৭. আর্ত চিৎকার

০৭.

আজকাল ঘুমের মধ্যেও মনোরম একটা আর্ত চিৎকার শুনতে পায়–ফলো হিম, ঝুমু, ওয়াচ হিম।

অস্ফুট যন্ত্রণাকাতর শব্দ করে মনোরম পাশ ফেরে। নিস্তব্ধ গলায় ঘুমের মধ্যেই বলে আমি কি পারি মামা? ওর সঙ্গে আমি কি পারি?

–ও যে মরবে ঝুমু! ও যে শীগগির মরবে! একদিন ওর ডেডবডি ধরাধরি করে নিয়ে আসবে রাস্তার লোক।

–মরে যদি কে ঠেকাবে?

–তুই ঠেকাবি ঝুমু। ফল হিম।

আমার যৌবন বয়স শেষ হয়ে গেছে মামা। অত স্পিড আমি কোথায় পাব? আমি তত বড় নই যে ওকে ঢেকে রাখব, বা ওকে আড়াল করব।

দয়া কর ঝুমু, তুই পারবি। তোর মতো ওকে কেউ বোঝে না। আমিও না।

-কী বুঝেছি মামা? কখনও মনে হয় ও চাঁদের মাটির ওপর হাঁটছে, ঠিক যেমন নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল চাঁদে। কখনও মনে হয়, ও এক অন্য গ্রহ থেকে আসা মানুষ, জ্যোৎস্নামাখা হলুদ কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে। মামা, বীরু কি রিয়ালি?

-কী বলছিস ঝুমু? রিয়াল নয়?

বীরু নামে সত্যিই কেউ আছে?

–নেই! কী বলিস তুই! বীরু নেই?

–আছে হয়তো। অন্য পৃথিবীতে।

–তুই কি পাগল? অন্য পৃথিবী আবার কী?

–জানো তো টেলিফোনের একটা তার-এ হাজার ফ্রিকোয়েন্সিতে হাজার মানুষের কথা ভেসে চলে! ধরো, একটাই তার, তাতে আমি কথা বলছি বিশ্বাসের সঙ্গে, তুমি সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। বিশ্বাসের কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ না, আমিও শুনতে পাচ্ছি না সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের কথা। ঠিক তেমনি, এই আমরা যেখানে বাস করি, সেই পৃথিবীতেই বসবাস করে বীরু। কিন্তু ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা, পৃথিবী আলাদা।

–তোর বড় হেঁয়ালি কথা! তবু যদি সত্যি হয়, ঝুমু, আমি তোর মাইনে বাড়িয়ে দেব, তোকে ম্যানেজার করব, তুই বীরুর ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে পড়।

–চেষ্টা করছি মামা, পারছি না। বয়স হয়ে গেছে, তা ছাড়া আমারও কি দুঃখ-টুঃখ কিছু থাকতে নেই মামা? দেখ, নড়ন্ত জিভ, একটা অ্যাকসিডেন্টের স্মৃতি, সীতা, স্বপ্নের মেয়েরা ইডিও-মোটর অ্যাকশন মিলিয়ে একটা কাল, এই জাল ছিঁড়ে সহজে কি বেরোনো যায়! চেষ্টা করছি।

-কর। তুই যা চাস তোকে আমি সব দেব।

–জানি মামা।

কী জানিস?

বীরুর জন্যই তুমি আমাকে ভালবাসো। কিন্তু এখন আমার ঘুমের সময়, তুমি আর স্বপ্নের মধ্যে আমাকে ডেকো না। আমি ঘুমোব, আমি উলটে রেখেছি বই, নিবিয়ে দিয়েছি বাতি। অন্ধকারে আমার শরীরের ভিতরে এক্ষুনি জ্বলে উঠবেনীল লাল স্বপ্নের আলোগুলি। ওই তো মোড়ের তে-মাথা পেরিয়ে সেঁটে আসছে আমার ঘুম, অবিকল মানুষের মতো, হাঁসের মতো গায়ের অন্ধকার কণাগুলি ঝেড়ে ফেলে সে আসবে কাছে। সম্মোহনের দীর্ঘ আঙুলগুলি নড়বে চোখের সামনে। তোমরা যাও…আমি ঘুমিয়ে পড়ব…

একটু স্যাঁতসেঁতে বিছানাটা। ফাঁকা। মনোলমের হাত এলিয়ে পড়ে থাকে। সেই হাত কিছুই স্পর্শ করে না।

.

ঠিক দুপুরবেলায় চোখের রোদ-চশমাটা খুলে মনোরম এসপ্ল্যানেডের ট্রামগুমটির টেলিফোন বুথ-এ ঢুকে গেল। ডায়াল করল, পয়সা ফেলল।

হ্যালো। একটা চাপা সতর্ক গলা ভেসে আসে।

–দিস ইজ জেমস বন্ড।

 –কে?

 –জিরো জিরো সেভেন।

–গুডনেস। ব্যানার্জি?

–ইয়াঃ।

–বিসোয়াস হিয়ার। আমাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে ব্যানার্জি? মানুষের আয়ুর তো শেষ আছে।

ফিসফিস করে একটা ভৌতিক গলায় কথা বলে বিশ্বাস।

–জানি বিশ্বাস। আমি একটা ট্রাফিক জ্যাম-এ পড়ে গেছি। সামনে একটা ফিয়াট গাড়ি, সেটাকে পেরোতে পারছি না। সেটাকে পেরোতে পারলেই আপনার কাছে পৌঁছে যাব। আর কয়েকটা দিন।

-ফিয়াট গাড়ি? কী বলছেন ব্যানার্জি? কার গাড়ি?

সেই ছেলেটার পিছু-নেওয়া এখনও শেষ হয়নি বিশ্বাস।

এখনও তাকে চেজ করছেন?

–এখনও?

-সে মরেনি তা হলে?

–না।

–তবে বোধহয় সে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকবে, কিন্তু আমি বোধহয় বাঁচব না ব্যানার্জি।

–কেন?

—আমার গলাটা কেমন বসে গেছে, লক্ষ করেছেন?

হু।

ক্যানসার।

 যাঃ।

বায়োপসি করিয়েছি। মাসখানেকের মধ্যেই হাসপাতালে বেড নেব।

 মনোরম চুপ করে থাকে।

ব্যানার্জি!

–উ।

সময় নেই। একদম না। আমার বাচ্চারা মাইনর, বউটা বুদ্ধি রাখে না। এত সব কে দেখবে? আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। আপনি কথা দিয়েছিলেন।

মনোরম একটা খাস ছাড়ল।

–শুনছেন ব্যানার্জি?

–শুনছি।

নতুন জবিনেস ওপেন করব ভাবছিলাম। ড্রাগ, নারকোটিকস। ম্যারিজুয়ানা থেকে হাশিস পর্যন্ত। খুব বাজার এখন। কিন্তু কী করে করব?

-দেখছি বিশ্বাস। আর কয়েকটা দিন।

–আপনাকে চাই-ই। ঠাট্টা নয় ব্যানার্জি, আপনি সত্যিকারের জিরো জিরো সেভেন হতে পারবেন। আমি একজন রিয়্যাল জিরো জিরো সেভেন চাই। হাত মেলান ভাই।

মনোরম হাসল।

হাসবেন না। হাতটা বাড়ান…বাড়িয়েছেন?

 মনোরম শূন্যে তার হাতটা সত্যিই বাড়িয়ে দিয়ে বলল বাড়িয়েছি।

–আমিও বাড়িয়েছি…এইবার ধরুন হাতটা…মুঠো করুন।

করেছি।

শূন্যেই হাত মুঠো করে মনোরম, শেকহ্যান্ডের ভঙ্গিতে।

দ্যাটস দ্য বন্ড। আমরা কিন্তু হাত মিলিয়েছি ব্যানার্জি।

–ইয়াঃ।

টেলিফোনটা হুক-এ ঝুলিয়ে রাখে মনোরম।

.

 এ বছর কলকাতায় খুব শীত পড়ে গেল। উত্তুরে হু-হুঁ হাওয়া দেয়। ময়দানের গাছগুলো থেকে পাতা খসে খসে পড়ে গেল সব। দেহাতিরা সেই পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালে, হাত-পা সেঁকে নেয়। বেকার আর ভবঘুরেরা পার্কে পার্কে বেঞ্চে আর ঘাসে শুয়ে কবোষ্ণ রোদে ঘুমোয় সারা বেলা। এসপ্ল্যানেডের চাতালে তিব্বতি কিংবা ভুটিয়া মেয়েরা সস্তায় সোয়েটার বিক্রি করছে। তাদের ঘিরে এ বছর ভিড় বেড়েছে। শহরতলির দিকে আপ লোকাল ট্রেনগুলো ছুটির দিনে বোঝাই হয়ে যায়। শীতের পিকনিকে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ। চিড়িয়াখানায় ভিড়, সিনেমা হল-এ লাইন। শীতের রোদ মাখাবার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ে লোকজন।

একটা তিব্বতি মেয়ের কাছ থেকে তার হলদে দাঁতের হাসি সমেত একটা পুলওভার কিনল মনোরম। সাদা। বুকে আর পেটে পাশাপাশি চারটে চারটে আটটা সবুজ বরফি। পুলওভারটা পরে বেরোলে যে কেউ মনোরমকে দুবার ফিরে দেখে।

বাটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে–শীতকালেই তো সাজগোজ। মনোরমও তাই ভাবে। এই শীতে সে একটু সাজবে। একজোড়া চমৎকার জুতো কিনে ফেলল সে। ক্রোকোডাইল প্যাটার্নের চামড়া। হাঁটুতে পকেটওলা একটা মার্কিনি কায়দার প্যান্ট করল, যার সেলাইগুলো দূর থেকে দেখা যায়। মামা টাকা দিচ্ছে। দেওয়ার হাত একটু একটু করে আসছে মামার।

পুরনো বন্ধুদের এক-আধজনের সঙ্গে দেখা হলে তারা জিগ্যেস করে কী ব্যাপার? চিনতেই পারা যায় না যে!

মনোরম উত্তর দেয়–জেমস বন্ড হয়ে গেছি ভাই, কমপ্লিট জিরো জিরো সেভেন।

কাজকারবার?

নতুন ব্যবসা খুলছি ভাই! কর ফাঁকি দিতে চাও, কি নতুন ধরনের নেশা করতে চাও, যা চাও কন্ট্যাক্ট বিসোয়াস অ্যান্ড ব্যানার্জি। শিগগিরই স্টার্ট করব।

কিন্তু ঝোলাচ্ছে বীরুটা। আর মামা। বিশ্বাসকে কথা দেওয়া আছে। কিন্তু মামা ছাড়ে না কিছুতেই। প্রতি মাসে টাকা বাড়াচ্ছে আজকাল। বলে–আর কটা দিন একটু দ্যাখ।

এই শীতে বীরু নতুন পোশাক তেমন কিছু করল না। শীতের শুরুতে মাসখানেকের জন্য হিল্লি-দিল্লি কোথায় কোথায় ঘুরে এল। ততদিন মামা দিনরাত তাকে কাঠের তত্ত্ব বোঝাত। মনোরমের জন্য নয়। মামার ধারণা, মনোরম শিখে বীরুকে শেখাবে। যদি বীরু না-ই শেখে কোনওদিন, তবে মনোরম ম্যানেজার হয়ে চালিয়ে নেবে কারবার। বীরুর যেন কষ্ট না হয়।

.

তিন দিকে ঘেরা জালের মধ্যে বীরু দাঁড়িয়ে আছে। একটা দিক খোলা। সেই ভোলা দিক দিয়ে ছুটে আসে রক্তাক্ত বল। বীরুর হাতে ব্যাটটা চমকায়। কিন্তু বলের লাইনটা ধরতে পারে না, স্ট্যাম্প ভেঙে জালে লাফিয়ে পড়ে বল। পরের পর এরকম হতে থাকে। বীরু বলের লাইন দেখতে পাচ্ছে না। যে-ছেলেটা বল করছে সে নতুন, স্কুল ক্রিকেটার। বল তেমন কিছু ভাল করে না। তবু বারবারই বীরু বল খেলতে পারল না। নেট প্র্যাকটিসের বাঁধা সময় পার হয়ে গেলে সে বেরিয়ে এল।

মনোরম বশংবদ দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ধারে। বীরুর ওপর সতর্ক চোখ।

বীরু তাকে দেখে একটু হাসল। তারপর তার ফিয়াটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললবাবার চাকরিটা করে যাচ্ছ তা হলে এখনও?

করছি।

 করো। কিন্তু কিছু জানার নেই। আমিই জানি না।

–এখনও ভুলতে পারছিস না বীরু?

কী?

–সেই স্টেশনে যেটা দেখেছিলি।

বীরু একটা খাস ছেড়ে মাথা নাড়ল–না।

-কেন?

–গেথে গেছে। অটো সাজেশানের মতো। মানুষের অনেক সময় হয়, খেতে বসলে সবচেয়ে ঘেন্নার কথা মনে পড়ে, একা ঘরে মনে পড়ে ভূতের গল্প। অনেকটা সেই রকমই। যত ভুলতে চাই, তত মনে পড়ে।

কী করবি?

–ভাবছি।

 –তুই একটুও ভাবছিস না।

–ভাবছি। তুমি অস্থির হয়ো না। চাকরিটা করে যাও।

বীরু, মামার বড় ভয়, তুই সুইসাইডফাইড করবি না তো কখনও?

সুইসাইড। বীরু একটু থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ একটি বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর চোখে, বলে–ভাবিনি তো কখনও!

মনোরম ভীষণ হতাশ হয়ে বলে-ভাবিসনি। তবে কি আমিই তোকে মনে করিয়ে দিলাম?

–দিলে। সুইসাইডের কথা ভাবতে বোধহয় মন্দ লাগে না কখনও কখনও! মাঝে মাঝে ভাবব।

–কেন ভাববি বীরু? ভাবিস না। আমি কথাটা উইথড্র করে নিচ্ছি।

ভয় পেয়ো না। সুইসাইডের চিন্তা কখনও করিনি। চিন্তাটা করতে বোধহয় ভালই লাগবে?

–যদি ওটাও অটো সাজেশানে দাঁড়িয়ে যায়?

বীরু ধীর পায়ে তার ফিয়াটের দিকে হেঁটে চলে গেল। আর ফিরে তাকাল না।

কদিনের মধ্যেই বীরু হেঁটে ফেলল লম্বা চুল, জুলফি। শুধু ছোট একটু গোঁফ রেখে দিল। এই শীতে একটা আধময়লা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতে লাগল। ফিয়াটটা গ্যারেজেই পড়ে থাকে। বীরু হাঁটে। এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। গলিখুঁজিতে চলে যায়। দিশি গাড়িটা নিয়ে বড্ড বিপদে পড়ে গেল মনোরম। এখন আর গাড়িতে বীরুকে অনুসরণ করার মানেই হয় না। সব গলিতে গাড়ি ঢোকে না, তা ছাড়া মানুষের হাঁটার গতির সমান ধীর গতিতে গাড়ি চালানো যায় না সব সময়ে। অতএব গাড়ি ছেড়ে হাঁটা ধরে মনোরম। এবং প্রথম ধাক্কাতেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতদূর হাঁটার অভ্যাস ছিল না তার। তার ওপর লম্বা পায়ে বীরু জোরে হেঁটে যায়, তাল রাখতে গিয়ে দমসম হয়ে পড়ে সে। তবু তীব্র এক আকর্ষণে সে ঠিকই চলে। পিছু ছাড়ে না। বীরু টের পায়। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কখনও হাসে একটু, ম্লান হাসি। কখনও চাপা গলায় বলে-বাক আপ।

বুধবার রাতে বীরুকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যেতে দেখেছে মনোরম। তারপর ফিরে গেছে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। পরদিন সকালে আবার এসেছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সারাদিন বীরু নামল না। দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিল মনোরম। না সাহেব নামেনি। অনেক রাত পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। বীরু নামল না। পরদিনও না।

তৃতীয় দিন মনোরমের বুক কাঁপছিল। দারোয়ান মাথা নেড়ে বলল–কিছু জানি না। এত বড় ফ্লট বাড়ি, কে কখন আসে যায়!

সন্ধেবেলায় চাঁদ ওঠে। মনোরম হেঁটে গেল পার্ক পর্যন্ত। কুয়াশা আছে। হলুদ জ্যোৎস্না। দু-চারজন লোক আছে পার্কে, সঙ্গে কারও কারও প্রেমিকা বা ভাড়াটে মেয়েছেলে। মনোরম পার্কটার একটা কোণে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চেয়ে রইল। বীরুর ঘরে যথারীতি অন্ধকার। তিনদিন ধরে আলো জ্বলছে না ওর ঘরে। মনোরম যখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করল তখন দেখে তার হাত থরথর করে কাঁপছে। পেট ডাকছে কলকল করে। উদ্বেগে সে অনেকক্ষণ কিছু খাওয়ার কথা মনে করেনি।

অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল মনোরম। পার্ক ক্রমে নির্জন হয়ে গেল। সে একা। মি পড়ে তার গা ভিজছে, মাথা ভিজছে। ঠাণ্ডায় চোখে জল আসে। গলায় ব্যথা, একটু একটু কাশি। হাতে পায়ে খিল ধরা ভাব। ঝিঁঝি লেগেছে। এ কয় মাসে বীরুকে সে ভালবেসে ফেলেছিল, তা আজ বুঝতে পারল। ওই অ্যাপার্টমেন্টে কী হয়েছে তা এত রাতে জানতে যেতে সাহস হল না তার। কোত্থেকে একটা রাতচরা পুলিশ ঘেঁটে লাঠি দোলাতে দোলাতে কাছে এসে বলল-কেয়া?

মনোরম মাথা নেড়ে বলে কুছ নহি।

–তব?

 মনোরম হাঁটতে থাকে। পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে রাস্তায় পড়ে। ফিরে আসে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। ঘুমোতে পারে না। স্বপ্ন দেখেনা। তার কোনও ইডিও-মোটর অ্যাকশনও হয় না আজ। রোজ কয়েকবার যে কথাটা তার মনে পড়ে সেই ট্রেন দুর্ঘটনাও মনে পড়ে না। ঘরের বাতি নিবিয়ে সে বসে থাকে জানালার পাশে। সিগারেট খায়। তার নিঃসঙ্গতায় কেবলমাত্র সঙ্গে দেয় নড়ন্ত জিভটা। টুক টুক করে নড়ছে। নড়ছেই। সে বড় মর্মান্তিকভাবে বুঝতে পারে, বীরুকে সে বড্ড ভালবেসে ফেলেছিল। বড় বেশি। বোধ হয় আর কিছু করার নেই।

খুব ভোরবেলা সে আর একবার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশায় গাঢ় আকাশে বহু দূর উঠে গেছে বাড়িটা। অন্ধকার জানালা সব। কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বীরুর জানলায় আলো নেই।

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে থাকে। শীতটা কি খুবই পড়ল এবার? হাত পা সিটিয়ে যাচ্ছে। ভোর-আলোয় দুটো হাত চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে সে। হাত দুটো রক্তহীন, সাদা, আঙুলের ডগায় চামড়া কুঁচকে আছে, অনেকক্ষণ জলে ভিজলে যেমন হয়। শরীরে একটা কাঁপুনি শীতের জন্যই? নাকি অন্তর্নিহিত গুঢ় শোক থেকে উঠে আসছে শরীর জুড়ে এক নিস্তব্ধ ক্রন্দন? নাকি ভয়? অনিশ্চয়তা? হাঁটে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নয়। খানিকটা উদভ্রান্তের মতো।

তবু ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে সে হাজির হয় কাঠগোলায়। বীরুর ফিয়াটটা বাইরে দাঁড়ানো। আপাদমস্তক শিউরে ওঠে মনোরম।

মামা বাইরের চালায় বসে আছে। কী গম্ভীর হয়ে চোখের কোলে কালি পড়েছে। ঘুমহীন জ্বালাভরা চোখ। কষ্টে শ্বাস টানছে।

–তিন দিন তুই দেখাই দিসনি ঝুমু। বীরুর খবর কী?

একই খবর। বীরুর গাড়িটা দেখছিসতর্ক গলায় বলে মনোরম।

গভীর ক্লান্তিতে মামা বলে–আমিই এনেছি ওটা। গ্যারেজে পড়ে আছে, মাঝে মাঝে চালু না করলে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাবে। ওর ঘরে গাড়ির চাবিটা পড়ে ছিল। ভাবলাম নিয়ে বেরোই। কখন হুট করে এসে হাজির হবে, তখন গাড়ি রেডি না পেলেই তো মাথা গরম হবে। তাই ইঞ্জিনটা চালু রাখছি।

–ও।

কী করছে এখন হারামজাদা?

–মামা, এবার আমাকে ছেড়ে দাও। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার সেই বন্ধুর গলায় হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বেশি দিন নেই।

যাবি? বলে যেন হাতের ভর স্বলিত হয়ে যায় মামার। রোগা লম্বা শরীরটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে।

ঝুমু! মামা হাঁফানির খাস টেনে বলে।

–বলো মামা। মনোরম মামার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে কী হয়েছে তোমার?

-শোন, ও যখনই ফিরুক, যবেই ফিরুক, ওর সব সাজানো রইল। ওর ঘর সাজানো আছে, ব্যবসাপত্র সব গুছিয়ে রাখা আছে, ওর গাড়ির ইঞ্জিন আমি চালু রাখছি। ওকে বলিস, আমার যা সাধ্য সব করে রেখেছি ওর জন্য।

বীরু তো সবই জানে মামা।

ভূপতিকে সব বুঝিয়ে গেলাম, তুইও দেখিস।

–তোমার কী হয়েছে?

ঝুমু, প্রদীপ নিবে গেলে একটা তেলপোড়া গন্ধ পাওয়া যায় জানিস তো?

–হ্যাঁ, বিচ্ছিরি গন্ধ।

–সেই গন্ধটা মানুষ যখন আর পায় না, তখনই বুঝতে হবে তার আর মরার দেরি নেই।

 –তার মানে?

–ও একটা তুক। মানুষ মরার আগে নেবানো প্রদীপের সামনে বসেও সেই গন্ধটা পায় না। আমি গতকাল সন্ধের সময়ে পুজোর পর প্রদীপটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে অনেকক্ষণ বসে গন্ধটা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। ঝুমু, আমারও আর দেরি নেই।

–এ সব কথার কোনও মানে হয় না মামা।

–তুই যেন কার সঙ্গে ব্যবসাতে নাবছিস?

বন্ধু।

–যাবিই ঝুমু? কথা দিয়েছি।

–তা হলে যা। ফাঁকে ফাঁকে এসে একটু বীরুকে দেখে যাস। তোর মামিকেও।

–দেখব মামা।

মনোরম কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে আসে। মামা এখনও কিছুদিন টের পাবে না। বীরু তো এরকম কতদিন ডুব দিয়ে থেকেছে। সে রকমই কিছু ভেবে নিশ্চিন্ত থাকবে। মনোরম একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

সামনেই গোল পার্কের ওপর শীতের প্রকাণ্ড আকাশ বোদভরা হয়ে ঝুঁকে আছে। হঠাৎ কলকাতা মুছে যায়। আবছা স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে মনোরম দেখতে পায় ঘাটের পৈঠার মতো দীর্ঘ সব সিঁড়ি। ইস্কুলবাড়ির তিনশো ছেলে সেই সিঁড়িতে সারি সারি দাঁড়িয়ে জোড়হাতে গাইছে–জয় জগদীশ হরে…

বহু দিনের পুরনো সেই আকাশ অতীত থেকে হঠাৎ আজ ঝুঁকে পড়ে মনোরমের চোখের ওপর। হাতের উল্টো পিঠে সে চোখের জল মুছে নেয়।

.

কলকাতায় এবার কি খুব শীত পড়েছে! এত বরাদুরে হাঁটে মনোরম, তবুও শরীর তার কেঁপে ওঠে। হাত দুটো সামনে সিঁটানো। হাঁটে মনোরম। শীত যায় না। গাড়ির শব্দ হয় চারপাশে, মানুষের পদশব্দ থেকে যায় পথে। মনোরম আর কারও পিছু নেয় না কখনও। রাতে সে তার ঠাণ্ডা বিছানায় এসে শোয়। একটু ওম-এর জন্য বড় খুঁতখুঁত করে তার শরীর। চোখ বুজতে না বুজতেই ফুলের পাপড়ির মতো স্বপ্নরা ঝরে পড়ে চোখে। মনে পড়ে সেই দুর্ঘটনা। চমকে উঠে বসে সে। ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে।

টেলিফোনে একদিন বিশ্বাসের নম্বর ডায়াল করল মনোরম অবশেষে।

 গমগমে একটা গলা উত্তর দিল–হ্যালিও…

মনোরম ভাবে, তবে কি ক্যানসার সেরে গেছে বিশ্বাসের! আবার সেই রোগমুক্ত প্রকাণ্ড চেহারাটা লুবাতাসের মতো মুখের ওপর খাস ফেলে বলবে–ব্যানার্জি, বিসোয়াস হিয়ার।

–হ্যালিও….

 মনোরম জিগ্যেস করে–বিশ্বাস?

ও।

-উনি তো হাসপাতালে আছেন।

 –কিছু বলার ছিল?

না। ঠিক আছে।

.

বাড়িভাড়া আবার বাকি পড়ে৷ জমে উঠেছে ঋণ। মনোরম হাঁটে। ওপেনিং খোঁজে পায় না। বয়স হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। তবু হাঁটে মনোরম। এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। সেই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে কখনও যায় না। যায় না মামার কাঠগোলাতেও। বিশ্বাসকে আর কখনও ফোন করেনি মনোরম। থাক, সে কিছুই জানতে চায় না। মনোরময় যেদিন মারা যায়, সেদিন সকালে সে প্রতিবেশীর বাসা থেকে ইস্কুলে বেরিয়ে, বাড়ির দিক থেকে কান্নার রোল শুনে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল ইস্কুলে। প্রার্থনার সারিতে দাঁড়িয়ে কেঁদেছিল। আজও পালায়, অবিকল সেইরকম। কল্পনা করে, মামা রোজ এসে কাঠগোলায় বসছে, নিবন্ত প্রদীপের গন্ধ আবার ফিরে পেয়েছে মামা। বীরু তাকে ফাঁকি দিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বোধহয় পালিয়ে গিয়েছিল মাঝরাতে। তারপর বোধহয় গিয়েছিল গৌরীর কাছে। ওরা দূরে কোথাও আছে, একসঙ্গে। বিশ্বাস অপারেশনের পর ভাল হয়ে আবার দাবড়াচ্ছে তার পুরনো বিদেশি গাড়ি, মদ খাচ্ছে, ফুর্তি করছে, বেশি রাতে বাড়ি ফিরে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ছুঁড়ে দিচ্ছে এক পাটি জুতো…

কল্পনায় সবই থাক। সত্যি কী, তা জানতে চায় না মনোরম। এবারের শীতে কলকাতা বড় সুন্দর। এ রকমই সুন্দর থাক সব কিছু। ভাবতে ভাবতে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। সে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় বিশ্বাসকে, শোঁ করে গাড়িতে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেল-বাই… গ্র্যান্ড হোটেলের উল্টোদকে পার্কিং লট-এ থেমে থাকা ভোঁতামুখ গাড়ি থেকে মামা যেন ডাক দেয় ঝুমু! আর কখনও ভিড়ের মধ্যে সামনে লম্বা বীরু হাঁটতে থাকে। ক্রু কুঁচকে পিছু ফিরে চায়, হাসে কখনও বলেবাক আপ।

অবিকল এইভাবে একদিন সীতাকে দেখতে পায় মনোরম। তখন দুপুর। নিউ মার্কেটের ছায়ায় ছায়ায় শীত গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল মনোরম। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন। গায়ে সাদার ওপর সবুজ বরফিওলা পুলওভার, মার্কিনি ছাঁটের প্যান্ট পরনে, পায়ে ক্রোকোডাইল মোকাসিন। ছায়া, তবু রোদ চশমাটাও ছিল চোখে, হঠাৎ দেখে, উল্টোদিক থেকে সীতা হেঁটে হেঁটে আসছে। পুরনো স্বভাব সীতার, দোকানের সাজানো জিনিস দেখছে নিচু হয়ে। এক পা এক পা করে হেঁটে আসে সীতা।

স্বপ্নই। বিভ্রম। এক্ষুনি কল্পনার সীতা মিলিয়ে যাবে। তবু যতক্ষণ তাকে দেখা যায় ততক্ষণ দেখবে বলে চোখে পিপাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে মনোরম। বহু দিন সীতাকে দেখেনি। সেই কতদিন আগে দেখেছিল এসপ্ল্যানেডের চাতালে, মেঘভাঙা রোদে। মহার্ঘ মানুষের মতো মাটি থেকে যেন একটু ওপরে শূন্যে পায়ের আলপনা ফেলে চলে গিয়েছিল। প্রাকৃতিক আলোগুলি রঙ্গমঞ্চের ফোকাসের মতো এসে পড়েছিল ওর গায়ে। তারপর বহুদিন বাদে আবার কল্পনায় দেখা হল। মনোরম চেয়ে থাকে।

সীতা হেঁটে আসছে। কাল্পনিক। তবু অপেক্ষা করে মনোরম। যদি তাকে না দেখে এরকমই হেঁটে আসতে থাকে, তবে সোজা এসে মনোরমের বুকে ধাক্কা খাবে। ঠিক যেমন স্থবির গাড়িতে চলন্ত ইঞ্জিন এসে লেগে যায়। সেই বিভ্রম, সেই প্রবল কাল্পনিক সংঘর্ষের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে মনোর। সীতা অনন্ত পথ পার হয়ে আসছে। একটু একটু করে। বড় একটা দোষ ছিল ওর, যা খুশি কিনে আনত। কলকাতার দোকান ছেয়ে গেছে নকল দু নম্বর মালে। রোজ ঠকে আসত। বকত মনোরম। ঠিক সেই রকমই বালিকার মতো অপার কৌতূহলভরা চোখে দোকানের সাজানো জিনিস দেখছে আজও। মনোরমকে দেখেনি। সচেতন নয়। মনোরমের বিভ্রমের পথ ধরে আসছে সীতা, কল্পনা, স্বপ্ন।

.

মনোরম ভুল করেছিল।

সীতা তাকে দেখেছিল ঠিকই। দোকানের আয়নায় প্রতিবিম্বিত মনোরমকে। একটু চমক কি লেগেছিল? কে জানে! কিন্তু সেই মুহূর্তেই ভুল হয়ে গেল বিচ্ছেদ, অন্য এক পুরুষ, বহুকালের অদর্শন। তীব্র অভিমানে ফুলে উঠল সীতার বালিকা-মুখের দুটি ঠোঁট, জ কুঁচকে গেল।

একটুও ভাবল না সীতা, অপেক্ষা করল না, কোনও ভূমিকাও না। কিশোরীর মতো দ্রুত নৃত্য-ছন্দে কয়েক পা দৌড়ে গেল মনোরমের দিকে। বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কৃশ, সাদা মুখখানা তুলে ধরে বলল আমার যে কী ভীষণ অসুখ করেছিল।

 মনোরম তাকিয়েই থাকে। বিভ্রম?

সীতা তার রোগা, পাণ্ডুর ডান হাতখানা তুলে নিঃসংকোচে তাকে দেখাল, বলল–দেখো কত রোগা হয়ে গেছি!

পৃথিবীতে মানুষের আয়ু খুব বেশিদিন নয়। বনে যাচ্ছে সময়। দ্রুত, কলস্বরা। মনোরম তাই বিনা প্রশ্নে সীতার রোগা হাতখানা ছুঁল। সেই মুহূর্তেই তাদের চারধার থেকে কলকাতা মুছে যাচ্ছিল। জেগে উঠল বনভূমি। অদূরে নদীর শব্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *