৭. অপরাধী ধরা পড়ল

অতপর অপরাধী ধরা পড়ল। নাম অ্যামাটক্সিন এক্স। এক্স স্ট্যান্ডস্ ফর এক্সট্রিম! গ্যালেরিনা, অ্যামানিটা মাসকারিয়া আর অ্যামানিটা ফ্যালয়েডের ডেডলি কম্বিনেশন।

ড. অসীম চ্যাটার্জী গ্রাম্ভারি হেসে বললেন–রাজা রানিকে মাত দিয়ে দিয়েছে। এই গেমটা এবার আমাদের দিকে ঘুরল।

অর্ণব হাঁ করে তাকিয়েছিল তার দিকে। কী সব ভয়ংকর ভয়ংকর নাম বলে যাচ্ছেন ভদ্রলোক! বলাই বাহুল্য, সবই মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে! অ্যামানিটা…! কী যেন!

এগুলো কোনো সুন্দরী মহিলার নাম নয়! ড. চ্যাটার্জী কটমটিয়ে অর্ণবের দিকে তাকালেন–তিনটেই ভয়ংকর ডেডলি মাশরুমের নাম। আসল বিষটার নাম অ্যামাটক্সিন। এই তিনটে মাশরুম থেকেই আলাদা আলাদা অ্যামাটক্সিন পাওয়া যায়। কিন্তু এই তিনটের কম্বিনেশন হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক। অ্যামাটক্সিন এক্স বা এক্সট্রিম। এর কোনো অ্যান্টিডোট এখনও আবিষ্কার হয়নি। রিসার্চ চলছে। শুধু অ্যামাটক্সিন খাওয়ালে তবু বাঁচার উপায় আছে। কিন্তু অ্যামাটক্সিন এক্স একদম শেষ করেই ছাড়বে। লোকগুলোকে যদি জীবন্ত পাওয়াও যেত, কারোর সাধ্য ছিল না তাদের বাঁচায়! অ্যামাটক্সিন এক্সের মাত্র জিরো পয়েন্ট ওয়ান মিলিগ্রামই একটা লোককে ফৌত করার জন্য যথেষ্ট।

অর্ণব বিমূঢ়ের মতো তাঁর দিকে তাকিয়েছিল–তবে ফরেনসিক এক্সপার্টরা অন্য বডিগুলোয় বিষটা পেলেন না কেন?

এই প্রশ্নটাই হচ্ছে আসল–হোয়াই? ড. চ্যাটার্জী টাকে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন–এক্সপার্টদের দোষ নেই। কারণ অ্যামাটক্সিন এক্স বিষটাই পিকিউলিয়ার। এর প্রয়োগের মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সমস্ত বডি পার্টস থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। বিষটা খাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরেই ব্লাড, সিরাম, ফ্লইড, স্টমাক, লিভার, কিডনি-তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোনো ট্রেস পাওয়া যাবে না! একদম ভ্যানিশ–পু!

সে কী! তবে আপনি পেলেন কী করে?

পেতে অনেক পাঁপড় বেলতে হয়েছে। রাজা যখনই হোয়াই প্রশ্নটা করল, তখনই সন্দেহ হয়েছিল। তারপর তাড়াহুড়ো করে লাশের ব্লাডারে যেটুকু ইউরিন তখনও ছিল সেটাকেই পরীক্ষা করেছি। সবটা তোমার মাথায় ঢুকবে না। তবু যতটা সম্ভব সহজ করে বলছি। তিনি খুব সিরিয়াস মুখ করে বললেন–যে বিষ এরকম মারাত্মকভাবে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়, তারও একটা উইক পয়েন্ট আছে। সাধারণ অ্যামাটক্সিন মোটামুটি বিষপ্রয়োগের পর ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সব জায়গা থেকে হাওয়া হলেও একটা জায়গায় ট্রেস রাখে। ওনলি ইউরিন! ইউরিনে মোটামুটি সত্তর থেকে নব্বই ঘণ্টা অবধি থাকে–তারপর আর পাওয়া যায় না। অ্যামাটক্সিন এক্স আবার অতিরিক্ত শক্তিশালী বলে সব জায়গা থেকে মিলিয়ে গেলেও মানুষের মৃত্যুর পরও। ছিয়ানব্বই ঘণ্টা পর্যন্ত তার ব্লাডারের মধ্যে জমা ইউরিনে থাকে। তারপর আর পাওয়া যায় না। রাজা সেই প্রশ্নটাই ডেলিরিয়ামের মধ্যেই বারবার করছিল। কেন ছিয়ানব্বই বা একশো কুড়ি ঘন্টা পরে লাশ পাওয়া গেল? কেন মরে গেলেও লাশটাকে রাতের অন্ধকারে ফেলে দেওয়ার বদলে ফ্রিজারে রাখতে হলো? এর একটাই উত্তর। মার্ডার ওয়েপনটা এমনই যেটা মৃত্যুর ছিয়ানব্বই ঘন্টা পরে নিজে থেকেই হাপিশ হয়ে যায়। তাকে আর ট্রেস করা যায় না। ফরেনসিক পুরো কনফিউজড়। ধরতেই পারবে না লোকটা কী করে মরল! এরকম অবস্থায় ন্যাচারাল ডেথের সার্টিফিকেট লিখতে বাধ্য! ড. চ্যাটার্জী বললেন-বরাতজোরে এবার লাশটা আগেই ডাম্প করেছে বলেই বিষটাকে ধরতে পেরেছি, নয়তো কিস্যু করার ছিল না। আর চব্বিশ ঘণ্টা পরে ফেললে আমি কেন, আমার বাপ-দাদা-চোদ্দগুষ্টি এসে ফরেনসিক সায়েন্সের মা-খালা ঘেঁটে এক করে ফেললেও বিষটাকে উদ্ধার করতে পারত না! আমাদের কপাল, রাজার গুগলিটা ঠিক জায়গায় লেগেছে।

কপাল শব্দটা শুনেই অর্ণব ড. চ্যাটার্জীর টাকের দিকে তাকিয়েছে। অভদ্রলোক সেটা লক্ষ্য করেই চিড়বিড়িয়ে উঠলেন–খবরদার, নিজের বসকে নকল করবে না। সবাইকে সব কিছু মানায় না।

ওকে। সরি। সে ঝাড় খেয়ে দুঃখিত মুখ করেছে-কিন্তু প্রথম দু বার খুনটা অনেক দেরিতে হয়েছিল। এবার এত তাড়াতাড়ি হলো কেন?

অ্যামাটক্সিনের ডোজের জন্য। ড. চ্যাটার্জী বললেন–এটা সায়ানাইডের মতো পুরো এক ছোবলেই ছবি করে না। একটু একটু করে মারে। জেনারেল অ্যামাটক্সিনের মতোই অ্যামাটক্সিন এক্সের সিম্পটমগুলোও প্রথমেই বোঝা যায় না। বিষ দেওয়ার মাত্রার ওপর নির্ভর করে সিম্পটমগুলো কখন থেকে দেখা দেবে। অ্যামাটক্সিন এক্স কাজ করতে সাধারণত মিনিমাম ছয় ঘণ্টা থেকে ম্যাক্সিমাম চব্বিশ ঘণ্টার মতো সময় নেয়। ঐ সময়টা যাকে বিষ দেওয়া হয়, সে ফিট থাকে। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরই তার অ্যাকিউট ডায়রিয়া হতে বাধ্য। ভমিটিং, হাই ফিভার, ডি-হাইড্রেশন, স্টমাক আপসেট, সিভিয়ার স্টমাক পেইন এমনকি ডেলিরিয়ামও হতে পারে। কিন্তু মজার কথা হলো, অ্যামাটক্সিন এক্স এমনই বিষ যেটা খুব কম মাত্রায় দিলে ভিকটিমকে টোট্যাল তিনটে ফেজে মারে। ফাস্ট ফেজে অ্যাকিউট ডায়েরিয়ার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে অ্যাটাক করার পর বিষটা সাময়িক বিরতি দেয়। স্ট্রং ওষুধ খেলে কয়েক ঘণ্টার জন্য ভিকটিম সামান্য সুস্থ হয়। ডায়রিয়াও সাময়িক কমে। এটা সেকেন্ড ফেজ। কিন্তু বিষটা ভেতরে ভেতরে লিভার এনজাইমগুলোকে ক্রমশ বাড়াতে থাকে আর লিভারটাকে ড্যামেজ করে দেয়। ফলস্বরূপ কয়েক ঘণ্টা পরে ফের মার মার কাট কাট। এটাই তার ফাইনাল অ্যাটাক। এবং এই অ্যাটাকেরই শেষ পরিণতি অ্যাকিউট হেপাটিক অ্যান্ড রেনাল ফেইলিওর। এই তিনটে স্টেজে কাউকে মারতে হলে প্রসেসটা লম্বাই হবে। ভিকটিম পাঁচ থেকে আট-দশদিন অবধি বাঁচতে পারে। সম্ভবত সর্বনাশিনী যেদিনই আরআইপি পোস্ট দিয়েছিল সেদিন, কিংবা তার আগের দিনই শিকারকে অ্যামাটক্সিন-এক্স দিয়ে দিয়েছিল। সে জানত এই মৃত্যু ঠেকানোর সাধ্য স্বয়ং ঈশ্বরেরও নেই। সেজন্যই অত কনফিডেন্ট। কিন্তু সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারের ক্ষেত্রে ডোসেজ সম্ভবত অনেক কম ছিল। যার জন্য লোক দুটো অতদিন বেঁচে ছিল। ড. বিজয় জয়সওয়ালের ক্ষেত্রে সে আরও নিষ্ঠুর। যেখানে জিরো পয়েন্ট ওয়ান এমজিই প্রাণঘাতী, সেখানে প্রায় আড়াই থেকে তিন মিলিগ্রাম বিষ দিয়ে দিয়েছে। লোকটাকে মারার খুব তাড়া ছিল দেখছি। ড. জয়সওয়াল খুব বেশি হলে চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচেছিলেন। ইনফ্যাক্ট তার থেকে কম হলেও আশ্চর্য হব না।

আচ্ছা..! অর্ণব জানতে চায়–অ্যামাটক্সিন নামের বিষটা যদি কিছুক্ষণের জন্য ভিকটিমকে সুস্থ করে দেয়, তবে দুজন ভিকটিম ঐ ফাঁকেই হসপিটালাইজড হলেন না কেন?

জীবনে কখনো অ্যাকিউট ডায়রিয়া নামক বস্তুটির পাল্লায় পড়েছ?

ড. চ্যাটার্জীর কটমটে প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল অর্ণব-না তো!

পড়লে বুঝতে অন্তত চল্লিশ থেকে পঞ্চাশবার বমি করে আর তার থেকেও বেশিবার টয়লেটে দৌড়ানোর পর পেশেন্টের কী অবস্থা হয়! ইনফ্যাক্ট, অনেকে ঐ ফার্স্ট ফেজটাই নিতে পারে না। হার্টফেল করে মরে যায়। এই বিষটা ভিকটিমকে বাঁচিয়ে রাখে ঠিকই, তবে তার উঠে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা রাখে না। পেশেন্ট সেন্সলেস হয়ে যেতে পারে, ডেলিরিয়াম হতে পারে। যার উঠে বসার ক্ষমতাই নেই সে হসপিটালে যাবে কী! যেতে পারত, যদি সঙ্গিনী নিয়ে যেত। কিন্তু সে তো পাবলিকটাকে মারার জন্যই এনেছে। বেচারি যখন রিসোর্টে বন্দি অবস্থায় তিলে তিলে পচে মরছিল তখন সে বসে বসে সেফ মজা দেখেছে। এবং শেষপর্যন্ত দুই ভিকটিমই মরেছে। তাদের পাকস্থলিতে খাবার থাকার চান্সই নেই। কারণ বিষ দেওয়ার পর হয়তো তারা আর কিছুই খাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। ডেথটা শ্লো, কিন্তু ভয়ংকর পেইনফুল।

অর্ণবের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। কী ভয়ংকর! চোখের সামনে একটা লোক বিষের প্রভাবে বিনা চিকিৎসায় তিলতিল করে মরছে, খাবি খাচ্ছে–অথচ তার চিকিৎসা করা দূর-কেউ বসে বসে তাদের মৃত্যুর লাইভ শো দেখেছে। কতখানি নিষ্ঠুর হলে এটা সম্ভব! সর্বনাশিনী নাম সত্যিই সার্থক।

তবে বিজয় জয়সওয়ালকে মারার বিশেষ তাড়া ছিল তার। কোনোরকম রিস্কই নেয়নি। ড. চ্যাটার্জী বললেন–সে জানত, পুলিশ তার প্রোফাইলের ওপর নজর রাখছে। রীতিমতো অ্যালার্ট হয়ে গেছে তারা। তা সত্ত্বেও কী সাহস! বিজয় জয়সওয়ালের আরআইপি পোস্টটা করতে হাত কাঁপল না। এবং সে এটা আগে থেকেই জানত যে বিজয় জয়সওয়াল বললেই তোমরা আগেই নিশান জুয়েলার্সের মালিকের কাছেই যাবে! এবং যদি সে লোকটা মিসিং হয়। তবে সব ছেড়েছুঁড়ে তাঁকে খুঁজতেই দৌড়াবে তোমরা। এটাই তার মাস্টারস্ট্রোক। সে প্রথমে জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালকে সরিয়ে দিল, যাতে দ্বিতীয় কোনো সম্ভাবনা তোমাদের মাথাতেই না আসে। তাকে কিছুক্ষণের মধ্যে ছেড়েও দিল যাতে তোমরা তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকো। অনেকটা বাচ্চা ছেলের হাতে ল্যাবেঞ্চস দিয়ে ভুলিয়ে রাখার মতো আর কী। যখন তোমরা জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছ, ততক্ষণে আসল টার্গেট খতম। সর্বনাশিনীর রাস্তা ক্লিয়ার। এই চালটা খুব সাবধানে খেলেছে। আমি খুব আশ্চর্য হব না, যদি সর্বনাশিনীর আসল টার্গেট ড. বিজয় জয়সওয়ালই হয়ে থাকেন। আগের দুটো জাস্ট ট্রায়াল। কারণ ড. জয়সওয়ালকে মারার জন্য সে একটা ফলস্ দান দিয়েছে তোমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য। এটা তাৎক্ষণিক বুদ্ধি হতেই পারে না। ফটু করে ঐ একই নামের লোককে বের করে হাপিশ করে দেওয়া–এটা মাত্র কয়েকদিনের প্ল্যানে সম্ভব নয়। রীতিমতো ওয়েল-প্ল্যানড়! এই গেমপ্ল্যানটা সে অনেকদিন ধরেই বসে বসে বানিয়েছে। প্রত্যেকটা স্টেপ দেখো। অনেক ভেবে-চিন্তে নেওয়া। আর বিষটাও কী আমদানি করল সে? অ্যামাটক্সিন এক্স! যার কোনো অ্যান্টিডোটই নেই। তাছাড়া বিষটাও আনকমন। কতগুলো মাশরুম থেকে বের করা একটা পয়জন! সাইলেন্ট কিলারও বলতে পারো।

অর্ণব একটু চিন্তিত হয়ে পড়ে। এই কেসের গতিপ্রকৃতি ঠিক কোন্ দিকে যাচ্ছে? ভিকটিমরা কেন হসপিটাল অবধি পৌঁছতে পারেনি, সেটা বুঝতে এখন আর অসুবিধে নেই। ভিকটিমরা প্রথমে স্টমাক আপসেট ভেবে ব্যাপারটাকে পাত্তা দেয়নি। তারা রিসোর্টে প্রেম করতে গিয়েছে। সামান্য পেটের গোলমালেই রণে ভঙ্গ দেবে? কিন্তু যখন পাত্তা দিতে হলো, তখন কিছু করার নেই! পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গিয়েছে। বিষের প্রভাবে আর নড়াচড়ার ক্ষমতাও ছিল না। এমনিতেই রিসোর্টের প্রাইভেসি ভীষণ ভাবে রক্ষা করা হয়। তার ওপর অফিসার পবিত্র আচার্য কিছুক্ষণ আগেই রিসোর্টের প্রত্যেকটি কটেজে ফরেনসিকের টিমসহ সার্চ করেছে। কিছুই পায়নি ঠিকই, তবে বেশ কয়েকটা তথ্য সে জানিয়েছে। প্রথমত, এখানে বোর্ডারদের নামের কোনো রেকর্ড নেই। কোনোরকম রেজিস্টার বুক মেইনটেইন করা হয় না। তাই কে আসছে আর কে যাচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। দ্বিতীয়ত, কটেজগুলো সাউন্ডপ্রুফ। সিসিটিভিও নেই। অর্থাৎ বোর্ডারদের প্রেমালাপ কিছুই দেখা বা শোনা সম্ভব নয়। তার ওপর কটেজগুলো বেশ দূরে দূরে আছে। একটাতে কী হচ্ছে বাকি কটেজের বোর্ডাররা জানতেও পারবে না। এমন জায়গায় যে খুন হবে, সেটাই স্বাভাবিক! হতভাগ্য মানুষগুলোর মরা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না।

শুধু তাই নয়–ড. বিজয় জয়সওয়ালের চামড়ায়ও আমি অ্যারোমা অয়েলের ট্রেসও পেয়েছি। যথারীতি, ল্যাভেন্ডার! অর্জুন শিকদারের স্কিন স্যাম্পলে এবং রাজার দেওয়া স্যাম্পলের অয়েলের সঙ্গে পারফেক্টলি ম্যাচ করছে। অর্থাৎ তিনটে স্যাম্পলের অয়েল একই! ড. চ্যাটার্জী একটু ভেবে বললেন–কেন জানি

অর্ণব, আমার মনে হচ্ছে খুনির বটানিস্ট হওয়ার পুরোপুরি সম্ভাবনা আছে। নয়তো অ্যামাটক্সিন এক্স সম্পর্কে সাধারণ মানুষের জানার কথা নয়। এই বিশেষ মাশরুমগুলো সম্পর্কে আলাদা করে রিসার্চ না করলে অ্যামাটক্সিন সম্পর্কে কোনো ধারণাই হয় না। একজন বটানিস্ট বা টক্সিকোলজিস্টের পক্ষেই কিন্তু অ্যামাটক্সিন-এক্সের মতো বিষের কথা জানা সম্ভব।

অর্ণবের মাথায় একটাই নাম এলো। মানসী জয়সওয়াল! এই কেসের একমাত্র স্কলার বটানিস্ট।

আর হ্যাঁ, তোমাদের সন্দেহই ঠিক। জুয়েলার বিজয় জয়সওয়াল রিয়া বাজাজদের ফ্ল্যাটের পার্সোনাল স্টোররুমেই ছিলেন। পবিত্র ওদের ফ্ল্যাট থেকে যে পেইন্টের কনটেনার এনেছে তার ওপরে মি. জয়সওয়ালের জুতোর ছাপ আছে। ওঁকে ওখানেই রাখা হয়েছিল। তোমরা যখন সর্বনাশিনীর সঙ্গে খুঁজি খুঁজি নারি খেলছিলে, তখন ভদ্রলোক ঠিক তার অপোজিটের ফ্ল্যাটেই ছিলেন। তিনি অর্ণবের মুখের দিকে তাকালেন একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে না?

বলুন স্যার।

আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন ড. চ্যাটার্জী–তোমার কর্ম নয়! ইনফ্যাক্ট তোমাদের কারোরই কম নয়। এ একেবারে জাত শয়তান। এরকম ঠান্ডা মাথার শয়তান ক্রিমিন্যালের জন্য তস্য ঠান্ডা মাথার শয়তান অফিসারই লাগবে। লোকিকে একমাত্র থরই হারাতে পেরেছিলেন। তেমনই সর্বনাশিনীর একটাই অ্যান্টিডোট–অধিরাজ ব্যানার্জী! তিনি কথাটা শেষ করে চাপা স্বরে হত ইতি গজ জুড়লেন–হয়তো বা দুর্বলতাও।

অর্ণব কথাটা শুনে আপনমনেই মাথা নাড়ল। কথাটা ভুল বলেননি ড. চ্যাটার্জী। এরকম তুখোড় বদমায়েশের সঙ্গে এঁটে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে সে শুধু একটা কাজই করতে পারে। তদন্তকে যতটা সম্ভব এগিয়ে রাখতে পারে। আর যদি সত্যিই এর মধ্যে আরও একটা আর আইপি পোস্ট পড়ে…!

স্যার।

হাতে একটা ফাইল নিয়ে স্তব্যস্ত হয়ে ঢুকল আহেলি মুখার্জী। ড. চ্যাটার্জী সাগ্রহে তাকালেন–ইয়েস?

দুই বিজয় জয়সওয়ালের গাড়ি অনেক খোঁজার পর কিছু এভিডেন্স পাওয়া গিয়েছে। আহেলি তার স্বভাবমতই এক নিঃশ্বাসে বলতে থাকে- ড্রাইভিং সিটে একটা ছোট হেয়ার স্যাম্পল আছে। চুলটা মেরিলিন প্ল্যাটিনামের গেট কীপার গগনের। গাড়িগুলোকে ঠিকানা সেই লাগিয়েছে। আর কার-এক্সপার্টরা বলছেন যে গাড়ি দুটোর সামনের পোশন আর মাডগার্ড এমনি তুবড়ে যায়নি। ডেলিবারেটলি হাতুড়ি বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়েই তোবড়ানো হয়েছে। এছাড়া…!

তুমি কী ব্রিদেলস গাইছ মিস শঙ্কর মহাদেবন? ড. চ্যাটার্জী অধৈর্য হয়ে। বললেন–নাকি ট্রেন ধরার তাড়া আছে?

ড. চ্যাটার্জীর কথা শুনে আহেলি চুপ করে যায়। উঃ, এই বুড়োর সামনে কিছু বলাই দায়। তড়বড়িয়ে কথা বলাই তার স্বভাব। কিন্তু এই লোকটা সবসময়ই কিছু না কিছু উৎপটাং মন্তব্য করে বসে থাকবেই।

আবার থেমে গেলে কেন! ফরেনসিক এক্সপার্ট আরও বিরক্ত–পজ দিতে বলেছি নাকি? শুধু একটু স্লো মোশনে যেতে বলেছি। তুমি তো স্টপই মেরে ফেললে!

আহেলি অতিকষ্টে নিজের মেজাজ নিয়ন্ত্রণে আনে–ব্যাকসিটে একটা লিপস্টিকের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। খুব হালকা রঙের লিপস্টিক। অফিসার ব্যানার্জী ঠিকই বলেছিলেন। মেয়েটি অত্যন্ত ফরসা!

ড. চ্যাটার্জীর চোখ দুটো চড়াৎ করে তার টাকে চড়ে গেল! কিছুক্ষণ চোখ পিটপিটিয়ে বললেন- একটা লিপস্টিকের দাগ দেখেই কমপ্লেক্সন ধরে ফেললে খুকি! বাপ রে!

স্যার। হসপিটালের ড. বলেছিলেন অফিসার ব্যানার্জীর ঠোঁটে স্ট্রবেরি লিপবাম পাওয়া গিয়েছে। স্ট্রবেরি লিপবাম কোনো গাঢ় কমপ্লেক্সনের মেয়ে ইউজ করে না…!

এক মিনিট…এক মিনিট…। আবার আহেলির চেন টেনে ধরলেন ড. চ্যাটার্জী। চোখ গোলগোল করে বলেন–তোমায় কে বলল যে রাজার ঠোঁটে স্ট্রবেরি লিপবাম্ ছিল? যখন সার্জেন এই কথাগুলো বলছিলেন তখন তুমি ওখানে ছিলেই না! তবে?

আহেলি ঠোঁট কামড়ে নিরুত্তর রইল। অর্ণব তাকিয়ে দেখল তার দু চোখে ঘন মেঘ নেমে এসেছে। সে মনে মনে প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ! কেস কী এখানেও জন্ডিস?

ই-উ! পিপিং টম! তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছ?

আহেলি একটু চুপ করে থেমে থেকে বলল-লেডি অফিসাররা বলাবলি করছিল। আমি ওখান থেকেই শুনেছি। তার ওপর আপনিও অফিসার আচার্যর সঙ্গে ওভারফোনে কথা বলছিলেন…!

ড. চ্যাটার্জীর মনে পড়ল তিনি যখন পবিত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে সে বা কোনো লেডি অফিসার অধিরাজকে সিপিআর দিয়েছিল কি না, তখনই স্ট্রবেরি লিপবামের কথা উঠেছিল। সম্ভবত সেখান থেকেই খবরটা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। লেডি অফিসারদের প্রায় সকলেরই অল্পবিস্তর অধিরাজের প্রতি ব্যথা আছে। অনেকেরই হার্টথ্রব! ফলে লিপবামের কাহিনিটা বেশি রসালো হয়েছে। তার ওপর আহেলির আবার আড়ি পেতে কথা শোনার অভ্যাস! তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–আই উইদড্র! ফুলের সংখ্যা দুই নয়–অজস্র! মালিকে ঈশ্বর রক্ষা করুন!

মিস মুখার্জী যেন কী বলছিলেন?

বেগতিক দেখে অর্ণব প্রসঙ্গটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়–লিপস্টিকের কথা বলছিলেন না?

হ্যাঁ। এবার আহেলি একটু আস্তে আস্তে বলল–একটা লিপস্টিকের দাগ পাওয়া গিয়েছে। এই দেখুন।

সে লিপস্টিকের স্যাম্পলটা দেখায়। অর্ণব আর ড. চ্যাটার্জী–দুজনেই একসঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন স্যামপলের ওপর। ফলস্বরূপ দুজনের মাথাই ঠুকে গেল!

ওঃ! গেছি…গেছি! ড. চ্যাটার্জী লাফিয়ে উঠলেন–কী টাইমিং! তোমাদের জ্বালায় আমায় এরপর থেকে হেলমেট পরে আসতে হবে দেখছি! অলপ্পেয়ে ছোঁড়া। এখনই তোমায় মুণ্ড বাড়াতে হলো!

সরি স্যার! অর্ণবেরও মাথায় জোরদার লেগেছিল। সে চেপে যায়–আপনি দেখুন।

ড. চ্যাটার্জী ভয়ে ভয়ে খুব সামান্য ঝুঁকে দেখলেন। লিপস্টিকটা হালকা গোলাপি। অদ্ভুত হালকা রঙ! একটু ফ্যাকাশে গোলাপির শেড।

এর থেকে প্রমাণিত হলোটা কী? তিনি বললেন–লিপস্টিক যে কেউ মাখতে পারে।

পারে না। আহেলি আত্মবিশ্বাসী–এটা একে ম্যাট লিপক্রিম, আর এর শেডটাকে বলে অ্যাপ্রিকট ব্লুম। মাসখানেক আগেই বাজারে এসেছিল স্যার। কিন্তু চূড়ান্ত ফ্লপ হয়েছে।

তাতে কী প্রমাণ হলো লিপস্টিক এক্সপার্ট? ড. চ্যাটার্জীর চোখ সরু হয়ে গিয়েছে মেয়েটি ফ্লপমাস্টার জেনারেল?

আহেলি তার বক্রোক্তিকে উড়িয়ে দেয়–এই অ্যাপ্রিকট ব্লম শেডটা ফ্লপ হওয়ার একটাই কারণ। এটা এতটাই ফ্যাকাশে, সাদাটে মার্কা যে ভারতীয়দের জেনারেল ট্যান্ড কমপ্লেক্সনে একদমই যায় না। কালো মেয়েদের ঠোঁটে মাখলে একদম জোকারের মতো লাগে। হুইটিশ কমপ্লেক্সনেও মানায় না। ঠোঁট সাদা মনে হয়। একমাত্র যারা ধবধবে সাদা–মানে, রীতিমতো গৌরবর্ণা তাদের গায়ের রঙের সঙ্গে চমৎকার মানায়। স্বাভাবিকভাবেই কোনো কৃষ্ণাঙ্গী এই লিপস্টিকটা লাগাবে না। অথচ এই লিপস্টিকটা সেদিন ঐ গাড়িতে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কেউ মেখেছিলেন। গেট কীপার গগন নিশ্চয়ই লিপস্টিক লাগায় না! কিন্তু তার মালকিন লাগাতেই পারেন। আর যদি এই লিপস্টিকটি তিনি মেখে থাকেন তবে কোনো সন্দেহের অবকাশই নেই যে তিনি ফুটফুটে ফরসা।

ড. চ্যাটার্জী তার দিকে কিছুক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন–বুঝলাম। আর কিছু?

না…কিন্তু…! আহেলি একটু ইতস্তত করে বলল–আপনি রাতে হসপিটালে ফোন করেছিলেন স্যার? অফিসার কেমন আছেন…?

তিনি প্রায় খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলেন–লিঙ্ক নেই–লাঞ্চের পরে এসো। ইস রুট কি সারি লাইন ভেয়াস্ত হ্যায়…!

আহেলি প্রায় দৌড়েই পালিয়ে গেল।

*

সাত দিন! অর্থাৎ একশো আটষট্টি ঘণ্টা! কীভাবে যে কেটে গেল তা ঠিক করে বুঝে ওঠাই গেল না। প্রচণ্ড ব্যস্ততা, দৌড়াদৌড়ির মধ্যেই প্রায় উড়েই গেল সাত-সাতটা দিন।

এই একশো আটষট্টি ঘণ্টা ধরে দুদিকে দুরকম লড়াই চলছিল। একদিকে সর্বনাশিনীর পরিচয় বের করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে সিআইডি, হোমিসাইড। অর্ণবের নেতৃত্বে যতরকম এভিডেন্স সম্ভব জোগাড় করে রাখছে। সাইবার টিম দিনরাত সর্বনাশিনীর প্রোফাইলে চোখ রেখে বসে আছে। নতুন আরআইপি পোস্ট পড়ল কিনা তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে। এ এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতীক্ষা। ব্যালিস্টিক রিপোর্ট এসেছে। তাতে বলা আছে, যে বন্দুকটি রিয়া বাজাজের হাতে ছিল, সেই বন্দুকের গুলিই বিদ্ধ করেছে গগন ও অধিরাজকে। রিয়াকে প্রাথমিকভাবে কাস্টডিতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তার মানসিক অবস্থা দেখে আপাতত জামিনে ছাড়া হয়েছে। কিন্তু রেগুলার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সে এখনও নিজের বয়ানে অনড়–সবাইকে আমিই খুন করেছি। কেন করেছি জানি না!

পবিত্র তার কাছে জানতে চায়–আরআইপি পোস্টগুলো কী তুমিই দিয়েছিলে সর্বনাশিনীর প্রোফাইলে? ঐ প্রোফাইলটা কী তোমার?

রিয়া শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–ওয়ান প্লাস ওয়ান-ইকোয়ালটু ওয়ান।

মানসী জয়সওয়াল, জুয়েলার বিজয় জয়সওয়াল, অহল্যা, রাধিকা আর সুপর্না জয়সওয়ালকে রাউন্ডের পর রাউন্ড জেরা করে চলেছে সিআইডি অফিসাররা। অহনা ভট্টাচার্য আর অ্যালিসকেও দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ছাড়া পাননি অ্যাডেলিন বাজাজও। প্রত্যেকের ব্যাকগ্রাউন্ড হিস্ট্রি রীতিমতো খুঁড়ে খুঁড়ে বের করছে খবরিরা। যতরকমের খবর পাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গেই যোগান দিচ্ছে ইনফর্মার নেটওয়ার্ক। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবরও সামনে এসেছে। যেমন গৌরব জয়সওয়ালের মৃত্যুর পেছনেও গোলমাল থাকা অসম্ভব নয়। তিনি যে চিকিৎসকের চিকিৎসাধীন ছিলেন, সেই ডাক্তার স্পষ্ট বললেন–দেখুন, মি. গৌরব জয়সওয়ালের কেসটা আমাদেরও গোলমেলে লেগেছিল। যখন ওঁকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছিল, ততক্ষণে সিরিয়াস অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। ইনফ্যাক্ট মেডিসিন দেওয়ার পর তিনি সামান্য সুস্থও হয়েছিলেন। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা পরেই অ্যাকিউট হেপাটিক আর রেনালফেইলিওরের ফলে আমাদের আর কিছু করার ছিল না!

আপনাদের সন্দেহ হয়নি?

অর্ণবের প্রশ্নের উত্তরে তিনি একটু চুপ করে থেকে বললেন স্বয়ং বিজয় জয়সওয়াল একজন দক্ষ ডাক্তার ছিলেন। তিনি কোনো সন্দেহ প্রকাশ করেননি। অদ্ভুত লেগেছিল ঠিকই। গৌরবের অবস্থা যে এমনভাবে ডিটোরিয়েট কবে তা আমরা ভাবতেই পারিনি। কিন্তু অ্যামাটক্সিন এক্সের কথা মাথায় আসেনি। তাই ন্যাচারাল ডেথেরই সার্টিফিকেট দিয়েছি। এখন এই কেস হলে হয়তো দুবার ভাবব।

অন্যদিকে অ্যাডেলিন বাজাজ ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। অর্ণবকে পারলে এক থাপ্পড়ই কষিয়ে দেন। অর্ণব কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে শান্তভাবে বলল–ম্যাডাম, আপনি মহিলা বলে ভাববেন না যে আপনার গায়ে হাত তোলা হবে না। আমাদের লেডি অফিসাররা একবার হাতা গুটিয়ে ফেললে ওদের থামানো কষ্টকর। প্লিজ কো-অপারেট করুন।

বিস্ময়ে, রাগে অ্যাডেলিনের চোখ যেন ফেটে বেরিয়ে আসে–আপনি জানেন আমার হাত কতদূর লম্বা?

অর্ণব আফসোসসূচক ভঙ্গীতে মাথা নাড়তে নাড়তে লেডি অফিসারদের দিকে তাকায়–উনি বুঝবেন না। এক কাজ করুন তো। প্রাইম মিনিস্টারকে ফোনে ধরুন। বলুন, এক লম্বা হাতওয়ালা মহিলা ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন!

অ্যাডেলিন বাম্বু খেয়ে চুপ করে গেলেন। তারপর থেকেই চুপচাপ কো অপারেট করছেন। আর কোনো বেগড়াই করেননি। তিনি জানালেন, ছোটবেলা থেকেই দাবা খেলার শখ। রীতিমতো প্রতিভাময়ী দাবাড়ু ছিলেন। ন্যাশনাল লেভেলে একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। কিন্তু বিয়ের পর সব গোল্লায় গিয়েছে। মি. এ বাজাজের ফুল নেম জিজ্ঞেস করলে জানালেন– আনন্দ বাজাজ। অ্যান্ড্রু বাজাজের ছবি দেখাতেই একটু যেন সতর্ক হয়ে গেলেন। যদিও মুখে বললেন–চিনি না।

আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা?

পিকিউলিয়ার কোয়েশ্চেন! তিনি অবজ্ঞায় ঠোঁট ওল্টালেন–বিএসসি ইন কেমিস্ট্রি।

বিয়ের আগের সারনেম?

ভেরি ফানি! অ্যাডেলিনের উত্তর–স্মিথ। অ্যাডেলিন স্মিথ।

ইতোমধ্যেই অবশ্য জানা গিয়েছে যে রাধিকা জয়সওয়াল সত্যিই একজন টক্সিকোলজিস্ট। রাধিকা জেরার মুখে স্বীকার করল যে অ্যামাটক্সিন এক্সের কথা জানে সে। ইনফ্যাক্ট বিষটা ওদের ল্যাবেও আছে। কিন্তু অ্যামাটক্সিন এক্সের প্রয়োগ করার বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করল। শিনা জয়সওয়াল অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। অবশ্য মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভদের সর্বক্ষণই ছোটাছুটি করতে হয়। তাকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়নি। কারণ কোম্পানির কাজে সে একটু কলকাতার বাইরে গিয়েছে। শিনাকে অবশ্য ফোনে ধরা হয়েছিল। সে খুবই বিনম্রভাবে জানিয়েছে কাজ সেরে এসেই ব্যুরোতে হাজিরা দেবে।

অবশ্য শিনা আর কত ব্যস্ত! সুপর্ণা জয়সওয়াল তার থেকেও ব্যস্ত! সকাল দশটার পর আর রাত দশটার আগে পাওয়াই যায় না তাকে। তবু যথাসম্ভব কো-অপারেট করেছে। সে স্বীকার করেছে, অধিরাজ সংক্রান্ত যে ফাইলটা রিয়া বাজাজের ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই খবরের অধিকাংশ খবরই তার লেখা। ইন্টারভিউটাও সে-ই নিয়েছে। তবে অধিরাজের তাকে চিনতে পারার কথা নয়। কারণ ইন্টারভিউটা ওভার টেলিফোন নিয়েছিল। বলতে বলতেই সুপর্ণা হেসে ফেলল–উনি ভারি মজাদার মানুষ! আমি হাসতে হাসতে আরেকটু হলেই মরছিলাম!

মানে? অর্ণব কৌতূহলী।

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম দু-একটা পার্সোনাল প্রশ্ন করতে পারি কি না! তিনি বললেন আন্ডারওয়্যারের ব্র্যান্ড আর মাপটা প্লিজ জানতে চাইবেন না। বাকি সব অ্যালাউড। সুপর্ণা একটু থেমে জানতে চাইল-মি, ব্যানার্জী এখন কেমন আছেন? গুলি লেগেছে শুনলাম। সত্যি?

প্রশ্নটা মৃদু হেসে এড়িয়ে গেল অর্ণব-আপনার বাবার মৃত্যু সম্পর্কে কিছু বলবেন?

সুপর্ণা জয়সওয়াল একটু থেমে জবাব দেয়–আমার কিছু বলার নেই। এরকম লোকেরা এভাবেই মরে। তিনি আমার বাবা ছিলেন। কিন্তু সত্যি বলছি, তাঁর মৃত্যুর জন্য আমি দুঃখিত নই। বাবা আমাকে আর মাকে মানুষ বলেই গণ্য করতেন না। ইনফ্যাক্ট কেউই দুঃখিত নয়। যদি কেউ দুঃখপ্রকাশ করে সে স্রেফ নাটক করছে!

এতখানি স্পষ্ট উত্তরের জন্য অর্ণব প্রস্তুত ছিল না। সে একটু হতচকিয়েই গেল। সুপর্ণা জয়সওয়াল কীরকম মেয়ে? নিজের বাবার খুনটাকে এভাবে নিল!

সে আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সুপর্ণা উঠে দাঁড়িয়েছে–আপনার যদি কোয়েশ্চেনিং শেষ হয়ে থাকে, তবে আমি যেতে পারি? আমার অফিসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যদি দরকার পড়ে তবে আবার ডাকবেন। আমি সময়মতো হাজিরা দেব।

অর্ণব নীরবে মাথা নাড়ল। সুপর্ণার বিরুদ্ধে তাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। তাকে জেরার নামে ব্যুরোতে আটকে রাখা যায় না। এরকম রূঢ় প্রতিক্রিয়ার জন্য দোষও দেওয়া যায় না। খবরিদের কাছ থেকে ড. বিজয় জয়সওয়ালের চরিত্রের যা বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে, তাতে যেকোনো মেয়েই ক্ষুব্ধ হবে। খবরিরা জানিয়েছে ড. বিজয় জয়সওয়ালের সঙ্গে তার বড় বউমা, রাধিকার যথেষ্টই ফষ্টিনষ্টি চলছিল। অহল্যা জয়সওয়াল সবই জানতেন। কিন্তু ভদ্রমহিলার ভয়ংকর পার্সোনালিটি। তার মনের কথা বোঝা দায়। শিনা জয়সওয়ালের সঙ্গে ছোট ছেলে গৌতম জয়সওয়ালের দাম্পত্যের সম্পর্কও খুব সুবিধের নয়। স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে থাকলেই অশান্তি শুরু হয়। ফলস্বরূপ গৌতম শিনার থেকে দূরে দূরেই থাকে। শিনাও স্বামীকে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নয়। সে নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। পেশাগত কারণে মাঝেমধ্যেই বাইরে ট্যুরে চলে যায়। কলকাতায় থাকলেও বেশিরভাগ সময়টাই বাইরে কাটায়।

জুয়েলার বিজয় জয়সওয়ালের এখন কিছু কথা ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছে। যেদিন তিনি অ্যাবডাক্টেড হন, সেদিন রাতে নিয়ম মতো মেরিলিন প্ল্যাটিনামের গেট-কীপার গগন তাকে ওয়াইন দিয়ে গিয়েছিল। গগন মাঝেমধ্যে তার একগ্লাসের সঙ্গী হতো। দামি মদের লোভেই এক্সট্রা সার্ভিস দিত। বাড়ির অন্য চাকরদের বললে মানসী জানতে পারবেন। তার ভয়েই গগনের সঙ্গে সিক্রেট সেটিং বানিয়েছিলেন। সেদিনও গগন তার সঙ্গেই মদ্যপান করেছিল। তারপর আর কিছুই মনে নেই।

অর্ণব সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করে–বড় তাড়াতাড়িই মনে পড়ল!

অহল্যা জয়সওয়াল আবার আরেক অবতার! তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি উত্তর দিয়ে বসে থাকেন! সন্দিগ্ধ যদি হ্যাঁ বললেই হাওড়া বুঝে যায়–তবে মহাবিপদ। অহল্যাকে কোনোরকম প্রশ্ন করার আগেই তিনি বললেন–আবারও বলছি, আমার স্বামী মদ্যপ বা লম্পট ছিলেন না।

কিন্তু তদন্তে তো…!

প্রশ্নটা করার আগেই আবার উত্তর চলে এলো–আপনাদের তদন্ত যা বলছে সেটা আপনাদের ব্যাপার। আর আমি যা বলছি, সেটা আমার বিশ্বাস। কোনটা সত্যি তা আপনারা বুঝে নেবেন।

কী জ্বালা! অর্ণব বিরক্ত হয়ে বলে–আপনি কী জানতে চান না যে আপনার স্বামীর খুনি…!

অহল্যার মুখে একটিও ভাঁজ পড়ল না–জেনে কী করব? ওটা জানা আপনাদের ডিউটি।

কিন্তু কো-অপারেট তো করবেন?

করছি তো! তার সপ্রতিভ উত্তর–আমার জানার পরিধির মধ্যে প্রশ্ন রাখুন, অবশ্যই উত্তর দেব। কিন্তু যা আমি জানি না–তা বলব কী করে? আমি জ্যোতিষী নই।

অর্ণব হালই ছেড়ে দেয়। এই ঝুনো নারকেলে দাঁত বসানোর উপায় নেই। বরং তাতে বত্রিশ পাটিই খুলে হাতে না চলে আসে!

মানসী জয়সওয়াল স্পষ্ট জানিয়েছেন নিজের উকিল ছাড়া তিনি একটি কথাও বলবেন না। অহনা ভট্টাচার্য অবশ্য অনেকটাই ফ্রেন্ডলি। ড. বিজয় জয়সওয়ালের সঙ্গে তার কোনও লিঙ্ক নেই। কিন্তু একটি অদ্ভুত তথ্য পাওয়া গেল। মানসী জয়সওয়ালই এ কেসের একমাত্র বটানিস্ট নন্। অহনাও একজন উদ্ভিদবিশারদ। তার একটি নিজস্ব নার্সারিও আছে। এবং আরও ভয়ংকর তথ্য যে তিনি মাশরুমের চাষও করেন! অ্যালিস যথারীতি চিরন্তন স্নেহময়ী। রিয়ার ব্যাপারে অসম্ভব পজেসিভ। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে বুকে করে মানুষ করেছে। সে বিশ্বাস করে না যে রিয়া অধিরাজকে গুলি করেছে। সাফ বলল–রিয়াবেবি কিছু করেনি। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় পৌঁছে যাওয়াটাই ওর স্বভাব। ব্যাডলাক।

অহনা প্রিয়া আর অহল্যা বাজাজের ছবি এনেছেন। অহল্যার ছবি দেখে পবিত্র ও অর্ণব থ! অধিরাজ যা সন্দেহ করেছিল হুবহু তা-ই! অহল্যা বাজাজকে দেখলেই মনে হয় আফ্রিকান কোনো সুন্দরী শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন! টিপিক্যাল নিগ্লোবটু টাইপের চেহারা। প্রিয়া ষোড়শী। কালো ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে। ফরসা ফুটফুটে, রোগা লিকলিকে। দাঁত উঁচু। চোখেও মোটা পাওয়ারের চশমা। এককথায় দেখতে মোটেই ভালো নয়। তার মাথার পেছনে ক্রিশ্চিয়ান বারিয়াল গ্রাউন্ড-এর নাম লেখা গেট উঁকি মারছে।

ইতোমধ্যে ফরেনসিকও কিছুটা অগ্রসর হয়েছে। ড. অসীম চ্যাটার্জী বিষটা ধরতে পারলেও সেটা কীসের মাধ্যমে দেওয়া হলে সে বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ অন্ধকারেই ছিলেন। কিন্তু তার অন্ধকারে থাকা কোনোদিনই পছন্দ নয়। লাশের বাইরে থেকে যখন কিছুই পাওয়া গেল না তখন হতাশ হয়ে বললেন–অ্যামাটক্সিন এক্স একমাত্র মুখের মাধ্যমেই যেতে পারে। এটা ইনহেল করানো যায় না কিংবা স্কিনের মাধ্যমেও যায় না। প্রয়োজন পড়লে এন্ডোস্কপি করতে হবে।

আপনি হিকিজগুলো দেখেছেন? অর্ণব বলে–এমনও তো হতে পারে যে কেউ দাঁতের মাধ্যমে…।

হোয়াট! ফরেনসিক এক্সপার্ট তাকে এই মারেন তো সেই মারেন তোমার মাথা ঠিক আছে? এটা অ্যামাটক্সিন এক্স! টুথপেস্ট পেয়েছ নাকি যে দাঁতে মেখে কামড়ে দেবে? কামড়ানো তো পরের কথা! যে দাঁতে অ্যামাটক্সিন এক্স মাখবে সে ভিকটিমের আগেই টপকে যাবে! আজকাল ভুলভাল থ্রিলার বেশি পড়ছ নাকি! শেষপর্যন্ত কি না দাঁত…!

বলতে বলতেই থমকে গেলেন তিনি। অস্ফুটে বললেন–তাই তো! দাঁত, দাঁত…!

তারপরই বাস্কেটবলের মতো একখানা বাউন্স মেরে জাপটেই ধরলেন অর্ণবকে। কথা নেই বার্তা নেই, চকাস্ চকাস্ করে চুমু খেয়ে বললেন–জিনিয়াস অর্ণব…!

সর্বনাশ! অর্ণব ভয়ের চোটে কাঁটা হয়ে গেল! বুড়োর হলো কী! উত্তেজনার চোটে তাকেই না লাভ বাইট দিয়ে দেন!

ড. চ্যাটার্জী অবশ্য অত ভয়ংকর কিছু করলেন না। উলটো হাঁক পেড়ে বললেন–আহেলি। ওপেন হিজ মাউথ। আমি ড. জয়সওয়ালের দাঁত দেখতে চাই। তার জন্য যদি বত্রিশ পাটি ভাঙতেও হয় তাও আপত্তি নেই।

ফলাফল পাওয়া গেল একটু পরেই। ড. চ্যাটার্জী জানালেন কী করে বিষটা গিয়েছে জেনেছি। তুমি দাঁতের কথা না বললে ধরতেই পারতাম না। মানছি, খুনির বুদ্ধি আছে! কী মাথাটাই না খেলিয়েছে। বাপ রে!

কী বেরোলো? সে উৎকণ্ঠিত।

দ্রলোকের দাঁতে জিঙ্ক কম্পাউন্ড আর অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল এজেন্ট পাওয়া গিয়েছে। সেটিলফাইরিডাইনিয়াম ক্লোরাইড, মনোহাইড্রেট ইউএসপি। ড. চ্যাটার্জী হাসলেন–মালটা খাবারের মধ্যে বিষ দেয়নি! দিয়েছে মাউথওয়াশের মধ্যে। এসব মাউথওয়াশ লোকে সেক্সের আগে নয়, পরে ব্যবহার করে। বেসিক্যালি শুতে যাওয়ার আগে।

মানে!

মানে একটু শৌখিন লোকদের অভ্যেস থাকে সেক্সের পর ব্রাশ করে মুখ ধোওয়ার। আর যারা মদ খায়, আফটার সেক্স তাদের মুখ একটু শুকিয়ে যায়। একেই চুমু টুমু খেয়েছে, তার ওপর অ্যালকোহল চিরকালই মুখ ড্রাই করতে ওস্তাদ। যখন ফাইনালি ঘুমোতে যাবে, তখন যাতে মুখ বা গলা শুকিয়ে না যায় সেজন্য মাউথওয়াশ ইউজ করে। তার মধ্যে জিঙ্ক কম্পাউন্ড থাকে। এ জাতীয় মাউথওয়াশ মুখকে ভেজা ভেজা রাখে। স্যালাইভা যাতে কন্টিনিউয়াস আসতে থাকে এবং ব্যাড ব্রি না হয় তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখানেও তাই হয়েছে। আফটার আ গুড সেক্স ড. বিজয় জয়সওয়াল মাউথওয়াশ ইউজ করেছিলেন। জিঙ্ক কম্পাউন্ড ছিল বলে স্যালাইভা এসেছে মুখকে ময়েশ্চারাইজ করার জন্য। এবং বিষ স্যালাইভার মাধ্যমেই মহানন্দে ওঁর পাকস্থলিতে চলে গিয়েছে। তারপর কী হয়েছে তা দেখতেই পাচ্ছ! ড. চ্যাটার্জী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–পুরো ঘোল খাইয়ে ছেড়েছে বেটি। আগের দুটো লাশ হাতের কাছে নেই। তবে নির্ঘাৎ দাঁতে এই জিনিসগুলোর ট্রেস পাওয়া যেত। কারণ লোকগুলো ব্রাশ করার পর সেই যে ঘুমিয়েছে তার মধ্যেই অ্যামাটক্সিন-এক্স কাজ সেরে ফেলেছে। অন্তত বিজয় জয়সওয়াল তো আর কিছু খাওয়ার সুযোগই পাননি।

কিন্তু মাউ ওয়াশ তো কুলকুচি করে ফেলে দেওয়া হয়! গিলে তো নেয় না!

গেলার দরকারই নেই। মাউথওয়াশ যতই কুলকুচি করে ফেলে দাও, কিছুটা মুখে, দাঁতে, জিভে লেগে থাকবেই। সেটা স্যালাইভার মাধ্যমে পেটে যাবে। ইনফ্যাক্ট টুথপেস্টের গল্পটাও তেমন। জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেললেও কিছুটা পেটে যায়। মাউথওয়াশের মাধ্যমে যতটুকু অ্যামাটক্সিন এক্স ওঁর পেটে গিয়েছে–তাই মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

অর্ণব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। তাহলে আর যাই হোক, সর্বনাশিনীর লাভ বাইট বিষাক্ত নয়! সে অনুভব করল, বুকের মধ্যে উত্তেজনার পারদ খানিকটা চড়ল। ঘন কুয়াশার মধ্যেও তারা সর্বনাশিনীর দিকে আরও এক পা এগোল!

এদিকে সর্বনাশিনীকে নিয়ে সিআইডি, হোমিসাইড লড়ছে। ওদিকে অধিরাজকে নিয়ে ডাক্তাররা ব্যতিব্যস্ত। তার অবস্থা প্রথম বাহাত্তর ঘণ্টায় রীতিমতো আশঙ্কাজনক ছিল। সে নিজে আর লাফালাফি না করলেও তার প্যারামিটারগুলো লক্ষঝম্প শুরু করে দিয়েছিল। সেলোরিয়াম জিরো। স্যাচুরেশন একবার বাড়ছে, একবার কমছে। ব্লাড প্রেশারের অবস্থাও তেমন। কখনো ঠিক আছে তো কখনো ধরধর করে নামছে। বডি টেম্পারেচারের অবস্থাও তেমনই। ডেলিরিয়াম যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ সামান্য হলেও নড়াচড়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তারপরই একদম স্থির। শান্ত, নিথর! প্রথম তিনদিন ডাক্তারদের ব্যস্ততা দেখে রীতিমতো ভয়ই লাগছিল! অবশেষে তার শারীরীক অবস্থা প্রাথমিক কুশিয়াল বাহাত্তর ঘণ্টা কাটিয়ে থমকে দাঁড়াল। জ্বর ছাড়ল। স্যাচুরেশনও নরমাল। ডাক্তাররা জানিয়েছেন–অবস্থা স্টের। মাঝেমধ্যে ভেন্টিলেশনের পার্সেন্টেজ কমিয়েও দেখছেন। আপাতত সে চুপচাপ আছে বলে দড়িদড়াও খুলে দিয়েছেন। জগদ্দল অক্সিজেন মাস্কের বদলে ন্যাসাল ক্যানুলা লাগানো হয়েছে। এখন তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। কিন্তু যতক্ষণ না হুঁশ ফিরছে, ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। অর্ণব, পবিত্র সমেত গোটা সিআইডি টিমই দু বেলা ভিজিট করছে। ড. চ্যাটার্জীও রোজ বিকেলবেলা একবার আসেন। প্রত্যেকদিনই ওরা এই আশায় থাকে যে হয়তো আজ কোনো সুখবর পাওয়া যাবে। কিন্তু তেমন কোনো লক্ষণই নেই।

তবে এত চাপের মধ্যেও একটাই ভালো খবর। ড. চ্যাটার্জীর কথায় অধিরাজকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখেছেন ডাক্তাররা। তার দেহে অ্যামাটক্সিন এক্স তো দূর, অন্যরকম কোনো বিষই নেই। অন্তত এই সর্বনাশটা হয়নি। তাছাড়া কোনোরকম ইন্টারন্যাল হেমারেজ বা ফুসফুসে কোনোরকম রক্তক্ষরণ হচ্ছে না।

আজও ভারাক্রান্ত মনে বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে হসপিটালে ঢুকল অর্ণব। উ, চ্যাটার্জী ওয়েটিং রুমে তারই অপেক্ষা করছিলেন। অর্ণবকে দেখে এগিয়ে এলেন তিনি–এসেছ? চলো, দেখা করে আসা যাক।

অর্ণবের মুখে বেদনার ছাপ–কী দেখব বলুন তো! সেই তো একই দৃশ্য!

সত্যিই! গত সাতদিন ধরে দৃশ্যটা একটুও পালটায়নি। একটা তরতাজা, ছটফটে লোক চোখ বুজে হসপিটালের বিছানায় নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। প্রথমদিনের মতো ভুল বকছে না, বা ছটফট করছে না ঠিকই তবে অর্ণবের মনে হয় সেটাই বরং ভালো ছিল। ঐ অস্থিরতাটুকু অধিরাজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই চুপ করে থাকাটা যেন আরও অসহ্য। বুকের সামান্য ওঠা পড়াটা লক্ষ্য না করলে বেঁচে আছে কিনা বোঝাই দায়। হাত দুটো বুকের ওপর জড়ো করা। গোটা দেহ শিথিল। যেন এমন অভিশপ্ত ঘুমে তলিয়ে আছে যা কখনই ভাঙবে না।

এখন ডাক্তাররা দুজন করে ভিজিটর অ্যালাউ করছেন। অর্ণব আর ড. চ্যাটার্জী যখন পৌঁছল তখন আবার ডাক্তারদের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়েছে। আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। ডাক্তাররা এত ব্যস্তসমস্ত হয়ে কী করছেন? তবে অবস্থা কী আবার ডিটোরিয়েট করল…!

এই তো। আপনাদেরই খুঁজছিলাম। পূর্বপরিচিত ডাক্তারবাবু ড. চ্যাটার্জীর দিকে এগিয়ে এলেন–আপনারা একটু দেরি করে ফেলেছেন।

মানে! কী বলছেন! অর্ণবের মনে হলো ড. চ্যাটার্জী এইবার নির্ঘাৎ ফেইন্ট হয়ে পড়ে যাবেন–আরও কোনো কমপ্লিকেসি…?

না…না! ডাক্তারবাবু হেসে ফেললেন–চিন্তার কোনো কারণ নেই। বরং খবর ভালোই। অফিসার সেন্সে ফিরেছেন। ইনফ্যাক্ট সকালেই চোখ খুলে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু, লুকটা ব্ল্যাঙ্ক ছিল বলে বুঝতে পারিনি যে সেন্সোরিয়াম ঠিকঠাক আছে কি না। এই দশ মিনিট আগেই পুনরায় তাকালেন। বাবা-মাকে চিনতে পেরেছেন, সামান্য কথাও বলেছেন। আপনাদেরও খুঁজছিলেন। তবে ড্রাউসিনেস আর ক্লান্তি থাকার কারণে বোধহয় বারবার ট্রান্সে চলে যাচ্ছেন। আমরা কতগুলো রুটিন টেস্ট করছি। আপনাদের জরুরি কোনো কথা থাকলে এখনই যান। কারণ যেহেতু এটা সিআইডির কেন্স, সুতরাং হয়তো ওঁর বয়ান। লাগবে আপনাদের। যা বলার এখনই বলে নিন। এরপর আর ওঁকে বিরক্ত করা যাবে না। আপাতত ঘুমোতে দেব। আজ আর কাল অবজার্ভেশনে রেখে আশা করছি পরশুই কেবিনে দিতে পারব।

ওকে। থ্যাঙ্ক ইউ।

কথাটা বলেই সিসিইউর দিকে দৌড়ালেন ড. চ্যাটার্জী। তার পেছন পেছনে অর্ণব।

অন্যান্য দিনের থেকে আজ অধিরাজকে তুলনামূলক সপ্রতিভ লাগছিল। এখনও তার চোখ বোজা ঠিকই, কিন্তু মুখের ফ্যাকাশে ভাবটা অনেক কম। জুনিয়র ডাক্তার ও সিস্টাররা কিছু নল ইতোমধ্যেই সরিয়েছেন। হয়তো আরও কয়েক ঘন্টা পরে আরও কিছু সরবে। ভেন্টিলেটর থেকে সরিয়ে দিলেই আর এত নলের যন্ত্রণা থাকবে না। অধিরাজের মা তার পাশেই বসেছিলেন। ড. চ্যাটার্জী আর অর্ণবকে দেখে ম্লান হাসলেন। ড. চ্যাটার্জী কোনোমতে তার পাশ থেকে ঝুঁকে পড়লেন অধিরাজের ওপর।

রাজা!

পুরো একশো আটষট্টি ঘণ্টা পরে আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকাল অধিরাজ। দৃষ্টিটা অসম্ভব ক্লান্ত। কিন্তু তৎস্বত্ত্বেও তীক্ষ্ণ। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে থেমে থেমে বলল–আমি কী মহাকাশে?

অর্ণব ভয় পেল! সে কী! আবার ডেলিরিয়াম! কিন্তু ডাক্তারবাবু যে বললেন সেন্স ফিরেছে! ড. চ্যাটার্জী ও ঘাবড়ে গিয়েছেন। সংশয়াম্বিত দৃষ্টিতে দেখছেন তার দিকে।

অধিরাজের ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চা ছেলের মতো ঠোঁট চেটে নিয়ে আবার স্তিমিত স্বরে বলল–তবে আমার নাকের সামনে পৃথিবী ঘুরছে কেন?

অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসি চাপার জন্য মুখ ঘুরিয়েছে। ড. চ্যাটার্জী রাগতে গিয়েও হেসে ফেললেন–শোনো দুই চাদু, তুমি যে বেঁচে ফিরেছ তার একটাই কারণ। অন্য কারোর হাতে নয়, তুমি আমার হাতেই খুন হবে। অ্যামাটক্সিন এক্স দিয়ে মারব তোমাকে।

অধিরাজ একটু সচকিত–অ্যা-মা-ট-ক্সি-ন!

হ্যাঁ। বিষটা পাওয়া গিয়েছে। ড. চ্যাটার্জীর চোখে উল্লাস-কেস আমাদের দিকে ঘুরছে বস্। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।

একটা স্মিত হাসি ভেসে উঠল তার ঠোঁটে। পরম প্রশান্তিতে সে চোখ খুঁজেছে। অর্ণব এবার প্রায় অসভ্যের মতো ড. চ্যাটার্জীকে ধাক্কা মেরে এগিয়ে গেল অধিরাজের মাথার কাছে। মৃদু স্বরে ডাকল–স্যার।

হুঁ?

সে একটু যেন বিরক্ত হয়েছে। একটু ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকাল অর্ণবের দিকে।

স্যার, বুঝতে পারছি আপনার অসুবিধে হচ্ছে। অর্ণব একটু বিব্রত–তবু ডিউটি! আপনাকে কে গুলি করেছিল দেখতে পেয়েছিলেন?

অধিরাজের জ্বরু কুঁচকে গেল। কী যেন ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু অথচ দৃঢ় ভাবে বলল–না।

অর্ণব স্তম্ভিত–আপনাকে রিয়া বাজাজ গুলি করেনি?

অধিরাজ আবার চোখ বুজে বলল–আই সেইড, নো।

যাব্বাবা! কী হলো!

ও বিরক্ত হচ্ছে। ড. চ্যাটার্জী অর্ণবকে প্রায় হিড়হিড় করে টেনে সরিয়ে আনলেন–এখন তোমার সওয়াল-জবাব বন্ধ রাখো।

কিন্তু…!

অর্ণব প্রতিবাদে কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল। তার আগেই আবার অধিরাজ মৃদুস্বরে ডেকে উঠল–অ—র্ণ–ব!

ইয়েস স্যার?

সে খুব ক্লান্তভাবেই বলল–এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে?

হ্যাঁ, ঐ ক্লাবের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে।

সে ছাড়া?

না। এখনও পর্যন্ত আর কাউকে না। অর্ণব জবাব দেয়–তবে সবাইকেই জেরা করা হচ্ছে।

অধিরাজ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল–বেশ। আপাতত সবাইকে ছেড়ে দাও। কাউকে জেরা করার দরকার নেই।

স্যার!

এভাবে হবে না, হওয়ার নয়! বরং তোমাদের জেরার চোটে অহল্যা জয়সওয়াল একটা বিরাট ভুল করতে পারেন। ওঁকে সেটা করতে দেওয়া ঠিক হবে না।

বলতে বলতেই সে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল। আর কথা বলতে চাইছে না। অর্ণব একটু বিভ্রান্ত হয়েই বেরিয়ে এলো আইসিইউ থেকে। অধিরাজের কথাটা অদ্ভুত লাগছিল তার। অহল্যা জয়সওয়াল এর মধ্যে আবার কোথা থেকে টপকে পড়লেন! যেখানে গোটা বাজাজ ফ্যামিলিই সামনে চলে এসেছে, দুজন বটানিস্ট সামনে আছেন, একজন টক্সিকোলজিস্ট–সবাইকে ছেড়ে হঠাৎ অহল্যা জয়সওয়ালই কেন! তিনি আবার কী ভুল স্টেপ নেবেন?

ভাবতে ভাবতেই হসপিটালের বাইরে বেরিয়ে আসছিল সে। আচমকা ফোন বেজে উঠেছে। পবিত্র আচার্য!

হ্যালো?

অর্ণব কাম শার্প!

পবিত্রর উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনে একটু নার্ভাস হয়ে যায় সে। সর্বনাশ! আবার কী হলো! আরআইপি পোস্ট পড়েনি তো! এখন আরেকটা ডেথ ফোরকাস্ট পড়লে আর দেখতে হবে না। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল–কেন? কী হয়েছে?

অহল্যা জয়সওয়াল ব্যুরোয় এসেছেন। পবিত্র রুদ্ধশ্বাসে বলল–এবং দাবি করছেন, সর্বনাশিনীর আসল মুখ তিনিই। গৌরব জয়সওয়াল থেকে শুরু করে ড. বিজয় জয়সওয়াল অবধি যত খুন হয়েছে, সব তিনিই করেছেন। স্বামী পুত্রসহ বাকি দুজনকেও তিনিই বিষ দিয়ে মেরেছেন।

অর্ণবের মাথায় যেন বাজ পড়ল! এটাই বাকি ছিল!

*

মানে মানে আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা কাটল। এর মধ্যে সিআইডি হোমিসাইডের অবস্থা রীতিমতো টাইট। অহল্যা জয়সওয়াল তাদের অতিষ্ঠ করে রেখেছেন। ভদ্রমহিলার এমন ব্যক্তিত্ব যে কিছু বলাই বিপদ। তিনি রীতিমতো লিখিত বয়ান দিয়েছেন যে অ্যামাটক্সিন এক্স দিয়ে সবাইকে তিনিই খুন করেছেন। এমনকি

গেট কীপার গগনকেও নাকি তিনিই গুলি করেছেন!

অর্ণব ভ্রূরু কুঁচকে বলে–আপনি গুলি চালাতে জানেন?

জানি কি না একটা রিভলবার দিয়েই দেখুন।অহল্যার শান্ত জবাব।

অর্ণব কী বলবে ভেবে পেল না। ঢোক গিলে বলল–কিন্তু কেন?

অহল্যার চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরে পড়ল–কারণ আমার স্বামী আমার লাইফ হেল করে দিচ্ছিলেন। আমাকে ও আমার মেয়েকে কথায় কথায় অপমান করতেন। আমি ফরসা সুন্দরী নই বলে চিরকালই তার আমার ওপর রাগ ছিল। ভীষণ অত্যাচার করতেন। শুধু তাই নয়, আমার বড় বউমা রাধিকাকে এক্সপ্লয়েট করছিলেন। আর গৌরব একটা ভেড়া। বাপের এই কাজে

তারও মদত ছিল। সহ্যেরও একটা সীমা থাকে। তাই দুজনকেই…!

তাহলে পরপর দুজনকে মারলেই তো হতো। মাঝখানের দুজনকে মারলেন কেন?

পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আমি এটাকে সিরিয়াল কিলিংয়ের কেস হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম। সঞ্জীব রায়চৌধুরী আর অর্জুন শিকদারকে গোল্ডেন মুন ক্লাবেই পেয়ে যাই। ওরা একটি কালো মেয়েকে যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করেছিলেন। তাই ওদেরও…!

অর্ণব এবং পবিত্র পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। এই মহিলাকে সর্বনাশিনী ভাবাই মুশকিল! দুই লম্পট দুশ্চরিত্র ও মাতালকে প্রেমের কুহকের জালে ফেলে বিষ খাইয়ে দেওয়া আর যাই হোক, এই মহিলার কাজ হতেই পারে না। আর যে স্ত্রীকে ড. বিজয় জয়সওয়াল নিজেই দুচক্ষে দেখতে পারতেন না, তার সঙ্গে রিসোর্টে কী করতে যাবেন! হয় অহল্যা মিথ্যে কথা বলছেন, নয়তো ওঁর কোনো সহকারী আছে।

কিন্তু কেউ যদি নিজেই কনফেস করে বসে থাকে কী উপায়! বাধ্য হয়ে তার বাড়িতেও এভিডেন্সের খোঁজ করেছে সিআইডি হোমিসাইড! আর সত্যি সত্যিই তার ঘর থেকে পাওয়া গিয়েছে অ্যামাটক্সিন এক্সের শিশি! তার সঙ্গে মাউথওয়াশটাও। ড. চ্যাটার্জী জানিয়েছেন যে ওটা অ্যামাটক্সিন এক্সই বটে! মাউথওয়াশে যে পরিমাণ অ্যামাটক্সিন এক্স আছে তার একফোঁটাও প্রাণঘাতী! মাউথওয়াশের বোতলের মুখে ড. বিজয় জয়সওয়ালের স্যালাইভাও পাওয়া গিয়েছে। বিষের শিশি ও মাউথওয়াশের গায়ে অহল্যার আঙুলের ছাপও আছে। যথেষ্টই জোরালো প্রমাণ!

কিন্তু তা সত্ত্বেও থিওরিটাকে কিছুতেই হজম করতে পারছে না টিম অধিরাজ। যে তথী, সুন্দরী, ফরসা, রতিক্রিয়ায় পারদর্শিনী, প্রেমিককে লাভ বাইট দেওয়া ট্যাটুওয়ালি দাবাডুকে তারা খুঁজছে সে কিছুতেই অহল্যা হতে পারেন না! আবার অধিরাজের একটা কথাও জর আন্দাজ করে যাচ্ছে না। তার মনে হয়েছিল যে অহল্যা জয়সওয়াল একজন চমৎকার খুনি হতে পারেন।

আগে রিয়া বাজাজ একাই বলছিল যে সে খুন করেছে। এখন অহল্যা জয়সওয়ালও জুটলেন। তিনি তো লিখিত বয়ানও দিয়ে দিয়েছেন! এবার প্লিজ উদ্ধার করে রাজা। আরও দু-একজন যদি এই একই ডায়লগ ঝাড়ে তবে আমাদেরও অ্যামাটক্সিন এক্স ছাড়া উপায় নেই।

অধিরাজ কোলের ওপরে ল্যাপটপ রেখে খুব মনোযোগ সহকারে প্রত্যেকের বয়ানের অডিও রেকর্ডিং আর ভিডিও ফুটেজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনছিল এবং দেখছিল। এখন তার গায়ে পেশেন্টের নীল জামা। গালে বেশ কয়েকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আজ সকালে ভিজিটিং আওয়ারে এসেই অর্ণব তার ল্যাপটপ, মোবাইল সমেত সমস্ত ফরেনসিক রিপোের্ট, এভিডেন্স আর ফুটেজও দিয়ে গিয়েছে। সে সকাল থেকেই বিকেল অবধি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সেগুলো দেখছিল। পবিত্রর কথা শুনে হেসে ফেলল-অত ভয়ংকর কিছু করতে হবে না আশা করছি। তবে শিনা জয়সওয়ালের বয়ান নাওনি তোমরা?

উনি কোম্পানির কাজে বাইরে গিয়েছেন। আজ রাতের ফ্লাইটে ফিরবেন।

অধিরাজ আলগোছে মাথা নাড়িয়ে ফের ফুটেজে মন দেয়। এখন তাকে কেবিনে শিফট করে দিয়েছেন ডাক্তাররা। যদিও এখনও নজরে নজরে রাখছেন। পুরোপুরি ফর্মে ফিরতে আরও আটচল্লিশ ঘণ্টা লেগেছে। ডাক্তাররা স্ট্রেস নিতে বারণ করলেও সে খুব একটা পাত্তা দেওয়ার লোক নয়। সুতরাং যথারীতি বিছানায় আধশোয়া হয়েই কাজে নেমে পড়েছে। পুলিশি তদন্তের সমস্ত ভিডিও, অডিও রেকর্ডিংগুলো খুব মন দিয়ে দেখছে। আজকাল কলকাতা পুলিশ থেকে সিবিআই পর্যন্ত সব গোয়েন্দা বিভাগেই সন্দিগ্ধদের বয়ানের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড থাকে। তাতে তদন্তের ক্ষেত্রেও সুবিধা হয়। কোর্টে প্রমাণ হিসাবেও পেশ করা যায়। অডিও প্রমাণ হিসাবে গ্রাহ্য না হলেও ভিডিও গ্রহণযোগ্য।

অহল্যা জয়সওয়ালের বাড়ি থেকে আর কী কী পেয়েছ তোমরা? এভিডেন্সের মধ্যে একটা চেসবোর্ড আছে দেখছি!

অর্ণব জানায়–হা স্যার। চেসবোর্ডটাও আমরা এনেছি।

ফিঙ্গারপ্রিন্টের জন্য ফরেনসিকের কাছে পাঠিয়ে দাও। জিজ্ঞেস করবে সাদা আর কালো যুঁটিগুলোয় কার কার হাতের ছাপ আছে। সে ফুটেজ দেখা শেষ করে ল্যাপটপটা বন্ধ করে সকালে যে বলেছিলাম, অহল্যা জয়সওয়ালের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও, তার কী হলো?

পবিত্র মাথা চুলকে বলল–ওঁকে এনেছি আমরা। লেডি অফিসাররা ওঁর সঙ্গে নিচে দাঁড়িয়ে আছেন।

সে কী! অধিরাজ শশব্যস্ত–ভদ্রমহিলাকে নিচে বসিয়ে রেখেছ তোমরা? ছি ছি! যাও, এখনই নিয়ে এসো। সঙ্গে লেডি অফিসারদের দরকার নেই। তিনি এক পেশেন্টকে দেখতে আসছেন। কোর্টে যাচ্ছেন না? বুঝেছ?

ওকে।

পবিত্র মাথা নেড়ে চলে গেল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই অবশ্য ফিরেও এলো। সঙ্গে অহল্যা জয়সওয়াল। অর্ণব দেখল ভদ্রমহিলার মুখে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা! এত সহজে বাঁকানো যাবে না তাঁকে। ভাঙা তো দূর! আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরে অনেক চেষ্টা করে দেখেছে। মহিলা নিজের জায়গা থেকে একচুলও নড়েননি।

অধিরাজকে দেখেই অহল্যার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ভেসে ওঠে–ভেবেছিলাম, বোধহয় পেশেন্ট দেখতে এসেছি। এখন আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি, ফের জেরা শুরু হলো বলে!

অধিরাজ কোনো কথা না বলে মৃদু হাসল। দুজনেই দুজনের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অর্ণব স্পষ্ট বুঝল, দাবা খেলাটা ফের শুরু হয়ে গিয়েছে।

আমার যা বলার আমি কিন্তু বলে দিয়েছি। অহল্যা দৃঢ়ভাবে বললেন–আমিই খুনি। স্বীকারোক্তিও দিয়েছি। কিন্তু আপনার এই দুই অফিসার বিশ্বাস করছেন না।

অধিরাজ আলগোছে একটা হাই তুলে বালিশের ওপর পিঠ রেখে আরাম করে আধশোয়া হয়ে বসেছে–ওরা বিশ্বাস করুক বা না করুক–আমি কিন্তু সত্যিই বিশ্বাস করেছি ম্যাডাম। আপনিই খুনি সে বিষয়ে সন্দেহই নেই।

এই ধরনের কথা সম্ভবত অহল্যা আশা করেননি। তাঁর পাথরের মতো মুখে সামান্য বিস্ময় উঁকি মেরেই মিলিয়ে গেল–তবে আমাকে ডেকে পাঠানোর মানে কী!

অধিরাজ তাঁর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল–আসলে আমি খুব ফিল্মি লোক। গল্প শুনতেও খুব ভালোবাসি। তার ওপর বাইরেও বেরোতে পারছি না। ডাক্তারেরা বাগে পেয়ে খুঁচিয়ে খাচিয়ে, ওষুধ গিলিয়ে বোর করছে। একটু এন্টারটেইনমেন্টেরও তো দরকার। তাই আপনার কাছে একটাই আবদার। অন্যদের বাদ দিন। গৌরবকে কীভাবে মারলেন সেটাই একটু বিস্তারিতভাবে বলবেন প্লিজ?

অহল্যার মুখ পাথরের কঠিন–কেন? অ্যামাটক্সিন এক্স দিয়ে?

সে তো আমাদের সবারই জানা। যেটা জানি না সেটাই বলুন। অধিরাজ তাঁর চোখে চোখ রেখেই বলে–একদম সিন বাই সিন। কাট বাই কাট–উইথ ডিটেলিং। আমারও একটু মনোরঞ্জন হবে।

আমি ওর খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর ও অসুস্থ হয়ে পড়ল। হসপিটালে নিয়েও যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু…!

অধিরাজ বাচ্চা ছেলের মতো ঠোঁট উলটে বলল–এটা একটা গল্প হলো! সরি ম্যাডাম, কিন্তু আপনি গল্পকার হলে ফেল মারতেন।

অহল্যা জয়সওয়াল একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মতো তার দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন–আমি গল্প বলতে জানি না।

কিন্তু বাংলা ক্লাসিক সাহিত্য তো পড়েন। দেখেননি ওখানে লেখকেরা কী সুন্দর বর্ণনা দিয়ে লেখেন? এত নিখুঁত ডিটেলিং যে মনে হয় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি! অধিরাজ শান্ত ভঙ্গিতে বলল–আপনি যখন পারেন না, তখন গল্পটা আমিই বলি। আপনি না হয় শুনুন। ভুল হলে শুধরে দেবেন। নাথিং সিরিয়াস-জাস্ট টাইমপাস।

অহল্যা সতর্ক দৃষ্টিতে অধিরাজকে মেপে নিলেন। মৃদু স্বরে বললেন–ওকে।

অধিরাজ আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল। তার কণ্ঠস্বর মায়াবী–গৌরব জয়সওয়াল আপনার প্রথম সন্তানের নাম। সে যখন জন্মেছিল তখন প্রথমবার আপনি মা হয়েছিলেন। সে ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আপনার এই কোকড়া চুলের গুচ্ছ মুঠো করে ধরত। ফোকলা মুখে খিলখিলিয়ে হাসত আর মা শব্দটা উচ্চারণ করার চেষ্টা করত। যখন প্রথমবার সে মা শব্দটা সঠিকভাবে উচ্চারণ করেছিল, আপনি আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন। যখন সে হাসত, তখন আপনিও হাসতেন। যখন কাঁদত, কী করে কান্না থামাবেন ভেবে অস্থির হয়ে যেতেন। অসুস্থ হয়ে পড়লে রাতের পর রাত জাগতেন। আপনার হাত ধরেই সে হাঁটতে শিখেছিল…!

অহল্যার চোখ দুটো যেন স্মৃতিমেদুর হয়ে আসে। যেন সত্যিই শিশু গৌরব জয়সওয়াল তাঁর সামনে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে। যেন নিষ্পাপ শিশু গৌরব টলমলিয়ে তার দিকেই ছুটে আসছে…!

সেই গৌরবই বড় হয়ে অন্যরকম হয়ে গেল। হ্যাঁ, তার দোষ ছিল। মহাপাপ করেছে সে। নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বাবার ভোগ্যবস্তু হয়ে ওঠার পথে বাধা দেয়নি। হয়তো বাবার কঠোর ব্যক্তিত্বের সামনে হেরে গিয়েছিল। আর সেই পাপের শাস্তি পেতেই হতো তাকে। আপনি নিজের হাতেই দিলেন। এবং আমার মতে একদম ঠিক কাজই করেছেন। অ্যামাটক্সিন এক্সের প্রভাবে প্রথমে তার পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করল। যখন সে বিছানায় পড়ে কাটা পঠার মতো দাপাদাপি করছিল তখন আপনি শুধু দেখছিলেন! একদম ঠিক করেছেন!

অহল্যার ভাবলেশহীন মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ পড়েছে। শান্ত চোখ দুটোয় ঈষৎ চাঞ্চল্য।

তারপর শুরু হলো অ্যাকিউট ডায়রিয়া! কিছু খেতে পারছে না! এমনকি জলও না! যা খাচ্ছে বমি হয়ে যাচ্ছে! বমি করতে করতেই একসময় রক্ত উঠতে শুরু করল। একদম টাটকা তাজা রক্ত। আপনার রক্তের ধন আপনারই সামনে মুখে রক্ত তুলছে, যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। আপনি জানতেন অ্যামাটক্সিন-এক্স তার লিভার ছিন্নভিন্ন করে দেবে। গৌরব আর কোনোদিন আপনাকে মা বলে ডাকবে না! তার লিভার আর রেনাল ফেইলিওর অবধারিত ছিল। ও আপনার চোখের সামনে যন্ত্রণায় আধমরা হচ্ছিল–হয়তো খুব কাতরভাবে ডাকছিল–মা…মা বলে। ওর আর কোনো চয়েসই ছিল না। নিজের উঠে দাঁড়ানোরও শক্তি ছিল না। একটু একটু করে বীভৎস এক যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে যাচ্ছিল। তবু আমার বিশ্বাস–সে আপনাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ডেকেছিল। কারণ প্রত্যেক সন্তানই বিশ্বাস করে যে তার মা এসে তার অসহ্য যন্ত্রণা কমিয়ে দেবেন.. যেমন ছোটবেলায় দিতেন…পড়ে গিয়ে চোট পেলে, আদর করে ব্যথা ভুলিয়ে দিতেন–তেমনভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ওষধটি নিয়ে আসবেন মা! তাই হয়তো আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েও সে আপনাকেই ডেকে যাচ্ছিল। আপনিই ছিলেন তার বাঁচার শেষ অবলম্বন। কিন্তু…!

স্টপ…স্ট–প! আই সে!

দুই অফিসারকে স্তম্ভিত করে দিয়ে হা হা করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন অহল্যা জয়সওয়াল–আপনি এত নিষ্ঠুর! চুপ করুন…প্লিজ! আমি আর পারছি না! …আর পারছি না।

অধিরাজ নির্বাক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তার বেডের পাশে একটা টিপেপারের বাক্স ছিল। সে নীরবে একটা টিপেপার বের করে অহল্যার দিকে এগিয়ে দেয়। অহল্যার দেহটা অদম্য কান্নায় কাঁপছে। কোনোমতে ধরা গলায় বললেন- ওঃ।

তাঁকে পুরোপুরি ধাতস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয় সময় ও সুযোগ দিল অধিরাজ। তারপর খুব সস্নেহভাবে বলল–আমার কথা শুনুন ম্যাডাম। বৃথাই কষ্ট করছেন আপনি। অনেকক্ষণ ব্যুরোতে আছেন শুনলাম। এখন বাড়ি যান। রেস্ট নিন। ভালো করে ঘুমোন। দু দিন ভাবুন। তারপরও যদি আপনার স্থির বিশ্বাস হয় যে গৌরব জয়সওয়ালকে আপনিই মেরেছেন–তখন না হয় দেখা যাবে।

অহল্যার গোটা দেহ তখনও কাঁপছিল। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পড়ে যাচ্ছিলেন। পবিত্র তাকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে।

ওঁকে একটু জল-খাবার খেতে দিও পবিত্র। অধিরাজ ফরেনসিক রিপোর্টের ফাইল তুলে নিয়েছে–তারপর একদম বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসবে।

ডান্।

মিসেস অহল্যা জয়সওয়ালকে নিয়ে চলে গেল পবিত্র। অর্ণব দেখল ভদ্রমহিলার হাত-পা তখনও থরথর করে কাঁপছে। ভেঙে পড়েছে ওপরের পাথুরে আবরণ! পাথরের ভেতরে এক মায়ের অপরূপ ভাস্কর্য বেরিয়ে পড়ে যেন নকশাটাকেই আমূল বদলে দিল। এক অন্য অহল্যা জয়সওয়ালকে এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল।

সরি ফর দ্য ড্রামা অর্ণব। টিস্যুপেপারে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল অধিরাজ–কিন্তু টেম্পোটা না তুললে মহিলাকে ভাঙা যাচ্ছিল না।

সে আর বলতে! স্নায়ু যুদ্ধটা তো এইমাত্র নিজের চোখেই দেখল সে। প্রায় বাকরুদ্ধই হয়ে গিয়েছিল অর্ণব। কোনোমতে বলল–এটা কী হলো?

দাবার চাল! কাসলিং বোঝো? চেকমেট বাঁচাতে কিং-এর সঙ্গে রুক, মানে নৌকো জায়গা পালটে নিচ্ছিল। আমি শুধু ডিফেন্সটা ভেঙেছি।

অধিরাজকে একটু ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে কথা বলতে বলতেই আবার বালিশে ঠেশ দিয়ে শুয়ে পড়েছে–চমৎকার মহিলা, আই মাস্ট সে। ইউ নো অর্ণব, আমার হাতে যদি চয়েস থাকত–আমি এই মহিলার প্রেমে পড়তাম।

উনি নন–তাই না?

কোনোমতেই না। কিন্তু তিনি কাউকে সন্দেহ করেছেন। অসম্ভব বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছু আঁচ করেছেন নিশ্চয়ই। যাকে সন্দেহ করেছেন, তাকে গার্ড করার চেষ্টা করছেন। আমি খুব অবাক হব না, যদি অহল্যা বাড়িঘর খুঁজে কোনো প্রিয় মানুষের ঘরে ঐ মোক্ষম এভিডেন্স দুটো পেয়ে থাকেন।

তবে তো ওঁকে জেরা করতে হয়!

একদম না। ভদ্রমহিলাকে দেখে তোমার মনে হলো যে তিনি সব গড়গড়িয়ে বলবেন?

অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–অহল্যা জয়সওয়াল! অভিশপ্ত নাম। কিন্তু তিনি সুন্দরী নন।

আমার মতে তিনি যথেষ্টই সুন্দরী। সৌন্দর্যের সবটাই চোখে দেখা যায় না অর্ণব। অধিরাজ আবার ফুটেজগুলো দেখছে–তবে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। তিনি যা জানেন, আমিও মোস্ট ব্যাবলি তাই জানি।

মানে!

অর্ণবের মাথার চুলগুলো যেন হাই ভোল্টেজ খেয়ে খাড়া হয়ে যায়! এ কী বলছে অধিরাজ। সে অস্ফুটে বলল–আপনি জানেন? কে এবং কেন?

অফকোর্স জানি। সে ল্যাপটপেই চোখ রেখে বলল-কিন্তু তোমরা এ কী করেছ! সব সন্দিগ্ধদের একটা ভাঙা চেয়ারে বসিয়েছ! নতুন চেয়ার নেই!

অর্ণব মনে মনে জিভ কাটে। এই রে! ওটাও গোয়েন্দা প্রবরের চোখে পড়েছে। তার মনের কথা পড়ে নিয়েই যেন বলল অধিরাজ–চোখে পড়াই স্বাভাবিক। কারণ প্রথমবার এটা আমাকে নিয়েই ভেঙে পড়েছিল! সে কোমর আর পিঠের ব্যথা এখনও মনে আছে। সুপর্ণা জয়সওয়াল যদি এই তথ্যটা জানতে পারতেন, তবে কাল সকালের নিউজেই বেরোত–সর্বনাশিনী সন্দেহে ভাঙা চেয়ারের দ্বারা গণহত্যার প্রচেষ্টা সিআইডি, হোমিসাইডের!

কিন্তু এটা আপনি কী বললেন স্যার! আপনি জানেন কে…?

কে, কী করে এবং কেন! অধিরাজ মিটিমিটি হাসল–কী করে তা তো সোনালি চাঁদে গিয়েই বুঝেছিলাম। রানির বোড়ে ভুলটা করে বুঝিয়ে দিল। বাকিটা তোমাদের ইনভেস্টিগেশন। এখন নিশ্চিতভাবেই জানি কে এবং কেন। ভেরি গুড জব অর্ণব। ফাটিয়ে দিয়েছ গুরু।

অর্ণব যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না! তার অবস্থা দেখে হেসে ফেলল অধিরাজ–আচ্ছা, একটা ছোট ক্ল দিই। যেদিন লোকটাকে চেজ করেছিলাম সেদিন তিনটে দফায় চেজ হয়েছিল। তুমি আর পবিত্র গাড়িতে ছিলে আর আমি রেসিং বাইকে। রেসিং বাইক আনার একটাই কারণ–ঐ বাইকে পুলিশ শব্দটা লেখা নেই। আর লেদার জ্যাকেট মার্কা হুলিয়াটা বাইক রেসারদেরই। তোমরা দুজন এমনভাবে ওকে পাগল করে দিয়েছিলে যে অনেকটা পেছনের বাইক রাইডারকে পাত্তাই দেয়নি। যদি দেখতেও পেত তাহলে ভাবত যে যেসব বাইক রাইডাররা আজকাল শহরের ফাঁকা রাস্তায় বে আইনি রেস করে, তাদেরই কেউ হবে। কোনো পুলিশ অফিসার যে রেসিং বাইকে ওরকম হুলিয়া মেরে ওর পেছনে দৌড়তে পারে এটা ঐ টেনশনের মধ্যে ভাবতেও পারেনি। স্বাভাবিকভাবেই ও একেবারে সটান গিয়ে হাজির হলো রানির দরবারে। রানি বিপদ বুঝতে পেরে ওখানেই ব্যাটাকে উড়িয়ে দিলেন। এবং সেখানেই দেখা দিলেন রিয়া বাজাজ।

রিয়া বাজাজই কি আপনাকে…?

ও প্রশ্নটা স্থগিত থাক।

সে অভ্যাসবশতই পেশেন্টের ইউনিফর্মেই বুক পকেট খুঁজছে। অর্ণব আস্তে বলল–ওটা ওখানে নেই। নো স্মোকিং স্যার। ডাক্তারদের বারণ আছে।

সরি। রিয়া বাজাজের প্রসঙ্গে আসি। অধিরাজ হতাশভঙ্গিতে আবার শুয়ে। পড়েছে–প্রথম কথা রিয়া বাজাজ ওখানে এল কী করে? এল তো এল– বন্দুক নিয়ে প্রায় দু মিনিট পোজ মেরে বসে রইল কেন? যাতে পুলিশ ওকে একেবারে হাতেনাতে ধরে ফেলে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, যার প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া আছে সে পাবলিকের এত সেন্স থাকতেই পারে না যে বন্দুকটা তাক করে চালাবে! ওর মাউ ওরফে মাসি অহনা ভট্টাচার্য বলেছেন যে ও ম্যানিকুইনটাকে মি, বাজাজ ভেবে খুন করে, তারপর বস্তাবন্দি করে টেনে হিঁচড়ে ডাম্প করে। হোয়াই? একটা ম্যানিকুইন এত ভারিও নয় যে সেটাকে রিয়ার মতো বড়সড় মেয়ে ঘাড়ে করে নিয়ে যেতে পারবে না! আজকাল লোকে বড় বড় স্যুটকেসে ভরেও লাশ ফেলে দেয়। তবে এত অপশন থাকতে ম্যানিকুইনটা বস্তাবন্দি করে নিয়ে যেতে হলো কেন? তাও আবার টেনে-হিঁচড়ে! বস্তাটা ঘাড়ে ফেলে নিয়ে গেলেই তো হয়।

অর্ণব সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়–তবে কী রিয়া অভিনয় করছে?

একদমই না। রিয়ার মেন্টাল প্রবলেম সত্যিই আছে। অধিরাজ রিয়া বাজাজের বইয়ের ছবিগুলো তুলে ধরল–এই দ্যাখো, ওর কম্পিউটার হ্যাঁকিংয়ের ওপর গুচ্ছ বই এবং তার ওপর ওর নিজের নামের স্টিকার। কোনোটাতে রিয়ার আরটা বড় হাতের কোনোটায় সেই আরই ছোট হাতের! অথচ কনস্ট্যান্টলি বাজাজের বিটা কিন্তু ক্যাপিটাল লেটার! মেয়েটার মাথার ঠিক নেই। ভাবনা চিন্তাগুলো অস্থির।

তবে?

রিয়া কাউকে নকল করছে। অধিরাজ বলল–স্কিজোফ্রেনিয়ার পেশেন্টরা অনেকসময়ই ইকোপ্র্যাক্সিয়ার শিকার হয়। সম্ভবত রিয়ারও সেই সমস্যাটা আছে। রিয়া কাউকে কাজটা করতে দেখেছে, এবং প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়ার সেলফ টর্চারের প্রবণতা অনুযায়ী নিজেকেই সেই অপরাধী ভাবছে! ও চোখের সামনে যে অ্যাকশনটা দেখেছে সেটাকেই বারবার রিপিট করছে।

তাহলে কী সত্যিই প্রিয়াকে মি. বাজাজ খুন করেছিলেন? অর্ণব বলল–রিয়া সেটাই দেখে ফেলেনি তো? অহনাও এরকম কিছুই সন্দেহ করেন! অহনা বলেছিলেন হয়তো রাতের অন্ধকারে প্রিয়াকে খুন করেছিলেন মি. বাজাজ! এবং তারপর বস্তাবন্দি করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে কোথাও ডাম্প করেছিলেন বা পুঁতে দিয়েছিলেন। টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার হয়তো ওটাই কারণ! একটা আস্ত মানুষকে ওভাবেই নিয়ে যাওয়া হয়। সেজন্যই রিয়া অত ভয় পায়! ও হয়তো ভাবেনি বাজাজ ওকেও খুন করবেন। ও মি, বাজাজকেই হয়তো নকল করছে।

ইম্পসিবল নয়। অধিরাজ মিটিমিটি হাসে-সবই সম্ভব। সুপর্ণা জয়সওয়ালের ক্যারেক্টারটাও কী অদ্ভুত দেখো। গোটা ইন্টারোগেশনে ওঁর একটা প্রশ্ন করা উচিত ছিল। কিন্তু করেননি! আশ্চর্য!

কী?

ওঁকে যখনই আমার ফাইলটা দেখিয়েছিলে তখনই তিনি স্বীকার করেছেন যে রিপোর্টগুলো এবং ইন্টারভিউটা ওঁরই নেওয়া। তার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল যে ওটা তোমরা কোথায় পেলে? ফাইলটা ওখানে গেলই বা কী করে? অথচ প্রশ্নটা সুপর্ণা করেনইনি। একজন ক্রাইম রিপোর্টার এত উদাসীন কী করে হন?

অর্ণব হাল ছেড়ে দেয়। এ কুয়াশা ভেদ করা তার সাধ্য নয়। সে অসহায়ভাবে বলল–তবে এরপর কী করব স্যার?

শিনা জয়সওয়ালকে ইন্টারোগেট করে ছেড়ে দাও। অধিরাজ একটু অন্যমনস্ক-আপাতত আর কিছু করার নেই। সেফ হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকো।

ইনভেস্টিগেশন চলবে না? অর্ণব অবাক।

দরকার নেই। কারণ তিনি জবরদস্ত একটা ইনভেস্টিগেশন এক্সপেক্ট করছেন। অন্তত অহল্যা জয়সওয়ালের কনফেশনের পর তো বটেই। এবার আমরা একটু তাঁকে হতাশ করি। ততক্ষণ কিছু করব না যতক্ষণ না তিনি কিছু করছেন। অর্থাৎ নেক্সট আর আইপি পোস্ট পড়ছে। আপাতত সব সাসপেক্টদের বলো একটা করে স্বহস্তলিখিত বয়ান দিতে। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–তলে তলে একটু খোঁজ নাও যে অ্যাডেলিন বাজাজের পতিদেব এর মধ্যে ভারতবর্ষে আসছেন কি না। এলে কবে আসছেন? আর ট্র্যাফিক ডিপার্টমেন্টকে একটু অ্যালার্ট করো। রাতের বেলায় চারটে চাকাই পাংচারওয়ালা কোনো বেওয়ারিশ কার দেখলেই যেন প্রথম ফোনটা সিআইডি, হোমিসাইডেই করে।

অর্ণবের মাথার ভেতরে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি! তাই তো! যারা যারা কালো মেয়েটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন–তাঁদের মধ্যে এখন অ্যাডেলিন বাজাজের স্বামীই শুধু বাকি আছেন। তাহলে কী এরপর তাঁরই পালা…!

ভাবতেই রক্তহিম হয়ে গেল অর্ণবের। সে কোনো কথা না বলে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল। এখন তার অনেক কাজ। তাই তাড়াহুড়োতে বিদায় সম্ভাষণ করতেও ভুলে গেল।

সে চলে যেতেই হঠাৎ অধিরাজ সচকিত হয়ে ওঠে। হাতের কাছেই কলিংবেল। সেটা টিপতেই সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্স এসে দাঁড়াল–ইয়েস স্যার?

গিভ মি আ মিরর প্লিজ।

মিরর নার্সটি যেন একটু অবাক হলো। কিন্তু মুখে প্রকাশ না করে বলল–ওকে স্যার।

অধিরাজের মুখ সন্দেহসঙ্কুল হয়ে ওঠে। গত আটচল্লিশ ঘণ্টা ধরেই একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছে সে। অর্ণব, ভ, চ্যাটার্জী, পবিত্র এমনকি অহল্যা জয়সওয়ালও কথা বলতে বলতেই তার ডান কাঁধের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ওরা ভেবেছে, সে লক্ষ্য করেনি! অধিরাজ অত বোকা নয়। প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো চোখের ভুল। কিন্তু এখন আর সন্দেহ নেই! ওরা তার ডানকাঁধের দিকেই খুব সন্তর্পণে তাকাচ্ছে। কিছু তো গোলমাল আছেই। কিছু গন্ডগোল…!

এই যে স্যার, আপনার আয়না।

সে বিনীত হেসে আয়নাটা নিয়ে নেয়। নার্সটি চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। আর তারপরই…!

আয়নায় ঠিক ধরা পড়ল সেই মোক্ষম জিনিসটি! এখনও মিলিয়ে যায়নি। সামান্য কালশিটের মতো জ্বলজ্বল করছে এখনও! লাভ বাইট!

অসহ্য রাগে, প্রচণ্ড অপমানে তার চোখদুটো জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলল অধিরাজ–

আই হে-ট ইউ!

*

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *