রতনকান্তি গঙ্গামহলে ফিরে এসেছে। এসেই শুনেছে অবনীন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘসময়ের জন্য হাওয়া বদলে বেরিয়েছেন। দ্বিজেন্দ্রর জমিদার হওয়া উপলক্ষ্যে গায়ত্রীও বহুবছর বাদে শ্বশুরবাড়ি থেকে গঙ্গামহলে এসেছিল। কিছুদিন থেকে সে আবার ফিরেও গেছে। তার সাথে গিয়েছেন বীণাবালা। রাইপুরে ব্যবসার কাজ থাকায় তাদের সাথে গিয়েছেন বিভূতিনাথ সাহাও। প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝার পর গঙ্গামহল এখন পুরোপুরি শান্ত, স্থির এক জমিদার বাড়ি। এর কোথাও যেন আর কোনো অস্থিরতা, উত্তেজনা নেই। সব কিছুই চলছে সহজ স্বাভাবিকভাবে। রতনকান্তি এসে আগের মতোই তার সেই আগের ঘরখানাতেই উঠেছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করেনি। দিনকয় বাদে রতনকান্তি আবার দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলেও যাতায়াত শুরু করল। দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। যেন রতনকান্তির কথা তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন।
রতনকান্তি তাকে বলল যে সে সুদক্ষিণাকে আবার গান শেখাতে চায়। জবাবে দেবেন্দ্রনারায়ণ কিছু বলেননি। তবে তার কেন যেন মনে হয়েছে রতনকান্তি আশেপাশে থাকলে তার মন্দ লাগবে না। রতনকান্তির সাথে দেখা হলো হরিহরণেরও। প্রথম দর্শনেই রতনকান্তিকে ভারি পছন্দ হয়ে গেল হরিহরণের। সে খানিক নিশ্চিন্তও বোধ করতে লাগল। দিনকয়েকের জন্য সে আবারো ফিরে গেল বারোহাটি।
দেবেন্দ্রনারায়ণ এতকাল জীবন নিয়ে ভাবেননি। আজকাল খুব ভাবেন। জীবনজুড়েই মানুষ কেবল আরো ভালো আরো ভালো সময়ের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু দিনের শেষে গিয়ে সে আবিষ্কার করে, সেই আরো ভালো সময়গুলো সে আসলে পার করে এসেছে। কিন্তু সেই পার করা সময়েও সে কেবল আক্ষেপই করে গিয়েছিল আরো ভালো সময়েরই। কী আশ্চর্য এই মানবজনম। যার পুরোটাজুড়ে এমন করেই কেবল লেখা থাকে আক্ষেপের গল্প। মানুষ আসলে রোজ রোজ জীবনের নামে যা যাপন করে তার নাম আক্ষেপ জনম। শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য তাই জীবনের অন্য নাম হয়ে থাকে কেবলই আক্ষেপ। পাতার পর পাতা জটিল সব হিসেব কষে সে জীবনের ফলাফল পায় শেষ অবধি শূন্য।
দেবেন্দ্রনারায়ণের মনে হচ্ছে, এ জীবন এক অদ্ভুত অঙ্কের নাম। যার ফলাফল সবসময়ই শূন্যে নির্ধারিত। অথচ মানুষ এই সুনিশ্চিত ফলাফল জেনেও কি সুতীব্র সম্মোহনে সারাটাজীবন ধরে সেই জটিল হিসেবগুলোই না কষে চলে!
.
সুদক্ষিণা প্রথমে গান শিখতে বসতেই চায়নি। প্রথম ক’দিন তো আসেইনি। তবে শেষ অবধি এলেও বার বার উঠে যেতে চাইছিল। রতনকান্তি অবশ্য তাকে আটকেও রাখেনি। সে কেবল বলেছিল, সুদক্ষিণার বাবা আজকাল কেমন গম্ভীর আর দুঃখি দুঃখি চেহারা করে বসে থাকেন, আগের মতো কথা বলেন না, রাগেন না। সারাক্ষণ কেমন চুপটি মেরে বসে থাকেন। সুদক্ষিণা ভালো গান গাইতে পারলে তিনি আর তেমন করে বসে থাকবেন না। সুদক্ষিণার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে আবার আগের মতো হয়ে যেতে পারেন। এখন সুদক্ষিণা এই কাজটি করতে চায় কিনা!
রতনকান্তির এই কথা কাজে লেগেছে। সুদক্ষিণা আজকাল গান শিখতে আসছে। কিন্তু রতনকান্তি অবাক হয়ে আবিষ্কার করেছে এই মহলের কোথাও সর্বজয়া নেই। আগে দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলে ঢুকলেই পাখির মতো কলকল করে ছুটে চলা সর্বজয়ার উপস্থিতি সবার আগে টের পাওয়া যেত। কিন্তু এই এখানে সর্বজয়া যেন কোথাও নেই। এ যেন এক নীরব নিস্তব্ধ মৃত্যুপুরী। কিন্তু সর্বজয়ার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করাটা তার জন্য মোটেই শোভন নয় বলে সে জিজ্ঞেস করতেও পারছিল না। তবে সেদিন শেষ বিকেলে রতনকান্তি হঠাৎ সুদক্ষিণাকে বলল, দিদির কি গান একদমই ভালো লাগে না?
রতনকান্তির এই প্রশ্নে ছোট্ট সুদক্ষিণা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। সে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, দিদির না অসুখ করেছে।
রতনকান্তি খানিক চমকে গেল। সে বলল, অসুখ? কী অসুখ?
সুদক্ষিণা বলল, চুপচাপ অসুখ।
রতনকান্তি হাসল, চুপচাপ আবার কী ধারা অসুখ?
সুদক্ষিণা বলল, দিদি যে সবসময় চুপচাপ থাকে। কারো সাথে কথা বলে, ঘর থেকে বের হয় না। আলো দেখলে কেঁপে কেঁপে ওঠে! আমি মাকে, অতসীবালাকে জিজ্ঞেসও করেছি, কেউ কোনো জবাব দেয়নি। মা বলেছে দিদির অসুখ করেছে, সময় গেলে সেরে যাবে।
সুদক্ষিণার কথা শুনে রতনকান্তি ভারি আশ্চর্য হলো। সর্বজয়ার মতো কেউ ঘর থেকে বের হবে না। কারো সাথে কথা বলবে না। এ কেমন কথা! সে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কতদিন ধরে সে এমন কারো সাথেই কথা বলছে না?
সুদক্ষিণা খানিক ভেবে উত্তর দিলো, অনেক দিন। সেই যে যেদিন বাবা আসল।
রতনকান্তি এবার ভারি অবাক হলো। কী হয়েছে সর্বজয়ার? কোনো অঘটন? কিন্তু কী? সে বলল, দিদির সাথে তুমি কথা বলেছো?
সুদক্ষিণা মাথা কাত করে উত্তর দিলো, আমি বলেছি। দিদি বলেনি। আমি কত বলেছি, দিদি দিদি বলে ডেকেছি। কিন্তু দিদি একটা কথাও বলেনি। আমায় ধাক্কা মেরে সরিয়েও দিয়েছে।
রতনকান্তি এবার সত্যি সত্যিই চিন্তিত বোধ করছে। সে সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট্ট সুদক্ষিণার চোখ জল ছলছল। রতনকান্তি এই এতদিনে একবারও খেয়াল করেনি, তার সামনের এই ছোট্ট মেয়েটি তার দিদির জন্য বুকের ভেতর এমন জল ছলছল আবেগ পুষে রেখেছে।
রতনকান্তি বলল, দিদি কথা বলে না দেখে কষ্ট হয়?
সুদক্ষিণা ঠোঁট ফুলিয়ে বুকের কাছে হাত চেপে ধরে বলল, দিদির জন্য ব্যথা হয়। এইখানে ব্যথা হয়।
রতনকান্তির কী হলো সে জানে না। ছোট্ট পাখির ছানার মতোন সুদক্ষিণাকে সে বুকের ভেতর টেনে নিল। তারপর মাথার চুলের ভেতর হাত বোলাতে লাগল। মুহূর্তের জন্য যেন সে নিজের পরিচয়, সুদক্ষিণার পরিচয় ভুলে গেল। ছোট্ট সুদক্ষিণাকে তার মনে হলো কতদিনের চেনা, ঘরের মানুষ। সুদক্ষিণা রতনকান্তির বুকের ভেতর কী এক মমতার, নির্ভরতার ওম পেল কে জানে! তবে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
সেই থেকে রতনকান্তির সাথে সুদক্ষিণার ভারি একখানা বোঝাঁপড়ার সম্পর্ক হয়ে গেল। তারা একসাথে কথা বলে, গান গায়, হাসে, খুনসুঁটি করে। সুদক্ষিণা রোজ অপেক্ষা করে রতনকান্তি কখন আসবে! রতনকান্তি রোজ নিয়ম করে তাকে সর্বজয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। সুদক্ষিণারও রোজ সেই একই উত্তর, দিদি কথা বলে না।
সর্বজয়ার সাথে রতনকান্তির দেখা হয়ে গেল কাকতালীয়ভাবেই। সে নিচতলায় সিঁড়ির গোড়ায় বসেছিল। খগেনকে কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। এই মুহূর্তে দাসী অতসীবালা চেঁচাতে চেঁচাতে নেমে আসল। সে খগেনকে খুঁজছিল। কিন্তু আশেপাশে কোথাও খগেনকে না দেখে সে রতনকেই বলল, এখানে বসে না থেকে এই দিকে একটু এসে দেখে যাও। কী লঙ্কাকাণ্ডই না ঘটে গেছে!
রতনকান্তি কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে অতসীবালার পিছু পিছু উপরে উঠে এলো। অতসীবালা সর্বজয়ার ঘরের সামনে এসে বলল, তুমি একটু এইখানে দাঁড়াও। আমি ভেতরে দেখে আসছি আগে।
অতসীবালা ভেতরে দেখে এসে রতনকান্তিকে ডাকল। রতনকান্তি ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠল। এ কোন সর্বজয়া? এই সর্বজয়াকে সে চেনে না, জানে না। দেখেওনি কোনোদিন। ভোলা দরজার আলোয় পালঙ্কের উপর যেন এক ভয়ঙ্কর উন্মাদিনী বসে ফুঁসছে। রতনকান্তি ঢোকা মাত্রই সে ফোঁস করে মাথা ঘোরালো। তারপর তীক্ষ্ণ চিৎকারে হাতের কাছে যা পেল সব ছুঁড়ে মারতে লাগল। রতনকান্তি দরজার আড়ালে সরে গিয়ে আঘাত এড়ালো।
অতসীবালা বলল, চান নেই, খানা নেই। এভাবে কি মানুষ বাঁচে বলো? এর চেয়ে জীব-জন্তু হয়ে যাওয়াও ভালো। আর পারছি না। আজ যে করেই হোক একে চান করে, খাইয়ে আমি ঘরের বার করবই। অসুখ তো মানুষেরই হয়, কী বলো? আপদ বিপদও ঘটে। তাই বলে কি এভাবে জীবন শেষ হয়ে গেল?
রতনকান্তি মুখ ফসকে বলে ফেলল, কী হয়েছে উনার?
অতসীবালা যেন এবার খানিক ধমকে উঠল। বলল, কী হয়েছে সে জেনে তোমার কাজ নেই। শুধু এইটুক জেনো, এর মরার শখ হয়েছে ভারি। সাত সকালে বারান্দা থেকে লাফানোর শখ হয়েছিল। সেই সকাল থেকে চাইছি একে চান করাতে নিয়ে যাবো। তা সে ঘর থেকেই বেরুবে না। আমার হাড়খানা কালা করে ফেলল এরা সকলে মিলে। তা তুমি বাপু একটু ধরো দেখিনি। দু’জন মিলে যদি চানঘরে নিয়ে যেতে পারি।
রতনকান্তি ছোটখাট একটা হোঁচট খেল। সর্বজয়া বারান্দা থেকে লাফিয়ে মরতে চেয়েছিল! কী হয়েছে ওর! সর্বজয়াকে স্নানঘর অবধি নিয়ে যেতে ভারি কষ্ট হলো রতনকান্তি আর অতসীবালার। সেই সারাটিদিন সর্বজয়াকে নিয়ে ভাবল রতনকান্তি। কী হয়েছে মেয়েটির? অমন তরতাজা প্রাণবন্ত মেয়েটি হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন? তার এখনো মনে আছে, শেষ যেদিন তার সাথে সর্বজয়ার দেখা হয়েছিল, কী গনগনে আগুনে গলায়ই না সে কথা বলছিল। তার আগে সেই সন্ধ্যায় দ্বিজেন্দ্রকে তো পুরো কথার ছোবলে ছোবলে নীল করে ফেলেছিল এই মেয়ে। এ কদিনে কী এমন হলো! ঠিক সেই মুহূর্তে রতনকান্তির আচমকা মনে হলো, সেদিন সিঁড়ির তলায় অন্ধকারে লুকিয়ে বিভূতিনাথ আর বীণাবালার কথা শুনতে গিয়ে সে যে দ্বিজেন্দ্রকে দেখেছিল, সেই দ্বিজেন্দ্র শান্ত কিন্তু ভয়ংকর! তখন পরিষ্কার ধরতে না পারলেও তার ভেতরে একটা অজানা আশঙ্কায় সে বয়ে নিয়েই বেরিয়েছিল। পরদিন সন্ধ্যায় বারোহাটির বাগানবাড়িতেও সেই ভয়টি তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। তাহলে কী খারাপ কিছু ঘটেছে সর্বজয়ার? কী হয়েছে?
রতনকান্তি মনে মনে আর সুস্থির হতে পারল না। তবে পরদিনই সর্বজয়ার সাথে তার আবারো দেখা হয়ে গেল। বিকেলে সুদক্ষিণাকে গান শেখাতে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল! দেখলো ছাদের মাঝখানে বিকেলের নরম রোদে বসে আছে সর্বজয়া। তার সাথে সতর্কভঙ্গিতে দাসী অতসীবালা আর সুদক্ষিণাও। সর্বজয়ার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। দেখতে গতকালের সেই এলোমেলো ভাবখানা অত না থাকলেও, চোখের নিচে কালি পড়ে যাওয়া সর্বজয়ার মুখ ফ্যাকাশে। সে তাকিয়ে আছে দূরে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে জীবন্ত এক মমি। এই জগতে মানুষের মতোন দেখতে তার শরীরখানাই যেন কেবল রয়ে গেছে। কিন্তু এই জগতের আর কোনো কিছুর সাথেই তার যেন কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো কিছুতেই না। সে কিছুই দেখছে না, শুনছে না, অনুভব করছে না। তার দৃষ্টিজুড়ে কেবল সীমাহীন শূন্যতা। এই শূন্যতা থেকে মুক্তির উপায়ও তার জানা নেই।
রতনকান্তি দীর্ঘসময় সর্বজয়ার দিকে তাকিয়েই রইল। সুদক্ষিণা বসে আছে দিদির গা ঘেঁষে। রতনকান্তি প্রবল দ্বিধা নিয়ে সর্বজয়ার দিকে এগিয়ে গেল। সুদক্ষিণা সর্বজয়াকে ডাকল, দিদি দেখো, কে এসেছে?
রতনকান্তি সুদক্ষিণার পাশের ছোট চৌকিখানাতে বসল। সর্বজয়া ফিরেও তাকাল না। সে তাকিয়ে আছে সোজা, সেখানে গঙ্গামহলের দীর্ঘ উঠান, উঠান পেরিয়ে ফটক, ফটকের পেরিয়ে রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে ঘাট। ঘাটের সাথে গঙ্গাবতী নদী। নদীর বুকে জল। সেই জল পেরিয়ে দূরে সারি সারি বৃক্ষ। সেই বৃক্ষরাজির মাথার উপরে আকাশ। আকাশে একটি নিঃসঙ্গ বাজ পাখি উড়ছে। সর্বজয়ার মতোন!
রতনকান্তিও একদৃষ্টিতে সেই বাজপাখির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সুদক্ষিণাকে ডেকে বলল, তুমি ওই পাখিটাকে চেনো?
সুদক্ষিণা বলল, না।
রতনকান্তি আঙুল তুলে বাজপাখিটিকে দেখালো। তারপর বলল, ওই যে একা পাখিটি উড়ে যাচ্ছে। ওর নাম বাজপাখি।
সুদক্ষিণা বাজ পাখিটির দিকে তাকিয়ে বলল, বাজপাখি কী করে?
রতনকান্তি বলল, বাজপাখি বাঁচে।
সুদক্ষিণা রকনকান্তির জবাব শুনে ভারি অবাক হলো। সে বলল, সকলেই তো বাঁচে!
রতনকান্তি বলল, না। সকলেই বাঁচে না। কেউ কেউ বেঁচে থেকেও মরে যায়।
সুদক্ষিণা কী বুঝল কে জানে, সে বলল, সকলেই তো বেঁচে থেকে মরে যায়।
রতনকান্তি বলল, নাহ্। বেঁচে থাকা শেষ হলে পরে সকলে মরে যায়। কিন্তু কেউ কেউ বেঁচে থাকতে থাকতেই মরে যায়।
সুদক্ষিণা রতনকান্তির এমন গুরুগম্ভীর কথার কিছুই বুঝল না। সে হা করে তাকিয়ে রইল। রতনকান্তি অবশ্য কথাগুলো সুদক্ষিণাকে বলছেও না। সে বলছে সর্বজয়াকে। কিন্তু সে জানে না, সর্বজয়া তার কথা শুনছে কিনা। রতনকান্তি বলল, কিন্তু ওই যে বাজপাখি দেখছ, ও বেঁচে থাকে মৃত্যুর আগ অবধি। সত্যিকারের মৃত্যুর আগ অবধি ও মরে না।
সুদক্ষিণা এবার বিরক্ত ভঙ্গিতে রতনকান্তির দিকে তাকাল। কী সব আবোল-তাবোল বকছে মানুষটা! অবশ্য সে আগেও দেখেছে, প্রায় এমন অদ্ভুতসব কথা বলে রতনকান্তি। রতনকান্তি খানিক হেসে বলল, এসো, তোমায় ওই বাজপাখির বেঁচে থাকার গল্প শোনাই। শুনবে?
সুদক্ষিণা গল্প শোনার কথা শুনে খুব কৌতূহলী হলো। সে দিদির কাছ থেকে খানিক সরে এসে বড় বড় চোখ করে রতনকান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। রতনকান্তি বলল, বাজপাখি কম-বেশি সত্তর বছরের মতোন বাঁচে। কিন্তু বছর পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশ হলেই ওকে প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যেতে হয়।
সুদক্ষিণা আগ্রহী কণ্ঠে বলল, কেন? মরে যেতে হয় কেন?
রতনকান্তি বলল, কারণ এই সময়ে এসে তার তীক্ষ্ণ নখ নরম হয়ে যায়। ফলে সে আর শিকার ধরতে পারে না। তার ধারালো চোখা ঠোঁট সামনের দিকে বেঁকে মুড়িয়ে যায়, ফলে সে খুঁটে খুঁটে বা ছিঁড়ে আর খাবার খেতে পারে না। আর তার ডানার পালকগুলো ভারী হয়ে যায়। ফলে সে ঠিকমতো উড়তে পারে না। আগের ক্ষীপ্রতা আর তার থাকে না। ফলে সে আর শিকার ধরতে পারে না। খাবার খেতে পারে না।
সুদক্ষিণা চিন্তিত গলায় বলল, তাহলে? তাহলে কি সে না খেয়ে খেয়ে মারা যায়?
রতনকান্তি মৃদু হাসল। তারপর বলল, না। সে না খেয়ে মারা যায় না। সে বেঁচে থাকে। কিন্তু তার সামনে সবচেয়ে নিশ্চিত এবং সহজ উপায় হচ্ছে মরে যাওয়া। আসলে তার সামনে তখন তিনটি উপায় ভোলা থাকে। এক, না খেয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে আত্মহত্যা করা। দুই, শকুনের মতোন মৃতদেহ খাওয়া। কিন্তু এটিও খুব কষ্টকর।
সুদক্ষিণার যেন উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে জিজ্ঞেস করল, আর তিন?
রতনকান্তি বুকের খুব গভীর থেকে অদ্ভুত প্রাণবন্ত গলায় বলল, আর তিন হচ্ছে নতুন করে বেঁচে থাকা। নিজের পুনর্জন্ম ঘটানো।
সুদক্ষিণা ফোঁস করে আটকে রাখা দম ছেড়ে বলল, পুনর্জন্ম?
রতনকান্তি নিশ্চিত নয়, তবে মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো সর্বজয়া খানিক মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল এই দিকে। কিংবা সে হয়তো উৎকর্ণ হয়ে রতনকান্তির গল্পের শেষটা শোনার অপেক্ষায় আছে। রতনকান্তি গলায় খানিকটা জোর এনে বলল, হ্যাঁ, পুনর্জন্ম।
সুদক্ষিণা বলল, কিভাবে?
রতনকান্তি বলল, বাজপাখিটা তখন উঁচু কোনো পাহাড়ে গিয়ে বাসা বাঁধে। তারপর চেষ্টা করে নতুন করে বাঁচবার। সে একটা পাথরে ঠুকরে ঠুকরে তার ঠোঁট ভেঙে ফেলতে চেষ্টা করে। এ ভয়ংকর যন্ত্রণার। নিজের শরীরের একটা অংশ আছড়ে আছড়ে ছিঁড়ে ফেলার চেয়ে কষ্ট আর হয় না। একই রকমভাবে পাথরে ঘষে ঘষে নিজের নখগুলোও ধ্বংস করে ফেলে। তারপর অপেক্ষা করে নতুন ঠোঁট আর নখ গজানোর। নতুন শক্তিশালী ঠোঁট আর নখ গজানোনার পর সে সেই ঠোঁট আর নখ দিয়ে ঠুকরে ঠুকরে তার পাখার পালকগুলোও ছিঁড়তে থাকে। অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করে সে একে একে তার সকল পালক তুলে ফেলে। তারপর অপেক্ষায় থাকে নতুন পালক গজানোর। প্রায় দেড়শ দিন বাদে আবার সে নতুন পালক, নতুন ঠোঁট আর নখ নিয়ে আগের মতো ক্ষীপ্র হয়ে জেগে ওঠে। বেঁচে থাকে জীবনের বাকিটা সময়।
সুদক্ষিণা বিস্মিত গলায় বলে, ওমা! ওর তো দেখছি অনেক সাহস! অত কষ্ট করেও বেঁচে থাকে! একদম মৃত্যুর কাছ থেকে আসে।
রতনকান্তি বলল, মৃত্যুর ভেতর থেকে জীবন খুঁজে এনে বেঁচে থাকাটাই তো জীবন। সবচেয়ে বেশি আনন্দের। জীবন মানুষকে নানানভাবে পরখ করে। সেখানে দুম করে হার মানলে চলবে কেন?
সুদক্ষিণা রতনকান্তির এত ভারী ভারী কথা বোঝে না। সে বলল, দেখলেন, দিদি কারো সাথেই কথা বলে না। আপনি না সেদিন বললেন, আমি ভালো গান শিখলে বাবা আবার আগের মতো হয়ে যাবে? দিদিও কি হবে?
রতনকান্তি হাসল। বলল, হবে।
সুদক্ষিণা বলল, সত্যি বলছেন?
রতনকান্তি বলল, হুম।
সুদক্ষিণা ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, আমি তো এখনো ভালো করে গান গাইতে পারিই না। আচ্ছা, আপনি কি একখানা ভালো গান শোনাবেন দিদিকে?
রতনকান্তি সুদক্ষিণার কথার জবাব দিলো না। তবে সে যেন এই অপেক্ষায়ই ছিল। সে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। তখন বিকেল মরে আসছিল প্রায়। সেই শেষ বিকেলের মরে যাওয়া আলোয় রতনকান্তি তার বুকের সকল অনুভূতি ঢেলে গাইলো
‘আমার সকল চাওয়ায় প্রার্থনা হয় তোমার অমল সুখ,
আমার সকল প্রহর অথৈ জলে, আঁকছে তোমার মুখ।
তুমি কই হারাবে, যাও বলে যাও, নিশিথ রাতের ছায়া,
তুমি প্রলয় জানো, প্রণয় তবু বিছায় কিসের মায়া!
এমন রিক্ত হলে, সিক্ত প্রেমে পূর্ণ কিসের দুঃখ,
আমার সকল চাওয়ায় প্রার্থনা হয় তোমার অমল সুখ।
এই অস্তরাগের সন্ধ্যা তারায় কিসের দুখের বাঁশি,
এই জনমজুড়ে, বাদল ঝড়ে, তোমায় ভালোবাসি।
তুমি শূন্যে মিলাও, জন্ম বিলাও, মৃত্যু ভ্রমে আসে,
তোমার চিহ্নবিহীন জলের ছায়ায় পুনর্জন্ম ভাসে।
ওহে শুচিস্মিতা, বিসর্জনেও তোমার হাসি সুখ,
আমার সকল চাওয়ায় প্রার্থনা হয় তোমার অমল মুখ।’
রতনকান্তির গান শেষ হয়েছে। কিন্তু সেই গানের সুর যেন সন্ধ্যার আকাশে বাতাসে অদ্ভুত অনুভূতির সুতীব্র স্পর্শ হয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। সর্বজয়া যেমন বসে ছিল, তেমনই বসে রইল। সুদক্ষিণা, অতসীবালা ডুবে রইল কোনো এক অপার্থিব তন্ময়তায়। কিন্তু সেই গানের কথা আর সুর সর্বজয়ার বুকের ভেতর ছুঁয়ে গেল কিনা রতনকান্তি জানে না।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রতনকান্তি এও জানে না যে সে কেন চাইছে এই গান সর্বজয়ার বুকের ভেতর ছুঁয়ে যাক!
*
দেবেন্দ্রনারায়ণের আজকাল সময় কাটে না। প্রবল দাপুটে যে মানুষটা জীবনজুড়েই চারপাশ শাসন করে বেরিয়েছেন, সেই মানুষটা দিনের পর দিন আটকে রয়েছেন চার দেয়ালের এক ঘরে। এর চেয়ে যন্ত্রণার আর কী আছে! আজকাল একেকটা দিন বড় দীর্ঘ মনে হয়। কিছুতেই আর সময় কাটে না। তবে বীণাবালার সাথে নিজের যে পরাজয়, সে পরাজয়। তার নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছেন দেবেন্দ্রনারায়ণ। নিয়তি না হলে এই সর্বনাশা অসুখ তার কেন হবে! দেবেন্দ্রনারায়ণ শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবেন। ভগবান নাকি এই জন্মের কর্মফল এই জন্মেই মিটিয়ে দেন। তাহলে এ তার কিসের কর্মফল! তিনি কি প্রকৃতই খারাপ মানুষ?
এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রায়শই পান না। খারাপ এবং ভালোর মাপকাঠিটা আসলে কী? তিনি কি কখনো কারো কোনো ক্ষতি করেছেন? তিনি রাগী, খামখেয়ালি ছিলেন। কখনো কখনো অত্যাচারীও বটে। কিন্তু মুহূর্তকাল পরেই তিনি আবার জলের মতোন শীতল হয়ে যেতেন। ওই মুহূর্তে কারো উপর অন্যায় করলে পরমুহূর্তেই আবার তার মন কেমন করে উঠত! মনে হতো, মানুষটার যে ক্ষতি তিনি করেছেন তা সুদে আসলে উসুল করে দিবেন। দিয়েছেনও। এমন কত এলোমেলো ভাবনায় দেবেন্দ্রনারায়ণের দিন কেটে যেতে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার আগে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুমের ভেতর তিনি অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। দেখলেন, তার খুব শীত লাগছে। শীতে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। কিন্তু আশেপাশে কোথাও একখানা চাদর বা কম্বল খুঁজে পাচ্ছেন না। হিম হাওয়ায় তিনি কুঁকড়ে যাচ্ছেন। তিনি জোরে জোরে রেণুকাকে ডাকছিলেন। কিন্তু হঠাৎ তাকিয়ে দেখলেন দরজার সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটাকে তিনি চেনেন না। মেয়েটা নরম গলায় বলল, শীত লাগছে?
দেবেন্দ্রনারায়ণ খুব রেগে গেলেন। তিনি রাগী গলায় বললেন, দেখে বুঝছিস না, শীত লাগছে কিনা?
মেয়েটা বলল, দেখে কি শীত বোঝা যায়? শীত বুঝতে ছুঁতে হয়। ছুঁয়ে দিব?
দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার বাজখাই গলায় বললেন, তোর সাহস তো কম নয়, তুই আমার সাথে হেঁয়ালিপনা করছিস?
মেয়েটা বলল, আপনার সাথে তো আমার হেঁয়ালিপনারই সম্পর্ক। কিন্তু আপনি আমায় তুই-তোকারি করছেন কেন? সুন্দর করে নরম কণ্ঠে তুমি বলে। ডাকুন। তুমি করে আমায় ন্যাংটো হতে বলুন। আমি ন্যাংটো হচ্ছি। এই যে দেখুন, আমি আমার শাড়ির আঁচল খুলে দিচ্ছি। আপনি আমার বুক দেখতে চেয়েছিলেন না? নিন দেখুন।
মেয়েটা শাড়ির আঁচল ফেলে দিল। তারপর মোহনীয় ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে লাগল। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ সেদিকে তাকালেন না। তিনি চোখ। ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। তার মেয়েটির প্রতি কোনো আগ্রহ হচ্ছে না। কোনো উত্তেজনা হচ্ছে না। তার যা হচ্ছে তার নাম ভয়। তিনি এবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কিন্তু বন্ধ চোখের ভেতরও তিনি মেয়েটিকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছেন। মেয়েটি তার শাড়ি খুলে ফেলছে!
এই মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণ মেয়েটিকে চিনতে পারলেন। মেয়েটির নাম তপতী! এই নাম তো তার মনে থাকার কথা না! কিন্তু মেয়েটির নাম তার স্পষ্ট মনে আছে। চেহারাও। তপতী ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ কাঁপছেন। এই কম্পন কি শীতে না ভয়ে তা দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝতে পারছেন না। মেয়েটি একদম তার কাছে চলে এসেছে। হাত বাড়িয়ে বাড়ুজ্জেদেবেন্দ্রনারায়ণকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে। তার মুখে রহস্যময় হাসি। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রবল ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মেয়েটি শেষ পর্যন্ত তাকে ছুঁয়ে দিলো না। সে যেটি করল সেটি হলো দেবেন্দ্রনারায়ণের চারপাশে শুকনো খড়কুটো, ডালপালা বিছিয়ে দিতে লাগল। দেবেন্দ্রনারায়ণ লাফ দিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তিনি হঠাৎ আবিষ্কার করলেন তিনি। শুয়ে আছেন একটি জঙ্গলে। তার চারপাশজুড়ে ঘন ঝোঁপ ঝাড়, গাছপালা। মেয়েটা কাকে যেন চোখের ইশারায় ডাকল। দেবেন্দ্রনারায়ণ দেখলেন শীর্ণকায় একটা মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষটার হাতে একখানা জ্বলন্ত মশাল।
দেবেন্দ্রনারায়ণ ভালো করে লক্ষ করে দেখলেন মানুষটির পুরো শরীর পুড়ে কয়লা হয়ে আছে। কেবল তার চোখজোড়া ভাটার আগুনের মতো জ্বলছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ এই মানুষটিকেও চিনতে পারলেন। নিতাই! মাঝি নিতাই। দেবেন্দ্রনারায়ণ হড়বড় করে কী সব জিজ্ঞেস করলেন নিতাইকে। কিন্তু নিতাই। কোনো জবাব দিলো না। সে যেন একইসাথে মূক ও বধির। নিতাই তার হাতের মশালখানা নামিয়ে চারপাশের শুকনো খড়কুটো, ডালপালায় আগুন জ্বালিয়ে দিল। মুহূর্তেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। দেবেন্দ্রনারায়ণ চিৎকার করে কাউকে ডাকছেন। কিন্তু কেউ আসছে না। তিনি আবিষ্কার করেলেন এমন গনগনে আগুনের তাপেও তার শীত করছে, প্রবল শীত। শীতে তার সারা শরীর কাঁপছে। তিনি দেখলেন তার চারপাশে মশাল হাতে একে একে জড়ো হচ্ছে বীণাবালা, বিভূতিনাথ, ভুজঙ্গ দেব, রামচরণ কারিগরসহ আরো অনেকে। তিনি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন। এই মুহূর্তে তিনি দেখলেন, দূরে একটি বালকের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে হেমাঙ্গিনী দেবী। তিনি চিৎকার করে হেমাঙ্গিনী দেবীকে ডাকছেন। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী তার ডাক শুনছে না। সে চলে যাচ্ছে তার মতো। ভীত, বিপর্যস্ত দেবেন্দ্রনারায়ণ দেখলেন, হেমাঙ্গিনী দেবীর হাত ধরে হেঁটে যাওয়া বালকটি অকস্মাৎ ঘুরে তাকাল। তারপর মায়ের হাত ছাড়িয়ে ছুটে আসতে লাগল দেবেন্দ্রনারায়ণের দিকে। দেবেন্দ্রনারায়ণ ছেলেটিকে দেখলেন, বিভূঁই। কিন্তু বিভুঁই তো অন্ধ!
অন্ধ বিভুঁই মাঝপথে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মাটিতে। সে আর মাটি থেকে উঠে দাঁড়াতে পারছিল না। চিৎকার করে তার মাকে ডাকছিল। কিন্তু হেমাঙ্গিনী দেবী সেই ডাক শুনতে পাচ্ছিল না। সে তার মতো হেঁটে যাচ্ছিল। এদিকে বীণাবালা আর বিভূতিনাথ জ্বলন্ত মশাল হাতে বিভূঁইয়ের দিকে ছুটে যেতে লাগল। দেবেন্দ্রনারায়ণ এবার আরো জোরে চিৎকার করে হেমাঙ্গিনী দেবীকে ডাকলেন, হেমাঙ্গিনী, হেমাঙ্গিনী, হেমাঙ্গিনী…।
এই মুহূর্তে দেবেন্দ্রনারায়ণের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি দেখলেন তার শিয়রের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেণুকা, অতসীবালা, খগেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ। চোখ খুলে প্রথমেই কিছু বুঝতে পারলেন না, তিনি কোথায় আছেন, কিভাবে আছেন, এখন সময় কত? কিছুই না। তার কানে কেবল ওই একটি শব্দই বাজছে, তিনি যে চিৎকার করে হেমাঙ্গিনী দেবীকে ডাকছিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ বুঝতে পারলেন না তার এই চিৎকার রেণুকা শুনেছে কিনা। তিনি সাথে সাথেই আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তার গা-জুড়ে প্রচণ্ড জ্বর। জ্বরে ঝাঁকুনি উঠেছে। তিনি প্রবল শীতে কাঁপছেন। এই জ্বরে তিনি দীর্ঘদিন ভুগলেন।
এই দীর্ঘ জ্বর শেষে উঠে দেবেন্দ্রনারায়ণ প্রথমেই যেই কাজটি করলেন তা হলো রতনকান্তিকে ডেকে বললেন রোজ প্রত্যুষে তিনি খানিকটা করে হাঁটতে বের হবেন। ঘরের ভেতর থাকতে থাকতে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। মাথাভর্তি নানান এলোমেলো চিন্তা। এই সকল কারণেই তিনি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তার শরীরের বাঁ দিকটা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেও পুরোপুরি নয়। তিনি খুব সামান্য হলেও বাঁ পাশ নাড়াতে পারেন। তারপরও তারপক্ষে একা হাঁটতে যাওয়া সম্ভব না। তিনি চান রতনকান্তি তার সাথে রোজ প্রাতঃভ্রমণে বের হোক। রতনকান্তি প্রফুল্লচিত্তেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। পরদিন থেকে রোজ প্রত্যুষে তারা গঙ্গাবতীর তির ধরে হাঁটেন। রতনকান্তি দেবেন্দ্রনারায়ণকে ধরে ধরে হাঁটায়। দেবেন্দ্রনারায়ণের হাতে ভর সামলানোর জন্য একখানা বেতের লাঠি। তার হাঁটতে খুবই পরিশ্রম হয়। খানিক হেঁটেই হাঁপিয়ে যান। কিন্তু হাল ছাড়েন না। তবে ভোরের আলো, গঙ্গাবতীর ফুরফুরে হাওয়া সকলই ভীষণ ভালো লাগে দেবেন্দ্রনারায়ণের। এতদিনের গৃহবন্দী দশার চেয়ে এ ঢের ভালো।
রতনকান্তির সাথে তার রাজ্যের কথা হয়। সেই সকল কথার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রতনকান্তি কেবল দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে তাল মিলিয়ে যায়। কোনো দ্বিরুক্তি করে না। দেবেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য এতে ভারি খুশি হন। সারা জীবনের খামখেয়ালি দাপুটে মানুষটির ভেতরে ভেতরে এখনও অবচেতনে সেই একরোখা ভাবটি রয়ে গেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ যে এখন কেবল একজন অপ্রয়োজনীয় অপাংক্তেয় মানুষ, তা গঙ্গামহল থেকে শুরু করে বিষ্ণুপুরের সকলেই জানে। আর বীণাবালাও চান, এটি সকলে জানুক এবং সেই মতোই আচরণ করুক দেবেন্দ্রনারায়ণের সাথে। কারণ, এতে দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস, চিন্তা, দেবেন্দ্রনারায়ণের প্রতি যে সমীহের জায়গা ছিল লোকের, তা ক্রমশই ভেঙে যেতে থাকবে। আর এটি ভাঙা জরুরিও। যদিও এতকিছুর পরও ভৃত্য থেকে শুরু করে পাইক-পেয়াদা অবধি সকলেই দেবেন্দ্রনারায়ণকে সমীহ করেই চলে। রতনকান্তি এর কারণ ভেবে দেখেছে। আসলে এই দেবেন্দ্রনারায়ণ মানুষটির হাঁটা, কথা বলার ভঙ্গি, চলন সকল কিছুর মধ্যেই এক প্রখর ব্যক্তিত্বের ছটা। সেখানে অন্যরা নিষ্প্রভ হতে বাধ্য।
.
গঙ্গামহলের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু এখন অবনীন্দ্রনারায়ণের মহল। তবে দীপেন্দ্রনারায়ণের ঘটনার এখনও কোনো কূল করতে পারেননি বীণাবালা। এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে তিনি পুড়ে মরছেন। কিন্তু তিনি এও জানেন দীপেন্দ্রনারায়ণকে তিনি কখনোই ছাড়বেন না। এমনিতে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ দেবেন্দ্রনারায়ণের ফণা তো তিনি পিষেই মেরেছেন, এমনকি তার কোমড়ও পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে পেরেছেন, এই বিষয়ে বীণাবালা নিশ্চিত। ফলে দেবেন্দ্রনারায়ণ বা তার মহল-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বীণাবালা আর কোনো আগ্রহ দেখান না। তবে পুত্র দ্বিজেন্দ্রনারায়ণের কিছু আচরণ নিয়ে বীণাবালা বিরক্ত। বীণাবালার ধারণা ছিল চুপচাপ দ্বিজেন্দ্র তার একান্ত বাধ্যগত হয়েই থাকবে। তা থাকেও। মায়ের কথা ছাড়া সে বলতে গেলে কিছুই করে না। কিন্তু মাঝেমাঝে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিজেন্দ্র বীণাবালাকে কানাকড়ির মূল্যও দেয় না। তখন দ্বিজেন্দ্রর আচরণে বীণাবালা ভয় পান। এমন নীরব ঔদ্ধত্য এই ছেলে কোথায় পেল তা তিনি জানেন না। এই নিয়েও বীণাবালার ভেতরে কষ্ট। তারওপর তীব্র মনোবেদনা সিন্দুক তিনখানা নিয়ে। প্রতিমুহূর্তে যা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সেই তিনখানা সিন্দুকভর্তি যে অবিশ্বাস্য মূল্যের অলঙ্কার ও নগদ অর্থ রয়েছে, তার কথা বীণাবালা ক্ষণকালের জন্যও ভুলতে পারছেন না।
মাসখানেক বাদে একদিন দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ রতনকান্তিকে ডেকে জুড়িগাড়ি প্রস্তুত করতে বললেন। রতনকান্তি দেবেন্দ্রনারায়ণের কথা শুনে চমকে গেল। কিন্তু তার কথায় কোনো প্রতিবাদ করল না। দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন যে তিনি একদিনের জন্য বারোহাটি যাবেন। দ্রুতগতির একখানা ভালো জুড়িগাড়ি হলে, আর সাথে কেঁচোয়ান হিসেবে রতনকান্তি থাকলে দিনে দিনে ফিরে আসা যাবে।
পরদিন কাকডাকা ভোরে দেবেন্দ্রনারায়ণকে নিয়ে বারোহাটির উদ্দেশ্যে যাত্রা করল রতনকান্তি। দেবেন্দ্রনারায়ণকে বিশেষ ব্যবস্থায় বসানো হলো। গাড়িতে। তারা দুপুরের খানিক আগে পৌঁছেও গেল। বারোহাটি বাগান বাড়ি ঢুকতে গিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ থমকে গেলেন। এ যেন বহুবছরের পরিত্যক্ত এক বাড়ি। চারপাশ থেকে জংলি লতাপাতা পাঁচিলের গা বেয়ে উঠছে। সামনের পরিষ্কার ঝকঝকে সেই পথ ঢেকে গেছে ঘাসে। বাড়ির কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণের এমন আচমকা আগমন মৃদু স্পন্দন তুলল। বারোহাটির বাগান বাড়িতে। অপলা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখে সে হাউমাউ করে কাঁদল। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ চেষ্টা করলেন আগের মতো সেই বাজখাই গলাতেই সকল কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু কতটা সফল হলেন তা বোঝা গেল না। রতনকান্তি একটি বিষয়ে নিশ্চিত যে দেবেন্দ্রনারায়ণ এখানে এসেছেন বিভুঁই-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে। এখন দেখার বিষয় তিনি আসলে কী করেন!
দেবেন্দ্রনারায়ণ এরপর রঘু আর অন্য এক ভূত্যের সাহায্য নিয়ে চলে গেলেন দোতলায়। যেহেতু কিছুক্ষণ পরেই আবার গঙ্গামহলে যাত্রা করতে হবে সেহেতু তিনি রতনকান্তিকে বলে গেলেন ঘোড়াগুলোর যত্ন নিতে। রতনকান্তি অবশ্য টুপ করে বেরিয়ে পড়ল বাড়ির বাইরে। সে পাঁচিল ঘুরে চলে এলো পেছনের সেই ঝোঁপের কাছে। বর্ষার কারণে এ কদিনেই লতাপাতা ঝোঁপঝাড় বেপরোয়া হয়ে ছেয়ে ফেলেছে পাঁচিলের চারধার। রতনকান্তি অনেক কষ্টে সেই ঝোঁপের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল সেদিনকার পালিয়ে যাওয়া মানুষটির ফেলে যাওয়া সেই থলেখানা এখনও তেমনই পড়ে রয়েছে। তার মানে মানুষটি আর ফিরে আসেনি। সেদিন অন্ধকারে রতনকান্তিকে ওভাবে গাছের ডালে ঝুলতে দেখে সে কী ভেবেছিল কে জানে! যদি অন্ধকারে গাছে ঝুলতে থাকা রতনকান্তি কে দেখে সে সত্যি সত্যিই মানুষ ভেবে থাকে তবে তার ফিরে আসার সম্ভাবনা আর নেই বললেই চলে। কিন্তু সেটি মনে করার কথা নয়। রতনকান্তি তার সেই পলায়নরত দৃশ্যের কথা কল্পনা করে হাসল। সে নিশ্চিত, মানুষটি তাকে ভূত প্রেত বা অন্য কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণীই ভেবেছিল। আর তাই রাম নাম জপতে জপতে অমন পালিয়েছিল।
দুপুরের খানিক পরেই দেবেন্দ্রনারায়ণ আবার যাত্রা করলেন গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে। তবে জুড়িগাড়িতে উঠেই তিনি রতনকান্তিকে বললেন পথে হরিহরণের বাড়িতে তিনি নামতে চান। বারোহাটি বাগানবাড়ি থেকে কিছুদূর পথ গেলেই খানিকটা বাঁ দিকে নেমে গাছ-গাছালি ঘেরা জায়গাটায় হরিহরণের ছোট্ট বাড়ি। জুড়িগাড়িতে বেশি দূরের পথ নয়। পৌঁছাতে সময়ও লাগল না। রতনকান্তি জানে না দেবেন্দ্রনারায়ণের সেখানে কী কাজ! সে গাড়ি থেকে ধরে দেবেন্দ্রনারায়ণকে নামালো।
হরিহরণ কাজ করছিল বাড়ির উঠানে। শুকনো বাঁশ চেঁছে কিছু একটা বানাচ্ছিল সে। হেমাঙ্গিনী দেবী বসে ছিল তার মুখোমুখি। চকিতে হরিহরণের দৃষ্টি পড়ল বাড়ির প্রবেশ পথে আগমনরত দেবেন্দ্রনারায়ণ আর রতনকান্তির দিকে। ভূত দেখার মতন চমকে গেল সে। তার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল মুহূর্তেই। তবে দেবেন্দ্রনারায়ণ এখনও তাদের দেখেননি। হরিহরণ অস্ফুট শব্দে হেমাঙ্গিনী দেবীকে ডাকল, চুপচাপ ঘরে যা। কোনো দিকে তাকাস না। বিপদ!
এমনিতেই হেমাঙ্গিনী দেবী এখানে সদা সতর্ক হয়ে থাকে। তার ওপর হরিহরণের এমন কণ্ঠ শুনে তার আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না যে কোনো একটা গোলমাল হচ্ছে। সে কোনো দিকে না তাকিয়েই উঠল। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে সে মৃদু স্বরে বলল, ঘরে যেতে বলছ?
হরিহরণ বলল, হু। ভয় নেই। যিনি আসছেন, তিনি ঘর অবধি যাবেন না।
হেমাঙ্গিনী দেবী উঠে ঘরের দিকে যাচ্ছিল। হরিহরণ আবার বলল, আমি না বলা অবধি ঘর থেকে বের হোস না।
দেবেন্দ্রনারায়ণ অবশ্য বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না। তিনি উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, হরিহরণ একখানা কথা আছে।
হরিহরণ বলল, আজ্ঞে কর্তা।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, দিনকয়েক বাদে অপলা একটা অন্ধ ছেলেকে তোমার কাছে দিয়ে যাবে। সাথে জুড়িগাড়িও থাকবে। ছেলেটাকে নিয়ে তুমি গঙ্গামহলে যাবে।
এইটুকু কথা শুনেই হরিহরণ রীতিমতো হকচকিয়ে গেছে। তবে সে তা ধরা দিলো না। যতটাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলল আজ্ঞে কর্তা।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, জীবনে পাপ তো কিছু কম করিনি। এখন যদি প্রায়শ্চিত্ত্য কিছু হয়। কোন আশ্রমের বাইরে এক অন্ধ ছেলেকে কাঁদতে দেখে দাসী অপলার ভারি মায়া হয়েছে। ছেলেটার ত্রিকূলে কেউ নেই। সম্ভবত গুটিবসন্তে মরেছে সবাই। ছেলেটার মুখেও শুকিয়ে যাওয়া গুটির বড় বড় দাগ। সেই থেকেই বোধহয় অন্ধ হয়েছে। খুব কাঁদছিল সেই ছেলে। অপলা তাকে নিয়ে এসেছে বারোহাটিতে। তা জানোই তো, বারোহাটির মতোন অত বড় বাড়ি সামলানোই অপলার জন্য এখন কঠিন। সেখানে ওই ছেলে! তা গুটিবসন্ত যখন আমায় অমন ধরলো, এই যে এত লোক মরল, তখন থেকেই আমার কত কিছুই না মনে হয়েছিল। জীবনখানা আসলে ভারি খেয়ালি। সে চাইলে তোমায় আমায়, আমাদের সকলকে নিয়েই ইচ্ছেমতো খেলাতে পারে। সে চায় আমরাও তাকে নিয়ে খেলি। তাই ভাবছি, গঙ্গামহলে আমার মহলখানার নিচতলায় কত ঘরই তো ফাঁকা পড়ে আছে। তার একখানাতে ওই ছেলেটাকে রেখে দিই। বাবা। মা নেই, এমন অন্ধ একটা ছেলের জন্য এই জগত বড়ই কঠিন। সে না হয়। থাকুক গঙ্গামহলের এক কোণায়। গঙ্গামহলের ইটের ফাঁকে ফাঁকে যে পাপ জমেছে, তাতে যদি তা কিছু কমে!
দেবেন্দ্রনারায়ণ খানিক থামলেন। তারপর বললেন, অপলাই নিয়ে যেতে পারত। কিন্তু গঙ্গামহলের অবস্থা তো জানোই! অপলা বারোহাটির বাগান বাড়ি থেকে ওই ছেলেকে নিয়ে গেলে নানান কথা উঠবে। বীণাবালার মাথাভর্তি এমনিতেই গিজগিজে কু-চিন্তা। সে আবার কী ভেবে বসবে! তার চেয়ে তুমিই নিয়ে যেও। তুমি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ানো মানুষ। তোমার সাথে অমন কেউ গেলে সেটি সকলের কাছেই অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
দেবেন্দ্রনারায়ণ রতনকান্তির কাঁধে ভর দিয়ে ঘুরতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, জুড়িগাড়িখানা গঙ্গামহল অবধি নিও না। কাছাকাছি কোথাও গিয়ে ছেড়ে দিও। তারপর ছেলেটিকে নিয়ে পায়ে হেঁটেই যেও। আমি চাই না কেউ কোনোভাবেই কোনো প্রশ্ন তুলুক।
হরিহরণ কেবল মাথা নাড়ল। কোনো কথা বলল না। রতনকান্তিও না। দেবেন্দ্রনারায়ণ ঘুণাক্ষরেও জানেন না, এই দু’জনই বিভুঁইর কথা জানে। তিনি এও জানেন না, তার ঠিক সামান্য দূরত্বেই যে মাটির ঘরখানা রয়েছে, সেই। ঘরখানার ভেতরে দেয়ালে হেলান দিয়ে হেমাঙ্গিনী দেবী তখন কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। সেই কান্নার জলের ফোঁটায় বিভুঁই যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছেন তিনিও।
*
সর্বজয়া আজকাল মাঝে-মধ্যেই ছাদে আসে। তবে সে এখনও কারো সাথেই কথা বলে না। ছাদে এসে চুপচাপ বসে থাকে। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে দূরের আকাশে। সেই সদা চঞ্চল, ছটফটে, আলো-ঝলমলে কিশোরী সর্বজয়াই যে এই সর্বজয়া, এ বিশ্বাস করা ভীষণ কঠিন। কিন্তু এটিই সত্য। জীবন সর্বজয়াকে চিনিয়ে দিয়েছে জগৎ। যে জগৎ বড় নিষ্ঠুর! যার রূপ বড় ভয়ংকর!
রতনকান্তি সেদিন সুদক্ষিণাকে বলল, আচ্ছা, আমরা যদি একদিন সর্বজয়াকে চমকে দিই, তাহলে কেমন হয়?
সুদক্ষিণা গোল গোল চোখ করে বলল, খুব খারাপ হয়।
রতনকান্তি খানিক থমকে গেল। বলল, কেন? খারাপ হয় কেন?
সুদক্ষিণা বলল, দিদি চমকে গেলে খুব রেগে যায়। ঝট করে হাত বাড়িয়ে খামচি দেয়।
রতনকান্তি কপট ভয়ের ভঙ্গিতে বলল, সর্বনাশ! কী বলছ?
সুদক্ষিণা তার বাহু তুলে রতনকান্তিকে দেখাল, এই যে দেখছেন, নখের আঁচড়?
রতনকান্তি দেখল, সুদক্ষিণার বাহুতে সত্যি সত্যিই তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়। সে বলল, সর্বজয়া তো তাহলে বাঘ!
সুদক্ষিণা আবারও চোখ গোল গোল করে বলল, কেন? বাঘ কেন?
রতনকান্তি বলল, বাঘের থাবার ভেতর এমন ধারালো নখ থাকে।
সুদক্ষিণা খানিক ভেবে বলল, কেন, বেড়ালের থাবার ভেতরও তো নখ থাকে। আমায় একবার আঁচড়ও দিয়েছিল!
রতনকান্তি এবার আড়চোখে সর্বজয়ার দিকে তাকাল। সর্বজয়া দূরে বসে আছে একা। দাসী অতসী বালা আজকাল আর সবসময় তার সাথে থাকে না। সকলেই বুঝতে পারছে, খুব সামান্য হলেও সর্বজয়া খানিকটা করে ধাতস্ত হচ্ছে। তাছাড়া রেণুকার নবজাত সন্তান নিয়েও অতসীবালার নানান ব্যস্ততা। এত বড় মহলের কাজকর্ম একা সামলাতে গিয়ে রীতিমত নাভিশ্বাস ওঠার দশা তার। সন্তান প্রসবের পর থেকে রেণুকাও অসুস্থ। কিন্তু বীণাবালার মহল থেকে আর কোনো দাসী পাঠানো হয়নি। এমনকি দীপেন্দ্রনারায়ণের মহলে অকারণেই ভৃত্য দাসীদের ভিড় লেগে থাকলেও এই মহলে আসার অনুমতি তাদের নেই।
সর্বজয়া নিথর নিস্তব্ধ বসে রয়েছে। কোনো অজানা অচেনা জগতে সে ডুবে রয়েছে, তা কেবল সে-ই জানে। রতনকান্তি সেই অচেনা জগতে ডুবে থাকা সর্বজয়ার দিকে তাকিয়ে গলার স্বর খানিকটা উঁচুতে তুলে সুদক্ষিণাকে বলল, তাহলে তুমি বলছ তোমার দিদি বেড়াল?
সুদক্ষিণা সাথে সাথে আঁৎকে উঠল। তারপর ভীত গলায় বলল, আমি কি তা একবারও বলেছি? দিদি শুনলে আমায়…।
রতনকান্তি সুদক্ষিণাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কী করবে দিদি শুনলে?
সুদক্ষিণা এবার কিছুটা থমকে গেল। সে নরম গলায় বলল, এখন কী করবে জানি না, তবে আগে হলে আমায় খুব মারত।
রতনকান্তি রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, আচ্ছা চলো, উনাকে বলে দেখি, উনি কী করেন?
সুদক্ষিণা ভীত গলায় বলল, না। আমায় আবারো মারবে। দিদিকে আমি ভয় পাই।
রতনকান্তি বলল, শুধু ভয়? ভালোবাসো না?
সুদক্ষিণা কী যেন ভাবল। তারপর চোখ নামিয়ে বলল, হু, বাসি।
রতনকান্তি বলল, তাহলে চলো, গিয়ে দেখি কী হয়?
সুদক্ষিণা প্রায় সময়ই রতনকান্তির কাজকর্ম কিছু বোঝে না। তবে সে এটুকু বোঝে, এই মানুষটি আর সকলের মতো নয়। এ অদ্ভুত এক মানুষ। অদ্ভুত ভালো এক মানুষ। এই মানুষটা পাশে থাকলে ভয় নেই। এই মানুষটা যা করতে বলে, তা নির্দ্বিধায় করা যায়। সে রতনকান্তির পিছু পিছু উঠে দাঁড়াল।
সর্বজয়া যেমন বসে ছিল তেমনই বসে আছে। রতনকান্তি আর সুদক্ষিণার উপস্থিতি সে টের পেল কিনা বোঝা গেল না। রতনকান্তি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সর্বজয়ার কাছাকাছিই ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল। তারপর দু’হাতে হাত ভাঁজ করে হাঁটুর উপর রাখতে রাখতে বলল, আমি আর সুদক্ষিণা আপনাকে নিয়ে একখানা বাজি ধরেছি।
রতনকান্তি এমন সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, যেন রোজ তার সাথে সর্বজয়ার এভাবেই কথা হয়। কিন্তু রতনকান্তির চোখ সতর্ক। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রয়েছে সর্বজয়ার চোখের দিকে। সর্বজয়া অনড়। তার চোখের পাতা পলকহীন। কোথাও কোনো সাড়া নেই। যেন খোদাই করা প্রস্তর মূর্তি।
রতনকান্তি বলল, আপনাকে কিভাবে যে বলি! ভয় হচ্ছে, আবার বলতে ইচ্ছেও হচ্ছে। ভয়ের কারণও অবশ্য যথার্থ। আমায় তো আপনি সহ্যই করতে পারেন না। এখন আপনাকে নিয়ে এই বাজির কথা শুনে আপনি যদি আবার তেমন করে রেগে যান!
রতনকান্তি থামল। কিন্তু সর্বজয়ার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সুদক্ষিণা ভীত চোখে রতনকান্তিকে চলে আসার ইশারা করছে। কিন্তু রতনকান্তি তাতে গা করল না। সে বলল, আমাদের বাজির বিষয়টা অবশ্য একটু উদ্ভট। ঘটনা শুনলে রেগে গিয়ে আপনি আমায় বাড়ি থেকে বেরও করে দিতে পারেন।
রতনকান্তি এবার সুদক্ষিণার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে হাসল। তারপর বলল, সুদক্ষিণা, আমার ভয় হচ্ছে, তুমি কি বিষয়টা বলবে?
সুদক্ষিণা সাথে সাথে বলল, না। দিদি, আমি কিছু জানি না। বিশ্বাস করো।
রতনকান্তি নকল রাগের ভান করে বলল, এখন ভয় পেয়ে খুব মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে না? তুমিই তো বললে, তোমার দিদির থাবার ভেতর বাঘের মতোন বড় বড় নখ লুকিয়ে রাখে! আর রেগে গেলে সেই ধারালো তীক্ষ্ণ নখ বের করে তোমায়…।
সুদক্ষিণা রতনকান্তিকে কথা শেষ করতে দিলো না। সে সন্ত্রস্ত গলায় বলল, আমি মোটেই সেটা বলিনি। আমি বলেছি বেড়ালের মতোন, আপনি বলেছেন বাঘের মতোন। এখন ভয় পেয়ে আপনি আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন
রতনকান্তি বলল, কিন্তু নখের কথা তো তুমিই প্রথম…।
এই অবধি এসে রতনকান্তি থমকে গেল। তার মনে হলো, মুহূর্তের জন্য হলেও সর্বজয়ার চোখের পাতা নড়েছে, দৃষ্টি সরেছে। সর্বজয়া তার কোলের উপর ভাজ করে রাখা হাতের আঙুলগুলো মুঠোবন্দী করে রেখেছে। মুহূর্তের জন্য সে তার সেই মুঠোবন্দী আঙুলগুলোকে যেন আলগা করে দিলো। তারপর আড়চোখে তাকালো আঙুলগুলোর মাথায় নখের দিকে। সামান্যতম সময়ের জন্য। কিন্তু এই সামান্যতম সময়ের এইটুকু ঘটনাও চোখ এড়াল না রতনকান্তি র। সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সর্বজয়ার চোখের দিকে।
এই সামান্য ঘটনায়ও রতনকান্তির বুকের ভেতর ভীষণভাবে আলোড়িত হয়ে উঠল।
.
সেই দিনের পর সর্বজয়া আর ছাদে আসেনি। রতনকান্তি রোজ অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু প্রতিদিনই তাকে নিরাশ হতে হয়। সর্বজয়ার দেখা নেই। সর্বজয়ার এই অনুপস্থিতি অবশ্য রতনকান্তির কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণও মনে হয়। তার ধারণা, সেই দিনের সেই সামান্য ঘটনাটিই সর্বজয়াকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে। তা যা-ই হোক। সেটি তার চোখ দেখেই বুঝতে পেরেছে রতনকান্তি। রতনকান্তি এখন অপেক্ষায় পরবর্তী ঘটনার।
প্রায় পনের দিন বাদে আবার ছাদে আসল সর্বজয়া। রতনকান্তি সুদক্ষিণাকে নিয়ে গানের রেওয়াজ করছিল। সর্বজয়াকে দেখে সে হঠাৎ রেওয়াজ থামিয়ে ফিসফিস করে বলল, দিদিকে আজ ভারি সুন্দর লাগছে না?
সুদক্ষিণা ঘাড় ঘুরিয়ে সর্বজয়ার দিকে তাকাল। তারপর বলল, দিদি তো সুন্দরই।
রতনকান্তি বলল, না, তা ঠিক আছে। মানে আমি বলতে চাইছি, দিদির সেই এলোমেলো অগোছালো ভাবটা আর নেই। দেখেছ?
সুদক্ষিণা বলল, হুঁ, দেখেছি।
রতনকান্তি বলল, চলো, আজ তোমায় আমি একখানা নতুন গান শেখাই।
সুদক্ষিণা নতুন গানের কথা শুনে ভারি খুশি হয়ে উঠল। সে বলল, আচ্ছা।
রতনকান্তি নতুন গান ধরল–
‘তোমার নয়ন তারায়, যে দ্বিধা জড়ায়, কতটুকু তার চিনেছ তুমি,
কতটুকু দুঃখ দিয়েছে বিধাতা, কতটুকু তার কিনেছ তুমি।
কতটা রোদনে, এ ভরা ভ্রমেতে, কতটা জীবন তুমি হারালে,
কার তরে তুমি কতটা তোমায়, রোজ অনলে দহিলে আড়ালে।
জলেই তবে জ্বলুক অগ্নি, বুকেতে জোগো হে, হে নির্ভয়া,
তোমার শক্তি চাহিছে তোমারে, জগজ্জননী, হে সর্বজয়া।’
এই অবধি এসে সুদক্ষিণা রতনকান্তিকে থামিয়ে দিলো। বলল, ও, দিদিকে নিয়ে গান?
রতনকান্তি হাসল, বলল, এ সর্বজয়া তো সে, যে সকল কিছু জয় করতে পারে। সে তোমার দিদি হতে পারে, তুমি হতে পারো। যে কেউ হতে পারে!
সুদক্ষিণা অবশ্য এতে দমল না। সে বলল, দিদিকে নিয়ে গান হয়েছে, এবার আমায় নিয়ে একখানা গান হতে হবে।
রতনকান্তি বলল, হ্যাঁ, তোমায় নিয়েও একখানা গান হবে, তবে তার আগে আমায় তো খানিক ভাবতে দিতে হবে। না ভাবলে গান হয়?
সুদক্ষিণা বলল, তাহলে দিদিকে নিয়ে যে হলো?
রতনকান্তি কিছু না ভেবেই বলল, দিদিকে নিয়ে তো ভেবেছি। আর ভেবেছি বলেই তো গানখানা হলো।
সুদক্ষিণা এবার যেন আহত হলো। সে অভিমানী গলায় বলল, ও দিদিকে নিয়ে আপনি ভাবেন। ভেবে ভেবে গানও হয়ে যায়! কেন? দিদিকে নিয়ে আপনি
এত ভাবেন কেন? দিদি আপনার কী হয়?
রতনকান্তি এবার বিব্রত হয়ে পড়ল। সে কাচুমাচু গলায় বলল, তোমায় নিয়েও তো ভাবি। এই যে তুমি একদিন অনেক ভালো গান গাইবে। তোমার গান শুনে সকলে মুগ্ধ হয়ে থাকবে।
সুদক্ষিণা বলল, তাহলে দিদি তো গান গায় না! তাকে নিয়ে ভাবেন কেন?
রতনকান্তি বলল, সকলকে নিয়ে তো এক রকম ভাবনা হয় না।
সুদক্ষিণা বলল, তাহলে দিদিকে নিয়ে কী রকম ভাবনা হয়?
রতনকান্তি এবার যেন ভীষণ সমস্যায় পড়ল। সে খানিক ভেবে তারপর বলল, দিদির তো অসুখ। কারো অসুখ হলে তাকে নিয়েই তো সকলে ভাবে, তাই না?
সুদক্ষিণা কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ও আচ্ছা। তাহলে আমারও যদি দিদির মতো অসুখ হয়, তাহলে আমায় নিয়েও সকলে ভাববে?
সুদক্ষিণা একটু থামল। তার চোখে টইটম্বুর জল। সে ভারি অভিমান মাখা গলায় বলল, আমায় নিয়ে তো এখন আর কেউ ভাবে না। মায়ের পেট থেকে ছোট ভাই যেদিন হলো, সেদিন থেকে মা, অতসী বালা কেউ আর আমায় নিয়ে ভাবে না। সকলে ওই ছোট ভাইকে নিয়ে ভাবে, আর দিদিকে নিয়ে ভাবে। আমি তো কারো কিছু না। বাবারও না। কারো না। আপনারও না।
প্রবল অভিমানে সুদক্ষিণার ঠোঁট ফুলে উঠেছে। টপটপ করে জল ঝরছে গালে। রতনকান্তির ভারি মায়া হলো। সে সুদক্ষিণার মাথায় হাত রেখে বলল, আচ্ছা, এই যে এখনই একখানা গান বাঁধছি। এখনই, সুদক্ষিণার জন্য একখানা গান হবে। হ্যাঁ?
সুদক্ষিণা সে কথা শুনল না। সে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, লাগবে না। আমার গান।
রতনকান্তি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। সুদক্ষিণা গটগট করে হেঁটে চলে গেল সোজা সর্বজয়ার দিকে। তারপর শক্ত হাতে সর্বজয়ার কাঁধ খামচে ধরে বলল, এখন থেকে আমারো অমন তোমার মতোন চুপচাপ অসুখ হবে। তখন। তোমার মতোন আমায়ও সকলে ভালোবাসবে। আমাকে তো কেউ ভালোবাসে না। মাও না, বাবাও না। অতসীবালাও না। যেই থেকে ছোট ভাই হলো, তাকেই সবাই ভালোবাসে। আর তোমার অসুখ বলে, তোমায়ও। আর তুমি তো একদিন আমায় মেরেই ফেলবে। আমি জানি, সব জানি।
সুদক্ষিণা কান্নার দমকে কথা বলতে পারছিল না। তার চোখ বেয়ে অঝর ধারায় জল ঝরছে। রতনকান্তি ততক্ষণে উঠে গিয়ে সর্বজয়া আর সুদক্ষিণার পেছনে দাঁড়িয়েছে।
সুদক্ষিণা কান্নায় বুজে আসা গলায় বলল, আমার যদি তোমার মতো অসুখ হয়, তাহলে বেশ হবে। সকলেই আমায় ভালোবাসবে। মাস্টারমশাইও আমায় নিয়ে ভেবে ভেবে গান বানাবে। আর আমিও কারো সাথে কথা বলব না। তোমার সাথেও না।
সুদক্ষিণা ঘুরে চলে যাচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে জগতের সকল মুগ্ধতা নিয়ে রতনকান্তি দেখল, নিশ্চল পাথরের মূর্তি সর্বজয়া হঠাৎ নড়ে উঠেছে। তারপর হাত বাড়িয়ে সুদক্ষিণার হাতখানা চেপে ধরেছে হাতের মুঠোয়। তারপর সুদক্ষিণাকে টেনে নিলো বুকের ভেতর। দুহাতে সর্বশক্তিতে যেন জাপটে ধরল। সুদক্ষিণার কী যে হলো! সে দিদির বুকের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিদিকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। সর্বজয়া কাঁদল না, কথা বলল না, নড়ল না। সে কেবল সুদক্ষিণাকে ছোট্ট পাখির মতোন তার বুকের ভেতর চেপে ধরে নিশ্চল বসে রইল।
রতনকান্তির হঠাৎ মনে হলো, তার চোখের সামনের এই দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর কিছু আর এই জগতে নেই, এর চেয়ে গভীর ভালোবাসাময় আর কিছু নেই।
*
হেমাঙ্গিনী দেবীর অন্তর্ধান নিয়ে বীণাবালা ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। এতদিন একের পর এক ঝামেলায় তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিলেন। গতকাল রাতে হেমাঙ্গিনী দেবীকে নিয়ে তিনি ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। দুঃস্বপ্ন দেখার পর থেকেই হেমাঙ্গিনী দেবীর কথা তার মাথায় ঘুরছে। তিনি দেখেছেন হেমাঙ্গিনী দেবী একটা পেয়ালা থেকে লাল রঙের তরল পান করছেন। সেই তরলে তার জিভ টকটকে লাল হয়ে আছে। শুধু জিভই না, লাল তরলে মাখামাখি হয়ে আছে হেমাঙ্গিনী দেবীর চিবুক, গ্রীবা। বীণাবালা ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলেন, হেমাঙ্গিনী দেবী এতক্ষণ যা পান করেছেন, তা আসলে রক্ত! হেমাঙ্গিনী দেবী হঠাৎ পেয়ালা থেকে মুখ তুলে তাকাল। তার সেই মুখ দেখে বীণাবালার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এ কোনো মানুষের মুখ নয়!
স্বপ্নের বাকি অংশজুড়ে সেই ভয়ালদর্শন হেমাঙ্গিনী দেবী বীণাবালাকে ধাওয়া করেছে আর প্রাণভয়ে ভীত বীণাবালা পালিয়ে বেরিয়েছে। এই স্বপ্ন দেখার পর থেকে বীণাবালা অস্থির হয়ে আছেন। এখন তার মনে হচ্ছে হেমাঙ্গিনী দেবীর বিষয়টিতে আরো গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল তার। কারণ তার যদি প্রকৃতই কোনো শত্রু থেকে থাকে, সে হচ্ছে হেমাঙ্গিনী দেবী। হেমাঙ্গিনী দেবী যদি বেঁচে থাকে, তবে সে নিশ্চিত করেই জানে যে তার পুত্রের জীবন্ত অগ্নিদাহের কারণ বীণাবালা। বীণাবালার তাকে বাঁচানোর কথা ছিল। কিন্তু তাকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টাই বীণাবালা করেননি। সুতরাং বীণাবালার ক্ষতি করার যেকোনো সুযোগ প্রথমেই লুফে নিবে হেমাঙ্গিনী দেবী। সন্তান হত্যার যন্ত্রণার চেয়ে বড় যন্ত্রণা আর কী আছে! এই হত্যার প্রতিশোধ নিতে জগতের কোনো মা-ই পিছু পা হবে না।
তবে হেমাঙ্গিনী দেবীর অবস্থা সম্পর্কে বীণাবালা পুরোপুরি অন্ধকারে। সেই রাতের পর একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেল হেমাঙ্গিনী দেবী! তাকে খুঁজতে যাদের পাঠিয়েছিলেন, তারাও কোনো খোঁজ দিতে পারল না। তারা অবশ্য বলেছে পথ জানা না থাকলে অত রাতে ওই জঙ্গলে কেউ ঢুকে পড়লে তার মৃত্যু নিশ্চিত। তাদের ধারণা, হেমাঙ্গিনী দেবীরও মৃত্যু ঘটেছে। সে বেঁচে নেই।
কিন্তু এই বিষয়েও বীণাবালার সংশয় রয়েছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে হেমাঙ্গিনী দেবী বেঁচে রয়েছে। এই ভাবনাটি তার মেরুদণ্ডে ভয়ের চোরা একটা স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। তিনি জানেন না হেমাঙ্গিনী দেবী বেঁচে আছে না মরে গেছে, অথচ এমন একটি মানুষের ভয়ে তাকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। এ বড় ভীতিকর বেঁচে থাকা। তার কেবলই মনে হচ্ছে হেমাঙ্গিনী দেবী আচমকা তার সামনে এসে দাঁড়াবে। আর তখন তিনি থাকবেন সম্পূর্ণ অসহায়। অবশ্য হেমাঙ্গিনী দেবীর খোঁজে বিনয়পুর, রাইপুরে তার বাড়িসহ সম্ভাব্য অনেক জায়গাতেই বীণাবালা লোক লাগিয়ে রেখেছেন। তাকে দেখামাত্র তারা বীণাবালাকে খবর দিবে।
এদিকে দীপেন্দ্রনারায়ণ এমন অবিশ্বাস্য একটি কাজ করবেন সেটিও বীণাবালা মেনে নিতে পারছেন না। মেনে নিতে পারছেন না এই কাজের সাথে ভৃত্য মুকুন্দর যুক্ত থাকার বিষয়টিও। এই সকল ঘটনায় তার মনের ভেতর এখন সার্বক্ষণিক শঙ্কা, সংশয়, অবিশ্বাস, কাকে বিশ্বাস করবেন তিনি? দিনের পর দিন মুকুন্দ তার মহলের ঘরে ঘরে অতি বিশ্বস্ত আপন মানুষের মতোন বিচরণ করেছে। অথচ তার হাতেও সে লুকিয়ে রেখেছিল অবিশ্বাসের বিষাক্ত ছোরা।
বীণাবালা আজকাল খুব ভাবেন। ভেবে ভেবে তিনি একটা বিষয় আবিষ্কার করেছেন, সেটি হলো গঙ্গামহল আর বিষ্ণুপুর যে আজ তার হাতের মুঠোয়, এর জন্য তাকে এর মধ্যেই বড় বেশি চড়ামূল্য গুনতে হয়েছে। তিনি তার চারপাশে অনেক শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন। এই শত্রুদের কেবল অল্প কয়েকজনকেই তিনি চেনেন। বেশির ভাগকেই চেনেন না।
ক্ষমতার এই এক যন্ত্রণা। ক্ষমতায় বন্ধু তৈরি হয় নকল, স্বার্থান্বেষী কিন্তু শত্রু তৈরি হয় শতভাগ খাঁটি, নির্ভেজাল। বীণাবালা এই সত্যটা আজকাল অনুভব করতে পারছেন। পরিষ্কার ধরতে না পারলেও বুঝতে পারেন যাদের বিশ্বাস করে এসেছেন, যাদের উপর নির্ভর করেছেন এতটা কাল, সামান্য স্বার্থের কারণেই তাদের বন্ধুত্বের মুখোশ মুহূর্তেই খুলে যেতে পারে। ভুজঙ্গ দেবের সাথে দীপেন্দ্রনারায়ণের সম্পর্ক নিয়েও বীণাবালা এখন সন্ধিগ্ধ। কোথাও যেন ষড়যন্ত্রের বীজ ছাড়া কিছু নেই। বাইরে থেকে দেখলে সকলই নিশ্ৰুপ, নিস্তরঙ্গ মনে হয় কিন্তু কে জানে ভেতরে ভেতরে কোথায় কোনো ষড়যন্ত্রের বীজ বেড়ে উঠছে। চারা থেকে তা ক্রমশই মহীরুহ হচ্ছে!
এই জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে তিনি নিজেই কম অবিশ্বাসের, কম ষড়যন্ত্রের বীজ বপন করেননি। কিন্তু তার ধারণা ছিল না তার বিরুদ্ধেও কেউ এমন চমকে যাবার মতো ষড়যন্ত্রের ছক কষে রাখতে পরে। মুকুন্দর ঘটনার পর। তিনি আজকাল দাসী ভৃত্যদের নিয়েও সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। তবে এই অবিশ্বাসের কালেও দাসী কমলাকে তার বড় আশ্রয় মনে হয়। ওই এক মানুষ। সেই জন্মের পর থেকে আর কখনো তাকে ছেড়ে যায়নি। আর রয়েছেন বিভূতিনাথ। এদের যেন অন্ধের মতোন আঁকড়ে ধরেছেন বীণাবালা। এই মানুষটিও কখনো তাকে ছেড়ে যায়নি। মুহূর্তের জন্যও কখনো মনে হয়নি এই মানুষটি তার সাথে কোনো অন্যায় করতে পারে। সেই শৈশব থেকে মানুষটিকে দেখে এসেছেন বীণাবালা। এই মানুষটির উপর নির্ভর করা যায় নিশ্চিন্তে।
দীপেন্দ্রনারায়ণের বিষয়টিও তেমনই রয়েছে। আসলে দীপেন্দ্রনারায়ণ ফিরে না আসা অবধি কিছু করারও নেই এই মুহূর্তে। অপেক্ষা করতে হবে দীপেন্দ্রনারায়ণের ফিরে আসা অবধিই। আজকাল মাঝে মাঝে কেমন ক্লান্তও লাগে বীণাবালার। প্রতিটি মুহূর্তে হরিণের মতোন উৎকর্ণ থাকতে থাকতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছেন। কতদিন নিশ্চিন্তে গভীর ঘুম হয় না। রাতভর কেবল নানান দুশ্চিন্তা, নানা পরিকল্পনা, নানান সন্দেহ। বুকের ভেতরটা চূড়ান্ত অশান্তির এক আধার হয়ে উঠেছে যেন।
আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল বীণাবালার। কী মনে করে সেই কাকডাকা ভোরেই তিনি ছাদে উঠে এলেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলো। তবে শীত চলে আসছে। এবার শীত যেন খানিক দেরি করেই এলো। মিহি কুয়াশা পড়েছে চারধারে। তারপরও এই স্নিগ্ধ ভোরটাকে ভারি ভালো লাগছিল বীণাবালার। তিনি এদিক-সেদিক তাকিয়ে বসার একখানা চৌকি দেখতে পেলেন। ওপরে ভারি গদি পাতা। চৌকিখানাতে বসতে গিয়ে হঠাৎ অবনীন্দ্রনারায়ণের কথা মনে পড়ল বীণাবালার। কতদিন হয় মানুষটা নেই। নেই মানে নেই! কোথাও নেই। এই গঙ্গামহলের অন্দরমহলের কোথাও মানুষটা নেই। কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা কেবল শরীরে কোথাও থাকেন, কিন্তু তাদের প্রকৃত অস্তিত্ব থাকে অন্য কোথাও। অবনীন্দ্রনারায়ণ যেন গঙ্গামহলে তেমনই ছিলেন। এই যে এতটা দিন মানুষটা এখানে নেই, কিন্তু কই, কেউ তো তাকে একবারের জন্যও মনে করল না। অথচ এখানেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা সব।
বীণাবালার আজ কী হয়েছে! নানান এলোমেলো ভাবনা তাকে একে একে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিনি গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার নিজের জীবনে কি অবনীন্দ্রনারায়ণের কোনো অস্তিত্ব আছে? তিনি অনেক ভেবে দেখেছেন, কিন্তু পাননি! মানুষটি আসলে এই পার্থিব হিসেব-নিকেশ, লাভ-ক্ষতি কিংবা এই ঘর সংসারের জন্য জন্মাননি। কিন্তু নিয়ম তাকে বাধ্য করেছে। আর বাধ্য করেছে। বলেই এখানে থেকেও তিনি আসলে ছিলেন না। কী অদ্ভুত, যেই মানুষটার সাথে জীবনের এই এতগুলো বছর প্রতিটি মুহূর্ত একসাথে কাটালেন, সেই মানুষটাকে এই এতদিনে একবারের জন্যও মনে পড়ল না বীণাবালার।
আসলেই মানুষের অনুভূতিগুলো এমনই। অদ্ভুত। এক মুহূর্তের চেনা কারো জন্যও সারাটাজীবন শূন্য মনে হয়, আবার সারা জীবনের চেনা কারো জন্যও একটা মুহূর্তও শূন্য মনে হয় না।
.
বীণাবালার সাথে দ্বিজেন্দ্র’র আজকাল দেখা হয় খুব কম। সিন্দুক খোয়া যাওয়ার ঘটনার বিস্তারিত দ্বিজেন্দ্রকে জানিয়েছেন বীণাবালা। দ্বিজেন্দ্র অবশ্য এ নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। সে চুপচাপ শুনেছে। শোনা শেষে সে তার ঘরে চলে গিয়েছে। পরেও এ নিয়ে আর কোনো কথাও বলেনি। সর্বজয়ার বিষয়টি নিয়ে তখনও এক ভয়াবহ গোলকধাঁধায় দ্বিজেন্দ্র। সেই রাতে মধু তাকে যা বলেছিল তার একটি যে অন্তত সত্য নয়, সেটি অবশেষে প্রত্যক্ষ করেছে সে। দীঘাগড় থেকে ফেরার বহুদিন পরে এক বিকেলে সে সর্বজয়াকে দেখেছে ছাদে। ছাদে বসে সুদক্ষিণার সাথে কিছু একটা করছিল সর্বজয়া। দৃশ্যটি দেখে দ্বিজেন্দ্র’র অনুভূতি হয়েছে মিশ্র। সেখানে মধুর প্রতি কেন যেন তীব্র এক ক্ষোভ কাজ করছিল। আবার সর্বজয়াকে দেখে কেন যেন স্বস্তিও কাজ করছিল। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেটি তাকে আন্দোলিত করছিল সবচেয়ে বেশি, তা হলো আরেকবার সর্বজয়ার মুখোমুখি হবার বাসনা। সে দেখতে চায় সেই ফণাতোলা হিংস্র সর্বজয়া এখনও তেমন রয়েছে কিনা! থাকলে ওই সর্বজয়াকে আরেকবার সে তার প্রতিহিংসা দেখাতে চায়। আসলে সর্বজয়াকে মেরে ফেলার কোনো ইচ্ছেই দ্বিজেন্দ্র’র ছিল না। সে কেবল চেয়েছিল সর্বজয়ার ওই ফণাখানা নামিয়ে তার পায়ের তলে পিষে রাখতে।
আজকাল বেশিরভাগ সময়ই দ্বিজেন্দ্র থাকে বিষ্ণুনারায়ণের মহলে। প্রয়োজন না হলে সে বীণাবালার কাছে আসে না। আজ এসেছে। বীণাবালা কেবল স্নান ছেড়ে বারান্দার রোদে চুল শুকাচ্ছিলেন। ঠিক এই মুহূর্তে দ্বিজেন্দ্র বারান্দায় ঢুকল। বীণাবালা একটু অবাক হলেন। এমন অসময়ে এভাবে দ্বিজেন্দ্র কখনো আসে না। তিনি অবাক চোখে দ্বিজেন্দ্র’র দিকে তাকালেন। দ্বিজেন্দ্র কথা বলল না। সে তার জামার লম্বা আস্তিনের ভেতর থেকে এক গাছি স্বর্ণের অলঙ্কার বের করে বীণাবালার সামনে রাখল। বীণাবালা অলঙ্কারখানা হাতে নিয়ে দেখলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি দ্বিজেন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী? এ কোথায় পেলি?
দ্বিজেন্দ্র বলল, বেনুচন্দের বাজারে।
বীণাবালা ভারি অবাক হলেন। বললেন, সেই অতদূরের বেনুচন্দের বাজারে কেন গিয়েছিলি? তা কিনে এনেছিস? কার জন্য? এ তো ভারি পুরোনো আমলের দেখতে।
দ্বিজেন্দ্র বলল, ভালো করে দেখো, চিনতে পারো কিনা!
কিন্তু বীণাবালা চিনতে পারলেন না। দ্বিজেন্দ্র অলঙ্কারখানা হাতে নিয়ে বলল, এই অলঙ্কার গঙ্গামহল থেকে উধাও হওয়া সিন্দুকের অলঙ্কার!
দ্বিজেন্দ্রর এইটুকু কথায়ই বীণাবালার শরীরে যেন বিদ্যুৎ চমকালো। তিনি এক ঝটকায় বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কী বলছিস তুই! তুই কিভাবে জানলি?
দ্বিজেন্দ্র ঠাণ্ডা গলায় বলল, তুমি তো জানো, দাদু ছোটবেলা থেকেই আমায় বেশ পছন্দ করতেন। তিনি খুব ছোটবেলায় বেশকয়েক বার আমায় নিয়ে ওই সিন্দুকের ঘরে নেমেছিলেনও। আমায় সিন্দুকের অলঙ্কারগুলো দেখিয়েছিলেন। কত পুরনো আমলের অলঙ্কার সেগুলো, সে কথা বলেছিলেন। ওই অলঙ্কারের নানান ভাগও রয়েছে, সেই ভাগও বুঝিয়েছিলেন। ওরকম অলঙ্কার এখন আর হাটে-বাজারে পাওয়া যায় না। সেসবের কিছুই আমি ভুলিনি।
বীণাবালা স্থির চোখে দ্বিজেন্দ্রর দিকে তাকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ অবধি কোনো কথাই বলতে পারলেন না। তারপর বললেন, বেনুচন্দের বাজারে কার দোকানে পেয়েছিস এ অলঙ্কার?
দ্বিজেন্দ্র বলল, সেঁকড়ার নাম লখাই। ওর দোকানে পেয়েছি।
বীণাবালা বললেন, খোঁজ পেলি কী করে?
দ্বিজেন্দ্র বলল, তুমি যেই দিন আমায় বললে, সেইদিন থেকেই আশেপাশের সকল স্যাকরার দোকানে লোক লাগিয়ে রেখেছিলাম, যদি কারো দোকানে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়! তুমি বলেছিলে ছোট কাকা সকল নিয়ে গেছে তার শ্বশুরালয়ে। কিন্তু আমার মন বলছিল ছোট কাকার সাথে মুকুন্দ ছাড়াও বিষ্ণুপুর বা গঙ্গামহলে যাতায়াত আছে এমন আরো কেউ না কেউ জড়িত রয়েছে। থাকতে বাধ্য। অতবড় কাজ মাত্র দু’জন মিলে করা অসম্ভব। তা মুকুন্দ না হয় ছোটকাকার সাথে পালিয়েছে, কিন্তু অন্যরা? তারা একজন হোক, দু’জন হোক বা তারও বেশি হোক, তাদের কেউ না কেউ তো এখানেই থাকবে। আর সে তার ভাগের অলঙ্কার আজ হোক কাল হোক সেঁকড়ার দোকানে বেচবেই। না বেচলে চলবে কেন? অলঙ্কার তো আর খাওয়া যায় না। ও অলঙ্কার পরতেও পারবে না। পড়তে চাইলেও ওই স্যাকরার দোকানে নিয়েই নতুন করে গড়ে নিতে হবে।
বীণাবালা হতভম্ব দৃষ্টিতে দ্বিজেন্দ্র’র দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন পুত্র গর্বে গরবিনী মাতা। এত দ্বিধা, সংশয়, দুশ্চিন্তার ভেতরও মুহূর্তের জন্য বীণাবালার মনে স্বস্তির শীতল হাওয়া বয়ে গেল। বিষ্ণুপুরের জমিদারি তাহলে যোগ্য লোকের হাতেই পড়েছে।
বীলাবালা বললেন, তাহলে এখন?
দ্বিজেন্দ্র বলল, লখাই স্যাকরাকে ধরে নিয়ে এসেছিল আমার লোকেরা। আমি তার সাথে কথাও বলেছি। গত পরশু সন্ধ্যার পরে এক লোক এসেছিল তার কাছে। যদিও লোকটা চাদরে মুখ ঢেকেই এসেছিল, কিন্তু লখাই বলেছে, এমনিতেও ও লোককে সে চিনত না। অমন গড়নের লোক সে বেনুচন্দের বাজারের আশেপাশে কখনো দেখেনি। গলার স্বরও অপরিচিত। বেনুচন্দের। কেউ হলেও নিশ্চিত চিনত। এই গয়না দেখেই লখাই চমকে গিয়েছিল। এই অলঙ্কারের যে মূল্য তা দেয়ার সাধ্য লখাই’র নেই, তাই সে অনেক কম মূল্যই। হেঁকেছিল। সেই লোক ওই কম মূল্যেই রাজি হয়ে গেল দেখে লখাই আর ঝামেলা করেনি।
বীণাবালা বললেন, তাহলে এখন উপায়?
দ্বিজেন্দ্র বলল, এই অলঙ্কার যে বিক্রি করতে এনেছিল, সে আবারও আসবে। তবে আমার ধারণা সে এক স্যাকরার কাছে বারবার যাবে না। আমাদের নজর রাখতে হবে।
বীণাবালা ক্লান্ত গলায় বললেন, তার মানে এই গঙ্গামহলেরই লোক সে?
দ্বিজেন্দ্র এবার শীতল গলায় বলল, সে জানি না মা। তবে যে-ই হোক। তাকে আমার চাই।
.
বিভূঁইকে গঙ্গামহলে নিয়ে এসেছে হরিহরণ। ঘটনা নিয়ে আলাদা কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি কারো মধ্যেই। অন্ধ এক ছেলে দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলের। নিচতলায় ভূত্যদের এক কক্ষে থাকে। এ নিয়ে কারই বা আগ্রহ হবে? তবে বিভূঁইকে বারোহাটি থেকে আনতে বেশ ঝামেলা হয়েছে। ঝামেলাটি করেছে। হেমাঙ্গিনী দেবী। সেদিন হরিহরণের বাড়িতে ঘরের ভেতর দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণের সকল কথাই শুনেছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। বিভূঁইয়ের কথাও। বিভুঁই ভালোই রয়েছে জেনে সে যতখানি স্বস্তি পেয়েছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি বিচলিত হয়েছিল এই জেনে যে বিভূঁইকে এবার গঙ্গামহলে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর থেকেই আবার সেই আগের মতো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। সে। কিন্তু তাকে শান্ত করেছিল হরিহরণ। টানা কয়েকদিনের অবিরাম চেষ্টায় হরিহরণ শেষ অবধি তাকে বোঝাতে পেরেছিল যে, এই পরিস্থিতিতে হেমাঙ্গিনী দেবী যদি বিভূঁইকে তার কাছে নিয়ে যেতে চায়, তবে তার ফলাফল হবে ভয়াবহ। শুধু যে হেমাঙ্গিনী দেবীর জন্যই ভয়াবহ হবে তা-ই নয়। বরং ভয়াবহ হবে বিভূঁইয়ে জন্যও।
ক্রমশই শান্ত হয়ে ওঠা পরিস্থিতি হয়তো এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আবার ঘোলাটে হয়ে উঠবে। হেমাঙ্গিনী দেবী বিভূঁইকে নিয়ে এখন কোথায় যাবে? তার জন্য নিরাপদ কোনো আশ্রয় কি কোথাও রয়েছে? তাছাড়া বিভুঁই বেঁচে আছে জানলে বীণাবালার কাছে সকলই স্বচ্ছ জলের মতোন পরিষ্কার হয়ে উঠবে। তার চেয়ে বিভুঁই বরং গঙ্গামহলেই নিরাপদে থাকবে। গঙ্গামহলের কেউই আগে কখনো তাকে দেখেনি। সুতরাং অন্য কোনো পরিচয়ে বিভুঁই সেখানে নিরাপদেই থাকবে। আর দেবেন্দ্রনারায়ণ যে বিভূঁইয়ের কোনো ক্ষতি হতে দেবেন না, এ বিষয়ে হরিহরণ নিশ্চিত।
হেমাঙ্গিনী দেবী শেষ অবধি হরিহরণের যুক্তি মেনে নিলেও শেষ দিনগুলোতে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে। সে কেবল বিভুঁইকে একবার দূর। থেকে দেখতে চেয়েছিল। তা হরিহরণ তাকে দেখিয়েছেও। বিভূঁইকে পাঠানোর দিন বারোহাটির বাগান বাড়ি থেকে অপলা দাসীকে যেন আর হরিহরণে বাড়ি অবধি আসতে না হয়, সেজন্য হরিহরণই আগেভাগে বারোহাটির বাগানবাড়ি চলে গিয়েছিল। গঙ্গামহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার দিন পথে নিজের বাড়ির সামনে জুড়ি গাড়িখানা খানিক থামিয়েছিল হরিহরণ। দূরে দাঁড়িয়ে ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী। হেমাঙ্গিনী দেবীর ওই মুখ এই জন্মে আর কোনো দিন ভুলবে না হরিহরণ। কী ভয়াবহ তেষ্টা, কী অসহনীয় যন্ত্রণা বুকে চেপেই না পাথরের মূর্তির মতোন দাঁড়িয়ে ছিল হেমাঙ্গিনী দেবী! মায়ের নাড়ি ঘেঁড়া ধন তার চোখের সামনে, কিন্তু সে তাকে ছুঁতে পারছে না, কথা বলতে পারছে না, বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরতে পারছে না। জগতে এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী আছে!
বিভুঁই অবশ্য হরিহরণকে চিনতে পেরেছিল। কী আশ্চর্য এক ক্ষমতা এই ছেলের! পথে আসতে বিভুঁই’র সাথে নানান কথা বলেছে হরিহরণ। বিভুঁইকে যে সে আগেও দেখেছে এ কথা যেন দেবেন্দ্রনারায়ণকে না জানায় বিভূঁই, সে কথাও হরিহরণ বলেছে। দেবেন্দ্রনারায়ণ যে এখন আর প্রবল প্রতাপশালী নেই, সে কথাও জানিয়েছে। গঙ্গামহলের ভেতরের ঘটনা সম্পর্কেও আঁচ দিয়েছে। বিভুঁই বুঝতে পারছিল, তাকে নিয়ে চারপাশজুড়ে এক জটিল চক্র চলছে। সে জানে না এই চক্র থেকে সে কখনো বের হতে পারবে কিনা। তবে সে এটি বুঝেছে, এই অন্ধ চোখেও তার এখন কেবল চারপাশ দেখার সময়, শোনার সময়। কিন্তু বলার সময় এটি নয়।
হরিহরণ বারোহাটি বাগানবাড়ির কাছাকাছি এসে জুড়িগাড়িখানা ছেড়ে দিয়েছিল। তখন যদি কেউ দূর থেকে দৃশ্যটি দেখত, তবে সে ভীষণ অবাক হতো! কৃশকায় এক বৃদ্ধের হাত ধরে পা টিপে টিপে হেঁটে আসছে এক অন্ধবালক। তার ডান পাশে বিশাল নদী। বা পাশে বিশাল পাঁচিল তোলা এক জমিদার বাড়ি। বালকটি খানিক দাঁড়ায়, দাঁড়িয়ে হরিহরণকে কোনো প্রশ্ন করে। তারপর আবার হাঁটে, আবার দাঁড়ায়, আবার প্রশ্ন করে। হরিহরণের বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগে ওঠে। সে বিভূঁইয়ের পিতৃপরিচয় জানে। সেই পরিচয় এতদিন তার বুকের ভেতর যে ঘৃণার, যে অস্বীকারের বোধ জমিয়ে রেখেছিল এই খানিকটা সময়ে যেন তা গলে গলে উবে যাচ্ছিল। এই ছেলেটির শরীরে হেমাঙ্গিনী দেবীর রক্তও বইছে। এই ভাবনাটি বহু বহু বছর বাদে হরিহরণের মনের অদ্ভুত সেই অনুভূতিকেও আলোড়িত করে তুলল। তার হঠাৎ মনে হলো তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা শশীচরণ বণিকও কি এই ছেলেটির শরীরে কোথাও না কোথাও রয়ে যায়নি!
শীতের সেই নরম দুপুরের মিষ্টি রোদে বালকটি হেঁটে আসতে আসতে হরিহরণকে জিজ্ঞেস করল, আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি, এখন তাহলে এই বাড়িখানা কাদের?
হরিহরণের কী হলো! সে শান্ত, নিষ্কম্প কণ্ঠে জবাব দিলো, তোমার। এই বাড়িখানা তোমারও।
বিভূঁই কিছু বলল না। কিংবা বুঝল না। বুঝল না গঙ্গামহলের আর কেউই। খানিকবাদেই বিষ্ণুপুরের জমিদার বাড়ি গঙ্গামহলের সিংহদরজা দিয়ে যে ছিন্ন কাপড়ের অন্ধবালকটি প্রবেশ করল এই জমিদার বাড়ির রক্ত তার শরীরে!
*
দিন কেটে যেতে লাগল নিস্তরঙ্গ।
বিভুঁই সারাদিন নিচতলায় তার ছোট্ট কুঠুরিতে বসে থাকে। এই বাড়িতে যে সে আছে, তা-ই যেন কেউ জানে না। হরিহরণ মাঝে মাঝে আসে। আবার চলে যায়। রতনকান্তির সাথে অবশ্য ভারি ভাব হয়ে গেছে বিভুঁই’র। তবে রতনকান্তি ব্যস্ত সর্বজয়াকে নিয়ে। অনেকটা দিন কেটে গেলেও সর্বজয়া এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেনি। অবশ্য দিনদিন যে সে গুছিয়ে উঠছে তা বোঝা যাচ্ছিল।
দেবেন্দ্রনারায়ণের পুত্রের নাম রাখা হয়েছে বীরেন্দ্রনারায়ণ। সকলে অবশ্য ছোট্ট বীরেন্দ্রনারায়ণকে বীরেন্দ্র বলেই ডাকে। বীরেন্দ্রর গায়ের রঙ হয়েছে। দুগ্ধশুভ্র। দেবেন্দ্রনারায়ণ সারাক্ষণ পুত্রের পাশে বসে থাকেন। রেণুকা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি মাঝে মাঝে দেবেন্দ্রনারায়ণকে দেখে খুব অবাক হন। এই সন্তান নিয়ে কী লঙ্কাকাণ্ডটাই না তিনি বাধিয়েছিলেন। অথচ সেই সন্তানের পাশ থেকে দেবেন্দ্রনারায়ণ আজকাল আর নড়তে চান না। তা বীরেন্দ্র দেখতে হয়েছেও ভারি সুন্দর। যেন সাক্ষাৎ কার্তিক। সে হাসলে যেন জগৎজুড়ে সকল কিছুই হাসতে থাকে। রেণুকার মাঝে মাঝে মনে হয়, ভগবানের বিচার খারাপ কিছু নয়। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। হয়তো অনেক কিছুই তিনি নিয়ে নিয়েছেন, কিন্তু তার বিনিময়ে কম কিছু তো দেননি। এই যে মানুষটাকে এখন রোজ কাছে পাচ্ছেন। ঘরের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। নিজের মানুষ মনে হচ্ছে। এ-ই বা কম কিসে? কোনোদিন তো এই মানুষটাকে এমন মনে হয়নি। সবসময় নিজেকে মনে হয়েছে ঘরের একখানা কারুকার্যখচিত পালঙ্কের মতোন। যে কেবল ঘরের শোভা বর্ধন করে আর অপেক্ষায় থাকে পালঙ্কের মালিক এসে তাতে শয়ন করুক। কিন্তু অত সময় তার ছিল কোথায়!
এখন তার অফুরন্ত সময়। রেণুকা সেই সময়ের কিছু কিছু মনপ্রাণ ভরে উপভোগ করে। কিন্তু একটা জিনিস সে টের পায়, মানুষটার কোথায় যেন তীব্র এক হাহাকার। সে ধন-সম্পদের হাহাকার নয়। ক্ষমতার হাহাকার নয়। এ অন্য কোনো হাহাকার। অন্য কোনো শূন্যতা। কিন্তু সেই শূন্যতা কিসের তা রেণুকা জানেন না। তিনি যে চেষ্টা করেননি, তা নয়। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ জীবনজুড়েই তার কাছে ছিলেন দূরের আকাশ। যাকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায় না। রেগে গেলে, দুঃখী হলে তার ঝড় বাদলে ভিজে যাওয়া যায়, আনন্দের রোদ হলে তাতে ওম পোহানো যায়, কিন্তু তাকে স্পর্শ করা যায় না। এই ক’মাসে এত কাছে পেয়েও কি তাকে ছুঁতে পেরেছেন রেণুকা? এই প্রশ্নের উত্তর রেণুকার। কাছে নেই। কখনো কখনো মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছে পেরেছেন, আবার। পরক্ষণেই মনে হয়েছে তাকে ছোঁয়ার সাধ্য তার নেই।
মানুষটা জীবনজুড়েই কেমন খেয়ালি ছিলেন, কখনো কখনো প্রবল অত্যাচারীও। কিন্তু মানুষটাকে ভালো না বেসে পারেননি রেণুকা। অসংখ্য নারীসঙ্গের জীবন দেবেন্দ্রনারায়ণের, এ নিয়ে রেণুকার কখনো আক্ষেপ ছিল না। তিনি শুধু চাইতেন তার সময়টুকু পরিপূর্ণরূপে মানুষটাকে নিজের করে পেতে। কিন্তু কখনো কি তেমন করে পেয়েছিলেন? রেণুকা জানেন না। জেনে কাজও নেই। তার চেয়ে এই ভালো। কেমন দিব্যি একটা সংসার সংসার ব্যাপার। মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও আজকাল মাঝে মাঝেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে রেণুকার। সেদিন সন্ধ্যেবেলা দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ তাকে ডাকলেন। রেণুকা বীরেন্দ্রকে সামলাতে গিয়ে ভারি অগোছালো, অপরিষ্কার হয়ে ছিলেন। স্নান অবধি সারা হয়নি। সেই অবস্থায়ই দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে গেলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ দীর্ঘ সময় তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, আমায় একটু ধরে বসিয়ে দাও তো।
রেণুকা তাকে ধরে বসিয়ে দিলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণ রেণুকাকে বললেন, এবার আমার সামনে বসো তো।
রেণুকা অবাক হলেন। এই অবস্থায় তিনি দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে বিছানায় বসবেন! সারাদিন বীরেন্দ্রকে নিয়ে ভারি ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। নিজের কাছেই কেমন অপরিচ্ছন্ন লাগছে নিজেকে। তারপরও তিনি বসলেন। দেবেন্দ্রনারায়ণের সামনে মুখোমুখি বিছানায়। কিন্তু দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে উল্টোদিকে ঘুরে বসতে বললেন। অবাক রেণুকা কিছুই বুঝল না। সে উল্টোদিকে ঘুরে বসল। দেবেন্দ্রনারায়ণ তারপর একটা অদ্ভুত কাজ করলেন। তিনি তার ডান হাতখানা বাড়িয়ে রেণুকার চুল ছুঁয়ে দিলেন। এলোমেলো অগোছালো চুল। তিনি সেই চুলগুলোকে আলতো হাতে বিন্যস্ত করতে লাগলেন। রেণুকা ক্ষণিকের জন্য আড়চোখে তাকিয়ে দেখল। তার বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করতে লাগল। ভারি লজ্জাও লাগছিল তার। এই এতগুলো বছর। এমন করে কোনোদিন দেবেন্দ্রনারায়ণ তাকে ছুঁয়ে দেননি। তিনি যখন ছুঁতেন তার পুরোটাই ছিল বুনো উন্মাদনা। সেখানে ভালোবাসা কি কখনোই ছিল? কি জানি, তবে রেণুকা কখনো পাননি। তার পুরোটাজুড়েই রেণুকা কেবল কাম খুঁজে পেয়েছেন। তাতে আদিমতম সুখের উন্মত্ত পীড়ন ছিল। কিন্তু এমন গভীর অনুভূতিময় ভালোবাসার স্পর্শ কখনোই ছিল না। আজ এই এতটুকু স্পর্শেই রেণুকার সারাশরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। শিহরিত হয়ে উঠল শরীরের লোমকূপ অবধি। রেণুকার লজ্জাও লাগতে লাগল ভারি। মনে হচ্ছিল। দেবেন্দ্রনারায়ণ এখনই তাকে আবার আগের সেই বুনো দস্যুর মতোন পুরোপুরি লুটে নিক। নিঃস্ব করে দিক। আজ আর দেবেন্দ্রনারায়ণ একা নয়, রেণুকা নিজেও তার পুরোটুকুই উপভোগ করবে। গ্রহণ এবং সমর্পণ হবে পরিপূর্ণরূপে।
সে রাতে বহুদিন বাদে দেবেন্দ্রনারায়ণের শয্যায় এলেন রেণুকা। এই এতটা বছরের শরীরের এই প্রথম যেন প্রবল তেষ্টা জেগে উঠল রেণুকার। প্রবল তেষ্টা। আদিম উন্মাদনার এক বন্য পুরুষের জন্য তেষ্টা। যে পুরুষ তাকে বুনো উন্মাদনায় ভালোও বাসবে। আবার অমন করে মমতায়ও ছুঁয়ে দিবে। তা। দেবেন্দ্রনারায়ণ দিলেনও। কিন্তু শরীরের বা দিকের অংশ পুরোপুরি সক্ষম না থাকায় শয্যার আগের সেই বুনো হিংস্র দেবেন্দ্রনারায়ণকে যেন খুঁজে পেলেন না রেণুকা। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে রাগমোচনের পর দেবেন্দ্রনারায়ণের বুকের কাছে শুয়ে থাকা ক্লান্ত রেণুকার মনে হলো এই জগতের সবচেয়ে সুখিতম নারী সে। সে শরীরের সুখে হোক কিংবা মনের। এতকাল যে শরীরের সুখ তিনি পেয়েছেন, তা তাকে এই মুহূর্তের এই তীব্র পরিতৃপ্তির অনুভূতি কখনো দেয়নি। আজ তিনি দেবেন্দ্রনারায়ণের শরীরে সেই শরীরি দস্যিপনা খুঁজে পাননি। কিন্তু যতটুকু স্পর্শ তিনি পেয়েছেন, তাতে কাম মাখামাখি হয়েছিল তীব্র ভালোবাসায়। সেই তীব্র ভালোবাসা কাম হয়ে এই প্রথম রেণুকার শরীরের সকল সংবেদনশীলতা, সকল উদ্দীপনা চূড়ান্ত আনন্দদায়ী স্পর্শ হয়ে ছুঁয়ে গেছে। রেণুকা দু’হাতে দেবেন্দ্রনারায়ণের গলা জড়িয়ে শুয়ে রইলেন।
প্রায় বিগত যৌবনা এক নারী এই এতবছরের চেনা শরীরে অবশেষে আবিষ্কার করলেন এক চির অচেনা সত্য। ভালোবাসাময় স্পর্শের সুতীব্র শক্তি! সেই ভালোবাসা মুহূর্তের আলতো স্পর্শে জাগিয়ে দিতে পারে যুগ যুগ ধরে ঘুমিয়ে থাকা বিবশ শরীর।
.
ফুটফুটে জোছনার রাত। জেঁকে শীত পড়েছে। কিন্তু কম্বলে পেঁচিয়ে বিভূঁইকে নিয়ে ছাদে বসেছে রতনকান্তি। দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলে রতনকান্তির যাতায়াত এখন আর বিধিনিষেধে আটকে নেই। যতটুকুও ছিল, বিভুঁই আসার। পর তাও শিথিল হয়েছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বিভূঁইয়ের সাথে পারতপক্ষে দেখা করেন না। তিনি চান না বিভূঁইয়ের জন্য তার বিশেষ কোনো যত্ন করে কারো নজরে পড়ুক। বিভূঁইকে তিনি যতটা সম্ভব পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলেছেন। তা বিভুঁই সে সকল আগেই বুঝেছে। সে রয়েছেও তেমনই। দেবেন্দ্রনারায়ণ একটা জিনিস খেয়াল করে ভীষণ খুশি হয়েছেন, রতনকান্তির সাথে বিভুঁই’র ভারি ভাব। তিনি মনে মনে চাইছেন, রতনকান্তি যতটা সম্ভব বিভুঁই’র সাথে মিশুক, সঙ্গ দিক। অন্ধ, অসহায় বিভুঁই’র যদি এতে খানিকটা নিঃসঙ্গতা কাটে।
বিভূঁইকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার আগে রতনকান্তি বলেনি যে আজ জোছনা। তারা বসেছে ছাদের একদম মাঝখানে। বিভুঁই বলল, এই বাড়িটার চারধারজুড়েই কি উঁচুমহল?
রতনকান্তি বলল, হুঁ। কে বলেছে তোমায়?
বিভুঁই বলল, কেউ বলেনি। চারপাশের সকল শুনে অনুমান করতে বড় ভালো লাগে আমার। সে মতো কল্পনায় ছবিও এঁকে নেওয়া যায়। সে দিন বাড়ির মাঝের উঠানে বসে কেউ উচ্চস্বরে কথা বলছিল, চারপাশে তার প্রতিধ্বনি হচ্ছিল বেশ। তখন মনে হলো, চারধারজুড়েই উঁচুমহল।
রতনকান্তি কিছু বলল না। কেবল তাকিয়ে রইল বিভূঁইয়ের দিকে।
বিভুঁই বলল, পাশের নদীটা অনেক সুন্দর, তাই না?
রতনকান্তি বলল, তা সুন্দর।
বিভুঁই বলল, শীতের সময় নদী শুকিয়ে যায় না?
রতনকান্তি দূরে গঙ্গাবতীর দিকে তাকাল। তাকানোর সাথে সাথে সে থমকে গেল। চারধারে কুয়াশা পড়েছে। কুয়াশা তেমন গভীর নয়। মিহি চাদরের মতোন কুয়াশা। সেই কুয়াশার চাদর গলে গলে নামছে অদ্ভুত অপার্থিব ধবল জোছনা। সেই জোছনা মাখা কুয়াশায় দূর থেকে রাতের গঙ্গাবতাঁকে দেখে। মনে হচ্ছে জোছনার নদী। যেন গঙ্গাবতী-ভর্তি জলের বদলে থই থই জোছনা। রতনকান্তি সেই গঙ্গাবতীর দিকে তাকিয়ে ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, জগতের কিছু কিছু কখনো শুকিয়ে যায় না।
বিভুঁই বলল, কিন্তু নদী তো শুকিয়ে যায়।
রতনকান্তি বলল, নদীও যায় না।
বিভুঁই মৃদু হাসল। বলল, কেবল কল্পনার নদীই শুকায় না।
রতনকান্তি ঝট করে বিভূঁইয়ের দিকে তাকাল। তারপর বলল, এটা কেন বললে?
বিভুঁই বলল, এই যে আমি জানতে চাইলাম, নদীটা শুকিয়ে গেছে কিনা, আপনি সাথে সাথে জবাব দিলেন না। জবাব দিলেন সময় নিয়ে। নদীটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কেমন অন্যরকম গলায় বললেন জগতের কিছু কিছু কখনো শুকিয়ে যায় না। কিন্তু সকলেই জানে, নদী শুকায়। তার মানে আপনি নদীর কথা বলেননি। কিংবা বললেও সেই নদী এই নদী নয়। সেই নদী আপনার কল্পনার নদী।
রতনকান্তি বলল, বাস্তবের নদী শুকিয়ে যেতে পারলে কল্পনার নদীরও শুকিয়ে যেতে পারবে, পারার কথা।
বিভুঁই এবার সাথে সাথে জবাব দিলো না। সে চুপ করে কি ভাবল। তারপর বলল, আপনার কি মাঝে মাঝে মনে হয় না, আমি দিন দিন এক অস্বাভাবিক মানুষ হয়ে যাচ্ছি? আমার চিন্তা ভাবনা কেমন এলোমেলো, অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছে! সবসময় কী সব উদ্ভট কথা বলি, উদ্ভট চিন্তা করি, তাই না?
রতনকান্তি বলল, কেন বলো তো?
বিভুঁই বলল, এই কী এক অসুখ যে আমার হয়েছে। সারাদিন রাত কেবল ভাবি আর ভাবি। ভাবতে ভাবতে কতকিছুর ছবি যে মনের ভেতর গেঁথে নিই। কত কত কথা যে নিজের সাথে নিজে বলি। তার অনেক কিছুই আমার নিজের কাছেই কেমন অস্বাভাবিক লাগে।
রতনকান্তি বলল, যেমন?
বিভুঁই বলল, এই যে আপনি বললেন বাস্তবের নদী শুকিয়ে যেতে পারলে কল্পনার নদীও শুকিয়ে যেতে পারার কথা। আপনার কথা কিন্তু ঠিক। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আমার ক্ষেত্রে ঘটে। আমি যতবার নদীর কথা কল্পনা করেছি, ততবার আমার চোখে জল ভরা নদীর ছবিই ভেসে উঠেছে। সে বর্ষার নদী হোক, আর শীতের। সেই থেকে আমার মনে হলো কল্পনার নদীরা সবসময় জলপূর্ণ হয়। কল্পনার নদীরা কখনো শুকায় না, শুকনো হয় না।
রতনকান্তি অভিভূত চোখে বিভূঁইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে না বিভুঁই যা বলছে, প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই তা ঘটে কিনা। কারণ সকল মানুষের ভাবনার ধরন এক নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে তার নিজেরও মনে হয়েছে বিভুঁই যা। বলেছে তা সত্য। সে নিজেও কখনো জলহীন শুকনো খটখটে নদীর কথা তার কল্পনায় ভাবেনি। নদীর কথা ভাবতে অবচেতনেই চলে এসেছে জল থৈ থৈ। নদী। তার কল্পনার নদীরাও কখনো শুকায়নি।
রতনকান্তি বলল, কিন্তু আমি তো এই মুহূর্তে কল্পনার নদীর কথা বলিনি। চোখের সামনের বাস্তব গঙ্গাবতীর কথা বলেছি।
বিভুঁই বলল, আমি হয়তো ভুল। কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার কেন যেন মনে হলো রাতের অন্ধকারে চারধারে কুয়াশা পড়েছে। সেই কুয়াশায় দূরের নদী দেখে আপনি মুগ্ধ হয়ে কল্পনায় চলে গেছেন। আমি জিজ্ঞেস করতেই আপনি সেই কল্পনার নদীর কথাই বলেছেন।
বিভুঁই খুব সামান্য সময়ের জন্য থামল। তারপর বলল, আজ কি পূর্ণিমা?
রতনকান্তি এবার আর চমকালো না। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ।
বিভুঁই বলল, কুয়াশায় জোছনা নামলে কেমন ঘোর লেগে যায় তাই না? চারপাশের সকলই কেমন স্বপ্নের মতোন লাগে!
রতনকান্তি চুপ করে রইল। বিভুঁই মিথ্যে বলেনি। চারপাশটা আসলেই স্বপ্নের মতোন লাগছে। বিভ্রমের মতোন লাগছে। হয়তো এই বিভ্রম কেটে গেলেই গঙ্গাবতী নদীকে আর তার জোছনা থৈ থৈ নদী মনে হবে না। মনে হবে খুব সহজ স্বাভাবিক এক নদী।
*
হরিহরণ আসল বেশ কিছুদিন বাদে। এবার হরিহরণকে দেখেই রতনকান্তি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল যে করেই হোক সর্বজয়ার ঘটনা কী ঘটেছিল তা হরিহরণের কাছ থেকে সে জানবেই। তার দৃঢ় বিশ্বাস, এই ঘটনার কিছু না কিছু হরিহরণ জানেই। শুধু এই ঘটনাই নয়, গঙ্গামহলের অনেক ঘটনাই হরিহরণ জানে। এমন মনে হবার কারণও অবশ্য রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সে হরিহরণকে এখানে সেখানে ওঁৎ পেতে থাকতে দেখেছে। শুধু তাই-ই নয়, রতনকান্তি এও খেয়াল করেছে যে হরিহরণ যা-ই জানুক, যা-ই শুনুক, সে সে সকল কথা আর কারো কাছেই বলে না। কিন্তু রতনকান্তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে করেই হোক এবার হরিহরণের কাছ থেকে সর্বজয়ার ঘটনা সে জানবেই।
সেদিন হরিহরণের সাথে বিভূঁইকে নিয়ে কথা হচ্ছিল রতনকান্তির। হরিহরণ বলল, তুমি তো এইখানেই রয়েছ! তা এই অন্ধ ছেলেটির দিকে একটু-আধটু খেয়াল রেখো। বড় দুঃখী এই ছেলে।
রতনকান্তি বরাবরেরই মতোই হেঁয়ালিপূর্ণ উত্তর দিলো, জগতে সকলেই দুঃখী গো হরিহরণ বণিক। তুমি দুঃখী, আমি দুঃখী, কর্তাবাবু দুঃখী। আবার দেখো গিয়ে ওই যে জমিদার মহলে যাদের সবচেয়ে সুখি থাকার কথা, তারাও দুঃখী। আমাদের ছোট্ট সুদক্ষিণা দুঃখী, তার দিদি সর্বজয়া দুঃখী। সেদিন শুনলাম অতসীবালাও দুঃখী। জগতে সুখি মানুষের বড় অভাব।
হরিহরণ বলল, তা কথা খারাপ বলোনি।
রতনকান্তি বলল, আমার কী মনে হয় জানো? আমার মনে হয় মানুষ দুঃখ পেতে ভালোবাসে। তাই সে কারণ থাকলেও দুঃখ পায়, কারণ না থাকলেও দুঃখ পায়।
হরিহরণ বলল, এ কথা বললে কেন?
রতনকান্তি বলল, ধরো যার ছোট একখানা ঘর, সে সেই ঘরে বসে বড় ঘর না থাকার কারণে দুঃখ পাবে। আর যার ঘর নেই, সে আবার অমন একখানা ছোটঘরের জন্য দুঃখ পাবে। কিন্তু যেই সে ছোট ঘরখানা পেয়ে যাবে, অমনি তার আবার বড় একখানা ঘরের দুঃখ পেয়ে বসবে। দুঃখ বলতে আলাদা কিছু নেই। মানুষের বুকের ভেতর যে সীমাহীন আক্ষেপ থাকে, অতৃপ্তি থাকে, তার নামই আসলে দুঃখ।
হরিহরণ বলল, তোমার কথা মিথ্যে নয়। তবে সকল ক্ষেত্রে আবার সত্যিও নয়।
রতনকান্তি বলল, জন্ম আর মৃত্যু ছাড়া আর কোনো কিছুই সকল ক্ষেত্রে সত্যি নয়।
হরিহরণ বলল, তোমার বড় ভারি ভারি কথা। ও আমার জন্য বোঝা কঠিন।
রতনকান্তি বলল, কঠিনের কিছু নেই। এই যে ধরো সর্বজয়া, কী হয়েছে জানি না। ধরে নিলাম কোনো কারণে সে মনে কষ্ট পেয়েছে। কেউ তাকে কষ্ট দিয়েছে, আঘাত দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে দিনের পর দিন এমন হয়ে থাকতে হবে? বাবা এমন অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন। এই অবস্থায় ছোট একটা ভাইও হলো। তার ওপর ওই মহল থেকে এত সব কাণ্ডকীর্তি। তার কি সাজে এভাবে এমন পড়ে থাকা? তাকে সামলাতেই তো দশজন লেগে যায়! একবার ভাবো, এ যদি এই জমিদার বাড়ির মেয়ে না হয়ে কোনো দাস-দাসীর মেয়ে হতো, তাহলে কী হতো? সেই মেয়ে এমন করে থাকতে পারত? কী এমন হয়েছে তার বলো দেখি!
রতনকান্তি থামলেও হরিহরণ কোনো জবাব দিলো না। রতনকান্তি খানিক হরিহরণের জবাবের অপেক্ষা করে বলল, তা যা-ই বলো, কথা ওইটেই ঠিক, যে মানুষ যত পায়, তার দুঃখ তত বেশি। তার আক্ষেপ আর অতৃপ্তিও তত বেশি। কী বলো, ভুল কিছু বলেছি?
হরিহরণ এবারও কথা বলল না। রতনকান্তি চাইছে যে করেই হোক হরিহরণের মুখ খোলাতে। কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে না তার এই ফাঁদে হরিহরণ পড়বে। রতনকান্তি আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হরিহরণ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি সর্বজয়ার ব্যাপারে জানতে চাইছ, তাই তো? তা আমায় সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো পারতে? এমন কৌশলে লুকোচুরি করবার কী আছে?
রতনকান্তি এবার থতমত খেয়ে গেল। সে বলল, না, না। লুকোচুরির তো কিছু দেখছি না। তা এতদিন ধরে এ বাড়িতে রয়েছি। তাদের খাচ্ছি। কদিন আগেও তো মেয়েটাকে দিব্যি সুস্থ দেখেছি। কী আগুনে মেয়েই না সে ছিল বাবা! সেই মেয়েটা হঠাৎ অমন হয়ে গেল, দেখে কার না মনে প্রশ্ন জাগে বলো?
হরিহরণ বলল, শোনো, তুমি মানুষ ভালো। সে তোমায় দেখেই আমি চিনেছি। তা কথাটি আমি নিজ থেকেই তোমায় বলতাম। কারণ সর্বজয়ার জন্য তুমি যা করছ, তা আমার চোখ এড়ায়নি। আর এই জন্যই আমার মনে হয়েছে, কথাটি তোমায় বলা দরকার।
রতনকান্তি এবার আর কথা বলল না। এই আপাতদৃষ্টিতে সহজ, সরল, অতি সাধারণ মানুষটিকে সে যত দেখছে তত চমকে যাচ্ছে। এই মানুষটির উপস্থিতি কখনো টের পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রয়োজনে তার সেই অস্পষ্ট অপ্রধান উপস্থিতিই মুহূর্তের ব্যবধানে হয়ে ওঠে সবচেয়ে তীব্র, সবচেয়ে উজ্জ্বল, শক্তিশালী। রতনকান্তি ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি তার দিকেও এমন সদাসতর্ক দৃষ্টি ছিল হরিহরণের। সে বরং ভেবেছিল মানুষটিকে সে দেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে গঙ্গামহলে নজর রাখতে।
হরিহরণ বলল, তুমি বললে না সর্বজয়ার দুঃখ বেশি কিনা? আমি বলছি শোন, সর্বজয়া তার নারী জীবনের সবচেয়ে কুৎসিততম অভিজ্ঞতাটির মুখোমুখি হয়েছে। এর চেয়ে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। শুধু তা-ই না, সে হয়তো মরেও যেতে পারত। সে যে বেঁচে আছে সে বড় ভাগ্যের জোর।
হরিহরণ সামান্য থামল। রতনকান্তি ফ্যালফ্যাল করে হরিহরণের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর যেন অজস্র বিষাক্ত বিছের দল একসাথে ক্রমাগত দংশন করে চলেছে। হরিহরণ বলল, এর চেয়ে বেশি আর কিছু জানতে চেয়ো না। আমি বলতে পারবো না। তবে কখনো যদি দরকার পড়ে, সময় আসে, আমি নিজ থেকেই বলব।
রতনকান্তি সেই সারাটি দিন নিঃসাড় বসে রইল। তার বুকের ভেতরটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় অবশ হয়ে রয়েছে। এই অনুভূতির কারণ তার জানা নেই। সর্বজয়া তার কেউ না। কিন্তু বুকের ভেতরের ব্যথারা সে কথা মানে না।
.
সেদিন ভোরে রতনকান্তিকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে দেবেন্দ্রনারায়ণ হঠাৎ বললেন, শীতকালও তো চলে যাচ্ছে রতনকান্তি।
রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে কর্তা। শীত এবার কেমন বিলম্বে এসে আবার তড়িঘড়ি চলেও যাচ্ছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, সকলই এমন বদলায় হে রতনকান্তি। কোনো কিছুই চিরকাল একই গতিতে, একই তীব্রতায় থাকে না, বদলায়। এই আমায় দেখ, কেমন বদলে গেছি। ছোটবেলায় যে শীত নামত, আজকাল তো আর তার কোনো লক্ষণ দেখি না। বর্ষায় তেমন বৃষ্টিও দেখি না। তবে গঙ্গাবতী যেন এবার শীতেও তেমন শুকায়নি, কী বলো হে?
রতনকান্তি বলল, আজ্ঞে, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কর্তা।
দেবেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আগে এই শীত এলেই অপেক্ষায় থাকতাম, বাবা কবে পাখি মারতে নিয়ে যাবেন। সে কালে বাবার সাথে বজরায় নিভারণের বিলে যেতাম পাখি মারতে। সে কী সময়ই না ছিল। একবার আমি বজরা থেকে পড়ে ভেসে গিয়েছিলাম অবধি। এখন আর কিছুই ইচ্ছে হয় না। আসলে জীবন। যখন ভোগ করা হয়, তখন বোঝা যায় না যে ভোগ হচ্ছে। তখন কেবল মনে হয়, প্রকৃত ভোগের সময় বুঝি সামনে রয়েছে।
দেবেন্দ্রনারায়ণ আজকাল একনাগাড়ে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। হাঁপিয়ে যান। তিনি খানিকটা দম নিয়ে বললেন, এই যে শীত আসবে, শীত যাবে, হয়তো সেই নিরণের বিলে কত কত পাখিও আসবে, কিন্তু সেই পাখি শিকারে তো আর কখনো যাওয়া হবে না। এই-ই জীবন। অথচ প্রতিবছর ভেবেছি, পরের বছর তো রয়েছেই, এত তাড়া কিসের! জীবনকে অবচেতনে অফুরন্ত ভেবেছিলাম, আসলে তো সে তো তা নয়।
রতনকান্তি সেদিন আর দেবেন্দ্রনারায়ণের কথার কোনো জবাব দেয়নি। তবে সেই রাতেই সে একটা পরিকল্পনা করে ফেলল। সেটি হরিহরণকেও জানালো। দেবেন্দ্রনারায়ণ এককালে খুব বজরাযোগে নদীভ্রমণে যেতেন। তিনি আমোদ-প্রমোদের মানুষের ছিলেন। কিন্তু আজকাল সেসকল আমোদ-প্রমোদ চিন্তার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেন না। রতনকান্তি হরিহরণকে বলল, অমন আরেকখানা বজরা ভ্রমণের আয়োজন করলে কেমন হয়? সাথে সর্বজয়ারও না হয় খানিক আলো হাওয়া বের হওয়া হলো।
হরিহরণ সাথে সাথে কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। কথা বলল না। রতনকান্তি এর কারণ বুঝল না। সে নানানভাবে হরিহরণকে জিজ্ঞেসও করল। কিন্তু হরিহরণ আর টু শব্দটি অবধি করল না। পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে হরিহরণকে আর কোথাও খুঁজে পেল না রতনকান্তি। সে ভারি অবাক হলো! দেবেন্দ্রনারায়ণের বজরা ভ্রমণের পরিকল্পনা শুনে হরিহরণ এমন প্রতিক্রিয়া দেখাল কেন! তবে রতনকান্তি তার পরিকল্পনা থেকে সরে এলো না। কিন্তু সে জানে, এ বাড়িতে যতটা সম্ভব দেবেন্দ্রনারায়ণের মহলখানাকে জাঁকজমকহীন করে রাখাই মঙ্গল। তাতে বীণাবালার শ্যেনদৃষ্টি যেমন এখানে কম পড়বে। তেমনি নানান উটকো বিড়ম্বনা থেকেও দূরে থাকা যাবে। সুতরাং অপেক্ষা করতে হবে কবে বীণাবালা গঙ্গামহলের বাইরে যান। তা সুযোগটি এসেও গেল। বিভূতিনাথ সাহার কী এক অসুস্থতার খবর শুনে তাকে দেখতে গেলেন। বীণাবালা। ফিরবেন দিন কয় বাদে। এই সময়টাতেই দেবেন্দ্রনারায়ণকে বলে রতকান্তি একখানা নৌবিহারের আয়োজন করে ফেলল। দেবেন্দ্রনারায়ণ এমনিতেই আনন্দপ্রিয় মানুষ। আর রতনকান্তির এমন উৎসাহ দেখে তিনি আর বাধাও দিলেন না। তিনি রেণুকাকে বললেন, তা রেণুকাও অমত করলেন না। বহুকাল পরে যেন গঙ্গামহলের সেই সবচেয়ে আলো ঝলমলে জাঁকজমকপূর্ণ মেজোকর্তার মাঝমহলখানায় আবার প্রাণ ফিরে এসেছে।
কিন্তু যার জন্য রতনকান্তির এই এত আয়োজন সেই সর্বজয়াই রাজি হলো না। রতনকান্তি মনে-প্রাণে চাইছিল সর্বজয়াকে খানিক আলো হাওয়ায় ঘুরিয়ে আনতে। কিন্তু সর্বজয়া একবার মুখ ফুটে বলেছে তো সেই থেকে তাকে আর নড়ানো গেল না। সর্বজয়া না গেলে এই নৌ-ভ্রমণের কোনো অর্থও হয় না। আর তাকে রেখে রেণুকা আর দেবেন্দ্রনারায়ণ যাবেনও না। তাছাড়া। দেবেন্দ্রনারায়ণ শেষ বেলায় এসে বিভুঁই’র কথাও ভাবছিলেন। ছেলেটাকে একা রেখে যেতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু তাকে নিয়ে যাওয়াটাও দৃষ্টিকটু ব্যাপার। শেষ অবধি নৌ-ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে গেল। রতনকান্তি এই নিয়ে আর কথা বলল না। সে তার মতো চুপচাপ আবার সুদক্ষিণাকে পড়াতে লাগল। বাদবাকি সময় বিভুঁই’র সাথে গল্প করেই তার কেটে যায়।
.
শীত যেন খুবই স্বল্পস্থায়ী হলো সেবার। শেষের দিকে কিছুদিন আঁকিয়ে পড়ল। সেই শীতে আচমকা বৃষ্টিও হলো। তারপর আচমকা উধাও হয়ে গেল। অবাক করা ব্যাপার হলো গঙ্গাবতীর জল বেড়ে গেল। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। এই সময়ে আর সকল বছরে গঙ্গাবতীর জল থাকে কম। এবার সারা বছরজুড়েই যেন তেমন দমল না গঙ্গাবতী। বরং সুযোগ পেলেই ফুলে ফেঁপে উঠতে চাইল।
এর মাঝে দেবেন্দ্রনারায়ণের কথামতো রতনকান্তি একবার বারোহাটির বাগানবাড়ির খোঁজ-খবরও নিয়ে এসেছে। সে সময় পাঁচিলের পাশের সেই গর্তও দেখে এসেছে। রতনকান্তির ধারণা ছিল, লোকটা আবার গর্ত খোঁড়া শুরু করেছে। অবাক ব্যাপার হলো সেই লোক আর আসেনি। যা যেমন ছিল তেমনই পড়ে রয়েছে। আজকাল রতনকান্তির বুকের ভেতরের সেই বাউণ্ডুলেপনা যেন। আবার উঁকি দিতে শুরু করেছে। সে জানে না, কিসের টানে এই এতদিন সে গঙ্গামহলে এমন আটকে রইল। কখনো তো এমন হয় না তার!
গত কিছুদিন থেকে আবার সেই গৃহবিমুখ রতনকান্তি যেন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। সর্বজয়ার সাথে তার দেখা হয় কালে-ভদ্রে। তবে কথা হয় না। সর্বজয়া যতটা পারে তাকে এড়িয়ে চলে। বিষয়টা নিয়ে রতনকান্তির বুকের ভেতর প্রায়ই অচেনা অজানা এক অনুভূতি হয়। অবশ্য সেই অনুভূতি জানার বা বোঝার চেষ্টাও রতনকান্তি করেনি কখনো। ইচ্ছে করে যে করেনি তা নয়। আসলে বুঝতে ভয় পাচ্ছিল রতনকান্তি। কিন্তু কিসের ভয়? রতনকান্তির মনে হলো কিসের ভয়, সেটিও সে জানতে চায় না।
.
বসন্ত এসে গেছে। মন কেমন করা এক অদ্ভুত স্পর্শ ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। গঙ্গামহলের পেছনের দিকের পাঁচিল ঘেঁষে মস্ত এক শিমুল বৃক্ষ। সেই বৃক্ষজুড়ে শিমুল ফুল ফুটেছে। সেদিকে তাকালেই বুকের ভেতর কেমন হু হু করে ওঠে। আজ বিকেলে বসন্তের ফুরফুরে উতলা হাওয়ায় সেই শিমুল বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে রতনকান্তির হঠাৎ মনে হলো সে মায়ায় আটকে গেছে। এই যে খানিক আগে বুকের ভেতর হু হু করে উঠল তা যেন সেই মায়ারই স্পর্শ। এই মায়াই তাকে এই গঙ্গামহলে স্থির করে রেখেছে। কিন্তু এই মায়া তাকে কাটাতে হবে। সে মায়ায় আটকে থাকার জন্য এই এতটা বছর পথে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে জীবন দেখেনি। মানুষ দেখেনি। সে জগতে এসেছে জগত দেখবার জন্য। মানুষ দেখবার জন্য। সেই মুহূর্তে রতনকান্তি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, সে আবার পথে নামবে। তার এই স্থিরজীবন হবে শেকড়হীন এক চলমান জীবন। সেই রাতেই রতনকান্তি তার ছোট্ট ঝোলাখানি গোছালো। খুব সামান্য জিনিসপত্র। তার। বেশি কিছু নেই। সে সকল গুছিয়ে সে বিকেলে সুদক্ষিণাকে গান শেখাতে গেল। ছাদের ঘরে গিয়ে রতনকান্তির সারা শীরের কাঁটা দিয়ে উঠল!
ঘরের ভেতর সর্বজয়া বসে আছে। সর্বজয়া যেমন থাকে, তেমনই সাধাসিধে চেহারায় নির্বিকার বসে রয়েছে। তবে তার অগোছালো ভাবটা একদম নেই। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল খোঁপা করা। কপালে বড় একখানা টিপ। দূর থেকেও রতনকান্তির ঘ্রাণেন্দ্রীয় ডুবে গেল এক মোহময় সুবাসে। সর্বজয়ার শরীর থেকে কী এক অদ্ভুত সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। সেই সুবাস রতনকান্তির মতোন মোহহীন হতে চাওয়া মানুষটিকেও মুহূর্তের জন্য মোহগ্রস্ত করে ফেলল।
সর্বজয়া সোজা রতনকান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। সর্বজয়ার সেই চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা রতনকান্তির নেই। তার বুকের ভেতর ওলট-পালট ঝড়ের মাতম শুরু হয়েছে। এই ঝড় থেকে সে মুক্তি চায়। এই ঝড়ে একবার পড়ে গেলে যে আর পরিত্রাণ নেই, দুমড়ে-মুচড়ে যে একাকার হয়ে যেতে হবে, তা যেন রতনকান্তি জানে। রতনকান্তি চকিতে চোখ নামিয়ে পায়ের দিকে তাকাল। তারপর ঘুরে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।
সর্বজয়া পেছন থেকে স্পষ্ট ও গম্ভীর গলায় বলল, আমায় গান শেখাবেন না?
রতনকান্তি থমকে দাঁড়াল। সর্বজয়া বলল, আপনাকে তো আমায় গান শেখাতেই আনা হয়েছিল।
রতনকান্তি কোনো কথা বলল না। তার মনে হচ্ছিল সর্বজয়া যা-ই বলুক, তার কোনো কিছুর জবাবই তার জানা নেই। সে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে না। কেবল উৎকর্ণ হয়ে শুনতে পারবে। কেবল সুবাসে ডুবে যেতে পারবে। কিন্তু সে জানে এ বড় ভয়ানক চোরাবালি। বড় ভয়ানক শিকারি ছায়া। এ কেবল প্রতি মুহূর্তে বুকের ভেতর অবশ করে দেয়।
সর্বজয়া আবার বলল, সুদক্ষিণার কাল রাত থেকে জ্বর। ওর আসার মতোন অবস্থা নেই। তাই আমি এলাম।
সর্বজয়ার কণ্ঠ গভীর, শান্ত, স্বচ্ছ জলের মতোন। শুধু তাই-ই নয়। কী বড়ই না লাগছে তাকে! যেন পরিপূর্ণ ঋদ্ধ এক নারী। এমন সর্বজয়াকে কখনো দেখেনি রতনকান্তি।
রতনকান্তি মৃদু গলায় বলল, আপনি গান শিখবেন?
সর্বজয়া সাথে সাথেই বলল, জানি না।
রতনকান্তি এবার দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল। এই মুহূর্তখানিক আগেই সর্বজয়া তাকে বলেছে যে সে গান শিখবে। কিন্তু এখন আবার বলছে শিখবে কিনা তা সে জানে না। আসলে কি চাইছে সে? এই অসময়ে সে এখানে এসে বসে আছে কেন? তার আচরণ, কথা বলার ধরন কোনোভাবেই তার সাথে যাচ্ছে না। এই কিছুদিন আগের নির্বাক সর্বজয়া যেমন অপরিচিত ছিল রতনকান্তির কাছে, অপরিচিত এই গভীর, স্থির এবং মুহূর্তেই আবার রহস্যময়ী হয়ে ওঠা সর্বজয়াও। রতনকান্তির মনের কোণে সূক্ষ্ম দ্বিধার কম্পন, সর্বজয়া সুস্থ তো! দ্বিধাগ্রস্ত রতনকান্তি আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। তবে সর্বজয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর দরজার কাছে দাঁড়ানো রতনকান্তির প্রায় বুক ঘেঁষে বেরিয়ে এলো বাইরে। রতনকান্তির বুকের কাছটা কি আলতো ছুঁয়ে গেল সর্বজয়া? রতনকান্তি জানে না। তবে তার মনে হলো কোনো এক সুতীব্র অথচ অবর্ণনীয় অনুভূতি মুহূর্তের জন্য তার হৃদস্পন্দন থামিয়ে দিয়েছিল। বুকের কাছটায় তখনও লেগে রয়েছে পাখির পালকের মতোন কেমন আলতো উষ্ণ এক স্পর্শ!
সর্বজয়া হেঁটে ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। রতনকান্তি দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। দু’জনই চুপচাপ, নিঃশব্দ। কতটা সময় এভাবে কেটে গেল কেউ জানে না। রতনকান্তি যেন হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল। সে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে সিঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। পেছন থেকে সর্বজয়া ডাকল, আচ্ছা, আমি যদি সত্যি সত্যি গান শিখতে চাই, আপনি আমায় শেখাবেন?
রতনকান্তি সাথে সাথে জবাব দিলো না। আবারও থমকে দাঁড়াল। সর্বজয়া বলল, জগতে মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর কি কিছু আছে?
রতনকান্তি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো। তাকে স্বাভাবিক হতে হবে। সর্বজয়ার সামনে এমন ওলট-পালট হয়ে যাবার কিছু নেই। সে নেহাত বাচ্চা একটা মেয়ে। রতনকান্তি খানিক ধাতস্ত হয়ে বলল, মৃত্যু কি ভয়ংকর?
সর্বজয়া ঘুরে তাকাল, মৃত্যু ভয়ংকর নয়?
রতনকান্তি বলল, মৃত্যু ভয়ংকর কেন হবে?
সর্বজয়া খানিক থমকে দাঁড়াল। তারপর বলল, মৃত্যু ভয়ংকর কারণ মৃত্যু যন্ত্রণাময়।
রতনকান্তি বলল, তা যন্ত্রণাময় সকল কিছুই তো ভয়ংকর। কেবল মৃত্যুই কেন?
সর্বজয়া বলল, সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাময় বলে হয়তো?
রতনকান্তি বলল, মানুষ কী করে জানল যে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাময়! সে কি মরে গিয়ে আবার মৃত্যুযন্ত্রণার স্মৃতি সাথে করে ফিরে আসতে পারে?
সর্বজয়া কথা বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হেঁটে রতনকান্তির কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, তাহলে মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় কেন? সবচেয়ে বেশি ভয়?।
রতনকান্তি বলল, মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না। মানুষ ভয় পায় শূন্যতাকে। আর ভয় পায় মায়াকে। মানুষ এক প্রবল মায়ার জগতে বাস করে, সে সেই মায়া ছিন্ন করতে ভয় পায়। মৃত্যু এক প্রবল শূন্যতা। মানুষ জানে না মৃত্যুর পরে কী আছে! সে বিশ্বাস করে অনেক কিছুই, কিন্তু সেই বিশ্বাস নিয়েও তার ভেতর নানা সংশয় থাকে। বিশ্বাস হচ্ছে এমন কিছু, যা চোখে দেখা যায় না। এই যে আমার এই হাত, এই যে চোখ, এই যে কান। এ সকল বিশ্বাস করার দরকার নেই। কারণ এ সকল আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি। এ আছেই। আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে এর কিছু আসে যায় না। এ সকল বাস্তব। কিন্তু যা আমি চোখে দেখতে পাই না, স্পর্শ করতে পারি না ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার অস্তিত্ব মেনে নেয়া হচ্ছে বিশ্বাস। মৃত্যুর পরের অবস্থাও সেই বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। মানুষ দেখেনি, জানে না, কিন্তু সে বিশ্বাস করে। আর সেই বিশ্বাসজুড়ে থাকে। নানান সংশয়। ফলে তাদের শূন্যতা তৈরি হয়। প্রবল শূন্যতা। অনিশ্চিত এক জগতের ভয়, যাকে সে দেখেনি। সেই অনিশ্চিত জগত নিয়েই তার ভয়। চেনা পরিচিত মায়ার এই নিত্যকার জগত থেকে প্রবল শূন্যতার, অনিশ্চয়তার এক জগতের ভয়।
সর্বজয়া বলল, তার মানে মানুষ মৃত্যুকে নয়, ভয় পায়ে অনিশ্চয়তাকে, শূন্যতাকে?
রতনকান্তি বলল, এ আমার ভাবনা। অন্য কারো ভাবনা হয়তো অন্যরকম।
সর্বজয়া বলল, আপনি মৃত্যুকে ভয় পান না?
রতনকান্তি বলল, কেন পাবো না? মৃত্যুকে সকলেই ভয় পায়। তবে আমার সবচেয়ে বড় ভয় মৃত্যু নয়।
সর্বজয়া বলল, আপনার সবচেয়ে বড় ভয় কিসের?
রতনকান্তি বলল, মায়া। আমি এই জগতের মায়াকে ভয় পাই। এই মায়াই মানুষকে রোজ রোজ প্রবল জাগতিক করে তোলে। আর সেই সকল জাগতিক মানুষ তখন মৃত্যুকে ভয় পায়। আর মৃত্যু যেহেতু অনিবার্য, সেহেতু মানুষকে এই মায়া কাটাতে হবে। সংসারের মায়া।
সর্বজয়া বলল, মায়া কাটিয়ে ফেললে জগতে আর কী রইল?
রতনকান্তি সাথে সাথে জবাব দিলো না। চুপ করে রইল। তারপর বলল, মায়া যেন মোহ না হয়।
সর্বজয়া বলল, দুটোই কি এক নয়? মায়া মানেই তো বিভ্রম। মোহই কি তাই নয়? এই জগতটাই তো মোহ-মায়ার।
রতনকান্তি গভীর বিস্ময় নিয়ে সর্বজয়ার মুখের দিকে তাকাল। সর্বজয়ার গভীর কাজল কালো চোখের ভেতর এ কিসের ছায়া? তার? তার নিজের? কিন্তু সেই ছায়াজুড়ে কি মায়াও?
সর্বজয়া গভীর জল ছলছল চোখে রতনকান্তির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল, আপনি আমায় ভয় পান?
রতনকান্তি জানে না তার কী হয়েছে। তবে সেও কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল, হ্যাঁ, পাই।
সর্বজয়া বলল, কেন? আমি কি আপনার মায়া? না মৃত্যু?
এই কথায় রতনকান্তির সমগ্র শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। সর্বজয়া তার মায়া, না মৃত্যু? সে আসলে কি ভয় পায়, মৃত্যু? না মায়া? নাকি তার মায়াই তার মৃত্যু?
সর্বজয়া বলল, কে বেশি বড়, মায়া না মৃত্যু?
রতনকান্তি বলল, মায়া।
সর্বজয়া বলল, মৃত্যুর চেয়েও?
রতনকান্তি বলল, মায়া আছে বলেই মৃত্যু এমন কঠিন, এমন সত্য। জগজুড়ে এই এত এত মায়া না থাকলে মৃত্যুর কোনো মূল্যই থাকত না।
সর্বজয়া বলল, তাহলে আমি আপনার কাছে মৃত্যুর চেয়েও বড় সত্য? রতনকান্তি বলল, মায়া তো বিভ্রম। কিন্তু মৃত্যু তা নয়।
সর্বজয়া বলল, কিন্তু আমরা যখন বিভ্রমে থাকি, তখন কি বুঝতে পারি এ বিভ্রম? বুঝতে পারলে সেই বিভ্রম কাটিয়ে ওঠার কথা।
রতনকান্তি বলল, জেনে শুনেও মানুষ সকল বিভ্রম কাটাতে পারে না। কাটাতে চায় না। কিছু কিছু বিভ্রমে মানুষ ইচ্ছে করে ডুবে থাকতে চায়।
সর্বজয়া বলল, সে ওই মায়ার কারণেই। জগতে মায়ার চেয়ে সত্য কিছু নেই। তার মানে জগৎ মানেই মায়া। জগৎ মানেই বিভ্রম। আর কী অদ্ভুত, এই জগতে একমাত্র বিভ্রমই সত্য। অথচ আমরা কেবল হন্যে হয়ে সত্য খুঁজে বেড়াই। সত্য সে তো বিভ্রমেই বিরাজ করে।
রতনকান্তি কথা বলল না। সে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। সেই অন্ধকারে সর্বজয়া রতনকান্তির বুকের কাছে সরে এলো। আরো কাছে। যেখানে নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। যেখানে বুকের স্পন্দন টের পাওয়া যায়। তারপর গভীর তপ্ত নিঃশ্বাসে রতনকান্তিকে ছুঁয়ে দিয়ে সর্বজয়া ফিসফিস করে বলল, এই জগত বিভ্রমের জগৎ। এখানে বিভ্রমের চেয়ে সত্য কিছু নেই। এই বিভ্রমজুড়ে কেবল যন্ত্রণা। এই মায়াজুড়ে কেবল কষ্ট। আর এই সকল বিভ্রম, মায়ার শেষ হচ্ছে মৃত্যু।
রতনকান্তি কী বলবে! সে প্রবল সঙ্কোচে চোখ তুলে সর্বজয়ার চোখে চাইল। সর্বজয়া কাঁপছে। তার চোখভর্তি থইথই জল। সেই জল ছুঁয়ে দেয়ার সাহস রতনকান্তির নেই। কিন্তু সে ছুঁয়ে দিলো। সে তার আঙুল বাড়িয়ে সর্বজয়ার জল থৈথৈ চোখের কোল ছুঁয়ে দিলো। তার আঙুলের ডগা মুহূর্তেই নদী করে দিলো গাল। সর্বজয়া কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। রতনকান্তি হাতে বাড়িয়ে সর্বজয়াকে ধরল। সর্বজয়া যেন শেকড়সহ উপড়ে পড়া এক বৃক্ষ। রতনকান্তির বুকের ভেতর সে তার সকল নিয়ে ডুবে গেল। রতনকান্তির কী হলো কে জানে, সে দু’হাতে শক্ত করে সর্বজয়াকে তার বুকের সাথে চেপে ধরল। ডুবে গেল সেই মোহময় সুবাসে। ডুবে গেল মায়ায়। জগতের সবচেয়ে বড় মায়ায়। রতনকান্তি জানে, এই মায়ার নাম বিভ্রম। সে সেই বিভ্রমে ডুবে গেল। সকলেই ডুবে যায়। জেনে-শুনেও এই বিভ্রমে ডুবে থাকে মানুষ।
মানুষের জন্মই বিভ্রমকে মায়া ভেবে ডুবে থাকার জন্য।