ষট্সপ্ততিতম অধ্যায় – বেতাল-ভৈরবের সিদ্ধিলাভ
ভগবান্ বলিলেন,–মন্ত্র শুদ্ধি দেখিয়াই উত্তম মন্ত্র গ্রহণ করিবে। অক্ষর ভেদে মন্ত্র চারি প্রকার–সিদ্ধ, সুসিদ্ধ, সাধ্য এবং শাত্রব। ১-২
আমি পূর্বে যে বর্ণক্রম বলিয়াছি, হে ভৈরব! প্রথমে উহা বিদিত হইয়া পরে আমার চক্র শ্রবণ কর। ৩
পূৰ্বে মুখাদি বর্ণের বৈষ্ণবী তন্ত্রসংজ্ঞক। ৪
যে মহামন্ত্র বলিয়াছি উহাতে যে সকল অক্ষর মূলীভূত, সেই সকল অক্ষর এবং তদ্ভিন্ন অন্য অক্ষরও বর্ধিত করিবে। ৫
অকার, ককার, চকার, টকার, তকার, পকার এবং যকার ইহারা বর্গের আদ্য অক্ষর বলিয়া পরিকীর্তিত হইয়াছে। ৬
আ, ঈ, ঊ, ঋ, ৯ এবং এ, ঐ, ও, ঔ, :, ং ইহারা দীর্ঘ বলিয়া খ্যাত হয়। ইহাদের হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদ দুইরূপ। ৭
অনন্ত এবং বয় এই সকলেরই স্বরূপ আমি পূৰ্বে নির্দেশ করিয়াছি। খ, গ, ঘ, এবং ঙ ইহার ব্যঞ্জনাদির মধ্যে ককারাদি বর্গ; ছ, জ, ঝ, ঞ ইহারা পর অর্থাৎ চকারাদি বর্গ, ঠ, ড, ঢক্কা শব্দের আদ্যক্ষর অর্থাৎ ঢ এবং ণ ইহারা টকারাদি তৃতীয় বর্গ। ৮
থ, দ, ধর্ম শব্দের আদি-ধ এবং নর শব্দের আদি-ন ইহারা চতুর্থ বর্গ। ৯
ফল শব্দের আদি ফ, বর্ণ শব্দের আদি ব, ভ এবং মন্ত্র শব্দের আদি ম। ইহারা পঞ্চম বর্গ। ১০
যকার, রকার, লকার এবং বকার এই চারি অক্ষরেই ষষ্ঠবর্গ। ১১
শ, ষ, স, হ এবং সংযোগ পরিবেদক ক্ষকার এই পাঁচটি অক্ষরে শেষ অর্থাৎ সপ্তমবর্গ কীর্তিত হইয়াছে। ১২-১৩
হে ভৈরব! মন্ত্রাদিতে বর্ণ সকল সংযোগ, অযোগ, লোম, প্রতিলোম এবং বাঙমাত্র হইয়া থাকে। বর্ণ সকল চতুৰ্ব্বর্গপ্রদ, সুখ ও দুঃখকর। ১৪
রোগ, তেজঃ, সম্পূজ্য এবং পূজক বলিয়া পরিকীর্তিত হয়। আমি বিষ্ণু, ব্ৰহ্মা, বেদমাতা গায়ত্রী এবং অপর ব্রহ্মবর্ণ ইহারা পরব্রহ্ম সুখদায়ক। ১৫-১৬
অপর ব্ৰহ্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা পরব্রহ্ম সুখলাভ করে। ১৭
ঈশ্বর জগত্রয়ের সিসৃক্ষু হইয়া আপনার ইচ্ছানুসারে বর্ণ সকলের সৃজন করিয়া আমার এবং ব্রহ্মার বক্ত্রে উহাদিগকে স্থাপিত করেন। ১৮
হে পুত্ৰ ভৈরব! আমি জ্ঞানমার্গের বর্ধন করিতে ইচ্ছুক হইয়া ঐ সকল বর্ণের বিন্যাস করিয়া অনেক শাস্ত্রের রচনা করিয়াছি। ১৯
আমি বর্ণের নিশ্চয়ের নিমিত্ত সেই সকল বর্ণের গণনা করিলাম। এক্ষণে মন্ত্রশুদ্ধির বিবেকের নিমিত্ত বর্ণচক্রের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি শ্রবণ কর। ২০
প্রথমে শক্তি এবং শম্ভু স্বরূপ রেখাদ্বয়ের বিন্যাস করিবে। তার মধ্য দিয়া পূর্বে বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীতলরূপ দুইটী রেখা অঙ্কিত করিবে। ঐ দুই রেখার মধ্যে সমানভাবে আর দুইটি রেখার বিন্যাস করিবে। ২১-২২
হে ভৈরব! ঐ চক্রের অরদেশে সংখ্যানুসারে রেখার অঙ্কন করিবে এবং অর মধ্যে চারিটি রেখার বিন্যাস করিবে। ২৩
এইরূপে ভেদ প্রাপ্ত অরদিগের আটটি সন্ধি কীৰ্তিত হইয়াছে এবং সন্ধিমধ্যে চারিটী নেমি অবস্থিত। ১৪
উত্তর মুখ হইয়া অষ্ট অরযুক্ত চক্রের বিন্যাস করিবে এবং পূর্বমুখ হইয়া চতুর্নেমিযুক্ত চক্রের অঙ্কন করিবে। বর্ণচক্র এইরূপে অঙ্কিত করিয়া বাহিরে একটি বেষ্টন দ্বারা ঘেরিবে। ২৫
এই চক্র দ্বারা মেষাদি রাশির উদয় পরিজ্ঞাত হওয়া যায় এবং ইহা শ্রীবৃদ্ধির কারক। ২৬
উত্তরমুখ বা পূৰ্বমুখে উপবিষ্ট, বিশুদ্ধ সমভূমিতে এইরূপ চক্র অঙ্কিত করিয়া ইষ্টগুরুকে প্রণাম করত বর্ণের বিন্যাস করিবে। ২৭
প্রদক্ষিণ করত উত্তর দিক হইতে ক্ৰমশঃ বর্ণের বিন্যাস করিবে। প্রথমে বকার বা ককার লিখিবে না। ২৮
হে সুরেশ্বরি! ঋকার এবং দীর্ঘ ঈকারেরও বর্জন। ঝ, ট, ঙ, ঞ, ণ বর্জিত অকারাদি ক্ষকারান্তবর্ণসমূহ প্রদক্ষিণক্রমে লিখিয়া আপনার নামের আদ্যক্ষর গ্রহণ করিবে। যে পর্যন্ত মন্ত্রের আদ্যক্ষর প্রাপ্ত না হয়, ক্রমশঃ গণনা করিবে এবং উহাতে সিদ্ধাদিরও যোগ করিবে। ২৯-৩০
আপনার নামের আদ্যক্ষর হইতে মন্ত্রের আদ্যক্ষর নবম, প্রথম বা পঞ্চম হইলে সিদ্ধ হয়, ষষ্ঠ, যুগ্ম বা দশম হইলে সাধ্য এবং তৃতীয়, সপ্ত বা একাদশ হইলে সুসিদ্ধ হয়। ৩১
দ্বাদশ, অষ্টম বা চতুর্থ হইলে শাত্রব বলিয়া গণ্য হয়। সিদ্ধ হইতে অচিরেই সিদ্ধি লাভ হয়, সাধ্য বহুকালে সিদ্ধিদায়ক। ৩২
শত্রু কামের বিনাশকারী এবং সুসিদ্ধও অচিরকালে সিদ্ধি প্রদান করে। ৩৩
মন্ত্রের দাক্ষিণ্য বিষয়ে এইরূপ বর্ণ ক্রম উক্ত হইয়াছে, এক্ষণে বাম্যারাধন মন্ত্রের ক্রম বলা যাইতেছে। ঋ হ্রস্ব-দীর্ঘ এই প্রকার ইকার, ঙ, ঞ, ণ, ন এবং ব, র, ষ বর্ণমন্ত্রবিৎ এই সকল বর্ণকে বর্ণচক্রে ক্রমশঃ লিখিবে। ৩৪-৩৫
নৃসিংহ, অর্ক, বরাহ, প্রাসাদ এবং প্রণব এই সকলের যে একাক্ষর বা দ্ব্যক্ষর বীজ আছে, তাহাতে সিদ্ধাদির চিন্তা করিবে না। ৩৬
হে ভৈরব! দীক্ষাৰ্থ সমুদয় বজেই সিদ্ধাদির চিন্তা করিবে, এবং যে মন্ত্রকে আবশ্যক বিবেচনা করিবে তাহাকেই গ্রহণ করিবে। সাধ্য এবং সিদ্ধির বিনিশ্চয়ে যাহা সুসিদ্ধ এবং কামপ্রদ হইবে, তাঁহারই গ্রহণ করিবে। ৩৭
পণ্ডিতেরা শাত্রব মন্ত্রের গ্রহণ করিবেন না, উহা গ্রহণ করিলে বিপৎ প্রাপ্ত হয়। যে বর্ণ যাঁহার একদেশ, উহা তন্নামক মন্ত্র বলিয়া প্রসিদ্ধ হয়। ৩৮
উহাও অর্ধচন্দ্র ও বিদ্যোগ করিলে বীজ বলিয়া বিখ্যাত হয়। যেমন শক্রের মন্ত্র শকার, উহা অর্ধচন্দ্র এবং বিন্দুযুক্ত হইলে বীজ বলিয়া কথিত হয়, এইরূপ অন্যত্র জানিবে। ৩১
সকল প্রকার মন্ত্রের উদ্ধারে পরে পরে অর্থাৎ অনুলোম ক্রমে গণনা করিতে হইবে। ৪০
কোন কোন মন্ত্রে পূর্ব হইতে পরে অর্থাৎ বিলোমক্রমেই গণনা হইয়া থাকে, বিশেষ উক্তি না থাকিলে পূৰ্বপক্ষই আশ্রয়ণীয়। ৪১
যেহেতু বৈষ্ণবীর ষোড়শ সহস্ৰ চক্ৰ দৃষ্ট হয়, এইজন্য চক্রকে ষোড়শ অরযুক্ত করিবে। ৪২
ত্রিপুরার মন্ত্র বিংশতি সহস্র, এই জন্য পণ্ডিতগণ ত্রিপুরার নিমিত্ত দ্বাবিংশতি অরযুক্ত চত্ৰু করিবে। ৪৩
ষোড়শ অরাদি চক্রই প্রধান চক্র, পণ্ডিত মন্ত্রশুদ্ধিবিষয়ে আরও অধিক রেখাদ্বারা চক্ৰ নিৰ্মাণ করিতে পারেন। ৪৪
হে পুত্র! তোমাকে এই অভীষ্টপদ মন্ত্রশুদ্ধির বিষয় বলিলাম। যে ইহা সম্যকরূপে জানে, সে জয়ী হইয়া সকল প্রকার অভীষ্ট লাভ করে। ৪৫
হে পুত্র বেতাল ও ভৈরব! ইহার প্রয়োগাদির প্রকার অতিরহস্য; আমি তাহাও সংক্ষেপে বলিতেছি শ্রবণ কর। ৪৬
পক্ষ বিড়ালের দন্ত উহার ত্বকদ্বারা পরিবেষ্টিত করিয়া বৈষ্ণবীর নির্মাল্যের সহিত উহাতে দ্বাদশসূত্র রজ্জুনিৰ্মিত গুণত্রয় বৈষ্ণবী মন্ত্রদ্বারা সম্মন্ত্রিত করিয়া পরিবেষ্টন করিবে। ৪৭
পরে উহা দক্ষিণ হস্তে গ্রহণ করিয়া অষ্টমীতে জিতেন্দ্রিয় হইয়া প্রথম হইতে বৈষ্ণবীর শত মন্ত্র জপ করিবে। ৪৮
অনন্তর সেই উত্তম যন্ত্র পণ্ডিতগণ দক্ষিণহস্তে ধারণ করিবেন। ঐ যন্ত্র ধারণ করিয়া কর্তা যদি তিন্তিড়ী ভোজন না করে, তাহা হইলে দ্বাদশ সিদ্ধি লাভ হয়; সংগ্রাম এবং বিবাদে জয় লাভ হয়, শরীর আরোগী হয়, রাজা এবং রাজপুত্র গণ বশীভূত হন; ভূত, প্রেত এবং পিশাচের দর্শন হয় না। ৪১-৫০
সমদ যোষিদবৃন্দ বশীভূত হয়, ছিদ্র সকল নষ্ট হয়। রুধির, শ্লেষ্মা ধাতু এবং তেজের স্তম্ভন হয় এবং চক্ষুর তেজ বৃদ্ধি হয়। ৫১
পক্ষ বিড়ালের মস্তকে হস্ত রাখিয়া বৈষ্ণবীতন্ত্রমন্ত্র তিনশত বার জপ করিয়া ঐ বিড়ালকে গৃহে স্থাপন করিবে। ৫২
হে ভৈরব! যে কুলাঙ্গনা ঐ বিড়ালকে দেখিবে, সে কদাপি পুত্রহীন হইবে না। ৫৩
সেইরূপ পক্ষ বিড়াল যে স্ত্রীর গৃহে অবস্থিত হয়, সে মৃতাপত্যা (মড়াঞ্চে) হইলেও তাঁহার গৃহে জীবৎ পুত্র হয়। ৫৪
কোকিলই হউক, ভৃঙ্গরাজই হউক, চকোরই হউক অথবা শুকই হউক, বৈষ্ণবীতন্ত্রোক্ত মন্ত্রধারা অভিমন্ত্রিত হইয়া যে গৃহে অবস্থান করে, তাঁহার প্রভাবে সে মন্দিরে কখন বিষ হয় না। ৫৫-৫৬
সে গৃহে সর্প প্রবেশ করে না, আর যদি কোনরূপে প্রবেশ করে, তবুও মনুষ্যকে দংশন করে না এবং সে গৃহে বন্ধ্যানারীও জন্মগ্রহণ করে না। ৫৭
পঞ্চমূর্তি চণ্ডিকাদেবীর পাঁচটি নির্মাল্য তাহাদিগের বলির মাংসের সহিত একত্র একটি স্থালীতে তিনদিন পাক করিয়া অষ্টমীতে সেই দেবীদিগের মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত জলদ্বারা উহার অভ্যুক্ষণ করিয়া পুনৰ্বার দেবীকে উহা নিবেদন করিয়া মনে মনে দেবীকে স্মরণ করিয়া যে মনুষ্য ভোজন করিবে, সে দীর্ঘায়ু, রোগহীন, তেজস্বী, শত্রুদমনকারী, কবি এবং বাগ্মী হয়। ৫৮-৬০
বৈষ্ণবীতন্ত্রমন্ত্রের যে আটটি অক্ষর আছে, উহাদিগকে ললাটে, মস্তকে,কণ্ঠে, বাহুদ্বয়ে, হস্ততলদ্বয়ে এবং হৃদয়ে কুঙ্কুমরস অথবা লাক্ষার সহিত ঘন চন্দন দ্বারা লিখিয়া মন্ত্রবিৎ পণ্ডিত মনুষ্য সংযত হইয়া অষ্টমীতে অথবা নবমীতে উক্ত প্রত্যেক স্থানে করন্যাস করিয়া মন্ত্রের আবর্তনপূর্বক আট আটবার জপ করিবে। তদনন্তর শিবার পূজন করিবে। ৬১-৬৪।
অনন্তর সেই দিনেই দেবীকে তিন জাতীয় তিনটি বলি প্রদান করিয়া সহস্র বার মন্ত্র জপ করিতে আরম্ভ করিবে। ৬৫
জপের অবসানে ঘৃত ভোজন করিয়া সংযত হইয়া রাত্রি যাপন করিবে। ৬৬
হে পুত্র! এইরূপ একবার করিলে যুদ্ধে অথবা শাস্ত্রবাদে কখন তাঁহার পরাজয় হয় না। ৬৭।
ক্ষত্রিয় রণকালে একবার এই বিধির অনুষ্ঠান করিয়া সকল যুদ্ধেই সর্বদা বিজয় লাভের নিমিত্ত মন্ত্রাক্ষর উক্ত স্থানে লিখিবে। ৬৮
ইহা যুদ্ধের অপর একটি অষ্টাঙ্গস্বরূপ অতি গুহ্য বলিয়া কীর্তিত হইয়াছে। এই গুহ্য অনুষ্ঠান দ্বারাই তুমি বিজয় লাভ করিবে। ৬৯
তোমাদের নিকট সকল প্রকারে গুহ্য হইতে গুহ্যতম সুখসম্পৎকর মন্ত্র যন্ত্র ও তন্ত্রের সহিত কীৰ্ত্তন করিলাম। ৭০
হে পুত্র বেতাল ও ভৈরব! যে অমৃত তুল্য মন্ত্র শ্রবণ করিবার নিমিত্ত দেবগণও সর্বদা অভিলাষ করেন, আমি তোমাদিগের নিকট তাঁহার কীৰ্ত্তন করিলাম। ৭১
হে পুত্র বেতাল ও ভৈরব! যে মনুষ্য এই সকল স্বরূপতঃ জ্ঞাত হয়, সে নিত্য সমুদয় অভিলাষ প্রাপ্ত হইয়া কৈবল্য লাভ করে। ৭২
যে মনুষ্য ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক কথ্যমান ইহাকে একবার মাত্র শ্রবণ করে, তাঁহার কোন রূপ বিঘ্ন হয় না এবং সে অপুত্রও হয় না। ৭৩
সে মনুষ্য দীর্ঘায়ুঃ, বলযুক্ত, নিত্য প্রমুদিত এবং কৃতী হয় এবং ইহলোকে সমুদয় অভিলষিত প্রাপ্ত হইয়া অন্তে দেবীলোক প্রাপ্ত হয়। ৭৪
তুমি নীলাচলনামক সেই পাঠস্থান কামরূপে গমন কর। ঐ স্থানে কুব্জিকা পীঠনামক কামাখ্যা দেবীর গুহ্য নিলয় আছে। ৭৫
যে স্থানে আকাশগঙ্গা আপনার জলদ্বারা ঐ স্থানকে অভিষিক্ত করিতেছেন, হে পুত্রদ্বয়; সেই স্থানে জগন্ময়ী মহামায়া দেবীর আরাধনা কর। সেই দেবী অচিরে প্রসন্না হইয়া তোমাদিগকে বর প্রদান করিবেন। ৭৬
ঔর্ব বলিলেন,–বৃষবাহন মহাদেব নিজ পুত্র বেতাল ও ভৈরবকে এই কথা বলিয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। ৭৭
অনন্তর সেই তপস্বী বেতাল ও ভৈরব নাটকশৈল পরিত্যাগ করিয়া ব্ৰহ্মার পুত্র মহাত্মা বসিষ্ঠের নিকট গমন করিল। ৭৮
তখন সন্ধ্যাচল গত সেই মহামুনি বসিষ্ঠ মহাদেবের পুত্র বেতাল ও ভৈরবকে উপস্থিত দেখিয়া শিষ্যের মত তাহাদিগকে সমাদর করিলেন। ৭৯
অনন্তর সেই বেতাল ও ভৈরব মহাত্মা বসিষ্ঠমুনির উপদেশ কামাখ্যাদেবীর আশ্রয় নীলনামক পৰ্বতে গমন করিল। ৮০
হে নরশার্দূল! মহাদেবের পুত্র মহাত্মা বেতাল ও ভৈরব সেই স্থানে গমন করিয়া ভৈরবনামক শিবলিঙ্গের নিকট অবস্থান করত আকাশগঙ্গায় অবগাহন পূৰ্ব্বক মৃত্তিকায় একটি উত্তম মণ্ডল নিৰ্মাণ করিয়া ও জগতের অধিষ্ঠাত্রী দেবী জগন্ময়ী মহামায়াকে বৈষ্ণবীতন্ত্র গোচর করিয়া মন্ত্র জপ করিয়াছিল। ৮১-৮৩
বেতালের সাধ্য সেই অষ্টাক্ষরাত্মক সিদ্ধমন্ত্রের তিনবর্ষে অষ্টলক্ষ জপ করিয়া তাহারা ভক্তিপূৰ্ব্বক চারিলক্ষ মন্ত্র জপের পর তিনবার করিয়া পাঁচটি পুরশ্চরণ করিয়াছিল। তাহারা সেই তিন বৎসরের মধ্যে পূজাবিষয়ে উত্তর তন্ত্র এবং কল্পে যাহা উক্ত হইয়াছে, তাহা সকলই করিয়াছিল। ৮৪-৮৫
কামাখ্যা, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য দেবীর একবার করিয়া পূজা করত বিধি পূৰ্ব্বক পীঠযাত্রা করিয়াছিল। ৮৬
এইরূপে সেই মহাদেবের পুত্রদ্বয় কবচ ধারণ ও ন্যাস করিয়া সুপ্রীত হইলে মহামায়া তাহাদিগকে অনুগ্রহ করিয়াছিলেন। ৮৭
তাহারা ধ্যানস্থ হইয়া মন্ত্র জপ এবং মনে মনে জগন্ময়ী দেবীর পূজা করিতেছে, এমন সময় মহামায়া শিবলিঙ্গ ভেদ করিয়া তাহাদের প্রত্যক্ষ হইলেন। ৮৮
লিঙ্গ হইতে দেবী নির্গত হইলে ঐ লিঙ্গ ভৈরব, ভৈরবী এবং হেরুক এই তিন প্রকারে বিভক্ত হইয়াছিল। বেতাল ও ভৈরব তখন সেই দেবীর মূর্তি দর্শন করিয়াছিল। ৮৯-৯০
সেই দেবীমূর্তি সৰ্বাঙ্গসুন্দরী, পীনোন্নত-পয়োধরা, বরদাভয়হস্তা, সিদ্ধ সূত্ৰধারিণী, রক্তপদ্ম-সদৃশ আভাযুক্ত শ্বেতবর্ণ, প্রেতাসনসংস্থিত এইরূপ দেবীমূর্তি দর্শন করিয়া সেই বেতাল ও ভৈরব নেত্ৰ নিমীলন করিয়া বারংবার ‘মহামায়ে ত্রাহি ত্রাহি’ বলিতে লাগিল। ৯১-৯৩
অনন্তর তাহারা মহামায়ার তেজে আপ্যায়িত হইলে সেই বৈষ্ণবী দেবী হস্তের অগ্রভাগ দ্বারা তাহাদের দুজনকে স্পর্শ করিলেন। ৯৪
সেইরূপ তেজে আপ্যায়িত বেতাল ও ভৈরব মনুষ্যত্ব পরিত্যাগ করিয়া দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়াছিল। ৯৫
তাহারা দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়া স্তুতি ও প্রণতি করিয়া জগন্ময়ী মহামায়া শিবার স্তব করিয়াছিল। ৯৬
তাহারা বলিয়াছিল, হে সুরগণাচ্চিত-পাদপঙ্কজে! বিশ্ব-বিভূতিভাবিনি! দেবি! আপনার জয় হউক, আপনার জয় হউক, হে শোকমোচন বন্ধমোচন পাপশাতন শুদ্ধমতে! দেবি! আমাকে কৃপা বিতরণ করুন। ৯৭-১০১
হে দেবি! আপনি সৰ্ব্ববিদ্যাত্মিকা, গুহ্যরূপা, মন্ত্রতন্ত্রময়ী, শিবা, মহামায়া এবং লোকে ও বেদে কীৰ্তিত আপনাকে নমস্কার করি। ১০২
আপনি পরাপরাস্বরূপা, শুদ্ধা, এক সাধ্যাধারে সংস্থিতা, কামাহ্লাদকরী, কান্তা এবং জগন্ময়ী আপনাকে নমস্কার করি। ১০৩
হে রক্তাঙ্গি দেবি! আপনি এই প্রপঞ্চ পর সুব্যক্ত জগতের এক মাত্র নিবন্ধন হেতু তত্ত্বরূপা আপনাকে নমস্কার করি। ১০৪
হে দেবি! আপনি কামাখ্যা, নিত্যরূপা, মহামায়া সরস্বতী বিষ্ণুর বক্ষঃস্থলস্থিত লক্ষ্মী, উদ্যমশালিনী এবং শিবরূপা, আপনাকে নমস্কার। ১০৫
যে ষোড়শ সহস্র মন্ত্র ও তাঁহার তন্ত্র আছে, আপনি সেই সকলের স্বরূপ; হে পাৰ্বতি! আপনাকে আমার নমস্কার। ১০৬
জগৎপ্রসবিনী মহামায়া তাহাদের দুইজন কর্তৃক এইরূপে স্তুত হইয়া পরম আনন্দিতচিত্তে বলিলেন, তোমরা দুজনে বর প্রার্থনা কর। ১০৭
অনন্তর সেই মহাদেবের পুত্রদ্বয় মহামায়া দেবীকে ধ্যানে যেরূপ দেখিয়া ছিল, সেইরূপ প্রত্যক্ষ দেখিয়া বলিতে লাগিল। ১০৮
বেতাল এবং ভৈরব বলিল,-হে দেবি! আমরা এই বর্তমান দেহেই যাবৎ চন্দ্র ও সূৰ্য বৰ্ত্তমান থাকিবে, তাবৎ আপনার এবং শঙ্করের শাশ্বত সেবা প্রার্থনা করি। ১০৯
হে মহামায়ে জগন্ময়ি! আমরা আপনার নিকট হইতে আর অন্য বরের প্রার্থনা করি না। যেন আপনার ভক্ত হইয়াই এই গিরিমন্দিরে স্থিতি করিতে পারি। ১১০
জগন্ময়ী মহামায়া দেবী তাহাদের দুইজন কর্তৃক এইরূপে উক্ত হইয়া বারংবার এইরূপ হউক এইরূপ হউক, বলিতে লাগিলেন। ১১১
সেই শিবদায়িনী জগদ্ধাত্রী দেবী এই কথা বলিয়া নিজের স্তনদ্বয়ের অগ্রভাগ নিষ্পীড়ন করিয়া দুইটি দুগ্ধধারা নিঃসারিত করিলেন। ১১২
হে মহারাজ! সেই নিঃসৃত দুগ্ধ বেতাল এবং ভৈরবকে পান করিতে বলিলেন এবং তাহারাও উহা পান করিল। ১১৩
বেতাল ও ভৈরব সেই দুগ্ধ পান করিয়া শাশ্বত দেবত্ব প্রাপ্ত হইয়া মহা তেজস্বী, অজর এবং অমর হইয়াছিল। ১১৪
ভগবতীর স্তন্যদুগ্ধই অমৃত, তাহা পান করিয়া সেই মহাবল বেতাল ও ভৈরব অমৃতপায়ী হইয়াছিল। ১১৫
তখন বৈষ্ণবী দেবী তাহাদিগকে বলিয়াছিলেন,–হে পুত্রদ্বয়! তোমরা দেব দেব মহাদেবের গণের অধীশ্বর হইয়া নন্দীর ন্যায় নিত্য আসন্নদ্বারস্থিত হও। ১১৬
ঔৰ্ব বলিলেন,–মহাদেবের সম্মতিক্রমে জগন্ময়ী মহামায়া এই কথা বলিয়া যোগিনীগণে পরিবৃত হইয়া সেই স্থানেই অন্তর্হিতা হইলেন। ১১৭
ভগবতী অন্তর্হিতা হইলে সেই বেতাল ও ভৈরব আনন্দিত, অতিশয় প্রীত এবং কৃতকৃত্য হইয়াছিল। ১১৮
অনন্তর পুত্র বেতাল ও ভৈরবকে সভাজন করিবার নিমিত্ত ভগবান হর, প্রমথ ও দেবগণের সহিত সেই স্থানে আগমন করিয়াছিলেন। ১৯৯
মহাদেব নীলনামক পৰ্বতে বেতাল ও ভৈরবকে প্রাপ্ত হইয়া সমূদয় পীঠ স্থান এক এক করিয়া দর্শন করাইয়াছিলেন। ১২০
প্রথমে মনোভবা কামাখ্যার গুহা দেখাইয়া, তাঁহার পর নিজের কাম গুহা, ছায়া, ছত্র, স্বকীয় আলয় দেখাইয়াছিলেন। ১২১
স্বকীয় পঞ্চমূর্তির সংস্থানও দেখাইয়াছিলেন। অনন্তর ত্রিপুরান্তকারী মহাদেব সেই বেতাল ও ভৈরবকে ক্ৰমশঃ কামরূপস্থ সমুদয় পীঠ-দেবতা একে একে দেখাইয়াছিলেন। ১২২
প্রথমে দক্ষিণ সমুদ্রগামিনী, পুণ্যতোয়া শুদ্ধা সদা শিবদায়িনী করতোয়া নাম্নী সত্যগঙ্গা দেখাইয়াছিলেন। ১২৩
ষট্সপ্ততিতম অধ্যায় সমাপ্ত। ৭৬