৭. উপসংহার

উপসংহার

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের মধ্যদিয়ে আসামভুক্ত সিলেট জেলাও গণভোটের ফলাফলে ভাগ হয়। কার্যত করিমগঞ্জের কিছু অংশ ছাড়া সমগ্র শ্রীহট্ট পাকিস্তানভুক্ত হয়। অথচ আসাম প্রদেশ গঠনের সময়কাল থেকে ভারত বিভক্তি পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৩ বছর সিলেট ছিল আসাম প্রদেশ বা রাজ্যের একটি জেলা যা মূলে ছিল বাংলার অন্তর্ভুক্ত।

বস্তুত সিলেট গণভোট ছিল পূর্ব পরিকল্পিত— যার চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল ত্রয়ীশক্তি সমবায়ে— ব্রিটিশরাজ, আসাম সরকার এবং ভারতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ। সিলেট চলে যাওয়ায় আসামে বসবাসকারী বাঙালি সমাজ পরিণত হয় একটি দুর্বল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে। ভারত ভাগের পূর্ব পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র এবং সুরমা উপত্যকার মাঝে ভারসাম্য হিসেবে দাঁড়িয়েছিল সিলেট। অসমিয়া নেতৃত্ব কেবল সিলেট নয়— কাছাড় জেলাকেও আসাম থেকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না হওয়ায় স্বাধীনতা উত্তরকালে শুরুতেই তাঁরা নববলে বলীয়ান হয়ে বাঙালি সমাজকে নিশানা করেন। স্বাধীনতার ঊষাকালেই অসমিয়া নেতৃত্ব চাইলেন উগ্র অসমিয়া জাতীয়তাবাদকে ধারণ ও লালন করে রাজ্যিক ভাষা হিসেবে কেবল অসমিয়ার স্বীকৃতিদান। ব্যাবসা, ভূমি, শিক্ষা, চাকরি, কৃষি তথা সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে তাঁদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ও আধিপত্য বিস্তার। আর এ কাজে অগ্রণী হন অহম জাতীয় মহাসভা ও আসাম সরকার।

জাতীয় মহাসভা ১৯৪৭ সালে ২৩ আগস্ট গৌহাটিতে এক বিশাল সভার আয়োজন করে। যেখানে মূল কথা ছিল বাঙালি বিরোধী অপপ্রচার তথা বাঙালি উৎসাদন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির শুরুতেই জাতিগত বিদ্বেষ।

সাতচল্লিশে ভারত বিভক্তির পরপরই সিলেটের একটি রেলওয়ে প্রতিনিধি দল আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রেলওয়েতে তাদের চাকরির বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি বলেন:

এই সরকারের নতুন নীতি হচ্ছে আসাম অসমিয়াদের জন্য। গোপীনাথ বরদলৈ সংকীর্ণ প্রাদেশিকতার পক্ষেই অবস্থান নিলেন। গোপীনাথজী-র এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এ সময় কলকাতায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত মহাত্মা গান্ধী। কিন্তু তারপরও আসামের প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবস্থানে অটল থাকেন।

গোপীনাথ বরদলৈ ১৯৪৭সালের ৩ অক্টোবর গৌহাটিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তাঁর সরকারের ভাষা নীতি সম্পর্কে বলেন, ‘Assamese would be the official and State language.’ তিনি আরও বলেন, ‘Assamese would also be the medium of instruction in schools.’ তিনি এ দিন এ কথাও বলেন যে, ‘The language of local people in certain areas would not however, be disturbed, but they must have Assamese as cumpulsory second language’.

এভাবেই শ্রী গোপীনাথ ভারতবাসীকে আসামের যাত্রা শুরুর পালা বিবৃত করেন।

আসাম প্রদেশে প্রথম আইনসভা বসে ১৯৪৭ সালের ৫ নভেম্বর। গভর্নর স্যার আকবর হায়দারী এদিনের সভাতে সদস্যদের উদ্দেশে যে ভাষণ দিলেন তাও তো জাতিবৈরীতায় পূর্ণ, উদ্দেশ্যমূলকভাবেই। সদ্য স্বাধীন দেশে সকল বৈরিতা, কলহ দ্বন্দ্ব পিছনে ফেলে একসঙ্গে যখন সকল জাতি-সম্প্রদায় পা ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করছেন— ঠিক তখনই আসাম গভর্নর একটি সুনির্দিষ্ট জাতির উদ্দেশে যেসব উক্তি করেন— তা ছিল অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি আসামের বাঙালিদের ‘Stranger’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। অসমিয়াদের কাছে বাঙালির আনুগত্যের কথাও বলেন গভর্নর।

গোপীনাথ বরদলৈ সাতচল্লিশের নভেম্বরে শিলচরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে দেওয়া স্মারকলিপির জবাবে পুনরায় ভাষা প্রসঙ্গে বলেন, ‘…Assamese as a state language would be made compulsory.’ শ্রী বরদলৈ আসাম বিধান পরিষদে গভর্নরের দেওয়া বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন:‘…His Excellency referred to Pakistan Bengalees and not the Cachar Bengalees.’ এই জবাবে কাছাড়ের বাঙালিরা খুশি হতে পারেননি। কারণ গভর্নরের ভাষণে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না।

এ সব উক্তি থেকে আসাম সরকারের অবস্থান স্পষ্ট। এক, অসমিয়া ভাষা রাজ্যের সরকারি ভাষা হবে এবং দুই, বাঙালি উৎসাদন। আর আসামে যদি থাকতেই হয়, তাহলে অসমিয়াদের সবকিছু গ্রহণ করে এবং তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই থাকতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বা অবস্থান ভারতের সংবিধান বিরোধী— যা গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং যে কোনো নাগরিক যে কোনো প্রদেশে যেতে পারেন, বসবাস করতে পারেন।

এ সময় শিলচরে নর্মাল স্কুল প্রাঙ্গণে ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাতচল্লিশের পঁচিশে নভেম্বর অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের মূল বক্তা ছিলেন বিশিষ্ট ভাষাবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি অধ্যাপক ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সম্মেলনে তিনি মিলনের বার্তা দিলেন। অসমিয়া এবং বাংলা ভাষার একত্রে পথ চলার কথাও বললেন। তিনি জানান, ‘জার্মানিতে জার্মান এবং চেক ভাষা যদি একত্রে পথ চলতে পারে, পাশাপাশি থাকতে পারে— তাহলে আসামে তা সম্ভব নয় কেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘ভাষার স্বাধীনতায় অনুচিত হস্তক্ষেপ ও পক্ষপাতিত্ব পৃথিবীর কোথাও বরদাস্ত করা হয়নি। তিনি জানান, ‘আসামের ভিতরে বাঙালিত্বের বড় ছাপ আছে ও থাকবে। ক্ষমতা হাতে পেয়ে অন্যের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর হামলা করা অন্যায় ও অনধিকার চর্চা। বাংলা ভাষাকে রোধ করার কোনো অপচেষ্টা আরম্ভ হলে তা অমার্জনীয়।’

ড. চট্টোপাধ্যায় স্বাধীনতার উষা লগ্নে ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে যে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন— তা যদি আসাম সরকার মান্য করতেন—তাহলে এত রক্তপাত, ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় এড়ানো যেত এবং শান্তির বাতাবরণ গড়ে উঠতে পারত।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে আসামের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসন্তকুমার দাস শিলং গভর্নর হাউসে ভারতের সহকারী প্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেলকে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে ‘সিলেট সম্মিলনী’র পক্ষ থেকে ভাষা বিষয়ে বলা হয়, আসামে মোট ৮০ লক্ষ লোকের মধ্যে ২২ লক্ষ অসমিয়া ভাষাভাষী।’ অন্যদিকে ‘৩০ লক্ষ ও ২৮ লক্ষ লোক যথাক্রমে বিভিন্ন পার্বত্য ভাষায় ও বাংলা ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু আসাম সরকার অসমিয়া ভাষাকে সরকারী ভাষারূপে চালাবার চেষ্টা করে প্রদেশের দুই-তৃতীয়াংশ লোকের ওপর অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক লোকের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন।’

বল্লভভাই প্যাটেল সেদিন ধৈর্য ধরে সব শুনেছিলেন বটে কিন্তু ফলাফল ছিল শূন্য।

এ বছর মে মাসে গৌহাটি ও তার আশপাশ এলাকায় বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর বড়ো রকমের হামলা চালানো হয়। এই হামলায় রেলওয়ে কর্মচারী, অন্যান্য শ্রেণি পেশার মানুষ এমনকী সাধারণ মানুষও আক্রান্ত হন। হাঙ্গামায় অসংখ্য দোকানপাট ও বাসগৃহ লুট এবং গৃহদাহের মতো ঘটনা ঘটে। হতাহত হয় অসংখ্য নর-নারী, শিশু। প্রশাসনের সম্মুখেই উন্মুক্ত ট্রাকে করে অসমিয়ারা বাঙালি বিরোধী স্লোগান দিয়ে বেড়িয়েছে। সন্ধ্যাতেও একই ঘটনা ঘটে। তারা গৌহাটির পল্টন বাজারের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিরোধী স্লোগান দিতে দিতে ধীর গতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরবর্তীতে আসাম সরকার হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী নামালেও বাংলা ভাষাভাষী জনগণকে তারা রক্ষা করতে পারেনি। এ সময় গৌহাটিতে ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটেছে। বাঙালি হিন্দু ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, বাসগৃহ আক্রান্ত হলেও কোনো বাঙালি মুসলমানের দোকানপাট, বাসগৃহ আক্রান্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে কেউ আক্রান্তও হননি। সব ঝড় বয়ে গেছে বাঙালি হিন্দুদের ওপর। অসমিয়া নেতৃত্ব সুচিন্তিতভাবেই বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা সফলও হয়েছিলেন।

১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ বা পশ্চিমবঙ্গের মতো আসামেও ব্যাপক আকারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া এবং বড়পেটার দাঙ্গা ছিল ভয়াবহ। কাছাড় জেলার করিমগঞ্জেও বড়ো রকমের দাঙ্গা সংঘটিত হয়। পুলিশকে গুলিও চালাতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। গৌহাটি, লামডিং, নওগাঁতেও দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু বিবৃতি প্রদান করেন। আসাম দাঙ্গার ব্যাপকতা, বিস্তৃতি এতটাই উদ্বেগজনক ছিল যে, সরকার দাঙ্গার কারণ অনুসন্ধানে কমিশন গঠনে বাধ্য হন। গভর্নর ‘Assam Disturbed Areas ordinance’ও জারি করেন। এই দাঙ্গার ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি অনেকটাই ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে, মানুষ পালটে যায়, চেনা লোককেও অচেনা মনে হয়। একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, নির্ভরতা তলানিতে নেমে যায়। দাঙ্গার স্মৃতি মুছে ফেলা সত্যিই কঠিন।

স্বাধীন ভারতে জনগণনা প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে। আসামে এই জনগণনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক কারচুপি, শঠতা, মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়। এ কাজে সরকারি কর্মচারীরাও যুক্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে। তাদের লক্ষ, অসমিয়া ভাষাভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধি অপরদিকে বাঙালির সংখ্যা হ্রাস। কাছাড়ের মানুষ দিল্লির দরবার পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার পুনর্গণনা নাকচ করে দেন। আসাম সরকার সব মহলেই এজন্য নিন্দিত হয়েছিলেন। অসমিয়াদের জন্মহার এতটাই বেশি দেখানো হয় যে, তা নাকি ইঁদুরের জন্ম হারকেও হার মানিয়েছে। এভাবেও অসমিয়া সমাজ এগিয়ে থাকতে চেয়েছেন, যা লজ্জাজনক। কিন্তু কোনো নিন্দাই সরকারকে স্পর্শ করেনি।

১৯৫৪ সালে করিমগঞ্জ কলেজ হলে ১৯ ও ২০ জুন অনুষ্ঠিত হয় ‘আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্মেলন’। দু’দিনের এই সম্মেলনে বক্তাগণ অসমিয়া ভাষাকে সমগ্র রাজ্যবাসীর ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলা ভাষা কখনও লুপ্ত হবে না, কোনো প্রাদেশিক সরকারের এক সার্কুলারে এই ভাষাকে দমন করা যাবে না। এই সম্মেলন জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়।

পুনরায় বাঙালি বিতাড়ন পর্ব শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। গোয়ালপাড়া জেলায় সংঘটিত এই ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। আমরা জানি, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের লক্ষ্যে এ সময় ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ সরেজমিনে তথ্যসংগ্রহে আসাম আসার কথা। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণসহ আসামের বাংলাভাষী অঞ্চলগুলো পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একীভূত করার জন্য ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ বরাবর আবেদন জানান। গোয়াপাড়ার বাঙালি সম্প্রদায় পশ্চিমবঙ্গের এই প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। এরপর থেকেই বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু হয়।

মার্চ মাসেই আক্রান্ত হন ধুবড়ির বাঙালিগণ। ২ এপ্রিল ৫০টি ট্রাকে করে অসমিয়া ও অন্য সম্প্রদায়ের কিছু সংখ্যক বাঙালি বিরোধী-ধ্বনি দিতে দিতে ধুবড়ির বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। এই ঘটনায় বাঙালিরা উদবিগ্ন হয়ে পড়েন। বিলাসীপাড়া, অভয়াপুরীর বাঙালিরাও অসমিয়াদের সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হন। বিজনী, বরপেটা, ফকিরাগ্রাম অঞ্চলের বাঙালিরাও আক্রান্ত হলেন। আক্রমণকারীরা গোয়ালপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে যায়। লুট, অগ্নিসংযোগ, মারধর চলে দিনের পর দিন। নারী নির্যাতন, নারীর সম্ভ্রমহানির মতো ঘটনাও ঘটে অগুনতি।

গোয়ালপাড়ায় বাঙালিদের ওপর হামলা এতটাই তীব্র ছিল যে, বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা, আসাম বিধানসভা এবং লোকসভাতেও একাধিকবার আলোচিত হয়। সর্বভারতীয় কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক এবং আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেস নেতৃত্ব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এসব নেতৃবর্গ জনসভাতেও বক্তৃতা দেন। আসাম মুখ্যমন্ত্রীও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন ও জনসভায় বক্তৃতা করেন। সেনাবাহিনী তলব করা হয়। অত্যাচারে বিপর্যস্ত বাঙালিদের একটি বড়ো অংশ ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। তারা আশ্রয় নিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষত আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে। গোয়ালপাড়ায় চোখে পড়ার মতো সরকারি তৎপরতা লক্ষ করা গেলেও বাঙালি সমাজ হামলার বিচার পাননি, কোনো সাহায্যও মেলেনি।

‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ শিলচর এসে পৌঁছান ১৯৫৫ সালের ৩ মে। কার্যত বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল শিলচর সফরের মধ্য দিয়ে কমিশন তাঁদের আসাম সফর শুরু করেন। শিলচর এবং শিলং-এ কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংস্থা, মন্ত্রী-আমলা, রাজ্যপাল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হন। বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বহু স্মারকলিপিও পেশ করা হয়। কমিশন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গেও কথা বলেন। কমিশন সদস্যগণ ধুবড়ি পৌঁছান ১৪ মে এবং ১৫ মে থেকে বিভিন্ন দল, ব্যক্তি ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। এখানেও বেশ কয়েকটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। গোয়ালপাড়া পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে কমিশন তাঁদের সফর শেষ করেন।

এ বছরেই কমিশন রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে আসামের বাঙালিদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি বলেই কাছাড় তথা গোয়ালপাড়ার বাঙালি সমাজ মনে করেন। তাঁরা ভারত সরকারের কাছে লিখিত প্রতিবাদও জানান কিন্তু কোনো উত্তর মেলেনি।

১৯৫৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘অসম সাহিত্যসভা’র ২৭তম বার্ষিক অধিবেশনে বক্তাগণ আসাম সরকারকে ১৯৬০ সালের মধ্যেই অসমিয়া ভাষাকে রাজ্য ভাষা করার আহ্বান জানান। আর সাহিত্যসভার কোনো আহ্বান অর্থই নির্দেশ। আমরা জানি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অসমিয়া রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে অনুমোদিত হয়।

অসমিয়া জনগোষ্ঠী চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছোতে আবারও বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর ব্যাপক হামলা চালাল ১৯৬০ সালে— যা ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন বা অভিযান নামে খ্যাত। অসমিয়াদের বিশ্বাস তাঁদের সকল উন্নতির অন্তরায় বাঙালি জাতি। সুতরাং আসাম থেকে বাঙালি হটাও। এ সময় আর কোনো জাতি-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের ওপর আঘাত হানা হয়নি বা তাঁরা কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হননি। এই হামলায় কেবল অসমিয়া নন, বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশ এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কিছু সংখ্যক মানুষও অংশগ্রহণ করে। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, এই হামলার একমাত্র লক্ষ্য ছিল আসামে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী বা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের ওপর এ সময় যে নারকীয় নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়—তা ’৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গাকেও হার মানিয়েছে।

১৯৬০ সালের মে মাস থেকে এই হাঙ্গামা শুরু হয়। এ সময় ট্রেনে, বাসে, লঞ্চে, রাস্তায় বাঙালিরা আক্রান্ত হন। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শহরের বাড়িঘরও বাদ যায়নি। ধর্ষণের শিকার হন অসংখ্য বাঙালি নারী, নিহত হন অনেক মানুষ। আসাম সরকার দাঙ্গায় ৪০ জনের মৃত্যু সংবাদ মেনে নিলেও বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যা অনেক বেশি। কার্যত সমগ্র ব্রহ্মপুত্র এলাকা জুড়েই বাঙালিরা আক্রান্ত হয়েছিলেন।

জুলাই মাস থেকে দাঙ্গা ভয়াবহ আকার নেয়। সেনা নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে, সরকারি কর্মচারী ও পুলিশ প্রশাসনের একটি বড়ো অংশ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী দাঙ্গার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারা সমর্থন যুগিয়েছেন, সাহায্য করেছেন একটি সুনির্দিষ্ট জাতিকে। ফলে, পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। আসাম সরকার তো বটেই, কেন্দ্রীয় সরকারও বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর এই অমানবিক নারকীয় নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। সমস্ত বিষয়টির প্রতি তাঁরা ছিলেন উদাসীন। বরং আসাম সরকারের প্রতিই তাঁরা ছিলেন সহানুভূতিশীল। মানব বিপর্যয়কারী এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হাজার হাজার বাঙালি ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। জীবন ও মান বাঁচাতে অধিকাংশ মানুষ পাড়ি দিলেন পশ্চিমবঙ্গে। নিজ দেশেই পরবাসী। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য শরণার্থী শিবির গড়ে তুলতে হয়। শেষপর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ষাট হাজার।

হতভাগ্য বাঙালি উদবাস্তুরা আসাম অভ্যন্তরে গঠিত বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরেও আশ্রয় নেন। লামডিং-এ আশ্রয় নিলেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু। কাছাড় জেলাতেও বাঙালি উদবাস্তুদের ঢল নামে। কেবল শিলচরেই ১৭টি শরণার্থী ক্যাম্প খোলা হয়। প্রায় চোদ্দো হাজার আশ্রিত মানুষের মধ্যে ২৫ জনের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যায় সরকারি সূত্রে।

বাঙালিদের ওপর এই আক্রমণ ছিল মানবসৃষ্ট, পরিকল্পিত। ভাষা উপলক্ষ্য, লক্ষ্য বাঙালি উৎসাদন। এ কাজে তারা সফলও হয়। সমগ্র আসামে বাঙালি সমাজ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তছনছ হয় তাদের পরিবারিক জীবন, জীবিকা।

হাঙ্গামায় আসামের একশ্রেণির পত্রপত্রিকা, প্রচারপত্র, পুস্তিকার ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক। অসংখ্য কবিতা, গান, গল্প, অসমিয়া যুবসমাজকে বিপথে যেতে প্ররোচিত করে। এ সবের নেপথ্যে ছিলেন এক শ্রেণির অসমিয়া বুদ্ধিজীবী— যাঁরা ধ্বংস তরান্বিত করেছেন। এ সময়ের বহুল প্রচারিত বই ‘মাটি কার’ এবং ‘আশীর্বাদ’।

এমন দুঃসহ, কলুষিত অস্থির আবহাওয়ার মধ্যেও অসমিয়া নেতৃত্ব তাঁদের ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষা করার জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। আসাম বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা জানান, ‘অসমিয়া ভাষা যাঁদের মাতৃভাষা নয়— সেইসব সম্প্রদায়ের মত না নিয়ে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা সঙ্গত হবে না। মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়। অসমিয়া ছাত্রছাত্রীরা পথে নামে। আর এর ফলে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর মত পালটে ফেললেন। তিনি অসমিয়া ভাষাকে অতি দ্রুত রাজ্যের সরকারি ভাষা করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেন। আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি এবং বিধানসভা কংগ্রেস দলের সঙ্গে যুক্ত বৈঠকে ২৪ মার্চ সিন্ধান্ত হয়: ‘অবিলম্বে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হোক।’ ঘোষণায় আরও বলা হয়, ‘স্বায়ত্বশাসনশীল পার্বত্য জেলাগুলি এবং কাছাড়ের বর্তমান ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করাই সরকারের কর্তব্য হবে।’

এই সিন্ধান্তের পর বাঙালি মহলে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। হরতাল, মিটিং, মিছিল অনুষ্ঠিত হয় নিত্যদিন। এ সবই অনুষ্ঠিত হয় গণতন্ত্রের পথ ধরে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। অসমিয়া নেতৃত্ব এ সবের তোয়াক্কা না করে নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। ২১ এবং ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের সরকারি ভাষার পক্ষে মত দেন। ২৩ জুন মুখ্যমন্ত্রী বি. পি. চালিহা বিধানসভার আগামী অধিবেশনে অসমিয়াকে আসামের রাজ্যভাষা হিসেবে অনুমোদনে একটি বিল উত্থাপন করবেন বলে ঘোষণা করেন।

বিতর্কিত এই ভাষা বিল মুখ্যমন্ত্রী চালিহা শেষ পর্যন্ত ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর বিধানসভায় পেশ করেন। কমিউনিস্ট পার্টি, পি এস পি এবং আর সি পি আই অসমিয়া ভাষাকে সরকারি ভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করে। অন্যদিকে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যও অসমিয়ার পক্ষ নেন। পাহাড়ি সদস্যদের মধ্যেও বিভাজন লক্ষ করা গেল। কেবল কাছাড়ের কিছুসংখ্যক সদস্য বাংলাকে রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কাছাড়ের সদস্যদের মধ্যেও বিভাজন ছিল। বেশ কয়েকজন বাঙালি প্রভাবশালী সদস্য বাংলার পক্ষে দাঁড়াননি। ফলে অসমিয়া অতিসহজেই এগিয়ে থাকে।

কিন্তু কাছাড়ের মানুষ একমাত্র অসমিয়াকে সরকারি ভাষা হিসেবে মেনে নেননি। তাঁরা বাংলাকেও অন্যতম সরকারি ভাষা করার দাবি জানান। প্রায় প্রতিদিন সভা, মিছিল, প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। কিন্তু আসাম সরকার তাঁদের অবস্থানে অটল থাকেন। গত জুলাই মাসে ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন যখন তুঙ্গে, আসামের বাঙালিরা যখন দিশেহারা, তখন মূলত কাছাড়ের বাঙালিদের উদ্যোগে শিলচরে ২, ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষা সম্মেলন। এই সম্মেলন বাঙালি মনে আশার সঞ্চার করে। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র কাছাড়ে প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ করা যায়। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাংসদ চপলাকান্ত ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট চিন্তাবিদ-সাহিত্যিক কাজী আবদুল ওদুদের মতো মানুষের উপস্থিতি এবং তাঁদের ভাষণ সমগ্র এলাকাকে উজ্জীবিত করে।

এ সময় শিলচরে সংস্কৃতি ভবনে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী আয়োজিত সম্মেলনও বাঙালি জনমনে সাহসের সঞ্চার করে। দুটি সম্মেলন থেকেই আসাম সরকার তথা অসমিয়া জনগোষ্ঠীকে একগুঁয়েমি ছেড়ে একাধিক ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণের বার্তা দেন।

বাঙালি জনগোষ্ঠী কার্যত প্রথমবারের মতো আসামের পরিস্থিতিগত কারণে নিজেদের একতাবদ্ধ করতে একটি সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষে নভেম্বর মাসে আসাম উপত্যকার একটি ছোট্ট শহর হোজাই-এ আয়োজন করেন ‘নিখিল আসাম বাংলা ভাষাভাষী’ সম্মেলন। সম্মেলনে সমগ্র প্রদেশ থেকেই বাঙালি প্রতিনিধি উপস্থিত হয়েছিলেন। সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বাংলা ভাষাভাষীদের একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। আসাম সরকার এখানেও হাত বাড়ান। সংগঠন কর্মকর্তাদের তৎপরতা থামাতে তাদের বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ক্ষমতা হাতে পেলে মানুষ যে ক্ষমতার অপব্যবহার কতভাবে করতে পারেন— তার জ্বলন্ত উদাহরণ এই সরকার। এ কাজে গোপীনাথ বরদলৈ থেকে বি পি চালিহা পর্যন্ত সকলেই যে পারংগম ছিলেন— তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

শেষপর্যন্ত ২৪ অক্টোবর বিতর্কিত ‘আসাম সরকারি ভাষা বিল ১৯৬০’ আসাম বিধানসভায় অনুমোদিত হয়। রাজ্যপালও বিলটি অনুমোদন করেন। এর বিরুদ্ধে সমগ্র কাছাড় জুড়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। বলা প্রয়োজন যে, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল কাছাড়ের মানুষের হাতে। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বাস এই অঞ্চলেই। স্বাভাবিকভাবে ভাষা বিল অনুমোদনের পরও আন্দোলন থামেনি। বাংলাভাষার পক্ষে তাঁরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন।

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা কংগ্রেস কর্মী সম্মেলন। সবার দৃষ্টি ছিল এই সম্মেলনের দিকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে কাছাড়কে আলাদা করে একটি পৃথক শাসনতান্ত্রিক সংস্থা গঠন এবং কাছাড় কংগ্রেসকে আসাম কংগ্রেস থেকে পৃথক করার প্রস্তাব গৃহীত হলেও সভায় বাংলাকে রাজ্যের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণের কোনো প্রস্তাব নেওয়া হয়নি— অথচ সময়ের দাবি ছিল বাংলা ভাষার দাবিকেই সর্বাগ্রে তুলে ধরা।

সম্মেলনে বাংলা ভাষা সম্পর্কে কথা না বলা, স্বতন্ত্র প্রদেশ কংগ্রেস এবং পৃথক প্রশাসনিক ইউনিট গঠন প্রস্তাবকে এই অঞ্চলের মানুষ ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। বাংলা ভাষা বিরোধী শক্তি এই পৃথক হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে তাদের প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। কাছাড় কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্ত ভাষা আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং আন্দোলনকে অনেকটাই দুর্বল করে দেয় বলে অনেকে মনে করেন। আমরা দেখেছি, ‘শান্তি পরিষদ’ সদস্যগণ, এমনকী মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী পর্যন্ত এই পৃথক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি মানুষের কাছে গুরুত্বের সঙ্গেই তুলে ধরেছেন। ফলে, বিভ্রান্তি বেড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জে আয়োজিত এক জন-সম্মেলনে গঠিত হল ‘কাছাড় জেলা গণ সংগ্রাম পরিষদ’, যে সংগঠন বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দানে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে। বিভিন্ন মত ও পথের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষেরা নেতৃত্বদানে এগিয়ে আসেন। নব সৃষ্ট সংগঠনে কোনো বড়ো মাপের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা বুদ্ধিজীবী যুক্ত হননি বা যুক্ত ছিলেন না।

অল্পদিনের মধ্যেই কাছাড়ের সাধারণ মানুষ ও ছাত্রছাত্রীরা এই সংগঠনের ডাকে বিপুলভাবে সাড়া দেয়। গণ সংগ্রাম পরিষদ অতিদ্রুত তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে অগ্রসর হন। সংগঠন মজবুত করতেও তারা যথাযথ পদক্ষেপ নেন। এরপরই পরিষদ বাংলা ভাষাকে অন্যতম সরকারি ভাষার মর্যাদা দানে আবেদন জানালেন রাজ্য সরকার তথা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ফলে, সংগ্রাম পরিষদ সরকারকে সুনির্দিষ্ট তারিখ বেঁধে দেন। নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতি পাওয়া না গেলে পরদিন থেকে অহিংস ‘সত্যাগ্রহ আন্দোলন’ শুরু করা হবে বলে ঘোষণা করা হল।

ইতিমধ্যে সংগ্রাম পরিষদ করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দি মহকুমায় ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করেন। প্রতিটি মহকুমায় মানুষের সঙ্গে বিশেষত গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন এবং মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার্থেই যে তাঁরা আন্দোলনের পথ বেছে নিয়েছেন— তা গ্রামবাসীকে বুঝিয়ে বলেন। এই পদযাত্রায় মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব সাড়া লক্ষ করা যায়। তাঁরা বাংলা ভাষার জন্য জান দিতেও প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিলেন। পথে পথে, গ্রামে গ্রামে সত্যাগ্রহীদের অভ্যর্থনা দান, কপালে চন্দন তিলক, শঙ্খ আর উলুধ্বনি পদযাত্রায় এক আলাদা মাত্রা যোগ করে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ‘পদযাত্রা’ কর্মসূচি এক ঐতিহাসিক দিকচিহ্নবাহী পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ১৯৬১ সালের ১৯মে কাছাড়ে শুরু হয় সত্যাগ্রহ তথা আইন অমান্য আন্দোলন। তিনটি মহকুমা করিমগঞ্জ, শিলচর এবং হাইলাকান্দিতে সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানুষের ঢল নামে। নারী, পুরুষ, শিশু-যুবা ভোর রাত থেকেই তাদের পথচলা শুরু করেন। সকলেই জানেন তাদের গন্তব্য।

আসাম সরকার শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচি বানচালে সম্ভাব্য সকল পথই বেছে নেন। পুলিশ, আধা সামরিক এবং সামরিক বাহিনী দিয়ে কাছাড় ছেয়ে ফেলা হল। গোয়েন্দা তৎপরতা ছিল অভাবনীয়। ১৮ মে রাতের মধ্যেই সংগ্রাম পরিষদের বহু সংখ্যক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সমগ্র জেলাতে পরিলক্ষিত হয় যুদ্ধকালীন তৎপরতা। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছিল অহিংস, শান্তিপূর্ণ। ভাষার দাবি কোনো বিদ্রোহ ছিল না, বিপ্লবও নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলন। কিন্তু চালিহা সরকার কাছাড়ের নিরস্ত্র, নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ সাধারণ মানুষকে রুখতে যে অবস্থান নিলেন— তা ছিল হিংসাত্মক, একনায়কসুলভ স্বৈরাচার। সাধারণ মানুষের সত্যাগ্রহ আন্দোলন রুখতে ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এমন অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ কোনো সভ্যদেশ মেনে নিতে পারেন না। কিন্তু রাজ্য আসামে সব কিছুই সম্ভব।

১৯ মে ১৯৬১। চালিহা সরকারের সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত্র, নিরুপদ্রুব সত্যাগ্রহীদের ওপর বেপরোয়া গুলি চালাল। একে একে লুটিয়ে পড়লেন নারী, শিশু, যুবা। একজন নন, দু’জন নন, বাংলা ভাষাভাষী এগারো জন মানুষ প্রাণ হারালেন। আহত হলেন কয়েকশো। জেলবন্দি শ’য়ে শ’য়ে।

এই হত্যাযজ্ঞের পরও কাছাড়ের মানুষ শান্ত, ধীর-স্থির। কিন্তু বাংলা ভাষার দাবিতে থাকলেন অটল, অনড়। চারিদিকে ধিক্কার ধ্বনিত হল। প্রতিবাদ জানাল। নিহতদের অপরাধ কী? তারা কি বোমাবাজি করেছে? গুলি চালিয়েছে? খুনি? ডাকাত? না, তাঁরা মাতৃভাষা, মুখের বুলি বাংলা ভাষার সরকারি মর্যাদা চেয়েছিলেন। তার বদলে লাভ করলেন বুলেট, বেয়নেট।

চারিদিককার ধিক্কার আর প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় সরকার নড়েচড়ে বসলেন। কংগ্রেস হাইকম্যাণ্ডের নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভাষা সমস্যা মীমাংসায় আসাম পাড়ি দিলেন। দফায় দফায় বৈঠক, কাছাড় বনাম কেন্দ্রীয় সরকার। দীর্ঘদিন আসামে অবস্থান করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক সমাধান সূত্র আবিষ্কার করেন— যা ‘শাস্ত্রী-ফর্মুলা’ নামে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু সমাধান সূত্রের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং কাছাড়র মানুষকে তিনি তা মেনে নিতে বলেন। কিন্তু কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ এবং কংগ্রেস নেতৃত্ব এক যৌথ বৈঠকে আলোচনা শেষে শাস্ত্রী-ফর্মুলা প্রত্যাখ্যান করেন।

এদিকে কাছাড় নেতৃত্বের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জুন মাসে বিভিন্ন জেলে আটক কয়েকশো বন্দিকে মুক্তি দেন। এই বন্দি মুক্তির বিনিময়ে কাছাড়ে সাময়িকভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত রাখা হয়।

১৯ জুন সত্যাগ্রহীদের জীবনদানের একমাস পূর্ণ হয়। কাছাড়ের মানুষ যখন শহিদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মৃতি তর্পণে আত্মমগ্ন—ঠিক সেই দিনেই হাইলাকান্দিতে ঘটে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। বাংলা ভাষা সমর্থনকারী বাঙালি হিন্দু পরিবার বিশেষত উদবাস্তু কলোনিগুলো আক্রান্ত হয়। দুর্ভাগ্যবশত এই হামলায় অংশ নেয় মুসলিম সম্প্রদায়ের এক বড়ো অংশ। পুলিশের গুলিতে প্রাণও দিতে হল তাদের অনেককে। অথচ অসমিয়া ভাষার পক্ষে, মুখ্যমন্ত্রী চালিহার পক্ষ নিয়েই তারা হামলায় নেমেছিল। যাঁরা তাদের ব্যবহার করলেন, কাজে লাগালেন, তাঁরা তো সমাজ ও রাষ্ট্রে বহাল তবিয়তে, ‘বড়ো মানুষ’ হয়েই থেকে গেলেন। কোনো আঁচ-ই তাঁদের গায়ে লাগেনি।

হামলার খবরাখবর কিছুদিন পূর্ব থেকেই পাওয়া যাচ্ছিলো। গণসংগ্রাম পরিষদ এবং কাছাড় কংগ্রেস নেতৃত্ব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা প্রকাশ করে আসাম সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষত প্রধানমন্ত্রী শ্রী নেহরু এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা যে কোনো পদক্ষেপ নেননি— তা হাইলাকান্দির ঘটনা প্রমাণ দিল।

কিন্তু কেন এই দাঙ্গা? এ সময় তো আন্দোলন স্থগিত ছিল। বন্দিরা মুক্তিলাভ করেছেন, সমগ্র কাছাড় ছিল শান্ত। শহীদ স্মৃতি-তর্পণ অনুষ্ঠান আয়োজনে সবাই ছিলেন ব্যস্ত। এ সময় কাছাড়ের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী, কতিপয় রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ প্রধান এবং কয়েকজন আমলার সন্দেহজনক গতিবিধি জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাঁদের মতে এই হামলা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত, ভাষা আন্দোলন স্তব্ধ করতেই এই আয়োজন।

বাঙালি জনগোষ্ঠী বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় কোনোভাবেই যাতে আসামে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, ভাষা আন্দোলনে যেতে সাহসী না হয়— সেজন্যেই এই পদক্ষেপ বলে আমাদের মনে হয়েছে। আমাদের এ কথাও মনে হয়েছে যে, আন্দোলনরত পক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়ার প্রচেষ্টাও ছিল এই হামলায়—যাতে ধারাবাহিকভাবে এই আন্দোলন আর অব্যাহত রাখতে না পারে।

হাইলাকান্দি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভাষা বিতর্ক সমাধানে নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নেন। তিনি কাছাড় কংগ্রেস এবং গণসংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বকে আলোচনায় বসার জন্য দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান। প্রথমবারের মতো সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বকে ভাষা বিতর্ক সমাধানে আলোচনার আহ্বান জানান। কাছাড়ের উভয় নেতৃত্বের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ২ ও ৩ জুলাই দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হন। এমনকী আলোচনা গভীর রাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। শেষপর্যন্ত উভয়পক্ষ সমঝোতায় আসেন।

আলোচনার নিট ফল কাছাড়ে সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। কাছাড় থেকে রাজ্য হেডকোয়ার্টারে বাংলায় চিঠিপত্র পাঠানো, বিল, গেজেট, বিভিন্ন নোটিশ ইংরেজি, অসমিয়া ছাড়া বাংলাতেও প্রকাশ করা হবে।

সংখ্যালঘুদের রক্ষাকবচ হিসেবে ১৯৫৬ সালের ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের মেমোরেণ্ডামের উল্লেখ করা হয়— যেখানে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষার মাধ্যমে দেওয়া হবে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও এই নীতি অনুসৃত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের অঙ্গীকার ছিল সমগ্র আসামে বাংলাকে অন্যতম সরকারি ভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু এ দাবি মানা হয়নি। তারপরও আইন অমান্য বা সত্যাগ্রহ আন্দোলন স্থগিত রাখা হয় কার্যত অনির্দিষ্টকালের জন্য। তবে কাছাড় নেতৃত্ব কেন্দ্রকে জানিয়ে দেন ১৯৫৬ সালের মেমোরেণ্ডাম যদি যথাযথভাবে মেনে চলা না হয়, তাহলে তাঁরা পুনরায় আন্দোলনে যাবেন। আসামে কাছাড়বাসীকে খন্ডিত দাবি মেনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এর বেশি কিছু পাওয়া যায়নি, আজও না।

কাছাড়ের এই গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল, একবাক্যে সবাই তা স্বীকার করেছেন। গ্রামে গ্রামে, নগরে-বন্দরে, পথে-প্রান্তরে কেবলই মানুষের ঢল। সাত থেকে সত্তর সবাই পথে নেমেছিলেন বাংলা ভাষার জন্য।

নারীর অংশগ্রহণ ছিল অভাবনীয়, গৃহিণীরাও পথে নেমেছিলেন। স্কুল-কলেজের ছাত্রীরা ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন। লাঞ্ছনার শিকার হন অগুনতি নারী। জেলবন্দি ছিলেন বহু নারী। গুরুতর আহত নারী হাসপাতালে ছিলেন। উল্লেখযোগ্য—তাঁরা ভাষার জন্য প্রাণ দিলেন, ইতিহাস সৃষ্টি করলেন এই কাছাড়ের গেঁয়ো মেয়েরাই।

ছাত্রছাত্রীরা ছিলেন এই আন্দোলনের প্রাণশক্তি। দিনরাত এক করেছিলেন এঁরা। নির্যাতন ভোগ করেছেন, জেল খেটেছেন, অর্ধাহারে থেকেছেন, নিদ্রাহীন রাত কাটিয়েছেন।

আন্দোলনে অতিসাধারণ নরনারী, খেটে-খাওয়া মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা না জেনে না বুঝে আসেননি, বাংলা ভাষার জন্যেই তাঁরা ছুটে এসেছিলেন। প্রাণও দিলেন তাঁরা। শহিদ এগারো জনই সাধারণ ঘরের মানুষ। আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণময়। অতিচড়া মূল্য দিলেন তাঁরা।

কিন্তু তারপরও বাংলা ভাষার স্বীকৃতি আংশিক, পূর্ণাঙ্গ নয় কেন? বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন অনেকেই। আমাদের বিবেচনায় কাছাড় কংগ্রেস দলীয় সদস্যদের মধ্যেই ছিল মতভেদ। এই মতভেদ প্রকাশ্যে আসে ১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি কাছাড় কংগ্রেসকর্মী সম্মেলনে। রণেন্দ্রমোহন দাস প্রকাশ্য সভায় তা স্বীকারও করেন। আসাম বিধানসভাতেও এই বিভাজন স্পষ্ট হয়। ফলে, তাঁরা বাংলা ভাষার কথা মুখে বললেও অন্তরের যোগে যে খামতি ছিল— তা অনেকেই স্বীকার করেছেন।

কাছাড়ের কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ছাড়া কার্যত আসামের কোনো রাজনৈতিক দলই বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়াননি। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, প্রজা সমাজতন্ত্রী দল, আর সি পি আই— কোনো দলই বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেননি, কথা বলেননি। বস্তুত তাঁরা বিরোধী অবস্থানই নিয়েছিলেন।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তথা পুলিশ প্রশাসনের একটি বড়ো অংশ ছিল বাঙালি, বাংলা ভাষা বিরোধী। এই শক্তি বরাবরই অসমিয়া ভাষাভাষীদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন, ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশও বাঙালি, বাংলা ভাষা বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন— যা বারবার প্রত্যক্ষ করা গেছে এই সময়কালে।

‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ কোনো রাজনৈতিক দল ছিল না। বিভিন্ন দল, শ্রেণি-পেশার মানুষের মিশেলে গঠিত গণসংগ্রাম পরিষদ ছিল সাধারণ মানুষের ‘প্ল্যাটফরম’— যাঁদের ‘কমিটমেন্ট’ ছিল বাংলা ভাষার প্রতি। একটি নিয়মিত রাজনৈতিক দলে যে শৃঙ্খলা, নিয়মনীতি, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বদান বর্তমান— সেই অভিজ্ঞতা, শৃঙ্খলা এবং দলীয় বিধির ঘাটতি চোখে পড়েছে সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বের মধ্যে। এই সংগঠনের বড়ো শক্তি ছিল সাধারণ মানুষ, তাঁরা এগিয়েও এসেছিলেন—কিন্তু সুনির্দিষ্ট পথে তাঁদের যথাসময়ে চালিত করা যায়নি।

পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বাঙালিদের প্রতি হাত বাড়িয়েই ছিলেন, কিন্তু সেই হাত শক্ত করে ধরার মতো নেতার অভাব ছিল বলে মনে হয়েছে। আসামের সব বাঙালিকেও এক ছাতার নীচে আনা সম্ভব হয়নি। সমন্বয়ের অভাবও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তারপরও প্রদেশ ও কেন্দ্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, দুষ্কৃতকারীসহ অসংখ্য শক্তির চাপ মাথায় নিয়েই তাঁরা আন্দোলন পরিচালনা করেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে ওঠা গণসংগ্রাম পরিষদ লড়াই অব্যাহত রাখার কারণেই পাকা ফসল পুরোপুরি না হলেও অংশত হলেও ঘরে তোলা সম্ভব হয়েছে।

১৯৪৭-১৯৬১ কাল পরিসরে আসামে বাঙালি এবং বাংলা ভাষা আক্রান্ত হয়েছে বারংবার। নারকীয় তান্ডব চলেছে নর-নারীর ওপর। সীমাহীন দুর্ভোগে দিন কেটেছে তাদের। আগামী দিনেও যে এ আঁধার কেটে যাবে, এমনটা ভাবা ঠিক হবে না।

কারণ বিগত পঞ্চাশ বছরে ভাষা ও জাতিগত লড়াই আমরা ধারাবাহিকভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। সম্প্রতি অসমিয়া জাতীয়তাবাদ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বড়ো জাতিসত্তা ও অন্যান্য খন্ড জাতিও তাঁদের দাবি নিয়ে সামনে এসেছেন। কেবল দাবি নয়— অস্ত্র হাতে লড়াইয়েও নেমে পড়েছেন। কোকড়াঝাড় সহ বেশ কয়েকটি স্থানে রক্তও ঝরেছে। আমরা জানি, মুসলিম সম্প্রদায় প্রাক-সাতচল্লিশ কাল থেকেই একতাবদ্ধ ছিলেন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ও বেশ শক্তপোক্ত অবস্থানে এসেছেন। কারণ ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক দুটি নির্দেশ জারি করে। জোড়া ফরমান অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে বা তার আতঙ্কে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু শ্রেণির যাঁরা পালিয়ে এসে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং বসবাস করছেন, তাঁদের তাড়ানো হবে না। … ২০১৪ সাল পর্যন্ত এসেছেন এমন অ-মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ভারতে থাকার জন্য একটি রক্ষাকবচ দেওয়া হল। এর ফলে এই প্রথম দেশের সরকার অনুপ্রবেশকারীদের ভারতবাসের স্থায়িত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে ধর্মীয় পরিচিতিকে নির্ণায়ক হিসেবে ধরে নিল। তারপরেও কি আমরা স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় বলতে পারব, ‘‘বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাব গ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি?’’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *