৭. একেনবাবুর জন্যই অপেক্ষা

।। ।।

ইন্সপেক্টর লান্ডি একেনবাবুর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের কথাও নিশ্চয়ই একেনবাবু ওঁকে বলেছিলেন, তাই আমরাও সাদর অভ্যর্থনা পেলাম। আমি আগে কখনও কোনও পুলিশ স্টেশনের ভেতরে ঢুকিনি। দেখলাম একটা বড় ঘরে বেশ কয়েকজন জুনিয়র অফিসার বসে। সেই ঘরের এক সাইডে একটা বড় দরজা।

সেখান থেকে লোহার গারদ দেওয়া লক আপ এরিয়াটা চোখে পড়ে। লক আপ এরিয়ার উলটোদিকে যে লাগোয়া ঘর, সেটা হল ইন্সপেক্টর লান্ডির। সারা ঘর উঁচু উঁচু ফাইভ-ড্রয়ার ফাইল ক্যাবিনেটে ভর্তি। দেওয়ালের শুধু একটু অংশই ফাঁকা। সেখানে হোয়াইট প্লেনস ও তার পাশাপাশি অঞ্চলের একটা ডিটেল ম্যাপ।

ইন্সপেক্টর লান্ডি ম্যাপটাতে আঙুল দিয়ে দেখালেন, ঠিক কোথায় ডেড বডিটা পাওয়া গেছে। টাপান জি ব্রিজটা পার হয়ে আপস্টেট নিউ ইয়র্ক যাবার পথে, ব্রিজ থেকে আধ মাইলও হবে না। ‘আপস্টেট নিউ ইয়র্ক’ এখানকার খুব একটা চলতি কথা। আসলে নিউ ইয়র্ক শহরটা হচ্ছে আবার নিউ ইয়র্ক স্টেটের মধ্যে, যেটা আমেরিকার একটা বিশাল স্টেট। আপস্টেট নিউ ইয়র্ক’ বলতে ওই স্টেটেরই উত্তর দিকটা বোঝায়।

.

যাক সে কথা। বডিটা পাওয়া গেছে হাইওয়ের পাশে, তবে অনেকটা নীচে। ওই জায়গায় হাইওয়েটা খুব উঁচু জমির ওপরে। সুতরাং মনে হয়, বডিটাকে কেউ ওপর থেকে রোল করে ফেলে দিয়েছে! যেহেতু জায়গাটা বরফে ভর্তি ছিল, সেইজন্য একেবারে গড়িয়ে নীচে চলে যায়নি, খানিকটা গিয়ে ঢালুর ওপরই একটা গর্তে বরফের মধ্যে আটকে গেছে। বডিটা বোধহয় কয়েকদিন ধরেই ওখানে পড়ে ছিল। কিন্তু বরফে ঢাকা ছিল বলে কারও নজরে পড়েনি। রোদে বরফ কিছুটা গলে যাওয়ায়, হাইওয়ে পেট্রল ওঁর ব্রাউন ব্রিফকেসটা বরফের ওপর দেখে, গাড়িটা থামিয়েছিল। ব্রিফকেসটা তুলতে গিয়ে বডিটা আবিষ্কার করে।

আমি অবশ্য ঠিক বুঝলাম না, কেন ইন্সপেক্টর লান্ডি অনুমান করছেন যে, কেউ মিস্টার জসনানির বডিটাকে হাইওয়ে থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে। ইন ফ্যাক্ট উনি যেজায়গায় বডিটা পাওয়া গেছে বললেন, আমি জানি সেখানে অনেক কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিল। শীতকাল বলে বেশিরভাগ কাজই এখন বন্ধ। ফলে অনেক টেম্পোরারি শেড ওখানে ফাঁকা পড়ে আছে। তা হলে কি মিস্টার জসনানি তারই কোনো একটায় আশ্রয় নিয়েছিলেন? হয়তো গতকাল হিচ হাইক করবেন বলে হাইওয়েতে উঠে আসার পথে ঠান্ডায় ওভার এক্সারশনে হার্ট ফেল করে মারা যান। সেটা হওয়া কিছু মাত্র অসম্ভব নয়। এদেশে ঠান্ডায় বরফ পরিষ্কার করতে গিয়ে তো কত কমবয়েসি লোকই মারা যায়, আর উনি তো বৃদ্ধ! আমি আমার সন্দেহের কথাটা বলতেই ইন্সপেক্টর লান্ডি মুচকি হেসে ক্লিয়ারলি ব্যাপারটা এক্সপ্লেন করে দিলেন। বললেন, “প্রথমত, ওই শেডগুলোতে কোনো হিটিং নেই। বাইরে যা ঠান্ডা, ইট ইজ হার্ড টু বিলিভ দ্যাট হি উড হ্যাভ সার্ভাইভড দেয়ার। দ্বিতীয়ত, ওঁর ব্রিফকেসটা পাওয়া গেছে ওঁর বডিটা থেকে অন্তত পাঁচ ফুট দূরে। মাটিতে বরফ না থাকলে বুঝতাম যে, ওটা গড়িয়ে দূরে চলে গেছে। এক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ওঠে না। তৃতীয়ত, বরফের ওপর কোনো পায়ের ছাপ নেই। অবভিয়াসলি, হি ওয়াজ নট ওয়াকিং।

হ্যাঁ, বলতে পারেন যে, বরফ পড়া শুরু হবার আগে উনি ওখানে উঠে এসে মারা যান। সেক্ষেত্রে উনি বা ওঁর ব্রিফকেস, দুটোই বরফে পুরোপুরি ঢাকা পড়ে থাকত। ফাইনালি, ওঁর চোখে যে চশমাটা ছিল, সেটা হল প্লাস পাওয়ারের, অর্থাৎ রিডিং গ্লাস। কেন একটা লোক রিডিং গ্লাস চোখে দিয়ে হাঁটতে বেরোবে?”

ইন্সপেক্টর লান্ডির কথা শুনে আমার ভারি অপ্রস্তত লাগল। আসলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদের গল্প পড়ে পড়ে আমার এমন অবস্থা হয়েছে –আমি ধরেইনি, পুলিশেরা সব গবেট, কিছুই ঠিকমতো ধরতে পারে না!

একেনবাবু বললেন, “স্যার ব্রিফকেসটা একটু দেখতে পারি?”

“নিশ্চয়ই।”

ব্রিফকেসটা ইন্সপেক্টর লান্ডির পেছনেই ছিল। উনি আমাদের সামনে ওটা রেখে বললেন, “কম্বিনেশনটা হচ্ছে থ্রি-টু-টু।”

.

কম্বিনেশনটা লক লাগানো স্যামসোনাইটের সচরাচর যে ধরনের ব্রিফকেস চোখে পড়ে, সেরকমই একটা ব্রিফকেস। আমি স্যামসোনাইট কখনো ব্যবহার করিনি। কিন্তু নিশ্চয়ই খুব মজবুত হবে। হাইওয়ে থেকে নীচে পড়াতেও কোনো টোল খায়নি। অবশ্য বরফ ছিল বলেই হয়তো।

“হাত দেব স্যার?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।

“স্বছন্দে। ব্রিফকেসে কোনো ফিঙ্গার প্রিন্টই পাওয়া যায়নি। ইট ওয়াজ ওয়াইপড ক্লিন!”

লকের থাম্ব হুইলগুলোকে থ্রি-টু টু পজিশনে আনতেই ব্রিফকেসের ডালাটা খুলে গেল। দেয়ার ইজ নাথিং ইনসাইড, একেবারে শূন্য!

“আপনি শিওর স্যার যে, এটাই রাইট ব্রিফকেস? এরকম তো অনেক ব্রিফকেসই আছে।”

“ইয়েস, আই অ্যাম শিওর। সাহানিরা এসে আইডেন্টিফাই করে গেছেন। দেখুন লেফটে সাইডে একটা ছোট্ট স্ক্র্যাচ আছে, ওটাই হল আইডেন্টিফিকেশন মার্ক। তাছাড়া লকের কম্বিনেশনটাও এক।”

“সবই এক। শুধু টাকাগুলোই নেই!”

“এগজ্যাক্টলি।”

“দিস ইজ কনফিউসিং স্যার,” একেনবাবু মাথা নাড়লেন। “মৃত্যুর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, অথচ মিস্টার জসনানির বডিটা আর ফাঁকা ব্রিফকেসটা একই সঙ্গে রাস্তায়

ফেলে দেওয়া হল!”

“ইট ইজ কনফিউসিং।” ইন্সপেক্টর লান্ডি মাথা নেড়ে বললেন।

“আর কিছু পাননি স্যার। চশমা আর ব্রিফকেস ছাড়া?”

“ও ইয়েস। লেট মি শো ইউ। এটা হচ্ছে ওর ওয়ালেট, আর ওঁর কোর্টের পকেটে এই কার্ডটা ছিল।” ড্রয়ার থেকে জিনিস দুটো বার করে ইন্সপেক্টর লান্ডি একেনবাবুকে দিলেন।

ওয়ালেটে দেখলাম ড্রাইভার্স লাইসেন্স, দুটো ক্রেডিট কার্ড, আর কয়েকটা শুধু ডলার। কোটের পকেটে যে কার্ডটা পাওয়া গেছে, সেটা হল একটা বিজনেস কার্ড। কার্ডে লেখা সলোমান লাজারাস, প্রেসিডেন্ট, এস.এল.প্ৰেশাস স্টোনস। নীচে ব্রুকলিনের একটা ঠিকানা, আর ফোন নম্বর।

“হু ইজ দিস পার্সন স্যার?”

ইন্সপেক্টর লান্ডি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “এর থেকেই স্যাম মিরশন্ডানি মিলিয়ন ডলারের ক্যাশ নিয়েছিলেন।”

স্যাম মিরশন্ডানি মানে অবশ্যই শ্যাম মিরচন্দানি। মাই গড! তাহলে কি বেন্টুমাসির থিওরিই ঠিক!

প্রমথ নিশ্চয়ই একই কথা ভাবছিল। জিজ্ঞেস করল, “ইজ দেয়ার এনি কানেকশন? আই মিন বিটুইন দ্য ডেথ অ্যান্ড দিস কার্ড।”

“কানেকশন ফর হোয়াট, দ্য ম্যান ওয়াজ নট মার্ডারড!”

“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু টাকাটা কোথায় গেল, কে চুরি করল? আমি প্রশ্ন করলাম।

“দ্যাট্‌স এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন, এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন,” বলে টেবিলের ওপর ঠ্যাং তুলে দিয়ে ইন্সপেক্টর লান্ডি একটা চুরুট ধরালেন।