উনিশশো বাহাত্তুর সালের মাঝামাঝি দিকে আলি কেনান নিমবাগান মাজারে আবার ফিরে আসে। যুদ্ধের এই ন মাস কোথায় ছিলো, কি অবস্থায় ছিলো কেউ তা জানেনা। ভীষণ কৃশ হয়ে গেছে আলি কেনান। শরীরের মেদ একবিন্দুও নেই। তাকে চকচকে কষ্টি পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। নিকষ কালো রঙ যেনো শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়। চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল। চুল দীর্ঘ হয়ে জটার মতো হয়েছে। গায়ের রঙিন লুঙ্গি আলখেল্লা নেই। একটি সাদা লুঙ্গি এবং চাদর তার পরনে।
নিমবাগান এলাকার মানুষ আলি কেনানকে বীরের সম্মান দিয়েই গ্রহণ করলো। এই এলাকার মানুষের আলি কেনানের প্রতি বাড়তি এ অনুরাগ, তার কারণ আছে। আলি কেনান জয় বাংলার দরবেশ। তার অবর্তমানে এ মাজার পুরোনো খাদেম দখল করেছিলো। এলাকার লোকদের প্রতি খাদেমের একটা তীব্র বিদ্বেষ ছিলো। কেননা তারা আলি কেনানকে নানা ব্যাপারে সাহায্য করেছে। সে জন্য খাদেম সব সময় মুহম্মদপুর থেকে বিহারীদের ডেকে আনতো। এলাকাবাসীদের ভীতি প্রদর্শন করাত। রাজাকারদের আনাগোনা ছিলো নিয়মিত। নিমবাগানের মানুষ সব সময় সন্ত্রস্ত অবস্থায় থাকতো কখন খাদেম কি বিপদ ঘটায়। নিমবাগানের একজন প্রবীণ বললেন,
আমাদের বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরা আইলেন, বাবাও মাজারে আইলেন। আলি কেনান মনে করলো এই তুলনা একান্তই যুক্তিসঙ্গত। তারপর থেকে আলি কেনানের চিন্তা ভাবনা সম্পূর্ণ নতুন একটি খাতে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করলো। কাউকে বলবার সাহস তার নেই। মর্মের গভীরে ধরে নিয়েছে শেখ মুজিব জয় বাংলার নেতা এবং সে নিজে জয়বাংলার দরবেশ। এতোকাল বাবা বু আলি কলন্দর এর সঙ্গে যে কাল্পনিক সম্পর্ক সে প্রতিষ্ঠা করেছিলো এই সম্পর্ক তার চাইতে অনেক জোরালো। কেননা এর বাস্তব ভিত্তি আছে। শেখ সাহেব যেমন সব ব্যাপারে হুকুম দিচ্ছেন, তেমনি হুকুম দেয়ার অধিকার তারও আছে।
আলি কেনানের সঙ্গে পূর্বের লোকজন নেই। যা কিছু অর্জন করেছিলো, সব হাওয়া হয়ে উড়ে গেছে। পরোয়া করে না আলি কেনান। মানুষের জীবনে এরকম তো কতোই ঘটে। কেউ না থাকুক না থাকুক আলি কেনানের অদম্য মনোবল আছে। দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত করে সে দেখতে পায় সামনের সময়টা তারই। এই সময়কেই সে চাষ করবে? সময়ের গর্ভে সৌভাগ্য তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। তখনকার সময়টা ছিলো ভীষণ টালমাটাল। দশ কোটি মানুষের একটা দেশের তাবত মানুষের সামাজিক বন্ধন আলগা হয়ে পড়েছে। সমাজের তলা থেকে প্রচণ্ড একটা গতিশীলতা জাগ্রত হয়ে গোটা সামাজিক কাঠামোকেই কাঁপিয়ে তুলেছে। পুরোনো যা কিছু ছিলো ভেঙে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এ এমন একটা পরিস্থিতি উচ্চ চিৎকার করে না বললে কেউ কারো কথা পর্যন্ত কানে তোলে না। আলি কেনান এলাকার ছেলেদের সহায়তায় খুব সহজে একটা মাইক্রোফোন যন্ত্র যোগার করে ফেললো। এক শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঘোষণা করে, এই বাংলাদেশে আমি আর শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাঘের বাইচ্চ্যা নাই। শেখ সাহেবের কতা যেমন হগলে হুনছে, হেইরকম আমার কতাও হুনুন লাগবো। অনেক লোক জুটেছিলো, কেউ আলি কেনানের কথার বিরোধিতা করলো না।
আলি কেনানের সাহস বাড়তে থাকে দিনে দিনে। প্রতিদিন সে মাজারের সামনের চত্বরটিতে মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। চীকার করে, অশ্লীল গালাগাল দেয়, কখনো খেলনা পিস্তল দিয়ে লোকজনকে ভয় দেখানোর ভঙ্গি করে। সব দিক দিয়ে সে যেনো সময়ের উপযুক্ত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সমাজ শরীরের ভেতর যতগুলো ধারা উপধারা ক্রিয়াশীল, তার সবগুলোই যেনো জীবন লাভ করে আলি কেনানের মধ্যে ঝর্ণার বেগে ফেটে পড়তে চাইছে। আশ্চর্য, মানুষও তার এই ভূমিকাটি মেনে গিয়েছে। সকলে মনে করছে, এটিই স্বাভাবিক এবং এ হওয়াই উচিত ছিলো।
আলি কেনান অসাধ্য সাধন করতে পারে, তার চরণস্পর্শে দুরারোগ্য বাতব্যাধি সেরে যায়। মুখের ফুঁ দেয়া পানি খেলে শুলবেদনার উপশম হয়, বন্ধ্যা রমনী গর্ভবতী হয়–এমনি কতো ধরনের আজগুবি গুজব তার নামে ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ তার কাছে আসে। যখন খুশি সে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার ঝাড়ে, গান গায়, যখন খুশি নাচে। এই যুদ্ধে যে ঝোড়োশক্তি বাংলাদেশের অন্তর থেকে মুক্তি লাভ করে সর্বত্র একটা তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি করেছে সেই গন্তব্যহীন অন্ধ আদিম শক্তির সবটাই যেনো তার শরীরে ভর করেছে। যখন সে নাচে তার চোখ দুটো লাল আরো লাল হয়ে জ্বলতে থাকে। দীর্ঘল চুলের জটারা জ্যৈষ্ঠ মাসের ঝড়ের পূর্বাভাস রচনা করে। শরীরের বাঁকে বাঁকে আদিম ছন্দ মূর্তিমান হয়ে ওঠে। যে দেখে চোখ ফেরাতে পারে না, সম্মোহিত হয়ে যায়।
আলি কেনান জানে না তার এই উন্মত্ততার মধ্যেও একটা নিখুঁত সাংসারিক হিসেব নিকেশ আপনা থেকে ক্রিয়া করে যাচ্ছিলো। তাকে মানুষ দরাজ হাতে টাকা দেয়। লোকজন তাকে চার পাশে থেকে সব সময় ঘিরে রাখে। মাঝখানে একটি গোলাকার বেষ্টনীর মধ্যে সে নাচে, গান গায়। সেখানে টাকা পয়সার স্তূপ জমে যায়। দশ টাকা, বিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা একশো টাকার নোট। কিছু মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে টাকা কুড়িয়ে নেয়। হিসেব করে কতো টাকা হলো। তারপর বান্ডিল বেঁধে আলি কেনানের ডেরায় পৌঁছে দেয়। আলি কেনান একেকটি বাভিল খুলে হাতের মুঠোতে যা ওঠে লোকদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। বাকি টাকা তোষকের তলায় ফেলে রাখে। এভাবে টাকার বান্ডিল জমতে জমতে তোষকটা ওপর দিকে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে। আলি কেনানকে কিছুই ভাবতে হয় না। তার চারপাশে আপনা থেকেই একদল ভক্ত জুটে গেছে। তারমধ্যে মেয়ে মানুষও আছে। তারা বাবার কাপড় কাঁচে, তামুক বানায়- মানে গাঁজার কল্কি সাজিয়ে দেয়। রান্না বান্না করে, গা টিপে। তাছাড়া বাবার আরো কতোরকম খেয়াল টেয়াল আছে। পুরুষ ভক্তদের কাজ একটু ভিন্নরকমের। তারা দর্শনার্থীদের সামলায়। সবাই যাতে বাবার কাছে আসতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি রাখে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এলে বাবার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা করে। টাকা পয়সার হিসেব রাখে। এমনকি কেউ কেউ গাঁজা চরশ এসব নেশার ব্যবসারও তদারকি করে।
এই সময়ের মধ্যে আলি কেনান আস্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেলো। জাতীয় সংবাদপত্রসমূহে অনেকগুলো সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। তাতে আলি কেনানের বিষয়ে অনেকগুলো খারাপ কথাও প্রকাশিত হওয়ায় শিষ্যেরা ঠিক করলো, এরপর থেকে তারাই সাংবাদিকদের সমস্ত খবরাখবর সবরাহ করবে, যাতে বাবার নামে এ ধরনের অপ্রচার না ঘটতে পারে। ব্রিটিশ টেলিভিশনের কোনো একটা চ্যানেল আলি কেনানের ওপর একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম প্রদর্শন করে। সেই ফিল্মের শিরোনাম ছিলো এ ডারবিশ হু হ্যাজ ওয়ান্ডারফুল সিক্রেট হিলিং পাওয়ার। এই সংবাদ যে দিন প্রচার পেলো, আলি কেনানের গলার জড়ির মালাটি চল্লিশ হাজার টাকা মূল্যে নিলাম হয়ে গেলো।
ভদ্রলোকের সন্তানেরা আলি কেনানের নামে পাগল হয়ে উঠলো। তারা দলে দলে তার চারপাশে ভীড় জমাতে আরম্ভ করে। আলি কেনান একটা মুক্ত দুনিয়া সৃষ্টি করে নিয়েছিলো। এখানে মদ চলে, গাঁজা চলে। শিল্পী আসে, কবি আসে, সাংবাদিক আসে। সকলেই আলি কেনানকে প্রেরণার একটা গভীর উৎস হিসেবে ধরে নিয়েছে। গুজব রটেছে, ভদ্রঘরের মেয়েরাও আলি কেনানের ওখানে গিয়ে গাঁজা টানে।
শহরের এসপি আলি কেনানের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছিলেন। তিনি সেকেলে ধরনের মানুষ। তাই তাঁর আশঙ্কা হওয়া খুবই স্বাভাবিক, এভাবে চললে সমাজ উচ্ছন্নে যাবে। সবদিক বিবেচনা করে তিনি আলি কেনানকে এক বিকেলে এ্যারেস্ট করে হাজতে চালান করে দিলেন। তারপর শুরু হলো হৈ হৈ ব্যাপার, রৈ রৈ কাণ্ড। হোমরা চোমরা ব্যক্তিরা তার অফিসে টেলিফোন করতে থাকেন। নিমবাগান থেকে মাঝারি ধরনের একটা মিছিল বের হলো। মিছিলকারীরা হোম মিনিস্টারের বাড়ির সামনে বসে থাকে। বাধ্য হয়ে হোম মিনিস্টারকে মিছিলকারীদের সঙ্গে দেখা করতে হয়। তিনি আশ্বাস দেন যে আজই দরবেশকে ছেড়ে দেবেন এবং অনতিবিলম্বে এসপির বদলির অর্ডার ইস্যু করবেন। একদিন পর জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসে আলি কেনান। ভক্তবৃন্দের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে,
তরা মনে রাহিস, আলি কেনান শেখ মুজিব ছাড়া আর কুনু বাপের বেটারে পরোয়া করে না। হে আমারে বুঝে, আমি হেরে বুঝি। হে সমাজতন্ত্রের তরিকার দরবেশ, আর আমি কলন্দরী তরিকার দরবেশ। এভাবে আলি কেনানের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করে কোত্থেকে একটা উৎপাত এসে তার মধ্যে একটা অন্যরকম অস্থিরতার সৃষ্টি করে। এক বিলেত ফেরত মহিলা একদিন সন্ধ্যেবেলা আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন,
বাবা আমাকে একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমি ভীষণ বিপদে আছি। আলি কেনান তাকিয়ে দেখলো, মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী। গায়ে দুধে আলতার রং। চুল কোমর অবধি নেমে এসেছে। চোখ দুটো অসম্ভবরকম কালো এবং ভাসা ভাসা। বয়স পঁয়ত্রিশ টয়ত্রিশ হবে। তখনই আলি কেনানের মনে হলো, তার পরনে একটা নেংটি জাতীয় পোষাক ছাড়া আর কিছু নেই। মহিলার দিকে তাকিয়ে এই প্রথম অনুভব করলো, সে অর্ধ উলঙ্গ। সামনে এমন সুন্দরী এক নারী- যার কণ্ঠস্বর এমন কোমল, দৃষ্টি এতো গভীর, এরকম একটি নারীর জন্য সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে সে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত ছুটে যেতে পারে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলার পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়বে। তার ইচ্ছে হয়েছিলো মহিলাকে বলবে,
আমি চুলের জটা কেটে ফেলবো। শহরের সবচেয়ে ভালো দোকান থেকে সবচেয়ে সুন্দর দামী জামা কাপড় কিনবো। আমার অঢেল টাকা আছে। আমি তোমার সঙ্গে পৃথিবীর অপর প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে যাবো, দয়া করে তুমি আমাকে গ্রহণ করো। কিন্তু আলি কেনানকে বাস্তবে বলতে হলো,
বেটি কুনু চিন্তা করবি না, তর উপর বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। সব দুঃখ বিপদ আপদ কাইট্যা যাইবো। মহিলা একান্ত ভরসার চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমার বিপদ আপদ কেটে যাবে?
আলি কেনান বললো, হ্যাঁ, বেটি সব কাইট্যা যাইবো।
বাবা আপনার এখানে মাঝেমাঝে এলে আপনি রাগ করবেন?
বেটি তুই আমার মাইয়া, যহন মন লয়, আইবি। মহিলা পা ছুঁয়ে আলি কেনানকে সালাম করে চলে গেলেন।
সেদিন আলি কেনান তার শিষ্য সাগরেদদের অশ্লীল অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করে,
শালা খানকির পুত, ভ্যাদামার বাইচ্চারা, আমারে নেংটি পিন্দাইয়া মজা লুটবার লাগছস। চোতমাড়ানীর পুতেরা। আমি তগোরে মজা দেখামু। সকলে তার কণ্ঠের অমৃত বর্ষণ শুনে কেমন জানি ভ্যাকাচ্যাকা খেয়ে যায়। আলি কেনানের কথার পিঠে কথা বলার কারো সাহস হলো না। শেষ পর্যন্ত তার ইচ্ছানুসারে দোকান থেকে এক জোড়া দামী পাঞ্জাবি কিনে আনা হলো। সে নিজের ঘরে গিয়েই পায়জামা পাঞ্জাবী পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুলের জটা ধরে টানাটানি করে আর গালাগাল দিতে থাকে : আমার মাথায় জটা ক্যান? খানকির পোলারা। নাপিত ডাইক্যা আন, কাইট্যা ফেলা। সিনেমার হিরোগো মতন কইরা চুল ছাইট্যা দে। সে রাতে তার সেবা করার জন্য দুটি মেয়ে গিয়েছিলো। তাদের পাছায় লাথি মেরে সে বের করে দিলো। অন্ন জল কিছুই স্পর্শ পর্যন্ত করলো না। কেবল আপন মনে আউড়াতে থাকলো, আহা কি খুবসুরত, কি দেইখলাম? গঙ্গা যমুনার পাড়ে খাড়াইয়া য্যান, দেখলাম সুরুজ অস্ত যাইতেছে। দেখলাম আন্দার রাইতে জঙ্গলের মাঝখান দিয়া চান উঠবার লাগছে। আহা কি দেইখলাম। কি খুব সুরত!
আলি কেনানের বায়না ছিলো সে সিনেমার হিরোর মতো চুল কাটাবে। শহরের সেরা দোকানের সবচেয়ে দামী পোষাক পরে মহিলার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। তারপর তার হাত ধরে পৃথিবীর অপর প্রান্তে ছুটে যাবে। কিন্তু পরের দিনেও তাকে সেই পুরোনো পোষাকে গিয়ে মাইকের সামনে দাঁড়াতে হলো। নাচতে হলো, গান করতে হলো। অসহ্য, অসহ্য লাগে আলি কেনানের। যদি পারতো তার জীবনের এই বাইরের খোলসটাকে ভেঙে চুরমার করে ফেলতো। কিন্তু পারে না। সে কম্বল ছাড়তে চায়, কিন্তু কম্বল তাকে ছাড়ে না। আসলে কম্বল নয় ওটা ভালুক। আলি কেনানের নানারকম ইচ্ছে জাগে। কখনো মনে করে সে এই মহিলাকে সবলে দুহাতে তুলে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় ছুটে যাবে। কখনো ভাবে তাঁর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মিনতি জানাবে। যে ভক্তি যে আবেগে সে বাবা বু আলি কলন্দরকে দিতে পারেনি সব মহিলাকে উজাড় করে দেবে। কিন্তু প্রতিদিন বাস্তবে ঘটে তার উল্টো।
মহিলাটি মাঝে মাঝে তার কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। প্রাণগলানো স্বরে বাবা বলে সম্বোধন করেন। বর্তমানে মহিলার একটি মানস সংকটকাল চলছে। তিনি অনেকদিন বিলেতে ছিলেন। দেশে ফিরে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সমাজের মক্ষীরাণী হয়ে বসেছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে সিগারেট খেতেন, ড্রিংক করতেন। তার অনেক ভক্ত, অনেক অনুরাগী জুটে গিয়েছিলো। তারা নিজেদের মধ্যে তার ব্যাপার নিয়ে এত ঝগড়া বিবাদ, এত হানাহানি করেছে যে খুব অল্প দিনের মধ্যেই তার পরিচিতি দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় চিত্রাভিনেত্রীর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলো। তাছাড়া মহিলার মাথায় ছিট ছিলো। আজকে যার সঙ্গে হেসে কথা বলতেন, কাল তার গালে চড় বসিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা অনুভব করতেন না।
হুঁশিয়ার মানুষেরা মহিলাকে প্লেগের মতো ভয় করতে লাগলেন। প্রেমের জাগ্রত দেবী মনে করে একদল পেছনে ছুটতে থাকলো। মহিলারা গার্হস্থ্য শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য তার মুখের ওপর বাড়ির দরোজা বন্ধ করে দিতে আরম্ভ করলেন। আত্মীয় স্বজনেরা এতো দূর বিগড়ে গিয়েছিলো যে পারলে খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে তাকে খুন করতো। ঢাকা শহর বড় শহর নয়। এখানে সকলে সকলের হাঁড়ির খবর খুব সহজে জেনে যায়। মোটামুটি পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিলো যে এই সম্প্রসারণশীল শহরটি তার ওজন বইতে পারছিলো না। এই রকমের একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে মহিলা আলি কেনানের কাছে আসতে শুরু করেন।
এখনো মহিলা আলি কেনানের কাছে আসেন। পা ছুঁয়ে সালাম করেন। তার খাস দিলের দোয়া প্রার্থনা করেন। মহিলা যেদিন আসেন আলি কেনানের অস্থিরতা ভয়ঙ্কর বেড়ে যায়। তাকে সামলাতে শিষ্যদের হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। মেয়ে সেবিকাদের পদাঘাত সহ্য করতে হয়। এক নাগাড়ে এই অবস্থা চার পাঁচ দিন ধরে চলতে থাকে। সে জন্য মহিলা এলেই তার শিষ্যকুল সচকিত হয়ে ওঠে। যদি ক্ষমতা থাকতো, আলি কেনানের সঙ্গে তাকে দেখা করতে দিতো না। বিলেত ফেরত অনিন্দ্য সুন্দরী মহিলা যাকে দেখলে পুরুষ ঘোড়া পর্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তাঁকে ঠেকানোর ক্ষমতা আলি কেনানের শিষ্যদের কি করে হবে?
এই সময়ে মহিলার সঙ্গে এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের পরিচয় হয়। এই ভদ্রলোকেরও দিনকাল তখন ভালো যাচ্ছিলো না। তাকে ছেড়ে তার স্ত্রী আর একজনের সঙ্গে আমেরিকা পালিয়েছে। তারা একজনে অন্যজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে কিঞ্চিত মানসিক সান্ত্বনা লাভ করে। যথাসম্ভব গোটা শহরের সহানুভূতিহীন দৃষ্টি এড়িয়ে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতো, সিনেমায় যেতো। কিংবা ছুটির দিনে দূরে কোথাও চলে যেতো। এভাবে তারা পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
একদিন মহিলা ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আলি কেনানের কাছে আসেন। আলি কেনানের পা ছুঁয়ে সালাম করে ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললেন,
বাবা ইনি আমার বন্ধু। আপনি আমাদের খাস দিলে দোয়া করবেন। আলি কেনানের ভদ্রলোককে খুন করার ইচ্ছে জেগেছিলো। কিন্তু উপস্থিত লোকজনের সামনে তাকে বলতে হলো,
বেটি তোগো উপরে বাবা বু আলি কলন্দরের দোয়া আছে। কুনু চিন্তা নাই। সব ঠিক অইয়া যাইবো। সেদিন ঘরে ফিরে আলি কেনান চীৎকার করে বলতে লাগলো,
শালা খানকির বাচ্চা, খেয়াল রাখিস তুই কার জিনিষের উপর নজর দিছস। খুন কইরা ফেলামু। কইলজা টাইন্যা ছিড়া ফেলামু। শরীলের লউ খাইয়া ফেলামু। আজরাইল অইয়া জান কবজ কইরা ফেলামু। অক্ষম আক্রোশে সে রাতভোর হাত পা ছুঁড়ে। খাটের উপর পদাঘাত করে যায় ক্রমাগত।
মহিলা তার ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুটি নিয়ে ক্রমাগত আসে। আলি কেনানকে সালাম করে। ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কানে কানে নিজেরা আলাপ করে। আলি কেনানকে এ দৃশ্য দেখতে হয়। দেখে নীরবে হজম করতে হয়। সন্ধ্যের পর ডেরায় যখন ফেরে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো অন্ধ আক্রোশে ফেটে পড়তে থাকে। যতো রাত অধিক হয়, রাগের মাত্রাও বাড়তে থাকে। তার উন্মুক্ত প্রলাপে শিষ্যদের কারো ঘুমোবার উপায় থাকে না। সে বলতে থাকে :
শালা পাটকাঠির মতন তর শরীল। তুই হেরে সামলাইতে পারবি না। তর চোখ দুইড্যা ট্যারা। কয় পয়সা তর আছে। তুই হেরে ছাইড়া দে। হে আমার। হেরে আমি রাণী বানামু। হের লগে আমি দ্যাশ ছাইড়া চইলা যামু। আর যদি তর লগে দেখি লাশ পইর্যা থাকবো- কইয়া রাখলাম।
ধীরে ধীরে আলি কেনানের সবকিছুর প্রতি আগ্রহ কমে আসতে শুরু করে। রাতের নিভৃত প্রলাপগুলো দিনের বেলাও বলা অভ্যাসে হয়ে দাঁড়ায়। মানুষ জনের প্রতি আর কোনো আকর্ষণ বোধ করে না। একেকটা দিন চলে যায়, সে নিজেকে ফাঁদে পড়া পশুর মতো মনে করতে থাকে। যদি পারতো ধারালো ছুরি দিয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করে ওই মহিলার পেছন পেছন ছুটে যেতো। তাকে আলিঙ্গন করে বলতো।
তোমাকে ছাড়া চলবে না, তুমি আমাকে নাও, আমাকে গ্রহণ করো। গ্রহণ করো এই উন্মত্ততা, এই বেদনা, এই দুঃখ, এই অস্থিরতা। মহিলা রাজী না হলে বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করতো, তারপর নিজে আত্মহত্যা করতো।
মাসখানেক সময়ের মধ্যে সেই মহিলা ও ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোকের সম্পর্ক অনেক নিবিড় হয়ে এসেছে। তারা স্থির করলো বিয়ে করবে। মহিলা বিলেত ফেরত হলে কি হবে মনে কুসংস্কারের অন্ত নেই। তিনি মনে করলেন বাবার দোয়াতেই তিনি এত তাড়াতাড়ি একটা স্বামী জুটিয়ে নিতে পারলেন। বাবার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা অনেক গুণে বেড়ে গেলো।
তাঁর হবু স্বামীকে সঙ্গে করে এক সন্ধ্যো বেলা আলি কেনানের আস্তানায় এসে পদধুলি নিলো এবং হবু স্বামীটিকেও পদধূলি নিতে বাধ্য করলো। যা আলি কেনানের কর্ণে অমৃত বর্ষণ করে, সেই প্রাণ গলানো কণ্ঠস্বরে আলি কেনানকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন :
বাবা একটু খাস দিলে দোয়া করবেন। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। হাতে বিশেষ সময় নেই। তবু আপনার অনুমতি এবং দোয়া চাইতে এসেছি।
আলি কেনানের মনে হয়েছিলো, দুনিয়া দুটুকরো হয়ে গেছে, সূর্য নিভে গেছে। কে যেনো তার বুকে তীক্ষ্ণধার ছুরি আমুল বিধিয়ে দিয়েছে। তবু তাকে বলতে হলো,
বেটি তর উপর বু আলি কলন্দর বাবার দোয়া আছে। সব ঠিক অইয়া যাইবো।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে আলি কেনান কোত্থেকে একটা রামদা খুঁজে বের করে। একটি পাথরের ওপর অনেকক্ষণ ধরে শান দিতে লাগলো। শিষ্যদের কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস করলো না। যদি একটা কোপ দিয়ে বসে। তারপর রামদাটি দুহাতে ঊর্ধ্বে তুলে চিৎকার করতে থাকলো : শালা, অহনও সময় আছে, তুই হেরে ছাইরা দে । হে আমার জিনিস। তুই অরে ছুঁইলে এই রামদা দিয়া তরে কুচিকুচি কইর্যা কাইট্যা গাঙ্গে ভাসাইয়া দিমু। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ডানে বামে রামদাটি ঘঘারাতে থাকে। তারপর এক সময় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরে ঢুকে।
ঘরে ঢুকে সে তোষকটা উল্টায়। তোষকের নিচে ভাঁজে ভাঁজে রাখা টাকার তোড়া। অনেক টাকা, অনেকগুলো বান্ডিল। সব একসঙ্গে জড়ো করে আবার চিৎকার আরম্ভ করে, আমার ভেস্তের হুর, আমার আসমানের চান, আমার হইলদ্যা পাখি। তুই আমার কাছে আয়। এই ট্যাহা বেবাক তর। অনেক ট্যাহা। শেখ মুজিবের ব্যাংকেও অত ট্যাহা নাই। সব তর লাইগ্যা। সব তর লাইগ্যা তুই আয়, গতরের চামড়া দিয়া তর জুতা বানাইয়া দিমু। শরীরের লউ দিয়া তর পায়ে আলতা কইরা দিমু। তুই আয়, তুই আয়। তরে ছাড়া আমার চলত না। বেবাক দুনিয়া লইয়া আমি কি করুম। তুই আয়, তুই আয়। এক সময় ক্ষিপ্তের মতো টাকার বান্ডিলগুলো একের পর এক বাইরে ছুঁড়ে মারতে থাকে।
আমার আসমানের চান নাই, আমার দিনের সুরুজ ডুইব্যা গেছে। হইলদ্যা পাখি উইড়া গেছে। আমি কাগজের ট্যাহা লইয়া কি করুম? সে হাউ মাউ করে উচ্চ শব্দে কাঁদতে থাকে। অনেকক্ষণ প্রাণফাটা চিৎকার করার পর এক সময়ে বিছানায় ঢলে পড়লো।
তাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে তার শিষ্য সাগরেদরা টাকার বান্ডিলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে নিজিদের মধ্যে ভাগাভাগি করে যে যার মতো রাতের অন্ধকারে কেটে পড়লো। আলি কেনানের সেবা করে কাউকে নিরাশ হতে হয়নি।
তার পরদিন ভোরবেলা পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে তার ঘুম ভাঙে। আলি কেনানের মনে পড়লো আগের রাতে সে কিছু খায়নি। মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছিলো, দুহাতে টিপে ধরে উঠে দাঁড়ালো। তখনি তার আনুপুর্বিক সমস্ত কথা মনে পড়ে গেলো। সে দাঁত তোলার মতো ব্যথা অনুভব করতে লাগলো। জীবনের সমস্ত সাধ, সমস্ত স্বপ্ন মিটে গেছে। তবু জীবন, এ পোড়া জীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। হায়রে জীবনের বিড়ম্বনা, হায়রে জীবনের মায়া। সে কিছু খেতে চাইলো। আজ কেউ আসেনি। কি ব্যাপার। সবাই গেল কই? উঠে সবগুলো ঘর তন্নতন্ন করে দেখলো, সব খা খা করছে। একটিও জনমানব নেই। কাউকে না পেয়ে রাস্তার কাছে চলে এলো। মোড়ের দোকানে রেডিওতে শুনতে পেলো শেখ মুজিবের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। আলি কেনানের চোখের সামনে গোটা জগতটাই দুলে উঠলো। সে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো,
শেখ মুজিবর বাঁইচ্যা নাই, আমি ঢাহায় থাকুম কেরে? হের সমাজতন্ত্র অইলনা আমি হইলদ্যা পাখিরে হারাইলাম। ভোলায় চইল্যা যামু। অই তরা আমারে লঞ্চের একটা টিকেট কাইট্যা দে।
কিন্তু তার চীৎকার হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে থাকলো। সময় নষ্ট না করে শোবার ঘরে ঢুকে তোষকটা উল্টে পাল্টে দেখলো। অবাক কাণ্ড। একটা আধুলিও পড়ে নেই। কাল এই তোষকের তলায় থরে থরে সাজানো ছিলো টাকার বান্ডিল। আজ কিছু নেই। সব হাওয়া। মাজারে ঢুকে গলা চড়িয়ে বলতে থাকলো, হাতে একটা পয়সাও নাই। আমি ভোলায় মা বাপের কাছে ফেরত যামু কেমনে? কেমনে যামু? মাজারের ভেতরে তার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো-কেমনে যামু? কেমনে যামু?…