কোলের উপর সেই বাক্স রেখে তার চাকনা খুলে ফেললাম। উপরে খানিকটা ছেঁড়ামতন হলদে হাতে তৈরি কাগজ, মাঝখানে একটা ছ্যাদা করে সুতো চালিয়ে কাগজগুলো একসঙ্গে আটকানো, যাকে বলে পুঁথি। তার একপৃষ্ঠায় সংস্কৃত মন্ত্র লেখা, অন্যপৃষ্ঠায় খোঁচা-খোঁচা হরফে গজা কি সব লিখেছে।
সেই পুঁথিও নামালাম। নামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। বাক্সের মধ্যে আট-দশটা সাদা লাল নীল সবুজ পাথর বসানো আংটি. হার, বালা আর একজোড়া জুলুজ্বলে লাল চুনী বসানো কানের দুল। বুঝলাম স্বপ্নে পদিপিসী এইটাই আমার মাকে দিতে বলেছিলেন। তাই সেটা তখুনি পকেটে পুরলাম।
তার পর পুঁথিটা খুলে, কি আর বলব, দেখলাম যে শ্রীগজার লেখা পড়া আমার সাধ্যি নয়। বুঝলাম পুঁথিটা সেজ-দাদামশাইয়ের হাতে দেওয়া দরকার, বাক্সটা দিদিমাকে দেব, যেমন খুশি ভাগ করে দেবেন। তখন আমি ওদের ক্ষমা করলাম। আমাকে গোল হয়ে মিছিমিছি আক্রমণ করার জন্য ওদের ওপর একটুও রাগ রইল না।
বাক্সটা নিয়ে সে যে কত কষ্ট করে দেয়াল বেয়ে গম্বুজের মাথায় উঠলাম, আবার দেয়াল বেয়ে বাইরের দেয়াল দিয়ে নামলাম সে আর কি বলব। তার পর বাঁদর-তাড়ানো সিঁড়ির খাঁজ বেয়ে নামাটাও প্রায় অমানুষিক কাজ। নেমে দেখি ওরা সবাই চক্রাকারে তখনো আমার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে, কিন্তু আমার হাতে ধরা একশো বছর আগে হারানো পদিপিসীর বমিবাক্স দেখে সবাই নড়বার-চড়বার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, কেবল ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি কাউকে কিছু না-বলে দিদিমার হাতে বাক্স দিলাম, আর ঢাকনির তলাটা থেকে হলদে পুথি বের করে সেজ-দাদামশায়ের হাতে দিলাম। সেজ-দাদামশাই অন্যমনস্কভাবে সেটা হাতে নিয়ে ওলটাতে লাগলেন। আর চিম্ড়ে ভদ্রলোকও অভ্যাসমতন নিঃশব্দে এগিয়ে ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সেজদাদামশাই খুব লম্বা আর চিম্ড়ে ভদ্রলোক খুব বেঁটে হওয়াতে বিশেষ সুবিধে হল না।
হঠাৎ সেজ-দাদামশাই বিষম চমকে উঠে বললেন, “আরে, এ যে বাবার পদিপিসীর ছোটোবোন মণিপিসীর বিয়ের আসন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই পুথি। এ কোথায় পেলি! আরে, এ হারানোর ফলেই তো পুরুতঠাকুর ভুলভাল মন্ত্র পড়িয়েছিলেন, আর তার ফলেই বাবার মণিপিসী আর পিসেমশাই সারাটা জীবন ঝগড়া করে কাটিয়েছিলেন।”
তার পর পাতা ওলটাতেই গজার হাতের লেখা চোখে পড়াতে আরো বিষম চমকে গিয়ে বললেন, “শোনো-শোনো, পদিপিসীর ছেলে শ্রীগজা কী লিখেছে শোনো। আরে, এটা যে একটা ডায়েরির মতন শোনাচ্ছে, না আছে তারিখ, না আছে বানানের কোনো নিয়মকানুন। ব্যাটা সাক্ষাৎ মাসির বিয়ের জায়গা থেকে বিয়ের মন্ত্রের পুথি চুরি করে তাতে কী লিখেছে দেখ!
“সোমবার।। সর্বনাশ হইয়াছে। মাতাঠাকুরানীর গোরুর গাড়ি উঠানে প্রবেশ করিতেই আগে নামিয়া আমার হাতে বর্মিবক্স গুঁজিয়া দিয়া মাতাঠাকুরানী সমস্ত ভুলিয়া গিয়াছেন ও অভ্যাসমতন বাড়িসুদ্ধ সকলকে তাড়নপীড়ন করিতেছেন।
“মঙ্গলবার।। আর পারা যায় না। বাক্স আমি কিছুতেই কাহাকে দেব না, স্থির করিয়াছি; অথবা ইহারা যেরূপ খোঁজাখুঁজি শুরু করিয়াছে, বাক্স বগলে লইয়া উহাদের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজা ছাড়া কোনো উপায় নাই। বগলে কড়া পড়িয়া গিয়াছে।
“শুক্রবার।। সৌভাগ্যবশতঃ তাড়িওয়ালার বাড়িতে বাক্স লুকাইবার সুবিধা পাইয়াছি। খোঁজাখুঁজি বন্ধ হইলে বাড়ি আনিব।
“সোমবার।। তাড়িওয়ালার সহিত পরামর্শ করিয়া গাঁজার ব্যবসা শুরু করিয়াছি। বিষম লাভ হইতেছে। এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরিও করিতে হয়।
“শনিবার।। জিনিসপত্র বহু কিনিয়াছি, বহু দানও করিয়াছি। ইহারা জিনিস লয় অথচ আমাকে সন্দেহের চক্ষে দেখে তাই মনে করিয়াছি শহরে বাড়ি কিনিব।
“রবিবার।। ঘটনাক্রমে গম্বুজের ভিতরকার এই নির্জন স্থান আবিষ্কার করিয়াছি। এখানেই আমার এই লিপি ও বাকি গুটিকতক অলংকার রাখিলাম। ইহাদের বিবাহাদি হইলে উপহার দেওয়া যাইবেক। ইতি শ্ৰীগজা।”
সেজ-দাদামশায় হতাশ গলায় বললেন, “তার পরই বোধ হয় ঠাকুরদা বাঁদরের সিঁড়ি কাটিয়ে দিয়েছিলেন, গজার আর কাউকে গয়না উপহার দেয়া হয় নি। শেষে তো সে কলকাতাতেই থাকত শুনেছি। পদিপিসীর ফিক করে হাসারও কারণ বোঝা গেল। তার মতে গজার থেকে বাক্স পাবার যোগ্য পাত্র আর কেই বা,ছিল।”
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ভেন্তিপিসী বললেন, “বাক্সে কী আছে?”
দিদিমা ঢাকনি খুলে দেখলেন। বললেন, “আমি ভাগ করে দিচ্ছি। খেন্তি, যদিও তুই আমার কাছ থেকে সেবার তিনশো টাকা ধার নিয়ে শোধ দিস নি, তবু এই হারটা তুই নো” সেজ-দাদামশাইকে বললেন, “ঠাকুরপো, তোমার কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো: তুমি এই হীরের আংটি নাও। এটা মেজঠাকুরপোর ছেলেকে দেব, এটা পাঁচুর; এটা ন্যাড়ার প্রাপ্য, এটা পুঁটকি পাবে, এটা কুঁচকি পাবে, এই বালাজোড়া আমার ভাগ, আমার মেয়েকে দেব।” বলে মাকে দেবার জন্য আমার হাতে দিলেন। তার পর সকলের সামনে আমাকে আদর করে বললেন, “বাকি রইল এই পান্নার আংটি, এটা দাদা তোমার, কারণ তুমি খুঁজে না-দিলে এদের দ্বারা হত না। এবার চল দিকিন, কত পুলি বানিয়েছি হাতমুখ ধুয়ে খাবে চল। হ্যাঁ, বাক্সটা কিন্তু আমি নিলাম, মসলা রাখব।”
দিদিমার সঙ্গে চলে যেতে-যেতে শুনলাম থেন্তিপিসী পাঁচুমামাকে বলছেন, “তাকে দিল সাত নহর আর আমার বেলা এক ছড়া!” আর চিমড়ে ভদ্রলোক সেজ-দাদামশাইকে বলছেন, “স্যার, আমার দুশো টাকা?”