এক দৌলতমন্দ পুলিশের তসবির
নিকাহর সুবাদে জব্বর খানের সঙ্গে আমার একটা রিস্তা তৈরি হয়। হররোজই আমাদের মুলাকাত হত। পুলিশ কর্তা নিয়াজ খানের সে ছিল খাস আর্দালি। এত হুঁশিয়ারির সঙ্গে জব্বর খান তার কাম-কাজ সামাল দিত যে হাতে তার বেশ দু-পয়সা জমে। তার জরু আর বাচ্চাদের দেখতাম হরবখত জেবরাত পরে ঘুরছে। পাঁচ সাল আগেই সে ছিল মামুলি এক বরকন্দাজ। না ছিল ঢঙের লিবাস না মিলত হররোজ খানা। এখন ব্যাটা এতই তেল চুকচুকে যে দেখলে মনে হবে রোজ পোয়াভর (Pou) ঘি খায়। আমাদের যে গুলতানি চলে এটা হল তারই একটা কিস্তি।
কোনও ফরিয়াদি থানায় নালিশ দর্জ১ করতে এলে জব্বর খান শুরুতেই জানতে চাইবে, কত খসাতে পারবে। শুরু হবে দরাদরি। যা পাওয়া যায়। কিছু না পারলে জুতো, টুপি বা কোমরবন্ধেও কাজ হবে। নিয়াজ খান যদি কখনও তাকে সওয়াল করে তা হলে কসম খেয়ে তার জবাব, নিজের জন্য কিছুই সে চায় না। আসলে তো সে মহা সেয়ানা। সে চুপচাপ ইন্তেজার করে শের কখন তার খানা খতম করবে। তারপর শুরু হবে তার ভোজ। হররোজ সে কিছু না কিছু দামি মাল ট্যাঁকে গুঁজে ঘরে ফেরে আর মোওকা মাফিক বড় বড় দাঁও তো আছেই। সে নিজেই কবুল করেছিল তার নজর থাকত সেই সব মুয়ামলা (moamlah)-র উপর যাতে ফেঁসে আছে কোনও রেস্তোদার আদমি বা মহাজন। ধরা যাক মহাজন হাত খুলে দিতে তৈরি নয়। তখন মামলা আসান। পুলিশ চাইবে কৈফিয়ত আর হাকিমকে চাপ দেবে তহকিকাতের হুকুম দিতে। তখন তো শুধু পাকা ফসল কাটো আর গোলায় ভরো। ধরা যাক কেউ ঢঙের লিবাস পরে হাজির হল থানায় (হতেই পারে ব্যাটা পাক্কা বজ্জাত)। সে চায় নেওয়াপাতি (nouputtee) মহাজনের খিলাফ মামলা রুজু করতে। মহাজন নাকি তার বহেন, বিটি বা জরু কোনও একজনকে ফুসলে নিয়ে গেছে। এইরকম কোনও নালিশ কানুনি ধারায় পড়ে না। তখন দেখা যাবে জব্বর খানের কেরামতি। সে বলবে, এই সঙ্গে বল সেই ঔরতের গায়ে ছিল ৫০০ টাকার জেবরাত সেটাও লুঠ হয়েছে। ফরিয়াদি ইশারা ধরে নিয়ে সেইমতো চলতে থাকে। বজ্জাতটা জানত মহাজনের কাছ থেকে সে ভালই টাকা কামাবে। রাজিনামার (razeenama) ওয়াস্তে তাই সে নিয়াজ খানকে ২৫ টাকা তহরির (Tahrir) কবুল করল। গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে জব্বর খান গেল মহাজনের কোঠি।
কোঠিতে পৌঁছে শুরু হল তার ভয়ানক চোটপাট। গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখিয়ে সে বলতে বসল, কোনও উপায় নেই দামরিলালকে থানায় হাজির হতেই হবে। বহু কাকুতি মিনতির পর ১০০ টাকায় রফা হল সেই দিনটার জন্য রেহাই। পরদিন জব্বর খান আবার হাজির। এরই ভিতর মহাজন তার খাস আদমির হাত দিয়ে ১০০ টাকা পাঠিয়ে ছিল নিয়াজ খানকে। শুরু হল করিন্দাকে চোটপাট তারপর তার মালিককে তেড়ে গালিগালাজ আর শেষে সবাইকে চালান (chulaned)-এর হুমকি। নিয়াজ খানের সামনে হাত জোড় করে এসে দাঁড়াল জব্বর। শুরু করল তোষামোদ। প্রথমে আসমানে চড়াল তারপর পির-পয়গম্বরের দোহাই পেড়ে আর্জি জানাল, থানেদার যদি একটু ঠান্ডা মাথায় পুরোটা ভেবে দেখেন। যেমনটা নালিশ করা হয়েছে তেমন কাজ কি দামরিলাল সাহুর মতো ইজ্জতদার আদমি করতে পারে? দামরিলাল হল নেওয়াপাতি মহাজন। বাজারে হুরমত (Hurmat) কিছু কম নয় আর যে নালিশ করেছে সে তো একটা দালাল, পয়লা নম্বর বদমাশ। জব্বরের সঙ্গে দামরিলালের তারিফ করে এবার গলা মেলাল মুহুরি আর জমাদার। নিয়াজ খান ফরকানো থামিয়ে এবার ঠান্ডা হয়। বলা শুরু করে, সেও শুনেছে দামরিলালের হৌসলা (housilah)-র কথা। করিন্দাকে তলব করে নিজের খাস কামরায়। তারপর তাকে হটিয়ে হাঁক পাড়ে, ওই বদমাশ কো বুলাও। এক চোট গালিগালাজ করে তাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ফের যদি সে কোনও ইজ্জতদার আদমির খিলাফ নালিশ দর্জ করতে আসে তবে তার নতিজা১ খুর খারাপ হবে। দালাল, জব্বর খানের কাছে জানতে চায় তার দেওয়া পঁচিশ টাকার ছোট রকম কি থানেদার পেয়েছেন? এখন তো সবার নজরে সে একজন ফেরেব্বাজ। তাকে বরদাস্ত করার কোনও দায় নেই। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাকে ভাগানো হয়। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের কাছে দাখিল করা হয় রিপোর্ট। সেখানে বলা ছিল এক দালাল দামরিলাল সাহুর খিলাফ অপহরণের তহমত২ দেয়। এইসব দালালদের খাসিয়ত হুজুরের অজানা নয়। পুলিশ তাই এই নালিশকে পাত্তা দেয়নি। জানিয়ে দিয়েছে, চাইলে আদালত-উল-আলেয়া (adalut-ool-alea)-তে যেতে পারে। এখানেই তামাশা খতম আর পয়সা হজম।
জব্বর খানের কাছে আরও মজাদার এক কিস্সা শুনেছিলাম। পুলিশ জেবরাত বা জড়োয়ার মতো মাল বাজেয়াপ্ত করলে কেমন করে তা হাত সাফাই হয়। এক ফরিয়াদি নালিশ জানাল তার অনেক জড়োয়া আর জেবরাত লুঠ হয়ে গেছে। কিছুটার হদিশ মিলল। থানেদারের যা যা মন পসন্দ সেসব সরিয়ে রাখা হল তার থেকে। যা চুরি গেছে তার সবই কী আর মেলে। যা মেলে না তার দায় চোরের। পুলিশকে সন্দেহ করবে কে আর সন্দেহ করলেই বা কী, সাবুদ কোথায় যে পুলিশই নিয়েছে। জব্বর খানকে একবার হুকুম করা হল এক জাল টাকার কারবারিকে গ্রেফতার করতে হবে। ব্যাটা বহুত সেয়ানা। রোজ রোজ বাজারে জাল টাকা হাত বদল করে। এই কারবার জালিয়াতরা নিজের হাতে করে না। খাস আদমি থাকে তারাই ভালোর সঙ্গে জাল মিশিয়ে চালায়। জ্বালাপ্রসাদের মাকানে তো বুক ঠুকে হাজির হল জব্বর। জানাল যেতে হবে হুজুরের কাছে। ঘরের ঔরতরা যতক্ষণ না সরছে ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হল। কমসে কম সোয়া ঘণ্টা ইন্তেজারের পর দেখা মিলল জ্বালাপ্রসাদের। কেন তাকে দলহিজেই (dalhiz) দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল তার জন্য চলল চোটপাট। তারপর সাফ জানিয়ে দিল, কোনও ছাড় নেই এখন তাকে যেতে হবে নিয়াজ খানের কাছে। গোস্তাখির জন্য বার বার মাফ চাইতে লাগল জ্বালাপ্রসাদ। জানাল যেতে সে রাজি। যাওয়ার মুখে জব্বর খানের হাতে গুঁজে দিল একটা সোনার মোহর। এইসঙ্গে তার আর্জি ছিল ইন্তেজারের কথাটা সে যেন না তোলে। সাহু সঙ্গে নিল একটা থলি যার ভিতর ছিল ১০০ টাকা। কাউকে খুশ করতে যদি দরকার পড়ে।
থানায় হাজির হতে না হতেই হুকুম হল, জ্বালাপ্রসাদকে বেড়ি পরাও। সেও ফিস ফিস করে বলতে বসল, নিয়াজ খান কি জানেন তাঁর খুশির জন্য সে ভেট চড়াতে চায়। পেশকশ ওজনদার হওয়ায় আসামির পা থেকে খুলে গেল বেড়ি। রাখা হল তাকে একটা ঢঙের কামরায়। মঞ্জুর হল বিস্তর (bistur)। যতটা আরাম আয়েশের বন্দোবস্ত করা যায় আর কী। কোনও সাবুদ না মেলায় জ্বালাপ্রসাদকে খালাস করা হল। তবে তার কাছে যা কিছু দামি দামি সামান ছিল সে সব আর ফেরত গেল না।
জব্বর খানের কথামতো কী তল্লাশি পরোয়ানা, কী গ্রেফতারি পরোয়ানা সবই বেকার। গুনাহগারকে জানতে হবে কখন, কোথায় কতটা ভেট চড়ালে কাম তামাম। সরকার তো তার আর্দালিকে দেয় চার টাকা করে মাসোহারা। তার ছয়গুণা যদি কেউ কবুল করে তবে সে নিজেকে সামলে রাখবে কেমন করে?
১. দর্জ: নথিবদ্ধ, পেশ করা
১. নতিজা: ফল পরিণাম
২. তহমত: অপবাদ