের। এ ধরনের সংগ্রাম স্লোগান মুক্তির সংগ্রামে পরিণত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এ সংগ্রামে সহযোগিতা করে না। এ সংগ্রামে তাদের নেতৃত্বের প্রশ্নই ওঠে না। অথচ এমন একটি সংগ্রামই ১৯৭১ সালে আমাদের সামনে হাজির হয়েছিল। যে সংগ্রামের আকাক্ষায় শোষণমুক্তির আকাক্ষা আছে। এ সংগ্রামের নেতৃত্ব আদর্শিকভাবে আদৌ শোষণমুক্তির পক্ষে নয়। অথচ একটি সংগ্রাম একান্তই আসন্ন। আমরা সকলেই সংগ্রামের কথা বলছি। ৭ মার্চ শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘোষণা না দেয়ায় তাঁর তীব্র সমালোচনা করছি। আবার সাথে সাথে তত্ত্ব হাজির করছি, শেখ সাহেবের মতো বুর্জোয়া নেতার পক্ষে এ ধরনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া আদৌ সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো আন্দোলনে এ ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অথচ এ রকম বিভ্রান্তির মধ্যেই ২৫ মার্চ এল। আর ২৫ মার্চ পূর্ব পর্যন্ত প্রত্যাশা দেওয়া হলো, যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তান সরকারের সাথে আপোষ রফা হতে পারে।
কিন্তু হলো না। একটা চরম গণহত্যা নেমে এল। লাখো লাখো অপ্রস্তুত মানুষ জীবন দিল। এক সময় আশ্রয়ের আশায় সীমান্ত পাড়ি দিল। তবে নির্জলা সত্য, সীমান্ত পাড়ি দিতে কেউ কাউকে নির্দেশ দেয়নি। অধিকাংশ মানুষ সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিল। আর এক সময় ভারতের সহযোগিতায় যুদ্ধ শুরু করল বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্যে।
এ যুদ্ধের সময় আমিও ভারতে গিয়েছি। বারবার আসা যাওয়া করেছি। আমাদের ছেলেরাও ট্রেনিং নিয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে। যে কথাটি আমি আগে বুঝিনি, ভারতে গিয়ে আমাকে সে কথাটি বুঝতে হয়েছে। ২৫ মার্চের পূর্বে আমার ধারণা ছিল শেখ সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কিছুতেই বাংলাদেশ স্বাধীন করতে পারবে না। কারণ নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী কোনো সংগঠন নয়। অথচ সশস্ত্র সংগ্রাম ব্যতীত বাংলাদেশ স্বাধীন করা সম্ভব নয়। সে সত্য ছিল যখন দিনের সূর্যের মতো স্পষ্ট। ভারতে গিয়ে বুঝলাম আমার ব্যাখ্যা সঠিক হলেও আমি জানতাম না, এ যুদ্ধের আর একটি দিক আছে। সে দিক ভারতের সহযোগিতা। ভারতের সহযোগিতার দিকটি আমার জানা ছিল না। ভারতে গিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেল, এ যুদ্ধের নিয়ামক শক্তি আমরা নই।
আমার ধারণা, এ যুদ্ধ নিয়ে প্রথম দিকে আওয়ামী লীগসহ প্রায় সকল মহলে বিভ্রান্তি ছিল। এ যুদ্ধ করা করবে, কোনো দল কবে। এ যুদ্ধের যে মিত্র তা আদৌ স্থির ছিল না। এপ্রিলে আসতলার পৌঁছে এ বিভ্রান্তির চরম রূপ দেখলাম। ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম রূপ নিয়েছে। ছাত্রলীগ তাজউদ্দিন সরকারকে সমর্থন করছে না। ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি আত্মপ্রকাশ করেছে। মুজাফফর (ন্যাপ) সভা সমাবেশ করছে যুদ্ধের জন্যে যুক্তফ্রন্ট গঠনের দাবিতে। পিকিংপন্থীরা মওলানা ভাসানীকে সামনে রেখে সংগ্রামের জন্যে কমিটি গঠন করেছে। বিপদে পড়েছি আমরা। আমরা পিকিংপন্থী নই, মস্কোপন্থীও নই। নিজেদের লেনিনপন্থী বলে দাবি করি। আমাদের ছেলেরাই বাংলাদেশ সীমান্তে নদীয়ার গেদেতে প্রথম মুক্তিবাহিনী শিবির স্থাপন করে। আমাদের শিবির জেনারেল ওসমানী ও তাজউদ্দীন পরিদর্শন করেন। কিন্তু আমাদের সাথে ভারতের আরএসপির সম্পর্ক থাকায় মুজিবনগর সরকার ওই শিবিরে সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করে। তখন আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এ যুদ্ধ কোথায় যাচ্ছে এবং কাদের নেতৃত্বে শেষ হচ্ছে! শেষ পর্যন্ত সমস্যার জোড়াতালি দিয়ে এক সমাধান করা হয়। মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। সেই পরিষদে স্থান হয় কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর এবং মওলানা ভাসানীর অর্থাৎ দেখাবার চেষ্টা করা হয়, সর্বদলীয় এবং জাতীয় ভিত্তিতে এ যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে এবং এই পরিবেশে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়।
আমি বাড়ি ফিরলাম ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ১০ জানুয়ারি শেখ সাহেব ফিরলেন। ছাত্রলীগে তখন বিতর্ক তুঙ্গে। বাংলাদেশে তখন একটি নতুন শ্লোগান শোনা গেলো। শ্লোগানটি হচ্ছে–বিশে এসেছে নতুনবাদ, মুজিববাদ, মুজিববাদ। খোন্দকার ইলিয়াস মুজিববাদ সম্পর্কে একটি বই লিখে ফেললেন। বইয়ের দাম ৩০ টাকা। মুজিববাদের স্লোগান শুনে আমার যেন চমক ভাঙল। এ ধরনের রাজনৈতিক আদর্শের কথা পৃথিবীর কোনো অভিধানে নেই। ছাত্রলীগের যে অংশটি এই শ্লোগান দিল তারা গণতান্ত্রিক সমাজবাদে বিশ্বাসী বলে জানতাম। তত্ত্বের দিক থেকে বিশ্ব প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত বলে জানি। একটি পুঁজিবাদ অপরটি সমাজবাদ। তবে সমাজতন্ত্র লক্ষ্য হলেও সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার পথ নিয়ে অনেক বিভক্তি আছে। মোটামুটিভাবে যারা গণতান্ত্রিক উপায়ে সংসদের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের গণতান্ত্রিক সমাজবাদী বলে অভিহিত করা হয়। যেমন ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের শ্রমিক দল বা ভারতের এক সময় জয় প্রকাশের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দল। সতন্ত্রে বিশ্বাসী অপর অংশটি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রযন্ত্র চূর্ণ করতে না পারলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বিশ্বাস ও আদর্শের জগতে এ পরিস্থিতিতে মুজিববাদের স্লোগান আমাকে কৌতূহলী করে তুলল। অন্তত আমার মনে হলো ৭১-এ সংগ্রামের মধ্যে একটি স্রোত অন্তত ছিল যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছে। স্বাধীনতা চেয়ে এবং শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্বতন্ত্র প্রমাণের জন্যে মুজিববাদের কথা বলেছে। কী বা কেন সেই মুজিববাদ আমার ধারণা শেখ সাহেব এ মুজিববাদ সম্পর্কে তেমন অবহিত ছিলেন না। এখানটাই ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের আর এক সঙ্কট।
এ পরিস্থিতিতে সকলে চমকে গিয়েছিল–১৯৭১ সালের ১ মার্চ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সেই দিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল আদৌ এ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারেনি। ফলে ১ মার্চের পর নাম পাল্টাবার হিড়িক পড়ে যায়। দলের নামের পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি তুলে বাংলাদেশ বসানো হলো। শুধু আমাদের তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। আমাদের দলের নাম ছিল শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল। দল গঠনকালে আমরা পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিলাম। দাবি করেছিলাম পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশের স্বাধীন স্বত্ব স্বীকার করে নিয়ে একটি কনফেডারেশনে রূপান্তর করা। কিন্তু সে আন্দোলন গড়ে তোলার আগেই একাত্তরের সংগ্রাম এসে গেল। অন্য সকলের মতোই সে যুদ্ধে আমরা জড়িয়ে পড়লাম। যুদ্ধ সম্পর্কে নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ইতোপূর্বে সে ইতিহাস আমি লিখেছি। আমার সুস্পষ্ট ধারণা হচ্ছে, কেউ কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই এ যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কোনো দলের কোনো স্থির সিদ্ধান্ত ছিল না। ব্যক্তি হিসেবে অনেকের বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষা ছিল। গোষ্ঠী হিসেবে কেউ কেউ হয়তো কাজ করেছে। কিন্তু কোনো দল সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে রণকৌশল কিংবা রণনীতি নির্ধারণ করে এ সংগ্রামে যোগ দেয়নি। দেশকে স্বাধীন করার আকাক্ষা থাকতেও কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগ্রামে নামেনি বা এ সংগ্রাম সংগঠিত করেনি।
কলকাতায় গিয়ে শুনেছি-স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে ভাবছেন। অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে কমিটিও গঠন করেছিল। কিন্তু সে হচ্ছে অনেক পরের কথা। তাই সুস্পষ্ট করে বলা যায়, নেতা থেকে কর্মী পর্যন্ত সকল মহলকেই ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি হামলা আমাদের এ যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। সবাই স্বাধীনতা যুদ্ধটাকে একটি শ্লোগান বা কথার কথা বলে মনে করেছিল। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতার সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি না থাকার জন্যেই ২৫ মার্চের রাতে অসংখ্য মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
এ পরিস্থিতিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ কয়েক মাস পর মুজিববাদ শ্লোগানটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ শ্লোগান ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের এককালীন প্রভাবশালী নেতা শেখ ফজলুল হক মনি তখন দৈনিক বাংলার বাণীর সম্পাদক। তিনি বাংলার বাণীতে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই। তার এ লেখার তীব্র বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল ভিন্ন কথা। আমার মনে হচ্ছিল ছাত্রলীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছে। দর্শনের জগতে সমাজ পরিবর্তনের জন্যে দুটি তত্ত্বই প্রচলিত ছিল। একটি হচ্ছে পুঁজিবাদ অপরটি সমাজবাদ। পুঁজিবাদী সমাজে মুক্তি নেই। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের সংগ্রামে একটি মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ছিল। সে আকাক্ষা শুধুমাত্র পাকিস্তান থেকে বন্ধন মুক্তির আকাক্ষা নয়, শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষাও। সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের সংগ্রামে সেই স্বপ্ন দেখেছিল। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হয়। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের শ্রেণি চরিত্রের পরিপন্থী। ফলে অবস্থাটা দাঁড়াল এমন যে শোষণমুক্তির কথা বলতে হবে আবার সমাজতন্ত্রের কথা বলা যাবে না। আমার ধারণা এ পরিস্থিতিতে জোড়াতালি দেয়ার জন্যে মুজিববাদের কথা বলা হয়েছিল। রাজনৈতিক বিচারে প্রথম দিকে মুজিববাদ ছিল গণতান্ত্রিক সমাজবাদেরই আর এক সংস্করণ। অর্থাৎ আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলব কিন্তু বৈপ্লবিক সমাজ পরিবর্তনের কথা বলব না। সমাজ যেমন আছে তেমনই থাকবে। যদিও পরবর্তীকালে মুজিববাদ উচ্চারিত হয়নি। সংবিধানে সমাজতন্ত্র সমাজ পরিবর্তনের সমাজতন্ত্র নয়। এ সমাজতন্ত্র ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোটি কোটি মানুষকে ভাওতা দেয়ার জন্যে এবং সমাজতন্ত্রের নামে স্বপ্ন দেখাবার লক্ষ্যে।
তবুও আমার মনে হয়েছে–যে গ্রুপের পক্ষ থেকেই এ শ্লোগান দেয়া হোক না কেন, তাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে দীর্ঘদিনের সংযোগ ছিল। তাদের কেউ এ ব্যাপারে ভেবেছে। স্লোগান দিয়েছে। গল্প, কবিতা লিখেছে। মিছিল করেছে। এবং বালকসুলভ চপলতায় কখনো এ সংগ্রামের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। নির্ণয় করতে পারেনি স্বাধীনতা সংগ্রামের শত্রু ও মিত্র। তারা ভাবতেই চায়নি, জাতিসংঘের জন্মের পর বিপ্লবাত্মক রাজনীতি ছাড়া আলাপ-আলোচনা ও নির্বাচনের রাজনীতি দিয়ে একটি দেশ স্বাধীন করা যায় না এবং সে ক্ষেত্রেও পরাশক্তিকে উপেক্ষা করা যায় না।
এছাড়া ওলন্দাজের হাত থেকে ইন্দোনেশিয়ার মুক্তি কিংবা ফরাসির কবর থেকে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যে সহজে আসেনি একথা মেধা ও বুদ্ধিসম্পন্ন নেতাদের বোঝানোর প্রয়োজন যে হয় না তা বলাই বাহুল্য। অথচ সবকিছু জেনে শুনেই সেকালের নেতৃত্ব আলোচনা ও কথার মারপ্যাঁচে একটি দেশ স্বাধীন করার চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টার রূপরেখা বা পরিণতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগসহ কোনো দলেরই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না। একটি মাত্র সংগঠনের মুজিববাদ ও পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের শ্লোগান ছাড়া কেউ দাবিও করতে পারেন না, পঁচিশে মার্চের আগে দলগতভাবে আমরা দেশ স্বাধীন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করেছিলাম। নেতা ও কর্মীদের সচেতন করেছিলাম। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহণের মানসিকতা গঠন করেছিলাম। অর্থাৎ সব মিলিয়ে বলা যায় ২৫ মার্চের হামলার পূর্বে কোনোদল বা কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, আমরা এ সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত করব। এ সংগ্রাম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ সংগ্রাম, ইতিহাসে তেমন কোনো স্বাক্ষর নেই বলে আমার দৃঢ় ধারণা।
জানি আমার এ বক্তব্যে অনেকে একমত হবেন না। আমার তীব্র সমালোচনা করবেন। আমি তাই এ প্রশ্নটি ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যেতে চাই। উৎসাহী গবেষকদের জন্যে এ প্রশ্নটি উত্থাপন করলাম। যারা প্রতিদিন ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে বলে শোরগোল করছেন তাঁদের বলব আমার এ কথাগুলো ভেবে দেখুন। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই ২৫ মার্চের ঘটনার পূর্বে হয়তো তাত্ত্বিকভাবে অনেকে বলেছেন, এবারই দেশ স্বাধীন হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু তবুও কেউ বা কোনো দলও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হলে জনসাধারণের সবকিছু জানা থাকলে ন্যূনতম প্রস্তুতি থাকলেও স্বাধীনতার ২৭ বছর পরে আজো গ্রামবাংলায় ৭১ সালকে হিড়িক বা গণ্ডগোলের বছর বলা হতো না।
এবার ভিন্ন আলোচনায় আসা যাক। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অন্যান্য সমস্যার মতো সাংবাদিকদেরও এক নতুন সমস্যায় পড়তে হয়। সেকালে জামাতে ইসলামের মুখপত্র সংগ্রাম’ ব্যতীত কোনো পত্রিকাই পাকিস্তান সরকারকে সমর্থন দেয়নি। এমনকি পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্ট পরিচালিত দৈনিক পাকিস্তান বা মর্নিং নিউজের অধিকাংশ বাঙালি সাংবাদিক কর্মচারী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলার সুযোগ ছিল না। অনেকেই সংগ্রামের ৯ মাস কাজে আসেনি। অনেকে সীমান্তের ওপারে গিয়েছে। আবার অনেকে দেশে থেকেছে। কিন্তু কাজে যোগ দেয়নি।
সেকালে পাকিস্তানে একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল সাংবাদিকদের। সংগঠনের নাম পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন। সেকালের পূর্ব পাকিস্তানে তার দুটি অঙ্গসংগঠন ছিল। একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন। অপরটি চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউনিয়নে সমস্যা দেখা দিলো। পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন থাকল না। আমি ভারত থেকে ঢাকা ফিরতে ফিরতে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের নাম বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়ন হয়ে গেল। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আলী আশরাফ বাংলাদেশ সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হলেন। পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক গিয়াস কামাল চৌধুরী হলেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। কারণ সাধারণ সম্পাদক কামাল লোহানী যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সুবাদে তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ বেতারে চলে গেলেন। এ সময় আমি ঢাকায় ফিরে দেখলাম এক ভিন্ন অবস্থা। আনুষ্ঠানিকভাবে আমি ইউনিয়নের কোনো নেতৃত্বের পদে ছিলাম না। তবুও স্বাধীনতার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলীয় রাজনীতি থেকে সাংবাদিক ইউনিয়ন করাই আমার কাছে মুখ্য হয়ে উঠল। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পত্রিকার জগতে বেসামাল অবস্থা। পত্রিকা বলতে ছিল দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক আজাদ, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পাসবান, দৈনিক মর্নিং নিউজ, দি পিপলস ও দৈনিক পয়গাম।
২৫ মার্চের হামলা শুরুর পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী দৈনিক ইত্তেফাক, দি পিপলস ও দৈনিক সংবাদ পুড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে ইত্তেফাক সামরিক সরকারের সহযোগিতা নিয়ে যুদ্ধের ৯ মাসের মধ্যেই প্রকাশিত হয়। সংবাদ, দি পিপলস যুদ্ধকালে আর বের হয়নি। পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ ওই ৯ মাসে চালু ছিল। অবজারভার ও পূর্বদেশের মালিক হামিদুল হক চৌধুরী ও আজাদের মালিক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে। পাসবান উর্দু দৈনিক। দৈনিক পয়গাম তৎকালীন গভর্নর মোনেম খানের মালিকানায়। তাই পত্রিকাও চালু ছিল। তবে এই বন্ধ ও ভোলা থাকার ভিত্তিতে তৎকালে এ পত্রিকা সাংবাদিক কর্মচারীদের সেকালের ভূমিকা ব্যাখ্যা করা যায় না। চাকরি করতে গিয়ে মারা পড়েছেন ইত্তেফাকের সিরাজউদ্দিন হোসেন। মর্নিং নিউজের আবুল বাশার, পূর্বদেশের আনম গোলাম মুস্তফা। অবজারভারের লাডু ভাই। চাকরি না করে মারা গেছেন সংবাদের শহীদুল্লাহ কায়সার। ফলে দেশ স্বাধীন হবার পর সংবাদপত্র জগত ছিল এক শোকের জগত-বিদ্বেষের জগত, অনিশ্চিত জগত। কী হবে পত্রিকা জগতে কারো জানা ছিল না।
আমি দেশে ফিরতে ফিরতে কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভারের শক্তিশালী ইউনিয়ন থাকায় তেমন অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তান অবজারভার নাম পরিবর্তন করেছে। নেতৃত্বে এসেছে পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি খোন্দকার গোলাম মুস্তফা। সম্পাদক হিসেবে এসেছেন আবদুস সালাম। নতুন নাম হয়েছে বাংলাদেশ অবজারভার। দৈনিক পাকিস্তান নাম নিয়েছিল দৈনিক বাংলাদেশ। প্রতিবাদ এলো বগুড়া থেকে। বগুড়ায় দেশ স্বাধীন হবার পূর্বেই এ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা ছিল। তাই দৈনিক বাংলাদেশ-এর পরিবর্তে দৈনিক পাকিস্তান হলো দৈনিক বাংলা। সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে সরিয়ে দেয়া হলো। প্রধান সম্পাদক হলেন হাসান হাফিজুর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক হলেন তোয়াব খান। তবে প্রথমে তোয়াব খানই সম্পাদক হয়েছিলেন। মর্নিং নিউজ থেকে গেল। আজাদ পয়গাম-এ প্রকাশক দেয়া হলো। পয়গামের নাম হলো স্বদেশ।
আমি কখনো তেমনভাবে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছিলাম না। কখনো কখনো ইউনিয়নের সহসভাপতি কিংবা কোষাধ্যক্ষ ছিলাম। ১৯৬২ সালে জেলখানা থেকে বেরুবার পর বরাবরই আমি নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলাম। আমি বারবার নির্বাচিত হতাম। কিন্তু কোনো দলে কোনো প্যানেলে সদস্য ছিলাম না। আমি স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবেই দাঁড়াতাম। তবে দীর্ঘদিন কোষাধ্যক্ষের পদে থাকায় এই পদটিতে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না।
এককালে সাংবাদিক ইউনিয়নে তেমন নির্বাচন হতো না। পত্রিকার সংখ্যা ছিল কম। সদস্য সংখ্যাও তেমন নয়। সর্বজনীন ভোটাধিকারও ছিল না। বিভিন্ন ইউনিট থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করত। পরবর্তীকালে সে পদ্ধতির পরিবর্তন হয়। সর্বজনীন ভোটে নির্বাচনের পদ্ধতি চালু হয়। শুধুমাত্র ফেডারেল ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচন হওয়ার পদ্ধতি বহাল থাকে।
ইউনিয়নের প্রথম দিকে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো না। সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। তাদের প্যানেলই জয় লাভ করতো। কখনো কখনো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হয়ে যেতো।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে মস্কো বনাম পিকিং দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সাংবাদিক ইউনিয়নেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। জামাতে ইসলামের পত্রিকা দৈনিক
সংগ্রাম আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া সেকালে কিছু ছিল সরকারপন্থী এবং মালিকপন্থী সাংবাদিক। ফলে ষাটের দশকের শেষ দিকে ইউনিয়নের নির্বাচনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন হয়। নির্বাচনে আলী আশরাফ সভাপতি ও কামাল লোহানী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আমি নির্বাহী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হই।
ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত নেতা ছিলেন খোন্দকার গোলাম মুস্তফা, সিরাজউদ্দীন হোসেন, খন্দকার আবু তালেব, আতাউস সামাদ, এবিএম মুসা নেতৃত্বে থাকলেও ইউনিয়নের চেয়ে তারা প্রেস ক্লাবকেই বেশি পছন্দ করতেন।
একাত্তরের সংগ্রামে সব চিত্র পাল্টে গেল। সিরাজউদ্দীন হোসেন নেই, খন্দকার আবু তালেব নেই, শহীদুল্লাহ কায়সার নেই, আতাউস সামাদ আছেন তবে তাঁর নেতৃত্ব নিতে অনীহা। খোন্দকার গোলাম মুস্তফা কেন্দ্রীয় ইউনিয়নের নেতা হিসেবে ইউনিয়নকে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু এই ইউনিয়নে তাঁর পক্ষে আসা তখন সম্ভব ছিল না। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি চাচ্ছিলেন কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত হতে। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি চাকরিতে যাবার আগে যতদূর সম্ভব ইউনিয়নকে চালু রাখতে সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। অর্থাৎ দেখা গেল দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইউনিয়নের পূর্বতন নেতৃত্বের কেউই আর নেই। এর মধ্যে আর একটি কাণ্ড ঘটালেন ইউনিয়নের সভাপতি আলী আশরাফ। সরকার তাঁকে দৈনিক বাংলার প্রশাসক নিযুক্ত করলেন। একজন প্রশাসক ইউনিয়নের সদস্য হতে পারেন না। ফলে ইউনিয়নের সদস্যপদ থেকে তাঁকে সরে দাঁড়াতে হলো। ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন সহসভাপতি গিয়াস উদ্দীন আহম্মদ। তিনি অবজারভারের রিডিং সেকশনে ছিলেন। অর্থাৎ ইউনিয়নেরই খোল-নলচে পাল্টে গেলো। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দু’জনেই ভারপ্রাপ্ত। আর এ ভারপ্রাপ্তের খেলায় আমি যে কী করে ঢুকেছিলাম সে কথা এখন আর আমার মনে নেই। তবে সব দায়িত্ব যেন আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। হয়তো বা কারো ধারণা থাকতে পারে, আমি গোপালগঞ্জের অধিবাসী বলে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি লোক হব এবং আমাকে সামনে নিয়ে এগোলে লাভ হবে। সেই লাভ-লোকসানের হিসাব মিলল না রাজনীতি করা নির্মল সেন-এর বেলায়।
বন্ধু আহমেদুর রহমান তখন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। ভীমরুল ছদ্মনামে কলাম লিখতেন ইত্তেফাকে। তাঁর কলাম মিঠেকড়া সেকালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। শেষ পর্যন্ত তার অনুরোধেই ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হয়েছিলাম। তবে জেলে যাওয়া ঠেকানো যায়নি। আমি ইত্তেফাকে যোগদানের এক সপ্তাহের মধ্যে ইত্তেফাকের সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া গ্রেফতার হয়ে যান। আমি জেলে যাই এক মাস পর।
বছর তিনেক পর জেলখানা থেকে এসে ইত্তেফাকের মাসিক একশ’ টাকার চাকরিটা আর হয়নি। দৈনিক জেহাদে চাকরি দিয়েছিলেন মোজাম্মেল হক। সেই জেহাদও বন্ধ হয়ে গেলো ১৯৬৩ সালে। শেখ সাহেবের অনুরোধে যোগ দিয়েছিলাম সোনার বাংলায়। সোনার বাংলা থেকে মোজাম্মেল দা টেনে এনেছিলেন দৈনিক পাকিস্তানে। তবে সে চাকরির পটভূমি আরো বড়। ইতোপূর্বে সে কথা আমি লিখেছি।
সেই দৈনিক পাকিস্তানে একাত্তরের ৯ মাস আমি চাকরি করিনি। যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে দেখলাম আমার চাকরিটি নেই। অর্থাৎ আমার শূন্য পদে ইতিমধ্যে লোক নেয়া হয়ে গেছে। এ সময় দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক সানাউল্লা নূরী, নতুন পত্রিকা দৈনিক গণবাংলার সম্পাদক হয়ে গেলেন। ওই শূন্য পদে দৈনিক বাংলায় আমি সহকারী সম্পাদক রূপে চাকরি পেলাম। এই ধারাবাহিক চাকরির সুবাদে আমার রাজনৈতিক পরিচয়টা যেন স্মৃতির আড়ালে চলে গেল। বড়ো হয়ে দেখা দিল সাংবাদিক পরিচয়। তখন অনিকেত ছনামে দৈনিক বাংলায় আমি কলাম লিখতাম। এ কলাম লেখাও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে আমাকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। একটি দেশ স্বাধীন হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের কথা বলা হচ্ছে। বেসরকারি খাতের হাল কী হবে কেউ জানে না। ইতোমধ্যে গোটা পাঁচ ছয়েক পত্রিকা এবং দুটি সংবাদ সংস্থার দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত হয়েছে। পত্রিকা কয়টি হচ্ছে বাংলাদেশ অবজারভার, পূর্বদেশ, দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ, দৈনিক স্বদেশ ও আজাদ। সংবাদ সংস্থা হচ্ছে এপিপি ও পিপিআই। এপিপি অর্থাৎ অ্যাসোসিয়েট অব প্রেস পাকিস্তান আর পিপিআই হচ্ছে পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল। এ ছয়টি পত্রিকা এবং দুটি সংবাদ সংস্থার মূল মালিক নেই। অপরদিকে উর্দু দৈনিক পাসবান বন্ধ হয়ে গেছে। পাসবান অফিস দৈনিক বাংলার বাণী অফিসে পরিণত হয়েছে। আর এ সময় অনিবার্য কারণে সাংবাদিক ইউনিয়নের পুরনো নেতাদের মধ্যে কেউই নেই।
বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম যে, আমার বন্ধুরা ভেবেই নিয়েছেন যে দেশে একটি সমাজতান্ত্রিক কাঠামো হতে যাচ্ছে। তাই তাদের প্রস্তাব হচ্ছে দেশের সকল সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থাগুলোকে সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত করা হোক। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এমন কি ইত্তেফাক, সংবাদ, বাংলার বাণীও শ্রমিক সমবায়ের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলা হয়।
আমার ধারণা একটি ভিন্ন বিবেচনা থেকেও সাংবাদিক ইউনিয়ন এ প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। বিবেচনাটি হচ্ছে তাদের চাকরির শর্ত এবং মালিকদের সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা। পৃথিবীর এই এলাকায় শিল্প হিসেবে সংবাদপত্র গড়ে ওঠেনি। কেউ রাজনৈতিক লক্ষ্যে এবং সেই অর্থে ব্যবসায়িক স্বার্থে পত্রিকা বের করেছে। একমাত্র আজাদ ও মর্নিং নিউজই পাকিস্তান সৃষ্টির আগে জন্ম নিয়েছে। এদের একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। ইত্তেফাক, সংবাদও রাজনৈতিক বিবেচনায়ই জন্ম নিয়েছিল। অবজারভার, পূর্বদেশ হামিদুল হক চৌধুরী তার ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যেই প্রকাশ করেছিলেন। এর কোনো পত্রিকায়ই সাংবাদিক ও কর্মচারিরা বেঁচে থাকার মতো বেতন পেত না। এই পটভূমিতে পাকিস্তান সরকার একটি বেতন বোর্ড গঠন করেছিল। এই বেতন বোর্ডের সুপারিশ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় কোনো সংবাদপত্রেই এই বেতন বোর্ডের সুপারিশ কার্যকর করা হলো না। এই নিয়ে বারবার তাদের আন্দোলন করতে হয়েছে। তখন অধিকাংশ সাংবাদিক কর্মচারীর বেতন ছিল ৫০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে। সেই বেতনও নিয়মিত দেয়া হতো না। ৪/৫ কিস্তিতে এক মাসের বেতন নিতে হতো। সাংবাদিক শব্দটি ছাড়া এ পেশায় তেমন মর্যাদা ছিল না। আমিও ১৯৫৯ সালে ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম ১০০ টাকা বেতনে।
১৯৬১ সালে বেতন বোর্ড সুপারিশের পর কিছুটা পরিবর্তন দেখা দেয়। নতুন পত্রিকাগুলো বেতন বোর্ডের রোয়েদাদ অনুযায়ী বেতন দিতে শুরু করে। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত দৈনিক জেহাদ বা ৬৪ সালে প্রকাশিত দৈনিক পাকিস্তান বেতন বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন দিতে শুরু করে। তবুও সংবাদ আজাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এর মধ্যে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে নতুন বেতন বোর্ড গঠনের দাবি উঠতে থাকে। বলা হয় যে, ১৯৬১ সালে প্রণীত বেতন বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী নির্ধারিত বেতনে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাই নতুন বেতন বোর্ড ও নতুন বেতন কাঠামো চাই। ১৯৬১ সালে প্রথম বেতন বোর্ডের সুপারিশে ৫ বছর পর নতুন বেতন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের কোনোই উদ্যোগ ছিল না। ফলে পাকিস্তানব্যাপী আন্দোলন হয় এবং আমার যতদূর মনে আছে ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সরকার দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠন করে। নতুন নতুন বোর্ডের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের অন্তর্বর্তীকালীন ভাতা মঞ্জুর করা হয়। কিন্তু কোনো মালিকই সেকালে এই ভাতা দিতে রাজি হয়নি। ফলে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে সাংবাদিকদের এই অন্তর্বর্তীকালীন ভাতার জন্যেই দীর্ঘদিনের জন্যে ধর্মঘটে যেতে হয়। সেই ধর্মঘটের অবসান হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বেতন বোর্ডের সুপারিশ তো দূরের কথা, প্রথম বেতন বোর্ডের সুপারিশও তখন কোনো কোনো পত্রিকায় কার্যকর হয়নি। এর মধ্যে স্বাধীনতার সংগ্রাম এগিয়ে আসে। দেশ স্বাধীন হয়। দুটি সংবাদ সংস্থা ও ৬টি পত্রিকা মালিকবিহীন হয়ে যায় এবং স্বাভাবিকভাবে সাংবাদিক ও কর্মচারীর মধ্যে ভয় ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে ভবিষ্যতের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা ছিল না। এদের মধ্যে দৈনিক বাংলা, মর্নিং নিউজ প্রেস ট্রাস্টের কাগজ ছিল। ফলে এ দুটি পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মচারীর বেতনের কোনো অসুবিধা হয়নি। পূর্বদেশ ও অবজারভারের অর্থনৈতিক কাঠামো মজবুত ছিল। ফলে সেখানেও বেতন হয়েছে। এপিপি-এর পরিবর্তিত নাম বিএসএস। পাকিস্তান আমলে, এপিপি সরকারি সংস্থা ছিল। সেই সুবাদে বিএসএস-এর সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতনের একটি হিল্লে হয়ে যায়। কিন্তু আজাদ, স্বদেশ এবং পিপিআই ছিল বেসরকারি মালিকানায়। এখানে কোনোদিনই সাংবাদিক কর্মচারীদের বেতনের নিশ্চয়তা ছিল না। তাই এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বেতন হচ্ছিল না। সে এক অস্বস্তিকর ও দুঃখজনক পরিস্থিতি।
এ অবস্থায় আমি দেশে ফিরেছি এবং আমার মনে হয়েছে এ তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই ইউনিয়নের পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে সমস্ত সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থা সমবায়ী মালিকানায় নেয়ার জন্যে। আমি দেশে ফিরে আর একটি ঘটনাও লক্ষ করলাম। লক্ষ করলাম যে শুধুমাত্র সাংবাদিক ইউনিয়ন নয়। সংবাদপত্রের শিল্পের সাথে জড়িত তিনটি ইউনিয়ন যৌথভাবেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই তিনটি ইউনিয়নের যৌথভাবে বসে আন্দোলনের একটি পটভূমি আছে। এ নিয়ে এখন অনেক বিতর্ক আছে। অনেক সময় এ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু আমি। বিতর্ক হচ্ছে সংবাদপত্রের সকল কর্মচারীদের জন্য একই বেতন বোর্ড গঠন এবং সংবাদপত্রের সংশোধনী বিভাগের অর্থাৎ প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক করা নিয়ে। আমার অনেক বন্ধুরা বলে থাকেন এ জন্য নাকি আমিই দায়ী। পৃথিবীর কোনো দেশেই নাকি প্রুফ রিডাররা সাংবাদিক নন এবং সংবাদপত্রের সকল কর্মচারীদের জন্যে একটি মাত্র বেতন বোর্ড নেই। সর্বত্রই সাংবাদিকদের জন্যে পৃথক বেতন বোর্ড। এ ক্ষেত্রে আমি বিতর্কে যাব না। শুধু সেকালের কিছু ঘটনা তুলে ধরব। ষাটের দশকের কথা। আমি তখন জেলে। সাংবাদিক ইউনিয়ন সম্পর্কে তখন আমার বেশি কিছু জানা নেই। জেলের বাইরে এসে শুনলাম আমাদের ইউনিয়নে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক করা হয়েছে। অনেকে মনে করেন তৎকালীন ইউনিয়ন নির্বাচনে জিতবার জন্য প্রুফ রিডারদের সদস্যপদ দিয়েছেন। আমি কোনো দিন এ বিতর্কে যাইনি। লক্ষ্য করলাম এ ব্যাপারে তীব্র মতানৈক্য আছে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক করা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। পশ্চিম পাকিস্তানে সাংবাদিক নে বৃন্দ উর্দু পত্রিকার প্রুফ রিডারদের সাংবাদিক বলে গণ্য করতে রাজি নয়। তাই পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের দুই অংশে দুই রীতি চালু আছে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রুফ রিডাররা সাংবাদিক কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে প্রুফ রিডার সাংবাদিক নয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কোনো মীমাংসাই হয়নি। পাকিস্তান ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সর্বশেষ বৈঠক বসেছিল ১৯৬৯ সালে ইসলামাবাদে। ওই বৈঠকে কে জি মুস্তফা সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন মিনজাহ বার্না। ওই সম্মেলনে এই সঙ্কট সমাধানের জন্যে আমি একটি প্রস্তাব তুলেছিলাম। আমাকে সমর্থন করেছিলেন কে জি মুস্তফা। পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়। তাঁদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ব্যাপারে তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাঁদের আরো এক বছর সময় দেয়া হোক। সে সময় অতিবাহিত হওয়ার আগেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সুতরাং প্রুফ রিডাররা পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিক এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সাংবাদিক নয় এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন হয়েছে। সে নির্বাচনে প্রুফ রিডাররা সাংবাদিক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছে। তাই তাদের বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। পরবর্তীকালেও বারবার এ প্রশ্নে আমাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। অথচ ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু করার ছিল না।
এবার আমি দ্বিতীয় প্রশ্নের জবাব দিতে চাই। বলা হয়ে থাকে ১৯৬১ সালে প্রথম বেতন বোর্ড শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্যে হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্যে পাকিস্তানের দ্বিতীয় বেতন বোর্ড আমাদের জন্যে কার্যকর ছিল না। ফলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বেতন বোর্ড গঠনের দাবি ওঠে। উল্লেখ্য, প্রথম বেতন বোর্ডে প্রেস শ্রমিক ও সাধারণ কর্মচারীদের সম্পর্কে কোনো সুপারিশ ছিল না। ফলে তারা ছিল সব ব্যাপারে বঞ্চিত। অথচ এ কথা সত্য, বিশেষ করে প্রেস শ্রমিকদের সহযোগিতা ছাড়া অন্তত সংবাদপত্রে ধর্মঘট করা যায় না। তারা মালিকদের সাথে সহযোগিতা করলে মালিকরা পত্রিকা বের করতে পারে। এ তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন ভাতার আন্দোলন নিয়ে। আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছিল যে তাদের সাথে সহযোগিতা না করলে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করা যাবে না। তাই ১৯৭০ সালে অন্তর্বর্তীকালীন ভাতা আন্দোলনের সময় আমার পূর্বসূরি সেকালের ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে দ্বিতীয় বেতন বোর্ড হবে সংবাদপত্রের সম্পাদক থেকে দারোয়ান পর্যন্ত সকল শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে। সাংবাদিকদের জন্যে পৃথক বেতন বোর্ড হবে না। ১৯৭২ সালে আমি যখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের এবং ১৯৭৩ সালে আমি ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হই তখন আমার ওপরই ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবি বর্তায়। তবে সে ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। স্বয়ং সেকালের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের ভিন্ন কথা বলেছিলেন। সে কথায় আমি পরে আসব।
সংবাদপত্র জগতে কী হবে আমাদের ঠিক মাথায় আসছিল না। আমি বার বার লিখেছি–তখন সবকিছু আমার গোলেমেলে মনে হতো। স্বাধীনতার পরবর্তীকালটা কোনো ব্যাখ্যা দিয়ে আমি মেলাতে পারতাম না। তখন আমার মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক সহযোগী আমার সাথে থাকত। তার বাড়ি ভোলা। দৈনিক পূর্বদেশে চাকরি করতো। তার অসীম সাহস। বারবার আমার সাথে সীমান্ত পারাপার করেছে। আমাকে সব সময় সতর্ক পাহারায় রেখেছে। তার সে ভূমিকা ভুলবার নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে পূর্ব দেশেই চাকরি পেয়েছিল। চাকরির পূর্বে বহু চেষ্টা করেও সে প্রবেশিকা পরীক্ষার চৌকাঠ পার হতে পারেনি।
একদিন সে রাতে আমার কক্ষে এল। বলল–স্যার, আমি যদি ম্যাট্রিকে প্রথম হই তাহলে কি সংবাদপত্রে আমার ছবি ছাপা হবে? সাংবাদিকরা কি আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসবে? তার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী করে তুই পরীক্ষা দিলি? তুই আমার বাসায় থাকিস অথচ আমি জানি না যে তুই ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। সে হেসে ফেলল। বলল–স্যার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছি। পরীক্ষা দেবে দু’জনে। দুটি অ্যাডমিট কার্ড জোগাড় করেছি। একটি আমার নামে, অপরটি আমার বন্ধুর নামে। আমার বন্ধু বিএ পাস। পরীক্ষার হলে সে আমার খাতায় লিখবে আর আমি তার খাতায় লিখব। তাই আমার ভয় হচ্ছে আমার বন্ধু আমার বদলে পরীক্ষা দিলে সে নিশ্চয়ই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবে। কিন্তু সকলে জানবে যে আমি প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছি। তখন আমি বিপদে পড়ে যাব। তখন সাংবাদিকরা আমার খোঁজে আপনার বাসায় আসবে। আপনার সুবাদে সকলেই আমাকে চেনে। আমরা দু’জনেই বিপদে পড়ে যাব। তার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ কী কথা আমি শুনছি। ছেলেটি কী বলছে। এই ছেলেটি একাত্তর সালের ন’মাস আমাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছে। সামরিক বাহিনীর হাতে পড়ে পালিয়ে এসেছে। আমার জন্য সব কিছু করেছে। ঢাকার বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে আমার জন্য টাকা সংগ্রহ করেছে। ভিন্ন নামে পত্রিকা বের করেছে। আমি কখনও ওর চোখেমুখে মৃত্যুর ভয় দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের কালের সেই ছেলে এখন অবৈধভাবে পরীক্ষায় পাস করতে চাচ্ছে? আমার বাসায় থাকে অথচ ঘৃণাক্ষরে আমি কিছু জানতে পারিনি। তাহলে এ ছেলে মুক্তিযুদ্ধে কেন গিয়েছিল? কোন লক্ষ্যে? কোন আশায়? সে কোন স্বপ্ন দেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে? কথাগুলো আমি বারবার বলতে চেষ্টা করেছি আমার পূর্বের লেখায়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ এদের কাছে ছিল সাময়িক উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা কেটে গেছে। তারা আবার পূর্ব জীবনে ফিরে গেছে। ওদের আমরা আদর্শ দিতে পারিনি। ওদের অনুপ্রাণিত করতে পারিনি। সামরিক উত্তেজনায় জীবন দিতে শিখিয়েছিলাম। আমি সাংবাদিক এবং রাজনীতিক। আমার চোখের সামনে ঘটনাগুলো এমনি করেই প্রতিভাত হচ্ছিল। কেউ লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা করিনি।
দেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধা তরুণেরা ঘরে ফিরে এল। যুদ্ধের জন্যে তাদের পড়া হয়নি। অনেকে পরীক্ষা দিতে পারেনি। তাই সকল মহল থেকেই এ দাবি উঠল, আমাদের বিশেষ পরীক্ষার সুযোগ দিতে হবে। আমরা জীবন হাতে নিয়ে যুদ্ধ করেছি। সুতরাং আমরা পাস করতে চাই। সরকার সম্মত হলো। অদ্ভুত এক বিধান করল। সকলকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দিল। বাৰু বছরের তরুণ থেকে শুরু করে সত্তর বছরের বৃদ্ধ পরীক্ষার্থী হলো। পরীক্ষার হলে নকলই হয়ে উঠল বৈধ কাজ। স্বামী-স্ত্রীকে নকল দিচ্ছে। পিতা পুত্রকে নকল দিচ্ছে। ভাই বোনকে নকল দিচ্ছে। সে এক নকলের মহোৎসব। পরীক্ষায় পাসের হার হলো ৯৮%, ৯৯%। প্রায় সকলের বাড়িতে আনন্দ এবং উচ্ছ্বাস। কেউ ভাববার চেষ্টা করল না দেশটাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাচ্ছি। আজো সে ট্রাডিশন চলছে।
অথচ ভাবনা হওয়া উচিত ছিল ভিন্ন ধারার। ভাবনা হওয়া উচিত ছিল দেশ গড়ার। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশকে গড়তে হবে। দেশ গড়ার জন্যে কারিগর চাই। ভালো ছাত্র চাই। দক্ষ কর্মী চাই। দক্ষ প্রকৌশলী, চিকিৎসক চাই। কিন্তু কারো যেন মাথায় এ কথাটি এল না। আমার ব্যাখ্যা ছিল এটাই স্বাভাবিক। কারণ কেউ ভেবে চিন্তে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। কেউ ধারাবাহিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন লালন করেনি। তার চোখের সামনে কোনো পরিকল্পনা ছিল না। নতুন সমাজ গঠনের কোনো স্বপ্ন ছিল না। যুদ্ধে নেতৃত্বেরও একই অবস্থা। যারা স্বাধীন বাংলা সরকার গঠন করেছিলেন, যারা সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন বা যারা এ সংগ্রামের সহযোগী বা সাহায্যকারী ছিলেন, কারো মাথায় এ সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন ছিল না। সবার মাথায় এ যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই তাদের কাছে সমস্যা ছিল কোনোমতে এ যুদ্ধে জিতে দেশে ফিরে যাওয়া। পূর্ব পাকিস্তান নামক যে দেশটি ফেলে এসেছি তার নাম পাল্টে বাংলাদেশ করাই ছিল একমাত্র লক্ষ্য। এ ধরনের লক্ষ্য বা বিবেচনা না থাকলে এভাবে ঢালাও পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ বা নকল করার সুযোগ দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কেউ ভাবলেন না যে, এ ধরনের পরীক্ষার সুযোগ দেয়ার ফলে পরীক্ষার্থীরা সমাজের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। পরবর্তীকালে অবৈধভাবে পরীক্ষায় পাসের মতোই জীবনের সর্বত্রই অবৈধভাবে কাজের অনুসারী হবে। সবকিছুই পেতে চাইবে অবৈধভাবে। আমি তখন দৈনিক বাংলার পাতায় বারবার লিখতে চেষ্টা করেছি। আর ভীষণভাবে বিতর্কে সৃষ্টি করেছি এবং বিতর্কিত হয়েছি। সে সময় আর একটি দুঃখজনক ছবি আমি দেখেছি মুক্তিযোদ্ধা মহলে। সবাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কিছু পেতে চাচ্ছে। সকলেই মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সংগঠন করার চেষ্টা করছে। সকলেরই দাবি আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি সুতরাং আমাকে চাকরি দিতে হবে। আমি বাড়ি চাই, গাড়ি চাই, আমি সবকিছু চাই। আর এই দাবি নিয়েই চেনাচেনা বড় মুক্তিযোদ্ধারা বাড়ি আর গাড়ি দখল করতে শুরু করলেন।
এ সময়ে একটি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মেলনে আমাকে ডাকা হয়েছিল। বহু আশা করেই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই সভায় গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম সেখানেও একই দাবি, আমাদের সব চাই। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। সুতরাং সবকিছু আমাদের প্রথম পেতে হবে। আমি বলেছিলাম–একথা জানা থাকলে টেন্ডার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করা উচিত ছিল। তাহলে দর কষাকষি করা যেত। টেন্ডার দিয়ে সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ শেষে সবকিছু দাবি করতে পারত না। আমার কথা কারও মনে ধরেনি এবং অবাঞ্ছিত হয়ে আমাকে সভা ত্যাগ করতে হয়।
দীর্ঘদিন পরে আজ আমি এ কথাগুলো লিখছি একটি বিশেষ পটভূমিতে। তখন এ পরিস্থিতি সামাল দেবার দায়িত্ব ছিল রাজনীতিকদের। বিশেষ ভূমিকা পালন করা উচিত ছিল সাংবাদিকদের। কিন্তু কেউ-ই সেই ভূমিকা পালন করলেন না। প্রথমদিকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগই দাবি করতে থাকল যে তারাই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তাই মুক্তিযুদ্ধের পর সব সুযোগ-সুবিধাই তাদের প্রাপ্য। কিছুদিন পর এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি মিলে গণতান্ত্রিক ঐক্য জোট ‘গজ’ গঠন করেছিল। এবার তিনটি দল ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের দাবিদার হলো। আর সবাই হলো ব্রাত্য।
এসময় সাংবাদিকরা বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু সাংবাদিক জগতেও দেখা গেলো ভাঙন। কেউ আর সাংবাদিকতা করতে চাচ্ছে না। সকলেই যুদ্ধ শেষে প্রাপ্য চাচ্ছে এবং সে সুযোগ সীমিত ক্ষেত্রে হলেও অনেকেই গ্রহণ করল এবং মোটামুটিভাবে এরাই ছিল এককালে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা। তাই দেশের এ বেসামাল অবস্থার বিরুদ্ধে কে দাঁড়াবে? পাকিস্তান আমলের অভিজ্ঞতা ছিল–কোনো কিছু হলে দুটি মহল থেকে প্রথমে বাধা উঠত। একটি ছাত্র, অপরটি সাংবাদিক। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে কোনোকালেই কোনো সরকার সাংবাদিকদের সমর্থন পায়নি। সাংবাদিকরা শুধু কলমই ধরেনি; রাজপথে মিছিল করেছে। পুলিশের লাঠি খেয়েছে। জেলে গিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাংবাদিক ইউনিয়নে সেই পুরনো নেতৃত্বকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
নতুন নেতৃত্ব তখন অপরিচিত। সংবাদপত্র জগতে তখন নিদারুণ সঙ্কট। দেশে ৯টি কাগজ। ছটি কাগজের ব্যবস্থাপনা সরকারের হাতে। দেশে দুটি সংবাদ সংস্থা। তার দায়িত্বও সরকারের ওপর ন্যস্ত। এই মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো বা সরকারের সমালোচনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। এর মাঝখানে ছিল আবার কিছু কিছু নতুন সাপ্তাহিকের দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা, কিছু কিছু রাজনৈতিক সাপ্তাহিকের চূড়ান্ত হঠকারিতা। এই দায়িত্বহীন সাংবাদিকতা এবং হটকারী সাংবাদিকতার জন্যে সেকালের সাংবাদিকদের তিন পা এগুলে পাঁচ পা পিছাতে হয়েছে।
এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল সাপ্তাহিক গণশক্তি নিয়ে। পত্রিকাটি সাম্যবাদী দলের (এমএল) মুখপত্র। সাম্যবাদী দল তখনো বাংলাদেশ মেনে নেয়নি। তারা বাংলাদেশের পরিবর্তে পূর্ববাংলা শব্দই ব্যবহার করে। পত্রিকাটির সম্পাদক প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা। এ পরিস্থিতিতে একদিন তোয়াহা সাহেবের সাথে আলাপ করার জন্যে তার যোগীনগরের বাসায় গেলাম। পরের দিন গণশক্তি বের হওয়ার কথা। আমি তোয়াহা সাহেবকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম বাস্তবতাকে মেনে নিতে। বাংলাদেশকে পূর্ববাংলা লিখবেন না। বিদেশের বহু রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আপনাদের স্বীকৃতি দিতে আপত্তি কোথায়? তিনি আমার সাথে একমত হলেন। আমি নিশ্চিন্তে বাসায় ফিরলাম। পরের দিন দেখলাম গণশক্তিতে বাংলাদেশের পরিবর্তে পূর্ববাংলাই লেখা হয়েছে। আমি হবাক হলাম। সরকার পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করলেন। প্রেস বন্ধ করলেন। উভয়পক্ষের কাছেই দায়ী হলো সাংবাদিক ইউনিয়ন।
আর একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে ডেকে পাঠালেন। আমি একটু দেরিতে পুরনো গণভবনের বৈঠকে পৌঁছালাম। সেখানে গিয়ে শুনি সিদ্ধান্ত হয়েছে সকল সাপ্তাহিক কাগজের কাছে নাকি ৫শ টাকা করে জামানত দাবি করা হয়েছে। কারণ সাপ্তাহিক হক কথায় লেখা হয়েছে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহের কথা। আর এক সাপ্তাহিক লিখেছে কে নাকি কিশোরগঞ্জ থেকে লিচু এনে প্রধানমন্ত্রীকে খাইয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে বললাম, দেশে এ ধরনের কোনো আইন নেই। আপনি এভাবে পত্রিকায় জামানত চাইতে পারেন না। আর এ ধরনের লেখালেখি বিবেচনা করতে হলে দেশ চলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী উড়িষ্যার জনসভায় ভাষণ দিতে গেলে তাকে ঢিল মারা হয়েছিল। তাঁর নাক দিয়ে রক্ত ঝরেছিল। কিন্তু এ জন্যে পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি বা সে সভায় পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি। প্রধানমন্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। বললেন, ঠিক আছে। এবার কিছু বলা হলো না। পত্রিকাগুলোকে সংযত হতে বলবেন।
সাংবাদিকদের এখনো অভিযোগ–স্বাধীনতার প্রথম দিকে নাকি একটু নরম হলে অনেক কিছুই পাওয়া যেত। আমি নাকি কোনোদিনই সরকারের সাথে সমঝোতায় রাজি হইনি। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সাংবাদিকদের অদেয় কিছুই তাঁর ছিল না। শেখ সাহেব সম্পর্কে এ মন্তব্য ভুল তা আমি বলতে চাই না। কিন্তু পাওয়া যায় বলেই একজনের কাছে সব কিছু চাইতে হবে এ তত্নে আমি বিশ্বাসী নই। আমার ধারণা এভাবে চাইতে গেলে আমরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। মনে হয় সাংবাদিকরা একটা ভিন্ন জাত। এরা বিশেষ সুবিধার অধিকারী। আমি এই ধারায় কোনোদিন বিশ্বাসী ছিলাম না। আমি জানতাম শেখ সাহেবের কাছে চাইলে অনেক কিছুই পাওয়া যেত কিন্তু সে চেষ্টা আমি করিনি। আবার সাংবাদিকদের বিশেষ অধিকার সম্পর্কেও আমি কোনোদিন একমত ছিলাম না। এ ব্যাপারে কখনো আমি তাদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছি। আবার কখনো তদের মতো করেই সাংবাদিকদের পক্ষে দাঁড়িয়েছি।
এ ধরনের দুটি ঘটনা আমার মনে আছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার বেশ পরের কথা। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এ উপলক্ষে একটি সভা ছিল জোনাকী সিনেমা হলে। আমি সেই সভায় যাইনি। প্রেস ক্লাবে বসে ছিলাম। তাদের অভিযোগ, তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়নি। তাদের বসবারও জায়গা ছিল না। তাই তারা চলে এসেছে। তাদের দাবি–ওই সভার কোনো ছবি বা খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হবে না। আমি একমত হলাম না। আমি বললাম সংবাদ সংগ্রহ করা সাংবাদিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোথায় বসতে দেয়া হলো বা না হলে এটা আদৌ মুখ্য বিষয় নয়। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ দিকে বার্লিনের পতন হচ্ছিল। মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন জেনারেল আইসেন হাওয়ার। সোভিয়েত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন মার্শাল জুকভ। বার্লিন পতনের ছবি তুলতে চল্লিশজন আলোকচিত্রী গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল। তারা কিন্তু দাঁড়াবার বা বসার জায়গার জন্যে বিতর্ক করেনি। আমরা ঝড়-ঝঞ্ঝা এবং দুর্ঘটনার ফলে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধার পরোয়া করি না। এটাই সাংবাদিকতার নীতিমালা। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সভার বিবরণ যাবে কি যাবে না এ নিয়ে সাংবাদিক ইউনিয়নের কিছু বলার নেই। এ ব্যাপারে সকল দায়িত্ব পত্রিকা কর্তৃপক্ষের। সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকরা বিপর্যস্ত হলে নিশ্চয়ই ইউনিয়ন পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু কোনো সভা কিংবা বৈঠকে গিয়ে সাংবাদিকরা চেয়ার বা চা-নাস্তা পেল কিনা এ প্রশ্ন একান্তই অপ্রাসঙ্গিক।
তবে শেখ সাহেবের আমলে ভিন্ন ভূমিকাও ইউনিয়ন পালন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দাউদকান্দি যাবেন। সেখানে তিনি এক জনসভায় ভাষণ দেবেন। সাংবাদিকদের অভিযোগ টেলিভিশন, বেতার, বিএসএস, এনা’র প্রতিনিধি ব্যতীত আর কাউকেই হেলিকপ্টারে নেয়া হবে না। সকলকে যেতে হবে সড়ক পথে। তখন সড়ক পথে দুটি খেয়া ছিল। মেঘনা ও দাউদকান্দিতে সেতু নির্মিত হয়নি। সাংবাদিকদের দাবি তাদের হেলিকপ্টারে নিতে হবে। অন্যথায় সবাইকেই যেতে হবে সড়ক পথে। এ দাবির কথা আমি গণভবনে জানিয়ে দিলাম। আমি বললাম, যাওয়া-আসার ব্যাপারে দু’ধরনের ব্যবস্থা হতে পারে না। সকলে একইভাবে যেতে হবে। গণভবন থেকে পাল্টা ফোন এল। বারবার অনুরোধ জানানো হলো তাদের ব্যবস্থা মেনে নেয়ার। আমি রাজি হলাম না। গণভবনকেই রাজি হতে হলো। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সহযোগীদের নিয়ে হেলিকপ্টারে চলে গেলেন। আর সবাই গেলেন সড়ক পথে। এই গণভবনের রাজি হওয়ার পেছনে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমি এখনও মনে করি সেই মানুষটির পক্ষেই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব ছিল। আর আমি আজো মনে করি যে সেদিন ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আমার দাবি সঙ্গত ছিল না। সরকারি হোক বেসরকারি হোক যে কোনো অনুষ্ঠানে সংবাদ সংগ্রহ করা পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। তাতে অন্য কারো কিছু করবার নেই। অথচ আমাদের দেশে একটি বিপরীত ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছি যে সভা, সেমিনার ও মিছিলের সংগঠকরা আমাদের ভাষায় আমাদের খুশি করতে চায়। এমনকি অনেক সংগঠন আমাদের আনা নেয়ার ব্যবস্থা করে। অথচ সাংবাদিকদের বেতন বোর্ডের রোয়েদাদে সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের জন্যে বিশেষ ভাতা দেয়ার নিয়ম আছে। অনেক সংবাদপত্র এই ভাতা দিয়েও থাকেন। অথচ এর পরও আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যতদূর সম্ভব সরকারি বেসরকারি সংস্থার কাঁধে চেপে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন।
ফলে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আজকের সমাজের সাংবাদিকরা কেনাকাটার পণ্যে পরিণত হয়েছে। সবার একটা ধারণা জন্মেছে, এমনকি প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করলেও সাংবাদিকদের জন্যে ভালো খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সংবাদপত্র অফিসে প্রেস রিলিজের সাথে বেশ কিছু টাকার অঙ্কের নোটও এসে পৌঁছে। সবচেয়ে ন্যক্কারজনক হচ্ছে-আমরা যারা সংসদে যাই তাদের সংসদে সংবাদ সংগ্রহের জন্য সকল পত্রিকা অফিস থেকে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা দেবার কথা। অনেক পত্রিকা দিয়েও থাকে। তবুও দেখা যায় সাংবাদিকদের সংসদে যাওয়া-আসার জন্যে প্রেস ক্লাবে একটি সরকারি গাড়ি রাখা হয়। এটা যে সাংবাদিকতা নীতিমালার বিরোধী সে কথাও যেন আমরা সবাই ভুলে গেছি। এ কথাও সত্যি, বাংলাদেশের সব পত্রিকায় বেতন বোর্ডের রোয়েদাদ কার্যকর হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে সপ্তম বেতন। বোর্ডের রোয়েদাদ প্রকাশিত হলেও ঢাকার অনেক দৈনিক কোনো বেতন বোর্ডের রোয়েদাদ-ই কার্যকর হয়নি। মালিকপক্ষ বেতন বোর্ডের রোয়েদাদের তোয়াক্কাই করেন না। অপরদিকে বাজারে অসংখ্য দৈনিক, সাপ্তাহিক ও পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন নতুন সাংবাদিক সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। বেতন কাঠামো নেই। ছুটি-ছাটা নেই। চাকরির শর্ত নেই। আজকে নিযুক্তি পেয়ে কালকে চাকরি যাওয়া বাংলাদেশে আজ খুব অস্বাভাবিক নয়। নতুন সাংবাদিকরা বলতে পারেন-এ পরিস্থিতিতে আমাদের কোনো কিছুই করার নেই। দরকষাকষির অবস্থায় আমরা নেই। আর আমাদের আজকের পূর্বসূরিদেরও তেমন কোনো নেতৃত্ব নেই। সবকিছুই মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো। নীতি বা নীতি মানার প্রশ্নটি একান্তই উহ্য।
এ কথাগুলো মেনে নিয়েও একটি কথা অস্বীকার করা যাবে না, আমরা আজ আর তেমন জনগণের আস্থাভাজন নই। আমাদের কোনো খবরই পুরোপুরি সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে না। এর জন্যে একমাত্র সাংবাদিকরা দায়ী আমি বলব না। আমার দুঃখ হচ্ছে–আজকের পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তেমন নিমতম প্রতিবাদ পর্যন্ত নেই।
আমি বুঝলাম না এক লেখা বারবার আসছে কেন?
হয়তো কোনও ভুল হয়েছে আমাদের। কোন লেখাবার আসছে যদি একটু ধরিয়ে দিতেন, আমরা ঠিক করে দিতে পারতাম। ধন্যবাদ।