৭. একটা শব্দ

সুজিতের ঘুমন্তই মনে হল, কীসের একটা শব্দ তার কানে আসছে। গুঁড়িয়াটাঁড়ের আশ্রমের ঘরে সে ছোলা ছড়িয়ে দিলে যেমন ময়ুরটা এসে ঠুক ঠুক করে খেত, সেইরকম শব্দ। ভুজঙ্গভূষণের কথা ভাবতে ভাবতেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সে জানে, এই বিশ্ব-সংসারের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক সত্যি কথা বলা যায় না। বললেও, তাদের বিশ্বাস করানো যায় না। যেমন সুনীতার কথা। ভুজঙ্গভূষণের কথাও সে যতই ভাবছিল, ততই তার মনটা যেন এক ব্যথিত অন্যমনস্কতায় ভরে উঠছিল। যত বারই সেই বড় বড় চোখ লোমশ –মুখখানি তার মনে পড়ছিল, তত বারই তার ভিতরে একটা হাসি উথলে উঠছিল। সে হাসিতে কোনও বিদ্রূপ বা ব্যঙ্গের ছাপ ছিল না। বরং একটা কষ্টের ছায়া পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল ভুজঙ্গভূষণ যেন একটা দুষ্টু দুর্ভাগা ছেলে। যার মা নেই, বাবা নেই, মাথার ওপরে কেউ নেই, যে একটু ভালবাসবে, স্নেহ করবে। চারদিক থেকে সবাই তাড়া দিয়ে আসে কেবল শাসন করতে। অথচ সেই দুষ্টুটা অনেক সাধ অনেক বাসনা পূরণ করবার জন্যে মাঝে মাঝে দুর্বিনীত হয়ে ওঠে। অথচ উনি এক সময়ে কত টাকা ঘেঁটেছেন। বন্ধুদের ষড়যন্ত্রে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কিন্তু এখনও একটু ভাল পানে ভোজনে বসনে থাকতে ভালবাসেন। তার উপায় নেই। তাই খানিকটা উঞ্ছবৃত্তিও অবলম্বন করেছেন হয়তো। কারণ, সারা জীবনের সবকিছু দেখে, এখন যেন সমূহ নিয়ম-কানুন, কথায় কথায় মানুষেরা যে সব সতোর কথা বলে, সে সবের ওপর ওঁর বিশ্বাস সম্ভবত একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জীবনে যিনি ঠকেছেন, তাঁর বিশ্বাস হারানোটা বিচিত্র নয়। কিন্তু জীবনে যারা কিছুই হারায়নি, তারা অধিকাংশ যে আবার কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না। যেমন শিবেন! ওর সঙ্গে কথা বলে, ও যে ঠিক কীসে বিশ্বাসী, তা বোঝাই যায় না। কেবল এইটুকু মনে হয়, ও টাকাকে বিশ্বাস করে, টাকাকে খুব ভালবাসে। সেটা আবার কেমন বিশ্বাস বা ভালবাসা, সুজিত বুঝতে পারে না অথচ ও কী হারিয়েছে, কে জানে! বাবার প্রতি ওর কী ভীষণ রাগ! খেতে বসে, সুজিতকে এমনভাবে কথা বলছিল যেন, ও নিজে একটা ভয়ংকর পাজি নচ্ছার আর হৃদয়হীন শয়তান ছেলের বাপ। সুজিতের সন্দেহ এবং ভয় হচ্ছিল, ভুজঙ্গভূষণকে ধরে শিবেন মারধোর করে কি না।…টাকা নিয়েছেন তো কী হয়েছে। সুজিতের যদি থাকত, তবে ভুজঙ্গভূষণকে সে অনেক টাকা দিত। তা হলে উনি মুক্তিতে আনন্দবোধ করতেন, আর মুক্তি পেলেই তো মানুষ সহজ হয়ে ওঠে। যার পাবার আশা আছে, সে কখনও চুরি করে না। শিবেন তাকে নিজের মুখেই বলেছে, ভুজঙ্গভূষণের এখনও সামান্য কিছু ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু, একলা চেক সই করে উনি যাতে টাকা না পান, শিবেনেরও যাতে সই থাকে, সে ব্যবস্থা করে নেওয়া হয়েছে। এবং শিবেন কিছুতেই চেক সই করে না। এমনকী পাঁচটা টাকা চাইলেও না। সারাদিনে চারটি চুরুট আর খাওয়া, এই ওঁর বরাদ্দ। এই বাড়ি উনি নিজে করিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই এ বাড়ি শিবেন তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। শিবেন ভাবে, এ সবই জোর করে করানো হয়েছে। মাতাল এবং দুষ্ট চরিত্রের বৃদ্ধকে জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা এক বারও ভাবল না, হয়তো ছেলেকে ভালবেসেই তা দিয়েছেন। বুঝেছেন হয়তো, ওঁর কাছে থাকলে কোনওদিন ঝোঁকের মাথায় বিক্রি করে দেবেন। নিজের জন্যে তো উনি কিছুই রাখেননি।

শিবেনের কথাও ভাববার আছে। এই সংসারের মধ্যে কোথাও তার শান্তি নেই। চিররুগ্না মা, তাঁকে সুজিত এখনও দেখেনি। ছোট ভাইটি স্কুলে পড়ে। বাবাকে তার একদম পছন্দ নয়। ভাইটির প্রতিও তার তেমন মনোযোগ নেই, বোঝা গিয়েছে। শিবেনের কথা নাকি বিশেষ শোনে না। কেন শোনে না, কে জানে। এর থেকে বোঝা যায়, এরকম কোনও সংসারে একটা লোক নিজেকে সুখী ভাবতে পারে না। কিন্তু সুজিতের মনে হয়, শিবেন কি এখানে একটা সুখী আবহাওয়া তৈরি করতে পারে না! এটা তো পরিষ্কার, এ বাড়িতে শিবেনকে সবাই ভয় পায়। সেই ভয়কে কি ভালবাসায় পরিণত করা যায় না?

যাই হোক, ভুজঙ্গভূষণকে সুজিতের খুবই ভাল লেগেছে। টাকাটার জন্যে তার একটুও কষ্ট হয়নি। একশো টাকার নোট সে কখনও হাতে করেনি, নিজের হাতে জীবনে সে কখনও টাকা খরচ করেছে কি না স্মরণ করতে পারে না। তবে একশোটা টাকা যে অনেকগুলি টাকা, এটা সে জানে। এবং একটা স্কেচ এঁকে দিলে যে কেউ একশো টাকা দিতে পারে, তাও তার কাছে অকল্পিত ছিল। হয়তো টাকা সম্পর্কে তার কোনও কৌতূহল আবেগ বা উত্তেজনা নেই বলেই ব্যাপারটা মোটেই দুঃখিত করেনি তাকে। শিবেন অবিশ্যি বলেছে, টাকার মূল্য আপনি বোঝেন না, কারণ টাকা আপনাকে আয় করতে হয় না, জীবনধারণের কোনও ধারণা আপনার আজও গড়ে ওঠেনি। হয়তো তাই। কিন্তু জীবনধারণের কোনও ধারণাই কি সুজিতের নেই? ছেলেবেলা থেকে কি সে হিংসা ও নিষ্ঠুরতা বর্জিত একটি নিবিড় শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বপ্ন দেখে আসেনি? যদিও এ সব কথা আর শিবেনের সঙ্গে সে আলোচনা করেনি। তার সত্যি ঘুম পাচ্ছিল। শিবেন চলে যাবার পর শুয়ে শুয়ে সে অনেক কথা ভেবেছিল। এবং যত বারই ভুজঙ্গভূষণের, টাকাটা নেবার আগে সেই ভয়চকিত চোখে বারে বারে শিবেনের দিকে তাকানো মুখখানি মনে পড়ছিল, তত বারই তার হাসি পাচ্ছিল। অথচ সেই হাসির মধ্যে একটি ব্যথার রেশ ঝংকৃত হয়ে উঠছিল।

শিবেন আরও বলেছিল, বাংলার লাটবাহাদুর, রাজা মহারাজা, মাছের ফ্রাই, সে সব নাকি সবই ভুজঙ্গভূষণের বানানো গল্প। শুনে সুজিতের হাসিটা আরও উচ্ছ্বসিত ও ব্যথাটা আরও তীব্র অনুভূত হয়েছে। কেন, তা সে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

ইতিমধ্যে কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, এবং আশ্চর্য, একটু আগেই সে সুনীতাকে স্বপ্নে দেখতে পাচ্ছিল। দেখছিল, হাওড়া স্টেশনের অনেক জনারণ্যের ভিড়ে সে নিজে চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর সুনীতা উদ্বেগ-ব্যাকুল চোখে তাকে খুঁজছে। তাকে ডাকছে, শুনুন, কোথায় গেলেন, শুনুন। আপনি কোথায় গেলেন? শুনুন! অথচ সুজিত নড়তে পারছে না, তার কণ্ঠে স্বর নেই। সে যেন একটা পাথরের মূর্তি। নিজেকে সে নড়াবার চেষ্টা করছে, চিৎকার করে সাড়া দিতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই পারছে না। এত কাছাকাছি, অথচ এই পারার দুঃসহ কষ্টে তার চোখে প্রায় জল এসে পড়ার উপক্রম করছে। এবং এই কষ্টের মধ্যেই তার ঘুম ক্রমে পাতলা হয়ে আসছিল। তার মধ্যেই সে শুনতে পেল, আশ্রমের ঘরে ছোলা ছিটিয়ে দিলে ময়ুরটা এসে যেমন খুট খুট করে খেত, সেইরকম শব্দ হচ্ছে।

আস্তে আস্তে সে চোখ মেলে চাইল। ঘরটা যেন ঈষৎ অন্ধকার মনে হল তার। সেই ঈষৎ অন্ধকারের মধ্যেই একটি মুখ সে পরিষ্কার দেখতে পেল। একটি ছেলের মুখ। পনেরো-ষোলো বয়সের একটি ছেলের মুখ। রুক্ষু চুলের একটি গোছা তার কপালে পড়েছে যেন কালো একটি ছুরির ফলার মতো। প্রায় ভুরুর ওপরে এসে পড়েছে। কালো দুটি চঞ্চল চোখের তারায় সুজিতকে দেখছে। কৌতূহলিত হয়ে। অথচ যেন মোটেই কৌতূহল নেই, মুখে এমনি একটি নির্বিকার ভাবও বজায় রাখার চেষ্টা আছে। সুজিতকে দেখছে, আর আপন মনে পকেট থেকে চিনেবাদাম বের করছে, ছুঁড়ে ছুঁড়ে মুখে ফেলছে এবং চিবোচ্ছে।

সুজিত তাড়াতাড়ি উঠে বসল। যতটা অন্ধকার সে মনে করেছিল, ঘরের মধ্যে ঠিক ততটা অন্ধকার নয়। তবে বাইরে সন্ধ্যা ঘনায়মান। উত্তরের বারোয়ারি উঠোনটা থেকে মেয়ে-পুরুষ এবং শিশুদের গলার স্বর ভেসে আসছে।

সুজিত ছেলেটিকে কী বলবে, ঠিক ভেবে পেল না। ছেলেটির আঁট প্যান্ট, পায়ের ওপর পা দিয়ে, টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো, বুকখোলা জামা, এবং সুজিতের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকা, সমস্ত ভঙ্গির মধ্যেই যেন একটি উদ্ধত অবিনীত ভাব ফুটে উঠেছে। সুনীতা স্বপ্ন, আর এটা আশ্রম নয়, এটা সে নিশ্চিন্ত হয়েছে ইতিমধ্যেই। এটা শিবেনদের বাড়ির সেই দোতলা ঘর। এবং ছেলেটি কি শিবেনের সেই ছোট ভাই? যদিও ওর ভঙ্গিতে একটা ঔদ্ধত্বের ভাব আছে, কালো চোখ দুটি সত্যি মিষ্টি, চঞ্চল, দুষ্টুমিতে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কেবল যেন একটু ছায়া-পড়া পুকুরের জলের মতো দেখাচ্ছে এখন। হাওয়া লাগলেই চলকে উঠবে।

হঠাৎ প্রায় একটি যুবতীর মতো গলার স্বরে, খানিকটা কৌতূহলমিশ্রিত স্বরে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, আপনি সুজিতবাবু?

বলেই খুট খুট করে আবার বাদাম চিবোতে লাগল। সুজিত ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

বাদাম চিবোতে চিবোতেই পরবর্তী জিজ্ঞাসা, আপনি এখন এখানে থাকবেন? সুজিত ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। এক মুহূর্ত বাদাম চিবোনো বন্ধ। আবার চিবোতে চিবোতে তার পরবর্তী জিজ্ঞাসা, আপনি পাগলা গারদ থেকে এসেছেন?

সুজিত বলল, মানসিক হাসপাতাল থেকে।

এক মুহূর্ত স্তব্ধ। হঠাৎ ঠোঁটের কোণ একটু কুঁচকে উঠল ছেলেটির। বলল, বাবা আপনাকে আজ খুব ভোগা দিয়েছে, না?

সুজিত উচ্চারণ করল, ভোগা?

–হ্যাঁ। ভোগা জানেন না? গ্যাঁড়া যাকে বলে, গ্যাঁড়া মারা?

 সুজিত চোখ বড় বড় করে উচ্চারণ করল, গ্যাঁড়া মারা?

ছেলেটি পর পর কয়েকটি বাদাম চিবিয়ে বলল, হাপিস মশাই, হাপিস বোঝেন তো?

সুজিত বড় বড় চোখে ঘাড় নেড়ে জানাল, সে জানে না।

 ছেলেটি বলে উঠল, যা বাব্বা! এ যে কিছুই জানে না দেখছি।

বলে সে কয়েকবার প্যান্টের দুই পকেটে হাত দিয়ে ঘাঁটল, এবং দুটি পকেটই বাইরে টেনে বের করে, ঝেড়ে ঝেড়ে আপন মনেই বলল, সব খতম, আর নেই। তারপর মাথাটা ঝেকে, চুলগুলি কপাল থেকে সরাবার চেষ্টা করে বলল, বাবা আজ আপনার কাছ থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে কেটে পড়েছে তো?

সুজিত অনুমান ঠিকই করেছিল, এ শিবেনের ভাই। সে বলল, কেটে পড়েছে মানে, টাকাটা চেয়ে নিয়ে গেছেন, ওঁর দরকার বলে।

দরকার? ছেলেটি ঠোঁট উলটে হেসে সুজিতের দিকে যেন অবাক হয়ে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, এতক্ষণে সব দরকার মিটে গেছে। কোথায় গিয়ে পড়ে আছে কে জানে। আমাকেই খুঁজতে যেতে হবে।

সুজিত জিজ্ঞেস করল, তোমার নামই বুঝি দীপেন?

–হ্যাঁ, দীপেন রায়।

একটু যেন গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করল সে। যেন পনেরো-ষোলো বছরটাকে সে পঁচিশ-ছাব্বিশে টেনে তুলতে চাইল।

সুজিত বলল, তা দাঁড়িয়ে কেন? এসো, এখানে বসো।

খাটের পাশেই জায়গা নির্দেশ করে সুজিত তাকে ডাকল। দীপেন সুজিতের দিকে চোখ তুলে তাকাল। যেন খানিকটা অবাক হল, এবং বসবে না বলে ঘাড় ফেরাতে গিয়েও হঠাৎ সুজিতের পাশে গিয়ে বসল। বসে পা দোলাতে দোলাতে সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা অনেকগুলো টাকা নিয়ে গেছে আজ, কোথায় যে পড়ে থাকবে কে জানে।

সুজিত বলল, তোমার বুঝি বাবার জন্যে খুব ভয় করছে?

–ভয়?…দীপেন এক বার ঠোঁট ওলটাল। তারপরে হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। বলল, মদ বেশি খেলে তো বাবার খুব কষ্ট হয়, চলতে পারে না, রাস্তায় পড়ে যায়। আমিই তো বাবাকে খুঁজে খুঁজে নিয়ে আসি কিনা।

সুজিত বলল, কেন, শিবেনবাবু যেতে পারেন না?

দীপেন চোখ বড় করে বলল, দাদা? আমি বাবাকে খুঁজতে গেলে আমার ওপরেই রাগ করে, ও আবার নিজে খুঁজতে যাবে? শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, মানে?

কীসের মানে?

–ওই যে শালুক চিনেছে গোপাল ঠাকুর?

দীপেন অবাক হল। বলল, ওর আবার মানে কী? দাদা যাবে না, তাই বলছি। তারপর সুজিতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, আপনি সব কথা এখনও বুঝতে পারেন না, না?

–পারি তো! কোনও কোনও কথা অবিশ্যি বুঝতে পারি না।…তুমি বুঝি বাবাকে খুব ভালবাস দীপেন?

দীপেন গম্ভীর হয়ে বলল, ভালবাসলেই বা কী। বাবা ও সব কিছু বোঝে না।

 সুজিত বলল, তাই কি কখনও হয়! ভালবাসা সবাই বোঝে।

দীপেন তাকাল এক বার সুজিতের দিকে। তারপর ঘন ঘন পা দোলাতে লাগল। সুজিত জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?

–টেন।

-ও! বেশ ভালই তো। আমি একটা কথা বলছি তোমাকে আমার তো কোনও কাজ নেই। তোমার বাবাকে যখন খুঁজতে যাবে, আমাকে বোলো, আমিও যাব, কেমন?

দীপেন অবাক হয়ে বলল, আপনি যাবেন?

–হ্যাঁ, যাব। ওঁকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার মনে হয়, তোমার মতো আমিও ওঁকে ভালবাসি।

দীপেন কয়েক মুহূর্ত সুজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, কিন্তু বাবাকে কেউ ভালবাসে না।

–তুমি বাস তা আমি জানি।

 দীপেন আবার তাকাল সুজিতের দিকে। তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবাকে এ বাড়িতে কেউ বোঝে না। বাবা খুব দুঃখী।

সুজিত দীপেনের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি তা জানি দীপেন।

দীপেন যেন গভীর বিস্ময়ে সুজিতের চোখ থেকে চোখ সরাতে পারল না। সুজিত হাসল দীপেনের দিকে তাকিয়ে। দীপেনের মুখেও আস্তে আস্তে হাসি ফুটে উঠল। চোখে তার ঈষৎ লজ্জা নেমে এল, কিন্তু একটি খুশি ও কৌতুকচ্ছটা দেখা দিল। বলল, আপনি ভারী আশ্চর্য!

সুজিত বলল, দীপেন, আমার চায়ের তেষ্টা পাচ্ছে। বিশুকে বললে দেবে?

 দীপেন লাফ দিয়ে উঠে বলল, দেবে বইকী। আমি বলে আসছি।

সে ছুটে যেতে গিয়ে, দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি আমাকে দীপু বলে ডাকবেন, ওইটা আমার ডাকনাম।

বলে সে আবার ছুটে চলে গেল। সুজিত খুশি হয়ে হেসে উঠল। দীপেন ফিরে এল একটু পরেই। বলল, চা নিয়ে আসছে, কিন্তু আপনি যদি আমার সঙ্গে বাবাকে খুঁজতে যান, দাদা তা হলে রাগ করবে না?

সুজিত বলল, দাদা রাগ করবে কেন? আমি তো আমার ইচ্ছেয় যাচ্ছি। না হয় বলেই যাব। তোমার দাদার তো অফিস থেকে আসার সময় হল।

দীপেন চোখ বড় করে বলল, দাদা কি এখন বাড়ি আসে নাকি! ও তো আসে রাত্রে।

-কেন?

–ছুটির পরে তো মিঃ রায়চৌধুরীদের বাড়ি যায়, তাঁর সঙ্গেই। সেখানেই চা খায়, কাজকর্ম থাকলে মেটায়। তারপরে নির্ঘাত আজ সুনীতাদির ওখানে যাবে।

–সুনীতাদি? সুজিত অনুসন্ধিৎসু জিজ্ঞাসায় তাকাল দীপেনের দিকে।

দীপেন বলল, হ্যাঁ, সুনীতাদি। দাদা তো এখন সুনীতাদিকে বিয়ে করার জন্যে খুব খেপেছে।

তাই নাকি? কে সুনীতাদি?

দীপেন বলল, সে আপনি চেনেন না। সুনীতা নাগ। খুব সুন্দর দেখতে।

সুজিত বলল, আমি বোধ হয় চিনি।

–চেনেন? কোথায় থাকে বলুন তো?

–তা জানি না।

 দীপেন হেসে ফেলল। আপনার কথার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝি না। আপনি সুনীতাদিকে চিনবেন কী করে?

সুজিত হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। ওর গলাবন্ধ কোটের পকেট থেকে সুনীতার স্কেচটা বের করে দেখাল। বলল, দেখো তো, এই কি তোমার সুনীতাদি?

স্কেচটা হাতে নিয়ে দীপেন প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ, এই তো সুনীতাদির ছবি। কোথায় পেলেন?

সুজিত বলল, আমি এঁকেছি।

–আপনি এঁকেছেন? কোথায় দেখলেন আপনি ওকে?

সুজিত জানাল যে, সে গতকাল রাত্রে ট্রেনে ওকে দেখেছে এবং আজ স্মৃতি থেকে দোলাদের বাড়িতে বসে এঁকেছে।

কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে ও অবিশ্বাসে কথাই বেরুল না দীপেনের মুখ থেকে। তারপরে বলল, আপনি এটা মন থেকে এঁকেছেন? মানে, আপনি তা হলে আঁকতে পারেন?

–পারি।

–কিন্তু…! ঠিক কী যে বলবে যেন স্থির করে উঠতে পারছে না দীপেন। কয়েক মুহূর্ত সুজিতের মুখের দিকে সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপরে আবার বলল, আপনার এতটা মনে ছিল সুনীতাদির মুখ যে, শুধু মনে করে করেই এঁকে ফেললেন?

সুজিত বলল, হ্যাঁ, তাই তো। কেন?

–আমার মুখটাও পরে মনে করে আঁকতে পারবেন?

সুজিত একটু থমকাল। বলল, তা ঠিক বলতে পারি না। এক-একটা মুখ আমার এত মনে থাকে যে, আমি যখন খুশি আঁকতে পারি।

দীপেন তেমনি হাঁ করে তাকিয়ে রইল। সুজিত বলল, কিন্তু তুমি যা বলছিলে তা তো বলা হল না। তোমার দাদা সুনীতাকে বিয়ে করতে চান বলছিলে না?

দীপেনের ঠোঁট বেঁকে উঠল। মাথা ঝাঁকিয়ে চুল সরাবার চেষ্টা করল। বলল, বিয়ে করতে চাইলেই তো আর সুনীতাদিকে বিয়ে করতে পারবে না। অনেক ব্যাপার আছে। বলে দীপেন খুব গম্ভীর হয়ে উঠল।

সুজিত বলল, তাই নাকি?

 দীপেন বলল, তাই বইকী। সুনীতাদি তো আমাকে নিজের মুখেই বলছিল এদের কাউকে আমার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না।

সুজিত অবাক হয়ে বলল, এদের মানে? আরও কেউ আছেন নাকি?

–নেই? দীপেন একেবারে চোখ কপালে তুলল। সুজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু হেসে উঠল। বলল, ও, আপনি তো সব কথা জানেন না। সুনীতাদিকে বিয়ে করার জন্যে অনেকে রেষারেষি করছে। কুবের সিং, অরূপ দত্ত, রঞ্জন মল্লিক, এরা সবাই। সেই জন্যেই তো সুনীতাদিকে আমার খারাপ লাগে।

-কেন?

–এই যে সকলের সঙ্গেই সুনীতাদির ভাব, সকলের সঙ্গেই মিশবে, কথা বলবে, গাড়িতে করে বেড়াতে যাবে, পাটিতে ড্যান্সে ডিনারে ছুটবে। এ সব আমি দুচোখে দেখতে পারি না।

সুজিত বলল, ও, তোমার সঙ্গে বুঝি সুনীতাদির ভাব আছে?

দীপেনের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল কথাগুলি বলতে বলতে। তার অন্তরের গভীরে যে একটা তীব্র ক্ষোভ আছে, তা চোখে-মুখে ফুটে উঠল। বলল, ভাব থাকলে কী হবে। আমার কথা তো শোনে না সুনীতাদি। কলকাতায় কি আর লোক নেই ওরা ছাড়া? ওদের সঙ্গে যে সুনীতাদি কেন মেশে!

সুজিত বলে উঠল, ও, তুমি চাও, খালি শিবেনবাবুর সঙ্গে যেন মেশে, না?

–দাদার সঙ্গে? দীপেনের ঠোঁট আবার বেঁকে উঠল। ঠোঁট তার এমনিতেও যেন প্রায় সবসময় বেঁকেই থাকে। যেন এই বিশ্ব সংসারের প্রতি তার নিয়ত বিদ্রূপ এবং বিতৃষ্ণা ঝরে পড়ছে। বলল, দাদা কি ওই অরূপ দত্ত, কুবের সিং, রঞ্জনদের চেয়ে ভাল নাকি? আপনি জানেন না, দাদা তো আগে ভেবেছিল, বীরেন রায়চৌধুরীর মেয়ে দোলাকে বিয়ে করবে। সেখান থেকে ধাক্কা খেয়ে আরও অনেক জায়গায় চেষ্টা করেছে। সুবিধে করতে পারেনি।

মুহূর্তে সুজিতের চোখের সামনে দোলা আর শিবেনের ব্যবহারটা মনে পড়ে গেল। আর সমস্ত কুয়াশা কেটে গিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল।

দীপেন আবার বলল, আসলে দাদা কী চায় জানেন তো? টাকা। যেখানে বিয়ে করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে, সেখানেই দাদা বিয়ে করবে।

দীপেনের মুখ থেকে এবংবিধ কথা শুনতে সংকোচ ও লজ্জা হচ্ছিল সুজিতের। কিন্তু সে জানে, দীপেন একটা পরিবেশের মধ্যে থেকে এ সব জেনেছে, শিখেছে এবং বলতেও অভ্যস্ত হয়েছে। সহসা তাকে পরিবর্তন করা যায় না। সে বলল, কিন্তু সুনীতাদির কি মেলাই টাকা আছে?

দীপেন বলল, আগে ছিল না। কিন্তু এখন তো সুনীতাদি অনেক টাকা পাবে। ওই যে প্রিয়নাথ দাশ বলে লোকটা আছে, যার কাছে সুনীতাদি ছিল, সে অনেক টাকা দেবে সুনীতাদিকে। প্রায় এক লাখ টাকার মতো।

-কেন?

দীপেন যেন একটু থতিয়ে গেল। হঠাৎ কোনও জবাব দিতে পারল না। মুখখানি তার শুকিয়ে কালো হয়ে উঠল। ভ্রূ কুঁচকে, ঠোঁট বেঁকিয়ে, হাত নেড়ে বলল, কী জানি, কেন টাকা দেবে তা জানি না। তবে দেবে শুনেছি। অথচ সুনীতাদি লোকটাকে এত ঘেন্না করে, বলবার নয়।

কাকে?

–ওই প্রিয়নাথ দাশটাকে। সুনীতাদির বাবা যে কেন মরবার সময় ওই লোকটার হাতে সুনীতাদিকে দিয়ে গেছল বুঝতে পারি না।

একটু থেমে দীপেন যেন খানিকটা আত্মগতভাবেই ফুঁসে উঠল, একটা শয়তান। ওর জন্যেই সুনীতাদির এত দুর্নাম। আর এখন সুনীতাদিকে ভাগিয়ে, তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে বলে, টাকাটা দিতে চাইছে।

গত রাত্রের ট্রেনের কথাগুলি সুজিতের মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তোমার সুনীতাদি প্রিয়নাথ দাশকে বিয়ে করবে ভেবেছিল বুঝি?

স্ফুরিত ঘৃণায় অদ্ভুত দেখাল দীপেনের মুখ। তীব্র ক্ষোভে উচ্চারণ করল, ওই লোকটাকে? ওই লোকটাকে সুনীতাদি গাড়ল বলে।

সুজিত কয়েক মুহূর্ত দীপেনের ঘৃণা-প্রজ্বলিত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই সময়ে বিশু চা দিয়ে গেল। সুজিত চা খেতে খেতে আবার কথা না বলে পারল না। দীপেনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কেন টাকা দেবে, তুমি তো জান, তবে বলতে চাইছিলে না কেন দীপু?

দীপেন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপরে নিচু স্বরে বললে, সুনীতাদির বিষয়ে কোনও খারাপ কথা বলতে আমার লজ্জা করে।

-তাই নাকি?

–হ্যাঁ, কষ্ট হয়।

সুজিত কাপে মুখ নামাতে গিয়ে থমকে গেল। দেখল, দীপেনের গম্ভীর কিশোর-মুখের সমস্ত রুক্ষতা ছাপিয়ে একটি ব্যথা ফুটে উঠেছে। আর সেই ব্যথাটা সুজিতের বুকেও যেন বিদ্ধ হল। সে বলল, আচ্ছা দীপু, তোমার সুনীতাদি যখন প্রিয়নাথ দাশকে বিয়ে করতেই চায় না, গাড়ল না কী সব বলে বলছিলে, অথচ এই লোকটার জন্যেই যখন ওঁর দুর্নাম, তখন লোকটার কাছ থেকে টাকা নিতে তুমি বারণ করছ না কেন?

দীপেন যেন আবার একটু উৎসাহিত হল। বলল, বারণ তো করেছি, সুনীতাদি যে শোনে না। বলে, তুই জানিস না দীপু, এই লোকগুলোকে সাজা দিতে হলে ওদের টাকার ওপরে ঘা দিতে হয়। ওরা মনে করে, মানুষ কিছু নয়, যা করে টাকাই সব করে, টাকার শোকই ওদের বেশি। ওদের সুনামে দুর্নামে কোনও ভয় নেই, টাকাকেই ভয়। সুনীতাদির কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না।

সুজিত অবাক হয়ে কথাগুলি শুনল। সুনীতার সেই তীব্র বিদ্রুপে জ্বলন্ত, শ্লেষের ছুরি-বিদ্ধ মুখখানি চোখের ওপর ভাসতে লাগল। এ কেমন প্রতিশোধ, সে ঠিক বোঝে না। কিন্তু একটা অন্ধ অসহায় আক্রোশে যে সুনীতা জ্বলছে, তা সে বুঝতে পারে। সে আবার বলল, দীপু, যে লোকগুলোর কথা তুমি বলছিলে, যারা খারাপ, তাদের সঙ্গে তোমার সুনীতাদিকে মিশতে বারণ কর না কেন?

দীপেন বলল, অনেক বার বারণ করেছি, সুনীতাদি শোনে না!

বলে মুখ নামাতে গিয়ে, আবার বলল, কেন যে শোনে না, তা আমি জানি।

-কেন?

–ওই যে প্রিয়নাথ দাশ, ওর কাছ থেকে সুনীতাদির এত দুর্নাম হয়েছে যে, সমাজের কেউ। সুনীতাদির সঙ্গে আর মেশে না। সবাই ওকে–ওকে–

দীপেনের বলতে দ্বিধা হল। কিন্তু সুজিতের মনে পড়ে গেল গত রাত্রে ট্রেনে সুনীতার তীব্র উত্তেজিত কথাগুলি। সে বলল, বুঝেছি দীপু।

দীপেন ঘাড় কাত করে সুজিতের দিকে চেয়ে বলল, বুঝেছেন তো? আর সমাজের অনেক বড় বড় লোকেরাই তো সুনীতাদির সঙ্গে আড়ালে আড়ালে ভাব জমাতে চায়। ওই যে কুবের সিং, অরূপ দত্ত, ওরা তো সব সমাজের খুব উঁচু লোক, যাকে বলে কোটিপতি। সুনীতাদির নামে ওরাই দুর্নাম রটায়, আবার ওরাই সুনীতাদির সঙ্গে ভাব করার জন্য নিজেদের মধ্যে রেষারেষি করে। সুনীতাদিকে অনেক জিনিস প্রেজেন্ট করে। আর সুনীতাদি আমাকে যখন এ সব বলে, তখন ঘরের মধ্যে হাততালি দিয়ে হাসে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। বলে, দীপু, এই জন্তুগুলোর খেলা আমার বেশ লাগে!

সুজিত অবাক হয়ে বলে, তোমাকে বলে?

 দীপেন সরলভাবেই বলল, তবে আর কাকে বলবে? কিন্তু জানেন, সুনীতাদি যখন হেসে ওরকম বলে, তখন আমার কী রকম একটা ভয় ভয় করে। মনে হয়, সুনীতাদি পাগল হয়ে যাবে।

সুজিতের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ঠিক এই কথাটা তারও এই মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল। সুনীতার সমস্ত অসহায় রূপটা যেন তার কাছে আরও স্পষ্ট ও নিষ্ঠুর হয়ে ফুটে উঠল। সুনীতা সকলের মুখের ওপর তীব্র হেসে যতই বিদ্রূপ করুক, সুজিত দেখতে পাচ্ছে, সুনীতার সর্বাঙ্গে শিকলের বেষ্টনী। তার কড়া ধরে সবাই টানাটানি করছে। এক দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধ অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। স্টেশনে বিদায় মুহূর্তের সেই বিস্ময়-চকিত ব্যাকুল চোখ দুটি আবার দেখতে পেল সুজিত। শুনতে পেল, শুনুন।…যেন ডাক শুনেই সুজিত যেন হঠাৎ বাইরের দিকে ফিরে তাকাল।

বাইরে তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘরের অন্ধকার আরও ভারী। দীপেন তাড়াতাড়ি দেওয়ালের দিকে সরে গিয়ে আলোর সুইচটা টিপে দিল। ঘর আলোকিত হয়ে উঠল। সুজিত ফিরে তাকাল দীপেনের দিকে। দীপেনও তাকিয়ে ছিল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছেন আপনি?

সুজিত বলল, তোমার সুনীতাদি বড় দুঃখী দীপু।

দীপেন অবাক হয়ে বলল, আপনি বুঝতে পারেন।

–পারি।

দীপেন হঠাৎ উত্তেজিত অথচ করুণ সুরে বলে উঠল, উঃ, একদিন সুনীতাদি এত কেঁদেছিল আমার সামনে! আমার ভয় হয়েছিল সেই কান্না দেখে। কেন যে কেঁদেছিল, কিছুই জানি না। খালি বার বার বলেছিল, কেন যে জন্মেছিলাম এ সংসারে। কেন যে জন্মেছিলাম।…

বলতে বলতে, দীপেনের চোখ দুটিই আরক্ত হয়ে উঠল। গলার স্বর নিচু হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কোনও কথা বলল না কেউ। টেবিলের ওপরে রাখা সুনীতার স্কেচটার দিকে সুজিত অপলক চোখে তাকিয়ে রইল।

দীপেন সহসা দরজার দিকে যেতে যেতে বলল, আমি মাকে একটিবার দেখে আসি, আপনি বসুন।

সুজিত আস্তে আস্তে সুনীতার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, আশ্চর্য, এর সঙ্গে আমার জীবনের কোথাও কোনও যোগাযোগ নেই। তবু এর কথা আমি ভুলতে পারছি না।

আবার দীপেন এল। বলল, জানেন, আজ আমার পড়তে বসতে একদম ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে, খালি আপনার সঙ্গে কথা বলি।

সুজিত বলল, তোমার ক্ষতি হবে না তো?

–এক দিন না পড়লে আর কী ক্ষতি হবে।

–তা হলে, বেশ তো, এসো গল্প করি। কিন্তু বাবাকে খুঁজতে যাবে না?

দীপেন বলল, দাঁড়ান, এখুনি গেলে হবে না। আর একটু রাত হোক, তখন বাবাকে ঠিক ধরে নিয়ে আসা যাবে। এখন গেলে বকবে, ধমকাবে, হাত-পা ছুড়বে। বাবার যখন আর গায়ে একদম শক্তি থাকবে না, তখন ধরে নিয়ে আসব। তার আগে, সব হোটেলগুলোতে ফোন করে জেনে নেব, বাবা ঠিক কোথায় আছে। সবাই তো চেনে বাবাকে।

–তাই বুঝি।

 দীপেন গিয়ে খাটে বসে পা দোলাতে লাগল। তারপরে হঠাৎ বলল, ও, রঞ্জনের কথাই তো বলিনি।

–কে রঞ্জন?

রঞ্জন মল্লিক। দাদার সঙ্গে এক সময় বন্ধুত্ব ছিল। সেও তো সুনীতাদির জন্যে পাগল। রঞ্জন কিন্তু খুব সাংঘাতিক ছেলে, জানেন?

-তাই নাকি? সে কে?

–খুব বড়লোকের ছেলে, কিন্তু সাংঘাতিক গুণ্ডা। ছেলেবেলা থেকে বখাটে হয়ে গেছল কিনা। ও যা সব গাড়িতে চেপে বেড়ায় না! দারুণ বড় বড় গাড়ি। সবাই বলে, ও নাকি খুনও করতে পারে। ওকে ভয় পায় না, এমন লোক কলকাতায় নেই।

বলো কী?

হ্যাঁ, ও পুলিশ-টুলিশ কাউকে কেয়ার করে না, একেবারে শাহেনশা যাকে বলে। চেহারাটাও দারুণ।

–গুণ্ডার মতো?

না, দেখতে বেশ ভালই। কিন্তু চোখগুলো এমন যে, তাকানো যায় না। ওর সঙ্গে নাকি সবসময় রিভলবার থাকে। এই তো কমাস আগে সুনীতাদিকে বারো হাজার টাকার একটা নেকলেস প্রেজেন্টেশন দিয়েছে।

–তোমার সুনীতাদি নিলেন?

নেয়ানেয়ির কী আছে। রঞ্জন এল, ঘরে ঢুকে নেকলেসটা রেখে বলল, উপহার দিয়ে গেলাম।

ব্যস?

–হ্যাঁ, বেশি কথা বলে না। আর রঞ্জন থাকতে সুনীতাদিকে বোধ হয় কেউ কোনওদিন বিয়ে করতে পারবে না।

কৌতূহলের পর কৌতূহল বেড়েই চলল সুজিতের। বলল, সে কী, বিয়েই করতে পারবে না কেউ?

 দীপেন দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বলল, না। ও যে বলেছে, আমি বেঁচে থাকতে সুনীতাকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না।

যদি তোমার সুনীতাদি না করেন?

–সেখানেই তো ও জব্দ। ও বোধ হয় পৃথিবীতে একমাত্র সুনীতাদিকেই কেয়ার করে। ও বলে, সুনীতা নাগ যদি ওর বাড়িতে আমাকে কুকুরের মতো রাখে, আমি তাও থাকব। সারা জীবন আমি তার চাকরের মতো থাকব, আমাকে যা হুকুম করবে, তাই মানব।

সুজিত সহসা কোনও কথা বলতে পারল না। রঞ্জনের কথাগুলি তাকে চমকে দিল, স্তব্ধ করে দিল। এতক্ষণ ধরে যতগুলি লোকের কথা সে শুনেছে, কারুর কথাই এমন বিস্ময়কর, চমকপ্রদ মনে হয়নি। কারুর কথার মধ্যেই যেন ঠিক এই সুরটা বাজেনি। সে জিজ্ঞেস করল, রঞ্জনের এ সব কথা তুমি কেমন করে জানলে দীপু?

দীপেন বলল, সবাই তো জানে এ সব কথা। আর সত্যি কথা বলতে কী, এই রঞ্জনের ভয়েই অনেকে সুনীতাদির কাছে ঘেঁষে না। ওর সব মারাত্মক দলবল আছে। কিন্তু সুনীতাদি তো ওকে একদম ভয় পায় না। ও-ই বরং সুনীতাদিকে ভয় পায়।

ভয় পায়? সে আবার কী রকম?

 দীপেন ঠোঁট উলটে বলল, কী রকম তা জানি না। রঞ্জনকে যখন বাইরে দেখি তখন এক রকম, আর সুনীতাদির সামনে যখন দেখি তখন আর এক রকম। অনেকটা ভাল মানুষের মতো।

সুজিত আপন মনেই উচ্চারণ করে, ভাল মানুষের মতো। তারপর হঠাৎ বলল, তোমাদের এই রঞ্জনকে আমার দেখতে ইচ্ছে করছে।

দীপেন বলল, একদিন না একদিন দেখতে পাবেনই, কলকাতায় যখন আছেন। তবে ও এখন খালি ছায়ার মতো সুনীতাদির পেছন পেছন ঘোরে। হয়তো সুনীতাদিও জানতে পারে না, ও কখন পেছনে পেছনে রয়েছে।

সুজিত জিজ্ঞেস করল, রঞ্জনকে তোমার সুনীতাদি ভালবাসেন, না?

 দীপেন অভিমত দিল, ওকে আবার কেউ ভালবাসতে পারে নাকি?

এই পর্যন্ত বলেই দীপেন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আপনাকে আমি সুজিতদা বলব।

–নিশ্চয়ই।

দীপেন টেবিলের ওপর থেকে সুনীতার স্কেচটা তুলে নিয়ে বলল, আমাকে এই ছবিটা দেবেন সুজিতদা?

সুজিত এক মুহূর্ত ভেবে ছবিটার দিকে তাকিয়েই জবাব দিল, হ্যাঁ, তুমি যখন সুনীতাদিকে ভালবাস, তখন ওটা তোমারই হওয়া উচিত!

দীপেনের মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, সুনীতাদিকে এটা আমি দেখিয়ে আপনার কথা বলব তো?

–আমার কথা?–সুজিত একটু ভেবে হেসে বলল, বলো, কিন্তু দীপু–কথাটা শেষ হল না। কলিং বেলের শব্দ শোনা গেল। দীপেনের প্রথমে ভ্রূ কুঁচকে উঠল। বলল, দাদা এসে পড়ল নাকি এর মধ্যে?

পরমুহূর্তেই শঙ্কা ফুটে উঠল তার মুখে। বলল, বাবার কোনও অ্যাকসিডেন্টের খবর-টবর আসেনি তো?

বলেই সে ছুট দিল। তার পিছনে পিছনে সুজিতও এগিয়ে গেল। বারন্দা দিয়ে এগিয়ে, উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে সে দেখল, দীপেন সিঁড়ির ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার নীচের দিকে। সুজিত সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যাবার আগেই শুনতে পেল, ভুজঙ্গভূষণের গলা। উনি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বলছিলেন, বড় রায় নেই? খুব ভাল কথা। এখন সে আমার সামনে থাকলে অনেক সত্যি কথা তাকে শুনতে হত। কারণ এখন আমি আর তাকে ভয় পাই না।…আর দীপু রায় কোথায়, আমার চোদ্দোপুরুষের শাসক মহাশয়, ভুজঙ্গভূষণের বাপ।

বলতে বলতে সিঁড়ির উচ্চতম ধাপে উঠেই, প্রায় দীপেনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পিছনে চাকর বিশু।

ভুজঙ্গ বললেন, কে? অ, দীপু। অমন চোখখাবলার মতন তাকিয়ে আছিস কেন? তোকে খুঁজতে যেতে হয়নি, আজ তো আমি অনেক তাড়াতাড়ি ফিরেছি বাপু।

দীপেন এক পাও সরল না। পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। ভুজঙ্গভূষণ টলছিলেন। চোখ তাঁর আধবোজা। তিনি দীপেনের বুকের ওপর একটা হাত রেখে বললেন, সর, আমাকে যেতে দে।

দীপেন তৎক্ষণাৎ বুকের ওপর থেকে বাবার হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল। দিয়ে সরে দাঁড়াল।

ভুজঙ্গভূষণের মাথাটা ঝুলে পড়ল। বললেন, রাগ করেছিস। ওই যে সেই ছেলেটার টাকা নিয়ে গেছি বলে, না? কিন্তু আমি সব টাকা খরচ করিনি, সত্যি বলছি। এমনকী অনেক খেয়ে রাস্তায় পড়েও থাকিনি, দ্যাখ, কেমন তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি।

দীপেনের কিশোর মুখটি রাগে দপ দপ করছিল। ফুঁসে উঠে বলল, কেন আপনি পরের টাকা নিয়েছিলেন?

ভুজঙ্গভূষণ আবার দীপেনের কাঁধে হাত দিলেন, বললেন, আমার আর আপন পরের কী আছে রে? আমি বেঁচে আছি না মরে আছি, তাই বুঝতে পারি না। এখন কথা হচ্ছে, সেই ছেলেটি মানে যার টাকা নিয়েছিলাম, সে কি রাগ করে চলে গেছে না আছে?

দীপেন বলল, তার খোঁজে আর আপনার এখন কী হবে?

ভুজঙ্গভূষণ গলার স্বর নামিয়ে বললেন, না, ওর খোঁজটা চাই। ছেলেটা এত বোকা যে, ওর সব টাকাগুলো খরচ করে ফেলতে আমার মায়া হল। ও আমার থেকেও বেচারি।

দীপেন সুজিতের দিকে তাকাল। সুজিতও তাকাল ওর দিকে আর ঠিক সেই সময়েই ভুজঙ্গভূষণ দীপেনের মুখের দিকে তাকালেন, এবং তার দৃষ্টি অনুসরণ করে, মুখ ফিরিয়ে বারান্দার একপাশে সুজিতকে দেখতে পেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পকেটে হাত ঢুকিয়ে, খুবই গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, এই যে সুজিতনাথবাবু, আমি খুবই লজ্জিত যে আপনার টাকাটা ফেরত দিতে দেরি হল।

কাছে এগিয়ে এসে পকেট থেকে হাত বের করে কতকগুলো নোট বাড়িয়ে ধরে বললেন, নিন, আপনার টাকাটা দয়া করে নিন। অবিশ্যি আপনাকে আমি বলেছিলাম দশ-পনেরো টাকার দরকার, কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ টাকা খরচ করে ফেলেছি। আপনি কিছু মনে করছেন না তো?

সুজিত হেসে বলল, মনে করব কেন? আপনার দরকার হয়েছে, তাই খরচা করছেন। দরকার হলে ওটাও আপনি খরচ করতে পারেন।

–পারি? যেন বিস্ময়েই কয়েকটা হেঁচকি তুলে, টাকাটা পকেটে ঢোকাবার উদ্যোগ করে ভুজঙ্গ বললেন, আপনার হৃদয়টি, সত্যি বলতে কী–

কথা শেষ করবার আগেই তীক্ষ্ণ গলায় ডাক শোনা গেল, বাবা!

ভুজঙ্গ চমকে উঠে বললেন, কে?বলেই পকেটে টাকাটা না ঢুকিয়ে হাতেই রাখলেন, অ্যা, কী বলছ?

কিন্তু ফিরে তাকালেন না। যেন ইতিমধ্যে কিছুই ঘটেনি, এমনভাবে জড়িয়ে জড়িয়ে বলে চললেন, এই টাকাটা আপনি রাখুন সুজিতনাথ, এটা আমার আর এখন খরচা করবার দরকার নেই। পরে দরকার। হলে, ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছিল আপনার হৃদয় নিয়ে! আপনার হৃদয়টি, সত্যি বলতে কী অনেক নির্বোধের মতো সুন্দর এবং উদার। আজকাল সব এত চালাক হয়ে গেছে, অনেকটা ছুঁচোর মতো, বুঝলেন না, তাদেরকে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। কিন্তু আপনি… ।

কথা অতিরিক্ত জড়িয়ে যেতে লাগল ভুজঙ্গভূষণের, মাঝে মাঝে টলে উঠলেন। তবু থামলেন না। বলেই চললেন, আপনি দানবীর। এই প্রসঙ্গেই আমার মনে পড়ছে, আমার এক জমিদার বন্ধু

দীপেন বাধা দিয়ে বলে উঠল, আবার আপনি এ সব গালগল্প আরম্ভ করছেন? বলে সে ভুজঙ্গভূষণের হাত থেকে টাকাগুলি নিয়ে বলল, আপনি এক বার মায়ের কাছে যান না। এ বেলা তো এক বারও যাননি।

হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস, সুনয়নীকে এক বারও এবেলা দেখিনি। এক বার দেখে আসি। কিন্তু তুই যে ভাবছিস দীপু আমি মিছে গালগপ্পো বলি, তা মোটেই নয়।

বলে তিনি বাড়ির ভেতর দিকে যেতে গিয়ে, ফিরে আবার বললেন, সুজিতনাথবাবু আপনিও আসতে পারেন আমার সঙ্গে, গৃহকত্রীকে এক বার দেখে যেতে পারেন। তিনি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে পারবেন না, কারণ তিনি অসুস্থ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত পঙ্গু যাকে বলে। এই দীপুর জন্মের পর থেকেই, আর আমার অবস্থার অবনতির সময় থেকে, তিনি একেবারেই যাকে বলে, জীবন্তে মৃত। আপনাকে দেখলে, আমার স্ত্রী সুখীই হবেন।

সুজিত দীপেনের দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু চোখে। দীপেন বলল, যান, মাকে দেখে আসুন। বলে সুজিতের হাতে টাকাগুলি গুঁজে দিল। সুজিত আর এক বার দীপেনের গম্ভীর কিশোর মুখের দিকে তাকিয়ে ভুজঙ্গভূষণকে অনুসরণ করল। পর পর দুটি ঘর পার হয়ে একটি স্বল্পালোকিত ঘরের দরজায় ভুজঙ্গভূষণ দাঁড়ালেন! সুজিত পাশ দিয়ে দেখতে পেল, পুরনো আমলের একটি উঁচু খাটের ওপর একজন মহিলা শুয়ে আছেন। তাঁর মুখ দরজার দিকে ঈষৎ ফেরানো। মাথার চুল তাঁর বিন্যস্ত আঁচড়ানো, সিঁথিতে সিঁদুর, চোখ সম্পূর্ণ খোলা। অনেকটা দীপেনেরই মুখের ছায়া যেন, অর্থাৎ এই মুখেরই ছাপ রয়েছে দীপেনের মুখে।

ভুজঙ্গভূষণ দরজার চৌকাঠ ধরে ডাকলেন, নয়ন।

সুনয়নীর মুখ ফিরল না, চোখের তারা চকিত হল, ভুজঙ্গের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। ভুজঙ্গ এগিয়ে গেলেন। পাছে টলে পড়েন, সেই ভয়ে সাধ্যমতো শক্ত থাকার চেষ্টা করেন। আস্তে আস্তে গিয়ে, সুনয়নীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মুখোমুখি হলেন। বললেন, কেমন আছ নয়ন?

সেই মুহূর্তেই সুজিতের প্রতি চোখ পড়ল সুনয়নীর। তাঁর মুখ ফেরানো সম্ভব হল না, কিন্তু চোখের তারার আন্দোলনে বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা ফুটে উঠল। ভুজঙ্গ তা লক্ষ করে বলে উঠলেন, ওঁর নাম সুজিতনাথ, ওঁকে নিয়ে এসেছে শিবেন, বুঝলে? খুব ভাল ছেলে, চমৎকার, একটু বোকাসোকা ধরনের, তা সে ভালই বলতে হবে। এখন থেকে উনি আমাদের বাড়িতেই থাকবেন খাবেন, পেয়িং গেস্ট যাকে বলে।

সুজিতের মনে হল, ভুজঙ্গভূষণ এখন যেন বেশ সহজভাবে কথা বলছেন। কিন্তু সুনয়নীর চোখের তারা সহসা স্থির হয়ে গেল, দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হল, নাসারন্ধ্র স্ফীত ও কুঞ্চিত হল, যদিও মুখের চামড়া একটুও কাঁপল না। ভুজঙ্গও সহসা অসহায়ভাবে বলে উঠলেন, হ্যাঁ নয়ন, আজ আমি মদ খেয়েছি, রাগ করো না। বুঝতে পেরেছি, তুমি সব কথাই শুনেছ, কিন্তু তুমি এঁকে জিজ্ঞেস কর, ইনি রাগ করেননি, ইনি অত্যন্ত উদার প্রাণ। নয়ন, নয়ন! লক্ষ্মীটি, আমার দিকে ফিরে তাকাও। নয়ন, আমার যে ইচ্ছে হয়, আমি সব সময় অচৈতন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকি, আমাকে যেন আর কিছুই চোখ চেয়ে, মন দিয়ে দেখতে না হয়। কিন্তু অনেক মদ খেয়েও তা পারি না। নয়ন!

ভুজঙ্গ তাঁর কম্পিত একটি হাত সুনয়নীর কপালে রাখলেন। সুনয়নীর চোখ ছাপিয়ে সহসা জল এসে পড়ল। তিনি চোখ বুজলেন। সুজিতের মনে হল, ওর চোখ ফেটেও জল এসে পড়বে।

ভুজঙ্গ বালিশের পাশ থেকে তোয়ালে নিয়ে সুনয়নীর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন। খানিকক্ষণ পরে সুনয়নী আস্তে আস্তে চোখ খুললেন, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল সুজিতের প্রতি। কয়েকবার চোখের পাতা কেঁপে উঠল তাঁর। ভুজঙ্গ তাড়াতাড়ি সুজিতের দিকে ফিরে বললেন, কাছে আসুন সুজিতনাথবাবু, নয়ন আপনাকে ডাকছে।

সুজিত তাড়াতাড়ি কাছে এল। ভাবলেশহীন মুখের সেই নিষ্পলক চোখের দিকে তাকাতে এক মুহূর্ত যেন কেমন অস্বস্তি হল, পরমুহূর্তেই সে-ও হাঁটু পেতে বসল। ভুজঙ্গ বলে উঠলেন, আ-হা-হা, আপনি কেন ওরকম করে বসছেন, আপনি

সুজিত বলল, তাতে কী হয়েছে। আমার যে বসতে ইচ্ছে করছে ওঁর কাছে।

সুনয়নীর চোখের তারা কেঁপে উঠল। ভুজঙ্গ বললেন, ও, আচ্ছা আচ্ছা, আপনি বসুন, নয়ন তাই বলছে। নয়ন, ছেলেটি ভালই, কী বলে?

সুনয়নীর চোখ দুটি যেন একটু উজ্জ্বল দেখাল, চোখের তারা কাঁপল। সুজিতের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। সুজিত দেখল, সেই চোখের মধ্যে গভীর স্নেহ যেন উথলে উঠছে। সে যেন দেখতে পেল, সুনয়নী হাসছেন, বলছেন, এসো বাবা, বস, বড় ভাল লাগছে তোমাকে দেখে। আর সে ভাবছে, এ কী মানুষের অসহায় রূপ। ভিতরে যাঁর সকল ভাবের খেলা নানান তরঙ্গে বইছে, বাইরে তিনি প্রস্তরীভূত। যেন শাপগ্ৰস্তা অহল্যা।

সুজিত বলল, আমি এখানে থাকব, সময় পেলেই আপনার কাছে আসব।

সুনয়নীর চোখের তারা নড়ে উঠল। চোখ উজ্জ্বল, আরক্ত হল, এবং আবার জল এল। এবার সুজিতই তোয়ালেটা দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিল।

ভুজঙ্গ বলে উঠলেন, অথচ এ সবের জন্যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না সুজিতনাথবাবু, জীবনটাকে আমি ভালভাবেই আরম্ভ করেছিলাম। লোকে বলে পাপ করলে সাজা পায়। আমি কী পাপ করেছি, তা জানি না।

সুনয়নীর চোখের তারা ভুজঙ্গের প্রতি নিবদ্ধ হল, এবং নড়াচড়া করল। ভুজঙ্গ বললেন, তা বেশ, কিছুই বলব না। কিন্তু ভাগ্যের একী খেলা।

সুজিত মনে মনে বলল, ভাগ্য এমনি। তার রথের দুই চাকা দুপাশে। একটা সৌভাগ্য, আর একটা দুর্ভাগ্য। এবং ভাগ্য অন্ধ। কোনদিকে তার সৌভাগ্যের চাকাটা পড়ছে, আর কোনদিকে দুর্ভাগ্যের, তা সে নিজেও বোধ হয় জানে না। সুজিত কিছু বলল না। তার শুধু একটি নিশ্বাস পড়ল, এবং সে অসংকোচে সুনয়নীর কপালে একটি হাত রাখল। সুনয়নী এক বার তাকালেন সুজিতের দিকে, তারপর চোখ বুজলেন।

সুজিত বলল, আপনি আমাকে নাম ধরেই ডাকুন।

ভুজঙ্গ বললেন, সেটা আমার মনে হচ্ছে বটে, তোমাকে আপনি করে বলার কোনও মানেই হয় না। যাই হোক, যা বলছিলাম, আমি দেখলাম, নয়ন তোমাকে খুবই ভালভাবে নিয়েছে, মানে কী বলব, ওর ছেলের মতোই। তোমার মতো একটা হাবাগোবা লোকের মধ্যে আমি দেখছি একটা বেশ প্রাণের ব্যাপার আছে। আমি খুবই খুশি হয়েছি তোমার ব্যবহারে—

সুজিত বলে উঠল, আমি বলছিলাম কী, এ টাকাগুলো আপনি রাখুন। তবে বেশি মদ খাবেন না।

ভুজঙ্গ যেন চমকে উঠে বললেন, মানে? তুমি কি বলতে চাও, তোমার টাকার জন্যেই আমি–

-না না, আপনার দরকার, তাই আমি বলছিলাম।

ভুজঙ্গ হঠাৎ ফিসফিস করে বললেন, দীপুকে বলবে না তো।

 সুজিত বলল, ও জিজ্ঞেস করলে আমি বলব অবিশ্যি।

ভুজঙ্গ দু-হাত পিছনে সরে গিয়ে, ভ্র জোড়া কুঁচকে বললেন, তার মানে?

তার মানে, আমি আবার মিছে কথা বলতে পারি না কিনা।

–মিছে কথা বলতে পার না!

আজ্ঞে না, মিছে কথা বলতে গেলেই আমার বুক ধড়ফড় করে, মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাব।

ভুজঙ্গ নির্বাক বিস্ময়ে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হা হা করে হেসে উঠলেন। বললেন, তার মানে তুমি একটা ব্রিলিয়ান্ট কাওয়ার্ড, ভীরু! মিছে কথা বলতে গেলে বুক ধড়ফড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে!

আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার সেই রকমই মনে হয়। ছেলেবেলায় দু-একবার চেষ্টা করেছি কিনা, তাইতেই বুঝতে পেরেছি। তার ওপরে আমার নার্ভ খুব খারাপ। মিছে কথা বলবার আগের থেকেই আমার ঘাম হতে থাকে।…তবে আমি দীপুকে বললেও, তাকে ভাল করে বুঝিয়ে বলব, যাতে সে আপনার ওপর রাগ না করে।

ভুজঙ্গ এক বার দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। তারপর সুজিতের হাত থেকে টাকাগুলো টেনে নিয়েই, কোমরের কষিতে গুঁজে, বলতে আরম্ভ করলেন, হ্যাঁ, তোমাকে যা বলছিলাম

এমন সময় আবার কলিং বেল বেজে উঠল। ভুজঙ্গ থমকে বলে উঠলেন, বড় রায়, এ আর দেখতে হবে না। আমি গিয়ে শুয়ে পড়ছি, তুমি বাইরের ঘরে চলে যাও। খবরদার, টাকার কথা যেন বোলো না।

বলেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। সুজিত হেসে বাইরের ঘরের দিকে গেল।