৭. অফিসার

অফিসার

রাইখ… সেলডনের নিজের ভাষ্যমতে রাইখের সাথে তার দেখা হওয়াটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। রাইখ ছিল নাম পরিচয়হীন, আশ্রয়হীন বালক। সেলডন তার। কাছে পথের হদিস জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই তার। জীবনের সাথে রাইখের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়, যতদিন না…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৭৭.

পরের দিন সকালে শেভ এবং গোসল সেরে শুধু একটা পাজামা পরে ডর্সের দরজায় শব্দ করলেন সেলডন। দরজা খুলল ডর্স। তার লালচে সোনালি বর্ণের কোঁকড়ানো চুলগুলো তখনো ভেজা। পরনে শুধু একটা পাজামা। উর্ধাঙ্গ নিরাভরণ।

বিব্রত হয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন সেলডন। মাথা নামিয়ে নিজের বুকের দিকে তাকালো ডর্স, তারপর একটা তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো ঢাকল। কী ব্যাপার, জিজ্ঞেস করল সে।

ডানদিকে তাকিয়ে সেলডন বললেন, আমি তোমাকে ওয়ির কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম।

স্বাভাবিক গলায় জবাব দিল ডর্স, কেন এবং কী? আর দয়া করে আমাকে বাধ্য করো না তোমার কানের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে। নারী সংসর্গের অভিজ্ঞতা তোমার নিশ্চয়ই আছে।

খানিকটা আহত বোধ করলেন সেলডন, আমি শুধু ভদ্র থাকার চেষ্টা করছি। তুমি যদি কিছু মনে না করো তাহলে আমারও কিছু আসে যায় না। আর কেন এবং কী নয়। আমি ওয়ি সেক্টরের কথা জানতে চাই।

কেন জানতে চাও? বা পরিস্কার করে বলতে গেলে : ওয়ি কেন?

দেখো, ডর্স, আমি সিরিয়াস। প্রতি দশটা কথার একটাতে ওয়ির নাম আমার কানে আসছে–প্রকৃতপক্ষে ওয়ির মেয়রের কথা। হামিন তার কথা বলেছে, তুমি বলেছ, ডাভান বলেছে। অথচ আমি এই সেক্টর বা তার মেয়র সম্বন্ধে কিছুই জানি না।

আমি ট্র্যান্টরের স্থায়ী বাসিন্দা নই, তাই বেশি কিছু জানি না। তবে যা জানি সেটা তোমাকে বলতে কোনো আপত্তি নেই। ওয়ি দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি বেশ বড়ো এবং যথেষ্ট জনবহুল-

দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি এবং জনবহুল?

আমরা এখন যেখানে আছি সেটা হ্যালিকন বা সিনা নয়। এটা ট্র্যান্টর। এখানে সবকিছুই আন্ডারগ্রাউন্ডে আর আন্ডারগ্রাউন্ডে বিষুবরেখা বা দক্ষিণ মেরু সবই প্রায় একরকম। অবশ্য আমার মনে হয় ওদের দিন রাতের ব্যবধান একটু বেশি। গ্রীষ্মকালে দীর্ঘ দিন শীতকালে দীর্ঘ রাত। সারফেসে মেরু অঞ্চলে ঠিক এইরকমই হওয়ার কথা। এটা শুধুই একটা কৃত্রিমতা, ওরা মেরু অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে বেশ গর্বিত।

কিন্তু আপারসাইডে নিশ্চয় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।

হ্যাঁ, ওয়ির আপারসাইডে শুধু তুষার আর বরফ। কিন্তু তুমি যেমন ভাবছ তেমন গভীর নয়। হলে গম্বুজে ফাটল ধরত, ভেঙ্গে পড়ত। সেরকম হয়নি এবং এটাই হচ্ছে। ওয়ির ক্ষমতার মূল উৎস।

বরফের স্তর আর ওয়ির ক্ষমতার মাঝে সম্পর্ক কী?

ভেবে দেখো। ট্র্যান্টরের চল্লিশ বিলিয়ন মানুষ বিপুল পরিমাণ শক্তি ব্যবহার করে। প্রতি ক্যালোরি শক্তি থেকে বিপুল তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপ ডিসচার্জ করতে হবে। প্রথমে পাইপের সাহায্যে উৎপন্ন তাপ মেরু অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিণ মেরুতে পাচার করা হয়, কারণ দুটোর মধ্যে ওটাই সবচেয়ে বেশি উন্নত। সেখান থেকেই তাপ মহাশূন্যে ডিসচার্জ করা হয়। তার জন্যই উপরের রাশি রাশি বরফ গলে যাচ্ছে। আমার মতে, আবহাওয়াবিদরা যাই বলুক না কেন গম্বুজের উপরে ট্র্যান্টরের আকাশে ঘন মেঘ এবং অবিরাম বৃষ্টিপাতের এটাই কারণ।

ডিসচার্জ করার আগে কী ওয়ি সেই শক্তি ব্যবহার করে?

বোধহয়, আমি যতদূর জানি। তাপ ডিসচার্জ করার কলাকৌশলের ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, কিন্তু আমি বলছি রাজনৈতিক শক্তির কথা। ডাহল যদি শক্তি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় তাহলে ট্র্যান্টরে অবশ্যই সমস্যা হবে, কিন্তু আরো অনেক সেক্টর শক্তি উৎপাদন করে এবং প্রয়োজনে তারা তাদের উৎপাদনের মাত্রা। বাড়াতে পারবে। এটা ঠিক যে ডাল যদি সেইরকম ঝামেলা তৈরি করে তবে সেটা শক্ত হাতে দমন করতে হবে কিন্তু তা ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে করা যাবে। অন্যদিকে, ওয়ি-

হ্যাঁ?

উৎপাদিত তাপের শতকরা নব্বই ভাগ ওয়ি ডিসচার্জ করে এবং ওয়ির কোনো বিকল্প ট্র্যান্টরের হাতে নেই। যদি ওরা তাপ বের করে দেওয়ার পথগুলো বন্ধ করে দেয় তাহলে পুরো ট্র্যান্টরেই তাপমাত্রা দ্রুতহারে বাড়তে থাকবে।

ওয়িতেও বাড়বে?

হ্যাঁ, কিন্তু ওয়ি যেহেতু দক্ষিণ মেরুতে ওরা শীতল বায়ু প্রবাহের একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারবে। যদিও খুব একটা লাভ হবে না, কিন্তু ওয়ি বাকি ট্র্যান্টরের চেয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে। মূল বিষয়টা হচ্ছে ওয়ি সম্রাটের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটা সমস্যা এবং ওয়ির মেয়র প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারবে।

ওয়ির বর্তমান মেয়র কেমন মানুষ?

আমি জানি না। তবে যা শুনেছি সেগুলো যোগ বিয়োগ করে বলা যায় যে বর্তমান মেয়র বুড়ো এবং প্রায় পুরোপুরিই অথর্ব, অথচ এখনো হাইপারশিপ-এর হালের মতো দৃঢ় মনোবলের অধিকারী এবং সীমাহীন চাতুর্যের সাথে ক্ষমতা দখলের পুরনো খেলা চালিয়ে যাচ্ছে।

ভাবছি, কেন? সে যদি অথর্ব বৃদ্ধই হয় তাহলে ক্ষমতা পেলেও তো তা বেশিদিন উপভোগ করতে পারবে না।

এই প্রশ্নের জবাব তোমাকে কে দেবে, হ্যারি? হয়তো এটা তার সারাজীবনের একটা মোহ। বা বলা যায় এটা একটা খেলা… ক্ষমতা দখলের। মেয়র যদি ডেমারজেলের পদটা পেয়ে যায় বা কোনোভাবে সিংহাসনে বসতে পারে তখন দেখা যাবে যে তার আনন্দ অর্ধেকটাই মাটি হয়ে গেছে কারণ চমৎকার একটা খেলা শেষ হয়ে গেল যে। অবশ্য, তারপরেও যদি সে বেঁচে থাকে তখনো সে ক্ষমতা ধরে রাখার খেলা চালিয়ে যেতে পারবে যা একইরকম কঠিন কাজ এবং একইরকম আনন্দদায়ক।

মাথা নাড়লেন সেলডন। আমার মনে হচ্ছে কেউই বোধহয় সম্রাট হতে চায় না।

কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষই চায় না। আমি একমত, কিন্তু রাজক্ষমতা বলে একটা কথা আছে। জিনিসটা ভয়াবহ রোগের মতো। যাকে একবার ধরে তাকে পুরোপুরি উন্মাদ বানিয়ে ছাড়ে। যতই উঁচু পদে উঠবে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। প্রতিটা পদোন্নতির সাথে সাথে

রোগটা আরো বেশি নিরাময় অযোগ্য হয়ে উঠবে, বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার এটাও মনে হচ্ছে যে ট্র্যান্টর সুবিশাল এক বিশ্ব। এখানে সবকিছুই অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত এত বেশি যে শুধু এই কারণেই শাসন। পরিচালনা করা সম্রাটের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তাহলে কেন তিনি ট্র্যান্টর ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে চলে যাচ্ছেন না?

ডর্স হাসল। ইতিহাস জানা থাকলে প্রশ্নটা তুমি করতে না। ঐতিহ্যগতভাবেই হাজার বছর ধরে এম্পায়ার বলতে ট্রান্টরকে বোঝায়। যে সম্রাট ইম্পেরিয়াল প্যালেসে বাস করে না সে আদতে সম্রাটই নয়। সম্রাট যতটা না ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি স্থান।

গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন সেলডন, বেশ অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও কথা বলছেন না দেখে ডর্স জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, হ্যারি?

ভাবছি, বিড় বিড় করেই জবাব দিলেন সেলডন। তুমি হ্যান্ড-অন-থাই স্টোরি বলার পর থেকেই আবছাভাবে কী যেন একটা মনে পড়ি পড়ি করেও পড়ছে না। আর এখন যখন তুমি বললে যে সম্রাট যতটা না ব্যক্তি তার চেয়ে বেশি স্থান তখন মনে হলো যেন মাথার ভেতরে লুকানো কোনো তারে একটা টোকা পড়ল।

মানে?

মাথা নাড়লেন সেলডন। এখনো ভাবছি। আমার ভুলও হতে পারে। তীক্ষ্ণ চোখে ডর্সের দিকে তাকলেন তিনি। যাইহোক। নিচে গিয়ে বরং নাস্তা সেরে ফেলা উচিত। অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং মিস্ট্রেস টিসালভার বোধহয় আমাদের আপ্যায়ন করার মুডে নেই।

তুমি তো তাও কিছুটা আশাবাদী। আমার তো মনে হয় মহিলা পারলে এখনই আমাদের বের করে দেন–ব্রেকফাস্ট তো দূরের কথা।

হয়তো বা, কিন্তু আমরা তাকে ভাড়া দিচ্ছি।

হ্যাঁ, কিন্তু এখন তিনি আমাদের এত বেশি ঘৃণা করেন যে পারলে সব ক্রেডিট ফেরত দিয়ে দেবেন।

তার স্বামী আশা করি ভাড়ার কারণে আমাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতিশীল হবে।

যদি নিজের মতামত খাটানোর ক্ষমতা ভদ্রলোকের থাকে। লোকটা যদি আমাদের পক্ষে কোনো কথা বলে তাহলে আমার চেয়ে বেশি অবাক হবে না কেউ।–বাদ দাও, চলো যাওয়া যাক।

.

৭৮.

ক্যাসিলিয়া টিসালভার একটা দৃঢ় খুটির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কুর হাসি, প্রতিহিংসায় চোখগুলো চকচক করছে। তার স্বামী গম্ভীর মুখে একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ঠিক মাঝখানে আরো দুজন লোক, দুজনেই পিঠ সোজা করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো।

দুজনের চুলই কোঁকড়ানো এবং কালো, ঠোঁটের উপরে পাতলা গোঁফ। গাঢ় রংয়ের পোশাক পরিচ্ছদ। বুঝতে অসুবিধা হয় না এগুলো ইউনিফর্ম। জামার হাতার দুপাশে কব্জির কাছ থেকে কলারের প্রান্ত পর্যন্ত এবং ট্রাউজারের দুপাশের বাইরের প্রান্ত দিয়ে সাদা পাইপিং আছে। দুজনেরই ইউনিফর্মের ডানদিকে বুকের উপরে স্পেস শিপ এবং নক্ষত্রের চিহ্ন, গ্যালাক্সির প্রতিটা বাসযোগ্য গ্রহে এটাই এম্পায়ারের প্রতীক, এক্ষেত্রে অবশ্য নক্ষত্রের ঠিক মাঝখানে আরো গাঢ় রংয়ের একটা D আঁকা।

সেলডন লোকদুটোকে দেখেই বুঝে নিয়েছেন যে এরা ডাহ্‌লাইট সিকিউরিটি ফোর্সের লোক।

কী ব্যাপার? কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

একজন সামনে এগোল। আমি সেক্টর অফিসার লিনাল রাস। আমার সঙ্গী জীবের অস্টিনওয়াল।

দুজনেই চকচকে আইডেন্টিফিকেশন হলো-ট্যাব বের করে দেখালো। ওগুলো নিয়ে মাথা ঘামালেন না সেলডন। কী চান আপনারা?

আপনি হ্যালিকনের হ্যারি সেলডন? শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল রাস।

আর আপনি মিস্ট্রেস, সিনার ডর্স ভেনাবিলি?

হ্যাঁ। জবাব দিল ডর্স।

আমি একটা অভিযোগের তদন্ত করতে এসেছি। গতকাল হ্যারি সেলডন নামে এক ব্যক্তি এখানে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছিল।

আমি ওরকম কিছু করিনি, সেলডন বললেন।

আমার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ছোট একটা কম্পিউটার প্যাড-এর দিকে তাকিয়ে রাস বলল, আপনারা একজন সাংবাদিককে ইম্পেরিয়াল এজেন্ট বলে তার বিরুদ্ধে লোকজনকে খেপিয়ে তুলছিলেন।

কথাগুলো আমি বলেছিলাম, অফিসার। লোকটাকে ইম্পেরিয়াল এজেন্ট ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল। নিজের মতামত প্রকাশ করাটা নিশ্চয়ই কোনো অপরাধ নয়।

এম্পায়ারে ছোট বড়ো সকলেরই বাক স্বাধীনতা রয়েছে।

এই কথা বলে ইচ্ছাকৃতভাবে দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগ এড়িয়ে যেতে পারবেন। না।

আপনি কীভাবে প্রমাণ করবেন যে আমরা দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছিলাম, অফিসার?

এবার মিস্ট্রেস টিসালভার তীক্ষ্ণ খ্যানখ্যানে গলায় বলল, আমি সব দেখেছি, অফিসার। এই মেয়েটা যখন দেখল যে বাইরে রাজ্যের সব চোর গুন্ডা বদমাশ ভিড় করেছে তখন সে ইচ্ছে করেই বলেছে যে সাংবাদিক আসলে ইম্পেরিয়াল এজেন্ট। জোরে জোরে বলেছে যেন সবাই শুনতে পারে এবং খেপে উঠে। সে জেনে বুঝেই কাজটা করেছে।

ক্যাসিলিয়া, অনুরোধের সুরে বলল মাস্টার টিসালভার কিন্তু স্ত্রী একবার কড়া চোখে তাকাতেই চুপসে গেল।

মিস্ট্রেস টিসালভারের দিকে ঘুরল রাস। অভিযুক্তদের কী আপনি এখানে থাকতে দিয়েছিলেন, মিস্ট্রেস?

হ্যাঁ, ওরা দুজন বেশ কিছুদিন ধরেই এখানে থাকছে, কিন্তু এই কয়দিনে সমস্যা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি। ছোট লোক গুন্ডা বদমাশদের বাড়িতে ডেকে এনে প্রতিবেশীদের কাছে আমাদের মানমর্যাদা খাটো করেছে।

এটা কী কোনো বেআইনী কাজ, অফিসার? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন। ডালাইটের কোনো নাগরিককে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করা। উপরের দুটো কামরা আমাদের। ওগুলোর জন্য গুনে গুনে ভাড়া দিচ্ছি। ডাহ্নাইটের কোনো নাগরিকের সাথে কথা বলা কী অপরাধ, অফিসার?

না, তা নয়। রাস বলল, সেটা নিয়ে কোনো অভিযোগও নেই। আচ্ছা, মিস্ট্রেস ভেনাবিলি, আপনি কীভাবে বুঝলেন যে লোকটা ইম্পেরিয়াল এজেন্ট?

লোকটার গোঁফ ছিল ছোট এবং বাদামী রংয়ের, আমি বুঝতে পারি যে সে ডালাইট নয় এবং অনুমান করে নেই যে সে ইম্পেরিয়াল এজেন্ট।

অনুমান করে নেন? আপনার সঙ্গী মাস্টার সেলডনের তো গোঁফই নেই। তাহলে কী ধরে নেবেন যে তিনিও ইম্পেরিয়াল এজেন্ট?

যাইহোক, বিরক্ত সুরে বললেন সেলডন, কোনো ধরনের দাঙ্গা ফ্যাসাদ হয়নি। যারা ভিড় করেছিল তাদের আমরা বলে দিয়েছিলাম যেন ওই সাংবাদিক বা এজেন্ট সে যাইহোক না কেন তার যেন কোনো ক্ষতি না করে। আমি নিশ্চিত যে ওরা। তার কোনো ক্ষতি করেনি।

আপনি নিশ্চিত, মাস্টার সেলডন? আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অভিযোগটা তুলেই আপনারা সেখান থেকে সরে পড়েন। তারপরে কী ঘটেছে সেটা কী আপনি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন?

না, পারব না, কিন্তু লোকটা কী মারা গেছে? আহত হয়েছে?

আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ইম্পেরিয়াল এজেন্ট এই অভিযোগ সে জোর গলায় অস্বীকার করেছে। আমাদের হাতেও তেমন কোনো তথ্য প্রমাণ নেই। সে এটাও দাবী করেছে যে ঘটনার সময় তার সাথে চরম অপমানজনক দুর্ব্যবহার করা হয়।

আমার মতে সে দুটো বিষয়েই মিথ্যা কথা বলেছে, সেলডন বললেন, আমি বরং সাইকিক ভোব ব্যবহার করার পরামর্শ দেব।

অপরাধের স্বীকার কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। রাস বলল। সেক্টর গভর্নমেন্ট এই ব্যাপারে অত্যন্ত কড়া। বর্তমান ক্ষেত্রে যেহেতু আপনারাই অপরাধী, তাই আপনাদের উপরেই হয়তো সেটা প্রয়োগ করা হবে। আপনারা কী চান আমরা। সেটা ব্যবহার করি?

সেলডন এবং ডর্স দ্রুত দৃষ্টি বিনিময় করলেন। তারপর সেলডন বললেন, না, অবশ্যই না।

অবশ্যই না, পুনরাবৃত্তি করল রাস। কিছুটা ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে, অথচ অন্য কারো উপর প্রয়োগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন ঠিকই।

দ্বিতীয় অফিসার, অস্টিনওয়াল এই পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি, এবার মুচকি একটু হাসল।

রাস বলল, আমাদের কাছে আরো তথ্য আছে। দুদিন আগে আপনারা বিলিবটনে নাইফ ফাইট করেছেন এবং একজন ডাহ্‌লাইট নাগরিককে মারাত্মক আহত করেছেন। তার নাম–কম্পিউটারের আরেকটা বোতামে চাপ দিল সে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, এলিন ম্যারন।

লড়াইটা কীভাবে শুরু হয়েছিল সেই তথ্য কী আপনার কাছে আছে? জিজ্ঞেস করল ডর্স।

এই মুহূর্তে সেটা অপ্রাসঙ্গিক, মিস্ট্রেস। লড়াই হয়েছিল আপনারা সেটা অস্বীকার করছেন?

অবশ্যই অস্বীকার করছি না। রাগের সাথে বললেন সেলডন। শুধু লড়াইটা আমরা শুরু করেছিলাম সেটা অস্বীকার করছি। আমরা আক্রান্ত হয়েছিলাম। ম্যারন নামের লোকটা মিস্ট্রেস ভেনাবিলির সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করে। পরবর্তীতে যা ঘটে সেটা নিখাদ আত্মরক্ষা ছাড়া আর কিছুই না। নাকি ডাহলে মেয়েদের সম্ভ্রমহানি তেমন কোনো অপরাধ নয়?

রাসের কণ্ঠস্বরে অতি সূক্ষ্ম বিরক্তির আভাস ফুটে উঠল, বলছেন আক্রান্ত হয়েছিলেন। কতজন ছিল ওরা?

দশজন।

আর আপনারা একজন আবার মহিলা–দুজনে মিলে দশজন শক্ত সমর্থ পুরুষের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করেছেন?

মিস্ট্রেস ভেনাবিলি এবং আমি দুজনে মিলে ওদের প্রতিহত করেছি, হ্যাঁ।

অথচ আপনাদের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি। কোন যাদুমন্ত্রে এটা সম্ভব হলো? নাকি শরীরের এমন জায়গায় কেটেছে যা সবার সামনে দেখাতে পারছেন না?

না, অফিসার।

কীভাবে সম্ভব? আপনি সাথে একজন মহিলাকে নিয়ে–দশজনের বিরুদ্ধে লড়াই করলেন, অথচ সামান্য আঘাতও পেলেন না? কিন্তু ম্যারন এমনভাবে আহত হয়েছে যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে তাকে। স্বাভাবিক চেহারা ফিরে পেতে হলে তার উপরের ঠোঁটে স্কিন ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

আমরা বেশ ভালোভাবে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছি, গম্ভীর সুরে বললেন সেলডন।

অবিশ্বাস্য রকম ভালো। যদি বলি যে আপনারাই ম্যারনকে অতর্কিতে হামলা। করে মারাত্মক আহত করেছেন এবং সেই ঘটনার তিনজন সাক্ষীও আছে, কী জবাব দেবেন?

শুধু এইটুকুই বলব যে আপনার বক্তব্য পুরোপুরি অবিশ্বাস্য। আমি নিশ্চিত যে সন্ত্রাসী এবং নাইফম্যান হিসেবে ম্যারনের অত্যন্ত বাজে রেকর্ড আছে। আপনাকে তো বলেছি যে ওরা ছিল দশজন। এটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে তাদের অন্তত ছয়জন মিথ্যে কথা বলেনি। বাকি তিনজন কী আপনাকে বলেছে যে যখন তাদের আমরা। অতর্কিতে হামলা করি, প্রাণ সংশয় দেখা দেওয়ার পরেও বন্ধুকে বাঁচাতে তারা এগিয়ে আসেনি কেন? কাজেই আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে ওরা মিথ্যে কথা বলেছে।

আপনি তাহলে সাইকিক প্রোবের পরামর্শ দিচ্ছেন?

হ্যাঁ, এবং আপনি বলার আগেই জানিয়ে রাখছি আমাদের উপর সেটা প্রয়োগ করার পরামর্শ কখনোই দেব না।

আমাদের কাছে আরো তথ্য আছে যে গতকাল দাঙ্গার ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর। আপনারা ডাভান নামে এক ব্যক্তির সাথে দেখা করেন। এই ডাভান কুখ্যাত এক বিদ্রোহী। সিকিউরিটি পুলিশ তাকে অনেকদিন থেকেই খুঁজছে। কথাটা সত্যি?

আমাদের সাহায্য ছাড়াই সেটা আপনাকে প্রমাণ করতে হবে, অফিসার। সেলডন বললেন। আমরা আপনার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।

কম্পিউটার প্যাড বন্ধ করে পকেটে রেখে দিল রাস। আপনাদেরকে আমাদের সাথে হেডকোয়ার্টারে যেতে হবে। আরো জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন।

তার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, অফিসার। আমরা আউটওয়ার্ল্ডার এবং কোনো অপরাধ করিনি। আমরা শুধু একজন বিরক্তিকর সাংবাদিককে এড়ানোর চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি সম্ভ্রমহানি এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। অনেক ডাক্লাইটের সাথেই কথা বলেছি আমরা। কাজেই আরো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া শুধু শুধু হয়রানি করা ছাড়া আর কিছুই না।

ভালো মন্দের সিদ্ধান্ত নেব আমরা, রাস বলল। যাচ্ছেন আমাদের সাথে।

 না, আমরা যাব না। ডর্স বলল।

 সাবধান! চিৎকার করে বলল মিস্ট্রেস টিসালভার। ওর কাছে দুটো ছুরি আছে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাস। ধন্যবাদ। আমি জানি। ঘুরল ডর্সের দিকে। আপনি জানেন এই সেক্টরে অনুমতি ছাড়া নিজের কাছে ছুরি রাখা মারাত্মক অপরাধ? আপনার অনুমতি আছে?

না, অফিসার নেই।

বুঝতে পারছেন কী যে এতে আপনাদের অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ?

সাথে ছুরি রাখাটা বেআইনি কিছু না, অফিসার, ডর্স বলল, বুঝতে পেরেছেন? আমি নিশ্চিত ম্যারনের কাছে যে ছুরিটা ছিল সেটার জন্যও তার কোনো অনুমতি নেই।

ম্যারনের কাছে ছুরি ছিল সেরকম কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। তাছাড়া বরং ম্যারনই ছুরির আঘাতে আহত হয়েছে।

অবশ্যই তার কাছে ছুরি ছিল, অফিসার। আপনি কী বোঝাতে চাইছেন যে বিলিবটনের সবাই এবং ডাল সেক্টরের অধিকাংশই বিনা অনুমতিতে ছুরি বহন করে এটা আপনি জানেন না। তাহলে বলতেই হচ্ছে যে ডাহলে আপনিই একমাত্র মূর্খ। এখানে অনেক দোকানেই সবার চোখের সামনে ছুরি বিক্রি করা হয়।

আমি কী জানি বা না জানি সেটা অপ্রাসঙ্গিক। অন্যেরা কে আইন মানছে বা ভঙ্গ করছে তারও কোনো গুরুত্ব নেই। আসল কথা হচ্ছে যে মিস্ট্রেস ভেনাবিলি বিনা। অনুমতিতে ছুরি রেখে আইন ভঙ্গ করেছেন। ওগুলো আমার কাছে দিন, মিস্ট্রেস তারপর দুজনেই হেডকোয়ার্টারে চলুন।

ঠিক আছে, যদি পারেন তো আমার কাছ থেকে নিয়ে যান। ডর্স বলল।

আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল রাস। কেন ভাবছেন যে ডালে ছুরিই একমাত্র অস্ত্র। বা আমি ছুরি দিয়ে আপনার সাথে লড়াই করব। আমাদের দুজনের কাছেই ব্লাস্টার আছে। আপনার যতই দক্ষতা থাকুক ওগুলো বের করার আগেই খুন হয়ে যাবেন। যেহেতু মেরে ফেলার কোনো ইচ্ছা নেই তাই ব্লাস্টার ব্যবহার করব না। কিন্তু নিউরোনিক হুইপ ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধা নেই। ওগুলো স্থায়ী কোনো ক্ষতি করে না, শরীরে কোনো চিহ্নও থাকবে না। আমার সঙ্গী তার হুইপ এই মুহূর্তে আপনাদের দিকে তাক করে রেখেছে। আর এই যে আমারটা।–এবার, ছুরিগুলো দিয়ে দিন মিস্ট্রেস ভেনাবিলি।

কামরা জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে এল, তারপর সেলডন বললেন, কোনো লাভ নেই, ডর্স। দিয়ে দাও।

ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার কাছ থেকে কর্ণবিদারক এক চিৎকার শোনা গেল।

.

৭৯.

ওদেরকে অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিয়ে আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করতে লাগল রাইখ।

ডাভানের অনুচরেরা তাকে ভালোই খাইয়েছে। মোটামুটি কাজ করে সেরকম একটা বাথরুম খুঁজে পাওয়ার পর ওজন কমানোর ব্যবস্থাও হয়ে যায়। তারপর ছোটোখাটো একটা ঘুম। তার আসলে এই মুহূর্তে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। বাড়ি একটা আছে বটে সেটা না থাকারই মতো। মা আছে কিন্তু এমন না যে সে বাড়ি ফিরল না বলে ভয়ে দুঃশ্চিন্তায় মায়ের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।

বাবাকে সে কোনোদিন চোখে দেখেনি, কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবে তার কী আসলেই বাবা ছিল। সবাই বলে যে ছিল নইলে তার জন্ম হলো কীভাবে। তাদের বলার ভঙ্গিটা সর্বদাই ছিল ভীষণ নিষ্ঠুর। শোনা কথাগুলো বিশ্বাস করবে কী না মাঝে মাঝে এটাও বুঝতে পারত না সে।

তবে এই আউটওয়ার্ল্ডার মহিলা অন্যরকম। বয়স অনেক হলেও দেখতে চমৎকার এবং পুরুষদের মতো লড়াই করতে পারে–বরং বলা চলে যে পুরুষদের চেয়ে অনেক ভালো। এই ব্যাপারটাই মহিলার প্রতি তার ভক্তি বাড়িয়ে তুলেছে।

এবং সে তাকে গোসল করতে বলেছিল। যখন পকেটের ক্রেডিটগুলো অন্য কোথাও খরচ করার জায়গা থাকত না শুধু তখনই সে বিলিটনের সুইমিং পুলে সাঁতার কাটত। শুধু তখনই পুরো শরীর ভেজাত এবং গায়ের পানি, ভেজা জামাকাপড় না শুকানো পর্যন্ত ঠাণ্ডায় কষ্ট করতে হত।

গোসল জিনিসটা অন্যরকম। গরম পানি, সাবান, তোয়ালে, উষ্ণ বাতাস। ব্যাপারটা যে কেমন সে কোনোদিন অনুভব করেনি, তবে নিশ্চয়ই চমৎকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জীবনটা তার ফুটপাথেই কেটেছে। তাই এমন একটা জায়গা খুঁজে পেতে বেশি একটা কষ্ট হলো না যেখানে কাছাকাছি একটা বাথরুম আছে এবং তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। আবার প্রয়োজন হলে দৌড়ে পালাতেও পারবে।

রাতটা কেটে গেল এলোমেলো অনেক চিন্তা ভাবনা করে। যদি লেখাপড়া শিখে? তাহলে কী কিছু করে খেতে পারবে? কী করবে সে জানে না, কিন্তু মহিলা হয়তো তাকে বলে দিতে পারবে। আবছা আবছা ধারণা আছে যে কিছু কিছু কাজ করে উপার্জন করা যায়। কিন্তু সেই কাজগুলো কী বা কেন, কেমন করে করতে হয় এই মুহূর্তে সে জানে না। হয়তো জেনে নিতে পারবে, কিন্তু কে জানাবে তাকে?

আউটওয়ার্ল্ডারদের সাথে থাকলে হয়তো ওরা সাহায্য করবে, কিন্তু ওরা তাকে সাথে রাখবে কেন?

তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল হঠাৎ করে। ভোর হচ্ছে। চারপাশে শুরু হয়েছে কর্মমুখর আরেকটি দিনের কোলাহল। কিন্তু সব ছাপিয়ে তার কানে একটা তীক্ষ্ণ গম্ভীর শব্দ ভেসে আসছে।

প্রতিটি শব্দের আলাদা অর্থ বের করা শিখেছে সে, কারণ বিলিটনের আন্ডারগ্রাউন্ড গোলাকধাঁধায় ন্যূনতম নিরাপত্তার জন্যই চোখে দেখার আগে কেবল শুনেই বুঝে নিতে হবে সব। এই এখন যে গ্রাউন্ড কারের শব্দ শুনছে তাতে এমন কিছু আছে যার ফলে সে বিপদটা ঠিকই চিনে নিতে পারল।

চট করে সজাগ হলো রাইখ, ফুটপাথ ধরে কিছুদূর এগোল। স্পেস শিপ এবং নক্ষত্র চিহ্ন দেখার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না। জানে কারা আসছে এবং কেন আসছে। আউটওয়ার্ল্ডার দুজনকে ধরার জন্য আসছে ওরা। কারণ দুজনেই ডাভানের সাথে দেখা করেছে। তার ধারণা ভুল না সঠিক তা ভেবে এক সেকেন্ডও নষ্ট করল না। ঝড়ের বেগে দৌড়াতে শুরু করল।

ফিরে এলো ঠিক পনেরো মিনিট পরে। গ্রাউন্ড কারটা এখনো আছে। ভিড় জমে গেছে চারপাশে। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কৌতূহলের সাথে দেখছে সবাই। দুপদাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সঠিক দরজা চেনার চেষ্টা করছে। এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই।

অবশেষে সঠিক দরজা খুঁজে পেল–অন্তত ধরে নিল এটাই হবে–শব্দ করল জোরে, একই সাথে চিৎকার করে বলল, লেডি লেডি!

উত্তেজনায় মেয়েলোকটার নাম ভুলে গেলেও পুরুষলোকটার প্রথম নামটা মনে পড়ল, হ্যারি, চিৎকার করে ডাকল, দরজা খুলেন।

দরজা খোলার পর সে দ্রুত ভিতরে ঢুকে পড়ল। অফিসারদের একজন শক্ত হাতে থামালো তাকে। দাঁড়াও খোকা, কোথায় যাচ্ছ?

ছাড়েন আমারে! আমি কিছু করি নাই। চারপাশে তাকালো সে। হেই, লেডি, কী করতাছে হারা?

আমাদের অ্যারেস্ট করছে। গম্ভীর সুরে বলল ডর্স।

ক্যান? রাইখ বলল, নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অই মিয়া ছাড়েন। লেডি, অগোর লগে যাইয়েন না। কুনু দরকার নাই।

বেরোও। রাইখকে প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি দিয়ে রাস বলল।

না, যামুনা। আপনারাও যাইতে পারবেন না। আমার দলের হগলেই আইতাছে। ওনাগো না ছাড়লে আপনেরাও যাইতে পারবেন না।

কীসের দল? ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল রাস।

এই মুহূর্তে হগলেই বাইরে আছে। বোধহয় আপনাগো গাড়ি পার্ট পার্ট কইরা খুলতাছে। আপনাগোও টুকরা টুকরা কইরা ফালাইব।

সঙ্গীর দিকে ঘুরল রাস, হেড কোয়ার্টারে খবর দাও। বলো ম্যাক্রোসহ আরো কয়েকটা ট্রাক পাঠাতে।

না! চিৎকার করল রাইখ, একটা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে ছুটল অস্টিনওয়ার্ল্ডের দিকে।

রাস নিউরোনিক হুইপ লেভেল করে ফায়ার করল।

আর্তনাদ করে উঠল রাইখ, কাঁধ খামচে ধরে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ছটফট করতে লাগল জবাই করা পশুর মতো।

রাস আবার পুরোপুরি ঘোরার আগেই সেলডন কব্জি ধরে একটা মোচড় দিলেন। প্রথমে রাসের হাত মোচড় দিয়ে উপরে তুললেন তারপর পিছন দিকে একটা ঠেলা দিলেন। কাঁধের হাড় সরে গেল টের পেলেন তিনি।

ব্লাস্টার তুলল অস্টিনওয়াল, কিন্তু ডর্স তার আগেই অফিসারের গলা পেচিয়ে ধরে তার কণ্ঠনালীর কাছে ছুরির ফলা ঠেকালো।

নড়বে না! বলল সে। শরীরের কোনো অংশ এক মিলিমিটার নড়লে তোমার গলা দুভাগ করে দেব। ব্লাস্টার ফেলে দাও। ফেলো। নিউরোনিক হুইপও।

রাইখ এখনো মাটিতে শুয়ে গোঙাচ্ছে। তাকে কোলে তুলে নিলেন সেলডন। টিসালভারের দিকে ঘুরে বললেন, বাইরে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। খেপে আছে সবাই। আমি বলা মাত্র ওরা ভিতরে ঢুকে সব তছনছ করে ফেলবে। আপনার বাড়ির প্রতি বর্গ ইঞ্চি দেয়াল খুলে নিয়ে যাবে। সেইরকম কিছু ঘটতে দিতে না চাইলে অস্ত্রগুলো তুলে পাশের রুমে নিয়ে যান। এই অফিসারের অস্ত্রগুলোও নিয়ে যান। আপনার স্ত্রীকে সাহায্য করতে বলুন। তাহলে নির্দোষ মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আগে দুবার চিন্তা করবে।–ডর্স, রাস আপাতত কোনো ঝামেলা করতে পারবে না, ওই ব্যাটাকেও তুমি অকেজো করে দাও। তবে মেরে ফেলো না।

ঠিক, ছুরিটা উল্টো করে ধরে বাট দিয়ে অস্টিনওয়ালের খুলিতে আঘাত করল ডর্স। হাঁটু ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল লোকটা।

ওরা রাইখকে ফায়ার করেছে, বললেন সেলডন। প্রাণপণ চেষ্টা করছেন নিজের অসুস্থ ভাবটা গোপন করার।

দ্রুত অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরলো দুজন। ফুটপাথে উঠতেই চোখে পড়ল হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ওদেরকে বেরিয়ে আসতে দেখে কাছাকাছি ভিড় করে এলো। সবাই। অধিকাংশই পুরুষ। কাপড় থেকে তাদের গায়ের ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে।

সানব্যাজারগুলা কই, একজন চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল।

ভিতরে, অনুত্তেজিত স্বরে ডর্স বলল। ওদেরকে ছেড়ে দিন। আপাতত ওরা কিছুই করতে পারবে না। তবে হেডকোয়ার্টারে খবর চলে গেছে। যেকোনো সময় রিইনফোর্সম্যান্ট চলে আসতে পারে। কাজেই এখান থেকে চলে যান সবাই।

আপনাদের কী হবে? প্রায় একডজন কণ্ঠ একযোগে জিজ্ঞেস করল। আমরাও চলে যাচ্ছি। ফিরব না আর।

আমি ওনাগরে লুকাইয়া রাখমু, রাইখ বলল। হাচড়ে পাঁচড়ে সেলডনের কোল থেকে নেমে নিজের পায়ে দাঁড়াল। পাগলের মতো ডান কাধ মালিশ করছে। হাঁটবার পারুম। দেহি, রাস্তা দ্যান।

ভিড়ের মানুষগুলো দুপাশে সরে গিয়ে তাকে রাস্তা করে দিল। মিস্টার, লেডি, আহেন আমার লগে।–জলদি।

অনেকটা পথ মানুষগুলো তাদের সাথে আঠার মতো লেগে রইল। রাইখ একটা প্রবেশমুখ দেখিয়ে বলল, এদিকে আহেন, আপনাগরে এমুন জায়গায় নিয়া যামু জিন্দেগীতেও কেউ খুইজা পাইব না। এমুনকি ডাভানও এইডার কথা জানে না। সমস্যা হইল গিয়া আমাগরে সুয়্যারেজ লেভেলে নামন লাগব। কেউ দেখব না ঠিক, তয় গন্ধ খুব খারাপ। কী কইতাছি, বুঝবার পারছেন?

আশা করি বেঁচে থাকা যাবে, বিড়বিড় করে বললেন সেলডন।

প্যাচানো র‍্যাম্প বেয়ে অনেকটা নিচে নামার পর তীব্র দুর্গন্ধ স্বাগত জানালো তাদের।

.

৮০.

লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে বের করেছে রাইখ। ধাতব মই দিয়ে এমন একটা কামরায় পৌঁছলেন সেটার যে কী কাজ সেলডন বুঝতে পারলেন না। চারপাশে অনেক যন্ত্রপাতি। সেগুলোও বিরাট রহস্য হয়ে রইল। কামরাটা মোটামুটি পরিস্কার। ধুলো বালি নেই। বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাও ভালো। বোধহয় সেজন্যই ধুলো জমে না।–সবচেয়ে বড়ো কথা–দুর্গন্ধ অনেক কম।

রাইখ প্রচণ্ড খুশি। দারুণ, তাই না? বলার ভঙ্গিটা এমন যেন দাবী করছে যেহেতু সে ভালো বলেছে বাকি দুজনকে সেটা মানতেই হবে।

আরো খারাপ হতে পারত, সেলডন বললেন। এই জায়গাটা কী কাজে ব্যবহার হয় তুমি জানো, রাইখ?

কাঁধ নাড়ল রাইখ, সাথে সাথে ব্যথায় মুখ বিকৃত করে ফেলল। জানি না, ঐডা নিয়া মাথা ঘামায় কে?

হাত দিয়ে ধুলো সরিয়ে মাটিতে বসল ডর্স। তীক্ষ্ণ চোখে হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ধারণা এটা বিশাল কোনো কমপ্লেক্সের অংশ যেখানে ডিটক্সিফিকেশন এবং বর্জ্য রিসাইক্লিং করা হয় তারপর সেগুলো দিয়ে সার তৈরি হয়।

তাহলে যারা এটা চালায় তারা যেকোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারে।

আমি এইহানে সব সময়ই তো আহি, রাইখ বলল, কাউরে চোখে পড়ে নাই কহনো।

আমার ধারণা ট্র্যান্টরে যেখানে সম্ভব সেখানেই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আর বর্জ্য রিসাইক্লিং-এর জন্য তো সবার আগে ব্যবহার করা হবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা নিরাপদ–অন্তত কিছুক্ষণের জন্য।

বেশিক্ষণের জন্য না। দানাপানির প্রয়োজন হবে, ডর্স।

আমি খাবার আর পানির ব্যবস্থা করবার পারমু। রাইখ বলল। ফুটপাথে টিকা থাকতে অইলে এই কাজ সবার আগে শিখতে অইব।

ধন্যবাদ, রাইখ। অন্যমনস্ক সুরে বললেন সেলডন। এই মুহূর্তে ক্ষিধে নেই। নাক কুঁচকে বললেন, বোধহয় আর কোনোদিন ক্ষিধে লাগবে না।

পাবে, পাবে। অন্তত খাবার রুচি না থাকলেও পানির তৃষ্ণা পাবে। আর মলমূত্র ত্যাগ করা কোনো সমস্যাই না। কারণ আমরা এখন যেখানে বসে আছি সেটা আসলে বিশাল একটা নর্দমা।

খানিক নীরবতা। অনুজ্জ্বল আলো। সেলডন বিস্মিত হয়ে ভাবলেন ট্র্যান্টরিয়ানরা পুরোপুরি অন্ধকার করে রাখে না কেন? তারপরই মনে পড়ল যে জনবহুল এলাকায় তিনি কখনো সত্যিকার অন্ধকার দেখেননি। এটা বোধহয় এনার্জি সমৃদ্ধ সমাজের নিয়ম। চারশ কোটি মানুষের গ্রহ শুধু অভ্যন্তরীণ তাপ দিয়েই যে বিপুল পরিমাণ এনার্জি সংগ্রহ করে তা সত্যি অবাক ব্যাপার। সৌরশক্তি এবং নিউক্লিয়ার ফিউশনপ্ল্যান্ট তো আছেই। সত্যি কথা বলতে কী এনার্জির স্বল্পতা আছে এমন একটাও গ্রহ তিনি এম্পায়ারে দেখেননি। এমন একটা সময় কী ছিল যখন প্রযুক্তি এত নিচু মানের ছিল যে এনার্জির স্বল্পতা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

সারিবদ্ধ কতগুলো পাইপের গায়ে হেলান দিলেন তিনি। এই পাইপগুলো দিয়েই ময়লা আবর্জনা পরিবাহিত হয়। কথাটা মনে হতেই ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। গিয়ে বসলেন ডর্সের পাশে।

চ্যাটার হামিনের সাথে যোগাযোগের কোনো উপায় আছে? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

সত্যি কথা বলতে কী, ডর্স বলল, আমি খবর পাঠিয়েছি, যদিও সেটা আমার পছন্দ হয়নি।

পছন্দ হয়নি?

আমার দায়িত্ব তোমাকে রক্ষা করা। হামিনের কাছে খবর পাঠানোর অর্থ আমি ব্যর্থ হয়েছি।

সরু চোখে ডর্সের দিকে তাকালেন সেলডন। নিজের উপর এত বেশি দোষ চাপানোর কী কোনো প্রয়োজন আছে, ডর্স? পুরো একটা সেক্টরের সিকিউরিটি অফিসারের হাত থেকে আমাকে তুমি বাঁচাতে পারতে না।

বোধহয়। কয়েকজনকে হয়তো ঠেকাতে পারতাম।

জানি। সেটাই করেছি আমরা। কিন্তু ওরা রিইনফোর্সমেন্ট পাঠাবে… আর্মার্ড গ্রাউনড কার… নিউরোনিক ক্যানন… স্লিপিং মিস্ট। আমি জানি না ওদের কাছে কী আছে আর কী নেই, কিন্তু পুরো সিকিউরিটি ফোর্সের প্রত্যেকটা সদস্য আমাদেরকে এখন হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করেছে, কোনো সন্দেহ নেই তাতে।

ঠিকই বলেছ, ডর্স বলল।

আপনাগরে কুমুদিনও খুঁইজা পাইব না, লেডি, রাইখ বলল। দুজনের আলোচনার সময় সে একবার ডর্সের আবার সেলডনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। ডাভানরে হ্যারা কুনোদিনও ধরতে পারে নাই।

হাসল ডর্স, প্রাণহীন হাসি। ছেলেটার মাথার চুল এলোমেলো করে দিল। তারপর বিরক্ত হয়ে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকালো। তোমার এখানে আর থাকা বোধহয় ঠিক হবে না, রাইখ। আমি চাই না আমাদের সাথে তুমিও ধরা পড়।

আমারে কুনোদিনও ধরবার পারব না। আর আমি চইলা গেলে আপনাগরে খাওন আর পানি আইন্যা দিব কেডা। লুকানোর লাইগা নতুন জায়গা খুঁইজা দিব কেডা?।

না, রাইখ, ওরা আমাদের ধরবেই। আসলে ডাভানকে ধরার জন্য ওরা। সেইরকম চেষ্টা করেনি কখনোই। লোকটা ঝামেলাবাজ কিন্তু সিকিউরিটি ফোর্স কখনোই তাকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি। বুঝতে পারছ কী বলছি?

বলবার চান যে হ্যাঁ শুধু একটা… একটা ফালতু ঝামেলা আর হ্যাঁরে ধরার লাইগা এ্যাতো সময় নষ্ট না করলেও চলে।

হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছ। কিন্তু আমরা দুজন অফিসারকে আহত করেছি। আমাদেরকে ওরা ছাড়বে না। যদি পুরো ফোর্স মাঠে নামানোর প্রয়োজন হয়–যদি প্রতিটি লুকানো, অব্যবহৃত করিডোর তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখতে হয় তাও করবে হাল ছাড়বে না।

তার মানে, আমি… আমিই ঝামেলা বাড়াইছি। আমি যদি অমনে দৌড় না। দিতাম তাইলে ওই ব্যাটা সানব্যাজার আমারে মারতও না, আপনেরাও বিপদে পড়তেন না।

না, আগে হোক পরে হোক ছাড়া পাওয়ার জন্য কাজটা আমাদের করতেই হতো। কে জানে হয়তো আরো বেশি অফিসারকে আহত করার দরকার হতো।

তয় আপনেরা ভালো ফাইট দিছেন। মাইর খাইয়া পইড়া না গেলে বেশ মজা কইরাই দেখবার পারতাম।

পুরো সিকিউরিটি সিস্টেমের সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে কোনো লাভ হবে না, সেলডন বললেন। প্রশ্ন হচ্ছে : ধরতে পারলে আমাদেরকে নিয়ে ওরা কী করবে? বন্দী করে রাখবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আরে না, প্রয়োজন হলে আমরা সম্রাটের কাছে আপীল করতে পারব। ডর্স বলল।

সম্রাট? চোখ বিস্ফারিত করে রাইখ বলল। আপনেরা সম্রাটরে চিনেন?

হাত নেড়ে তার উৎসাহে পানি ঢেলে দিলেন সেলডন। গ্যালাক্সির যেকোনো নাগরিকই সম্রাটের কাছে আপীল করতে পারে। সেটা হবে মারাত্মক ভুল, ডর্স। আমি আর হামিন ইম্পেরিয়াল সেক্টর ত্যাগ করার পর থেকেই সম্রাটের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

কিন্তু ইম্পেরিয়াল আপীলের ফলে ডালাইটদের সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরী হবে–আমরা সময় পাবো–এবং তার ফাঁকে বিকল্প একটা কিছু বের করে নিতে পারব।

হামিনের সাহায্যের আশা করতে পারি।

হ্যাঁ, পারি। অস্বস্তি নিয়ে ডর্স বলল। কিন্তু হামিনের পক্ষে সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলা সম্ভব সেটা আশা করা ঠিক না। আমার ম্যাসেজ যদি পায় এবং দ্রুত ডাহলে ছুটে আসেও আমাদেরকে কীভাবে খুঁজে পাবে সে? আর পেলেও পুরো একটা সিকিউরিটি ফোর্সের বিরুদ্ধে একা কী করবে?

সেই ক্ষেত্রে ধরা পড়ার আগে আমাদের নিজেদেরই একটা পথ বের করে নিতে হবে। সেলডন বললেন।

আমি লগে থাকলে, রাইখ বলল, ধরা পরনের কুনু ভয় নাই। এইহানের সব জায়গা আমি চিনি।

একজন বা দুইজনের কাছ থেকে পালিয়ে থাকার জন্য হয়তো তুমি সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু ওরা আসবে শয়ে শয়ে। করিডর ধরে পালানোর সময় হয়তো এক দলের কাছ থেকে পালিয়ে আরেক দলের কাছে ধরা পড়ব।

দীর্ঘ সময় নীরব হয়ে বসে রইল সবাই। এমন একটা জটিল পরিস্থিতি কারোরই কিছু করার নেই। তারপর ডর্স ভেনাবিলি হঠাৎ সোজা হয়ে বসল। সতর্ক এবং উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এসে পড়েছে, ফিস ফিস করে বলল সে, আমি শুনতে পাচ্ছি।

টান টান উত্তেজনা আর ভয় নিয়ে কিছুক্ষণ সেইভাবেই বসে রইল তিনজন। তারপর রাইখ দাঁড়িয়ে হিস হিস করে বলল, এই দিকেই আইতাছে। সইরা পড়ুন দরকার।

সেলডন দ্বিধায় ভুগছেন, কিছুই শুনেননি তিনি যদিও বাকি দুজনের অতীন্দ্রিয় শ্রবণ শক্তি নিয়ে কোনো সন্দেহে ভুগলেন না। কিন্তু রাইখ যখন উল্টোদিকে চলা শুরু করল ঠিক তখনই করিডরে একটা কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শোনা গেল, যাবেন না। যাবেন না।

দাঁড়িয়ে পড়ল রাইখ, ডাভান। জানল ক্যামনে আমরা এইহানে আছি?

ডাভান? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন। তুমি নিশ্চিত?

হ, আমি নিশ্চিত। হ্যাঁ, আমাগোরে সাহায্য করবার পারব।

.

৮১.

কী হয়েছে? ডাভান জিজ্ঞেস করল।

খানিকটা স্বস্তি বোধ করছেন সেলডন। যদিও ডাল সেক্টরের পুরো সিকিউরিটি ফোর্সের বিরুদ্ধে ডাভান কিছুই করতে পারবে না, কিন্তু তার দল বেশ ভারী, যার ফলে সামান্য হলেও নিরাপত্তা পাওয়া যাবে।

আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই টিসালভারদের বাড়ির সামনে যারা ভিড় করে ছিল তাদের বেশির ভাগই আপনার দলের।

হ্যাঁ, অনেকেই ছিল। আমি শুনেছি যে আপনাদেরকে গ্রেফতার করার সময় সানব্যাজারদের পুরো একটা স্কোয়াড্রনের সবাইকে আহত করে পালিয়ে আসেন। কিন্তু ওরা আপনাদের গ্রেফতার করতে চেয়েছিল কেন?

মাত্র দুজন, দুটো আঙ্গুল তুলে সেলডন বললেন। দুইজন সানব্যাজার। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। আমাদের গ্রেফতার করার পিছনে একটা কারণ হচ্ছে যে আমরা আপনার সাথে দেখা করেছিলাম।

শুধু এই কারণটাই যথেষ্ট নয়। সানব্যাজাররা আমাকে নিয়ে অতটা মাথা ঘামায় না। তিক্ত সুরে বলল সে। ওরা আসলে আমাকে আন্ডারঅ্যাস্টিমেট করে।

হয়তো, সেলডন বললেন। কিন্তু যার বাড়িতে আমরা ভাড়া থাকতাম সেই মহিলা অভিযোগ করেছে যে আমরা দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করছিলাম। সাংবাদিকের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার ঘটনাটাকেই সে এভাবে রং চড়িয়ে বলেছে। ঘটনাস্থলে আপনার লোকজনও ছিল। আর আজকে সকালে দুজন অফিসার আমাদের হাতে আহত হয়েছে। এখন ডালাইটের সিকিউরিটি ফোর্স হয়তো এই করিডোরগুলো পরিস্কার করার উদ্যোগ নেবে–তার মানে আপনাকেও ভুগতে হবে। আমি দুঃখিত। এইধরনের ঝামেলা ডেকে আনার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না।

কিন্তু ডাভান মাথা নাড়ল। না, সানব্যাজারদের আপনি চেনেন না। এত সামান্য কারণে ওরা উন্মাদ হয়ে উঠবে না। আর আমাদেরকে দমন করার কোনো ইচ্ছাও ওদের নেই। থাকলে সেক্টর প্রশাসন অনেক আগেই তা করতে পারত। ওরা চায়ই যে আমরা বিলিবটন বা অন্য কোনো বস্তিতে মারামারি কাটাকাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। না, ওরা চায় আপনাকে আপনাকে। কী করেছেন আপনি?

আমরা কিছুই করিনি, অধৈর্য সুরে বলল ডর্স। আর কীইবা আসে যায়। হয়তো আপনাকে নয় আমাদের ধরাটাই ওদের মূল উদ্দেশ্য, ওরা এখানে ঠিকই চলে আসবে। যদি আপনাকেও এখানে পেয়ে যায়, আপনি বাঁচতে পারবেন।

না, আমার কিছু হবে না। আমার অনেক বন্ধু আছে–ক্ষমতাবান বন্ধু, ডাভান বলল। গত রাতেই আপনাদের তা জানিয়েছি। আমার বন্ধুরা আপনাকেও সাহায্য করতে পারবে। আপনি যখন আমাদের সাহায্য করার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালেন, সাথে সাথে আমি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করি। ওরা আপনাকে ভালো করেই চেনে, ড. সেলডন। আপনি বিখ্যাত মানুষ। আমার বন্ধুরা যথেষ্ট ক্ষমতাবান, ডাহুলের মেয়রের সাথে ওরা কথা বলেছে। কিছুই হবে না আপনার। শুধু ডাল থেকে চলে যেতে হবে।

হাসলেন সেলডন। স্বস্তির শীতল পরশে দেহমন জুড়িয়ে গেল তার। আপনি এমন একজনকে চেনেন যে ভীষণ ক্ষমতাবান, তাই না, ডাভান? এমন একজন যে কিনা সাথে সাথেই ডাল প্রশাসনের সাথে কথা বলে আমাদেরকে এখান থেকে

অক্ষত অবস্থায় চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারে? চমৎকার। অবাক হইনি। আমি। হাসিমুখেই ঘুরলেন ডর্সের দিকে। মাইকোজেনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি এখানেও। হামিন কীভাবে এতকিছু সামলায়?

কিন্তু ডর্স মাথা নাড়ল। এত দ্রুত।–ঠিক বুঝতে পারছি না।

হামিন সবকিছু করতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করি। সেলডন বললেন।

আমি ওকে তোমার চেয়ে ভালো চিনি এবং অনেকদিন থেকে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।

হাসলেন সেলডন। ওর ক্ষমতাকে ছোট করে দেখো না। তারপর এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে তার ভালো লাগছে না এমন একটা ভঙ্গি করে ঘুরলেন ডাভানের দিকে। কিন্তু আপনি আমাদের খুঁজে পেলেন কীভাবে? রাইখ বলছিল আপনি এই জায়গার কথা জানেন না।

জানে না, কর্কশ সুরে চিৎকার করল রাইখ। এই জায়গা আমার। আমিই এইডা খুঁইজ্জা বাইর করছি।

এখানে আমি কখনো আসিনি, চারপাশে একবার ভালোভাবে দেখে তারপর ডাভান বলল। চমৎকার জায়গা, রাইখ আসলে একটা করিডর ক্রিয়েচার, এই গোলক ধাঁধার ভেতরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতে পারে।

হ্যাঁ, ডাভান, সেটা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। কিন্তু আপনি আমাদের কীভাবে খুঁজে পেলেন?

হিট-সিঙ্কার-এর সাহায্যে। আমার কাছে একটা যন্ত্র আছে যা অতি বেগুনি রশ্মির বিকীরণ ধরতে পারে। ঠিক নির্দিষ্ট সাইত্রিশ ডিগ্রি সেলডসয়াস তাপমাত্রায় যে নির্দিষ্ট থার্মাল প্যাটার্ন তৈরি হয় শুধু সেটাই। শুধু মানুষের উপস্থিতিতে এটা রি-অ্যাক্ট করে, অন্য ধরনের হিট সোর্সে কোনো কাজ করে না।

ভুরু কুঁচকে ফেলল ডর্স, ট্র্যান্টরে এই যন্ত্র কী কাজে লাগবে। এখানে তো সবখানেই মানুষ। অন্যান্য গ্রহে আছে জানি, কিন্তু

কিন্তু ট্র্যান্টরে নেই। আমি জানি, কিন্তু বস্তিতে ভুলে যাওয়া করিডর বা ফুটপাথে এগুলো যথেষ্ট দরকারী।

যন্ত্রটা আপনি কোথায় পেয়েছেন? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।

আমার কাছে আছে সেটা জানাই যথেষ্ট। কিন্তু এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। অনেকেই আপনাকে হাতের মুঠোয় নিতে চায়। কিন্তু আমি চাই আমার ক্ষমতাবান বন্ধুর সাথে যাবেন আপনি।

কোথায় আপনার ক্ষমতাবান বন্ধু?

আসছে। আমার যন্ত্রে নতুন আরেকটা সাইত্রিশ ডিগ্রি রেজিস্ট্রার করছে। সেটা আমার বন্ধু ছাড়া অন্য কেউ হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না।

দরজা দিয়ে একটা লোক ধীরপায়ে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই সেলডনের মুখের হাসি নিভে গেল দপ করে। লোকটা চ্যাটার হামিন নয়।

.

ওয়ি

ওয়ি… বিশ্বনগরী ট্র্যান্টরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সেক্টর।… গ্যালাক্টিক এম্পায়ার-এর শেষ শতাব্দীগুলোতে ওয়ি ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। এই সেক্টরের শাসনকর্তারা বহুযুগ থেকেই অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ইম্পেরিয়াল সিংহাসনে বসার, তাদের যুক্তি ছিল যে যেহেতু তাদের একজন পূর্বপুরুষ সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন তাই সিংহাসনে বসার অধিকার। তাদেরই সবচেয়ে বেশি। চতুর্থ ম্যানিক্স-এর অধীনে ওয়ি সামরিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে, এবং (ইম্পেরিয়াল কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী) তারা গ্যালাক্সিব্যাপী একটা অভ্যুত্থান বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয়…
—এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা

.

৮২.

লোকটা দীর্ঘদেহী এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী। বাদামী রংয়ের লম্বা গোফ, প্রান্ত দুটো উপরের দিকে বাঁকানো। মুখের দুপাশে পাতলা দাড়ি একেবারে চিবুকের নিচ পর্যন্ত। দাড়ি যেখানে শেষ হয়েছে চিবুকের সেই অংশ থেকে নিচের ঠোঁট পর্যন্ত নিখুঁতভাবে কামানো এবং কেমন যেন ভেজাভেজা। মাথার পাতলা চুলগুলো ভীষণ ছোট। হঠাৎ করেই মাইকোজেনের কথা মনে পড়ল সেলডনের, অস্বস্তি বোধ করলেন।

আগন্তুকের পোশাক লাল এবং সাদা রংয়ের। নিঃসন্দেহে ইউনিফর্ম। কোমরে চওড়া বেল্ট। সামনের দিকে অনেকগুলো চকচকে রূপালি বোতাম।

নিচুলয়ের গুরুগম্ভীর কিন্তু সুরেলা কণ্ঠস্বর। অপরিচিত বাচনভঙ্গি। সেলডন আগে কখনো শুনেননি।

আমি সার্জেন্ট এমার থালুস, লোকটা প্রতিটি শব্দ ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল। ড. হ্যারি সেলডনকে খুঁজছি।

সামনে বাড়লেন সেলডন। আমিই হ্যারি সেলডন। তারপর ডর্সের কানে কানে বললেন, বোধহয় হামিন নিজে আসতে না পেরে মাংসের এই প্রদর্শনীটাকে পাঠিয়েছে।

তীক্ষ এবং দীর্ঘায়িত দৃষ্টিতে সেলডনকে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল সার্জেন্ট। তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিকই আছে। আপনার চেহারার বর্ণনা আমার কাছে আছে। দয়া করে আসুন আমার সাথে, ড. সেলডন।

পথ দেখান, সেলডন বললেন।

সার্জেন্ট কয়েক পা পিছিয়ে গেল, ডর্স এবং সেলডন সামনে বাড়লেন।

লম্বা হাত বাড়িয়ে ডর্সের পথ আটকালো সার্জেন্ট। শুধু ড. সেলডনকে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে আমাকে, অন্য কাউকে না।

কয়েকটা মুহূর্ত বিস্মিত হয়ে সার্জেন্টের দিকে তাকিয়ে রইলেন সেলডন। তারপর বিস্ময়টা ক্রোধে পরিণত হলো। অসম্ভব, সার্জেন্ট। এইরকম নির্দেশ কেউ আপনাকে দিতে পারে না। ড. ডর্স ভেনাবিলি আমার সহকারী। সে অবশ্যই আমার সাথে যাবে।

সেটা আমার নির্দেশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ডক্টর।

আপনাকে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেটা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই, সার্জেন্ট থালুস। ডর্সকে ছাড়া আমি একপাও এগোব না।

তাছাড়া, বিরক্ত সুরে বলল ডর্স, আমার দায়িত্ব ড. সেলডনকে সবধরনের বিপদআপদ থেকে রক্ষা করা। ওর সাথে যদি নাই থাকি তাহলে তাকে কীভাবে রক্ষা। করব? কাজেই ও যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব।

দ্বিধায় পড়ে গেল সার্জেন্ট। আমাকে পরিস্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আপনার কোনো ক্ষতি না হয়, ড. সেলডন। স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে জোর খাটাতে বাধ্য হব আমি। চেষ্টা করব যেন আপনার কোনো ক্ষতি না হয়।

দুহাত সামনে বাড়ালো সে, সেলডনকে তুলে কাঁধে করে নিয়ে যাবে।

দ্রুত পিছিয়ে গেলেন সেলডন। একই সাথে তিনি ডান হাতের তালু দিয়ে সার্জেন্টের ঊর্ধ্ব বাহুতে যেখানে মাংসপেশী পাতলা সেখানে কোপ মারলেন।

লম্বা দম নিল সার্জেন্ট, থমকে গেল খানিকটা। তারপর নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার সামনে বাড়ল, ডাভান যেখানে ছিল সেখানেই কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু রাইখ সার্জেন্টের পিছনে চলে গেল।

আবার কোপ মারলেন সেলডন, আবার মারলেন, কিন্তু সার্জেন্ট থালুস কাঁধ নামিয়ে প্রতিটা আঘাত কাঁধের শক্ত মাংসপেশীতে হজম করল।

ছুরি বের করল ডর্স।

সার্জেন্ট, হিংস্র গলায় বলল সে, বোঝার চেষ্টা করুন, ড. সেলডনকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে চাইলে আপনাকে মারাত্মকভাবে আহত করা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় থাকবে না।

থামল সার্জেন্ট, ডর্সের হাতের ছুরিগুলো গম্ভীরভাবে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, আমার নির্দেশ শুধু ড. সেলডনকে অক্ষত রাখতে হবে, অন্যদের কী হবে সেটা দেখার প্রয়োজন নেই।

বিস্ময়কর গতিতে কোমরের হোলস্টারে রাখা নিউরোনিক হুইপের দিকে হাত বাড়ালো সে, এক পা সামনে বেড়ে চুঁড়ি চালালো ডর্স।

দুজনের কেউই সফল হলো না।

দৌড়ে সামনে এগোল রাইখ। বা হাত দিয়ে ধাক্কা মারল সার্জেন্টের কোমরে, ডান হাত দিয়ে হোলস্টার থেকে অস্ত্রটা কেড়ে নিল। পিছিয়ে এলো দ্রুত। সার্জেন্টের নিউরোনিক হুইপ এখন শোভা পাচ্ছে তার হাতে। দুহাতে সেটা বাগিয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, হাত তুলেন, সার্জেন্ট, নইলে বুজবেন মজা কারে কয়।

থমকে গেল সার্জেন্ট, ভয়ের আভাস ফুটে উঠল মুখে। মাত্র এই একবারই কয়েক মুহূর্তের জন্য গাম্ভীর্য খসে পড়ল তার। ওটা নামাও, খোকা। কীভাবে চালাতে হয়। তুমি জান না।

জানি, এইডারে কয় সেফটি। এইডা অব কইরা এই বোতামডা দিয়া ফায়ার করন যায়। আপনি আমার দিকে আগাইলে সত্যি ফায়ার করমু।

জমে গেল সার্জেন্ট। বারো বছরের উত্তেজিত বালকের হাতে ভয়ংকর মারণাস্ত্র থাকাটা যে কেমন বিপজ্জনক এটা সে ভালো করেই জানে।

ব্যাপারটা সেলডনেরও ভালো লাগল না। সাবধান, রাইখ, তিনি বললেন। ফায়ার করো না। ট্রিগার থেকে আঙ্গুল সরাও।

ওরে আমার কাছে আইতে দিমু না।

আসবে না।–সার্জেন্ট নড়বেন না, প্লীজ। কয়েকটা কথা পরিস্কার হওয়া দরকার। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আপনাকে, ঠিক?

ঠিক। সার্জেন্ট বলল। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইখের দিকে (রাইখও একইরকম কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)।

কিন্তু অন্য কাউকে সাথে নেওয়ার কথা বলা হয়নি আপনাকে, ঠিক।

না, সেইরকম কিছু বলা হয়নি, ডক্টর। দৃঢ় গলায় বলল সার্জেন্ট। নিউরোনিক হুইপের সামনে দাঁড়িয়েও যে সে ভয় পায়নি, সবাই সেটা দেখল।

বেশ, শুনুন সার্জেন্ট। অন্য কাউকে সাথে না নেবার কথা কী আপনাকে বলে দিয়েছে?

আমাকে শুধু বলা হয়েছে

না, না, মন দিয়ে শুনুন, সার্জেন্ট। ফাঁকটা তো এখানেই। আপনাকে কি এভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ড. সেলডনকে নিয়ে এসো! শুধু এইটুকুই। বাকিদের ব্যাপারে কোনো উল্লেখই ছিল না, নাকি নির্দেশটা ছিল আরো নির্দিষ্ট? এরকম, শুধু ড. সেলডনকে নিয়ে আসবে অন্য কাউকে সাথে আনবে না?

প্রশ্নগুলো নিয়ে মাথার ভিতরে বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখল সার্জেন্ট। তারপর বলল, শুধু বলা হয়েছে ড. সেলডনকে নিয়ে এসো, ব্যস আর কিছু না।

অর্থাৎ অন্যদের ব্যাপারে কোনো নির্দেশই দেওয়া হয়নি, ঠিক?

 খানিকটা বিরতি নিয়ে জবাব দিল সার্জেন্ট ঠিক।

ড, ভেনাবিলিকে সাথে নেওয়ার আদেশ আপনাকে দেওয়া হয়নি আবার সাথে না নেওয়ার আদেশও দেওয়া হয়নি, ঠিক?

আবারও বিরতি, হ্যাঁ।

অর্থাৎ আপনি তাকে সাথে নিতেও পারেন, নাও নিতে পারেন, নির্ভর করছে আপনার ইচ্ছের উপর, ঠিক?

এবার অনেকক্ষণ বিরতির পর জবাব দিল সে, তাইতো মনে হয়।

বেশ, ঐযে রাইখ, আপনার দিকে নিউরোনিক হুইপ তাক করে রেখেছে আপনার নিউরোনিক হুইপ, মনে আছে তো–এবং অস্ত্রটা ব্যবহার করার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে।

ঠিকই কইছেন, চিৎকার করে বলল রাইখ।

থামো রাইখ, সেলডন বললেন। আর এই যে ড. ভেনাবিলির হাতে দুটো ছুরি। জিনিসগুলো তিনি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে ব্যবহার করতে পারেন। আপনি কী এখন ড. ভেনাবিলিকে সাথে নেবেন, না নেবেন না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আপনার উপর।

শেষ পর্যন্ত হার মেনে নিল সার্জেন্ট। মহিলাও যাবে আপনার সাথে।

এবং রাইখও যাবে।

রাইখও যাবে।

আপনি কথা দিচ্ছেন–একজন সৈনিক হিসেবে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে–এইমাত্র যা বললেন তার ব্যতিক্রম করবেন না…?

প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। আমি একজন সৈনিক এবং সৈনিকরা কখনো কথার বরখেলাপ করে না।

চমৎকার। রাইখ, হুইপটা ফিরিয়ে দাও।–এখনি। দেরি করবে না।

অখুশির ছাপ পড়ল রাইখের মুখে, ডর্সের দিকে তাকালো। ডর্সও একইরকম অখুশী কিন্তু আস্তে করে মাথা নেড়ে সায় দিল।

নিউরোনিক হুইপটা সার্জেন্টের হাতে ফিরিয়ে দিল রাইখ। বিড়বিড় করে কী বলল ঠিক বোঝা গেল না।

ছুরিগুলো এবার রেখে দিতে পার, ডর্স।

প্রতিবাদ না করে ছুরিগুলো খাপে রেখে দিল ডর্স।

 এবার সার্জেন্ট? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।

সার্জেন্ট একবার সেলডন তারপর নিউরোনিক হুইপের দিকে তাকালো। বলল, আপনি একজন মানী লোক, ড. সেলডন আর আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তারপর সৈনিকসুলভ দক্ষতায় অস্ত্রটা হোলস্টারে রেখে দিল।

ডাভানের দিকে ঘুরে সেলডন বললেন, ডাভান, যা দেখেছেন এখানে ভুলে যান সব। আমরা তিনজন স্বেচ্ছায় সার্জেন্ট থালুসের সাথে যাচ্ছি। ইউগো এমারিলের সাথে যখন দেখা হবে তাকে বলবেন ঝামেলাগুলো শেষ হয়ে গেলে যখন আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব তখন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। এবং আপনার জন্য যুক্তিসঙ্গত কিছু করার সুযোগ যদি কখনো পাই আমি অবশ্যই তা করব।–সার্জেন্ট, চলুন যাওয়া যাক।

.

৮৩.

আগে কখনো এয়ার জেটে চড়েছ, রাইখ? সেলডন জিজ্ঞেস করলেন।

জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ল রাইখ। এয়ার জেট এগোচ্ছে সামনের দিকে, আপারসাইডের দৃশ্যগুলো শন শন করে ছুটে চলেছে পিছনের দিকে। ভয় এবং বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টিতে ওগুলোই দেখছে সে।

সেলডনের কাছে ট্র্যান্টরকে মনে হয় শুধু এক্সপ্রেসওয়ে আর টানেলের গ্রহ। দীর্ঘাত্রার জন্যও সাধারণ মানুষ আন্ডারগ্রাউন্ডই ব্যবহার করে। আউটওয়ার্ল্ডে এয়ার ট্রাভেল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও ট্র্যান্টরে তা বিলাসিতা আর এটার মতো এয়ার জেট

হামিন কীভাবে এত কিছু ম্যানেজ করে সে-ই জানে। অবাক হয়ে ভাবলেন।

জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। গম্বুজগুলোর চড়াই উতরাই, গ্রহের এই অংশের বিশেষ ধরনের উদ্ভিদ, জায়গায় জায়গায় টুকরা টুকরা সবুজের ছোঁয়া, সেগুলোকে জঙ্গল বলা ভুল হবে। মাঝেমাঝে চোখে পড়ছে সমুদ্রের বর্ধিত অংশ, ঘন মেঘের আড়াল থেকে আচমকা সূর্য বেরিয়ে এলেই সমুদ্রের পানিতে আলো পড়ে দামী পাথরের মতো ঝিকমিক করে উঠছে।

কমবেশি একঘণ্টা হয়ে গেছে তারা এয়ার জেটে চড়েছেন। ডর্স এতক্ষণ নতুন একটা ইতিহাসের বুক-ফিল্ম দেখছিল, যদিও তেমন একটা উপভোগ করছিল না। এবার সেটা বন্ধ করে বলল, কোথায় যাচ্ছি সেটা জানা দরকার।

তুমি বলতে না পারলে আমিও পারব না, সেলডন বললেন। কারণ ট্র্যান্টরে আমার চেয়ে তুমিই বেশি দিন বাস করছ।

হ্যাঁ, কিন্তু সবসময়ই ছিলাম ভিতরে। আপারসাইডে আমি ছোট বাচ্চাদের মতোই পথ হারিয়ে ফেলব।

যাইহোক–হামিন তার কাজ ভালোই বোঝে।

কোনো সন্দেহ নেই তাতে, রসকষহীন সুরে ডর্স বলল, কিন্তু বর্তমান ঘটনার সাথে তার বোধহয় কোনো সম্পর্ক নেই। তুমি কেন ভাবছ যে এই ব্যবস্থা হামিন করেছে?

সেলডনের ভুরুজোড়া কপালে উঠে গেল। জানি না। অনুমান করছি। সে হবে–ই বা কেন?

কারণ ব্যবস্থাটা যেই করে থাকুক আমাকে নেওয়ার কথা সে বলেনি। হামিন আমার কথা ভুলে গেছে এটা আমি বিশ্বাস করি না। আরেকটা কারণ স্ট্রিলিং এবং মাইকোজেনে যেমন সে নিজে এসেছিল এক্ষেত্রে কিন্তু তা করেনি।

সবসময়ই আসবে এটা তুমি আশা করতে পার না, ডর্স। হয়তো কাজে ব্যস্ত। আগের দুটো ঘটনায় নিজে এসেছিল এবার আসেনি, এটা নিয়ে তো দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

মানলাম সে আসতে পারল না, তাই বলে এইরকম একটা উড়ন্ত প্রাসাদ পাঠানোর মানে কী? হাত নেড়ে বিলাসবহুল এয়ার জেটের চারপাশে দেখালো সে।

হয়তো এটাই হাতের কাছে ছিল তখন। হয়তো সে মনে করেছে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে তারা এমন একটা দর্শনীয় বস্তু ব্যবহার করবে না। প্রতিপক্ষকে ধোকা দেওয়ার সেই পরিচিত কৌশল।

খুব বেশি পরিচিত, আমার মতে। তাছাড়া নিজের বদলে সার্জেন্ট থালুস-এর মতো একটা বোকা লোককে পাঠাবে?

সার্জেন্ট মোটেই বোকা নয়। তাকে শুধু নির্দেশ পালন করার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সঠিক নির্দেশ দিতে পারলে লোকটার উপর তুমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখতে পারবে।

এতক্ষণে তুমি আবার আসল কথায় ফিরে এসেছ, হ্যারি। সার্জেন্টকে সঠিক নির্দেশ দেওয়া হয়নি কেন? আমি বিশ্বাস করি না যে হামিন শুধু তোমাকে ডাল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে বলবে আর আমার কথা বেমালুম ভুলে যাবে। মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়।

এই কথার কোনোই জবাব দিতে পারলেন না সেলডন, দমে গেলেন যেন। খানিকটা।

আরো একটা ঘণ্টা নীরবে পার হলো, তারপর ডর্স বলল, ঠাণ্ডা বাড়ছে বাইরে। গাছপালাগুলো এখন আর সবুজ নয়, বাদামী এবং ভিতরে বোধহয় হিটার চালু করা হয়েছে।

তাহলে কী বোঝা গেল?

ডাহলের অবস্থান উষ্ণমণ্ডলে, অর্থাৎ আমরা উত্তর বা দক্ষিণ মেরুর দিকে যাচ্ছি এবং অনেক দূরত্ব পাড়ি দিতে হচ্ছে। নাইটলাইন কোন দিকে সেটা যদি বুঝতে পারতাম তাহলে বলা যেত কোন মেরুতে যাচ্ছি।

সত্যি কথা বলতে কী উপর থেকে নিচে তাকিয়ে চোখে পড়ল গম্বুজগুলোকে জড়িয়ে রেখেছে বিশাল বিশাল আইসবার্গ আর সেগুলোকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে। সাগর।

তারপর হঠাৎ করেই এয়ার জেট গোত্তা মেরে নিচের দিকে ছুটল।

 চিৎকার করে উঠল রাইখ, আমরা ধাক্কা খামু! সব ভাইঙ্গা যাইব!

সেলডনের দেহের সমস্ত পেশী শক্ত হয়ে গেল, সিটের হাতল আঁকড়ে ধরলেন। তিনি।

ডর্স নির্বিকার। বলল, পাইলট তো একেবারে স্বাভাবিক। বোধহয় টানেলে ঢুকছি।

তার কথা শেষ হতে না হতেই জেট-এর ডানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলো এবং বুলেটের মতো ঢুকে পড়ল একটা টানেলে। কয়েকটা মুহূর্ত সব অন্ধকার। তারপর টানেলের নিজস্ব আলোর ব্যবস্থা চালু হলো।

যত যাই বলো, টানেলের ভিতরে যে আরেকটা এয়ার জেট নেই এটা আমি কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না। বিড়বিড় করে বললেন সেলডন।

আমার ধারণা এক কিলোমিটার দূরে থাকতেই ওরা নিশ্চিত করে নেয় যে টানেলটা খালি, যাইহোক, কেন যেন মনে হচ্ছে আমরা পথের শেষ মাথায় পৌঁছে গেছি এবং কোথায় যাচ্ছি সেটা জানার জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে তারপর বলল, এবং এটাও মনে হচ্ছে যে যখন জানতে পারব আমাদের তা পছন্দ হবে না।

.

৮৪.

টানেল থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা রানওয়ের উপর এয়ার জেট অবতরণ করল। এখানে ছাদ এত উঁচু যে একটা বিভ্রম তৈরি হয়। মনে হয় যেন অকৃত্রিম দিনের আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে, ইম্পেরিয়াল সেক্টরের মতো।

সেলডন যা আশা করেছিলেন তার চেয়েও দ্রুত থেমে দাঁড়ালো এয়ারজেট। তবে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেতে হলো। ধাক্কার চোটে প্রায় সিটের ভেতরে সেধিয়ে গেল রাইখ। ভয়ে আতঙ্কে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল তার। কাঁধে হাত বুলিয়ে তাকে আশ্বস্ত করল ডর্স।

পাইলট কম্পার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে দিল সার্জেন্ট থালুস। নামতে সাহায্য করল সবাইকে।

সবশেষে বেরুলেন সেলডন। থালুসের দিকে ঘুরে বললেন, সফরটা চমৎকার হয়েছে, ধীরে ধীরে সার্জেন্টের মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। স্যালুটের ভঙ্গিতে টুপির প্রান্ত স্পর্শ করল সে। বলল, ধন্যবাদ ডক্টর।

এবার তাদেরকে চড়তে হলো চমৎকার ডিজাইনের আরামদায়ক একটা গ্রাউন্ড কারে। সার্জেন্ট নিজে বসল চালকের আসনে।

প্রশস্ত রাস্তা, দুপাশে সারি সারি চমৎকার উঁচু ভবন, দিনের আলোয় ঝকমক করছে। কানে আসছে এক্সপ্রেসওয়ের দূরাগত গমগম শব্দ। ট্র্যান্টরের যেকোনো জায়গাতেই এই শব্দ পাওয়া যাবে। ফুটপাথে অনেক মানুষ। পায়ে হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছে। সকলেরই পোশাক পরিচ্ছদ অত্যন্ত চমৎকার। চারপাশে কোনো ময়লা আবর্জনা নেই, অবিশ্বাস্যরকম পরিস্কার।

আরো ভয় পেয়ে গেলেন সেলডন। ডর্সের অনুমানই বোধহয় ঠিক হতে যাচ্ছে। একটু ঝুঁকে তার কানে কানে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী মনে হয় আমরা আবার ইম্পেরিয়াল সেক্টরে ফিরে এসেছি?।

না, ইম্পেরিয়াল সেক্টরের স্থাপত্য আরো বেশি কারুকার্যময়। এখানে একটা পাথুরে ভাব আছে বুঝতে পারছ কী বলছি?

তাহলে আমরা কোথায় এসেছি ডর্স?

প্রশ্ন করে জেনে নিতে হবে, হ্যারি।

এবারের যাত্রা খুব বেশি দীর্ঘ হলো না। কিছুক্ষণ পরেই একটা কার-বেতে এসে থামলেন তারা। ভবনটা মোটামুটি চল্লিশ তলা উঁচু হবে। ছাদে কল্পিত একটা প্রাণীর বিশাল নকশা আকা, গোলাপী পাথরের অলংকরণ দ্বারা জিনিসটা আরো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চমৎকার ডিজাইন এবং রংয়ের ব্যবহার।

এটা নিঃসন্দেহে কারুকার্যময়। সেলডন বললেন।

ডর্স শুধু অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ নাড়ল।

সার্জেন্ট থালুস ইশারা করল, পরিস্কার বুঝিয়ে দিল যে শুধু সেলডনকে তার সাথে আসতে বলছে। সেলডনও ইশারাতেই কাজ সারলেন। হাত নেড়ে বাকি দুজনকে দেখালেন তিনি।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করল সার্জেন্ট। তারপর বলল, আপনারা তিনজনেই। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। তবে অন্যরা আমার মতো ব্যবহার নাও করতে পারে।

মাথা নাড়লেন সেলডন। অন্যদের কাজের জন্য আপনাকে আমি দায়ী করব না সার্জেন্ট।

খুশি হলো সার্জেন্ট। একবার মনে হলো সেলডনের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে বা অন্য কোনোভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। কিন্তু সেরকম কিছু না করে সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা রাখল।

সেলডন এবং ডর্সও কোনো সমস্যা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ির প্রথম ধাপে চড়লেন। রাইখ অবশ্য হোঁচট খেল। ভারসাম্য ফিরে পেয়ে দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে শিস বাজাতে লাগল।

সিঁড়ির শেষ মাথায় একটা গোলাপি রঙের দরজা। দুটো মেয়ে চমৎকার ভঙ্গিতে এসে দরজার দুপাশে দাঁড়ালো। দুজনেই অল্পবয়সী এবং সুদর্শনা। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক, কোমরের কাছে বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। দুজনের বাদামী চুল, মাথার দুপাশে বিনুনি করা (সেলডনের কাছে বেশ চমৎকার মনে হলো, কিন্তু ভেবে পেলেন না প্রতিদিন সকালে এইরকম বিনুনি করার জন্য কী পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হয়। আসার সময় পথে অন্য কোনো মহিলার মাথায় এ রকম সাজসজ্জা দেখেছেন বলে মনে হয় না)।

দুটো মেয়েই আগন্তুকদের দিকে খানিকটা অবজ্ঞা নিয়ে তাকিয়ে আছে। অবাক হলেন না সেলডন। সারা দিনে যে ধকল গেছে তার ফলে তাদের পোশাক-আশাক আর চেহারা সুরত যে রাইখের মতোই হয়ে গেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যাইহোক মেয়ে দুটো নিজেদের সামলে নিতে পারল। চমৎকার ভঙ্গিতে কুর্নিশও করল। তারপর অর্ধেক ঘুরে তাদেরকে ইশারা করল ভিতরে আসার (ওরা বোধহয় এই আনুষ্ঠানিকতাগুলো অনুশীলন করে রেখেছে)। তিনজনকেই যে আসতে বলছে। এবার সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ রইল না।

বিশাল এক ঘরে প্রবেশ করলেন তারা। অসংখ্য মূল্যবান আসবাবপত্র এবং শো পিস দিয়ে ঘরটা সাজানো। সেগুলোর বেশিরভাগই যে কী কাজে ব্যবহার করা হয় সেলডন বুঝতে পারলেন না। মেঝের রং হালকা। একটা ব্যাপার খেয়াল করে কিছুটা। বিব্রত বোধ করলেন সেলডন। মেঝেতে তাদের নোংরা পায়ের ছাপ পড়ছে।

কামরার ভেতরের দরজাটা খুলে গেল। আরেকজন মহিলা এসে ঢুকল, অন্য দুজনের চেয়ে বয়স্ক, (সেই দুজন আবার নতুন মহিলাকে দেখে এত চমৎকার ভঙ্গিতে কুর্নিশ করল যে সেলডন মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। নিঃসন্দেহে এর জন্য ব্যাপক অনুশীলন করতে হয়েছে)।

সেলডন অবশ্য বুঝতে পারলেন না তারও একইভাবে কুর্নিশ করা উচিত কিনা, তাই শুধু সামান্য একটু মাথা নাড়লেন। ডর্স এসবের ধার দিয়েও গেল না, দাঁড়িয়েই। থাকল পাথরের মতো। রাইখ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে শুধু চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে, নতুন আরেকজন মহিলা যে এসেছে এটা বোধহয় তার চোখেই পড়ল না।

মহিলা খানিকটা মোটা–তবে মোটেই চর্বিসর্বস্ব নয়। তার চুলের ফ্যাশনও তরুণী দুজনের মতো তবে আরো মূল্যবান গহনা ব্যবহার করা হয়েছে।

নিঃসন্দেহে মধ্যবয়সী, কিন্তু গালের কয়েকটা ব্রনের কারণে মনে হয় নব্য তরুণী। হালকা বাদামী রংয়ের চোখ দুটোয় হাসির ছোঁয়া এবং সবকিছু মিলিয়ে তাকে যতটা না বয়স্ক মনে হয় তার চেয়ে বেশি মনে হয় একজন স্নেহশীল মা।

কেমন আছেন আপনারা? আপনারা সবাই। সে বলল, (ডর্স এবং রাইখের উপস্থিতিতে মোটেই অবাক হয়নি এটা বোঝা গেল)। আমি অনেকদিন থেকেই আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। স্ট্রিলিং-এর আপারসাইডে আপনাকে প্রায় হাতের মুঠোয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আপনি ড. হ্যারি সেলডন। আর আপনি সম্ভবত ড. ডর্স ভেনাবিলি। এই ভদ্রলোককে অবশ্য আমি চিনি না, তবে তাকে দেখে খুশী হলাম। যাইহোক বেশি কথা বলে আর কষ্ট দেব না, আপনাদের নিশ্চয়ই বিশ্রাম প্রয়োজন।

এবং গোসল, ম্যাডাম, বেশ জোর দিয়েই কথাগুলো বলল ডর্স, আমাদের প্রত্যেকেরই ভালোভাবে গোসল দরকার।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, মহিলা বলল, পরিস্কার পোশাকও পাবেন। বিশেষ করে এই ভদ্রলোকের জন্য। রাইখের দিকে তাকালো মহিলা, কিন্তু তার দৃষ্টিতে অন্যান্যদের মতো ঘৃণা বা অবজ্ঞা নেই।

কী নাম তোমার, খোকা? জিজ্ঞেস করল সে।

রাইখ, খসখসে এবং কিছুটা বিব্রত গলায় জবাব দিল রাইখ, তারপর এটাও যোগ করল, মিসাস।

কী অদ্ভুত কো-ইন্সিডেন্স, মহিলা বলল, খুশিতে চোখ দুটো তার চকচক করছে। বোধহয় সৌভাগ্যের লক্ষণ। আমার নাম রিশেলি। অদ্ভুত না?–যাইহোক। আপনাদের সবার জন্য বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। তারপর ডিনার এবং কথা বলার। জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে।

এক মিনিট ম্যাডাম। জানতে পারি আমরা কোথায়?

ওয়ি, ডিয়ার, আর আমাকে শুধু রিশেলি বললেই হবে, তাতে আমাদের পরিচয়টা আরো মজবুত হবে। ইনফর্মালিটিই আমার বেশি পছন্দ।

ডর্সের দেহের মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করাতে কী আপনি অবাক হয়েছেন? কোথায় এসেছি সেটা জানতে চাওয়াটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

চমৎকার আমুদে ভঙ্গিতে হাসল রিশেলি। সত্যি, ড. ভেনাবিলি, এই নামটা নিয়ে কিছু একটা করা দরকার। আমি আসলে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করিনি বরং জবাব দিয়েছি। আপনি আমাকে একটা প্রশ্ন করেছেন আর আমি বলেছি ওয়ি। আপনারা এখন আছেন ওয়ি সেক্টরে।

ওয়ি? চমকে জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

হ্যাঁ, অবশ্যই, ড. সেলডন। গণিত সম্মেলনে বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্ত থেকেই আমরা আপনাকে হাতের মুঠোয় পেতে চেয়েছি আর সত্যি সত্যি পেয়েছি। সেজন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।

.

৮৫.

গোসল করে ভালোমতো ঘুমিয়ে নেওয়ার জন্য পুরো দিনটাই পার হয়ে গেল। সবাই নতুন পোশাকও পেয়েছে। মখমলের মতো মোলায়েম আর একটু ঢিলাঢোলা (ওয়ির। নিজস্ব স্টাইল)।

ম্যাডাম রিশেলির প্রতিশ্রুত ডিনারে উপস্থিত হওয়া গেল ওয়িতে তাদের অবস্থানের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায়।

বিশাল ডাইনিং টেবিল–অন্তত যে চারজন খেতে বসেছে : হ্যারি সেলডন, ডর্স ভেনাবিলি, রাইখ এবং রিশেলি সেই চারজনের জন্য বিশাল লম্বাই বলতে হবে। দেয়াল এবং সিলিং মৃদু আলো দ্বারা ইলিউমিনেট করা। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাচ্ছে। দ্রুত। যার কারণে দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় কিন্তু এত দ্রুত না যে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। টেবিল ক্লথ, যা আদতেই কাপড় জাতীয় কিছু নয় (সেলডন বুঝতেও পারলেন না কী দিয়ে তৈরি), মনে হয় যেন একটা দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে।

খাবার পরিবেশনকারীর সংখ্যা অনেক, সবাই নিঃশব্দ এবং দরজা খোলার পর সেলডনের মনে হলো তিনি সামরিক পোশাক পরা সৈনিকদেরও দেখেছেন। সবাই সশস্ত্র এবং প্রস্তুত। বুঝতে পারলেন যে রাজকীয় আয়েশের মাঝে থাকলেও পায়ে আসলে বেড়ী পড়ানো।

রিশেলির আচরণ সৌজন্যে ভরপুর, আতিথেয়তার কোনো ত্রুটি নেই। রাইখের প্রতি একটু বিশেষভাবে সদয় এবং তাকে ঠিক নিজের পাশের আসনটাতেই বসতে দিয়েছে।

গোসল করে শরীরে বহুদিনের জমে থাকা আবর্জনা দূর করার ফলে রাইখের চেহারাটাই পাল্টে গেছে। নতুন পোশাক, সুন্দর করে আঁচড়ানো চুল এসবের কারণে পুরনো রাইখকে আর চেনাই যাচ্ছে না। ভয়ে কোনো কথাই বলছে না সে। বুঝতে পেরেছে এই পরিবেশে তার বাচনভঙ্গি মোটেই শোভন নয়। সহজ হতে পারছে না এবং ডর্স যেভাবে থালাবাসন কাটাচামচ ব্যবহার করছে দেখে দেখে সেগুলো অনুকরণ করার চেষ্টা করছে।

খাবার বেশ সুস্বাদু, মশলার পরিমাণ বেশি খাবারের ধরনটা অবশ্য সেলডন বুঝতে পারলেন না।

হাসলে রিশেলির মুক্তোর মতো সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়ে। ফোলা মুখে সুখী সুখী একধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, হয়তো ভাবছেন যে আমরা এতে মাইকোজেনিয়ান। স্বাদবর্ধক ব্যবহার করেছি, আসলে কিন্তু তা নয়। এগুলো পুরোপুরি আমাদের নিজস্ব উৎপাদন। পুরো গ্রহে ওয়ির মতো আত্মনির্ভরশীল সেক্টর আর একটাও নেই। এবং আমরা সেটা ধরে রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করি।

গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সেলডন বললেন, আপনার আতিথেয়তা তুলনাহীন। সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞ।

অবশ্য এখানের খাবারগুলো মাইকোজেনের সমমানের নয় মোটেই। মনে মনে ঠিক সেইরকমই তিক্ত বোধ করলেন যে তিনি আসলে নিজের পরাজয়টা সেলিব্রেট করছেন। অথবা হামিনের পরাজয়, যাইহোক দুটোই তার কাছে সমান।

কারণ শেষপর্যন্ত তিনি ওয়ির হাতে ধরা পড়েছেন, আপারসাইডের দুর্ঘটনার পর থেকেই তিনি আর হামিন যে ভয় করছিলেন সেটাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

মেজবান হিসেবে দুএকটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না। রিশেলি বলল। আমার এই ধারণাটি কী ভুল যে আপনারা আসলে এক পরিবার নন; অর্থাৎ আপনি এবং ডর্স স্বামী-স্ত্রী নন, রাইখ আপনাদের সন্তান নয়?

আমাদের তিনজনের মাঝে সেইরকম কোনো সম্পর্ক নেই, সেলডন বললেন। রাইখের জন্ম ট্র্যান্টরে, আমার হ্যালিকনে, ডর্সের সিনায়।

আপনারা তিনজন একসাথে জোট বাধলেন কীভাবে?

ব্যাখ্যা করে বোঝালেন সেলডন, যতটুকু পারা যায় সংক্ষেপে, আমাদের একসাথে থাকার পেছনে রোমান্টিক বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কারণ নেই। সবশেষে বললেন তিনি।

অথচ আমার ব্যক্তিগত এইড, সার্জেন্ট থালুস রিপোের্ট করেছে যে সে যখন শুধু আপনাকে ডাহল থেকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল আপনিই তখন বেঁকে বসেছিলেন।

আসলে ডর্স এবং রাইখের সঙ্গ আমার ভালো লাগে, তাই ওদের কাছ থেকে আলাদা হতে চাইনি। গম্ভীর গলায় বললেন সেলডন।

রিশেলি খানিকটা মুচকি হেসে বলল, আপনি বেশ আবেগপ্রবণ।

হ্যাঁ, আমি আবেগপ্রবণ। এবং সেই সাথে খানিকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়?

কিংকর্তব্যবিমূঢ়?

নিশ্চয়ই। যেহেতু আপনি দয়া করে ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন আমিও দুই একটা জিজ্ঞেস করতে পারি?

অবশ্যই, মাই ডিয়ার হ্যারি। যেকোনো প্রশ্ন।

প্রথম সাক্ষাতেই আপনি বলেছিলেন যে গণিত সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করার সময় থেকেই ওয়ি আমাকে হাতের মুঠোয় পেতে চেয়েছে। জানতে পারি কেন?

আপনি নিশ্চয়ই সেটা না বোঝার মতো বোকা নন। আমরা আপনাকে চেয়েছি আপনার সাইকোহিস্টোরির জন্য।

সেটা আমি আন্দাজ করেছি। কিন্তু আপনাকে কে বলল যে আমাকে ধরার অর্থই হচ্ছে সাইকোহিস্টোরি পেয়ে যাওয়া?

জিনিসটা নিজের কাছ থেকে দূরে রাখার মতো অসতর্কও নন নিশ্চয়ই?

তারচেয়েও খারাপ, রিশেলি, জিনিসটা কখনো আমার কাছে ছিলই না।

রিশেলির গালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। কিন্তু সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করার সময় বলেছিলেন যে আছে। আপনার কথা যে সব বুঝতে পেরেছিলাম তা বলব না। কারণ আমি গণিতবিদ নই। কিন্তু আমার বেতনভুক অনেক গণিতবিদ আছে। তারাই আমাকে বুঝিয়েছে আপনি কী বলছেন।

সেক্ষেত্রে, মাই ডিয়ার রিশেলি, আপনার আরো মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত ছিল। কোনো সন্দেহ নেই যে আপনার গণিতবিদরা ঠিক এইভাবে বলেছে যে, আমি প্রমাণ করেছি সাইকোহিস্টোরিক্যাল প্রেডিকশন সম্ভব, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই এই কথাটাও বলেছে যে প্রেডিকশনগুলো প্র্যাক্টিক্যাল হবে না।

আমি বিশ্বাস করি না, হ্যারি। ঠিক পরের দিনই আপনাকে নকল সম্রাটের সামনে হাজির করা হয়।

নকল সম্রাট? ঠোঁট বাঁকিয়ে বিড়বিড় করল ডর্স।

হ্যাঁ অবশ্যই, এমনভাবে বলল রিশেলি যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। নকল সম্রাট। সিংহাসনে বসার কোনো যোগ্যতা বা অধিকার তার নেই।

রিশেলি, অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন সেলডন, আপনাকে এইমাত্র যা বললাম, ক্লীয়নকেও ঠিক তাই বলেছি এবং সে আমাকে ছেড়ে দেয়।

এবার আর রিশেলি হাসল না, বলার সুরে খানিকটা কাঠিন্য ফুটে উঠল। হ্যাঁ, আপনাকে সে ছেড়ে দেয়, ঠিক যেমনি করে শিকারী বিড়াল ইঁদুরকে ছেড়ে দেয়। তারপর থেকেই আপনাকে সে ধরার চেষ্টা করছে–স্ট্রিলিং, মাইকোজেন, ডাল। তার সাহসে কুলালে এখানেও চেষ্টা করবে। যাইহোক আমাদের আলাপ আলোচনা। বেশি সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। সময়টা উপভোগ করা যাক। সঙ্গীত হলে কেমন হয়।

বলার সাথে সাথে মৃদু কিন্তু উফুল্ল বাদ্য সঙ্গীত বেজে উঠল। রাইখের দিকে ঝুঁকে মোলায়েম সুরে বলল, মাই বয়, ছুরি কাটাচামচ দিয়ে সমস্যা হলে তুমি হাত দিয়েই খেতে পার, আমি কিছু মনে করব না।

ঠিক আছে, ম্যাম, বলল রাইখ, কিন্তু ডর্স তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিঃশব্দে বলল, চামচ।

রাইখ চামচ দিয়েই খেতে লাগল।

চমৎকার বাজনা ম্যাডাম, ডর্স বলল, ইচ্ছে করেই সে আনুষ্ঠানিক সম্বোধন বজায় রেখেছে। কিন্তু আলোচনা থেকে সরে যাওয়াটা ঠিক হবে না। আমার কেন। যেন মনে হচ্ছে প্রতিটি সেক্টরে হ্যারি সেলডনের ক্ষতি করার চেষ্টা করেছিল যারা তারা সবাই ওয়ির লোক। নইলে প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি এত বিশদভাবে কীভাবে জানলেন আপনি।

রিশেলি এবার শব্দ করে হাসল। ওয়ি তার চোখ কান সবখানেই ছড়িয়ে রেখেছে, কিন্তু ওই ঘটনাগুলোর পেছনে আমাদের হাত নেই। যদি চেষ্টা করতাম তাহলে প্রথমবারেই সফল হতাম। তার প্রমাণ ডাল সেক্টরে শেষ পর্যন্ত আমরা আপনাদের ধরার সিদ্ধান্ত নেই এবং সফল হয়েছি। ব্যর্থ যদি কেউ হয়তো সে হচ্ছে ডেমারজেল।

ডেমারজেলকে আপনি এত ছোট করে দেখছেন? বিড়বিড় করে বলল ডর্স।

 হ্যাঁ। আপনি অবাক হচ্ছেন? আমরা তাকে পরাজিত করেছি।

আপনি? নাকি ওয়ি সেক্টর?

যেহেতু ওয়ি বিজেতা, কাজেই বলা যায় যে আমিও বিজেতা।

অদ্ভুত। অথচ সারা ট্র্যান্টরে সবাই জানে যে জয়-পরাজয় বা অন্য কোনো কিছুতেই ওয়ির জনগণের কিছু আসে যায় না। এখানে শুধু একজনের ইচ্ছাই প্রাধান্য। পায়, তার কথাই এখানে আইন এবং সে হচ্ছে ওয়ি সেক্টরের মেয়র। তার তুলনায় আপনি বা অন্য কোনো ওয়িয়ান আসলে কিছুই না।

রিশেলির মুখে চওড়া হাসি ছড়িয়ে পড়ল, রাইখের গালে একটু টোকা দেওয়ার জন্য থামল, তারপর বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন, ওয়িতে মেয়রের ইচ্ছাই আইন, তিনি একনায়ক। তারপরেও আমি নিজের কথাই বলতে পারি। কারণ আমার ইচ্ছাও গুরুত্বপূর্ণ।

কেন? জিজ্ঞেস করলেন সেলডন।

কেন নয়? বলল রিশেলি, চাকরবাকরেরা এরই মধ্যে টেবিল পরিস্কার করতে শুরু করেছে। আমি ওয়ির মেয়র।

.

৮৬.

মন্তব্যটা শুনে সর্বপ্রথম প্রতিক্রিয়া দেখালো রাইখ। ভুলে গেল যে অস্বস্তিকর এবং গুরুগম্ভীর একটা পরিবেশে বসে আছে সে। অভ্যাসবশতই গলা ছেড়ে হেসে উঠল। বলল, হেই লেডি, আপনে ক্যামনে মেয়র হইবেন। মেয়ররাতো ব্যাডা মানুষ।

রিশেলি এই কথা শুনে রাগ করল না বরং স্নেহময় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। রাইখের কণ্ঠ এবং বাচনভঙ্গি হুবহু নকল করে বলল, অই ছ্যামড়া, কুনো মেয়র অয়। ব্যাডা, কুনো মেয়র অয় মাইয়া। বুঝবার পারছ।

হতবাক হয়ে গেল রাইখ, চোখ দুটো বিস্ফারিত। কোনোমতে শেষ পর্যন্ত বলল, হেই, আপনে অককরে আমগোর মতন কইবার পারেন।

হ, অককরে তোমগোর মতন। এখনো হাসছে রিশেলি।

আপনি বেশ ভালো বলতে পারেন রিশেলি, সেলডন বললেন।

একপাশে মাথা হেলিয়ে রিশেলি বলল, এভাবে কথা বলার সুযোগ খুব একটা পাই না। তবে একবার শিখলে কখনো ভুলবে না কেউ। আমার এক বন্ধু ছিল, খুব ভালো বন্ধু এবং সে ছিল ডালাইট–তখন আমার বয়সও কম ছিল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রিশেলি। অবশ্য সবসময়ই এই ভাষায় কথা বলত না–সে ছিল ভীষণ বুদ্ধিমান–তবে ইচ্ছে হলেই বলতে পারত এবং আমি তার কাছ থেকেই শিখেছি। ওর সাথে এই ভাষায় কথা বলাটা আমার কাছে ছিল দারুণ আনন্দের ব্যাপার। আমার জন্য তা ছিল অজানা এক নতুন জগৎ। ভীষণ চমৎকার। কিন্তু একইসাথে সেই জগতে বিচরণ করাটাও ছিল অসম্ভব। আমার বাবা সেটা পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর এখন এই খুদে দস্যিটাকে দেখে পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। রাইখের বাচনভঙ্গি, চোখ, মুখের কাঠামো ঠিক তার মতো, এবং আগামী ছয় বছর পরে ও মেয়েদের ঘুম হারাম। করে দেবে। তাই না, রাইখ?

আমি জানি না, লেডি–আহ, ম্যাম। রাইখ বলল।

আমার তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তোমার চেহারাটা হবে ঠিক আমার… পুরনো বন্ধুর মতন। সেই সময় তোমার সাথে দেখা না হলেই আমার জন্য ভালো। যাইহোক, ডিনার শেষ। তুমি বরং এবার নিজের ঘরে চলে যাও। ইচ্ছে হলে কিছুক্ষণ হলোভিশন দেখতে পারো। পড়তে জানো না বোধহয়।

রাইখের চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। একদিন ঠিকই পড়বার পারমু। মাস্টার সেলডন কইছে।

তাহলে আমি নিশ্চিত যে তুমি অবশ্যই পারবে।

অল্পবয়সী একটা মেয়ে রাইখের দিকে এগিয়ে এল, রিশেলি যে কোন ফাঁকে মেয়েটাকে ইশারা করেছে সেলডন দেখতেই পাননি।

আমি মাস্টার সেলডন আর মিসাস ভেনাবিলির লগে থাকবার পারি না? জিজ্ঞেস করল রাইখ।

উনাদের সাথে তোমার পরে দেখা হবে, মোলায়েম সুরে বলল রিশেলি। মাস্টার এবং মিসাসের সাথে আমার অনেক জরুরি কথা আছে তোমার এখানে বসে থাকতে ভালো লাগবে না। যাও।

ডর্স কড়া গলায় বিড়বিড় করে বলল, যাও! কোনো দ্বিরুক্তি না করেই গোমড়া মুখে অ্যাটেনডেন্টের সাথে চলে গেল রাইখ।

সেলডন এবং ডর্সের দিকে ফিরে রিশেলি বলল, ওর কোনো সমস্যা হবে না, আরামেই থাকবে। চিন্তা করবেন না, আমিও নিরাপদেই থাকব। মেয়েটা কীভাবে এলো দেখলেনই তো। ইশারা পাওয়া মাত্র ডজন খানেক সশস্ত্র সৈনিক চলে আসবে আরো দ্রুত। আমি চাই ব্যাপারটা আপনারা ভালোভাবে বুঝে নেবেন।

আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই, রিশেলি, নিরাসক্ত গলায় বললেন সেলডন। –নাকি ম্যাডাম মেয়র, বলব?

রিশেলি, শুধু রিশেলি। আমি শুনেছি, হ্যারি, আপনি হাতাহাতি লড়াই-এ বেশ দক্ষ, ছুরিতে ডর্সের হাত বেশ পাকা। ওগুলো অবশ্য ইতিমধ্যে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি চাই না নিজেদের দক্ষতার উপর আপনারা বেশি নির্ভর করেন, বোকার মতো কোনো ঝুঁকি নিয়ে ফেলেন, যেহেতু আমি হ্যারির কোনো ক্ষতি না করে বরং বন্ধুত্ব করতে চাই।

আমরা সবাই জানি, ম্যাডাম মেয়র, ডর্স বলল। রিশেলির বন্ধুত্বের প্রস্তাব পাত্তাই দিল না সে, গত চল্লিশ বছর থেকে এখন পর্যন্ত ওয়ির মেয়র চতুর্থ ম্যানিক্স। তিনি এখনো বেঁচে আছেন। ক্ষমতা এখনো তার হাতেই। আসলে আপনি কে?

যা বললাম আমি ঠিক তাই, ডর্স। চতুর্থ ম্যানিক্স আমার বাবা। ঠিকই বলেছেন, তিনি এখনো জীবিত এবং সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সম্রাট এবং পুরো এম্পায়ারের দৃষ্টিতে তিনিই ওয়ির মেয়র, কিন্তু তিনি ক্ষমতা নিয়ে টানা হ্যাঁচড়া করে করে ক্লান্ত। তাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন ধীরে ধীরে সব আমার হাতে ছেড়ে দেবেন, আমিও তা নেবার জন্য তৈরি হয়েই ছিলাম। বাবার একমাত্র সন্তান আমি এবং সারাজীবন শুধু কীভাবে শাসন করতে হয় তাই শিখেছি। আইনত আমার বাবাই মেয়র, কিন্তু তা শুধু নামেই। মূলত আমিই এখন প্রকৃত মেয়র। ওয়ির সশস্ত্র বাহিনী আমার অনুগত এবং ওয়িতে সেটাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

আপনার কথা আমাদের মেনে নিতে আপত্তি নেই। সেলডন বললেন। কিন্তু মেয়র চতুর্থ ম্যানিক্স বা মেয়র প্রথম রিশেলি–ধরে নিচ্ছি আপনিই প্রথম যে-ই ক্ষমতায় থাকুক না কেন আমাকে আটকে রেখে কোনো লাভ হবে না। আগেই বলেছি। ফলপ্রসূ সাইকোহিস্টোরি আমি তৈরি করতে পারিনি। আমি বা অন্য কেউ তা পারবে বলেও মনে হয় না। সম্রাটকে একই কথা বলেছি। অর্থাৎ তার বা আপনার কোনো উপকারেই আমি আসব না।

আপনি ভীষণ বোকা, হ্যারি। এম্পায়ারের ইতিহাস আপনি জানেন?

মাথা ঝাঁকালেন সেলডন। কয়েক দিন থেকেই ভাবছি যে আরো ভালোভাবে জানতে পারলে বোধহয় উপকারই হতো।

ইম্পেরিয়াল ইতিহাস আমি যথেষ্ট ভালোই জানি, শুকনো গলায় বলল ডর্স। যদিও আমার বিশেষত্ব হলো প্রি-ইম্পেরিয়াল যুগ, ম্যাডাম মেয়র। কিন্তু জানি বা না জানি তাতে কী আসে যায়?

ইতিহাস ভালোভাবে জানা থাকলে এটা নিশ্চয়ই জানেন যে হাউজ অব ওয়ি অত্যন্ত প্রাচীন বিশেষ সম্মানের অধিকারী এবং ডেকিয়ান রাজবংশের পরবর্তী বংশধর তারা।

ডেকিয়ানরা শাসন করেছিল পাঁচ হাজার বছর আগে। কথাটা শুনতে যতই অবান্তর মনে হোক না কেনো সেটা যদি মেনে নেই তাহলে বলা যায় যে পরবর্তীকালে তাদের একশ পঞ্চাশটি প্রজন্মে যারা জন্মেছে, মারা গেছে তাদের সংখ্যা গ্যালাক্সির অর্ধেক জনসংখ্যার সমান হবে।

আমাদের দাবী, ড. ভেনাবিলি, এই প্রথম রিশেলির কণ্ঠ বরফের মতো শীতল শোনালো,–মোটেই অবান্তর নয়। হাউজ অব ওয়ি প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছে এবং আমাদেরই পূর্বপুরুষ এক সময় সিংহাসনে বসেছিল এবং সম্রাট হিসেবে গ্যালাক্সি শাসন করেছিল।

ইতিহাসের বুক ফিল্মে ওয়ি শাসকদের সম্রাট বিরোধী হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

সেটা নির্ভর করে বুক-ফিল্মগুলো কারা লিখছে তার উপর। ভবিষ্যতে আমরাই লিখব, কারণ একসময় আমাদের যে রাজক্ষমতা ছিল তা আবার আমাদেরই হবে।

সেই উদ্দেশ্য সফল করতে হলে আপনাকে একটা গৃহযুদ্ধ বাধাতে হবে।

সেইরকম সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, রিশেলি বলল, আবার হাসি ফিরে এসেছে মুখে। ব্যাখ্যা করে বলতেই হচ্ছে আমাকে। আসলে এই ধরনের বিপর্যয়। ঠেকানোর জন্যই ড. সেলডনের সাহায্য আমার প্রয়োজন। আমার বাবা, চতুর্থ ম্যানিক্স সবসময়ই শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন। ইম্পেরিয়াল প্যালেসে যে-ই আসুক না কেন তার প্রতি তিনি থাকতেন অনুগত এবং ওয়িকে তিনি ট্র্যান্টরিয়ান অর্থনীতির একটা মজবুত ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন যাতে পুরো এম্পায়ারেরই মঙ্গল হয়।

সম্রাট কখনো তাকে বিশ্বাস করেছে বলে আমি শুনিনি। ডর্স বলল।

বিশ্বাস যে করেনি তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই, শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল রিশেলি। কারণ আমার বাবার সময়ে যারাই সম্রাট হিসেবে ইম্পেরিয়াল প্যালেসে বাস করেছে তারা সবাই ছিল জবরদখলকারী। আর একজন জবরদখলকারী কখনোই প্রকৃত শাসককে বিশ্বাস করতে পারে না। তারপরেও আমার বাবা শান্তি বজায় রেখেছেন। তিনি অবশ্য এই সেক্টরের শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নতির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য অত্যন্ত দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত একটা সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন। এবং ইম্পেরিয়াল অথরিটি সেটা মেনে নিয়েছে। কারণ তারা চেয়েছিল ওয়ি যেন তাদের অনুগত থাকে।

কিন্তু আসলেই কী অনুগত?

প্রকৃত সম্রাটের কাছে অবশ্যই। এবং আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যে ইচ্ছে হলেই ক্ষমতা দখল করে নিতে পারব–সত্যি কথা বলতে কী ঠিক বিদ্যুৎ চমকের মতো এবং গৃহযুদ্ধ কথাটা কারো মুখ দিয়ে বেরোবার আগেই একজন। প্রকৃত সম্রাট–বলা যায় না সম্রাজ্ঞীও হতে পারে–ক্ষমতায় বসবে এবং ট্র্যান্টর হয়ে উঠবে আগের মতোই শান্তির রাজ্য।

একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি কী আপনাকে খানিকটা জ্ঞান দান করতে পারি? মাথা নেড়ে ডর্স বলল।

নিশ্চয়ই, আমি সবসময়ই শুনতে আগ্রহী, ডর্সের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো রিশেলি।

হতে পারে আপনার সেনাবাহিনী অনেক বড়ো, প্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, কিন্তু তা কখনোই পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের মদদপুষ্ট ইম্পেরিয়াল ফোর্সের সমকক্ষ হতে পারবে না।

ঠিক, কিন্তু আপনি আসলে অবৈধ সম্রাটের মূল দুর্বলতাটা তুলে ধরেছেন, ড. ভেনাবিলি। পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহে ইম্পেরিয়াল সেনাবাহিনী ছড়িয়ে আছে। অগণিত অফিসারের অধীনে সেই সেনাবাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং তারাও নিজেদের প্রভিন্সের বাইরে কোনোরকম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে আগ্রহী। নয়, অধিকাংশই এম্পায়ারের স্বার্থের বদলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। অন্যদিকে আমার সেনাবাহিনী রয়েছে এখানে, ট্র্যান্টরে। এখানে তাদের প্রয়োজন কথাটা দূরের ওইসব জেনারেল এবং অ্যাডমিরালদের মাথায় ঢোকার আগেই। আমার সৈনিকেরা কাজ করে ফেলবে।

কিন্তু ওরা আসবেই, পূর্ণ শক্তি নিয়ে সেটা ঠেকানোর সাধ্য আপনার নেই।

আপনি কি এই ব্যাপারে নিশ্চিত? আমরা প্যালেস দখল করে নেব। ট্র্যান্টরের ক্ষমতা থাকবে আমাদের হাতে। শান্তি ফিরে আসবে। তাহলে কেন ইম্পেরিয়াল ফোর্স এটা নিয়ে মাথা ঘামাবে যেখানে প্রতিটি মিলিটারি লীডার নিজেদের গ্রহ বা প্রভিন্সের পূর্ণ শাসন ক্ষমতা হাতে পাবে।

আপনি কী এটাই চান? ভীষণ অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন সেলডন। আপনি কী ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়া একটা এম্পায়ার শাসন করতে চান?

আমি ঠিক সেটাই চাই। আমি শাসন করব ট্র্যান্টর, কক্ষপথে বসানো স্পেস সেটলমেন্ট এবং হয়তো বা আশেপাশের কয়েকটা প্ল্যানেটরি সিস্টেম যেগুলো ট্র্যান্টরিয়ান প্রভিন্সেরই অন্তর্গত। গ্যালাক্সির সম্রাট হওয়ার চেয়ে শুধু ট্র্যান্টরের সম্রাট হওয়াতেই আমার বেশি আগ্রহ।

আপনি শুধু ট্র্যান্টর দখল করেই খুশি? ডর্সের গলায় চরম অবিশ্বাস।

কেন নয়? রিশেলি বলল, হঠাৎ করেই তার চোখে একটা আলো ফুটে উঠেছে। আগ্রহের আতিশয্যে সামনে ঝুঁকল, হাত দুটো টেবিলের উপর, আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল। চল্লিশ বছর ধরে আমার বাবা এই স্বপ্ন দেখছেন। তিনি এখনো বেঁচে আছেন শুধু তা পূরণ হতে দেখার জন্যই। পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহ নিয়ে আমরা কী করব? দূরের ওই গ্রহগুলোর কোনো গুরুত্বই নেই আমাদের কাছে। ওগুলো আমাদের দুর্বল করে দেবে, আমাদের সৈনিকদের অপ্রয়োজনে শত শত পারসেক দূরে পাঠাতে হবে, ওগুলো আমাদের সীমাহীন প্রশাসনিক জটিলতা তৈরি করবে। আমাদের নিজেদের গ্রহ–নিজেদের প্ল্যানেটরি সিটি–আমাদের কাছে সেটাই গ্যালাক্সি। সব দিক দিয়েই আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাকি গ্যালাক্সির যা খুশি তাই হোক, আমাদের কী? সামরিক নেতারা যত খুশি ক্ষমতা দখল করুক, ঝগড়া করারও দরকার হবে না, কারণ সবার জন্যই যথেষ্ট আছে।

কিন্তু তারপরেও ওরা লড়াই করবে। ডর্স বলল, শুধু নিজের প্রভিন্স নিয়ে কেউ খুশি হবে না। সে ভাববে হয়তোবা তার প্রতিবেশীও নিজের প্রভিন্স নিয়ে খুশি নয়। প্রত্যেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে এবং পুরো গ্যালাক্সি শাসন করার স্বপ্ন দেখবে। কারণ শুধু ওভাবেই নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, ম্যাডাম এমপ্রেস অব নাথিং। এর ফলে দীর্ঘকালব্যাপী এক লড়াই শুরু হবে–ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু।

রেগে গেল রিশেলি, আপনার মতো অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষের মতো বিচার করলে বা শুধু ইতিহাসের সাধারণ শিক্ষার উপর নির্ভর করলে সেইরকমই মনে হবে।

এর চেয়ে বেশি আর কী বোঝার আছে, সমান তেজে জবাব দিল ডর্স। ইতিহাসের উপর নির্ভর না করে আর কীসের উপর নির্ভর করতে পারে?

আর কী আছে? বলল রিশেলি। কেন, সে? এবং তর্জনী দিয়ে হ্যারি সেলডনকে দেখালো।

আমি? সেলডন বললেন। আমি তো বলেছি যে সাইকোহিস্টোরি-

এক কথা বারবার বলার দরকার নেই, প্রিয় ড. সেলডন। কোনো লাভ হবে না তাতে। আপনার কী মনে হয়, ড, ভেনাবিলি, দীর্ঘকালব্যাপী গৃহযুদ্ধের কথা আমার বাবা চিন্তা করেননি? একটা সমাধানের চেষ্টা তিনি করেননি? দশবছর আগে থেকেই যেকোনো মুহূর্তে ক্ষমতা দখল করার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়ে আছেন। শুধু প্রয়োজন। বিজয়ের পরেও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

যা আপনাদের নেই, ডর্স বলল।

ডিসেনিয়াল কনভেনশনে ড. হ্যারি সেলডনের গবেষণাপত্র শোনার পর থেকেই সেটা আমাদের কাছে আছে। আমি সাথে সাথেই বুঝতে পারি যে ঠিক এই জিনিসই। আমাদের প্রয়োজন। বাবার বয়স হয়েছে, চট করে ধরতে পারেননি। কিন্তু আমি বুঝিয়ে দেওয়ার পর তিনিও বুঝতে পারেন এবং তারপরেই আনুষ্ঠানিকভাবে আমার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। কাজেই আমার বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যতের আরো উন্নত অবস্থান নির্ভর করছে আপনার উপর, হ্যারি।

আমি এখনো বলব- শুরু করলেন সেলডন।

কী করা যাবে আর যাবে না সেটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনগণকে কী বিশ্বাস করানো যাবে আর যাবে না। ওরা আপনাকে বিশ্বাস করবে, হ্যারি, যখন আপনি বলবেন যে সাইকোহিস্টোরিক প্রেডিকশন অনুযায়ী ট্র্যান্টর নিজেকে শাসন করতে পারবে এবং প্রভিন্সগুলো স্বাধীন রাজ্য হিসেবে শান্তিতে থাকবে।

সত্যিকার সাইকোহিস্টোরি ছাড়া এই ধরনের কোনো প্রেডিকশন আমি করব না। কারো হাতের পুতুল হওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। আপনার প্রয়োজন হলে আপনি নিজেই বলেন।

শুনুন, হ্যারি, আমাকে ওরা বিশ্বাস করবে না। আপনাকে করবে। দ্য গ্রেট ম্যাথমেটিশিয়ান। ওদেরকে আপনি নিরাশ করবেন কেন?

সম্রাটও আমাকে তার স্বার্থ হাসিল করার জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল। আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। সেজন্যই কী ভাবছেন যে আমি আপনাকে সাহায্য করব?

কিছুক্ষণ বিরতি নিল রিশেলি। তারপর যখন কথা বলল তার গলাটা প্রায় অনুনয়ের মতো শোনালো।

হ্যারি, ক্লীয়ন এবং আমার মাঝে যে পার্থক্য আছে সেটা বোঝার চেষ্টা করুন। ক্লীয়ন যা চেয়েছিল সেটা নিঃসন্দেহে নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যে প্রচারণা। এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করে কোনো লাভ হতো না। কারণ তার এই ক্ষমতা থাকবে না। আপনি কী জানেন না যে গ্যালাক্টিক এম্পায়ার ভেঙ্গে যাচ্ছে। পঁচিশ মিলিয়ন গ্রহের প্রশাসনিক জটিলতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে ট্র্যান্টর। আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে দীর্ঘকালব্যাপী এক গৃহযুদ্ধ। ক্লীয়নের জন্য আপনি যাই করুন এটা ঠেকাতে পারবেন না।

এইরকম কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু কথাটা সত্যি হলেও কী আসে যায় তাতে?

আপনি কোনো রক্তক্ষয়ী লড়াই ছাড়াই এই কাঠামো ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করতে পারেন। এমন একটা সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আমাকে সাহায্য করতে পারেন যা আয়তনে হবে যথেষ্ট ঘোট এবং যা আরো দক্ষভাবে শাসন করা যাবে। বাকি গ্যালাক্সিকে আমি স্বাধীনতা দেব, প্রতিটি অংশ তার নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি অনুযায়ী ইচ্ছেমতো চলতে পারবে। মুক্ত বাণিজ্য, পর্যটন এবং অবিরত যোগাযোগের মাধ্যমে পুরো গ্যালাক্সি আবার একসূত্রে বাঁধা পড়বে, সেই বন্ধন হবে অনেক বেশি সুদৃঢ়। বর্তমানে যে শাসনব্যবস্থা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পুরো গ্যালাক্সি একত্র করে রেখেছে এবং তার ফলে যে চরম বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেটা আর ঘটবে না। আমার প্রত্যাশা খুব বেশি না; মিলিয়ন নয় একটা গ্রহ; যুদ্ধ নয় শান্তি দাসত্ব নয় স্বাধীনতা। ভেবে দেখুন এবং আমাকে সাহায্য করুন।

কিন্তু, রিশেলি, গ্যালাক্সি আপনাকে বিশ্বাস না করে আমাকে বিশ্বাস করবে কেন? তারা আমার ব্যাপারে কিছুই জানে না এবং আমাদের ফ্লীট কমান্ডাররা শুধু সাইকোহিস্টোরি এই শব্দ দ্বারা প্রভাবিত হবে না।

হয়তো এই মুহূর্তে কেউ আপনাকে বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এখনই আপনাকে কিছু করতে বলছি না আমি। হাউজ অব ওয়ি হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করেছে। আরো এক হাজার দিন অপেক্ষা করতে পারবে। আমার সাথে সহযোগিতা করলে আপনাকে আমি বিখ্যাত করে দেব। কথা দিচ্ছি যে সাইকোহিস্টোরির ব্যাপকতা প্রতিটি গ্রহে ছড়িয়ে পড়বে এবং যখন আমার মনে হবে যে সঠিক সময় উপস্থিত ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা আঘাত করব। তারপর মাত্র কয়েক মুহূর্তের ভেতর পাল্টে যাবে ইতিহাস, এমন এক নতুন শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে যার ফলে গ্যালাক্সিতে অনন্তকালের শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। এত কিছুর পরেও কী আপনি আমাকে সাহায্য করবেন না, হ্যারি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *