2 of 2

৭৭. মালটিন্যাশনাল কোম্পানির যত দোষ

মালটিন্যাশনাল কোম্পানির যত দোষ আছে সান ফ্লাওয়ার তার কোনওটা থেকেই মুক্ত নয়। দীপনাথকে সানফ্লাওয়ারে ঢুকবার আগে একটা বন্ড সই করে দিতে হয়। সে যে শর্ত দিয়েছিল তার কোনওটাই কোম্পানি মানল না। তবে বেতনটা ঠিক রাখল। যাতায়াতের জন্য অফিসারদের নিজস্ব গাড়ি থাকলে ভাল কথা, নইলে চমৎকার একটা বাস সার্ভিস আছে। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অফিসারদের নিয়ে আসা বা পৌঁছে দেওয়া হয়। দীপনাথ সেই সুবিধাটুকু পেল। কোম্পানি কোনও বাড়ি দেবে না। তবে কালক্রমে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার টাকা ঋণ দেবে।

এর চেয়ে রজার্স ভাল ছিল হয়তো। কিন্তু রজার্স দেশি কোম্পানি। সে টোপ ফেলে দীপনাথকে গেঁথে নিয়ে তাকে দিয়ে দু’নম্বরি কাবাব করাত। তার চেয়ে সানফ্লাওয়ার ঢের ভাল। ছ’মাস বাদে আমেরিকায় ট্রেনিং-এ পাঠাবে। সেটাও দীপনাথের প্রতি বিশেষ দাক্ষিণ্যবশে নয়, বেশির ভাগ অফিসারকেই তারা আমেরিকায় নিয়ে একটু স্ট্রিমলাইনড় করিয়ে আনে।

এত বড় কোম্পানিগুলি ভাত ছড়িয়ে ধসে তু বলে ডাকলেই দীপনাথের মতো ঝাকে ঝাকে কেজো লোক এসে জড়ো হয়ে লেজ নাড়ে; সুতরাং দীপনাথকে ডেকে চাকরি দেওয়ার দরকার। ছিল না এদের। তর দিয়েছে কেন সেটা দীনাথ ভাল বুঝল না। প্রথম কয়েকটা দিন নতুন ধাঁচের কাজকর্ম বুঝতে সে হিমশিম খেল। অটোমেশন জিনিসটারও মুখোমুখি সে কখনও হয়নি। এখানে হল।

গুজরাটি কোম্পানি বোস সাহেবের যোগ্যতা অনুযায়ী তাকে কাজে লাগাতে পারেনি। কিন্তু বোস সাহেব কাজের লোক। সানফ্লাওয়ারে কার আগে মাসখানেক বোস সাহেব দীপনাথকে অটোমেশন বুঝিয়েছে। চেনা বিভিন্ন কোম্পানিতে ইনট্রোডাকশন দিয়ে পাঠিয়েছে আই বি এম এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির কাজ দেখতে। সেই ঘরোয়া ট্রেনিংটা খুব কাজে লাগাল দীপনাথের। হিমশিম খেলেও নতুন কাজে সে হাস্যকর কিছু করল না।

সাতদিন পর এক ছোকরা সাহেব তার টেবিলের সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, লাইক দি জব?

ইয়াঃ।–অনায়াসে বলতে পারল দীপনাথ।

আট্টা বয়।— বলে সাহেব হেসে চলে গেল।

বোস সাহেব মাঝে মাঝে ফোন করে খবর নেয়, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো, চ্যাটার্জি?

না। চালিয়ে নিচ্ছি।

আপনার হিসেবটা হয়ে গেছে। একদিন এসে টাকাটা নিয়ে যাবেন।

গুজরাটি কোম্পানিতে দীপনাথের কিছু পাওনা টাকা পড়ে আছে। খুব বেশি হবে না। বলল, যাব।

দেরি করবেন না। টাকাটা ব্যাংকে রাখলে সুদ পাবেন, এখানে খামোখা ফেলে রেখে লাভ কী?

দীপনাথ মৃদু হেসে বলে, সময় পাচ্ছি না যে। এই অফিস থেকে সহজে বেরোনো যায় না।

জানি। সানফ্লাওয়ার ইজ বিগ। ভেরি বিগ। আপনিও এখন বিগ। তবে আপনি যদি একটা ডেট বলেন তবে অফিস-আওয়ার্সের পর আমি টাকাটা রেডি রেখে দেব। ইউ জাস্ট ড্রপ ইন অ্যান্ড কালেক্ট।

আচ্ছা। মিসেস বোসের খবর কী?

নাথিং নিউ। নাইদার হ্যাপি নর আনহ্যাপি।

আপনি?

আমি? আমি জাস্ট ওকে।

কোম্পানি?

বুঝতে পারছি না। রিয়েলি বুঝতে পারছি না। ড়ুয়িং বিজনেস নো ডাউট। কিন্তু একসপানশান নেই।

আচমকাই দীপনাথ বলে, আপনি সানফ্লাওয়ারে আসবেন?

বোস বোধ হয় অবাক হয়। তারপর হেসে বলে, ও! নো।

কেন বোস সাহেব?

বোস সাহেব একটা ছোট খাসের শব্দ করে বলে, সানফ্লাওয়ার অনেক আগেই আমাকে পিক করেছিল। কিন্তু কোনও বড় কোম্পানিতে আমার যাওয়ার উপায় নেই চ্যাটার্জি।

কেন?

কারণ আমি যে কনসানে কাজ করব আই মাস্ট বি দেয়ার নাম্বার ওয়ান ম্যান। আমি নাম্বার ওয়ান হয়ে কোনও কোম্পানিতেই কাজ করিনি। বড় কোম্পানি আমাকে মস্ত পোস্ট দেবে, অনেক মাইনেও, কিন্তু প্রথমেই নাম্বার ওয়ান জায়গাটা ছাড়বে না। তাই আমার কপালে বড় কোম্পানি নেই।

এবার দীপনাথও একটু হাসে। বলে, আপনি যদি কখনও কোনও নিজস্ব কোম্পানি খোলেন তবে আমাকে ডাকবেন।

বোস আবার শ্বাস ছেড়ে বলে, সেসব আরও কম বয়সে শখ ছিল। এখন নেই। এখন আমি ফিজিক্যালি আনফিট। সাইকোলজিকালিও। কিন্তু আপনাকে একটা আডভাইস দিয়ে রাখি। চট করে কোনও লোভে পড়ে সানফ্লাওয়ার ছাড়বেন না। ইউ আর উইথ গুড পিপল। দে উইল ড়ু ইউ গুড। কমপিটিটর কোম্পানি অনেক সময় সাবোটাজ করার জন্য বড় কোম্পানি থেকে তোক ভাঙিয়ে নিয়ে আসে। যারা লোভে পা দেয় জেনারেলি এন্ড ইন দি গাটার। সানফ্লাওয়ারে থাকুন। দে উইল মেক ইউ ভেরি ভেরি এফিসিয়েন্ট।

ঠিক আছে। কথাটা মনে রাখব।

আই অলওয়েজ উইশ ইউ গুড।

সানফ্লাওয়ারে আসার মাস দুয়েক বাদে একদিন মণিদীপা ফোন করল।

গলাটা চেনা লাগছে, দীপনাথবাবু?

দীপনাথ মৃদু হেসে বলে, যে ভোলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিব না, আমি তারে ভুলিব না। কেমন আছেন?

চমৎকার। আপনি?

চমৎকার।

একটা চাকরি দেবেন আপনার কোম্পানিতে? আপনার পি-এ করে নিন না!

আমার পি-এ বলে কিছু নেই।

তা হলে আপনি কিসের বড় চাকরি করেন?

বড় চাকরি নয়। কিন্তু এই কোম্পানির বেয়ারাও এত বেশি মাইনে পায় যে অনেক সরকারি অফিসারও পাল্লা দিতে পারবে না।

তা হলে বেয়ারার চাকরিই দিন না।

কেন? ব্যাবসার কী হল?

কী আবার হবে? টাকা কই? ঢাকুরিয়ার এই দোকানটা এখন পঞ্চাশ হাজার সেলামিতেও রাজি। কিন্তু তাই বা আমাকে দেবে কে?

দু’লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজারে নেমেছে? বলেন কী!

এমনিতে নামেনি মশাই, দোকানের মালিককে বেশ কয়েকটি কটাক্ষ উপহার দিতে হয়েছে।

তা হলে আরও গোটাকয় দিন। বিনি পয়সায় দিয়ে দেবে।

না। এখন দোকানের মালিক আর কটাক্ষে খুশি নয়। হি ওয়াস সামথিং টানজিবল। হয় টাকা, হয় কাইন্ডস।

কাইন্ডনেস নয় তো!

না। কাইন্ডস, একস্ট্রিমলি ফেমিনিন কাইন্ডস।

কুপ্রস্তাব করেছে বলছেন?

নট ইন সো মেনি ওয়ার্ডস। তবে আমরা মেয়েরা ঠিক বুঝতে পারি।

ওর কাছে আর যাবেন না।

গিয়ে লাভও নেই। লোকটা বুঝে গেছে, আমি ক্যাশ বা কাইন্ডস কোনওটাই দিতে পারছি না। শুনুন, আমরা একটু পাহাড়ে বেড়াতে যাচ্ছি। মে বি নৈনিতাল। না হয় সিমলা। আপনি কি ছুটি পাবেন?

পেলেও যাব না।

কেন? টু অ্যাভয়েড মি?

সেটাও হয়তো কারণ। তবে আমার ভয় এবার বড় পাহাড়ের কাছে গেলে আমি হয়তো ফিরতে পারব না।

ওমা! সে কী?

জানেন তো, প্রীতম আজও ফেরেনি?

জানি।

প্রীতম আমার কতটা ছিল তা তো আর জানেন না!

অনেকটা আন্দাজ করতে পারি।

অনেকটা, তবু সবটা নয়। প্রীতম ছিল এই পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের সবচেয়ে বড় কারণ, এখন তাই আমার কোনও পিছুটান নেই। বড় চাকরি, অনেক টাকা, এ সব কিছুই আমাকে টেনে রাখতে পারবে না। মাঝে মাঝে আজকাল নিশুত রাতে পাহাড় ডাকে।

যাঃ! কী যে কিম্ভুত একটা খেয়াল আছে আপনার মাথায়!

দীপনাথ তা জানে। কিন্তু কথাটা তো মিথ্যেও নয়। সারাদিন সানফ্লাওয়ার যতক্ষণ পারে মেদ মজ্জা মাংস মস্তিষ্ক চিবিয়ে ছিবড়ে করে দেয়। কিন্তু তারপর যখন ক্লান্ত দীপনাথ তার হোটলে ফিরে আসে তখনই আসে প্রীতমের শূন্যতা। বড় ভারহীন, বন্ধনহীন লাগে নিজেকে।

সব ক’টা বড় খবরের কাগজে দিনের পর দিন নিজের পয়সায় প্রীতমের ছবি সহ নিরুদ্দেশের খবর বের করেছে সে। শিলিগুড়িতে শতমও দাদাকে খুঁজতে তোলপাড় করছে আজও। কোথাও কোনও হদিশ মেলেনি।

হয়তো প্রীতম আছে। হয়তো নেই।

বিলুর হাবভাব একদম ভাল লাগে না দীপনাথের। বিলু চাকরিতে একটা লিফট পেয়েছে। বাসাটা সাজিয়েছে অনেক টাকা খরচ করে। প্রতি রবিবার অরুণ ওর বাসায় খায়। মাঝে মাঝে বেড়াতে যায় অরুণের সঙ্গে।

এ সব এক রকম চলছিল। খুব সম্প্রতি সে খবর পেয়েছে, বিলু একজন উকিলের পরামর্শ নিচ্ছে। খবরটা দিয়ে গিয়েছিল শতম। মাসখানেক আগে সে একটা টেন্ডার ধরতে কলকাতায় এসে দু’দিন বিলুর কাছে থেকে গিয়েছিল।

স্বামী নিরুদ্দেশ বলে একসপার্টি ডিভোর্স পেতে অসুবিধে হবে না বিলুর। কিন্তু ডিভোর্সই বা চাইবে কেন? প্রীতম মরে গেলেই কি সব শেষ হয়ে গেল?

কথাটা সরাসরি বিলুকে জিজ্ঞেস করতে তার লজ্জা করে। কিন্তু ভাবলেই লজ্জায় ক্ষোয় ভিতরটা অস্থির হয়ে ওঠে তার। আর তখনই মনে হয়, এই জীবনটা নেহাতই একটা অর্থহীন প্রলাপ মাত্র। এর চেয়ে সব ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে পড়া ভাল।

পাহাড় তো ডাকছেই। অবিরল ডাকে। এসো, চলে এসো দীপনাথ। এখানে নীরব মহান এক প্রস্থানপথ খোলা আছে। এখানে দীনতা নেই, নিম্নগতি নেই। স্বর্গের এই সিঁড়ির কাছে এসো। আমি কোলে তুলে নেব।

দীপনাথ বোস সাহেবের কাছে খবর পেল, ডাক্তারের পরামর্শে মণিদীপা আর বোস সাহেব নৈনিতাল বেড়াতে যাচ্ছে। যাক। ওরা এত সহজে মিশ খাবে না, তা জানে দীপনাথ। দুজনের মধ্যে এখনও কাঁটাতারের বেড়া। তবু এভাবেই হয়তো একদিন একটু বেশি বয়সে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরবে অসহায়ের মতো। শেষ পর্যন্ত তো মানুষ অসহায়ই। সে বোসই হোক, মণিদীপাই হোক।

নৈনিতাল গেলেও হত। পাহাড়ের মতো আর-একটা দুর্নিবার ডাকও আছে দীপনাথের জীবনে। এখনও তার মূলসুদ্ধ কেঁপে ওঠে যদি মণিদীপা ডাকে।

দিনের মোটা একটা সময় কাজ কাজ খেলা দিয়ে তাকে ভুলিয়ে রেখেছে বলে সানফ্লাওয়ারের প্রতি বড় কৃতজ্ঞতা বোধ করে দীপনাথ। আরও ভাল হত যদি সে সারা রাত ধরে আর-একটা চাকরি করত। একমাত্র কাজই তাকে ভুলিয়ে রাখতে পারে। টাকা নয়, প্রতিষ্ঠা নয়, পোমোশন নয়, কেবল ভুলিয়ে রাখে বলে যত দিন যায় তত আরও বেশি কাজ-পাগল হয়ে ওঠে দীপনাথ।

অফিসের পর এই শূন্যতা এত অসহ্য লাগত যে, বেশ কিছুদিন তাকে বীথির কাছে যেতে হয়েছে। একটা কুৎসিত বদ অভ্যাস তৈরি হয়ে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ একদিন সুখেন মেসে ফিরল হাতে আর মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে। মুখে করুণ হাসি। চমকে উঠে দীপনাথ জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

ঘরে আর কেউ ছিল না। সুখেন কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থেকে বলল, বীথির ছেলেকে দেখেছেন তো?

এক কি দুই দিন।

বীথি ভাল নয়, কিন্তু ছেলেটা মেরিটোরিয়াস। পলিটিকস করে, সোশ্যাল ওয়ার্ক করে।

জানি।

এতদিন কোনও ঝামেলা করেনি। বীথি ডিভোর্স পেয়ে গেছে, সুতরাং এখন যদি সে বিয়ে করে তা হলেও ছেলের আপত্তি নেই। কিন্তু আপত্তি আমাকে বিয়ে করায়। ছেলেটি মনে করে, আমি করাপটেড সরকারি কর্মচারী। আমাকে বিয়ে করা মানে সোশ্যাল ইনজাসটিসকে প্রশ্রয় দেওয়া।

তারপর? এই রক্তারক্তি কাণ্ডটা কখন হল?

আজ। উই হ্যাড অলটারকেশনস। আমার পেটে একটু মাল ছিল ঘড়াম করে মেরে দিয়েছিলাম এক ঘুসি। ছোকরাও পালটা ঘুসি ঝেড়েছে। সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গিয়ে এই কাণ্ড।

তারপর?

তারপর আর কী? ক্ষমা চাওয়াচাওয়ি হল। কাল বীথির সঙ্গে আমার বিয়ে।

কালই?

কালই। শুভস্য শীঘ্রম।

রেজিস্ট্রি না সোশ্যাল?

সোশ্যাল হলে বিশ্রী দেখাবে। রেজিস্ট্রি আর তারপর কালীঘাট।

আপনি বীথির সঙ্গে ঘর করতে পারবেন?

পারব।

নোয়িং ফুললি যে, আমার সঙ্গেও বীথির…!

আমিই তো আপনাকে নিয়ে গেছি, সুতরাং জানব না কেন? শরীরের কোনও দোষ নেই। মনটা ঠিক থাকলেই হল।

এসব মেয়েদের মনও কি ঠিক থাকে?

সেসব পরে ভাবব। আমিও কিছু ভাল লোক নই। বীথিও নয়। সুতরাং ভেবে লাভ কী?

তা বটে।

তা হলে কাল। আপনি তৈরি থাকবে। সাক্ষী দিতে হবে।

 

পরদিন রাতে বাস্তবিকই ঘটনাটা দীপনাথের চোখের সামনে বীথির ড্রয়িংরুমে ঘটে গেল। দীপনাথ সাক্ষী ছিল।

এই বিয়েতে এক রিকশায় বসে সুখেনের সঙ্গে গিয়েছিল দীপনাথ। ফিরল একা।

সুখেন রয়ে গেল। আর ফেরেনি। ফিরবেও না। হোটেলের ম্যানেজার নতুন বোর্ডার খুঁজছে। সুখেন চলে যাওয়ার পর এখন আরও বেশি একা লাগে দীপনাথের। নতুন বোর্ডার আসবে, সে কী রকম লোক হবে কে জানে! দীর্ঘদিন মেসে হোটেলে থেকে নতুন লোকের সঙ্গে সমঝোতা করার অভ্যাস হয়ে গেছে তার। তবু ইদানীং তার এ রকম হাটবাজারের মতো জায়গায় থাকতে ভাল লাগে না।

তার জিনিসপত্র খুব বেশি নেই। সামান্যই। ফ্ল্যাট ভাড়া করলে তা সাজানো গোছানোর ব্যাপার আছে। তার ওপর আর-কিছুদিন পরই তাকে আমেরিকা যেতে হচ্ছে। খামোখা ফ্ল্যাট ভাড়া করার মানে হয় না। ফাঁকা পড়ে থাকবে। অথচ এই ভারাক্রান্ত হৃদয়টিকে রাখার জন্য একটু সুন্দর নির্জনতা খুঁজছে সে মনে মনে।

অনেক হিসেব করে সে দেখল, তার বয়স এখন তেত্রিশ বা চৌত্রিশ। জন্মের সঠিক তারিখ জানা

নেই। এই বয়সে প্রকৃতপক্ষে তার কোনও আপনজন নেই। ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই। এখন তার এই তেত্রিশ বা চৌত্রিশ বছর বয়সে একাকিত্বের ভূত কাঁধে চেপে ঠ্যাং দোলাচ্ছে আর রগড় দেখছে।

মাঝরাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায় দীপনাথের। আর ঘুম আসতে চায় না। বরং আসে প্রীতম, মণিদীপা, শিলিগুড়ি, আসে সেই অচেনা মহান পর্বত। বিরহের এক শুষ্ক বাতাস বয়ে যায় বুকের পাজর ভেদ করে। তখন আলো জ্বেলে একটু বই টই কিছু পড়তে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু রুমমেটদের ঘুম ভেঙে যাবে ভেবে পারে না। একটু পায়চারি করলেও হয়তো ভাল লাগে। কিন্তু সেই পরিসর নেই।

মেস বদলাবে, একটা সিংগল-সিটেড ঘর দেখে চলে গেলে কেমন হয়?

এ সব ভেঁড়া টুকরো সমস্যা যখন তাকে বিব্রত করছিল তখনই রতনপুর থেকে বউদির চিঠি এল, … আমি মরলে খাটে কাঁধ দেওয়ার জন্যও কি আসবে না?

সানফ্লাওয়ারে ফাইভ ডেজ উইক। শনি রবি ছুটি। কিন্তু প্রায়দিনই শনিবারে অফিস করতে হয় দীপনাথকে। তার জন্য মোটা ওভারটাইম আছে, কিন্তু সেজন্য নয়। দীপনাথ কাজ করার আগ্রহের বশে ফি শনিবার অফিসে চলে যায়। ইচ্ছে করলে এক শনি বা রবিবার সে চলে যেতে পারে রতনপুরে। কিন্তু তার ইচ্ছে হয় না। মেজদা ক্রমে এক জড়ভরত হয়ে যাচ্ছে। বউদি এতদিনে সংসারের পালটা মার খেতে শুরু করেছে। একমাত্র আকর্ষণ সজল। কিন্তু সজলকে তো নিজের মতো করে মানুষ করতে পারবে না দীপনাথ। অত সময় কোথায়? সজলও ক্রমে রতনপুরের প্রভাবে অন্য রকম হয়ে যাবে, যাকে ভালবাসা যাবে না। একমাত্র উপায় সজলকে বোর্ডিং-এ দেওয়া, মা-বাবার কু-প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে রাখা।

এক শনিবার শ্রীনাথের প্রেসে হানা দেয় দীপনাথ।

মেজদা!

আরে, মেন আছিস?

তুমি কেমন?

ওই এক রকম।

দীপনাথ দেখে, গত এক বছরে শ্রীনাথের চেহারায় বুড়ো মানুষের ছাপ বড় বেশি পড়ে গেছে। সে বলে, আমি তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।

বল না!

সজলের ব্যাপার কী ঠিক করলে?

সজলের কী হয়েছে? একটু উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে শ্রীনাথ।

কিছু হয়নি। কিন্তু রতনপুরে থাকলে ছেলেটা মানুষ হবে না।

তা হলে কোথায় থাকবে?

যদি বলো তা হলে বাইরে কোনও ভাল হোস্টেলে দিয়ে দিই।

হোস্টেল!–বলে শ্রীনাথ একটু ভাবে। তারপর অসহায় একটা মুখের ভাব করে করুণ গলায় বলে, সজল চলে গেলে আমার কী হবে বল তো!

তোমার আবার কী হবে?

তুই তো ঠিক বুঝবি না। বলতে কী, সই আমার একমাত্র অন্ধের নড়ি। ও যদি চলে যায় তবে আমার আয়ু চট করে ফুরিয়ে যাবে।

ফত বাপ তাদের ছেলেকে হোস্টেলে দেয়, তারা থাকে কী করে?

আমাদের ব্যাপারটা তো অন্য সকলের মতো নয়। চারদিকে ষড়যন্ত্র, কূটকচালি। একমাত্র সজলই আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখে। যেই ও সরে যাবে অমনি আমাকে ছিড়ে খাবে সবাই।

কেন? তুমি কী করেছ যে ছিড়ে খাবে?

সে অনেক কথা। তোকে তো বহুবার বলেছি। তবে যদি সজলকে সরিয়ে দিতে চাস তা হলে আমাকেও সরিয়ে দে। ওখানে সজলও খুব নিরাপদ নয়।

কেন? কী হয়েছে?

তৃষার সঙ্গে ওর বনিবনা হয় না। তৃষা ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে।

তোমার মাথাটা একদম গেছে। মা হয়ে কেউ ছেলেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করে?

তৃষা তো আর-পাঁচজন মায়ের মতো নয়। তুই সব বুঝবি না।

বউদিকে আমিও কম চিনি না মেজদা। অনেক দোষ থাকলেও বউদি অমানুষ নয়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপনাথ উঠে পড়ল। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ পরিবার লক্ষ লক্ষ রকমের নিজস্ব জীবনযাপন ও সম্পর্কের ছক তৈরি করে নিয়েছে। দীপনাথ আগন্তুকের মতো গিয়ে সেই সব ছক ভেঙে ফেলতে চাইলেই তো হবে না।

তৃষার চিঠিটার একটা এলেবেলে জবাব দিয়ে দিল সে। নিজে রতনপুরে গেল না। ইচ্ছে করল। তার নিজের নানা রকম নিজস্ব ব্যথা-বেদনা রয়েছে। এখন মনকে আরও ভারী করার মানে হয় না।

দীপনাথ তার নতুন চাকরির কথা আত্মীয়স্বজনকে জানায়নি ভাল করে। সে কত মাইনে পায় তাও কারও জানার কথা নয়।

তবু গন্ধে গন্ধে একদিন সোমনাথ এসে হাজির।

সেজদা, আরেব্বাস, তুমি তো একখানা পেল্লায় চাকরি বাগিয়েছ।

দীপনাথ এ ধরনের কথায় বিরক্ত হয়। গম্ভীর মুখে বলে, বাবা কেমন আছে?

সেই কথাই বলতে এলাম। বাবার চোখটা এবার না কাটালেই নয়।

চোখ কাটানোর কথা অনেক আগে হয়ে গেছে। তখন কাটাসনি কেন?

টাকা ছিল না।

বাজে কথা। আমরা টাকা দিয়েছিলেন।

সেজদা, তুমিও আজকাল অন্য রকম হয়ে গেছ। কেবল টাকার কথা তুলে আমাকে খোঁটা দাও। আমার অবস্থা কী জানো না?

অবস্থা যা-ই হোক, স্বভাবটা ভাল কর। বাবার চোখ কাটানোর ব্যবস্থা কর, খরচ সব আমি দেব। কিন্তু সেটা আগাম তোর হাতে দেব না।

সোমনাথ গম্ভীর হল। তারপর ক্ষুন্ন স্বরে বলল, তুমি চার হাজার টাকার ওপর বেতন পাও। অনেক ক্ষমতা। তোমার মুখে সবই মানায়। ঠিক আছে, তাই হবে।

সোমনাথ চলে যাওয়ার পর দীপনাথ ভাবল, আমি কি একটু নিষ্ঠুর হয়ে গেছি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *