সন্ধ্যার মা ডাকল, খেতে এসো দিদিমণি।
তিতির শুয়ে শুয়ে একটা ইংরিজি ম্যাগাজিন উল্টোচ্ছিল। সিনেমার। কন্দর্পর ঘরে পড়ে ছিল, নিয়ে এসেছে। চটুল অর্ধসত্যে ভরা পত্রিকা, মন না দিয়েও তরতর চোখ বোলানো যায়। এসব পত্রিকা আগে টানত না তিতিরকে, গল্পের বই-ই তার প্রাণ ছিল। এখন গল্পের বই পড়তে বেশিক্ষণ ভাল লাগে না, সহস্ৰ বুক-ভারকরা চিন্তা সেঁধিয়ে যায় গল্প উপন্যাসের পাতায়, শব্দ বাক্য সবই অর্থহীন অক্ষরের সমষ্টি বলে মনে হয়। তার চেয়ে এই ভাল। এই চিন্তাশূন্য, ভোঁতা এক রঙিন কাল্পনিক জগৎ।
সন্ধ্যার মা আবার ডাকল, কই এসো, ভাত বেড়ে যে বসে আছি।
যাই।
যাই নয়, এসো। আমি আজ তাড়াতাড়ি যাব, বাড়িতে পুজো আছে।
বিরক্ত মুখে পত্রিকাটা রেখে উঠল তিতির। পাখার হাওয়ায় ফরফর উড়ছে রঙিন পাতা। রূপসী নায়িকার ভাঁজ করা নির্লজ্জ পোস্টার খুলে ছড়িয়ে গেল। খোলা কাঁধ, খোলা পিঠ, খোলা ঊরু। নাচছে হাওয়ায়। ছবিটাকে ভাঁজ করে আব্রু টানার চেষ্টা করল না তিতির, পাখা বন্ধ করে খাওয়ার টেবিলে এল।
এসেই আড়ষ্ট। বাবা। খাচ্ছে।
নিঃশব্দে চেয়ার টেনে আদিত্যর পাশে বসল তিতির। ভাত মাখছে মাথা নিচু করে। মুসুর ডালের কাঁচা লঙ্কাটা তিতিরের পাতেই পড়েছে, কচকচ চিবোল সেটাকে। জ্বলে যাচ্ছে জিভ, তবু মুখ থেকে লঙ্কা ফেলল না। আঙুল দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিপল আলুপোস্তর আলু, ডাল-মাখা ভাতে পুরো তরকারিটা চটকে নিল। চটকাচ্ছে, চটকেই চলেছে।
আদিত্যর বুঝি নজরে পড়েছে দৃশ্যটা। খাওয়া থামিয়ে বলল, হল কী তোর! খাচ্ছিস না কেন!
গপ গপ করে দু গাল ভাত মুখে ঠেসে দিল তিতির।
–ওকি করিস! গলায় আটকে যাবে যে!
কোঁত করে ভাতটা গিলে নিল তিতির। সবটা পারল না, জল দিয়ে বাকিটা চালান করতে হল পাকস্থলীতে। ঠকাং করে গ্লাস নামিয়ে রাখল।
আদিত্যর ঠোঁটে হাসি ফুটেছে, এখনও আমার ওপর রেগে আছিস?
রাগ কিসের। আমি কারুর ওপর রাগ করি না।
বললেই হল! তাকা, আমার দিকে তাকা।
তিতির চোখ তুলল না। স্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে বলল, – কেন আমি মিছিমিছি রাগ করব বাবা? আমি রাগ করলে কারুর কি কিছু বদল হবে?
–এও তো রাগেরই কথা। আদিত্য তিতিরের কাঁধে হাত রাখল, দূর পাগলি, আমি কি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি? গেলেও…তোকে ছেড়ে কি আমি থাকতে পারি? ঠিক ফাঁক বুঝে মাঝে মাঝে চলে আসব।
গেলে বুঝি কেউ আর ফেরে! এই পরিবার থেকে একে একে সবাই সরে যাচ্ছে। দাদা চলে গেল, কাকা কাকিমারা চলে গেল, দাদু তো…এবার বাবাও কেটে পড়ার মতলব ভাঁজছে। বাবাকে ছাড়া কী করে এ বাড়িতে নিশ্বাস নেবে তিতির!
তিতিরের চোখ ভিজে আসছিল। মেঘলা গলায় বলল, – যাও না, আমি কি তোমাকে বাধা দিয়েছি? দু মাস পরে কেন, আজই চলে যাও।
আদিত্য হাত সরিয়ে নিল তিতিরের কাঁধ থেকে। মলিন গলায় বলল, -তুইও আমাকে বুঝবি না তিতির? চাস না তোর বাবা একটু শান্তি পাক?
তিতির চুপ।
–এখন তোর মনে হচ্ছে তোর বাবাটা খুব নিষ্ঠুর। কারুর কথা ভাবে না, শুধু নিজের কথা ভাবে। আমি চলে গেলে দেখবি তোর ধারণাটা কত ভুল। এই দুনিয়ায় কিছু কিছু মানুষ থাকে জ্যান্ত উপদ্রবের মতো, তারা যেখানে হাত ছোঁয়ায় সেখানে অশান্তি, যেদিকে তাকায় সেদিকেই দুঃখের ফোয়ারা খুলে যায়। তারা সংসারের কূটতর্ক বোঝে না, সুখ খুঁজে আনার গোপন রহস্যও তাদের জানা নেই। তারা…
–থাক, তোমার ওই তত্ত্বকথা তোমার রঘুবীরবাবুকে শুনিয়ো। রোজ এক লেকচার শুনতে আমার ভাল লাগে না।
নীরস স্বরে আদিত্যকে থামিয়ে দিল তিতির। সন্ধ্যার মা বাটিতে ডিমের ঝোল রেখে গেছে, পাতে ঢেলে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ। এ জগতে কে না নিজের কাজের সাফাই গায়! চোর ডাকাত খুনে বদমাশ, তাদেরও নিজেদের কাজের পিছনে মনোমতো যুক্তি খাড়া করা থাকে। আর বাবা তো সাধুসন্তর জীবন যাপন করতে চাইছে! তবে হাজারটা খরগোশ জোড়া দিয়ে যেমন একটা ঘোড়া বানানো যায় না, তেমন হাজারটা যুক্তি দিয়েও আপনজনের দুঃখের ভার লাঘব করা যায় না। বাবার অনস্তিত্বে এ সংসারে সুখের প্লাবন বইবে, এমন উদ্ভট ধারণাই বা বাবার এল কোত্থেকে!
যাক গে, যে যার সুখ খুঁজুক, যে যার আনন্দ নিয়ে থাকুক, তিতির কাউকে আর কিছু বলবে না। তিতির আর শিশুটি নেই, সে নিজেকে শক্ত করে নিতে জানে।
খাওয়া শেষ করে তিতির উঠছিল, আদিত্য ডাকল তাকে, –তুই কি এখন বাড়িতেই আছিস?
তিতির ভারী মুখে ঘুরে দাঁড়াল, আমার তো তোমার মতো একশোখানা যাওয়ার জায়গা নেই বাবা।
–তুই একদম মার মতো করে কথা বলছিস কেন?
–সে তো বলিই। আমি তো মারই মেয়ে।
আদিত্যর মুখটা যেন কালো হয়ে গেল।
পলকের জন্য নরম হল তিতির, –কী বলবে বলো। আমি এখন বাড়িতেই আছি।
–আমার সঙ্গে চল না। আদিত্য সঙ্কুচিতভাবে বলল।
–কোথায়?
–মানিকতলায়। …তোর মা অত করে বলে গেল।
মানিকতলার বাড়িতে দিদা আজ সত্যনারায়ণ পুজো করছে। দশটা বাজতে না বাজতেই মা চলে গেছে সেখানে। তার আগে বাবার সঙ্গে মার মৃদু বিতণ্ডা চলছিল, শুনেছে তিতির। বাবাকে সঙ্গে যেতে বলছিল মা, বাবা যেতেই রাজি নয়। মা বলছিল, যাবে কি যাবে না সেটা তোমার ব্যাপার। বাবা মা তোমাদের বারবার যেতে বলেছেন, এটা জানিয়ে দিলাম। তোমার মেয়েকেও পায়ে ধরে সাধব না, তোমাকেও না।
তিতির ভুরু কুঁচকে তাকাল, তুমি যাচ্ছ?
যাই। তোর দাদু-দিদা মনে কষ্ট পাবেন।
–অন্যের কষ্ট তা হলে তোমার মনে লাগে?
–আবার সেই মার মতো কথা। যাবি কিনা বল।
তিতির দুদণ্ড চিন্তা করল। দাদু-দিদাকে এখনও বিজয়ার প্রণাম করতে যাওয়া হয়নি, পুজো দেখা আর প্রণাম এক ঢিলে দু পাখি মেরে আসা যায়। দাদু-দিদাকে দেখতেও ইচ্ছে করছে খুব। প্রতিবার পুজোতে ছোটকার সঙ্গে একবার মানিকতলায় ঢুঁ মেরে আসে, এবার পুজোয় একদিনও ছোটকার টিকি দেখা গেল না। সক্কাল হলেই গাড়ি নিয়ে আউট, দুপুরে ফিরে ভোঁস ভোঁস ঘুম, আর সন্ধে না হতেই গোঁফ ছেটে, চুল ফাঁপিয়ে আবার গাড়ি চালিয়ে ভ্যানিশ। নবমীর দিন সকালে তিতিরকে অবশ্য একবার বেরোতে সেধেছিল ছোটকা, তিতির রাজি হয়নি। কে জানে কেন বেড়ানোর মুডই ছিল না সেদিন। আজ গেলে বাবার সঙ্গেও একটু বেড়ানো হয়। কতকাল যে বাবার সঙ্গে বেরোয়নি তিতির।
কিন্তু না। যা যা ইচ্ছে করছে তার একটাও করবে না তিতির। ছোট ছোট ইচ্ছের মধ্যে যেটুকুনি শরতের বাতাস লুকিয়ে আছে, সে-টুকুনিও টিপে টিপে নিংড়ে বার করে দেবে ফুসফুস থেকে। মৃত ইচ্ছেগুলো যত বেশি আকুল করবে তিতিরকে, তত বেশি উচ্ছল হবে তিতির।
মুখ ফিরিয়ে তিতির বলল, তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও। আমাকে টানাটানি কোরো না।
সন্ধ্যার মা বাসন-কোসন মেজে চলে গেছে। আদিত্যও বেরিয়ে গেল। গ্রিল-দরজায় তালা দিয়ে একটুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল তিতির। সূর্য পশ্চিমে হেলছে, শেষ আশ্বিনের রোদ্দুর এখনও ভারী তেজি। ফেনা ফেনা মেঘ ভাসছে আকাশে। একটা চিল উড়তে উড়তে মেঘেদের ছুঁয়ে ফেলল। পাক খেয়ে খেয়ে নামছে আবার, ছোট হচ্ছে বৃত্ত। রোদ্র মাড়িয়ে একঝলক বাতাস ছুটে এল তিতিরের দিকে, নির্জন দুপুর ভারী কোমল হয়ে গেল।
এই ভাল লাগাটাও ভাল নয়। সরে এল তিতির।
বিছানায় ফিরে তিতির আবার বিশ্রী ম্যাগাজিনটা নিয়ে শুয়ে পড়ল। দুই নায়কের অকপট মিথ্যে ভাষণ পার হতে-না-হতেই চোখ আটকে গেছে সামনের দেওয়ালে। পশ্চিমের খোলা জানলা দিয়ে এক টুকরো আলো এসে দেওয়ালে একটা মায়াবী পর্দা তৈরি করেছে। পর্দায় জাফরি কেটেছে জানলার গ্রিল। জাফরির পিছনে ভাসছে ওপাশের শিউলি গাছের ছায়া। দুলছে গাছ, ছায়াও দুলছে। একটা ছোট্ট টুনটুনি ডালে বসেই ফুড়ৎ উড়ে গেল। আবার বসল এসে, এবার একটা নয়, দুটো। তিরতির কাঁপছে পাতারা, কাঁপছে ছায়ার মায়া।
তিতির মুগ্ধ চোখে ছবি দেখছিল, ছবির বদল দেখছিল, ছবির নির্মিতি দেখছিল। অভিমানী বুকে কুল কুল করছে সুখ, যা কিনা শুধু তিতিরের বয়সেই আসে। এই সুখ আর দুঃখের মাঝে একচুল ব্যবধান। ডালে ডালে পিড়িং পিড়িং নাচছে জোড়া টুনটুনি, অপরূপ এক বিভ্রমে উপচে যাচ্ছে তিতির। দুলন্ত পাতার ছায়া এত শিহরন তোলে মনে!
তখনই তিতিরের পোস্তদানা মনটা কুনকুন করে উঠল। বহুদিন পর।
–তোর জন্য এককণা সুখও ভাল নয় রে তিতির।
–সে কি আমি জানি না! খুব জানি।
–মিছিমিছি তবে কেন ভাল লাগা খুঁজিস?
–খুঁজি না তো। চোখে পড়ে যায়। মনে এসে যায়।
–এর জন্যই তোর অনেক শাস্তি পাওনা হচ্ছে।
–আরও শাস্তি?
–হুঁ হুঁ। সামলা, নিজেকে সামলা।
হঠাৎ এ কথা কেন?
পোস্তদানা মন ডেলফির দৈববাণীর মতো নীরব হয়ে গেল। অমোঘ সত্যের আশঙ্কায় খানিকটা দোনামোনায় পড়ে গেল তিতির। জানলাটা বন্ধ করে দেবে? টেনে দেবে পর্দা?
কলিংবেল বাজছে। ঘরের মধ্যেকার সুনসান দুপুরটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। অলস পায়ে বারান্দায় গিয়ে ভারী অবাক হল তিতির, ওমা, মেশিনদাদু তুমি!
দুর্লভ আগের মতোই জাদুমাখা হাসি হাসছে, বুড়োটাকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি দিদিভাই? দরজা খুলবে না?
এমা ছি ছি, এসো এসো। দুর্লভকে আদিত্যর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল তিতির। পাখা চালিয়ে দিল, আমাদের এ বাড়ি তুমি চিনলে কী করে?
ম্যাজিক। হাত উল্টে বিচিত্র ভঙ্গি করল দুর্লভ।
জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় পলকে শৈশব জেগে উঠেছে তিতিরের। জেগে উঠেছে সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখি, রঙিন প্রজাপতি, সুরভিত ফুল, সুদূর নীহারিকা। জেগে উঠেছে এক অলীক স্বপ্নপুরী।
মায়া রাজ্যের স্থপতি ধুতির খোঁটায় ঘাম মুছছে। হাসল, তোমার বড়কাকার সঙ্গে মাঝে মাঝে অফিসপাড়ায় দেখা হয় গো দিদি। কতদিন ধরে ভাবি আসব আসব, হয়েই ওঠে না। এর মধ্যে আবার পুজোর ছুটিতে দেশে গেলাম…
–তুমি আবার কাজ করছ? কোথায়?
আমি যে একই যন্ত্রে বাঁধা দিদি। সেই ঘটাংঘট। বউবাজারের এক গাছে এখন কোমরের দড়ি বেঁধেছি।
দ্রুত অন্দরে গিয়ে এক গ্লাস শরবত করে নিয়ে এল তিতির, সঙ্গে এক প্লেট মিষ্টি। সন্ধ্যার মা দশমীর দিন কিছু কুচো নিমকি ভেজেছিল, তাও খুঁজেপেতে বার করে সাজিয়ে দিল। কত যুগ পর এক আপনজন এসেছে ঘরে।
নাও, খেয়ে নাও।… তা হলে আর তোমার দেশে ফেরা হল না মেশিনদাদু?
কপাল দিদি। তোমাদের এই শহরটা যে অজগরের মতো পাকে পাকে বেঁধে ফেলেছে। দেশে গিয়ে মন টেকে না, হাওড়ার পুল দেখার জন্য চোখ হেদিয়ে মরে…। ওদিকে ছোট জামাইটা সেই যে সাইকেল থেকে পড়ে মাজা ভেঙে হাসপাতালে গেল, এখনও পুরোপুরি সেরে উঠল না। তার পেছনে কি কম খরচপাতি গো! ওষুধটা-বিষুধটা…সপ্তাহে দু দিন ভ্যানরিকশা করে মহকুমা হাসপাতালে থেরাপি করতে ছোটা…তোমার মেশিনদাদুর কাজ না করে উপায় কি?
মেশিনদাদুর মুখে এসব দুঃখের কাহিনী মানায় না। স্বপ্নের ফেরিঅলা রূঢ় বাস্তবের কথা বলবে এ কেমন কথা!
তিতির ফস করে জিজ্ঞাসা করল, নতুন প্রেস লাগছে কেমন? ওখানেও কি তোমার পুরনো খেলা চলছে?
সময় পাই না গো দিদি, মালিক বড্ড খাটায়। কাজে ভুল হলে হপ্তা দিতে চায় না…। দুনিয়া বড় কঠিন হয়ে গেছে গো দিদিভাই, কচি কচি ছানারাও আর এখন স্বপ্ন দেখতে চায় না। আমারও আর ওসব আসে না দিদি।
এর পরে আর গল্প জমে! তিতিরকে দু-চারটে কুশল প্রশ্ন করল দুর্লভ, আদিত্য ইন্দ্রাণী কন্দর্প বাপ্পার খবর নিল। গা বাঁচিয়ে ভাসা ভাসা উত্তর দিল তিতির। এ বাড়িতে আসার পথে তিতিরদের পুরনো বাড়িটা দেখে এসেছে দুর্লভ, কেমন ভোজবাজিতে মিলিয়ে গেছে বাড়িটা, নতুন করে বিশাল বিশাল পিলার গাঁথা হচ্ছে, সে গল্পও করল খানিক। ইনিয়ে বিনিয়ে জানতে চাইল ফ্ল্যাটবাড়িতে ইন্দ্রাণীর আবার প্রেস করার ইচ্ছে আছে কিনা, যদি হয় আবার ফিরে আসতে চায় দুর্লভ, দু-দশ টাকা কম পেলেও।
কিছু শুনছিল তিতির, কিছু শুনছিল না। নির্জন দুপুরের বিষণ্ণতা আবার চারিয়ে যাচ্ছে বুকে। এতদিনে মেশিনদাদু বুড়িয়ে গেল। চোখ অনেক নিষ্প্রভ, স্বর উচ্ছ্বসহীন, মুখের বলিরেখা হঠাৎই প্রকট। তরতরে তাজা ভাবের চিহ্নমাত্র নেই। স্বপ্ন ফুরিয়ে গেলে কি মানুষের এই দশাই হয়!
এক সময়ে উঠল দুর্লভ। খেটো ধুতি পরা ছোটখাট কুঁজোটে মানুষটা জীর্ণ ক্যাম্বিসের ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। পথে নেমে আকাশের দিকে চোখ তুলল একবার, ছাতার আড়ালে মিলিয়ে গেল মাথা। তিতিরের হঠাৎ মনে পড়ল ফি বছরই পুজোয় মেশিনদাদুকে ধুতি শার্ট দিত মা, এ বছরও কি সেই আশায় এসেছিল গরিব মানুষটা? বাবা তো কালেভদ্রে ধুতি পরে, অনেক নতুন ধুতি জমে আছে, দৌড়ে ডেকে এনে দিয়ে দেবে একটা? থাক গে। মেশিনদাদু গরিব কিন্তু হাতপাতা স্বভাবের নয়, যদি কিছু মনে করে!
ঘরে ফিরে তিতির মায়ামাখা ছবিটাকে খুঁজল। নেই। সূর্য আরও ঢলে গেছে, এক ক্লান্ত ছায়া ছড়িয়ে আছে ঘরে।
আবার বিছানায় শুয়ে চোখ বুজল তিতির। ভাল লাগছে না। বাড়িঅলা পাম্প চালিয়েছে, উগ্র। ঝিঁঝির ডাকের মতো একটা শব্দ বেজে চলেছে একটানা। মাথার ওপর একা একা পাখা ঘুরছে, তারও একটা নিজস্ব ধ্বনি বিন বিন করছে কানে। শরতের এই আলোআঁধার মাখা বিকেলে ওইসব শব্দরাজি আরও আরও যেন উদাস করে দেয় মন। এক্ষুনি কারুর সঙ্গে কথা বলতে পারলেও বুঝি ভাল লাগত।
মাস চারেক কন্দর্পর তদ্বির-তদারকির পর অবশেষে টেলিফোন ফিরেছে তিতিরদের। এই সবে পুজোর মুখে মুখে লাইন দিয়েছে। ঠিকানা বদল করতেই এত দিন সময়, নতুন যারা দরখাস্ত করেছে তাদের যে কী হাল! তিতিরের বন্ধু দেবোপমরা সাত বছর আগে অ্যাপ্লিকেশন করেছে, এখনও খোঁজ নিতে গেলে নাকি শোনে, রহু ধৈর্যং, ইলেকট্রনিক এক্সচেঞ্জ হল বলে, তখন আর কারুর টেলিফোন নিয়ে সমস্যা থাকবে না!
টেলিফোনের সামনে এসে তিতির চিন্তায় পড়ল। কাকে ফোন করবে? ঝুলন? সে তো শুশুনিয়ায়। দেবস্মিতাকেও করা যায়, অনেক দিন দেবস্মিতার কোনও খোঁজখবর নেই। এই স্কুলের বন্ধুদের ফোন করবে? এবার পুজোয় দিল্লি গেছে কুলজিৎ, গাড়ি নিয়ে এবার আর দল বেঁধে ঠাকুর দেখতে বেরোনো হয়নি, জিজ্ঞেস করা যায় কার পুজো কেমন কাটল।
সহসা তিতিরের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। টোটো তো এখন একা আছে, তাকে রিঙ করলে কেমন হয়? কী ভীষণ চমকে যাবে টোটো। আজেবাজে কথা বলে দেবে কি? যদি বলে? অপমান করে তিতিরকে?
একটা মন বাধা দিচ্ছে, অন্য মন টকটক টিপছে নাম্বার। বেশ খানিকক্ষণ ফোন বাজার পর টোটোই ধরেছে। ঘুম ঘুম গলা, হ্যালো?
কটাস করে লাইন কেটে দিল তিতির।
মিনিট খানেক পর আবার তিতির বোতাম টিপেছে। আবার হ্যালো। আবার ফোন রেখে দিল তিতির।
আবার।
আবার।
বারপাঁচেকের মাথায় খেপে গেছে টোটো। চিৎকার করছে, ইউ বাস্টার্ড। স্টপ দিস জোক ইউ সোয়াইন।
তিতিরের কান লাল হয়ে গেল। একটু মজাও লাগল যেন। প্রকাণ্ড ফ্ল্যাটে টোটোর অস্থির হাত-পা ছোঁড়া কল্পনা করতে পারছে। কথা না বলে সে ভালই করেছে। কীই বা বলত! তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। তুমি আমার সঙ্গে আর ঝগড়া কোরো না প্লিজ! যাহ, তিতির কি টোটোর কাছে নিজেকে অত খেলো করতে পারে কখনও! তার চেয়ে এই মজার খেলাটাই বেশ।
মেঘ সরে আলো আসছে মনে। প্রফুল্ল চিত্তে এক কাপ চা করে ফেলল তিতির। কাপ হাতে কন্দর্পর ঘরে এল। গতকালই তিন দিনের আউটডোরে বোলপুর গেছে ছোটকা, ঘরটা সামান্য অগোছালো হয়ে আছে। ইদানীং ঘর টিপটপ রাখার ব্যাপারে ছোটকা বেশ অমনোযোগী। কেন কে জানে! হয়তো বিখ্যাত হওয়ার আনন্দে ছোট ঘর, ছোট আসবাবে আর মন ওঠে না।
আলগোছে ঘরটাকে একটু ঝাড়পোঁচ করল তিতির। খাটে দুখানা মোটা মোটা বই পড়ে আছে, টেবিলে গুছিয়ে রাখল। খোলা ভিডিও ক্যাসেট খাপে ভরল, ভিসিপিটাকে মুছল যত্ন করে। সেতারে আঙুল টেনে টুং টুং করল, কান পেতে শুনল ধ্বনিটাকে। ছোটকার কাছে এই বাজনাটা শিখলে হত, এও বেশ সঙ্গী হতে পারত তিতিরের।– টেলিফোনের ঝংকারে সচকিত হল তিতির। হরিণ পায়ে ছুঁয়ে এসে রিসিভার তুলল।
কী ব্যাপার? তখন থেকে ফোন করে যাচ্ছি শুধু এনগেজড বাজছে! কার সঙ্গে এত কথা বলছিলে, অ্যাঁ?
সুকান্তর কথার মালগাড়ি ছুটছে।
তিতির হাসি চাপল, – আমার কি বন্ধুর অভাব আছে! কজনের নাম বলব?
–আমারই শুধু কোনও বন্ধু নেই।
আহা, তোমার গ্যারেজ পার্টি কী হল?
–ওরা বন্ধু কেন হবে! ইয়ার দোস্ত।
–ও, বন্ধুর ডেফিনেশানটা তবে কি?
–এই ধরো, যাকে দেখতে না পেলে চোখে আঞ্জনি হয়। যার সঙ্গে দশ পা না হাঁটলে হাঁটুতে ব্যথা হয়। যার বকুনি না খেলে রাতে ঘুম আসে না …
থাক থাক, হয়েছে। ফোন কেন? আমার তো আজ বাড়ি থাকার কথা নয়।
–আছ কেন?
নিশ্চয়ই তোমার ফোন ধরার জন্য নয়। আমার অন্য কাজ আছে।
দূরভাষ একটুক্ষণের জন্য নীরব। তারপর গলা বাজছে, আজ কোজাগরী পূর্ণিমা, একটুও বেরোবে না?
–বেরিয়ে?
–এমনিই। তোমার সঙ্গে একটু এদিক ওদিক ঘুরব।
তিতির এক সেকেন্ড চিন্তা করল। ফাঁকা বাড়িতে এখন একা থাকা মানেই আবার সেই দুঃখী দুঃখী মুহূর্তগুলোর খপ্পরে পড়া। সুকান্তর সঙ্গে বেরোনোও যে খুব সুখের তা নয়, বড্ড আলতু-ফালতু কথা বলে ছেলেটা। তা হোক, সঙ্গী তো বটে। পাশে হাঁটলে শহরের নির্জনতা কেটে যায়।
স্বর নির্লিপ্ত রেখে তিতির বলল, ঠিক আছে, বেরোচ্ছি। তুমি বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করো। অষ্টমীর দিনের মতো অতক্ষণ কিন্তু বাইরে থাকব না।
ফোন রেখে তিতির অল্প সাজগোজ সারল। বাতাস শুকনো হয়ে আসছে, একটু ময়েশ্চারাইজার লাগাল মুখে, ঠোঁটে চিলতে লিপস্টিক। সালোয়ার কামিজ পরতে গিয়েও কি ভেবে রেখে দিল, কন্দর্প এবার একটা দামি সিল্কের শাড়ি দিয়েছে পুজোয়, অতি যত্নে পরল শাড়িটা। দরজা-জানলায় ভাল করে ছিটকিনি তুলল, কোনও খুঁত পেলেই মা ফিরে এসে বাঁকা বাঁকা কথা শোনাবে।
পিত্তি জ্বালানো পুঁতে রঙ অ্যাম্বাসাডার নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে সুকান্ত। তিতিরকে দেখেই লাফিয়ে উঠল, — আইব্বাস, কী দিয়েছ! এক্কেবারে কোজাগরী হয়ে বেরিয়েছ যে!
তিতির তেরিয়া চোখে গাড়িটার দিকে তাকাল, — এটা কী? তোমাকে না কত দিন গাড়ি নিয়ে আসতে বারণ করেছি!
উপায় ছিল না। মাসির বাড়ি থেকে তোমাকে ফোন করছিলাম, সঙ্গে গাড়িটা ছিল। গাড়ি রেখে আসতে গেলে লেট হয়ে যেত।
লাই।
–মাইরি না। আপ অন গড। তোমাকে ছুঁয়ে বলতে পারি।
–থাক। সামনের সিটের দরজা খুলে বসল তিতির। জানলার কাচ নামিয়ে দিল। স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে সুকান্ত বলল, – কোন দিকে যাবেন মেমসাহেব?
–যে চুলোয় খুশি।
কয়ামতসে কয়ামত তক-এর ক্যাসেট আছে, চালাই?
না।
সুকান্ত গাড়ি স্টার্ট দিল, গঙ্গার ধারে যাবে?
তিতির উত্তর দিল না। ছুটন্ত গাড়ি থেকে পড়ন্ত বিকেল দেখছে, ফিরোজা রঙ আকাশ দেখছে। দুর্গাপুজোর জাঁকজমক আর নেই, তবু রেশ রয়ে গেছে তার। দায়সারা লক্ষ্মীপুজো চলছে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে, মলিন মুখে বসে আছেন অনাথ প্রতিমা। লক্ষ্মীঠাকুর নাকি বাদ্যি শুনলে পালান, তবু কোথাও কোথাও মাইকে হিন্দি গান বাজছে জোর।
রবীন্দ্রসদন পেরিয়ে গাড়ির স্পিড বাড়িয়েছে সুকান্ত, সাঁ সাঁ টপকে যাচ্ছে অন্যান্য যান। ক্ষণেকের জন্য তিতিরের মনে পড়ল এমনই এক উদ্দেশ্যহীন জয় রাইডে হিয়াকে নিয়ে বেরিয়েছিল টোটো। সঙ্গে সঙ্গে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছে সুকান্তর দিকে, কী হচ্ছে কি, আস্তে চালাতে পারো না!
রাস্তা তো ফাঁকা। এমন সুন্দর বিকেলে…
খবরদার। আমি তা হলে নেমে যাব।
–যো হুকুম মেমসাব। এই নাও চল্লিশে নেমে গেলাম।
গঙ্গার ধারে পৌঁছতে-না-পৌঁছতে সূর্য ডুবে গেছে। শেষ শরতের সান্ধ্য আঁধার তরল কুয়াশা মেখে ভাসছে নদীর গায়ে। টিপটিপ আলো জ্বলে উঠছে, এপারে, ওপারেও। নদীর পাড়ে সার সার গাছেরা অদ্ভুত শব্দময়, পাখিরা কুলায় ফিরছে। জোড়ায় জোড়ায় মানুষ-মানুষী নদী দেখছে, নিবিষ্ট মনে বলছে নিজেদের কথা। গরম কলসি কাঁধে ঘুরছে চাঅলা, ফুচকাঅলা ভেলপুরিঅলাদের সামনে থোকা থোকা ভিড়। মোটা গোঁফ হাতেলাঠি কনস্টেবল সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ঘোরাফেরা করছে এদিক ওদিক। জলরেণু মাখা বাতাস উঠছে নদী থেকে, তার সোঁদা আঁশটে গন্ধও এখন ভারি মনোরম। জল কেটে অবিরাম ভেসে যায় তরণী, পাড়ে তার ঢেউ বাজে ছলাৎছল।
গাড়ি রেখে হাঁটছে দুজনে। কথা না বলে। ধীর পায়ে।
একটা পরিত্যক্ত গম্বুজের সামনে এসে দাঁড়াল সুকান্ত, চুপচাপ কেন? ভাল লাগছে না?
–হুঁ। তিতির আবিষ্ট চোখে তাকাচ্ছে চতুর্দিকে। বলল, কতকাল পর সন্ধেবেলা গঙ্গার ধারে এলাম। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে প্রায়ই…ওই মোটা মোটা থামঅলা ঘাটটায় বসে থাকতাম দুজনে…কী ভাল যে লাগত!
যাবে ওখানটায়? বসবে?
–নাহ্। তিতির ছোট্ট শ্বাস ফেলল, চলো হাঁটি।
কয়েক পা হাঁটতেই সামনে ঝকঝকে স্ন্যাক বার, নদীতীরের নাগরিক বিলাসঘর। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের জটলা, ভেতরে অজস্র রঙের সমারোহ।
আঙুলে গাড়ির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে সুকান্ত বলল, – আইসক্রিম খাবে?
উঁহু।
–খাও না। তোমার তো একটা খাওয়া পাওনা আছে।
কিসের খাওয়া?
বাহ্, বি কম পাশ করলাম না! তুমি না গুঁতো দিলে আমার পরীক্ষায় বসা হত!
–পাশ করলে কোথায়! তুমি তো ব্যাক পেয়েছ।
–এক সাবজেক্টে ব্যাককে পাশই বলে।
তিতির হেসে ফেলল, তোমার মতো শেমলেস ছেলে আমি লাইফে দেখিনি।
–এত লড়লাম তাও কথা শোনাচ্ছ? অন্য পেপারগুলো যে টপকে গেলাম, তার বুঝি ক্রেডিট নেই?
কথা বলতে বলতে কাচের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে সুকান্ত। অগত্যা তিতিরও। ভিড় ঠেলে কাউন্টার থেকে দু হাতে দুখানা দামি আইসক্রিম নিল সুকান্ত, ডাকল তিতিরকে, ওপরে যাই চলো।
দোতলার টেবিলে দুজনে বসেছে পাশাপাশি। জিভে তালুতে বিদঘুটে শব্দ করে আইসক্রিম খাচ্ছে সুকান্ত। তিতিরের চোখ কাঁচে, অন্ধকারে, নদীতে। পাড়ে বাঁধা নৌকোর ছই-এ টিমটিম আলো, অস্পষ্ট নড়াচড়া করে মানুষ। কোজাগরী চাঁদ এইমাত্র ফুটেছে আকাশে, তার বিভায় নদী এখন রুপোর স্রোত। রুপো মাখা জলের মাথায় আছে সদ্য সমাপ্ত সেতু, দু পাড়ে প্রলম্বিত শরীর আলোআঁধারে ধনুকের মতো লাগে। অতিকায়। আদিম। অপ্রাকৃত।
সহসা মুগ্ধতা ভেঙে খানখান। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে পরিচিত স্বর। টোটো আর হিয়া!
তিতিরের সমস্ত স্নায়ু অসাড় হয়ে গেল। আজই টোটো হিয়াকে এখানে আসতে হল! এ কি কাকতালীয়! নাকি দৈবনির্দিষ্ট! নাকি নিয়তির খেলা!
ওপরের এই জায়গাটা বড় স্বল্পপরিসর, কোথায় এখন লুকোয় তিতির! হিয়া কি এসে ন্যাকা ন্যাকা করে কথা বলবে তিতিরের সঙ্গে! টোটো মুখ বেঁকাবে!
হিয়া টোটো এদিকেই তাকাচ্ছে। তিতির ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সজোরে আঁকড়ে ধরেছে সুকান্তর হাত। সুতীক্ষ চাপা স্বরে বলল, শিগগিরই আমার কাঁধে হাত রাখো, শিগগিরই।
সুকান্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে, দেখছে এদিক ওদিক। বুঝি বা হিয়া টোটোকেও দেখল, চিনতে পারল না।
তিতির কড়া গলায় বলল, আহ্, বলছি কোনও দিকে তাকাবে না। আমার চোখে চোখ রাখো। একদম সরাবে না বলে দিলাম। একদম না।
বিহ্বল সুকান্তর হাত তিতিরের কাঁধ ছুঁয়ে আছে। দুই পিপাসিত চোখ তিতিরের চোখের মণিতে স্থির, অথবা আরও গহীনে। অস্ফুটে কি যেন বলছে বাঁচাল সুকান্ত। কী বলে! ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসি!
কাকে বলে!
তিতির এখন নিশ্চেতন। অন্ধ। বধির।
.
৭৭.
দেখতে দেখতে টেনশায় দশ দিন কেটে গেল, শুভাশিসের কাছে এখনও পুরনো হল না জায়গাটা। শালিনী যেমনটি বলেছিল টেনশা তার থেকে ঢের বেশি সুন্দর। পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা অধিত্যকা শহর। যেদিকে চোখ যায় ছোট বড় অগুন্তি টিলা, আঁকাবাঁকা পথে রহস্যময় চড়াই উতরাই, এদিক সেদিকে জংলা ঝোপ, ছড়ানো ছেটানো শাল, সেগুন, আমলকী ইউক্যালিপটাস, প্রায় সব কোয়ার্টারের সামনে অপরূপ গোলাপ বাগান, সব ছাপিয়ে এক দুষ্প্রাপ্য নির্জনতা–এমন জায়গায় বড় একটা আসা হয় না শুভাশিসের। তারা ছোটে নামী জায়গায়, উটি সিমলা মানালি মুসৌরি কোডাইকানাল গোয়া, দেখে বেড়ায় নানান দর্শনীয় স্থান, তবু যেন ঠিক তৃপ্তি হয় না। প্রতিবার ফিরে কারুর না কারুর কাছে শুনতে হয় দেখার তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেছে একটা জলপ্রপাত কিংবা কোনও গুম্ফা, অথবা আপেল বাগান। আর অমনি ছন্দার ভুরু কঠিন, টোটো বন্ধুদের কাছে মুখ দেখাতে পারে না, শুভাশিসকেও ছোটখাট মন্তব্য হজম করতে হয়। টেনশায় এ সমস্যা নেই, কারণ এখানে তেমন কোনও দর্শনীয় জায়গাই নেই। যেখানে খুশি যাও, যেদিকে ইচ্ছে হাঁটো, যেভাবে প্রাণ চায় তাকাও, চারদিকে শুধু নয়নাভিরাম নিসর্গ।
চারপাশের পাহাড়গুলো অবশ্য নিছকই নিসর্গচিত্র নয়, তারাই এই ছোট্ট জনপদটার প্রাণভোমরা। প্রায় প্রতিটি পাহাড়ই এক একটি লোহার আকর। প্রতিদিন ওই পাহাড় কেটে চাঁই চাঁই হিমাটাইট এসে পৌঁছচ্ছে বারশুয়ার কারখানায়, টেনশা থেকে মাইল পাঁচ-ছয় দূরে। সেখান থেকে আকরিক লোহা চলে যায় দূর-দূরান্তের ইস্পাত কারখানায়। বোকারো, রাউরকেল্লা, ভিলাই, দুর্গাপুরে। ওই খনির সুবাদেই, খনিকে কেন্দ্র করে, গড়ে উঠেছে এই টেনশা শহর।
এখানে বাড়িঘর বলতে অফিসবাবুদের কোয়ার্টার, মজুরদের ব্যারাক, অফিসারদের বাংলো। কারখানার ভোঁ এই জনপদের বায়োক্লক, কারখানার চিমনি এই শহরের ফুসফুস।
এত কিছু থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ্য বিরাজ করে টেনশায়। দিনভর।
এখানকার সবচেয়ে মনোরম স্থানটিতে উঠেছে শুভাশিস, কোম্পানির গেস্ট হাউসে। সুন্দর বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি, খোলামেলা ঘরদোর আর অফুরান আলো বাতাস। পুবের জানলা দিয়ে ভোরের সূর্য ডেকে তোলে শুভাশিসকে, বাংলোর হাতায় নাচে অজস্র বাহারি ফুল, দূরে নীচের উন্মুক্ত সমভূমির ঘন সবুজ বনানী শান্তির প্রলেপ মাখায় চোখে, আঁধার নামার আগে উল্টো দিকের পাহাড় পড়ন্ত সূর্যের গাঢ় লাল রঙ ছড়িয়ে বুকে আলোড়ন তোলে। আদর যত্নেও কোনও ত্রুটি নেই শুভাশিসের, আরদালি কুক মালি সর্বসময়ে সেবার জন্য হাজির। সকাল বিকেল খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে শালিনীর দাদা মোহন রানাডে, বোনের বন্ধুদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সুখসুবিধের দিকে তারও খর নজর। ইট কাঠ ছুরি কাঁচির জগৎ ভুলে বেশ আছে শুভাশিস।
ছন্দার শরীর মনও অনেক তাজা এখন। বয়স যেন অনেক কমে গেছে তার, মন থেকে সব মালিন্য উধাও। ঘুরছে, ছুটছে, চঞ্চলা কিশোরীর মতো লাফালাফি করছে। প্রায়ই ভোরে লম্বা পিচ রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় বহু দূর, এক আশ্চর্য ঝরনার পাশে গিয়ে থামে, স্বচ্ছ জলে পা ভিজিয়ে খুশিতে চনমন করে ওঠে। শুঁড়িপথ বেয়ে নেমে যায় একা একা, ছিঁড়ে আনে বুনো ফুল, খোঁপায় গুঁজে গেস্ট হাউসের আয়নায় নিজেকে দেখে বারবার।
শুভাশিসকে ডেকে ডেকে বলে, অ্যাই, এই ফুলটার নাম কী গো?
ভুরুতে ছদ্ম ভাঁজ ফেলে শুভাশিস গভীর মনোযোগে দেখে ফুলটাকে। তারপর অলস মেজাজে হাই তুলে বলে, এটা হল গিয়ে কুর্চি ফুল।
ধ্যাৎ, মোটেই এটা কুর্চি নয়। আমি কুর্চি ফুল চিনি।
–তবে ওটা বনজুঁই।
কচু। জুঁই ফুলের এমন চেহারা হয় নাকি?
–তাহলে বোধহয় বুনো তেউড়ি। কিংবা দুধিয়া। শৈশবে বিভূতিভূষণের আরণ্যকে পড়া নামগুলো আন্দাজে আন্দাজে আউড়ে যেতে থাকে শুভাশিস। হেসে কুটিপাটি হয় ছন্দা। হঠাৎ হঠাৎ প্রবল ভালবাসায় মথিত হয়, নির্লজ্জর মতো শুভাশিসকে ডাকে বিছানায়। শুভাশিসের ইচ্ছে-অনিচ্ছের পরোয়া করে না, রমণে রমণে ক্লান্ত করে দেয় শুভাশিসকে। ছন্দার এখন চব্বিশ ঘণ্টাই মধুযামিনী।
টেনশায় এসে শুভাশিসের প্রথম যে অনুভূতিটা হয়েছিল তা হল অপরিসীম শ্রান্তি। গত কয়েকটা বছর শ্রম উদ্বেগ আর অশান্তি তার শরীরকে যেন নিংড়ে নিয়েছে। কাজ ছাড়া সে আর কিছুই করেনি কবছর। বেড়ানোও ছিল তার এক ধরনের কাজ, বউ ছেলেকে তাদের পাওনা সঙ্গ দেওয়া, যাতে তারা নিজেদের বঞ্চিত না ভাবে। কিন্তু প্রকৃত বিশ্রাম তার কখনও হয়নি। এখানে এসে প্রথম দু-তিন দিন সে খুব ঘুমোল, সকালে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে ঘুম, দুপুরে লাঞ্চের পর দিবানিদ্রা, রাতেও কোনওক্রমে খাওয়া সেরে শুয়ে পড়া। কদিনেই শরীর বেশ ঝরঝরে হয়ে গেল। মন চিন্তাশূন্য, হৃদয় উদ্বেগহীন, মেজাজ ফুরফুরে, এ এক তুরীয় দশা।
তবে চিন্তা ছাড়া শুভাশিস কদিনই বা থাকতে পারে! একটু একটু করে ভাবনারা ফিরতে শুরু করল। ছন্দাই ফেরাল। কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধেয় বাংলোর বারান্দায় বসে স্কচ খাচ্ছিল শুভাশিস। মোহন সেদিন আসেনি, কি এক জরুরি কাজে রাউরকেল্লা গেছে।
ছন্দাও পাশে গ্লাস নিয়ে বসেছে। বহুদিন পর। হঠাৎ বলে উঠল, অ্যাই, আমরা একটা কাজ করতে পারি না? যদি এরকম একটা পাহাড়ি জায়গায় বাড়ি বানাই কেমন হয়?
বানিয়ে?
মাঝে মাঝে গিয়ে থাকব। …ধরো, তুমি আমি তো একসময়ে বুড়ো হব, তখন আমরা সেখানে গিয়ে পাকাপাকি…
–তোমার ছেলে এমন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এসে থাকবে?
–থাকলে থাকবে, না থাকলে থাকবে না। এমনিই বা সে আর কদিন আমাদের কাছে আছে!
শুভাশিস কথাটার মর্মার্থ বুঝতে পারল না।
ছন্দা মুচকি হাসল, বাহ, ছেলে জয়েন্ট দিচ্ছে না! ও তো এবার হস্টেলেই চলে যাবে।
জয়েন্ট দিচ্ছে! আমাকে যে বলল…
-সে তো মেডিকেল পড়বে না বলেছে। ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। তারপর জি আর ই দিয়ে বাইরে চলে যাওয়ার প্ল্যান। আর একবার বিদেশে গেলে তোমার ছেলে আর ফিরবে বলে মনে হয় না।
শুনেই কেমন যেন অভিমান হল শুভাশিসের। ছন্দা ছেলের সম্পর্কে এত উদাসীন আজকাল, তবু তার কাছে ছেলের মনের গোপন কথাটি অজানা নেই। শুধু শুভাশিসই পড়ে আছে অন্ধকারে। ছেলে ফিরবে না… দূরে চলে যাবে… কেন? শুভাশিস তার বাবাকে ছেড়ে পৃথক জীবন গড়ে তুলেছে, তাই বোধহয় আজ আর এই নিয়ে প্রশ্ন করার তার অধিকার নেই। সুদূর হিউস্টন সিয়াটল কি আরিজোনায় নিজস্ব দ্বীপ গড়ে বাস করবে রাজর্ষি সেনগুপ্ত, তার বংশধর হয়তো থাকবে প্যারিস কি ইস্তাম্বুলে, এই বোধহয় পরিবারের নিয়তি এখন। পরিবারের, না পরিবার প্রথার? নাকি পরিবার প্রথার জীর্ণ দশার?
শীতল চাঁদের আলো ঢুকে পড়ছিল শুভাশিসের বুকের ভেতর। তবে কার জন্য শুভাশিসের এত পরিশ্রম? এত রোজগার করার বাসনা? কার জন্য সঞ্চয়? কে ভোগ করবে সম্পদ?
এই সময়েই শুভাশিসের মস্তিষ্কের কোষে ঢুকে পড়ে তিতির। মেয়ে তো তাকে বাবা বলে জানলই না। ওই মেয়ের জন্য শুভাশিস যদি কখনও কিছু রেখে যেতে চায়, সে কি নেবে? কেন নেবে? ইন্দ্রাণী তাকে নিতেই দেবে না। নিজের দম্ভে ইন্দ্রাণী নিজেকে মহীয়সী করে রাখবে চিরকাল।
ছন্দাও কি যেন ভাবছিল চুপচাপ। একটু চাপা গলায় বলল, চিন্তা করছ কী?
কিছু না।
–কিছু তো একটা ভাবছই। ..কলকাতা ছেড়ে নড়তে পারবে না, তাই তো? ছন্দার ঠোঁটের কোণে সুরার ঝিলিক।
–আহ্ ছন্দা, আমরা বেড়াতে এসেছি।
চটো কেন? আমি তো ঠাট্টা করছি গো। ছন্দা খিলখিল হেসে উঠল। সন্ধের পরে টেনশায় বিদ্যুতের ভোল্টজ অনেক কমে যায়। ক্ষীণ আলো আরও ক্ষীণ লাগছিল শুভাশিসের। জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, – আমি অন্য কথা ভাবছিলাম।
–কি শুনি?
–যদি উত্তর দিতে আপত্তি থাকে তো দিয়ো না।
বলোই না।
তুমি কেন ছেলের সম্পর্কে এত নিস্পৃহ হয়ে গেলে ছন্দা? টোটো আমাদের কাছ থেকে চলে যাবে, এ কথা বলতে তোমার ঠোঁট কাঁপল না?
না, কাঁপল না।
–কিন্তু কেন? হোয়াই?
কারণ আমি জীবনের সার বুঝে গেছি। ছেলে বড় হয়ে গেলে সে আমারও না, তোমারও না, সে তার নিজের। ছন্দা গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিল, আর একটা কথাও বুঝে গেছি। প্রতিটি মানুষই নিজের জন্য বাঁচে। তুমিও। আমিও। টোটোও। যদি রাগ না করো তো বলি, তোমার ইন্দ্রাণীও। কেউ অন্যের জন্য বেঁচে আছে, এ ভাবা ভীষণ মুর্খামি।
শুভাশিস থম হয়ে গিয়েছিল। তবে এই যে এখানে এসে ছন্দার এত উদ্দাম হয়ে ওঠা, তা কি শুধু নিজেরই বাঁচার রসদ খোঁজা? শুভাশিস অনুষঙ্গ মাত্র? প্রায় রাতেই যে এখান থেকে টেলিফোনে টোটোর খবর নেয় শুভাশিস আর ছন্দা, সেও কি নিজেদের তৃপ্তির জন্য? অবসাদ কাটিয়ে ওঠার পর এত নির্লিপ্তি এল ছন্দার মধ্যে? নাকি এই নির্লিপ্তিই অবসাদের প্রতিষেধক?
সে রাতে শুভাশিসের ঘুম এল না। একটার পর একটা চিন্তা আসে মাথায়, অথচ কোনওটাই স্থায়ী হয় না। যদি বা একটু তন্দ্রা নামে, কুৎসিত স্বপ্নে ছিঁড়ে খুঁড়ে যায় ঘোর। এক পাল শকুন ঠুকরোচ্ছে মরা গরুর কঙ্কাল। কাঠের সাঁকো পার হচ্ছে শুভাশিস, ভেঙে পড়ছে সাঁকো। রাশি রাশি চোখ খুবলোনা মাছেরা তাকিয়ে আছে শুভাশিসের দিকে। একসময়ে অতিষ্ঠ হয়ে বারান্দায় উঠে এল শুভাশিস। বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে এখানে, কম্বল মুড়ি দিয়ে বারান্দার চেয়ারে বসে ঢুলতে থাকল। তখনই মনে পড়ে গেল মেডিকেল হোস্টেলের এক বন্ধুর কথা। অনুতোষ। নকশাল করত অনুতোষ, গোপীবল্লভপুরে পুলিশের গুলিতে মরেছিল। দিব্যকান্তি ছেলে, মুখে সব সময়ে একটা প্রশান্ত ভাব লেগে থাকত অনুতোষের। চরম উদ্বেগের মুহূর্তেও মন সংযত রাখার উপায় কি, একদিন অনুতোষ বলেছিল শুভাশিসকে। যে কোনও বিষয়ের একটা বিশেষ বিন্দুতে সংহত করো মন। এমনভাবে করো যাতে বিশ্বসংসার সামনে থেকে লুপ্ত হয়ে যায়। শুধু ওই বিন্দুটাই প্রদীপশিখার মতো জ্বলতে থাকবে মনে। অথবা মনকে সম্পূর্ণ ফাঁকা করে দাও, একদম ফাঁকা, ধু ধু ফাঁকা। দুটো পদ্ধতিই রাতভর পালা করে চেষ্টা করল শুভাশিস। কোনও জটিল অস্ত্রোপচারে কেন্দ্রীভূত করতে চাইল মন, পারল না। আর মন তো শূন্য হয়ই না, এত পলি পড়ে আছে মনে!
তবু খেলাটা ভাল লেগে গেল। রোজই চেষ্টাটা চালায়। কখনও বাহারি ফুলের দিকে তাকিয়ে, কখনও সবুজ অরণ্যকে দেখে। কিংবা চোখ বুজে, অন্ধকারে। আকাশকে সামনে রেখে।
টেনশায় এও এক ভাল লাগা শুভাশিসের।
আজও শুভাশিস খেলছিল খেলাটা। শেষ বিকেলে। বাংলোর লনে গার্ডেন চেয়ার পেতে বসে। একা একা। কারিয়া মুণ্ডা নামের মালিটা অত্যাশ্চর্য গোলাপ ফুটিয়েছে বাগানে, তারই একটাকে লক্ষ্যবস্তু করে। টেনিস বল সাইজের রক্তগোলাপ, তার পাপড়িতে জড়ো হচ্ছিল স্নায়ু।
মোহন রানাডের জিপ ঢুকছে বাংলোয়, শুভাশিসের মনসংযোগের চেষ্টা ছিঁড়ে গেল। লাফিয়ে জিপ থেকে নামল মোহন। শুভাশিসেরই সমবয়সী প্রায়, খুব জোর এক আধ বছরের বড় হবে। মাজা রঙ, তীক্ষ্ণ নাক, লম্বা দোহারা চেহারা। মাথায় টুপি, পরনে হাফ সোয়েটার, হাফশার্ট, জিনসের ট্রাউজার। মুখে চোস্ত ইংরিজি বুলি, একসময়ে খঙ্গপুর আই আই টির ছাত্র ছিল।
গুড ইভনিং ডক্টর। একা বসে কেন? ম্যাডাম কোথায়?
শুভাশিস উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাল। একটু আগেও তো ছন্দা বাগানে ঘুরছিল, গেল কোথায়!
হাত নেড়ে কারিয়াকে ডাকল শুভাশিস, কাঁহা হ্যায় মেমসাব?
কারিয়া হিন্দি বাংলা সবই বোঝে, তবু শুভাশিস তার সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলে। তার ধারণা যে কোনও গরিব অবাঙালির সঙ্গে হিন্দিতেই কথা বলা যায়, হোক না সে ওড়িশার আদিবাসী।
মোহন স্থানীয় ভাষায় কারিয়াকে কী যেন প্রশ্ন করল, দূরে আঙুল দেখাল কারিয়া। মোহন এগিয়ে গেল সামনে, নীচের দিকে দেখছে। হাত নাড়ল। খানিকটা বিস্মিত মুখে এসে বসল চেয়ারে, টিনুর সঙ্গে ম্যাডামের আলাপ হল কী করে?
–কে টিনু?
–ওই যে ম্যাডাম যার সঙ্গে নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
শুভাশিস পায়ে পায়ে লনের একদম প্রান্তে এসে দাঁড়াল। অনেকটা নীচে দেখা যাচ্ছে ছন্দাকে। কোমরে আঁচল জড়িয়ে খাকি প্যান্ট শার্ট পরা দাড়িঅলা লোকটার সঙ্গে কথা বলছে ছন্দা। মাঝে মাঝেই লোকটা বাংলোর দিকে আসে, পাশ দিয়ে একটা বুনো পথ নেমে গেছে, ওই পথ দিয়েই লোকটার আনাগোনা। টিলার গায়ে ছোট একটা গ্রাম আছে আদিবাসীদের, বোধহয় সেখানেই থাকে।
শুভাশিস চেয়ারে এসে বসল, লোকটা হার্মফুল নয় তো? ছন্দার আবার গায়ে গয়নাগাটি আছে।
–আরে না না, টিনু একজন সেন্টলি ম্যান। মহুয়া পর্যন্ত খায় না, ভাবতে পারেন?
ট্রাইবাল? গায়ের রঙ দেখে তো মনে হয় না!
ট্রাইবাল নয়, তবে ট্রাইবালই হয়ে গেছে। বহুদিন আছে এখানে। বলে আগে নাকি ওয়েস্ট বেঙ্গলের দিকে থাকত।
বিজয় বেহেরা বাংলোর কুক। চিফ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে দেখেই তার টি-পট রেডি। সঙ্গে মুচমুচে পকোড়া।
কাপে কাপে চা ঢেলে দিল বিজয়।
মোহন চুমুক দিল, তাহলে ডক্টর চলুন, কাল আমাদের বারশুয়ার ফ্যাক্টরিটা আপনাদের দেখিয়ে আনি।
আমি কী বুঝি ফ্যাক্টরির! শুভাশিস আলগা আড়মোড়া ভাঙল।
–আপনি আগে কখনও মাইন দেখেছেন?
না। মাইনফাইনে আমার খুব ইন্টারেস্ট নেই। খনি গর্ত…
–ডেথ ফিয়ার? আরে, এটা ওপেনকাস্ট মাইন।
–হোক গে। কারখানায় ঢুকলে আমার মিসেসের চাকা চাকা র্যাশ বেরিয়ে যাবে।
হা হা হেসে উঠল মোহন। গমগমে স্বর। হাসির ছন্দে কোথায় যেন শালিনীর সঙ্গে মিল আছে। হাসতে হাসতেই বলল, আমার বোন জানিয়েছিল আপনি নাকি খুব স্ট্রং, টারবুলেন্ট। ম্যান অব অ্যাক্টিভ হ্যাবিটস। আমি কিন্তু স্কচ পান করা ছাড়া আপনার কোনও হ্যাবিট দেখলাম না। এত সুন্দর জায়গা, আপনি বাংলো থেকে পর্যন্ত বেরোন না! নাহ্, বোনটা আমায় মিসগাইড করেছে।
–আপনার বোনের কাজই মিসগাইড করা। দিব্যি বলে দিল টেনশা নাকি রাউরকেল্লা থেকে বিশ মাইল দূর, জিপ ভাড়া করতে গিয়ে শুনি প্রায় শ কিলোমিটারের ধাক্কা। ওফ, আসার সময়ে কোমর ব্যথা হয়ে গিয়েছিল।
স্বর্গে পৌঁছতে গেলে একটু তো কষ্ট করতেই হয় ডক্টর।
ছন্দা ফিরে এসেছে। অনেকটা চড়াই উঠে হাঁপাচ্ছে, লাল হয়ে গেছে মুখ। কোঁচড় ভর্তি এক রাশ তেজপাতা।
মোহন সহাস্য মুখে জিজ্ঞাসা করল, ম্যাডাম কি এগুলো ক্যালকাটায় নিয়ে যাবেন?
নিশ্চয়ই। এত কষ্ট করে কুড়োলাম।
বারান্দায় পাতাগুলো উপুড় করে দিয়ে এল ছন্দা, বসল চেয়ার টেনে। বিজয়ের কাছে চা চাইল।
শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, – কি কথা বলছিলে লোকটার সঙ্গে?
–ওমা, আমি আবার কী বলব! ওই তো আমাকে ডেকে ডেকে কথা বলে।
–তাই! কী বলে?
–এই আমরা কোত্থেকে এসেছি, তোমার নাম কি, আমরা থাকি কোথায়… বেশ ভাল বাংলা বলে লোকটা।
-স্ট্রেঞ্জ! রোজ এক প্রশ্ন করে?
–তা কেন। কলকাতার কথা জানতে চায়। ওদিকে বোধহয় গেছিল কোনও সময়ে, অনেক জায়গার নামও জানে।
মোহন বলে উঠল, টিনু ওরকমই। খ্যাপাটে ধরনের। ওর কথার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। তবে কাজ করে খুব মন দিয়ে। মেশিনপত্র সম্পর্কেও টিনুর নলেজ আছে, ছোটখাট রিপেয়ারিং-এর কাজও করে দিতে পারে।
–কি পোস্টে চাকরি করে? টেকনিকাল?
–আরে না না, স্রেফ লেবার। ওটাও ওর খ্যাপামি। কতবার ওকে ওভারশিয়ার করে দিতে চেয়েছি, ব্যাটা মজুরদের সদার পর্যন্ত হতে চায় না। অথচ নয় নয় করেও তেরো চোদ্দ বছর এখানে চাকরি হয়ে গেল। সংসার টংসার নেই তো…। তবে এখানকার লেবারদের কাছে ও কিন্তু খুব পপুলার, সব ইউনিয়ন ওকে সমঝে চলে।
কথায় কথায় সন্ধে নেমে গেছে। ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে নীচের জঙ্গল। হিম পড়ছে।
ছন্দা ভেতর থেকে একটা শাল জড়িয়ে এল, চলুন মিস্টার রানাডে, আর তো চার দিন আছি, ফেরার আগে একটা হোল ডে আউটিং করে আসি।
–চলুন না, আমি তো রোজ ডক্টর সাহেবকে বলছি। কোথায় যাবেন? রাউরকেল্লার দিকে একটা চমৎকার পয়েন্ট আছে। শঙ্খ আর কোয়েল নদী মিশে যেখানে ব্রাহ্মণী স্টার্ট করছে… ভেরি নাইস পিকনিক স্পট। কোয়েলে ডেঞ্জারাস চোরাবালি আছে, তাও দেখাব।
–ওরে বাবা, চোরাবালিতে আমি নেই। শুভাশিস ছদ্ম ত্রাসে হাত জোড় করল।
–তাহলে কেওনঝাড় ফরেস্ট চলুন। সামনের রাস্তাটা সোজা কেনঝাড় হয়ে ময়ূরভঞ্জের দিকে চলে গেছে। জিপ নিয়ে যাব, সারাদিন হইহল্লা করব, অ্যান্ড বাই ইভনিং উই উইল বি হোম। আপনি আপনার স্কচ নিয়ে বসে যেতে পারবেন।
মোহন তার বোনের মতোই মদ্য পান থেকে শত হস্ত দূরে, মাঝেমাঝেই তাই শুভাশিসকে হালকা কটাক্ষ করতে ছাড়ে না। তবে তার বলার ভঙ্গি এত সরল যে আহত হওয়ার সুযোগ নেই।
শুভাশিস ঠোঁটে সিগারেট চাপল। মোহনের দিকে বাড়িয়ে দিল প্যাকেট। মোহন কালেভদ্রে খায়, নিল না।
সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল শুভাশিস, জঙ্গল তো অনেক দেখেছি। আবার ওসব হাঙ্গামা কেন? এই তো বেশ আছি। খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমোচ্ছি..
অমন করো কেন গো? চলো না। ছন্দা ঠোঁট ফোলাল।
–ও কে। চলো তবে। …আপনার মিসেসকেও কিন্তু সঙ্গে নেবেন মিস্টার রানাডে। আর আপনার বাংলোতে সেদিন ডিনারে যে কাবাবটা খাইয়েছিলেন, ওটা অবশ্যই করে নিয়ে যেতে বলবেন। …কবে যাবেন? কাল?
সরি। কাল হবে না। কাল আমাদের পেমেন্ট ডে। পরশু ভোরে আমরা স্টার্ট করতে পারি। ..ছটার মধ্যে জিপ চলে আসবে, আপনি কিন্তু তখনও ঘুমোবেন না ডক্টর, প্লিজ। যাওয়ার পথে আমাদের হসপিটালটাও আপনাকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।
–এখানেও হসপিটাল! আমি মরে যাব মিস্টার রানাডে।
–আরে না, ভেতরে ঢুকতে হবে না। সামনের মাঠটা দেখবেন। মাঠটায় আগে টিন টিন গ্রিজ রাখা থাকত।
–পেশেন্টদের জন্য গ্রিজ!
-হা হা, ওটাই তো ক্যাচ। মোহন গোপন তথ্য ফাঁস করার ভঙ্গিতে গলা নামাল, পেশেন্টদের জন্য নয় ডক্টর, গ্রিজ লাগত লোকাল জঙ্গলের হাতিদের সামলাতে। আগে আগে দল বেঁধে সব হামলা করতে আসত, বাড়িঘর তছনছ করে দিত। ওই গ্রিজ খেতে পেলেই একদম সুবোধ বালক। ঠিক যেন আমার ছেলে আকাশ কাপ থেকে আইসক্রিম খাচ্ছে। এখন অবশ্য তোকজন বাড়াতে ওদের উপদ্রব অনেক কমে গেছে। ওই টিনুর সঙ্গে কথা বলে দেখবেন, ওই লোকটা হাতির অনেক মজার মজার গল্প বলবে।
–দারুণ ইন্টারেস্টিং তো! সত্যিই, কত জন্তুর যে কত বিচিত্র টেস্ট!
–মানুষেরই বা কম কি। মোহন হাসতে হাসতে উঠে পড়ল, আমরা কি না খাই? ঘাস পাতা পোকামাকড় থেকে তিমি মাছ, সব। ওই যে আপনি তরলটা খান, ওটাই কি খুব সুস্বাদু? হোস্টেলে একবার জিভ ঠেকিয়ে দু রাত্তির আমার ঘুম হয়নি।
মোহন চলে গেল। ধোঁয়া ছেড়ে। শব্দ তুলে।
পরদিন সকালে ব্রেকফার্স্ট সেরে লনে পায়চারি করছিল শুভাশিস। কারিয়া কোত্থেকে কটা পাতা তুলে এনে দেখাচ্ছে। পাতাগুলো ভারী অদ্ভুত, চিপলেই রক্তের মতো লাল রঙ বেরোয়।
খিলখিল হেসে দু হাতে লাল রঙ মাখছে ছন্দা। দেখতে ভাল লাগছিল না শুভাশিসের। পায়ে পায়ে বাংলা থেকে বেরিয়ে বুনো পথ ধরে নামছে। ফার্লংটাক গিয়ে এক ঝাঁকড়া গাছের নীচে দাঁড়াল। এটা নাকি মহুয়া গাছ, বিজয় বলছিল। একটা পাতা ছিঁড়ে শুকল শুভাশিস, তেমন কোনও মাদক গন্ধ পেল না। আলগোছে দাঁতে কাটল, কেমন যেন কষ কষ। এই পাতা সেদ্ধ করে কি মহুয়া তৈরি হয়? নাকি এর ফল থেকে? নাকি ফুল?
মাথা তুলে গাছটাকে দেখছিল শুভাশিস। হঠাৎ আঁকাবাঁকা পথে চোখ পড়ে গেল। সেই টিনু লোকটা আসছে। খাঁকি প্যান্টের ওপর খাকি শার্ট আলগাভাবে ফেলা, গলায় রঙিন মাফলার। লোকটার পায়ে কি কোনও ডিফেক্ট আছে! কেমন যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে!
হঠাৎ শুভাশিসের গা সিরসির করে উঠল। তার দিকেই দৃষ্টি রেখে এগিয়ে আসছে লোকটা। মন্থর পায়ে। দাড়ি গোঁফের জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে যে টুকুনি মুখ দেখা যায়, তা যেন কেমন চেনা চেনা, ! ওই চোখ আগে কোথাও দেখেছে শুভাশিস! কোথায়?
লোকটা শুভাশিসকে পার হয়ে গেল, তাকাচ্ছে না ফিরে শুভাশিসের কি যেন মনে হল। অনুচ্চ স্বরে ডাকল, শোনো।
ঘুরল লোকটা। দাঁড়িয়ে আছে। শুভাশিস আবার বলল, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি। শোন এদিকে।
আবার শুভাশিসের চোখে চোখ রেখে ফিরছে লোকটা। মন্থর পায়ে। সামনে একটা পাথরের টুকরো, আচমকা হোঁচট খেল জোর। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুটে আর্তনাদ করে উঠেছে, আহ্।
উল্কা বেগে শব্দটা আঘাত করল শুভাশিসের মস্তিষ্কে। পলকে আঠেরো বছর আগের একটা মুখ মনে পড়ে গেছে।
শুভাশিস আঙুল তুলল, তুমি তনুময় না!
.
৭৮.
লোকটা দাঁড়িয়ে পড়ল। একদম স্থির। তনুময়ের প্রায় বিস্মৃত মুখখানা আর একটু যেন স্পষ্ট মনে পড়ল শুভাশিসের। সে মুখে ঘন কালো দাড়ি ছিল, এ লোকটার শ্মশ্রূ-গুম্ফে বাদামি আভাস, একটা দুটো রুপোলি রেখাও যেন দেখা যায়। শরীর তনুময়ের তুলনায় অনেক বেশি মজবুত, পেটানো। মুখে তনুময়সদৃশ কমনীয়তার লেশমাত্র নেই। গায়ের রঙ তামাটে, তনুময় যেন অনেক বেশি ফর্সা ছিল। আহত তনুময়ের চোখ ঘোলাটে থাকত সব সময়ে, সামনের লোকটার চোখের মণি অসম্ভব উজ্জ্বল। এত উজ্জ্বল যে বেশিক্ষণ চোখে চোখ রাখতে অস্বস্তি হয়।
শুভাশিস সামান্য ইতস্তত করে বলল, তুমি ইন্দ্রাণীর ভাই না?
–আমি টিনু। বারশুয়া কারখানার শ্রমিক। ঠোঁট চেপে বলল লোকটা।
আর কোনও সংশয় নেই। এ তনুময়। তনুময়ই। কথা বলার ওই ঠোঁট-টেপা ভঙ্গি অতি পরিচিত এক মুখ মনে পড়িয়ে দেয়। নাম চেহারা পরিবেশ সবই আমূল বদলে ফেলতে পারে মানুষ, কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভঙ্গি তবু রয়েই যায়।
নরম গলায় শুভাশিস বলল, আমাকে চিনতে পারছ না তনুময়? আমি শুভাশিস সেনগুপ্ত। ডাক্তার। সেই যে তোমার কাঁধে আর থাইতে তিনটে গুলি লেগেছিল… আমি তোমার অপারেশান করলাম…বাড়িতে…তুমি আমার বাড়িতে ছিলে…
–আমি তনুময় নই। আমি টিনু। ভারী স্বর ঈষৎ কর্কশ।
শুভাশিস দু পা এগোল, ডাক্তারের চোখ ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয় তনুময়। তুমি ধরা পড়ে গেছ।…তোমার পায়ের চোট কি এখনও পুরো সারেনি?
–আমি পুরনো কথা ভুলে গেছি ডাক্তারবাবু।
তনুময়ের বাংলায় বেশ ওড়িয়া টান এসে গেছে। রুক্ষ পোড়খাওয়া মুখে একটু যেন হাসি ফুটল, তির্যক। ঘুরে নিজের পথে এগোতে শুরু করেছে।
শুভাশিস পিছন থেকে বলে উঠল, ভুলে গেছি বললে তো চলবে না তনুময়। তুমি জানো, তোমার বাবা মা দিদির আজ কী অবস্থা! শুধু তোমার জন্য। শুধু তোমাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে…ইওর ফাদার ইজ অলমোস্ট আ লুনাটিক ম্যান নাউ।
চলন্ত তনুময়ের গতি মুহূর্তের জন্য মন্থর যেন। আবার হাঁটতে শুরু করেছে। জোরে জোরে। বাঁ পা বেশ টেনে টেনে।
তনুময়, যেয়ো না। শোনো।
সময় নেই ডাক্তারবাবু। এক্ষুনি কারখানার ভোঁ বাজবে।
পায়ে চলা পথ ধরে ওপরে উঠে গেল তনুময়। গেস্টহাউস পেরিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।
অদ্ভুত এক ছটফটানি নিয়ে ফিরল শুভাশিস। বারান্দায় বেতের চেয়ার পাতা আছে, বসল কিংকর্তব্যবিমূঢ়। চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরাল। তনুময়কে কি তার জোর করে আটকানো উচিত ছিল? কেন পারল না? ইন্দ্রাণীর মধ্যে যে চোরা অপরাধবোধ রয়েছে, সেই মনস্তাপই কি শুভাশিসকে স্থাণু করে দিল? মনে মনে যতই ইন্দ্রাণীকে উপহাস করুক, হৃদয়ের গভীরতম প্রদেশে শুভাশিসও কি একই অপরাধবোধের অংশীদার নয়?
একটা ক্রোধও ক্ষীণ ভাবে গজরাচ্ছিল শুভাশিসের ভেতরে। এই ছেলেটার জন্যই তার জীবনের গতিপথ সোজা হতে গিয়েও বেঁকেচুরে গেছে। সে যে আজ এক আদ্যন্ত অসুখী মানুষ, তার পরোক্ষ কারণও কি ওই তনুময় নয়? তনুময় আজ তার ওপর ফেটে পড়তে পারত, বোঝাপড়া চাইতে পারত, তা না করে শুধু উপেক্ষা দেখিয়ে চলে গেল কেন?
কেনই বা তনুময়ের এই স্বেচ্ছানির্বাসন! বাবা-মার কথাতেও তনুময়ের তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া হল না! কেন?
না, তনুময়কে ছেড়ে দিলে চলবে না। খোঁজ নিতেই হবে। কিন্তু কী ভাবে? বারশুয়া কারখানায় চলে যাবে দুপুরে? মোহনকে খবর দিলেই এক্ষুনি গাড়ি এসে যায়। তা হলে তো ছন্দাও নিশ্চয়ই সঙ্গে যাবে। সেখানে কি তনুময়কে ডেকে…?
ছন্দা গভীর অভিনিবেশে কারিয়ার সঙ্গে লনে কথা বলছে। বাংলা হিন্দি ওড়িয়া মেশানো এক নিজস্ব মিশ্র ভাষায়। মাঝে মাঝে হাত পা নেড়েও ভাব বিনিময় চলছে। বোধহয় ফুলগাছ নিয়ে আলোচনা। কাল রাতে ছন্দা বলছিল এখান থেকে গোলাপের কলম নিয়ে যাবে।
কি ভেবে উঠে পড়ল শুভাশিস, গেস্ট হাউসের কিচেনে গেল। মশলা বাটছে বিজয়, রান্না চড়াবে। শুভাশিস কদাচ এদিকে আসে না, তাকে দেখেই সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়েছে বিজয়, স্যার আপনি! চা দিব?
–না। তোমার সঙ্গে একটা কথা ছিল।
বলুন স্যার।
–তুমি টিনু বলে লোকটাকে চেনো?
-খুব চিনি স্যার। এখানে আসে তো মাঝে মাঝে। ডিউটি থেকে ফেরার পথে এসে গল্প করে, গান শোনায়। এই কদিনই যা…
–টিনু থাকে কোথায়?
কাছেই স্যার। এই তো নীচে। মজুরদের লাইনে।
মোহনের কথাটা মনে রেখেই শুভাশিস জিজ্ঞাসা করল, টিনু লোক কেমন?
–খুব ভাল স্যার। বলতে বলতে হঠাৎই যেন সন্ত্রস্ত হল বিজয়, – কেন স্যার, টিনুভাই কি কোনও অপরাধ করিল?
-না না, এমনিই জানতে চাইছি। শুভাশিস আলগা হাসল, লোকটা শুনছিলাম বাঙালি?
বঙালিই তো। তবে এখন স্যার বারশুয়ার লোকই হয়ে গেছে। টিনুভাইকে নিয়ে অনেক গল্প আছে স্যার।
কীরকম? শুভাশিস রান্নাঘরের দরজায় ভর দিয়ে দাঁড়াল।
–অনেক বছর আগে নাকি টিনুভাই ঝাড়সুগুদা স্টেশনে এসে মরে পড়ে ছিল। কেউ বলে টিনুভাই নাকি ট্রেনে যাচ্ছিল, পথে দস্যুরা তার টাকাপয়সা সব কেড়ে নিয়ে, মারধর করে স্টেশনে ফেলে দিয়েছিল। কেউ বলে টিনুভাই নাকি খুব ধনীঘরের ছেলে ছিল, সম্পত্তির লোভে আত্মীয়রা তাকে খুন করে ট্রেনের কামরায় তুলে দেয়। কেউ বলে ট্রেনে নাকি ডাকাত উঠেছিল, পুলিশ ভুল করে টিনুভাইকেই গুলি করে। আমাদের কারখানার বংশী বাইগার দাদা ভীম আর তার মা তখন ঝাড়সুগুদায় থাকত। ওরা ছত্তিশগড়ের লোক, অনেক ঝাড়ফুঁক জানে, শিকড়বাকড় জানে, মরা মানুষকেও বাঁচিয়ে তুলতে পারে। ভীমদাদার মাই লতাপাতার ওষুধ খাইয়ে টিনুভাইকে নবজীবন দিল।
এ যে একদম সিনেমার গল্প হে! শুভাশিসের একটু মজা লাগল, মরা মানুষ বেঁচে উঠল?
–মরা মানুষও তো বাঁচে স্যার। সাবিত্রী মরা সত্যবানের প্রাণ ফেরায়নি?
সরল লোকটার চোখে অন্ধ বিশ্বাস, আর তর্ক বাড়াল না শুভাশিস। মনে মনে অবস্থাটা আন্দাজ করে নিল। অসুস্থ তনুময় ট্রেনে করে চলে যাচ্ছিল, পথে হাল খুব বেশি খারাপ হয়, যাত্রীরা আপদ ভেবে নামিয়ে দেয় কামরা থেকে। তারপর ওই জংলি লতাপাতার গুণেই…।
শুভাশিস আর একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, – তা নয় ধরে নিলাম তোমাদের ভীম বাইগার মা মরা মানুষই বাঁচিয়েছিল। কিন্তু তোমরা কখনও টিনুভাইকে জিজ্ঞেস করোনি, সে কোত্থেকে এল, তার তিন কুলে কেউ আছে কিনা…
কত করেছি। জবাব দেয় না, হাসে। বলে পুনর্জন্ম পেয়েছি, আগের জন্মের কথা মনে থাকবে কি করে! তবে টিনুভায়ের হৃদয়টা বিশাল স্যার। সকলের জন্য খুব দরদ। ঘরে ঘরে গিয়ে সবার খোঁজ করে। আশপাশের গ্রামে খোঁজ নিন, শুনবেন বিপদে-আপদে টিনুভাই ঠিক তাদের পাশে আছে। কার অসুখ করল, কার ঘরের চালা ভাঙল, কোথায় ভয়ে ভয়ে মারামারি লাগল, কে কোথায় দরখাস্ত লিখবে, কাকে চিঠি লিখে দিতে হবে, সবার সব কাজে টিনুভাই হাজির। এখানকার কত জন যে টিনুভায়ের কাছে সাহায্য পায় স্যার। বুদ্ধি পায়। উপকার পায়।
বাহ্! বিপ্লবী ট্রান্সফর্মড টু সমাজসেবী! এ কি আত্মকণ্ডুয়ন, নাকি নিছকই পলায়নী মনোবৃত্তি? মোহন যা বলছিল তাতে তো মনে হয় তনুময় ইউনিয়ন-ফিউনিয়ন করে না, তবে কি শ্রেণীসংগ্রাম ছেড়ে এখন মহামানব বনার চেষ্টা করছে তনুময়? তার জন্য মজুর সেজে টেনশায় পড়ে থাকা কেন, কলকাতাই তো এদের আদত ঠাঁই। প্রকৃতি পরিবেশ, নারী নিপীড়ন, বৃদ্ধ বৃদ্ধা অথবা অনাথ শিশু, কোনও একটা লাইন ধরে নিতে পারত, গড়ে তুলত একটা সংগঠন, ঝটপট ঠিকরে পড়ত নাম।
নাকি ইন্দ্রাণীর অনুমানই সত্যি? স্রেফ ঘৃণায় অভিমানে শহর থেকে গা ঢাকা দিয়েছে তনুময়?
বিজয় বিনীত ভাবে বলল, টিনুভাইকে এখানে আসতে বলব স্যার? কথা বলবেন?
–থাক গে। যদি পথে দেখা হয় তো আমি নিজেই তোমাদের টিনুভায়ের সঙ্গে…শুভাশিস রান্নাঘর থেকে সরে এল।
দুপুরে খেয়ে উঠে বিছানায় গড়াচ্ছিল শুভাশিস। বাইরে রোদ এখন বেশ চড়া, তবে চোরা একটা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। অলস আমেজে চোখ জড়িয়ে আসে। ঘুমোলে রক্ষে নেই, সারা বিকেল গা ম্যাজম্যাজ করবে, অথচ চোখ খুলে রাখাও ভারী কঠিন এখন। ঘুম তাড়াতে শুভাশিস উঠে বারান্দায় এল। মনের ভেতর একটা সুক্ষ্ম আলোড়ন চলছে তার। চলছেই। তনুময়ের সন্ধান যখন একবার পাওয়া গেছে, তখন যে করে হোক তাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতেই হবে। জীবনে একটি বারের জন্য ইন্দ্রাণীকে যদি অকৃত্রিম আনন্দ দিতে পারে, সে কি শুভাশিসের কম সৌভাগ্য। ইন্দ্রাণী সত্যিই খুশি হবে তো? যে বেদনার সঙ্গে হৃদয়ের একটা নিঃশব্দ বোঝাপড়া হয়ে যায়, নির্মিত হয় এক নতুন ভারসাম্য, তাকে বিঘ্নিত করাও কি এক ধরনের ঝুঁকি নেওয়া নয়? খবরটা শুনে ইন্দ্রাণীর বাবা-মার স্ট্রোক-ফোক না হয়ে যায়!
ছন্দা ঘরে শুয়েছিল, উঠে এসেছে। পাশে দাঁড়িয়ে বলল, -কী ভাবছ?
কই, কিছু না তো।
না বললেই হল! সকাল থেকে দেখছি তোমার মুখ-চোখ কেমন হয়ে গেছে! অত সুন্দর মুরগিটা রেঁধেছিল, খুঁটে খুঁটে খেলে…!
-এমনি। বোর লাগছে।
–টোটোর কথা ভাবছ?
শুভাশিস হেসে ফেলল। ছন্দাকে ট্রেনে সে যে প্রশ্ন করেছিল, ছন্দা সেটাই ফিরিয়ে দিচ্ছে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে একটু সচেতনও হল। অনর্থক ছন্দাকে বেশি কৌতূহলী হতে দেওয়াও ঠিক নয়। তনুময়ের প্রসঙ্গ ছন্দার অজানাই থাকুক, না হলে নতুন নির্মিত শুভাশিস ছন্দার ভারসাম্যটা টলমল হওয়ার আশঙ্কা আছে।
হেসে বলল, কালকের ট্যুরটার কথা ভাবছিলাম। পরশু ফেরা, কাল অতটা জার্নি হবে, তোমার আবার শরীর-ফরির না খারাপ হয়।
–কিচ্ছু হবে না। আমি এখন দুশো পারসেন্ট ফিট। ছন্দা খুশিতে কলকল করে উঠল, এই শোনো, আমাদের কিন্তু খুব অন্যায় হচ্ছে জানো। মিস্টার রানাডে আমাদের জন্য এত করছেন, আমরা কিছুই রিটার্ন দিতে পারলাম না।
-বাহ, আমি তো ওদের কলকাতায় ইনভাইট করেইছি। তখন যত খুশি হসপিটালিটি দেখিও।
–সে তো তখনকার কথা। শালিনীর কাছে আমাদের কিন্তু খুব নিন্দে হবে।
–তো কি করতে হবে শুনি?
কাল মিসেস রানাডে একা খাবার করে নিয়ে যাবেন কেন, আমরাও কিছু নিয়ে যেতে পারি। বেশি কিছু নয়, এই ধরো কলা, ডিমসেদ্ধ, শশা টোম্যাটো দিয়ে ভেজিটেবল স্যান্ডউইচ..এখানে টোম্যাটো সস পাওয়া যাবে না?
ছন্দাকে একটু ঈর্ষা হল শুভাশিসের। কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মগ্ন থাকতে পারে ছন্দা। মুচকি হেসে শুভাশিস বলল, – তার মানে বিকেলে আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে, তাই তো?
–প্লিইইজ।
মাথা নাড়ল শুভাশিস। যাবে। বিকেলে এই মুক্তিটুকু তার বড় জরুরি ছিল।
.
লেবার লাইন খুঁজে পেতে খুব অসুবিধে হল না। ছোট্ট টিলার পায়ের কাছে বারশুয়া কারখানার মজুরদের বসতি। বসতি বলতে লম্বা টানা অ্যাসবেসটসের চালঅলা সার সার ব্যারাক। মুখোমুখি ঘর, পিঠোপিঠি ঘর, মাঝে সরু সরু উঠোন। অনন্ত দীর্ঘ বারান্দায় শাল বল্লার খুঁটি, ছোট ছোট দরমার পার্টিশান। নোংরা উঠোনে একপাল বাচ্চা কিচমিচ করছে, দুর্গন্ধময় নালার ধারে নিভাবনায় ঘুরছে মুরগির ছানা, এদিক সেদিকে শুয়োর কুকুর বেড়াল। খানিক আগে সকালের শিফট শেষ হয়েছে, দলে দলে পুরুষ ফিরছে পাড়ায়। তাদের হাঁকডাক আর মেয়ে শিশু জন্তুদের কলরবে মুখর হয়ে আছে গোটা এলাকাটা। ঘরে ঘরে বিকেলের আঁচ পড়েছে উনুনে, চিমনি থেকে বেরোনো গলগল ধোঁয়ায় দিনশেষের গোলাপি আকাশও বড় মলিন দেখায় এখন।
এই হতশ্রী পরিবেশে বাস করে তনুময়! ইন্দ্রাণীর ভাই!
সামনের এক ছোকরাকে ধরল শুভাশিস, এখানে টিনুর ঘরটা কোথায়?
অনেকেই ঘুরে ঘুরে দেখছে শুভাশিসকে। ধোপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এমন সম্ভ্রান্ত চেহারার মানুষ বোধহয় এদিকে আসে না বড় একটা।
ছেলেটিও জরিপ করছে শুভাশিসকে।
শুভাশিস আবার বলল, টিনু। তোমাদের আয়রন মাইনসে কাজ করে।
ওড়িয়া ভাষায় ছেলেটি উত্তর দিল, ওই দিকে। চার নম্বর লাইনের একদম শেষে।
পায়ে পায়ে ব্যারাকের প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়াল শুভাশিস। তনুময়ের ঘরের দরজা খোলা, কম পাওয়ারের একটা বালব জ্বলছে ঘরে।
বাইরে থেকে শুভাশিস গলা ওঠাল, তনুময়…তনুময়…
ঘর থেকে কেউ বেরোল না। ভেতর থেকে উত্তর ভেসে এল, – আসুন ডাক্তারবাবু। আমি আপনার অপেক্ষাতেই আছি।
ব্ল্যাক জাপান মারা সস্তা কাঠের দরজাটা বেশ নিচু। শুভাশিস তেমন লম্বা নয়, তবু তাকেও মাথা নামিয়ে ঢুকতে হল। পলকের জন্য শুভাশিসের মনে এল কোথায় যেন পড়েছিল মালিকরা নাকি ইচ্ছে করেই মজুরদের জন্য ছোট ছোট দরজা বানায়। যাতে সকাল বিকেল মাথা হেঁট করে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে মাথা নত করাটাই তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়। বেশির ভাগ এমনটাই ঘটে, তবে এর বিপরীতও যে হয় না তা নয়। এই বেঁটে দরজাই অনেক উন্নতশির মজুরের মনে প্রথম বিদ্রোহের বীজ বপন করে।
অনুজ্জ্বল আলোয় তনুময়ের ঘরটাকে দেখছিল শুভাশিস। নিতান্ত নিরাভরণ ঘর, একটা দড়ির চারপাই, কেরোসিন স্টোভ, আর অল্প কয়েকটা বাসনপত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। ঘরের মধ্যিখান দিয়ে টাঙানো দড়িতে ঝুলছে তনুময়ের খাকি প্যান্ট শার্ট, গেঞ্জি, গামছা। চারপাইতে এলোমেলো পড়ে বালিশ কম্বল চাদর, তনুময়ের একখানা জোব্বা সোয়েটারও।
সোয়েটারটা দড়িতে ঝুলিয়ে দিল তনুময়। খানিক ছড়িয়ে দিল কম্বলখানা। বলল, বসুন ডাক্তারবাবু।
ডিম কলা শশার ব্যাগ দরজার পাশে নামিয়ে রাখল শুভাশিস, তুমি জানতে আমি আসব?
তনুময় উত্তর দিল না। মৃদু হেসে বলল, চা খাবেন?
–কে করবে? তুমি?
–খেয়ে দেখুন না। চা আমি মন্দ করি না।
করো। শুভাশিস ভেতর পানে উঁকিঝুঁকি মারছে। ছোট্ট রান্নাঘর, পাশেই স্নান পায়খানার জায়গা, সব মিলিয়ে খুবই ছোট ইউনিট। রান্নাঘরে কিছু ছেঁড়া কাগজের ডাঁই, বাথরুমে ছোট একটা বালতি আর মগ, ব্যস। লঘু স্বরে শুভাশিস বলল, এই তবে তোমার প্রেজেন্ট শেল্টার?
–শেল্টার কেন, এই আমার বাসস্থান। তনুময়ের ঠোঁটে আলগা হাসি, – দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসবেন না?
সন্তর্পণে খাটিয়ায় বসল শুভাশিস। সিগারেট ধরিয়ে বলল, চলবে?
না। নেশা নেই।
–শুনেছি আগে নাকি খুব সিগারেট খেতে?
তনুময় যেন কথাটা শুনতে পেল না। নিচু হয়ে বসে পাম্প দিচ্ছে স্টোভে। নীলচে আগুনে জলের বাটি বসাল। ছোট্ট ঠোঙা থেকে গুঁড়ো দুধ বার করে দিচ্ছে কাপে। চোখ না তুলেই বলল, – আপনার কি এখনও দিদির সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
প্রশ্নটা আসবে জানাই ছিল, তবে ঠিক শুরুতেই সেটা আশা করেনি শুভাশিস। একটু চুপ থেকে বলল, -তুমি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব দিচ্ছ না তনুময়।
–আপনি তো তেমন কোনও প্রশ্ন করেননি ডাক্তারবাবু।
–আমার উপস্থিতিটাই তো প্রশ্ন। তোমার এখানে থাকাটাই তো প্রশ্ন। কেন তুমি চলে এলে? কেন ফিরলে না? কেন বছরের পর বছর লুকিয়ে আছ? তোমার কি কিছুই বলার নেই?
তনুময় ভাবলেশহীন মুখে ফুটন্ত বাটিতে চা-পাতা ফেলল। অভ্যস্ত হাতে সাঁড়াশি দিয়ে ধরে দোলাচ্ছে অল্প অল্প। স্টোভের পাম্প খুলে দিল। কাপে চা ঢেলে নাড়ছে চামচ দিয়ে। শুভাশিসের দিকে কাপ বাড়িয়ে দিল, দেখুন তো, চিনি ঠিক হয়েছে কিনা।
–ঠিক আছে। চুমুক না দিয়েই বলল শুভাশিস। সামান্য বেঁঝে উঠল, তুমি কিন্তু আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ তনুময়।
তনুময় এতক্ষণে সোজাসুজি তাকিয়েছে, আপনার কি ধারণা আমি এমন কিছু করেছি যার জন্য আপনাকে এড়িয়ে যাব?
তনুময়ের স্বর শান্ত, কিন্তু তীক্ষ্ণ। যেন শুভাশিসের কাছেই কৈফিয়ত চাইছে তনুময়। শুভাশিস রাগ রাগ গলায় বলল, তোমার বাবা-মাকে যে দগ্ধে দগ্ধে মেরেছ, তার জন্যও তোমার অনুশোচনা নেই?
কলকাতা ছাড়ার অনেক আগে থেকেই তো বাবা-মার চোখে আমি মৃত ছিলাম ডাক্তারবাবু। যেদিন থেকে পার্টির কাজে নেমেছিলাম, সেদিন থেকেই তো…
বাবা-মার চোখে মৃত থাকা, আর সত্যি সত্যি মরে যাওয়া, দুটো এক নয় তনুময়। তুমি যে বেঁচে আছ, এ খবরটুকু তাদের দিতে কি অসুবিধে ছিল?
–তা হলে তো আমায় ফিরতে হত।
–না হয় নাই ফিরতে। ঠিকানা না হয় নাই জানাতে।
–সেও তো এক ধরনের ফেরাই ডাক্তারবাবু। পিছুটান মানেই দোটানা।
নাটুকে কথা ছাড়ো। সত্যি বলো তো, বাবা মা দিদি কারুর জন্য তোমার কখনও মন কেমন করেনি?
ছোট ছোট চুমুক দিয়ে চা শেষ করল তনুময়। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছে পা ছড়িয়ে। বাঁ হাঁটু সামান্য উঁচু হয়ে আছে। শূন্য কাপ দু হাতে ধরা, একেবারে গ্রামীণ ভঙ্গি।
হাতের কাপ অল্প ঘোরাতে ঘোরাতে তনুময় বলল, – সত্যিটা শুনতে আপনার ভাল লাগবে না ডাক্তারবাবু। সত্যিই আমার কারুর জন্য মন কেমন করে না। প্রথম প্রথম হয়তো করত, কিন্তু এখন আর…। বিশ্বাস করুন, সেই জীবনটা এখন আমার সম্পূর্ণ অর্থহীন মনে হয়। আমি, আমার পরিপার্শ্ব, আমার বাবা মা বন্ধুবান্ধব…
–আশ্চর্য!
–অবাক হওয়ার কিছু নেই ডাক্তারবাবু। একবার সেই সময়টার কথা ভাবুন তো। তনুময় ডান পাটা গুটিয়ে বসল। চোখ কুঁচকে বলল, – একাত্তরের শেষের দিক থেকে আমাদের পার্টি ছত্রখান হতে শুরু করেছে। আমরা তখন অণু-পরমাণুর মতো ভেঙে যাচ্ছি। রোজ নতুন নতুন মত আসছে, রোজ শ্রেণীশত্রুর সংজ্ঞা বদলাচ্ছে, আজ ট্রাফিক পুলিশ আমাদের শ্রেণীশত্রু, কাল কাবুলিঅলা, পরশু হয়তো পাথরের স্ট্যাচু। সজল দীপেনরা তিন দিন আগে আমাদের সঙ্গে ছিল, কাল তারা ভিন্ন গোষ্ঠীর। আজ রবিন সুরজিত্রা প্রখর বিপ্লবী, পরের দিন তারাই প্রতিবিপ্লবী। আমরা কে কার সঙ্গে আছি, একসঙ্গে আছি কি নেই, তাও বোধহয় ভাল করে জানি না। আমরা তখন শুধুই এক-একটা কোড। প্রত্যেকে চিৎকার করছি, দেশের জনগণের চারটেই শত্রু। সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সংশোধনবাদ, ফিউডালিজম, আর আমলাতান্ত্রিক মুৎসুদ্দির পুঁজিবাদ। অথচ অতি প্রাথমিক কথাও তখন আমরা ভুলে গেছি। জলের মধ্যে যেভাবে মাছ মিশে থাকে, সেইভাবে জনগণের মধ্যে মিশে থাকে বিপ্লবী, ঘাসের মধ্যে পিঁপড়ের মতো সমাজে লুকিয়ে থাকে জনযোদ্ধা–এই সহজ কথাগুলো আমাদের আর মনেই নেই। দেড়শোটা জোতদার মেরে থাকলে পঁচাত্তরটা ট্রাফিক কনস্টেবল মেরেছি। একটা ছাপোষা কনস্টেবল, যার সাকুল্যে মাইনে তখন একশো বারো টাকা, সে যদি শুধুমাত্র রাষ্ট্রশক্তির অংশ বলেই শ্রেণীশত্রু বনে যায়, তবে তো কারখানার মজুররাও শ্রেণীশত্রু। কারণ তারাই তো পুঁজিবাদী সিস্টেমটাকে টিকিয়ে রেখেছে, মুনাফা করতে সাহায্য করছে, তাই না ডাক্তারবাবু?
–হুম। পার্টির ডিসিশানে তখন কিছু মারাত্মক ভুল ছিল। তবে তোমার মজুরদের উপমাটা বোধহয় ঠিক হল না তনুময়। মুনাফা আর মজদুরদের সংঘর্ষই বিপ্লব। মজুররা মুনাফার অংশ নয়।
–যারা মরেছিল তারাও সবাই রাষ্ট্রশক্তির অংশ ছিল না ডাক্তারবাবু। যাক গে, যে কথা বলছিলাম…। গ্রামে পুলিশি অ্যাকশনের ধাক্কায় আমাদের বিপ্লব তখন শহরে ঘাঁটি গেড়েছে। গাড়বে না? শহরে অ্যাকশন করা কত সহজ। নলিতে চপার টেনে দিয়ে গলিতে লুকিয়ে পড়, কে তোমায় খুঁজে পাবে! আর আর্মস তো তখন শহরে থই থই করছে। মনে আছে একটা ছিটকিনি পাইপগান আমি কিনেছিলাম সতেরো টাকায়। এক-একটা দানা, মানে গুলি পাওয়া যেত তিন টাকা চার টাকায়। ছিনিয়ে নিতে হয় না, কষ্ট করে জোগাড় করতে হয় না, বোমা পাইপগান থ্রি নট থ্রি যা চাও পয়সা ফেলে কেননা, আর বিপ্লব করো।
তনুময় সহসা চুপ হয়ে গেল। ভাবছে কি যেন। হলদেটে নিষ্প্রভ আলো তার ছায়া ফেলেছে মেঝেতে, ছায়াও যেন আলোর মতোই মলিন।
ছায়াটার দিকে কয়েক সেকেন্ড স্থির তাকিয়ে রইল তনুময়। তারপর আবার কথা শুরু করেছে, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে আমাকে কী অবস্থায় আপনার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?
শুভাশিসও সেই পুরনো সময়টাকে দেখছিল। অন্যমনস্কভাবে বলে উঠল, তুমি প্রফিউসলি ব্লিড করছিলে।
কারা আমাকে মেরেছিল জানেন?
–তাও জানি। দা লুম্পেনস। যারা পার্টিতে ইনফিলট্রেট করেছিল।
–আজ আঠেরো বছর দূরে বসে তাদের লুম্পেনস বলা খুব সহজ ডাক্তারবাবু। কিন্তু সেদিন আমরা লুম্পেনস আর কমরেডদের তফাত পর্যন্ত বুঝতে পারিনি। কেন পারিনি? কেন অনুমান করতে পারিনি আমাদের মধ্যেই রাষ্ট্রশক্তির চর ঢুকে পড়েছে? কারণ আ মক রেভলিউশন টার্ড আস ব্লাইন্ড। দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের জন্য আমাদের তো প্রস্তুতিই ছিল না, আমাদের মধ্যে কে বিপ্লবী, কে খুনি, কে ছাঁচোড় বোঝার সুযোগ কোথায়! দোষটা আমাদের, ওই লুম্পেনদের নয়। একটা আইডিয়ার জন্য লড়াই করতে গিয়ে চারদিকে এত অবিশ্বাস, এত সন্দেহ, এত পাগলা কুকুরের মতো দশা…। না ডাক্তারবাবু, রাষ্ট্রশক্তি যে ক্যানসারের জীবাণুর থেকেও মারাত্মক হয়ে আমাদের ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিতে পারে, সে বোধটুকু আমাদের ছিলই না। অতএব শেষ হয়ে যাওয়াই ছিল আমাদের নিয়তি। যে কোনও ফর্মে শেষ হয়ে যাওয়া। এই অনুভূতিটা আমাদের কাছে, মানে আমরা যারা আদর্শটাকে জানপ্রাণ দিয়ে মানতাম তাদের কাছে কী যন্ত্রণাদায়ক তা আপনি বুঝতে পারবেন না ডাক্তারবাবু। তনুময়ের চোখ দুটো যেন জ্বলে উঠল। আহত বাঘের মতো গজাচ্ছে, রোজ খতমের লিস্ট বানানো হচ্ছে! কে বানাচ্ছে, তাও জানি না। কেন বানানো হচ্ছে, তাও জানি না। শুধু খতম দেখে শিহরিত হচ্ছি, বদলা নেওয়ার জন্য রক্ত টগবগ করে ফুটছে! এ সময়ে দলে তো লুম্পেন ঢুকবেই। তারা তখন আমাদের থেকেও চড়া বিপ্লবী! যখন আমরা চুরচুর, তখন তাদের আসল দাঁত বেরিয়ে গেল। রাতের পর রাত যে দেবদাসের সঙ্গে আমি এক বিছানায় কাটিয়েছি, সেই দেবদাসই পুলিশের খোঁচড় হয়ে…। টের পেয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই ওই দেবদাস…। এর পর কি আর বাঁচার ইচ্ছে থাকে? মনে হয় না নিজের সমাজকে, বাবা-মাকে খুব নিষ্ঠুরভাবে ঠকিয়েছি? আর ফিরতে ইচ্ছে করে সেখানে?
এতক্ষণে শুভাশিস ভেতরে ভেতরে মজা পাচ্ছিল একটু। তনুময়ের মধ্যে নিজেরই যেন এক না-গড়ে ওঠা প্রতিরূপ দেখছিল। ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বলল, তুমি যেসব যুক্তি দিচ্ছ, তার অনেকটা কাছাকাছি যুক্তি দিয়ে আমিও পার্টি ছেড়েছি। তফাত একটাই। তোমার বছর তিনেক আগে। কোন দিকে ব্যাপারটা যাচ্ছে আমি অনেক আগেই আন্দাজ করেছিলাম। তোমার দিদি তার জন্য এখনও আমাকে রেনিগেড বলে।
তা হলে আমার অনুমানটা ঠিক? তনুময় ঘাড় হেলিয়ে শুভাশিসকে দেখল, আপনি এখনও দিদির সঙ্গে…
–আমি তোমার দিদিকে খুব ভালবাসি তনুময়।
কথাটা উচ্চারণ করে অসম্ভব তৃপ্তি হল শুভাশিসের। ইন্দ্রাণী ছাড়া এই বিশ্বসংসারে কথাটা আর কাউকে বলেনি, আজই বলল প্রথম। এই মলিন ঘরে। বড় নিষ্প্রভ আলোর নীচে বসে। পলকে বুকটা যেন তুলোর মতো হালকা হয়ে গেল। তনুময়, তনুময়কে ঘিরে শতেক প্রশ্ন, যুক্তি, প্রতিযুক্তি, সবই মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল শুভাশিস।
নিচু গলায় শুভাশিস আবার বলল, – তোমার দিদিকে আমি ভালবাসি তনুময়। তার বিয়ের আগে থেকেই। পার্টির কাজে নিজেকে ডেডিকেট করতে চেয়েছিলাম, ইন দা মিন টাইম তোমার দিদির বিয়েটা হয়ে গেল। তারপর তো…বিপ্লবও হল না…তোমার দিদিও…। তোমার দিদিকে কিন্তু তুমি ভুল বুঝেছিলে তনুময়। শি ইজ পিওর, ইনোসেন্ট। যা ঘটেছিল তা ভালবাসার টানেই…
–আপনি কি আমাকে কোনও পুরনো ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাইছেন ডাক্তারবাবু?
শুভাশিস চুপ। তনুময়ের প্রতিক্রিয়া দেখছে।
আবার পা ছড়িয়ে দিল তনুময়। উদাস মুখে বলল, হ্যাঁ, আপনাদের দেখে আমি খুব আহত হয়েছিলাম বটে। আপনার বাড়ি থেকে সেই রাত্রে বেরিয়ে পড়ার কারণও একটা ওটাই। পরে ভেবে দেখেছি কাজটা ছেলেমানুষি হয়েছিল। ভীষণ ছেলেমানুষি। মুখে যতই যা বলি, আসলে তখনও আমার ভেতরে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধগুলো তো ষোলো আনা রয়েই গেছে। আবার এমনও হতে পারে, আমার মধ্যে পালানোর ইচ্ছেটা ছিলই, মধ্যবিত্ত মনটা একটা বোকা বোকা বাহানা খুঁজে নিল। ওই মধ্যবিত্ত মানসিকতা না থাকলে আপনার সঙ্গে দিদির সম্পর্কটা বৈধ, না অবৈধ, তা ভেবে আমি মাথা খারাপ করব কেন?
শুভাশিস মিনমিন করে বলল, হয়তো তোমার নীতিবোধে লেগেছিল।
–সেই নীতিবোধটাই তো ভণ্ডামি। মধ্যবিত্ত চেতনা থেকে উঠে আসা বুড়বুড়ি। ওই মধ্যবিত্ত আবেগই আমাকে বিপ্লবের পথে ঠেলেছিল। ওই মধ্যবিত্ত আবেগই আমাদের লড়াইয়ের সর্বনাশ করেছে। তনুময় সোজা হয়ে বসল, আপনি বাবা-মার জন্য আমার মন কেমন করার কথা বলছিলেন না? জানেন কি, ওই সব কিছু বদলানোর ইচ্ছেটা আমার জেগেছিল বাবাকে দেখেই? বাবা আমাকে ইন্সপায়ার করেনি, বাবাকে দেখে আমার ঘেন্না হত। একটা মানুষ সব সময়ে ভয়ে কাঁপছে। অফিসে কর্তাদের ভয়ে থরথর, বাজারে দোকানদাররা চোখ রাঙালে কুঁকড়ে যায়, ডাক্তারে ভয়, উকিলে ভয়, পুলিশে আতঙ্ক..আবার তারই মধ্যে ইচ্ছে ঘাপটি মেরে আছে, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হলে দুনিয়াকে দেখিয়ে দেবে ধীরাজবাবু কম বড় কেউকেটা নয়। এই যে কেন্নোসুলভ মানসিকতা, এটাই আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। মনে হত যে-সমাজ এই ধরনের মানুষ তৈরি করে, সেই সমাজটা ছারখার হয়ে যাওয়াই ভাল।
–এও তো তোমার মধ্যবিত্তসুলভ ভাবনা। খ্যাপামি।
বটেই তো। এই ভাবনা থেকে নৈরাজ্যবাদ আসতে পারে, সন্ত্রাসবাদ আসতে পারে, কিন্তু বিপ্লব? ঘৃণা থেকে কি কিছু আমূল বদলানো যায় ডাক্তারবাবু? পুঁথির বিদ্যে থেকে মনের জড় কতটা কাটে?
আচমকা শিবসুন্দরের কথা মনে পড়ল শুভাশিসের। এরকমই সব কথা বলত না বাবা? শুধু রাগ আর ঘৃণা দিয়ে বিপ্লব হয় নারে শুভ, আমূল পরিবর্তনের জন্য দরকার ভালবাসা। ভালবাসা ছাড়া নতুন সমাজ গড়বি কী করে? যাদের জন্য তোরা সমাজ পাল্টাতে চাস, তাদেরকে সত্যি সত্যি তোরা কতটা ভালবাসতে পেরেছিস? শহর থেকে বিদ্যে বোঝাই মাথা নিয়ে তোরা তাদের গুরুঠাকুর সাজতে পারিস, কিন্তু তোরা তো তারা নোস! তোরা ঠিক করে ফেললি ভূমিহীন চাষার ঘরে গিয়ে থাকবি, তাদের সঙ্গে গেঁড়ি-গুগলি শাকপাতা খাবি, তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাটবি, ওরা উপোস তো তোরাও উপোস–এ কি তোদের পক্ষে সম্ভব! পার্টি আবেদন জানাল শ্রমিক চাষিদের সঙ্গে একাত্ম হও, একাত্ম হও, ওমনি তোরা একাত্ম হয়ে গেলি? বাইরে থেকে একটা মানুষকে অনুভব করা এক জিনিস, আর নিজে সেই মানুষটা হয়ে যাওয়া আর এক জিনিস। দ্বিতীয়টা খুব খুব কঠিন কাজ রে শুভ। ফতোয়া জারি করে সেটা হয় না। এর জন্য অনেক প্রস্তুতির প্রয়োজন।
প্রস্তুতি যে ছিল না, যা ছিল সবটাই মনের কাছে চোখ ঠারা, এ কথা শুভাশিসের থেকে বেশি আর কে জানে!
বিড়বিড় করে শুভাশিস বলল, – এতই যখন বুঝেছ, তখন বাড়ি ফিরলে না কেন?
–ফিরে?
নরমাল লাইফ লিড করতে। চাকরি-বাকরি করতে, অনেকেই যেন করছে। বুড়ো বাবা-মার দেখাশুনো করতে।
–ও জীবন তো অনেক আগেই আমি বাতিল করে দিয়েছি ডাক্তারবাবু।
–এই জীবনই কি তুমি চেয়েছিলে?
তনুময় হাসল, এখানে আমি খারাপ আছি ভাবছেন কেন?
বালির মধ্যে মুখ গুঁজে থাকা জীবনই তবে তোমার পছন্দ? হোয়াই ডোন্ট ইউ ফেস দা ওয়ার্ল্ড তনুময়?
–যেমন আপনারা করছেন?
শুভাশিস সপাং করে একটা চাবুক খেল যেন। তবে জ্বালাটা গায়ে বসতে দিল না। মুখে হাসি বজায় রেখে বলল, আমি কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে লুকিয়ে রাখি না তনুময়। আমি যা, আমি তাই। উইথ অল মাই ভাইসেস অ্যান্ড ভারচুজ।
আমিও তো নিজেকে লুকোই না ডাক্তারবাবু। আমি তো পার্টিতে যোগ দেওয়ার আগেই ঠিক করে ফেলেছিলাম জীবনে কী চাই। এবং কেন চাই। হতে পারে আমাদের বিপ্লবটা মিথ্যে হয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের স্বপ্নটা তো মিথ্যে ছিল না। শয়ে শয়ে যে ছেলেগুলোকে মেরে ফেলা হল, দিনের পর দিন যারা জেলে পচল, যারা কানা খোঁড়া নুলো হয়ে বেরোল, তাদের ভেতরও তো সেই স্বপ্নটারই উদ্দীপনা কাজ করেছিল। পথে ভুল থাকতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য? সমাজটা পচে গলে গেছে এ কথা আগেও মানতাম, এখন আরও বেশি করে মানি। আর মানি বলেই এই জীবনই আমি বেছে নিয়েছি। বিপ্লবের স্মৃতি রোমন্থন আর শুকনো তত্ত্বের জগতে বিচরণ এতে আর আমার স্পৃহা নেই। আমি আমার পথে চলছি, আমার মতো করে ভাবছি। তনুময় উঠে দাঁড়িয়ে একটা আলোয়ান জড়াল গায়ে, একটা কথা সার বুঝে গেছি ডাক্তারবাবু। মধ্যবিত্ত মানসিকতা দিয়ে সমাজ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখা যায়। হল্লা খুনোখুনিতে মাতা যায়, গরম গরম বক্তৃতা দিয়ে মানুষের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু যাদের জন্য বিপ্লব চাই তাদের জন্য কিছুই করা যায় না।
শুভাশিসেরও বেশ শীত শীত করছিল। বিকেলে বেরোনোর সময়ে শাল চাদর কিছুই সঙ্গে নেওয়া হয়নি। চারপাই ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, – তার মানে তুমি এখান থেকেই বিপ্লব করছ, তাই তো?
–আমার অত শক্তি কোথায় ডাক্তারবাবু? আমি শুধু নিজেকে তৈরি করতে চাইছি। আপনি তো জানেন না আমি কীভাবে এখানে এসে পৌঁছেছি…
–কিছু কিছু জানি। তুমি তো এখানকার লোকাল মিথ। মরে গেছিলে, ভীম বাইগার মা তোমায় নতুন প্রাণ দিয়েছে…
-ঠাট্টা করছেন?
–না। যা শুনেছি তাই বলছি।
আমারও তাই বিশ্বাস। নতুন জীবনটা পেয়ে আমার শুধু একটাই চিন্তা ছিল। খুব ভাবতাম, কোথায় ভুল ছিল আমাদের। ওই মধ্যবিত্ত আবেগগুলোর কথা মনে আসত, যেগুলোর কথা এতক্ষণ বলছিলাম আর কি। তখনই ঠিক করি নিজের শ্রেণী আগে বদলাতে হবে। সেই চেষ্টাই করছি, করে যাচ্ছি। মজুরদের সঙ্গে খাঁটি, তাদের সঙ্গেই ওঠা-বসা, তাদের সুখে আছি, দুঃখে আছি…। আমাদের বারশুয়া কারখানায় অনেক আদিবাসী আছে, মুণ্ডা, ওঁরাও, হো, সাঁওতাল। আছে নানা প্রদেশের লোক, ওড়িয়া বিহারি মধ্যপ্রদেশি তেলেঙ্গি। এই খনিতেই আমি ছোটখাট এক ভারতবর্ষকে দেখতে পাই ডাক্তারবাবু।
শুভাশিস চোখ ছোট করে শুনছিল কথাগুলো। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া আইডিয়ার মতো লাগছে। তনুময় পাগল-টাগল হয়ে যায়নি তো! তত্ত্ব শ্রেণীসংগ্রাম যুদ্ধ ছেড়ে নিজেকেই মজদুর বানানো আবার কেমন ধরনের চিন্তা! তথাগতর কাজের ধারাটা তবু বোঝা যায়। নিরক্ষর মানুষদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে, গরিব চাষিদের সংগঠিত করছে, জোতদারদের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাস শোনাচ্ছে গাঁয়ে গাঁয়ে কিছু একটা নিয়ে আছে তথাগত। কিন্তু তনুময়?
দুৎ, কথার কচকচি আর ভাল লাগছে না। শুভাশিস সরাসরি প্রশ্ন করল, এত বছর তো এখানে রইলে, নিজেকে পুরোপুরি ডিক্লাসড করতে পেরেছ তো?
তনুময় যেন একটু থমকাল। তাকিয়ে আছে শুভাশিসের দিকে। বড় একটা শ্বাস ফেলল। খানিকটা সময় নিয়ে বলল, – ভেবেছিলাম পেরেছি। এখন বুঝতে পারছি পারিনি। যদি পারতাম, তা হলে কি আপনাকে দেখে দুর্বল হয়ে পড়তাম? নাকি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে যেচে আলাপ করে আপনার খোঁজখবর নিতাম? নিজের ওপর বড় রাগ হচ্ছে এখন।
একমুখ জংলাদাড়ি ছেলেটা আনমনা হয়ে গেছে। ভাসা ভাসা দু চোখে ছলছল করছে চাপা বিষাদ। কেমন কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনুময়! কুঁজো হয়ে, না ভারী হয়ে!
লাইমলাইটের বুড়ো ক্লাউনটার কথা মনে পড়ল শুভাশিসের। বিষণ্ণ ক্লাউন বলেছিল, আই হেট ব্লাড, বাট ইটস ইন মাই ভেইনস।
তনুময় কি পরাজিত? নাকি লড়ছে?
আপাত শান্তির মোড়কে আলোড়িত হচ্ছে ছেলেটা?
শুভাশিসের বুকটা টনটন করে উঠল। কাছে গিয়ে হাত রাখল তনুময়ের কাঁধে। নরম গলায় বলল, তোমার বাবা কিন্তু আর বেশি দিন বাঁচবেন না তনুময়।
–উ? হুঁ।
যাবে না তাঁদের কাছে?
সরে গেল তনুময়। দরজার পাশ থেকে শুভাশিসের প্লাস্টিক ব্যাগটা তুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। মৃদু স্বরে ডাকল, রাত হয়ে যাচ্ছে ডাক্তারবাবু।
শুভাশিস এবার আর সাবধান হতে পারল না। দরজা পেয়োনোর সময়ে জোর ঠোক্কর খেল একটা।
–ইশ, লাগল তো! তনুময় ঝটিতি ঘুরে তাকিয়েছে।
–ঠিক আছে।
আপনার হাত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম কিছু তো আনেননি, একটা চাদর দিয়ে দিই?
লাগবে না। থ্যাংক ইউ। শুভাশিসের স্বর বিরস।
–পথে কিন্তু ঠাণ্ডা লাগবে খুব।
–তোমার ঘরের চেয়ে বেশি নয়। শুভাশিস ব্যাগটা তনুময়ের হাত থেকে নিয়ে নিল।
তবে চলুন, আপনাকে একটু এগিয়ে দিই।
–প্রয়োজন নেই।
জঙ্গলের পথ ধরবেন না। বাঁধানো রাস্তা ধরে সোজা চলে যান, ওটাই আপনার জন্য ভাল। টর্চ থাকলে তাও নয়…
তনুময়ের কথাগুলো কি খুব বেশি ইঙ্গিতবহ? তার সম্পর্কে কীই বা জানে তনুময়? নাকি সোজা মনেই কথা বলছে তনুময়, তার কানে এসেই বেঁকে যাচ্ছে কথাগুলো?
শুভাশিস গম্ভীর মুখে বলল, আমি কীভাবে ফিরব, সেটা আমাকেই ভাবতে দাও। নেমে এসেছি যখন, উঠতেও পারব।
–আপনি আমার ওপর অযথা রাগ করছেন। যা হয় না তার জন্য জোর করছেন কেন? সত্যিই আমি আমার মধ্যবিত্ত পরিচয়টা মুছে ফেলতে চাই, মনেপ্রাণে চাই। আর এখানে আমি খুব ভাল আছি। জীবনযাপন আর আদর্শর মাঝে ফারাক না থাকলে তবেই না মানুষ মানুষ হয়। ভাবনাটা কি ভুল ডাক্তারবাবু?
কথাগুলো যেন পুট পুট ফুটছে। শুভাশিস অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, – কলকাতায় ফিরে তোমার দিদিকে আমি কী বলব?
যা দেখলেন, যা শুনলেন, তাই বলবেন। আরও ভাল হয় যদি কিছু না বলেন। দিদি যদি এসে টানাটানি করে আমাকে হয়তো বারশুয়া ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। ভীম বাইগার মা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, আমাকে ছেলের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন, তাঁর মায়াতেও আমি বাঁধা পড়িনি ডাক্তারবাবু।
ইন্দ্রাণীর ভাই বলেই কি তনুময় এত নির্দয়! স্বার্থশূন্য মানুষেরও কি এক ক্রূর স্বার্থপর চেহারা থাকে! আপনজনদের আঘাত করেই তাদের বেশি সুখ!
হা ঈশ্বর, ইন্দ্রাণীর ভাইকে কেন শুভাশিসই খুঁজে পেল!
.
রাতদুপুরে বদ্ধ মাতাল হয়ে গেল শুভাশিস। কনকনে বারান্দায় টলমল হাঁটছে, খালি পায়ে। মেঝের শৈত্য চিনচিনে নেশা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শরীরে।
আচমকা শুভাশিস হুঙ্কার ছাড়ল, ছন্দা, ছন্দাআআ… আমার বোতল শেষ। আর একটা লাগাও।
ঘাড়ে গলায় নাইট ক্রিম মাখছিল ছন্দা। ছুটে এল। কটমট চোখে তাকাচ্ছে, আর খেতে হবে, সাড়ে এগারোটা বাজে, এবার শুয়ে পড়ো। কাল আবার সকাল সকাল ওঠা আছে।
–নো। আই ওয়ান্ট মোর।
–তোমার ব্যাপারখানা কী বলো তো? সন্ধেবেলা কোথায় না-কোথায় চরকি মেরে এলে, এসেই এই বোতল মহাকাব্য শুরু হয়ে গেল! মিস্টার রানাডে তোমার জন্য কতক্ষণ এসে বসেছিলেন। বললাম একটা ফোন করো, একটু ভদ্রতা দেখাতে কী অসুবিধে হয় তোমার?
–আ, লেকচার মেরো না। আই হেট লেকচারস। আই অ্যাম সিক অফ লেকচারস। ডিসগাস্টেড অফ লেকচারস…
কী প্রলাপ বকছ? কে তোমায় লেকচার শুনিয়েছে?
–সব্বাই শোনায়। এভরিবডি। বাপ শোনায়…যে চান্স পায় সেই শোনায়…ওই যে দ্যাট লেডি যার সঙ্গে তোমার নিটিপিটি হিংসে হিংসে খেলা চলে, সে শোনায়…
ছন্দার ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। ঘন ভাঁজ। স্থির তাকাল, ঠিক করে বলো তো কোথায় গিয়েছিলে?
বলব? শুভাশিস ছন্দার মুখের ওপর ঝুঁকল, তোমার টিনুর কাছে। টিনু। টিইইইনু। শালা ডিক্লাসড হতে চায়! মধ্যবিত্ত আইডেনটিটি ওয়াইপ আউট করে দেবে! হিহি।…মধ্যবিত্ত আইডেনটিটি যদি সত্যি মুছতে চাস, তবে আয়, শুভাশিস সেনগুপ্তর কাছে ট্রেনিং নে। অ্যান্ড ইউ উইল গেট দা হ্যাপিনেস।..আজব খেলা অ্যাঁ? তনুময় থেকে টিনু! বেড়ে খেলা!
–কে তনুময়?
–শুনবে? বলব?…উউউহঁ, তোমাকে তো বলা যাবে না। তুমি তা হলে আবার ডিপ্রেশানে চলে যাবে। শুভাশিস চেতনার প্রান্তসীমায় ঘোরাফেরা করছে। আঙুল তুলে স্খলিত স্বরে বলল, তোমাকে আমি আর দুঃখ দেব না। কক্ষনও না। তুমি পৃথিবীর সব থেকে হ্যাপি উওম্যান হবে। আমি হব হ্যাপি টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। উইথ অল মাই ভাইসেস…উইথ অল মাই ভারচুজ। …ভাইসেস…ভারচুউজ…
বিড়বিড় করতে করতে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল শুভাশিস। দু হাতে আঁকড়ে ধরেছে ছন্দাকে, শিশুর মতো।
সুখ আর পাপপুণ্য তালগোল পাকিয়ে গেল।
.
৭৯.
জাহাজের ব্রিজে বসে রুটিন নেভিগেশনের কাজ করছিল বাপ্পা। তাদের মামেড় জাহাজটি অত্যাধুনিক, এর গতিপথ কম্পিউটার নির্ধারিত, তবু নিয়মিতভাবে সারা দিন সারা রাত জাহাজের যাত্রাপথের অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে নোট করতে হয় বাপ্পাদের। আটলান্টিক মহাসাগরে বাতাসের কোনও ঠিকঠিকানা নেই, হঠাৎ হঠাৎ ঝড় চলে আসে, তখন এই ব্রিজ থেকেই জাহাজের অভিমুখ স্থির রাখতে হয়। ব্রিজ অর্থাৎ জাহাজ চালানোর ঘরটি জাহাজের মাথায়, সামনের দিকে। কাচঘেরা ঘরখানা থেকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। দৃশ্য অবশ্য খুবই সীমিত, একঘেয়ে। উল্টোনো বাটির মতো আকাশ, আর টাল খাওয়া থালার মতো সমুদ্র। তবে এই মুহূর্তে বাপ্পার কিছু দেখার নেই, বাইরে এখন কুচকুচে আঁধার।
বাপ্পাদের জাহাজে লোকলস্কর খুব বেশি নেই। মাত্র সাঁইত্রিশ জন মানুষ এই বিশাল চল্লিশ হাজার নের অর্ণবপোতটিকে গোটা পৃথিবীর বন্দরে বন্দরে ছুটিয়ে নিয়ে বেড়ায়। বাপ্পা হিসেব করে দেখেছে তাদের জাহাজটা দুটো ফুটবল গ্রাউন্ডের চেয়েও বেশি লম্বা। চওড়াও কম নয়, তিরিশ মিটার। অমনি ঘুরেফিরে বেড়ালে এর বিশালত্ব নজরে পড়ে না, কিন্তু জাহাজের খোল যখন থাক থাক গাড়ি সাজানো থাকে তখন বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। এই নিয়ে তৃতীয় রাউন্ড সমুদ্র পাড়ি দিচ্ছে বাপ্পা, এখনও তার বিস্ময়বোধ পুরোপুরি কাটল না। এখন অবশ্য জাহাজের খোল অনেকটাই খালি। লস এঞ্জেলেস সানফ্রান্সিসকো হাউস্টন বোস্টনে প্রায় ছাব্বিশ শো জাপানি গাড়ি নেমে গেছে, মাৰ্মেড এখন চলেছে ডোভারের পথে। চল্লিশ নটিকাল মাইল বেগে। পথে যদি আকস্মিক ঝড়ঝা না আসে তবে ডোভার পৌঁছতে আরও দু দিন।
রামালু এসে গেছে। বাপ্পার রিলিভার। মছলিপত্তনমের ছেলে, বয়সে বাপ্পার চেয়ে বছর তিন-চারের বড়। তারই মতো ডেক ক্যাডেট, তবে এক বছরের সিনিয়ার। হাসিখুশি ছেলে, সিনেমার পোকা। অবসর পেলেই এন্টারটেনমেন্ট হলে গিয়ে ভিসিআর চালিয়ে বসে থাকে।
রামালু ডাকল, হাই নীল!
-হাই। ঘড়ি দেখল বাপ্পা। দশটা দশ। হেসে বলল, সো আর্লি?
–আর্লি কোথায়! আই অ্যাম ইন টাইম।
দশ মিনিট লেট, তাও বলে ইন টাইম! তবু ভাল, অন্য দিনের মতো আধ ঘণ্টা দেরি করেনি! বাপ্পা উঠে দাঁড়াল। টুপি চাপাচ্ছে মাথায়।
রামালু বলল, কি বলছে ওয়েদার?
–ফাইন। একুশ ডিগ্রি নর্থে একটা মাইনর স্টর্ম আছে, এদিকে আসবে বলে মনে হয় না।
–শুড নট। ডোভারে ইন টাইম রিচ করলে সুধাকে একটা রিঙ করব।
হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বাপ্পা। প্রতিটি বন্দর থেকে ফিয়াসেকে ফোন করা রামালুর ডিউটি। সুধা নাকি পৃথিবীর সব থেকে সুন্দরী মেয়ে। বাপ্পাকে ছবি দেখিয়েছে, গাবলু-গুবলু ছাড়া কিছু মনে হয়নি বাপ্পার। তিতিরকে দেখলে রামালু বোধহয় ফেন্ট হয়ে যেত।
সিঁড়ি দিয়ে নামছিল বাপ্পা। তাদের জাহাজটা চোদ্দতলা, অষ্টম তলায় বাপ্পার ঘর। নিজের ঘরে ফিরে বাপ্পা কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর উঠে পোশাক-টোশাকগুলো বদলাল। পরে নিয়েছে ঢোলাঢালা নাইট ড্রেস। আবার সেই ছটায় ডিউটি। ওসাকা থেকে কেনা রিস্টওয়াচটায় অ্যালার্ম দিল। পাঁচটায়। কঁকর কঁক শব্দ করে ঘড়ি, ঠিক মোরগের মতো।
এত তাড়াতাড়ি বাপ্পার ঘুম আসে না। সাড়ে সাতটায় ডিনার সেরেছে, একটু একটু ক্ষিধেও পাচ্ছে। টিন থেকে খানিকটা জেলি বার করে সরাসরি মুখে চালান করল বাপ্পা। পোশাকের ওপর একটা উইন্ডচিটার চাপিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এই সময়টা তার ডেকে দাঁড়ানোর সময়। জাহাজের ভেতরে এয়ার কন্ডিশনিং প্ল্যান্ট আছে, ঠাণ্ডা-গরম কিছুই তেমন বোধ হয় না। কিন্তু ডেকের হাওয়া এখন বেশ শীতল, মিনিট খানেক দাঁড়ালেই কাঁপুনি এসে যায়। হবে নাই বা কেন! অক্টোবর শেষ হয়ে গেল, অক্ষাংশের হিসেবে সে এখন আছে চুয়াল্লিশ ডিগ্রি নর্থে, একটু কনকনে ভাব তো আসবেই।
হাঁটতে হাঁটতে ডেকের একদম কোনায় চলে এল বাপ্পা। ইয়া মোটা ক্যাপস্টানটা পার হয়ে ডেকের রেলিঙ ধরে দাঁড়াল। ধু ধুকালো। মিশমিশে কালো।
বাপ্পা চোখ বুজে প্রিয় খেলাটায় নেমে পড়ল। একা থাকার সময়ে এই খেলাটা আজকাল তাকে আবিষ্ট করে রাখে। ঠিক এই মুহূর্তে কী ঘটছে কলকাতায়? কী হচ্ছে বাড়িতে? এই মাত্র সে দেখে এসেছে মার্সেড আছে আঠাশ ডিগ্রি সাতান্ন মিনিট ওয়েস্টে, আর কলকাতা হল গিয়ে অষ্টআশি ডিগ্রি চব্বিশ মিনিট ইস্ট। এখানে এখন দশটা পঞ্চাশ, তার মানে কলকাতায়…. ছটা উনচল্লিশ। কাল সকাল। ভাবতেই কী আশ্চর্য লাগে! আগামী কালটা শুরু হয়ে গেছে কলকাতায়! অথচ সেই একই মুহূর্তে এই আটলান্টিক মহাসাগর এখন রাত পিঠে নিয়ে বসে! কী করছে এখন মা? স্কুলের পথে রওনা হয়ে গেছে? তিতিরটা যা ঘুমকাতুরে, নিশ্চয়ই ওঠেনি। স্কুল যাওয়ার পথে কি এখন বাপ্পার কথা মনে পড়ছে মার? ঠিক এই মুহূর্তে? যদি মনে পড়ে, তো কী ভাবছে মা? কল্পনা করতে পারছে একই মুহূর্তে মার কথা ভাবছে বাপ্পাও! নিঃসীম একা হয়ে! তটহীন এক মহাসমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে!
একটা ভিজে নোনা হাওয়া বাপ্পার মুখে ঝাপটা মারল। বুকটা হু হু করে উঠল বাপ্পার। প্রায়শই করে আজকাল। মাকে দেখতে ইচ্ছে করে হঠাৎ হঠাৎ। বোনকে দেখার জন্য উথাল-পাথাল করে মন। কান্না পায় বাপ্পার, সামনের অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয় আর বুঝি কোনওদিন কোনও আপনজনের সঙ্গে দেখা হবে না। সব থেকে আশ্চর্যের কথা সেই লোকটাকেও দেখতে খুব ইচ্ছে করে। মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে, একটু কুঁজো হয়ে হাঁটছে লোকটা, বাপ্পার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রোগা মুখে হাসি ফুটেই মিলিয়ে গেল। কলকাতা ছাড়ার দিন বাবা এয়ারপোর্টে আসতে চেয়েছিল, বাপ্পা খেঁকিয়ে উঠেছিল। ম্লান হয়ে গেল বাবার মুখ, নিঃশব্দে বাপ্পার জন্য ট্যাক্সি ডেকে এনে চলে গেল ভেতরে। বাবা হয়ে উঠতে পারেনি বলে কি মর্মপীড়ায় ভোগে বাবা? তাকে কখনও কটু কথা বলেনি বাবা, জোর ফলায়নি। একটু অধিকারবোধ না দেখালে কি তার ওপর টান জন্মায় না? যদি তাই হয়, তবে সহস্র মাইল দূরে থেকে বাবা তার স্বপ্নে হানা দেয় কেন! সেই শহরটাই বা কেন তাকে টানে আজকাল! নোংরা ঘিঞ্জি ক্লেদাক্ত পূতিগন্ধময় সেই শহরটা! অত ঘৃণা করেছে বলেই কি সেই মায়াবিনী কুহকজালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে তাকে! কত সুন্দর জিনিস দেখল পৃথিবীতে, কত ঐশ্বর্যময় শহর দেখল, তবু কোনও কিছুতেই যেন মন ভরে না। কেন?
চোখ বুজল বাপ্পা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কলকাতার সকাল। একটু ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব, নরম হাওয়া বইছে, অলস পায়ে হাঁটছে লোকজন। ঢাকুরিয়া ব্রিজের পাশে চা দোকানটায় আড্ডা মারছে বাস কন্ডাক্টাররা, লেক থেকে ফিরছে রুন্টুর বাবা। লেক নিশ্চয়ই এখন ঘন সবুজ, টিলটিল জল ছুপ ছুপ ধাক্কা মারছে পাড়ে। পিপুল শিমুল জারুল কৃষ্ণচূড়া গুলমোহরের নীচে শিশির পড়েছে খুব, এখনও শুকোয়নি। ছোটকার জগিং শেষ, ফিরছে এবার। বড়কাকা সিগারেট কিনতে বেরিয়েছে, দোতলার বারান্দা থেকে অ্যাটম চেঁচিয়ে ডাকছে বড়কাকে। মিনতি বাজারে বেরোবে, একতলার রান্নাঘরে কাকিমার কাছ থেকে নির্দেশ নিচ্ছে। চায়ের কাপ প্লেট হাতে সন্ধ্যার মা উঠছে দোতলায়।
ধুস, বাড়িটাই তো নেই। এখন তো সব…।
বাপ্পাদের নতুন বাড়িটা কেমন হয়েছে? বড়কাকার ডেরাটাই বা কেমন?
–হেই নীল! নট স্লিপিং?
বাপ্পা জাহাজে ফিরল। লিয়েম। টলমল পায়ে আসছে। সারা দিনই চড়িয়ে থাকে লিয়েম, সন্ধে থেকে একটু একটু দোলে।
বাপ্পা হাসল, – ঘুম আসছে না।
লিয়েমের মঙ্গোলিয়ান ভারী মুখে দাঁতগুলো ফুটে উঠল, দিস থিঙ হ্যাপেনস। ফার্স্ট টাইম বাড়ি ছেড়েছ তো! কত দিন হল?
–চার মাস সাতাশ দিন।
প্রায়প্রৌঢ় স্কুল লোকটা হা-হা হাসল। অভ্যস্ত ক্রিয়াপদবিহীন ইংরিজিতে বলল, – ফিলিং হোমসিক? কাউন্টিং ডেজ?
বাপ্পা ধরা পড়া মুখে বেফাঁস বলে ফেলল, তুমি এর কী বুঝবে? তোমার তো হোমসিকনেস নেই।
–আছে বইকি। নইলে দরিয়ায় ঘুরি কেন? দরিয়াই হল আসল কাঁদার জায়গা। বাড়ির দুঃখে কি বাড়িতে বসে কাঁদা যায়!
সর্বনাশ। এক্ষুনি লিয়েম তার জীবনী শোনাতে শুরু করবে। অন্তত সত্তরবার বাপ্পার শোনা হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও। কবে লিয়েমের বউ পেনাং ছেড়ে মালাক্কা পালিয়েছিল, কত কষ্ট করে নিনিকে মানুষ করেছে লিয়েম, নিনি এখন বিয়ে করেছে এক বার্মিজ ছোকরাকে, উ মঙ তার নাম, মেয়ে জামাই লিয়েমের পেনাং-এর বাড়িতেই থাকে, কিন্তু জামাই তাকে দুর দুর করে, ঘরে ঢুকতে দেয় না, নিনিও তাকে কিছু বলে না, এই সব। লিয়েমের তেমন কোনও বদ নেশা নেই, শুধু এই সারাক্ষণ মদ খাওয়াটুকু ছাড়া। একটাই বান্ধবী আছে লিয়েমের, হংকং-এ, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই কদিন যা চনমনে থাকে লিয়েম, নয়তো বছরভর তার শুধু দুঃখই দুঃখ।
বাপ্পা কথা ঘুরিয়ে নিতে চাইল, আজ একটু তারা-টারা হবে না লিয়েম?
–হোক। লিয়েমের ভুরুহীন দুই চোখ পলকে জ্বলে উঠেছে, কোন দিক থেকে শুরু হবে?
–পশ্চিমই হোক।
প্রথম সমুদ্রযাত্রার সময়ে আকাশের একটি তারাও চিনত না বাপ্পা। না, একটা চিনত। পোলারিস। ধ্রুবতারা। তারাটা মা চিনিয়েছিল তাকে, খুব ছোটবেলায়। বাকি গোটা আকাশ সে চিনেছে এই লিয়েমের কাছ থেকে। লিয়েমই তাকে তারাদের উদয়-অস্ত বুঝিয়েছে, কোন তারা কেন কবে সৃষ্টি হল তাই নিয়ে উপকথা শুনিয়েছে বিস্তর। অদ্ভুত সব গল্প। বলেছে সিফিউস আর ক্যাসিওপিয়ার কন্যা অ্যান্ড্রোমিডার কাহিনী, দেখিয়েছে আকাশের তিমিমাছ সেটাসকে যার খাদ্য হয়ে শিকল দিয়ে পাহাড়ে বাঁধা ছিল অ্যান্ড্রোমিডা। বলেছে জুপিটার আর ডানাই-এর পুত্র দুঃসাহসী পারসিউসের কথা। কোথা থেকে এল ওই আকাশের গায়ে পক্ষীরাজ ঘোড়া পেগাসাস, কোন কৌশলে পারসিউস মায়াবিনী মেডুসার মুণ্ডু কাটল, সব লিয়েমের ঠোঁটস্থ। এখন লিয়েম প্রায়ই পরীক্ষা নেয় বাপ্পার, এ আর একটা ভারী মজার খেলা।
লিয়েম বাপ্পার কাঁধে হাত রেখেছে, অ্যালটেয়ার কোথায়?
খাড়া পশ্চিমে গাঢ় নীল তারাটাকে চট করে খুঁজে নিল বাপ্পা, ওই তো।
–গুড। লিয়েম পিঠ চাপড়াল, — আরিগা কোথায়?
ধ্রুবতারার ডান দিকে চোখ চালাল বাপ্পা। পারসিউসের পূর্ব দিকে ছায়াপথের মধ্যে চারটে নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। সরলরেখায়। বাপ্পা আঙুল তুলল, – ওই যে।
এরিডেনাসটা দেখাও।
–স্বর্গের নদী? ওই তো পুব-দক্ষিণ আকাশ জুড়ে এঁকেবেঁকে গেছে। আচ্ছা লিয়েম, এরিডেনাসের একদম সাউথের ওই লাস্ট তারাটা আচেনার নয়?
–উঁহু, ওটা ফিনিক্স। আচেনার এখন দেখা যাচ্ছে না, আরও নীচে আছে।
খেলা জমে গেছে। আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোণে জ্বলছে ভেগা, অ্যাকুইলা ক্রমশ সরে যাচ্ছে
পশ্চিমে, পেগাসাসের উত্তরে হাঁটছে অ্যান্ড্রোমিডা…..
কত শত ছবি ফুটে থাকে আকাশে। ভাল্লুক হরিণ সিংহ কুকুর গরু বাছুর, গাছপালা কত কি। দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায় বাপ্পার।
বাপ্পার এই তারা দেখার কথা জাহাজে চাউর হয়ে গেছে। চিফ অফিসার সুজিত পোদ্দারের বউ অনুরাধা বউদি ঠাট্টা করে বলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে লিয়েমের কী হাল হয়েছে তো দেখেছ! গোটা জাহাজে ওই লোকটাই শেষে তোমার গুরুঠাকুর হল!
বাপ্পা হাসে চুপটি করে। কি করে বোঝায় লিয়েমের অনেক আগেই আর এক গুরুঠাকুর আকাশটা ঢুকিয়ে দিয়েছে তার মাথায়। তারই ধাঁধার উত্তর খুঁজতে সুলিভানের বইটা ঘাঁটত বাপ্পা, নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকত, আর তখন থেকেই কি করে যেন ওই প্রকাণ্ড নভোমণ্ডল ছড়িয়ে গেছে বাপ্পার বুকের গভীরে। কেউ জানে না প্রতি রাতে তাকে একটা করে চিঠি লেখে বাপ্পা, কিন্তু পাঠায় না। প্রতিটি চিঠিই গোপনে রাখা আছে নাইট স্কাই-এর পাতায় পাতায়। কলকাতা ফিরে রোজ একটা করে চিঠি তুলে দেবে বিষ্ণুপ্রিয়ার হাতে। ততদিন তারারাই বিষ্ণুপ্রিয়াকে মনের কথা বলুক।
লিয়েম চলে যাওয়ার পরও আরও খানিকক্ষণ ডেকে দাঁড়িয়ে রইল বাপ্পা। মা বাবা বোন কেউ নয়, এখন শুধু একটাই মুখ ভেসে উঠেছে নিকষ অন্ধকারে। আট ঘণ্টা আগে ওই ক্যাপেল নক্ষত্রটা কলকাতায় জেগেছিল, সে এখন ফুটে উঠেছে বাপ্পার আকাশে। ওই নক্ষত্র কি কোনও বার্তা বয়ে আনল! আবার কাল ফিরে গিয়ে তাকে কি শোনাবে বাপ্পার কথা!
এটাই বুঝি বিষ্ণুপ্রিয়ার পাজল!
সিঁড়ি ভেঙে এন্টারটেইনমেন্ট হলে এল বাপ্পা। এত রাতেও একা একা বিলিয়ার্ড খেলছে তাইল্যান্ডের সোমপাল। মালয়েশিয়ার মিসবুন, গোয়র ডিক্রুজ আর কেরালার ভার্গিজ রামি খেলায় মত্ত, হাতে তাদের রঙিন পানীয়। ভিসিআর চলছে, বিশাল টিভির রঙিন পর্দায় নেচেকুঁদে প্রেম জানাচ্ছে নায়ক, দেখছে না কেউ।
ডিক্রুজ হাত নেড়ে ডাকল বাপ্পাকে।
বাপ্পা সামনে গিয়ে দাঁড়াল। জাহাজে এসে তিন-চার রকম তাস খেলা শেখা হয়ে গেছে তার, সবই জুয়া। রামি ফিশ ফ্ল্যাশ পোকার। হাই স্টেকে খেলে ডিক্রুজরা, যখন তখন একশো-দুশো ডলার এ-হাত ও-হাত হয়ে যায়। দু-চার দিন দেখে বাপ্পা বুঝে গেছে এদের সঙ্গে খেলা খুব নিরাপদ নয়।
ভার্গিজ বলল, -বসে পড়ো নীল।
–নো। বাপ্পা কপালে আঙুল রাখল, –গট আ হেডএক।
মিসবুন ছুঁচোলো দাড়িতে হাত বোলাল, হ্যাভ এ সিপ। মাথা ছেড়ে যাবে।
বাপ্পা আবার হাসল, থ্যাঙ্ক ইউ। ড্রিঙ্কস নিলে আমার হেডএক বেড়ে যায়।
আবার তিন ইঞ্জিনিয়ার ডুবে গেছে খেলায়। বাপ্পাব একটু বসে গান শোনার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু এ ঘরে থাকলেই মিসবুনরা হয়তো আবার পীড়াপীড়ি শুরু করবে।
বেরিয়ে এল বাপ্পা। সিঁড়িতে ক্যাপ্টেন বিশালা তেনিকুনের সঙ্গে দেখা। একজন ডেক-ক্রু আর মোটরম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নামছে। বাপ্পা আলতো নড করল, – প্রত্যুত্তর দিল তেনিকুন, ব্যস্ত মুখে কথা বলতে বলতে চলে গেল।
নিজের কেবিনে ফিরল বাপ্পা। ঘরখানা ছোট্ট, বাহুল্যবর্জিত। একটা খাট, চেয়ার টেবিল, ক্লোসেট, দু-তিনখানা গদিমোড়া টুল মোটামুটি এই সম্বল।
বাপ্পা চেয়ারে বসল। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে চিঠি লিখছে। রোজকার মতো। ডিয়ার নাইট স্কাই, আজকের দিনটাও একইরকম কাটল। কোনও বৈচিত্র্য নেই। রোজ সেই আট ঘণ্টা ডিউটি, আট ঘণ্টা অফ, সেই ব্রিজে বসে রাশি রাশি ইন্ডিকেটারে চোখ বোলানো, কখনও একা, কখনও দল বেঁধে, কিংবা ডেকে ঘুরে ঘুরে ছোটখাট কিছু মেরামতি ওয়াচ করা, কিংবা…
দরজায় কে নক করছে। এত রাতে কে এল রে বাবা!
দরজা খুলে বাপ্পা চমকে গেল। অনুরাধা বউদি!
বাপ্পা নার্ভাসভাবে বলল, কী হয়েছে বউদি?
–তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ভাবলাম এখনই… তুমি শুয়ে পড়েছিলে?
–নাহ, তোড়জোড় চলছে।
–তুমি তো বেশ ভাল ছেলে। জাহাজে এসে লেটনাইট করছ না, বুজিং করছ না… তোমার সুজিতদা তো তোমার মতো যখন ব্যাচিলার ছিল, কাউকে সারা রাত ঘুমোতেই দিত না।
বাপ্পা হাসল সামান্য। জাহাজে সে মদ্যপান করে না, এমন নয়। একদিন তো চূড়ান্ত বেহেড হয়ে গিয়েছিল। সেই ভয়েজটায় সুজিতদা ছিল না। বাপ্পা তুমুল হইহল্লা করেছিল সেদিন, ঘরে ফিরে বমিও করেছিল খুব। তখনই কেমন যেন মনে হল আদিত্য রায়ের প্রোটোটাইপ হয়ে যাচ্ছে নাকি বাপ্পা! তারপর থেকে অনেক সংযত হয়ে গেছে সে, অকেশান ছাড়া গ্লাসে চুমুকই দেয় না।
বাপ্পা ঘাড় চুলকে বলল, রাত্তিরবেলা এই সার্টিফিকেট দিতে এলেন বউদি?
বছর পঁয়ত্রিশের মিষ্টিমুখ অনুরাধা ভারী সুন্দর করে হাসল, বাঙালি ছেলেরা তোমার মতো শান্তশিষ্ট হলে আমার খুব ভাল লাগে। তোমার সুজিতদা তো ঠিক এমনটা নয়…
–কেন, সুজিতদা তো খুব ভাল লোক। ঠাণ্ডা মানুষ।
–সে তো আমি সঙ্গে থাকি বলে। ছেলেও নৈনিতালের হোস্টেল থেকে চিঠিতে কড়া শাসন করে বলে। যাক গে, কাল সকালে তুমি একবার আমার ঘরে আসবে।
–কেন বউদি?
কাল ভাইফোঁটা না! এই প্রথম বছর ভাইফোঁটার দিন আমি জাহাজে আছি। কাউকে তো একটা ফোঁটা দিতে হবে, না কি?
বাপ্পার রক্ত ছলাৎ করে উঠল। ঢোঁক গিলে বলল, – যাব। নিশ্চয়ই যাব।
–আমি নিজে একটা স্পেশাল ডিশ তৈরি করব। তোমাকে ফোঁটা না দেওয়া অবধি আমার খাওয়া নেই। মাথায় থাকে যেন।
অনুরাধা চলে যাওয়ার পর পাথরের মতো চেয়ারে বসে রইল বাপ্পা। চিঠি লিখতে পারছে না। ধুপ ধুপ নেহাই পড়ছে বুকে।
তিতিরের কি এ বছর খুব মন খারাপ হবে দাদার জন্য!
.
৮০.
–ছোটকা, ও ছোটকা…
স্নানঘরের দরজায় দুম দুম ধাক্কা পড়ছে। কন্দর্প শাওয়ার বন্ধ করল, কি?
তাড়াতাড়ি বেরোও। আজ আমার স্কুল খুলছে না! কখন ঢুকেছ…।
সুখী সুখী মেজাজটায় টান ধরল কন্দর্পর। স্নান তার বড় প্রিয় ব্যসন। আধ ঘণ্টা চল্লিশ মিনিটের কমে তার গোসল হয় না। দীর্ঘ সময় ধরে গাত্রমার্জনা, দু দিন বাদে একদিন শ্যাম্পু, শাওয়ারের ধারা থেকে প্রতিটি রোমকূপে জল আহরণ, সবই তার পেশার জরুরি রসদ। সুখও বটে। রায়বাড়িতে কোনও তাড়া থাকত না, কিন্তু এখানে…
কন্দর্প গা মুছতে মুছতে চেঁচাল, দু মিনিট দাঁড়া।
–দু মিনিট নয়, এক্ষুনি বেরোও। পৌনে নটা বাজে।
তিতিরের স্বর বড় রুক্ষ হয়ে গেছে ইদানীং। অপ্রসন্ন মুখে কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে এল কন্দর্প। ঘরের দিকে গেল না, দাঁড়িয়ে পড়ে তিতিরকে দেখল একঝলক। গোমড়া মুখে প্রশ্ন করল, -কাল বিকেলে তোর সঙ্গে ছেলেটা কে ছিল রে?
তিতির সুড়ৎ করে বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছিল। কন্দর্প হাতটা চেপে ধরল, উত্তর দিলি না?
তিতির নাক কুঁচকোল, কোন ছেলেটা?
আজকাল অনেক ছেলের সঙ্গে ঘুরিস বুঝি?
বারে, আমার স্কুলের বন্ধু নেই?
–ছেলেটা তোর স্কুলের নয়। যথেষ্ট দামড়া। কাল বিকেলে ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপর দিয়ে যার সঙ্গে হাঁটছিলি।
–ও, সুকান্ত! তিতির আলগোছে হাত ছাড়িয়ে নিল, ও-ও আমার একটা বন্ধু।
করে কী?
–কিছু একটা করে। তিতির অদ্ভুত এক ভঙ্গি করল, অত জেরা করছ কেন বলো তো?
কন্দর্প আর কিছু বলল না। চোখের সার্চলাইট ফেলে আর একটু দেখল ভাইঝিকে। এই বয়সে অনেক কিছু উল্টোপাল্টা ঘটে যায়, তিতিরটা যা সরল, কোনও বোকামি না করে বসে!
এসব পলকা চিন্তা মনে বেশিক্ষণ থাকে না, বিশেষত যদি কাজের চিন্তা থাকে মাথায়। খেয়ে উঠেই এক্ষুনি ডাবিং থিয়েটারে ছুটতে হবে, দিনভর ছবির সঙ্গে মেলাতে হবে ঠোঁট।
সন্ধ্যার মার রান্না হয়ে গেছে, দ্রুত খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে নিল কন্দর্প। আদিত্য সবে ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভাঙছে, চা চাইছে সন্ধ্যার মার কাছে, সেদিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পাড়ার গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা ডাবিং সেন্টার।
সাড়ে তিনটে নাগাদ কাজ শেষ হল। অসম্ভব ধকল গেছে, ডাবিং রুমের বাইরে এসে সিগারেট ধরাল কন্দর্প। রিসেপশনে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে, হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। কন্দর্পও হাসল, একটু নাম হয়েছে তার, এখন আর অভদ্র হওয়া সাজে না। মেয়েটি সিট ছেড়ে এগিয়ে এল, আপনার একটা ফোন এসেছিল। মিস্টার অশোক মুস্তাফির।
কখন?
–দুটো নাগাদ। খুব জরুরি দরকার। আজই আপনাকে ওঁর অফিসে একবার যেতে বলেছেন।
–আমাকে ডাকেননি কেন?
–আপনিই তো বলেছেন কাজের সময়ে আপনাকে ডিসটার্ব না করতে।
হক কথা। ডাবিং-এর সময়ে মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটলে খুব অসুবিধে হয়।
ঝটিতি মুস্তাফির বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট অফিসে ছুটল কন্দর্প। গিয়ে দেখে অশোকদার গাল ঝোলা, যা শুনল তাতে নিজেরও চক্ষুস্থির। সামনের সপ্তাহের যে কোনও দিন নাকি অশোকদার ফিনান্স কোম্পানিতে রেড হবে। পুলিশের এনফোর্সমেন্ট আর ইনকাম ট্যাক্স একসঙ্গে জাঁতা দিতে আসবে মুস্তাফিকে।
মুস্তাফি কপাল চাপড়াচ্ছে, কে আমাকে এমন বাঁশটা দিল বলো তো কন্দর্প?
কন্দর্প মাথা চুলকোল, হবে আপনার কোনও বিজনেস রাইভাল।
ব্যবসার রাইভালরা কেউ এভাবে কাঠি দেয় না। কেউই তো আর সতীসাবিত্রী নয়, সকলের কাপড়ে ফুটোফাটা আছে। দিস মাস্ট বি সামওয়ান এলস।
কিন্তু আপনি খবরটা পেলেন কোত্থেকে?
–ওদের অফিসে আমার লোক নেই! মুস্তাফি মুখ ভেংচাল, যারা সব মাসকাবারি খাম নিয়ে যায়, তারা কি গাব জাল দিতে বসে আছে!
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুস্তাফিকে দেখে একটু মজা পাচ্ছিল কন্দর্প। বিজ্ঞের মতো বলল, – বাঘের ঘরে আপনি ঘোগের বাসা করে রেখেছেন, তেমন হয়তো আপনার ঘরেও বাঘ ঘাপটি মেরে আছে।
মুস্তাফির চোখ ছুন্নি গুলির মতো হয়ে গেল, মানে?
–আপনার অফিসেরই কেউ হয়তো ইনফরমেশন পাস করেছে।
-ফুট, তুমি একটা ছাগল। লো পয়েন্টে চলা অফিসঘরের এসিটা বেয়ারাকে ডেকে বাড়িয়ে দিতে বলল মুস্তাফি। সিগারেট ধরাল, – আজ আমার কোম্পানিতে তালা ঝুললে ওরা খাবে কী? কোন এনফোর্সমেন্ট ইনকামট্যাক্সবাবারা অন্ন দেবে?
–তা ঠিক। কন্দর্প মাথা নাড়ল, আপনি আপনার সেফগার্ডগুলো রেডি করুন।
–সে তো করবই। আজ সন্ধেবেলা আমার কনসালটেন্টের সঙ্গে বসছি। কিন্তু…
–কিন্তু কি?
–কিছু টাকা তো আমাকে হোয়াইট করতেই হবে। এ বিষয়ে আমি কি তোমার হেলপ পেতে পারি? সাপোজ আমি তোমায় কিছু টাকা ক্যাশ দিলাম, তুমি সেগুলো তোমার অ্যাকাউন্টে জমা করে আমায় কটা চেক দিয়ে দিলে…
কত টাকার?
–এই ধরো, পাঁচ-সাত লাখ। তোমার মতো আরও কয়েকজনকে আমি ধরছি… তারাও কিছু কিছু এইভাবে…
–আমি অত টাকা কী করে দেখাব? কন্দর্প আঁতকে উঠল, আমাকেও তো ইনকাম ট্যাক্স…
–সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। পনেরো-বিশটা ফিকটিশাস প্রোডিউসার তোমাকে ফিলমের জন্য অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে দেবে। তার জন্য যা ট্যাক্স লাগে, আই শ্যাল বেয়ার।
–কিন্তু আমার চেক দেওয়াটা কি ইনকাম ট্যাক্স মানবে?
–ওদের চোদ্দপুরুষ মানবে। মুস্তাফি ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল, আমি তো ফিলম প্রোডিউস করার জন্য তোমার কাছ থেকে লোন নিচ্ছি কন্দর্পভাই।
প্যাঁচটা কন্দর্পর মাথায় ঢুকছিল না। মনে হচ্ছে কোথায় যেন একটা ফাঁক আছে! বিপদের গন্ধও যেন পাওয়া যায় আবছা।
মুস্তাফি সিগারেট নেবাল, — তা হলে তুমি এগ্রি করছ? আমি তাহলে পেপার তৈরি করতে বলি?
থতমত মুখে কন্দর্প বলল, কিসের পেপার?
আরে বাবা, কোনও প্রোডিউসারের কাছ থেকে তুমি কোন ছবির জন্য কত টাকা নিচ্ছ, তার একটা লিখিত-পড়িত ডকুমেন্ট থাকবে না?
কন্দর্পকে আর প্রশ্ন করার অবকাশ না দিয়ে উঠে গেল মুস্তাফি। হলঘরে গিয়ে বড়বাবুর সঙ্গে কথা বলছে, কন্দর্প উঁকি মেরে দেখল। বড়বাবু হাসি হাসি মুখে তাকাচ্ছে এদিকে, ঘন ঘন ঘাড় নাড়ছে। এ কী গেরোয় পড়া গেল রে বাবা! কতদিন পথে গাড়িটা বেগড়বাই করে, আজ কোথাও একটা বেমক্কা খারাপ হয়ে গেল না কেন! এখান থেকে এখন পালানো যায় না! জানলা দিয়ে ঝাঁপ মারবে! রেনপাইপ বেয়ে নেমে যাবে!
ধুস, ওসব কাজ তো স্টান্টম্যানরা করে! সে এখন নায়ক, তার কি সে ক্ষমতা আছে।
মুস্তাফি ফিরে এসেছে। চেয়ারে বসতে বসতে বলল, ঠাণ্ডা খাবে?
কন্দর্প দীর্ঘশ্বাস ফেলল, -বলুন।
বেল বাজিয়ে হুকুম জারি করে দিল মুস্তাফি। রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিয়ে ছোট্ট পাক খেয়ে মা কালীর ছবির দিকে তাকিয়ে রইল করুণ মুখে। ম্রিয়মাণ স্বরে বলল, – বড় ঝামেলায় ফেঁসে গেছি গো। সব দিকে ঝঞ্ঝাট, সব দিকে ঝঞ্ঝাট। কাল-পরশুই দিল্লির গভর্নমেন্ট ফল করবে, আবার ডামাডোলের বাজার শুরু হয়ে যাবে। ভাবতে পারো, রেলে আমার কত টাকা বাকি? তেরো লাখ। শালা মিনিস্টার বদলাক ঠিক আছে, মিনিস্ট্রির সঙ্গে সঙ্গে যে ব্যুরোক্র্যাটগুলোও বদলে যায়…
–তাতে আপনার কী? সবাই তো টাকা খায়। কন্দর্প একটু তেতো স্বরে বলল।
–খায়, নিশ্চয়ই খায়। যারা খায় না মন্ত্রীরা তাদের ধারেকাছে রাখে না। মুস্তাফি ঘুরে কন্দর্পর মুখোমুখি হল, বাট দা প্রবলেম ইজ নতুন মানুষ মানেই আবার নতুন করে চ্যানেল তৈরি করো। কে টাকা নেবে, কে কন্টিনেন্ট ঘুরবে, কে মেয়েছেলে চাইবে… ডিসগাসটিং।
দ্যান কেন? কন্দর্প সাহস করে বলে ফেলল, – অনেক তো কামালেন, এখন বাকি জীবনটা শান্তিমতো এনজয় করুন না। এ সবের মধ্যে আর নাই বা রইলেন।
–পুড়কি মারছ?
ছি ছি, আমি আপনার ছোট ভাই। জাস্ট বলছিলাম।
মুস্তাফির মুখটা একটু যেন অন্যরকম হয়ে গেল। কেমন যেন উদাসীন, দূরমনস্ক। চেনা মুস্তাফির মধ্যে একটা অচেনা মুস্তাফি যেন ভেসে উঠল মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে মিলিয়েও গেল। হাসি হাসি মুখে বলল, – এসব কথা আটার কোরো না কন্দর্প, মনটা দুর্বল হয়ে যায়। তোমার কী ধারণা টাকা রোজগার আমাকে এখন কোনও নতুন সুখ দিতে পারে? না। পারে না। বাট স্টিল আই হ্যাভ টু রান ফর মানি। আমাকে টাকা অ্যাকোয়্যার করতে হবে, টাকা বাড়াতে হবে, প্রয়োজন হলে টাকা লুঠ করতে হবে। এটা আমার প্যাশান। বেঁচে থাকার অবলম্বন। তোমার যেমন অভিনয়।
জীবনে প্রথম মুস্তাফির জন্য ঈষৎ করুণা হল কন্দর্পর। মুস্তাফি যেন নিজের অলকাপুরীতে আটকে পড়া যক্ষরাজ।
মুস্তাফিকে একটু হালকা করতে চাইল কন্দর্প। বলল, আমি সে কথা বলছি না অশোকদা। আপনার মতো কর্মী মানুষ কজন আছে!
বলছ?
বলছিই তো। এই সব রেড-ফেড আপনার করবেটা কী? আপনার মেজর টাকা তো শেয়ারে খাটছে, বড়বাজারে ঘুরছে…
–সেখানেও তো টালমাটাল, তাই না চিন্তা। কী সব তোমরা রামজন্মভূমি বাবরি মসজিদ নিয়ে গোল পাকাচ্ছ, আর হুড়কো যাচ্ছে আমাদের। আরে বাবা, থাক না, সবই থাক। আমরাও একটু শান্তিতে…ওই যে তোমার ইউ পি মহারাষ্ট্রে কারফিউ হয়ে বসে আছে, তার এফেক্ট তো শেয়ার মার্কেটেও পড়ে, না কি? তারপর ধরো গভর্নমেন্ট পড়ে গেলে যদি মিডটার্ম ইলেকশানই হয়, কেমন গভর্নমেন্ট আসবে নো ওয়ান ক্যান সে। তিনঠেঙে, না পাঁচঠেঙে, না চারঠেঙে, না দুঠেঙে…! বলতে বলতে মুস্তাফি থামল, ধুস, ভাললাগে না। কখলে একটা বাড়ি করে নদীর পাড়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকব। সেই ভাল।
কন্দর্প মুচকি হাসল, আপনি তো আমার দাদার মতো কথা বলছেন।
মানে?
কোল্ড ড্রিঙ্কস-এ টান দিতে দিতে আদিত্যর অভিলাষটা ব্যক্ত করল কন্দর্প। মন দিয়ে শুনল মুস্তাফি। ঘাড় দোলাচ্ছে, তোমার দাদাই জীবনের সার বুঝতে পেরেছে হে। দুনিয়ায় কেউ কারও নয়। হঠাৎ গলা নামাল মুস্তাফি, –ইন ফ্যাক্ট নিকটজনেরাই হল রিয়েল বায়ু।
কন্দর্প আহত গলায় বলল, আমরা দাদাকে বাস্তু দিই!
–তুৎ, সেই ছাগলের মতো কথা। আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট মাইসেলফ। আই ডাউট, এই রেড-ফেডের চক্করটার পেছনে আমার সাহেবজাদাই আছে।
যাহ, বাবুরাম এসব করতে যাবে কেন?
-খারে। ছেলেই হল বাবার সব থেকে বড় শত্রু। তুমি মোগল হিষ্ট্রি পড়নি? ছেলের জন্যই বাবা সম্পদ বানায়, সেই ছেলেই বাবার বুকে ছুরি মারে। কদিন ধরেই মাকে খুব শাসাচ্ছিল বাবুরাম। দেখে নেবে। মালের দোকানটা করতে পারল না তো, শুয়োরের বাচ্চা তাই খেপে ষাঁড় হয়ে গেছে। বাট আই অ্যাম হিজ ফাদার। ও যদি হারামজাদা হয়, আমি সেই হারামজাদার বাপ। দুখানা লোক লাগিয়ে দিয়েছি বাবুরামের পেছনে। টোয়েন্টিফোর আওয়ারস ওরা তাকে কুকুরের মতো শ্যাডো করছে। কার সঙ্গে কি কথা বলে, কোথায় যায়…
কন্দর্প বিস্ফারিত চোখে মুস্তাফিকে দেখছিল। লোকটা দেবতা, না দানব, না মানুষ!
মুস্তাফি হাসছে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তো? আরে ব্রাদার, ছেলেকে যখন সন্দেহ করছি, অবশ্যই কিছু ডেফিনিট প্রুফ আমার আছে। অনেকগুলো সিক্রেট ডকুমেন্ট বাড়ি থেকে মিসিং। ওই ফিনান্স কোম্পানিরই। আমার ছেলে ছাড়া আমার বাড়ি থেকে ওই সব পেপার কে সরাতে পারে?
কাগজপত্র এসে গেছে। টাইপ করা, রেভিনিউ স্ট্যাম্প লাগানো। কন্দর্প পড়ল না কিছু সই করে দিল। একটু বুঝি কাঁপছিল আঙুল, ঘামছিল।
কাগজের তাড়া ড্রয়ারে রাখল মুস্তাফি। পেশাদারি ভঙ্গিতে বলল, তোমার কোনও ভয় নেই কন্দর্প। আমি অ্যাসিওর করছি তুমি কোনও মেজর বিপদ বা কেলেঙ্কারিতে জড়াবে না। ইফ আই ফাইন্ড এনিথিং রং, সমস্ত ফিনান্সিয়াল রেসপন্সিবিলিটি আমি নিয়ে নেব। ওয়ার্ড অব অনার। কাল সকালে তোমার কাছে টাকা পৌঁছে যাবে, তুমি প্লিজ চেকটা দিয়ে দিয়ো।
পথে বেরিয়ে মেজাজটা আরও খিঁচড়ে গেল কন্দর্পর। কাগজগুলো যদি কুচি কুচি করে উঠে আসত, কী করতে পারত অশোকদা? ছবিতে চান্স দেবে না? বয়েই গেল। ফ্ল্যাট নিয়ে কিছু বখেড়া করবে? অত সহজ নয়। মেজদা আছে, বউদি আছে, পাকা এগ্রিমেন্ট আছে, ওখানে মুস্তাফির নড়াচড়া করার জায়গা নেই। বড় জোর দু-চার মাস দেরি করতে পারে। তাতেও মুস্তাফিরই লোকসান বেশি। তবু….
ওই তবুটাই তো কন্দর্প।
স্টিয়ারিং-এ আলগা হাত পড়ে আছে, চলছে গাড়ি। শেষ বিকেলে থইথই করছে রাস্তাঘাট, পশ্চিম আকাশে বিচ্ছুরিত হচ্ছে গোলাপি আভা। পার্ক স্ট্রিটের মোড় জ্যাম-জমাট, শয়ে শয়ে গাড়ি খোঁয়াড়ে আটকানো পশুর মতো ছটফট করছে। একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট, গোটা তিন-চার কনস্টেবল ছোটাছুটি করছে রাস্তায়। আলো কমছে ক্রমশ।
কন্দর্প স্যাস ক্লিনিকে পৌঁছল ছটার পর, তখন সন্ধে নেমে গেছে। মধুমিতা প্রতীক্ষাতেই ছিল। বলল, আমি কিন্তু আর একটু দেখেই বেরিয়ে যাচ্ছিলাম।
-সরি। যা জ্যাম। কন্দর্প দরজা খুলে দিল, – এসো।
ইতালিয়ান ফিয়াট সুছন্দে বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পার হল। বাইপাস কানেক্টারের দিকে এগোচ্ছে। চারদিন পর দেখা হল, কত কথা জমে আছে। কিন্তু কি কথা? দুজনের কারুরই যেন মনে পড়ে না। নিশ্চুপ চলতে থাকে গাড়ি।
কন্দর্পর বুকে চিড়িক চিড়িক করছে মুস্তাফি। চাপা কিরকিরে ভাব নীলচে শিখা হয়ে দপদপ করছে মাথায়। মুস্তাফিকে ভুলতে চাইল কন্দর্প। অনুচ্চ স্বরে ডাকল, মিতা?
উঁ?
-কী ভাবছ?
–ভাবছি না তো। বাড়ি ফিরছি।
–ভাইফোঁটার দিন তোমার দাদা এসেছিল?
হুঁ।
কথা হল কিছু? বললে?
নাহ্।
–কেন বলোনি?
মধুমিতা নিরুত্তর। নীল শিফনের কোণ পাকাচ্ছে আঙুলে।
আঁধার দিনের তাপ শুষে নিয়েছে। এখন কীটপতঙ্গ আর ফুলেদের জেগে ওঠার সময়।
কন্দর্প জোরে শ্বাস নিল, মার সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে?
না।
–কেন না? কন্দর্প সামান্য অসহিষ্ণু হল, তোমার ব্যাপারখানা কী বলো তো? তুমি কী চাও?
-রোজ বলতে হবে?
–তাহলে তুমি মা দাদার সঙ্গে কথা বলছ না কেন?
বলব।
–কিন্তু কবে? আর কবে?
মধুমিতা আবার নিরুত্তর।
চার নম্বর পুল পার হল গাড়ি। নীচ দিয়ে একটা ট্রেন ঝঙ্কার তুলে ছুটে গেল।
কন্দর্প গোমড়া মুখে বলল, তুমি কি এখনও ডিসিশান নিতে পারছ না?
–তাই বলেছি?
–মউকে নিয়ে কোনও প্রবলেম হচ্ছে? আমি তো বলেছি মউকে আমি লিগালি অ্যাডপ্ট করে নেব। মউ এখন আমার মেয়ে।
দু পাশে ফাঁকা ফাঁকা জমি। এদিকটায় আলো কম, চাপ চাপ কুয়াশায় অন্ধকারে সাদা সাদা ছোপ।
আর একটা কি যেন প্রশ্ন পাক খেয়ে চলে কন্দর্পর মাথায়। কন্দর্প হাতড়াতে থাকে, কুয়াশার দিকে তাকায় বারবার। খুঁজে না পেয়ে অন্য প্রশ্ন করে, আমাকে একটা কথার উত্তর দেবে মিতা? তোমার মা দাদার যদি আপত্তি থাকে, তাহলে কি তুমি…
প্রশ্নই ওঠে না। মধুমিতার রিনরিনে স্বর চুড়ির আওয়াজের মতো শোনায়, আমার জীবন আমারই জীবন। অন্যের ফালতু খবরদারি আমি মানব কেন?
–তাহলে তুমি তাদের সঙ্গে কথা বলছ না কেন? আবার কেনই বা বলো তাদের না বলে কিছু করবে না?
উত্তর দেয় না মধুমিতা। কি যেন ভাবে। কি যেন একটা কথা আসি আসি করেও আটকে যায়। এ নারীর রহস্যের কূলকিনারা পায় না কন্দর্প। নিজেদের ভবিষ্যৎ তারা স্থির করে ফেলেছে, তবু যেন সবই ঘোর অনিশ্চিত। মাঝে একবার রেজিস্ট্রি করার কথা তুলেছিল কন্দর্প, মধুমিতা সম্মত হয়নি। শুধু বলে, তাড়া কিসের! একটা একটা করে যে দিন চলে যায়, প্রতিদিনই তিল তিল কমে যায় আয়ু, এ কথা কি মধুমিতা বোঝে না?
গাড়ি বাইপাসে ঢুকে পড়েছে। দু পাশের উগ্র দুর্গন্ধ হঠাৎ হঠাৎ ঝাপটা মারে নাকে। পথের দু ধারে সদ্য ফোঁটা ফুলকপি হাতে দাঁড়িয়ে আছে মেয়ে পুরুষ, ছায়া ছায়া। হেডলাইট জ্বেলে তীব্র গতিতে পাশ দিয়ে ছুটে যায় গাড়ি। পুব আকাশে চাঁদ উঠেছে। ডোঙা নৌকোর মতো ভাসছে চতুর্থীর চাঁদ। হিম পড়ছিল।
গাড়ি একটা ছোট্ট ব্রিজ পার হল। বাঁক নিয়ে ছুটছে সোঁ সোঁ। আলোকিত এক চৌরাস্তার মোড়ে এসে থেমে গেল। পুলিশ পথ আটকেছে। কোনও ভি আই পি বোধহয় ঢুকবেন সল্ট লেকে। পর পর গাড়ি দাঁড়াতে দাঁড়াতে ক্রমশ যানের মিছিল হয়ে গেল।
কন্দর্প নিরাশ মুখে সিগারেট ধরাল। মধুমিতা আচ্ছন্ন করে আছে মন, তবু মুস্তাফিও মাঝে মাঝে চোরা উঁকি দেয়। কাল সকালে অশোকদার লোক আসবে, টাকাটা যদি তখনই ফেরত পাঠিয়ে দেয় কন্দর্প! অত লাখ লাখ টাকা দেখলে বউদিই বা কী ভাববে! উঁহু, বউদি তখন থাকবে না। কিন্তু তিতির, কিংবা দাদা…! কন্দর্প জোরে জোরে সিগারেটে টান দিল। মধুমিতার দ্বন্দ্বটা কোথায়? কন্দর্পে অনাস্থা! তবে কেন…! অশোকদা ডাহা মিথ্যে বলল না তো! হয়তো কোনও একটা জটিল দুষ্কর্ম করিয়ে বেঁধে রাখছে কন্দর্পকে! মধুমিতার সঙ্গে পরামর্শ করবে? মেয়েদের বাস্তববুদ্ধি অনেক প্রখর হয়।
কন্দর্প মধুমিতার দিকে ঘাড় ঘোরাল। কথা বলতে গিয়ে বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে আছে। মধুমিতার আঁখি দুটি বোজা, জোর জোর শ্বাস নিচ্ছে। মধুমিতার ঠাণ্ডার ধাত। জানলার কাচ আধখানা তোলা, থেমে থাকা গাড়ির অন্দর ভরে গেছে পোড়া তামাকের ধোঁয়ায়। হাঁ করে যেন ধোঁয়া গিলছে মধুমিতা। দৃশ্যটা কী অপার্থিব! কে এই নারী!
কন্দর্প অস্ফুটে আবৃত্তি করে উঠল, এ যেন নিশিডাক, মৃতের হাতছানি। এ যেন কুহকের অজানা বীজ/ এমন মোহময় কিছুই কিছু নয়/ হৃদয় খুঁড়ে ভোলা মায়া-খনিজ।
মধুমিতা ফিসফিস করে বলল, কিছু বলছ?
কন্দর্পর স্বর প্রায় শোনা গেল না, তুমি ধোঁয়া খাচ্ছ কেন মিতা?
মধুমিতা আরও জোরে নিশ্বাস নিল, ভাল লাগছে।
কন্দর্প মধুমিতার মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ল, পাগলি। ধোঁয়া কি আদর?
–আদরই তো। মধুমিতা চোখ বুজেই হাসল, তুমি ঠিক দীপঙ্করের মতন। দীপঙ্করও এভাবেই ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ঘর ভরিয়ে দিত। কী ভাল যে লাগত!
কন্দর্পর মধ্যে দীপঙ্করকেই খুঁজছে মধুমিতা! তবে যে…! তবে যে…!