৭. আল বাত্তানী (৮৫৮–৯২৯ খ্রি:)
যে মুসলিম মনীষী সর্ব প্রথম নির্ভুল পরিমাপ করে দেখিয়ে ছিলেন যে, এক সৌর বৎসরে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড হয়, তার আসল নাম হলো আবু আবদল্লাহ ইবনে জাবীর ইবনে সিনান আল বাত্তানী। তিনি আল বাত্তানী নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায়নি। যতদূর জানা যায় ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেসোপটেমিয়ার অন্তর্গত ‘বাত্তান নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্ম স্থানের নামেই তিনি বিশেষভাবে খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর পিতার নাম জাবীর ইবনে সানান। তাঁর পিতাও ছিলেন তৎকালীন সময়ের একজন বিখ্যাত পণ্ডিত ও বিজ্ঞানী। আল বাত্তানী পিতার নিকটই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। শৈশব কাল থেকেই শিক্ষা লাভের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। তিনি যে শিল্প কর্মেই হাত দিতেন তা নিখুঁত ভাবে শুরু করতেন এবং এর ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া ও ফলাফল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। পিতার নিকট প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর উচ্চ শিক্ষার জন্যে তিনি ইউফ্রেটিস নদীর নিকটবর্তী রাক্কা নামক শহরে গমন করেন ৷ মাত্র ২০ বছর বয়সেই তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পণ্ডিত হিসেবে নিজকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
আল বাত্তানীর বয়স যখন মাত্র ৫ বছর খলিফা মুতাওয়াক্কিলের ইন্তেকাল হয়। পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণে তরুণ বয়সেই তাঁকে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হয় এবং সিরিয়ার গভর্নর পদে অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রীয় কাজের চরম ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি তাঁর জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনার কোন ক্ষতি করেননি। রাজধানী রাক্কা ও এস্টিয়োক থেকে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে গবেষণা চালাতেন। তিনি ছিলেন একজন অংক শাস্ত্রবিদ ও শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র প্রভৃতির প্রকৃতি, গতি ও সৌরজগৎ সম্বন্ধে তাঁর সঠিক তথ্য শুধুমাত্র অভিনবই নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞানে টলেমী সহ পূর্বতন বহু বৈজ্ঞানিকের ভুলও তিনি সংশোধন করে দেন। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কিত টলেমী যে মতবাদ ব্যক্ত করেছেন, আল বাত্তানী তা সম্পূর্ণ ভুল বলে বাতিল করে দিতে সক্ষম হন। তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, সূর্যের আপাত কৌণিক ব্যাসার্ধ বাড়ে ও কমে। নতুন চন্দ্র দেখার ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ নতুন ও নির্ভুল বক্তব্য পেশ করেন। সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ সম্পর্কে ও তাঁর বক্তব্য সুস্পষ্ট। আল বাত্তানী তাঁর নতুন উদ্ভাসিত যন্ত্র দিয়ে প্রমাণ করে দিলেন যে, সূর্য স্থির বলে এতদিনের প্রচলিত টলেমীর মতবাদটি সত্য নয়। সূর্য তার নিজস্ব কক্ষে গতিশীল। আল বাত্তানী আরো প্রমাণ করেন যে, টলেমীর সময় থেকে তাঁর সময় পর্যন্ত সূর্যের ১৬.৪৭ বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং সূর্য স্থির নিশ্চল নয় এবং তার নিজস্ব কক্ষে গতিশীল। আল বাত্তানী টলেমীর প্রচারিত আরো বহু মতবাদকে ভুল বলে প্রমাণ করেন। তিনি অক্ষর মালাকে সংখ্যার প্রতীক হিসেবে ব্যবহারমূলক একটি ‘জিজ’ তালিকা তৈরি করেন। এটি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা অনূদিত হয়ে ৩ খণ্ডে প্রকাশিত হয়।
আল বাত্তানীই সর্ব প্রথম আবিষ্কার করেন যে, ত্রিকোণমিতি হচ্ছে একটি স্বয়ং স্বাধীন বিজ্ঞান। তিনি গোলাকার ত্রিকোণমিতির কিছু কিছু সমস্যার অত্যন্ত বিস্ময়কর সমাধান দিয়েছেন। অন্যান্য বৈজ্ঞানিকগণ ত্রিকোণমিতির প্রতি এতদিন অমনোযোগী ছিলেন। আল বাত্তানীর অসাধারণ প্রতিভার সংস্পর্শে নির্জীব ত্রিকোণমিতি সজীব হয়ে উঠে। সাইন, কোসাইনের সঙ্গে ট্যানজেস্টের সম্পর্ক আল বাত্তানীই প্রথম আবিষ্কার করেন। ত্রিভুজের বাহুর সঙ্গে কোণের ত্রিকোণমিতি সম্পর্কও তাঁরই আবিষ্কার। বাত্তানীই সর্ব প্রথম অংক শাস্ত্রে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রীক স্বর গ্রামের পরিবর্তে লম্বের ব্যবহার করেন। এক কথায় আল বাত্তানীর জীবন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিস্তৃত। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি ও অংকশাস্ত্রে বহু মূল্যবান গ্রন্থ ইউরোপে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মুসলিম মনীষীগণের জ্ঞান বিজ্ঞান দিয়েই অমুসলিমগণ আজ জ্ঞান বিজ্ঞানের শীর্ষে উন্নীত হয়েছে। অপরদিকে মুসলিম জাতি তাদের পূর্ব পুরুষদের জ্ঞান বিজ্ঞান সাধনাকে উপেক্ষা করে আজ অমুসলিমদের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে। এ মহা মনীষী ৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৭২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।