পিটারকে দেখে ভারি খুশি হলো স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড। স্পেনে কদিন থাকায় তার গায়ের চামড়া খানিক পুড়েছে, তবে আগের চেয়ে বেশ একটু মুটিয়েছে সে। এভাবে যদি ওজন বাড়তে থাকে, সমস্যায় পড়বে স্টিভেন। সাফল্যের এই এক বিড়ম্বনা, ভালো খাবার আর দামি ওয়াইন এড়িয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
লাঞ্চে বসে চোরাচোখে ভাইকে লক্ষ্য করল পিটার। দুজন প্রায় সমান লম্বা, তবে চওড়ায় স্টিভেন টেক্কা দেবে। রীতিমতো হাসিখুশি দেখাল তাকে, কোনো রকম উদ্বেগ আছে বলে মনে হলো না।
জঙ্গলে শেয়ালের উপদ্রব খুব বেড়েছে, লাঞ্চ শেষ হওয়ার পর লাইব্রেরিতে বসে ধূমপান করছিল ওরা, মৃদুকণ্ঠে কথাটা বলল পিটার। চাষীরা নাকি অভিযোগ করে গেছে, এভাবে চলতে থাকলে একটা মুরগিও নাকি বাঁচানো যাবে না।
তাই? বলল স্টিভেন, হঠাৎ উৎসাহী হয়ে উঠল সে। তাহলে তো ওদিকে একবার ঢু মেরে আসতে হয়। চল, যাবে নাকি?
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পিটার বলল, আপত্তি নেই, যেতে পারি।
পিটারকে নিয়ে গানরুমে লে এল স্টিভেন, র্যাক থেকে একটা শটগান নামাল, মুঠো ভর্তি কারট্রিজ ফেলল পকেটে।
এস্টেটের কোথাও কোথাও কাঁটাতারের বেড়া আছে, কোথাও আবার সীমানা একেবারেই চিহ্নিত করা হয়নি। তবে এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে জানে পিটার, চিনতে ভুল হয় না স্টিভেনের। নদীর কিনার ঘেঁষে পাশাপাশি হাঁটছে ওরা, রাস্তা যেখানে সরু সেখানে পিছিয়ে আসছে একজন, এক লাইনে হাঁটছে। স্টিভেনের হাতে শটগান, অর্থাৎ শেয়াল সেই মারবে, কাজেই তাকে সামনে থাকতে দেয়ার একটা অজুহাত রয়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে ওদের মধ্যে কোনো কথা হলো না।
একটা খরস্রোতা নালাকে পিছনে রেখে বাক নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল ওরা। স্পেন ভ্রমণ সফল হয়েছে, সেই আনন্দে বকবক করে চলেছিল স্টিভেন। সাগর পাড়ে আরো একটা হোটেল কমপ্লেক্স কেনার সমস্ত ব্যবস্থা চুড়ান্ত করে এসেছে সে। তার আগের হোটেলের ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর কাজও চলছে, বছর শেষ হবার আগেই পাঁচশ রুম তৈরি করা হবে।
কেনাকাটার এখনই সময় পিটার, পরামর্শ দেয়ার সুরে পিটারকে বলল সে। শিল্পপতিরা এতদিনে মোটা লাভের মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।
হ্যাঁ, মৃদুকণ্ঠে বলর পিটার। সম্ভবত তেলের দাম কমে যাওয়ায় ভাগ্য খুলে যাচ্ছে তোমাদের।
এ আর কি কমেছে, কাঁধের ওপর দিয়ে পিটারের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল স্টিভেন। আগামী মাসে আরো পাঁচ পার্সেন্ট কমবে বলে ধরে নিতে পার। এতদিনে পথে এসেছে আরবরা। তোমার যদি অলস কিছু টাকা থেকে থাকে, পিটার, এই কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে ফেল–এখনই সময়।
নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল পিটার। কি, ঠাণ্ডা?
না, মনে হলো যেন কবরের উপর দিয়ে কেউ হেঁটে গেল, বলল পিটার।
নিচু পাঁচিল টপকে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছে স্টিভেন, চোখ তুললেই রোমান ক্যাম্পের পেরিমিটার দেখা যাচ্ছে। তাকে অনুসরণ করল পিটার। ধ্বংসাবশেষকে পাশ কাটিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে শুরু করল ওরা। যখন উঠে এল, স্টিভেন হাঁপাচ্ছে। কিনারায় একটা গাছ, তার ছায়ায় দাঁড়াল ওরা।
গাছের গায়ে শটগানটা ঠেস দিয়ে রাখল স্টিভেন, কোমরে দুহাত রেখে তাকিয়ে আছে নিচের উপত্যকায়। চওড়া বুকটা ঘন ঘন ওঠা-নামা করছে তার। গাছের গায়ে হেলান দিল পিটার, হাত দুটো পকেটে নয়, কোটের ল্যাপেল ধরে আছে। দেখে মনে হচ্ছে পেশিতে কোনো টান নেই, আসলে প্যাঁচানো প্রিঙের মতো হয়ে আছে শরীরটা। ডান হাতের নাগালের মধ্যে রয়েছে শটগান।
আগেই লক্ষ্য করেছে পিটার, নাম্বার ফোর শট লোড করেছে স্টিভেন, দশ কদম দূরের একজন লোককে মাঝখান থেকে দুভাগ করে দেবে।
কোটের সাইড পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করল স্টিভেন। ব্যারনেস ম্যাগডার ব্যাপারটা সত্যি দুঃখজনক, গম্ভীর সুরে বলল সে, কিন্তু পিটারের চোখের দিকে তাকাল না।
হ্যাঁ, ফিসফিস করে বলল পিটার।
তবু ভালো যে নোংরা ঝামেলা পাকায়নি। তোমাকে ওরা অনায়াসে ফাসাতে পারত।
তা পারত, একমত হলো পিটার।
নার্সকোয় তোমার চাকরিটা কি…? প্রশ্ন শেষ না করে অপেক্ষা করে থাকল। স্টিভেন।
জানি না। ব্রাসেলসে না ফিরলে কিছু বোঝা যাবে না।
মুখে কখনো উচ্চারণ করিনি, পিটার, কিন্তু তুমি জানো কোনো রকম সাহায্য দরকার হলে আমাকে তুমি সব সময় পাশে পাবে, আন্তরিক কণ্ঠে বলল স্টিভেন।
ধন্যবাদ, স্টিভেন, শুকনো গলায় বলল পিটার।
ডানহিল লাইটার জ্বেলে সিগারেটটা এতক্ষণে ধরাল স্টিভেন। লম্বা টান দিয়ে আয়েশ করে করে ধোয়া ছাড়ল।
পিটার বলল, অল্টম্যানের শেয়ার কেনা নেই তো হে? একেবারে তলায় নেমে গেছে দর।
আশ্চর্যই বলতে হবে, মাথা নেড়ে হাসল স্টিভেন, কসপ্তাহ আগে সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছি, ফর গডস সেক। সান ইস্তাবানের জন্যে টাকার দরকার ছিল।
লাকি, বিড়বিড় করে বলল পিটার; কিন্তু আসলে তা নয়, জানে ও। একটু অবাক হলো, এত সহজে শেয়ার বিক্রির কথাটা স্বীকার করল কেন স্টিভেন? এক সেকেন্ড পর কারণটা মাথায় ঢুকল পিটারের ব্যাপারটা গোপন রাখা সম্ভব নয়, কে শেয়ার বিক্রি করেছে অনায়াসে খোঁজ করে বের করা যাবে।
চোরা চোখে স্টিভেনের দিকে তাকিয়ে পিটার ভাবল, স্টিভেন কি এত বড় একটা প্রতিভা যে এরকম জটিল একটা প্ল্যান করার যোগ্যতা রাখে? কি ব্যাপার, পিটার–অমন করে কি দেখছ? সামান্য একটু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল স্টিভেন।
ভাবছি, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। তোমার সে যোগ্যতা আছে কিনা সন্দেহ হয়।
দুঃখিত। বুঝলাম না। কি নিয়ে কথা বলছ?
খলিফা, একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল পিটার। চমকে স্থির হয়ে গেল স্টিভেন। পরমুহূর্তে তিরতির করে কেঁপে উঠল চোখের পাতা, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে সে।
দুঃখিত, এবারও তোমার কথা বুঝলাম না।
চমৎকার অভিনয়, মনে মনে প্রশংসা করল পিটার। না, স্বীকার করতে হয়, স্টিভেনের মধ্যে এমন কিছু গুণ আছে এতদিন যা ওর চোখে ধরা পড়েনি। অন্তত অভিনয়ে সে একটা জিনিয়াস।
হয়তো খলিফা হবার জন্যে আর যে সব গুণ দরকার তাও স্টিভেনের মধ্যে আছে।
তোমার একমাত্র ভুলটা ছিল, স্টিভেন, অল্টম্যানকে নিজের নামটা জানতে দেয়া, শান্ত কণ্ঠে বলল পিটার। আমার ধারণা, তুমি জানতে না অল্টম্যান মোসাড এজেন্ট ছিল, তোমার নামটা সরাসরি ইসরায়েলি ইন্টেলিজেন্সের কম্পিউটারে চলে যাবে। কারো সাধ্য নেই মেমরি রোল থেকে ওটা মুছে ফেলে। তুমি ফাঁস হয়ে গেছ, স্টিভেন।
চট করে একবার শটগানের দিকে তাকাল স্টিভেন। পিটারের নিশ্চিত হবার জন্যে আর কি প্রমাণ দরকার।
না, স্টিভেন। ওটা তোমার জন্যে নয়। মাথা নাড়াল পিটার। ওটা আমার কাজ। তোমার গায়ে চর্বি জমেছে, তাছাড়া ট্রেনিংও পাওনি। সে জন্যেই খুন করার কাজগুলো অন্য লোকদের দিয়ে করাতে হয় তোমাকে। অস্ত্রের দিকে এমনকি হাত বাড়ানোও উচিত হবে না তোমার।
শটগান থেকে পিটারের মুখে উঠে এল স্টিভে তার চেহারা এখনো বদলায়নি। ব্যাপার কি বল তো, কি বলছ?
তোমার অন্তত জানার কথা, যে কোনো মানুষকে খুন করার ক্ষমতা আমার আছে। তোমার কিছু কাজ সেই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে আমাকে।
হেঁয়ালি চিরকাল অপছন্দ করি, হেসে উঠে বলল স্টিভেন, যেন কিছুই হয়নি। কেন তুমি কাউকে খুন করতে যাবে, পিটার?
স্টিভেন, আমাদের দুজনকেই অপমান করছ তুমি। আমি জানি। কাজেই অস্বীকার করে কোনো লাভ হবে না। নিজেদের মধ্যে বসে এর একটা সমাধান খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। ফাঁদ, আপোসের টোপ ফেলে অপরাধ স্বীকার করাতে চাইছে পিটার। স্টিভেনের চোখে সন্দেহের ছায়া দেখল ও, সেও ভাবছে এটা ফাঁদ কিনা। ঠোঁটের কোণ একটু বেঁকে গেল, সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু প্লিজ, নিজের বিপদটাকে ছোট করে দেখ না, স্টিভেন, আবার বলল পিটার, পকেট থেকে কালো একজোড়া লেদার গ্লাভস বের করে পরল হাতে। সাধারণ একটা কাজ, কিন্তু কি যেন একটা ভয়ঙ্কর অর্থ আছে। গ্লাভস দুটোর দিকে পালা করে তাকাল স্টিভেন।
কি করছ তুমি? এই প্রথম একটু বেসুরা শোনাল স্টিভেনের গলা।
এখনো শটগান ছুঁইনি, বলল পিটার, নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বর। ওটায় শুধু তোমার হাতের ছাপ আছে।
গড, ভেবেছ আমাকে মেরে বাঁচতে পারবে তুমি?
কে জানবে? কাদা ভরা বা উঁচু নিচু জায়গা দিয়ে যেতে হলে লোড করা শটগান রাখতে নেই সাথে, সবাই জানে। সবাই বলবেও তাই।
তোমার দ্বারা সম্ভব নয়–এ রকম ঠাণ্ডা মাথায়, উঁহু, অসম্ভব! চেহারায় না হলেও, স্টিভেনের কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক।
তুমি পারলে আমি কেন পারব না। প্রিন্স হাশিদ আবদেল হায়েক-কে কি তুমি রাগের মাথায় খুন করেছিলে?
আমি তোমার ভাই, সে তো স্রেফ একটা রক্তচোষা জোক ছিল,বলে ফেলে হতভম্ব হয়ে গেল স্টিভেন, বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকল পিটারের দিকে, জানে এখন আর ভুলটা সংশোধন করার উপায় নেই।
স্টিভেনের ওপর চোখ রেখে শটগানের দিকে হাত বাড়াল পিটার।
থামো! আর্তনাদ করে উঠল স্টিভেন। পিটার, থামো!
কেন? অস্বাভাবিক শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল পিটার।
আমাকে অন্তত সব কথা ব্যাখ্যা করতে দাও।
বেশ, কি বলার আছে শুনি।
একটু সময় দাও আমাকে একটু ভাবতে দাও…ব্যাপারটা এত জটিল…।
ঠিক আছে, স্টিভেন। এসো শুরু থেকে আরম্ভ করি—জিরো-সেভেন-জিরো হাইজ্যাক থেকে। কেন, বল আমাকে।
আমরা একটা নির্দিষ্ট প্ল্যান ধরে কাজ করছি, পিটার, আবেগে কাঁপছে স্টিভেনের কণ্ঠস্বর। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রসঙ্গে বলি। দেশটায় ব্রিটিশ পুঁজি রয়েছে চার বিলিয়ন পাউন্ড, আরো রয়েছে তিন বিলিয়ন ডলার মার্কিন পুঁজি। যে সব দেশ সবচেয়ে বেশি সোনা আর ইউরেনিয়াম উৎপাদন করে, দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের অন্যতম। এ ধরনের আরো দশ রকম খনিজ লবণে সেরা ওরা। মাই গড, পিটার! দেশটার বর্তমান প্রশাসকরা আত্মহত্যার পথ ধরেছে। দেশটার শাসন ভার আমাদের হাতে আসা দরকার, আমরা তাহলে যোগ্য একজনকে দিয়ে নতুন প্রশাসন চালু করতে পারব। তা না হলে কমিউনিস্টরা গ্যাট হয়ে বসে পড়বে। আমরা কিভাবে তা হতে দিই, বল?
তোমরা তাহলে বিকল্প সরকার ঠিক করে রেখেছিলে?
অবশ্যই, দ্রুত, আবেগতাড়িত ভঙ্গিতে বলল স্টিভেন, দেখে নিল এখনো কোমরের কাছে শটগানটা ধরে আছে পিটার। সব দিক ভেবেই প্ল্যান করা হয়েছিল। দুবছর সময় কি আর এমনি লেগেছে?
ঠিক আছে, এবার প্রিন্স হাশিদ আবদেল প্রসঙ্গ।
ব্যাকুল হয়ে পিটারকে বুঝাতে চেষ্টা করল স্টিভেন, ওটা খুন ছিল না, পিটার। ফর গডস সেক! ইট ওয়াজ অ্যাবসলিউটলি নেসেসারি। ইট ওয়াজ এ ম্যাটার অভ সারভাইভাল। বখাটে বাচ্চাদের মতো দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে ওরা। ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, কোনো যুক্তি শুনতে রাজি নয়। তেলের দাম বাড়িয়ে ডলার, পাউন্ড, আর মার্কের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে ওরা। প্রতিদিন হুমকি দিচ্ছে আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের ব্যাংক থেকে নিজেদের সব টাকা তুলে নেবে—অর্থনীতি অচল করে দিতে চায় ওরা। কত দিন এই আতঙ্কের মধ্যে থাকতে পারে মানুষ? ওদের যাতে হুশ ফেরে তার অবস্থা তাই করতে হলো, এবং খুব সামান্যই ক্ষতি হলো ওদের। ধীরে ধীরে তেলের দাম এভাবে আমরা আরো কমাতে পারব ১৯৭০ সালের দরে ফিরে যেতে যেতে বাধ্য করব ওদের। এবং তেলের দাম কমে গেলে পশ্চিমা দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে উঠবে…
কয়েকটা প্রশ্ন আছে আমার।
কি প্রশ্ন, পিটার? কেমন যেন ক্লান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল স্টিভেন।
ডক্টর কিংস্টোন পার্কার আর ব্যারনেস ম্যাগডাকে খুন করার প্ল্যান কেন করা হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল পিটার।
পিটারের দিকে তাকিয়ে থাকল স্টিভেন, অনেকক্ষণ পর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল নিঃশব্দে। না, মৃদু কণ্ঠে বলল। ব্যাপারটা অন্য রকম।
এবং কেনই বা ব্যারনেস অল্টম্যানকে খুন করার দরকার পড়ল?
তার ব্যাপারটার সাথে আমি জড়িত নই-হ্যাঁ, জানতাম ঘটেছে, কিন্তু আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্তত খুনের সাথে সরাসরি আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ওহ্ গড, ঠিক আছে, জানতাম লোকটা মারা যাবে, কিন্তু… নিস্তেজ হয়ে একেবারে থেমে গেল গলার আওয়াজ, পিটারের দিকে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল স্টিভেন।
আবার প্রথম থেকে শুরু কর, স্টিভেন। সবটুকু শোনা যাক–প্রায় কোমল সুরে বলল পিটার।
না, পিটার–সম্ভব নয়। কি ঘটতে পারে তুমি বুঝবে না। সব তোমাকে বললে…
শটগানের সেফটি ক্যাচ অফ করল পিটার। নিস্তব্ধ পাহাড়ের ওপর ক্লিক শব্দটা অস্বাভাবিক জোরাল শোনাল। আঁতকে উঠল স্টিভেন, পিছিয়ে গেল এক পা। চোখ পিটপিট করছে সে, তাকিয়ে আছে পিটারের দিকে।
গড, ফিসফিস করে বলল সে। তুমি সত্যি খুন করবে আমাকে?
ব্যারন অল্টম্যান সম্পর্কে জানতে চাই আমি।
আরেকটা ধরাতে পারি, পিটার-সিগারেট?
মাথা ঝাঁকাল পিটার, কাঁপা কাঁপা হাতে সিগারেট ধরাল স্টিভেন। আমি ব্যাখ্যা করার আগে তোমার জানতে হবে সিস্টেমটা কি।
জানাও।
আমাকে রিক্রুট করা হয়।
মিথ্যে কথা বল না, স্টিভেন, বাধা দিল পিটার। তুমিই খলিফা।
নো, গড! নো, পিটার! সবটাই তুমি ভুল জানো, চেঁচিয়ে বলল স্টিভেন। এটা একটা চেইন। খলিফার চেইনে আমি স্রেফ একটা লিঙ্ক। আমি খলিফা নই।
তাহলে খলিফার একটা অংশ তুমি।
না, তাও নয়। চেইনের শুধু একটা লিঙ্ক।
শটগানের ব্যারেল এক চুল সরাল পিটার, লক্ষ্য করে আরো একটু বিস্ফোরিত হলো স্টিভেনের চোখ– বল।
একজন লোক, অনেক দিন থেকে চিনি। আগেও তার সাথে কাজ হয়েছে আমার। বিরাট ধনী আর প্রভাবশালী, তার তুলনায় আমাকে চুনোপুঁটি বলতে পার। ব্যাপারটা হঠাৎ করে বা রাতারাতি ঘটেনি। অনেক মাস, অনেক বছর ধরে ধরে কথা হয়েছে, বিতর্ক হয়েছে, অবশেষে মত পাল্টেছি আমি, তার আদর্শই ঠিক বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। একপর্যায়ে এই লোক আমাকে বলল, পশ্চিমা জগতের রাজনীতিক আর শিল্পপতিদের নিয়ে একটা সমিতি গঠন করা হয়েছে, যারা নিজেদের একটা পৃথিবীর স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছেন, আমি সমিতিতে যোগ দিতে চাই কিনা।
লোকটা কে, স্টিভেন?
পিটার, এ প্রশ্ন কর না!
উত্তর না দিয়ে তোমার উপায় নেই, স্টিভেন। পরস্পরকে দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল ওরা, এক সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্টিভেন।
বেশ। লোকটা হলো…, এমন এক লোকের নাম বলল স্টিভেন, আন্তর্জাতিক ব্যাবসায়ী মহলের সবাই তাকে এক ডাকে চেনে। মুক্তবিশ্বের বেশিরভাগ নিউক্লিয়ার ফুয়েল নিয়ন্ত্রণ করে লোকটা, সোনা কেনা-বেচায় তাকে ছাড়ানো প্রায় অসম্ভব, মূল্যবান পাথরের সবচেয়ে বড় স্টক রয়েছে তার।
জিরো-সেভেন-জিরো অপারেশন সফল হলে তাকেই তাহলে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতায় বসাতে তোমরা?
নিঃশব্দে মাথা ঝাঁকাল স্টিভেন।
বলে যাও।
আমার মতো তাকেও রিক্রুট করা। কিন্তু তাকে কে রিক্রুট করেছিল আমার জানা নেই। সমিতিতে আমি যোগ দিলাম, এবার আমার দায়িত্ব হলো ভালো একজন সদস্য জোগাড় করা–সে কে হবে তা কেবল আমি একাই জানব। চেইনের চিনবে–যে তাকে রিক্রুট করেছে, এবং সে যাকে রিক্রুট করল।
খলিফা? খলিফা সম্পর্কে বল।
কেউ জানে না কে সে।
কিন্তু সে জানে তুমি কে।
হ্যাঁ, অবশ্যই জানে।
তাহলে খলিফার কাছে মেসেজ পাঠাবার একটা উপায় তোমার থাকতে বাধ্য, বলল পিটার। ধরো, নতুন একজন সদস্যকে রিক্রুট করলে, খবরটা খলিফাকে জানাতে হবে তো? কিংবা তোমাকে কোনো নির্দেশ দিতে চায় সে, যোগাযোগ না করে দেবে কিভাবে?
হ্যাঁ।
কিভাবে?
গড, পিটার! এর মূল্য আমার জীবনের চেয়েও বেশি!
এ প্রসঙ্গে পরে ফিরে আসব আমরা, অধৈর্য হয়ে উঠে বলল পিটার। ব্যারন অল্টম্যান সম্পর্কে বল।
ব্যাপারটা লেজে-গোবরে হয়ে যায়, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। রিক্রুট করার জন্যে তাকে আমি নির্বাচন করি। মনে হচ্ছিল ঠিক তার মতো একজন লোকই আমাদের দরকার। অনেক বছর ধরে তার সাথে পরিচয়, জানা ছিল প্রয়োজনে অসম্ভব কঠোর হতে পারে সে। কাজেই তাকে আমি প্রস্তাব দিলাম।
প্রথমে খুব আগ্রহ দেখাল সে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জেনে নিল, বিশেষ করে খলিফার কাজের পদ্ধতি। তার মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে সমিতির সদস্য করতে যাচ্ছি, এই আনন্দে বগল বাজাচ্ছিলাম। আমাকে আভাস দিল, সমিতির ফান্ডে পঁচিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার চাঁদা দেবে সে। কাজেই খবরটা আমি খলিফার কাছে পাঠালাম। বললাম, ব্যারন অল্টম্যানকে রিক্রুট করতে যাচ্ছি নার্ভাস হয়ে থেমে গেল স্টিভেন, পাথরের ওপর সিগারেট ফেলে জুতোর তলা দিয়ে ঘষল।
তারপর কি হলো? তাগাদা দিল পিটার।
সাথে সাথে সাড়া পেলাম খলিফার। আমাকে হুকুম করা হলো, এই মুহূর্তে ব্যারন অল্টম্যানের সাথে সমস্ত যোগাযোগ কেটে দিতে হবে। বুঝলাম, নির্ঘাত আমি বিপজ্জনক এক লোককে রিক্রুট করতে যাচ্ছিলাম। আজ তোমার মুখ থেকে শুনলাম, ব্যারন মোসাড ছিল। আমি জানতাম না, কিন্তু খলিফা নিশ্চয়ই জানত।
তারপর তুমি কি করলে?
বুঝলাম অল্টম্যান আগুনের গোলা, কাজেই ফেলে দিলাম হাত থেকে। চারদিন পর কিডন্যাপ করা হলো তাকে। তাতে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না, পিটার। খোদার কসম, যীশু আর মেরীর কসম। লোকটাকে আমি পছন্দ করতাম, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল…
কাজটা যে খলিফার, আর তুমিও যে দায়ী, এটা বুঝেছিলে কি?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাথা নত করল স্টিভেন। হ্যাঁ।
অল্টম্যানকে টরচার করা হয় কেন? খলিফা সম্পর্কে তথ্য মোসাডকে সে বলে দিয়েছে কিনা জানার জন্যে, তাই না?
হ্যাঁ। মনে হয়। আমি জানি না।
অল্টম্যান সম্পর্কে যা শুনেছি তা যদি সত্যি হয়, ওরা তার মুখ খোলাতে পারেনি।
পারার কথা নয়। ব্যারন মচকাবার লোক ছিল না। সম্ভবত ধৈর্য হারিয়ে টরচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ওরা, আর তাতেই মারা যায় সে।
আচ্ছা, তুমি বুঝতে পারছ কি জঘন্য একটা ব্যাপারে জড়িয়েছ নিজেকে? মাথায় ঢোকে, গোটা ব্যাপারটা ঘৃণ্য?
শুরুতে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমিও তো চাই দুনিয়াটা সুন্দর হোক। তারপর দলে যোগ দেয়ার পর মনে হলো ঝড়ের বেগে ছুটছে ট্রেন, থামার কোনো উপায় নেই।
বেশ। তারপর তুমি কি করলে? বঁবুইলে রোডে খুন করার চেষ্টা করলে আমাকে জানতে পারি, আমার অপরাধ কি ছিল?
গুড গড, না! বিহ্বল দেখাল স্টিভেনকে। তুমি আমার ভাই, গুড় গড়-!
ব্যারনেস ম্যাগডা স্বামী হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাইছিল, আমি তাকে সাহায্য করতে যাচ্ছিলাম, খলিফা ব্যাপারটা টের পেয়ে আমাকে সরাবার ব্যবস্থা করে…।
এর আমি কিছু জানি না, প্লিজ পিটার, বিশ্বাস কর! খলিফা নিশ্চয়ই জানে তুমি আমার ভাই, সে যদি তোমাকে খুন করার প্ল্যান করে থাকে, আমাকে তো জানতে না দেয়ারই কথা।
বেশ, তাহলে বল এরপর তোমার অপারেশন কি ছিল?
কোনো অপারেশন ছিল না…
সাবধান, স্টিভেন, কঠোর সুরে বলল পিটার। মিথ্যে কথা বলবে না। প্রিন্স হাশিদ আবদেল খুন হবে, তুমি জানতে না?
জানতাম, হ্যাঁ, সব ব্যবস্থা আমাকে করতে হয়। খলিফা আমাকে হুকুম করেছিল।
তারপর তুমি মেলিসাকে কিডন্যাপ করাও, তার আঙুল কেটে…।
না-না-না-! তুমি জেনেশুনে কষ্ট দিচ্ছ আমাকে। গলা ভেঙে গেছে স্টিভেনের, জবা ফুলের মতো লাল হয়ে উঠেছে চোখ জোড়া।
আমি যাতে ডক্টর পার্কারকে খুন করতে বাধ্য হই…
না, পিটার, না!
তারপর তুমি চাইলে আমি যেন ব্যারনেস ম্যাগডাকেও খুন করি…
পিটার, তুমি আমার নিজেরই অংশ–তোমার বা তোমার প্রিয় কারো ক্ষতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বাস কর, প্লিজ বিশ্বাস কর! মেলিসাকে তুমি কি রকম ভালোবাসো আমি জানি। সত্যি বলছি, ওর ব্যাপারটায় খলিফার হাত আছে আমি জানতাম না। জানলে আমি বাধা দিতাম, অবশ্যই বাধা দিতাম…
পিটারের চেহারায় ভীতিকর নিষ্ঠুরতা ফুটে আছে। স্টিভেনের মনে হলো, এর কাছ থেকে ক্ষমা আশা করা বৃথা।
মেলিসার ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না, কথাটা প্রমাণ করার জন্যে তুমি যা বলবে তাই করব, পিটার-যে-কোনো ঝুঁকি নিতে আমি প্রস্তুত।
মৃদু মাথা ঝাঁকাল পিটার, যেন কি ঝুঁকি নিতে বলবে ভাবছে। দেখল, রক্ত নেমে গিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে স্টিভেনের চেহারা, ঠোঁট কাঁপছে। স্টিভেন যে মিথ্যে কথা বলছে না, বুঝতে পারল। একটাও কথা না বলে শটগানটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিল ও।
স্তম্ভিত হয়ে গেল স্টিভেন, হাত বাড়িয়ে শটগানটা ধরল বটে, কিন্তু হাত ফিরিয়ে নেয়ার কথা মনে থাকল না কিছুক্ষণ। তুমি মস্ত বিপদের মধ্যে আছো, স্টিভেন, শটগানটা বুকের সামনে এনে ভাজ করল, কার্ট্রিজগুলো বের করে পকেটে ভরল।
পুরো এক কেস হুইস্কি দরকার আমার। ভাঙা গলায় বলল স্টিভেন।
.
স্টিভেনের স্টাডি, ফায়ারপ্লেসে গনগনে আগুন জ্বলছে। স্টাডির জানালা দরজা ঘোড়শ শতাব্দীর, একটা জার্মান চার্চে ব্যবহার হত, স্প্যানিশ এক ডিলারের কাছ থেকে নিলামে কিনে সুইটজারল্যান্ড থেকে চোরা পথে আনিয়েছে স্টিভেন। জানালার বাইরে কাঁচমোড়া গোলাপ বাগিচা। স্টাডির দুদিকের দেয়ালে বুক শেলফ, প্রতিটি বই সোনালি এনগ্রেভ করা। ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্টিভেন, লকলকে শিখার দিকে পিঠ। আঁচ পাবার জন্যে কাঁধ থেকে নিচের দিকে একটু নামিয়ে দিয়েছে জ্যাকেট, হাতে ক্রিস্টাল টাম্বলার, এখনো হুইস্কিতে ভরে আছে অর্ধেকটা। কামরার আরেক প্রান্তে একটা ভিক্টোরিয়ান আমলের আর্ম চেয়ারে বসে আছে পিটার, পা দুটো কাশ্মীরী কার্পেটের ওপর লম্বা করা, হাত দুটো পকেটে ঢোকানো।
খলিফার যুদ্ধখাতে কত টাকা চাঁদা দিয়েছ? হঠাৎ জানতে চাইল পিটার।
ব্যারন অল্টম্যান আর আমি তো আর এক সারিতে পড়ি না, শান্তভাবে জবাব দিল স্টিভেন, পাঁচ মিলিয়ন স্টার্লিং দিতে বলা হয় আমাকে, ভাগ ভাগ করে পাঁচ বছরে দিয়েছি।
তার মানে খলিফা পুরানো পাপী!
স্টিভেন কোনো কথা বলল না।
তার মানে আন্তর্জাতিক সীমারেখা ছাড়িয়ে সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে তার সমিতি। সব দেশেই তার প্রভাবশালী সদস্য আছে, প্রত্যেকে মোটা টাকা চাঁদা দিচ্ছে, স্রোতের মতো চারদিক থেকে আসছে ইনফরমেশন…
মাথা ঝাঁকাল স্টিভেন। গাঢ় রঙের হুইস্কি খেল আরো এক ঢোক।
কোনো দেশে কজন সদস্য, সংখ্যাটা জানো?
মাথা নাড়ল স্টিভেন।
প্রতি দেশে একজন বা দুজন সদস্য আছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। হয়তো শুধু ইংল্যান্ডেই আছে বিশজন। জার্মানিতে আরো বেশি থাকার কথা। আর আমেরিকাতে বোধ হয় একশর ওপর…
সম্ভব।
কাজেই অন্য একটা লিঙ্ককে দিয়ে মেলিসাকে কিডন্যাপ করিয়ে থাকতে পারে…
তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে, পিটার, এ ব্যাপারটার সাথে আমি ছিলাম না।
অসহিষ্ণু একটা ভঙ্গি করে স্টিভেনের প্রতিবাদ এড়িয়ে গেল পিটার, আপন মনে কথা বলে উঠল, এমনো হতে পারে খলিফা হয়তো প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একটা কমিটি-একজন লোক নাও হতে পারে।
আমার তা মনে হয় না,–ইতস্তত করল স্টিভেন, প্রথম থেকে খুব জোরালো একটা অনুভূতি হয়েছে আমার, সে একা একজন। কোনো কমিটির পক্ষে এত দ্রুত আর দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব নয়।
চুপ করে তাকিয়ে থাকল পিটার, স্টিভেনকে কথা বলার সুযোগ দিতে চায়।
খলিফা সম্পর্কে মাত্র একজন লোকের সাথে আলাপ করার সুযোগ হয় আমার, যে আমাকে রিক্রুট করেছে। বুঝতেই পারছ, আস্থা না আসা পর্যন্ত পাঁচ মিলিয়ন স্টার্লিং দিতে রাজি হইনি আমি। খলিফার প্রভাব আর ক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা দেয়া হয় আমাকে। সে যে একা একজন মানুষ, তখনই আমি বুঝতে পারি। সমস্ত বিষয়ে সে একা সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সকলের স্বার্থে।
কিন্তু সব সদস্য তার সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারে না।
না। সবাইকে সব জানানো তো পাগলামি। সাফল্যের চাবিকাঠিই তো গোপনীয়তা।
জীবনে কখনো দেখনি, যার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে, তাকে তুমি এত টাকা দিয়ে বিশ্বাস করতে পার? বিশ্বাস করতে পার, পৃথিবীর মঙ্গল চায় সে? রাগ চেপে রেখে জিজ্ঞেস করল পিটার।
অবতারের মতো তার একটা প্রভা আছে, পিটার। তার জগৎত্রাতা ভূমিকায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। যে লোক আমাকে রিক্রট করেছিল তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। খলিফার প্রতি তার আস্থা দেখে আমিও…
এখন কি মনে হচ্ছে তোমার? এখনো কি তুমি তার প্রতি আস্থা রাখতে পারছ?
টাম্বলারের অবশিষ্ট হুইস্কি দুঢোকে খেয়ে ফেলল স্টিভেন, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ভেজা গোঁফ মুছল। নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে।
উত্তর দাও, স্টিভেন।
আমি এখনো মনে করি আইডিয়াটা ভালো… অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল স্টিভেন। আমরা একটা বাতিলযোগ্য দুনিয়ায় বাস করছি। আরেক ছাচে ফেলে এটাকে নতুন করে গড়ে তোলা সম্ভব…।
তুমি বলতে চাইছ খলিফা অসৎ লোক? তার মহৎ কোনো উদ্দেশ্য নেই?
আমি কেন বলব, তুমিই নিজেই বলেছ অল্টম্যান খুন হবার পর তার প্রতি বিশ্বাসে তোমার চির ধরে, বলল পিটার। তারপর মেলিসাকে কিডন্যাপ করে সে। বলতে পার, এর পিছনে কি মহৎ উদ্দেশ্য ছিল তার?
হ্যাঁ, মৃদুকণ্ঠে বলল স্টিভেন, তার এই দুটো কাজ অন্যায় হয়ে গেছে…
তার মানে খলিফা মানবজাতির মঙ্গলের জন্য নয়, নিজের স্বার্থে কাজ করছে, এটা বুঝতে পারছ?
আমি এখনো নিশ্চিত নই
এখন তাহলে বিশ্বাস হয় না যে লোকটা একটা শয়তান?
কিন্তু পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার একটা ব্যাপক পরিকল্পনা থাকা উচিত, এ আমি এখনো বিশ্বাস করি।
কিন্তু সে ধরনের কোনো পরিকল্পনা খলিফার নেই।
হয়তো নেই, তবে থাকলে ভালো হতো… থমথম করছে স্টিভেনের চেহারা।
তুমি বলেছ, মেলিসার কিডন্যাপিঙের ব্যাপারে জড়িত ছিলে না প্রমাণ করার জন্যে যে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি আছো। খলিফাকে বাধা দেয়ার কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করবে?
পিটারের চোখে চোখ রেখে স্টিভেন বলল, তুমি কিছু চাইলে সেটা না দিয়ে পারব না।
আমি তোমার সাহায্য চাইছি, বলল পিটার। কিন্তু তার আগে বুঝে দেখবিরাট ঝুঁকি নিতে হবে তোমাকে।
জানি। খলিফাকে আমি তোমার চেয়ে ভালো চিনি।
আমাকে দিয়ে কি করাতে চাও, পিটার?
খলিফার সাথে একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করবে তুমি—সামনাসামনি।
অসম্ভব! সাথে সাথে ধারণাটা বাতিল করে দিল স্টিভেন।
তুমিই না বললে তার কাছে মেসেজ পাঠাবার একটা উপায় আছে?
আছে, কিন্তু দেখা করার প্রস্তাবে খলিফা কখনোই রাজি হবে না।
আচ্ছা, স্টিভেন, বল তো খলিফার সবেচেয়ে বড় দুর্বলতা কি?
তার কোনো দুর্বলতা নেই।
ভেবে দেখ–আছে, বলল পিটার।
তুমিই বল।
তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, ব্যক্তিগত পরিচয়টা ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে আতঙ্কিত থাকে। এর সাথে তার নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। যখনই তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ার ঝুঁকি দেখা দেয়, তখনই সে মরিয়া হয়ে উঠে হাইজ্যাক, কিডন্যাপ, টরচার, আর মার্ডার শুরু করে।
এ তার দুর্বলতা নয়, শক্তি, মন্তব্য করল স্টিভেন।
মেসেজে বল, তার পরিচয় ফাস হতে চলেছে, পরামর্শ দিল পিটার। বল, কেউ একজন, তার এক শত্রু, সিকিউরিটি স্ত্রীন ভেদ করে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
প্রায় দশ সেকেন্ড চিন্তা করল স্টিভেন, পায়ে ব্যথা অনুভব করে এগিয়ে এসে একটা সোফায় বসল। হ্যাঁ, দ্রুত প্রতিক্রিয়া হবে তার। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি জেনে ফেলবে আমি মিথ্যে কথা বলছি। আমাকে সে শত্রু বলে চিনে ফেলবে, তারমানে ঝুঁকি নেব ঠিকই কিন্তু তোমার কোনো কাজে আসব না।
কথাটা মিথ্যে নয়, বলল পিটার। খলিফার কাছাকাছি মোসাডের একজন এজেন্ট সত্যি আছে।
তুমি জানলে কিভাবে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল স্টিভেন।
তা বলা যাবে না। তবে তথ্যটা নির্ভুল। এমনকি এজেন্টের কোড নেম-ও আমি জানি।
সেক্ষেত্রে, আবার কিছুক্ষণ চিন্তা করল স্টিভেন, এরই মধ্যে সন্দেহ দেখা দিয়েছে খলিফার মনে, আমার কথা সাথে সাথে বিশ্বাস করবে সে। তবে লাভ নেই। লোকটার শুধু নাম জানতে চাইবে সে, বলবে রুটিন চ্যানেলে নামটা আমাকে জানাও।
তুমি বলবে, তথ্যটা ভারী সেনসিটিভ, সামনাসামনি ছাড়া দেয়া সম্ভব নয়। বলবে, এর সাথে তোমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও জড়িত।
সে আমার ওপর চাপ দিতে থাকবে…
কিন্তু তুমিও যদি জেদ বজায় রাখ?
মনে হয় শেষপর্যন্ত দেখা করতে রাজি হবে। তোমার কথা ঠিক, পরিচয় নিয়ে একটা আতঙ্কে ভোগে সে। কিন্তু, আমার সাথে দেখা করলে তার পরিচয় কিন্তু সেই ফাসই হয়ে গেল…
কাজেই চিন্তা কর, স্টিভেন–ভেবে বের কর কি করবে সে, উৎসাহ দেয়ার সুরে বলল পিটার।
বুঝতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগল স্টিভেনের, বদলে গেল তার চেহারা, এমনভাবে বেকে গেল ঠোঁট যেন ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে। গুড গড! বাধ্য হয়ে দেখা সে করবে, কিন্তু তারপর আমি আর বাঁচব না।
ঠিক তাই, বলল পিটার। তোমাকে সে দেখা দেবে, কিন্তু তার পরিচয় তুমি আর কাউকে জানাবার আগেই তোমাকে সে খুন করবে।
তাহলে? একটু অসহায় দেখাল স্টিভেনকে। আমি মোটা হয়ে গেছি, ওর সাথে লড়ে আমি পারব না। আমতা আমতা করল স্টিভেন।
খলিফাকে লোকটার নাম না জানানো পর্যন্ত তুমি নিরাপদ, বলল পিটার।
হ্যাঁ, কিন্তু তারপর?
তার আগে বা তার পরে, তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমার, স্টিভেন। কথা দিচ্ছি, তোমার কোনো বিপদ হবে না।
বেশ। কখন তার সাথে যোগাযোগ করতে বল তুমি?
যোগাযোগ কর কিভাবে?
ব্যক্তিগত কলামে বিজ্ঞাপন ছাপি।
সোমবার সকালে ছাপতে দাও, নির্দেশ দিল পিটার। হঠাৎ ওকে খুব করে নিরিক্ষণ করতে লাগল স্টিভেন।
কি হলো, স্টিভেন?
না, ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, যদি খলিফা তোমার মতন কেউ হয়, পিটার?
আমার মতন? দারুণ রকম আশ্চর্যান্বিত হলো পিটার।
হ্যাঁ। আপোষহীন, নির্দয় সৈনিক। নিজের বিশ্বাসের জন্যে যে কোনো কিছু করতে প্রস্তুত?
কিন্তু আমি অমন নই, পিটার প্রতিবাদ করে।
হ্যাঁ, তুমি তাই, নিঃসন্দেহ কণ্ঠে বলে স্টিভেন! তুমি ঠিক খলিফার মতন মানুষ। এ ধরনের মানুষই যে আমাদের দরকার।
.
পিটারকে ধরে নিতে হলো, ওর ওপর কড়া নজর রাখছে খলিফা। ব্যারনেস ম্যাগডাকে ও খুন করার পর ওর ওপর খলিফার আকর্ষণ শতগুণ বেড়ে গেছে। কাজেই স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে ওকে।
সোমবার ভোরের ফ্লাইট ধরে ব্রাসেলস ফিরে এল ও, দুপুরের আগে হেডকোয়ার্টারে নিজের ডেস্কে দেখা গেল ওকে। এখানেও ওকে নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে, তার সাথে শুরু হয়েছে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারার তোড়জোড়। অল্টম্যান ইন্ড্রাস্ট্রি তার চীফ একজিকিউটিভকে হারিয়েছে, কাজেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ডিরেক্টররা মাথাচাড়া দিচ্ছে, প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কে কার চেয়ে বেশি ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে। এই দ্বন্দ্ব থেকে কৌশলে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল পিটার। তবে গোটা ব্যাপারটার ওপর নজর রাখল, পরে যাতে ব্যারনেসকে রিপোর্ট করা যায়। এই পরিস্থিতিতে অনেক ডিরেক্টরের মুখোশ খসে পড়বে, পরে প্রয়োজনে তাদের বিদায় করে দেয়া সহজ হবে ব্যারনেসের পক্ষে।
সোম নয়, মঙ্গলবারের কাগজে ছাপা হলো স্টিভেনের বিজ্ঞাপন। ব্রাসেলসে বসে বিজ্ঞাপনটা পড়ল পিটার–
ইসরায়েলের শিশুরা প্রভুর সাহায্য কামনা করেছে, বলেছে, যুদ্ধে যাব কি? জাজেজ, ২০:৩০
স্টিভেন পিটারকে জানিয়েছে, সাড়া দিতে সাধারণত আটচল্লিশ ঘণ্টা সময় নেয় খলিফা।
লিডেনহল স্ট্রিটে, নিজের অফিস বিল্ডিংয়ে প্রতিদিন অপেক্ষা করবে স্টিভেন, দুপুর থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত, এই সময়ের মধ্যেই আসবে ফোনটা। বুধবারে কোনো ফোন এল না, তবে আসবে বলে আশাও করেনি স্টিভেন। বৃহস্পতিবারে অফিসের মেঝেতে পায়চারি শুরু করল সে।
বিকেল চারটের সময় বাজল টেলিফোন। একবার, তারপর আরেকবার। রিসিভার তুলল স্টিভেন, হাতটা কাঁপছে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। ভাবল, পিটারের কথা ঠিক, আমি বদলে গেছি। স্টিভেন, বলল সে। অপরপ্রান্তের এই কণ্ঠস্বর তার চেনা। যতবার শুনেছে স্টিভেন, বুকের ভেতরটায় কাপ ধরে গেছে। যেন কোনো রোবট কথা বলেছে। অলডগেট আর লিডেনহল স্ট্রিটের মাঝখানে। তারপরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
কর্মচারীদের কারও চোখে ধরা না দিয়ে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে এল স্টিভেন, খোলা গ্যারেজে রোলস রয়েসটা রয়েছে, সেদিক না তাকিয়ে ফুটপাথ ধরে ছুটল সে। দুটো রাস্তার মাঝখানে একটাই ফোন বুথ, কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই শুনতে পেল বেল বাজছে। বুথের ভেতর ঢুকে রিসিভার তুলল সে। স্টিভেন।
আলডগেট টিউব স্টেশন, হাই স্ট্রিট এন্ট্রান্স।
বুদ থেকে বেরিয়ে আবার হনহন করে এগোল স্টিভেন, বাঁক নিতেই দেখা গেল হাই স্ট্রিটের মুখে আরেকটা বুথ। এবারও ভেতরে ঢোকার আগেই বেলের আওয়াজ পেল সে। রিসিভার তুলে রুদ্ধশ্বাসে বলল, স্ট্রাইড।
একটা মেসেজ আছে।
ইয়েস।
খলিফার বিপদ।
ইয়েস।
একটা সরকারি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি তার কাছাকাছি একজন এজেন্টকে পাঠিয়েছে, এত কাছে যে কোনো মুহূর্তে তার পরিচয় ফাঁস হয়ে যেতে পারে।
তথ্যের উৎস বলুন।
আমার ভাই। জেনারেল পিটার স্ট্রাইড। স্টিভেনকে নির্দেশ দিয়েছে পিটার, যতটা সম্ভব সত্যি কথা বলতে হবে।
ইন্টেলিজেন্সের নাম বলুন।
নেগেটিভ। তথ্যটা ভয়ঙ্কর। খলিফা ব্যক্তিগতভাবে মেসেজটা রিসিভ করলেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে আমাকে।
শত্রু এজেন্টের নাম আর পজিশন বলুন।
নেগেটিভ। সেই একই কারণ।
রোলেক্স হাতঘড়ির ওপর চোখ বুলাল স্টিভেন। পনেরো সেকেন্ড হলো কথা বলছে ওরা। জানে, যোগাযোগ ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হবে না।
অপরপ্রান্তে যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর শব্দ করছে না।
আমি শুধু খলিফাকে তথ্যটা দেব, আমাকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে একা তিনিই পেলেন। আমি তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করছি।
তা সম্ভব নয়।
তাহলে খলিফা সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে থাকবেন, গম্ভীর গলায় বলল স্টিভেন।
আই রিপিট, শত্রু এজেন্টের নাম আর পজিশন বলুন।
পঁচিশ সেকেন্ড পেরিয়ে যাচ্ছে।
আমি আবার বলছি, নেগেটিভ। যেভাবেই হোক তার সাথে আমার সামনাসামনি দেখা করার ব্যবস্থা করুন। স্টিভেনের জুলফি থেকে ঘামের ধারা গড়াচ্ছে।
আপনার সাথে যোগাযোগ করা হবে, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর জানাল, তারপরই বিচ্ছিন্ন হতে গেল যোগাযোগ।
বুক পকেট থেকে সাদা সিল্কের রুমাল বের করে মুখ মুছল স্টিভেন। এরপর, যত্ন করে এলোমেলো ভঙ্গিতে পকেটে রাখল রুমালটা।
কাঁধ উঁচু করে, চিবুক খাড়া রেখে বুথ থেকে বেরিয়ে গেল সে। অনেকদিন পর নিজেকে সাহসী মানুষ মনে হচ্ছে তার। এমন অনুভূতি দারণ আনন্দ দিচ্ছে স্টিভেনকে। হাতের ছাতাটা নাচাতে নাচাতে হেঁটে চলল সে।
.
পুরো সপ্তাহ টেলিফোনের কাছাকাছি থাকল পিটার। তাহিতিতে যাবার আগে অনেক কাজ ফেলে রেখে গিয়েছিল, নতুন আরো কিছু জমেছে, সেগুলো সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ও। দুটো চুক্তিপত্র চূড়ান্ত করার জন্যে অসলো আর ফ্রাঙ্কফুর্ট যেতে হলো, সকালে গিয়ে সন্ধ্যায় মধ্যে ফিরে আসতে পারল। প্রতিদিন সন্ধ্যাটা ন্যাটো অফিসার্স ক্লাব জিমনেশিয়ামে শরীর-চর্চায় কাটে, ওখান থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পিস্তল রেঞ্জে, টার্গেট প্র্যাকটিস করে রাত বারোটা পর্যন্ত। নাইন এম,এম, কোবরা ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠল দুটো হাত আর দশটা আঙুল।
স্টিভেন বিজ্ঞাপন ছেপেছে মঙ্গলবারে, আজ রোববার। পাঁচ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ স্টিভেনের কোনো ফোন পাচ্ছে না পিটার।
রোজকার মতো আজও খবরের কাগজ নিয়ে বসল পিটার। হিলটন হোটেলে রুম সার্ভিসকে দিয়ে দেশী-বিদেশি যত কাগজ পাওয়া যায় সব আনাবার ব্যবস্থা করেছে ও। শুধু হেডিংগুলোর ওপর চোখ বুলায়, কৌতূহল হলে কোনো খবরের সবটুকু পড়ে। খলিফা নতুন কোনো তৎপরতা চালাচ্ছে কিনা ইঙ্গিত পেতে চায় ও।
ইটালিতে তুমুল উত্তেজনা। চীনা বংশোদ্ভূত পাঁচজন বিলিওনিয়ার ব্যবসায়ীকে কিডন্যাপ করার পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার আগে সন্ত্রাসবাদীরা
মুক্তিপণ হিসেবে চল্লিশ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আদায় করে। সন্দেহ করা হচ্ছে কিডন্যাপাররা রেড ব্রিগেড নামে কুখ্যাত টেরোরিস্ট গ্রুপের সদস্য। পুলিশ কোনো সূত্র পায় নি। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, খলিফা আছে এর পিছনে। ইতালির একজন মিলিওনিয়ার নিজ দেশে সবচেয়ে বিপদে থাকে। নির্ঘাত তারাই খলিফাকে ইন্ধন জুগিয়েছে।
কন্টিনেন্টাল পত্রিকা শেষ করে স্বস্তির সাথে ইংরেজি এবং আমেরিকান পত্রিকা খোলে পিটার। আগামীকালের আগে স্টিভেনের রিপোর্ট পাচ্ছে না–সে সুনিশ্চিত। এতটা সময় কাটবে কেমন করে?
সময় কাটাতে ইংরেজ পত্রিকা পড়া শুরু করল পিটার।
ব্রিটিশ লিল্যান্ড মোটর কোম্পানির স্ট্রাইক পনেরোতম সপ্তাহে গড়িয়েছে। স্টিভেনের সাথে আলোচনা থেকে পিটার জানে, এতে খলিফার অবদান থাকা বিচিত্র নয়।
সকালের পত্রিকার আরো একটা খবরে আগ্রহ বোধ করল পিটার।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডক্টর কিংস্টোন পার্কারকে তাঁর বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ করেছেন। ডক্টর পার্কারের দায়িত্ব হবে ইসরায়েল কর্তৃক দখলীকৃত আরব ভূমি উদ্ধারে নতুন প্রচেষ্টা চালানো। ভদ্রলোকের পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে, ডক্টর পার্কার প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বন্ধু, এবং সিনিয়র ও প্রিয় উপদেষ্টাদের একজন, যাকে দলমত নির্বিশেষে সবাই পছন্দ করে, এবং এ ধরনের জটিল কাজে একমাত্র যোগ্য লোক তিনি।
ডক্টর পার্কারের ক্ষমতা ও প্রভাব, যোগাযোগ ও জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। মনে মনে তার প্রশংসা করল পিটার, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিতে কখনোই তিনি দ্বিধা করেন না।
হাত থেকে পেপার ফেলে দিল পিটার। দারুণ বোর হচ্ছে সে। বিছানার পাশে তিনটি বই পড়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে। নামকো দলিলের কোনো শেষ নেই। কিন্তু পিটার জানে, এক খলিফা ছাড়া আর কিছুতে এখন মনোনিবেশ করা তার দ্বারা সম্ভব নয়।
বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল পিটার, ব্ল্যাক থেকে প্লাস্টিকের একটা প্যাকেট নামিয়ে খুলল। শহরের সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কসমেটিক সেকশন থেকে কাল কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনেছে ও।
উইগটা মানুষের চুল দিয়ে তৈরি, নাইলন নয়, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি আর গোঁফটাও তাই। নতুন পোলারয়েড ক্যামেরা দিয়ে মেলিসার তোলা একটা ফটো সামনে নিয়ে আয়নার দিকে মুখ করে বসল পিটার। উইগ, দাড়ি, গোঁফ, তিনটেই কাঁচি দিয়ে কেটে-হেঁটে সাইজ করে নিতে হলো, তারপর পরল পিটার। ছবিটা গত ক্রিসমাসের, অ্যাবোটস ইউ-তে তোলা। ফটোর দিকে বারবার তাকাল ও, পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হাসছে স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড আর স্ট্রাইড পিটার, দুই ভাই। দুজনের চুলের রঙ দুরকম; কৃত্রিম উইগ, দাড়ি, আর গোঁফের সাথে মেলে না। কাজেই ওগুলো রঙ করতে বসল পিটার। পিটারের চেয়ে আধ কি এক ইঞ্চি বেশি লম্বা হবে স্টিভেন, তবে সেটা কারও চোখে পড়বে বলে মনে হয় না। ওদেরকে খলিফা বা তার ঘনিষ্ঠ সাঙ্গপাঙ্গরা চামড়ার চোখে কাছাকাছি থেকে দেখেছে কিনা সন্দেহ আছে পিটারের।
বিকেল হয়ে এল, তবু চেহারা বদলের কাজে সন্তুষ্ট হতে পারল না পিটার। পোশাকে তেমন সমস্যা হলো না। ওরা দুই ভাই বহুকাল থেকে একই টেইলরের কাছে কাপড় বানায়। পোশাক পরে, আয়নার সামনে স্টিভেনের হাবভাব নকল করে হাঁটাহাঁটি করল কিছুক্ষণ। অলস, চনমনে ভঙ্গিতে হাঁটে স্টিভেন। সবশেষে কোবরা প্যারাবেলাম পিস্তলটা ব্রিফকেস থেকে বের করল ও।
খানিক চিন্তা করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নিল পিটার, পিস্তলটা নিয়ে যাবে না। প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা লন্ডনে ঘটবে। বৃহস্পতিবারে স্টিভেনের সাথে যে যোগাযোগটা হয়েছিল, বোঝাই যার লন্ডন থেকে করা হয়েছিল সেটা। সাথে বিপজ্জনক একটা অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ কাস্টমসকে বোকা বানাবার ঝুঁকি নেয়ার কোনো মানে হয় না। অস্ত্র রাখার দায়ে ওকে যদি থামানো হয়, ব্যাপারটা। রটে যাবে। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে যাবে খলিফা। দরকার কি, ইংল্যান্ডে পৌঁছে থোর কমান্ড থেকে একটা অস্ত্র জোগাড় করে নিতে পারবে ও। প্রয়োজনটা ব্যাখ্যা করে বললে ঠিকই একটা ব্যবস্থা করে দেবে কলিন নোবলস।
হোটেলের রিসেপশন ডেস্কে সেফ ডিপোজিট বক্সে অস্ত্রটা রেখে এল পিটার। রুমে ফিরে আবারো সেই অপেক্ষার পালা। সৈনিকের এই একটা দায়িত্ব সে কখনই স্বস্তির সঙ্গে পালন করতে পারেনি।
যা হোক, রবার্ট অ্যাসপ্রের ওয়ার ইন দ্য শ্যাডোস পড়তে বসল সে। যুদ্ধের উন্মত্ততার প্রাচীন কাহিনি। হঠাৎ ঘড়িতে চোখ পড়তে দেখে আটটা বাজে দেখে খুশি হলো মনে মনে। রুম সার্ভিসের ফোনের রিসিভার তুলে ওমলেট আর কফির অর্ডার দিল পিটার। রিসিভার নামিয়ে রেখেছে দশ সেকন্ডেও হয়নি, বেল বাজল। সম্ভবত কিচেন থেকে জানতে চাইবে ডিনারের জন্যে স্পেশাল কিছু ওর দরকার হবে কিনা।
ইয়েস, হোয়াই ইট ইজ? বিরক্তি চেপে জিজ্ঞেস করল পিটার।
পিটার?
স্টিভেন?
দেখা করতে রাজি হয়েছে সে।
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হলো, শান্ত থাকার চেষ্টা করল পিটার। কখন? কোথায়?
জানি না। কাল আমাকে প্লেনে করে ওরলিতে যেতে হবে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে নির্দেশ পাব।
নিজের নিরাপত্তার দিকে কড়া নজর রেখে সাক্ষাতের আয়োজন করছে খলিফা। এ ধরনের কিছু ঘটবে, আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল পিটারের। ব্যস্তভাবে ওরলি এয়ারপোর্টের লে-আউট কল্পনা করার চেষ্টা করল ও। সবার চোখের আড়ালে কোথাও স্টিভেনের সাথে দেখা হওয়া চাই ওর, তা না হলে ভূমিকা বদলের সুযোগ পাওয়া যাবে না। লাউঞ্জে সম্ভব নয়, সম্ভব নয় ওয়াশরুমে। বাকি রইল আর মাত্র একটা জায়গা। তুমি ওখানে পৌঁছুবে কখন?
আমার ফ্লাইট সকালের দিকে, পৌঁছুবে সোয়া এগারোটায়।
তোমার আগে পৌঁছুব আমি, স্টিভেনকে বলল পিটার, সাবেনা ফ্লাইটের টাইমটেবল মুখস্থ হয়ে আছে ওর, আর নার্মকোর সিনিয়র একজিকিউটিভদের ভি.আই.পি কার্ড থাকায় যে-কোনো ফ্লাইটে সীট পাওয়া কোনো সমস্যাই নয়। মন দিয়ে শোনো, কিংবা লিখে নাও–ওরলি সাউথ টার্মিনালের পাঁচতলায় এয়ার হোটেল, জানো? তোমার নামে ওখানে আমি একটা কামরা ভাড়া করব। সোজা রিসেপশনে গিয়ে কামরার চাবি চাইবে তুমি। লাউঞ্জেই অপেক্ষা করব আমি দেখব কেউ তোমাকে ফলো করছে কিনা। আমাকে চেনো না। বুঝতে পারছ সব, স্টিভেন?
পারছি।
তাহলে কাল দেখা হবে।
কানেকশন কেটে দিয়ে আবারো বাথরুমে গিয়ে নিজের মুখ পরখ করল পিটার! কলিনের থেকে অস্ত্র ধার চাওয়ার বারোটা বেজে গেল।
আবার পায়চারি শুরু করল পিটার। বোঝা যাচ্ছে, খলিফা ইংল্যান্ডে দেখা করবে না। প্যারিসও সম্ভবত মধ্যবর্তী একটা স্টেশন মাত্র, গন্তব্য নয়। সাবজেক্টকে এভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা ঘোরাবার অনেক কারণের মধ্যে একটা, সে যাতে সাথে কোনো অস্ত্র নিয়ে যেতে না পারে। তাহলে সাক্ষাতের পর খুন করা সহজ হবে।
পোশাক, ভাঁজ করা ছুরি, কসমেটিক সামগ্রী, সব একটা গুচি ব্যাগে গুছিয়ে নিল পিটার। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে।
.
ওরলি সাউথ এয়ার হোটেলের লবিতে বারোটা পাঁচে দেখা গেল স্টিভেনকে, কৃতজ্ঞ পিটার মনে মনে অভিবাদন জানাল নিজেকেই। নীল ডাবল ব্রেস্টেড ব্লেজার, সাদা শার্ট, আর ক্রিকেট-ক্লাব টাই পরেছে স্টিভেন, পায়ে গ্রে রঙের উলেন মোজা আর কালো ইংলিশ জুতো, হাতে তৈরি। ট্রেঞ্চ কোটের নিচে পিটারও একটা ডাবল ব্রেস্টেড পরেছে, পায়ের জুতো জোড়াও কালো।
স্টিভেনের সাধাসিধা পোশাকের একটা। তবে টাইয়ের ব্যাপারে একটু ভুল হয়ে গেছে ওর। সে নিজেও ডাবল ব্রেস্টেড জ্যাকেট আর কালো জুতো, ট্রেঞ্চ কোট পরেছে।
লবির চারদিকে একবার চোখ বুলাল স্টিভেন, পত্রিকায় মনোনিবেশ করা পিটারকে দেখেও দেখল না। হাবভাবে কর্তৃত্বের ভাব নিয়ে ডেস্কের সামনে দাঁড়াল সে।
আমার নাম স্যার স্টিভেন স্ট্রাইড, একটা রুম রিজার্ভ করা আছে–চাবিটা।
তাড়াতাড়ি খাতা চেক করে মাথা ঝাঁকাল ক্লার্ক, স্টিভেনকে একটা ফর্ম আর চাবি দিল।
চারশ খোলো, নম্বরটা ভারী গলায় পড়ল স্টিভেন, পিটার যাতে শুনতে পায়।
মুখের সামনে খবরের কাগজ মেলে ধরে প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে আছে পিটার, স্টিভেন লবিতে আসার পর অল্প দু-একজন ভেতরে ঢুকেছে, একজনকেও খলিফার চর বলে মনে হলো না। অবশ্য প্যারিস যদি মধ্যবর্তী স্টেশন হয়ে থাকে, স্টিভেনের ওপর নজর রাখার জন্যে এখানে খলিফা লোক পাঠাবে বলে মনে হয় না।
স্টিভেন এলিভেটরের দিকে এগোল, পেছনে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে পোটার। এলিভেটরের সামনে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে রয়েছে, কাগজ রেখে পিটারও ধীরে পায়ে এগোল সেদিকে, সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত।
এলিভেটরে পাশাপাশি দাঁড়াল ওরা, কেউ কারো দিকে তাকাল না। পাঁচতলায় পোর্টারকে নিয়ে নেমে গেল স্টিভেন, পিটার আরো তিনতলা পর্যন্ত উঠে বেরিয়ে এল করিডরে, খানিক হাঁটাহাঁটি করে আবার ফিরে এল আগের জায়গায়, আরেকটা এলিভেটরে চড়ে নামল পাঁচতলায়।
চারশ দশ নম্বর কামরার দরজা ভিড়িয়ে রেখেছিল স্টিভেন, চাপ দিতেই খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে এক পাশে সরে দাঁড়াল পিটার, সাথে সাথে তালা লাগিয়ে দিল স্টিভেন।
কোনো সমস্যা হয়নি তো?
সহাস্যে মাথা নাড়ল, বলল। ড্রিঙ্ক চলবে? ডিউটি ফ্রি শপ থেকে একটা বোতল এনেছি।
গ্লাসের সন্ধানে বাথরুমে ঢুকল স্টিভেন, এই ফাঁকে কামরাটা চেক করে নিল পিটার। ডাবল বেড, টি ভি আর রেডিও, ছোট একটা টেবিল, দুখানা চেয়ার, একটা ওয়ারড্রোব। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেল না।
দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল, পিটারের হাতে ধরিয়ে দিল একটা। একবার মাত্র চুমুক দিয়ে গ্লাসটা রেখে দিল পিটার।
খলিফার নির্দেশ কিভাবে পাবে আন্দাজ করতে পার? জিজ্ঞেস করল ও।
পাব মানে, পেয়ে গেছি! চেয়ারের পিঠে ঝোলানো ব্লেজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে লম্বা একটা এনভেলাপ বের করল স্টিভেন এয়ার ফ্রান্সের ইনফরমেশন ডেস্কে আমার জন্যে রাখা ছিল।
চেয়ারে বসে এনভেলাপটা খুলল পিটার। তিনটে আইটেম পেল ভেতরে। একটা ফাস্ট ক্লাস এয়ার ফ্রান্স এয়ারলাইন টিকেট, শোফার চাতি একটা লিমুসিন এর ভাউচার, আর একটা হোটেল রিজার্ভেশন ভাউচার। প্লেনের টিকেট যে কোনো এয়ার ফ্রান্স এজেন্সি বা কাউন্টার থেকে কেনা সম্ভব, লিমুসিন আর হোটেল বুকিং ও পরিচয় গোপন রেখে করা যায় না। না, সূত্র হিসেবে এ-সব কাগজের কোনো গুরুত্ব নেই।
প্লেনের টিকেটের ভাজ খুলল পিটার, গন্তব্যটা দেখতে চায়। পরমুহূর্তে শিরশির করে উঠল শরীর, চামড়ার নিচে যেন বিষাক্ত পোকা ঢুকে গেছে, কিলবিল করছে মন্থরবেগে। লিমুসিন আর হোটেল ভাউচার চেক করার সময় লক্ষ্য করল, ওর হাত কাঁপছে।
সন্দেহ আর অবিশ্বাসের তীক্ষ্ণমুখ কাঁটা আবার ওকে খোঁচাতে শুরু করেছে। অসুস্থ বোধ করল পিটার।
কি হলো, পিটার?
কিছু না, সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল পিটার। প্লেনের টিকেটটা ওরলি থেকে বেন গারিয়, ইসরায়েলে নিয়ে যাবে ওকে। ভাড়াটে গাড়ির ভাউচার ওকে সেখান থেকে নিয়ে যাবে জেরুজালেম, আর শেষ ভাউচারটা প্রাচীন ও পবিত্র নগরীর একটা হোটেলের। কিং ডেভিড হোটেল।
জেরুজালেম, বিড়বিড় করে উঠল ও। খলিফা তোমার সাথে জেরুজালেমে দেখা করবে। আর, পিটার জানে, এই মুহূর্তে একজনই আছে জেরুজালেমে। যাকে বোরা-বোরাতে শেষবার আলিঙ্গন করেছিল পিটার, যার কথা মুহূর্তের জন্যে ভুলে থাকাও ওর জন্যে কষ্টকর।
খলিফা জেরুজালেমে। ব্যারনেস ম্যাগডা অল্টম্যানও জেরুজালেমে।
সত্যিই কি ওকে বোকা বানানো হচ্ছে? বারবার? নাকি এটা খলিফারই একটা কূট-কৌশল? তাহলে কি সবকিছু অভিনয়?
পিটার, কি হলো? উদ্বেগে অস্থির হয়ে কাছে সরে এল স্টিভেন।
মৃদু হাসল পিটার, শোনো, তোমার বদলে আমি যাচ্ছি।
কি! আকাশ থেকে পড়ল স্টিভেন। কোথায়? জেরুজালেমে?
আমরা জায়গা বদল করছি, স্টিভেন, মানে ভূমিকা বদল করছি।
তীব্র প্রতিবাদের সাথে মাথা নাড়ল স্টিভেন। পাগল নাকি! খলিফা তোমাকে মেরে ফেলবে।
প্রতিবাদ কানে না তুলে কাজ শুরু করল পিটার।
ব্রিফকেস খুলে কাপড়, উইগ, দাড়ি, আর গোঁফ বের করল ও, সব নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। খানিক পর সেখান থেকে ডাকল স্টিভেনকে, শুনে যাও।
বাথরুমে ঢুকে হতভম্ব হয়ে গেল স্টিভেন। মাই গড! আরেকজন আমি।
কাজ হবে কিনা বল, জিজ্ঞেস করল পিটার।
হবে, রায় দিল স্টিভেন। কিন্তু তুমি জানলে কিভাবে আজ আমি ব্লেজার আর গ্ৰে মোজা পরব?
জানতে হয়, হাসল পিটার। এবার এসো কাগজপত্রগুলো ঠিকঠাক করা যাক।
যে যার কাগজপত্র বিছানার ওপর আলাদাভাবে রাখল ওরা।
পাসপোর্টের ফটোগ্রাফ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তবে পিটারের পাসপোর্ট স্টিভেনের কাছে থাকবে, ফলে তার চেহারা একটু বদল করতে হবে।
করুণ স্বরে স্টিভেন বলল, আমার এত সাধের দাড়িটা কেটে ফেলতে বলছ!
পিটার অন্যমনস্ক, স্টিভেনের পাসপোর্ট দেখে অন্য একটা কাগজে সই নকল করার চেষ্টা করছে ও। দুমিনিটের মধ্যে আয়ত্তে এনে ফেলল।
এই ছদ্মবেশ নিয়ে তুমি আমাকে পথে বসাতে পার, আশঙ্কা প্রকাশ করল স্টিভেন। আমার ব্যাংকে গিয়ে সব টাকা তুলে নেবে, তারপর বাড়ি গিয়ে বিছানায় উঠবে প্যাটের সাথে…
আরে, দারুণ আইডিয়া তো! চিন্তামগ্ন হবার ভান করল পিটার।
আরে ভাই, দোহাই লাগে, এ ধরনের ব্যাপার নিয়ে জোক কর না!
এরপর ওরা ক্রেডিট কার্ড, ক্লাব মেম্বারশিপ কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ অন্যান্য কার্ড বদলাবদলি করল। সই নকল করার ব্যাপারে পিটারের দ্বিগুণ সময় নিল স্টিভেন।
সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি ব্রাসেলসে গিয়ে দিনকতক একটা হোটেলে লুকিয়ে থাকো, বলল পিটার। কারও সাথে যোগাযোগ করবে না, বাইরে কোথাও বেরুবে না।
জানতাম এ ধরনের হুকুমই করবে তুমি… মুখ হাঁড়ি করল স্টিভেন। এখুনি বেরিয়ে পড়ো, তাগাদা দিল পিটার। তার আগে এটা পরো… ট্রেঞ্চ কোটটা দেখিয়ে দিল ও তারপর, এসো টাই বদল করি।
বিদায়ের সময় পিটারের হাত ধরে একটু চাপ দিল স্টিভেন।
স্টিভেন, একটা ব্যাপার জানতে চাইতে পারি? পিটার জানে না, এত বছর পর কেন এই কথাটা বলছে সে।
অফকোর্স, ওল্ড বয়, স্টিভেনের আমুদে স্বর ওকে আমন্ত্রণ জানায়।
স্যান্ডহার্স্ট, গলার সরে অস্বস্তি লুকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা করল পিটার। তুমি কর নি ওটা, তাই না?
ওর চোখে চোখে চাইল স্টিভেন। নির্ভয়ে। আমি করি নি। বিশ্বাস কর।
ভাইয়ের ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে একটু চাপ দেয় পিটার। অনেকটা সময় পর নিজকে ভারমুক্ত লাগছে।
আমি আনন্দিত, স্টিফেন।
টেইক কেয়ার, ওল্ড বয়।
রাখব, পিটার বলে। কিন্তু আমার কিছু হলে, অস্বস্তিভরে যোগ করে সে, মেলিসা জেইন
বলতে হবে না। নিশ্চিত থাকো।
কেন যে মনের ভাব প্রকাশে ইংলিশম্যানদের এত কার্পণ্য, পিটার ভেবে পায় না। এরা পরস্পরের প্রতি এমনকি কৃতজ্ঞ হতেও জানে না।
তো, আমি ঠিক থাকব, চিন্তা কর না। স্টিফেন বলে।
মিডল স্ট্যাম্পে গার্ড নাও, স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বসো না যেন!, পুরানো দিনের মতো করে ভাইকে সাবধান করে পিটার।
আরে না, ওকে রুমে একা রেখে বেরিয়ে যায় স্টিভেন।
.