2 of 3

৭৭. ডারলিং আৰ্থ বইটা

৭৭

ডারলিং আর্থ বইটা হাতে এসেছিল কয়েকদিন আগে। চারুশীলার বাড়িতে ঝকমকে বইটা দেখে নিয়ে এসেছিল। লেখক ডঃ কৃষ্ণজীবন বিসোয়াস। প্রকাশক লস এঞ্জেলেসের একটা বই কোম্পানি। সাড়ে তিনশো পৃষ্ঠার শক্ত মলাটের বই। ভিতরে কিছু আর্ট প্লেট আর লাইন ড্রয়িং আছে। ত্রিশ ডলার দামটা বড্ড বেশি। লোকে কি কিনবে?

বইটা আনলেও পড়ার সময় পায়নি প্রথমে। অফিসের বকেয়া কাজ নিয়ে হিমসিম খেতে হচ্ছিল! এক শুক্রবার রাতে খাওয়ার পর বইটা নিয়ে শুয়ে পড়ল। খটোমটো টেকনিক্যাল বই নয়। যেন এক দার্শনিকের লেখা প্রবন্ধ-উপন্যাস। প্রথম পরিচ্ছেদের শুরুতেই এলিয়টের একটা উদ্ধৃতি, দিস ইজ দি ওয়ে দি ওয়ার্ল্ড এন্ড্‌স, নট উইথ এ ব্যাং, বাট এ হুইম্‌পার। প্রথম পরিচ্ছেদেই প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত এক মানুষ বেরিয়েছে তার সঙ্গে পৃথিবী ও বিশ্বজগতের সম্পর্ক অনুসন্ধানে। রোমান্টিক এক কবির মতো। কিন্তু রোমান্টিক কবি কখনও চায় না তার অনুসন্ধান চরিতার্থ হোক মীমাংসায়, সমাধানে, প্রত্যুত্তরে। শুধু ওই অনুসন্ধানই তার কাম্য, তার প্রার্থিত হল ওই রহস্যময়তার ঘেরাটোপ। কিন্তু কৃষ্ণজীবন চায় স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ সত্যকে। জড় থেকে চৈতন্যের স্তরে ক্রম অভিগমনকে নানা জ্বলন্ত প্রশ্নে, জরিপে, এষণায় উল্টেপাল্টে দেখছে পাগল কৃষ্ণজীবন। খ্যাপার হাহাকার শুরু হল দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে, যার শুরুতেই কৃষ্ণজীবন উদ্ধৃতি দিয়েছে, কুয়ো ভেদিস? এক মহাকাশযাত্রীর চোখ দিয়ে দেখা পৃথিবীর দৃশ্য দিয়ে শুরু। আর তারপর এই উন্মাদ বৈজ্ঞানিক মানুষের সব ধ্যানধারণার ওপর যেন উপর্যুপরি আঘাত করতে চেয়েছে। কোথায় যাচ্ছো? কোথায় চলেছে তোমরা? এইভাবে এই গ্রন্থ এগিয়ে গেছে চূড়ান্ত রোমান্টিক পাগলামি আর বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যানে গাঁটছড়া বেঁধে। পড়তে পড়তে ঘুম কোথায় পালাল হেমাঙ্গর। শোয়া থেকে উত্তেজনায় উঠে বসল। সাড়ে তিনশো পাতার বই শেষ হয়ে গেল লহমায়। তখন হেমাঙ্গর দু’চোখে টলটল করছে জল। বুক ভার। গলায় ঠেলাঠেলি করছে কান্নার ডেলা।

রাত সাড়ে তিনটে। লন্ডনে রাত দশটাও বোধহয় নয়। হেমাঙ্গ থাকতে পারছিল না। কাউকে এই বইটার কথা তাকে বলতেই হবে। দ্রুত রশ্মির নম্বর ডায়াল করল সে।

আমি তোমাকে একটা বইয়ের কথা বলতে চাই রশ্মি।

তুমি এখনও জেগে আছো? কী করছিলে?

একটা বই পড়ছিলাম। সেই বইটার কথাই বলতে চাই। বইটা তুমি পড়ো। অবশ্যই পড়ো।

কী বই বলো তো!

ডারলিং আর্থ।

ও! বলে একটু হাসল রশ্মি। তারপর বলল, এতদিনে পড়লে? আমার কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে।

সে কী! তুমি বইটা পেলে কোথায়?

কেন, এখানে তো খুব বিক্রি হচ্ছে। সাত-আটটা রিপ্রিন্ট হয়েছে। আমারটাই বোধহয় সেভেনথ্‌ ইমপ্রেশন।

মাই গড! কৃষ্ণজীবন তা হলে এখন ওয়ার্ল্ড ফেমাস!

তাও বলতে পারো। তবে তুমি তো জানোই এসব দেশে বই এমনিতেই বেশি বিক্রি হয়। আর ওয়ার্ল্ড ফেমাস হতে বেশি দেরিও লাগে না। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ফেমাসদের সংখ্যাও যে বড্ড বেশি।

তা বটে। বই পড়ে তোমার কেমন লেগেছে বলো তো!

এত প্যাশনেট লেখা অনেকদিন পড়িনি। তুমি ভীষণ ইমপ্রেসড মনে হচ্ছে!

আমার মাথাটা একটু বিভ্রান্ত। ঠিক অ্যাসেস করতে পারছি না।

তুমি তো ভাল অ্যাসেসর নও। অনেক কিছুই অ্যাসেস করতে পারোনি।

রশ্মির হাসির শব্দটা শুনে একটু লজ্জা পেল হেমাঙ্গ। বলল, তোমার বোধহয় ততটা ভাল লাগেনি, না?

আমি ভদ্রলোককে চিনি। চারুদির বাড়িতে কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি ওঁর প্যাশনের কথা জানি। ডারলিং আর্থ-এ ইমোশন একটু বেশি। কিন্তু তবু ভাল। এখানকার কাগজে ভাল রিভিউ হয়েছে। এশিয়াবাসী বলে একটু ক্ষমাঘেন্নার ভাবও আছে। সাহেবরা যেমনটা হয় আর কি।

বলছো, এ বই সাহেব লিখলে নোবেল প্রাইজ পেত?

ও বাবা, তা জানি না। নোবেল প্রাইজ অনেক বড় ব্যাপার।

আমার ক্ষমতা থাকলে দিতাম।

ভাগ্যিস তোমার ক্ষমতা নেই! রোজ এত রাত অবধি জেগে থাকো নাকি?

না। আজ বইটা পড়তে গিয়ে ঘুম চটে গেল। কৃষ্ণজীবনকেই ফোন করতাম। কিন্তু আন্‌গডলি আওয়ার্সে ফোন করলে হয়তো প্রশংসাও ভাল মনে নেবেন না। কিন্তু কাউকে তো বলা দরকার, তাই তোমাকে বলতে হল।

বেশ করেছে। ডারলিং আর্থকে ধন্যবাদ। বইটার সুবাদে অন্তত তোমার গলা শোনা গেল।

কেন, আমি কি তোমাকে প্রায়ই ফোন করি না?

রশ্মি হাসল, মাসে দু’বার। আমি কতবার করি বলল তো! চারবার।

আমাকে কৃপণ বলার চেষ্টা করছে নাকি?

একটু আছে। সব ব্যাপারেই তুমি একটু কৃপণ। এমন কি হৃদয়ের ব্যাপারেও।

তাই বুঝি?

শুধু এই ডারলিং আর্থের ব্যাপারে দেখছি খুব অকৃপণ।

বইটা তোমাকে কেন ইমপ্রেস করল না ভাবছি।

রশ্মি একটু চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল, দেখ, পৃথিবীকে নিয়ে কৃষ্ণজীবনের কিছু উদ্ভট ভয় আছে। তাই উনি কল-কারখানা বন্ধ করতে বলছেন, মোটরগাড়ির ব্যবহার কমিয়ে সাইকেল, ঘোড়া এইসব ব্যবহার করতে বলছেন। তা করলে যে আন্‌এমপ্লয়মেন্টের সৃষ্টি হবে তার সমাধান কে করবে? আরও অনেক কথা আছে যা খুব লজিক্যাল নয়।

একটু দমে গেল হেমাঙ্গ। তারপর বলল, জনসংখ্যা কমে গেলে আন্‌এমপ্লয়মেন্টও কমবে।

জনসংখ্যা কি করে কমবে? একটা থিওরি অব মাল্টিপ্লিকেশন আছে। সেটা অপটিমামে না গেলে রিভার্স ট্রেন্ডটা শুরু হয় না।

তার মানে তুমি কি বলতে চাইছে পৃথিবীর জনসংখ্যা একটা চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে তারপর কমবে?

সেরকমই তো মনে হয়।

ডারলিং আর্থ তুমি আর একবার পড়ো।

কেন বলো তো!

পড়লে দেখবে, পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে তৃতীয় বিশ্বে। উন্নত দেশগুলোতে নয়। আমাদের এই তৃতীয় বিশ্ব জনসংখ্যার চাপে গোল্লায় যাক, পশ্চিমি দেশগুলো তাই চায়।

সব ব্যাপারেই বুঝি আজকাল আমেরিকা ইউরোপের দোষ? থার্ড ওয়ার্ল্ডের পপুলেশন বাড়লে এদের কী করার আছে?

আছে রশ্মি, আছে। থার্ড ওয়ার্ল্ড, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড বলে এখন আর কিছু থাকা উচিত নয়। থার্ড ওয়ার্ল্ডও ওয়ার্ল্ড। সেখানে ঘা হলে ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডও সাফার করবে।

ওটা ফিলজফি।

ফিলজফি মানে কি ফ্যাক্ট নয়? আমার তো মনে হয় সমস্যার সমাধানে গোটা দুনিয়ার এগিয়ে আসা উচিত।

রশ্মি মৃদু হেসে বলে, থার্ড ওয়ার্ল্ড চাইলে এরা জাহাজ ভর্তি কন্ট্রাসেপটিভ পাঠিয়ে দেবে। তাতেই কি হবে?

না, তুমি বুঝলে না রশ্মি। কন্ট্রাসেপটিভ নয়, থার্ড ওয়ার্ল্ডের দরকার প্র্যাকটিকাল ইডিওলজির। কিন্তু তুমি কি খেতে বসেছিলে? চিবোনোর শব্দ পাচ্ছি যেন।

রশ্মি হেসে ফেলল। বলল, রাতে আমি কি খাই জানো? মাত্র চারখানা ক্র্যাকার আর দুধ। তুমি যখন ফোন করলে তখন আমি সবে বিস্কুটে কামড় দিয়েছি।

ইস! ডিস্টার্ব করলাম। তুমি বরং খাও, আমি ছাড়ছি।

ছেড়ো না। আমি বরং পরে খাবো। বেশি রাত তো হয়নি।

এদিকে যে ভোর হতে চলেছে!

তুমি যা উত্তেজিত হয়ে রয়েছে, এখন তো ঘুমোতেও পারবে না।

ঘুমটা কি খুব প্রয়োজন? বরং বাকি রাতটা এইসব প্রবলেম নিয়ে ভাববো। কৃষ্ণজীবন অন্তত আমাকে ভাবতে শেখাচ্ছেন।

তা ঠিক। বইটা পড়ে আমিও কিন্তু ক’দিন খুব ট্রান্স-এর মধ্যে ছিলাম। ঠিক আছে, তুমি বরং ভাবো।

বইটার ক’টা এডিশন হয়েছে বললে?

সাত-আটটা তো বটেই। বেশিও হতে পারে।

সেটা কি বেশ বেশি বিক্রি?

খুব না হলেও মন্দ নয়।

সাত-আট এডিশনে কত কপি হয় বলল তো।

মিনিমাম সাত-আট লাখ। অলমোস্ট এ মিলিয়ন। কৃষ্ণজীবনবাবু ইজ নাউ এ ভেরি রিচ ম্যান।

রিচ ম্যান! দূর, সেটা কোনও কথা নয়। হি ইজ রিচ ইন আদার ম্যাটারস্। ছাড়ছি রশ্মি।

বাই।

আরও খানিকক্ষণ জেগে রইল হেমাঙ্গ। ক্যাসেট চালিয়ে স্টিরিওতে আমির খাঁ সাহেবের হংসধ্বনি শুনল। তারপর শুলো এবং ঘুমোলো।

শনিবার আজকাল অফিস ছুটি থাকে। সকালেই সে ফোন করল কৃষ্ণজীবনকে।

ডারলিং আর্থ পড়লাম। অভিনন্দন।

কৃষ্ণজীবন শিশুর মতো শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, কী আশ্চর্য! পড়েছেন? ইটস্ এ গুড নিউজ!

আপনার বইটা যে দারুণ বিক্রি হচ্ছে তা কি আপনি জানেন?

কৃষ্ণজীবন আর হাসল না। বলল, বিক্রি! তা জানি। কিন্তু লোকে ব্যাপারটা বুঝতে পারছে কি?

আমি বোধহয় বুঝেছি।

কিন্তু অন্যরা? অনেকে বই পড়ে, কিন্তু বইয়ের কথাকে ভিতরে নেয় না। অনেক পণ্ডিত আছে বইয়ের মধ্যে প্রতিবাদযোগ্য অংশগুলি খোঁজে। ডারলিং আর্থ হয়তো খুব কমপিটেন্ট রাইটিং নয়, কিন্তু কাঁচাহাতে আমি যা লিখেছি তার উদ্দেশ্য হল, মানুষ আর একটু চিন্তিত হোক, একটু বিষণ্ণ হোক, একটু ভাল করে চারদিকটাকে লক্ষ করুক।

আমি বইটা পড়ার পর থেকে ঘুমোতে পারিনি। একটা কথা আছে। আপনি সামনের উইক এন্ডে আমার গাঁয়ের বাড়িতে যাবেন?

সামনের উইক এন্ড? বোধহয় আমি ম্যানিলায় যাব।

তা হলে আজই চলুন।

আজ? আজ!

ভাববেন না। ভাবলে আর যাওয়া হবে না।

একটা অসুবিধে আছে। রিয়া আজ কয়েকজনকে নেমন্তন্ন করেছে। তারা সব আসবে।

কখন?

আজ বিকেলে। যদি কিছু মনে না করেন, আপনিও আসুন। খুব ইনফর্মাল ব্যাপার।

না, সেটা ভাল দেখাবে না। আমি বাইরের লোক।

বোধহয় ইনভাইটিদের কাউকে কাউকে আপনার অপছন্দ হবে না। কারণ তাঁদের একজন আপনার দিদি চারুশীলা।

মাই গড। চারুদি হলে তো আমি আরও যাবো না।

কেন বলুন তো!

ওঃ সে অনেক কথা। বিয়ে বিয়ে করে ও আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। রিসেন্টলি ও আর একটি মেয়েকে আমদানি করেছে। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে বিয়েটা একজন মানুষের জীবনে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার নয়।

একটা বয়সের পর কিন্তু বিয়েটা ইম্পর্ট্যান্ট। ইভন এ রং ম্যারেজ ইজ ওয়েলকাম দ্যান নো। ম্যারেজ।

আপনি একজন বুদ্ধিমান লোক হয়ে এ কথা বলছেন? রং ম্যারেজ যে মানুষকে নষ্ট করে দিতে পারে। ডিভোর্স, সুইসাইড কত কী হয়!

শিরঃপীড়া হলে কি মাথাটা কেটে বাদ দিতে হবে?

বুঝেছি। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, বিয়ে জিনিসটা সবাইকে স্যুট করে না।

আচ্ছা, ঠিক আছে। ইনভাইটিদের সঙ্গে আপনাকে মিট করাবো না। আমি আর আপনি সামনের বারান্দায় বসব। হবে? একটু ধরুন, রিয়া নিজে আপনাকে নেমন্তন্ন করবে।

আহা, তার দরকার কি?

আছে। ও আপনাকে খুব পছন্দ করে। খুশি হবে।

রিয়া এল এবং ফোন ধরেই বলল, আমার কি এমন ভাগ্যি হবে যে আপনি আসবেন?

কেন, আমি কে এমন খাঞ্জা খাঁয়ের নাতি?

সত্যি আসবেন?

আসতে বলেই দেখুন না! সেই যে হিং-এর কচুরি খাইয়েছিলেন আজও ভুলিনি।

ইস, ছিঃ ছিঃ, কচুরি কি একটা খাবার!

আমি খুব ভালবাসি।

আজ কিন্তু কচুরি নয়। ফুল ডিনার।

আপনি কি ডারলিং আর্থ বইটা পড়েছেন?

ডারলিং আর্থ? না। সময় পাই কোথায় বলুন!

আপনি কি জানেন যে কৃষ্ণজীবনবাবু এখন একজন ওয়ার্ল্ড ফেমাস লোক?

রিয়া হাসল, অতটা জানি না।

ইটস্ এ ফ্যাক্ট।

আসছেন কিন্তু।

যাবো।

ফোনটা রেখে দিল হেমাঙ্গ। এইজন্যই সে বিয়ে করতে চায় না। ভদ্রমহিলা তাঁর স্বামীর বইটা অবধি পড়েননি!

সারাদিন ধরে বইটা আবার পড়ল হেমাঙ্গ। এবার ধীরে ধীরে। ক্রিটিকের মতো। সজাগ ও সতর্ক। কিন্তু কৃষ্ণজীবন তার বইয়ের সম্মোহক অভ্যন্তরে ঠিকই টেনে নিল তাকে। শেষ অধ্যায়ের শুরুতে জীবনানন্দ দাশের একটি উদ্ধৃতি রয়েছে। হে নাবিক, হে নাবিক, জীবন অপরিমেয় নাকি—ও সেইলার, সেইলার, ইজ দি লাইফ স্টিল ইনফিনিট। ক্ষ্যাপা বৈজ্ঞানিক তার বলগাছাড়া কলমে লিখে গেছে, তোমাকে কে বলে দেবে, একটি প্রস্ফুটিত শিউলি ফুলের সৌন্দর্যে কেন তোমার এত আনন্দ? দূরের নক্ষত্রের দিকে চেয়ে শুয়ে আছছ ছাদে, চিৎপাত! তোমার সর্বস্ব হারিয়ে যাচ্ছে অনন্ত নক্ষত্রবীথির রহস্যময়তায়—তখন কে তুমি মনে পড়ে? ওই নক্ষত্ররা কি তোমার সঙ্গে কথা বলে? বলতে চায়? বিজ্ঞান কি ব্যাখ্যা করে এক মহৎ কবিতার অন্তলোককে? সুন্দর গানের মধ্যে কোথায় হারিয়ে যায় তোমার লজিক? হে মানুষ, কোন জড়বস্তু থেকে এল এত চৈতন্যের প্লাবন? ভালবাসা? মুগ্ধতা! কে ব্যাখ্যা করবে তা? বিজ্ঞান তো অন্ধের যষ্টি মাত্র। পথের ঠাহর দেয়, কিন্তু সে তো নয় চোখ! বীজের ভিতরে বটবৃক্ষের সম্ভাবনা—এ কি ভাবতে পারা যায়? একটু ভাবো। ভাল করে ভাবো। ঈশ্বরীয় বা নিরীশ্বর যাই হও তুমি, দাঁড়াও। দুই হাত অঞ্জলিবদ্ধ করে প্রার্থনা করো, জ্ঞানবান করো আমাকে। সৃষ্টির দুর্ভেয় অবগুণ্ঠন সরিয়ে দাও। বুঝতে দাও, আমি কে। বুঝতে দাও, তুমি কে!

আপনি কি খুব কবিতা পড়েন?

কবিতা! বলে কৃষ্ণজীবন লাজুক একটু হাসল, একটু-আধটু।

নিজে লেখেনও নাকি?

না, না, কী যে বলেন!

হেমাঙ্গ একটু চুপ করে থেকে বলল, আমার মনে হচ্ছিল, কবিতার প্রতি আপনার কিছু আনগত্য আছে।

কৃষ্ণজীবন চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, অ্যাফ্লুয়েন্ট দেশগুলোতে কবিতা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। টেকনোলজি খেয়ে ফেলছে সাহিত্যকে। এইসব কবিতা-টবিতা যা কিছু সব আজকাল থার্ড ওয়ার্ডের নিষ্কর্মাদের পাসটাইম। জানেন?

কিছুটা জানি।

বাঁচোয়া। আর সব দিকে এগিয়ে গেলেও ওরা, ওইসব টেকনোলজিক্যালি হাই সোসাইটি, বোধহয় কবিতাকে আমাদের হাতে ছেড়ে দেবে।

তাই হোক।

বিকেল মরে সন্ধে হয়ে আসছে। কৃষ্ণজীবনের সাততলার ঝুল-বারান্দা থেকে সূর্যাস্তের শেষ রশ্মি মিলিয়ে যেতে দেখেছে হেমাঙ্গ। অতিথিদের সমাগম এখনও হয়নি। কৃষ্ণজীবনকে একা পাওয়ার জন্য একটু আগেই এসেছে হেমাঙ্গ।

রেলিঙে থুতনির ভর হাতের পাতায় রেখে কৃষ্ণজীবন সামনের দিকে চেয়ে দূরাবলোকন করছিল। কেমন এক দূর গলায় বলল, আমার ছোটো দুটো ভাই সামান্য বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারপিট করে এ ওকে জখম করেছে। আমার একটা বোন যাত্রা করে বেড়ায়। আমার বাবা-মা কাঁচাঘরে বাস করে। আর আমি? সাততলায় থাকি। মোটা মাইনে পাই। আমেরিকা থেকে আমার বই বেরোয়। হেমাঙ্গবাবু, আমাকে যা দেখছেন, যতটুকু দেখা যাচ্ছে আমার, এটুকুই সব নয়। আমি যেমন বাইরের দূষণের কথা বলি, তেমনি ভিতরের দৃষণের কথাও বলি। মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে, তার মনের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে কি কম পলিউশন?

হেমাঙ্গ চুপ করে কৃষ্ণজীবনের দিকে চেয়ে রইল।

কৃষ্ণজীবন মৃদু স্বরে বলল, মাঝে মাঝে আমি কেমন যেন মূক-বধির হয়ে যাই। এমন সব সিঁচুয়েশন তৈরি হয় যাতে আমি ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ি, কিছুই করতে পারি না। তখন কি ভাবি জানেন? ভাবি, তোর ওপরে নেই ভুবনের ভার। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি বৃথা চিৎকার করে মরছি, পৃথিবীর কেউ আমার কথা শুনছে না, গুরুত্ব দিচ্ছে না, হয়তো আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

আপনার কেন এরকম মনে হয়?

কৃষ্ণজীবন যখন মুখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল তখন হেমাঙ্গ লক্ষ করল কৃষ্ণজীবনের মুখে বিষণ্ণতার ছাই মাখানো। চোখের দীপ্তি হঠাৎ নিবে গেছে। মৃদু স্বরে বলল, ডারলিং আর্থ বইটা প্রকাশের আগে পাবলিশারের অনেক দ্বিধা ছিল। রিভিউয়াররা সবাই ফেবারেবল ছিল না। অনেক আগু-পিছু, অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর ওরা ডিসিশন নেয় যে, বইটা শেষ অবধি ছাপা হবে। যখন বইটা নিয়ে ইনডিসিশন চলছে তখন আমার প্রায়ই মনে হত, ওই বইয়ের মধ্যে বোধহয় আমার পাগলামিই রয়েছে। কিন্তু এই পাগলামি ছাড়া আর যে আমি কিছুই পারি না।

কোনও কোনও পাগলামি হয়তো প্রতিভার লক্ষণ।

প্রতিভা! না না, ওসব আমার নেই। আপনি ঠিক বুঝবেন না, আমি খুব আনসাকসেসফুল ম্যান।

তার মানেটা কি হল?

সাকসেস তাকেই বলে যখন মানুষ নিজের সঙ্গে এই গোটা বিশ্বজগতের প্রকৃত সম্পর্কটা আবিষ্কার করতে পারে। সারাজীবন আমি সেই চেষ্টাই তো করেছি। কিন্তু হল না। মনে হচ্ছে, একটা নিরেট দেয়ালে মাথা ঠুকে মরছি। কিছুতেই বুঝতে পারছি না, আমি কি। সত্যিই আমি কে। এই যন্ত্রণা আমাকে মাঝে মাঝে পাগলের মতো করে দেয়। এই গাড়ি বাড়ি টাকা ডক্টরেট সব যেন একমুঠো ধুলোর মতো অর্থহীন হয়ে যায়।

হেমাঙ্গ স্মিতমুখে বলল, অ্যান্ড দ্যাট ইজ সাকসেস। আপনার যন্ত্রণাটাও যদি আমার থাকত তা হলে নিজের পিঠ চাপড়ে বলে উঠতাম, সাবাস।

এ বই কি মানুষকে ভাবাবে হেমাঙ্গবাবু?

কাঁদাবে।

আপনি ঠাট্টা করছেন না তো!

এই বুঝলেন এতক্ষণে?

না না। ইউ আর সো কাইন্ড।

ডোরবেল বাজতেই উঠে গেল কৃষ্ণজীবন। অতিথি সমাগম শুরু হল বোধহয়। ভিড় হয়ে যাবে। কত অর্থহীন কথার গ্যাঁজলা উঠবে। বিষণ্ণ, মন্থর, গভীর যে সময়টুকু এই বারান্দায় ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল তা ডানা মেলে পালিয়ে যাবে।

কী রে কিম্ভূত?

হেমাঙ্গ ঘোর অন্যমনস্কতা থেকে মুখ তুলে কয়েক পলক মহিলাটিকে চিনতেই পারল না। মনে মনে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিল সে। এক মহাকাশচারীর মতো সে কালো আকাশে সবুজাভ নীল পৃথিবীর গোলকটিকে অবলোকন করছিল। সেও ভাবছিল, কেন জন্ম? কেন এই চৈতন্য? কেন এই বিশাল সৃষ্টির আয়োজন? এর কি কোনও মানে হয় না?

চারুশীলাকে চিনতে তাই সময় লাগল। সে একটু হাসল। নিজেই টের পেল, হাসিটা ফুটল না। হাসিটা হাসির মতো হল না। অস্ফুট স্বরে সে বলল, চারুদি!

তোরও নেমন্তন্ন ছিল বলিসনি তো! কৃষ্ণজীবনবাবুর কাছে শুনে তো আমি অবাক।

হেমাঙ্গ বেশ কষ্ট করেই নিজেকে বাস্তবে নামিয়ে আনল। বলল, নেমন্তন্ন? ও হ্যাঁ, নেমন্তন্নটা আজ সকালেই হয়েছে। তোকে বলবার সময় পাইনি।

এত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে কেন তোকে? কী হয়েছে?

না, কিছু নয়।

ভেতরে আয় না! মুখ গোমড়া করে বসে আছিস কেন? আয়।

হেমাঙ্গ উঠল।

মস্ত হলঘরটায় অতিথি সমাগম হচ্ছে। বেশির ভাগই চেনা মুখ। সুব্রত, অনু, চারুদির ছেলেমেয়েরা।

আপনি কিন্তু রোগা হয়ে গেছেন।

হেমাঙ্গ ফিরে তাকাল। যাকে দেখল তাকে চিনতেও একটু সময় লাগল তার।

রোগা হয়ে গেছি!

অনেক। কেন রোগা হলেন? বিরহে নয় তো!

হেমাঙ্গর কান দুটো হঠাৎ একটু গরম হয়ে গেল। বিড় বিড় করে সে কয়েকবার আওড়াল, বিরহ? বিরহ? কেন বলুন তো!

ঝুমকি একটুও হাসছে না। মুখটা থমথমে গম্ভীর। বলল, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না।

হেমাঙ্গ ছিপছিপে সুন্দর মেয়েটার দিকে চেয়ে ভাবতে লাগল, একে কী বলা যায়! মেয়েটা কি তাকে নিয়ে মজা করছে?

একটু সময় নিয়ে সে গম্ভীর গলায় বলল, বিরহের কোনও কারণ তো দেখতে পাচ্ছি না।

ঝুমকি একটু হাসল। বলল, তা হলে বোধহয় ডায়েটিং করছেন।

ফাজিল মেয়েটির কাছ থেকে সরে যাওয়ার জন্য সে ‘এই যে, চয়নবাবু’ বলে এগিয়ে গেল।

কিন্তু সারাক্ষণ সে মাঝে মাঝেই টের পেতে লাগল, একজোড়া চোখ তাকে কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করছে, অনুসরণ করছে। কিছু বলতেও চাইছে কি? গেরো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *