৬১.
পরের দিন।
কক্ষপথ প্রায় গোলাকার, ট্র্যাভিজ চূড়ান্ত গলায় বলল, তার মানে সেখানে জীবনধারণ সম্ভব। এখনো কেউ আমাদের ধরার জন্য ছুটে আসেনি। আরো কাছে গিয়ে দেখতে হবে।
ছোট ছোট জাম্প দিতে এত দেরি করছ কেন? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
শোন কথা। বড় জাম্পের তুলনায় ছোট জাম্প সামলানো কঠিন। একটা পাথর তোলা সহজ না বালুর ঘোট কণা তোলা সহজ। তাছাড়া গায়া-স রয়েছে কাছাকাছি এবং মহাকাশ এখানে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। ফলে কম্পিউটারের জন্যও হিসাব করা কঠিন। একজন মিথলজিস্টও এটা বুঝতে পারবে।
পেলোরেট মেনে নিল।
খালি চোখেই এখন তুমি গ্রহটা দেখতে পারবে। ওই যে,দেখ। আহ্নিক গতি বাইশ গ্যালাকটিক ঘণ্টা এবং অক্ষের উপর বার ডিগ্রি হেলে আছে। বাসযোগ্য গ্রহের আদর্শ উদাহরণ। এবং ওখানে প্রাণ আছে।
কিভাবে বললে?
এ্যাটমোস্ফিয়ারে প্রচুর মুক্ত অক্সিজেন আছে। প্রচুর গাছপালা ছাড়া সেটা সম্ভব না।
বুদ্ধিমান প্রাণী।
রেডিও-ওয়েভ রেডিয়েশন বিশ্লেষণ করে বলতে হবে। অবশ্য অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী প্রযুক্তি পরিত্যাগ করেছিল।
হ্যাঁ, এমন কিছু ঘটনা আছে।
তোমার কথাই আমি মেনে নেব। ওটা তোমার ডিপার্টমেন্ট। তবে কতগুলো মেষপালকের ভয়ে মিউল পালিয়ে গিয়েছিল, স্বাভাবিক মনে হয় না।
কোনো উপগ্রহ আছে? পেলোরেট প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, আছে, ট্র্যাভিজও স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিল।
কত বড়? হঠাৎ পেলোরেটের গলার স্বর ফ্যাসফ্যাসে হয়ে গেছে।
নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবনা, সম্ভবত একশ কিলোমিটার ব্যাস।
ওহ্, পেলেরেট বিষঃ গলায় বলল। আরো চমৎকার কিছু বিস্ময়বোধক শব্দ বলার ইচ্ছা ছিল, মাই ডিয়ার চ্যাপ, তার আর দরকার নেই।
তোমার ধারণা উপগ্রহটা আরো বড় হলে এটা পৃথিবী হতে পারত?
হ্যাঁ, কিন্তু এখনতো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
বেশ, কম্পরের কথা ঠিক হলে পৃথিবী গ্যালাক্সির এই অংশে নেই। রয়েছে। সিরিয়াস সেক্টরে সত্যিই জেনভ, আমি দুঃখিত।
নাহ, ঠিক আছে।
শোন আমরা অপেক্ষা করব, আর ঝুঁকি নিয়ে ছোট একটা জাম্প করব। যদি বুদ্ধিমান প্রাণের কোনো চিহ্ন না পাই তখন হয়তো ল্যান্ড করা নিরাপদ হবে শুধু তখন ল্যান্ড করার কোনো কারণ থাকবে না। থাকবে কি?
.
৬২.
পরবর্তী জাম্প দিয়ে ট্র্যাভিজ অবাক সুরে বলল, ঠিক আছে জেনভ। এটাই গায়া, ঠিক আছে। অন্তত এর একটা উন্নত সভ্যতা আছে।
রেডিও ওয়েভ দেখেই বলে দিচ্ছ?
তারচেয়েও ভালো। একটা স্পেস স্টেশন গ্রহটাকে ঘিরে ঘুরছে। দেখেছ? ভিউস্ক্রিনে একটা বস্তু দেখা যাচ্ছে, পেলোরেট অনভ্যস্ত চোখে সেটা চিনতে পারল না। ট্র্যাভিজ বলে দিল, কৃত্রিম, ধাতব এবং রেডিও-সোর্স।
এখন কি করব?
কিছুই না, অন্তত কিছুক্ষণ। প্রযুক্তির এমন উন্নত অবস্থায় আমাদেরকে ওরা দেখতে পায়নি, সেটা অসম্ভব। কিছুক্ষণ পরেও যদি ওরা কিছু না করে আমি একটা রেডিও মেসেজ পাঠাবো। তারপরও যদি কিছু না করে ধীরে ধীরে সামনে এগুবো।
যদি ওরা কিছু করে?
সেটা নির্ভর করছে কিছুর উপর। যদি সেটা আমার পছন্দ না হয়, তখন আমি এই মহাকাশযানের সুবিধা নেব। আশা করি ওদের প্রযুক্তি এত উন্নত না।
তার মানে আমরা পালাব?
একটা হাইপার স্পেস মিসাইলের মতো।
পালাববাই যখন বোকার মতো এলাম কেন?
মোটেই না। আমরা অন্তত জানলাম গায়ার অস্তিত্ব আছে, উন্নত প্রযুক্তি আছে এবং আমদের ঘাবড়ে দেয়ার মতো কিছু একটা করছে।
কিন্তু, গোলান, সহজেই ভয় পাওয়া ঠিক না।
শোন জেনুভ, আমি জানি পৃথিবী খুঁজে বের করা ছাড়া গ্যালাক্সিতে তোমার আর কিছু চাওয়ার নেই। কিন্তু তোমার মতো আগ্রহ আমার নেই। আমাদের মহাকাশযানে কোনো অস্ত্র নেই, আর নিচের ওই মানুষগুলো বহুশতাব্দী নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে। ওরা হয়তো ফাউণ্ডেশনের নাম শুনেনি বা জানে না কিভাবে ভালো
আচরণ করতে হয়। হয়তো ওরা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন–একবার ওদের হাতে পড়লে আমরা আর আগের মতো হতে পারবনা। তুমি চাও ওরা তোমার মাইন্ড মুছে ফেলুক, যেন এরপর দেখা যায় তুমি মিথলজিস্টও না বা কোনো কিংবদন্তীও জান না।
পেলোরেট ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। যদি এভাবে বল–কিন্তু পালিয়ে আমরা কোথায় যাবো?
সহজ। আমরা টার্মিনাসে ফিরে যাবো।–অথবা বৃদ্ধ মহিলা যতটুকু কাছে যেতে দেয় ততটুকু কাছে যাবো। তারপর একটা বা পুরো এক ফ্লিট যুদ্ধযান নিয়ে ফিরে আসব। তখন পরিস্থিতি হবে ভিন্ন।
.
৬৩.
অপেক্ষা করছে ওরা। একটা রুটিনে পরিণত হয়েছে। টার্মিনাস থেকে সেশেল আসতে যত সময় লেগেছে, গায়ার কাছাকাছি তারা এর চেয়েও বেশি সময় অপেক্ষা করছে।
ট্র্যাভিজ কম্পিউটারে অটোমেটিক এলার্ম সেট করে হালকা ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল। সেই সময় এলার্মের শব্দ শুনে ধরমড় করে উঠে বসল। পেলোরেট দৌড়ে এসে ঢুকল ট্র্যাভিজের রুমে। শেভ করছিল, বাধা পড়েছে মাঝখানে।
কোনো মেসেজ এসেছে? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল।
না, ট্র্যাভিজ উৎফুল্ল স্বরে বলল। আমরা এগোচ্ছি।
এগোচ্ছি? কোথায়?
স্পেস স্টেশনের দিকে।
কেন?
আমি জানি না। মোটর চালু হয়ে গেছে, আর কম্পিউটার আমার সাথে সাড়া দিচ্ছে না কিন্তু আমরা এগোচ্ছি।–জেনভ, ওরা আমাদের আটকে ফেলেছে। গায়ার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি।
.
এক যাত্রা
৬৪.
ভিউস্ক্রীনে কম্পরের মহাকাশযান দেখে স্টর জেনডিবলের মনে হলো যেন অসম্ভব লম্বা যাত্রা শেষ হয়েছে। আসলে শেষ হয়নি, বরং শুরু হয়েছে। ট্র্যানটর থেকে সেশেল পর্যন্ত যাত্রা ছিল শুধু ভূমিকা।
সুরা নোভী ভয় পেয়েছে। ওটা আরেকটা যান মহাকাশের, মাস্টার?
মহাকাশযান, নোভী, হ্যাঁ। এটার কাছে পৌঁছানোর জন্যই এতদূর ছুটে এসেছি। এটা আমাদের যানের চেয়েও বড় এবং ভালো। এত জোরে ছুটতে পারে যে আমরা ওটাকে ধরতে পারব না–এমনকি অনুসরণও করতে পারব না।
মাস্টারদের যানের চেয়েও দ্রুতগতির? নোভী আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ল।
জেনডিবল কাঁধ ঝাঁকালো। তোমার কথামতো আমি হয়তো মাস্টার, তবে সবকিছুর মাস্টার না। আমাদের স্কলারদের কাছে ওরকম মহাকাশযান নেই, ওটার যারা মালিক তাদের যত বস্তুগত যন্ত্র আছে সেগুলোও আমাদের নেই।
কেন নেই, মাস্টার?
কারণ আমরা হচ্ছি আসল জিনিসের মাস্টার। ঐ সব বস্তুগত অগ্রগতি সবই তুচ্ছ।
গভীর চিন্তায় নোভীর দুই ভুরু এক হয়ে গেছে। আমার মনে হয় মাস্টারদের চেয়ে দ্রুত ছুটতে পারাটা কোনো সামান্য বিষয় না। ওই লোকগুলো কারা।
প্রশ্নটা শুনে জেনডিবল মজা পেল। নিজেদেরকে ওরা বলে ফাউণ্ডেশন। তুমি কখনো ফাউণ্ডেশনের নাম শুনেছ?
(অবাক হয়ে ভাবল হ্যামিশরা গ্যালাক্সির ব্যাপারে কতটুকু জানে। স্পিকাররাও এই ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি কেন।–নাকি শুধু সেই মাথা ঘামায়নি–শুধু তারই ধারণা যে হ্যামিশরা মাটি কাটা ছাড়া আর কিছু পারে না।)
নোভী চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ল। কখনো শুনিনি মাস্টার। স্কুলে শিক্ষকরা আরো অনেক বিশ্বের নাম বলেছিল। বলেছিল আমাদের হ্যামিশ বিশ্বের আসল নাম ছিল ট্র্যানটর এবং সেটা সবগুলো বিশ্ব শাসন করত। ট্র্যানটর চকচকে লোহা দিয়ে ঢাকা ছিল এবং ছিল একজন সম্রাট যে ছিল সবকিছুর মাস্টার।
জেনডিবলের দিকে লজ্জিতভাবে তাকিয়ে আবার বলল, আমি অবশ্য কিছুই বিশ্বাস করি না। দীর্ঘ রাতের সময় মিটিং হলে গল্প কথকরা অনেক গল্প শোনাতো। যখন ছোট ছিলাম তখন বিশ্বাস করতাম, কিন্তু এখন করি না। স্কুল মাস্টারের। গল্পতো আরো বিশ্বাস করি না।
নোভী, ঐ স্কুল মাস্টারের, গল্পটা সত্যি তবে ঘটনাগুলো ঘটেছিল বহুদিন আগে। সত্যি সত্যিই ট্র্যানটর একসময় ঢাকা ছিল ধাতু দিয়ে, একজন সম্রাট ছিল, যে পুরো গ্যালাক্সি শাসন করত। আর এখন এই ফাউণ্ডেশন কোনো একদিন সবগুলো বিশ্ব শাসন করবে। দিনে দিনে ওরা শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
ওরা সবকিছু শাসন করবে, মাস্টার?
এখনই না, পাঁচশ বছর পরে।
এবং তারা মাস্টারদেরও মাস্টার হবে?
না, না। তারা বিশ্বগুলো শাসন করবে। আমরা ওদের শাসন করব তাদের। এবং বিশ্বগুলোর নিরাপত্তার জন্য।
নোভী আবার চিন্তায় পরে গেল। মাস্টার, ফাউণ্ডেশনের কাছে এরকম মহাকাশযান অনেক আছে, তাই না?
আমার তাই মনে হয়, নোভী।
আর অন্যান্য জিনিসগুলো বেশ অদ্ভুত?
ওদের কাছে বিভিন্ন রকম শক্তিশালী অস্ত্র আছে।
তাহলে, মাস্টার, ওরা এখনই সবগুলো বিশ্ব দখল করতে পারে না?
না, পারে না। এখনো সময় আসেনি।
কেন? মাস্টাররা বাধা দেবে।
না। আমরা কিছু না করলেও ওরা সবগুলো বিশ্ব দখল করতে পারবে না।
কে তাদেরকে থামাবে?
শোন, এর জন্য একটা পরিকল্পনা আছে, অনেকদিন আগে এক মহাজ্ঞানী ব্যক্তি সেটা তৈরি করেছিলেন
থেমে একটু হাসল, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, বোঝানো একটু কঠিন, নোভী। অন্যসময় বলব। তাছাড়া ট্র্যানটরে ফেরার আগে যা ঘটবে সেটা দেখে তুমি। নিজেই বুঝতে পারবে, আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে না।
কি ঘটবে, মাস্টার?
ঠিক জানি না। তবে যা ঘটবে ভালোই ঘটবে।
অন্তত আশা করি। কথাটা সে মনে মনে ভাবল। তারপর ঘুরে কম্পরের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে লাগল।
নিজের উপরই তার রাগ লাগছে। এমন একটা দুর্বল বোকা-বোকা চিন্তার উৎস সে জানে। সেটা হচ্ছে কম্পরের মহাকাশযানের আকারে ফাউণ্ডেশনের বিশাল ক্ষমতার ছবি তার কাছে পরিষ্কার ধরা পড়েছে আর নোভী সেটার প্রশংসা করেছে খোলাখুলি।
বোকা! সে কিভাবে তার ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতার সাথে তুচ্ছ বস্তুগত শক্তি ক্ষমতার তুলনা করতে পারল?
এখনো বাইরের চাকচিক্য দেখে সে ভুল করে।
.
৬৫.
কম্পর নিশ্চিত হতে পারছেনা কেমন হবে তার আচরণ। সারাজীবন সে সর্বময়। ক্ষমতার অধিকারী স্পিকারদের ছবি কল্পনা করেছে–যে স্পিকারদের সাথে মাঝে মাঝে তার যোগাযোগ হয় এবং যাদের রহস্যময় হাতে রয়েছে সমগ্র মানবতা।
তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে স্টর জেনডিবলের কাছ থেকে সে সরাসরি নির্দেশ পেয়েছে। শুধু যে কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে তাই নয়, বরং মাইন্ডে তার উপস্থিতিও টের পেয়েছে–হাইপার রিলে ছাড়া হাইপারস্পীচ।
এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন অনেকদূর এগিয়ে গেছে ফাউণ্ডেশন থেকে। কোনো প্রকার বাস্তবযন্ত্র ছাড়াই, শুধু শিক্ষিত এবং অগ্রসর মাইন্ড পাওয়ারের সাহায্যে তারা যোগাযোগ করতে পারে বহু পারসেক দূরে, যা বাইরে থেকে কেউ কখনো ধরতে পারবে না। এটা এমন এক ধরনের অদৃশ্য, অস্পর্শনীয় নেটওয়ার্ক যা কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ মানুষের সাধনার বলে সবগুলো বিশ্বকে ধরে রেখেছে শক্ত হাতে।
কম্পর প্রায়ই উচ্ছ্বসিত হয় নিজের ভূমিকা নিয়ে। তার অবস্থান অনেক নিচে অথচ কত প্রভাবশালী। আর কত গোপন। এমনকি তার স্ত্রীও এই গোপন জীবনের ব্যাপারে কিছু জানে না।
আর এই স্পিকার জেনডিবলের হাতে রয়েছে লাটাই। হয়তো সেই হবে পরবর্তী ফার্স্ট স্পিকার, সম্রাটদের চেয়ে বড় সম্রাট, শাসন করবে সাম্রাজ্যের চেয়েও বড়। সাম্রাজ্য।
জেনডিবল পৌঁছে গেছে ট্র্যানটরের মহাকাশযান নিয়ে। সাক্ষাৎকারটা ট্র্যানটরে না হওয়ার হতাশা কম্পর জোর করে দূর করে দিল।
ট্র্যানটরের মহাকাশযান! গ্যালাক্সির অস্থির সময়ে ফাউণ্ডেশনের বণিকরাও এর থেকে ভালো যান ব্যবহার করত। ট্র্যানটর থেকে সেশেল আসতে যে এত সময় লেগেছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এটাতে একটা ইউনিক মেকানিজম পর্যন্ত নেই যাতে দুটো যানকে একত্র করে যাত্রীদের সরানো যায়। এমনকি সেশেলিয়ান ফ্লিটেও এই ব্যবস্থা রয়েছে। তার বদলে স্পিকারকে গতি নিয়ন্ত্রণ করে একটা দড়ি ছুঁড়ে দিতে হবে। তারপর সেটা ধরে ভেসে ভেসে এগোতে হবে,–ইমপেরিয়াল যুগের মতো।
ঠিক তাই, কম্পর তার হতাশা লুকাতে পারছে না। এই যান প্রাচীন ইমপেরিয়াল ভেসেল এবং ছোট।
দুটো কাঠামো দড়ি ধরে এগোচ্ছে তাদের একজনকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় এর আগে কখনো ভোলা মহাকাশে ভাসার অভিজ্ঞতা হয়নি।
শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছল দুজন। খুলে ফেলল স্পেস স্যুট। স্পিকার স্টর জেনডিবলের উচ্চতা স্বাভাবিক। দেখে বিশাল আর ক্ষমতাশালী মনে হয় না। এখন এমনকি স্পিকারও চমকিত হয়ে চারপাশে দেখছে।
অন্যজন একটা মেয়ে, প্রায় জেনডিবলের সমান লম্বা, অতি সাধারণ চেহারা। হা করে দেখছে চার পাশে।
.
৬৬.
দড়ি ধরে মহাশূন্যে ভাসার অভিজ্ঞতা জেনডিবলের জন্য নতুন কিছু না। অবশ্য সে মহাকাশচারী না আবার পুরোপুরি ভূ-চারীও না। প্রতিটি দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারকেই মহাকাশ ভ্রমণের সামান্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে হয়। (প্রীম পালভার, যার মহাকাশ ভ্রমণ কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছে, একবার বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন।–একজন স্পিকার তত বেশি সফল হবে সে যত কম মহাকাশে থাকবে।)।
এর আগে জেনডিবল তিনবার এরকম দড়ি ধরে ভেসেছে, এবার নিয়ে হবে চতুর্থবার। মনে কোনো ভয় থাকলেও নোভীর কথা চিন্তা করে সেটা দূর হয়ে গেল। শূন্যে পা ফেলতে মেয়েটা যে ভয় পাচ্ছে সেটা বলার জন্য মেন্টালিক্স এর কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি ভয় পাচ্ছি, মাস্টার, সব বুঝিয়ে দেয়ার পর সে বলেছিল। এটা কিছুই না যেখানে আমি পা রাখব। হঠাৎ করে হ্যামিশ উচ্চারণ শুরু করাতেই বোঝা যায়। কতখানি ভয় পেয়েছে।
জেনডিবল নরম সুরে বুঝিয়েছিল। তোমাকে এখানে রেখে যেতে পারি না, নোভী। আমি যেহেতু ঐ মহাকাশযানে যাচ্ছি তোমাকেও যেতে হবে। কোনো বিপদ হবে না, কারণ তোমার স্পেসস্যুট রক্ষা করবে তোমাকে। দড়ি থেকে হাত ছুটে গেলেও তুমি এক জায়গায় ভেসে থাকবে, পড়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমি থাকব তোমার একহাতের মধ্যেই। এস, নোভী, আমাকে দেখাও তুমি খুব সাহসী আর বুদ্ধিমতি–স্কলার হওয়ার যোগ্য।
এর পর আর কোনো আপত্তি করে নি। আর জেনডিবলের ইচ্ছা ছিল না নোভীর মাইন্ডের মসৃণতাকে নষ্ট করে, তারপরও মাইন্ড সারফেসে শান্ত স্পর্শ করল।
তুমি আমার সাথে কথা বলতে পারবে, স্পেসস্যুট পড়ার পর সে বললো। গভীর ভাবে চিন্তা কর, একটার পর একটা। আমার কথা শুনতে পারছ?
জি, মাস্টার।
ট্রান্সপারেন্ট ফেসপ্লেটের ভিতর ঠোঁট নড়তে দেখে সে বলল, ঠোঁট নাড়তে হবে, নোভী। কোনো ধরনের রেডিও নেই। সব করতে হবে মাইন্ড দিয়ে।
ঠোঁট নড়ল না কিন্তু চোখদুটো আরো গম্ভীর হয়ে গেল: আপনি শুনছেন, মাস্টার?
চমৎকার, জেনডিবল চিন্তা করল–তারও ঠোঁট নড়ল নাঃ তুমি শুনতে পারছ?
পারছি মাস্টার।
তাহলে আমার সাথে এস এবং আমি যা করি তাই কর।
পদ্ধতিটা জেনডিবলের জানা আছে। কোমর থেকে পা দুটো একসাথে ছড়িয়ে দিতে হবে। সরল পথে এগোনোর জন্য কোমর মধ্যাকর্ষণের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে, সেই সাথে বাহু দুটো সামনে বাড়িয়ে দোলাতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই সুরা নোভীকে বুঝিয়ে দিল। এখন পিছনে না তাকিয়েই নোভীর মস্তিষ্কের সংবেদনশীল স্পন্দন থেকে তার শারীরিক ভঙ্গি বুঝতে পারছে।
প্রথমবার হিসেবে নোভী যথেষ্ট ভালো করল, প্রায় জেনডিবলের মতোই। দুঃশ্চিন্তা বাদ দিয়ে মন দিয়ে নির্দেশ পালন করে গেল। যাই হোক আবার মহাকাশযানে উঠতে পেরে দুজনেই খুশী। স্পেস স্যুট থেকে বেরিয়ে যন্ত্রপাতির বহর দেখে জেনডিবল থমকে গেছে। কোনোটাই সে চেনে না, চেনার জন্য বেশি সময়ও পাবে না। যে এরই মধ্যে এই যান চালিয়েছে, তার কাছ থেকে প্রতিস্থাপন করে কৌশল জেনে নেয়া যাবে, কিন্তু সেটা প্রকৃত শিক্ষা হয় না।
তারপর কম্পরের দিকে মনোযোগ দিল। লম্বা, হালকা-পাতলা। তার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং সুদর্শন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে জীবনে প্রথমবার একজন স্পিকারকে দেখে সে হতাশ। কিছুটা অবজ্ঞাও প্রকাশ করছে। বড় কথা, নিজের অনুভূতি সে গোপন রাখতে পারছে না।
এটা কোনো ব্যাপার না। কম্পর ট্রানটোরিয়ান না পরিপূর্ণ দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারও না তার নিজের কল্পনা থাকতেই পারে। এমনকি মাইন্ডের অগভীর বিশ্লেষণেও সেগুলো ধরা পড়ছে। একটা কল্পনা হচ্ছে সত্যিকার ক্ষমতার বাহ্যিক প্রকাশ থাকবেই। অবশ্যই সে তার কল্পনাকে ধরে রাখতে পারে যতক্ষণ না সেগুলো জেনডিবলের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে। এই মুহূর্তে সেটা বাধা তৈরি করছে।
জেনডিবল যা করল সেটা হচ্ছে মেন্টালিক মান অনুযায়ী আঙ্গুল দিয়ে একটু টোকা দিল। তীক্ষ্ণ কিন্তু ভাসমান ব্যথার অনুভূতিতে হাবুডুবু খেতে লাগল কম্পর। তার চেতনার চামড়া ভেদ করে একটা একাগ্রতা ঢুকে পড়ছে জোর করে এবং তাকে অনিয়মিত কিন্তু ভয়ংকর একটা ক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন করে তুলছে, যা স্পিকার ইচ্ছা করলেই ব্যবহার করতে পারে।
কম্পর পড়ে থাকল জেনডিবলের প্রতি সীমাহীন শ্রদ্ধা নিয়ে।
জেনডিবল আমুদে গলায় বলল, আমি শুধু তোমার মনোযাগ আকর্ষণ করছি, কম্পর, প্রিয়বন্ধু। দয়া করে তোমার বন্ধু গোলান ট্র্যাভিজ এবং তার বন্ধু জেনভ পেলোরেটের বর্তমান অবস্থান আমাকে জানাও।
কম্পর দ্বিধা করছে, এই মেয়েটার সামনেই বলব, স্পিকার।
এই মেয়েটা, কম্পর, আমারই বর্ধিত অংশ। সব খুলে বলতে পারো।
আপনি যা বলেন, স্পিকার। ট্র্যাভিজ এবং পেলোরেট গায়া নামের একটা গ্রহের দিকে এগোচ্ছে।
শেষ যোগাযোগের সময় তুমি সেই কথাই বলেছিলে। নিশ্চয়ই ওরা গায়ায় ল্যান্ড করে আবার চলে গেছে। সেশেলে ওরা বেশিদিন ছিল না।
আমি যখন অনুসরণ করছিলাম তখনো ওরা ল্যান্ড করেনি। গ্রহটার দিকে এগোচ্ছে খুব বেশি সতর্ক হয়ে, মাইক্রো-জাম্পের আগে প্রচুর সময় নষ্ট করছে। আমার মনে হয় যথেষ্ট তথ্য না থাকায় ভয় পাচ্ছে ওরা।
তোমার কাছে তথ্য আছে, কম্পর?
নেই, স্পিকার। বা বলা যায় মহাকাশযানের কম্পিউটারে কিছু নেই।
এই কম্পিউটার, জেনডিবল কন্ট্রোল প্যানেলের উপর চোখ রেখে হঠাৎ আশা নিয়ে বলল। এটা কি মহাকাশযান চালাতে সাহায্য করবে?
হ্যাঁ, পুরোপুরি। আপনাকে শুধু চিন্তা করতে হবে।
হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল জেনডিবল। ফাউণ্ডেশন এতদূর এগিয়ে গেছে?
হ্যাঁ, কিন্তু আনাড়ীভাবে। কম্পিউটারটা ভালো কাজ করে না। বারবার চিন্তা করেও বেশি তথ্য পাইনি।
আমি হয়তো আরো ভালোভাবে করতে পারব।
কোনো সন্দেহ নেই, স্পিকার। কম্পর শ্রদ্ধার সাথে বলল।
ঠিক আছে বাদ দাও। এতে গায়ার ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই কেন?
আমি জানি না, স্পিকার। এটা দাবী করে একটা কম্পিউটার যতটুকু দাবী করতে পারে–এখানে গ্যালাক্সির সবগুলো মনুষ্য বসতি-গ্রহের রেকর্ড আছে।
এর ভেতরে যতটুকু তথ্য ঢোকানো হয়েছে ততটুকুই সে বলবে, এবং যারা তথ্যগুলো ঢুকিয়েছে তারা যদি মনে করে এধরনের সবগুলো গ্রহের রেকর্ড অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কিন্তু আসলে করেনি, তখন কম্পিউটারও ভুল ধারণা দেবে, ঠিক?
অবশ্যই, স্পিকার।
সেশেলে খোঁজ-খবর করেছ?
স্পিকার, কম্পর অস্বস্তির সাথে বলল, সেশেলে অনেকেই গায়ার ব্যাপারে কথা বলেছে। কিন্তু সব অর্থহীন কুসংস্কার। যে গল্পটা শুনিয়েছে সেটা হচ্ছে গায়া অত্যন্ত শক্তিশালী একটা গ্রহ যাদেরকে মিউলও ভয় পেত।
ওরা তাই বলেছে? জেনডিবল উত্তেজনা দমন করে বলল। তুমি এতই নিশ্চিত যে আর খোঁজ-খবর করো নি?
না, স্পিকার। অনেক খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু সব কথার শেষ কথা হচ্ছে এইমাত্র আমি যা বললাম।
স্বভাবতই, জেনডিবল বলল, ট্র্যাভিজও এগুলো শুনেছে এবং কোনো কারণে সেই মহাশক্তিকে ধরার জন্য ছুটেছে গায়ার দিকে। সতর্কতা দেখে মনে হয় ভয় পাচ্ছে সে।
অবশ্যই সম্ভব, স্পিকার।
অথচ তুমি তাকে অনুসরণ করোনি?
করেছি, স্পিকার। অন্তত গায়ার দিকে যাচ্ছে সেটা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত অনুসরণ করেছি। তারপর গায়ান সিস্টেমের বাইরের সীমানায় ফিরে এসেছি।
কেন?
তিনটা কারণ, স্পিকার। প্রথমত আপনার পৌঁছানোর সময় হয়ে গিয়েছিল এবং আমি চেয়েছিলাম কিছুটা এগিয়ে এসে আপনাকে তুলে নেই। যেহেতু আমার যানে হাইপার রিলে বসানো আছে, তাই টার্মিনাসে সন্দেহ না জাগিয়ে ট্র্যাভিজের কাছ থেকে দূরে যেতে পারব না, তবে এই পর্যন্ত আসাটা মনে হয়েছে নিরাপদ। দ্বিতীয়ত যখন দেখলাম ট্র্যাভিজ খুব ধীর গতিতে গায়া গ্রহের দিকে এগোচ্ছে, তখন ভাবলাম একটু এগিয়ে এসে আপনার সাথে দ্রুত সাক্ষাৎ করলে কোনো সমস্যা হবে না, কারণ যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় সেটা আমার চেয়ে আপনিই ভালো সামলাতে পারবেন।
একেবারে ঠিক কথা। আর তৃতীয়টা?
আমাদের শেষবার যোগাযোগের পর স্পিকার, এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যা আমি আশা করিনি–বুঝতেও পারছি না। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে আসার সেটাও একটা কারণ।
কোন ঘটনাটা তুমি আশা করোনি, বুঝতে পারোনি।
ফাউণ্ডেশন ফ্লিটের যুদ্ধযানগুলো সেশেল সীমান্তের দিকে এগোচ্ছে। আমার কম্পিউটার সংবাদটা ধরেছে সেশেল নিউজ ব্রডকাষ্ট থেকে। যুদ্ধযানের বহরে কমপক্ষে পাঁচটা আধুনিকযান রয়েছে যার একটাই সেশেলকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
জেনডিবল সাথে সাথে উত্তর দিলনা, কারণ এটা সে আশা করেনি–সেও বুঝতে পারছে না। তাই এক মুহূর্ত পরে অবজ্ঞার সুরে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হয় ট্র্যাভিজের গায়ার দিকে এগোনোর সাথে এর কোনো সম্পর্ক আছে?
অবশ্যই ঘটনাগুলো পর পর ঘটেছে–আর যদি খ অনুসরণ করে ক-কে তাহলে সামান্য হলেও সম্ভাবনা থাকে যে ক এর জন্য খ ঘটছে।
বেশ, আমরা সবাই তাহলে যাচ্ছি গায়া–ট্র্যাভিজ, আমি এবং প্রথম ফাউণ্ডেশন।–যাই হোক তোমার ভূমিকা তুমি ভালোভাবেই পালন করেছ, কম্পর। এখন কিছু কাজ সেরে ফেলি। প্রথমেই আমাকে দেখাও এই কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে এবং এটা দিয়ে কিভাবে মহাকাশযান চালাব। মনে হয় না বেশি সময় লাগবে।
তারপর তুমি আমার যানে উঠবে, এরই মধ্যে সেটা চালানোর কায়দা তোমার মাইন্ডে ছাপিয়ে দেব। কোনো সমস্যা হবে না। শুধু বলতে বাধ্য হচ্ছি (চেহারা দেখেই বুঝতে পারছ) জিনিসটা একেবারে প্রাগৈতিহাসিক। এখানেই অপেক্ষা করবে তুমি।
কতদিন, স্পিকার?
আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত। বেশিদিনের জন্য যেতে চাইনা, যাতে সাপ্লাই শেষ হয়ে গিয়ে তুমি বিপদে পড়। আর যদি দেরি হয়েই যায়, সেশেল ইউনিয়নের কোনো বসতি গ্রহে যাবে। যেখানেই থাকো তোমাকে খুঁজে নেব।
আপনি যেভাবে বলেন, স্পিকার।
আর কাউকে কিছু বলবে না। এই রহস্যময় গায়াকে আমি সামলাতে পারব, এবং যদি প্রয়োজন হয়, ফাউণ্ডেশনের পাঁচটা যুদ্ধযানকেও সামলাতে পারব।
.
৬৭.
লিটোরাল টোবিং সাত বছর ধরে সেশেল-এ ফাউণ্ডেশনের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছে। কাজটা তার ভালো লাগে।
লম্বা মজবুত কাঠামো, যখন ফাউণ্ডেশন এবং সেশেলের ফ্যাশন ছিল ক্লীন শেভ করা তখন থেকেই সে পাতলা গোফ রাখে। দৃঢ় প্রসন্ন মুখভাব, বয়স চুয়ান্ন হলেও শিশুসুলভ চেহারা। সহজে নিজের কাজের প্রতি আগ্রহী হতে দেখা যায় না।
অথচ এই কাজটা সে পছন্দ করে। এর কারণেই সে টার্মিনাসের রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচ থেকে দূরে থাকতে পেরেছে। সেশেলে বিলাসী জীবনযাপন করতে পারছে, নিজের স্ত্রী কন্যাকে এই সমাজে আসক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। জীবনে, কোনো ছন্দপতন ঘটুক সে চায় না।
অন্যদিকে সে কোডেলকে পছন্দ করে না, হয়তো কোডেলও গোঁফ রাখে বলে, যদিও অনেক ছোট এবং কাঁচাপাকা। পুরনো দিনগুলোতে এ ব্যাপারে দুজনের ভেতর যথেষ্ট প্রতিযোগিতা ছিল, এখন নেই।
সে টার্মিনাসে থাকতেই কোডেল নিরাপত্তা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব শুরু করে। তখন সে স্বপ্ন দেখছিল হারলা ব্র্যান্নোকে পরাজিত করে মেয়র হওয়ার। মেয়র নিজের স্বার্থেই তাকে অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব দিয়ে সরিয়ে দেয়, বিনিময়ে তার জন্য সে বয়ে আনে যথেষ্ট সুনাম। কিন্তু কোডেলকে পছন্দ করে না, তার সবসময়ের আমুদে ভঙ্গির কারণেই। কোডেল এমন একজন তোক যে কারো গলা কেটে ফেলার পরও হাসি খুশী থাকতে পারে।
এখন কোডেল বসে আছে হাইপার স্পেসাল ইমেজে, বরাবরের মতো হাসিখুশী আন্তরিক, তার আসল শরীর রয়েছে টার্মিনাসে, ফলে টোবিং আতিথেয়তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে।
কোডেল, টোবিং বলল, আমি চাই যুদ্ধযানগুলো সরিয়ে নেয়া হোক।
কোডেল উজ্জ্বলভাবে হাসল। আমিও চাই, কিন্তু ওল্ড লেডী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
তুমি তাকে বোঝাতে পারবে।
মাঝে মধ্যে পারি। যখন সে বুঝতে চায়। এখন চাচ্ছে না।–টোবিং, নিজের কাজ কর। সেশেলকে শান্ত রাখ।
সেশেলকে নিয়ে ভাবছিনা, কোডেল। আমি ভাবছি ফাউণ্ডেশনকে নিয়ে।
আমরা সবাই ভাবছি।
তর্ক করো না কোডেল। আমার কথা শোন।
সানন্দে, কিন্তু এখানে, টার্মিনাসে সময় খুব খারাপ। আমি সারাজীবন তোমার কথা শুনতে পারব না।
যতটুকু সম্ভব সংক্ষেপে বলছি।–যদি এই হাইপারস্পেসাল লাইন নিরাপদ হয় তাহলে খোলাখুলি বলতে পারি।
নিরাপদ।
তাহলে বলতে দাও। কিছুদিন আগে গোলান ট্র্যাভিজ নামে কারো কাছ থেকে একটা খবর পাই। পুরনো রাজনৈতিক জীবনে একজন ট্র্যাভিজকে চিনতাম, সে ছিল পরিবহনের কমিশনার।
ছেলেটার চাচা। কোডেল বলল।
আহ্, এই ট্র্যাভিজকে তুমি চেন তাহলে। তারপরে জানতে পেরেছি, সে ছিল একজন কাউন্সিলম্যান, যাকে সাম্প্রতিক সেলডন ক্রাইসিস শেষ হবার পর গ্রেফতার করে নির্বাসন দেয়া হয়।
ঠিক।
আমি বিশ্বাস করি না।
কি বিশ্বাস করো না?
যে তাকে নির্বাসন দেয়া হয়েছে।
কেন?
কোনো নাগরিককে নির্বাসন দেয়া হয়েছে, এমন ঘটনা ফাউণ্ডেশনের ইতিহাসে আছে? টোবিং দাবী জানালো। তাকে গ্রেফতার করা হবে বা হবে না। গ্রেফতার হলে বিচার হবে বা হবে না। বিচার হলে সে দোষী সাব্যস্ত হবে বা হবে না। দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে জরিমানা করা হবে, পদাবনতি দেয়া হবে, যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। নির্বাসন দেয়া হবে না।
প্রথমবার বলে একটা কথা আছে।
বোকা। সর্বাধুনিক মহাকাশযানে নির্বাসন? কোন বোকা বুঝবেনা যে সে তোমার ওল্ড লেডির বিশেষ মিশনে রয়েছে? কার চোখকে তিনি ফাঁকি দিতে চান?
মিশনটা কি হতে পারে?
হয়তো গায়া গ্রহ খুঁজে বের করা।
কোডেলের হাসিখুশি ভাব কিছুটা দূর হয়ে গেল। চোখের দৃষ্টি কঠোর। জানি আমার কথা বিশ্বাস করার কোনো আগ্রহ আপনার নেই, মি. অ্যাম্বাসেডর। তবে বিশেষভাবে অনুরোধ করব এই কথাটা বিশ্বাস করতে। ট্র্যাভিজকে নির্বাসন দেয়ার সময় মেয়র বা আমি কেউই গায়ার নাম জানতাম না। গতকালই প্রথম নামটা শুনেছি। কথাটা বিশ্বাস করলে আলোচনা আরেকটু এগোনো যায়।
কষ্ট হলেও আমি আমার সন্দেহপ্রবণ মানসিকতা বাদ দেব।
কথাটা সত্যি, মি. অ্যাম্বাসেডর, আর ছোট্ট একটা কথা যোগ করা প্রয়োজন। সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর আপনি অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন, আপনার জন্য আনন্দের কিছু হবে না। এমনভাবে বলছেন যেন গায়া আপনার পরিচিত। আপনি কিছু জানেন অথচ আমরা জানি না, কিভাবে সেটা সম্ভব হলো। আপনি যা জানেন সব আমাদের জানানো আপনার দায়িত্ব ছিল।
টোবিং নরম সুরে বলল, গায়া সেশেল ইউনিয়নের মধ্যে পড়ে না। হয়তো এর কোনো অস্তিত্বই নেই। সেশেলে গায়ার ব্যাপারে যত রূপকথা আর কুসংস্কার চালু আছে, সেগুলো টার্মিনাসে পাঠানো আমার দায়িত্ব ছিল? তুমি যদি বল যে ট্র্যাভিজকে পাঠানো হয়েছে গায়া খুঁজে বের করার জন্য এবং পাঁচটা আধুনিক যুদ্ধযান এই অনুসন্ধানে তাকে সাহায্য করছে, তারা কখনো বিশ্বাস করবে না। সাধারণ মানুষ রূপকথা বিশ্বাস করলেও সরকার করেনা এবং ফাউণ্ডেশন বিশ্বাস করে সেটাও তারা মানবে না। ওরা ধরে নেবে ফাউণ্ডেশন জোর করে সেশেলকে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে।
যদি সেরকমই পরিকল্পনা করে থাকি তাহলে?
ভুল হবে। কোডেল পাঁচ শতাব্দীর ইতিহাসে আমরা কখনো রাজ্য দখলের জন্য যুদ্ধ করেছি? বরং নিজেদেরই দখলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করেছি এবং একবার ব্যর্থ হয়েছি কিন্তু কোনো যুদ্ধ শেষেই আমাদের সীমানা বাড়েনি। ফেডারেশনে যোগ দেয়ার ব্যাপারটা সবসময়ই হয়েছে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। যারা মনে করেছে আমাদের সাথে যোগ দিলে লাভ হবে তারাই যোগ দিয়েছে।
হয়তো সেশেল এখন মনে করছে আমাদের সাথে যোগ দিলে তাদের লাভ হবে।
কখনোই মনে করবে না যতক্ষণ আমাদের যুদ্ধযানগুলো তাদের সীমান্তে থাকবে। ওগুলো সরিয়ে নাও।
সম্ভব না।
কোডেল, সেশেল ফাউণ্ডেশনের জন্য চমৎকার একটা বিজ্ঞাপন। ওদেরকে আমরা চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছি, অসহায় অবস্থায় আছে ওরা। অথচ এখনো স্বাধীন, নিজের মতো চলছে, এমনকি সরাসরি ফাউণ্ডেশনের বিরুদ্ধে বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করছে। গ্যালাক্সিতে এর থেকে আর কত ভালোভাবে প্রমাণ করা যাবে যে আমরা বল প্রয়োগ করতে চাইনা, বন্ধুত্ব চাই?–সেশেল দখল করা মানে নিজেদের জিনিস আবার দখল করা। অন্তত অর্থনৈতিকভাবে ওরা আমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু সামরিক শক্তি প্রয়োগ করা হলে গ্যালাক্সির সবাই বুঝে নেবে আমরা সাম্রাজ্যবাদী হয়ে পড়েছি।
আর যদি বলি যে আমরা আসলেই গায়ার ব্যাপারে আগ্রহী?
সেশেল ইউনিয়ন যতটুকু বিশ্বাস করেছে আমি তার বেশি বিশ্বাস করবনা। ট্র্যাভিজ আমাকে জানালো যে সে গায়ার দিকে যাচ্ছে এবং সেটা যেন টার্মিনাসকে জানাই। ইচ্ছা না থাকলেও আমি জানালাম। হাইপারস্পেসাল লাইন ঠাণ্ডা হওয়ার আগেই ফাউণ্ডেশন নেভী নড়তে শুরু করল। সেশেলিয়ান স্পেস ভেদ না করে তুমি কিভাবে গায়া পৌঁছবে?
প্রিয় টোবিং, নিজের কথাই তুমি ভুলে যাচ্ছ। এক মিনিট আগেই বলেছ গায়া সেশেল ইউনিয়নের মধ্যে পড়ে না। আমার ধারণা তুমি ত, যে হাইপার স্পেস সবার জন্য উন্মুক্ত, কোনো বিশ্বের নিজস্ব অঞ্চলের মধ্যে পড়েনা। এখন যদি ফাউণ্ডেশন টেরিটোরি থেকে হাইপারস্পেসের মধ্য দিয়ে গায়ান টেরিটোরিতে পৌঁছাই এবং তাদের স্পেসের এক কিউবিক সেন্টিমিটার অংশও অতিক্রম না করি, তখন সেশেলিয়ানরা কিভাবে অভিযোগ করবে?
ব্যাপারটা ওরা এভাবে দেখবে না, কোডেল। গায়াকে ওরা চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। রাজনৈতিকভাবে এক না হলেও তারা সেটাকে নিজেদের অংশ বলে দাবী করবে। শত্রুদের যুদ্ধযান এগিয়ে আসলে একথা বলবেই।
আমরাতো ওদের শত্রু না, বন্ধু।
আমি বলছি সেশেল যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে। হয়তো সামরিক শক্তিতে সে হেরে যাবে, কিন্তু এই যুদ্ধ গ্যালাক্সিতে ফাউণ্ডেশনের বিরুদ্ধে প্রবল জনমত তৈরি করবে; বিরুদ্ধপক্ষগুলোকে সাহায্য করবে জোট বাঁধতে। ফেডারেশনের কিছু সদস্য হয়তো নতুন করে নিজেদের অবস্থা বিবেচনা করবে। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার কারণেই যুদ্ধটা আমরা হেরে যাবো। পাঁচশ বছরের সব অগ্রগতি থেমে যাবে।
শান্তি, শান্তি, টোবিং কোডেল আগের সুরেই বলল। এমনভাবে বলছ যেন পাঁচশ বছর কিছুই না, এখনো স্যালভর হার্ডিনের যুগে পড়ে আছি। গ্যালাকটিক এম্পায়ার যখন সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল, আমরা এখন তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। ফাউণ্ডেশন নেভীর একটা স্কোয়াড্রন পুরো গ্যালাকটিক নেভীকে পরাজিত করতে পারবে, যে কোনো গ্যালাকটিক সেক্টর দখল করতে পারবে।
আমরা গ্যালাকটিক এম্পায়ারের সাথে যুদ্ধ করছিনা। যুদ্ধ করছি নিজেদের সময়ের গ্রহ এবং সেক্টরগুলোর সাথে।
যারা আমাদের মতো উন্নতি করতে পারেনি। আমরা এখনই পুরো গ্যালাক্সি একত্র করতে পারব।
সেলডন প্ল্যান অনুযায়ী তার জন্য আরো পাঁচশ বছর লাগবে।
সেলডন প্ল্যানে প্রযুক্তির অগ্রগতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। আমরা এখনই পারব।–বোঝার চেষ্টা করো, আমি বলছি না যে এখনই করব বা করা উচিত। শুধু বলছি যে করতে পারব।
কোডেল, সারাজীবন তুমি টার্মিনাসে কাটিয়েছ। গ্যালাক্সির আসল অবস্থা জান না। আমাদের নেভী যে কোনো গ্রহের সামরিক শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে,–কিন্তু তারপর বিদ্রোহে পরিপূর্ণ গ্যালাক্সিকে শাসন করতে পারবে না আর বল প্রয়োগ করলে ঠিক তাই ঘটবে। জাহাজগুলো ফিরিয়ে নাও!
সম্ভব না, টোবিং। ভেবে দেখ–গায়া যদি পৌরাণিক কাহিনী না হয়?
টোবিং থেমে কোডেলের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করল। হাইপারস্পেসে হারিয়ে যাওয়া একটা গ্রহ পৌরাণিক কাহিনী না?
এটা একটা কুসংস্কার, আর প্রত্যেক কুসংস্কারের পেছনেই কিছুটা সত্য থাকে। ট্র্যাভিজ এ ব্যাপারে এমন আচরণ করছে যেন সেটা বাস্তব মহাকাশের বাস্তব গ্রহ। তার কথা যদি ঠিক হয়?
ননসেন্স! আমি বিশ্বাস করিনা।
না? একবারের জন্য বিশ্বাস কর। একটা বাস্তব গ্রহ যে সেশেলকে মিউল এবং ফাউণ্ডেশনের কাছ থেকে রক্ষা করছে।
নিজের যুক্তি নিজেই খণ্ডন করছ। গায়া কিভাবে সেশেলকে রক্ষা করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযান পাঠাচ্ছি না?
তাদের বিরুদ্ধে না, গায়ার বিরুদ্ধে, যে গ্রহ রহস্যময়ভাবে অজানা–নিজেদের গোপন রাখতে এত বেশি সতর্ক যে প্রকৃত মহাকাশে থাকার পরেও প্রতিবেশী গ্রহগুলোকে কোনোভাবে বুঝিয়েছে সে হাইপারস্পেসে চলে গেছে এবং সর্বাধুনিক গ্যালাকটিক ম্যাপের পরিপূর্ণ কম্পিউটারাইজড ডাটা থেকে নিজেকে বাইরে রেখেছে।
খুব অস্বাভাবিক গ্রহ, কারণ হয়তো এটা মাইন্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আর তুমিই বলেছ একটা সেশেলিয়ান গল্পে বলা হয়েছে গ্যালাক্সি দখল করার জন্য মিউলকে পাঠিয়েছিল গায়া। মিউল কি মাইন্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না?
তাহলে গায়া মিউলদের গ্রহ?
সত্যি কথাটা তুমি বলতে পারবে?
পুনর্জন্ম লাভ করা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের গ্রহ হতে পারে।
কেন নয়? ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা উচিত না?
টোবিং একটু নরম হলো। কিছুক্ষণ আগেও মুখ বাঁকা করে হাসছিল, এখন মাথা নিচু করে রেখেছে। তারপর ভুরুর নিচ থেকে চোখ তুলে বলল, তদন্ত করে দেখাটা বিপজ্জনক হবে না?
হবে কি?
প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করায় বোঝা যাচ্ছে সঠিক উত্তরটা তোমার জানা নেই। মিউল বা দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশনারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযানগুলো কি কাজে আসবে। ওরা তোমাকে ধ্বংস করে ফেলবে। বরং সবকিছু স্বাভাবিকভাবে ঘটতে দাও। রক্তপাত এড়িয়ে, শান্তি বজায় রেখে। যুদ্ধযানগুলো ফিরিয়ে নাও।
সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি, টোবিং, মেয়র ব্র্যান্না নিজে এগুলোর সাথে থাকবেন, এবং স্কাউটশীপগুলো এরই মধ্যে হাইপারস্পেসের মধ্য দিয়ে গায়ান টেরিটোরির দিকে রওয়ানা দিয়েছে।
টোবিং এর চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে, যুদ্ধ একটা লাগবেই, আমি বলে দিলাম।
তুমি আমাদের অ্যাম্বাসেডর। সেটা ঠেকাও। সেশেলিয়ানদের যত ধরনের নিশ্চয়তা দরকার দাও। বোঝাও আমাদের কোনো অসৎ ইচ্ছা নেই। যা ইচ্ছা হয় তাই বল। শুধু ওদেরকে শান্ত রাখ।
একটু থেমে টোবিং এর হতভম্ব চেহারাটা দেখে নিল। এইটুকুই। ফাউণ্ডেশন শীপ ইউনিয়নের কোনো গ্রহে নামবেনা বা তাদের মহাকাশ অতিক্রম করবে না। যদি কোনো সেশেলিয়ান যান ইউনিয়নের বাইরে, কিন্তু ফাউণ্ডেশন এলাকার ভেতরে আমাদের চ্যালেঞ্জ করে, সাথে সাথে সেটাকে মহাকাশে মিশিয়ে দেয়া হবে। এব্যাপারেও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেবে এবং সেশেলিয়ানদের শান্ত রাখ। ব্যর্থতার জন্য দায়ী থাকবে তুমি। এবং যদি ব্যর্থ হও গ্যালাক্সির কোথাও গিয়ে বাঁচতে পারবে না।
যোগাযোগ কেটে দেয়ার সময় কোডেলের গলায় হুমকি বা বন্ধুত্ব কিছুই ছিল না।
টোবিং হা করে দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়।
.
৬৮.
ট্র্যাভিজ এমনভাবে চুল খামচে ধরল যেন নিজের চিন্তা ভাবনা বুঝতে চাইছে। অন্যমনস্ক গলায় পেলোরেটকে জিজ্ঞেস করল, তোমার মনের অবস্থা কি?
মনের অবস্থা? পেলোরেট ফাঁকা গলায় বলল।
হ্যাঁ। আমরা ফাঁদে পড়েছি–আমাদের যান চলে গেছে বাইরের নিয়ন্ত্রণে এবং দ্রুতগতিতে একটা অজানা গ্রহের দিকে এগোচ্ছি। তুমি ভয় পাচ্ছ?
পেলোরেটের লম্বা বিষণ্ণ মুখটা আরো বিষণ্ণ হয়ে গেল। ভালো লাগছে না ভয়ও পাচ্ছি না। তবে কিছুটা উদ্বিগ্ন।
আমারো একই অবস্থা। অদ্ভুত ব্যাপার! সেরকম ভয় পাচ্ছি না কেন?
এটাইতো আমরা আশা করেছিলাম গোলান।
কম্পিউটারের স্ক্রিনে স্পেস স্টেশনটা এখন আরো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। তার মানে যথেষ্ট কাছে চলে আসা গেছে।
ট্রাভিজের মনে হলো না এই স্পেস স্টেশন তেমন উন্নত। অথচ অনেক দূর থেকেই তাদের মহাকাশযানের নিয়ন্ত্রণ কজা করে ফেলেছে।
আমি বেশ ভালোভাবে চিন্তা করতে পারছি, জেনভ। ঠাণ্ডা মাথায়!–আমারতো উচিত এখন লাফ ঝাঁপ দিয়ে ঘেমে অস্থির হয়ে পড়া। কিছু একটা আশা করার মানে অসহায়ভাবে মরে যাওয়া না।
আমার তা মনে হয় না, গোলান। যদি গায়ানরা দূর থেকেই আমাদের মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তাহলে দূর থেকেই আমাদের মেরে ফেলতে পারবে। এখনো যখন বেঁচে আছি
কিন্তু আমাদের স্পর্শ করা হয় নি। আমরা খুব বেশি শান্ত। হয়তো আমাদের প্রশান্ত করে রেখেছে।
কেন?
মানসিকভাবে আমাদের সুস্থ রাখার জন্য। হয়তো ওরা কিছু প্রশ্ন করবে, তারপর মেরে ফেলবে।
যদি প্রশ্ন করার মতো যুক্তিবোধ তাদের থাকে, তাহলে কোনো ভালো কারণ ছাড়া আমাদের না মারার মতো যুক্তিবোধও থাকবে তাদের।
ট্র্যাভিজ চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিলের যেখানে হাত রাখত সেখানে পা তুলে দিল। হয়তো একটা ভালো কারণ তারা বের করে নেবে। তারপরেও, যদি আমাদের মাইন্ড স্পর্শ করে, খুব বেশি করে নি। মিউল হলে, সে আমাদেরকে ওখানে যাওয়ার জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী করে তুলত–অতি সানন্দে, অতি উৎসাহে আমাদের প্রতিটি লোমকূপ চিৎকার করে ওখানে যেতে চাইত। আঙ্গুল দিয়ে সে স্পেস স্টেশনের দিকে দেখালো। তোমার সেরকম মনে হচ্ছে, জেনভ?
অবশ্যই না।
আমি বেশ ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তির সাথে চিন্তা করতে পারছি। বেশ অদ্ভুত। নাকি আমি আসলে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, আতঙ্কে উন্মাদ হয়ে গেছি–শুধু কল্পনা করছি যে আমার যুক্তিবোধ ঠিক আছে।
পেলোরেট কাঁধ ঝাঁকালো। তোমাকে আমার পাগল মনে হচ্ছে। হয়তো আমিও তোমার মতোই পাগল এবং একই রকম কল্পনা করছি। সব মানুষের ভেতরেই একই রকম পাগলামী থাকে, সেটা যে কোনো সময় দেখা দিতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু নিজেদের অনুভূতি অনুসরণ করা ছাড়া আর কি করার আছে। তারপর অন্যমনস্ক গলায় বলল, তাছাড়া আমার নিজেরও কিছু যুক্তি রয়েছে।
হ্যাঁ?
বেশ, আমরা বলেছি গায়া মিউলের গ্রহ বা পুনর্গঠিত দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন। কিন্তু তৃতীয় অরেকটা বিকল্প থাকতে পারে, প্রথম দুটো থেকে অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত।
কি সেটা?
পেলোরেট যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়ল। ট্রাভিজের দিকে না তাকিয়ে নিচু চিন্তিত সুরে বলতে লাগল, গায়া–এমন এক বিশ্ব–অনির্ধারিত সময় ধরে যে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। অন্য কোনো গ্রহের সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করে নি। এদের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে অথচ কোনো চেষ্টাই করে নি ক্ষমতা আরো বাড়ানোর। শুধু চেয়েছে একা থাকতে।
ট্র্যাভিজ চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল, তো?
ব্যাপারটা মানুষের আচরণের সাথে মেলেনা। মহাকাশে মানুষের বিশ হাজার। বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাসে দেখা যায় যে তারা সবসময় সীমানা বৃদ্ধি করে চলেছে। যতগুলো বাসযোগ্য গ্রহ পাওয়া গেছে বসতি করেছে সবগুলোতে। সীমানা। বৃদ্ধির জন্য গ্রহে গ্রহে লড়াই হয়েছে, প্রত্যেকটা গ্রহই কোনো না কোনো সময়। লাঞ্ছিত হয়েছে প্রতিবেশীদের দ্বারা। গায়া মানুষের এই স্বাভাবিক আচরণ মানেনি, তার কারণ হয়তো তারা মানুষ না।
ট্র্যাভিজ মাথা নাড়ল, অসম্ভব।
কেন অসম্ভব? রাগের সাথে বলল পেলোরেট। আমি তো বলেছি গ্যালাক্সিতে মানুষই একমাত্র বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়েছে, সেটা একটা মস্ত ধাঁধা। যদি তা না হয়? অন্তত আরো একটা বুদ্ধিমান প্রজাতি থাকতে পারে–এই একটা গ্রহে–যাদের মানুষের মতো বিস্তারণশীল স্বভাব নেই? তাছাড়া, পেলোরেট আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ল, হয়তো গ্যালাক্সিতে এক মিলিয়ন বুদ্ধিমান প্রজাতি রয়েছে, তারমধ্যে মাত্র একটা বিস্তারণশীল–আমরা। বাকীরা ঘরে লুকিয়ে আছে।
অবাস্তব! ট্র্যাভিজ বলল। থাকলে দেখা পেতামই। যত উন্নত প্রযুক্তিই থাকুক আমাদের ঠেকাতে পারত না। স্পেস! মানুষ ছাড়া অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সভ্যতার ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাইনি, পেয়েছি? তুমি তো ইতিহাসবিদ, তুমিই বলো, পেয়েছি?
পেলোরেট মাথা নাড়ল। না পাইনি। কিন্তু একটা থাকতে পারে! এই একটা!
আমি বিশ্বাস করি না। তুমি বলেছ গায়া অতিপ্রাচীন একটা শব্দ যার অর্থ পৃথিবী। সেটা মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর হয় কিভাবে?
এই গ্রহের নাম গায়া রেখেছে মানুষ কে জানে কেন? প্রাচীন শব্দের সাথে এর মিলটা হতে পারে কাকতালীয়। ভেবে দেখো, আমরা বেশ আগ্রহ নিয়ে গায়ার। দিকে এগোচ্ছি–একটু আগেই তুমি বিস্তারিত বুঝিয়ে বলেছ–আর এখন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই গায়ানরা মানুষ কিনা সেই ব্যাপারে যুক্তি তৈরি করছি।
কেন? মানুষ ছাড়া অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে কি সম্পর্ক?
ওরা আমাদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে মানুষের ব্যাপারে?
জেনভ, তুমি পাগল হয়ে গেছ। হাজার বছর ধরে ওরা এমন এক গ্যালাক্সিতে বাস করছে যার চারদিকে রয়েছে শুধু মানুষ। এতদিন পরে কেন আগ্রহী হবে? আগে হয়নি কেন? আর যদি হয়ই কেন আমাদের বেছে নিল? কাছাকাছি সেশেল বাদ দিয়ে এতদূর টার্মিনাসে গেল কেন?
হয়তো ওরা ফাউণ্ডেশনের ব্যাপারে আগ্রহী।
ননসেন্স, হিংস্র গলায় বলল ট্র্যাভিজ। জেনভ, তুমি মানুষ ছাড়া বুদ্ধিমান প্রাণী চাইলে আর একটা পেয়ে গেলে। আমার মনে হয় এখন তুমি ধরা দিতে বা অসহায়। অবস্থায় মরে যেতেও আপত্তি করবে না–যদি ওরা তোমাকে কৌতূহল নিবৃত্ত করার একটু সময় দেয়।
পেলোরেট আপত্তি জানাতে গিয়েও থেমে গেল। গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, বেশ, হয়তো তোমার কথাই ঠিক, গোলান, কিন্তু অন্তত কিছুক্ষণ আমি আমার বিশ্বাস ধরে রাখব। ওখানে কি আছে সেটা জানার জন্য হয়তো বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।–দেখ।
স্ক্রিনের দিকে দেখালো সে। ট্র্যাভিজ উত্তেজনায় চোখ সরিয়ে নিয়েছিল, আবার ফিরে তাকালো। কি এটা?
স্টেশন থেকে একটা যান বেরিয়ে আসছে না?
কিছু একটা, ট্র্যাভিজ নিরাসক্ত গলায় স্বীকার করল। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। ছবিটাও আর বড় করা যাবে না। মনে হচ্ছে আমাদের দিকেই আসছে এবং আমার ধারণা এটা একটা মহাকাশযান। আমরা একটা বাজী ধরতে পারি?
কি ধরনের বাজী?
ট্র্যাভিজ আমুদে গলায় বলল, যদি টার্মিনাসে ফিরতে পারি, তাহলে একটা ডিনারের ব্যবস্থা করা হবে এবং আমরা দুজনেই সর্বোচ্চ চারজন গেস্ট নিয়ে আসতে পারব যে মহাকাশযান আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে তাতে যদি মানুষ ছাড়া অন্য কোনো। বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, ডিনারের খরচ দেব আমি, যদি মানুষ থাকে খরচ দেবে তুমি।
আমি রাজি।
ঠিক আছে, তাহলে। ভালোমতো বোঝার জন্য ট্র্যাভিজ গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের দিকে। অবাক হয়ে ভাবছে মানুষ না অন্য কোনো জীব সেটা কি আসলেই বোঝা যাবে।
.
৬৯.
ব্র্যান্নোর মরিচা রঙের চুলগুলো সুন্দর করে আচড়ানো। যেন তিনি প্রশান্ত মেজাজে মেয়রাল প্যালেসে বসে আছেন। স্বাভাবিক আচরণে মনেই হয় না যে তিনি জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো মহাকাশে বেরিয়েছেন। (প্রথমবার যখন তিনি বাবা-মায়ের সাথে কালগানে গিয়েছিলেন-হিসেবে না ধরলেও বলবে। তখন তার বয়স ছিল তিন।)
কোডেলকে তিনি ক্লান্ত গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, নিজের মত জানানো এবং আমাকে সতর্ক করে দেয়া টোবিং-এর দায়িত্ব। বেশ, সে আমাকে সতর্ক করেছে। তার বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই।
সমস্যা এড়ানোর জন্য কোডেল মেয়রের মহাকাশযানের ইমেজ বড় করে নিয়েছে, বলল, এই পদে সে অনেকদিন থেকে আছে। চিন্তা ভাবনা হয়ে পড়েছে সেশেলিয়ানদের মতো।
এটা হচ্ছে অ্যাম্বাসেডরশীপের পেশাগত বিড়ম্বনা। এই ব্যাপারগুলো শেষ হয়ে যাক, তাকে একটা দীর্ঘ ছুটি দেব। তারপর দায়িত্ব দিয়ে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেব। লোকটা দক্ষ। অন্তত ট্র্যাভিজের খবর সে দেরি না করেই জানিয়েছে।
ছোট করে হাসল কোডেল। হ্যাঁ, আমাকে বলেছে যে নিজের বিচার বুদ্ধির বিরুদ্ধে গিয়ে সে কাজটা করেছে। আসলে ম্যাডাম মেয়র, ট্র্যাভিজ সেশেল ইউনিয়নের মহাকাশে প্রবেশ করার সাথে সাথে অ্যাম্বাসেডর টোবিংকে আমি সমস্ত খবর দেরি না করেই জানাতে বলেছিলাম।
ওহ? মেয়র ব্র্যান্নো কোডেলের মুখটা আরো ভালোভাবে দেখার জন্য নিজের চেয়ারে ঘুরে বসলেন। কেন করেছিলে?
আসলে স্বাভাবিক বিবেচনা বোধ। ট্র্যাভিজের হাতে রয়েছে একটা লেটেস্ট মডেল ফাউণ্ডেশন ন্যাভাল ভেসেল। অথচ সে ডিপ্লোম্যাট না। সেশেলিয়ানরা দুটো ব্যাপারই খেয়াল করবে। ফলে সে হয়তো বিপদে পড়ত। ফাউণ্ডেশনাররা গ্যালাক্সির যেখানেই সমস্যায় পড়ে নিকটস্থ ফাউণ্ডেশন প্রতিনিধির কাছে দৌড়ায়। ট্র্যাভিজ সমস্যায় পড়লে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশী হতাম। কিন্তু আপনি তাকে পাঠিয়েছেন লাইটনিং রড হিসেবে। আপনার উদ্দেশ্য যাতে ব্যাহত না হয় সেজন্যই আমাদের নিকটস্থ প্রতিনিধিকে তার উপর নজর রাখতে বলেছিলাম।
আচ্ছা, বেশ, বেশ, এখন বুঝতে পারছি কেন টোবিং এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। আমিও তাকে ঠিক একই নির্দেশ পাঠিয়েছিলাম। দুজনের কাছ থেকে আলাদাভাবে একই নির্দেশ পাওয়ার পর, কয়েকটা যুদ্ধযানের অগ্রগতিকে সে অনেক বড় বলে ধরে নিয়েছে। কেউ তাকে দোষ দিতে পারবে না। কিন্তু নির্দেশটা পাঠানোর আগে তুমি আমার সাথে পরামর্শ করনি কেন?
কোডেল ঠাণ্ডা গলায় বলল, আমার সব কাজে যদি আপনাকে জড়াই, আপনি আর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। আপনার উদ্দেশ্যের কথাও আমাকে জানান নি।
ব্র্যান্নো তিক্ত গলায় বললেন, আমার সব উদ্দেশ্যের কথা জানলে, লিয়নো, তুমি অনেক বেশি জেনে ফেলবে। বাদ দাও এসব ছোটখাটো ব্যাপার। আমি ট্র্যাভিজের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী।
আমাদের স্কাউটরা কম্পরকে খুঁজে পেয়েছে। ট্র্যাভিজকে অনুসরণ করছে সে, আর দুজনেই এগোচ্ছে গায়ার দিকে, অত্যন্ত সাবধানে।
স্কাউটদের পুরো রিপোর্ট আমি পেয়েছি, লিয়নো। স্পষ্টই কম্পর এবং ট্র্যাভিজ পায়াকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে।
গায়ার কুসংস্কারের কথ্য শুনে সবাই নাক সিটকায়, ম্যাডাম মেয়র, আবার সবাই ভাবে যদি সত্যি হয়। এমনকি অ্যাম্বাসেডর টোবিং পর্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছিলেন। সেশেলিয়ানদের এটা একটা চৌকয় নীতি একধরনের নিরাপত্তা। যদি কেউ রহস্যময় ও অজেয় একটা গ্রহ নিয়ে পাল্প ছড়ায়, মানু তখন শুধু ঐ গ্রহ থেকেই দূরে থাকবেনা, বরং চারপাশের গ্রহগুলো থেকেও দূরে থাকবে–যেমন সেশেল ইউনিয়ন।
তোমার ধারণা সেকারণেই মিউল সেশেল থেকে ফিরে গিয়েছিল?
সম্ভবত।
নিশ্চয়ই ভাবছনা যে গায়ার কারণে ফাউণ্ডেশন সেশেলের উপর প্রভাব বিস্তার করবে, যেখানে এই গ্রহের কথা আমরা জানিই না।
স্বীকার করছি, আমাদের আর্কাইভে গায়ার নাম নেই, কিন্তু সেশেল ইউনিয়নের প্রতি সংযত আচরণের নিশ্চয়ই অন্য কোনো কারণ আছে।
আশা করা যায় সেশেলিয়ান সরকার কিছুটা হলেও গায়ার শক্তি আর ভয়ংকর স্বভাব নিয়ে নিজেদের বুঝিয়েছে।
কেন?
কারণ একমাত্র তখনই আমরা গায়ার দিকে এগোলে ওরা আপত্তি করবে না। যতই অসন্তুষ্ট হোক নিজেদেরকে বোঝাবে যে গায়া আমাদের চিবিয়ে খাবে। এর থেকে তারা হয়তো ভবিষ্যতের জন্য ভাল শিক্ষা নিতে পারবে বলে আশা করছে।
যদি তাদের বিশ্বাস সঠিক হয়, মেয়র? যদি আসলেই গায়া ভয়ংকর হয়?
তুমিও সেই একই প্রশ্ন তুলছ, লিয়নো যদি সত্যি হয়। তাই না?
সব সম্ভাবনা আমাকে বিবেচনা করতে হবে, মেয়র। এটাই আমার কাজ।
গায়া যদি সত্যি সত্যি ভয়ংকর হয়, ট্র্যাভিজকে ওরা ধরে নিয়ে যাবে। লাইটনিং রড হিসেবে এটাই ওর দায়িত্ব। এবং আশা করি হয়তো কম্পকেও ধরবে।
আশা করেন? কেন?
কারণ, তখন তারা অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, আমাদের জন্য ভালো। ছোট করে দেখবে আমাদের শক্তিকে। ফলে সহজে তাদেরকে সামলানো যাবে।
কিন্তু যদি আমরাই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি?
আমরা হব না। ব্র্যালো সহজ গলায় বললেন।
এই গায়ানরা তারা যাই হোক এমন কিছু যার কোনো ধারণা আমাদের নেই, তাই আসল বিপদ বুঝতে পারছি না। আমার পরামর্শ এই সম্ভাবনাটাও বিবেচনা করা দরকার।
অবশ্যই তোমার মাথায় এই প্রশ্ন এলো কেন?
কারণ, আমার ধারণা, আপনি সন্দেহ করছেন গায়া দ্বিতীয় কাউণ্ডেশন। যাই হোক সেশেলের চমৎকার ইতিহাস রয়েছে। এমনকি এম্পায়ারের যুগও সে তার স্বশাসন বজায় রেখেছিল। শোষক সম্রাটদের আরোপিত করের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। সংক্ষেপে সেশেল গায়ার কাছ থেকে নিরাপত্তা পেয়েছে। এমনকি ইমপেরিয়াল যুগেও।
বেশ?
কিন্তু হ্যারি সেলডন দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন ঠিক যে সময়ে ফাউণ্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইমপেরিয়াল যুগে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন ছিল না–গায়া ছিল। কাজেই গায়া দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন হতে পারে না। এটা অন্য কিছু–এবং সম্ভবত আরো খারাপ।
আমি অজানা ভয়ে ভীত হতে চাইনা, লিয়নো। সম্ভাব্য বিপদের উৎস দুটো–বাস্তব অস্ত্র, মেন্টাল অস্ত্র–দুটোর জন্য আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত। নিজের যানে ফিরে যাও এবং পুরো ইউনিটকে সেশেল সীমান্তের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখ। শুধু এই যান একা গায়ার দিকে এগোবে। তোমাদের সাথে যোগাযোগ থাকবে। যদি প্রয়োজন হয় একটা জাম্প দিয়ে তুমি আমার কাছে পৌঁছবে। যাও, লিয়নো।
শেষ একটা প্রশ্ন। আপনি জানেন আপনি কি করছেন?
আমি জানি, তিনি হাসিমুখে বললেন। সেশেলের ইতিহাস আমিও পড়েছি, এবং বুঝতে পেরেছি গায়া দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন না। কিন্তু বলেছি তো স্কাউটদের পুরো রিপোর্ট পেয়েছি এবং সেখান থেকে
হ্যাঁ?
বেশ, আমি জানি কোথায় রয়েছে দ্বিতীয় ফাউণ্ডেশন, এবং আমরা দুটোকেই সামলাবো, লিয়নো। প্রথমে সামলাবো গায়া, তারপর ট্রানটর।
.
গায়া
৭০.
স্পেস স্টেশন থেকে মহাকাশযান ফার স্টারের কাছে পৌঁছতে এক ঘণ্টা লাগল–ট্র্যাভিজের জন্য অসহ্য একটা ঘণ্টা।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে সংকেত পাঠিয়ে সাড়া পাওয়ার চেষ্টা করত। সাড়া না পেলে চেষ্টা করত সরে যাওয়ার।
যেহেতু সে নিরস্ত্র এবং কোনো সাড়া পাচ্ছেনা, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কম্পিউটার তার কোনো নির্দেশই মানছে না।
ভিতরে সবকিছু স্বাভাবিক। জীবন সহায়ক উপাদানগুলো যথাযথ কাজ করছে, তার আর পেলোরেটর শারীরিক কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু সেটা কোনো উপকারে লাগছে না। সামনের অনিশ্চয়তা তাকে ক্লান্ত আর হতাশ করে তুলছে। খেয়াল করল পেলোরেট একেবারে শান্ত। যেন পরিস্থিতি আরো খারাপ করে তোলার জন্য, যেখানে ট্র্যাভিজের মোটেই খিদে পায়নি, পেলোরেট মুরগীর মাংসের ছোট একটা কৌটা খুলল। ঢাকনা খোলার সাথে সাথে মাংস গরম হতে শুরু করেছে। এখন সে খাচ্ছে ধীরে ধীরে।
ট্র্যাভিজ বিরক্ত সুরে বলল, স্পেস, জেনভ! অসহ্য!
পেলোরেট কেঁপে উঠে কৌটোর গন্ধ শুকল। গন্ধটাতো ঠিকই আছে, গোলান।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। কিছু মনে করোনা। আমি বেশি অস্থির হয়ে পড়েছি। কিন্তু কাটাচামচ ব্যবহার করা। নইলে সারাদিন আঙ্গুলে মুরগীর গন্ধ লেগে থাকবে।
অবাক হয়ে আঙ্গুলের দিকে তাকালো পেলোরেট। দুঃখিত! খেয়াল করিনি। অন্য কিছু ভাবছিলাম।
নিশ্চয়ই ভাবছিলে ঐ মহাকাশযানে কি ধরনের প্রাণী আছে? ট্র্যাভিজ লোক হাসানো ভঙ্গিতে বলল। পেলোরেট তার চেয়ে শান্ত থাকায় সে লজ্জা পাচ্ছে। সে ছিল নেভীতে (যদিও কোনো যুদ্ধ দেখেনি) আর পেলোরেট একজন ইতিহাসবিদ। অথচ তার সঙ্গী একেবারে শান্ত।
পেলোরেট বলল, পৃথিবী থেকে ভিন্ন পরিস্থিতিতে কোন ধরনের বিকাশ ঘটবে সেটা কল্পনা করা অসম্ভব। সম্ভাবনাটা অসীম হবে না, তবে যতদূর সম্ভব বিচিত্র হবে। যাই হোক, আমার অনুমান ওরা অনুভূতিহীন পশু না এবং আমাদের সাথে সভ্য আচরণ করবে। কথাটা সত্যি না হলে এতক্ষণে আমরা মারা যেতাম।
অন্তত তোমার যুক্তি বুদ্ধি ঠিক আছে, জেনভ, প্রিয় বন্ধু।–এখনো তোমাকে প্রশান্ত রাখা হতে পারে। ওদের প্রশমিতকরণের বিরুদ্ধে আমার প্রতিটি স্নায়ু প্রবল বাধা দিচ্ছে। প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছে উঠে দৌড়ে পালাতে। মহাকাশযানটা পৌঁছচ্ছে না কেন?
আমি একজন অকর্মণ্য লোক, গোলান। সারাজীবন রেকর্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করেছি আর শুধু অপেক্ষা করেছি। তুমি হচ্ছ সক্রিয় কাজের লোক। যখন কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তুমি কষ্ট পাও।
ট্র্যাভিজ বুঝতে পারল তার স্নায়ুর চাপ কিছুটা কমে গেছে। ফিসফিস করে বলল, তোমার অনুভূতিকে আমি খাটো করে দেখেছিলাম, জেনভ।
না, করোনি, শান্ত গলায় বলল পেলোরেট, কিন্তু একজন সাধারণ শিক্ষিত লোকও জীবন থেকে বোধ বুদ্ধি তৈরি করে নিতে পারে।
এবং অনেক সময় সবচেয়ে চতুর রাজনীতিবিদও সেটা করতে পারে না।
আমি তা বলিনি, গোলান।
না, কিন্তু আমি বলছি। আমাকে এখন সক্রিয় হতে দাও। বাইরের মহাকাশযান যথেষ্ট কাছে চলে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ প্রাচীন।
মনে হচ্ছে?
সম্ভবত অন্য কোনো প্রাণীর বুদ্ধি এবং হাত দিয়ে তৈরি। সেকারণেই প্রাচীন মনে হচ্ছে।
তোমার ধারণা এটা অন্য কোনো বুদ্ধিমান জীবের তৈরি আকাশযান? পেলোরেট জিজ্ঞেস করল, চেহারা অল্প লাল হয়ে গেছে।
বলতে পারব না। আমার ধারণা ছিল বিভিন্ন সভ্যতার আকাশযানের মধ্যে যে পার্থক্য হয় সেটা জেনেটিক পার্থক্যের মতো বিশাল হবে না।
এটা তোমার একটা অনুমান। আমরা শুধু বিভিন্ন সভ্যতার কথা জানি। ভিন্ন বুদ্ধিমান জীবের সাথে আমাদের কোনো পরিচয় নেই। তাই বলারও কোনো উপায় নেই আকাশযানগুলো কেমন হবে।
মাছ, ডলফিন, পেংগুইন, স্কুইড, এমনকি এ্যামবিফ্লেক্স, যার উৎপত্তি সম্ভবত পৃথিবীতে হয়নি-বাকীগুলোর হয়েছে সবগুলোই এমনভাবে নিজেদের গতি সমস্যার সমাধান করেছে যে সহজে আলাদা করা যায় না, অথচ জেনেটিকভাবে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আকাশযানের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে।
স্কুইডের শুড় এবং এ্যামবিফ্লেক্সের ভাইব্রেটরের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এমনকি ডানা, পাখনা এবং ভাইব্রেটরের বাহুগুলোর মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে। আকাশযানের ক্ষেত্রেও এমন হতে পারে।
যাই হোক, ট্র্যাভিজ বলল, ভালো লাগছে এখন। তোমার সাথে আজগুবি কথা বলে অস্থিরতা কমে গেছে। কিসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি সেটা জানার জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে না বেশিক্ষণ। ঐ যানটা আমাদের যানের সাথে এক হতে পারবে না, ওটার ভিতরে যাই থাকুক, পুরনো কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করে এগোতে। হবে–অথবা আমরাই কোনোভাবে ওটার দিকে এগোনোর জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী হয়ে। উঠব।–যদি না কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী অন্য কোন পদ্ধতি ব্যবহার করে।
বাইরের মহাকাশযানটা কত বড়?
কম্পিউটার অকেজো হয়ে পড়ে আছে, তাই রাডার দিয়ে দূরত্ব মাপা যাচ্ছেনা, বলা যাচ্ছেনা কত বড়।
সাপের মতো এঁকেবেঁকে একটা দড়ি এগিয়ে এল ফার স্টারের দিকে।
হয় ওখানে মানুষ আছে অথবা অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীরা একই পদ্ধতি ব্যবহার। করে। দড়ি ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতি হয়তো কাজ করবে না।
টিউব বা সমান্তরাল মই ব্যবহার করতে পারত।
অনেক বেশি অনমনীয়। সমস্যা তৈরি হয়। তোমার এমন একটা জিনিস দরকার যা একই সাথে শক্ত এবং নমনীয়।
দড়িটা ফার স্টারের গায়ে লেগে হালকা শব্দ করল সেই সাথে কেঁপে উঠল হাল এবং ভিতরের বাতাস। অন্য যান তার গতি নিয়ন্ত্রণ করছে যেন দুটো যানের বেগ সমান হয়। দুই যানের ভিত্তিতেই দড়ি স্থির হয়ে আছে।
দ্বিতীয় যানের হাল-এ কালো একটা বিন্দু চোখের মনির মতো বড় হতে লাগল।
মাথা নাড়ল ট্র্যাভিজ। স্লাইডিং প্যানেলের বদলে এক্সপানডিং ডায়াফ্রাম।
অন্য কোনো প্রাণী?
হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই।
একটা কাঠামো বেরিয়ে এল।
ঠোঁট শক্ত করে ফেলল পেলোরেট, তারপর হতাশ গলায় বলল, খুব খারাপ। মানুষ।
হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, ট্র্যাভিজ শান্ত সুরে বলল। এখান থেকে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অনুমান করা যেতে পারে। ওটা মাথা, দুটা হাত, দুটা পা–কিন্তু। নাওতো হতে পারে। দাঁড়াও!
কি?
জিনিসটা আমি যা আশা করেছিলাম তার চেয়েও দ্রুত আর স্বাভাবিকভাবে এগোচ্ছে।-আহ্!
কি?
গতি বাড়ানোর জন্য কিছু একটা ব্যবহার করছে, রকেট না, যতদূর বুঝতে পারছি। তারপরও নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না মানুষ কিনা।
খুব দ্রুত এগোলেও তাদের মনে হল যেন অনেক সময় লাগছে। শেষে পৌঁছানোর শব্দ পাওয়া গেল।
ওটা যাই হোক, ভিতরে ঢুকছে। আমার ইচ্ছা প্রথম সুযোগেই হামলা করা। ট্র্যাভিজ হাত মুঠো করে বলল।
আমাদের শান্ত থাকা দরকার, পেলোরেট বলল। এটা আমাদের চেয়ে শক্তিশালী হতে পারে। আমাদের মাইন্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিসের মুখোমুখি। হতে যাচ্ছি সেটা না জানা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।
সময়ের সাথে সাথে তোমার সচেতনতা বাড়ছে, জেনভ। আর আমার কমছে।
এয়ারলক খোলার শব্দ পেল ওরা। একটা কাঠামো মহাকাশযানের ভেতরে এসে ঢুকল।
স্বাভাবিক উচ্চতা, পেলোরেট ফিসফিস করে বলল। স্পেস স্যুট মানুষের উপযোগী।
এমন ডিজাইন আমি দেখিনি, তবে এটা তৈরি করা মানুষের সাধ্যের মধ্যে পড়ে।
স্পেস-স্যুট পরা কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে তাদের সামনে। মাথার হালমেট একমুখী স্বচ্ছ কাঁচ দিয়ে তৈরি। বাইরে থেকে ভিতরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ট্র্যাভিজ পরিষ্কার বুঝতে পারল না, এত দ্রুত সামনের কাঠামো হাত তুলে হালমেট স্পর্শ করল, সাথে সাথে বাকী স্যুট থেকে হালমেট আলাদা হয়ে গেল।
তারপর যা বেড়িয়ে এল সেটা হচ্ছে এক তরুণীর অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী।