৭. কলিং বেল বাজাতেই

৭.

বাসায় ফিরে এসে দবির চাচা কলিং বেল বাজাতেই আব্বু দরজা খুলে দিলেন। দবির চাচাকে দেখে এক ধরনের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, আপনি চলে এসেছেন? ভেরি গুড। কিছু না বলে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে চলে গেলেন, তাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।

দবির চাচা বলল, না, না, আমাকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা কিসের?

আব্বু বললেন, সব কিছু ঠিক আছে তো?

দবির চাচা বলল, হ্যাঁ সবকিছু ঠিক আছে। ঠিকের ওপর ঠিক, ডাবল ঠিক আছে। তারপর দাঁত বের করে হাসল।

আব্বু বললেন, ভালোই হয়েছে আপনি চলে এসেছেন, আমাদের অফিসের একটা গেট টুগেদার, ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে যাওয়ার কথা। হঠাৎ করে নীতু বলেছে সে যাবে না! আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মতিগতি বোঝা কঠিন! নীতুকে তাহলে বাসায় রেখে যাই। আপনি যখন আছেন।

দবির চাচা এবারে তার সবগুলো দাঁত বের করে হাসল। বলল, নিশ্চিন্ত মনে যাও, আমি আছি!

.

আব্বু-আম্মু বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীতু টেলিফোনের কাছে ছুটে গেল। সে খুব দ্রুত মিতির বাসায় টেলিফোন করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর মিতি টেলিফোন ধরল, মিতির গলার স্বর শুনে নীতু উত্তেজিত গলায় বলল, মিতি তুই?

হ্যাঁ। কী হয়েছে?

সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হয়েছে তোকে বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।

কী হয়েছে সাংঘাতিক ব্যাপার?

তোকে বলছি শোন

নীতু অবশ্যি আর কিছু বলতে পারল না, তার কারণ ঠিক তখন দবির চাচা ঘরে এসে ঢুকেছে। নীতুর হাত থেকে টেলিফোনটা নিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে কর্ডটা ছিঁড়ে ফেলে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। নীতু ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে দবির চাচা?

দবির চাচা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এখনো কিছু হয় নাই, হবে।

কী হবে?

মজা হবে। অনেক মজা হবে। তুমি যদি চিৎকার করো, চেঁচামেচি করো তাহলে ঝামেলা হবে। আর তুমি যদি ভালো মানুষের মতো চুপচাপ বসে থাকো তাহলে কোনো ঝামেলা হবে না, শুধু মজা হবে।

নীতু বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কী বলছেন আপনি? তোমার কিছু বোঝার দরকার নাই। মেয়েমানুষেরা যত কম বোঝে তত ভালো। খালি চুপচাপ বসে থাকো। খালি মুখটা বন্ধ রাখো।

কেন মুখটা বন্ধ রাখতে হবে?

কারণ আমি তোমার ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে ধরব।

নীতু ভয়ানক চমকে উঠল, কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারল না, আমতা আমতা করে বলল, কী বলছেন আপনি? ভূ ভূতের বাচ্চা?

হ্যাঁ। দবির চাচা দাঁত বের করে খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, হ্যাঁ। আমি তোমার ভূতের বাচ্চাকে ধরব। ভূতের বাচ্চা বাজারে কত টাকায় বিক্রি হয় জানো? জানো না! তোমার জানার কথা না। আমি জানি। মানুষের বাচ্চা যত টাকায় বিক্রি হয় তার থেকে অনেক বেশি টাকায়। বুঝেছ? তাই বলছিলাম তুমি চিৎকার করবা না, চেঁচামেচি করবা না। করে লাভও নাই–

নীতু চিৎকার করে বলল, না”।

দবির চাচা তখন তার লোহার মতো হাত দিয়ে খপ করে নীতুকে ধরে তার মুখে জোর করে একটা টেপ লাগিয়ে দিল। তারপর হাত দুটো পেছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধে। তারপর একটা দড়ি দিয়ে তার পা দুটো বেঁধে তাকে পাজাকোলা করে বাইরের ঘরে সোফার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তারপর রিমোট কন্ট্রোলটা টিপে একটা হিন্দি চ্যানেল বের করে বলল, নাও মেয়ে এখন বসে বসে তুমি সিনেমা দেখো! আমি তোমার ভূতের বাচ্চাকেও ধরে আনি।

নীতু সোফায় বসে ছটফট করতে থাকে, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু কোনো লাভ হয় না, কোনোভাবেই শক্ত বাধন ছোটাতে পারে না। রাগে-দুঃখে তার চোখে পানি এসে যায়, কী করবে বুঝতে পারে না। ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে সে কথা দিয়েছিল তাকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে কিন্তু তার বদলে এখন দবির চাচা তাকে ধরে কোনো এক জায়গায় বিক্রি করে দেবে, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

দবির চাচা এদিকে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় চাকু নিয়ে নীতুর ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর চাকুটা দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, সোলায়মান! ওগো ভূতের বাচ্চা সোলায়মান! তুমি কোথায়? কিচি কিচি কু! কিচি কিচি কু! আমি তোমাকে নিতে এসেছি সোলায়মান! চলে আস আমার কাছে। আমি তোমার জন্যে এসেছি! কোথায় তুমি?

ভূতের বাচ্চাটিকে দবির চাচা দেখতে পায় না, তাই সে হাত নেড়ে তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। ভূতের বাচ্চা ভয় পেয়ে নিঃশব্দে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু হঠাৎ তার হাত লেগে টেবিল থেকে একটা কলম নিচে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দবির চাচা সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অল্পের জন্যে সোলায়মানকে ধরতে পারল না। সোলায়মান সরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে নীতুর একটা ক্রিমের কৌটা নিয়ে দবিরের দিকে ছুঁড়ে দিল। সেটা দবির চাচার কপালের ওপর গিয়ে লাগল এবং সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা লাল টমেটোর মতো ফুলে গেল। দবির চাচা কপালটা ধরে কিছুক্ষণ আউ আউ করে চিৎকার করল, তারপর হুঙ্কার দিয়ে বলল, ওরে সোলায়মানের বাচ্চা সোলায়মান, আজকে যদি তোকে ধরে আমি পিটিয়ে সিধা না করে ফেলি তাহলে আমার নাম দবির না! আমার সঙ্গে রংবাজি করো? আমার সঙ্গে ঘিরিঙ্গিবাজি করো? তোমাকে আজকে আমি জন্মের মতো শিক্ষা দিব। আমাকে তুমি চিন না! তুমি কই যাবে বল? এই ঘরের মাঝে আছ তুমি আমি জানি সোলায়মানের বাচ্চা সোলায়মান!

দবির চাচা চাকু ঘোরাতে ঘোরাতে এগোতে থাকে, যখন এক কোনায় কোণঠাসা করে ফেলল তখন নীতুর টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাস ছুঁড়ে মারল, সেটা একেবারে সরাসরি দবির চাচার নাকে এসে লাগল। দবির চাচা নিজের নাক চেপে ধরে চিৎকার করে নাকী গলায় বলল, ও মাইয়ারে মাইয়ারে মেরে ফেলবে মেরে ফেলল আউ আউ আউ! তারপর হিংস্র গলায় বলল, তুই আমারে এখনো চিনস নাই বান্দরের বাচ্চা বান্দর ভূতের বাচ্চা ভূত…

দবির চাচা তখন নীতুর বিছানা থেকে চাদরটা নিয়ে জালের মতো এদিকে-সেদিকে ছুঁড়তে থাকে, ভূতের বাচ্চা সোলায়মান তখন বিপদে পড়ে যায়। তার ওপর চাদরটা পড়তেই দবির চাচা বুঝে গেল সে কোথায় এবং চাদরের ওপর দিয়ে তাকে জাপটে ধরে ফেলল! ভূতের বাচ্চা নিজেকে ছোটানোর জন্যে চেষ্টা করল, প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগল কিন্তু বসার ঘরে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে থাকা নীতু ছাড়া আর কেউ সেই চিৎকার শুনতে পেল না।

দবির চাচা তখন ভূতের বাচ্চা সোলায়মানকে চাদরে পেঁচিয়েই বাইরে থেকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে নীতুর বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসার ঘর থেকে নীতুকে টেনে নিয়ে এসে তাকেও সোলায়মানের পাশে বসিয়ে দিয়ে আনন্দে হাঁ হাঁ করে হাসতে লাগল।

নীতুর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, এখন কেমন হলো? বুঝেছ সোনার চান্দ আমার সঙ্গে কোনো রংবাজি নাই! নিজের মাথায় টোকা দিয়ে বলল, এই যে আমার মাথাটা দেখেছ, এইটার মাঝে আছে ঘিলু আর ঘিলু। সেই ঘিলুর মাঝে আছে বুদ্ধি আর বুদ্ধি! এই বুদ্ধি দিয়ে আমি চলি, কারো কথার সাধ্যি নাই আমাকে ধরে।

তারপর নীতুর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তোমার বাবা মা আসতে আসতে রাত দশটা, ততক্ষণে আমি হাওয়া। আর তুমি তোমার বাবা-মায়েরে কী বলবা? দবির চাচা ভূতের বাচ্চাকে ধরে নিয়ে গেছে? সেই কথা কেউ বিশ্বাস করবে? উল্টা ভাববে তোমার মাথায় গোলমাল হয়ে গেছে! কথা শেষ করে দবির চাচা খাটাসের মতো হাঁ হাঁ করে হাসতে লাগল।

.

ঠিক তখন মিতি তার দুই ভাই সজল আর সজীবকে নিয়ে পরামর্শ করছে। নীতু তাকে ফোন করেছে কথা বলার জন্যে হঠাৎ করে কথা বন্ধ হয়ে গেল তারপর যতবার ফোন করেছে কোনো সাড়া-শব্দ নেই।

মিতি বলল, নীতুর নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে।

সজল-সজীব দুজনেই মাথা নাড়ল। মিতি বলল, আমাকে বলছিল একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে ঠিক তখন কথা বন্ধ হয়ে গেল।

সজীব জিজ্ঞেস করল, কী ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে?

জানি না।

সজীব বলল, মনে হয় ডাকাত পড়েছে।

সজীব ভয় পেয়ে বলল, ডাকাত? সর্বনাশ! এখন কী করব?

মিতি বলল, আমাদের যেতে হবে।

ডাকাতেরা যদি আমাদের কিছু করে?

করলে করবে। সেই জন্যে ঘরে বসে থাকব নাকি?”

সজল ভয়ে ভয়ে বলল, আব্বু-আম্মুকে বললে হয় না?

আব্বু পরীক্ষা নিতে ময়মনসিংহ গেছে। আম্মু গেছে ট্রেনিংয়ে। কাকে বলবি?”

সজল মাথা নাড়ল, বলল, বড় মানুষেরা আমাদের কথা বিশ্বাসও করবে না। কখনো বিশ্বাস করে না।

মিতি বলল, যা করার আমাদেরই করতে হবে।

সজীব মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমাদেরই করতে হবে।

সজল বলল, কিন্তু যদি আসলেই ডাকাত থাকে তাহলে তো বিপদ।

মিতি বলল, আমার কী মনে হয় জানিস?

সজল-সজীব দুজন একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, কী?

আমার মনে হয় ডাকাত না, দবির চাচা কিছু একটা করেছে।

সজীব চোখ বড় বড় করে বলল, দবির চাচা?

হ্যাঁ। মনে নাই আব্বু বলেছিল মানুষটা ক্রিমিন্যাল?

সজীব আর সজল দুজনেই মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, এটা আসলে দবির চাচাই হবে।

মিতি বলল, আমাদের দরজা দিয়ে ঢুকতে দেবে না। জানালা দিয়ে ঢুকতে হবে।

জানালা দিয়ে? সজীব অবাক হয়ে বলল, জানালা দিয়ে কেমন করে ঢুকব?

গ্রিল কেটে।

গ্রিল কেমন করে কাটব?

সজল বলল, হ্যাকস দিয়ে।

মিতি বলল, দেরি করে লাভ নাই, তাড়াতাড়ি চল। একটা ব্যাক পেকে যা যা দরকার নিয়ে নে।

সজল বলল, দড়ি, মোমবাতি, টর্চ লাইট, চাকু।

সজীব বলল, চাকু? চাকু কেন?

কখন কী দরকার হবে কে জানে?

তিনজন ছোটাছুটি করে ব্যাক পেকে সবকিছু ভরে ঘর থেকে। বের হয়ে গেল। রাস্তার পাশ দিয়ে তারা ছুটতে থাকে। তখন একটা স্কুটার পেয়ে গেল, লাফ দিয়ে তারা স্কুটারে উঠে বসল! কোথায় যেতে হবে বলে তারা চিৎকার করতে থাকে, তাড়াতাড়ি। খুব তাড়াতাড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *