ছলিম মিঞা সকিনা খাতুনের প্রতি অযথা অন্যায় ব্যবহার করেছে বা আশঙ্কাটি অহেতুক-এমন ধারণা কারো মনে থেকে থাকলে তা তখন দূর হয় যখন সবাই স্ত্রী করিমনের অদ্ভুত কথাটি শুনতে পায়। স্বামীর আচরণের কারণ বোঝাবার চেষ্টায় বা হঠাৎ যা আবিষ্কার করেছে তা বলার লোভ সামলাতে পারে না বলে করিমন সকলকে কথাটি বলে বেড়ায়, সাইকেলের দোকানে কর্মরত স্বামী তাকে বাধা দিতে পারে না। তারপর অন্যদের পক্ষেও আশঙ্কাটি আর চেপে রাখা দায় হয়ে পড়ে।
সেদিন সন্ধ্যার পর নবীন উকিল আরবাব খান, ইস্কুলের থার্ড-মাস্টার মোদাব্বের, মুহুরি হবু মিঞা এবং আরো দু-একজন শহরবাসীদের স্ত্রীরা বিচিত্র কান্নাটির রহস্যভেদ করার চেষ্টায় মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। স্ত্রীরা আসে, কারণ ইস্কুলের চাকরির খাতিরে পথে বেরুতে হয় বটে তবে সকিনা খাতুন কেমন পর্দাও করে, বাইরে বৈঠকখানায় পরপুরুষের সামনে দেখা দেয় না।
স্ত্রীর দল সরাসরি অন্দরে এসে অযথা কালক্ষেপ না করে সকিনা খাতুনকে জেরা করতে উদ্যত হয়। নবীন উকিল আরবাব খানের স্ত্রী আয়েষাই জেরা-কার্যে নেতৃত্ব গ্রহণ করে। আয়েষার মধ্যে বংশের একটু দেমাগ। আজ তার বাপদাদার অবস্থা তেমন সুবিধাজনক না হলেও এককালে তারা যে বড় জমিদার ছিল, তারই দেমাগ। স্বামীর পেশাজনিত সার্থকতার জোরে তার দেহে গহনা-অলঙ্কারের ছড়াছডিও, যে-গহনা অলঙ্কারের দীপ্তি এবং ঝঙ্কারের সঙ্গে নূতন শাড়ির খসখস শব্দ, কণ্ঠের নাকী উচ্চ সুর, ধনুকের মতো বাঁকা জ্বর ওঠা-নাবা, ঠোঁটের পাশে একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের আভাস, কটকটে চোখ-এসব মিলে যে-একটি ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় তা অনেকের মনে যুগপৎ ঈর্ষা এবং অনুগত্যের ভাবের সৃষ্টি করে।
সামনে সকিনা আড়ষ্ট হয়ে বসলে সে প্রথমে কটকটে চোখে নয়, নরম চোখেই মেয়েটির দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে, দেখে তার শীর্ণ লাবণ্যহীন চেহারা, হাসিশূন্য মুখ। সকিনা খাতুনের জন্মদাগটিও লক্ষ করে দেখে। জন্মদাগটি তেমন স্পষ্ট নয়, শ্যামল রঙের ওপর আরেকটু শ্যামল একটা ছাপ যা মুখের নিম্নাংশ থেকে শুরু হয়ে গলা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়। তারপর সে দেখে তার কষ্ঠাস্থি, অলঙ্কারশূন্য বুকের উপরাংশ, প্রায় সমতল বুক। অবশেষে সে মিষ্টি কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
সত্যি কিছু শুনতে পান নাকি?
এমনভাবেই সে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করে যেন কান্নার কথা সে বিশ্বাস করে না, বা তা সত্য নয় সে-কথা মেয়েটিকে বলার সুযোগ দেওয়াই তার ইচ্ছা।
সকিনা খাতুন একটু ভাবে, যেন সঠিক উত্তর সে জানে না। বস্তুত, আয়েষার নরম দৃষ্টি এবং মিষ্টি কথা তাকে হঠাৎ কেমন নিরস্ত্র করে ফেলে, সদলবলে এতজন মেয়েলোকের আকস্মিক আবির্ভাবে মনে যে-কোণঠাসা ভাব দেখা দিয়েছিল সে-ভাবটি দূর হয়। হয়তো একবার ভাবে, যদি সে বলতে পারত কিছুই সে শোনে না, কী কারণে তেমন একটা খেয়াল হয়েছিল গত কয়েকদিন কিন্তু সে-খেয়াল কেটে গিয়েছে, তবে স্বস্তিই পেত। কিন্তু সে জানে তা সত্য নয়। প্রথমে কান্নাটি শুনতে পেলে মনে হত, সত্যি কি কিছু শুনতে পায়? এখন তা-ও মনে হয় না, যখন কিছু শুনতে পায় না তখনও কান্নার রেশটি অন্তরে কোথাও যেন ঘোরাঘুরি করে।
না, একটা কান্নার শব্দ থেকে-থেকে শুনতে পাই। অবশেষে ক্ষীণকণ্ঠে সে বলে।
শুধু আপনিই শোনেন, আর কেউ শুনতে পায় না-তা কী করে সম্ভব?
এ-প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সকিনা খাতুন? সে জানে সে-ই কেবল শুনতে পায়, আর কেউ শুনতে পায় না। কেন, তা বলতে পারবে না। অনেক সময় কান্নার আওয়াজটি এমন সশব্দে ফেটে পড়ে যে তার মনে হয় শহরের অন্য প্রান্তে পর্যন্ত সে-আওয়াজ পৌঁছানো উচিত, কিন্তু কেউ এক হাত দূরে বসে থাকলেও কিছু শুনতে পায় না।
সকিনা নীরব হয়েই থাকে। একটু অপেক্ষা করে আয়েষা আবার জিজ্ঞাসা করে, কান্নার আওয়াজটা কেমন ধরনের?
এ-প্রশ্নের জবাব দেওয়া শক্ত নয়। কান্নার আওয়াজটা কেমন ধরনের? নিঃসন্দেহে গলাটা কোনো মেয়েলোকের। অজানা মেয়েলোকটি কখনো কাঁদে করুণ গলায়, কখনো বিলাপের ভঙ্গিতে, কখনো গুমরে-গুমরে, কখনো মরণকান্নার ঢঙে। কখনো মনে হয় কাছে কোথাও কাঁদছে, কখনো আবার মনে হয় আওয়াজটি বেশ দূরে সরে গিয়েছে। কখনো কাঁদে উচ্চ তীক্ষ্মকণ্ঠে, কখনো অস্ফুটভাবে নিম্নকণ্ঠে।
তবে আওয়াজটা সব সময়ে একদিক থেকেই আসে।
কোনদিক থেকে?
নদীর দিক থেকে।
কান্নাটি শুনলে ভয় করে না?
সকিনা আবার একটু ভাবে। কান্নাটি শুনলে সে কি ভয় পায়? হয়তো আগে যেমন ভয় পেত তেমন ভয় আর পায় না, সে যেন কেমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। হয়তো সে বুঝতে পেরেছে, কে কাঁদে কেন কাঁদে তা জানে না বটে কিন্তু তাতে ভয়ের কিছু নেই। কণ্ঠস্বরটি কেমন চিনেও ফেলেছে। সে-কণ্ঠের বিভিন্ন খাদ, বিভিন্ন সুর-সবই চিনে ফেলেছে এবং এমনও মনে হয় যে, যে কাঁদে তার সঙ্গে তার অনেক দিনের পরিচয়।
না, ভয় করে না।
না, সত্যি ভয় করে না আর। যে-কণ্ঠস্বর এত পরিচিত মনে হয়, সে-কণ্ঠস্বরে ভয় হবে কেন? এমনকি তার কেমন মনে হয়, কণ্ঠস্বর যেন জারুনার মা নামক মেয়েমানুষটির যার নিকট বালিকাবয়সে কতগুলি ছড়া শিখেছিল। তবে তার কণ্ঠস্বর চিনতে কষ্ট হয় কারণ তাকে কখনো কাঁদতে শোনে নি। সে সর্বদা হাসত, কখনো কাঁদত না। কিন্তু জারুনার মা কাঁদবে কেন? এই দুনিয়ায় যে কোনোদিন কাঁদে নি দুনিয়া ত্যাগ করার পর, সমস্ত দুঃখকষ্টের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সে কাঁদবে কেন? কখনো কখনো মনে হয় : জীবিতকালে না কেঁদে হেসে গিয়েছিল বলে, হাসির তরে সব ব্যথাবেদনা লুকিয়ে রেখেছিল বলে এখন সে কাঁদছে, এখন তার পক্ষে কান্না ঢাকা সম্ভব নয়; মৃত্যুর পর যা সত্য তা কেউ ঢাকতে পারে না, কারণ দেহহীন হবার পর কিছু ঢাকার শক্তিও বিলোপ পায়।
আয়েষা কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্মদৃষ্টিতে সকিনা খাতুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সহসা তার চোখে কটকটে ভাবটি ফিরে আসে। সে ভাবে, সকিনা খাতুন ভয় পায় না তবে মানুষের মনে আশঙ্কার ভাব দেখা দিয়েছে কেন, সকালে ছলিম মিঞা ক্রোধে এমন সম্বিৎ হারিয়ে ফেলেছিল কেন, সকিনা খাতুনের চোখের নিচে এমন কালচে দাগ পড়েছে কেন?
মন খুশিতে আত্মহারা হয়ে ওঠে বুঝি? বিদ্রুপের স্বরে আয়েষা বলে।
সকিনা খাতুন তার উক্তিটি ঠিক শুনতে পায় না, কারণ সহসা সে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। সে ভাবে, না, জারুনার মা কাঁদবে কেন? তাছাড়া তার কান্না কখনো শোনে নি বটে কিন্তু সে কাঁদলেও তার কণ্ঠস্বর নির্ভুলভাবে চিনতে পারবে; হাসির কণ্ঠে এবং কান্নার কণ্ঠে তেমন আর কী প্রভেদ? না, গতকাল থেকে একটি বিচিত্র কথাই বারবার মনে দেখা দিচ্ছে। হয়তো কান্নাটি কোনো মানুষের নয়, কোনো জীবজন্তুরও নয়, জীবিতের নয় মৃতেরও নয়, অন্য কারো। কে জানে, কান্নাটি হয়তো নদীরই, হয়তো তাদের মরণোন্মুখ বাকাল নদীই কাঁদে।
কী, কান্নার আওয়াজ শুনলে মন বুঝি খুশিতে ভরে ওঠে? আয়েষা আবার বলে। আয়েষার কথা না হলেও তার কণ্ঠের রুক্ষতা এবার সকিনা খাতুনের কানে পৌঁছায়। চকিত দৃষ্টিতে সে উকিলের স্ত্রীর দিকে তাকায়, তার চোখের কটকটে ভাবটি লক্ষ্য করে, সহসা সাইকেলের দোকানের মালিকের রক্তাক্ত চোখের কথাও একবার তার স্মরণ হয়। সে কি বলবে কথাটি? হয়তো বলাই উচিত হবে। দৃষ্টি সরিয়ে সকিনা খাতুন কয়েক মুহূর্ত লণ্ঠনের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে; সে-আলো তার চোখে প্রতিফলিত হয় বলে মনে হয় সহসা তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ভয় হত, তবে আর হয় না। নদীর কান্নায় ভয় কী? নদী কাঁদে, বাকাল নদী কাঁদে।
সেদিন কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুক্তাগাছি গ্রামে কালু মিঞার বাড়ি যাই নি। যেতে পারি নি। যে-দায়িত্বের ভার গ্রহণ করেছিলাম সে-দায়িত্ব অক্ষরে-অক্ষরে পালন করব এমন একটি সংকল্প নিয়েই পথ ধরেছিলাম, তবে ক্রোশখানেক পথ অতিক্রম করার পর কী কারণে আমার পদক্ষেপ মন্থর হয়ে ওঠে, তারপর কখন একেবারে থেমে পড়ে। নিকটে একটি হিজল গাছ দেখতে পাই। ভাবি, একটু বিশ্রাম করি। তারপর গাছের তলে বসে অদূরে একটি ক্ষেতে কার্যরত লোকেদের দিকে অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তখন রোদটা বেশ চড়ে উঠেছে, শুষ্ক-হয়ে-ওঠা হাওয়ায় চড়চড়ে ভাব দেখা দিয়েছে। নিকটে কোথাও একটি ভ্রমর গুনগুন করে শব্দ করে, দূর আকাশে একটি চিল শ্লথগতিতে কালো বিন্দুর মতো ভাসে, তারপর কোত্থেকে একটি ফড়িং এসে কিছুক্ষণ লাফালাফি করে আমার দৃষ্টিপথে। হয়তো অনেকক্ষণ এমনি বসেছিলাম। তারপর এক সময়ে পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ক্ষেতের লোকদের সন্ধান করি, দেখতে পাই তারা ক্ষেতের ওপাশে আরেকটি গাছের তলে মধ্যাহ্নের রোদ থেকে আশ্রয় নিয়েছে। এবার উঠে পড়ে আবার পথ ধরি। তবে সে-পথ মুক্তাগাছি গ্রাম বা আমাদের বাড়ির দিকে আমাকে নিয়ে যায় নি, সময় কাটাবার জন্যে অন্যত্র চলে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে বুঝে নিয়েছিলাম, কালু মিঞার বাড়ি যাওয়া সম্ভব নয়। তবু কিছুক্ষণ মনটা কেমন খচখচু করে। মুহাম্মদ মুস্তফা যদি জানতে পায়? অবশেষে মনকে এই বলে প্রবোধ দেই যে সে কখনো জানতে পারবে না, কারণ কালু মিঞা বা সে-বাড়ির কোনো লোকের সঙ্গে তার আর কখনো মোকাবিলা হবে না। কালু মিঞা কি মসজিদে গিয়ে বলে নি সে নির্দোষ?
তবে ক-দিন আগে মুহাম্মদ মুস্তফা পথ ভুলে মুক্তাগাছি গ্রামে কালু মিঞার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়ে ভীমরুলের চাকে কাঠি দেয়ার মতো কিছু করেছিল-তা যদি তখন বুঝতে পারতাম তবে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও যে-কাজ করার ভার পড়েছিল আমার ওপর, সে-কাজটি করতাম। কেবল করলে কোনো ফল হত কিনা জানি না। ভীমরুলের চাকে একবার কাঠি দিলে রোষান্বিত ভীমরুলদের বশ মানানো সহজ নয়।
পরদিন দুপুরের দিকে কালু মিঞার জামাই দুটি ষণ্ডাগোছের লোক এবং একটি বারো-তেরো বছরের ছেলে সঙ্গে করে আমাদের বাড়ির সামনে দেখা দেয়। বাপজানই বোধ হয় প্রথম তাদের দেখতে পায়। একটু পরে কেমন বিচলিত হয়ে বাপজান ভেতরে আসে এবং দক্ষিণ-ঘর থেকে মুহাম্মদ মুস্তফাকে ডেকে নিয়ে আবার বাইরে যায়।
সেদিনের কথা মনে পড়লে আকাশের ঘনঘটা, এবং অঝোরে অবিচ্ছিন্ন ধারায় বৃষ্টি পড়ার কথাই মনে পড়ে। সেদিন এক মুহূর্তের জন্যেও যেন বৃষ্টি থামে নি, কখনো কখনো ধারাটা কিছু ক্ষীণ হয়েছে তবে আবার মুষুলধারায় নেবে আসতে দেরি হয় নি। স্তরে-স্তরে সজ্জিত পুঞ্জীভূত মেঘের তলেও দিনটা হয়তো তেমন অন্ধকার ছিল না, কিন্তু স্মৃতিতে কেবল কী একটা বিষাদভরা সুনিবিড় তমসাচ্ছন্ন দিনই দেখতে পাই। যে-বৃষ্টি অঝোরে ঝরেছিল ক্লান্তিহীনভাবে সে-বৃষ্টিতে, যে-ঘনীভূত অন্ধকারে দিনটা সন্ধ্যার মতো হয়ে উঠেছিল সে-অন্ধকারে সব কিছু মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি কেন? যে-কথা সত্য নয় কিন্তু অতিশয় জঘন্য, সে-কথাই-বা কেন শুনতে হয়েছিল, অবিশ্রান্ত বৃষ্টির উচ্চ শব্দের তলে তা ঢাকা পড়ে যায় নি কেন?
বাহিরঘরে পৌঁছুতে আমার দেরি হয় নি। আমাদের বাহিরঘরটি নামেই বাহিরঘর, আসলে সেটি গোয়ালঘর। একপাশে শুধু নিচু করে তৈরি বাঁশের মাচার মত; সে-মাচায় রাখাল লোক রাত্রিযাপন করে। সে-ঘরে উপস্থিত হলে দেখতে পাই কালু মিঞার জামাই এবং ষণ্ডাগোছের লোকদুটি মাচার ওপর বসে। দরজার কাছে বাপজান, পাশে দাঁড়িয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা। তারপর মাচার পশ্চাতে আবছা অন্ধকারের মধ্যে ছেলেটিকে দেখতে পাই। আবছা অন্ধকারে তার চেহারা ভালো করে দেখতে না পেলেও কেমন চমকে উঠি, কারণ, মনে হয় ছেলেটি যেন খেদমতুল্লার একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ : একই মুখে আকৃতি, একই নাক, একই থুতনি, একই ধরনের কেমন ছড়ানো কান। তারপর ছেলেটি আমার দিকে ক্ষণকালের জন্যে তাকালে তার চোখে যে-রুক্ষতা দেখতে পাই সে-রুক্ষতাও অবিকল মুহাম্মদ মুস্তফার জন্মদাতার চোখেরই রুক্ষতা; খেদমতুল্লার চোখে এমন একটি ভাব ছিল যে মনে হত নিদ্রা বলে কোনো জিনিস সে জানত না।
বাপজান বড় উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। হয়তো আসলে সে তখন উত্তেজনার চেয়ে ক্রোধ-আক্রোশই বেশি বোধ করছিল, কিন্তু যা সে সবেমাত্র শুনতে পেয়েছে তাতে সে এমনই বিহ্বল হয়ে পড়েছিল যে ক্রোধ-আক্রোশ প্রকাশ করার ক্ষমতা তার ছিল না। বাপজান কী বলছে তা প্রথমে বুঝতে পারি নি; বাপজান বোধগম্য ভাষায় কিছু বলার ক্ষমতাও সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলে থাকবে। থেকে-থেকে একটি মেয়েলোকের নাম শুনতে পাই, কিন্তু বাপজান তার বিষয়ে কিছু জানে বলে মনে হয় না। সে কে, তা আমিও গোড়াতে ধরতে পারি না। তারপর সহসা একটি মুখ ভেসে ওঠে মনশ্চক্ষে। একটু পরে ভালোভাবেই মনে পড়ে তার কথা : খেদমতুল্লা তার জীবনের শেষভাগে কী দুর্বোধ্য তাড়নায় একটি-একটি করে যে-কয়েকজন বাদি ঘরে আমদানি করেছিল সে তাদেরই একজন। গ্রাম্য মেয়ে, নাক ভোতা, চোখ কুতকুতে, রঙ বেশ কালো। তবে মুখে-চোখে আবার কালো মিছরির মিষ্টতা। সুযোগ পেলেই হাতমুখ নেড়ে কাঁচের চুড়িতে ঝঙ্কার তুলে সে সোনাপুর গ্রামের মস্ত বিলের কথা বলত, ছোটবেলায় ভাইবোনে মিলে রাতের অন্ধকারে সে-বিলে নাকি মাছ ধরত। অমনি করে অনেকে মাছ ধরে, পরে ভুলেও যায়, বা সে-বিষয়ে কিছু বলার কোনো কারণ দেখতে পায় না। কিন্তু কোনো কারণে বিলে মাছ-ধরার কথা ভুলতে পারে নি সে। হয়তো মাছ ধরা নয়, যা ভুলতে পারে নি তা বিলের স্মৃতি : যে-বিলের পানি একদিন তার অন্তরে বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়েছিল সে-পানি তখনো হয়তো নেবে যায় নি, সে-পানিতে তখনো তার অন্তর মাছের মতো খেলা করত। হয়তো বিলের কথা এমনভাবে তার মনে পড়ত কারণ খেদমতুল্লার সংসারে সে জাওলা মাছের মতোই বোধ করত।
মেয়েটির নাম কেন বারেবারে শুনতে পাই তা এবার বুঝি। এবার ছেলেটির দিকেও আবার তাকাই। সাদৃশ্যটা অত্যাশ্চর্য : মৃতলোকটি যেন বালকরূপে ফিরে এসেছে। তবে মুখটা এবার ভালো করে দেখতে পাই না। কী কারণে হঠাৎ সে লজ্জা বোধ করতে শুরু করেছে বলে তার মাথা ঝুঁকে পড়েছে বুকের ওপর, কাঁধটা উঠে এসেছে। নতমুখে সে পায়ের নখ দিয়ে মাটি আঁচড়াতে থাকে।
তবে বাপজানের কণ্ঠস্বর ততক্ষণে অতিশয় উচ্চ হয়ে উঠেছে, যে-ক্রোধ-আক্রোশ এতক্ষণ প্রকাশের পথ খুঁজে পায় নি তা দুর্বার বেগে ফেটে পড়েছে। জামাইটি একবার এক পলকের জন্যে বাপজানের দিকে তাকায়, ভাবভঙ্গি অবিচল, কেবল মনে হয় সে বাপজানের প্রচণ্ড ক্রোধ-আক্রোশের কোনো কারণ দেখতে পায় না। বস্তুত তখন আমিও ঠিক দেখতে পাই নি।
সে-সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফার ওপর আমার দৃষ্টি পড়ে। দেখতে পাই চোখ বুজে সে কেমন নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারপর আরেকটি জিনিস নজরে পড়ে। তার ঠোঁট কাঁপছে, প্রচণ্ড শীতে ঠিরঠির করে কাঁপার মতো। একটু পরে বুঝতে পারি, ঠোঁট দুটি কাঁপছে না, সে নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে কী বলছে, সে যেন দোয়াদুরুদ পড়ছে। হয়তো তার ঠোঁটের নিঃশব্দ কম্পন দেখেই সহসা সব কিছু পরিষ্কার হয়ে ওঠে, বাপজানের কথা যা হেঁয়ালির মতো মনে হয়েছিল তা বোধগম্য হয়ে ওঠে, সঙ্গে-সঙ্গে ভেতরটা কেমন শীতল হয়ে পড়ে। তখন মেঘের ভারে নুয়ে-পড়া আকাশ থেকে উচ্চ শব্দে ঝরঝর করে বৃষ্টি পড়ছিল, কিন্তু হয়তো কিছুক্ষণ সে-শব্দ কানে পৌঁছায় নি, হয়তোবা কিছুক্ষণ কিছু দেখতেও পায় নি। মনে বারবার একটি প্রশ্নই জাগে : এ কী-ধরনের কথা বলতে এসেছে লোকটি? তারপর সহসা বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই। মনে হয় মুষলধারে ঝরতে-থাকা বৃষ্টির শব্দ নয়, মহাপ্লাবনের গর্জন শুনছি, কোথাও মহাপ্লাবন শুরু হয়েছে যে-মহাপ্লাবনে ষণ্ডগোছের লোকটি সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভেসে যাবে। তারপর তাদের দেখতে পাই : প্রথমে ষণ্ডাগোছের লোক দুটিকে। তারা কেমন নিশ্চল ভঙ্গিতে বসে। তারপর দৃষ্টি যায় কালু মিঞার জামাই-এর দিকে। এবার তার মুখে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পাব ভেবেছিলাম কিন্তু তাতে অস্বাভাবিক কিছু নজরে না পড়লে বিস্মিত হই : অতি সাধারণ মধ্যবয়সী একটি চেহারা, চ্যাপটা ধরনের মাথা, ঈষৎ ভারী চোয়াল, কানের প্রান্তে মোটা কর্কশ লোম। মুখে কেমন বেজার ভাব, যেন কারো অন্যায় আচরণে সে অসন্তুষ্ট, তাছাড়া সে-মুখে কোনো অস্বাভাবিকতার বিন্দুমাত্র স্পর্শ নেই। তবু সে-ই কথাটি বলেছে, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে দুটি ষণ্ডাগোছের লোক এবং বারো তেরো বছরের একটি ছেলে যে খেদমতুল্লার একটি ক্ষুদ্র সংস্করণ। ছেলেটি হয়তো খেদমতুল্লারই ঔরসজাত সন্তান, তারই রক্তমাংস এবং লালসায় সৃষ্ট : তা বিশ্বাস্য। কিন্তু তা না বলে এমন একটি অবিশ্বাস্য কথা বলছে কেন? ছেলেটির মা যদি বলেই থাকে খেদমতুল্লা নয় মুহাম্মদ মুস্তফাই তার বাপ-তা কেউ বিশ্বাস করবে কেন? সে কথাই বাপজান বারবার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করছিল। একটু পরে জামাইটির মুখের অসন্তুষ্টির ভাবটি একটু গাঢ় হয়েছিল কেবল, তার আত্মসংযমে টোল পড়ে নি। সে শান্ত অনুচ্চ গলায় বলেছিল, সে কেবল একটি অসহায়া অবলা নারীর কথা বহন করে এনেছে। সে-ই বলে খেদমতুল্লা নয়, মুহাম্মদ মুস্তফা ছেলেটির জন্মদাতা। সত্যাসত্য বিচারালয়ে নির্ধারিত হবে, কারণ ছেলেটির মা মনস্থির করেছে ছেলেটির জন্মদাতা সন্তানের ভরণপোষণের ব্যবস্থা না করলে উকিল সঙ্গে নিয়ে আদালতে হাজির হবে। অনেক ন্যায়পরায়ণ দরদবান লোক তাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু এতদিন পরে কেন, কোথায়-বা ছেলেটিকে লুকিয়ে রেখেছিল এতদিন, লোকটি উত্তরে বলেছিল, এতদিন ছেলেটির এক মামা দয়াপরবশ হয়ে তার দেখাশুনা করছিল, কিন্তু কিছুদিন হল রক্তবমি করে সে ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেছে, তার দেখাশুনা করার আর কেউ নেই। তাছাড়া এতদিন কারো রক্ষনাবেক্ষণের ভার নেবার ক্ষমতা ছিল না মুহাম্মদ মুস্তফার, এখন সেয়ানা হয়েছে, অনেক পড়াশুনা করে লায়েক হয়েছে।
বাপজান আইনকানুনের কথা বিশেষ জানত না, তবু প্রথমে আইনকানুনের কথাই সে ভাবে। যা জলজ্যান্ত মিথ্যা তা মিথ্যাই, সে-বিষয়ে কোনো তর্কের অবকাশ নেই-তা বুঝতে পারলেও আদালতের কথা বারবার তার মনে আসে যেন লোকটি ইতিমধ্যে মুহাম্মদ মুস্তফাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সে ভালোভাবে বুঝে নিয়েছিল যে সেদিন মুহাম্মদ মুস্তফা মুক্তাগাছি গ্রামে প্রাচীন বটগাছটির তলে দেখা দিয়েছিল বলেই ছেলেটিকে খুঁজে বের করে কালু মিঞার জামাই আমাদের বাড়ি উপস্থিত হয়েছে, কিন্তু খেদমতুল্লাকে নয় তার সন্তানকে কেন ছেলেটির জন্মদাতায় পরিণত করার চেষ্টা করছে। তা বুঝতে পারে নি। সে ভাবে, বাপ বেঁচে নেই বলে সৎভাইকে জন্মদাতায় রূপান্তরিত করলে ভরণপোষণ আদায় করা হয়তো সহজ এবং এমন ধরনের রূপান্তর যে অতিশয় জঘন্য তা হয়তো নীচ প্রকৃতির লোকেদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তবে সহসা সে বুঝতে পারে। সে বুঝতে পারে, কথাটি আদৌ ভরণপোষণের কথা নয়, যুক্তিতর্ক নিয়েও তারা আসে নি।
বজ্রাহত মানুষের মতো বাপজান কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থাকে, তারপর তার দৃষ্টি যায় মুহাম্মদ মুস্তফার দিকে। ততক্ষণে বাপজানের চোখে খুন চড়েছে। উন্মাদের মত চিৎকার করে সে বলে, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তুমি মরদ না মাগী, বুকে একটু হিম্মত নাই?
হয়তো কালু মিঞার জামাই এসে আমাদের যা বলে তা মুহাম্মদ মুস্তফাও প্রথমে সম্যকভাবে বোঝে নি; এমন কথা ছেলে কী করে বোঝে? তবে বাপজানের উক্তির পর না বুঝে উপায় থাকে না। কয়েক মুহূর্ত সে পূর্ববৎ নিমীলিত চোখে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পূর্ববৎ দোয়াদরুদ পড়ে চলে, যেন বাপজানের কথা শোনে নি। তারপর সহসা সে চোখ খুলে লোকটির দিকে তাকায়। এ-সময়ে ষণ্ডাগোছের দুটি সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও লোকটি ঈষৎ ভীত হয়ে থাকবে, কারণ আড়চোখে সে মুহাম্মদ মুস্তফার দিকে তাকিয়ে স্থির হয়ে থাকে। কয়েক মুহূর্ত কাটে।
তারপর মুহাম্মদ মুস্তফা বমি করতে শুরু করে। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই সে, বসে পড়ে দেহের অভ্যন্তরে কী-একটা ভীষণ শব্দ করে-করে বমি করতে থাকে। দুপুরের আগে যা খেয়েছিল তা তখনো হজম হয় নি, সে-সব খণ্ড-খণ্ড হয়ে বেরিয়ে আসে, ন্যাক্কারজনক একটি দুর্গন্ধ ঘরে ভারি-হয়ে-থাকা গো-দেহ এবং গোবরের গন্ধের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে পড়ে। আমার মনে হয়, এতক্ষণ নিঃশব্দে সে যে-সব দোয়াদরুদ পড়ছিল সে-সব দোয়াদরুদ বেরিয়ে আসছে। সে-সব কোথাও পৌঁছায় নি।
এর কিছুক্ষণ পরে ষণ্ডাগোছের দুটি লোক এবং ছেলেটিকে নিয়ে কালু মিঞার জামাই বমি-ছড়ানো স্থানটি এড়িয়ে ঘরত্যাগ করে বাড়িমুখো হয়। তখন বৃষ্টি কিছু ধরেছে।
তারপর বাপজান কিছু বলে নি। বস্তুত সহসা তার মুখের কথা শুকিয়ে যায় যেন কিছুই আর বলার নেই। এ-ও মনে হয় হঠাৎ তার মধ্যে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যার কিছু আগে মুহাম্মদ মুস্তফা প্রবল বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলে সে কোনো কৌতূহলও দেখায় নি।
অনেক রাত পর্যন্ত আমরা মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যে অপেক্ষা করি, কোথায় গিয়েছে। কেন গিয়েছে কী করছে-এ-সব বিষয়ে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করতে সাহস হয় নি। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ে। দক্ষিণ-ঘরে উত্তর-ঘরে যে যার বিছানায় আশ্রয় গ্রহণ করে, কেবল মুহাম্মদ মুস্তফার মা আমেনা খাতুন উত্তর-ঘরে এসে খোদেজাকে নিয়ে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা একটি পিদিমের আলোয় কাঁথা সেলাই করতে বসে। একসময়ে : তাদের দিকে দৃষ্টি গিয়েছে এমন সময়ে দেখতে পাই আমেনা খাতুন তার বুক উন্মুক্ত করে খোদেজাকে নিম্নকণ্ঠে বলছে, সে-বুকের দুধ দিয়েই সে একদিন শিশু মুহাম্মদ মুস্তফার ক্ষুধা-তৃষ্ণা দূর করত। খোদেজা ঘুম জড়ানো চোখে অনেকটা নির্বোধের মতো আমেনা খাতুনের বুকের দিকে নয়, মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত।
মুহাম্মদ মুস্তফা যখন ফিরে আসে তখনো বৃষ্টি থামে নি। তবে সে-সময়ে তাকে দেখি নি; দক্ষিণ-ঘরে কে যেন অনুচ্চ স্বরে কথা বলে উঠলে বুঝতে পারি সে ফিরে এসেছে। ততক্ষণে আমেনা খাতুন দক্ষিণ-ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
সে-রাতে মুহাম্মদ মুস্তফা কোথায় গিয়েছিল, কার সঙ্গে দেখা করেছিল, দেখা করে কী বলেছিল-এ-সব কথা কখনো সে না বললেও আমরা ঠিক অনুমান করতে পেরেছিলাম। তারপর মুক্তাগাছি গ্রামের কালু মিঞার বাড়ির দিকে থেকে আর কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে, এবং বাপজান তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করলে অনুমানটি নিশ্চিত জ্ঞানে পরিণত হয়।
তবারক ভুইঞার মুখে একটি হাসির আভাস দেখা দিয়েছে যেন। হয়তো এতদিন পর কুমুরডাঙ্গা নামক মহকুমা শহরের মোক্তার মোছলেহউদ্দিনের মাস্টারনি মেয়ে সকিনা খাতুনের অদ্ভুত ধারণাটির কথা মনে পড়ায় তার একটু হাসি পেয়েছে। শ্রোতাদের মধ্যে সহসা কেউ সশব্দে হেসে ওঠে। হাসি ঠিক নয়, নাকে একটা আওয়াজ হয়, যে-আওয়াজ নাকে জেগে-উঠে নাকেই থেমে যায়। ততক্ষণে তবারক ভুইঞার মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়েছে।
অদ্ভুত ধারণা, তবু তা শোনার পর কী যেন হয়, যাদের মনে মেয়েটির প্রতি ধিকিধিকি করে একটা রাগ জ্বলতে শুরু করেছিল, তাদেরই কেউ-কেউ এবার কী-যেন শুনতে শুরু করে, তবারক ভুইঞা বলে।
মিহির মণ্ডল বলে একটি লোক একদিন সকালে বলে, গভীর রাতে কী কারণে ঘুম ভেঙ্গেছে এমন সময়ে সে শুনতে পায় নদীর দিকে একটি মেয়েলোক যেন আর্তস্বর কাঁদছে। মিহির মণ্ডল কাপড়ের ব্যবসায়ী মোহনচাঁদের গদিতে কাজ করে; সাবধানী হুঁশিয়ার লোক, সত্যবাদী বলেও সুনাম। তবে মোহনচাঁদ তার স্বাভাবিক শ্লেষ্মঘন কণ্ঠে হাপর-হাসি হেসে-বক্তব্যের বিষয় যাই হোক, হাসিছাড়া মোহনচাঁদকে কল্পনা করা যায় না-বলে, মানুষের জীবনে আপদ-বিপদ অসময়েই আসে, অসময়েও তাকে পথ ধরতে হয়। কে জানে, কোনো মর্মান্তিক দুঃসংবাদ শুনে একটি মেয়েলোক নিশীথ রাতে নৌকায় সওয়ার হয়ে কোথাও যাচ্ছিল। সে-মেয়েলোকের বুকফাটা কান্নাই তার কর্মচারীটি শুনে থাকবে।
কথাটা যুক্তিসঙ্গত, নিতান্ত বিশ্বাসযোগ্যও বটে, কিন্তু কদিন ধরে মোজার মোছলেহউদ্দিনের মেয়ে সকিনা খাতুনও কি তেমন একটা কান্না শুনতে পায় বলে দাবি করে না?
পরদিন আরেকটি খবর শোনা যায়। সেটি এই যে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত অশীতিপর বৃদ্ধ ঈমান মিঞা যে অন্ততপক্ষে পাঁচ বছর ঘর থেকে বের হয় নি, সে-ও একটি বিচিত্র কান্না শুনতে পেয়েছে। এত বয়সেও কানে তার দোষ-দুর্বলতা নেই, বরঞ্চ নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই বলে তার শ্রবণশক্তিটা অতি প্রখর হয়ে উঠেছে, বিড়ালের পদধ্বনিও সে শুনতে পায়। তাছাড়া, তার বাড়ি নদীর ধারে; বাড়ি এবং নদীর মধ্যে কেবল একটি কাঁঠালগাছ এবং সরু একটি পথ। নদীর কলতান, ঝড়ের সময়ে তার বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের আর্তনাদ, কখনো-কখনো তার নীরবতাও সে শুনতে পায়; মধ্যে-মধ্যে নদীও জম্ভর মতো নিথর হয়ে ঘুমায়। তারপর নদীর বুক থেকে মাঝিদের কণ্ঠধ্বনি শোনে, যে কণ্ঠধ্বনি স্থলের মানুষের কণ্ঠধ্বনির মতো নয় : দুটি কণ্ঠ ভিন্ন ধরনের। তবে নদী থেকে কখনো কোনো কান্না শোনে নি, এবং সে-জন্যে সেদিক থেকে কান্নার শব্দটি শুনতে পেলে সে বড় বিস্মিত হয়েছিল। কেউ জিজ্ঞাসা করে, কান্নাটি কেমন? কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বৃদ্ধ ঈমান মিঞার পক্ষে সহজ নয়। উত্তর দেবার চেষ্টায় তার ঠোঁট কিছুক্ষণ নড়ে, হয়তো অন্য বৃদ্ধ মানুষের মতো বর্তমান সময়ের কোনো ঘটনার বিষয়ে উত্তর দিতে গিয়ে তার মন সুদূর অতীতে উপনীত হয় বলে চোখে দূরত্বের ভাব জাগে, কিন্তু প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারে না। অবশেষে ঈমান মিঞা বলে, না, কান্নাটি কী রকম সে জানে না, কেবল জানে কণ্ঠটা কোনো মেয়েমানুষের, এবং আওয়াজটা নদীর দিকে থেকেই এসেছিল।
কান্নার কথাটি অবিশ্বাস করার আর যেন উপায় থাকে না; একজন নয়, দুজন নয়, তিন-তিনটে লোক শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তা শুনতে পেয়েছে। সহসা কুমুরডাঙ্গার অনেকে এবার ঘোরতরভাবে শঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কে কাঁদে, কেন কাঁদে, এ কান্নার অর্থই-বা কী? এ-সময়ে কান্নাটি শুনবার জন্যে কারো-কারো মনে একটি প্রবল কৌতূহলও দেখা দেয়। হয়তো তারা ভাবে, কোথাও যদি সত্যিই কিছু শোনা যায় তবে তা নিজের কানে শুনতে পেলে তার রহস্যভেদ করতে সক্ষম হবে। অন্যের অগোচরে তারা কান্নাটি শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে শুরু করে, একা হলে একামনা সকর্ণতার মধ্যে দিয়ে, মানুষের কণ্ঠস্বর-মুখরিত স্থানে কাজে-কর্মে ব্যস্ত থাকলে থেকে-থেকে সমগ্র অন্তরে নিথর-নীরব হয়ে পড়ে, রাতে শুতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘুম ঠেকিয়ে নিশ্চলভাবে জেগে থাকে।
তাদের এই শোনার চেষ্টা বা তাদের এই অপেক্ষা ব্যর্থ হয় না, কারণ শীঘ্র একে একে তাদের মধ্যে অনেকেরই মনে হয় তারাও কান্নাটি শুনতে পেয়েছে।
ওষুধের দোকানের রুকুনুদ্দিন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল এমন সময়ে তার স্ত্রী সচকিতকণ্ঠে তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে সে কিছু শুনতে পাচ্ছে কিনা। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পেছরেন দেয়ালের পাশে কাঁঠালগাছে অসংখ্য পাখি কলরব তুলে হয়তো সারাদিনের খবরাখবর আদান-প্রদান করতে শুরু করেছে, দূরে রাস্তায় কোনো
গরুগাড়ি চাকায় ক্যাচর-ক্যাচর শব্দ করে বাড়ির পথ ধরেছে, তাছাড়া চতুর্দিকে গভীর নীরবতা, কোথাও কোনো শব্দ নেই। রুকুনুদ্দিন কিছু শুনতে না পেলেও তার স্ত্রী গভীর বিস্ময়ে কী যেন শুনে চলে। তারপর আওয়াজটি আর শুনতে না পেলে স্বামীর দিকে তাকিয়ে কেমন এক গলায় বলে, সে যেন কী-একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল।
বাজারের পথে তার দোকানে বসে মুদিখানার মালিক ফনু মিঞা ছাদ থেকে ঝোলানো লণ্ঠনের পতেটা একটু উঁকিয়ে দিতে যাবে এমন সময়ে সহসা সে চমকে ওঠে। প্রথমে তার মনে হয়, কোথাও একটা–সাঁ আওয়াজ উঠেছে। কিন্তু একটু কান পেতে শোনার পর বুঝতে পারে, আওয়াজটি যেন তীক্ষ্ম বিলম্বিত নারীকণ্ঠের কান্নার মতো যে-আওয়াজ ক্রমশ নিকটে আসছে বা হয়তো কেবল উচ্চতর হয়ে উঠছে। অবশেষে আওয়াজটি থামলে মুদিখানার মালিক লণ্ঠনের কথা ভুলে অনেকক্ষণ নিথর হয়ে থাকে।
শহরের অন্য পাড়ায় হবু মিঞা মুহুরির স্ত্রী জয়তুনবিবি কঙ্কালসার অসুস্থ ছেলের মুখে দাওয়াই দেবার চেষ্টা করছিল। ছেলের মুখে দাওয়াই দেয়া সহজ নয়; চামচ-ভরা ওষুধ নিয়ে অনুনয়-মিনতি করছে এমন সময়ে মুহুরির স্ত্রী হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে পড়ে, কারণ হঠাৎ সে শুনতে পায় অদূরে কে যেন বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে : কেমন মন উদাস করা করুণ সুর, তেমন উঁচু নয়। মধ্যে-মধ্যে দূরে কেউ বাঁশি বাজায়, তবে বেশ রাত হলেই বাজায়, তাও সচরাচর চাঁদনি-রাতে। মহুরির স্ত্রী শীঘ্র বুঝতে পারে আওয়াজটা ঠিক বাঁশির মতো নয়, তাতে সপ্তস্বরের খেলা নেই, কোনো সুর নেই, বাঁশি হলেও উচ্চ একটি সরে যেন থেমে রয়েছে। তারপর সে চমকে ওঠে, বুকের ভেতরটা সহসা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। তবে সে কি বিচিত্র কান্নাটি শুনছে? হৃদপিণ্ডের স্পন্দন আরো দ্রুততর হয়ে উঠে তারপর সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে, মনে কী-যেন একটা দুর্বোধ্য আলোড়ন উপস্থিত হয়। তবু যা সে শুনতে পায় তা স্পষ্টভাবেই শুনতে পায়, যা বাঁশির আওয়াজ নয় নারীর-কণ্ঠের কান্নার ধ্বনিঃ তীক্ষ্ম কিন্তু করুণ স্বর, গলাছাড়া আর্তনাদের মতো হলেও আবার গোপন-কান্নার মতো সংযত, অশ্রুহীন হাহাকার হলেও আবার বর্ষাসিঞ্চিত হাওয়ার মতো সজল।
সে-সন্ধ্যায় হয়তো কান্নাটি আর কেউ শোনে নি। তবে ততক্ষণে দুর্বোধ্য ব্যাখ্যাতীত কান্নাটি কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের অন্তরে পৌঁছে গিয়েছে, তা আর ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয় যেন। ধীরে-ধীরে অনেকে সময়ে-অসময়ে সে-কান্না শুনতে পায়, যে কান্না কখনো বাঁশঝাড়ে হাওয়ার মর্মরের মতো শোনায়, কখনো-বা বাঁশির রব ধরে, কখনো আবার রাতের অন্ধকারে পাখি-শাবকের কাতর আর্তনাদের মতো শুরু হয়ে অবশেষে বিলম্বিত রোদনে পরিণত হয়।
দু-দিন পরে কাছারি-আদালতের নিকটে এক-কামরার বার-লাইব্রেরিতে মধ্যবয়সী উকিল সুরত মিঞা বসেছিল। এ-ঘরে বসে কুমুরডাঙ্গার কতিপয় উকিলের মামলা যুদ্ধের ফন্দি-কাররবাই-এর সন্ধান করে, গল্পগুজব করে, চা-সিগারেট পান করে, গা ঢালা নিস্পন্দতায় চুপ করে থেকে আরাম করে, অথবা চতুষ্পার্শ্বের কলরব বা সামনের মাঠ থেকে জনতার যে-অত্যান্ত গুঞ্জন ভেসে আসে সে-গুঞ্জন অগ্রাহ্য করে নিন্দ্রা দেয়। ঘরের এক কোণে একটি আলমারিতে ঠাসা ইংরেজ-হিন্দুদের আমলের পুরাতন আইনের বই। তবে আলমারির কাঁচের দরজা অনেকদিন হল ভেঙে গিয়েছে বলে সে সব বইতে ধুলার প্রলেপ : সামনের ঘাসশূন্য, শুষ্ক মাঠ থেকে নিরন্তর যে-ধুলা ভেসে আসে সে-ধুলা ছোট ঘরটির সর্বত্র অবাধে বিচরণ করে একটি ঘন আবরণ ছড়িয়ে রাখে। কখনো-কখনো কেউ চৌকিদারকে ডেকে নিজের কুর্সিটা ঝেড়ে নিয়ে ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধান করে, ঘরের অন্যত্র দৃষ্টি দেয় না; যে-সমস্যা সর্বব্যাপী তার বিষয়ে উদাসীনতাই হয়তো বুদ্ধিসঙ্গত।
তবে সেদিন সুরত মিঞার দৃষ্টি যেন পড়ে ঘরের ধুলার দিকে। তার চোখ ঘুরতে থাকে চতুর্দিকে : মেঝে, বইঠাসা কাঁচশূন্য আলমারি, বিবর্ণ দেয়াল, কোণে স্থাপিত সুরাহি-কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না। এ-ধরনের অনুসন্ধান তার চরিত্রবিরুদ্ধ বলে শীঘ্র তা উপস্থিত সহযোগীদের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করে; পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে তো বটেই, জীবন সম্বন্ধেও সুরত মিঞা সম্পূর্ণভাবে নিস্পৃহ-যে-জন্যে কদাচিৎ মক্কেল তার শরণাপন্ন হয়।
কী দেখছেন? কেউ প্রশ্ন করে।
সে উত্তর দেয় না; তার চোখ পূর্ববৎ ঘুরতে থাকে। বস্তুত সে কিছু দেখবার চেষ্টা করে না, শুনবারই চেষ্টা করে; হঠাৎ সে যে-অস্বাভাবিক একটি শব্দ শুনতে পায় তা কোত্থেকে আসছে তাই বুঝবার চেষ্টা করে চতুর্দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। হয়তো ঘরের কোণে একটা ডানা-ভাঙ্গা পাখি এসে পড়েছে। বা ইঁদুর কি? কিন্তু আওয়াজটা যেন কেমন। ক্রমশ সুরত মিঞার চোখে-মুখে বিস্ময়াভিভূত ভাব সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, তারপর তাতে দেখা দেয় উপলব্ধির স্বচ্ছতা : এবার তার দৃষ্টি ধুলাচ্ছন্ন ছোট ঘরটি ত্যাগ করে খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘাসশূন্য মাঠ অতিক্রম করে নদীর দিকে যায়, কারণ সে দিক থেকেই আওয়াজটি যেন আসে। সে আর দেখে না, শুধু শোনে, কী একটা কান্না শোনে। ঘরময় ততক্ষণে গভীর নীরবতা নেবেছে, যেন অন্যেরাও কান্নাটি শুনতে পেয়েছে।
এ-সময়ে কেউ আবার জিজ্ঞাসা করে, কী হল সুরত মিঞা?
সুরত মিঞার চমক ভাঙে। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থেকে সজোরে মাথা নেড়ে বলে, কিছু না।
ডাক্তার বোরহানউদ্দিন নদীর তীরে বাস করলেও কান্নাটি নিজের কানে শোনে নি, তবে একদিন রাতের বেলায় তারই সামনে স্থানীয় স্কুলের হেডমাষ্টার তা বেশ স্পষ্টভাবে শুনতে পায়। স্বাস্থ্য সম্বন্ধে হেডমাষ্টারের উকট চিন্তা এবং প্রয়াশ নানাপ্রকার কল্পিত বা কিছু সত্য ব্যাধির দরুন গভীর মানসিক অশান্তিতে ভুগে থাকে। সে-রাতে ডাক্তার বোরহানউদ্দিনের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার দুর্বোধ্য ব্যাধির বিভিন্ন লক্ষণের সুদীর্ঘ বিবরণ দিচ্ছে-এমন সময়ে সহসা অস্বাভাবিকভাবে সে নীরব হয়ে পড়ে। প্রথমে তার মনে হয় কানে বুঝি ঝা-ঝা ধরেছে সেটি তার রোগের একটি নূতন লক্ষণ হবে। একটু অপেক্ষা করে কানে আঙ্গুল দিয়ে সে-আঙ্গুল ভীষণভাবে ঝাকে, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় না, ঝাঁ-ঝাঁ রবটি থামে না।
তারপর সহসা সে বুঝতে পারে।
এ কি সম্ভব? তারও কি মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে? ঘোর অবিশ্বাস সত্ত্বেও সে কিন্তু নিশ্চল হয়ে থাকে, ক্ষীণদেহ মানুষটির বড় ধরনের চোখ বিস্ফারিত হয়ে আরো বড় হয়ে ওঠে। তবে বিস্ময়ে নয়, ক্রোধে, কারণ সে-ও কান্নাটি শুনতে পেয়েছে মনে হলে নিজের ওপর তার ভয়ানক ক্রোধ হয়।
বোরহানউদ্দিনের দৃষ্টি লক্ষ্য করে অবশেষে ঈষৎ লজ্জা-লাল মুখে বলে, কানেও ঝাঁ-ঝাঁ ধরে মধ্যে-মধ্যে।
একদিন তবারক ভুইঞা বিস্মিত হয়ে তার স্ত্রী আমিরুনকে জিজ্ঞাসা করে, কী শুনছ?
আমিরুন মাথা হেলিয়ে শোনার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে ছিল, সচকিত হয়ে বলে, না, কিছু শুনছি না। তবে লোকেরা যে কী কান্না শুনতে পায়, সে-কথা ভাবছিলাম।
ওসব বাজে কথায় কান দিয়ো না। স্ত্রী আমিরুনকে সে ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলে।
কিন্তু এত লোক শুনতে পায় যে।
কোনো রকমের কানের ভুল বা খেয়াল হবে।
কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আমিরুন উত্তর দেয়, তবু কথাটায় মনটা কেমন-কেমন করে যেন।
লোকটির দিকে একবার আড়চোখে তাকাই এবং একদা তার চেহারার যে-বর্ণনা শুনেছিলাম সে-বর্ণনার সঙ্গে তার মুখটি মিলিয়ে দেখবার চেষ্টা করি। তবে বহুদিন আগে শোনা বর্ণনা থেকে একটি মানুষকে চেনা সহজ নয় : কারো চরিত্র বা মুখের চেহারা বহুদিন এক থাকে না, কালের স্পর্শ পড়ে দুটিতেই। তাছাড়া একদিন তার চেহারা-চরিত্রের যে-বর্ণনা শুনেছিলাম সে-সবের সঙ্গে সে-দিনই আসল লোকটির তেমন সাদৃশ্য ছিল কিনা কে জানে। যাকে কখনো দেখি নি যার কণ্ঠস্বর শুনি নি যার চলনভঙ্গি মুখভঙ্গি বা মুদ্রাদোষ লক্ষ্য করার সুযোগও পাই নি, পরের মুখে তার কথা শুনলে আমরা তাকে সাধারণত মনে সদা-মওজুদ মানুষ-চরিত্র সম্বন্ধে ছাঁচে-ঢালা নির্দিষ্ট কতকগুলি নকশার একটির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে লোকটি কেমন তা বুঝবার চেষ্টা করি। আমাদের সকলের মনে এমন কতকগুলি নকশা থাকে-মানুষ-চরিত্রের বিভিন্ন নিদর্শন। নানাপ্রকার দোষ-গুণের প্রতীক, যা আসলে মানবজাতি সম্বন্ধে আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা-মতামত ছাড়া আর কিছু নয় : আমরা কেউ মানবজাতির দিকে তাকাই আশার চোখে, কেউ নিরাশার, কেউ বিশ্বাসের চোখে, কেউ অবিশ্বাসের, কেউ প্রেমের চোখে, কেউ ঘৃণা-বিদ্বেষের; আমরা কখনো তাতে সর্বপ্রকারের দুই প্রবৃত্তি, কখনো আবার নিষ্কলঙ্ক ফেরেশতার গুণাবলি আরোপ করি। অতএব যার কথা শুনি ঠিক তাকে নয়, তার নামে আমাদের নিজস্ব মতামতই বলিষ্ঠ করি, মুষ্টিমেয় কয়েকটি নিদর্শনের মধ্যে যে সর্বচরিত্র সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে তা ভুলে গিয়ে মানুষ-চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের কিছু অনবগত নেই-সে-গর্বকে তুষ্ট করে আত্মতৃপ্তি লাভ করি। অজানা-অপরিচিত লোকটির কথা যে বলে তার বর্ণনাও দোষমুক্ত নয়, কারণ যে-মানুষ তার অন্তরপথে ঘুরে আবার বাইরে প্রকাশ পায় সে-মানুষ তার দৃষ্টিরঙে রঞ্জিত হয়ে পড়ে, নিঃস্বার্থ নিরপেক্ষ সততাও সে-রঞ্জন ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। কেউ যখন কারো কথা বলে তখন সে কেবল তার কথাই বলে না, দশজনের কথা এবং নিজের কথাও বলে; কাউকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করে বিচার করা সম্ভব নয়। বিস্ময় কী যে, যার বিষয়ে পরের মুখে শুনেছি তাকে যখন স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয় তখন দেখতে পাই কল্পনার লোকটির সঙ্গে তার সাদৃশ্য তেমন নেই, দুজন যেন ভিন্ন মানুষ।
তবে সন্দেহটি কেন আবার দেখা দিয়েছে, তা বুঝতে পারি। চেহারা বা চরিত্রের জন্যে নয়, সন্দেহ জাগে এই কারণে যে, সে এখনো একবারও মুহাম্মদ মুস্তফার নাম নেয় নি। তবে সে কি তবারক ভুইঞা নয়?
অল্পক্ষণ সন্দেহের দোলায় দুলে সে যে তবারক ভুইঞাই হবে-সে-বিশ্বাসটি আবার দৃঢ়বদ্ধ হয় আমার মনে। সঙ্গে-সঙ্গে বিস্ময়টিও বাড়ে। কেন তবারক ভুইঞা মুহাম্মদ মুস্তফার নাম নেবে না তা আমার বোধগম্য হয় না। অথচ যখন কুমুরাঙ্গার অধিবাসীদের মনে এই ধারণা জন্মেছিল যে চরা পড়ে থাকলেও স্টিমার-চলাচল বন্ধ হবার কারণ নেই এবং শীঘ্র স্টিমার ফিরে আসবে, তখন শহরবাসীদের নির্বুদ্ধিতার সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করতে প্রায়ই মুহাম্মদ মুস্তফার সঙ্গে সে দেখা করতে আসত। স্টিমারঘাট বন্ধ বলে তখন সে বেকার। তার বাড়িটা ছিল মুহাম্মদ মুস্তফার সরকারি বাংলোর পশ্চাতে, সুযোগ পেলে কারণে-অকারণে এসে হাজির হত। তারপর শহরবাসীরা কী একটা বিচিত্র কান্না শুনতে শুরু করার পর তার আসা-যাওয়াটা যেন বেড়ে যায়। ততদিনে সে মুহাম্মদ মুস্তফার চিত্ত জয় করে নিয়েছে; হাসি-খুশি সরলচিত্ত সশ্রদ্ধ, তার সুখসুবিধার বিষয়ে সদা সজাগ লোকটির প্রতি মুহাম্মদ মুস্তফার মনে কেমন একটা স্নেহভাব জেগে উঠেছিল। মনে হত তার খেদমত করার শখের অন্ত নেই যেন তবারক ভুইঞার। বস্তুত, একটি ইচ্ছা প্রকাশ করেছে কি অমনি তা পূর্ণ করার জন্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যেত, কোনো-কোনো সময়ে তার কী দরকার তো নিজেই লক্ষ্য করে দেখে যথাবিধি ব্যবস্থা করত।
এ-সময়ে শ্যাওলা-আবৃত ক্ষুদ্র পুকুরে খোদেজার মৃত্যুর কথা কেউ উল্লেখ করত–না তবারক ভুইঞা না মুহাম্মদ মুস্তফা। মুহাম্মদ মুস্তফা ধরে নিয়েছিল যে খোদেজার মৃত্যু সম্বন্ধে বাড়ির লোকেদের আজগুবি কথাটা তবারক ভুইঞা বিশ্বাস করে না। তেমন কথা বিশ্বাস করা কি সহজ? কে না জানে আপন হাতে নিজের প্রাণ নেওয়া কত কঠিন। একমাত্র সন্তান হারালেও অত্যন্ত স্নেহশীলা মাতা আত্মহত্যা করে না, জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে দিয়ে মর্মান্তিক শোক সহ্য করে নেয় কারণ জীবনের মায়ার চেয়ে বড় মায়া নেই, যতক্ষণ শ্বাস থাকে ততক্ষণ প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণের আশারও শেষ নেই। সে যদি বিশ্বাস করে খোদেজা আত্মহত্যা করেছিল-তাতেই-বা আপত্তি করা যায় কি? বাড়ির লোকেরাও কি তেমন একটি কথা বিশ্বাস করে না? তাছাড়া, বিশ্বাস করলেও অবাক হবার কিছু নেই। আত্মহত্যার চেয়ে অপঘাতে মৃত্যুর কথা গ্রহণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও মানুষের পক্ষে আপন প্রাণ নেয়া অত্যন্ত কঠিন বলে তা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি চমকপ্রদ, অনেক বেশি চাঞ্চল্যকর। আত্মহত্যার মধ্যে মানুষ সর্বপ্রধান, কিন্তু দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর মধ্যে সে কোরবানির গরু-ছাগলের মতো অসহায়। বিকৃত কোনো মানসিক অবস্থার সাহায্যে হলেও কেউ সেই চরম নিঃসহায়তার ঊর্ধ্বে উঠেছে-এমন কথা মনে আঘাত করলেও আবার চিত্তাকর্ষক। খোদেজা আত্মহত্যা করেছে তা যদি সে বিশ্বাস করে, তবে সে-জন্যেই করে।
তারপর একদিন সহসা মুহাম্মদ মুস্তফা নিজেই কথাটি তোলে কোনো কারণ ছাড়া। সে বলে, বাড়ির লোকেদের কথাটি ভাবছিলাম। কী করে তারা তেমন একটা কথা ভাবতে পারে বুঝি না।
তখন বেশ রাত হয়েছে। নিত্যকার মতো শুতে যাওয়ার আগে তবারক ভুইঞা নদীর ধারে একটু হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, এমন সময়ে মুহাম্মদ মুস্তফাকে দেখতে পেয়ে দু-দণ্ড আলাপ করবার জন্যে বারান্দার প্রান্তে এসে বসেছে, সিঁড়ির ধাপে পা। সহসা উত্তর না পেলে মুহাম্মদ মুস্তফা তার দিকে দৃষ্টি দেয়। অন্ধকারে তার চেহারা স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু মনে হয় উক্তিটি তার চোখে কী-একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে, যেন পানির গভীরে একটা বড় গোছর মাছ সন্ত্রস্তভাবে লেজ সঞ্চালন করাতে তার সামান্য আভাস দেখা দিয়েছে পানির বুকে।
তারপর হঠাৎ তবারক ভুইঞা মাথা নিচু করে, তার চোখ অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমিও তাই ভাবি।
এবার দু-জনেই নীরব হয়ে থাকে। একবার অল্প সময়ের জন্যে একটু হাওয়া ভেসে আসে নিঃস্পন্দ রাতের বুক থেকে, তার পালক-হাল্কা স্পর্শ লাগে মুখে-চোখে, রাস্তার পাশে নিমগাছের পাতায় মর্মরধ্বনি জাগে; সে-মর্মরধ্বনি যেন কিসের। প্রতিধ্বনি। একটু পরে মুহাম্মদ মুস্তফা অন্ধকারের মধ্যে আবার তবারক ভুইঞার দিকে তাকায়। লোকটি তখন দূরে কোথাও দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিথর হয়ে বসে। তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে এমন সময় মুহাম্মদ মুস্তফার মনে একটি বিচিত্র কথা দেখা দেয়। তার মনে হয়, সে জানে তবারক ভুইঞার দৃষ্টি কোথায়, জানে সে-দৃষ্টি কী দেখছে তাকিয়ে তাকিয়ে। তার দৃষ্টি একটি পুকুরের ওপর নিবদ্ধ। পুকুরটি শ্যাওলা-আবৃত বদ্ধ ডোবার মতো, যে-পুকুরে একটি মেয়ে ধীরে-ধীরে নাবছে। পাড় থেকে ধাপ-কাটা একটি নারকেলগাছের গুঁড়ির যে-সিঁড়ি পানির দিকে চলে গিয়েছে, সেটা বেয়ে নাবছে। এক ধাপ, দুই ধাপ-পাশাপাশি করে রাখা দুটি পায়ে সন্তর্পণে কিন্তু অনায়াসে সে নেবে যাচ্ছে। অনেকদিনের অভ্যাসের ফলে। এবার তৃতীয় ধাপ। সে-ধাপের পরে কালো পানি, নিস্তরঙ্গ বদ্ধ পানি। মেয়েটি নেবেই চলে। প্রথমে হাঁটুপানি-তারপর কোমরপানি, অবশেষে বুক পর্যন্ত ওঠে সে-পানি। এবার মেয়েটি আর না নড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, দৃষ্টি কালো পানির দিকে। যেন তার মধ্যে দ্বিধা-সংশয় দেখা দিয়েছে, যেন এবার কী করবে তা সে ঠিক বুঝতে পারছে না, তার গাঢ় শ্যামল ক্ষুদ্র মুখাবয়বে নিথর ভাব। তারপর হঠাৎ সে এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেন পেছন থেকে কেউ তাকে ধাক্কা দিয়েছে, মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ নিঃসৃত হয়। শীঘ্র তার মাথা, মাথার উপরাংশ, তারপর মাথার যে-চুল পানিতে ছড়িয়ে পড়েছিল সে-চুল অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু আবার তাকে দেখা যায়, কারণ সে ভেসে ওঠে। হয়তো অল্পক্ষণ সে ভয়ানকভাবে হাত-পা নাড়ে, ভেসে থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু ক্রমশ তার দেহ স্তব্ধ হয়ে পড়ে, কাঠের মতো, তারপর পাথরের মতো। এবং একবার তার দেহ পাথরে পরিণত হলে চোখের পলকে সে শ্যাওলা-আবৃত বদ্ধ পানিতে অদৃশ্য হয়ে যায়। এভাবেই কি মানুষ পানিতে ডুবে মরে?
মুহাম্মদ মুস্তফা নিজেকে সংযত করে। তবে তার মনে হয় সহসা তার তন্দ্রাভঙ্গ হয়েছে। সে কি তার অগোচরে ঘুমিয়ে পড়েছিল? রাত্রি পূর্ববৎ নীরব, কেউ কোথাও নেই, সিঁড়ির ধাপে পা রেখে যে-লোকটি বসে-সে-ও যেন নেই। সচকিত হয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালে সে তাকে দেখতে পায়। সেখানে শুধু যে বসে তা নয়, কেমন একটা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সে। সহসা মুহাম্মদ মুস্তফা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে।
যাই, শুয়ে পড়ি গিয়ে। আড়মোড়া ভেঙ্গে মুহাম্মদ মুস্তফা বলে, তৎক্ষণাৎ উঠেও পড়ে। তবে সে-রাতে ঘুমোতে গিয়েও মুহাম্মদ মুস্তফা সহজে ঘুমাতে পারে না। বার বার তবারক ভুইঞার কথাই তার মনে আসে। সে যে-কথা বলেছিল তা যে সত্য নয় তা বলামাত্রই বুঝেছিল, তা অপ্রত্যাশিতও মনে হয় নি। তবু সে-কথা তাকে কেমন নিপীড়িত করে যেন।