2 of 2

৭৯. ডক্টর সূৰ্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী

ডক্টর সূৰ্যকুমার গুডিভ চক্রবর্তী এর আগেও নবীনকুমারের চিকিৎসা করেছেন, কিন্তু এবার নবীনকুমার যেন অন্য মানুষ। এ রকম রোগী পাওয়া চিকিৎসকদের পক্ষেও সৌভাগ্যের বিষয়। এই রোগী চিকিৎসকের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করবার জন্য প্ৰস্তুত, যে-কোনো ঔষধ-পথ্যে আপত্তি নেই এবং ব্যাণ্ডেজ খোলা-বাঁধার সময় একটুও ব্যথা বেদনার অনুযোগ করে না। সে শুধু বার বার বলে, ডক্তর চক্রবর্তী, আমাকে খুব শিগগির চাঙ্গা করে তুলুন, আমার এখন অনেক কাজ, মাতার মধ্যে হাজারো পরিকল্পনা গিসগিস কচ্চে।

এমনকি ব্যথা খুব বৃদ্ধি পেলে তার কিছুটা লাঘবের জন্য ডাক্তার যখন পরামর্শ দিলেন মাঝে মাঝে একটু ব্র্যাণ্ডি সেবন করতে, তখন নবীনকুমার বলে উঠলো, না, না, আমায় ওসব আর ছুঁতে বলবেন না। আমি ওসব থেকে মুক্ত হয়িচি।

সূৰ্যকুমার ভাবলেন, মানুষের জীবনের গতি কী বিচিত্র! কয়েক বৎসর আগেও এই মানুষটিকে শত ঝুলো বুলি করেও মদ্যপানের উৎকট স্বভাব ছাড়ানো যায়নি। আর আজ সে ওষুধের ডোজেও মদ্য সম্পর্শ করতে অরাজি।

 

সপ্তাহখানেক কেটে যাবার পর সূৰ্যকুমার অন্য কয়েক জন চিকিৎসককে দিয়ে এই রোগীকে পরীক্ষা করাতে নিমরাজি হলেন। এমনিতে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ঘটেনি, পূৰ্ণবয়স্ক-যুবক নবীনকুমারের স্বাস্থ্যটি চমৎকার। মেদহীন মজবুত শরীর, ব্যাধির আর কোনো উপসর্গ নেই। এর মধ্যেই সে উঠে চলাফেরার শক্তি ফিরে পেয়েছে, শুধু ক্ষতস্থানটি শুকোচে না। সেই রকমই দগদগে ভাব। গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে এমনও বলা যায় না। আর জখমটি এমনই মোক্ষম জায়গায় যে ওখানে সাজারিরও তেমন সুযোগ নেই!

নবীনকুমার এখনই নিজেই স্নানাগার-শৌচাগারে যেতে পারে বটে, কিন্তু সামান্য চলাফেরা করলেই তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। সূৰ্যকুমারের কোনো ঔষধেই এই রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না, সেই জন্য তিনি অন্য পদ্ধতির ঔষধ একবার পরখ করে দেখতে চান।

প্ৰথমে মহেন্দ্রলাল সরকার এবং রাজাধিরাজ দত্ত নামে হোমিওপ্যাথির দুই চিকিৎসক এলেন। মহেন্দ্রলাল সরকার এদেশের হোমিওপ্যাথির প্রধান চিকিৎসক তো বটেই, অ্যালোপ্যাথিতেও এ দেশের সবোচ্চ উপাধি এম ডি পেয়েছিলেন। ভারতের তিনিই দ্বিতীয় এম ডি। তা সত্ত্বেও তিনি অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হ্যানিম্যান প্রবর্তিত হোমিওপ্যাথির সমর্থক হয়েছেন। রাজাধিরাজ দত্তও যথেষ্ট খ্যাতিমান। দু জনেই মত প্ৰকাশ করলেন যে গ্যাংগ্রিন হয়নি। এই ক্ষত ঔষধেই নিরাময় করা যায়।

পরদিন এলেন দুই কবিরাজ ভৃগুকুমার সেন এবং বিষ্ণুচরণ সেন। তাঁদেরও ঐ একমত। চিকিৎসা বিভ্রাটেরও কোনো সম্ভাবনা দেখা দিল না, কারণ নবীনকুমার শুধুমাত্র ধনীর দুলাল নয়, সে যথেষ্ট খ্যাতিমান এবং নানা কারণে দেশবাসীর কাছে শ্ৰদ্ধেয়। সুতরাং চিকিৎসকরা নিজেদের অহমিকা প্রচ্ছন্ন রেখে রোগীর দ্রুত আরোগ্যের ব্যাপারেই মনোযোগী হলেন।

মহেন্দ্রলাল সরকার নিজেই বললেন, এখনই অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বন্ধ করে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দেবার দরকার নেই। সূৰ্যকুমারের চিকিৎসা যেমন চলছে চলুক। সেই সঙ্গে কবিরাজি ওষুধও চলতে পারে, কারণ অ্যালোপ্যাথিক এবং কবিরাজি ওষুধ প্রয়োগের মধ্যে কোনো সংঘাত নেই।

যে-হেতু রোগীরও পূর্ণজ্ঞান বর্তমান, তাই চিকিৎসকরা নবীনকুমারেরও মতামত জানতে চাইলো এ ব্যাপারে। নবীনকুমার মহেন্দ্রলাল সরকারের পরামর্শই মেনে নিল। গঙ্গানারায়ণেরও মনে হলো, এটাই উচিত ব্যবস্থা।

শয্যার ওপরে তিনটি বালিশে হেলান দিয়ে আধ-শোয়া হয়ে আছে নবীনকুমার। চক্ষু দুটি উজ্জ্বল। মুখে সামান্য পাণ্ডুর ভাব, তার কথা কওয়া নিষেধ হলেও সে মাঝে মাঝে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিচ্ছে, দু-একবার হাস্য পরিহাসও করছে।

কবিরাজ ভৃগুকুমার সেন পরম বৈষ্ণব। তিনি শুধু ঔষধ দিয়েই চিকিৎসা সারেন না। রোগীর কল্যাণার্থে নামজপও করেন। অন্য চিকিৎসকরা গল্পে রত, কবিরাজ ভৃগুকুমার অনেকক্ষণ ধরে নবীনকুমারের এক হাতের নাড়ি ধরে কী যেন বলে চলেছেন অস্ফুট স্বরে। তাঁর দুই চক্ষু মুদিত, দেহ এমনই নিষ্পন্দ যে মনে হয় ঘুমন্ত, শুধু ওষ্ঠ নড়ছে একটু একটু।

সেদিকে তাকিয়ে রাজাধিরাজ দত্ত এক সময় ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বলে উঠলেন, ও কোবরেজ মোয়াই, আপনাদের বোষ্টমদের হরিসভায় কদিন আগে কী কাণ্ড হয়ে গেল, শুনোচোন?

ভৃগুকুমার চোখও খুললেন না, উত্তরও দিলেন না।

বিষ্ণুচরণ জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে?

বিষ্ণুচরণও বৈষ্ণব, তবে ততটা আচার অনুষ্ঠান মানেন না। এবং প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে শাক্তমতে একটু কারণবারি পান করেন। ভৃগুকুমারের বেশী খ্যাতির জন্য তাঁর মনে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা ঈর্ষা আছে।

রাজাধিরাজ দত্ত বললেন, সে তো এক হুলুস্থুলু ব্যাপার। কলুটোলার কালী দত্তের নাম শুনেছেন? যার বাড়িতে প্ৰকাণ্ড হরিসভা বসে?

কালী দত্তের বাড়িতে হরিসভার আসর বসলে এমন জনসমাগম হয় যে সামনের পথ দিয়ে লোকজন গাড়িঘোড়া চলাচল করতে পারে না। সভার মধ্যখানে একটি বেদীতে পাতা থাকে একটি শূন্য আসন। সকলকে কল্পনা করে নিতে হয় যে ঐ আসনে মহাপ্ৰভু শ্ৰীচৈতন্য সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থান করছেন। তাঁকে ঘিরে ভক্তরা ভাগবত পাঠ করে। তারপর নৃত্য সহযোগে নামগান হয়।

সেই কালী দত্তের হরিসভার কথা কে না শুনেছে!

—কী হয়েছে সেখানে?

রাজাধিরাজ দত্ত বললেন, যা হয়েচে, তাতে বোষ্টম বাবাজীরা একেবারে স্ক্যাণ্ডালাইজড। কালীসাধক রামকৃষ্ণ সেখানকার চৈতন্যদেবের আসনের ওপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেল। শুধু তাই নয়, ডাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই অজ্ঞান।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, রামকৃষ্ণ কে?

—রানী রাসমণির দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের পুজুরী। যে রামকুমার চাটুজেকে দিয়ে রাসমণি দক্ষিণেশ্বরের মন্দির খোলালেন, এ তার ভাই।

বিষ্ণুচরণ বললেন, আমি গেছি। দক্ষিণেশ্বরে। রামকুমারের ভায়ের নাম তো গদাধর।

রাজাধিরাজ দত্ত বললেন, হ্যাঁ, সেই গদাধর ঠাকুরই বটে। কোন এক নাগা সন্ন্যোসী নাকি একে দীক্ষা দিয়ে অবধূত বানিয়ে ন্যাচেন। এখন নাকি তাঁর একেবারে ন্যাবড়া-জ্যাবড়া অবস্থা। যখুন। তখুন ভাব হয়। একটা হাত ওপর দিকে উঠে আঙুল বেঁকে যায়।

বিষ্ণুচরণ বললেন, আমি মানুষটি সম্পর্কে অনেক রকম কথা শুনেছি। পূজ্যপাদ, ধন্বন্তরি গঙ্গাপ্রসাদ সেন কিছুদিন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে এর চিকিৎসা করেছেন। তাঁর মুখেই শুনেছি যে লোকটির ধরন-ধারণ অত্যাশ্চর্য। উন্মাদরোগ হয়েছে বলে মথুরবাবু নানা চিকিৎসক ডেকে এই পূজারীটির চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। কিন্তু এ কেমন উন্মাদ? দিনের পর দিন ঘুমোয় না, বুক-পিঠ লাল, কুকুরের সামনে থেকে খাবার তুলে নিয়ে নিজে খায়। কালীপূজা করতে বসে ফুল-বেলপাতা দিয়ে নিজেকেই পূজা করে, অথচ মুখখানি বড় করুণ। চক্ষু দুটি কান্না মাখানো। পূজ্যপাদ গঙ্গাপ্রসাদ সেন আমায় বলেছিলেন, কোনো ঔষধেই সেই মানুষটির কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। বড়ই বিস্ময়কর।

রাজাধিরাজ দত্ত বললেন, সে যাই হোক গে, কিন্তু এটা কেমন ব্যাপার বলুন! এক শাক্ত কালীসাধক বোষ্টমদের আখড়ায় গিয়ে চৈতন্যদেবের আসনের ওপর উঠে দাঁড়াবে? অ্যাঁ?

ভৃগুকুমার এবার নবীনকুমারের হাত ছেড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর চক্ষু খুলে বললেন, বেশ করেছেন তিনি! আমি সেই সভায় স্বয়ং উপস্থিত ছিলাম। আমি স্বচক্ষে দেখেছি। তিনি সাধারণ মানুষ নন। তাঁর মুখের পানে তাকালেই দিব্যভাব টের পাওয়া যায়।

নবীনকুমার জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন মানে? তাও কি সম্ভব?

ভৃগুকুমার বললেন, সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ওঁর হলো ভাব সমাধি। চক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মশায়, এই আমি বলে দিলুম, ঐ রামকৃষ্ণ ঠাকুর যে-সে লোক নন, ক্ষণজন্ম পুরুষ! দেখবেন, একদিন শত সহস্ৰ লোক ওঁর পায়ে গিয়ে আছড়ে পড়বে।

নবীনকুমার বললো, তা হলে তো এই সাধুটির সঙ্গে একদিন দেকা করতে হয়।

গঙ্গানারায়ণ বললো, তুই ভালো হয়ে ওঠ, ছোট্‌কু, তারপর তোতে আমাতে একদিন একসঙ্গে যাবো।

 

শয্যায় শুয়ে শুয়েই নবীনকুমার নানা রকম বিষয়কর্ম পরিচালনা করতে লাগলো। ভুজঙ্গধর মারফত তাদের অন্যান্য জমিদারির নায়েবদের ডেকে পাঠানো হয়েছে। নবীনকুমার নির্দেশ দিল, সমস্ত প্রজাদের খাজনা মকুব করে দেওয়া হবে। যার যা জমি আছে তাতে সে চিরস্বত্ব ভোগ করবে। সরকারের ঘরে জমিদারের দেয় খাজনা জমা পড়বে জমিদারের তহবিল থেকে।

কিন্তু খাজনা একেবারেই আদায় না করলে জমিদারের তহবিল থাকবে কী?

কেন, জমিদারের নিজস্ব অনেক খাস জমি, বাগান, জলকর আছে, তার থেকে আয় কম নয়। তাতেও ব্যয় সকুলান না হলে সেগুলি বিক্রয় করতে হবে একের পর এক। এর মধ্যেই উড়িষ্যার এক বিশাল জঙ্গল এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় দুটি বিল নবীনকুমার বিক্রি করে দিয়েছে। সেই টাকায় শহরের উপকণ্ঠে কেনা হয়েছে অনেকখানি জমি সমেত একটি বাড়ি। সেখানে খোলা হবে কৃষি কলেজ। তার জন্য ট্রাস্টি বোর্ডও সে ঠিক করে ফেলেছে।

গঙ্গানারায়ণ একদিন কুণ্ঠিতভাবে বললো, তুই এ সব কী কচ্চিস, ছোট্‌কু? আমাদের কলকাতার হৌসে খুব দুঃসময় চলচে, বহু টাকার শেয়ার গচ্চা গ্যাচে, এখন ঋণ করে খাতকদের টাকা শুধতে হবে। তুই এর মধ্যে দুহাতে সব উড়িয়ে দিচ্চিস?

নবীনকুমার সে প্রসঙ্গে কান না দিয়ে অত্যুৎসাহের সঙ্গে বললো, কিন্তু, কৃষি কলেজের খুবই দরকার কিনা বলো? হিন্দু কলেজের আগেই আমাদের এখেনে কৃষি কলেজ খোলা উচিত ছিল না? চাষ-বাস থেকেই এ দেশের যাবতীয় আয়, আর সেই চাষীদের জ্ঞান বুদ্ধি দেবার কোনো ব্যবস্থা না করে আমরা শুধু কেরানি তৈরি কচ্চি? দাদামণি,শুধু কলকেতায় নয়, আমরা গ্রামে গ্রামেও কৃষি বিদ্যালয় খুলবো। চাষীরা সেখেনে এসে ইংরিজি-বাংলা শিকবে না, চাষের নতুন নিয়ম শিকবে। আয়ারল্যাণ্ডের চাষীরা উত্তম সেচ ব্যবস্থা জানে, সেখেন থেকে আমরা শিক্ষক আনাবো।

 

দুপুরবেলা নবীনকুমার ঘুমিয়ে পড়লে সকলে ঘর ফাঁকা করে চলে যায়। শুধু মেঝেতে মাদুর পেতে শুয়ে থাকে দুলাল। হঠাৎ এক সময় নবীনকুমারের ঘুম ভেঙে যায়, এই অনুভূতি নিয়ে যে সব কিছুর জন্যই বড় বেশী দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখুনি সব কিছু সক্রিয়ভাবে শুরু করা দরকার। এ রকম ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে থাকলে চলবে না।

আস্তে আস্তে উঠে বসে সে কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে চেয়ে থাকে। ঘরের সাদা দেয়ালটি বড় শান্ত, মায়াময়। বেশ একটা মেহের ভাব আছে। ওদিকে তাকালেই মনে হয়, এই পৃথিবী বড় উপভোগ্য স্থান।

নবীনকুমার নিজেই ধীরে ধীরে ব্যাণ্ডেজটা খুলতে শুরু করে। প্রতিবারই খোলার সময় খুব যন্ত্রণা হয়। নবীনকুমার ওষ্ঠ কামড়ে থাকে, টু শব্দটি করে না। একেবারে খোলা হয়ে গেলে সে একবার ব্যথিত নিঃশ্বাস ফেললো। ক্ষতস্থানটি ঠিক যেন একই রকম রয়েছে।

ধীরে ধীরে খাট থেকে নেমে সে গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার পাশে। হেঁটে আসতে তার কষ্ট হলো না, কিন্তু বুকের বাঁদিকে তাকিয়ে তার মন খারাপ হয়ে গেল। অদ্ভুত ধরনের লাল একটা গর্ত। এই গর্তটা বুজবে না? নবীনকুমারের আবার মনে হলো, এই গর্ত দিয়ে আমার হৃৎপিণ্ডটা বেরিয়ে আসবে না তো?

আস্তে আস্তে রক্ত গড়াতে লাগলো ক্ষত থেকে। নবীনকুমার আবার ব্যাণ্ডেজ জড়াতে গিয়ে হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে বললো, কে?

সেখানে কেউ নেই।

অথচ নবীনকুমারের স্পষ্ট মনে হলো, আয়নায় সে অন্য একজনের ছায়া দেখেছে।

অবিবেচকের মতন একটু দ্রুতই এসে নবীনকুমার উঁকি দিল দরজার বাইরে। কারুর চিহ্ন নেই সেখানে। তাহলে কি মনের ভুল!

 

বুক থেকে ঝরঝরিয়ে রক্ত পড়ছে। নবীনকুমার এলোমেলোভাবে ব্যাণ্ডেজের গজ জড়িয়ে ফেললো বুকে। তারপর শয্যায় ফিরে আসবার সময় পালঙ্কে একটু হাঁটুর আঘাত লাগতেই সেই শব্দে জেগে উঠলো দুলাল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে সে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েচে, ছোটবাবু?

নবীনকুমার বললো, না রে, কিচু না। একটু দেকচিলুম ঘোরাফেরা করতে পারি কিনা। বেশ পেরে তো গেলুম।

দুলাল বললো, না, ছোটবাবু। ডাক্তাররা বারণ করেচেন!

নবীনকুমার বালিশে মাথা দিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে একটা চাদর চাপা দিল বুকের ওপর। তারপর বললো, দুলাল, শোন!

-কী ছোটবাবু?

—যে লোকটা আমায় কামড়েছেল তাকে তুই একেবারে মেরে ফেললি? কেন রে?

—আমার মাথায় খুন চেপে গেসলো।

—লোকটাকে তোর মারা ঠিক হয়নি কো। ধরে বেঁধে নিয়ে আসতে পারতিস।

–কী বলচেন, ছোটবাবু, সে কি মানুষ, না নরপশু? ওকে যে আমি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলিনি…

—তুই নিয়তিতে বিশ্বাস করিস, দুলাল?

—নিশ্চয়, ছোটবাবু। নিয়তিই তো মানুষকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্চে!

—আমার নিয়তিই কি আমায় টেনে নিয়ে গেল ঐ লোকটার কাচে? একটা সাধারণ পাগল, সে হঠাৎ আমাকেই কামড়ে দিল কেন?

—আপনি ভালো হয়ে যাবেন, ছোটবাবু। এত সব তা বড় তা বড় ডাক্তার কোবরেজরা বলচেন।

—ভালো হয়ে তো উঠবেই। কিন্তু বড় দেরি হয়ে যাচ্চে রে!

পর মুহূর্তেই নবীনকুমার আবার চেঁচিয়ে উঠলো, কে?

দুলাল বললো, কোতায় কে ছোটবাবু?

—দরজার পাশ থেকে কে যেন স্যাৎ করে চলে গেল। দ্যাকতো দ্যাকতো! কে উঁকি দিয়ে ফিরে যাচ্চে!

দুলাল ছুটে বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজে এলো। কারুর চিহ্ন নেই এবারেও।

দুলাল ফিরে এসে বললো, না ছোটবাবু, কেউ নেইকো।

নবীনকুমার ভুরু কুঁচকে রইলো।

 

পরদিন মধ্য দুপুরে নবীনকুমার আবার নামলো পালঙ্ক থেকে। বেশ কয়েক পা ঘুরে বেড়ালো। ব্যাণ্ডেজ আস্তে আস্তে লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে বটে কিন্তু আজ সে আরও সাবলীলভাবে হাঁটতে পুরস্কাস্করণের ফলেও যদি শরীরের দুর্বলতা বোধ না হয়, তা হলে আর চলাফেরা করতে আপত্তি কী?

গায়ে একটা মুগার চাদর জড়িয়ে নিয়ে নবীনকুমার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। যেন সে একটা মুক্তির স্বাদ পাচ্ছে, অনেক দিন ধরে সে বন্দী হয়ে আছে।

ওপর মহলে মানুষজন এমনিতেই খুব কম। দুপুরবেলা একেবারে সুনসান থাকে। সরোজিনীও দিনের বেলা নবীনকুমারের কাছে আসে না। এখন সে প্রায় সর্বক্ষণই ঠাকুর ঘরে থাকে।

এক সময়ে নবীনকুমারের মনে হলো, এই গৃহটি কার? এত বড় বড় খিলান, প্রশস্ত সব কক্ষ, কারুকার্যখচিত দরজা, এ সব কে বানিয়েছে? কারা থাকে। এখানে? নবীনকুমার যেন এক আগন্তুক, ভুল করে কোনো অচেনা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। বড় সুন্দর তো এই বাড়িটি?

কে যেন বড় সুমধুর স্বরে গান গাইছে। খুবই মৃদু কণ্ঠ, কিন্তু এই শূন্য পুরীতে সেই গানের তরঙ্গ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। নবীনকুমারের সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ হলো। কেমন যেন অলৌকিক অনুভূতি হয়। এই ঘুমন্তপুরীতে কোনো রমণী একা একা গান গেয়ে চলেছে।

সেই সুরের টানে আকৃষ্ট হয়ে নবীনকুমার পায়ে পায়ে তার উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাম হাত দিয়ে বুকটা চেপে ধরে আছে, যেন এইভাবে ধরে থাকলে রক্তক্ষরণ কম হবে।

 

একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে সে থামল। এবার সে চিনতে পেরেছে। এ তো তার জননীর কক্ষ। এখানে কে গান গায়? তার জননী তো আর ইহলোকে নেই।

ডান হাত দিয়ে একটু ঠেলা দিতেই দরজাটা খুলে গেল।

ভিতরে একটা জলচৌকিতে বসে আছে কুসুমকুমারী। তার আলুলায়িত কুন্তল পিঠের ওপর ছড়ানো। হাতে একজোড়া খঞ্জনী। তার সামনে পা ছড়িয়ে বসে গান গাইছে এক দাসী আর কুসুমকুমারী তাতে তাল দিচ্ছে।

গানের মধ্যে তন্ময় হয়ে ছিল দুজনেই, অকস্মাৎ দরজাটা খুলে যেতেই কুসুমকুমারী চমকিত হয়ে বললো, ওমা!

বিম্ববতীর কক্ষে যে গঙ্গানারায়ণ-কুসুমকুমারী অনেক দিন ধরেই রয়েছে, সে কথা নবীনকুমার ভালোভাবেই জানে। কিন্তু আজ যেন তার ঘোর লেগেছে, কিছুই মনে নেই। সে কয়েক মুহূর্তের জন্য কুসুমকুমারীকে চিনতে পারলো না।

দারুণ উৎকণ্ঠার সঙ্গে কুসুমকুমারী উঠে এসে বললো, কী হয়েচে, ঠাকুরপো?

কথা শোনা মাত্র নবীনকুমারের ঘোর কেটে গেল। এ তো তার ভ্রাতৃবধু কুসুমকুমারী। সে দুপুরবেলা দাসীর কাছে গান শুনচে, এর মধ্যে অস্বাভাবিক তো কিছু নেই।

নবীনকুমার লজ্জিত, বিব্রতভাবে বললো, না, না, আমার ভুল হয়ে গ্যাচে, আমি এখেনে ভুল করে এসিচি!

সঙ্গে সঙ্গে সে ফিরে দাঁড়ালো।

কুসুমকুমারীর বারংবার ব্যাকুল প্রশ্নের আর কোনো উত্তর দিল না সে। আবার ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো নিজের কক্ষের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *