৭. কৃষিপণ্যের বাজার: কৃষিপণ্য, কৃষি-ঋণ, কৃষি-উপকরণের যুক্ত বাজার প্রক্রিয়া

সপ্তম অধ্যায়

কৃষিপণ্যের বাজার
কৃষিপণ্য, কৃষি-ঋণ, কৃষি-উপকরণের যুক্ত বাজার প্রক্রিয়া

ঐতিহাসিক ভাবে এদেশে কৃষিপণ্যের বাজার গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও স্থানীয় ব্যবসায়ী-ছোট উৎপাদকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে। পরবর্তী কালে ভারতীয় কৃষি-পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হলে দেশীয় বড় ব্যবসায়ী, কমিশন এজেন্টদের প্রাধান্য বাড়ে। তুলার মতো বাণিজ্যিক পণ্যে দীর্ঘদিন এই অবস্থা চালু ছিল। স্বাধীনতার পরেও বৈদেশিক বাণিজ্য অনেকাংশে বিদেশি বণিক ও দেশি এজেন্টদের হাতেই ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই একটি বণিক-মহাজন শ্রেণির উদ্ভব হয়, যারা বাংলা দেশে ধান-চালের মতো খাদ্যপণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুব ছোট বিক্রেতাদের ওপর কর্তৃত্ব করতে থাকে। এদের মধ্যে একটা বড় অংশ বৃহৎ ও মাঝারি চাষিদের মধ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছে। গম উৎপাদনের অঞ্চলে গমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা তৈরি হয়। যদিও চাষিরা মূলত নিজ পরিবারের ভোগের জন্যই তা উৎপাদন করত, বাজারের উদ্দেশ্যে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন প্রায় হতই না, তবুও কর দেওয়া, ঋণ পরিশোধ করা বা ভোগের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার প্রয়োজন থেকেই ধান, চাল, গম ইত্যাদির স্থানীয় ছোট বাজার গড়ে ওঠে ও এই ব্যবসায় স্থানীয় ছোট ব্যবসায়ীদের ভূমিকা বাড়ে। ব্রিটিশযুগেই জমিদাররা সরাসরি বাজারে উদ্বৃত্ত ফসল বিক্রি করত না। কারণ তারা খাজনা নিত টাকার অঙ্কে, সেই টাকা থেকে ব্রিটিশরাজকে কর দিত টাকার অঙ্কে। ফলে ছোট-বড়-মাঝারি সব চাষিকেই খাজনা দেওয়ার জন্য বাজারে শস্য বিক্রি করতে হত। রায়তওয়ারি জায়গাগুলিতে সরাসরি কর দেওয়ার জন্য ফসল বিক্রি করতে হত। ফলে ফসলের একটা ভাল অংশ বাজারে বিক্রি হত, আবার ছোট চাষিকে অসময়ে হয় মহাজন-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য ধার করতে হত বা টাকা ধার নিয়ে বাজার থেকে ফসল কিনতে হত। ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগই একই সঙ্গে মহাজনি কারবারে টাকা খাটাত, কেউ কেউ এর সঙ্গে সার ইত্যাদি কৃষি-উপকরণের ব্যবসা করত, সবক্ষেত্রেই ব্যাপক মহাজনি কারবার চলত। বড় ব্যবসায়ী-মহাজনরা ছোট ব্যবসায়ীদের পণ্য একত্রিত করে তুলনামূলক বড় আকারে অন্যান্য জায়গায় চালান দিত। দেশের মধ্যেই অতিরিক্ত উৎপাদনের অঞ্চলগুলি থেকে যে-অঞ্চলগুলিতে উৎপাদন কম হয়, সেখানকার সঙ্গে কেনা-বেচা চলত। বাণিজ্যিক পণ্যগুলির মতো অত বৃহৎ আকারে অবশ্যই বাণিজ্য চলত না। তার কারণ বাণিজ্যিক পণ্যের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্রিটিশ ও অন্যান্য বিদেশি বণিকদের যোগাযোগ ছিল, অনেক সময় দেশি বণিকরা বিদেশি বণিকদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে জোগানের শৃংখলটি অত বিস্তৃত ছিল না।

ধীরে ধীরে খাদ্যশস্যের বাণিজ্যে বড় পাইকার-দালালদের উদ্ভব হয়। এক-একটি খাদ্যশস্য বিক্রির জন্য বাজারে আলাদা আলাদা জোগান-শৃংখল তৈরি হয়। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ক্রমে চালকল মালিকরা স্থানীয় পণ্যের বাজারে অনুপ্রবেশ করে। এরা ছোট-মাঝারি উৎপাদকদের মধ্যে ফসল ওঠার পরপরই সেই সময়কার কম বাজার-মূল্যের হিসাবে ফসলের বিনিময়ে শোধ করার শর্তে আগাম টাকা বিতরণ করে। এই ভাবে গ্রামীণ ছোট-মাঝারি উৎপাদকের উৎপাদিত সমস্ত শস্যের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে। গ্রামের বড় জমির মালিক অনেক ক্ষেত্রেই ধান চালের ব্যবসা করে, এরাই চালকল মালিকের কমিশন এজেন্টের কাজও করে। সেইসঙ্গে এরা অনেক ক্ষেত্রেই সার-বীজ-কীটনাশকের ব্যবসাও করে। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সার-বীজ-কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ইত্যাদি অত্যন্ত দামি উৎপাদনের উপকরণ অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে উৎপাদন-ব্যয় বাড়ে বহুল পরিমাণে। চাষির পক্ষে চাষের খরচ মেটানো দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যতে ফসল ওঠার পর শোধ করার শর্তে টাকা বা উৎপাদনের উপকরণগুলি তখন কমিশন এজেন্টের কাছ থেকে ধার নেওয়ার জন্য নির্ভর করা ছাড়া তাদের আর কোনও উপায় থাকে না। এর ওপর যেহেতু নতুন কৃষি-উপকরণ ব্যবহারের পদ্ধতি, পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়েও তাকে কমিশন এজেন্টের পরামর্শের ওপর নির্ভর করতে হয়, ফলে এই জোগানদাতার পরামর্শ অনুযায়ীই চাহিদা নির্ধারিত হয়। উপকরণের বাজারে জোগানদাতার সিদ্ধান্ত ও বিচারবিবেচনা অনুযায়ী বিক্রির পরিমাণ নির্ধারিত হয়ে থাকে, গ্রহীতার কোনও স্বাধীন ভূমিকা থাকে না। বিশেষ করে এই বাজারটি ঋণের বাজার ও পণ্যের বাজারের সঙ্গে যুক্তভাবে ক্রিয়া করে বলে এখানে পণ্য ও উপকরণের দামের ওপর ঋণদাতা, উপকরণ জোগানদারের একাধিপত্য কাজ করে। বাজার-ব্যবস্থার স্বাভাবিক ক্রিয়াকে তা বিকৃত করে। গ্রামের অপেক্ষাকৃত ছোট উৎপাদকের ওপর একদিকে বড় ব্যবসায়ী চাষি-মহাজন, অন্যদিকে কমিশন এজেন্টের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। তার উৎপাদিত উদ্বৃত্তকে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে লাগানো যায় না। যা কিছু উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হয় তা বাণিজ্যিক ও মহাজনি পুঁজির যৌথ ক্রিয়ায় কমিশন এজেন্ট বা বণিক মহাজন–বড় চাষির হাতে জমা হয় এবং ওই ব্যবসা-শৃংখলের মধ্যেই ঘুরতে থাকে। বিক্রি সংক্রান্ত সরকারি হিসাবে অনেক সময়েই পণ্যের বাজারে এই কমিশন এজেন্ট বা বড় চাষি-মহাজনরা পণ্যের ক্রেতা হিসেবে বা রাইস মিলে পণ্যবিক্রেতা হিসেবে যে-ভূমিকা পালন করে তা উল্লিখিত হয় না।

সারণি ৭.১ জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে প্রতি ১০০০ জন কৃষকের কয়েকটি নির্দিষ্ট ফসল বিক্রির বিবরণ (বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে)

সারণি ৭.১ জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে প্রতি ১০০০ জন কৃষকের কয়েকটি নির্দিষ্ট ফসল বিক্রির বিবরণ (বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে)

Source: Key Indicators of Situation of Agricultural Households in India (NSS 70th Round)

সারণি ৭.২ জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে বিক্রি হওয়া ফসলের বিভিন্ন এজেন্সি অনুযায়ী শতকরা বিভাজন

সারণি ৭.২ জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে বিক্রি হওয়া ফসলের বিভিন্ন এজেন্সি অনুযায়ী শতকরা বিভাজন

Source: Key Indicators of Situation of Agricultural Households in India (NSS 70th Round)

উন্নত কৃষি-অর্থনীতিতে শিল্পজাত দ্রব্যের মতোই কৃষিপণ্য উৎপাদনের মূল লক্ষ্য হল বাজার। এবং কোনও বছরে বিভিন্ন শস্যের উৎপাদনে জমির বণ্টন ও উৎপাদিত শস্যের বাজারজাত অংশের তুলনামূলক পরিমাণ আগের কয়েক বছরে বিভিন্ন শস্যের দামের অনুপাতের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ভারতের কৃষিতে প্রান্তিক ও ছোট চাষিদের প্রাধান্য থাকলেও কৃষিপণ্যের একটা বড় অংশ বাজারজাত হয়। চাষি তার মোট উৎপাদিত ফসলের সব অংশই যে বাজারজাত করে এমন নয়। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে একটা অংশ সে নিজের পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে কাজে লাগায়। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, ভারতের কৃষিতে পারিবারিক শ্রম এখনও অনেকটা পরিমাণে শ্রমের চাহিদা মেটায়, তাই স্বাভাবিকভাবেই শস্যের একটা বড় অংশ পারিবারিক ভোগে সরাসরি কাজে লাগে। ফলে শস্যের যতটা অংশ বাজারজাত করা যেত, এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না। বাকি অংশের খানিকটা ক্ষেত্রবিশেষে বীজের জন্য রাখে। অনেকসময় ঋণের শর্ত অনুযায়ী পুরনো ঋণ ফসলের মাধ্যমেই শোধ দিতে হয়। এই অংশ রেখে দেওয়ার পর বাকি অংশ সে বাজারজাত করে। এই বাজারজাত করার একটা উদ্দেশ্য হতে পারে সংসারের ভোগ্য পণ্য কেনা। আবার কখনও কখনও অর্থের মূল্যেও ঋণ পরিশোধ করার শর্ত থাকে। সে ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত অনুযায়ী ফসল ওঠার ঠিক পরে আর্থিক মূল্যে ঋণ পরিশোধ করার বাধ্যবাধকতার জন্য ফসল বাজারজাত করার দরকার হয়। এছাড়া উৎপাদনে সার, কীটনাশক, সেচের জল ইত্যাদির ব্যয় মেটানোর জন্য ফসল বাজারজাত করার দরকার হয়। চাষি তার ফসলের কতটা অংশ রেখে কতটা অংশ বিক্রি করবে তা সবসময় বাজার-দামের ওপর নির্ভর করে না। জোতের আয়তন, চাষি পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্যের পরিমাণ, চাষির ঋণগ্রস্ততা, ঋণ পরিশোধের শর্ত, চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের পরিমাণ ও দাম ইত্যাদি অনেক বিষয়ের ওপর এটি নির্ভর করে। অনেক সময় প্রান্তিক ও ছোট চাষি এই সব নানা প্রয়োজনে ফসল ওঠার ঠিক পরেই ফসলের একটা বড় অংশ কম দামে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। তারপর সারা বছর ধরে সে তার পরিবারের জন্য খাদ্যশস্য বাজার থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে বাধ্য থাকে। প্রান্তিক ও ছোট চাষি যে-পরিমাণ ফসল বাজারজাত করে, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ ফসল বাজার থেকে কেনে। অর্থাৎ তার নিট বিক্রির পরিমাণ প্রায়শই ঋণাত্মক। ফলে ছোট ও মাঝারি গোত্রের নানা আয়তনের জোত আছে যে-চাষিদের, তাদের মোট উৎপাদনের নিট বাজারজাত শস্যের পরিমাণ শতাংশের হিসেবে প্রায়ই ঋণাত্মক। এর থেকে বড় আয়তনের জোতের চাষিদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি শুধু যে ধনাত্মক তাই নয়, জোতের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মোট উৎপাদনে বাজারজাত পরিমাণের শতাংশ বাড়তে থাকে। জোতের আয়তনের সঙ্গে ফসলের বাজারজাত অংশের সম্পর্ক নিয়ে কোনও কোনও কৃষি অর্থনীতিবিদ এই পর্যবেক্ষণটিকে ভারতীয় কৃষিতে সাধারণভাবে প্রযুক্ত একটি নিয়ম হিসেবে দেখেছেন।

বাজারজাত কৃষিজের একটা অংশ খোলা বাজারে বিক্রি হয় ও একটা অংশ সরকার ফসল ওঠার পর সহায়ক মূল্য দিয়ে কিনে নিতে পারে। উৎপাদনব্যয় অনুযায়ী সহায়ক মূল্য স্থির হয়। এই অংশটি রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছয়। রেশন ব্যবস্থার নতুন নীতি অনুযায়ী কেবলমাত্র দারিদ্ররেখার নীচে অবস্থিত মানুষকে রেশন ব্যবস্থার পূর্ণ সুবিধা দেওয়ার কথা, দারিদ্রসীমার ওপরে বাসকারী মানুষদের জন্য রেশনব্যবস্থার সুযোগ সীমিত করা হয়েছে। পণ্যের এই সরকার-সংগৃহীত অংশটি বাদ দিয়ে বাকি অংশ খোলা বাজারে বিক্রির প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট দীর্ঘ। ছোট ব্যবসায়ী থেকে আড়তদার ও তার থেকে ছোট বিক্রেতা – এই প্রক্রিয়ায় অনেক সময় বহু স্তরে বহু ব্যক্তি যুক্ত থাকে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই বড় চাষি, পণ্য ব্যবসায়ী, জল ও কৃষি উপকরণের জোগানদার ও মহাজনরা তাদের যুক্ত-বাজারের কার্যকারিতা মারফত একই সঙ্গে পণ্যের বাজার, ঋণের বাজার ও কৃষি-উপকরণের বাজারের একটি অংশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। এইসব কারণে শস্যের বাজার-দাম ও চাষির প্রাপ্ত দামের মধ্যে তফাত ঘটে এবং তা বিভিন্ন মাপের জোতের চাষিদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হয়। এই তফাতের পরিমাণ স্থান, কাল, পাত্র ইত্যাদি আরও নানা বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এই বাস্তবতা সত্ত্বেও কোনও কোনও অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ভারতীয় কৃষিপণ্যের বাজার প্রতিযোগিতামূলক বাজারের নিয়মে পরিচালিত হয়। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণের বিপরীত যুক্তি ও তথ্যগত ভিত্তি অত্যন্ত জোরালো।

এই ধরনের যুক্ত-বাজার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একই সঙ্গে কীভাবে ঋণ, কৃষি উপকরণ ও কৃষিপণ্যের বাজার ক্রিয়া করে, তার বিস্তারিত বিবরণ মেলে তৃণমূল স্তরে সমীক্ষাতে। এই বিষয়টি দেখার জন্য আমরা ১৯৮৯–৯০ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ সোসাল সায়েন্স রিসার্চের আনুকূল্যে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাঁচটি গ্রামের একটি অঞ্চলে জোত স্তরে সমীক্ষা চালাই। ওই অঞ্চলের মোট ৪৮০টি কৃষক পরিবারের মধ্য থেকে ১ হেক্টরের ওপর জমি চাষ করে এমন ৩৩০টি চাষি পরিবারকে বেছে নিয়ে এদের উৎপাদন, ফসল বিক্রি, সেইসঙ্গে কৃষি-উপকরণ কেনা ও ঋণের উৎস সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করি। যে-তথ্যগুলি পাওয়া যায় সেগুলি হল, ক) যদিও সমস্ত ধরনের চাষিই অল্পবিস্তর ব্যবসায়ী বা আঞ্চলিক ছোট ব্যবসায়ীদের তাদের ফসল বিক্রির চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার করে, ছোট ও আধা-মাঝারি চাষিরা এই চ্যানেলের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল। খ) উদ্বৃত্ত উৎপাদন করতে সক্ষম চাষিদের মধ্যে একটি বড় চাষি-মাঝারি চাষির গ্রুপকে চিহ্নিত করা যায়, যাদের ওপর অন্য মাঝারি ও অপেক্ষাকৃত ছোট চাষিরা চাষের সময় প্রয়োজনীয় উপকরণের জন্য নির্ভর করে। আগাম উপকরণগুলি নিয়ে তারা চাষে ব্যবহার করে এবং শর্ত থাকে ফসল ওঠার পর সেই সময়কার বাজার-দামের হিসেবে উপকরণের দাম ফসলে শোধ দেওয়া হবে। অথবা টাকার অঙ্কে আগাম নিয়ে তারা চাষের খরচ মেটায় ও ফসল উঠলে সেই সময়কার বাজার-দামের হিসেবে ফসলের বিনিময়ে ঋণ পরিশোধ করে থাকে। গ) মাঝারি ও বড় চাষিরা প্রায় প্রত্যেকেই সরাসরি চাল-কলে তাদের ফসল বিক্রি করে থাকে। বিক্রয়ের জন্য নির্ধারিত ফসলের বেশিরভাগই এই চ্যানেলটির মাধ্যমে বাজারজাত হয়। অথচ ছোট ও আধা-মাঝারি চাষি, চাষবাসই যাদের একমাত্র পেশা হওয়ার কারণে সঙ্গতি অল্প, তাদের মধ্যে একজনও সরাসরি রাইসমিলে তাদের ফসল বিক্রি করতে পারে না। এর কারণ, ঋণে উপকরণ কেনা বা টাকার অঙ্কে ঋণ নেওয়ার জন্য ফসল ওঠার আগেই তা বড় চাষি-ব্যবসায়ী-মহাজনদের কাছে বাঁধা পড়ে থাকে। ঘ) কৃষি-উপকরণ ধারে নেওয়ার সময় উপকরণের চড়া দাম হিসেব করেই দাদনের পরিমাণ নির্ধারিত হয়, যদিও যে-ফসলের মাধ্যমে এই দাদন পরিশোধ করা হয় তার দাম হিসাব করা হয় ফসল ওঠার পরের কম দামে। ঙ) ধান-চালের ব্যবসায়ী বড় চাষিরা তাদের নিজ জমিতে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ উৎপাদনশীল বিনিয়োগে যথেষ্ট উৎসাহী নয়, বরং তারা তাদের হাতে জমা পণ্য বাজারজাত করে যে-আর্থিক পুঁজি আসে, তা বাণিজ্য-মহাজনি খাতে ব্যবহার করতে বেশি আগ্রহী। চ) এই বিভিন্ন ধরনের চাষিদের পাশাপাশি বড় চাষিদের আর-একটি ছোট দলকে চিহ্নিত করা যায়, যারা স্বাধীনভাবে তাদের পণ্য বাজারজাত করে, যারা তাদের উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদনশীল বিনিয়োগে আগ্রহী, তাই তারা ব্যবসায়িক বা মহাজনি কারবারে তাদের আর্থিক পুঁজি ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। এই বড় চাষির দলটিকে অবশ্যই প্রগতিশীল চাষি দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। বড় চাষিদের মধ্যেকার ব্যবসায়ী-মহাজন গোষ্ঠীটি অপ্রগতিশীল। এদের কাজকর্মের কারণে শুধু এদের জোতে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পথ বন্ধ হয় না, আধা-মাঝারি ও ছোট চাষি, যারা তাদের ওপর ঋণের জন্য ও উপকরণের জন্য নির্ভর করে, তাদের সম্ভাব্য উদ্বৃত্তও উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পথ থেকে অনেক দূরে চলে যায়, এই উদ্বৃত্ত বাণিজ্যিক মহাজনি পুঁজির আকারে অনুৎপাদনশীল খাতে আবদ্ধ হয়ে থাকে। ফলে সামগ্রিকভাবে কৃষির প্রগতিশীল বিবর্তনের প্রক্রিয়া বাধা পায়। আমাদের সমীক্ষায় আমরা দেখেছি, নমুনা দলটির মধ্যে শতকরা ২১ ভাগ চাষি চাষ শুরু হওয়ার সময় যে-স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে সার ধার নিয়েছিল, তার কাছেই সারের দাম মেটানোর জন্য উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে। শতকরা ১২জন চাষি ধারে সার কিনেছিল টাকায় ধার শোধ দেওয়ার শর্তে, ফলে সেই সার ব্যবসায়ীর কাছেই তারা ধান বিক্রি করে। বাকি শতকরা ৪৭ ভাগ চাষি ধার শোধের কোনও বাধ্যবাধকতা ছাড়াই নগদে স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছেই ধান বিক্রি করে। শতকরা প্রায় ১৮ ভাগ চাষি দূরে শহরের বাজারে তাদের ধান বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিক থেকে নমুনাভিত্তিক অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, যে-চাষিরা ধান বিক্রি করে, তাদের মধ্যে ২০.৮০ ভাগ তা বিক্রি করে সরাসরি চাল-কলে, শতকরা ৬৯.১২ ভাগ চাষি তাদের ফসল বিক্রি করে বড় চাষি-এজেন্টদের কাছে, শতকরা ১২.০৮ ভাগ বিক্রি করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে। এদের মধ্যে আমাদের নমুনা দলের শতকরা ৪৩.৬২ ভাগ ব্যবসায়ী মহাজনদের কাছে চাষের শুরুতে নেওয়া ধার শোধ করার জন্য ধান বিক্রি করে, শতকরা ২০.৮১ ভাগ চাষি চাষের শুরুতে ধারে নেওয়া সারের দাম শোধ করার জন্য ধান বিক্রি করে থাকে।

এই অনুসন্ধানটি অনেক পুরনো, প্রায় তিন দশক আগের। তবু এটি ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির একটি অংশের বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রসঙ্গত অন্য একটি গবেষণামূলক কাজের উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১১ সালে করা অনুরূপ একটি সমীক্ষা থেকেও এই অঞ্চলের কৃষিতে উপকরণ, ঋণ ও পণ্য-বাজারের একই ধরনের যৌথ ক্রিয়া ঘটতে দেখা যায়। এই সমীক্ষায় দেবজিৎ রায় পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান ও বীরভূম এই দু’টি জেলার দুই ভিন্ন স্তরের পরিকাঠামো ও সেচের ব্যবস্থা মনে রেখে ৪৫০টি চাষি পরিবার নিয়ে জোত স্তরে চাষের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমীক্ষা করেন। এই ৪৮০টি জোতের মধ্যে ৩৬৮টি জোতের চাষি পরিবার কোনও না কোনও ধরনের ঋণের ওপর নির্ভরশীল ও ৮২টি জোতের চাষি পরিবার চাষের জন্য কোনও ঋণ করে না। ৩৬৮টি ঋণী পরিবারের মধ্যে ৫৭টি পরিবার শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নেয়, ২৭৯টি পরিবার শুধুমাত্র অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নেয়, এবং ৯২টি পরিবার উভয় উৎস থেকেই ঋণ নিয়ে থাকে। অর্থাৎ দেবজিতের নমুনাটিতে ১৪৯ জন, বা ঋণী পরিবারের শতকরা ৪০.৫ ভাগ প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ নেয়, এবং এই ১৪৯ জনের মধ্যে শতকরা ৬১.৭ ভাগ আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণও নিয়ে থাকে। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের উৎসগুলি হল ধানের ব্যবসায়ী যারা একই সঙ্গে সারের ব্যবসাও করে, শুধু ধানচালের ব্যবসা করে, শুধু সারের ব্যবসা করে, জমির মালিক যে খাজনায় জমি চাষের জন্য লিজ দেয়, বড় জমির মালিক, চাল-কল, খুচরো দোকানদার, সোনা-রুপার দোকানদার ও স্থানীয় ব্যবসায়ী। ধার নেওয়া হয় টাকা, উপকরণ, টাকা ও উপকরণ। ঋণ শোধ দেওয়ার সময় শোধ দেওয়া হয়, টাকায়, ধান-চালের মাধ্যমে, অথবা শ্রমের বিনিময়ে। দেবজিতের নমুনাটিতে টাকায় ধার নিয়ে শতকরা ৭০ ভাগ চাষি টাকাতেই ধার শোধ দেয়, শতকরা ২৮ ভাগ শোধ দেয় শ্রমের বিনিময়ে, শতকরা ৩৬ ভাগ শোধ দেয় ধান-চালের মাধ্যমে। কৃষি-উপকরণ যারা ধার নেয়, তাদের শতকরা ৬৩ ভাগ শোধ দেয় ধান-চালের মতো উৎপাদিত শস্যের বিনিময়ে।

শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পঞ্জাবে জোত-স্তরে সমীক্ষা চালিয়ে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনিতা গিল (২০০৪) কৃষি-ঋণের বাজারে অনুরূপ পণ্য ও উপকরণ-বাজারের সংযুক্ত এক প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। পাতিয়ালা ও অমৃতসরের কৃষিতে কৃষক ও জমিহীন কৃষি-শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর এই অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়, জমিহীন কৃষি-শ্রমিকরা বছরের যে-সময়ে যথেষ্ট কৃষি-কাজ থাকে না সে সময়ে ঋণের জন্য জমির মালিক ও কমিশন এজেন্টদের ওপর নির্ভর করে। জমির মালিকদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ তারা ব্যস্ত মরশুমে কম মজুরিতে শ্রমের বিনিময়ে শোধ করে। জমি আছে এমন চাষিরা ঋণ শোধের জন্য অনেক সময়ে জমি বন্ধকি হিসেবে রেখে বড় চাষির কাছে ঋণ করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ছোট চাষির জমি যথাসময়ে সুদ সমেত ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য বড় মালিকের কাছে হস্তান্তরিত হয়।

মহারাষ্ট্রের কৃষি-ঋণের বাজারেও কৃষি উপকরণের ও পণ্যের ব্যবসায়ীরা যে একই সঙ্গে ঋণ, পণ্য ও উপকরণ জোগানদাতার ভূমিকায় কাজ করে তা উল্লেখ করেছেন সৃজিত মিশ্র (২০০৬)। টাকা যখন ঋণ শোধের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, তখন সুদের অত্যুচ্চ হার চাপানো হয়। এর পাশাপাশি অনেক সময়েই কৃষি-উপকরণের জোগানের বিপরীতে কৃষিপণ্যের মাধ্যমে ঋণ শোধিত হয়। ঋণের অর্থমূল্য হিসাবের সময় উপকরণের দামের ওপর জোগানদাতার একচেটিয়া সিদ্ধান্ত কাজ করে, ফসল ওঠার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের কম দামের ওপর ভিত্তি করে ঋণ শোধের জন্য প্রয়োজনীয় ফসলের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।

অন্ধ্রপ্রদেশে তৃণমূল স্তরে অনুরূপ যে-সমীক্ষা করেছেন ভি নরসিমা রাও ও কে সি সুরি (২০০৬) এবং ভি শ্রীধর (২০০৬), সেগুলিও একই ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। প্রথমত, চাষে শস্যবৈচিত্র আনার ফলে অন্ধ্রপ্রদেশে খাদ্যশস্যের জন্য বরাদ্দ জমির পরিমাণ কমেছে এবং তার জায়গায় অন্যান্য বাণিজ্যিক শস্যের চাষ বেড়েছে, কিন্তু তা গরিব ছোট চাষি বা বড় চাষি কারও পক্ষেই কল্যাণকর হয়নি। বাণিজ্যিক চাষের অতিরিক্ত ব্যয় অথচ উৎপন্ন ফসলের চাহিদা ও দামের অনিশ্চয়তার কারণে চাষের ব্যয় মেটাতে গিয়ে শুরুতেই চাষিকে যে-ঋণ নিতে হয়, তার পক্ষে সেটা শোধ দেওয়া হয়ে ওঠে অসম্ভব। এই ঋণ সুদে-মূলে জমতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত উপায়ান্তর না থাকায় চাষিকে আত্মহত্যার পথ নিতে হয়। পি নরসিমা রাও ও কে সি সুরি ২০০৫ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের দু’টি গ্রামে সমীক্ষার যে-ফল বিশ্লেষণ করেছেন তাতে আমরা দেখি, বিটি তুলা হোক বা উচ্চফলনশীল সাধারণ তুলা, কোনও ক্ষেত্রেই চাষি বাজারে প্রাপ্ত তুলার দাম থেকে চাষের বিপুল খরচ তুলতে পারে না। দু’টি গ্রামেই, বিশেষ করে বড় ও মাঝারি চাষির, চাষ থেকে আয় ঋণাত্মক। এটি শুধু তুলা চাষের ক্ষেত্রেই নয়, ধান চাষেও ঋণাত্মক আয় খুবই দেখা যায়, কারণ ফসল ওঠার পর চাষি যে-দাম পায় তা অধিকাংশ বছরেই চাষের বিপুল খরচ মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। চাষের বিপুল ব্যয়বৃদ্ধির কারণ প্রথমত চাষের উপকরণগুলি, বিশেষ করে বীজ ও সারের দামের বিপুল বৃদ্ধি, দ্বিতীয়ত, উপকরণের জোগানদাতা যারা, সেই ব্যবসায়ী-মহাজন, কমিশন এজেন্টরাই চাষের ব্যাপারে প্রধান পরামর্শদাতা, তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চাষি ব্যয়বহুল আধুনিক উপকরণগুলি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ভি শ্রীধর অন্ধ্রপ্রদেশের একটি গ্রামে সমীক্ষা করে চাষিদের আত্মহত্যার প্রসঙ্গে অনুরূপ সিদ্ধান্তে আসেন। নয়া উদারীকরণ নীতির কুফলগুলি আলোচনা করে এই নীতিগুচ্ছের প্রভাব ভারতীয় কৃষিকে কীভাবে সংকটে ফেলছে সে-বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেন। প্রথমত, এই নীতির নির্দেশ অনুযায়ী কৃষিপণ্যের মূল্যকে বিশ্ব-বাজারের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত করতে হয়েছে, যা চাষির জীবনে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলেছে। এই নীতির নির্দেশে কৃষিতে সবরকম সরকারি সহযোগিতার নীতি পরিহার করতে হয়েছে, ফলে সরকার আগে যে-ভরতুকিতে বিভিন্ন কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে সার, সরবরাহ করত তা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে। সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম উৎপাদন-মূল্যের স্তর এতই কম থাকে যে তা অনেক সময়ে বাজার-দামেরও নীচে নেমে যায় এবং মোট উৎপাদনের ব্যয় পূরণ করতে পারে না। সরকারি বিনিয়োগ কমার ফলে কৃষিতে স্থির পুঁজিগঠনের মাত্রা যথেষ্ট কমেছে, বেসরকারি পুঁজিগঠন বাড়লেও তা মোট পুঁজিগঠনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে স্থির পুঁজির গঠনে, হ্রাসের মাত্রা কমাতে পারেনি। এসবের মিলিত কারণে কৃষি উৎপাদন কমেছে, কৃষি থেকে আয় ঋণাত্মক হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তুলা চাষে এই ঋণাত্মক আয়, অর্থাৎ ক্ষতি, চাষিকে শেষপর্যন্ত মহাজনের উপর নির্ভরশীল করে তুলছে। আসলে অন্ধ্রপ্রদেশে বহুদিন ধরেই কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধির হারে নিম্নগতি লক্ষ করা যাচ্ছিল। তার ওপর খাদ্যশস্য উৎপাদনে নিযুক্ত জমির পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার ফলে রাজ্যে গরিব কৃষকের খাদ্যের পরিমাণে ঘাটতি কৃষকের দুর্দশা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এস মহাননকুমার ও আর কে শর্মার (২০০৬) কেরালা সম্পর্কিত সমীক্ষাও অনুরূপ সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়। নয়া উদারীকরণ নীতির ফলে রফতানি পণ্যগুলির উপর নির্ভরশীল কৃষকদের আয় বিশেষ ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে। বিশ্ব-বাজারে দামের ওঠানামা ও অনিশ্চয়তার কারণে কেরালার নারকেল, রাবার, গোলমরিচ, বড় এলাচ, কফি, চা ইত্যাদি বাণিজ্যিক রফতানিপ্রধান পণ্যগুলি চাষির জীবনে অনিশ্চয়তা ডেকে আনছে। বিশ্ব-বাজারে এইসব রফতানিমুখী পণ্যের দাম সর্বদাই ওঠানামা করে। চাষিদের পক্ষে এই অনিশ্চিত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠলে তাদের আত্মহত্যা ছাড়া অন্য উপায় থাকে না। যখনই বিশ্ব-বাজারে দাম নেমে যায় এবং তাদের আয় উৎপাদন-ব্যয় মেটাতে পারে না, তারা দেশের বাজারে মহাজন-ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। এই ঋণ তারা পরে শোধ করতে পারবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও থাকে না, কারণ সেটা নির্ভর করে তারা চাষ শুরু করার জন্য কতটা মূলধন জোগাড় করতে পারল এবং পরের উৎপাদন-চক্রে তারা বিশ্ব-বাজারে কী দাম পাবে তার ওপর। প্রায়শই একবার ঋণ নিলে ঋণের ফাঁদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, শেষপর্যন্ত জমা ঋণের ভার থেকে উদ্ধার না-পাওয়া চাষি আত্মহত্যার পথ নেয়।

২০১৭ সালে জ্ঞান সিং ও অন্যান্যরা পঞ্জাবের তিনটি অঞ্চলের ২৭টি গ্রাম থেকে ১০০৭টি কৃষক পরিবার ও ৩০০টি কৃষি-শ্রমিক পরিবার নিয়ে একটি নমুনাদল গঠন করে কৃষি-ঋণের বাজারের বর্তমান অবস্থা সমীক্ষা করেন। তাঁরা দেখেছেন, কৃষি-শ্রমিকরা তাদের মোট ঋণের শতকরা ৯১ ভাগের বেশি অংশ অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে নিয়ে থাকে। কৃষি-শ্রমিকের কাছে ঋণের প্রধান উৎস বড় চাষিরা। প্রান্তিক চাষি তাদের মোট ঋণের শতকরা ৪০ ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে নিয়ে থাকে। চাষির কাছে অসংগঠিত ঋণের প্রধান উৎস হল কমিশন এজেন্ট। তার পরই বড় জমির মালিকের ভূমিকা। বড় জমির মালিক এবং কমিশন এজেন্টরা তাদের অধিক ক্ষমতার জোরে কোনও অঞ্চলের ব্যাংকে কৃষকদের জন্য ধার্য ঋণের পরিমাণের বড় অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। প্রান্তিক চাষি, ছোট চাষিরা নানা শর্তে এই বড় চাষি, যারা অনেক সময় কমিশন এজেন্ট বা ব্যবসায়ীর কাজও করে, এদের কাছে কখনও চড়া সুদে টাকা, কখনও কৃষি-উপকরণ নেয়। দেখা যায় সুদের হার কখনও কখনও শতকরা ২২ থেকে ২৮ ভাগ বা তারও বেশি, এমনকী শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি হতে পারে। কৃষি-শ্রমিক ও প্রান্তিক চাষিরা সবচেয়ে বেশি সুদে ধার করতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন শ্রেণির চাষি, উৎপাদিত শস্যের বিনিময়ে ধার শোধ দেওয়ার শর্তে ঋণ নেয়। কৃষি-শ্রমিকরা ঋণ শোধ করতে না পারলে আবদ্ধ শ্রমিকে পরিণত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসংগঠিত ঋণের বাজারের এই শর্তগুলি, এদের চাপানো সুদের হার, আবদ্ধ শ্রমিক নিয়োগ ব্যবস্থা ইত্যাদি আইন অনুযায়ী ঘটে না। তাই সাধারণত সরকারি তথ্য সংগ্রহ ব্যবস্থায় বা গবেষকের সমীক্ষায় এগুলি যথাযথ উঠে আসে না। আমাদের নিজেদের সমীক্ষা ছাড়াও উল্লিখিত বেশ কিছু সমীক্ষায় এই বিষয়গুলি প্রকাশ পেয়েছে।

কৃষি-ঋণ, কৃষি-উপকরণ ও পণ্য-বাজারের একটি অংশ এই প্রকারে যৌথভাবে ক্রিয়া করে ও বিভিন্ন পিছিয়ে পড়া বৈশিষ্ট্য নিয়ে চালু থাকে। এই বাজার-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক পুঁজি একই সঙ্গে কৃষিপণ্য, কৃষি-ঋণ ও কৃষি-উপকরণের বাজার ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে ও তার মারফত জোগান ও চাহিদা এবং দামের ওপর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে চাষির সমস্ত উদ্বৃত্ত মূল্য শোষণ করে। ঋণ নিলে যন্ত্রপাতি ও উপকরণ কেনার কাজে চাষির খরচ করার ক্ষমতা বাড়ে ঠিকই কিন্তু দামের হেরফের করে ব্যবসায়ীরা চাষির সমস্ত সম্ভাব্য উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন-ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে রাখতে পারে। এটা ব্যবসায়ীর পক্ষে করা সম্ভব কারণ অসংখ্য ছোট ও প্রান্তিক চাষির উৎপাদন ও সম্ভাব্য উদ্বৃত্ত বাজারজাত করার প্রক্রিয়াটি থাকে ব্যবসায়ীরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই কারণেই আমরা দেখি এমনকী অতি ছোট ও প্রান্তিক চাষিও তাদের উৎপাদনের একটা বড় অংশ বাজারজাত করছে। কৃষিতে উন্নত যন্ত্রপাতি, অধিক ফলনশীল বীজ ও সারের ব্যবহার হওয়া সত্ত্বেও কেন ভারতীয় কৃষি দীর্ঘকালীন স্থবিরত্বের মধ্যে পড়েছে তার অনুসন্ধান এই প্রবন্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। এর প্রতিকারের জন্য আমাদের সুপারিশগুলো হল, কৃষিতে ভূমিসংস্কারের মধ্য দিয়ে উৎপাদন কাঠামোর পুনর্গঠন; একই সঙ্গে অ-কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিকের নিয়োগ বৃদ্ধির অবস্থা সৃষ্টি করে কৃষি থেকে অতিরিক্ত শ্রমশক্তিকে অন্য উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে সরিয়ে নিয়ে কৃষিতে উৎপাদন-কাঠামোর পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াকে চালু রাখার অবস্থা বজায় রাখা; এবং সেই সঙ্গে কৃষি-উপকরণ, কৃষি-ঋণ ও কৃষি-পণ্যের বাজারকে পরস্পর থেকে বিযুক্ত করে তাদের স্বাধীন ক্রিয়ার রাস্তা অবাধ রাখা।

ভারতীয় কৃষিজাত পণ্যের একটি অংশ সরকারি ব্যবস্থায় বাজারজাত করা হয়। সরকার চাল, গম, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা, তুলা, আখ ইত্যাদি পণ্যের জন্য একটি সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। এই সহায়ক মূল্যটি নির্ধারণ করার সময় শস্য উৎপাদনের ব্যয়ের ওপর একটি বাড়তি মূল্য যোগ করা হয়। উৎপাদন-ব্যয় হিসাবের সময় পারিবারিক শ্রমের মূল্যও বাজার-দামে হিসাব করে এতে যোগ করা হয়। বাজারে পণ্যের দাম শস্য ওঠার পরপরই খুব নীচে নেমে যায়। শস্য ওঠার পর দাম অনেক সময় এত নীচে নেমে যায় যে, চাষিদের উৎপাদন ব্যয়ের ওপর জীবনধারণের মতো কোনও উদ্বৃত্তই অবশিষ্ট থাকে না। বাজার-দামের অস্থিরতা-জনিত ক্ষতির হাত থেকে চাষিদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সরকার সহায়ক মূল্যে চাষিদের উৎপাদিত শস্যের একটি অংশ কিনে নেয়, এবং রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব ভোক্তাদের তা বিক্রি করে। কিন্তু ১৯৯১ সালের নয়া আর্থিক নীতি অনুযায়ী খাদ্যশস্যের বাজারে সরকারি কার্যকলাপকে অনেক সীমিত গণ্ডিতে বাঁধা হয়েছে, শস্যসংগ্রহের নীতিতে সরকারি প্রভাব কমিয়ে ফেলা হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি-সংক্রান্ত নীতিতেও সরকারি সংগ্রহের গুরুত্ব ও রেশন ব্যবস্থার গুরুত্ব কমিয়ে ফেলার স্পষ্ট নির্দেশ আছে। ফলে শুধুমাত্র দারিদ্রসীমার নীচে অবস্থিত মানুষদের রেশন ব্যবস্থার আওতায় রাখার এবং সাধারণ রেশন ব্যবস্থার ব্যাপ্তিকে সংকুচিত করে তাকে এই বিশেষ লক্ষ্যে ঢেলে সাজানোর নীতি অনুসৃত হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে, সরকারি সহায়ক মূল্যে সরকারি সংস্থাকে বিক্রির সুযোগ সম্বন্ধে সচেতন কৃষকের সংখ্যা (প্রতি হাজার কৃষক বিক্রেতার মধ্যে) অতি নগণ্য। ধান, গম ও আখের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি সবচেয়ে বেশি হলেও প্রতি হাজার কৃষক পরিবারের মধ্যে যথাক্রমে ৩১২, ৩৯২ ও ৪৫৪ জন, অর্থাৎ মোট কৃষকের সংখ্যার অর্ধেকও নয়। এদের মধ্যে আবার সচেতন কৃষকদের যে-অংশটি সরকারি সহায়ক সংস্থায় সহায়ক মূল্যে ফসল বিক্রি করে, তাদের সংখ্যা যথাক্রমে ১০০, ১৬২ ও ৩৬৬, অর্থাৎ মোট কৃষক জনগণের একটি ছোট অংশ মাত্র। যে-কোনও কারণেই হোক, দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ কৃষক এই সুযোগটি গ্রহণ করতে পারছে না। অধিকাংশ কৃষককে কোনও সহায়তা ছাড়াই ঋণের জন্য অসংগঠিত বাজারে কমিশন এজেন্ট ও মহাজনদের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাদের ফসল বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি রেখে ও ফসলের দামের হেরফের ঘটিয়ে কমিশন এজেন্টরা চাষিদের তৈরি উদ্বৃত্ত কৃষিক্ষেত্র থেকে বাণিজ্য-মহাজনিতে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ভারতের কৃষির বাজারে মহাজন-কমিশন এজেন্টদের এই ক্ষতিকারক ভূমিকা দেশের নীতি নির্ধারকদের অনেকের কাছেই গভীর উদ্বেগের বিষয়।

সারণি ৭.৩ প্রতি ১০০০ জন কৃষক পরিবারের মধ্যে যতজনের সরকারি সহায়ক মূল্য ও সংগ্রহ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা আছে (জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে সংগৃহীত তথ্য)

সারণি ৭.৩ প্রতি ১০০০ জন কৃষক পরিবারের মধ্যে যতজনের সরকারি সহায়ক মূল্য ও সংগ্রহ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা আছে (জানুয়ারি ২০১৩ থেকে জুন ২০১৩-র মধ্যে সংগৃহীত তথ্য)

Source: Key Indicators of Situation of Agricultural Households in India (NSS 70th Round)

কৃষিপণ্যের বাজারের সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা এবং সেই লক্ষ্যে কৃষি-বাজারের সংস্কার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত কাঠামোগত পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা নীতি নির্ধারকদের মধ্যে বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। পঞ্জাব সম্বন্ধে রমেশ চাঁদ উল্লেখ করেছেন যে, পঞ্জাবে প্রতিটি কৃষিপণ্যের বাজারে ২২০০০ কমিশন এজেন্ট ও অসংখ্য মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী মহাজন রয়েছে, এটা কৃষিপণ্য বিক্রির বাজারে কৃষকের আয় কমে আসার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কৃষি উৎপাদন-ব্যয় ও কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ বিষয়ক সংস্থার (Commission for Agricultural Costs and Marketing) প্রাক্তন সভাপতি অশোক গুলাতি উল্লেখ করেছেন, কমিশন এজেন্টরা কৃষিপণ্যের বাজারে অতিরিক্ত উচ্চ হারে কমিশন বসায়, চাষিদের আয়ের একটি বড় অংশ তারা কেটে নেয়।

এইভাবে অসংগঠিত বাজার-ব্যবস্থার কারণে কৃষকের মাথাপিছু উৎপাদন বাড়লেও আয় আশানুরূপ বাড়তে পারে না। ফলে কৃষকের হাতে বিনিয়োগ করার মতো উদ্বৃত্ত থাকে না, সামগ্রিকভাবে কৃষি উৎপাদনের ওপর তার ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে।

তথ্যসূত্র

১. Mukherjee, A. The New Agricultural Strategy and Uneven Rural Development. Research Project Sponsored by Indian Council of Social Science Research, 1988–89.

২. Roy, D. 2012. Some Aspects of Indian Agriculture Under New Agricultural Policy Regime: a Case study of some District of west Bengal, unpublished PhD thesis.

৩. Gill, A. 2004. “Interlinked Agrarian Credit markets.” Economic and Political Weekly. vol. 39 no 33.

৪. Mishra, S. 2006. “Farmers’ Suicides in Maharashtra.” Economic and Political Weekly. vol 41 no 26.

৫. Singh, G., Anupama, G. Kaur, R. Kaur, S. Kaur. 2017. “Indebtedness among Farmers and Agricultural Labourers in Rural Punjab.” Economic and Political Weekly. vol 52 no 6.

৬. Narayanamoorthy, A. & P. Ali. 2018. “Agriculture Market Reforms are must.” The Hindu Businessline 1st Jan 2018.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *