জুডিথ খোলা আকাশ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। দীর্ঘদিন যাবত সে এরূপ নোংরা কর্দমাক্ত জায়গায় আটকে আছে। সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করে না। মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে না সে।
তারা মোট দশ জন এই ভ্রমণে অংশ নিয়েছে : পেরেরিয়া নামে পেলিকান এর সেই পর্তুগীজ, আর তার সাথে আছে তিনজন পর্তুগীজ নাবিক যাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে বন্দুক আর একটা করে চাবুক রয়েছে; দুজন আফ্রিকান নাবিক যাদেরকে দারোয়ান-এর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে; জুডিথ আর অ্যান; সবশেষে রয়েছে মুখোশ পরা সেই লোকটা এবং তাকে সেবা প্রদানকারী দাস। জুডিথ কিছুতেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না যে, কেন এই লোকটা এরূপ মুখোশ পরেছে। কেন এইরকম অদ্ভুত কদাকার মুখোশের ভেতর চেহারাকে বন্দি করে তালা লাগানো হয়েছে। তবে জুডিথ নিশ্চিত যে লোকটি ইচ্ছে করে এরূপ মুখোশ পরেনি। কোনো কিছুর শাস্তিস্বরূপ তাকে এটা পরানো হয়েছে। এমনকি তার একহাতে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করার মতো শক্তি থাকার পরও খাবার এবং পানির জন্য সে দাসের ওপর নির্ভরশীল।
একদিন সন্ধ্যায় জুডিথ তার অন্ধকার জগতে কোনরকমে একটু আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছিল। হালকা ধোয়ার মধ্যে সময় কাটাচ্ছিল সে। এমন সময় বুজার্ড আসলে সে বুজার্ডকে জিজ্ঞেস করে যে কেন সে তার এই মুখোশ খুলে ফেলে নি, “অসহ্য গরম পড়েছে। এই গরমে এটা পরে থাকা অসম্ভব। এ অবস্থায় তুমি কীভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছ?”
“ওহ। আমি যদি এটা খুলে ফেলি তখন কী হবে? আমি হয়ত এটা দিয়ে কাউকে ভয় দেখাতে পারি। কিন্তু এটা ছাড়া আমি চেহারাবিহীন এক পঙ্গু ছাড়া আর কিছুই নই।”
“তোমার জন্য বেশ আফসোস হচ্ছে,” জুডিথ তার কণ্ঠে কোনোরকম অনুভূতি না ফুটিয়ে তুলেই কথাটা বলল।
বুজার্ড সামনে ঝুঁকে জুডিথ-এর কথার উত্তর দিল। আমার জন্য আফসোস করা বাদ দিন। আপনার আফসোেস আপনার নিজের জন্য যত্ন করে রেখে দিন।
.
তারা পেলিকান থেকে ছোট্ট একটা পানসিতে করে যাত্রা শুরু করে। সাগর এবং ভূমির মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট ছোট উপনদী দিয়ে তারা অগ্রসর হতে থাকে। স্থলপথের চেয়ে জলপথের আঁকাবাঁকা রাস্তায় পথ চিনে নেয়াটা মানুষের জন্য আরও বেশি দুর্বোধ্য। কিন্তু বুজার্ড এবং সোনালি দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ পেরেরিয়া সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে সঠিকপথে নৌকো চালানোর। তারা ম্যানগ্রোভ গাছের ডাল ভেঙে পথের চিহ্নস্বরূপ সেগুলোকে নদীর পাশে পুঁতে রেখে যাচ্ছে যাতে ফেরার সময় তারা যেন পথ ভুলে অন্য কোনো উপনদীতে প্রবেশ না করে। মাঝে মাঝে তারা তর্কে লিপ্ত হচ্ছে যে তাদের কোনপথে যাওয়া উচিত। আর অন্য সময় তারা যেকোনো একটা পথের ব্যাপারে একমত হয়ে লোকজনকে সেই পথে নৌকো চালাতে নির্দেশ দিচ্ছে।
যেখানে পানির গতি কমে গিয়েছে সেখানে তারা কিছু বিশাল আকারের জলহস্তী ভেসে থাকতে দেখে। বুজার্ড তার নাবিকদেরকে অস্ত্র হাতে নিতে বলে এবং জন্তুগুলোকে এড়িয়ে যেতে বলে। জুডিথ জলজ এসব প্রাণীকে খুব ভালভাবেই চিনত। দক্ষিণ ইথিওপিয়ায় যাত্রার পথে সে এগুলোকে প্রায়ই দেখতে পেত। অ্যান এগুলোকে প্রথম বারের মতো দেখছে। সে বুঝতে পারছে না যে মুখোশ পরা লোকটা হঠাৎ করে এত সতর্ক হয়ে উঠেছে কেন আর আফ্রিকান লোকগুলোও এই প্রাণীগুলোকে এত বেশি ভয় পাচ্ছে কেন।
“ওগুলোরে দিকে তাকিয়ে দেখুন,” অ্যান মুখ চেপে হাসতে হাসতে বলে। “ওগুলো ওখানে শুয়ে শুয়ে মাথাটাকে একবার ভাসাচ্ছে একবার ডুবাচ্ছে। এদের অর্ধেকটা পানির নিচে আর অর্ধেকটা পানির উপরে। চোখ আর নাকগুলো যেন একটু পর পর পানির নিচ থেকে উঁকি মেরে ভেসে উঠছে। ওদের কান নাড়ানোর ভঙ্গিটাও দেখতে বেশ মজার। দেখুন ওদের একটার মাথায় পাখি বসে আছে।”
“ওরা যদি একবার আক্রমণ করে তবে তোমার সব হাসি বন্ধ হয়ে যাবে।” জুডিথ বলতে থাকে। “একটা রাগান্বিত ষাড় কিংবা একটা গরু যদি আক্রমণ করে তাহলে হয়ত তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ভূমির ওপর অনেক লোক ওদেরকে চষে বেড়ায়। কিন্তু এগুলোর একটা যদি একবার আক্রমণ করে তবে তোমাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারবে।”
ঠিক তখনই একটা জলহস্তী বিশাল এক হাই তুলে তার বাঁকা দাঁতগুলো দেখিয়ে দিল। অ্যান-এর মুখ থেকে সমস্ত হাসি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সাথে সাথে।
কিন্তু তারপরও ওদের জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা বিশাল আকারের পশুগুলোর কাছ থেকে আসেনি, বরং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা-মাকড়ের কাছ থেকে এসেছিল। বিশেষ করে রাতের বেলা বন্য পোকামাকড়ের কামড়ে শরীরের খোলা অংশ লাল হয়ে যাচ্ছিল। যে করেই হোক সমস্ত শরীর কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে হচ্ছিল সবাইকে।
অন্তত স্বস্তির ব্যাপার এই যে ওদের খাবারের কোনো কমতি পড়েনি। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, ঝিনুক এবং কাঁকড়ার কোনো অভাব ছিল না আশেপাশে। পাখি শিকারীরা কিছু সামুদ্রিক পাখি শিকার করে নিয়ে আসে। সেই সাথে বন্য মধু। জুডিথ আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে কিছু সবুজ রঙের জলপাই পাতা জোগাড় করে নিয়ে এলো। পেটের পীড়া কমানোর জন্য এগুলোর মিশ্রণ সে পান করবে। কিছু অপরিপক্ক ঔষধি ফলও জোগাড় করল সে; এগুলোর রস সে পোকামাকড়ের কামড়ের ওপর লাগাবে।
নদীর মোহনায় দ্বিতীয় দিন কাটানোর সময় একজন নাবিক একটা অদ্ভুত প্রাণী হত্যা করে নিয়ে আসে, যেটার লেজ এবং ভদ্র চেহারা দেখতে অনেকটা ডলফিনের মতো। আবার প্রাণীটি দেখতে অনেকটা কুকুরের মতোও বটে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন মুখটা বাঁকা হয়ে হাসি ফুটে আছে। “এটার নাম হচ্ছে ডুগং,” বুজার্ড এতই সামাজিকভাবে কথাটা বলল যেটা ঠিক ওর চরিত্রের সাথে। যাচ্ছিল না। এরা ঘাস খায়। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে এটার মাংস তোমরা বেশ উপভোগ করবে।
অদ্ভুত প্রাণীটাকে টেনে আনতে তাদের পাঁচজন লোক প্রয়োজন হয়। তারা এটার চামড়া ছাড়িয়ে মাংসে লবণ মাখিয়ে রাখে। পরবর্তী কয়েক দিনের জন্য তাদের নিশ্চিত খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। বুজার্ড-এর কথা সত্য প্রমাণ করে সবাই প্রাণীটার মাংস বেশ উপভোগ করল। অনেকে তর্ক করতে থাকল। তর্কের বিষয় : ওটার স্বাদ কী গরুর মাংসের মতো নাকি শূকরের মাংসের মতো।
সময়ের সাথে সাথে ডুগং-এর মাংসের শেষ অংশটুকুও শেষ হয়ে যায়। এক সময় তারা নৌকো ছেড়ে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে যাত্রা শুরু করল। নদীর নাব্যতা এতটাই কমে এসেছে যে নৌকোকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই তাদেরকে পায়ে হেঁটে পথ চলতে হচ্ছে। নোংরা কর্দমাক্ত পথে অনেক সময় তাদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছিল। এক সময় তারা একটু জায়গা পেয়ে গাছের ডালপালা জোগাড় করে আগুন জ্বালাল, এরপর সেই আগুনে মাছ পুড়িয়ে তাদের খাবার জোগাড় করল।
সাদা রঙের বানর তাদের আশেপাশে গাছের ওপর কিচিরমিচির করতে থাকে। সাপ এবং অন্যান্য সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী ফোঁস-ফাস শব্দ করতে করতে তাদের পথ ধরে চলে যাচ্ছে। সারারাত ধরে এখানে সেখানে বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর পতপত আওয়াজ পাওয়া যায়। দিনের আলোতে উজ্জ্বল রঙের মাছরাঙা পাখি দেখা যায়।
কিন্তু দিনের পর দিন চলে গেলেও কেউই বুঝতে পারে না যে বুজার্ড তাদেরকে আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কিংবা বুজার্ডের আসল উদ্দেশ্যে কি। জুডিথ শুধু এটুকুই জানে যে সে যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই হাল-এর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এই কর্দমাক্ত পথ দিয়ে যেতে যেতে কিছু একটা খুঁজে পেল সে। একজন পর্তুগীজ নাবিক গাছের ডাল কেটে কেটে তলোয়ার দিয়ে তীক্ষ্ণ করে মাছ ধরার যন্ত্র বানাচ্ছিল। একটা ভাল যখন সে বেশি তীক্ষ্ণ করে ফেলেছিল তখন সেটার মাথাটা ভেঙে যায়। সেই ডাল ফেলে দিয়ে নাবিকটি তখন আরেকটা ডাল খুঁজতে চলে গিয়েছিল। জুডিথ তখন সেই তীক্ষ্ণ ডালটা নিজের কাছে রেখে দেয়।
এটাকে যদিও অস্ত্র বলা যায় না। এটা তাকে বুজার্ডের তলোয়ার থেকে বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু তারপরও…তার হাতে অন্তত একটা কিছু তো রইলো যেটা থেকে ক্ষীণ আশা জাগতে পারে।
.
মাদ্রি দি ডিয়াস কোয়েলিম্যান-এর বন্দরে এসে নোঙর ফেলল। দাসেরা সবাই ভয় আর অনিশ্চয়তা নিয়ে ডেক-এর ওপর অপেক্ষা করতে থাকে। তাদেরকে বণিকদের নিজস্ব নৌকোয় করে উপকূলে নিয়ে যাওয়া হলো না বরং আলাদা একটা নৌকোয় একসাথে বারজন করে নিয়ে যাওয়া হলো।
হাল সাগরের কোমল শান্ত পানির দিকে তাকিয়ে আছে এখন। সে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে : যদি একবার সে সুযোগ পায় তবে বারোস-এর শরীর থেকে হাড়-মাংস আলাদা করে ফেলবে।
তারা যখন উপকূলে পৌঁছাল তখন হাল এবং অন্যান্য দাসকে লাইন করে দাঁড়ানোর জন্য বলা হলো। তাদের প্রত্যেকের হাতে এবং গলায় শেকল দিয়ে বাঁধা আছে। সেই শেকলগুলো আবার আরেকটা শেকল দিয়ে সংযুক্ত, একজনের গলায় বাঁধা শেকল থেকে আরেকটা শেকল বেরিয়ে পেছনের জনের হাতের শেকল-এর সাথে সংযুক্ত হয়ে আছে। শুধু মাঝের দুজন এভাবে সংযুক্ত নয়। তাদের দুজনের মাঝে একটা কাঠের ভারী খণ্ড লাগানো আছে। সেই খণ্ড থেকে আবার একটা জোয়াল দুজনের কাঁধে এমনভাবে লাগানো আছে যেন তারা একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলতে বাধ্য হয়।
প্রথম নৌকোতে চড়েই বারোস উপকূলে পৌঁছে যায়। দাসদের সারির দিকে তাকিয়ে সে হ্যাট মাথায় একজন লোকের সাথে কথা বলতে থাকে। হ্যাট মাথায় লোকটাকে দেখে হাল-এর কন্সাল গ্রে-এর কথা মনে পড়ে যায়।
“তাকিয়ে দেখুন, সেনোর কাপেলো,” বারোস তাকে বলতে থাকে। জাঞ্জিবার-এর বাজার থেকে আমরা খাঁটি জিনিসই কিনেছি। আমার মনে হয় সেনোর লোবো এদের কাজের গতি এবং শক্তি দেখে বেশ সন্তুষ্ট হবে।
“এদের মধ্যে একজন সাদা, কাপেলো হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। সাদারা বেশিদিন টেকে না।”
“ওকে নিয়ে আপনার চিন্তার কোনো কারণ নেই,” বারোস তাকে আশ্বস্ত করে। “ওটা বেশ খাঁটি জিনিস। ষাড়ের মতোই শক্তিশালী।”
কাপেলো অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায় কিন্তু বারোস-এর কথা কিছুটা মেনেও নেয়। সে মিউল-এর ওপর থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং হাল-এর দিকে এগিয়ে যায়। এরপর ভালভাবে হালকে পরীক্ষা করে দেখে। হাল-এর ঊরু, বাইসেপস, চোখ, জিহ্বা সব ভালভাবে পরীক্ষা করে দেখে। “আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার কথায় আমি একে নিচ্ছি।” কাপেলো বলতে থাকে। কিন্তু সে যদি ঠিকমতো কাজ করতে না পারে তবে আমি একে ফিরিয়ে দেব এবং তুমি আমাকে এর বদলে অন্য একজন কালো দাস দেবে। কিন্তু তখন তোমাকে কোনো পয়সা দেয়া হবে না।”
“অবশ্যই, অবশ্যই। বারোস বলতে থাকে। কিন্তু এখন কী আপনি একে নিতে চান?”
“অবশ্যই,” কাপেলো তার মিউলটার দিকে এগিয়ে যায়, এরপর মিউল এর পিঠের বস্তা থেকে একটা থলে বের করে নিয়ে আসে। সেই থলে ভর্তি পয়সা ঝনঝন করতে থাকে। যা বলা হয়েছিল তার সবটুকুই এটাতে আছে। তুমি চাইলে গুনে নিতে পার”।
“কোনো প্রয়োজন নেই,” বারোস একটা হাসি দিয়ে বলল। “আমি জানি আপনি কিংবা মাননীয় লোবো কখনোই আমার সাথে বেইমানি করবেন না। তাহলে আমি এখন আপনাকে বিদায় জানাচ্ছি। খনির দিকে আপনার যাত্রা শুভ হোক সেই প্রত্যাশা রইল।”
বারোস সরে আসে। কাঁপোলো তার মিউল-এর ওপর চড়ে বসে। এরপর গার্ডদেরকে নির্দেশনা দেয়। এর কিছুক্ষণ পরেই হাল তার পিঠে সেই পরিচিত চাবুকের আঘাত অনুভব করে। সে বুঝতে পারে তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আদেশ দেয়া হচ্ছে। এরপর দাসদের লাইন আফ্রিকার বুকের ওপর দিয়ে যাত্রা শুরু করে দেয়।
শেকল দিয়ে বাঁধা একসারি মানুষকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেও একটু সময় লাগে। তাড়াহুড়ার কারণে অনেকে পড়ে যেতে থাকে। সেই সাথে আরেকজনের হাতেও টান পড়তে থাকে। গার্ডরা যদিও আফ্রিকান কিন্তু তারা স্বজাতির প্রতি কোনো মায়া-মমতা দেখাচ্ছে না। যাদের নড়াচড়া কিংবা হাঁটা তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না, তাদের পিঠেই চাবুক দিয়ে আঘাত করছে লোকগুলো।
*
জুডিথ-এর সমস্ত শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে। তার শরীরের প্রতিটা মাংসপেশি ব্যথায় টনটন করছে। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসছে। মাথাটাকে তার পাথরের মতো ভারী মনে হচ্ছে। সে অন্যান্য দাসের সাথে একটু দূরত্ব রেখে এগিয়ে যাচ্ছে।
উপকলের কাদামাটি এবং জলাভূমির অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে শুষ্ক পথের দেখা পাওয়া গিয়েছে। দীর্ঘসময় পানিতে এবং নরম কাদামাটিতে থাকার ফলে জুডিথের পাদুটো পানিতে ভেজানো পাউরুটির মতো নরম হয়ে গিয়েছে। তাই সে যখন প্রথম শুষ্ক মাটিতে পা রাখে তার পায়ে ফোঁসকা পড়ে যায় এবং রক্ত ঝড়তে থাকে। কিন্তু সেগুলো আস্তে আস্তে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। কখনো কখনো সারাটা দিন হাঁটার পর শেষদিকে তার মনে হচ্ছিল যে নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও সে এগিয়ে চলছিল। কারণ যে করেই হোক তার পেটের মূল্যবান সম্পদকে তার বাঁচাতে হবে।
সে সামনে এগিয়ে যায়, পেটের বাচ্চাটা যেন তাকে বলতে থাকে : ওদের কাছে হেরে যেও না। আমরা বিপদ কাটিয়ে উঠব। আমি যদি লড়তে পারি তবে তুমি কেন পারবে না।
অ্যানকেও অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে, যদিও তার নিজের এই করুণ অবস্থা তারপরও সে অ্যানকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। সাহস দেয়ার চেষ্টা করছে। অ্যান যখন হাঁটু ভেঙে পড়ে যেতে শুরু করে তখন তাকে ধরে ফেলল সে। এরপর অ্যান আবার চলতে শুরু করে। অ্যানকে দেখে মনে হচ্ছিল সে শুয়ে পড়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে প্রস্তুত তবুও আর হাঁটতে রাজি নয়।
মুখোশ পরা লোকটা প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর অন্তর সবাইকে আধা ঘন্টা বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ দেয়। অ্যান জুডিথের পেছনে বসে আছে। সে হাঁটুদুটো ভাঁজ করে হাঁটুর ভাঁজে মুখ ঢেকে বসে আছে।
“আজকে রাতে”, জুডিথ তার কাছাকাছি গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আজকে রাতে আমরা কাজটা সম্পন্ন করব।”
আস্তে আস্তে করুণ চেহারা নিয়ে অ্যান তার মুখটা উঠায়। ক্লান্তিতে তার চোখদুটি মিটি মিট করতে থাকে। আপনি কী এবার সত্যি সত্যি বলছেন?”
তারা এর আগেও বহুবার পালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা-ভাবনা করেছে। কিন্তু শুধু আলোচনা করা ছাড়া বেশিদূর এগুতে পারেনি।
“এই আমি সত্যি বলছি। আমরা কাজটা করেই ছাড়ব,” জুডিথ তাকে আশ্বস্ত করল। গলার স্বর বেশি উপরে উঠাল না সে, কারণ পেলিকান-এর নাবিকেরা কিছুদর সামনে বসে পানি খাচ্ছে এবং অশ্লীল গল্পে মগ্ন রয়েছে।
“কীভাবে?” অ্যান-এর চোখ আশার আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
জুডিথ নাবিকদের দিকে একবার নজর দিল এরপর বুজার্ডের দিকে তাকাল যে কিনা এরইমধ্যে তার কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। তলোয়ারটা তার মাথার কাছে বেশ সতর্কভাবে রাখা আছে। মুখোশের কারণে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না যে সে কী জেগে আছে নাকি ঘুমিয়ে গিয়েছে।
এরপর কোনোরকম আগাম বার্তা না দিয়ে হঠাৎ করেই উঠে বসল বুজার্ড। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে জুডিথদের প্রতিটি কথা শুনতে পাচ্ছে। তার ভয়ার্ত এক চোখ দিয়ে সে তাদেরই দিকে তাকিয়ে আছে এটা বেশ বোঝ যাচ্ছে।
“ওর দিকে তাকিও না,” জুডিথ নিচু স্বরে অ্যানকে বলল। সে দেখতে পায় অ্যান কাঁপছে। জুডিথ মেয়েটার হাত নিজের হাতে তুলে নেয় এবং পেটের ওপর রাখে। “ভান কর যেন আমরা বাচ্চা নিয়ে কথা বলছি, সে বলতে থাকে। অ্যান এখনো মুখোশ পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে আছে। “অ্যান,” জুডিথ আবারো ফিসফিস করে ডাকতে থাকে। মেয়েটি তার মাথা ঘুরিয়ে ঠোঁট শক্ত করে জুডিথ-এর পেটের দিকে তাকাল যেন সে বাচ্চার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে।
আর এদিকে জুডিথ তাকে কীভাবে পালাবে সেই পরিকল্পনার কথা বলতে থাকে।
মধ্যরাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে আছে তখন জুডিথ আর অ্যান তাদের থাকার জায়গা থেকে আস্তে আস্তে বের হয়। খুব সাবধানে পা ফেলে তারা। আগুনের আশেপাশে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা কেউ যেন ঘুম থেকে জেগে না উঠে। রাতে পাহারাদারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল পেরেরিয়া নামের সেই লোকটিকে যে তাদের নৌকোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। লোকটি বেশ সতর্ক পাহারা দিচ্ছে, জুডিথ তার চোখ এড়িয়ে যেতে পারল না।
“অ্যানকে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যেতে হবে,” জুডিথ ব্যাখ্যা করল “সে একা যেতে ভয় পাচ্ছে।”
পেরেরিয়া ক্যাম্পের পাশে একটা ভোলা জায়গা দেখিয়ে বলল, “ওখানে যাও।”
জুডিথ মাথা নেড়ে জবাব দিল, “না, না, মানুষের সামনে নয়।”
পেরেরিয়া খুব দ্রুত তাদের কথার প্রতিক্রিয়া দেখাল। “এখানে থাক, সে তার স্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণে আদেশ করে, এরপর আগুনের দিকে এগিয়ে যায়।
তারা অপেক্ষা করতে থাকে। জুডিথের ভয় হয় পেরেরিয়া হয়ত বুজার্ডকে জাগিয়ে তুলবে। কিন্তু না, স্বস্তির ব্যাপার হচ্ছে পেরেরিয়া তা করে না। বরং সে সামনে এগিয়ে গিয়ে একজন পেলিকান নাবিককে জাগিয়ে তোলে। আগুনের আলোয় জুডিথ লোকটার ঘুমঘুম চেহারা দেখতে পায়। নাবিকটা তখন তার কম্বলটা সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে আস্তে আস্তে জুডিথদের দিকে এগিয়ে আসে।
একহাতে তার বন্দুকটি ধরে অন্যহাতে জুডিথদেরকে ইশারা করে তাকে অনুসরণ করার জন্য।
“তুমি কী কোনোভাবেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবে না?” জুডিথ অ্যানকে জিজ্ঞেস করে। এসব সাজানো কথামালা তাদের পূর্বেই পরিকল্পনা করা।
“না, আমাকে এখনই যেতে হবে।” অ্যান তার কণ্ঠে জোর দিয়ে বলে।
জুডিথ মাথা নাড়ায়। সে অ্যান-এর কাছ থেকে এরকম উত্তরই প্রত্যাশা করছিল।
নাবিকটি তাদেরকে পথ দেখিয়ে জায়গা মতো নিয়ে যায়। ক্যাম্প থেকে প্রায় ত্রিশ গজ দূরে। লম্বা লম্বা আগাছা জন্মে বেশ জঙ্গলের মতো একটা জায়গা হয়েছে। চাঁদের আলোয় পথঘাট বেশ পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পের আগুনের আলো দেখা যাচ্ছে না যদিও কিন্তু আকাশে ধোঁয়া উড়ছে সেটার কিছুটা বোঝা যাচ্ছে।
“ওখানে গেলে চলবে?” নাবিকটি লম্বা লম্বা ঘাস যুক্ত একটা জায়গা দেখিয়ে বলল।
অ্যান লজ্জাবনত হয়ে একবার লোকটির দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার জুডিথ-এর দিকে তাকাচ্ছে। এরপর মাথা নাড়ল এবং বোঝাল, যে লোকটিকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। লোকটিও কোনো বাক্য ব্যয় না করে একটু দূরে সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। অ্যান তার স্কার্ট ভাঁজ করে হাঁটু গেড়ে বসার ভান করল।
ওদিকে নাবিকটিও তার হাতের বন্দুকটা মাটিতে রেখে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বসে গেল।
লোকটির তরল পদার্থ বিসর্জনের শব্দ শুনতে পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জুডিথ অপেক্ষা করে। এরপর সে নিঃশব্দে লোকটির পেছনে চলে যায় এবং তার স্কার্টের নিচে পায়ের সাথে বেঁধে রাখা তীক্ষ্ণ কাঠের ফলাটা আস্তে আস্তে বের করে। লোকটি উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্ব পর্যন্ত জুডিথ চিতাবাঘের মতো অপেক্ষা করতে থাকে। যখনই সে ঘুরে দাঁড়ায় তখনই জুডিথ তার অস্ত্রটা লোকটির গলায় ঢুকিয়ে দেয়। সেই সাথে পা দিয়ে লোকটির পায়ে আঘাত করে। এরপর বাম হাত দিয়ে এমনভাবে গলা প্যাচিয়ে ধরে আঘাত করে যে লোকটি কোনোরকম শব্দ করতে পারে না, শুধু গলা দিয়ে গার্গল করার মতো আওয়াজ বের হয়। আর সেটাও কিছুক্ষণ পর বন্ধ হয়ে যায়।
চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। জুডিথ মৃতদেহটার কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য হাঁপাতে থাকে ও। সে যুদ্ধে বহু মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম ব্যাপার হয়েছে। তার নিজেকে ফিরে পেতে কিছুটা সময় লাগল।
“তাড়াতাড়ি,” সে অ্যান-এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল। “বন্দুকটি নাও।” অ্যান ঘাসের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে মৃত লোকটির অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করে নিল।
জুডিথ লোকটির কোমড় থেকে বেল্ট খুলে নেয়। বেল্ট-এর সাথে আটকানো গুলির বক্স এবং ফ্লাক্স খুলে নিল সে। লোকটির তরবারিটাও নেবে বলে ভাবল, কিন্তু এটা আসলে তাদের জন্য বেশ ভারীই হয়ে যাবে। ভারী কোনো জিনিসই এখন নেয়া যাবে না। বন্দুক এবং গুলিই তাদের জন্য যথেষ্ট।
“পানি,” সে ফিসফিস করে বলে উঠে। অ্যান মাথা নাড়ায়, এরপর পানির ফ্লাস্কটা জুডিথ-এর ঠোঁটের কাছে ধরে। যদিও জুডিথের নিজের ফ্লাস্ক আছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে যুক্তিতর্কে যাওয়ার সময় নয়।
জুডিথ আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সবকিছু একটু বোঝার চেষ্টা করে। আর তারপর দৌড়াতে শুরু করে একযোগে। তারা দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। মুখোশ পরা লোকটা হয়ত ধারণা করবে যে তারা পূর্বদিকে গিয়েছে যেদিক দিয়ে তারা এসেছে। জুডিথ-এর উদ্দেশ্যও পূর্বদিকেই যাওয়া কিন্তু সেটা সে কেবল তখনই করবে যখন একটা নিরাপদ দূরত্ব তৈরি করতে পারবে ওরা।
পালানোর উত্তেজনায় তাদের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে তারা বন্যপ্রাণীর মতো দৌড়াতে থাকে।
*
পানসিটা অ্যাবোলি এবং আরও আটজন অ্যামাডোডা সৈন্যকে কোয়েলিমান-এর উত্তরে একটা বীচ-এ এনে নামিয়ে দেয়। তারা থে তাদের সাথে প্রয়োজনীয় কোনো জিনিসই নিয়ে আসে নি। তারা যে ভূমিতে নেমেছে সেটা হয়ত সাদা লোকদের কাছে বৈরী পরিবেশ হতে পারে। কিন্তু তাদের কাছে এটা বন্ধুসুলভ পরিবেশ। অস্ত্র হিসেবে হয়ত তাদের কাছে কোনো বন্দুক ও গুলি নেই। কিন্তু তাদের কাছে বল্লম, শিল্ড, তীর ধনুক রয়েছে যেগুলোর সাথে তারা ছোট বেলা থেকেই পরিচিত।
ওপাশের পৃথিবী থেকে অ্যাবোলি শুধু একটা জিনিসই নিয়ে এসেছে। একটা লম্বা প্যাচানো রশির মাথায় একটা বাঁকানো লোহা। গোল্ডেন বাউ-এর নাবিক হিসেবে সে এটা শত্রুর জাহাজে ওঠার কাজে ব্যবহার করত। জুডিথ কিংবা হালকে উদ্ধার করার জন্য শত্রুর বিল্ডিং-এ উঠতে হলে হয়ত এটা তার প্রয়োজন পড়বে।
বিগ ডেনিয়েল পানসির লোকদেরকে আদেশ করেছে তারা যেন অ্যামাডোডা সৈন্যদের উপকূলে নামিয়ে দিয়ে আসে। নিজের আবেগের বহিঃপ্রকাশ করা হয়ত ডেনিয়েল-এর স্বভাববিরুদ্ধ, কিন্তু যখন সে দেখতে পায় অ্যামাডোডারা চলে যাচ্ছে তখন সে অ্যাবোলিকে জড়িয়ে ধরে। এরপর পেছনে সরে গিয়ে অ্যাবোলির কাঁধ চাপড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে, “ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। যাও, যেখান থেকে পার আমাদের ক্যাপ্টেন এবং তার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে নিয়ে এসো।”
অ্যাবোলি কিছু বলল না। শুধু মাথাটা এদিক ওদিক নাড়াল। এরপর অ্যামাডোডা সৈন্যরা দৌড়াতে শুরু করে এবং কিছুক্ষণের মধ্যে পাম গাছের আড়ালে হারিয়ে যায়।
*
সেই রাতে পর্তুগীজ নাবিককে হত্যা করার পর জুডিথ এবং অ্যান যেন পাখির মতো উড়ে বেড়িয়েছে। ভয়ে আতংকিত হয়ে নিজেদের এ জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে বেড়িয়েছে। শারীরিক পরিশ্রম তখন তাদের কাছে কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু পরবর্তী দিনটা ছিল আরও কঠিন; সূর্যের তাপ এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল মাটি থেকে ছয় ফিট উঁচুতে সূর্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। খুন করার সেই উত্তেজনা উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। দুর্বলতা এবং ক্লান্তিবোধ তাদেরকে ঘিরে ধরে। কথা বলে শক্তি অপচয় করার মতো সামর্থ্যও যেন তাদের নেই। তারা দুজন দুজনের চিন্তায় মগ্ন থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না জুডিথ বলে যে তাদেরকে এখন বিশ্রাম নিতে হবে।
দ্বিতীয় রাতে তারা একটা খাট গাছের নিচু ডালে জড়োসডো হয়ে বসে ছিল। ঠাণ্ডা বাতাস এবং শীতে কাঁপছিল ওরা। এমন সময় হঠাৎ তারা দূর থেকে কান্নার মতো আওয়াজ শুনতে পায়। কান্নার আওয়াজগুলো তীক্ষ্ণ চিৎকারে গিয়ে শেষ হয়। অ্যান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জুডিথ-এর বাহু খামচে ধরে। তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
“এটা শেয়ালের শব্দ,” জুডিথ অ্যানকে বোঝানোর চেষ্টা করে। প্রাণীটা দেখতে কুকুরের মতো কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না। সে ব্যাখ্যা করে বলতে থাকে। “এরা ইদুর, পাখি এবং ফলমূল খায়। এমনকি পোকামাকড়ও খায়। জুডিথ এটা উল্লেখ করে না যে শেয়াল ছোট ছোট হরিণও খেয়ে ফেলতে পারে। এরপরও অ্যান জুডিথের বাহু খামচে ধরে আছে। যতবার শেয়াল চিৎকার দেয় ততবার তার নখ জুডিথের মাংসের মধ্যে যেন গেঁথে যাচ্ছে।
জুডিথের তীব্র ইচ্ছে হচ্ছিল আগুন জ্বালিয়ে নিজের শরীরকে গরম করতে। তাদের কাছে যে বন্দুক আছে সেটা দিয়েই আগুন জ্বালানো যেতে পারে। কিন্তু গুলির শব্দ কিংবা আগুনের শিখার আলোতে তাদের উপস্থিতি হয়ত কেউ না কেউ টের পেয়ে যাবে। তাই সে কাঁপতে থাকে এবং সূর্য উঠার জন্য প্রার্থনা করতে থাকে।
জুডিথ অ্যান-এর ওপর ভরসা করতে পারছে না যে অ্যান জেগে থাকবে এবং পাহারা দেবে। তার নিজেকেই এ কাজ করতে হবে। তাই সে খাট গাছ থেকে একটু বাকল ছিঁড়ে মুখে নিয়ে চিবাতে থাকে। ইংরেজ মেয়েটি তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে এখন।
“আমি কখনো কোনো মানুষকে গাছ খেতে দেখিনি,” অ্যান মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলে উঠল।
“আমার দেশে এই গাছ হচ্ছে বিখ্যাত,” জুডিথ জবাব দেয়। এমনকি এই গাছ পুরো আফ্রিকা জুড়েই বিখ্যাত। সে গাছের একটা পাতা ছিঁড়ে অ্যান-এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই নাও। এটা মুখে নিয়ে দেখ!”
অ্যান গাছের পাতাটা নেয়। সেটা নাকের কাছে নিয়ে শুঁকে দেখে। এরপর সে এটা মুখে নিয়ে আস্তে আস্তে এমনভাবে চিবাতে থাকে যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই বিষে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। জুডিথ হেসে বলে, “ছাগল যেভাবে জাবর কাটে ঠিক সেভাবেই আমাদের দেশের লোকদের সবসময় খাট গাছের পাতা চিবাতে দেখা যায়।”
“আমি বুঝতে পারছি না কেন”, অ্যান তার ঠোঁটগুলোকে নিচের দিকে বাকিয়ে বলল, “এটার স্বাদও তেমন একটা ভাল মনে হচ্ছে না।”
জুডিথ মাথা নাড়ায়। কিন্তু এটা তোমাকে শক্তি দেবে। তুমি বেশ ভাল অনুভব করবে। একটু অপেক্ষা কর তবেই দেখেতে পাবে।”
তাদেরকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয় না। অ্যান-এর পাতা চিবানো দেখে জুডিথ-এর গ্রামের সেই টিয়া পাখিটার কথা মনে পড়ে যায়, যে টিয়া পাখিটা লম্বা গাছের ওপর বসে বসে পাতা খেত। এরপর যান তার সাহসী স্বামীর গল্প বলে, তার স্বামী তাকে কতটা ভালবাসতো সেই গল্প বলে, তাদের কীভাবে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই গল্প বলে।
এরপর কোনো শিশু যেভাবে বারবার তার ঘুমপাড়ানি রূপকথার গল্প শুনতে চায় অ্যানও জুডিথ-এর কাছে ঠিক সেভাবে হাল-এর গল্প শুনতে চাইলো।
জুডিথ তাদের প্রথম পরিচয়ের গল্প বলল। সে যখন ইথিওপিয়ার ক্রিশ্চিয়ান সৈন্যদের নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল তখন তাদের প্রথম পরিচয় হয়। অ্যান-এর অভিব্যক্তি সব সময়ের মতো অবিশ্বাস্য এবং শ্রদ্ধাভক্তি মিশ্রিত। তার অবিশ্বাসের মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন সে জানতে পারল যে “জুডিথ একসময় হলি গ্রেইল-এর গার্ডিয়ান ছিল।”
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আপনার মতো এক মানবীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে।” অ্যান বলতে থাকে। এছাড়া আমরা দুজন এখানে এভাবে বনের মধ্যে আটকা পড়ে আছি। দুই বোনের মতো পাশাপাশি আছি। যদিও ব্যাপারটা বেশ মজার কারণ আমাদের গায়ের রং আলাদা। নিরাপদ জায়গামত পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত আমরা একসাথে থাকব। ঘটনা যাই ঘটুক না কেন।
“ঘটনা যাই ঘটুক না কেন।” জুডিথ সম্মতি জানায়।
কিছু সময়ের জন্য জুডিথ অ্যানকে কথা বলতে দেয়। যদিও এরপর তাকে আর কোনো পাতা খেতে দেয় না সে। তাহলে হয়ত সে সারারাত কথা বলতেই থাকবে। অ্যান-এর একটু বিশ্রাম প্রয়োজন। জুডিথও একটু ঘুমানোর জন্য চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জানে শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই সে অ্যান-এর চাইতে শক্তিশালী। তারমধ্যে দুটি জীবনশক্তির স্পিরিট কাজ করছে। এক, তার পেটের সন্তান যে কি-না পৃথিবীর আলো দেখার জন্য লড়াই করছে। আর এক তার নিজের জীবন যে কি-না তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করছে।
এখানে শুধু মুখোশ পরা লোকটাই ভয়ের বস্তু নয়। এই জঙ্গলে আরও অনেক জন্তই তাদের জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই জুডিথকে এক চোখ খোলা রেখে হলেও সারারাত জেগে থাকতে হবে।
সূর্যের আলো ফুটে উঠার সাথে সাথেই তারা প্রস্থান করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। রাতের তীব্র ঠাণ্ডা কিছুটা কমতে থাকে। ফ্লাক্স থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অল্প একটু পানি দিয়ে তারা গলাটা ভিজিয়ে নেয়। নিরাপদ খাবার পানি পাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটুকুই হচ্ছে তাদের অবলম্বন। জুডিথ মনে-মনে অ্যান এর ধৈর্য এবং সামর্থ্যের প্রশংসা করল। জুডিথ-এর মতো এই মেয়েটি এতটা কঠিন পরিশ্রম করতে প্রস্তুত নয়। তবে আজকে তাকে দেখে বেশ সতেজ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। তাকে দেখে জুডিথ-এর মনে একটু আশা জাগে যে তারা শেষ পর্যন্ত হয়তো বা উপকূলে পৌঁছাতে পারবে। তারপর তারা কোনো না কোনো জাহাজের দেখা পাবে যেটাতে করে মুখোশ পরা লোকটার কাছ থেকে বহুদূর চলে যেতে পারবে।
“আমরা কোনো না কোনো ইংরেজ ক্যাপ্টেনকে খুঁজে পাব। কিংবা কোম্পানির কোনো জাহাজ, অ্যান বেশ উৎফুল্ল হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে। সে তার পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। তার জুতোজোড়াও যেন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছে। বাম পায়ের একটা আঙুল বের হয়ে রক্তাক্ত হয়ে আছে। আমি তাকে আমাদের গল্প বলব। সে নিশ্চয়ই আমাদের কলকাতা পৌঁছে দেবে কিংবা সরাসরি ইংল্যান্ডে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে। এরপর সে জুডিথের দিকে তাকিয়ে বলল যে তার পেটের সন্তান সেখানে নিরাপদ থাকবে। তার চেহারায় পূর্বের খুশি খুশি ভাব অব্যাহত রেখে বলল। তোমরা দুজনেই সেখানে আমার সাথে থাকবে। “ব্রিস্টল-এর কাছেই আমার পরিবার থাকে। সেটা বেশ শান্তিপূর্ণ আর নিরাপদ জায়গা”, সে আশেপাশে তাকিয়ে এই জায়গার সাথে তুলনা করে বলল। তার চোখে যেন সেই জায়গাগুলোর ছবি ভাসছে।
দক্ষিণ দিকে তারা কয়েকশ মহিষের পাল দেখতে পায়। পুরো জায়গাটা কালো করে সেগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেই সাথে মাথা নিচু করে ঘাস খাচ্ছে। জুডিথ প্রথমে ভাবে এদেরকে অনুসরণ করলে হয়ত খাবার পানির দেখা মিলবে। কিন্তু পরে আবার সিদ্ধান্ত বদল করে। তাদেরকে পূর্বদিকে যেতে হবে। আলো থাকতে থাকতে যে করেই হোক তাদেরকে উপকূলে পৌঁছতে হবে। মহিষের পাল এখনো তাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আছে।
“ওয়েস্টবারিতেও নিরাপদ”, অ্যান পূর্বের কথার জের ধরে আবার বলতে শুরু করে। সেখানে হলি ট্রিনিটি নামে একটা চার্চ আছে। যেখানকার যাজক আমাকে বেল টাওয়ার-এর চূড়া পর্যন্ত উঠতে দিত। বেলটা দেখতে অনেক সুন্দর ছিল। জুডিথ মেয়েটাকে হতাশা করে না। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে বাড়ির কথা চিন্তা করাটা তার মনে সাহস যোগাচ্ছে। একারণে জুডিথ তাকে কল্পনার জগতে বসবাস করতে দেয়। সে হয়ত অ্যান-এর ইচ্ছে সম্পূর্ণরূপে পূরণ করতে পারবে না।
তাছাড়া তারা যদি উপকূলে পৌঁছে কোনো ক্যাপ্টেনকে তাদের কষ্টের কথা বলে এবং সেই ক্যাপ্টেন যদি তাদেরকে তাদের জন্মভূমিতে পৌঁছে দেয় তবেই কী জুডিথ সুখী হবে? হালকে ছাড়া একা একা পৌঁছে সে কী সুখী হতে পারবে?
আমি কী বোকার মতো কাজ করেছিলাম, জুডিথ মনে মনে চিন্তা করল। জাঞ্জিবার-এ গিয়ে আমি যদি বাউ-এর উপরে থাকতাম তবে কতই না– নিরাপদে থাকতে পারতাম। হাল যদি তার জন্য ভুল ওষুধ নিয়ে আসত তবে এমন কী আর ক্ষতি হত। সে তখন যদি অসুস্থ হয়েও পড়ত তবে সেটা কী আজকের অবস্থার চেয়ে খারাপ হত?
কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করার সময় ফুরিয়ে গিয়েছে। সে তার শত্রুর ফাঁদে পড়েছে। তার সন্তান কোনোদিন তার বাবাকে চিনবে না। তার বোকামির জন্য তাকে এই শাস্তি পেতে হচ্ছে।
“ওই দিকে তাকিয়ে দেখুন,” অ্যান-এর কথায় জুডিথের শোকাত্মক চিন্তা ভাবনায় বাধা পড়ল। অ্যান উত্তর-পূর্ব দিকে হলুদ ঘাসের মাঝে কালো কিছু একটা নড়াচড়া করতে দেখল। “এটা কী?” সে জিজ্ঞেস করল। “দেখতে অনেকটা পাখির মতো। কিন্তু বেশ বড়,” সে সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচিয়ে ভালভাবে দেখার চেষ্টা করছে।
“শকুন”, জুডিথ চোখ বড় বড় করে দেখল। যখন সে দেখল যে একসাথে থাকা বড় কালো বস্তুটা ভেঙে কয়েকটা পাখি হয়ে গিয়েছে, তখন জুডিথ-এর হার্ট প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হলো।
এরপরই অ্যান কয়েকটা সিংহ দেখতে পেল। অ্যানও ভয়ে জুডিথ-এর মতো বরফ হয়ে যেতে শুরু করল।
তাদের দুজনের পা যেন মাটির সাথে আটকে আছে। একটুও নড়াতে পারছে না।
একটা সিংহ মাথাটা ঘুরিয়ে দুটো শকুনের দিকে হুঙ্কার দিচ্ছে, কারণ শকুন দুটোও তাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। শকুন দুটো একটু দূরে সরে গেল-যদিও বেশিদূর না। জুডিথ এক-দুই করে পাঁচটা পর্যন্ত সিংহ গুনতে পারল। কিন্তু ঘাসের মধ্যে আরও দুই একটা শুয়ে থাকতে পারে যেগুলো হয়তো দেখা যাচ্ছে না।
“তারা তাদের নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। তারা যেন কিছুতেই আমাদেরকে দেখতে না পায়।” জুডিথ অনেক আশা নিয়ে কথাটা বলতে থাকল। একটা বুশবাক এবং ছোট কুড়ুর মৃতদেহ নিচে পড়ে আছে। সিংহদুটো তাদের মাংস টেনে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এখনো বেশ অনেকটা মাংস বাকি আছে। “খাও ভালমত খাও। এতটা ভালভাবে যেন নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়,” অ্যান সিংহগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে।
জুডিথ এবং অ্যান দক্ষিণ-পূর্ব দিকে তাদের যাত্রা চালিয়ে যেতে থাকে। তাদের খাবার পানি প্রায় ফুরিয়ে আসছে। শরীর বেয়ে ঘাম চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। অ্যান-এর সাদা শরীর লাল হয়ে যেন ফোঁসকা পড়ে যাচ্ছে তবুও অ্যান কোনো কথা বলছে না।
যেতে যেতে একসময় তারা একটা উঁচু জায়গার পাশ দিয়ে চলা শুরু করল। উঁচু জায়গাটা যেখানে ডানদিকে মোড় নিয়েছে সেখানে তারা একটা ঝর্নাধারা দেখতে পেল। আনন্দে ভরে উঠল তাদের মন। তারা ফ্লাক্স ভর্তি করে পানি নিল।
“আমরা এখানে ক্যাম্প বানাতে পারি। এখানে খাবার পানিও আছে,” অ্যান বলল।
“না”, জুডিথ তার মাথা নাড়াল। “ওদিকে তাকিয়ে দেখ।” জুডিথ দক্ষিণ দিকে হাত উঠিয়ে বলল যেদিকে ঝরনাটা অনেক চওড়া হয়ে গিয়েছে। সেদিকে একডজন বা তারও বেশি সরীসৃপ জাতীয় বন্য প্রাণী পানি পান করছে। জুডিথ এবং অ্যান যতটা তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি পান করছে ওরাও ঠিক ততটা পিপাসা নিয়েই পান করছে। “চিতাবাঘ কিংবা সিংহ যেকোনো সময় এই প্রাণীগুলোর খোঁজ পেয়ে এখানে চলে আসবে। তাই এই জায়গাটা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়।”
এত কষ্টের ভেতরেও অ্যান মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। “ওয়েস্টবেরীতে থাকলে আমাদেরকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হত না।” “আমার মায়ের বিশাল টম ক্যাট সবকিছু একাই সামাল দিয়ে দিত।”
অ্যান-এর কথা শুনে জুডিথও না হেসে পারল না।
তারা যখন তার বানানো শেষ করল তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে। জুডিথ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা আগুন জ্বালাবে। যদি সিংহের ভয় না থাকত সে কখনোই এই ঝুঁকিটা নিত না। তাছাড়া সে আর আন অনেকটা সময় ধরে সামনে এবং পেছনে তাকিয়ে দেখেছে কোথাও মুখোশ পরা লোকটার চিহ্ন দেখা যায় কি-না। কিন্তু তারা কোনো চিহ্ন দেখতে পায় নি।
জুডিথ মৃত পর্তুগীজ সৈন্যটার কাছ থেকে ধনুক এবং তরবারি নিয়ে এসেছে সেগুলোর সাহায্য নিয়ে কোনোভাবে একটা পাখি শিকার করল। সেই পাখির চামড়া ছাড়িয়ে মাংস আগুনে ঝলসে খাওয়ার ব্যবস্থা করল। জুডিথ মাটিতে বেশ খানিকটা গর্ত করে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে যেন আগুনের আলো বেশিদূর না যায়। সেই সাথে আগুনের চারপাশটা ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেয়ার ব্যবস্থা করল।
“কী অদ্ভুত কাণ্ড দেখেছেন, ছোট্ট একটু আগুন চারপাশটাকে কেমন জীবন্ত করে তুলেছে,” অ্যান বলে উঠল। তার মুখের হাসিটা আগুনের আলোতে জ্বলজ্বল করছে। বন্য পোকামাকড়ের গুনগুন শব্দে চারপাশটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। জুডিথের মনে হচ্ছে সে আগুন জ্বালিয়ে সঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছে।
তারা বিভিন্ন গাছ থেকে সংগ্রহ করা ফলমূল খেতে থাকে। জুডিথ অ্যানকে বলে যে এটার নাম হচ্ছে মাঙ্কি বেড। এরপর জুডিথ কিছু রেখে দেয়া খাট গাছের ছাল চিবুতে থাকে। কিন্তু সেগুলো জুডিথকে জাগিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো।
আগুনের শেষ শিখাটা নিভে যাওয়ার পরও অনেকটা সময় বাকি ছিল সূর্য উঠার।
আর ঠিক তখুনি হায়েনারা এলো।
*
দ্বিতীয় দিনের মতো তাদের পিছু ধাওয়া করা শেষ হয়েছে। জুমু নামে বুজার্ডের ব্যক্তিগত দাস বুজার্ডের শুষ্ক মুখে পানি তুলে দিচ্ছে। শুধু এই সময়টাতেই বুজার্ডকে খুব অসহায় মনে হয়। জুমু এটা জানে। অন্য সময় বুজার্ড যতই তার ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা করুক না কেন এ সময় সে খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। পানি পান করার শত ইচ্ছে থাকার পরও সে পানি পান করতে পারে না যদি না কেউ তার মুখে তুলে দেয়। এই সময়টা তার সাথে কথা বলার জন্য বা কোনো অনুরোধ করার জন্য উপযুক্ত সময় নয়। কিন্তু মুটে দুজন জুমুকে কথা বলার জন্য এতবার করে প্ররোচনা দিতে থাকে যে জুমুর আর কিছুই করার থাকে না।
“মাস্টার, সে আস্তে আস্তে বলতে শুরু করে। সুবিধার ব্যাপার এই যে নল মুখে নিয়ে বুজার্ড পানি পান করা শুরু করলে অনেকক্ষণ যাবত কথা বলতে পারবে না। এই সময়ের মধ্যে কথাটা বলে ফেলা যাবে। “আমাকে মাফ করবেন। কিন্তু আমি আমার ভাইদের হয়ে কিছু কথা বলতে চাইছি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমরা সেই মেয়েটার খুব কাছাকাছি রয়েছি। আমরা যদি আরও একটু সামনে এগিয়ে যাই তবে এই অন্ধকারেও আমরা তাকে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।”
বুজার্ড তার মাথা ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। “তুমি বলছ, আমরা তাদেরকে হয়ত খুঁজে পাব?”
“হ্যাঁ, মাস্টার।”
“যদি তাকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তখন?”
“মাস্টার, ভবিষ্যতে কী ঘটবে এটা বলাটা অসম্ভব। সেটা ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ীই হবে। কিন্তু আমার এমনটাই মনে হচ্ছে।”
“তোমার কী মনে হচ্ছে না যে তাদেরকে সকালে খুঁজে বের করাটা আরো সুবিধাজনক হবে?”
“হ্যাঁ, মাস্টার।”
“তাহলে আমরা তা-ই করব। এখন কালো বেলুনের মতো আমার সামনে বকবক না করে খাবারের ব্যবস্থা কর, যাও।”
জুমু তার মনিবের জন্য নরম খাবার প্রস্তুত করতে চলে গেল।
কয়েক ঘণ্টা পর সে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দেখল যে বুজার্ড গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। তার কাঁধ ঝাঁকিয়েও তাকে জাগানো যাচ্ছে না। অবশেষে দানবটা ঠোঁট ঘুরিয়ে জ্বলন্ত চোখে জুমুর দিকে তাকাল।
বুজার্ড কথা বলার পূর্বেই জুমু দ্রুত বলে উঠল। “মাস্টার! মাস্টার! আমাদের এখনই যেতে হবে…সেই মেয়েটা!”
“তুমি কী বলতে চাইছ?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করল।
“শুনুন, মাস্টার! কান পেতে শুনুন।”
বুজার্ড কিছুক্ষণ চুপ করে শোনার চেষ্টা করে। এরপরই সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। উঠ! উঠ!…সবাই তৈরি হও। সে চিৎকার করতে করতে তার তলোয়ার হাতে নেয় এবং রাতের অন্ধকারের ভেতর দৌড়াতে শুরু করে।
.
দুটি হায়েনার গোঁ গোঁ আওয়াজ এবং হুঙ্কারে জুডিথ জেগে উঠে। এত বড় হায়েনা জুডিথ-এর পূর্বে কখনও দেখেনি। সে এবং অ্যান যেখানে শুয়ে আছে। তার সামনেই হায়েনা দুটো উত্তেজিত হয়ে সামনে পেছনে লাফাচ্ছে। হায়েনা দুটোর উত্তেজনা দেখে জুডিথ-এর রক্ত প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে।
অ্যান জেগে উঠে হায়েনা দেখে চিৎকার করে উঠে, “দূর হ এখান থেকে।” সে হামাগুড়ি দিয়ে পেছনে যেতে থাকে। “দূর হ এখান থেকে শয়তান।”
তার এই চিৎকার বা ধমক হায়েনাগুলোকে দূরে সরিয়ে দেয়া তো বহু দূরের কথা বরং সেগুলোকে আরও উত্তেজিত করে তুলল। সেগুলো রাগে গজরাতে থাকল।
ভয়ে এবং শীতে কাঁপতে কাঁপতে জুডিথ আগুনের দিকে এগিয়ে গেল। সে একটা কাঠি তুলে ছাইগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে কিন্তু সেটাতে সে কোনো অঙ্গার দেখতে পায় না।
“ওদেরকে গুলি করুন,” অ্যান চিৎকার করে উঠল। “একটাকে গুলি করলে অন্যটা পালিয়ে যাবে।”
কিন্তু আগুনের শিখা ছাড়া হাত বন্দুকটা একদম অকেজো; ওটার ম্যাচ কর্ড-এ আগুন না ধরালে শুট করা যায় না।
সে তার কোমড়ে গুঁজে রাখা চামড়ার থলেটা হাতে নিয়ে সেটা থেকে পাথরের টুকরা এবং স্টীলের পাতটা বের করে আনল। হাঁটুর ওপর পাতটা রেখে পাথর দিয়ে ঘষে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করতে লাগল সে।
আগুনের গন্ধ তার নাকে আসতে থাকে।
“তাড়াতাড়ি,” অ্যান বলে উঠল। জুডিথ আশপাশ থেকে দ্রুত কয়েকটা শুষ্ক খড়খুটো নিয়ে সেটার ওপর স্টীলের পাত এবং পাথর রেখে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাতাসে কয়েকটা স্ফুলিঙ্গ দেখা গেলেও সেটা আগুন জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
“জুডিথ, দয়া করে তাড়াতাড়ি করুন।”
অধিকাংশ হায়েনাই মানুষের সামনে আসলে ভীত হয়ে যায়। বিশেষত যেগুলোর গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে। কিন্তু এগুলোর গায়ে ধূসর চামড়ার কোট পরানো আছে। তার ওপর গাঢ় বাদামি রঙের দাগ আছে। একটা হায়েনা অ্যান-এর খুব কাছাকাছি চলে এসে ওপর নিজ মাথা নাড়াচ্ছে আর হাসছে।
অ্যান চিৎকার দিয়ে উঠে। অ্যান-এর চিৎকারে জম্ভটা নড়ে উঠে কিছুটা পিছিয়ে যায়।
“ওহ, গড”, অ্যান কেঁদে ফেলল। “ও গড, আমাদেরকে সাহায্য কর।”
হঠাৎ রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে বন্য চিৎকার শোনা যায়। জুডিথ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখার চেষ্টাও করল না। আসলে তাকিয়ে দেখার কোনো প্রয়োজনও নেই। সে জানে প্রথম হায়েনা দুটি চিৎকার দিয়ে তাদের দলকে ডাকছে এই হত্যাযজ্ঞে যোগ দেয়ার জন্য।
পাথর ঘষতে ঘষতে জুডিথ-এর হাত কাঁপতে থাকে।
“আমরা মারা যাচ্ছি।” সে অ্যান-এর ফোপানো কান্না শুনতে পায়। এরপর… অবশেষে…বহুচেষ্টার পর একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ খড়খুটোর গায়ে লাগল। খড়খুটোর কুণ্ডলীটাকে সে হাতের ওপর উঠিয়ে নিয়ে ফুঁ দিতে শুরু করল। জুডিথ সর্বোচ্চ চেষ্টা করে দম আটকিয়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছে।
“জুডিথ!”
পুরনো খড়খটোর মধ্যে অবশেষে আগুনের শিখা জ্বলে উঠল। আগুন দেখে হায়েনার দল কিছুটা পিছিয়ে পড়ল। জুডিথ মাথা তুলে আশেপাশে তাকাল কিন্তু অ্যানকে দেখতে পাচ্ছে না সে। দুই ডজন কিংবা তারও বেশি হায়েনা অ্যান-এর আশেপাশে পাক খাচ্ছে। ছাই-এর পাশে আরেকটা ছোট কাঠি পড়ে আছে। কিন্তু এটা দিয়ে আগুনকে বেশিক্ষণ টিকিয়ে রাখা যাবে না।
কিন্তু জুডিথ-এর কাছে এখনো হাত বন্দুকটা রয়েছে।
“ঈশ্বর আমাদের সাহায্য কর,” জুডিথ মনে মনে এই প্রার্থনা করতে থাকে। এরপর সে হাত বন্দুকে আগুন লাগানোর ম্যাচ কর্ডটাকে আগুনের শিখায় ধরল। একই সাথে হাত বন্দুকটা এবং পাউডার ফ্ল্যাক্সটা শক্ত হাতে তুলে নিল। হাতবন্দুক-এর প্রিমিং প্যানটা খুলে ফেলে ফ্ল্যাক্স-এর স্টপারটা দাঁত দিয়ে টেনে ধরে যথেষ্ট পরিমাণ পাউডার প্যান-এর মধ্যে ঢেলে দিল। এরপর প্যান-এর কভার লাগিয়ে অতিরিক্ত পাউডার সরিয়ে ফেলল, তারপর সে হাত বন্দুক-এর বাটটা মাটিতে রেখে সেটার মাজুল-এ পাউডার প্রবেশ করালো।
“আমি আসছি, অ্যান”, সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কিছু ঘাস হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ে নিল। এরপর সেই ঘাসগুলো মুখে দিয়ে চিবাতে থাকল। তাকে যেহেতু নিচের দিকে তাক করে গুলি করতে হবে তাই শুট করার আগেই গুলিটা বন্দুক থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। আর তাই শুট করার আগ পর্যন্ত গুলিটাকে ওখানে ধরে রাখার জন্য কিছু একটা দরকার। চিবানো ঘাসটা মুখ থেকে বের করে মাজল-এর মুখ আটকে দিল জুডিথ, যাতে শুট করার আগ পর্যন্ত বুলেটটা ব্যারেল থেকে বেরোতে না পারে।
“ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাও”, অ্যান জুডিথকে অনুনয় করে বলতে থাকে। জুডিথ জ্বলতে থাকা কাঠিটাকে বন্দুকের স্টক-এ লাগিয়ে গুলি করার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করল। বন্দুকটা নিজের বুকে ঠেকাল সে। কিন্তু সমস্ত গান পাউডার ঢেলে দেয়ার ফলে একবারই সে গুলি করতে পারবে। আরেকবার গুলি করার জন্য বন্দুকটাকে হয়ত সে প্রস্তুত করার সময় পাবে না।
“ওর চিন্তা বাদ দাও! জন্ম না নেয়া বাচ্চাটা যেন জুডিথ-এর পেটের ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠে। আমরা হয়ত একবারই গুলি করার সুযোগ পাব। ওই মেয়েটার জন্য সেটা নষ্ট করো না। এটা রেখে দাও। তাকিয়ে দেখ হয়েনাগুলো আমাদের দিকেও এগিয়ে আসছে।
জুডিথ আবারও অ্যান-এর দিকে তাকায়। ওর চারপাশে হায়েনাগুলো ঘোরফেরা করছে। কোনোটা তার শক্ত থাবা অ্যান-এর গায়ে ঠেকিয়ে দিচ্ছে আবার কোনোটা পিছিয়ে আসছে।
সে ক্যাম্পের মধ্যে ম্যাচকর্ডটা ঠিকমত লাগিয়ে টিগার ধরে টান দেয়। এরপর চোখের দৃষ্টিতে দূরত্ব মাপতে থাকে।
“দূর হ।” সে চিৎকার দিল। “দূর হ।” একপা সরে গিয়ে জুডিথ তার খুব কাছের হায়েনাটার দিকে ব্যারেল তাক করল। সে তার বন্দুকটাকে চারদিকে ঘুরিয়ে হায়েনাগুলোকে সরে যেতে হুমকি দিল যদিও সে গুলি ছুড়ল না।
এখনো পর্যন্ত গুলি ছুঁড়েনি জুডিথ। সে আবারো অ্যান-এর দিকে তাকায়। অ্যানের দিকে এগিয়ে আসা সবচেয়ে বড় হায়েনাটার দিকেই তার নজর। এটাই নিশ্চয়ই দলনেতা। সে যদি এটাকে হত্যা করতে পারে তাহলে বাকিগুলো নিশ্চয়ই পালিয়ে যাবে।
“কিন্তু তুমি যদি ব্যর্থ হও? পেটের বাচ্চা আবারও বলে উঠল। তখন কী ঘটবে?”
“হত্যা করুন”, অ্যান চিৎকার করে উঠল। “এটাকে গুলি করুন।”
জুডিথ বন্দুকটা তার কাঁধের ওপর রেখে বড় হায়েনাটার দিকে তাক করল। সে জানে তার পেছনেও হায়েনাগুলো ওত পেতে আছে। হায়েনাগুলো সবখানেই আছে। এরা চারদিকটা ঘিরে ফেলেছে। জুডিথ হায়েনাগুলোর নিঃশ্বাস অনুভব করছে। রাতের ঠাণ্ডা বাতাস ভেদ করে গরম বাতাস এসে জুডিথ-এর গায়ে লাগছে।
কিন্তু বড় হায়েনাটা এক জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে নেই। এখানে সেখানে ঘুরছে ওটা। তাই সেটার দিকে লক্ষ্য স্থির করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
“এই দিকে তাকা, শয়তান”, জুডিথ তার মাতৃভাষা অ্যামহারিক-এ চিৎকার করে উঠল। এই দিকে তাকিয়ে দেখ তোর জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।” সে এবার অ্যানকেও দেখতে পাচ্ছে। অ্যান-এর গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তার চোখে ভয়ের আতঙ্ক উপচে পড়ছে। ঠিক তখনই সে পায়ের নিচে কিছু একটা অনুভব করল। নিচে তাকিয়ে দেখল যে অ্যান-এর ফ্ল্যাক্সটা নিচে পড়ে আছে। সেটা নিচের থেকে তুলে সমস্ত শক্তি দিয়ে বড় হায়েনাটার দিকে ছুঁড়ে মারল।
হায়েনাটা গর্জন করে তার দিকে ফিরে তাকাল।
এটাই জুডিথ চেয়েছিল। তার হার্টবিট বাড়তে থাকে। সে জানে এর চেয়ে ভাল সুযোগ সে হয়ত আর নাও পেতে পারে। তাদের ভাগ্যের চাকা হয়ত ঘুরেও যেতে পারে। এ যাত্রায় হয়ত তারা বেঁচেও যেতে পারে। ইতোমধ্যেই বন্দুকের টিগারে জুডিথ-এর আঙুলগুলো বাকা হতে শুরু করেছে।
ঠিক তখন অ্যান তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। দৌড় দিল মেয়েটা।
হায়েনাটা তার পিছু পিছু যেতে থাকে। “না,” জুডিথ চিৎকার করে উঠল, এরপর টিগার-এ টান দিল। বন্দুকটা গর্জে উঠল সাথে-সাথে।
অন্ধকার ভেদ করে আগুনের গুলি এগিয়ে যেতে থাকে। আগুন দেখে হায়েনাগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু তারপরও জুডিথ-এর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কারণ অ্যান দৌড় দেয়ার ফলে তার স্থির লক্ষ্যবস্তু চলন্ত লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে। তাই সে ব্যর্থ হয়। সে দেখতে পায় হায়েনাটা দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় অ্যান-এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, এরপর বাম উরুতে কামড়ে ধরল শক্ত করে। অ্যান-এর চিৎকার হায়েনাগুলোর গর্জন এবং হুড়োহুড়ির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে। বন্দুকের গর্জন ভুলে গিয়ে হায়েনাগুলো তাদের দলনেতাকে অনুসরণ করা শুরু করে দিল।
জুডিথ বন্দুকটা হাতে নিয়ে ব্যারেলটা দুহাত দিয়ে ধরে হায়েনাটার পেছনে তীব্রভাবে আঘাত করল। সেটা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে অ্যানকে ছেড়ে দিয়ে জুডিথ-এর দিকে তাকায়। বাকি হায়েনাগুলো অ্যান-এর রক্তের নেশায় মগ্ন হয়ে আছে। সেগুলোর সমস্ত মনোযোগ এখন অ্যান-এর দিকে। একটা প্রাণী ভিড়ের মাঝ থেকে মুখ তুললে জুডিথ দেখতে পায় সেটার মুখে রক্ত লেগে আছে।
“ওর কথা ছেড়ে দাও,” পেটের শিশুটি আবার বলতে শুরু করে। “আমাদের আর কিছুই করার নেই। কিন্তু আমরা যদি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকি তবে আমাদেরকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে এরা।”
“হেল্প মি”, এখনো অ্যান-এর চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
অ্যান-এর চারদিকে হায়েনাগুলো একটা ক্ল্যান তৈরি করে ফেলেছে। জুডিথ তার এই জীবনে অনেক যুদ্ধ ক্ষেত্র দেখেছে। কিন্তু কোনোটাকেই এটার সাথে তুলনা করা যায় না। হঠাৎ তার বমি বমি ভাব শুরু হলো। সে বাঁকা হয়ে ঘাসের ওপর বমি করে দিল। একটা হায়েনা তার বমির গন্ধে তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকল। সে বন্দুকটা দিয়ে হায়েনাটাকে আঘাত করতে উদ্যত হয়। কিন্তু হায়েনাটার মনোযোগ তার দিকে না, মাথা নিচু করে হায়েনাটা ঘাসের ওপর থেকে বৃমি চেটে চেটে খাচ্ছে।
ঠিক তখনই একটা তলোয়ার এসে হায়েনাটার মাথা ভেদ করে দিল। হায়েনাটা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। জুডিথ মাথা ঘুরিয়ে দেখে যে মুখোশ পরা লোকটা এসে উপস্থিত হয়েছে ওখানে।
“ওকে সাহায্য কর”, জুডিথ বলতে থাকে।
জুডিথ এবং হায়েনার মাঝে এসে দাঁড়াল তলোয়ার হাতে লোকটা। এরপর অন্যান্য পর্তুগীজ নাবিক এবং দুজন উপজাতি জুডিথকে রক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়াল। জুডিথ চিৎকার করে উঠল, “কেউ ওকে সাহায্য কর,” ঈশ্বরের দোহাই লাগে কেউ ওকে বাঁচাও।”
মুখোশ পরা লোকটা কোনো কথাই বলল না। সে তার মাথাটা ঘুরিয়ে তাদের সামনে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনার দিকে তাকিয়ে দেখছিল।
“তোমার তলোয়ারটা আমাকে দাও,” “আমি ওকে সাহায্য করব,” জুডিথ বলল।
লোকটি আড়চোখে জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মুখ বন্ধ করে শুধু দেখে যাও।” এরপর সে একজন নাবিককে ইশারা করল জুডিথ-এর হাত থেকে বন্দুকটা কেড়ে নেয়ার জন্য।
একটা হায়েনা লাফ দিয়ে অ্যান-এর বাহুতে কামড় দিয়ে ধরেছে। হায়েনাটার ভারে অ্যান চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জুডিথ শেষবারের মতো আকুতিভরা অ্যান-এর চোখদুটো দেখতে পায়। এরপর সব শেষ হয়ে যায়, “প্লিজ।” জুডিথ কাঁদতে থাকে। কিন্তু সে জানে এখন আর কোনো আশা ভরসাই নেই। হায়েনাগুলো তাকে জীবন্ত খেয়ে ফেলল। জুডিথ হায়েনাগুলোর মুখের কচুমচ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত না মুখোশ পরা লোকটা সবাইকে যাওয়ার জন্য আদেশ করল ততক্ষণ পর্যন্ত সে তাকিয়েই রইলো।
“আপনার ভাগ্য ভাল যে, আমাদের একজন আপনার বন্দুকের আগুন দেখতে পেয়েছিল, “ধূসর দাঁড়িওয়ালা অফিসারটা বলল। নয়ত ওই শয়তানগুলো আপনাকে এবং আপনার পেটের সন্তানকে খেয়ে ফেলত। জুডিথ কিছু বলল না। এ মুহূর্তে তার বলার মতো কোনো কথা নেই। সে শুধু হাতদুটো তার পেটের ওপর রাখল। সে হাত দিয়ে পেটের ওপর চাপ দিতে থাকে যেন সে বাচ্চাটার হাত-পা ছুঁড়ে নিশ্চিত হতে চাচ্ছে যে বাচ্চাটা এখনো নিরাপদে আছে।
যদিও তার মন এই নির্ভরতা মেনে নিতে চাচ্ছে না। প্রতিটা ইন্দ্রীয় তাকে বলছে যে এ পর্যন্ত সে যত কষ্ট ভোগ করেছে সেই কষ্টগুলো সামনে এগিয়ে আসা কষ্টের তুলনায় কিছুই না।
*
হাল সময়ের নিশানা হারিয়ে ফেলেছে। সে এখন বলতে পারবে না যে কতটা সময় তারা দ্বীপের ভেতর দিয়ে হেঁটেছে। যদিও সে স রাতের বেলা চাঁদের আলোর দিকে খেয়াল রাখতে পেরেছে। চাঁদের আবার দুই তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এ থেকে সে ধারণা করতে পারল যে প্রায় তিন সপ্তাহ যাবত তারা সামনের দিকে এগুচ্ছে।
সামনে এগুতে এগুতে তারা ভূমির ওপর বড় বড় গ্রানাইট পাথর দেখতে পায়, পূর্বদিকে বড় বড় পাহাড়ও তাদের নজর এড়ায়নি। তারা বুঝতে পারে যে তারা মিয়েম্বো ফরেস্ট-এ পৌঁছে গিয়েছে।
মাঝে মাঝে রাতের বেলা বৃষ্টি তাদের পথ রুখে দাঁড়ায়। তারা তখন গাছের ডালপালা দিয়ে অস্থায়ী তাবু বানিয়ে আশ্রয় নেয়। আগুন ছাড়া তারা কখনোই বিশ্রাম নিত না কারণ বহুদূর থেকেও বন্য পশুপাখিরা আগুনের গন্ধ পায়, ভয় পায়।
“শুধু সিংহ বাদে,” অ্যাবোলি তাকে একসময় বলেছিল। “সিংহ ক্যাম্প ফায়ার-এর কাছাকাছি ঘুরাঘুরি করে দেখার চেষ্টা করে যে সেখানে কী ঘটছে?”
যদিও বেশ গরম পড়েছিল তবুও চাঁদ এবং তারার আলোতে রাতের পরিবেশ ভালই দেখা যাচ্ছিল। তখন তারা স্বর্গীয় এসব জিনিসের মহত্ত্ব বুঝতে পারছিল। একদিন সকাল বেলা দেখতে পায় হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা লেক-এর ধারে চলে এসেছে। যদিও শুকনো মৌসুমের কারণে পানি নিচে নেমে এসেছে, ফলে জায়গাটা বন্য জলহস্তীদের জন্য বেশ ভাল আবাসস্থল হিসেবে কাজ করছে। লেক-এর ধারে কুমিরও রয়েছে। এরা সম্ভবত ঊষালগ্নে সূর্যের তাপ সেবন করার জন্য জল থেকে উঠে এসেছে। এগুলোকে আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে খুব একটা সংবেদনশীল মনে হচ্ছে না। যখন সাদারঙের এক ঝাঁক পাখি ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে দক্ষিণ দিকে উড়ে যায় তখন কুমিরগুলো পানিতে নেমে আসে।
অবশেষে কাপেলো ক্যাম্প বানিয়ে রাতটা কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। হাল এবং অন্যান্য দাসের হাতের শেকল আলগা করে দেয়া হয় যেন তারা কাজ করতে পারে। ক্যাম্পের চারপাশে শক্ত বেড়া প্রস্তুত করতে বলে যেন অকস্মাৎ শিকারীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পারে। আরও সুরক্ষার জন্য তারা ক্যাম্প ফায়ার প্রস্তুত করে। মোটা লোকটার মনের ভাব এখনো খুব একটা ভাল মনে হচ্ছে না। তাই দেখে একজন গার্ড জিজ্ঞেস করে বসলো, “আপনার কী হয়েছে সেনোর?”
“আমাদের কেউ অনুসরণ করছে,” কাপেলো জবাব দিল।
“আপনি কীভাবে নিশ্চিত হলেন, স্যার?” গার্ড প্রশ্ন করল। “আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।”
“কেউ আমাদের পেছনে আসছে এটা বোঝার জন্য কাউকে দেখার প্রয়োজন নেই।”
ওদের থেকে দশ গজ দূরে অ্যাাবোলি তার দলবল নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিন পূর্বেই সে কৃতদাসদের এই সারিটাকে খুঁজে পেয়েছে। এখন আক্রমণ চালিয়ে কাপেলোর দলবল এবং গার্ডদের ছিন্নভিন্ন করে দেয়া কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তারপর কী ঘটবে?
শুধু হালকে উদ্ধার করাই যথেষ্ট নয়। জুডিথকেও উদ্ধার করতে হবে। অ্যাবোলি এরইমধ্যে তার দুজন লোককে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল। তারা জানিয়েছে যে খনি এখান থেকে প্রায় একদিনের পথ। তারা একজন রমণীসহ আটজনের একটা দল খুঁজে পেয়েছে যারা ঐদিনই খনিতে পৌঁছেছে।
আর একদিনের মধ্যে হাল এবং জুডিথ একই জায়গায় পৌঁছাবে। তখনই তাদেরকে উদ্ধার করার উপযুক্ত সময়। ততক্ষণ পর্যন্ত অ্যাবোলি তার উপস্থিতি গোপন রাখছে। হালকে আরও কিছুটা সময় দাস হয়ে জীবনযাপন করতে হবে-যত কষ্টই হোক না কেন।
.
বুজার্ড এবং জুডিথ কোনো ব্যাপারে একমত হয়েছে খুব কমই। যদিও কেউ কোনো কথা বলছে না তবুও তারা জানে যে অপরজনের মনেও ঠিক একই প্রশ্ন উদয় হয়েছে : “এটাই কী বালথাজার লোবো?”
এই কী সেই ব্যক্তি যে আফ্রিকার বুকে নিজের রাজত্ব তৈরি করেছে? পাহাড়ের নিচে সোনা খুঁজে পেয়েছে এবং দাসদেরকে কিনে এনে বাধ্য করছে সোনার খনিতে কাজ করার জন্য? জুডিথ ভেবেছিল লোবো হয়ত কোনো শক্ত সামর্থ্য মোটাসোটা, দেখতে বিদঘুঁটে ধরনের লোক হবে। তার বদলে চিকন পাতলা রোগা একটা মানুষকে দেখতে পেল সে। লোবোর নিচের চোয়ালটা একটু সামনের দিকে ঝুঁকে আছে। জুডিথ তার ইউরোপ ভ্রমণের সময় হাবসবার্গ বংশের লোকদের গল্প শুনেছে যারা বিভিন্ন সময় স্পেইন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া এমনকি সমগ্র রোমান সাম্রাজ্য শাসন করেছে। এই বংশের লোকেরা সামনের দিকে বাড়ানো কুৎসিৎ রকমের নিচের চোয়ালের জন্য বিখ্যাত ছিল। লোবো হয়ত সেই হাবসবার্গ লাইনের কোনো জারজ সন্তান। বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্যই হয়তো বা আফ্রিকায় এসে ঘাঁটি বসিয়েছে।
“তা হলে,” জুডিথ-এর দিকে বেশ সন্তুষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলা শুরু করল লোকটা। জুডিথ দেখতে পায় লোকটার মুখের কোণা থেকে একটা চিকন লালা গড়িয়ে পড়ছে। “তুমিই তাহলে সেই সুন্দরী রমণী যে আমার পরবর্তী বউ হতে যাচ্ছ? কিন্তু এতটা রাস্তা ভ্রমণ করে আসার ফলে তোমাকে খুব একটা ভাল দেখাচ্ছে না। তুমি ভেতরে গিয়ে বিশ্রাম নাও প্রিয়তমা। তোমার ঘর প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে। তোমার জন্য বিয়ের পোশাক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এটা এর পূর্বে মাত্র দুবার ব্যবহার হয়েছে। তোমার ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হবে। যাও আজকের মধ্যে গিয়ে নিজেকে প্রস্তুত কর। বিশ্রাম নাও ইচ্ছেমতো। কাল সকালে প্রস্তুত হয়ে আমার সামনে হাজির হবে। তারপর আমি সিদ্ধান্ত নেব যে তোমাকে নিয়ে কী করা যায়।”
সে পুনরায় জুডিথ-এর ওপর দৃষ্টি স্থির করে তাকিয়ে দেখতে লাগল। জুডিথ হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং ইচ্ছে পূরণের জন্য কতটা বল প্রয়োগ করতে পারে এই লোক, সেই সাথে কতটা নির্মম হতে পারে।
“হুম,” সে তার মাথাটা একপাশে বকিয়ে দেখতে থাকে। “বেশ সুন্দর বুক, গোলগাল পেট, পাগুলো বেশ চিকন। আচ্ছা, তুমি আবার গর্ভবতী নও তো, মেয়ে?”
জুডিথ কিছু বলল না।
“সে গর্ভবতী কি-না তাতে কী এসে যায়?” বুজার্ড জিজ্ঞেস করল। আমি ব্যাপারটা নিয়ে হাইপোথিটিক্যালভাবে কথা বলছি। ধরুন সে কোনো সাদা লম্বা কোনো ইংরেজের বাচ্চা পেটে ধরেছে। ধরুন আপনার বিয়ের পর সে সেই বাচ্চার জন্ম দিল। তাহলে সেই বাচ্চা আপনার হবে। আপনি তার পেটে বীজ বপন করেছেন কি-না সেটা কী বড় কোনো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে?”
লোবো জুডিথ-এর আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখতে থাকে, এরপর বলে উঠল, “না, আমার তা মনে হয়না। ভালভাবে ঘুমাও ইয়ং লেডি, তুমি কালকে তোমার সেরাটাই আমাকে দেখাবে।”
*
অ্যামাডোডারা নিচের দিকে তাকিয়ে বালথাজার-এর লোকদের বাসস্থান দেখছে, যেখানে থেকে লোবো তার বাসস্থান গড়ে তুলেছে। তার বাড়িটা অনেকটা গভীর চারকোণা জায়গায় গড়ে উঠেছে। দেয়ালগুলো বেশ চওড়া করে মাটি দিয়ে উঠানো হয়েছে। দেয়ালগুলোতে কোনো জানালা নেই এবং উচ্চতা প্রায় একজন মানুষের উচ্চতার দ্বিগুণ। বাড়ির ভেতর দিকটায় বেশ খানিকটা খোলা জায়গা রয়েছে যেখানে নানা ধরনের উজ্জ্বল ফুলের বাগান আছে। “সে নিশ্চয়ই জুডিথকে ওখানে নিয়ে গেছে, অ্যাবোলি মনে মনে চিন্তা করে দেখল।
অ্যাবোলি অনুভব করল যে কেউ একজন তার পিঠে টোকা দিচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে পেল যে তার একজন সঙ্গী হাত দিয়ে নিচের দিকে ইশারা করে দেখাচ্ছে। কয়েকজন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সাদা চামড়ার একজন মোটাসোটা লোক লোবোর কমপ্লেক্স-এ প্রবেশ করছে। অ্যাবোলি নিশ্চিত যে এই লোকটিই কাপেলো এবং ওদের মাঝে যে সাদা চামড়ার দাসটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই হচ্ছে হাল কার্টনি।
“আই সি ইউ, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলে উঠল। এই কথাটার অন্যরকম একটা অর্থ আছে। দক্ষিণ আফ্রিকার লোকজন একে অন্যের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় “আই সি ইউ”, কথাটা ব্যবহার করে। আর একটু ধৈর্য ধর ক্যাপ্টেন, তোমার কাছে পৌঁছাতে আর বেশি দেরি নেই।”
এরপর অ্যাবোলি আরো একটা জিনিস দেখতে পায়। সেটা দেখার পর সে নিজে নিজে ফিসফিস করে উঠে, “ফারো?”
.
সেদিনের সূর্য উঠার পর কাপেলো তার দাসদের সবকিছু বুঝিয়ে বলে। তারা কোথায় যাচ্ছে, কে তাদের নতুন মনিব হবে, মনিবের কথা অমান্য করলে তাদেরকে কী শাস্তি দেয়া হবে ইত্যাদি। দাসদের সারি যখন খনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন হালও একটা সাদা রঙের দুর্গ দেখতে পেল। এটাই সেই লোবোর বাসস্থান। এটা থেকে সে যেমন দাসদের সামনে উন্মুক্ত করেছে ঠিক তেমনি দাসরা যদি কখনো বিদ্রোহ করে তবে এই দুর্গই তাকে রক্ষা করবে।
সামনে এগিয়ে যেতে যেতে তারা একটা প্রবেশপথ অতিক্রম করে। প্রবেশপথটার নিচের দিকে বার ফিট গভীর এবং বিশ ফিট চওড়া আর অনেকটা প্রাসাদের চারদিকে গভীর পরিখার মতো আছে। তারা দেখতে পায় এই পরিখাঁটি অতিক্রম করার জন্য দুটি রাস্তা রয়েছে। একটি হচ্ছে রশি দিয়ে টানানো ব্রিজ যেটার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার জন্য খুবই সরু একটা রাস্তা রয়েছে। অন্যটি হচ্ছে প্রাসাদের গেট থেকে ঝুলানো একটা সিঁড়ি যেটা পুনরায় টেনে উঠিয়ে ফেলা যায়।
হাল ভ্রু কুঁচকে গোলকধাঁধার ন্যায় দুর্গটার দিকে তাকায়। যদিও দুৰ্গটার চারপাশে গভীর পরিখা খনন করে রাখা হয়েছে তবুও এটা বেশ বিপজ্জনক। শিকারী চিতাবাঘ কিংবা সিংহ যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ চালাতে পারে। লোবো সম্ভবত হাতি পোষ মানিয়ে রেখেছে। হাল জানে বহুবছর ধরে হাতি আনুষ্ঠানিক কাজে কিংবা সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। কিন্তু যদি তাই হয়, তবে কোথাও ওগুলোকে দেখা যাচ্ছে না কেন?
তখনই হাল পরিখার ধারে অদ্ভুত এক প্রাণী দেখতে পায়। দুটি শিংযুক্ত বিশাল আকারের, ধূসর চামড়াযুক্ত প্রাণীটা অপরিচিত মানুষের গন্ধ পেয়ে এখানে চলে এসেছে। দাসের সারি থেকে কয়েকগজ দূরে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক মাথাটাকে নাড়াচ্ছে।
কাপেলো হালকে উদ্দেশ্যে করে বলল, “তুমি কী এই প্রাণীগুলোর মতো প্রাণী দেখেছ কখনো, ইংলিশম্যান?”
হাল হয়ত বহুবার দেখেছে এগুলোকে, কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের জ্ঞান জাহির করার চাইতে যতই নিজের অজ্ঞতাকে প্রচার করবে ততই তার জন্য মঙ্গলজনক।
“এটা হচ্ছে রাইনোসোরাস। যদিও এখানকার লোকেরা এটাকে বলে “ফারো।” কাপপলো তাকে আরও জানায়, “পৃথিবীতে সেনোর লোবোই একমাত্র ব্যক্তি যে কি-না রাইনোসোরাস বন্দি করতে পেরেছে। বহু মানুষ মারা গিয়েছে এটা ধরতে গিয়ে। কিন্তু যতদিন সেনোর লোবোর কাছে এই ফারো আছে ততদিন তার কথাই হচ্ছে আইন।”
কাপেলো জানোয়ারটার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করে। “ওটার সামনের শিংটা বেশ বড়। লম্বায় একটা তলোয়ার-এর দ্বিগুণ। ওটা দিয়ে জানোয়ারটা যে কোনো মানুষকে কাবাবের ন্যায় টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে। ওটার দিকে ভালভাবে তাকিয়ে দেখ এবং প্রার্থনা কর যেন তোমাকে কখনো ওটার নিচে পড়তে না হয়।”
কাপেলো হাল-এর শেকল ধরে টান দেয় যেন হাল এগিয়ে এসে কাপেলোর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে। যখন তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে তখন কাপেলো নিচের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলতে থাকে, “যদি কোনো দাস অবাধ্য হয়, যদি তার মনিবকে সম্মান না করে, যদি সে কঠোর পরিশ্রম করতে ব্যর্থ হয় তবে তাকে শুধু চাবুকই মারা হয় না। তাকে ঐ ঘেরাও করা পরীখার দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখান থেকে কেউ জীবিত ফেরত আসে না। তুমি কী আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”।
“হ্যাঁ, মালিক”, হাল জবাব দেয়।
“তুমি তার কথার অবাধ্য হবে না কিংবা নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করবেনা, বুঝেছ?”
“হ্যাঁ, মালিক।”
“আমার বুটটা চেটে পরিষ্কার কর ইংলিশ ম্যান”, কাপেলো বলে উঠল, এরপর তার পা-টা এমনভাবে বাড়িয়ে দিল যেন একজন বিশপ তার আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছে।
হাল কাপেলোর কথার কোনো রকম প্রতিবাদ করার চেষ্টা না করে তাকে যা বলা হয়েছে তাই করল।
“চালিয়ে যাও। আমাকে অপমান করে তুমি যদি নিজেকে বড় মনে কর তবে তাই কর। আমি এর চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে টিকে ছিলাম”, হাল মনে মনে ভাবতে থাকে।
.
পড়ন্ত বিকেলে সূর্য যখন প্রায় হেলে পড়ছে তখন তাদেরকে পাহাড়ের পাদদেশে কীটগছি যুক্ত পথের ওপর দিয়ে হাঁটতে বলা হয়। দাসরা সেখানে কাঠের লরি ঠেলে একটা নালার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। লরিগুলোকে খনির ভেতর থেকে ধাতব পদার্থে ভর্তি করে নিয়ে আসা হয়েছে। এই ধাতব পদার্থগুলোকে এরপর নালার ভেতর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এই নালা বা টানেল পাহাড়ের ভেতর দিয়ে অনেক দূর বয়ে গিয়েছে। টানেলের অন্যপাশ থেকে এই ধাতব পদার্থ অন্যদাসেরা আবার সংগ্রহ করছে। এরপর পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে সোনাগুলো আলাদা করছে। এই কাজ চলার সময় কয়েকজন দাস মিলে জলন্ত কাঠের পাত্র বা জলন্ত কাঠ বয়ে বেড়াবে। এতে করে কর্মরত দাসরা আলোও পাবে এবং উষ্ণতাও পাবে।
এখানে সেখানে প্রত্যেক জায়গায় সাদা এবং কালো চামড়ার লোকেরা দাসদেরকে পাহারা দিচ্ছে। তাদের হাতে চাবুক, বন্দুক, ছুরি এবং নানা রকম অস্ত্র রয়েছে। তারা দাসদের কাজ দেখাশোনা করছে, সেই সাথে কেউ যেন সোনা নিজের পকেটে ভরতে না পারে সেদিকে নজর রাখছে।”
স্টকেড-এর ভেতরে লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি কতগুলো কুড়েঘর রয়েছে। দাসদের দলকে সেই কুড়েঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটাই হচ্ছে। তোমাদের থাকার জায়গা।” কাপেলো তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এটাই তোমাদের শেষ বাড়ি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তোমাদের এখানেই থাকতে হবে। শীঘ্রই তোমাদের শেকল খুলে দেয়া হবে। তারমানে এই নয় যে তোমরা মুক্ত। আমি তোমাদেরকে শেষবারের মতো মনে করিয়ে দিচ্ছি যে তোমরা কেউ যদি পালানোর চেষ্টা কর তবে সেটার শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। শীঘ্রই তোমাদের খাবার দেয়া হবে। যতটা পার খেয়ে নাও। কারণ আগামীকাল সকাল পর্যন্ত তোমাদের কোনো খাবার দেয়া হবে না। বরং ঐ অবস্থাতেই সকাল বেলা তোমাদেরকে কাজে লাগিয়ে দেয়া হবে।”
এরপর তাদের হাত এবং গলা থেকে শেকল খুলে দেয়া হয়। কাঠের বাটিতে তাদেরকে তরল জাতীয় এক ধরনের মিশ্রণ খেতে দেয়া হলো। হাল কেপ কলোনীতে থাকার সময় এইটুকু শিখেছে যে শ্রমিকদের কখনো খাবার ফিরিয়ে দিতে নেই তা সে যতই খারাপ হোক না কেন। সেই সাথে দ্রুত সময়ের মধ্যে খাবার শেষ করে ফেলতে হয় যেন খাবারের বিস্বাদটা মুখে লেগে না থাকে।
কুড়েঘরের ভেতরে কোনো বিছানা বা কোনো বাঙ্ক দেখতে পেল না সে। শুধু প্রায় ছয়ফিট লম্বা দুটো কাঠের টেবিল রাখা আছে ওখানে। টেবিল দুটি ঘরের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। যখন তারা সেখানে উপস্থিত হলো, তখন জায়গাটা তাদের সবার জন্য অপ্রতুল মনে হচ্ছিল। কিন্তু এরপর যখন আরও পঞ্চাশ জন দাস প্রবেশ করে নতুন আগত দাসদের সরিয়ে নিজেদের জায়গা করে নিতে থাকে তখন কুড়ে ঘরটার অবস্থা দাসভর্তি জাহাজের চেয়েও খারাপ মনে হচ্ছিল। হাল নিজেকে সরাতে সরাতে একেবারে দেয়ালের কাছে নিয়ে যায়। তার পাশের লোকটা তাকে এমনভাবে ধাক্কা দিতে থাকে যে একটি পেশিও নাড়াতে পারছে না সে।
কিন্তু এটাও তার কাছে কোনো ব্যাপার মনে হয় না। কারণ অবশেষে হাল সেই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে যেখানে তার জুডিথকে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও তাদের মাঝে এখন মাত্র কয়েকগজের দূরত্ব; কিন্তু হাল-এর মনে হচ্ছে দূরত্বটা কয়েক হাজার মাইলের। কিন্তু হাল এই দূরত্ব দূর করবে। হয়ত কয়েক সপ্তাহ সময় লাগবে, এমনকি কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে কিন্তু সে জুডিথকে উদ্ধার করেই ছাড়বে।
এসব চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে রেখে সে দুচোখ বন্ধ করে ফেলে। কেপ কলোনীতে থাকার সময় সে আরেকটা শিক্ষা লাভ করেছে তা হলো যেখানেই বা যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে একটু ঘুমিয়ে নিতে হবে। বেচে থাকার জন্য ঘুম খাবারের মতই জরুরি।
.
বুজার্ড এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিবাদী বিয়ের পাত্রীর সম্মুখীন হয়েছে। “এই পোশাকটা পরে নিন, নয়ত…”
“নয়ত কী?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল। তুমি তোমার এক হাত দিয়ে কী করতে পারবে? আঘাত করবে? আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতে পারব। তুমি কোনো দাসকে ডেকে আনবে চাবুক মারার জন্য? কিন্তু তাতে সেনোর লোলবার কাজের অপচয় হবে, যেটা সে হতে দেবে না। আমাকে হত্যা করবে? কিন্তু আমার মৃতদেহ থেকে তুমি কত টাকা আয় করতে পারবে?”
“এসব অনর্থক কথা বলা বন্ধ করুন। আপনি এখন কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই। শুধু বিছানা ছাড়া অন্য কোনো কাজে মাননীয় লোবোর নারীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটা দাসকে সে কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। যখন বিয়ের ঘণ্টা বাজানো হবে তখন তৈরি হয়ে নিচে নেমে পড়বেন। নয়ত আপনি আপনার ফল ভোগ করবেন।”
এরপর বুজার্ড চেয়ারে বসে পড়ল। আঙুল দিয়ে শব্দ করে তার দাসকে ডেকে বলল আরও ওয়াইন দিয়ে যাওয়ার জন্য। “তাহলে”, বুজার্ড উচ্চ স্বরে আবারও বলতে শুরু করল। “আর মাত্র একঘণ্টার মধ্যে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন জীবন বেছে নেবেন। মাননীয় লোবোর সাথে বিলাসী জীবন নাকি সেই নোংরা ব্রিটিশ দাসটার সাথে কঠিন জীবন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বুঝতে পারছি না কেন আপনার মনকে ঠিক করতে এতটা সময় লাগছে। আমি যদি আপনার জায়গায় হতাম তবে এমন বিলাসী জীবন পেলে বৃদ্ধ মাতাল লম্পটটাকে যা খুশি করতে দিতাম।”
দাসদেরকে যে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে তার প্রবেশপথে দুজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে। তারা বিপরীত দিক থেকে হেঁটে একজন আরেক জনকে অতিক্রম করছে। অ্যামাডোডা সৈন্যরা একটু দূরে বাওবাব গাছের আড়ালে লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। তাদের হাতে শক্ত কাঠ দিয়ে তৈরি তীক্ষ্ণ ছুরির ন্যায় অস্ত্র রয়েছে যেটাকে বলা হয় নবকেরি। গার্ডটা হাঁটতে হাঁটতে যখন বাওবাব গাছের সামনে আসলো তখন একজন অ্যামাডোডা তার হাতের তীক্ষ্ণ কাঠের টুকরাটাকে গার্ডটার মাথা বরাবর ছুরে দিল। মাথায় আঘাত লাগার ফলে লোকটি নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করল।
এরপর একজন অ্যামাডোডা ছায়া থেকে বের হয়ে এসে গার্ডটাকে টানতে টানতে গাছের পেছনে নিয়ে গেল। তারপর গলায় ছুরি বসিয়ে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করল সে।
কয়েক মিনিট পরে দ্বিতীয় গার্ডটা যখন হাঁটতে হাঁটতে বাওবাব গাছের কাছাকাছি চলে আসলো তখন সে হতভম্ব হয়ে এদিকে সেদিক তাকাতে লাগল। হঠাৎ করে তার সহযোদ্ধা কোথায় হারিয়ে গেল সেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
ঠিক তখনই একজন অ্যামাডোডা তার হাতে ধরা নবকেরিটা পূর্বের ন্যায় গার্ডটার দিকে ছুরে দিল। ফলাফল একই হলো।
গেট-এর অন্যপাশে দাঁড়ানো গার্ডগুলোও অ্যামাডোডাদের উপস্থিতি বুঝতে পারল না-যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিঃশব্দে গিয়ে গার্ডগুলোর গলায় ছুরি বসিয়ে দিল। মৃতদেহগুলোকে টানতে টানতে কাটাগাছের ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেল ওরা। এরপর দুজন অ্যামাডোডাকে বাইরে পাহারায় দাঁড় করিয়ে অ্যাবোলি বাকি অ্যামাডোডাদের নিয়ে কুড়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করল। তারা সবাই ঘুমন্ত দাসদের ভেতরে তাদের ক্যাপ্টেনকে খুঁজতে থাকে।
অ্যাবোলির উপস্থিতিতে দু-একজন দাস ঘুম থেকে জেগে উঠে।
“তোমাদের কোনো ভয় নেই”, অ্যাবোলি পরিষ্কার সাওহিলি ভাষায় নিচুস্বরে দাসদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে। যদিও এটা তাদের মাতৃভাষা নয় কিন্তু আফ্রিকার প্রায় সব লোক এই ভাষা বুঝতে পারে। “আমি সেই সাদা লোকটাকে খুঁজছি যে আজকে এখানে এসে পৌঁছেছে। আমাদের মনিব মাননীয় লেবো তার ব্যাপারে খুবই কৌতূহলী। তিনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তোমরা কী বলতে পার আমি তাকে কোথায় পেতে পারি?”
সবাই দেয়ালের পাশে ঘুমিয়ে থাকা দাসটাকে দেখিয়ে দেয়। আরও কয়েকজন দাস জেগে উঠে এবং কথা বলতে শুরু করে। দু-একজন এতরাতে বিরক্ত করার জন্য রেগে উঠে এবং উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকে।
“চুপ কর সবাই”, তোমাদের কথায় অন্য কুড়েঘরে, ঘুমিয়ে থাকা তোমাদের ভাইয়েরা জেগে উঠবে। একথা বলার পর অ্যাবোলি হাল-এর বাহু ধরে টানতে টানতে বের করে নিয়ে আসে।
“আমরা যদি চুপ না করি তাহলে কী হবে? ওরা কেউ আমাদের ভাই নয়।” একজন তর্ক করতে থাকে। “তোমরা কারা? আমি তোমাদেরকে চিনি না।”
পরিস্থিতি আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠিক আছে, “ঠিক আছে। আমরা এখন যাচ্ছি।” অ্যাবোলি এই কথা বলার পর হালকে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে থাকে। একজন দাস উঠে এসে তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পেছন থেকে একটা নবকেরি এসে তার মাথাটাকে এফোড় ওফোঁড় করে দিল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন অ্যামাপোড়া সেই নবকেরিটা নিক্ষেপ করেছিল।
“দৌড়াও!” অ্যাবোলি ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলে উঠল। তাদের দুজনের দেখা হওয়ার অনুভূতি বা আবেগ প্রকাশ করার সময় এখন নয়। পরে হয়ত সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু তার পূর্বে তাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।
অ্যাবোলির হাতে একটা পাঙ্গা ছোরা রয়েছে যেটা সে একটু আগেই হত্যা করা একজন গার্ডের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। সেই পাঙ্গাটা সে হাল-এর হাতে দিল। এই সময়ের মধ্যে হাল আর অ্যাবোলি গেট-এ পৌঁছে গেল। হাল পেছন থেকে শুনতে পায় যে কুড়ে ঘরে সে ছিল সেখান থেকে দাসেরা বের হয়ে চিৎকার করছে, “আমরা মুক্ত। আমরা এখন মুক্ত।”
চিৎকার-এর শব্দ ছাপিয়ে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পেল সে। হাল আর অ্যাবোলি এতক্ষণ কোনো সমস্যা ছাড়াই ব্যারাকের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু দাসদের চিৎকার-চেঁচামেচির কারণে তা আর হলো কই? সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠা গার্ডদের একজন পেছন থেকে চিৎকার করে উঠল, “ওদেরকে ধরতে হবে। ঘোড়া নিয়ে আস।” যদিও ওদের কয়েকজন ঘোড়া আনতে চলে গেল, তবুও পায়ের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। এরপর আরেকটা গুলির শব্দ শোনা যায়, সেই সাথে একজন অ্যামোডোডা চিৎকার করে উঠে মাটিতে পড়ে যায়।
“থামবে না, গাল্ডওয়েন!” অ্যাবোলি চিৎকার করে উঠল। “আমাদের এখন তার জন্য কিছুই করার নেই।”
হাল কোনো উত্তর দেয় না। তারা পেছন থেকে একের পর এক বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পায়। সম্ভবত দাসেরা বিদ্রোহ শুরু করেছে এবং এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। তবে এসব কিছু নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা হাল-এর নেই। এখন তার একমাত্র চিন্তা হচ্ছে একের পর এক পা ফেলে কীভাবে সামনে এগুবে। তার পায়ের পেশিগুলো জ্বালাপোড়া করছে। বুক ধড়ফড় করছে। সে তার সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
আর ঠিক তখনই সে দেখতে পেল লম্বা কিছু একটা অন্ধকারের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসছে। তার উদ্যম ফিরে এলো। এখনো তাহলে আশা আছে!
*
লোবোর ব্যক্তিগত দুর্গে বাধ্য হয়ে বিয়ের পোশাক পরতে রাজি হয়েছে জুডিথ। যদিও বার বার ব্যবহারের ফলে পোশাকটাতে নোংরা কাদামাটি, ময়লা লেগে আছে। কিন্তু সেটা খুব বেশি কিছু নয়। বুজার্ড যে যুক্তি দাঁড় করিয়েছে-যদিও তার এটা মানতে ঘৃণা হচ্ছে সেটা তর্কের বাইরে। যতদিন পর্যন্ত সে এই ব্যক্তিগত রাজত্বের শাসন মেনে নিবে সে ততদিন পর্যন্ত একটা আশা বেঁচে থাকবে। কিন্তু সে যদি এই দাসত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করে তাহলে আর কোনো আশাই অবশিষ্ট থাকবে না।
কিন্তু তখনই সে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পায়। মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে যে এটা গুলির আওয়াজ। এরপর একের পর এক কয়েকটা গুলির আওয়াজ হয়। তারপর অনেক গুলির আওয়াজ একত্রে পাওয়া যায়। আস্তে আস্তে গুলির আওয়াজের শব্দ, কম্পন এবং সংখ্যা বাড়তে থাকে। হঠাৎ জুডিথ-এর মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো। সারা আফ্রিকাতে সে-ই সম্ভবত একমাত্র মেয়ে যে বিয়ের সাজে বসে বসে গুলির আওয়াজের হিসাব করছে।
বাইরে কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। বুজার্ড তাকে বলল, “এখানে থাকুন। আপনার নিরাপত্তার জন্য আমি গিয়ে দেখে আসছি বাইরে কী ঘটছে। আবারো বুজার্ডের কথার সাথে তর্ক করার মতো কোনো কিছু সে খুঁজে পেল ।
হাল সামনের দিকে ইশারা করল। অ্যাবোলি বুঝতে পারল যে হাল কী। দেখাতে চাচ্ছে। ড্রব্রিজটার দুপাশে যে গেটপোস্ট রয়েছে সেটা রাইনোর খাঁচা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। টানা দেয়া ব্রিজটা থেকে একটা রশি ঝুলে আছে যেটাতে টান দিয়ে ব্রিজটাকে উপরে উঠানো যায় এবং নিচে নামানো যায়। দড়িটা আবার একটা কপিকল-এর সাথে প্যাচানো আছে। হাল কোনোভাবে কপিকলের কাছে। পৌঁছে দড়িটা টান দিয়ে ধরল। অ্যাবোলি আর অ্যামাডোডারা সবাই মিলে হাল-এর চারদিকে প্রাচীর তৈরি করল।
অনেকদিন এর রোদ, বৃষ্টিতে রশির তণ্ডুগুলো আরও শক্ত এবং মজবুত হয়েছে। বারবার চেষ্টা করেও পাঙ্গার ব্লেড দিয়ে সে রশিটা কাটতে পারছিল না। ওদিকে প্রায় বিশগজ দূরে প্রতিপক্ষের সৈন্যরা তাদের মাক্সেটকে গুলি করার জন্য প্রস্তুত করছে।
কার্তুজ-এর মুখে ওরা কামড় বসিয়েছে তাড়াতাড়ি। প্যান-এর মধ্যে গান পাউডার ভরছে। কিন্তু দড়িটা এখনো কাটছে না।
মাক্সেট-এর ব্যারেল-এ হাত বসিয়েছে শক্ররা। আর এরপরেই গান ফায়ার-এর শব্দ শোনা গেল।
“ইয়েস!”
তারা অবশেষে দড়িটা কাটতে পেরেছে। ড্রব্রিজটা নিচে নেমে এসেছে। অ্যামাডোডারা ওদের অবস্থান ছেড়ে বিজ্রের ওপর দিয়ে দৌড়ে রাইনোর খাঁচার দিকে যেতে থাকে।
ওদের পেছনে একের পর এক বন্দুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।
ওরা কাজটা করতে পেরেছে। ওদের উদ্দেশ্য এখন একটাই-রাইনোটাকে জাগিয়ে তোলা।
.
রাইনোসোরাস-এর চোখের দৃষ্টি খুবই ক্ষীণ। কিন্তু তার শ্রবণ এবং ঘ্রাণশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। তাই এটা দিনের বেলায় যেমন বিপদজনক রাতের বেলায়ও ঠিক তেমনই। দিন এবং রাতের যে-কোনো ঘণ্টায় যে-কোনো মুহূর্তে এটা সমান তালে আক্রমণাত্মক এবং ভয়ঙ্কর।
ওটা হয়ত অ্যাবোলির তলোয়ার-এর নড়াচড়া দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু আফ্রিকান লোকটার বনের ভাষা তার ইন্দ্রিয়কে ঠিকই জাগিয়ে তুলেছে।
সম্ভবত রাইনোটা বুঝতে পেরেছে যে তাকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে। তাই সে তার পাঁচ ফিট লম্বা শিংটা নাড়িয়ে অ্যাবোলিকে স্যালুট জানিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল। এরপর ওটা অ্যাবোলির দিকে সোজা তেড়ে এলো। চিতাবাঘের মতো লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল অ্যাবোলি, এরপর উদ্ধত চিতার ন্যায় আবারো দাঁড়িয়ে পড়ল। জানোয়ারটা হয়ত হাল-এর সমস্ত হাড় মাংস গুড়ো করে দিত যদি না সে সময় মতো সরে যেত।
জন্তুটা কাদামাটির ওপর দিয়ে বিশালকার পা ফেলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অ্যামাডোডাদের মাঝখান দিয়ে ড্রব্রিজটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ওদিকে হাল এবং অ্যামাড়োডোদের খুঁজতে আসা লোকগুলো ততক্ষণে দেরি করে ফেলেছে। তারা বুঝে ফেলেছে যে তাদের ভাগ্যে কি ঘটতে যাচ্ছে। তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পেছন থেকে এগিয়ে আসা জনতার ভিড়ে সেটা সম্ভব হলো না।
ব্রিজটার ওপর যখন রাইনোর পা ফেলার শব্দ লোবোর লোকদের কানে গিয়েছিল তখনই তারা বুঝে ফেলেছিল যে তাদের জীবনের শেষ ঘণ্টাধ্বনি বেজে গিয়েছে। জটা তার শিংটা নিচু করে একজনের পেটে ঢুকিয়ে তাকে ছুরে ফেলে দিল। রাইনোটা কিছুসময়ের জন্য থেমে চারপাশটা বোঝার চেষ্টা করল। এরপর ওটা নাক দিয়ে শব্দ করতে করতে চারদিকে ঘুরতে থাকে। তারপর জন্তুটা তার মাথা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে থাকে যেন ওটা মাথা দিয়ে সমস্ত মাটি সরিয়ে ফেলবে।
লোবোর একজন লোক চিৎকার করে উঠল “এখনি!” এরপর তারা অনেক বল্লম একের পর এক নিক্ষেপ করল। কিন্তু বল্লমগুলো জন্তুটাকে আরো বেশি উত্তেজিত করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে পারল না। জন্তুটা রেগে গিয়ে আগত লোকজনের ওপর এমনভাবে শিং চালাতে থাকল যেন মাটির ওপর দিয়ে লাঙল চষে যাচ্ছে।
এরপর আরেকবার লোবোর লোকেরা বন্দুক চালাতে শুরু করল। এতে করে জটা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। গার্ড এবং দাসদের ছাউনির দিকে দৌড়াতে শুরু করেছে সে।
হাল, অ্যাবোলি এবং অ্যামাডোডারা দেখতে পায় তাদের আশেপাশে লোবোর কোনো লোক নেই। লোবোর দুর্গ এবং তাদের মাঝে এখন আর কোনো বাধা নেই। তারা ফিরে এসে পুনরায় টানা দেয়া ব্রিজটার ওপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। হাল অ্যাবোলির দিকে দেখিয়ে বলল, “দেখ! ওরা সবাই উপরে জড়ো হয়েছে।”
অ্যাবোলি মুখে একটা আফ্রিকান হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, “তারা নিচে রাইনোটার দিকে তাকিয়ে আছে আর দেখছে যে কিভাবে তাদের লোকেরা রাইনোটার নিচে পদদলিত হয়ে মারা যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ, ওদের কপাল ভাল যে এসময় তারা নিচে নেই। কিন্তু ওরা এখানে জড়ো হওয়ার কারণে দুৰ্গটার তিন দিকেই এখন আর কোনো পাহারা নেই।”
তারা দুর্গের দূরের পথ দিয়ে দৌড়াতে থাকে। তাদেরকে এখনো কেউ দেখতে পায়নি। দাস বিদ্রোহ কতক্ষণ স্থায়ী হবে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা হালকে অতিরিক্ত সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা দুর্গের কাছাকাছি চলে এসেছে। এমন একটা দেয়ালের কাছে তারা পৌঁছল যেখানে কোনো পাহারাদার দেখতে পাচ্ছে না সে। অ্যাবোলি বলল, “আমাকে প্রথমে যেতে দাও, গান্ডওয়েন। আমার গায়ের রং দেখে কেউ বুঝতে পারবে না।”
হাল সম্ভবত সেটা শুনতে পায় নি। “আমার প্রথমে যাওয়া উচিত অ্যাবোলি।” হাল বলে উঠল, যেন বুঝাতে চাইলে যে সে সবার সামনে না থেকে সবাইকে ভালভাবে গাইড করতে পারবে না। সে দড়ি এবং হুকটা অ্যাবোলির কাছ থেকে নিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে দিল। এরপর সে পাঙ্গাটা কোমড়ের বেল্টে খুঁজে রাখল। তারপর সে চাঁদের দিকে তাকিয়ে পরবর্তী মেঘের খণ্ডে চাঁদটা ঢেকে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগল।
মেঘ চলে এসেছে। এখনই তাকে কাজটা করতে হবে।
সে অমসৃণ মাটির ওপর দিয়ে দুর্গের দেয়ালের দিকে দৌড়াতে থাকে। যে লোক মাস্তুলের ওপর উঠে অভ্যস্ত তার কাছে এটা কোনো উচ্চতাই নয়। সে জানে সে এটার ওপর উঠতে পারবে। সে হোয়াইটওয়াশ করা মাটির দেয়ালের দিকে সর্বোচ্চ উচ্চতায় লাফ দিল।
হাল কান পেতে কোনো মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কি-না তা শোনার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু, সৌভাগ্যবশত দেয়ালের উপরের লোকেরা তাদের পেছনের বিপদ সম্পর্কে অসচেতন। হাল ছায়ার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। তার বক্ষপিঞ্জরের নিচে হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। হাল পেছন ফিরে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে হা-সূচক মাথা নাড়ায়। এরপর রশিটা নিয়ে হুকটাকে এক, দুই, তিনবার ঝুলিয়ে ওপর দিকে ছুঁড়ে দেয় দেয়ালের উপরে।
সতর্কতার সাথে রশিটাকে টানতে থাকে হাল। রশিটা আসতে আসতে এক পর্যায়ে থেমে যায়। তার মানে হুকটা দেয়ালের সাথে আটকে গিয়েছে। আর এটাই হাল-এর প্রয়োজন। সে উঠতে শুরু করে। উঠতে উঠতে যখন একেবারে দেয়ালের চূড়ায় পৌঁছে যায় তখন সে তার পাঙ্গাটা কোমড় থেকে টেনে হাতে নেয়। এরপর সে তার বামহাতটা মুখের ওপর গোল করে রেখে নিশাচর পাখির মতো ডাক দেয়-এটা এক ধরনের সিগন্যাল যার অর্থ হল তারা এবার হালকে অনুসরণ করতে পারে। হাল মাথা নিচু করে একা একা দেয়ালের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে এবং মাথা ঘুরিয়ে দেখে যে অ্যাবোলিরা প্রায় সবাই দেয়ালের ওপর উঠে গিয়েছে।
কিন্তু তখনই দেয়ালের ওপারের উঠোনে দাঁড়ানো লোবোর একজন লোক সবকিছু দেখতে পেল। সে দেখতে পেল যে দেয়ালের ওপর দিয়ে ছায়ার মতো কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। সে চিৎকার দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। সাথে সাথে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। দেয়ালের শেষ মাথায় হাল একটা সিঁড়ি দেখতে পায়। সিঁড়ির নিচ থেকে লোবোর সৈন্যদের একজন তলোয়ার হাতে হাল-এর দিকে এগিয়ে আসছে। হাল দেয়াল থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে লোকটির তলোয়ার ধরা হাত নিজের বাম হাত দিয়ে ধরে ডান হাতে লোকটির মুখে আঘাত করল। এরপর পাঙ্গা দিয়ে লোকটিকে মেরে বসলো সে।
“গান্ডওয়েন”, অ্যাবোলি চিৎকার দিয়ে ওঠে। হাল ঘুরে তাকিয়ে দেখে দ্বিতীয় আক্রমণকারী তার দিকে তেড়ে আসছে। সে যদি সময়মত সরে না যেত তাহলে আক্রমণকারীর তরবারি তার বুকের পাঁজর ভেদ করে চলে যেত। সে ভেতরের দিকে সরে গিয়ে নিজের তরবারির বাঁট দিয়ে আক্রমণকারীর মুখে আঘাত করল। এরপর আরও একজন তার দিকে তেড়ে আসতে থাকল। একপাশে সরে গিয়ে নিজের তরবারিটা লোকটির গলায় বসিয়ে দিল হাল। অ্যাবোলি তিনজন আক্রমণকারীকে প্রতিহত করল, আর একজনকে মেরেই ফেলল। তখনই হাল শুনতে পেল বুজার্ড তার নাম ধরে গর্জন করে উঠছে এবং একজনের মাথার ওপর দিয়ে নিজের তলোয়ারটা তাক করে আছে। লোবোর লোকেরা তাদের দুজনের মাঝে ভিড় করে হাল–এর সাথে যুদ্ধ করছে। হাল যদি যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে না যায় তবে বুজার্ড তার কাছে আসতে পারবে না।
তখনই দুটি গুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। হাল-এর পেছন থেকে এগিয়ে আসা গুলি দুটি তার কানের পাশ দিয়ে চলে গেল। সেই সাথে বন্দুক হাতে লোবোর দুজন লোক ছাদের ওপর থেকে পড়ে গেল।
হাল ঘুরে তাকিয়ে গুলির আওয়াজ-এর উৎস খুঁজতে থাকে। আর সাথে সাথে তার মন আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল।
সেখানে জুডিথ দাঁড়িয়ে আছে!
জুডিথ তার রুমের ছাদের ওপর দিয়ে পায়ের আনাগোনা শুনেই বুঝতে পেরেছিল যে তাকে উদ্ধার করতে হাল পৌঁছে গিয়েছে। সে তখন আশেপাশে খুঁজে সুবিধামত পোশাক পেয়ে নিজের পোশাকটা দ্রুত পাল্টে ফেলল। কারণ সে জানে তাকে যদি আফ্রিকার জঙ্গল দিয়ে দৌড়াতে হয় তবে এই পোশাক মোটেও উপযুক্ত নয়।
সে যখন দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি দেয়, তখন দেখতে পায় হাল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর পাশে অ্যাবোলিও ছিল। আশেপাশে পরিচিত অ্যামাড়োডাদের মুখ দেখতে পায় জুডিথ।
জুথিড-এর পায়ের কাছেই লোবোর একজন লোক মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। তার হাতে একটা তলোয়ার এবং বেল্টে দুটি পিস্তল আটকানো আছে। জুডিথ একটা পিস্তল উঠিয়ে চল্লিশ ফিট উপরে ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া একজন সৈন্যকে গুলি করে দিল। সে মাটিতে পড়ে যাওয়ার পূর্বেই দ্বিতীয় পিস্তলটি উঠিয়ে আরেকজনকে গুলি করল জেনারেল জুডিথ নাজেত।
এই মুহূর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, স্বয়ং হাল! জুডিথকে দেখে আনন্দে চিৎকার করছে সে। অ্যাবোলি এবং অ্যামাডোডারা যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। যদিও লোবোর সারা দুর্গেই যুদ্ধ লেগে গিয়েছে কিন্তু এ অংশটুকু তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
বুজার্ড সবসময়ই একটু সুবিধাবাদী চিন্তা-ভাবনা করে-ঠিক যেমনটা সে এতদিন করে এসেছে। সে বুঝতে পারছে যে পরিস্থিতি কার্টনির পক্ষে চলে যাচ্ছে। নিজের চামড়া বাঁচানোর জন্য এখন তার যার কথা মাথায় আসছে সে হচ্ছে বালথাজার লোবো। প্রিন্স জাহানের সাথে শত্রুতা তৈরির পর এখন তার একজন শক্তিশালী বন্ধু প্রয়োজন। সে যদি বিয়ের পাত্রী এনে দিয়ে লোবোর মন জয় করতে না পারে তাহলে অন্তত তার রোগা চর্মসার ঘাড়টা বাঁচিয়ে তার মন জয় করতে হবে।
সে উঠান পার হয়ে লোবোর শোবার ঘরের দিকে দৌড়াতে থাকে। বুড়ো ছাগলটা কোথায় লুকিয়েছে কে জানে, কিন্তু যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। কিন্তু লোকটাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আর ঠিক তখনই সে কতগুলো কাঠের ডেস্কের পেছন থেকে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেল। “ক…কে ওখানে?”
“আমি স্যার, আর্ল অব কাম্রা। আমি আপনাকে বাঁচাতে এসেছি স্যার!” বুজার্ড উত্তর দেয়। তারপর লোবো যেখানে লুকিয়ে আছে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলে, “তাড়াতাড়ি স্যার”, “সময় থাকতে আমাদের এই বিল্ডিং ছেড়ে পালাতে হবে।”
বুজার্ড বৃদ্ধ খনির মালিককে নিয়ে বেরিয়ে আসে। বাইরে পা দিয়ে প্রথমেই কার্টনি এবং তার লোকেরা কোনদিকে আছে সেটা দেখে নিল।
মালিকের আগমনে লোবোর লোকেরা সাহস ফিরে পায়।
তারা আবারও নতুন উদ্যমে কার্টনি আর তার লোকদের পেছনে ধাওয়া করা শুরু করে দেয়।
হাল তাদেরকে দেখতে পেয়ে জুডিথ-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জুডিথ মৃত লোকটির কাছ থেকে গান পাউডার এবং পিস্তল নেয়ার চেষ্টা করছে। “না, ডালিং, ওটা ছেড়ে দাও”, সে বলে উঠে। “অস্ত্রের চেয়ে আমাদের এখন বেশি প্রয়োজন। হচ্ছে দ্রুত গতিতে পালিয়ে যাওয়া। চল এখনই পালাতে হবে এখান থেকে।”
“হ্যা”, অ্যাবোলিও যোগ দেয়। “আমাদের এখনই দৌড়ানো উচিত।”
.
যে দাস বিদ্রোহের সূচনা অ্যাবোলি করেছিল সেই দাস বিদ্রোহ সমাপ্ত হতে প্রায় সারাটা রাত লেগে যায়। যখন ভোরের আলো দেখা দেয় তখন বুজার্ড, লোবো এবং কাপেলোকে নিয়ে আলোচনায় বসে। সে বুঝতে পারে, যে লোকেরা কার্টনির পরে এখানে এসেছিল তারা সবাই নিশ্চয়ই কার্টনির জাহাজের লোক। তারা নিশ্চয়ই জাঞ্জিবার থেকে কার্টনির পিছু পিছু এসেছে। কোন উপকূলে কার্টনিকে নামানো হয়েছিল?”
“কোয়েলিম্যান-এ,” কাপেলো জবাব দেয়।
“তাহলে সেখানেই নিশ্চয়ই কোথাও গোল্ডেন বাউ নোঙর করা আছে। কাপেলো তুমি কী কোয়েলিম্যান-এর রাস্তা চেন?”
“অবশ্যই।”
“তাহলে, মাননীয় লোবো, আমি আপনার অনুমতি সাপেক্ষে বলছি যে আমাদের সেদিকে যাত্রা করা উচিত। আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য কার্টনিকে ধরে ফেলা। সেজন্য বাউ ছাড়ার পূর্বেই আমাদেরকে তার কাছে পৌঁছাতে হবে। আমি আপনার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি সেই মেয়েটাকে আপনার কাছে ফিরিয়ে আনবই।”
“তাহলে, আমার বিয়ের আশা এখনো আছে?” লোবো বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলল।
“অবশ্যই স্যার”, বুজার্ড তার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করল। কিন্তু “যদি কোনো কারণে জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে আমরা তার কাছে পৌঁছাতে না পারি তাহলেও আমরা আশা ছেড়ে দেব না। কারণ আমি জানি সে কোথায় যাবে। মাননীয় লোবো আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যদি আমি তাকে তার গন্তব্যস্থলে গিয়েও ধরতে পারি তবে কার্টনির মাথা, তার স্ত্রী আর সেই সাথে কার্টনির সমস্ত সোনাদানা আপনার সামনে হাজির করব।”
লোবোর মুখে ঝকঝকে হাসি ফুটে উঠে। “তার সোনাদানা? ওহ, তাহলে তো ভালই হয়।”