৭. চিকু মরেনি

অধ্যায়: ৭

চিকু মরেনি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বুলটন যখন চায়ের কাপটা নিয়ে লোহার চেয়ারটায় বসেছে, তখন ভয়ডরহীন চিকু টিভির টেবিলের তলা থেকে লাজুক মুখটা বের করে তার দিকে চেয়ে যেন একটু মেপে নিল তাকে। রোজই তার মাপজোক নেওয়া চিকুর স্বভাব। হেভি চালাক। মুখখানা ভালমানুষিতে মাখানো, এরাই বজ্জাত হয় বেশি। মেঝেয় কিছু একটু খাবারের টুকরো খুঁজে পেয়ে চিকু বোধ হয় ব্রেকফাস্ট সেরে নিচ্ছিল। বুলটন তার দিকে চেয়ে বলেই ফেলল আজ, “চিকু, রোজ কারও সমান যায় না, বুঝলি! আমারও দিন আসবে। আর তুই তো অমর নোস।”

চিকু কী বুঝল কে জানে। বুলটনের দিকে চেয়ে বোধ হয় বলল, ফোট শালা, মস্তানি অন্য জায়গায় দেখাস।

বুলটনকে অবশ্য ফুটতেই হল। ডিউটি।

ঘোষালবাবু আমেরিকায়। তাঁর দামি হাম্বার গাড়িটা এখন বুলটনের হেফাজতে। বারবার বলে গেছেন রোজই যেন গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে একটু চালিয়ে আনে বুলটন। নইলে গাড়ি বসে যায়, ব্যাটারি ডাউন হয়ে থাকে। বুলটন গাড়িটা আজ স্টার্ট দিয়ে দেখল তেলের কাঁটা এম্পটি দেখাচ্ছে। টাকা দিয়েই গেছেন ঘোষাল সাহেব। তারা, অর্থাৎ বুলটনরা যে ক্লাসে বিলং করে সেই ক্লাসের ছেলেরা আর কিছু না হোক গাড়ি চালানোটা শিখে রাখে, বলা যায় না, অন্তত ড্রাইভারের চাকরি হয়তো পাওয়া যাবে। গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বুলটন। শব্দহীন মসৃণ গাড়ি। পঁচাত্তর লাখের জিনিস। চালিয়েও আরাম। সেলিমপুর পাম্পে তেল ভরে সে অনেকটা চালাল আজ। গল্‌ফ গ্রিন পর্যন্ত। মনটা ভাল ছিল না ক’দিন, ভাল হয়ে গেল। সেই যে বাউন্সারের চাকরি ছেড়ে ফিরে এল, তারপর একদিনও বুলা আসেনি। ভয়ে ফোনও করে না সে। কী না কী মনে করবে। লাভ অ্যাফেয়ার তো আর নয় রে বাবা! যদি বলে বসে, এত আঠা কীসের তোমার বলো তো! নিজের প্রেস্টিজ নিজের কাছে। ফিরে এসে গাড়িটা জায়গায় রেখে অনেকক্ষণ গাড়িতেই বসে রইল সে। মাঝে-মাঝে তার নিজেকেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে বাউন্সারের চাকরিটা কেনই-বা নিল না সে? এতকালের একটা ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাচ্ছিল, তবু পিছিয়ে এল কেন? সে কি বুলার জন্য! শুধু বুলা বারণ করেছিল বলে! তা হলে বুলা কে? কতখানি? এসব প্রশ্ন খুব বিপজ্জনক, কারণ এর জবাব খুঁজতে গেলে বোধ হয় শেষে নিজেকে আহাম্মক বলেই মনে হবে তার। হাসির পাত্র বলে মনে হবে হয়তো। গাড়িটা লক করে নেমে এল বুলটন। ল্যান্ডিংয়ে প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসে ঘটনাহীন ফ্যাকাসে একটা দিন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল।

কখন যে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে। তার দোষ নেই। নিষ্কর্মা বসে থাকলে ঘুম তো পাবেই। টেবিলের ওপর মাথাটা হাতের বালিশে রেখে হিজিবিজি স্বপ্নও দেখছিল সে। কে খুব নরম করে আলতো হাতে মাথাটা ছুঁয়ে খুব নিচু গলায় বলল, “ওঠো!”

বুলটনের ঘুম খুব সজাগ। টক করে মাথা তুলতেই বুলা হেসে ফেলে বলে, “এই বুঝি সিকিওরিটি গার্ড?”

বুলটন এত চমকে গিয়েছিল যে, মাথা কাজ করছিল না। একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি!”

বুলা পাশের চেয়ারটায় বসে বলে, “কিছু ভাল লাগছিল না আজ। টানা কাজ করতে করতে হঠাৎ মনে হল এবার একটু হাঁফ ছাড়া দরকার। ভাবলাম, যাই, আমার বাউন্সার সাহেবের সঙ্গে একটু আড্ডা মেরে আসি। মুখটা অমন শুকিয়ে গেছে কেন বলো তো! টিফিন খাওনি?”

“না, এখনও সময় হয়নি।”

“তা হলে আজ আর টিফিন খেতে হবে না। চলো, আজ সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের চাইনিজ় দোকানে দু’জনে খেয়ে আসি। যাবে? আমার হাতে আজ অনেক টাকা এসে গেছে।”

বুলটন হাসল। বলল, “যাব।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *