2 of 3

৭৮. স্ট্রোক জিনিসটা কি

৭৮

স্ট্রোক জিনিসটা কি বলো তো! ডিকশনারিতে যা লেখা আছে ডাক্তারি মতে তো তা নয়! ব্যাপারটা কি বলল তো!

পুলিন ডাক্তার একটু হেসে বলে, কেন, ওসব জেনে হবেটা কি?

বিষ্ণুপদ অপ্রতিভ হেসে বলে, জেনে রাখা ভাল, মানুষের স্ট্রোক হয় শুনেছি, মারাও যায়। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

ওসব অলক্ষুণে ব্যাপার জানার দরকারটা কি? দুনিয়ায় জানার আরও অনেক জিনিস আছে। তোমাকে তো চিনি। ভেঙে বললেই ওসব নিয়ে ভাবতে শুরু করে আবার একটা রোগ বাধিয়ে বসবে।

বিষ্ণুপদ ফের একটু হেসে বলে, মানুষ তো মরেই। বয়স হলে, সময় ফুরোলে একটা না একটা ছলছুতোয় প্রাণপাখি ফুরুৎ হয়ে যায়। তা বলে বাঁচার ইচ্ছেটা কি মরে? এই যে এত আতান্তরে আছি, তাও মরতে কেমন ইচ্ছে যায় না। আরও কথা কি জানো, সংসারের যা অবস্থা দেখছি তাতে ভুগে মরতে ভয় হয়। স্ট্রোক হলে শুনেছি, ফুরুৎ হতে এক লহমা লাগে।

এই বলছে মরতে ইচ্ছে যায় না আবার বলছো ফুরুৎ হতে চাও, তোমাকে নিয়ে তো মুশকিল দেখছি। এক নিশ্বাসে দুটো উল্টো কথা বলে ফেললে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে খুব হেসে বলে, উল্টোপাল্টা ভাবি আর বলি বলেই তো আমি মনিষ্যির মধ্যে পড়ি না। ভাবছিলাম কি জানো, মরতে ইচ্ছে যায় না সে কথা ঠিক। তা বলে কি মরণ-বাবাজী আমাকে ছাড়বে? বুকে হাঁটু দিয়ে পাওনা-গণ্ডা আদায় করে নেবে না একদিন? তা মরাটা যদি ওই স্ট্রোকে হয় তাহলে ল্যাটা একটু কম, তাই না?

তোমাকে বলেছে! যারা হুট বলতে মরে তারা ভাগ্যবান। ভোগে না, ভোগায় না। স্ট্রোক হলেই যে তেমনধারা হবে তার মানে নেই। অনেক সময় জড়ভরত হয়ে বেঁচে থাকে। পক্ষাঘাত হয়, আরও নানা জটিল জিনিস হয়। ফুরুৎ হতে চাইলে বরং গলায় দড়ি দেওয়া ভাল, নয়তো ঢকাঢক ফলিডল মেরে দাও, হাতের কাছেই রয়েছে।

তাতে পাপ হবে না?

তা হবে। সব দিক সামলে চলতে গেলে কি হয়?

আত্মহত্যা করলে নাকি আত্মা আকাশের সব অন্ধকার গ্রহে ঘুরে বেড়ায়। মুক্তি হয় না।

তা হবে। তোমার মতো শাস্ত্রজ্ঞান আমার নেই। তবে একটা কথা জেনো, আত্মহত্যা হচ্ছে জোয়ান বয়সের ব্যাপার। বুড়ো বয়সে আর ওসব করার মতো বুকের পাটা থাকে না। তখন লাথি ঝাঁটা খেয়েও প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। আজকাল খুব মরার কথা ভাবছো নাকি?

দু’রকমই ভাবি। মরার কথাও, বাঁচার কথাও।

পুলিন ডাক্তার তার প্রেশার দেখার যন্ত্র আর স্টেথসকোপ বের করে বলে, দেখি প্রেশারটা।

বিষ্ণুপদ হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে একটু হেসে বলে, তোমার ওই যন্ত্রখানার বয়স কত হল বলো তো! চল্লিশ পঞ্চাশ বছর হবে না?

তাতে কি? বিলিতি জিনিস!

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, আমার মনে হয়, যন্ত্রটা এবার পুরোনো লোহার দরে বেচে দিলে ভাল। যেমন তুমি, তেমন তোমার যন্ত্র।

বেশি বোকো না হে, ত্রিশ বছর ধরে প্রেশার দেখে আসছি। এক চুল এদিক-ওদিক হয়নি।

হলেই বা ধরছে কে? তুমি হলে মোত্রাবনে খাটাস বাঘ।

পুলিন গম্ভীর হয়ে প্রেশার দেখে বলল, একটু বেড়েছে। মার্জিনাল। ওষুধ খাবে নাকি?

বিষ্ণুপদ ভ্রূ কুঁচকে বলে, কে যেন বলছিল থোড়ের রস খেলে প্রেশার কমে যায়।

তাও যায়। খেয়ে দেখতে পারো। তবে প্রেশারটা বেড়ে থাকলে কষ্ট। যা দিয়ে পারো বেঁধে রাখো। নইলে সামান্য উত্তেজনায় চড়াক করে উঠে পড়বে। তখনই বিপদ।

যন্ত্রখানা দেখছিল বিষ্ণুপদ। লম্বাটে সরু একখানা বাক্স, তার ডালায় বিরাট একখানা থার্মোমিটারের মতো জিনিস, নিচের খোঁদলে রবারের পটি আর পাম্প দেওয়ার জিনিসটা গুছিয়ে রাখার জায়গা। বাক্সটা কট করে বন্ধ করল পুলিন। মানুষ কত যন্ত্রই না বের করেছে! যত ভাবে তত অবাক হয়।

বিষ্ণুপদ বলল, একই শরীর, তবু কত তফাত দেখ। এই শরীরেই তো নৌকোয় বৈঠা মেরেছি, লাঙল ঠেলেছি, বোঝা টেনেছি, দশ-বিশ মাইল সাইকেল চালিয়েছি, দু-তিন ক্রোশ এক চোপাটে হেঁটে মেরে দিয়েছি। আবার সেই শরীরটাই এখন কেমন লাতন হয়ে পড়েছে দেখ।

আহা, কালধর্ম নেই?

সে যে আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আমার কি মনে হয় জানো, মানুষের মরতে তত অনিচ্ছে নেই। কিন্তু বুড়ো হয়ে যেতে ভাল লাগে না। বুড়ো হওয়া মানে যেন ভেজা কাঁথা জড়িয়ে বসে থাকা। তোমরা ডাক্তাররা বাপু এর একটা বিহিত করতে পার না? যে ক’বছর বাঁচব বেশ ডেঁড়েমুশে বগল বাজিয়ে বাঁচব। তারপর ফুরুৎ হওয়ার সময় হলে পট করে নেই হয়ে যাবো।

তোমার আমার ইচ্ছেমতো যদি সব হত তাহলে তো কথাই ছিল না। তবে কথাটা তুমি খুব আজগুবি বললেও মিথ্যে বলোনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, বুড়ো বয়সটা যেন এক পাপ।

পাপও বলতে পারো, প্রায়শ্চিত্তও বলতে পারো। জীবনটা হেলাফেলা করে কাটিয়ে বুড়ো বয়সে তার গুনোগার দেওয়া।

তোমার আর গুনোগারটা কি? একটা ছেলে তো মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। সেই ঢের। এত লোক তো এত ছেলে পয়দা করছে, ক’টা মানুষ হচ্ছে বলো তো! গরু ছাগলের মতো নম্বরে বাড়ছে। একখানা যে সোনার টুকরো হয়েছে তাই মহা ভাগ্য বলে জেনো।

বিষ্ণুপদ মৃদু একটু হেসে বলে, সোনার টুকরো তো বটে, কিন্তু সে যে এখন পরের সিন্দুকে।

তা হোক। ছেলে তো আর ট্যাঁকে গুঁজে রাখতে পারবে না। বাঙালি মা-বাপ তাই চায় বটে, কিন্তু তোমার ছেলের ওপর দুনিয়াটারও কিছু হক তো আছে।

তা যা বলেছে। মাঝে মাঝে তোমার মুখ দিয়ে একেবারে নির্ঘাত কথাটা বেরিয়ে আসে।

বামা তাহলে পাততাড়ি গুটোলো?

বিষ্ণুপদ একটা শ্বাস ফেলে বলে, তাই তো দেখছি। বলেও গেল না একবার।

পুলিন একটু হেসে বলে, বলে গেল না মানে? বামার বউ চলে যাওয়ার সময় চেঁচিয়ে তোমাদের যে বাপান্ত করছিল তা তো গাঁ-সুদ্ধু লোক শুনেছে!

বিষ্ণুপদ কাহিল হেসে বলে, হ্যাঁ, সে একরকম বলে যাওয়াই বটে।

তাহলে আর দুঃখ কি? শ্বশুরবাড়িতেই গিয়ে উঠেছে তো?

সেরকমই কথা।

আজকাল শ্বশুরদেরই কপাল। বেলা হল, চলি হে বিষ্ণুপদ। কাঁচা নুনটা খাচ্ছে না তো? না!

না। তেমন আলুনি লাগলে ওই একটু খাই আর কি।

ওই রোগেই তো ঘোড়া মরে। নুন-টুন খেও না বাপু।

নুন না খেলে ক’ দিন এক্সটেনশন পাবো বলল তো! তোমরা তো নিদান দিয়েই খালাস। কিন্তু গিলতে তো হবে আমাকেই। না কি?

তবে খাও। মনের আনন্দে খাও। নিজের শ্রাদ্ধের চিঠিটা নিজের হাতেই মুসাবিদা করে বসে বসে। নুন এমন কোন অমৃতটা শুনি! কয়েকটা দিন একটু আলুনি লাগে, তারপর দেখবে বিস্বাদটা চলে গেছে।

পুলিন চলে গেলে বিষ্ণুপদ ফাঁকা বাড়ি বুকে নিয়ে বসে রইল। বামাচরণ সস্ত্রীক বিদেয় নিয়েছে। এ বাড়িতে তারা প্রাণের ভয়ে আর থাকতে নারাজ। তা বলে বাড়ির অধিকার ছেড়ে দিয়ে যায়নি। শ্যামলীর কোন কাকা পুলিশের লোক, তাকে বলে রামজীবনকে ঢিট করবে বলে শাসিয়ে গেছে। বাড়ির দখলও তারা নেবে, তবে সবাইকে ঝেঁটিয়ে তাড়িয়ে। কথাগুলোর কিছু ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু কিছু আবার তত ফাঁকা নয়। একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠবেই। যাওয়ার সময় বামা রা কাড়েনি। কিন্তু বিষ্ণুপদর ধারণা, বউ সামনে না থাকলে বামা তার বাপ-মাকে কিছু একটা বলে যেত। বামার ঘর ফাঁকা পড়ে আছে তালাবন্ধ হয়ে। রাঙা বউমাও কদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেল কাল। বাড়িতে শুধু বুড়োবুড়ি। আর রামজীবন। রামজীবন বেহানে বেরোয়। দুপুরে কখনও খেতে আসে, কখনও আসে না। ফেরে রাতে। তার থাকা না-থাকা সমান।

বাগানে শাক তুলতে গিয়েছিল নয়নতারা। চুপড়ি কোলে নিয়ে ফিরল।

শাক পেলে?

হ্যাঁ। অনেক পেয়েছি। হ্যাঁগো, ব্যাঙের ছাতাও এনেছি কয়েকটা। খাবে?

বিষ্ণুপদ একটু দ্বিধায় পড়ে বলে, দেশের বাড়িতে তো কখনও খাইনি। তবে এদেশে সবাই খায় শুনি। চেখে দেখতে দোষ কি?

তাহলে রাঁধি? আমিও কখনও খাইনি। সেদিন কুসুমের মা বলছিল, মাসিমা, কী ভাল ছাতু হয়েছে আপনাদের বাগানে, খান না কেন? না খেলে আমাদের দেবেন।

বিষ্ণুপদ নড়েচড়ে বসে একটু হেসে বলে, তাহলে বেঁধেই ফেল। খেয়েই দেখি এমন কি জিনিস। সাহেবরাও খুব খায় জানি।

পুলিন ডাক্তার কী বলে গেল?

ডাক্তারদের কথা আর বোলো না। মান্ধাতার আমলের যন্ত্র দিয়ে কী দেখল ও-ই জানে। তবে তেমন কিছু নয়। কাঁচা নুন খেতে বারণ করে গেল আবার।

তাহলে আজ থেকে আর নুনটা পাতে নিও না।

না নিলাম। কিন্তু আমার তো চিকিৎসা হচ্ছে। তোমার ব্যবস্থা কী হবে? কোনওদিন ডাক্তার দেখাও না, এ ভাল নয়।

রক্ষে করো। পুরুষ ডাক্তার বুক দেখবে, পেট দেখবে, ও আমার পোষাবে না বাপু। আমি বেশ আছি। শয্যা নিলে তখন দেখা যাবে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, এ বয়সে আর লজ্জার কী?

আমার আছে বাপু।

বিষ্ণুপদ খুব হাসল। সবকিছু পাল্টায়, কিন্তু নয়নতারারা আর পাল্টায় না। হাসি থামিয়ে বলল, শরীর এক জটিল যন্ত্র, বুঝলে? হাসসা, কাঁদো, কাজ করো, ঘুমোও, যা কিছু করো না কেন, সবই করছ শরীরের ভিতরকার নানা সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির জন্য। এ এক আশ্চর্য জিনিস। বাইরে থেকে বোঝাই যায় না যে ভিতরে এত সব কাণ্ডকারখানা।

তা হোক গে। আমার অত জেনে দরকার নেই।

আমিও যে জানি তা নয়। তবে তোমার চেয়ে একটু বেশি জানি, এই যা। জম্পেশ একখানা যন্ত্র বটে।

নয়নতারা রান্নাঘরে গেল। কথাটা আর এগোলো না।

আর একটু বেলা গড়ালে একখানা ঘটনা ঘটল। এমনটা অনেক আগে ঘটত বটে, ইদানীং ঘটছিল না। পিওন এসে পাঁচশো টাকার একখানা মানি অর্ডার দিয়ে গেল। ফর্মের টোকেনে কৃষ্ণজীবনের একটু লেখা, বাবা, অনেকদিন কিছু পাঠাইনি। গিয়ে থোক কিছু টাকা আপনার হাতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। সময়াভাবে হয়ে উঠছে না। রামজীবনকে বলুন, আপনার আর মায়ের ঘরটা পাকা করতে। খরচ আমি দেবো। মা ও আপনি, প্রণাম নেবেন। সেবকাধম কৃষ্ণ।

টাকাটা হাতেই থর থর করে কাঁপছিল। পাঁচশো টাকা এখনও তার কাছে অনেক টাকা।

টাকাটা নিয়ে উঠে রান্নাঘরের দরজায় এল বিষ্ণুপদ, কী গো, কানে কম শুনছে নাকি আজকাল?

নয়নতারা মুখ তুলে হাসল, কেন, ডাকছিলে নাকি? উনুনটা ধরাতে আজ দেরি হল, এক হাতে সব কাজ। কোটা, বাটা, রাঁধা।

না, ডাকিনি। তবে পিওন এসেছিল, শুনতে পাওনি!

পিওন! ও মা, তোমার হাতে একগোছা নোট যে! কে দিল?

কৃষ্ণ পাঠিয়েছে। এই পিওন এসে মানি অর্ডার দিয়ে গেল। পাঁচশো টাকা।

ওম্মা গো। পাঁচশো!

ভাল-মন্দ খাওয়া যাবে ক’দিন। আরও কথা আছে। আমাদের ঘরখানা পাকা করে দিতে চাইছে।

এতদিনে বুঝি মা-বাবার দুঃখ বুঝতে পারছে সে!

ইংরিজিতে একটা কথা আছে, বেটার লেট দ্যান নেভার। তা দেরি করেছে বটে, কিন্তু সে এককথার মানুষ।

নয়নতারার চোখে জল এসেছিল। আঁচলে চোখ দুটো মুছে নিয়ে বলল, বলেছে সেই ঢের। বললেও তো বুকটা ঠাণ্ডা হয় গো। ছেলেমেয়েরা তো বোঝে না ওরা আদর করে এক ঢেলা মাটি এনে দিলেও মা-বাপের বুক ভরে ওঠে!

কেঁদো না। কান্নার মতো কিছু হয়েছে নাকি?

কৃষ্ণ আমার তো খারাপ ছেলে নয়। তার বুকে মায়া-দয়া কিছু কম নয়। কিন্তু ওই গেছে মাগীটাই যে খেল ওকে।

ওভাবে বলতে নেই। তাদের জীবনের ধারা আলাদা, আমাদের সঙ্গে কি বনে? এসব কথা এখন তুললে আনন্দটা মাটি হবে।

আচ্ছা, আর বলব না।

টাকাটা তোমার কাছে রাখো।

নয়নতারা হাসল, কেন, তোমার কাছেই থাক না!

ও বাবা! আমি লক্ষ্মীছাড়া মানুষ, আমি টাকা রাখব কি? কোনোদিন রেখেছি নাকি? যতদিন মা বেঁচে ছিল, টাকা এনে মায়ের হাতে দিয়েছি। মা চলে যাওয়ার পর থেকে তোমার হাতে। টাকা আমার সয় না।

নয়নতারা হেসে বলল, আচ্ছা গো আচ্ছা। কিছুক্ষণ রাখো, রান্নাটা সেরে গিয়ে নিচ্ছি।

এ ঘর যদি কৃষ্ণ পাকা করে দেয় তাহলে আর রেমোর পাকা ঘরে আমাদের না যাওয়াই ভাল। বউমা, বাচ্চারা সব থাকবে’খন ওখানে।

সেই বুদ্ধিই ভাল। কিন্তু হুট করে আবার রেমোকে এসব কথা বোলো না। হয়ত মান হবে।

বিষ্ণুপদ মাথাটা একটু নেড়ে বলল, এই তো বুদ্ধি! কিন্তু কেন যে সবসময় বলে বেড়াও যে তোমার নাকি বুদ্ধি নেই।

আহা, এ আবার কী এমন বুদ্ধির কথা হল শুনি!

আমার মাথায় তো আসেনি।

এসব ছোটো কথা তোমার মাথায় না আসাই ভাল। তুমি, আমার ভোলানাথ শিবঠাকুরটি হয়েই থেকো।

শোনো, আমার মাথাতেও ছোটো কথা আসে। কৃষ্ণ তো রেমোকে দিয়ে ঘর করাতে চাইছে। কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে? সে নেশাখোর মানুষ, টাকা হাতে পেলে কি করে না-করে তার ঠিক নেই।

নয়নতারার মুখ শুকোলো, ও বাবা! এ কথাটা ভাবিনি তো৷ ঠিকই বলেছে। কৃষ্ণকে লিখে দাও যেন টাকা আমাদের কাছেই দেয়। তাহলে রাশ থাকবে।

হ্যাঁ। তাকে বাড়ির ঠিকানায় চিঠি দেওয়া বারণ। ইউনিভার্সিটির ঠিকানায় দিতে হবে। নইলে বৌমা আবার—

নয়নতারা একটু হাসল। বলল, ওসব পরে হবে। এখন স্নান করতে যাও। শাক আর ঝোল। হবে না?

খুব হবে।

কাল বাজারে গিয়ে মাছ এনো। অনেকদিন খাও না। ইদানীং রেমোটার হাতে বোধহয় পয়সা নেই। বাজার-টাজার দেখে মনে হয় টানাটানিতে আছে।

বিষ্ণুপদ স্নানে গেল। শীত শেষ হয়ে আসছে। গায়ে জল ঢালতে আর কষ্ট নেই।

খেতে বসে বড় চমৎকৃত হল বিষ্ণুপদ। ব্যাঙের ছাতার ঝোল দিয়ে ভাত মেখে দু’গ্রাস খেয়ে বলল, এ তো অমৃত! একেবারে মাংসের মতো খেতে লাগে!

নয়নতারা চোখ বড় বড় করে বলে, তাই!

একটু খেয়ে দেখ না।

আচ্ছা। তুমি খাও তোত। সত্যিই ভাল?

অপূর্ব জিনিস। এতদিন খাইনি বলে আফসোস হচ্ছে।

অজান জিনিস তো, রাঁধতে ভয় হত। কেমন লাগবে তোমার কে জানে।

খুবই ভাল জিনিস। সাহেবরা খায়। দামও নাকি খুব।

এবার থেকে তাহলে প্রায়ই রাঁধব।

খুব বেঁধে। অতি চমৎকার।

বিষ্ণুপদর উদ্ভাসিত মুখ দেখে নয়নতারা মৃদু মৃদু হাসতে থাকে। এই তার স্বর্গসুখ। আর বেশি সে কিছু চায় না।

দুপুরে দুজনে পাঁচশো টাকা নিয়ে বসল খরচের আগাম হিসেব কষতে। অনেক দিন এক সঙ্গে এত টাকা হাতে পায়নি তারা। কী করবে তা পরামর্শ করতে বসে একটু ছেলেমানুষ হয়ে গেল দুজনেই।

বিষ্ণুপদ বলল, কিছু তেল কিনে রাখো। তেল প্রায়ই ফুরিয়ে যায়।

না না। তেল খেয়ে শরীর খারাপ করবে নাকি? তোমার লুঙ্গি দুটো তো ছিঁড়েছে। একজোড়া ভাল দেখে কিনতে হবে। একখানা গেঞ্জিও।

আরে পাঁচশো টাকা তো মেলা টাকা। লুঙ্গি ছাড়াও অন্য জিনিস কেনা যাবে। আমার পুরোনো লুঙ্গিতেই চলে যাচ্ছে।

শোনো, আমাদের বালিশ তোশকের অবস্থা দেখেছো? তুলো জমে জমে আর তেলচিটে হয়ে একেবারে ছোটোলোকি চেহারা। বালিশ দুটো তো ইটের মতো শক্ত। এসব করালে একটু আরাম করে শোয়া যায়।

বিছানা! পুরোনো বিছানায় শোয়া অভ্যাস। বেশি নরম হলে আবার হয়তো ঘুম হবে না।

তাহলে টাকাটা দিয়ে করবোটা কী?

দুজনেই খানিক ভাবল। তারপর বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বরং মাঝে মাঝে একটু ভাল-মন্দ খাওয়া-দাওয়া হোক। বাকি টাকাটা রেখে দাও।

নয়নতারা একটু ম্লান হেসে বলে, তাই হবে। কিন্তু টাকা পুষে রেখে আমাদের কী লাভ বলো তো! কে কবে আছি, কবে নেই, টাকাগুলো বেহাত হয়ে যাবে।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, তা খুব ঠিক কথা। কিন্তু এই বয়সে টাকা-পয়সার দরকারটাও অনেক কমে যায় কিনা। দেখ না, টাকাটা পেয়ে দুজনেই কেমন দিশাহারা হয়ে বসে আছি। তাই ভাবছি, আমাদের টাকা-পয়সার দরকারটাও ফুরিয়েছে।

নয়নতারা মাথা নেড়ে বলে, তা ঠিক। কিন্তু তবু হাতে টাকা থাকলে মনে একটু বল ভরসা হয়। এখন রেমো যদি বাজার-হাট না করতে পারে তাহলেও আমরা চালিয়ে নিতে পারব।

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।

ঘরটা যদি সত্যিই পাকা করে দেয় কৃষ্ণ তাহলে কত ভাল হবে বলো তো!

খুব ভাল। বর্ষায় জল পড়ে ঘর ভেসে যায়। শীতে ফুটো ফাটা দিয়ে হাওয়া ঢোকে। দরজা জানালার অবস্থাও তো ঝুরঝুরে।

দুজনের চোখেই একটা আশার আলো। একটা আনন্দের অনুভূতি আজ দুপুরটাকে বড্ড ফুরফুরে করে দিয়েছে।

নয়নতারা বলল, হ্যাঁ গো, বামা আর শ্যামলী যে এত ঝগড়া করে গেল, ওদের ফিরিয়ে আনা যায় না?

আনতে চাও?

কি জানো, কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে। বামাটা তো ষণ্ডা গুণ্ডা নয়। সে এমনিতে নিরীহ। সেদিন রেগে গিয়ে দা নিয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু সে অত খারাপ নয়। মারধর খেল। বউমা গালমন্দ করলেও বামা কিন্তু শেষতক কিছু বলেনি। চুপটি করে ছিল।

তোমার হল মায়ের মন।

একটা ভয় খাই, জানো? শ্যামলী বাপের বাড়ি গিয়ে তো ঘোঁট পাকাবে। তারপর রেমোর পিছনে পুলিশ লাগাবে। গুণ্ডাদেরও লেলিয়ে দিতে পারে। শেষ অবধি খুনোখুনি না হয়। তার চেয়ে আপসে মিটে গেলে হয় না?

বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলল, দুনিয়াসুদ্ধ যত ঝগড়া-কাজিয়া তার ক’টা আপসে মিটছে বলো তো! এ ঝগড়া মিটলেও বাইরে বাইরে মিটবে, ভিতরে ভিতরে শত্রুতা থেকে যাবে। তবে লোভ দেখালে বামা ফিরতেও পারে। সে আমাদের ঘরখানা চেয়েছিল। এখন ঘরখানা পাকা হবে শুনলে সে লোভে পড়তে পারে।

নয়নতারা চুপ করে রইল। মুখখানা মলিন। কিছুক্ষণ পর বলল, শ্যামলী যে-সব কথা বলে গেল তা কি কেউ উচ্চারণ করতে পারে, বলো! আমাকে বেশ্যাও বলেছে, তোমাকে…উঃ, সে কথা ভাবলে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে।

কথাই তো! কথার আর কী দাম বলল। এ যুগে সব দূষিত কথা লোকের মুখে মুখে এত ফিরছে যে কথাগুলোর ধার কমে গেছে। কেউ গায়ে মাখে না।

আমি তো কখনও এ সংসারে এইসব কথা কারও মুখে শুনিনি। এক রেমো মাতাল হয়ে এসে যখন চেঁচামেচি করে। তা সে মাতালের কথা। সে তো ধরতে নেই।

ভোলো, নয়নতারা, সব ভোলো। এই বয়সে আর কিছু শোধবোধ করতে পারবে না। লাথি খেলেও হজম করে যেতে হবে। ভুলে যাওয়াই ভাল। দশটা টাকা দেবে?

কী করবে?

নিতাইয়ের দোকানে বিকেলে রসগোল্লা হয়। গরম রসগোল্লা নিয়ে আসি গে। তারপর বুড়োবুড়ি বসে বসে খাই।

নয়নতারা একশ টাকার একখানা নোট এগিয়ে দিয়ে বলে, ভাঙিয়ে নিয়ে এসো। টাকা ফেরত নিতে ভুল কোরো না।

বিষ্ণুপদ হাসে, ছেলেমানুষ পেলে নাকি?

ছেলেমানুষ ছাড়া কি? ভোলানাথ শিবঠাকুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *