৭. চক্রান্তের মূল নায়করা

চক্রান্তের মূল নায়করা

পলাশি চক্রান্তের উদ্ভব ও বিকাশ সম্যক উপলব্ধি করতে হলে, এই চক্রান্তের মূল নায়কদের সম্পূর্ণ পরিচয় ও তাদের ধ্যানধারণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রতিপাদ্য, যেহেতু ইংরেজরাই পলাশি ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা এবং তাদের সক্রিয় সমর্থন ও উৎসাহ ছাড়া পলাশির চক্রান্ত পরিপূর্ণতা লাভ করে বিপ্লব ঘটাতে পারত না, তাই ইংরেজদের মধ্যে যারা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল তাদের নিয়ে প্রথমে আলোচনা করব, পরে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের। ইংরেজদের মধ্যে যে তিনজন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা হলেন উইলিয়াম ওয়াটস, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন ও রবার্ট ক্লাইভ।

উইলিয়াম ওয়াটস

ওয়াটস ছিলেন কাশিমবাজার কুঠির প্রধান। যেহেতু কাশিমবাজারের অনতিদূরেই রাজধানী মুর্শিদাবাদ, তাই তিনি নবাবের দরবারে ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধিও ছিলেন। ফলে, বাংলায় ইংরেজদের মধ্যে তাঁরই সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল দরবারের সব খোঁজখবর রাখার। তা ছাড়া, এই সময় বাংলায় ইউরোপীয়দের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানির প্রধান হিসেবে বাংলার তিন প্রধান বণিকরাজার (merchant prince)—জগৎশেঠ পরিবার, খোজা ওয়াজিদ ও উমিচাঁদ—সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ কাশিমবাজার ছিল তখন বাংলার সবচেয়ে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র—বিশেষ করে বাংলার দুই প্রধান রফতানি পণ্যের—কাঁচা রেশম ও বস্ত্র—উৎপাদন ও ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে। তা ছাড়া খুব সম্ভবত দরবারে ইংরেজ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সঙ্গে দরবারের প্রধান প্রধান রাজপুরুষের—মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, প্রমুখ—ভাল রকম যোগাযোগই ছিল। ফলে নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাবার পক্ষে ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি থেকে তার প্রমাণ মেলে। আমরা আগেই দেখেছি, স্ক্র্যাফ্‌টন লিখেছেন, ক্লাইভ যদি ওয়াটসকে একটু ইঙ্গিত ও উৎসাহ দেন তা হলে ওয়াটস সঙ্গে সঙ্গে ‘একটি ‘দল’ [party] [নবাবের বিরুদ্ধে] গড়তে লেগে যাবেন।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন যে ক্লাইভ ওয়াটসকে ইংরেজদের সমর্থনে দরবারে একটি চক্র তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। এতেই পলাশি ষড়যন্ত্রের সুত্রপাত।

স্ক্র্যাফ্‌টনের লেখা থেকে জানা যায়, বাংলায় বহুদিন থাকার ফলে এখানকার রাজনীতি, ভাষা ও রীতিনীতি সম্বন্ধে ওয়াটসের যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল। তাতে ইংরেজদের খুব সুবিধে হয়েছিল কারণ তাদের মধ্যে এমন একজন ছিলেন যাঁর এই দেশ ও এখানকার লোকজন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা ছিল এবং যিনি দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সোজাসুজি যোগাযোগ করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো সম্ভব কি না সে সম্বন্ধে তাদের চিন্তাভাবনা যাচাই করে নিতে পারেন। ওয়াটসই ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে পরামর্শ দেন যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করার কাজ চালিয়ে যেতে কারণ তাঁর ধারণা হয়েছিল যে নবাব আলিবর্দি ব্যাপারটা খেয়ালই করবেন না। তিনি কাউন্সিলকে এ-ভরসাও দিয়েছিলেন যে, তিনি এ-বিষয়ে সজাগ থাকবেন এবং এটা নিয়ে নবাবের সঙ্গে কোনও ঝামেলা হলে তার জন্য কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্যের যাতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে তা তিনি দেখবেন। আবার ইংরেজরা যখন চন্দননগর আক্রমণ করার কথা ভাবছিল এবং কীভাবে এতে এগুনো যাবে তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছিল, তখন ওয়াটসই সমস্যার সমাধানে সাহায্য করলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন:

As Mr. Watts was on the spot, watched every motion of the Suba [Sirajuddaullah], knew exactly the character of his courtiers and prin- cipal Ministers, and had the most certain Intelligence of everything that passed, he continued to represent the Necessity of attacking Chandernagore.

ওয়াটস ঘটনাস্থলে থাকার ফলে নবাবের কাজকর্মের ওপর নজর রাখতে পারতেন এবং দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের চালচলন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহালও ছিলেন। দরবারে যে সব ঘটনা ঘটত সব তাঁর নখদর্পণে ছিল। তাই তিনি বারবার চন্দননগর আক্রমণ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি সবিস্তারে এটাও জানিয়েছেন কীভাবে তিনি নবাবের মুৎসুদ্দিকে ঘুষ দিয়ে নবাবের নামে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে লেখা চিঠির এমন বয়ান করিয়েছিলেন যাতে ওই চিঠির অর্থ দাঁড়ায় যে নবাব ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ করার অনুমতি দিচ্ছেন।

পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও বিকাশে ইংরেজদের মধ্যে ওয়াটসই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনিই উমিচাঁদের সাহায্যে দরবারের বিক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট রাজপুরুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ধীরে ধীরে তাদের অনেককে ইংরেজদের দলে টেনে আনতে সমর্থ হন। রবার্ট ওরম লিখছেন যে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোর ব্যাপারে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখার জন্য ওয়াটসই উমিচাঁদকে কাজে লাগান এবং এর ফলেই ইয়ার লতিফ ওয়াটসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করতে চান। ওয়াটস তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে উমিচাঁদকেই ইয়ার লতিফের কাছে পাঠান। লতিফ উমিচাঁদকে তাঁর বাসনার কথা জানান—সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে তিনি নিজে নবাব হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। ওরম যদিও বলছেন যে, মীরজাফর আর্মানি বণিক খোজা পেট্রুসের মারফত তাঁর প্রস্তাব ওয়াটসকে জানান, ওয়াটস নিজে কিন্তু তাঁর পিতাকে পরে লিখেছেন যে তিনি নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে ষড়যন্ত্রে সামিল করেছিলেন।

কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ নবাবের দরবারের রাজনীতি এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। সেই ল’ পলাশি চক্রান্তে ওয়াটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন:

দরবারে ইংরেজদের সপক্ষে ছিল তাদের অস্ত্রবল, সিরাজদ্দৌল্লার ভুলত্রুটি, শেঠদের অমিত প্রভাব ও সূক্ষ্ম কূটনীতি। তা ছাড়াও তাদের পক্ষে ছিল নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রায় সব সেনাপতি ও দরবারের প্রায় সব অমাত্য, এমনকী মুৎসুদ্দি ও ওয়াকিয়ানবিশরাও। এই সবগুলি শক্তিকে একত্রিত করে তাদের চালাবার জন্য ওয়াটসের মতো এমন একজন সুচতুর ব্যক্তি যখন ছিলেন, তখন ইংরেজরা কি না করতে পারত।

ওয়াটস কীভাবে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেছিলেন তার বর্ণনা নিজেই দিয়েছেন:১০

তিনি [ওয়াটস] বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ও আলাপ আলোচনার কথা সবিস্তারে [কর্তৃপক্ষকে] জানিয়েছেন। তা ছাড়াও নবাবের তখনকার অবস্থা, তাঁর কাছাকাছি প্রধান অমাত্যদের চিন্তাভাবনা, শক্তিসামর্থ্য, ধ্যানধারণা ও কামনাবাসনার কথাও বিশদভাবে জানানো হয়েছে। সঙ্গে এটাও যে [আমাদের] পরিকল্পনা [সিরাজের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসানো] সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এটা করতে গেলে যে-সব বাধা বিপত্তি আসতে পারে এবং তা কী করে প্রতিহত করা যেতে পারে তাও তিনি জানিয়েছেন।

তবে ওয়াটস বিচক্ষণ বলে সতর্কতার সঙ্গে এগোতে চেয়েছিলেন। মীরজাফরকে নবাব করার প্রস্তাবে ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটির উত্তর আসার জন্য যখন তিনি অপেক্ষা করছিলেন, তখন ক্লাইভকে লেখেন, তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করে ক্লাইভ যেন অন্য কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ না করেন। কারণ তিনি ঘটনাস্থলে আছেন বলে এবং দরবারের হালচালের সব খবর রাখেন বলে ‘আমাদের’ (ইংরেজদের) পরিকল্পনা রূপায়ণ করা যাবে কিনা এবং তা কী করে সুসম্পন্ন করা যাবে, সে সম্বন্ধে তিনিই সবচেয়ে ভাল বোঝেন।১১ পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ও কাউন্সিল তাঁকে সরকারিভাবে ধন্যবাদ জানান।১২ ক্লাইভও লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লেখেন যে ওয়াটসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা না বললে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হবে না।১৩

লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন

পলাশি ষড়যন্ত্রে ওয়াটসের পরে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন। ইংরেজরা এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার আগে স্ক্র্যাফ্‌টন ঢাকায় ইংরেজ কুঠির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভই তাঁকে ঢাকা থেকে আনিয়ে মুর্শিদাবাদে পাঠান। আসলে ওয়াটসের মতো সতর্ক ও কিছুটা ভীরু লোকের চাইতে স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো তারুণ্য ও উৎসাহে ভরতি যুবককে ক্লাইভের বেশি পছন্দ ছিল। স্বভাবতই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনের মধ্যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হত না। তাই ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল মুর্শিদাবাদ থেকে স্ক্র্যাফ্‌টনকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু ক্লাইভ তাতে কিছুতে রাজি হননি। কাউন্সিল অবশ্য জানিয়ে দিল যে ওখানকার সব ব্যাপারের তত্ত্বাবধানে থাকবেন ওয়াটসই।১৪ স্ক্র্যাফ্‌টন মুর্শিদাবাদে উমিচাঁদের সঙ্গে বরাবর যোগাযোগ রেখেই চলতে লাগলেন এবং তার মতে, উমিচাঁদ ইংরেজদের জন্য যা করছেন, তাতে তাঁর যথেষ্ট প্রশংসা প্রাপ্য। তিনি প্রায়ই উমিচাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং তাঁর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনা হচ্ছিল, যদিও উমিচাঁদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার পরিকল্পনা করার জন্য ওয়াটসকেই ভার দেওয়া হয়েছিল। স্ত্র্যাফ্‌টন কিন্তু ওয়াটসকে নেহাত ‘গোবেচারি’ [simpleton] বলেই মনে করতেন।১৫

ওয়াটস ক্লাইভকে ২৩ এপ্রিল জানাচ্ছেন যে তিনিই উমিচাঁদকে ইয়ার লতিফের কাছে পাঠিয়েছিলেন কারণ লতিফ নবাব হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্‌টনই ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর মনে হয়, উমিচাঁদ ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা জানাতে জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। এ-ব্যাপারে তিনি বেশ উত্তেজিতই বোধ করেন, যেটা ওয়াটস করতেন না। তিনি ওয়ালসকে লিখছেন:১৬

আমার মনে হয় আমি স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য কিছু একটা করতে উদ্বুদ্ধ বোধ করছি। আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হলে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, দশদিনের মধ্যে আমি এমন ব্যবস্থা করতে পারি যাতে আপনারা উত্তর দিক থেকে যাত্রা করে দু’দিন এগুলেই এক বিরাট বাহিনী আপনাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আপনাদের কী শর্ত [সন্ধির] তা আমাকে জানান, আমি কথা দিচ্ছি আমার যথাসাধ্য আমি করব।

স্ক্র্যাফ্‌টন এতেই ক্ষান্ত হননি। শর্তগুলি কী হওয়া উচিত তিনি নিজেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। আসলে তিনি ওয়াটসের চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ওয়ালসকে তিনি ২০ এপ্রিল লেখেন:১৭

আমাদের অবস্থা মানুষের শরীরে একটা দুষ্ট ক্ষতের মতো, যেটা বাইরে থেকে শুকিয়ে যাবে মনে হবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে পচে পুঁজ হতে শুরু করেছে। দক্ষ চিকিৎসকের মতো আমাদের এর সুরাহা করতে হবে। ক্ষতস্থান কেটে তার মধ্যে থেকে সব পচা জিনিস বার করে একেবারে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।

কিন্তু সরকারিভাবে ওয়াটসের অধঃস্তন হিসেবে কাজ করতে হত বলে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি ওয়ালসকে সতর্ক করে দেন, তিনি যে-সব খবরাখবর পাঠান সেগুলি যেন ওয়াটস ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারেন। তা ছাড়াও তিনি ওয়ালসকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন উমিচাঁদকে তাঁর সঙ্গে মিলে কাজ করার জন্য একটা চিঠি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালসকে এটাও জানিয়ে দেন যেন এ-সব কিছু গোপন থাকে এবং সিলেক্ট কমিটিকে যেন কিছুই না জানানো হয়। এই পর্যায়েও, যখন ষড়যন্ত্র দানাই বাঁধেনি, তিনি কিন্তু বিপ্লব সফল হওয়া সম্বন্ধে বেশ আশাবাদীই ছিলেন এবং ওয়ালসের মাধ্যমে ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ তৈরি হওয়া পর্যন্ত একটু ধৈর্য ধরে থাকুন—এটা অল্প কিছুদিনের ব্যাপার। মাত্র।’১৮

স্ক্র্যাফ্‌টনের নিজের অবশ্য ধৈর্য বিশেষ ছিল না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে তিনি খুবই উত্তেজিত বোধ করতে থাকেন। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদ যখন সবেমাত্র সিরাজদ্দৌল্লার বিকল্প নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফকে জোগাড় করতে পেরেছেন কিন্তু ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা কিছুই বিশেষ তৈরি হয়নি, তিনি কিন্তু ওয়ালসকে লিখে বসলেন (২১ এপ্রিল ১৭৫৭):১৯

আমার মাথার মধ্যে এখন রাজনীতির চিন্তা কিলবিল করছে, আমার ঘুম হচ্ছে না। নানা পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরছে। ওয়াটসের কিন্তু এরকম অবস্থা হয়নি। তিনি চিন্তাভাবনা দূরে সরিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। আমার কিন্তু তা হবার জো নেই। খারাপ কিছু হলেও আমি কিন্তু মোটেই ভয় পাব না—ভয় পাওয়ার লোক আমি নই।

ওয়ালসের মাধ্যমেই তিনি সব কিছু ক্লাইভকে জানাতেন। কিন্তু ২৪ এপ্রিল তিনি সোজা ক্লাইভকে চিঠি লিখলেন কারণ ‘ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানালেন যে নবাব কিছুতেই ইংরেজদের রেহাই দেবেন না, সুযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন। একই সঙ্গে তিনি ক্লাইভকে ওয়াটসের ভীরুতার সম্পর্কে সতর্ক করে দেন এবং বিপ্লবের ব্যাপার কতটা এগিয়েছে তা জানান। তিনি লেখেন:২০

ওয়াটস কখনও এ-সব ব্যাপারে লেখার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেননি। উপরন্তু আমি যখন তাঁকে সব জানালাম তখন তিনি আমাকে দোষারোপ করলেন যে আমি নাকি ঘোঁট পাকাচ্ছি। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নেই। উমিচাঁদ বরং আমার মতো একজন লড়াকুকে পেয়ে খুব খুশি। তাঁর মাথায় মস্ত বড় একটা প্ল্যান কাজ করছে। তিনি আমাকে গতকাল বলেছেন, তাঁকে খুব গোপনীয়তার সঙ্গে এগুতে হবে কিন্তু আমরা যেন প্রস্তুত থাকি—সময় হলেই তিনি আপনাকে সব জানাবেন। ব্যাপারটা কী আমি বেশ আন্দাজ করতে পারছি—তা হচ্ছে জগৎশেঠের সঙ্গে মিলে লতি[ফ]কে নবাব করা….মহাশয়, আপনাকে এও জানাচ্ছি ওয়াটসের মতো ভীরু লোকের ওপর নির্ভর করলে আপনার [অর্থাৎ ইংরেজদের] সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।

কিন্তু তিনি যেহেতু ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা নিতে চেয়েছিলেন, তাই ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন তিনি যেন উমিচাঁদকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস না করেন, এবং তাঁকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন উমিচাঁদকে লেখেন যাতে উমিচাঁদ পুরো পরিকল্পনার কথা তাকে [স্ক্র্যাফ্‌টনকে] খুলে বলেন।

এ সময় কোম্পানির অন্যান্য কর্মচারীর মতো স্ক্র্যাফ্‌টনও ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। ক্লাইভকে একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে ক্লাইভের নির্দেশে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য [পলাশির ষড়যন্ত্র করার?] তাঁকে ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ চলে আসতে হওয়ায় তাঁর ব্যক্তিগত কাজে [ব্যবসায়?] যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। ক্লাইভকে তিনি অনুরোধ করেন সিলেক্ট কমিটিকে জানাতে যে তিনি মুর্শিদাবাদে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সমাধা করার জন্যই ওখানে চলে এসেছিলেন এবং সেজন্যই লখিপুর [Luckipore] কুঠির প্রধানের কাজটি গ্রহণ করতে পারেননি, যদিও এই পদটি বাংলায় কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ। বলা বাহুল্য, লখিপুরে ব্যক্তিগত ব্যবসার সুযোগও অনেক বেশি ছিল যার জন্য পদটি খুব লোভনীয় বলে গণ্য হত। তাই স্ক্র্যাফ্‌টন ক্লাইভকে জানিয়ে রাখেন তিনি যেন সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেন, মুর্শিদাবাদের কাজটি সম্পন্ন হলে তাঁকে যেন অন্তত ঢাকায় ফিরে যাবার [লখিপুরের পদটি ততদিনে শূন্য থাকবে না বলে হয়তো] অনুমতি দেওয়া হয়। ঢাকায় ফিরে যাবার জন্য তাঁর ব্যগ্রতা থেকে অনুমান করা সহজ যে তিনি ওখানে ব্যক্তিগত ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন।২১

রবার্ট ক্লাইভ

ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন যখন ঘটনাস্থল থেকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করার চেষ্টায় ব্যস্ত, তখন ক্লাইভ দূরে অন্তরাল থেকে সবকিছুর তদারকি করছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেবার পর যখন মাদ্রাজ থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠানো হল, তখন ক্লাইভকে শুধু সমর বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার দেওয়া হয়নি, বাংলায় কোম্পানির রাজনৈতিক ব্যাপারেও উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য তাঁকে কলকাতার সিলেক্ট কমিটির—যার সদস্য ছিলেন তিনি, গভর্নর ড্রেক, ওয়াটস, ম্যানিংহাম ও রিচার্ড বেচার—সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানানো হয়েছিল যে প্রয়োজন হলে ওই কমিটিকে অগ্রাহ্য করেও কাজ করার স্বাধীনতা তাঁকে দেওয়া হল।২২

ক্লাইভ প্রথমদিকে কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মচারীই ছিলেন কিন্তু করমণ্ডলে তাঁর নেতৃত্বে ইংরেজদের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিজয়ের পর তিনি রাতারাতি খ্যাতনামা হয়ে যান। স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন:২৩

কর্নেল ক্লাইভ সাধারণ কর্মচারী হয়েও করমন্ডল উপকূলে যুদ্ধ করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। ওখানে কোম্পানির অবস্থা বেশ সংকটজনক হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ফরাসিদের বেশ কয়েকবার পরাজিত করে ওখানে কোম্পানিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। সম্প্রতি তিনি অ্যাংগ্রিয়াদের (Angria) বিরুদ্ধে সফল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং এখন যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই বাংলায় কোম্পানির একটা সুরাহা করতে এসেছেন।

আসলে ক্লাইভ কিন্তু মোটেই প্রতিভাসম্পন্ন সেনানায়ক ছিলেন না, যদিও তখনকার ফারসি ইতিহাসে তাঁকে ‘সবিৎ জঙ্গ’ বা ‘সাহসী, যুদ্ধজয়ী’ (‘the brave, tried in battles’) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।২৪ বাংলায় এসে বজবজে রাজা মানিকচাঁদের সঙ্গে তাঁর যে প্রথম সংঘর্ষ হয়, তাতে সমরনায়ক হিসেবে তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও কুশলতার তেমন পরিচয় পাওয়া যায়নি। একটু শরীর খারাপ হলেই তিনি সহজে মুষড়ে পড়তেন। তাঁর রোগ রোগ একটা বাতিক ছিল (hypocondriac) এবং সর্বক্ষণই তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন। প্রায়ই তিনি নিরাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি খুব তাড়াতাড়ি এ-সব কাটিয়ে উঠতে পারতেন। কিছুদিন আগে তাঁর এক জীবনীকার লিখেছেন:২৫

ক্লাইভ কিন্তু মোটেই যোদ্ধা ছিলেন না। যুদ্ধ বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও ছিল খুব সীমিত। তাঁর সমসাময়িক সমরনায়কদের দক্ষতার মান বেশ নিচুই ছিল। তাঁদের তুলনায়ও তাঁকে খুব একটা উন্নতমানের সৈন্যাধ্যক্ষ বলা যায় না। বস্তুতপক্ষে তিনি গেরিলাযুদ্ধে সাফল্য লাভ করেই সুনাম অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এ-সব সাফল্য সত্ত্বেও তিনি দক্ষ সেনানায়ক হয়ে উঠতে পারেননি।

বাংলায় অভিযাত্রী দলের সর্বাধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ায় ক্লাইভ খুবই পুলকিত হন এবং এই অভিযানের মাধ্যমে অনেক কিছু সম্পন্ন করার উচ্চাভিলাষ তাঁর মনে জাগে। যেদিন তিনি ওই পদে নিযুক্ত হওয়ার খবর পেলেন সেদিনই লন্ডনে সিক্রেট কমিটিকে তিনি লেখেন (১১ অক্টোবর ১৭৫৬): ‘আমি গর্ব করে বলতে পারি শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার করে এই অভিযানের কাজ শেষ হবে না—কোম্পানির জন্য এমন ব্যবস্থা করতে পারব যা আগের চেয়ে শুধু অনেক ভালই হবে না, আগে কোনওদিন যা হয়নি তাই এবার হবে।’২৬ মাদ্রাজ থেকে যাত্রা করবার আগেই তিনি লেখেন যে ‘সিরাজদ্দৌল্লা একজন দুর্বল নবাব এবং তাঁর দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশ তাঁর প্রতি বিরূপ।’২৭ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তাকে কাজে লাগিয়ে, ক্লাইভের ভাষায়, ইংরেজরা ‘রাজনীতির দাবা খেলায় বাজিমাৎ করেছিল’ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল। ক্লাইভ যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘বাংলায় এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব’, তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না।২৮ এখানে উল্লেখযোগ্য, পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে কলকাতার ইংরেজ ইঞ্জিনিয়র কর্নেল স্কট বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনার যে প্ল্যান তৈরি করেছিলেন, ক্লাইভ ও ওরম দু’জনেই সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন এবং এই পাণ্ডুলিপিটি তখন মাদ্রাজেই ছিল, যেখানে তখন ওঁরা দু’জনও ছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভ যখন ১৭৪৯-৫০-এর শীতকালে কলকাতায় এসেছিলেন, বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তখন তাঁর মনে প্রচণ্ড রকমের দাগ কেটেছিল। তিনি খুব সম্ভবত মনে মনে ভাবছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।২৯ এই পরিপ্রেক্ষিতেই বাংলা বিজয়ের আগে তাঁকে মাদ্রাজ থেকে ডেকে পাঠাতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ দেখা গেছে তা সহজে বোধগম্য।

ক্লাইভ তথা ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে যে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল—যা আমরা আগেই বিশদভাবে আলোচনা করেছি—তা হল তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভ লোকসানের খতিয়ান। এ-বিষয়ে এর আগে কখনও দৃষ্টিপাত করা হয়নি। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ তাঁর পিতাকে লেখেন যে ডডিংটন (Doddington) জাহাজ ডুবে যাওয়ার ফলে তাঁর প্রায় তিন হাজার পাউন্ড ক্ষতি হয়েছে (খুব সম্ভবত ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিয়োজিত) এবং তাঁর ভয় যে বাংলায় তাঁর ক্ষতির পরিমাণ (সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের ফলে) আরও বেশি হবে।৩০ এ-সব থেকে স্পষ্ট যে তিনি ব্যক্তিগত বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। বস্তুতপক্ষে কলকাতা পুনরুদ্ধার করার ক’দিন আগে, সম্ভবত যখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার হিসেবপত্র পান, তখন তিনি তাঁর পিতাকে আবার লেখেন যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের ফলে তাঁর ক্ষতির পরিমাণ আড়াই হাজার পাউন্ডের কম নয়।৩১ তা ছাড়া মনে হয় যে বাংলায় অভিযানকে তিনি তাঁর কিছু ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণ করার উপায় হিসেবেও দেখেছিলেন। কলকাতা পুনরুদ্ধার ও নবাবের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি সম্পাদন (৯ ফেব্রুয়ারী ১৭৫৭) করার পর তিনি তাঁর পিতাকে লেখেন:৩২

আমার এই সাফল্যে যেহেতু কোম্পানি খুব বেঁচে গেছে, সেজন্য আমার নিজের স্বার্থ গুছিয়ে নেবার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। আমি লর্ড চ্যান্সেলর, আর্চবিশপ, মি. ফক্স (Fox) ও যুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী লর্ড ব্যারিংটনকে আমার দিকটা দেখতে লিখেছি। তা ছাড়াও আমি কোম্পানির ডাইরেক্টর মি. ম্যাবট (Mabbot) , ড্রেক ও পেইন-কেও (Payne) লিখেছি আমার কথাটা মাথায় রাখতে। আমার খুব বাসনা আমাকে ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেলের পদে নিয়োগ করা হোক, যদি এরকম পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয়। আমি অবশ্য মি. ম্যাবটকে অনেকটা খোলাখুলি ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছি। তবে আপনি এ-বিষয়টা অত্যন্ত গোপনে এবং খুব সাবধানে সম্পন্ন করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ওঁদের মধ্যে কেউ গভর্নর জেনারেল পদের ইঙ্গিত না দিলে আপনি কথাটা উচ্চারণ করবেন না।

ক্লাইভ যে প্রথম থেকেই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেবেন তা মাদ্রাজ কাউন্সিল তাঁকে যে নির্দেশ দিয়েছিল তা থেকেই অনুমান করা যায়। তাতে বলা হয়েছিল, ‘কলমের সঙ্গে অস্ত্রও ব্যবহার করতে হবে’ এবং নবাবের বিরুদ্ধে খুব তাড়াতাড়ি এবং দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দিতে হবে।৩৩ সঙ্গে সঙ্গে এটাও মাদ্রাজ থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে নবাবের কলকাতা আক্রমণের বদলা হিসেবে হুগলি বা অন্য কোনও মুসলিম শহর আক্রমণ করে তা ধ্বংস করতে হবে।৩৪ মনে হয় ক্লাইভের কৌশল ছিল যে কূটনীতি ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যদি কাজ হয় তো ভাল। তবে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যে নবাবকে যুদ্ধক্ষেত্রে এমনভাবে পর্যুদস্ত করতে হবে যে আর কোনওদিন তিনি ইংরেজদের এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য আক্রমণ করতে সাহস করবেন না। হয়তো তিনি এটাও ভেবেছিলেন যে একটা কিছু নাটকীয় কাণ্ড করতে পারলে তিনি লন্ডনে কোম্পানির পরিচালকদের সুখ্যাতি অর্জন করতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ভবিষ্যতের উচ্চাভিলাষ ও বর্তমান কৌশলের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল। মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে তিনি ৮ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে লেখেন যে, ‘আমার ওপর যে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাতে কোম্পানির এখানকার লোকজন খুবই অসন্তুষ্ট মনে হয়। এরা যা বলে তাতে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করবেন না। বিশ্বাস করুন এই লোকগুলি অত্যন্ত বাজে ধরনের এবং এদের মনোবৃত্তি অত্যন্ত জঘন্য। আমার বিরুদ্ধে আপনার মন বিষিয়ে দিতে এরা সবকিছু করতে পারে।….পেরু এবং মেক্সিকোর সব ধনরত্ন দিলেও এদের মধ্যে আমি থাকতে চাই না।’৩৫

সে যাই হোক, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে পলাশির ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে ক্লাইভই প্রথমে উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং তিনিই ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁরা যেন মুর্শিদাবাদ দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি ‘দল’ (party) তৈরি করতে লেগে যান। রবার্ট ওরম পরিষ্কার লিখেছেন যে মীরজাফর নবাবের ওপর বিরূপ জানতে পেরে ক্লাইভ ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে নির্দেশ দেন। বলা বাহুল্য, উদ্দেশ্য ষড়যন্ত্রের ভিত তৈরি করা।৩৬ আবার ক্লাইভই সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে স্ত্র্যাফ্‌টনকে মুর্শিদাবাদে থাকতে অনুমতি দেওয়া হয় কারণ ‘ওখানে প্রয়োজনীয় কাজে তাঁকে দরকার হবে।’ কমিটিও তাতে রাজি হয়ে গেল কারণ তারা বুঝেছিল ‘কাজটা’ হচ্ছে দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা কমিটি তাই ক্লাইভকে জানাল তিনি যেন উপযুক্ত লোক দিয়ে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের বাজিয়ে দেখেন, ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তারা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে রাজি কি না।৩৭ স্ক্র্যাফ্‌টনও লিখেছেন যে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি যেন একটি ‘দল’ তৈরি করেন, যারা নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাবে।৩৮ পলাশির ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধের পূর্ববর্তী ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে এ-কথা বলা যায় যে, ক্লাইভ ষড়যন্ত্রের সাফল্যের জন্য যে-কোনও উপায় অবলম্বন করতে প্রস্তুত ছিলেন। অ্যাডমিরাল ওয়াটসন নবাবের অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে রাজি ছিলেন না, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। এই বাধা দূর করতে ক্লাইভের নির্দেশেই নাকি ওয়াটসনের সই জাল করা হয়েছিল। আবার তাঁর উদ্যোগেই সাদা ও লাল চুক্তির কৌশল অবলম্বন করে উমিচাঁদকে প্রতারিত করা হয়েছিল অথচ এই ক্লাইভই কিছুদিন আগে তাঁর মত ব্যক্ত করে জানিয়েছিলেন যে, চুক্তিতে উমিচাঁদের জন্য বিশেষ প্রাপ্তির ব্যবস্থা থাকা উচিত। সর্বোপরি সিলেক্ট কমিটির চাইতে তিনিই বেশি অস্থির ও অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন যাতে মীরজাফর এবং অন্যান্যরা চক্রান্তে অনড় থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের যেন পরিত্যাগ না করে।৩৯ এটা আমরা পরের অধ্যায়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।

দেশীয় চক্রান্তকারী

দেশীয় ষড়যন্ত্রীরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে পলাশি চক্রান্ত সংগঠিত করেছিল এটা বলা যায় না। তাদের ভূমিকা ছিল গৌণ। সন্দেহ নেই, বিভিন্ন কারণে তারা সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু এগিয়ে এসে এ-ব্যাপারে কোনও উদ্যোগ নিতে তাদের সাহস হয়নি। কিন্তু তারা যখন দেখল যে ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করতে এবং তার নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত, তখনই তারা সিরাজদ্দৌলাকে হঠাতে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়, তাও অত্যন্ত গোপনীয়তা ও সতর্কতার সঙ্গে। তারা পর্দার অন্তরালেই থাকতে চেয়েছিল এবং একেবারে শেষ মুহূর্তেই শুধু বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। খুব সম্ভবত তারা দু’দিকেই তাদের পথ খোলা রাখতে চেয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হতে চায়নি। মনে হয় তাদের কৌশল ছিল বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং শেষপর্যন্ত যে-পক্ষ জয়ী হবে, সে-পক্ষে যোগ দেওয়া, যাতে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের মুখোশ খুলতে না হয়। এ-বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে ওয়াটসের লেখায়— ইংরেজদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের রাজনীতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।

মীরজাফর

পলাশি চক্রান্তের নায়ক মীরজাফরই এবং তিনিই আসল বিশ্বাসঘাতক—এ-ধারণা বহুল প্রচলিত। বাংলায় মীরজাফর নামটাই বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হয়ে গেছে— ওটা বিশ্বাসঘাতকতার সমার্থক শব্দ। এ ধরনের বিকৃত ধারণা সমাজে চলে আসছে এই বিশ্বাস থেকে যে, পলাশির চক্রান্ত এবং পলাশির যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের জন্য দায়ী শুধু মীরজাফরই। সুতরাং মীরজাফরই ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে যে ধারণা বহুদিন ধরে প্রচলিত তা কতটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য তার তথ্য-ভিত্তিক বিচার-বিশ্লেষণ খুবই প্রয়োজন।

এখানে বলে নেওয়া দরকার, মীরজাফর পলাশি চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, এটা খুবই সত্য। এটাকে অস্বীকার করার কোনও চেষ্টা এখানে করা হচ্ছে না। যে মূল প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজছি তা হল, মীরজাফরই কি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন বা পলাশি চক্রান্তের আসল নায়ক কে বা কারা? বস্তুত আমাদের কাছে এমন তথ্য-প্রমাণ আছে যা থেকে সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরা, সঙ্গে দোসর ছিল জগৎশেঠরা। আমরা দেখেছি ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের জায়গায় নবাব হিসেবে ইয়ার লতিফ খানকে বসাবার মতলব করেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা জগৎশেঠদের মনোনীত প্রার্থী মীরজাফরের দিকে ঝুঁকল কারণ তারা জানত জগৎশেঠদের সমর্থন ছাড়া বাংলায় কোনও রাজনৈতিক পালাবদল সম্ভব নয়।

নবাব সুজাউদ্দিনের অধীনে সাধারণ সৈনিক হিসেবেই মীরজাফর তাঁর জীবন শুরু করেন। আরব দেশের নজফ (Najaf) থেকে আসা সৈয়দ আহমেদ নজাফী ছিলেন তাঁর পিতা। হাজি আহমেদ ও আলিবর্দি খানের বৈমাত্র ভগিনী শা’ খানমের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। বাঁকিবাজার (Banki Bazar) থেকে অস্টেন্ড (Ostend) কোম্পানিকে বিতাড়িত করে যোদ্ধা হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন এবং এখান থেকেই তাঁর উন্নতির সূত্রপাত।৪০ তবে তাঁর জীবনে নানা উত্থান-পতন দেখা গেছে—কখনও কখনও তিনি উচ্চপদ থেকে অপসারিত হয়েছেন আবার নানা উপায় অবলম্বন করে সে-পদে পুনর্বহালও হয়েছেন। সরফরাজের বিরুদ্ধে গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০) তিনি আলিবর্দির হয়ে যুদ্ধ করেন এবং তাতে তিনি আলিবর্দির বিশ্বাস অর্জন করেন। এরপর ১৭৪৫ সালের নভেম্বরে মারাঠাদের বিরুদ্ধে সফল অভিযান করে নবাব আলিবর্দির সুনজরে পড়েন। নবাব তাঁকে উড়িষ্যার ছোট নবাব (ডেপুটি গভর্নর) এবং মেদিনীপুর ও হিজলির ফৌজদার পদে নিযুক্ত করেন—তাঁর পূর্বতন বক্সিপদও বহাল রইল।৪১

কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি নবাবের রোষানলে পড়েন এবং তাঁর পদ থেকে অপসারিত হন। নবাব আলিবর্দি তাঁকে মারাঠাদের প্রতিহত করতে উড়িষ্যাতে পাঠান। পথিমধ্যে মেদিনীপুরে তিনি মারাঠাদের সম্মুখীন হন। কিন্তু ফারসি ঐতিহাসিকদের মতে তিনি যেহেতু আলস্য ও ভোগবিলাসে মত্ত থাকতেন এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের (হাকিম বেগের পুত্র গোলাম আলি ও মীর আলি খান ছিলেন নীচ এবং বিকৃত রুচির লোক) সঙ্গে মূর্খের মতো দিনরাত মদ্যপান ও ইন্দ্রিয় সুখে বিভোর হয়ে পড়ে ছিলেন, তাই মারাঠাদের হঠাতে তিনি কোনও প্রচেষ্টাই করলেনু না, ভয় পেয়ে বর্ধমানে পালিয়ে গেলেন। তাঁর এই নিকৃষ্ট আচরণে আলিবর্দি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হন এবং তাঁকে হিজলির ফৌজদার ও বক্সিপদ থেকে অপসারিত করেন। এই দুই পদে নবাব যথাক্রমে সুজন সিং ও নিরুল্লা বেগ খানকে নিযুক্ত করেন।৪২ কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফর ঢাকার নবাব ও আলিবর্দির ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা, নওয়াজিস মহম্মদ খানকে হাতে পায়ে ধরে বক্সিপদে পুমহাল হন। এর কিছুদিন পরে আবার তিনি তাঁর পদগুলি হারান কারণ মারাঠারা যখন আবার মুর্শিদাবাদের দিকে আসছিল, তিনি তাদের বাধা দিতে অক্ষম হন। তা ছাড়া খাজা আব্দুল হাদি খান সৈন্যবাহিনীর হিসেবপত্র পরীক্ষা করে বার করেন যে মীরজাফর জালিয়াতি করে সৈন্যবাহিনীর তহবিল তছরুপ করেছেন।৪৩ নবাব আলিবর্দি তাই আব্দুল হাদিকেই বক্সিপদে নিযুক্ত করেন এবং মীরজাফরের ‘রিসালা’ থেকে একশত সৈন্য ছাঁটাই করেন। এভাবে মীরজাফর নবাবের বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি থেকে অপসারিত হন এবং নবাবের বিশ্বাসচ্যুত হন।৪৪

সিরাজদ্দৌল্লার আমলে মীরজাফর প্রথমে নবাবের প্রিয়পাত্র ছিলেন না। কিন্তু কলকাতা আক্রমণের সময় বীরত্ব ও নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তিনি নবাবের নেকনজরে আসেন ও বিশ্বাসভাজন হয়ে বক্সিপদ লাভ করেন।৪৫ কিন্তু সিরাজ অল্পদিনের মধ্যেই মীরজাফরের সম্বন্ধে সন্দেহভাজন হয়ে পড়েন এবং ইংরেজদের চন্দননগর দখল করার পর তাঁর বিশ্বাসঘাতকতা সম্বন্ধে কিছুটা নিঃসন্দেহ হন। তাই তিনি তাঁকে বক্সিপদ থেকে সরিয়ে দেন এবং আব্দুল হাদিকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।৪৬ আবার কিছুদিন পরে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে বক্সিপদ ফিরিয়ে দেন কারণ নবাব সম্ভবত ইংরেজদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। নবাবের ঘনিষ্ঠ এবং অনুগত সেনাপতিরা—মীর মর্দান, মোহনলাল, আব্দুল হাদি খান প্রভৃতি—এতে প্রবল আপত্তি করেছিলেন কিন্তু তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি।৪৭ ফারসি ঐতিহাসিকরা সবাই লিখেছেন যে পলাশিতে রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লতিফের সঙ্গে মীরজাফরও তাঁর ‘মনিব’ সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন—তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে নীরব দর্শকের মতো শুধু দুরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।৪৮ আসলে এটা বলা হয় যে আলিবর্দি মীরজাফরের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন যে তিনি সিরাজকে সাহায্য করবেন। এটা হয়তো ঠিক যে প্রথমদিকে মীরজাফরের সাহায্য ছাড়া সিরাজদ্দৌল্লার পক্ষে মসনদে বসা খুবই কঠিন হত। অবশ্য মুজাফ্‌ফরনামা-র লেখক করম আলি জানাচ্ছেন যে মীরজাফর প্রথম থেকেই একটি ‘দল’ তৈরি করে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।৪৯

তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সিরাজদ্দৌল্লার সিংহাসন আরোহণের কয়েক মাস পরেই মীরজাফর নবাবকে হঠাবার মতলব ভাঁজতে থাকেন। তার কারণ হিসেবে বলা হয় যে নতুন নবাব তাঁর প্রতি অবিচার ও অসম্মান দেখাতে শুরু করেছিলেন। আবার এটাও বলা হয়ে থাকে যে মীরজাফর পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গকে লেখেন সিরাজের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে, তা হলে সৈন্যবাহিনীর কয়েকজন সেনাপতি ও দরবারের কিছু অমাত্যকে নিয়ে তিনি তাঁর সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু শওকত জঙ্গের অবহেলায় ও নেতৃত্ব দেওয়ার অক্ষমতায় এই পরিকল্পনা সফল হয়নি।৫০ পলাশি চক্রান্তে মীরজাফরের ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই যদিও সম্ভবত তিনি জগৎশেঠ ও দুর্লভরামের হাতের পুতুল ছিলেন মাত্র। আসলে ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে তাঁকে নবাব করতে চেয়েছিল কারণ তিনি ছিলেন শেঠদের পছন্দের লোক। তাঁর কোনও বিশেষ গুণাবলীর জন্য তারা তাঁকে বেছে নেয়নি যদিও ওয়াটস বলেছেন যে তিনিই নবাবের পদে ‘সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।’৫১ কিন্তু ইংরেজরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মীরজাফরের ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রাখতে পারছিল না। সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে সম্পূর্ণ উন্মোচন না করে বেড়ার ধারে অপেক্ষা করা এবং যে-দল শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে, তার সঙ্গে যোগ দেওয়া।

জাঁ ল লিখেছেন যে মীরজাফর ছিলেন সাহসী ও নির্ভীক, কিন্তু স্ক্র্যাফ্‌টন বলছেন যে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করার আগে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনীর যে হাতাহাতি যুদ্ধ (skirmish) হয়, তাতে মীরজাফরের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক—তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে শেষপর্যন্ত কী হয় তাই দেখছিলেন।৫২ পলাশির যুদ্ধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে ক্লাইভ শুধু নন, এখনকার ঐতিহাসিকরাও বলছেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের কোনওরকম সাহায্য করেননি, শুধু দুরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ-কথা বলে অবশ্য পলাশি যুদ্ধের ইংরেজ সাফল্যে মীরজাফরের যা অবদান তার গুরুত্ব হ্রাস করা হচ্ছে। এভাবে, মীরজাফর তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে নবাবের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে ইংরেজদের যে পরোক্ষভাবে কতটা সাহায্য করেছিলেন তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হচ্ছে। নবাবের সেনাপতি হয়েও তাঁর সঙ্গে যোগ না দিয়ে তিনি প্রকৃতপক্ষে ইংরেজদের বিরাট সাহায্য করেছিলেন।৫৩ স্ক্র্যাফ্টন ও অবশ্য পলাশি বিপ্লবে মীরজাফরের ভূমিকা গৌণ করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন এবং তাঁকে নবাব করার ব্যাপারে ইংরেজদের ‘মহানুভবতার’ ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি লিখছেন:৫৪

আমাদের সাফল্যে মীরজাফরের অবদান কতটা সামান্য তা হয়তো তিনি নিজেই জানেন। কিংবা আমাদের হাতে সমস্ত ক্ষমতা চলে আসা সত্ত্বেও আমাদের বিনম্র ব্যবহারে তিনি হয়তো মুসলমান হিসেবে অবাক হয়ে গেছেন। তাই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে আমরা তাঁকে এত উচ্চপদে বসাতে চাইছি। অনেক চেষ্টা করে মি. ওয়াটস ও আমি শেষ পর্যন্ত তাঁকে নবাবের গদিতে বসাতে সমর্থ হয়েছি।

সিরাজদ্দৌল্লার চরিত্রের জন্য তাঁর তীক্ষ্ণ সমালোচনা করা হয়। মীরজাফর যে তাঁর চেয়ে বেশি চরিত্রবান ছিলেন তা কিন্তু নয়। আমরা আগেই দেখেছি মীরজাফর যে আলস্যে ও ইন্দ্রিয়সুখে নিমগ্ন ছিলেন তা ফারসি ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি পরিষ্কার জানিয়েছেন। তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মধ্যে ছিলেন গোলাম আলি ও মীর আলি খানের মতো নীচ ও জঘন্য প্রকৃতির লোকজন।৫৫ সিয়র-এর লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দোসর খাদিম হোসেন খানের চরিত্রের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মীরজাফরের বোন যাঁকে বিয়ে করেন, তাঁর অপর এক স্ত্রীর গর্ভে এই খাদিম হোসেনের জন্ম এবং সেই সূত্রে ইনি মীরজাফরকে ‘মামু’ বলে ডাকতেন। গোলাম হোসেন লিখেছেন: ‘ইনি মীরজাফরের প্রায় সমবয়সী। এঁর কামাসক্তি ছিল বড় প্রবল, বিশেষ করে একপ্রকার অস্বাভাবিক রমণাভিলাষের প্রতি তাঁর অপ্রতিরোধ্য ঝোঁক ছিল যা তাঁদের দু’জনের [তিনি ও মীরজাফর] ছোটবেলা থেকে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল এবং এ-ব্যাপারে দু’জনে পরস্পরের সঙ্গে আশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁরা প্রায়ই একসঙ্গে থাকতেন এবং একসঙ্গে শুতে যেতেন।’ তিনি আরও লিখেছেন যে নবাব হওয়ার পর মীরজাফরের চরিত্র আরও জঘন্য হয়ে পড়ে এবং তাঁর লোভের বিকৃত মানসিকতা আরও বেড়ে যায়। রাজ্যের কাজকর্মের দিকে কোনও নজর না দিয়ে তিনি সবরকমের ইন্দ্রিয়সুখে ডুবে রইলেন।৫৬

জগৎশেঠ

পলাশি চক্রান্তে দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৫৭ বস্তুতপক্ষে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে নবাব হওয়ার দুই প্রতিযোগী, ইয়ার লতিফ খান ও মীরজাফর, শেঠদেরই লোক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু ইয়ার লতিফের তুলনায় মীরজাফর অনেক বেশি ক্ষমতাবান এবং শেঠদের অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন, সেজন্য ইংরেজরা লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরের দিকে ঝুঁকেছিল কারণ তারা জানত, জগৎশেঠদের সক্রিয় সমর্থন ছাড়া পলাশি বিপ্লব সম্ভব হবে না। সেজন্য চন্দননগর পতনের আগেই, চক্রান্ত যখন কোনও রূপই নেয়নি, কলকাতা থেকে সিলেক্ট কমিটি ওয়াটসকে লিখেছিল ‘জগৎশেঠ পরিবার যাতে আমাদের পক্ষে থাকে’ তার জন্য সচেষ্ট থাকতে।৫৮ আবার এপ্রিলের শেষদিকে যখন ষড়যন্ত্র বেশ কিছুটা রূপ নিয়েছে তখন ক্লাইভ মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লিখলেন: ‘নবাবের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক গণ্যমান্য লোক আছেন এবং এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জগৎশেঠ।৫৯ বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল করতে গেলে শেঠদের সাহায্য ও সহযোগিতা যে কতটা প্রয়োজনীয় তা বোঝাতে গিয়ে তিনি লিখেছেন: ‘তিনটি সুবার মধ্যে জগৎশেঠই হচ্ছেন সবচেয়ে ধনী ও প্রতিপত্তিশালী। দিল্লির মুঘল দরবারেও তাঁর যথেষ্ট প্রভাব। সুতরাং এখানকার ব্যাপারে কিছু করতে হলে যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সাহায্যই সবচেয়ে জরুরি।’৬০ পলাশির ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠদের ভূমিকা এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে বিপ্লবের কুড়ি বছর পরেও ফরাসি অধিকৃত পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের গভর্নর ল’ দ্যা লরিস্টন (Law de Lauriston) ১৭৭৭ সালে লিখেছেন যে ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠরা সক্রিয় অংশ না নিলে বাংলায় বিপ্লব সম্ভব হত না।৬১

শেঠ পরিবার রাজস্থানের মাড়ওয়ার অঞ্চলের নাগর থেকে সপ্তদশ শতকের শেষদিকে বাংলায় আসেন। এই পরিবারের মানিকচাঁদ ও তাঁর পুত্র ফতেচাঁদের সময় এঁদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি এতই প্রসার লাভ করে যে মুঘল সম্রাট ১৭২২ সালে ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ বা ‘দুনিয়ার ব্যাঙ্কার’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং এই উপাধি হয় বংশানুক্রমিক। জগৎশেঠ ফতেচাঁদের আমলেই শেঠদের ক্ষমতা ও প্রভাব তুঙ্গে ওঠে। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে ১৭৪৪ সালে ফতেচাঁদ দেহরক্ষা করেন। এরপর তাঁর দুই নাতি, জগৎশেঠ মহতাব রায় ও মহারাজ স্বরূপচাঁদ, শেঠ পরিবারের অধিকর্তা হন এবং পলাশির ষড়যন্ত্রে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা নেন।৬২ এঁদের প্রচণ্ডরকমের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও তার ফলে অপরিসীম রাজনৈতিক প্রভাবের উৎস ছিল নানা উপায়ে ধনোপার্জন। বাদশাহি টাঁকশালে মুদ্রা তৈরি করার কার্যত একচেটিয়া অধিকার ছিল তাঁদের; প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ রাজস্ব আদায়ের ভারও ছিল তাঁদের ওপর; তা ছাড়া বাংলায় বিভিন্ন রকমের মুদ্রার বিনিময় এবং বাট্টা ও সুদের হার নির্ধারণও করতেন তাঁরাই। এ-সব ছাড়া চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়ার মহাজনি ব্যবসাও ছিল তাঁদের। এ সমস্ত বিভিন্নসূত্রে জগৎশেঠদের প্রচুর উপার্জন হত।

রবার্ট ওরম ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে বাংলায় ছিলেন। তিনি লিখেছেন যে ‘আমার জানা পৃথিবীতে জগৎশেঠরাই সর্বশ্রেষ্ঠ সরাফ (sarraf) ও ব্যাঙ্কার।’৬৩ তখন কলকাতায় বসবাসকারী অন্য একজন ইংরেজ, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Fenwick), বলছেন, ‘লন্ডনের লম্বার্ড [Lombard] ষ্টিটের [যেখানে সব ব্যাঙ্কারদের অফিসকাছারি ছিল] সমস্ত ব্যাঙ্কারকে যোগ করলেও জগৎশেঠ মহতাব রায়ের সমকক্ষ হবে না।’৬৪ ১৭৫৭ সালে স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভকে লিখেছিলেন: ‘একদিক থেকে জগৎশেঠরাই [নবাবি] সরকারের ব্যাঙ্কার, রাজস্বের দুই-তৃতীয়াংশ তাঁদের ঘরেই জমা পড়ে। কোনও ব্যবসায়ী যেমন ব্যাঙ্কের ওপর ড্রাফট দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনিভাবেই নবাব সরকার এঁদের [জগৎশেঠদের] ওপরই ড্রাফট দেন।’৬৫ জাঁ ল’-ও জগৎশেঠদের মুঘল সাম্রাজ্যের ব্যাঙ্কার হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তাঁদের মতো এত ধনী এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি আর দেখা যায়নি বলে মত ব্যক্ত করেছেন।৬৬ অন্যদিকে উইলিয়াম ওয়াটস লিখেছেন, জগৎশেঠরা সমগ্র হিন্দুস্থানের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার এবং বাংলায় নবাবের পরেই তাঁদের সর্বোচ্চ ক্ষমতা।৬৭

বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের পুরো সময়টাই জগৎশেঠরা মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা বাংলার প্রশাসনে ও অর্থনীতিতে এমন প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেছিলেন যা এর আগে কেউ কখনও করতে পারেনি। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জগৎশেঠ ফতেচাঁদের সময় থেকে বাংলায় যে কোনও রাজনৈতিক পালাবদলে জগৎশেঠরাই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দিল্লির মুঘল দরবারের সঙ্গেও তাঁদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।৬৮ জগৎশেঠরাই ছিলেন বাংলার রাজনীতির আসল ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। জাঁ ল’ লিখছেন, ‘জগৎশেঠ পরিবারই আলিবর্দির আমলে শাসন চালাতেন এবং অনেকদিন ধরে এঁরাই বাংলার রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রধান হোতা ছিলেন।’৬৯

পলাশি প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র যা বক্তব্য—দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে শেঠরাই পলাশি চক্রান্ত ও বিপ্লবের মূল উদ্যোক্তা, এবং এঁদের সম্মতি ও সহযোগিতা ছাড়া ইংরেজরা যা করেছে তা কখনও করতে পারত না—বেশ সমীচীন বলেই মনে হয়।৭০ তবে তাঁরা পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন। বিপ্লব সফল হওয়ার পরই শুধু নিজেদের মুখোশ খুলে ফেলেছিলেন। জাঁ ল’ হয়তো ঠিকই বলেছেন, হিন্দু বলে শেঠরা আগেভাগে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়ে নিজেদের বিপদ ডেকে আনতে চাননি। তিনি আরও জানাচ্ছেন যে তাঁরা সম্ভবত ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করতে পারতেন। তবে তার জন্য তাদের অনেক সময়ের প্রয়োজন হত। ইংরেজদের পক্ষে কিন্তু দেরি করা পোষাত না। তিনি এটাও বলছেন যে শেঠদের স্বার্থ ও ইংরেজদের স্বার্থ এক হয়ে গেছল এবং তাঁদের মতো প্রভাবশালী লোকদের পক্ষে, বিশেষ করে যখন ইংরেজরা তাদের সঙ্গে সামিল হয়েছিল, বিপ্লব ঘটাতে বিশেষ কোনও অসুবিধে হত না।৭১ এখানে বলা প্রয়োজন যে ল’-র উপরোক্ত বক্তব্য সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে, এটা তাঁর অত্যুক্তি। মনে হয় এটা বলে তিনি তাঁর নিজের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করেছেন কারণ তিনি বলছেন যে অন্য কারও চাইতে শেঠরাই ইংরেজদের বেশি সাহায্য করতে পারতেন যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়িক যোগ ছিল। কিন্তু আমরা পরে দেখতে পাব যে, জগৎশেঠদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের প্রধান উৎস মোটেই ইউরোপীয়দের বা ইংরেজদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য নয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্কও সবসময় হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল না। শেঠরা অনেক ব্যাপারে একচেটিয়া অধিকার অর্জন করে ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা বাধার সৃষ্টি করেছিলেন।

তবে এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থে ইংরেজরা ও শেঠরা পলাশি চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলেন—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল এক, সিরাজদ্দৌল্লাকে মসনদ থেকে হঠানো। তরুণ নবাব ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন কারণ তিনি তাদের বেআইনি ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য ও দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। শেঠরা ভয় পেয়েছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা তাঁদের সম্পদ পুঞ্জীভবনের উৎসগুলি বন্ধ করে দেবেন। এ-প্রসঙ্গে জাঁ ল’-র বক্তব্য যে, শেঠদের ধনসম্পদই সিরাজের লক্ষ্য ছিল—এখন হোক বা পরে তিনি তাঁদের সম্পদ কেড়ে নিতেন—তা যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় না।৭২ ওয়াটস বা স্ক্র্যাফ্টন, যাঁরা মুর্শিদাবাদ দরবারের সব খোঁজখবর রাখতেন, তাঁদের কেউই এরকম কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত দেননি। এমনকী কোনও ইংরেজি বা ইউরোপীয় নথিপত্রেও এমন কোনও তথ্য নেই যা থেকে প্রমাণ করা যায় যে, শেঠরা তাঁদের ধনসম্পদ বাঁচাবার জন্যই সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন। শেঠরা সিরাজকে কেন হঠাতে চেয়েছিলেন তার অন্য একটি কারণও দেখানো হয়ে থাকে। বলা হয় যে নবাব তাঁর পুর্ণিয়া অভিযানের জন্য জগৎশেঠকে সওদাগর ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন কোটি টাকা জোগাড় করতে বলেন। জগৎশেঠ এ-ব্যাপারে তাঁর অক্ষমতা জানালে সিরাজ নাকি তাঁকে প্রকাশ্য সভায় চড় মারেন। এটা নেহাতই গুজবের ওপর ভিত্তি করা বাজারে গল্প, এর সত্যতার কোনও প্রমাণ নেই।৭৩

এই আজগুবি গল্পের উৎস হল কোম্পানির সার্জন উইলিয়াম ফোর্থ (Forth)। কোম্পানির বাণিজ্য সংগঠনে বা প্রশাসনে সার্জনের গুরুত্ব একেবারেই নগণ্য। ফোর্থ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখেন যে ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তাঁকে খবর দেন ব্যাপারটা কাউন্সিলকে জানাবার জন্য।৭৪ এখানে প্রশ্ন, বিসডম এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা খবর সোজাসুজি কলকাতায় কোম্পানির প্রেসিডেন্ট বা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে না জানিয়ে ফোর্থের মতো নগণ্য এক সার্জনকে জানাতে গেলেন কেন? দ্বিতীয়ত, বিসডমের ডায়েরি বা ডাচ রেকর্ডে কোথাও এ-ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। তৃতীয়ত, গল্পটা সত্য হলে, তখনকার ফারসি ইতিহাসগুলিতে এমন রসালো গল্প অবশ্যই স্থান পেত। বিশেষ করে ওই ঐতিহাসিকেরাই যেখানে সিরাজদ্দৌল্লার খুঁত বার করতে ব্যস্ত। তা ছাড়া যে দু’জন ইংরেজ—ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্টন এবং একজন ফরাসি জাঁ ল’, দরবারের হাঁড়ির খবর রাখতেন, তাঁদের মধ্যে কেউই এ-ঘটনার কথা উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। সর্বোপরি, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় সিরাজদ্দৌল্লা ‘প্রভূত অর্থশালী’ এবং তাঁর ‘রাজকোষ পরিপূর্ণ’। এ-কথা জানিয়েছেন গোলাম হোসেন, জাঁ ল’, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টনের মতো ব্যক্তিরা।৭৫ এ-সব বিবেচনা করে তাই বলা যায় যে জগৎশেঠকে চড় মারার গল্প আজগুবি ছাড়া আর কিছু নয়।

আসলে সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই শেঠদের প্রতি বিরূপ ছিলেন না এবং সিংহাসনে আরোহণ করার পরেই তাঁদের নিজের আস্থাভাজন করে নেন। এটা যে তার সঠিক প্রমাণ, সিরাজ আলিবর্দির বিধবা পত্নীর সঙ্গে জগৎশেঠ মহতাব রায়কে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠিয়েছিলেন যাতে বেগম নবাবের বশ্যতা স্বীকার করে নেন।৭৬ আবার শেঠদের গোমস্তা রঞ্জিত রায়ই আলিনগরের চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।৭৭ আসলে তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের প্রতি জগৎশেঠদের মনোভাব খুব অনুকূল ছিল না। তাঁরা বরং তখন নবাবের প্রতিই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। জগৎশেঠ নিজেই এ সময় জানিয়েছিলেন যে তরুণ নবাবের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব আছে। এ-প্রসঙ্গে তিনি ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭-তে ক্লাইভকে যা লিখেছিলেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৭৮

আপনি লিখেছেন যে আমি যা বলি নবাব তা শোনেন এবং আমি যেন কোম্পানির এবং বাংলার হিতার্থে নিজেকে নিয়োগ করি। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং সম্ভবত আমি যা বলব নবাব তা শুনবেন। তবে আপনারা যা করেছেন তা মোটেই উচিত হয়নি। যুদ্ধ করে কলকাতা পুনর্দখল করেছেন এবং তারপর হুগলি শহর ধ্বংস করেছেন। মনে হয় আপনারা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছুতে [আপস আলোচনায়] আগ্রহী নন। যদি তা হয় তা হলে আমি কীভাবে নবাব এবং আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতার ব্যবস্থা করব? আপনাদের উপরোক্ত শত্রুতামূলক কাজকর্ম দেখে আপনাদের আসল উদ্দেশ্য বোঝা মুশকিল। এ-সব বন্ধ করুন এবং আপনাদের কী কী দাবি আমাকে জানান। তা হলে আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন যে আমি নবাবের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা কাজে লাগিয়ে এ-সব সমস্যার সমাধান করতে পারব। আপনারা কী করে আশা করেন যে দেশের রাজা বা সর্বময় কর্ণধারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে আপনারা যে আচরণ করেছেন তা নবাব অগ্রাহ্য করবেন বা চোখ বুজে সহ্য করবেন?৭৯

খুব সম্ভবত জগৎশেঠরা ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার ও চন্দননগর আক্রমণের মধ্যবর্তী কোনও সময় থেকে নবাবের প্রতি তাঁদের মনোভাব বদলাতে শুরু করেন। তাঁরা যখন দেখলেন যে নবাব একদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, খাজা আবদুল হাদি খানকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করছেন এবং অন্যদিকে মীরজাফর, হাকিম বেগ প্রভৃতি পূর্বতন নবাবের বিশ্বাসভাজন অমাত্যকে দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন, এমনকী রায়দুর্লভ রামের ক্ষমতাও খর্ব করছেন, তখন তাঁরা ভয় পেলেন যে তরুণ ও বেপরোয়া এই নবাব এবার তাঁদের সম্পদ আহরণের পথগুলি রুদ্ধ করে দেবেন। পূর্বতন নবাবদের কাছ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে তাঁরা এ-সব সুযোগসুবিধেগুলি পেয়ে এসেছেন। তাই সিরাজদ্দৌল্লা এগুলি কেড়ে নিতে পারেন ভেবে তাঁরা ভয় পেয়ে যান এবং তাঁকে মসনদ থেকে হঠাবার জন্যে তাঁরা ধীরে ধীরে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন। এটাই যে আসল ঘটনা সিয়র-এর লেখকও তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের (জগৎশেঠরা অবশ্যই তাদের অন্যতম) ‘ভালভাবে কাজে’ লাগাননি। জাঁ ল’ অভিযোগ করেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের প্রতি কোনওরকম সৌজন্য দেখাননি কিংবা তিনি প্রায়ই তাদের অসম্মান ও অবজ্ঞা করতেন, এমনকী তিনি তাঁদের ছুন্নত (circumcision) করার ভয় দেখাতেন।৮০ এ-সব অভিযোগগুলিই কিন্তু অসার। রবার্ট ওরম পরিষ্কার জানাচ্ছেন সিরাজ জগৎশেঠদের সঙ্গে সৌজন্যমূলক ব্যবহারই করতেন।৮১ সমসাময়িক নথিপত্রের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা জগৎশেঠদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার করতেন এবং সব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তাঁদের পরামর্শ নিতেন। এমনকী ল’ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে ‘আলিনগরের সন্ধির পর থেকে নবাব জগৎশেঠদের প্রতি ভদ্র এবং বিনম্র ব্যবহার করেছেন এবং প্রতিটি ব্যাপারে তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।’ অবশ্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, ‘আসলে এ-সব নবাবের ছলচাতুরি এবং ভেতরে ভেতরে তিনি শেঠদের ধ্বংস করার মতলব করছিলেন। ওদিকে শেঠরাও বিরাট পরিকল্পনা (Grand Project) নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং তা হচ্ছে মসনদ থেকে সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ।’৮২ সম্ভবত নবাব এবং শেঠরা পরস্পরের প্রতি তখন অবিশ্বাস পোষণ করছিলেন কিন্তু কেউই তা বাইরে প্রকাশ করতে চাননি। নবাব হয়তো শঙ্কিত হচ্ছিলেন যে তাঁর চারদিকে বিশ্বাসঘাতকতার জাল ছড়িয়ে পড়ছে। তাই কাউকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। অন্যদিকে শেঠরা বাইরে চুপচাপ থাকতে চাইছিলেন যাতে নবাব তাঁদের প্রতি বেশি বিরূপ না হন আর ওদিকে তলায় তলায় চক্রান্তের ব্যাপারে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন।৮৩

জাঁ ল’-র লেখা থেকেই প্রমাণিত হয় যে মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর বিতাড়নের আগে (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা ও শেঠরা পরস্পরের প্রতি প্রকাশ্যে কোনও বিরূপতা দেখাননি। ল’ যখন এ সময় জগৎশেঠদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কেন ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাহায্য করছেন তখন তাঁরা তা অস্বীকার করেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি যদি কোনও সাহায্য চান তা হলে তাঁরা তা নবাবকে জানাবেন। ল’ তখন তাঁদের অনুরোধ করেন তাঁরা যেন নবাবকে বোঝান যে ইংরেজদের চন্দননগর আক্রমণ আটকাতে সেখানে নবাবি সৈন্য পাঠানো জরুরি হয়ে পড়েছে।৮৪ এ থেকে বোঝা যায় তখনও পর্যন্ত ল’র বিশ্বাস ছিল যে নবাবের সঙ্গে শেঠদের সম্পর্ক ভালই ছিল। সিরাজের দিক থেকে বলা যায় যে তিনি তখনও পর্যন্ত শেঠদের ওপর আস্থা সম্পূর্ণ বিসর্জন দেননি শেঠদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরদিন সকালে ল’ নবাবের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা জানান। তিনি এটাও বললেন যে অন্যান্যদের সঙ্গে জগৎশেঠরাও এই চক্রান্তে সামিল হয়েছেন, কিন্তু বেচারি নবাব তাতে হো হো করে হেসে উঠলেন যেন ল’ আষাঢ়ে গল্প বলছেন।৮৫ সম্ভবত জগৎশেঠ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন এমন একটা আন্দাজ সিরাজ করতে পেরেছিলেন কিন্তু তাঁর পক্ষে ওরকম সংকটময় মুহূর্তে শেঠদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলতে চাননি। এমনও হতে পারে যে, তিনি তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারেননি কারণ ষড়যন্ত্র তখনও পূর্ণ রূপ নেয়নি এবং শেঠরা তখনও পর্যন্ত মাঠের বাইরেই অপেক্ষা করছিলেন আর পর্দার অন্তরাল থেকেই কলকাঠি নাড়ছিলেন।

উমিচাঁদ

পলাশি চক্রান্তে উমিচাঁদের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাঁর সাহায্যেই ইংরেজরা দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের টোপ গেলায় এবং এভাবে ষড়যন্ত্র পাকা করে তোলে।৮৬ চক্রান্তের সূত্রপাত হবার অনেক আগে থেকেই যখন ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হয়ে ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিল, তখনই উমিচাঁদ তাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন জগৎশেঠদের হাত করার চেষ্টা করে।৮৭ অবশ্য ইংরেজরা প্রথমে সিরাজের কলকাতা আক্রমণের ব্যাপারে উমিচাঁদের হাত ছিল মনে করে তাঁকে ইংরেজদ্রোহী ভেবেছিল। উমিচাঁদও কলকাতা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে গেছিলেন। পরে ক্লাইভ এসে যখন কলকাতা পুনরুদ্ধার করলেন তখন উমিচাঁদ তাঁকে লিখলেন যে ‘তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করতে চান এবং তাঁর কাছ থেকে সুবিচার আশা করেন’।৮৮ উমিচাঁদ সম্বন্ধে সব খোঁজখবর নেবার পর ক্লাইভ তাঁকে যা লিখলেন (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ‘আমি খুব চাই যে আপনি আমার সঙ্গে দেখা করুন। আপনাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আপনি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও নির্ভয়ে আমার কাছে আসতে পারেন, আপনার কোনও ক্ষতি করা হবে না। আপনি যখনই যেখানে যেতে চাইবেন সেখানে ফিরে যেতে পারবেন।’৮৯ এ থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে ক্লাইভ উমিচাঁদকে ইংরেজদের পরিকল্পিত চক্রান্তে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। তাই আলিনগরের সন্ধির পর যখন ওয়াটসকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হল তখন ঠিক হল যে উমিচাঁদও তাঁর সঙ্গে যাবেন। এটাও বলা হল যে সন্ধির সময় উমিচাঁদ যেভাবে সাহায্য করেছেন তাতে তাঁর সম্বন্ধে আগের অভিযোগ বাতিল হয়ে গেছে। ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল তিনি যেন কোনও দ্বিধা না করে সব বিষয়ে খোলাখুলিভাবে উমিচাঁদের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং তাঁকে দিয়ে নির্দ্বিধায় কাজ করান।৯০

বাংলার অন্য দুই বণিকরাজা জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের মতো উমিচাঁদ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের শেষ তিন দশকে বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির জগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।৯১ তিনি ছিলেন আগ্রার অধিবাসী। আগ্রা থেকে এসে তিনি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেন অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে। কলকাতার প্রভাবশালী দাদনি বণিক ও একসময় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান সওদাগর (Broker) বিষ্ণুদাস শেঠের [কলকাতার বিখ্যাত শেঠ পরিবার— জগৎশেঠদের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই] তত্ত্বাবধানে কলকাতায় উমিচাঁদের ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রপাত। ১৭৩০-এর দশকেই তিনি নিজেকে কলকাতার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিরিশ দশকের শেষ দিক থেকে তিনি পাটনাতে আলিবর্দি খানের প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন। তাঁর ভাই দীপচাঁদ বিহারে সোরা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র ‘সরকার’ শরণের ফৌজদারি চালাতেন। উমিচাঁদ প্রধানত বিহারের সোরা ও আফিং-এর ব্যবসাতে যুক্ত ছিলেন। ইংরেজ কোম্পানিকে সোরা সরবরাহকারীদের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি। তিনি ও তাঁর ভাই মিলে বিহার প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে সোরার প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা কুক্ষিগত করেছিলেন। কলকাতায় তিনি ইংরেজ কোম্পানির পণ্য সরবরাহকারী দাদনি বণিকদের অন্যতম প্রধান ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর ছিল ব্যাঙ্কিং ও টাকাপয়সা লেনদেনের ব্যবসা।৯২

তিনি বহুদিন ধরে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। একবার যখন দাদনি বণিক হিসেবে কোম্পানির তালিকা থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়া হল তখন আলিবর্দির বড় ভাই ও মুর্শিদাবাদ দরবারের অন্যতম প্রভাবশালী অমাত্য, হাজি আহমেদ উমিচাঁদকে পুনর্বহাল করার জন্য কোম্পানিকে লিখেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে উমিচাঁদের জন্য যে-কোনও পরিমাণ টাকার জামিন হতে তিনি রাজি। এ থেকেই বোঝা যায় যে মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের একজন সদস্য একবার বিতর্কের সময় দেশের অন্তর্বাণিজ্য সম্বন্ধে উমিচাঁদের গভীর জ্ঞানের কথা বলেন এবং তাঁর অর্থের বিরাট জোগান আছে বলেও উল্লেখ করেন। উমিচাঁদ যে সোরার উৎপাদন ও বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করতে চেয়েছিলেন, বিহারের অর্থনীতি ও সোরা-আফিং-এর ব্যবসায় তাঁর যে প্রতিপত্তি—এগুলি সবই মুর্শিদাবাদ ও পাটনার দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলেই সম্ভব হয়েছিল। তাই এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে নবাব আলিবর্দির সময় তিনি দরবারে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন। পরে তিনি সিরাজদ্দৌল্লারও বিশেষ প্রিয়পাত্র হন। তাঁর সম্বন্ধে ওরম লিখেছেন:৯৩

কলকাতার হিন্দু বণিকদের মধ্যে একজন হলেন উমিচাঁদ। ব্যবসায়িক বুদ্ধি খাটিয়ে ও প্রচণ্ড অধ্যবসায়ের জোরে তিনি তাঁর ধনসম্পদ বাড়িয়েছেন…. এই শহরে তিনিই সবচেয়ে বড় ধনী। অসংখ্য ঘর নিয়ে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়ি, বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত তাঁর অসংখ্য চাকরবাকর ও নানারকমের কর্মচারী এবং বেশ কিছু সশস্ত্র পাহারাদার দেখে মনে হবে তাঁর বাড়িটা কোনও রাজার প্রাসাদ, শুধুমাত্র একজন সওদাগরের বাড়ি নয়।

এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ইংরেজরা বাংলায় বিপ্লব করার ষড়যন্ত্রে উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়েছিল। ক্লাইভ বাংলায় আসার আগেই চার্লস এফ. নোবেল (Charles F. Nobel) নামক এক ইংরেজ ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে জানিয়েছিলেন যে, ‘আমাদের কাজে লাগাবার পক্ষে উমিচাঁদই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি, যদি তিনি তা করতে ইচ্ছুক হন।’৯৪ উমিচাঁদ অনেকদিন ধরেই মুর্শিদাবাদ দরবার ও ইংরেজ কোম্পানির মধ্যে প্রধান যোগসূত্র ছিলেন।৯৫ তাঁর সঙ্গে দরবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে এবং তিনি দরবারের প্রায় সব অমাত্যকেই ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন বলেই ইংরেজরা তাঁকে ওয়াটসের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ পাঠান। স্ক্রাফ্টন লিখেছেন যে উমিচাঁদ ওয়াটসের অধীনে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করতেন।৯৬ ওয়াটস প্রথম থেকেই উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও মুর্শিদাবাদের রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞানের অনুরক্ত ছিলেন এবং সেজন্য তিনি সবসময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই চলতেন। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে উমিচাঁদ ইংরেজদের হিত চিন্তায় খুবই নিষ্ঠাবান এবং আগ্রহী ছিলেন। এমনকী তিনি ক্লাইভকে এটা পর্যন্ত লিখেছিলেন যে, ‘কোম্পানির কাজে উমিচাঁদ অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দ্বিধা করেন না এবং কোনও ব্যক্তি যদি কোম্পানির অনুগ্রহ লাভের সবচেয়ে যোগ্য হয় তা হলে উমিচাঁদই সেই ব্যক্তি।’৯৭ বস্তুতপক্ষে তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হালচাল, তাদের মধ্যে ধূমায়িত অসন্তোষ ইত্যাদি নিয়ে উমিচাঁদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতেন। উমিচাঁদ রোজ দরবারে গিয়ে বিশিষ্ট অমাত্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাঁদের সামিল করা যায় কি না তা চেষ্টা করে দেখা।৯৮

উমিচাঁদ চেয়েছিলেন সিরাজদ্দৌল্লার পরিবর্তে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে, মীরজাফরকে নয়। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন, ইয়ার লতিফ দরবারের তেমন জবরদস্ত অমাত্য নন বলে তিনি তাঁকে সহজেই নিজের তাঁবে রাখতে পারবেন। কিন্তু মীরজাফর যেহেতু অমাত্যদের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী ছিলেন এবং যেহেতু তাঁর সঙ্গে জগৎশেঠদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল, তাই তাঁকে সামলানো উমিচাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তা ছাড়া মীরজাফরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও খুব একটা ভাল ছিল না। ওয়াটস লিখেছেন: ‘উমিচাঁদ সম্বন্ধে মীরজাফরের খুব একটা ভাল ধারণা নেই কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর ওপরে বিশ্বাস রেখে তাঁকে কাজে লাগানো প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এতে অবশ্য মীরজাফর বিশেষ আপত্তি করেননি, যদিও উমিচাঁদের প্রতি তাঁর বিরাগ বিন্দুমাত্র কমেনি।’৯৯

কিন্তু ইংরেজরা ইয়ার লতিফের বদলে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় উমিচাঁদের পরিকল্পনা মাঠে মারা গেল। তিনি দেখলেন নতুন যে ব্যবস্থা হতে যাচ্ছে তাতে তাঁর ভূমিকা হবে নগণ্য এবং তাতে তাঁর লাভও বিশেষ কিছু হবে না। আসলে তাঁর নিজের স্বার্থই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় চিন্তা। তাই তিনি নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন যে বিপ্লবের পরে নবাবের ধনদৌলতের একাংশ যাতে তিনি আত্মসাৎ করতে পারেন। তিনি ওয়াটসকে জানালেন যে বিপ্লবের পর নবাবের ধনসম্পদের পাঁচ শতাংশ তাঁকে দিতে হবে। ওয়াটসের ধারণা এর পরিমাণ দাঁড়াবে। দুই কোটি টাকা। মুর্শিদাবাদের রাজকোষে তখন চল্লিশ কোটি টাকা ছিল বলে অনুমান করা হয়, যদিও এটা নেহাতই অতিরঞ্জন৷ আবার রায়দুর্লভকে নিজের দলে টানার জন্য উমিচাঁদ দাবি করলেন যে, রায়দুর্লভকেও মীরজাফরের ভাগ থেকে কিছুটা দিতে হবে। এ-সব দেখে ওয়াটস, যিনি এতদিন উমিচাঁদের কাজকর্ম ও সাহায্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, এখন ক্লাইভকে লিখে পাঠালেন: ‘উমিচাঁদের এ-সব দাবির মধ্যে তাঁর উচ্চাভিলাষ, ধূর্ততা ও অর্থলোলুপতার নগ্নরূপ বেরিয়ে পড়ছে। তিনি সব দাবিগুলিই বজায় রাখতে চান, একটি দাবিও ছাড়তে রাজি নন।’১০০

মীরজাফরও ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির মধ্যে উমিচাঁদের প্রাপ্য সম্বন্ধে কোনও উল্লেখ থাকুক তা একেবারেই চাননি এবং তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন।১০১ জগৎশেঠরাও ওয়াটসকে জানিয়েছিলেন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিতে যেন উমিচাঁদের কথা কিছু না থাকে। ১৭ মে সিলেক্ট কমিটির বৈঠক বসল উমিচাঁদের দাবি সম্পর্কে আলোচনার জন্য এবং তাতে ঠিক হল যে, তাঁর ব্যবহারের জন্য শাস্তি ও অপমানই তাঁর প্রাপ্য, কোনও পুরস্কার নয়। তারপর কমিটি বিবেচনায় বসল:১০১

উমিচাঁদকে কীভাবে আমরা এমন করে ফাঁকি দেব যে তিনি তা জানতেই পারবেন না, সেটা ভাবতে হবে। একদিকে তাঁর অন্যায় আবদার ও অসঙ্গত দাবিগুলি প্রত্যাখ্যান করলে বা তা মানতে দ্বিধা দেখালে আমাদের বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আমাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে কোনও কাজে লাগবে না, তাঁর অত্যধিক সব দাবি মেনে নেওয়াও অত্যন্ত অনুচিত। কিন্তু তাঁর স্বার্থ আমরা একেবারেই দেখছি না এবং তাঁকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছি, উমিচাঁদের মতো চরিত্রের লোককে এমন ভাব দেখালে তাতে প্ররোচিত করাই হবে এবং সেক্ষেত্রে তিনি আমাদের সর্বনাশ করতে উঠে-পড়ে লাগবেন। তা হলে আমাদের সব পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।

এ-সব ভেবে কমিটি দুটি চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিল। দুটিতেই মীরজাফর এবং ইংরেজরা সই করবে তবে একটিতে (লাল কাগজ) উমিচাঁদের প্রাপ্যের উল্লেখ থাকবে কিন্তু অন্যটিতে (সাদা কাগজ) তা সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হবে।১০২

সেই একই দিনে অর্থাৎ ১৭ মে ওয়াটস ক্লাইভকে লিখলেন যে মীরজাফর তাঁকে জানিয়েছেন, তিনি উমিচাঁদকে বিশ্বাস করবেন না এবং নেহাত প্রয়োজনের খাতিরেই তাঁর সঙ্গে বাহ্যত ভাব দেখিয়ে যাবেন।১০৩ আসলে ততদিনে উমিচাঁদের প্রতি ইংরেজদের মনোভাব পুরোপুরি পাল্টে গেছে। তারা এখন তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ভিলেন’ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে এবং সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে যে তিনি একজন ‘আদি ও অকৃত্রিম দুর্জন’। তাই তারা ঠিক করল যে বিপ্লব একবার সফল হয়ে গেলে তাঁর সঙ্গে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবহার করা হবে। ক্লাইভ ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন, উমিচাঁদকে মিষ্টি কথায় তোষামোদ করে আপাতত কার্যোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ভলিয়ে ভালিয়ে রাখতে।১০৪ ওয়াটসও তাঁর দিক থেকে ক্লাইভকে জানালেন যে তিনি যেভাবে উমিচাঁদকে প্রতারিত করার মতলব করেছেন, হয় সেটাই করা হোক কিংবা এমন ভাব দেখানো হোক যে, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছি যাতে উমিচাঁদকে আমাদের গোপন কাজকর্ম থেকে দূরে রাখা যায়।’১০৫ কিন্তু ইংরেজদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে উমিচাঁদ পলাশিতে গিয়ে দুর্লভরামের সঙ্গে দেখা করেন এবং ইংরেজদের অভিসন্ধি সম্বন্ধে তাঁকে সতর্ক করে দেন। এতে ওয়াটস ভীষণ মুষড়ে পড়েন কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে এই সাক্ষাতের ফলে ‘আমাদের সঙ্গে মীরজাফরের যে পরিকল্পনা’ তা ভেস্তে গেল। এর ক’দিন পর রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদ ফিরলে তাঁকে যখন মীরজাফরের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হল তখন তিনি তাতে যে টাকাকড়ি, লেনদেনের ব্যাপার ছিল তা নিয়ে প্রবল আপত্তি জানালেন। ওয়াটসের ধারণা, পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে উমিচাঁদের শলাপরামর্শের ফলেই রায়দুর্লভ এরকম করলেন।১০৬ মীরজাফর চুক্তি স্বাক্ষর করার পরদিন ওয়াটস লেখেন যে, রায়দুর্লভ স্বীকার করেছেন উমিচাঁদ তাঁর কানে বিষমন্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁকে বলেছিলেন যে, একবার ইংরেজরা মুর্শিদাবাদ পৌঁছুলে তিন বছরের আগে তারা সেখান থেকে নড়বে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেন যে ‘আমাদের ব্যাপারটা কাচিয়ে দিতে ওই ধূর্ত সাপ [উমিচাঁদ] কোনও কিছুই করতে বাকি রাখেনি।‘১০৭

ওয়াটসের ধারণা, উমিচাঁদ যখন বুঝতে পারলেন যে তাঁর বিপদের সম্ভাবনা নেই তখন তিনি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে দেন এবং তা ওয়াটস, মীরজাফর এবং অন্যদের একবারে চরম পরিণতির মুখে প্রায় ঠেলে দিয়েছিল।১০৮ উমিচাঁদ সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দিয়েছিলেন কি না তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের ভয় দেখিয়েছিলেন, তারা যদি তাঁকে পরিত্যাগ করে তা হলে তিনি নবাবের কাছে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেবেন। তিনি সত্যিই তা আদৌ করতেন কি না সেটা অন্য প্রশ্ন—ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখানোটাই ইংরেজদের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। সিরাজদ্দৌল্লা যদি কোনও বিশ্বস্তসূত্রে চক্রান্তের কথা জানতে পারতেন, তা হলে তিনি অবশ্যই মীরজাফরকে খতম করে দিতেন এবং খুব সম্ভবত ফরাসিদের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের সঙ্গে মোকাবিলা করতেন। উমিচাঁদের দিক থেকে এ সময় ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেওয়ার কোনও যৌক্তিকতা দেখা যায় না কারণ তাতে তাঁর পক্ষে নবাবের কাছ থেকে নগদ টাকাকড়ি বা পারিতোষিক পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। অন্যদিকে নবাবকে ষড়যন্ত্রের কথা জানাতে গেলে তিনি যে নিজেই এতে জড়িত ছিলেন সেটা বেরিয়ে পড়ত এবং তা হলে তিনি নবাবের রোষানলে পড়তেন। তাঁর পক্ষে সবচেয়ে নিরাপদ পন্থা ছিল, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা এবং বিপ্লব সফল হলে তিনি লাভবান হচ্ছেন কি না সেটা দেখা।

ষড়যন্ত্র যখন পাকা হতে চলেছে তখন (৫ জুন) কলকাতায় এটা নিয়ে কানাকানি শুরু হয়ে গেল এবং মুর্শিদাবাদে ৭ জুন নাগাদ এ-খবর ছড়িয়ে পড়ে।১০৯ ওয়াটস মুর্শিদাবাদ ছাড়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন কিন্তু পাছে উমিচাঁদ ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে দেন, সেই ভয়ে তাঁকে ওখানে রেখে তিনি পালাতে পারছিলেন না। তাই ঠিক হল, বিপ্লবের পরে উমিচাঁদকে মুর্শিদাবাদে ইংরেজদের প্রধান এজেন্ট করা হবে— এ-আশ্বাস দিয়ে স্ক্র্যাফ্টন তাঁকে কলকাতা নিয়ে যাবেন। এভাবে স্ক্র্যাফ্টন উমিচাদঁকে নিয়ে কলকাতা পৌঁছুলেন ৮ জুন।

মীরজাফরকে মসনদে বসাবার পর জগৎশেঠের বাড়িতে যখন মিটিং শেষ হল তখন স্ক্র্যাফ্‌টন উমিচাদঁকে জানালেন, লাল কাগজের চুক্তি আসলে একটি ভাঁওতা এবং উমিচাঁদ একেবারে কিছুই পাবেন না। রবার্ট ওরম লিখেছেন, এ-কথা শুনে উমিচাঁদের মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল এবং তিনি মূৰ্ছা গেলেন। তাঁর রক্ষীরা তাকে ধরে না ফেললে তিনি মাটিতে পড়ে যেতেন। তিনি আরও বলছেন যে, এর পর উমিচাঁদ একদম পাগল হয়ে গেলেন।১১০ কিন্তু এটা সত্য বলে মনে হয় না। কারণ এর পরেও উমিচাঁদ সুস্থ শরীরে এবং বহাল তবিয়তে থেকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। ক্লাইভ তাঁকে কোম্পানিকে সোরা সরবরাহ করার একচেটিয়া অধিকার দিতে চেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

ক্লাইভ লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে লিখেছিলেন (৬ আগস্ট ১৭৫৭):১১১

উমিচাঁদ ওয়াটসের সঙ্গে মিলে বেশ ভাল কাজই করছিলেন কিন্তু আমার মনে হয় নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধূর্ততার সঙ্গে অনেক কুকর্মও করার চেষ্টা করেছেন। তাই আমি তীর্থ করতে তাঁকে মালদহে যেতে পরামর্শ দিলাম। ঠিকমতো চালাতে পারলে এঁকে দিয়ে অনেক কাজ করানো যাবে। সে কারণে এঁকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করাটা ঠিক হবে না।

তবে এর পরে উমিচাঁদ বেশিদিন বাঁচেননি। সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তিনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। তা সত্ত্বেও ইংরেজরা তাঁকে শেষপর্যন্ত প্রতারিত করায় নিদারুণ আশাহত হয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

রায়দুর্লভ

মীরজাফর, জগৎশেঠ বা উমিচাঁদের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর যোগ অনেকটাই পরোক্ষ। নবাবের দেওয়ান এবং সৈন্যবাহিনীর একাংশের অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও দুর্লভরাম নবাবের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণত বলা হয় এর মূল কারণ সিরাজদ্দৌল্লা হঠাৎ মোহনলালকে সব অমাত্যদের ওপর বসিয়ে দিলেন এবং এই মোহনলাল আলিবর্দির আমলের সব পুরনো অমাত্যদের হেনস্থা ও অপমান করতে লাগলেন।১১২ ফারসি ঐতিহাসিকরা মীরজাফর ও রায়দুর্লভের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কথা বলেছেন এবং তাঁদের ধারণা উক্ত দু’জন জগৎশেঠদের সঙ্গে মিলে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাবার জন্য পলাশির ষড়যন্ত্র করেছিলেন।১১৩ স্ক্র্যাফ্টনও বলেছেন যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগ থাকায় নবাব তাঁকে সন্দেহ করতেন। আর গোলাম হোসেন লিখেছেন, সিরাজদ্দৌল্লা সন্দেহ করেছিলেন যে দুর্লভরামের সঙ্গে মিলেই মীরজাফর দরবারের অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীকে সংগঠিত করেছিলেন। তবে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার বা তাঁদের কারারুদ্ধ করার মতো সাহস সিরাজের হয়নি।১১৪

যদিও এটা সত্য যে মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের বেশ ঘনিষ্ঠতাই ছিল, তা সত্ত্বেও এটা বলা যায়, রায়দুর্লভ কিন্তু চক্রান্তের প্রথম দিকে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। খুব সম্ভবত ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধার করা পর্যন্ত তিনি দরবারের ইংরেজ-বিরোধী ও ফরাসিদের প্রতি অনুকূল গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেজন্যই জাঁ ল’ ভেবেছিলেন যে দরবারে রায়দুর্লভ একমাত্র ব্যক্তি যাঁর ওপর তাঁর সবচেয়ে বেশি ভরসা করা উচিত। তাঁর মতে, ক্লাইভ বাংলায় আসার আগে রায়দুর্লভকে ইংরেজ-বিরোধী বলে গণ্য করা যেতে পারে। রায়দুর্লভও এমন ভাব দেখাতেন যে তিনিই ইংরেজদের পরাজিত করে কলকাতা থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু ক্লাইভ কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে এসে ৫ ফেব্রুয়ারিতে যখন নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হলেন তা দেখে রায়দুর্লভের চোখ ছানাবড়া। জাঁ ল’-র ভাষ্য অনুযায়ী ওই যুদ্ধে তিনি [রায়দুর্লভ] ইংরেজদের ভয়ে ল্যাজ তুলে পালানো ছাড়া আর কিছুই করেননি। তখন থেকেই তিনি অন্য মানুষ। তিনি নাকি ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করার মতো ভীতিপ্রদ আর কিছুকে মনে করতেন না। সম্ভবত ক্লাইভের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর রায়দুর্লভ দরবারের রাজনীতিতে তাঁর দলবদল করেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, ইংরেজদের প্রতি এই ভয় থেকেই যে-জগৎশেঠদের প্রবল প্রতাপ ও প্রতিপত্তির জন্য তিনি তাঁদের প্রচণ্ড ঈর্ষা করতেন, শেষপর্যন্ত তাঁদের দিকেই তিনি ঝুঁকলেন। ফলে ফরাসিদের হয়ে তিনি একটা কথাও আর নবাবকে বললেন না। এটা ঠিক যে দেশীয় চক্রান্তকারীদের নিজেদের মধ্যেও নানা টানা-পোড়েন ছিল। জগৎশেঠ ও রায়দুর্লভের মধ্যে মোটেই সদ্ভাব ছিল না যদিও দু’জনেই মীরজাফরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং শেষপর্যন্ত সবাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য—সিরাজদৌল্লাকে হঠানো—পূর্ণ করতে হাত মেলালেন। তবে অন্য দু’জনের মতো রায়দুর্লভ কিন্তু প্রথম থেকে ষড়যন্ত্রে সামিল হননি। তিনি চক্রান্তে যোগ দেন একেবারে শেষ পর্যায়ে। জাঁ ল’ লিখেছেন, ‘নিজেকে অন্যদের, বিশেষ করে জগৎশেঠদের তাঁবে চলে যেতে হবে ভয়ে রায়দুর্লভ ঠিক করেছিলেন যে তিনি আপাতত নিরপেক্ষ থাকবেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও একেবারে স্থির করে রেখেছিলেন যে, যে-দল শেষপর্যন্ত ভারী হবে এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তাঁর মনে হবে, সে-দলেই তিনি যোগ দেবেন।’১১৫

রায়দুর্লভ ছিলেন বিহারের ডেপুটি গভর্নর জানকীরামের পুত্র। তবে তিনি পিতার বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন না। মৃত্যুর আগে জানকীরাম নবাব আলিবর্দিকে লেখেন যে, তাঁর পুত্ররা কেউ পাটনার (অর্থাৎ বিহারের) শাসনকার্য চালাতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় না। তাই তাঁর অবর্তমানে তাঁর পেশকার রাজা রামনারায়ণকে যেন বিহারের ডেপুটি গভর্নরের পদে নিযুক্ত করা হয়। এ-পরামর্শ মেনে আলিবর্দি জানকীরামের মৃত্যুর পর ১৭৫৩ সালে রাজা রামনারায়ণকে ওই পদে নিযুক্ত করেন।১১৬ রায়দুর্লভ অবশ্য তাঁর পিতার জীবিতাবস্থায় মুর্শিদাবাদে সৈন্যবিভাগের হিসাবপত্র দেখার কাজে ডেপুটি দেওয়ান হিসেবে কাজ করতেন এবং তাঁর পিতার মৃত্যুর পর আলিবর্দি তাঁকে ওই বিভাগেরই দেওয়ান পদে উন্নীত করেন। তাঁর কাজকর্ম এতই ভাল হচ্ছিল এবং তিনি সবার এতই প্রশংসা লাভ করেছিলেন যে মুর্শিদাবাদের দরবারে বিহারের স্বার্থ দেখার জন্য রামনারায়ণ তাঁকে দরবারে বিহারের ডেপুটি গভর্নরের প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। আলিবর্দির বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মধ্যে রায়দুর্লভ ছিলেন অন্যতম।১১৭

মীরজাফরের সঙ্গে রায়দুর্লভের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও, ইংরেজদের সঙ্গে মীরজাফরের চুক্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি যোগ দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তা না হলে এর ক’দিন আগে উমিচাঁদ পলাশিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করায় ইংরেজরা তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে বলে এত ভয় পেত না। রায়দুর্লভ যে চুক্তির ব্যাপারে প্রথমে আপত্তি করেছিলেন সেটা, ইংরেজদের সন্দেহ, উমিচাঁদের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ফল। ওয়াটস মনে করতেন মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুল। তাই তিনি লিখেছিলেন যে মীরজাফর রায়দুর্লভের সঙ্গে পরামর্শ না করে চুক্তিতে সই করবেন না।১১৮ ইংরেজরা আসলে রায়দুর্লভ সম্বন্ধে সন্দেহমুক্ত হতে পারছিল না। তাই ক্লাইভ ৬ জুনও ওয়াটসকে লেখেন যে, তাঁর সন্দেহ, মীরজাফর ও ইংরেজদের উভয়ের প্রতিই রায়দুর্লভ বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।১১৯ বিপ্লবের পরেও কিন্তু তিনি রায়দুর্লভের প্রতি সদয় ছিলেন না। সিলেক্ট কমিটিকে তিনি ২৭ জুন লিখলেন : ‘আমি কালই মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি কারণ রায়দুর্লভের হাতে যে প্রচণ্ড ক্ষমতা এবং সেই সঙ্গে তাঁর ছলনাচাতুরি ও দুষ্টবুদ্ধি মিলে নবাব এবং আমাদের উভয়েরই পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। তা আটকাতেই আমার যাওয়া প্রয়োজন।’১২০ যা হোক নবাব হওয়ার পর মীরজাফর দুর্লভরামকে তাঁর প্রধান অমাত্য ও সব দায়িত্বের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই দু’জনের সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। গোলাম হোসেন লিখছেন, এই দু’জন এক সময় এত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন কিন্তু এখন পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তাঁদের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ এবং একে অপরের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন।১২১ এর ফলে দু’জনের মধ্যে যে বিরোধের সৃষ্টি হয় তাতে ক্লাইভ দুর্লভরামকে সমর্থন করেন কারণ পলাশি-উত্তর ক্ষমতার লড়াইয়ে দুর্লভরামের পেছনে দাঁড়ানোই ইংরেজদের স্বার্থের অনুকূল ছিল।

ইয়ার লতিফ

পলাশির ষড়যন্ত্রে ইয়ার লতিফের ভূমিকা নিতান্তই নগণ্য। উত্তরভারতীয় এই যোদ্ধা ছিলেন দু’হাজারি মনসবদার। জগৎশেঠদের সুরক্ষার জন্য তিনি তাঁদের কাছ থেকে একটা মাসোহারা পেতেন। নবাবের সৈন্যবাহিনীতে তাঁর স্থান খুব একটা উঁচুতে ছিল না। তবু তাঁর ছিল প্রবল উচ্চাকাঙক্ষা। তাই ওয়াটস যখন উমিচাঁদের সাহায্যে সিরাজের জায়গায় নবাব হওয়ার বাসনা আছে এমন কারও খোঁজ করছিলেন, তখন ইয়ার লতিফ উমিচাঁদকে তাঁর মনোবাসনার কথা ব্যক্ত করেন এবং ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিতে তিনি রাজি আছেন বলে জানান। তিনি এটাও বলেন যে, জগৎশেঠরা তাঁর পেছনে আছেন যেটা পরে মীরজাফরও দাবি করেছিলেন। যদিও ওয়াটস উমিচাঁদের মারফতই ইয়ার লতিফের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তবে সম্ভবত ইয়ার লতিফ উমিচাঁদেরই পছন্দসই লোক। ইয়ার লতিফের প্রস্তাব যে শুধু ওয়াটসই লুফে নিলেন তা নয়, ক্লাইভও এ-প্রস্তাবে সায় দিলেন। যদিও স্ক্র্যাফ্টন বলেছেন, ইয়ার লাতিফ নবাব হওয়ার পক্ষে ‘যোগ্য লোক’ এবং তাঁর পেছনে জগৎশেঠদের সমর্থন আছে এবং যদিও ওয়াটস প্রথমে প্রায় একই ধরনের কথা বলেছিলেন, ক্লাইভ কিন্তু ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানতেন না। তা সত্ত্বেও তিনি লতিফকে সিরাজের পরিবর্তে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় সামিল হয়েছিলেন।১২২ আসলে ইংরেজরা বিপ্লব ঘটাবার আগ্রহে ও তাগিদে সিরাজদৌল্লার পরিবর্তে নবাব হতে চায় এমন যে-কোনও রাজপুরুষকে খুঁজে বার করতে চাইছিল। ব্যক্তি হিসেবে তিনি কেমন হবেন তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা ছিল না। এ-বক্তব্য যে একেবারে যথার্থ তার প্রমাণ, ইয়ার লতিফকে নবাব করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক’দিন পরেই যখন মীরজাফরের হদিস পাওয়া গেল, তখন তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ইয়ার লতিফকে পরিত্যাগ করে মীরজাফরকে নবাব করার পরিকল্পনা করল। আমরা অন্যত্র বলেছি, ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে ইয়ার লতিফকে সামনে রেখে সিরাজদৌল্লাকে হঠাবার যড়যন্ত্র সফল করা মুশকিল হতে পারে। সেজন্য যেই মীরজাফরের মতো শক্তিশালী আরেকজন প্রার্থী পাওয়া গেল, তক্ষুনি তারা ইয়ার লতিফকে বাদ দিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নিল।

খোজা ওয়াজিদ

বাংলার দুই বণিক রাজা জগৎশেঠ ও উমিচাঁদের মতো অন্য বণিকরাজা আর্মানি খোজা ওয়াজিদ কিন্তু পলাশির চক্রান্তে যোগ দিয়েছিলেন একেবারে শেষ পর্যায়ে— যখন চক্রান্ত একেবারে পাকা। তাই তিনি কেন যে শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগ দিলেন তা বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। প্রথম থেকেই ওয়াজিদ ছিলেন নবাব সিরাজদৌল্লার একান্ত আপনজন ও অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন, নবাবের অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের একজন, ফরাসিদের বন্ধু এবং সে হিসেবে ইংরেজবিরোধী। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনিও সিরাজদৌল্লাকে পরিত্যাগ করে তাঁর শত্রুদের সঙ্গে যোগ দেন এবং ইংরেজদের বিপ্লবের পরিকল্পনায় নিজেকে যুক্ত করেন।

ওয়াজিদ যে ১৭৪০ ও ৫০’-এর দশকে বাংলার বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।১২৩ বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যের রাজধানী হুগলি থেকেই তিনি তাঁর ব্যবসার সাম্রাজ্য চালাতেন, সূক্ষ্ম কূটনীতি অবলম্বন করে এবং প্রয়োজনমতো নবাব আলিবর্দিকে আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে ওয়াজিদ নবাবের দরবারে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রকৃতপক্ষে হুগলি ফৌজদারের দরবারে সামান্য ব্যক্তি থেকে ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি মুর্শিদাবাদ দরবারে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন।১২৪ আর ১৭৪০-এর দশকের শেষদিকে দরবারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিহারের অর্থনীতির ওপর নিজের প্রায় একচেটিয়া দখল প্রতিষ্ঠিত করে নেন।

ওয়াজিদ একদিকে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে পণ্যসরবরাহের সূত্রে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ফরাসি ও ডাচ কোম্পানির সঙ্গে এবং উমিচাঁদের মাধ্যমে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গেও তাঁর ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে তিনি কিছু কিছু পণ্যের একচেটিয়া ব্যবসা করার চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে তিনি বাংলায় সোরা ও লবণের ব্যবসা কুক্ষিগত করেন।১২৫ তিনি বিহারের আফিং-এর ব্যবসাও নিজের একচেটিয়া আয়ত্তে আনার চেষ্টা করেছিলেন। ওখানেও দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি এ-সব করতে সক্ষম হন।১২৬ এভাবে বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি সমুদ্রবাণিজ্যে অংশ নিতে শুরু করেন। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে জানা যায়, ১৭৪০-এর দশকের মাঝামাঝি ওয়াজিদের বাণিজ্যতরী বাংলা থেকে পণ্যসম্ভার নিয়ে সুরাট যাচ্ছে আর পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে তাঁর বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী বিভিন্ন দিকে পাড়ি দিচ্ছে। ওই সব রেকর্ডস থেকে ওয়াজিদের এরকম অন্তত ছয়টি বাণিজ্যতরীর হদিস আমরা পাই যেগুলি হুগলি থেকে জেড্ডা (Jedda), মোখা (Mocha), বসরা (Basra), সুরাট ও মসুলিপট্টনমে পণ্যসম্ভার নিয়ে যাতায়াত করত। বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুম (Jan Kerseboom) ও কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল সুরাটে ওয়াজিদের বাণিজ্য কুঠির উল্লেখ করেছেন।১২৭

সুতরাং ১৭৫০-এর দশকের সংকটপূর্ণ সময়ে এ হেন ওয়াজিদ যে বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। প্রায় সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইউসুফ আলি খান লিখেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দির বিশেষ প্রিয়পাত্র এবং ব্যক্তিগত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। হুগলির সবচেয়ে বড় সওদাগর ওয়াজিদের ব্যবসা-বাণিজ্য এতই সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে যে তিনি তা থেকে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। তিনি সাধারণত ফখর-উল-তুজ্জার (সওদাগরের গর্ব) হিসেবেই পরিচিত ছিলেন।১২৮ তাঁর প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার আরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে। ডাচ কোম্পানির প্রধান হাউখেনস (Huijghens) ১৭৫০-এর প্রথমদিকে তাঁর Memorie-তে লেখেন যে, ওয়াজিদের সঙ্গে ডাচ কোম্পানির ভাল সম্পর্ক রেখে চলা উচিত কারণ মুর্শিদাবাদ দরবারে তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত প্রবল।১২৯ বস্তুত বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রায় সব ডাইরেক্টর মুর্শিদাবাদ দরবারের সঙ্গে ওয়াজিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে কথা ও সেখানে তাঁর বিশিষ্ট স্থান সম্বন্ধে মন্তব্য করে গেছেন। ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীরাও দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব দেখে একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী কিংবা তিনি ‘নবাব সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।’১৩০ বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তা ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টর ইয়ান কারসেবুমের লেখা থেকেও স্পষ্ট। কারসেবুম তাঁর ‘মেমোরি’-তে ১৭৫৫ সালে লেখেন :১৩১

বাংলায় যে-সব গণ্যমান্য ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের কোম্পানির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন, তাদের মধ্যে খোজা ওয়াজিদ অন্যতম। সম্প্রতি তাঁকে ফখর-উল-তুজ্জার উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। এর অর্থ তিনি ‘সম্পদের পূজারি’। প্রকৃতই তিনি শাসককুলের ধনসম্পত্তির রক্ষকের ভূমিকা নিয়েছেন। তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এঁদের প্রয়োজনমতো অর্থ সাহায্য করেন, কোনও রকম জোরজুলুমে বাধ্য হয়ে নয়।

সেই বছরই কারসেবুমের পরবর্তী ডাইরেক্টর টেইলেফার্ট (Taillefert) মন্তব্য করেন যে, কোম্পানির উপনিবেশ চুঁচুড়াতে ওয়াজিদের মতো এমন সব সম্মানিত ও প্রতিপত্তিশালী সওদাগরকে বসবাস করার অনুমতি দেওয়া ঠিক হয়নি। কারণ এঁরা একদিকে সমুদ্রবাণিজ্য করেন অন্যদিকে অন্তর্বাণিজ্যেও লিপ্ত। ফলে এঁদের ডাচ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী বলেই গণ্য করা যায়। এঁরা নিজেদের ডাচ কোম্পানির ডাইরেক্টরদের থেকে বড় না ভাবলেও তাদের সমকক্ষ বলে মনে করেন। ১৩২

উপরোক্ত বর্ণনা থেকেই প্রাক্-পলাশি বাংলার রাজনীতিতে ওয়াজিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। মুর্শিদাবাদ দরবারে ওয়াজিদের প্রভাব যে কতটা প্রবল তার প্রমাণ, সিরাজদৌল্লা মসনদে বসার পর তাঁকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করেন। জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে ওয়াজিদ ইউরোপীয়দের সঙ্গে নবাবের কটনৈতিক আলাপ-আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন।১৩৩ ইংরেজরা কলকাতা থেকে বিতাড়িত হবার পরে মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে রবার্ট ক্লাইভ ও মেজর কিলপেট্রিক (Killpatrick) বাংলায় এসে ওয়াজিদকে (অবশ্য অন্য দু’জন বণিকরাজাকেও) অনুরোধ করেন, কোম্পানি ও নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের ব্যবস্থা করতে।১৩৪ আবার ইংরেজরা হুগলি বন্দর আক্রমণ ও লুঠ করার পর নবাবের সঙ্গে শান্তিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলোচনা করার জন্য ক্লাইভ ওয়াজিদকেই পাঠান ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭। ওয়াজিদ ক্লাইভকে জানিয়েছিলেন যে এই শর্তগুলির মধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ নবাব মেনে নিলেও, অন্য শর্ত যে তাদের মুদ্রা তৈরির স্বাধীনতা দিতে হবে, সেটা নবাব কিছুতেই মেনে নেবেন না।১৩৫ এই থেকেই বোঝা যায় যে ওয়াজিদ তদানীন্তন বাংলার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রের বাস্তব পরিস্থিতি সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি জানতেন জগৎশেঠরা টাঁকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকার ভোগ করছিলেন এবং তাঁরা কোনওমতেই এটা হাতছাড়া হতে দেবেন না।১৩৬ সমসাময়িক নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট, ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের ফলে ওয়াজিদ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তিনি কিন্তু নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন।১৩৭

মুজাফ্ফরনামা-র লেখক করম আলি বলেছেন যে, ওয়াজিদ নবাব আলিবর্দি ও সিরাজদৌল্লা উভয়কেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে উসকানি দিয়েছিলেন।১৩৮ এটা অবশ্য ওয়াজিদের প্রতি ক্লাইভসহ ইংরেজদের যে মনোভাব তারই প্রতিধ্বনি। এর ওপর নির্ভর করা যায় না। ক্লাইভ ওয়াজিদকে ফরাসিদের ‘এজেন্ট’ বলে মনে করতেন।১৩৯ নিজের স্বার্থ ওয়াজিদ ভাল করেই বুঝতেন এবং তিনি এটাও ভাল করে জানতেন, ইংরেজদের বিতাড়িত করে তাঁর কোনও স্বার্থসিদ্ধিই হবে না। তাঁর সোরা ও লবণের একচেটিয়া ব্যবসা বা আফিং-এর বাণিজ্য কিংবা তাঁর সমুদ্রবাণিজ্য, কোনওটাই ইংরেজদের তাড়িয়ে দিলে খুব কিছু লাভবান হবে না। তবে এ-কথা সত্য যে তিনি ইংরেজদের চেয়ে ফরাসি ও ডাচদের প্রতি বেশি অনুকূল ভাবাপন্ন ছিলেন। কিন্তু প্রথমোক্ত দু’জনের সঙ্গে তাঁর যে সম্পর্ক তা ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের পরিপন্থী ছিল না। জাঁ ল-’র মন্তব্যই সঠিক যে ওয়াজিদ সবার সঙ্গেই ভাল সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইতেন।১৪০ তবে তাঁর নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে সাম্রাজ্য তা বজায় রাখাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য—যে-কোনও মূল্যেই তিনি তা করতে প্রস্তুত ছিলেন। সম্ভবত এ জন্যই তিনি ১৭৫২ সালে মসনদের ভাবী উত্তরাধিকারী সিরাজদৌল্লার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি এবং দরবারে প্রতিপত্তি নবাবের আনুকূল্যের ওপরই সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। অচিরেই তিনি সিরাজের ঘনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গ পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম বলে পরিগণিত হন।

জাঁ ল’-র সঙ্গে ওয়াজিদই সিরাজদৌল্লার পরিচয় করিয়ে দেন। ল’ তাঁর সম্বন্ধে যে বিবরণ দিয়েছেন তা শুধু আকর্ষণীয় নয়, অনেকাংশে সঠিকও বটে। তিনি লিখেছেন:

সবাই জানে ওয়াজিদ আমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী এবং তিনি হুগলির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। তবে তিনি খুবই দুর্বল প্রকৃতির লোক। খুব সম্ভবত তিনি শেঠদের পছন্দ করতেন না। তাঁদের ভয় করতেন। সেজন্য আমাদের দিক থেকে তাঁর প্রয়োজনীয়তা বিশেষ ছিল না।১৪১

অবশ্য বাইরে থেকে ওয়াজিদের সঙ্গে শেঠদের শত্রুতা বোঝা যেত না, যদিও তাঁরা যে পরস্পরের বন্ধু ছিলেন না সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সম্ভবত এই কারণেই দরবারের ষড়যন্ত্রীদের মধ্যে জগৎশেঠরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন বলেই ওয়াজিদ যতদিন সম্ভব পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন এবং নবাবের সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন।

ওয়াজিদ যে জগৎশেঠদের সঙ্গে নিজেকে প্রথম দিকে যুক্ত করেননি তার প্রমাণ দরবারে উমিচাঁদের ‘এজেন্ট’ হাজারিমলের ১৭৫৬-এর ২৩ নভেম্বরের চিঠিতে পাওয়া যায়। হাজারিমল লিখছেন, দরবারে জগৎশেঠরা ও ওয়াজিদ দুটো ভিন্ন দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং শেঠদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তিনি ইংরেজদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করছিলেন।১৪২

এখানে যে-প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসছে সেটা হচ্ছে, তা হলে ওয়াজিদ কেন শেষপর্যন্ত পলাশি চক্রান্তে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন? মনে হয় ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের পর তিনি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সম্বন্ধে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাই তিনি সিরাজদৌল্লাকে পরামর্শ দেন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করার জন্য। ১৭৫৭ সালের ২৩ মার্চ ইংরেজদের হাতে চন্দননগরের পতনের পর ওয়াটস লেখেন যে, ফরাসিদের পরাজয়ের পর সিরাজদৌল্লা ওয়াজিদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন কারণ ওয়াজিদ নবাবকে বুঝিয়েছিলেন যে ফরাসিরা ইংরেজদের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী এবং ইংরেজরা তাদের বিরুদ্ধে কখনওই সফল হবে না।১৪৩ এ থেকে স্পষ্ট যে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের সম্ভাব্য আঁতাতের ওপরই ওয়াজিদ তাঁর নিজের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে ভেবেছিলেন। সেটা তো হল না, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওয়াজিদ সবার শেষেই পলাশির ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ষড়যন্ত্র সফল করার পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই ওয়াটস ৩ মে ক্লাইভকে লেখেন:১৪৪

আমি শুনলাম যে খোজা ওয়াজিদের গোমস্তা শিববাবু আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।….তাঁর মনিব ফরাসিদের মঙ্গলার্থে আত্মোৎসর্গ করেছেন এবং প্রথম থেকেই তিনি দরবারে তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং তিনি সেখানে তাদের ‘এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ফরাসিদের ক্ষমতা ও সামরিক শক্তি সম্বন্ধে নানারকমের অতিরঞ্জিত গল্প বাজারে চালু করেছিলেন….সংক্ষেপে বলতে গেলে তিনি আমাদের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি শত্রুতা করেছেন এবং এখনও করে যাচ্ছেন। নবাবের সঙ্গে আমাদের যে ঝামেলা চলছে তার জন্য তিনিই অনেকাংশে দায়ী। তিনি নবাবকে আমাদের বিরুদ্ধে সবসময় উসকে দেন এবং আমাদের সম্বন্ধে প্রায়ই নবাবের মনে ভীতি ও আশঙ্কা ধরিয়ে দেন….শিববাবু এবং তাঁর মনিব আমার আর স্ক্র্যাফ্‌টনের প্রতি অত্যন্ত বিরূপ এবং পারলে আমাদের শেষ করে দেন।

যদিও ওয়াজিদ অনেকদিন পর্যন্ত পলাশি চক্রান্তের বাইরে ছিলেন, তা সত্ত্বেও তিনি ভাল করেই জানতেন যে দরবারের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি এতে জড়িত ছিলেন। রবার্ট ওরম জানিয়েছেন যে, দেশীয়দের মধ্যে ষড়যন্ত্রের অন্যতম নায়ক উমিচাঁদ ছিলেন ওয়াজিদের বন্ধু এবং অনেক ব্যবসাতেই তাঁর অংশীদার।১৪৫ খুব সম্ভবত উমিচাঁদ তাঁর ঘনিষ্ঠ ওয়াজিদের কাছে যড়যন্ত্রের কথা গোপন করেননি। তা ছাড়া দরবারের অমাত্যদের সঙ্গে ওয়াজিদের যে ঘনিষ্ঠতা ছিল এবং সারা দেশে তাঁর নিজের বিস্তৃত ব্যবসায়িক সংগঠনের যে-সব লোকজন ছিল তাদের মারফত তিনি নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে খবর পেতেন এবং একেবারে অন্ধকারে ছিলেন না। কিন্তু সুচতুর ও পাকা হিসেবি ওয়াজিদ একেবারে শেষ মুহূর্তে ষড়যন্ত্রে সামিল হন, যখন তিনি বুঝলেন যে, নবাবের পরিত্রাণের আর কোনও সম্ভাবনাই নেই। তিনি শেষ মুহুর্তে ষড়যন্ত্রে যোগ দেন কারণ তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক আনুকূল্য। ততদিনে মুর্শিদাবাদ থেকে জাঁ ল-’র বিতাড়নের ফলে নবাবের পক্ষে ফরাসিদের হস্তক্ষেপের সব সম্ভাবনাই নষ্ট হয়ে যায়। আবার, তাঁর দেওয়া পরামর্শ—নবাব ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করুন—ব্যর্থ হওয়ায় সিরাজদৌল্লাও তাঁর প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং তাঁকে পরিত্যাগ করেন। মে মাসের প্রথমদিকে দরবারে তাঁর অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে পড়ে এবং তিনি নিরাপত্তার এমনই অভাব বোধ করতে থাকেন যে সম্ভবত তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠিতে আশ্রয় নেন। ওয়াটস ক্লাইভকে ৯ থেকে ১৩ মে-র মধ্যে কোনও এক সময় লেখেন, ‘খোজা ওয়াজিদ এখন নবাবের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত। উমিচাঁদকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন আমি যেন তাঁকে আমাদের কুঠিতে লুকিয়ে আশ্রয় দিই।’১৪৬

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ওয়াজিদ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাম্রাজ্য বাঁচাতে অনন্যোপায় হয়েই একেবারে শেষ মুহুর্তে পলাশি চক্রান্তে যোগ দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁর এবং তাঁর মতো অন্য দু’জন বণিকরাজারও কপাল খারাপ— পলাশি, কিছুটা আগে-পরে, বাংলার এই তিন বণিকরাজারই পতন ডেকে আনে। ১৭৫৮ সালেই ওয়াজিদের পতন সম্পূর্ণ হয়ে যায়—তিনি ঘোষণা করেন যে ইংরেজরা তাঁর ব্যবসাবাণিজ্য ধ্বংস করেছে এবং তাঁকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে ওয়াজিদের পতন পলাশিতে ইংরেজবিজয়ের প্রত্যক্ষ ফল। অবশ্য জাঁ ল’ বলছেন যে, ওয়াজিদ তাঁর কূটনীতি ও হঠকারিতার শিকার হয়েছেন।১৪৭ এটা ঠিক মানা যায় না। যদি কোনও একটা বিশেষ কারণকে ওয়াজিদের পতনের মুখ্য কারণ হিসেবে ধরতে হয়, তবে তা হল তাঁর প্রতি ক্লাইভের প্রচণ্ড রোষ। ক্লাইভ তাঁকে ‘ভিলেন’ বলে মনে করতেন কারণ তিনি সন্দেহ করতেন ওয়াজিদ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করছিলেন। তা ছাড়াও ক্লাইভের ঘোরতর সন্দেহ ছিল যে পলাশির পর ১৭৫৭ সালে ফরাসিদের বাংলায় হস্তক্ষেপ করার পরিকল্পনার সঙ্গে ওয়াজিদও যুক্ত ছিলেন। ক্লাইভ ওয়াটসকে লেখেন: ‘কাগজপত্রের মধ্যে ওয়াজিদের একটা চিঠি পাওয়া গেছে যাতে ও-সব [ফরাসিদের পরিকল্পনা] ব্যাপারের উল্লেখ আছে। আমি চাই যে আপনি ওই ভিলেনের সর্বনাশের ব্যবস্থা করুন—ও কিন্তু মনেপ্রাণে ফরাসি৷’১৪৮ ইংরেজদের পক্ষে ওয়াজিদের সর্বনাশ সম্পূর্ণ করার সুযোগ এল ১৭৫৯-তে।

ওয়াজিদ বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজরা যতদিন বাংলায় ক্ষমতার শীর্ষে থাকবে, ততদিন তাঁর ধ্বংসোন্মুখ বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য রক্ষা করার কোনও উপায় নেই। তাই মরিয়া হয়ে তিনি আবার জুয়া খেলে নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলেন। জুয়ায় আবার হারলেও তাঁর আর বেশি কী ক্ষতি হবে কিন্তু জিতলে অনেক লাভ—হয়তো এটাই তিনি ভেবেছিলেন। তিনি ডাচদের সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন যে, ডাচরা বাংলা আক্রমণ করে ইংরেজদের তাড়াবার চেষ্টা করবে। কিন্তু পলাশির মতো, তাঁর এই দ্বিতীয় জুয়া খেলাও ব্যর্থ হল৷ ডাচদের পরাজয়ের পর ওয়াজিদের সর্বনাশ ঠেকানো আর কোনও রকমেই সম্ভব ছিল না। ক্লাইভ খুব উৎফুল্ল হয়ে ওয়াজিদের পতন বর্ণনা করেছেন: ‘আমি জানতাম যে নবাবের সঙ্গে আমাদের কলকাতায় যে সাম্প্রতিক ঝামেলাটা হয়েছিল তার প্রধান হোতা হচ্ছে ওই ‘রাসকেল’ ওয়াজিদটা। আবার আমাদের সঙ্গে ডাচদের বিরোধ বাঁধাতে সে এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই আমি ভাবলাম তাকে হাতকড়া পরানো দরকার যাতে সে ভবিষ্যতে মহামান্য নবাব [মীরজাফর], আপনি [মীরণ] এবং আমার [ক্লাইভ] মধ্যে যে দৃঢ় বন্ধুত্ব হয়েছে তা যেন ভাঙতে না পারে।’১৪৯ ওয়াজিদকে ধরে জেলে পোরা হল। সেখানে তিনি বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন।১৫০

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. পূর্বতন ঐতিহাসিকদের মতো (পিটার মার্শাল, রজত রায় ইত্যাদি) সম্প্রতি কুমকুম চ্যাটার্জীও (Merchants, Politics and Society, 1996, p. 103) বলেছেন যে ভারতীয় ষড়যন্ত্রকারীরাই সিরাজদৌল্লাকে হঠাবার জন্য চক্রান্তে যোগ দিতে ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এ বক্তব্য মোটেই যুক্তিগ্রাহ্য নয়। তিনি আরও বলেছেন যে ইংরেজরা নবাব-বিরোধী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিল কারণ তারা ভয় পেয়েছিল সিরাজদৌল্লা হয়তো ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে আঁতাত করবেন। আমরা অবশ্য তথ্য-প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছি তাঁর এই মতও গ্রহণ যোগ্য নয়।

২. ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 343.

৩. Scrafton, Reflections, p. 81.

৪. ঐ, পৃ. ৯৮।

৫. Watts’ to Governor and Fort William Council, 15 Aug. 1755, BPC, Range 1, vol. 28; FWIHC, vol. 1, pp. 884-85.

৬. Watts’ Memoirs, p. 37.

৭. ঐ, পৃ. ৪২।

৮. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec, I, p. 148; তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.

৯. Law’s Memoirs, Hill, III, p. 191.

১০. Watts’ Memoirs, p. 80.

১১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 392-93.

১২. ওয়াটস তাঁর পিতাকে, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 469.

১৩. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভ, ৬ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 465.

১৪. Hill, 1, p. clxxxiv; Hill, II, p. 367.

১৫. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

১৬. ঐ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 349.

১৭. ঐ, পৃ. ৩৫০৷

১৮. ঐ।

১৯. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, I, p. 351.

২০. ক্লাইভকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ২৪ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 357-58.

২১. ঐ, পৃ. ৩৫৮।

২২. Fort St. George, Select Committee Consultations, 1 Oct. 1756, Hill, II, p. 225; ক্লাইভকে ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল, ১৩ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, II, p. 234.

২৩. Scrafton, Reflections, p. 62.

২৪. সিয়র-উল-মুতাখারিন, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭১; রিয়াজ-উস-সলাতিন,পৃ. ৩৭০।

২৫. Michael Edwardes, Plassey, p. 84; Mark Bence-Jones, Clive of India, p. 189.

২৬. লন্ডনে সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ১১ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, pp. 232-33.

২৭. Ome Mss.,O.V.vol. 6, f. 1500.

২৮. পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

২৯. Powe Collection, Box 20, John Brown to Clive, 27 Feb. 1752, quoted in Mark Bence-Jones, Clive, p. 93.

৩০. ক্লাইভ তাঁর পিতাকে, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

৩১. পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩ বা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 210.

৩২. ঐ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p.243.

৩৩. ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিকে লেখা ফোর্ট সেন্ট জর্জের সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৩ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p.239.

৩৪. Fort St. George Public Consultations, 29 Sept. 1756, Hill, I, p. 222.

৩৫. পিগটকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৮ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 96-97.

৩৬. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৩৭. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, ff. 1212-14; Ome Mss. O.V. 170, f. 222.

৩৮. Scrafton, Reflections, p. 81.

৩৯. সম্প্রতি কুমকুম চ্যাটার্জী (Merchants, Politics and Society, pp. 103-04, fn. 4). আমার একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য মানতে দ্বিধা প্রকাশ করেছেন। আমি বলতে চেয়েছি যে প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার ব্যবসায়ী ও বাণিজ্যিক শ্রেণীর কোনও রকমের ‘কোলাবোরেশন’ গড়ে ওঠেনি যাতে করে কেমব্রিজ স্কুলের পলাশি সম্বন্ধে কোলাবোরেশন থিসিস আমি খণ্ডন করতে চেয়েছি। কারণ হিসেবে আমি দেখিয়েছি যে ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কুমকুম বলছেন, যেহেতু আমার বক্তব্যে ইউরোপীয় এবং এশীয় বণিকদের বাণিজ্যের তুলনামূলক যথেষ্ট পরিসংখ্যানের অভাব আছে, তাই আমার বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। তার মত যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত তা আমার বই, From Prosperity to Decline, ৫ম, ৭ম ও ৮ম অধ্যায় এবং এই বইয়ের ৪র্থ অধ্যায় ও আমার Etrafo 24h The Asian Merchants and Companies in Bengal’s Export Trade, Circa, mid-Eighteenth Century’, S. Chaudhury and M. Morineau, eds., Merchants, Companies and Trade: Europe and Asia in Early Modern Era’, পৃ. ৩০০-৩২০, একটু যত্ন করে পড়লেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণ পরিসংখ্যান আছে।

৪০. রজতকান্ত রায় (পলাশী, পৃ. ১৩৫) লিখেছেন যে মীরজাফর বাঁকিবাজার থেকে ডাচদের বিতাড়িত করেন—এটা সম্পূর্ণ ভুল।

৪১. ইউসুফ আলি, আওয়াল-ই-মহবৎ-জঙ্গ, যদুনাথ সরকারের Bengal Nawab গ্রন্থে উদ্ধৃত, পৃ: ১১৬-১১৯; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ২৬।

৪২. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১১৯-২১; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ২৬।

৪৩. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২৮, ১৪২-৪৩।

৪৪. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৪৯, ৫৬।

৪৫. ঐ, পৃ. ৪৯-৪৫।

৪৬. ঐ, পৃ. ৬৪; রিয়াজ, পৃ. ৩২৩।

৪৭. ইউসুফ আলি, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭২-৭৪; রিয়াজ, পৃ. ৩৭০; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৬ তারিখ-ই বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১৩১।

৪৮. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ: ১৩১; রিয়াজ, পৃ: ৩৭৫; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫।

৪৯. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৫; Hill, III, p. 217.

৫০. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬-৯৯।

৫১. Watts’, Memoirs, p. 82; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397; ৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 398; সিয়র, পৃ. ১৯৭, ২২৭-৩০; রিয়াজ, পৃ. ৩৭০।

৫২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 211; Scrafton, Reflections, pp. 72, 82.

৫৩. Select Committee Proceedings, Fort William, 26 June 1756, Hill, II, p. 430; Narrarve of Plassey, Hill, II, p. 450; যেমন পিটার মার্শাল, Bengal; রজতকান্ত রায়, পলাশী ; ‘Colonial Penetration’.

৫৪. Scrafton, Reflections, p. 98.

৫৫. ইউসুফ আলি, পৃ. ১২০।

৫৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৫৩।

৫৭. অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনে জগৎশেঠদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১০৯-১১৬ দ্রষ্টব্য।

৫৮. উইলিয়াম ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., India V,f. 1275; O.V .170, p. 397,

৫৯. পিগটকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368.

৬০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ৩০ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 437.

৬১. C. A. Bayly, Paris Lectures, p. 18.

৬২. S, Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 110.

৬৩. Orme Mss., India VI, f. 1455.

৬৪. ঐ, পৃ. ১৫২৫.

৬৫. Orme Mss., India, XVIII, f. 504.

৬৬. Law’s Memoir, Hill, III, P. 185.

৬৭. Watts’ Memoirs, p. 28.

৬৮. Hunter, Statistical Account, vol. IX, p. 254.

৬৯. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175.

৭০. কুমকুম চ্যাটার্জী লিখেছেন যে (পৃ. ১০৩) ১৭৫৭-র ঘটনাবলীর সঙ্গে ১৭২৭ এবং ১৭৪০-এ বাংলায় জগৎশেঠদের নেতৃত্বে যে দুটি বিপ্লব সংগঠিত হয়, তার কোনও তফাত নেই। ১৭৫৭ সালে একমাত্র নতুন জিনিস হচ্ছে ইংরেজদের উপস্থিতি। এটা সমস্ত ব্যাপারটাকে অতি সরলীকরণের প্রচেষ্টা। মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ইংরেজ ও ফরাসিদের সবল উপস্থিতি এবং বাংলার রাজনীতিতে উভয়ের সক্রিয় অংশ নেওয়ার ফলে আগের তুলনায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে পড়েছিল। পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা মুখ্য ভূমিকা না নিলে জগৎশেঠরা বিপ্লব করতে রাজি হত কি না সে-বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে, বিশেষ করে একদিকে যখন সিরাজদৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা ছিল এবং অন্যদিকে মোহনলাল, মীর মর্দান, আব্দুল হাদি খানের মতো নবাবের অনুগত গোষ্ঠীর একটি দল তৈরি হচ্ছিল।

৭১. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 175, 186.

৭২. ঐ, পৃ. ১৭৫।

৭৩. J. H. Little, Jagat Seth, p. 165; Marshall, Bengal, p. 76; Ray, পলাশী, পৃ. ১৫৬, ‘Colonial Penetation’, p. 14.

৭৪. Fort William Consultations, Fulta, 5 Sept., 1756; Bengal Secret and Military Consultations (Select Committee Consultations), Range A, vol.1.

৭৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২১৮; Watts’ Memoirs, P. 117. Scrafton, Reflections, p. 61; Law’s Memoir, Hill, III, p.172.

৭৬. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩।

৭৭. ক্লাইভকে রঞ্জিত রায়, ৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 213-14; রঞ্জিত রায়কে ক্লাইভ ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 219; নবাবকে ক্লাইভ, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 221; শেঠদের ক্লাইভ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 224.

৭৮. ক্লাইভকে জগৎশেঠদের চিঠি, ১৪ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 104.

৭৯. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।

৮০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 175; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২২৫।

৮১. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148

৮২. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 185, 208.

৮৩. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৩।

৮৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 193.

৮৫. ঐ, পৃ. ১৯৪।

৮৬. কুমকুম চ্যাটার্জী বলছেন (পৃ. ১০৩) যে উমিচাঁদ ইংরেজদের সঙ্গে মিলে পলাশি চক্রান্তের সূত্রপাত করেননি। কিন্তু আমরা এখানে যেসব তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি তাতে তাঁর বক্তব্য অসার প্রমাণিত হয়।

৮৭. Fort William Consultations, Fulta, 7 Oct. 1756; Bengal Secret and Military Consults. (Select Committee Consults.) Range A, vol. I.

৮৮. ক্লাইভকে লেখা উমিচাঁদের চিঠি, ২৮ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hil, II, p. 174.

৮৯. উমিচাদকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 174.

৯০. ওয়াটসকে লেখা সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 225.

৯১. বিস্তারিত বিবরণের জন্য আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ.১১৬-২০।

৯২. ঐ।

৯৩. Orme, Military Transactions, vol. II, pp. 50-51.

৯৪. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা চার্লস এফ নোবেলের চিঠি, ২২ সেপ্টেম্বর ১৭৫৬, Hill, III, p. 328।

৯৫. Eur. Mss. D. 283, f. 29; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 21.

৯৬. Scrafton, Reflections, p. 81.

৯৭. ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ২৬ মার্চ ১৭৫৭, Hill, II, p. 294.

৯৮. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৯৯. Watts’ Memoirs, p. 94.

১০০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 381. ওয়াটস লিখেছেন যে ‘সব শুনে মনে হয় নবাবের ধনসম্পদের পরিমাণ ৪০ কোটি টাকার মতো। ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

১০১. Hill, II, p. 382.

১০২. Proceedings of the Select Committee, 17 May 1757, Hill, II, p. 383.

১০৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৭ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 386.

১০৪. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 388-89.

১০৫. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭, Hill, If, p. 393.

১০৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

১০৭. Watts’ Memoirs, p.97; ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

১০৮. Watts’ Memoirs, p. 98.

১০৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ জুন ১৭৫৭, Hil, II, p. 398; ওয়াটস ক্লাইভকে, ৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, P. 400.

১১০. Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 154.

১১১. লন্ডনের সিক্রেট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ৬ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 465.

১১২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৫; Ome, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148; তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ১২৫, ১২৮।

১১৩. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৪; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৭।

১১৪. Scrafton, Rejlections, p. 12; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২২৪।

১১৫. Law’s Memoir, Hill, II, pp. 190-91.

১১৬. মুজফ্‌ফরনামা, পৃ. ৫১।

১১৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৮।

১১৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩১ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 396; ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 396-97.

১১৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

১২০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 431.

১২১. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৩৭, ২৫২।

১২২. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 343; Watts’ Memoirs, পৃ. ৭৭, ৮০; ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 353; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 362; ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

১২৩. ওয়াজিদ সম্বন্ধে তথ্যগুলি আমার প্রবন্ধ ‘Khwaja Wazid in Bengal Trade and Politics’, Indian Historical Review, vol. xvi, nos.l-2, pp. 137-44 থেকে সংগৃহীত।

১২৪. Mayor’s Court Records, Calcutta, 7 May 1751, Range 155, vol 24, f. 30vo.

১২৫. Bengal Letters Recd, vol. 22, para 18, f. 410; BPC, Range 1, vol. 26, f. 110, 2 April753; Ome Mss. 0. V. 134, f. 13; Mss. Eur. D. 283,f. 22.

১২৬. Dutch Director Huijghen’s ‘Memorie’, VOC 2763, f. 458, 20 March 1750; VOC 2732, ff. 9-10, HB 27, 24 Jan. 1750.

১২৭. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, VOC2849,f. 122, 14 Feb, 1755; Hill, II, p. 87.

১২৮. ইউসুফ আলি, জামিয়া-ই-তাদকিরা-ই-ইউসুফি, পৃ. ১৭।

১২৯. Huijghen’s ‘Memorie’, voc 2763,f. 467, 20 March 1750.

১৩০. BPC, Range 1, vol. 26, ff. 131vo-132vo, 3 May 1753.

১৩১. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, V0c2849, f. 128yo, 14 Feb. 1755.

১৩২. Tailleferr’s ‘Memoire’, VOC 2849,f. 264, 27 Oct, 1755.

১৩৩. Law’s Memoir, Hill, III, p. 187.

১৩৪. Select Committee Consults., Fulta, 22 Aug. 1756, quoted in Brijen Kr. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 89-90.

১৩৫. Hill, II, pp. 126-27.

১৩৬. জগৎশেঠদের টাকশালে মুদ্রা তৈরির একচেটিয়া অধিকারের প্রচেষ্টা বিস্তারিতভাবে আমার বই From Prosperity to Deiline-এ আছে, পৃ. ৭৭-৭৯।

১৩৭. ক্লাইভকে ওয়াজিদ, ১০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc, vol. 193, ff. 14-15; ওয়াজিদকে ক্লাইভ, ২১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Home Misc., vol. 193, ff. 125-26.

১৩৮. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৫৬, ৬৩।

১৩৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Orme Mss., India, X, f. li2vo.

১৪০. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190.

১৪১. ঐ।

১৪২. Select Committee Consults., Fulta, Bengal Secret and Military Consults., 23 Nov. 1756.

১৪৩. সিলেক্ট কমিটিকে ওয়াটাস, Select Committee Consults., Orme Mss., India V, f. A210; O.V. 170, f. 215.

১৪৪. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৩ মে ১৭৫৭, Hili, II, pp. 374-75.

১৪৫. জন পেইনকে ওরম, ৩ নভেম্বর ১৭৫৬, Orme Mss., O.V.28,f. 52.

১৪৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯-১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.

১৪৭. Law’s Memoir, Hill, III, p. 190, fn.1

১৪৮. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৪ আগস্ট ১৭৫৮, Ore Mss., India x, f. 112vo.

১৪৯. মীরণকে ক্লাইভের চিঠি, ২৭ নভেম্বর ১৭৫৯, Clive Mss. 269, no. 982.

১৫০. Mss. Eur.G. 37, Box 22.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *