৭. উইল স্টিউটলির ফাঁসী
মহাফাঁপরে পড়ে গেলেন শেরিফ। রাজার কাছে যদি নালিশ করতে না যেতেন তাহলে আর এই বিপদে পড়তে হতো না তাঁকে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে যদি রবিন হুডকে গ্রেফতার না করতে পারেন, নিজের চাকরি নিয়েই টানাটানি পড়ে যাবে। অথচ গ্রেফতারী পরোয়ানা পাঠিয়ে কোন লাভ হয়নি, শূটিং প্রতিযোগিতার কৌশলও মাঠে মারা গেছে। কোন ভাবেই এঁটে ওঠা যাচ্ছে না দস্যুটার সাথে। শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, শেষ চেষ্টা হিসেবে সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করে দেখবেন ওকে ধরা যায় কিনা।
যত কনস্টেবল, নগর-রক্ষী আর জঙ্গল-রক্ষী ছিল সবাইকে ডেকে পাঠালেন তিনি। নির্দেশ দিলেন, ‘যুদ্ধের সাজ পরে নাও সবাই। আমাদের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে শেষ চেষ্টা করবো এবার আমরা। বর্ম পরে থাকবে তোমরা, সাথে নেবে ঢাল তলোয়ার আর তীর-ধনুক। গোটা শেরউড জঙ্গলের প্রত্যেকটি রাস্তা, মেটোপথ আর বুনোপথের ধারে ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করবে তোমরা চার-পাঁচজনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। যদি ওদের বড়সড় দলের মুখোমুখি পড়ে যাও, শিঙা বাজিয়ে সংকেত দেবে আশেপাশের দলগুলোকে, সবাই মিলে আক্রমণ করবে একযোগে। শুনে রাখো, রবিন হুডকে যে ধরে আনতে পারবে তাকে পুরস্কার দেয়া হবে পুরো একশো পাউণ্ড- জীবিত হোক বা মৃত, আমার সামনে এনে হাজির করতে পারলেই পাবে পুরস্কার। তাছাড়া ওর দলের যে-কোন লোককে, জীবিত হোক বা মৃত, ধরে আনতে পারলে পাবে চল্লিশ পাউণ্ড করে। যাও, তোমাদের আর সব ডিউটি মওকুফ করে দেয়া হলো কিছুদিনের জন্যে, যেমন করে পারো ধরে নিয়ে এসো দস্যুদের।’
ষাটটি উপদল তৈরি করলো ওরা, প্রতিটি উপদলে পাঁচজন করে লোক, অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রওনা হয়ে গেল শেরউডের উদ্দেশে। প্রত্যেকের মনে আশা, বলা যায় না, হয়তো পুরস্কারটা ঝুলছে তারই কপালে। পর পর সাতদিন সাতরাত পাহারা দিল ওরা, টহল দিল প্রতিটি রাস্তায়, কিন্তু সবুজ পোশাক পরা লোক তো দূরের কথা, একটুকরো সবুজ কাপড়ও চোখে পড়লো না কারো। কারণ ব্লু বোরের ঈডমের কাছ থেকে আগেই জেনে গেছে রবিন শেরিফের এই সর্বাত্মক প্রচেষ্টার কথা।
খবরটা কানে যেতেই দলের সবাইকে ডেকে আত্মগোপন করবার নির্দেশ দিয়েছে রবিন হুড। বলেছে, ‘আমি অযথা রক্তপাত পছন্দ করি না। ওদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে গেলে হয়তো আমরাই জিতবো, কিন্তু দু’পক্ষেরই প্রচুর লোক হতাহত হবে তার ফলে, অনেক স্ত্রী হারাবে তাদের স্বামী, অনেক সন্তান হারাবে পিতা। এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলে আমি চাই না এই যুদ্ধে জড়াতে। কতদিন টহল দেবে ওরা? ক্লান্ত হয়ে একদিন ফিরে যেতেই হবে ওদের। ততদিন ডেরা ছেড়ে কোথাও বেরোবো না আমরা। সবার মঙ্গলের জন্যেই এটা করবো আমরা। কিন্তু যদি ওরা আমাদের বাধ্য করে যুদ্ধে নামতে, জান-প্রাণ দিয়ে লড়বো, দেখিয়ে দেব ওদের লড়াই কাকে বলে।
রবিনের এই নির্দেশ মনঃপূত হলো না অনেকেরই, মেনে নিতে পারলো না এই আত্মগোপনের পরিকল্পনা, ক্ষুণ্ন মনে বিড় বিড় করে বললো, ‘ভীতুর ডিম মনে করবে তাহলে শেরিফ আমাদেরকে। সারা দেশের লোক মনে করবে কাপুরুষ রবিনের সাহসে কুলায়নি এদের মোকাবিলা করার।’ অসন্তুষ্ট হলো বটে, কিন্তু রবিনের নির্দেশ মেনে নিল সবাই বিনা আপত্তিতে, একটি কথাও বললো না ওর কথার উপর।
সাতদিন সাতরাত লুকিয়ে রইলো রবিনের দস্যুদল আস্তানার আশে পাশে, কেউ বেরোলো না বাইরে। অষ্টম দিনের সকালে আবার সবাইকে ডাকলো রবিন হুড। বললো, ‘বেশ অনেক দিন তো হলো, এবার লোক পাঠিয়ে দেখা দরকার কি করছে ব্যাটারা। চিরকাল তো আর টহল দিতে পারবে না, ইতিমধ্যেই হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছে। তোমাদের মধ্যে কে দেখে আসবে ওরা আছে না গেছে?’
হুল্লোড় উঠলো সবার মধ্যে, ধনুক উঁচিয়ে প্রত্যেকে দাবি জানালো যেন তাকেই পাঠানো হয়। গর্বের সাথে সবার উপর একবার চোখ বুলালো রবিন হুড, সবার সাহস দেখে বুক ভরে গেছে তার। হাত তুলে চুপ করার নির্দেশ দিল সবাইকে, তারপর বললো, ‘তোমাদের সবাইকে তো আর পাঠানো সম্ভব নয়, কাজেই তোমাদের মধ্যে থেকে একজনকে মনোনীত করবো আমি। তোমরা সবাই সাহসী এবং বীর, কোন সন্দেহ নেই তাতে, কিন্তু এ কাজের জন্যে বীরত্ব ও সাহসের চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন ধূর্ততার। বুড়ো শেয়ালের মত চতুর একজন দরকার আমাদের। আমি প্রস্তাব করছি উইল স্টিউটলির নাম।
খুশিতে লাফিয়ে শূন্যে উঠলো উইল স্টিউটলি, এত লোকের মধ্যে থেকে তাকেই এই কাজের জন্যে বেছে বের করা হয়েছে দেখে হাসি আর ধরে না তার। ধন্যবাদ, রবিন,’ বললো সে। যদি ব্যাটাদের কোন খবর না আনতে পারি তাহলে আমার চতুর উইল স্টিউটলি নাম পাল্টে অন্য নাম রেখো। চললাম!’
সবুজ পরিচ্ছদের ওপর মঠবাসী সন্ন্যাসীর ঢোলা কাপড় চাপালো সে, তলোয়ারটা এমন ভাবে ঝুলিয়ে নিল যাতে বাইরে থেকে কিছুই বোঝা না যায়, অথচ প্রয়োজনের সময় খুব সহজেই বের করে আনা যায় এক টানে। মাথার ঢাকনিটা বেশ খানিকটা টেনে সামনের দিকে নামিয়ে দিয়ে ধীরপায়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়লো সে। শেরিফের পাঠানো দুটো দল পড়লো তার চোখে। অবাক হলো সে এখনো তাড়জোরের সাথেই পাহারা চলছে দেখে। সাথে সাথেই ফিরে না এসে স্থির করলো সে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাবে ব্লু বোরে, সেখানে ঈডমের কাছ থেকে সব সংবাদ শুনে তারপর ফিরে যাবে আস্তানায়। ডাইনে বাঁয়ে না চেয়ে, দুই হাত বুকে বেঁধে, যেন কতই না গভীর তত্ত্বচিন্তায় মগ্ন, মাথা হেঁট করে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সে ব্লু বোরের নামনে।
ব্লু বোরে পৌঁছে দেখলো সে শেরিফের জনাকয়েক লোক বসে মদ গিলছে। কারো নাথে কোন কথা না বলে দূরের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলো সে। হাতের লাঠির ওপর ভর দয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলো, যেন গভীর ধ্যানে মগ্ন। আসলে অপেক্ষা করছে সে ডিমকে একা পাওয়ার আশায়। ব্লু বোরের মালিক ঈডম দেখলো ওকে ঠিকই, কিন্তু চনতে পারলো না। মনে করলো, ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে কোন বুড়ো সাধু, নিক, কেউ সিলে কিছু আর ক্ষয়ে যাবে না বেঞ্চটা।
ঈডম চিনতে পারলো না বটে, কিন্তু তার পোষা বিড়ালটা ঠিকই চিনতে পেরেছে টইল স্টিউটলিকে। বরাবর যেমন আদর পায় তেমনি আদরের আশায় কাছে এসে গা ঘষতে শুরু করলো ওর পায়ে। ফলে সন্ন্যাসীর ঢোলা পোশাকটা উপরে উঠে গেল চার মাঙুল পরিমাণ। দ্রুত হাতে কাপড়টা আবার নামিয়ে দিল স্টিউটলি, কিন্তু ইতিমধ্যেই চলের সবুজ কাপড় চোখে পড়ে গেছে একজন কনস্টেবলের। তক্ষুণি কাউকে কিছু বললো না সে, মনে মনে বিচার বিবেচনা করে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে বেঞ্চে সো লোকটা কিছুতেই মঠের সন্ন্যাসী হতে পারে না, কোন সন্দেহ নেই, ও রবিন হুডের দলের লোক।
বিনয়ের সাথে ডাকলো সে সন্ন্যাসীকে, ‘আসুন না, ফাদার, মনে হচ্ছে খুবই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছেন, কয়েক ঢোক বিয়ার খেয়ে তৃষ্ণা দূর করুন।
মাথা নেড়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলো উইল স্টিউটলি, কারণ কথা বলে উঠলে কেউ হয়তো ওর গলার স্বর চিনেও ফেলতে পারে। কিন্তু কথা না বলে উপায় থাকলো না তার। আবার প্রশ্ন করলো কনস্টেবল, ‘এই গরমে কোথায় চলেছেন, ফাদার?’
গলার স্বর একটু মোটা করে উত্তর দিল স্টিউটলি, ‘তীর্থে চলেছি। ক্যান্টারবারি শহরে।’
হাসলো কনস্টেবল। বললো, ‘ক্যান্টারবারিতে তীর্থযাত্রায় যেতে হলে হলি ফাদারদের জোব্বার নিচে লিংকন গ্রীন কাপড় পরার নিয়ম আছে বুঝি? হাঃ হাঃ হাঃ! ভেবেছো ফাঁকি দিতে পেরেছো আমার চোখকে? আমি জানি, হয় ছদ্মবেশী চোর তুমি, নয়তো দস্যু রবিন হুডের লোক। খবরদার! এক ইঞ্চি নড়লেই এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেব তলোয়ার দিয়ে
এই বলে একটানে চকচকে তরবারী বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লো সে উইল স্টউটলির ওপর। কিন্তু ততক্ষণে বুঝে ফেলেছে স্টিউটলি যে ধরা পড়ে গেছে, হাতটা মাগেই চলে গিয়েছিল তলোয়ারের বাঁটের কাছে, টান দিয়ে ঢোলা কাপড়ের নিচ থেকে বের করলো সে নিজের তলোয়ার, উঠে দাঁড়ালো এক লাফে। সাঁই করে প্রচণ্ড বেগে তলোয়ার চালালো কনস্টেবল, কিন্তু ওই একবারই, আর কোন সুযোগ পেল না সে, মাঘাত ঠেকিয়ে দিয়ে একের পর এক আঘাত হেনে চললো উইল স্টিউটলি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। দরদর করে রক্ত নামলো কনস্টেবলের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে। পালাবার পথ পরিষ্কার হয়েছে বুঝতে পেরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড় দিতে যাবে, এমন সময়ে টলতে টলতে মাটিতে পড়লো আহত কনস্টেবল, এবং পড়েই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো উইল স্টিউটলির হাঁটু জোড়া। ছুটে এলো অন্যান্যরা। সবার আগে যে ছিল তার মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালালো স্টিউটলি, কিন্তু মাথায় শিরস্ত্রাণ থাকায় বেঁচে গেল সে এ-যাত্রা; গভীর একটা দাগ সৃষ্টি হলো শুধু ইস্পাতের শিরস্ত্রাণে, মাথাটা ঘুরে উঠলো বটে, কিন্তু মারা পড়লো না সে। এদিকে জ্ঞান হারাচ্ছে আহত কনস্টেবল, কিন্তু হাতের বাঁধন আলগা করছে না, ঝটকা দিয়ে পা ছাড়াবার চেষ্টা করলে আরো জাপটে ধরে। ওর এই রকম বেকায়দা অবস্থা দেখে যে তিনজন এগোতে সাহস পাচ্ছিল না তারাও ছুটে এসে ঘিরে ধরলো উইল স্টিউটলিকে। এপাশ-ওপাশ ফিরে বীরত্বের সঙ্গে চারজনের আক্রমণ ঠেকাবার চেষ্টা করছে স্টিউটলি, সুযোগ পেলেই তলোয়ারের খোঁচায় আহত করছে শত্রুদের। কিন্তু বেশিক্ষণ পারলো না। পিছন থেকে আচমকা একটা আঘাত এসে পড়লো ওর মাথার উপর, কুলকুল করে রক্ত নেমে অন্ধ করে দিল ওর চোখ। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে মেঝেতে, হাত থেকে খসে গেল তরবারি। একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেসে ধরলো এবার সবাই ওকে, কিন্তু তাও কি রাখা যায়! – কিল ঘুসি লাথি চালাচ্ছে সে সমানে। কিন্তু বেশিক্ষণ এইভাবে যুঝতে পারলো না সে, চেপে ধরে বেঁধে ফেললো ওরা ওর হাত-পা, বন্দী হলো উইল স্টিউটলি।
গ্রীনউড গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রবিন হুড, ভাবছিল উইল স্টিউটলির কথা, ওর দেরি দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছিল মনে মনে। এমন সময় দেখতে পেল দু’জন অনুচর ছুটে আসছে ওর দিকে, ওদের মাঝখানে দৌড়াচ্ছে ব্লু বোরের মুটকি মেকেন। ওদের দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল রবিনের, পরিষ্কার বুঝতে পারলো সে, অশুভ-সংবাদ বয়ে আনছে ওরা।
‘উইল স্টিউটলিকে ধরে নিয়ে গেছে! হাঁপাতে হাঁপাতে বললো একজন।
‘খবরটা কে আনলো? তুমি?’ মেয়েটার দিকে ফিরলো রবিন।
হাপরের মত হাঁপাচ্ছে মুটকি মেকেন। বললো, ‘হ্যাঁ। পুরোটা ঘটনা নিজ চোখে দেখেছি আমি। বীরের মত লড়েছে স্টিউটলি, জখম হয়েছে মারাত্মক রকম, অনেক রক্ত পড়তে দেখলাম। হাত-পা বেঁধে নিয়ে গেল ওকে নটিংহাম শহরে, কাল নাকি ফাঁসী হবে ওর। তাই শুনে পিছনের দরজা দিয়ে ছুটে এসেছি আমি খবরটা জানাতে।’
‘ফাঁসী হবে না,’ ঘোষণা করলো রবিন। ‘অন্ততঃ আমাদের প্রাণ থাকতে নয়!’ এই বলে শিঙাটা মুখে তুলে তিনটে ফুঁ দিল সে। জরুরী বিপদ সংকেত।
হুড়মুড় করে চারদিক থেকে ছুটে এলো সাতকুড়ি তাগড়া জোয়ান, ঘিরে ধরলো রবিনকে।
‘সবাই শোন!’ হাঁক ছাড়লো রবিন হুড। ‘আমাদের প্রিয় সহচর উইল স্টিউটলি বন্দী হয়েছে শয়তান শেরিফের লোকের হাতে। আগামীকাল নাকি ফাঁসী হতে যাচ্ছে ওর। যেমন করে হোক ঠেকাতে হবে সেটা, ওকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে আনতে হবে আমাদের মধ্যে। ও যেমন আমাদের জন্যে বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে, নিজের জীবন বিপন্ন করেছে, প্রয়োজন হলে ওর জন্যে আমাদের প্রত্যেকের তাই করাই উচিত বলে মনে করি। কাজটা ছেলেখেলা নয়, বিপদের সম্ভাবনা আছে, মৃত্যুও ঘটতে পারে। কারও ওপর জোর জবরদস্তি নেই। লিটল জন আর আমি তো যাবই, তোমাদের মধ্যে আর কে কে যেতে চাও, হাত তোল।’
‘আমি যাব,’ শুধু দু’টি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হলো। প্রচণ্ড এক হুংকারের মত আকাশ কাঁপিয়ে দিল শব্দ দুটো, কারণ একসাথে সবাই উচ্চারণ করেছে কথাটা। সবাই মাথার উপর তুলে ধরেছে ধনুক।
‘তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ,’ বললো রবিন। বন্ধুর বিপদে যদি তাকে আমরা সাহায্য না করতে পারি, তাহলে কিসের মানুষ! কাল খুব ভোরে রওনা হবো আমরা, তৈরি থেকো সবাই।’
পরদিন খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই ছদ্মবেশ ধরে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা বিভিন্ন পথে, একসাথে তিনজনের বেশি নয়। কথা রইলো, নটিংহাম শহরের কাছেই একটা জংলা উপত্যকায় মিলিত হবে সবাই।
‘খবর জানা দরকার সবচেয়ে আগে,’ নির্দিষ্ট জায়গায় সবাই সমবেত হতেই বললো রবিন। ‘কোথায় কিভাবে কি করতে যাচ্ছে ওরা সেটা না জানা পর্যন্ত করার কিছুই নেই আমাদের। চুপচাপ গা ঢাকা দিয়ে থাকো সবাই, লক্ষ্য রাখো দুর্গ-তোরণের দিকে। কাউকে একা বেরোতে দেখলেই আমরা কথা বলবো তার সাথে।
বেলা বেড়ে চলেছে, উশখুশ করছে সবাই, কিন্তু শহর থেকে বেরোচ্ছে না কেউ। খুব সম্ভব উইল স্টিউটলির ফাঁসী দেখার জন্যে আর সমস্ত কাজ বাতিল করেছে শহরবাসীরা আজকের জন্যে। অপেক্ষা করতে করতে যখন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সবাই, তখন দেখা গেল শহর থেকে বেরিয়ে নগর-প্রাচীরের ধার ঘেঁষা রাস্তা ধরে হাঁটছে এক শীর্ণকায় বৃদ্ধ তীর্থযাত্রী। কনুই দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিল রবিন ডংকাস্টারের ডেভিডের পাঁজরে। ‘যাও, ওর কাছ থেকে কোন খবর পাওয়া যায় কিনা দেখে এসো।’
এগিয়ে গেল তরুণ ডেভিড, বৃদ্ধের কাছাকাছি এসে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করলো। হাসতে হাসতে বললো,
উইল স্টিউটলির কোন খবর আছে, হোলি ফাদার? বদমশাটার ফাঁসী দেখবো বলে বহুদূর থেকে এসেছি আমি। কখন কোথায় ফাঁসী হবে বলতে পারেন?’
‘ছি, ছি!’ ডেভিডের দিকে চেয়ে ভুরু কুঁচকে ভর্ৎসনা করলেন বৃদ্ধ। ‘বিনা দোষে একজন ভাল মানুষকে ফাঁসীতে ঝোলানো হচ্ছে, আর তুমি এসেছো সেই তামাশা দেখতে?’ রাগের ঠেলায় হাতের লাঠিটা ঠুকলেন তিনি। ‘অন্যায়, ভয়ানক অন্যায়! কি দোষ করেছিল সে যে তাকে ধরে এনে ফাঁসী দিতে হবে? উচ্ছন্নে যাবে, আমি বলে দিচ্ছি, উচ্ছন্নে যাবে সব! জানতে চাইলে, তাই বলছিঃ আজ সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের কিছু আগে নগর-তোরণের বাইরে নিয়ে আসা হবে ওকে, ওই তে-রাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে দেয়া হবে ফাঁসীতে, যাতে এই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নমুনা দেখে সতর্ক হয়ে যায় আর সব দস্যুরা। কিন্তু দস্যু?-কাদের তুমি দস্যু বলবে? রবিন হুডকে?’ এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, ‘ধন সম্পদ কেড়ে নিচ্ছে সে ঠিকই, কিন্তু কাদের কাছ থেকে? অসৎ, নিষ্ঠুর, ধনী, পাজি লোকের কাছ থেকে। কোথায় যাচ্ছে সেই টাকা? খোঁজ নিয়ে দেখো, আশেপাশের গোটা এলাকায় যত অসহায় বিধবা, যত অক্ষম বৃদ্ধ, যত অসচ্ছল কৃষক-শ্রমিক রয়েছে, যত পঙ্গু-দীন-দুঃখী আছে, সবার জন্যে একমুঠো অন্ন, শীত নিবারণের বস্ত্র জুগিয়ে আসছে সে বছরের পর বছর। আহা, তারই এক বিশ্বস্ত অনুচরকে অন্যায় ভাবে ফাঁসীতে ঝোলাতে যাচ্ছে নিষ্ঠুর শেরিফ, ভাবতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছি আমি শহর ছেড়ে। যদি জানতাম সে কোথায় থাকে, আমি নিজে গিয়ে খবর দিতাম রবিন হুডকে, বলতাম অন্যায় ভাবে খুন করা হচ্ছে তোমার এক অনুচরকে, যেমন করে পারো উদ্ধার করো তাকে।’
এই বলে নিজের পথে পা বাড়ালেন বৃদ্ধ। কিন্তু তিন কদম এগিয়েই থমকে থেমে দাঁড়ালেন তিনি। কারণ কথা বলে উঠেছে যুবক। আপনার কথা পৌঁছে যাবে রবিন হুডের কানে। আমার বিশ্বাস, নিজের প্রিয় অনুচরকে রক্ষা করার চেষ্টায় কোন ত্রুটি করবে না সে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ফাদার, আজ যদি উইল স্টিউটলি মারা যায়, চরম প্রতিশোধ নেয়া হবে সে মৃত্যুর।
বৃদ্ধ যখন ঘুরে দাঁড়ালেন, দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে তখন ডংকাস্টারের ডেভিড। ওর ঋজু, বলিষ্ঠ পদক্ষেপ দেখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর মুখে। হাত তুলে আশীর্বাদ করে রওনা হয়ে গেলেন তিনি নিজের পথে। বুঝতে পেরেছেন তিনি, এই ছেলে রবিন হুডেরই দলের কেউ, কাছে পিঠেই ওৎ পেতে বসে আছে রবিন। ভালো।
ডেভিডের মুখে সব শুনে সবাইকে কাছে ডাকলো রবিন হুড। বুঝিয়ে দিল পরিকল্পনাটা। ‘দুপুর গড়িয়ে গেলেই উইল স্টিউটলির ফাঁসী দেখতে লোকজন আসতে আরম্ভ করবে আশপাশের অঞ্চল থেকে। আমরা একজন-দু’জন করে ভিড়ে যাব তাদের সাথে, ঢুকে পড়বো শহরে। খেয়াল রেখো, দল থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে কেউ। সবাই খেয়াল রাখবে সবার দিকে। উইল স্টিউটলিকে নিয়ে যখন রওনা হবে রক্ষীরা, তোমরা প্রত্যেকে চেষ্টা করবে যতটা সম্ভব ওদের কাছাকাছি থাকার। লিটল জনকে বুঝিয়ে দিয়েছি আমি কি করতে হবে। ওর কাজ ও করবে, যতক্ষণ না আমার শিঙার সংকেত পাবে ততক্ষণ তোমরা কেউ কিছু করতে যাবে না। সংকেত পাওয়ার পরও অযথা রক্তপাত ঘটাবে না, একান্ত প্রয়োজন না পড়লে কাউকে আঘাত করবে না; কিন্তু যদি প্রয়োজন পড়ে, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত হানবে, যেন এক লোককে দ্বিতীয়বার আঘাত করার প্রয়োজন না হয়। মনে রাখবে, আমাদের মূল উদ্দেশ্য উইল স্টিউটলিকে শেরউডে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া, শেরিফ বা তার সৈন্যদলকে শায়েস্তা করা নয়। উদ্ধারের কাজ হাসিল হয়ে গেলেই দল বেঁধে আমরা সরতে থাকবো জঙ্গলের দিকে। আমাদের মধ্যে কেউ আহত বা নিহত হলে তাকে তুলে নেব কাঁধে, ফেলে রেখে পালাবো না। সবাই সব কথা বুঝেছো? কারো কোন প্রশ্ন আছে?’
বুঝেছে সবাই। কেউ কোন প্রশ্ন করলো না।
সূর্য ঢলে পড়লো পশ্চিম আকাশে। দুর্গ-প্রাচীরের উপর থেকে বেজে উঠলো বিউগল। শহরের লোক যে যেখানে ছিল নেমে এলো রাস্তায়। রাজপথ লোকে লোকারণ্য, সবাই চলেছে নগর তোরণের দিকে। সবাই জানে, ফাঁসী দেয়া হচ্ছে রবিন হুডের ঘনিষ্ঠ সহচর উইল স্টিউটলিকে। ধীরে ধীরে খুলে গেল দুর্গ-তোরণ। সবার আগে সাদা ঘোড়ায় চড়ে বেরোলেন শেরিফ, তাঁর পিছনে মার্চ করে আসছে সশস্ত্র রক্ষীদল। রক্ষীদলের মাঝখানে দু’চাকার একটা ঘোড়াটানা গাড়িতে গলায় দড়ির ফাঁস লাগানো অবস্থায় বসে রয়েছে উইল স্টিউটলি, হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে দিনের আকাশে চাঁদের মত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে ওর মুখটা। কয়েক গোছা চুল রক্ত জমে শক্ত আর চোখা হয়ে পড়ে আছে কপালের উপর। দুর্গ থেকে বেরিয়েই চারদিকে চাইলো সে। কিছু কিছু বন্ধুত্ব ও সহানুভূতিপূর্ণ মুখ নজুরে পড়ুলো তার, কিন্তু চেনা মুখ দেখতে পেল না সে একটাও। ভারি সীসার মত গভীর পানিতে তলিয়ে গেল ওর সমস্ত আশা-ভরসা। বুঝলো, খবর পায়নি রবিন হুড।
কিন্তু তবু দমে গেল না সে। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী জেনে শক্ত করলো মনটা। শেরিফের উদ্দেশ্যে বললো, ‘আমাকে এভাবে না মেরে বরং আমার হাতে একটা তলোয়ার তুলে দিন, স্যার শেরিফ। আপনারা যতজন খুশি আসুন, মরার আগে পর্যন্ত লড়াই করে মরতে চাই আমি।’
বীরের মরণ তোমার কপালে নেই, হে ছোকরা,’ বললেন শেরিফ। ‘তলোয়ার পাবে না। সাধারণ চোর-ডাকাতের মতই ঘৃণ্য তুমি, সেই রকম নীচ মৃত্যুই ঘটবে তোমার।
‘ঠিক আছে, আমার হাতের বাঁধন কেটে দিন, অস্ত্র না হয় নাই দিলেন, খালি হাতেই আপনাদের সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে মরবো আমি।’
হা হা করে হেসে উঠলেন শেরিফ। ‘কেন, ফাঁসীটা পছন্দ হচ্ছে না তোমার? বুক কাঁপছে এখন? রবিন হুডের দলে যোগ দেয়ার সময় এই সম্ভাবনার কথা উঁকি দেয়নি মনে? এখন খুব খারাপ লাগছে বুঝি?’ আবার একপেট হেসে নিয়ে বললেন, ‘না হে, তে-রাস্তার মোড়ে ফাঁসীতেই ঝুলতে হবে তোমাকে আজ। চোখ ঠুকরে তুলবে দাঁড়কাকে।’
রক্ত চড়ে গেল উইল স্টিউটলির মাথায় শেরিফের এই কথা শুনে, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গালিগালাজ করলো সে শেরিফকে। ‘কাপুরুষ, নীচ, নরকের কীট, বদমাশ, শেরিফ! তুই ভেবেছিস আমাকে ফাঁসীতে ঝোলালেই দমন করতে পারবি রবিন হুডকে? তোর অন্ততঃ সে সাধ্য নেই। থাকলে তোকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো না, টিটকারি মারতো না তোর নির্বুদ্ধিতা দেখে। জেনে রাখ, আজকের এই কৃতকর্মের ফল হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছেড়ে দেবে তোকে রবিন হুড।’
‘তাই নাকি?’ রেগে উঠলেন শেরিফ। ‘কোথায় তোর রবিন হুড? গর্তে লুকিয়ে রয়েছে কেন? আসুক না সামনে যদি সাহস থাকে! যাই হোক, তোর এই ঔদ্ধত্যের জন্যে শাস্তির মাত্রা আর একধাপ চড়িয়ে দেয়া গেলঃ ফাঁসী দেয়ার পর এক এক করে কেটে নামানো হবে তোর হাত-পা-ধড়-মাথা!’ এই বলে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সামনে এগোলেন তিনি।
নগর-প্রাচীরের বিশাল তোরণের সামনে এসে পৌঁছলো ওরা। গেট দিয়ে বাইরে দৃষ্টি চলে গেল উইল স্টিউটলির। কী সুন্দর! ঘন সবুজে ছেয়ে আছে পাহাড়, টিলা, ঢিবি, মাঠ, জঙ্গল। বহুদূরে শেরউডের বিশাল ওকের সারি দেখা যাচ্ছে আবছা মত। তির্যক লালচে রোদ বিছিয়ে পড়েছে মাঠে-ময়দানে, শস্যক্ষেত্রে। আলো লেগে কী অপূর্ব মায়াময় হয়ে উঠেছে দূরের ওই কুটিরগুলো। কুলায় ফেরা পাখিদের কল-কাকলি কানে গেল ওর, পাহাড়ের ধারে গলা ছেড়ে ডাকছে একটা ভেড়া, পরিষ্কার আকাশে উড়ছে সোয়ালো। বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো উইল স্টিউটলির, আবছা হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি, উত্তপ্ত লোনা পানি নামলো গাল বেয়ে। কী সুন্দর এই পৃথিবীটা! অথচ সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে তাকে অকালে।
চট্ করে মাথাটা নামিয়ে নিল সে। সে যে ভয়ে কাঁদছে না, ভালবাসায় কাঁদছে, একথা বুঝবে ক’জন? লোকে যদি ভুল বোঝে ওকে, সেটা রবিনের অসম্মান, তাই মাথা নিচু করে চললো সে বাকি পথটুকু। নগর-তোরণ দিয়ে সবাই বেরিয়ে এলো বাইরে। মনটা শক্ত করে বেঁধে নিয়ে আবার যখন মুখ তুললো স্টিউটলি, বুকের ভিতর লাফ দিয়ে উঠলো ওর কলজেটা-আরে! এ এখানে কেন! ভিড়ের মধ্যে পলকের জন্যে দেখতে পেল সে শেরউডের এক সহচরের অতি পরিচিত মুখ। চারপাশে চোখ বুলিয়েই আনন্দে দম আটকে এলো তার। আরে! চারপাশ থেকে প্রহরীদেরকে ঘিরে রয়েছে ওর একান্ত প্রিয় বন্ধু-বান্ধবেরা, চেষ্টা করছে আরো চেপে আসার। হঠাৎ বুকের ভিতর ছলকে উঠলো এক ঝলক রক্ত-ভিড়ের মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে সে তার প্রিয় নেতা দস্যু রবিনের মুখ। আশেপাশের লোকদের কনুই দিয়ে গুঁতো মেরে সরিয়ে আরো কাছে আসার চেষ্টা করছে রবিন।
‘অ্যাই! কি হচ্ছে?’ জোরে ধমক মারলেন শেরিফ একদল লোককে। ‘এখানে গুঁতোগুঁতি হচ্ছে কেন? সরো, সরে দাঁড়াও!’
আরেক দিকে একটু গোলমালের আভাস পেয়ে সেদিকে মুখ ফেরালো উইল স্টিউটলি। লিটল জন! গাড়িটার আরো কাছে আসার চেষ্টা করছে লিটল জন-ওর সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
‘অ্যাই! খবরদার! সরে দাঁড়াও!’ লিটল জনের কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে চেঁচিয়ে উঠলো একজন সশস্ত্র রক্ষী। ধাক্কাধাক্কি করছিস কেন, হারামজাদা! সরে দাঁড়া!’
‘তুই সরে দাঁড়া, কুত্তার বাচ্চা!’ বলেই ধাঁই করে ভীষণ এক চাপড় কষালো লিটল জন লোকটার মাথার পাশে। লোকটা কাটা কলাগাছের মত দড়াম করে মাটিতে পড়তেই এক লাফে উঠে এলো সে উইল স্টিউটলির গাড়িতে
‘বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই এভাবে চলে যাওয়াটা কি তোমার উচিত হচ্ছে, উইল?’ বললো লিটল জন। যদি যেতেই হয়, চলো, আমাকেও নিয়ে চলো সাথে, তোমার মত বন্ধুর সাথে মরতে আমার কোনই আপত্তি নেই।’ এই বলে ঘ্যাচ ঘ্যাচ দুই পোঁচ দিয়ে কেটে দিল সে ওর হাত-পায়ের বাঁধন। সাথে সাথেই এক লাফে নেমে পড়লো স্টিউটলি গাড়ি থেকে।
‘আরে! ওই দেখো! কে ওই লোকটা? দস্যুটার বাঁধন কেটে দিল! ধরো, ধরো ওকে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন শেরিফ। নিজেই ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে এলেন দ্রুতবেগে সাঁই করে চালালেন উন্মুক্ত তলোয়ার।
ঝনাৎ করে ঠেকিয়ে দিল লিটল জন শেরিফের আঘাত। ছদ্মবেশের নিচ থেকে ইতিমধ্যেই বের করে ফেলেছে সে নিজের তরবারী। আঘাত ঠেকিয়েই ইচ্ছে করলে নিজের তরবারীটা সেঁধিয়ে দিতে পারতো শেরিফের গলায়, কিন্তু তা না করে বাম হাতে খপ্ করে চেপে ধরলো সে শেরিফের তলোয়ার ধরা হাতের কব্জি। জোরে এক মোচড় দিতেই হাত থেকে ছেড়ে দিলেন শেরিফ তরবারীটা। চট্ করে সেটা তুলে নিয়ে উইল স্টিউটলির দিকে বাড়িয়ে দিল লিটল জন। ‘নাও, ধরো এটা। মাননীয় শেরিফ ধার দিয়েছেন এটা তোমাকে। জলদি, আমার পিঠে পিঠ দিয়ে দাঁড়াও, উইল-মেরে-কেটে বেরোতে হবে এদের মধ্যে থেকে।
খ্যাপা ষাঁড়ের মত চেঁচিয়ে উঠলেন শেরিফ, ‘ঝাঁপিয়ে পড়ো, ঝাঁপিয়ে পড়ো সবাই এদের ওপর, একসাথে!’
ঠিক এমনি সময়ে বেজে উঠলো রবিনের শিঙা। খটাং করে একটা তীর এসে লাগলো শেরিফের শিরস্ত্রাণে। শেরিফ চেয়ে দেখলেন, কে কার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, নিজ নিজ প্রাণ বাঁচাবার জন্যে লড়ছে তাঁর রক্ষীরা। হঠাৎ নিম্নবিত্ত নিরীহ দর্শকদের একাংশ খেপে উঠেছে যেন, শিঙার সংকেত পেয়ে কেউ বের করেছে তলোয়ার, কেউ তীর-ধনুক। ঝনাৎ-ঝন শব্দে বাড়ি খাচ্ছে তলোয়ারের সাথে তলোয়ার, অস্তগামী সূর্যের আলোয় ঝিলিক দিয়ে উঠছে ইস্পাত। যে যেদিকে পারছে ছুটতে শুরু করেছে শহরবাসীরা। পালাও, পালাও রব উঠেছে।
সাঁই সাঁই আরো কতকগুলো তীর ছুটে গেল শেরিফের দিকে। প্রমাদ গুণলেন তিনি, নিরস্ত্র অবস্থায় তীর খেয়ে মরার চেয়ে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলেন। ‘হটে এসো! নইলে মারা পড়বে সব! পিছন দিকে হটে এসো!’ চেঁচিয়ে নির্দেশ দিলেন তিনি তাঁর বাহিনীকে। এবং তাঁর নির্দেশ মান্য করা হচ্ছে কি হচ্ছে না দেখার জন্যে না দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে ছুটিয়ে দিলেন ঘোড়া।
ইচ্ছে করলে শেরিফের বেশির ভাগ লোককেই হত্যা করতে পারতো রবিনের দল, কিন্তু তা না করে পালিয়ে যাবার সুযোগ দিল, যাতে দ্রুত পালায় সেজন্যে গোটা কয়েক তীর পাঠিয়ে দিল ওদের পিছন দিক লক্ষ্য করে।
‘আরে! যান কোথায়! দাঁড়ান না!’ শেরিফের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বললো উইল স্টিউটলি। ‘পালিয়ে গেলে রবিন হুডকে ধরবেন কি করে?’ কিন্তু এত ডাকাডাকি করেও ফেরানো গেল না শেরিফকে, তীরের ভয়ে বাঁকা হয়ে ঘোড়ার পিঠে সেঁটে তীরবেগে ছুটলেন তিনি নগর-তোরণের দিকে।
এবার লিটল জনের বিশাল দুই কাঁধে হাত রেখে ওর চোখে চোখ রাখলো উইল স্টিউটলি। দরদর করে পানি নামলো ওর দু’চোখ বেয়ে। পাগলের মত কোলাকুলি করলো সে। চুমো খেল লিটল জনের দুই গালে। তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো, ‘বন্ধু! প্রাণের বন্ধু!’ কাঁদছে আর প্রলাপ বকে চলেছে স্টিউটলি, ‘সত্যিকার প্রাণের বন্ধু তোমরা আমার! তোমাদের ভালবাসি, লিটল জন, তোমাদের সবাইকে আমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসি! বুকটা আমার কানায় কানায় ভরে গেছে, জন, গর্বে। ভাবতেও পারিনি এ জীবনে আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে!’ কোন উত্তর দিতে পারলো না দৈত্যাকার লিটল জন। অঝোরে কাঁদছে সে-ও। দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে রবিন হুড, হাসছে মিটিমিটি।
সবাইকে ডেকে জড়ো করে রওনা হয়ে গেল রবিন হুড। সবার মাঝে রয়েছে উইল স্টিউটলি। ঝড়ের পর যেমন মেঘগুলো দ্রুত সরে যায়, তেমনি দ্রুত সরে গেল ওরা নগর-তোরণের কাছ থেকে; জঙ্গলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। পিছনে তে-রাস্তার মাথায় পড়ে রইলো শেরিফের দশজন আহত লোক।
রবিন হুডের দুঃসাহস দেখে এবার সত্যিই ভয় পেলেন শেরিফ। পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি, ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিয়েছে তাঁকে আজ রবিন হুড। ইচ্ছে করলেই একটা তীর ঢুকিয়ে দিতে পারতো সে তাঁর কণ্ঠনালী চিরে। মরতে মরতে বেঁচে এসেছেন তিনি আজ। মনে মনে স্থির করলেন, চাকরি যায় যাক, ওদেরকে সহজে ঘাঁটাতে যাবেন না তিনি আর। অনেকদিন ঘর থেকে বেরোলেন না তিনি। কারণ, যদিও সাহস করে মুখের ওপর কেউ কিছু বলে না, লক্ষ্য করেছেন তিনি, তাঁকে দেখলেই লোকের মুখ কেমন যেন হাসি হাসি হয়ে ওঠে।