বউবাজারের বাড়ি থেকে থিয়েটারে যাবার সোজা পথ ছেড়ে নয়নমণি প্রায়ই ঘুরপথে যায়। এখন তার একলার জন্যই গাড়ি আসে, অন্য অভিনেত্রীদের তুলতে হয় না। নয়নমণি সহিসকে বলে, রহমত মিঞা, চিৎপুরের রাস্তা দিয়ে চলো। গাড়ির জানলা দিয়ে সে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। কী দেখে সে? নয়নমণি নিজেই বোঝে যে, দিন দিন এটা তার বাতিকের মতন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সে যাঁর দেখা পেতে চাইছে, এ ভাবে তাঁর দর্শন পাওয়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। তবু হৃদয় সব সময় যুক্তি মানে না, মানুষ অসম্ভবকে সম্ভব করতে চায়। নয়নমণির আশা, কোনও না কোনওদিন জোড়াসাঁকোর গলি দিয়ে বেরিয়ে আসবেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সে তাঁকে এক ঝলক অন্তত দেখে চক্ষু সার্থক করবে।
রবীন্দ্রনাথ যে স্ত্রী বিয়োগের পর বছরের বেশির ভাগ সময়ই আর এ বাড়িতে থাকেন না, সে খবর জানে না নয়নমণি। সে রবীন্দ্রনাথের রচনাগুলি বারবার পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছে, জোড়াসাঁকোর প্রাসাদটিও সে দূর থেকে দেখেছে। সে মনে মনে কল্পনা করে, ওই বাড়ির কোনও নিভৃত কক্ষে বসে রবীন্দ্রনাথ ওই সব অমূল্য কবিতা, গান, গল্পগুলি লিখে যাচ্ছেন।
রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি গান সে সরলা ঘোষালের কাছ থেকে শিখে নিয়েছে। থিয়েটারে এই সব গান চলে না, কিন্তু নয়নমণি একা একা এই গান গেয়ে গভীর আনন্দ পায়। গান গাইবার সময় তার চোখ বুজে আসে, মনশ্চক্ষে সে দেখতে পায় গানের স্রষ্টাকে।
ভরতকে সে ভুলে যায়নি। ভরতের সঙ্গে আর দেখা যোক বা না হোক, তার জীবনে আর কোনও পুরুষের স্থান নেই। সে ধরেই নিয়েছে ভরতের সঙ্গে তার আর দেখা হবে না। সরলা ঘোষালের কক্ষে একদিন সেই আকস্মিক সাক্ষাঙ্কার, ভরত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, কথা বলতে ঘৃণা বোধ করেছে। খুব সম্ভবত নয়নমণিকে এড়াবার জন্যই সরলা ঘোষালের কাছে আর কখনও আসেনি ভরত। ও বাড়িতে বিভিন্ন ব্যক্তিদের আলাপ-আলোচনা শুনে নয়নমণি বুঝতে পেরেছে যে, ভরত কোনও গুপ্ত দলের সঙ্গে জড়িত। সেই দলটিকে সরলা ঘোষালও আর পছন্দ করে না, ওরা বন্দুক পিস্তলের কারবার করে। ভরতকে সে যে-ভাবে দেখেছে, তাতে তার এই ভূমিকা যেন কল্পনাও করা যায় না। সে ভরত যা-ই করুক, তার বিচার করতে চায় না নয়নমণি, ভরত তাকে ভুলে যায় যাক, তবু একবার ওই ভরতকে সে তার হৃদয় সমর্পণ করেছিল, দ্বিতীয় আর কারুকে সে হৃদয় দিয়ে দ্বিচারিণী হতে পারবে না।
তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যই এই ব্যাকুলতা কেন? তিনি কোনওদিন জানতে পারবেন না। তবু তো তাঁকে মন-প্রাণ সব দিয়ে চায় নয়নমণি! অনেক ভেবে ভেবে নয়নমণি এর একটা উত্তরও খুঁজে পেয়েছে। কোনও নারী যখন নিবিষ্টভাবে তার দেবতার আরাধনা করে, তখন কি, সে তার স্বামী বা দয়িতকে ভুলে যায়? নারীর দেহ-মন সব কিছুরই মালিক তার স্বামী, তারপরেও দেবতাকে সর্বস্ব উজাড় করে দেওয়া যায়। এ হল ভাব-সর্বস্ব, যাতে বস্তু জগতের কোনও ছোঁয়া নেই। নারীর জীবনে তার স্বামী বা একজন পুরুষ থাকার যেমন প্রয়োজন, তেমনই একজন দেবতা থাকারও প্রয়োজন। পুরুষ তাকে পরিত্যাগ করতে পারে, কিন্তু দেবতা যেহেতু কখনওই কাছে আসবেন না, তাই পরিত্যাগেরও প্রশ্ন নেই। একা একা সেই দেবতার কথা চিন্তা করে, তাঁকে হৃদয়ের ব্যথার কথা নিবেদন করেই অনেক পরিশুদ্ধ হওয়া যায়। আগে নয়নমণি শ্রীকৃষ্ণের মূর্তির সামনে ধ্যান করত, এখন রবীন্দ্রনাথই তার জীবন্ত দেবতা।
দেবতা কখনও কাছে আসবেন না জেনেও একটা দুর্বলতা কিছুতেই দূর করা যায় না। একবার অন্তত চর্মচক্ষে দেখতে ইচ্ছে করে। নয়নমণির সেই অভাবনীয় সৌভাগ্য ঘটে গেল।
রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন রচনাগুলি পড়ার জন্য নয়নমণি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকাটির গ্রাহক হয়েছিল। সেখানে কবির অনেক কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, মজার রচনা থাকে এবং ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস। প্রতি মাসের কিস্তি পড়ার জন্য সে অধীর হয়ে থাকে, কোনও মাসে পত্রিকা প্রকাশে দেরি হলে যেন তার দিন কাটতে চায় না। এই উপন্যাসটি ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে পূর্ণ। কোথায় গিয়ে শেষ হবে কে জানে! রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটি তার অতি প্রিয়, কতবার যে পড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। মহেন্দ্র ও বেহারী এই চরিত্র দুটির সঙ্গে সে যেন শশিভূষণ ও ভরতের মিল খুঁজে পায়। তবে কি সে বিনোদিনী? না, না, তা কেন হবে, সে অতি সামান্যা নারী। মহেন্দ্র ও বেহারীর মতন মানুষ সে আরও দেখেছে, সরলা ঘোষালের বাড়িতে খুব বেশি।
একদিন সে অমর দত্তকে বলেছিল, রবিবাবুর ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়ে স্টেজে নামানো যায় না?
অমর কয়েক পলক তাকিয়ে ছিল নয়নমণির মুখের দিকে।
ক্লাসিক থিয়েটারে বিপর্যয় শুরু হয়ে গেছে। নিজ দোষে অমর দত্ত দ্রুত ডেকে আনছে তার পতন। বয়েস বাড়লেও তার মধ্যে এখনও একটি বেহিসেবি, বেপরোয়া বালক রয়ে গেছে, লোকে যাতে তা না বুঝতে পারে তাই যখন তখন সে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাক্য ও কটুক্তি করে সেটাকে চাপা দিতে চায়। তার আত্মম্ভরিতায় অনেকে যেমন বিরক্ত, অনেকে আবার সেই সুযোগে সামনা সামনি অতিরিক্ত চাটুকারিতা করে আড়ালে তার সর্বনাশ করতে চায়। কয়েক বছরের অসাধারণ সাফল্যে সে মাথার ঠিক রাখতে পারেনি। বরাবরই আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করার দিকে তার ঝোঁক, দানের ব্যাপারেও তার কার্পণ্য নেই। অনেক চাটুকার মিথ্যে কথা বললেও তার কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়ে যায়।
মিনার্ভা থিয়েটারের অবস্থা সে সময় খারাপ হয়ে পড়ার পর অমর দত্ত সে থিয়েটার চালাবারও ভার নিয়ে নেয়। একসঙ্গে ক্লাসিক ও মিনার্ভা দুটি থিয়েটার চালাবার দৃষ্টান্ত আগে আর নেই। অমর সকলকে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার একার পক্ষে দুটি জায়গায় সর্বক্ষণ নজরদারি করা সম্ভব নয়, নির্ভর করতে হয় কর্মচারীদের ওপর, তারা টাকাপয়সা সরিয়ে ফাঁক করে দিতে লাগল। মিনার্ভায় শুধু ক্ষতির পর ক্ষতি, ক্লাসিকের লভ্যাংশ দিয়ে মিনার্ভা চালাবার চেষ্টা করেও সুফল হল না। অচিরকালের মধ্যেই ভরাডুবি হল মিনার্ভার। অমরের প্রচুর অর্থদণ্ড গেল। রিত
এক বিপদ যেন আর এক বিপদকে টেনে আনে। মিনার্ভার ক্ষতি সামলে নেবার জন্য ক্লাসিকে সাড়ম্বরে নামানো হল গিরিশবাবুর নতুন নাটক ‘সনাম। ঐতিহাসিক নাটক, প্রচুর ব্যয়বহুল সেট ও সাজসজ্জা। হিন্দুদের কাছে বহু নিন্দিত, সম্রাট ঔরঙ্গজেব এই নাটকের কেন্দ্ৰচরিত্র। তিন-চার রাত্রি চলার পরই হঠাৎ এক সন্ধ্যায় কয়েক হাজার লোকের এক উত্তেজিত জনতা এসে ঘিরে ধরল ক্লাসিক থিয়েটার। তারা সবাই মুসলমান, কুদ্ধ কণ্ঠে তারা দাবি জানাতে লাগল, এই নাটকে মুসলমানদের সম্পর্কে কুৎসা ছড়ানো হয়েছে, অবিলম্বে বন্ধ না করলে তারা থিয়েটারে আগুন ধরিয়ে দেবে। দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায় আর কি! অবিলম্বে পুলিশ এসে দাঁড়াল মাঝখানে। অমর দত্ত রঙ্গালয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে ‘সত্যম নাটক বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত জানাল।
‘সৎনাম’ গেল, তার সঙ্গে জলাঞ্জলি গেল বহু টাকা। এর পরেও কোনও নাটক আর জমতে চায় না। ও দিকে স্টার আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। হস্তান্তরিত মিনার্ভাতেও শুরু হয়েছে নাটক। অমর বারবার নাটক বদল করেও দর্শক টানতে পারছে না। তখন সে দর্শকদের উপহার দিতে শুরু করল। বই উপহার। একখানা টিকিট কাটলেই সেই দর্শক ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলি বা মধুসূদন গ্রন্থাবলি বা গিরিশচন্দ্র গ্রন্থাবলি উপহার পাবে। প্রথম প্রথম একটি বই, তারপর একাধিক। দর্শকদের ভারী মজা, টিকিটের দামের চেয়ে উপহার পাওয়া বইয়ের দাম অনেক বেশি। কেউ কেউ টিকিট কিনে উপহারের বইগুলি নিয়ে বাড়ি চলে যায়, নাটক দেখতে ঢোকে না।
ক্ষতি সামলাবার জন্য অমর দত্ত চতুর্দিকে ধার নিতে লাগল। দু এক বছর আগেও যে অমর দত্ত ধনকুবেরের মতন মুঠো মুঠো টাকা ছড়াত, এখন সেই তাকেই অন্যের কাছে হাত পাততে হয়। এবং ঋণ ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
এই রকম দিশেহারা অবস্থায় অমর যখন বারবার নাটক বদলাচ্ছে, তখন নয়নমণির প্রস্তাব শুনে সে উড়িয়ে দিতে পারল না। নয়নমণির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার মন আর্দ্র হয়ে এল। ফুটো জাহাজ ছেড়ে যেমন অনেকেই পালায়, সেই রকমই অমরের বিপদের সময় অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রীই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। চতুর্দিকে পাওনাদার। কিন্তু নয়নমণি অন্য থিয়েটার থেকে বারবার প্রলোভনের ডাক পেয়েও যায়নি। অমর তাকে তিন চার মাসের বেতন দিতে পারেনি, নয়নমণি মুখ ফুটে একবারও সে কথা উচ্চারণ করে না।
অমর অস্ফুট স্বরে বলল, চোখের বালি, চোখের বালি! দেখা যাক, তোর কথা মতন যদি এই নাটকে টিকিট ঘর চাঙ্গা করা যায়।
গিরিশবাবুর ওপর নাট্যরূপের ভার দেওয়া হল। এ উপন্যাস সম্পর্কে গিরিশবাবু খুব একটা উৎসাহী নন। তিনি দু-চার পাতা লিখলেন বটে, কিন্তু তারপরই শুরু হয়ে গেল অন্য গোলমাল। গিরিশবাবু তাঁর পাওনা টাকা দাবি করতে লাগলেন। তাঁর তিন মাসের বেতন নশো টাকা মিটিয়ে না দিলে তিনি আর কোনও কাজে হাত দেবেন না।
অমর দত্ত নিজেই দ্রুত নাট্যরূপ দিয়ে রিহার্সাল শুরু করে দিল। এই সব পেশাদারি মঞ্চে সাতদিনের মধ্যে নতুন নাটক নামিয়ে দেওয়া হয়। নট-নটীরা কেউই পুরো পার্ট মুখস্থ করে না, নির্ভর করে প্রমটিং-এর ওপর। অনেক সময় প্রমটিং এত জোরে জোরে হয় যে, দর্শকরাও শুনতে পেয়ে যায়। নয়নমণির এটা পছন্দ নয়। সে নিষ্ঠার সঙ্গে, বাড়িতে রাত জেগেও সব সংলাপ মুখস্থ করে।
নয়নমণি খুব আশা করেছিল, মহড়ার সময় গ্রন্থকার রবীন্দ্রবাবু একবার অন্তত আসবেন। যেমন তিনি এসেছিলেন অনেকদিন আগে। কিন্তু তিনি এলেন না।
হুড়োহুড়ি করে চোখের বালি মঞ্চস্থ করা হল। নতুন নাটকের কথা লোকের মুখে মুখে ছড়াবার জন্য সময় দিতে হয়, প্রথম কয়েক রাত দর্শক সংখ্যা কম থাকে। কিন্তু সে সময় পাওয়া গেল না। পাওনাদাররা মামলা ঠুকে দিল অমরেন্দ্রনাথের নামে। অনেক দিনের বাড়িভাড়া বাকি পড়ে আছে, সে বাবদে উচ্ছেদের নোটিস জারি হয়ে গেল। অমর দত্তকে ঋণ দেবার মতনও আর কেউ নেই।
ক্লাসিক থিয়েটারের মালিকানা অমর দত্তর হস্তচ্যুত হয়ে গেল! কিছুদিন পরে অমর আবার ক্লাসিকে ফিরে এল বটে, কিন্তু বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে। তার মাইনে পাঁচশো টাকা। নতুন মালিকরা তাকে এত বেশি মাইনে দিতে রাজি হয়েছে এই শর্তে যে, তাকে লাভ দেখাতে হবে। ভাঙা দল আবার গড়ে তোলার চেষ্টা করল অমর, গিরিশবাবু, দানী, তিনকড়ির মতন খ্যাতিমানরা অন্য থিয়েটারে যোগ দিয়েছে, পুরনোরা প্রায় কেউই নেই, নয়নমণি ছাড়া। মাঝখানে যখন ক্লাসিক বন্ধ ছিল, সে বাড়িতে বসে ছিল। অমর তাকে নিজে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে এসেছে।
নয়নমণির ব্যবহারের কুলকিনারা পায় না অমর। নাচ, গান, অভিনয়, এই তিনটির জন্যই নয়নমণির খুব কদর, বিশেষত তার মতন নৃত্য পটিয়সী কোনও মঞ্চেই আর নেই। স্টার নয়নমণিকে পাবার জন্য খুব ব্যর্থ, তা অমর ভাল করেই জানে, গিরিশবাবুও তাঁর নতুন নাটকের জন্য একজন নর্তকী-অভিনেত্রী খুঁজছেন, তবু গেল না কেন নয়নমণি? এই ক মাস তার উপার্জন বন্ধ ছিল, তবু গেল না? সে জানত, অমর দত্ত আবার ফিরে আসবে? অথচ অমর বার বার চেষ্টা করেও নয়নমণিকে তার নর্সঙ্গিনী করতে পারেনি। সবাই জানে, অমর দত্তর সঙ্গে নয়নমণির পিরিত নেই, বরং মাঝেমাঝেই ঝগড়া হয়, তবু ক্লাসিকের প্রতি তার এত টান কেন? দুর্জ্ঞেয় নারী চরিত্র!
৫
* হালকা রঙ্গরসের নাটক নামিয়ে দর্শক আকৃষ্ট করার চেষ্টা করল অমর। কিন্তু ক্লাসিক যেন এখন ভাঙা হাট, দর্শকরা ছুটছে স্টারে, মিনার্ভায়। উদ্বেগে, অস্থিরতায় চুল ছিঁড়ছে অমর! তখন নয়নমণি আবার অমরকে বলল, চোখের বালি’ নাটকটা তো আমরা ঠিকমতন শুরু করতেই পারিনি, এখন সেটা আবার অভিনয় করা যায় না!
অমর নয়নমণিকে দু হাতে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে উচ্ছ্বসিতভাবে বলল, বেশ কথা! তুই আমার লক্ষ্মী, নয়ন! তোর কথা কি আমি ঠেলতে পারি? দেখি, ওই নাটক দিয়েই যদি ক্লাসিকের গৌরব ফেরানো যায়।
অমরের স্পর্শ বাঁচিয়ে দূরে সরে গিয়ে নয়নমণি বলল, ‘প্রেমের পাথার’, ‘প্রণয়-পরিণাম’, ‘প্রণয় না বিষ’ ধরনের নাটকগুলো একঘেয়ে হয়ে গেছে। ‘চোখের বালি’ অন্যরকম, ঠিকমতন করতে পারলে লোকে নতুন একটা স্বাদ পাবে।
অমর বলল, আমি মহেন্দ্র, তুই বিনোদিনী, আমরা দুজনেই অ্যাকটিং-এ ফাটাব, আর যারা আছে কাজ চালিয়ে দেবে। আজ থেকে মহড়া শুরু হোক!
এবারেও প্রথম রাতে অর্ধেক আসনের বেশি ফাঁকা রইল। অমর দত্তর নামের জাদু আর লোক টানছে না? তবু ধৈর্য ধরতে হবে। দ্বিতীয় রাতে অভিনয় শুরু হবার আগে অমর দত্ত বারবার গিয়ে টিকিট ঘরে খোঁজ নিয়ে আসছে। বিক্রি কিছু বেড়েছে, তবু আশানুরূপ নয়। মালিকপক্ষের লোক শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে সেখানে বসে আছে, চোখাচোখি হলেই অমরের অস্বস্তি হয়। থার্ড বেল পড়ে যায়, তবু অমর মেক আপ নেয়নি, প্রায় জোর করে তাকে টেনে আনা হল সাজঘরে।
পাঁচ অঙ্কের নাটক, দ্বিতীয় অঙ্কের শুরুতে জানা গেল, কাহিনীকার রবীন্দ্রনাথ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে অভিনয় দেখতে এসেছেন। তা শোনামাত্র বুক কাঁপতে লাগল নয়নমণির। তিনি এসেছেন! প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার থাকে, তাঁকে নয়নমণি দেখতে পাবে না, কিন্তু তিনি দেখবেন নয়নমণিকে। আজ নয়নমণি তার দেবতার কল্পনার নারী।
কত রাজা-মহারাজ, কত সাহেবসুবো আসে অভিনয় দেখতে, নয়নমণি বিচলিত হয় না। আজ তো তার বুক কাঁপলে চলবে না, আজ তাকে সমস্ত মন-প্রাণ একাগ্র করে অভিনয় করতে হবে। তবু নাটক ঠিক যেন জমছে না। অমর দত্ত বড় অস্থির, চঞ্চল, বারবার সে অন্ধকারের মধ্যেও দেখার চেষ্টা করছে, দর্শকদের আসন কতগুলি পূর্ণ হয়েছে। দুবার সে পার্ট ভুলে গেল, উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে প্রমটিং শোনার চেষ্টা করল।
শেষ হবার পর অবশ্য হাততালি পাওয়া গেল যথেষ্ট।
অমর দৌড়ে ডেকে আনল রবীন্দ্রনাথকে। বারবার বলতে লাগল, আপনি কেন খবর দিয়ে আসেননি। আপনাদের জন্য বক্স-এর ব্যবস্থা করে রাখতুম।
অমর আগে কয়েকবার আমন্ত্রণ জানিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ আসার সময় পাননি। আজ এ পাড়াতেই একটি সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন, তারপর চলে এসেছেন।
মঞ্চের পেছনে সিংহাসনের মতন একটি চেয়ারে বসানো হল রবীন্দ্রনাথকে। প্রথা অনুযায়ী সব নট-নটীকে এনে পরিচয় করে দেওয়া হচ্ছে তাঁর সঙ্গে। সকলেই একে একে প্রণাম করে যাচ্ছে, নয়নমণি আর আসতেই চায় না। কী যে লজ্জা পেয়ে বসেছে তাকে। আড়াল থেকে দেখছে ওই দেবদুলভ রূপ, এই দেখাই তো যথেষ্ট, কাছে যাবার দরকার কী? কাছে গেলেই উনি যদি বুঝে ফেলেন যে, নয়নমণি প্রতিনিয়ত ওঁর কথাই চিন্তা করে? লেখকরা তো অন্তর্যামী হন!
অমরের হাঁকডাকে নয়নমণিকে কাছে আসতেই হল। পদ স্পর্শ করল না, সে অধিকারও তার নেই। একটু দূরে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সে প্রণাম জানাল রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথ কিছুটা যেন অন্যমনস্ক। নাটক দেখে তিনি যেন একটু হতাশই হয়েছেন। অন্যরা তবু চলনসই, কিন্তু অমর দত্ত যেন মহেন্দ্রর চরিত্রটা ধরতেই পারেনি। মহেন্দ্রর প্রকৃতি অতি প্রবল, তার প্রণয়ে মিশে আছে উগ্রতা, কিন্তু সে দুশ্চরিত্র নয় কোনওক্রমেই। মুখে অবশ্য রবীন্দ্রনাথ সে সব বললেন না, অতিশয় ভদ্রতায় সকলকেই প্রশংসা করলেন, নয়নমণিকে তিনি আলাদাভাবে লক্ষ করলেন না। শুধু অমর দত্তকে একবার বললেন, তুমি মহেন্দ্রকে যে রূপ দিয়েছ, তা অবশ্যই ভাল হয়েছে, তবে একটু অন্যরকমভাবেও তাকে চিন্তা করা যায়। বিনোদিনীর সঙ্গে কথা বলার সময় কণ্ঠস্বর অতটা উঁচুতে না তুলেও…
রবীন্দ্রনাথ যে নয়নমণির দিকে বিশেষ মনোযোগ দিলেন না, বা একটাও কথা বললেন না, তাতেই নয়নমণি স্বস্তি পেল। সে তো অন্তরালবর্তিনীই থাকতে চায়। তবু যে চোখের দেখাটুকু হয়েছে, তাতেই সে ধন্য। সারা রাত তার ঘুম এল না।
এবারেও ‘চোখের বালি’ ক্লাসিক-এর ভাগ্য ফেরাতে পারল না। সমালোচকদের মতে এ কাহিনীতে নাটকীয় সংঘাত নেই। নয়নমণি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করছে, কিন্তু অমর তার আগেকার প্রতিভার পরিচয় দিতে পারছে না। প্রচুর অর্থব্যয়ের বিলাসিতা ও অহঙ্কারের মধ্যেই তার প্রতিভা খোলে। আগে সে ছিল এই থিয়েটারের মালিক, এখন কর্মচারী, এই হীনমন্যতা সে কিছুতে সহ্য করতে পারে না। টিকিট বিক্রির চিন্তায় যতই সে উতলা অস্থির হয়ে পড়ছে, ততই খারাপ হচ্ছে তার অভিনয়। সেটা যখন সে বুঝতে পারছে, তখন নিজের ওপর রাগ করে বাড়িয়ে দিচ্ছে মদ্যপান। রাত্রি জাগরণ ও অত্যাচারে তার শরীরও আর বইছে না।
আগে সে কখনও অভিনয়ের আগে বা মধ্যখানে মদ স্পর্শ করত না। অন্যদেরও সে নিখুঁত শৃঙ্খলা মানিয়ে চালাত। এখন সে সন্ধে হতে না হতেই লুকিয়ে লুকিয়ে মদ খায়, এক একটি অঙ্কের মাঝখানে বোতল থেকে কাঁচা মদ গলায় ঢালে, শেষের দিকে তার কথায় জড়তা এসে যায়, তা ঢাকবার জন্য তাকে বারবার কাশতে হয়।
একদিন অভিনয়ের শেষে সে নয়নমণিকে বলল, তুই আমার ঘরে আয়, তোর সঙ্গে কথা আছে!
টেবিলের ওপর পা তুলে বসল সে, হাতে মদের বোতল। সামনে চেয়ার থাকলেও তাতে বসল না নয়নমণি, দাঁড়িয়ে রইল। মেক আপ মোছেনি সে, সাদা থান পরা, বিনোদিনীর বিধবার বেশ।
অমর বলল, কী রে নয়ন তোর কথা শুনে চোখের বালি চালিয়ে কী লাভ হল? লবডঙ্কা! বক্স অফিসে বসে কেবলরাম মাছি তাড়াচ্ছে। আজ কত বিক্রি হয়েছে জানিস, একশো সাতাশি টাকা! তাতে আমার ইয়ে… হবে!
অমর জানে নয়নমণি অশ্লীল কথা পছন্দ করে না, কিন্তু আজ সে কিছুই গ্রাহ্য করছে না। দর্শক সংখ্যা না বাড়লে যে অমরকে আরও অপমান সহ্য করতে হবে, তা নয়নমণি বোঝে। সে মৃদুস্বরে বলল, সেটা তো নাটকের দোষ নয়। এ নাটকের প্রধান দোষ এর অভিনয়, সেটাই তো আমরা পারছি না!
অমর বলল, কোন শুয়োরের বাচ্চা মহিন্দিরের পার্টে আমার চেয়ে ভাল অভিনয় করবে? এ নাটকে আরও মাল ঢোকাতে হবে। নাচ নেই, গান নেই, লোকে শুধু শুধু পয়সা খরচ করতে আসবে? কাল থেকে তুই দুখানা নাচ দিয়ে দেখত!
নয়নমণি হেসে ফেলে বলল, মদ খেয়ে খেয়ে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে অমরবাবু! বিনোদিনী হিন্দু ঘরের বিধবা না? সে নাচবে? তা দেখলে দর্শকরাই আমাদের মারতে আসবে!
অমর বলল, ওসব বাজে কথা ছাড়! কেন, বেধবারা বুঝি নেত্য করে না! ঠিক মতন নাচতে জানলেই নাচে! বিনোদিনী ঘরের মধ্যে একা একা নাচবে। সে রকম দুখানা সিন ঢুকিয়ে দেব। লোকে নয়নমণির বকবকানি শুনতে আসে না, তার নাচ দেখতে আসে, তার গান শুনতে আসে। লাস্ট সিনে তুই একখানা গান গাইবি। খুব স্যাডের মাথায় গাইবি, লোকে যেন হুপুস হাপুস করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যায়। বাঙালিরা কাঁদতে বড় ভালবাসে!
নয়নমণি বলল, কী আবোল তাবোল বকছ? এসব শোনার আমার সময় নেই, বাড়ি যাচ্ছি।
অমর এবার গর্জে উঠে বলল, চোপ! আমি আবোল তাবোল বকছি? কাল থেকে তোকে নাচতে হবে। এই আমার হুকুম!
নয়নমণি তবু হালকাভাবে বলল, হু, হুকুম না ছাই! কাল সকালে এসব কথা মনে থাকবে? মনেক খেয়েছ, এখন ঘুমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করো।
নয়নমণি পেছন ফিরতেই অমর আবার বলল, অ্যাই, যাচ্ছিস কোথায়? কথাটা কানে গেল না? ভেবেছিস আমি মাতাল হয়েছি? মোটেই না! যা বলছি, ঠিক বলছি। কাল থেকে তোকে নাচতে হবে!
নয়নমণি সংক্ষিপ্তভাবে বলল, আমি পারব না!
অমর বলল, পারবি না মানে? আলবাত পারতে হবে!
নয়নমণি বলল, জোর করে আমাকে দিয়ে কোনওদিন তুমি কিছু করাতে পেরেছ? এই নাটকে নাচ দেখানোর চেয়ে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরাও ভাল! অমন বিশ্রী কথা আমি আর শুনতেও চাই না।
দাঁতে দাঁত চেপে অমর বলল, অত বেশি দেমাক দেখাবি না আমাকে। আমি অমর দত্ত!
টেবিল ছেড়ে উঠতে গিয়ে হাত থেকে মদের বোতলটা পড়ে ভেঙে গেল। তাতে আরও রাগ বেড়ে গেল অমরের। নেশার ঝোঁকে কী যে করছে তার খেয়াল রইল না, ছুটে এসে নয়নমণির গালে সপাটে এক চড় কষাল!
খানিকটা টলে গিয়ে দেওয়াল ধরে সামলে নিল নয়নমণি। গালে জ্বালা করছে, সেখানে একটা হাত রাখল। অমরের শরীরটা জ্বলছে, আর ফোঁস ফোঁস করে সে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে।
পরস্পর সোজাসুজি চেয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ।
নয়নমণি শান্ত কঠিন গলায় বলল, অমরবাবু, আমার গায়ে আর হাত তুলল না কক্ষনও। পুরুষের স্পর্শ আমি সহ্য করতে পারি না। তোমাকে অনেকদিন আগেই বলেছি না, আমার কাছে সবসময়। একটা ছুরি থাকে, আর একবার কাছে এলে তুমি খুন হয়ে যাবে।
অমর বলল, ওসব ছুরি ফুরি আমি গ্রাহ্য করি? আজ আমি তোর সতীপনার গুমোর ভাঙব!
নয়নমণি স্থিরভাবে চেয়ে থেকে বলল, সাবধান, এগিয়ো না, আর এগিয়ো না, অমরবাবু তোমার। মান-সম্মান সব ধুলোয় লুটোবে! এই নাটকে যদি তুমি নাচ ঢোকাতে চাও, তা হলে অন্য মেয়ে খোঁজো। আমি পারব না, এই আমার শেষ কথা। তুমি অন্য মেয়েকে নাও। আমি কাল থেকে আসব না।
বিকৃত স্বরে অমর বলল, আসতে হবে না। আর কোনওদিন আসতে হবে না। দূর হয়ে যা! তোকে ছাড়াও আমার নাটক চলবে। আর কোনওদিন আমার থিয়েটারে পা দিবি না!
আঁচলটা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিল নয়নমণি। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, যাক, তুমি নিজের মুখে এই কথাটা বলে আমাকে বাঁচালে। তুমি না তাড়িয়ে দিলে আমি যেতে পারছিলাম না। তোমার ওপর আমার কেমন যেন মায়া পড়ে গিয়েছিল। এত ভাল একটা থিয়েটারকে তুমি নিজেই নষ্ট করলে। তুমি যেন আকাশের একটা উল্কা, ধ্বংস হয়ে যাওয়াই তোমার নিয়তি। যাক, চলোম, থিয়েটারের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে!
অমর বলল, যা, যা, দূর হয়ে যা! ঘেন্না! তোর মতন মেয়েকেই আমি ঘেন্না করি। খালি বড় বড় কথা! থিয়েটারকে বাঁচাবার জন্য আমি মুখে রক্ত তুলে মরছি, হারামজাদি, আমার কথা শুনবি না, আমি অন্য মেয়েকে গড়ে পিটে নেব…
নয়নমণি আর কথা বলল না, বেরিয়ে এল ঘর থেকে। অমর তবু তাকে তাড়া করে এল, চ্যাঁচামেচি শুনে জড়ো হল আরও অনেকে।
দর্শকরা সবাই চলে গেছে, প্রেক্ষাগৃহ অন্ধকার। মঞ্চে এখনও পাদপ্রদীপের আলোগুলো নেভাননা হয়নি। অমর মঞ্চে এসে পাগলের মতন চিৎকার করতে লাগল, আমি অমর দত্ত! কারুর পরোয়া করি না। আমি জঙ্গলে গিয়ে একা অভিনয় করলেও দর্শকরা ছুটে আসবে। বেরিয়ে যা, দূর হয়ে যা, যা যা যা যা যা! অমর দত্ত উল্কা, অ্যাঁ? অমর দত্ত সূর্য, আর সব কটা জোনাকি!
নয়নমণি কোনও উত্তর না দিয়ে মুখ নিচু করে নামতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে, মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
আগেও বেশ কয়েকবার এরকম ঝগড়াঝাটি হয়েছে, সুরার নেশায় আত্মবিস্মৃত হয়ে অমর অনেক কটুকাটব্য করেছে। পরে সুস্থ অবস্থায় আবার অনুতাপ করেছে, নয়নমণির ওপর সে অনেকখানি নির্ভরশীল, লোক পাঠিয়ে নয়নমণিকে ডেকে আনিয়েছে, কখনও কখনও নিজে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। এবার সে আর এল না, একটানা তিন-চারদিন মদ্যপান চালিয়ে যেতে লাগল। চোখের বালি’র অভিনয় বন্ধ।
এক থিয়েটারের ভেতরকার খবর অতি দ্রুত অন্য থিয়েটারের মালিক-ম্যানেজারদের কাছে পৌঁছে যায়। অমর দত্ত নয়নমণির মতন অভিনেত্রীকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে এই সংবাদ শোনামাত্র অন্য থিয়েটার থেকে লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে আনাগোনা শুরু করে দিল দূতেরা। কারুর সঙ্গে দেখাই করল না নয়নমণি। দিন সাতেক বাদে ক্লাসিক থিয়েটার থেকেই সহ-অভিনেতাদের তিন-চারজনের একটি দল এল তার বাড়িতে, নয়নমণিকে এদের সঙ্গে কথা বলতেই হল। নয়নমণিকে অমর দত্ত অমন কুৎসিত ভাষায় গালিগালাজ করার জন্য তারা দুঃখিত এবং ক্রুদ্ধ। নয়নমণি অবশ্য সে অপমান গায়ে মাখেনি। বেহেড মাতাল অবস্থায় কেউ কেউ অমন প্রলাপ বকে, এ তো নতুন কিছু নয়। আরও কত শ্রদ্ধেয় মানুষও তো কত কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করে, ওসব গায়ে মাখতে নেই।
ওই দলের মুখপাত্রটি অন্য একটি প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। অমর দত্ত যে ভাবে চালাচ্ছে, তাতে ক্লাসিক থিয়েটারের শিগগিরই আবার যে ভরাডুবি হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তাদের ভাগ্য অনিশ্চিত। সুতরাং অনেকে মিলে এখনই ক্লাসিক ছেড়ে বেরিয়ে এসে অন্য একটি রঙ্গমঞ্চ ভাড়া নিয়ে একটি নতুন দল গড়তে চায়। অর্ধেন্দুশেখরকে আনার চেষ্টা হবে। নয়নমণিকে তো সেই দলে অবশ্যই চাই।
নয়নমণি শান্তভাবে শুনল। নতুন মালিকপক্ষ যে-ভাবে চাপ দিচ্ছে, তাতে ক্লাসিক থিয়েটারে অমর দত্ত যে বেশিদিন টিকতে পারবে না, সেটা নয়নমণিও বুঝেছে। থিয়েটারে দল ভাঙাভাঙি তো চলেই। কিন্তু নয়নমণি সে দলে যোগ দেবে না।
নয়নমণি বলল, আমি থিয়েটার একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছি। যেটুকু টাকাকড়ি জমা আছে, তাতে খাওয়াপরার চিন্তা করতে হবে না। রং মেখে স্টেজে নামতে আর আমার ইচ্ছে করে না।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে পেড়াপিড়ি, অনুনয় বিনয় চলল, কিন্তু নয়নমণি অনড়। এটা তার হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়, কিছুদিন ধরেই মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেবার কথা ভাবছিল, অমর দত্ত নিজে থেকেই তাকে বিদায় দেবার পর সে একেবারে মনস্থির করে ফেলেছে।
সেই দলটি ক্ষুণ্ণ হয়ে চলে গেল। নয়নমণির তবু একটা আশঙ্কা রইল, যদি অর্ধেন্দুশেখর স্বয়ং তাকে অনুরোধ জানান, তখন সে কী ভাবে প্রত্যাখ্যান করবে? অর্ধেন্দুশেখর অবশ্য শপথের বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি দিয়ে গেছেন, কিন্তু সে কথা কি তাঁর মনে আছে? কিছুকালের বিস্মৃতির পর অর্ধেন্দুশেখর আবার অতি উজ্জ্বলভাবে ফিরে এসেছেন মঞ্চে, এখন গিরিশবাবুর সহযোগী হয়ে বেশ সার্থকভাবে মিনার্ভা চালাচ্ছেন।
অর্ধেন্দুশেখর অবশ্য প্রস্তাব পাঠালেন না। নতুন দলটিও গড়া হল না।
পুঁটি কয়েকমাস আগেই স্টার থিয়েটারে সুযোগ পেয়েছে, তার দায়িত্বও আর নিতে হবে না নয়নমণিকে।
দেখতে দেখতে সে বেশ লম্বা হয়েছে, রূপ খুলেছে তার, মুখে বেশ লাবণ্য আছে, তাকে দেখলে এখন কে বলবে যে কয়েক বছর আগে সে ছিল বাপ মায়ের খেদানো এক পথের কাঙাল। তার কোমর কৃশ, নিতম্ব ও বক্ষদেশ পুরু, তার নাচের ভঙ্গিমা সাবলীল। ক্রমশ থিয়েটারে তার কদর বাড়ছে, সে যেন হয়ে উঠছে আর এক নয়নমণি।
এখন নিজেকে বেশ মুক্ত আর স্বাধীন মনে হয় নয়নমণির। থিয়েটারে আর যেতে হবে না। সে একা একা মনের সুখে কিংবা দুঃখে গান গাইবে, ইচ্ছে হলে ঘরের মধ্যে নাচবে। কন্তু দর্শক-শ্রোতাদের হাততালি কুড়োবার জন্য তাকে আর ওসব করতে হবে না। হাততালির মোহ তার কেটে গেছে। থিয়েটারের মালিকদের নির্দেশে অনেক সময় অনিচ্ছার সঙ্গেও নাচতে হয়। যেখানে গান মানায় না সেখানেও গাইতে হয়। তাতে একটুও আনন্দ পাওয়া যায় না। তবু মুখে নকল খুশির ভাব ফুটিয়ে রাখতে হয়। এখন সেসব থেকে মুক্তি।
অনেকদিন সরলা ঘোষালের বাড়িতে যাওয়া হয়নি। বঙ্গ ভঙ্গ উপলক্ষে সারা দেশ উত্তাল, চতুর্দিকে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে। প্রায় দিনই সভা সমিতি হচ্ছে বিভিন্ন স্থলে। তবু সরলা ঘোষালের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি দেশের কথা এত ভাবেন। তিনি তো এ সময় চুপ করে থাকার পাত্রী নন। নয়নমণি শুনেছিল, সরলা হিমালয়ে মায়াবতী আশ্রমে বেড়াতে গেছেন। সেখানে তিনি কতদিন বসে থাকবেন?
নয়নমণির থিয়েটার ছেড়ে দেবার কথা শুনে সরলা নিশ্চয়ই খুশি হবেন। সরলা নয়নমণিকে অনেক কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। দেশের তৈরি বস্ত্র ও নানারকম সামগ্রী বিক্রি করার জন্য একটা স্বদেশি শিল্পভাণ্ডার খোলা হয়েছে, সরলার ইচ্ছে ছিল নয়নমণি সেই দোকানটি চালনার ভার নিক। দেশের মানুষকে এই সব দেশি জিনিস কেনার জন্য উদ্বুদ্ধ করা দরকার। কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে নয়নমণিকে অনেক মানুষ চেনে। সে একটা দোকানে সর্বসমক্ষে দাঁড়াতে সংকোচ বোধ করেছে। অভিনেত্রীদের অনেক জ্বালা, কিছুতেই লোকেরা অভিনেত্রীদের সহজ, সাধারণ মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না। নয়নমণিকে আগে ওই পরিচয়টা মুছে ফেলতে হবে।
সরলা মায়াবতী আশ্রম থেকে ফিরেছেন কিনা তা খোঁজ নেবার জন্য নয়নমণি একদিন গেল বালিগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে একটি সংবাদ শুনে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সে বাড়িতে সরলার বাবা, মা কেউ নেই, কথা হল একজন পরিচারিকার সঙ্গে। সরলা ফেরেননি তো বটেই, এর মধ্যে তার বিয়ে হয়ে গেছে। তাও কলকাতায় নয় দেওঘরে!
এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল, তা নয়নমণি ঘুণাক্ষরেও টের পেল না? এই বিখ্যাত পরিবারে কিছু একটা ঘটলেই সারা শহরে জানাজানি হয়ে যায়। আর সরলা ঘোষালের সঙ্গে কোনও বঙ্গ ললনারই তুলনা হয় না, তিনি অনেক নিয়ম ভেঙে দুঃসাহসের পরিচয় দিয়েছেন। তাকে বিবাহ করার জন্য কত বিশিষ্ট পুরুষ ব্যগ্র হয়েছে, হঠাৎ বিয়ে হয়ে গেল কার সঙ্গে? তাও কলকাতার বদলে দেওঘরে কেন? অতি সামান্য কারণে এই ঘোষাল বাড়িতে প্রায়ই বিশাল ভোজের ব্যবস্থা হয়, এ বাড়ির কনিষ্ঠা কন্যার বিবাহে সেরকম কিছুই হল না?
নয়নমণি কেন, কলকাতার উচ্চ সমাজের প্রায় কেউই সরলার বিবাহ-সংবাদ জানতে পারেনি। বলা যেতে পারে, ব্যাপারটি সংঘটিত হয়েছে গোপনে। পাত্রও সম্পূর্ণ অপরিচিত।
সরলা ছিলেন মায়াবতী আশ্রমে, দেওঘর থেকে তাঁর মা বাবা জরুরি তলব দিয়ে তাকে সেখানে আনালেন। সেখানে তাঁর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। জিনিসপত্র কেনাকাটিও শেষ। সরলা আপত্তি জানাবার চেষ্টা করতেই ধমক খেলেন মায়ের কাছে।
জানকীনাথ বেশি কথা বলেন না, স্বর্ণকুমারী বললেন, তুমি এতদিন যা যা করতে চেয়েছ, আমরা বাধা দিইনি, তোমার বাবা বরং প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু সব কিছুরই একটা সীমা আছে। আমাদের বংশ, আমাদের পরিবারের সুনামের কথাও তোমাকে চিন্তা করতে হবে। তুমি বিয়ে করবে না ঠিক করেছিলে। কিন্তু তোমাকে নিয়ে গুজবের পর গুজবে কান পাতা যায় না। সমাজে আমরা এখন মুখ দেখাতে পারি না। ওই প্রভাতকে নিয়ে কী কেলেঙ্কারিটাই না হল! তুমি তাকে প্রশ্রয় দাওনি!
সরলা নিরুত্তর হয়ে মুখ নিচু করে রইল।
নবীন লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আসা যাওয়া করতেন সম্পাদিকা সরলা ঘোষালের কাছে। ক্রমে সাহিত্য আলোচনা ছাড়াও আরও কিছু কিছু ব্যক্তিগত আলোচনা শুরু হয় দুজনের মধ্যে। দেশ-বিদেশে কখনও কোনও সম্পাদকের বিশেষ কোনও লেখিকার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ার নিদর্শন আছে, কিন্তু সম্পাদিকার সঙ্গে কোনও লেখকের প্রণয়ের কথা আগে শোনা যায়নি। সরলা ঘোষালের সব কিছুই তো অভিনব। যাই হোক, প্রভাতের সঙ্গে সরলার এই ঘনিষ্ঠতা তার পিতা মাতা ও মাতুল পরিবার মেনে নিয়েছিলেন। এখন বিবাহ সম্পন্ন হলেই হয়। অবশ্য তার আগে পাত্রটিকে যোগ্য করে তোলা দরকার। প্রভাতের বংশগৌরব নেই। সাধারণ এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান, অন্তত ব্যারিস্টার না হলে ঘোষাল বাড়ির জামাই হয় কী করে? সরলার মামা মত্যেন্দ্রনাথই প্রভাতকে বিলেত পাঠিয়ে ব্যারিস্টারি পড়াবার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। প্রভাতদের পরিবারে আগে কেউ বিদেশে যায়নি, কালাপানি পার হওয়া এখনও পাপ মনে করেন প্রভাতের মা। জানতে পারলে তিনি অনুমতি দেবেন না, তাই প্রভাত চুপি চুপি জাহাজে উঠে পড়ে।
যথা সময়ে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এলেন প্রভাত। ততদিনে অনেকেই জেনে গেছে যে সরলার সঙ্গে প্রভাতের বিবাহ আসন্ন। কিন্তু প্রভাতের বাড়ির লোকের কানে যখন এই কথা পৌঁছল, তখন ঘোর আন্দোলন শুরু হল। ব্রাহ্ম পরিবারের কন্যাকে ঘরের বউ করে আনতে প্রভাতের মায়ের ঘোর আপত্তি। তা ছাড়া ও মেয়ে বয়স্কা, অনেক পর-পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে। শেষ পর্যন্ত মাতৃভক্তি জয়ী হল, প্রভাত নিজেও এ বিবাহে অসম্মতি জানিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। তাতে ঘোষাল পরিবারের চরম অপমান হয়নি? জানকীনাথ ঘোষাল মর্মাহত হলেন। তিনি নিজে পিতার ত্যাজ্যপুত্র ও জমিদারি থেকে বঞ্চিত হবার ঝুঁকি নিয়েও ব্রাহ্ম পরিবারে বিয়ে করেছিলেন। তার এক প্রজন্ম পরেও এক শিক্ষিত, সাহিত্যরুচি সম্পন্ন যুবক মায়ের কুসংস্কার ও জেদের কাছে হার স্বীকার করল?
শুধু প্রভাত নয়, সরলার আরও পাণিপ্রার্থীর অভাব ছিল না। বাড়ির বৈঠকখানায় সব সময় কেউ না কেউ বসে থাকে। কোনও কোনও অবাঙালির সঙ্গেও সরলার নাম জড়িয়ে কথা কানাকানি হয়েছে। কংগ্রেসের প্রখ্যাত নেতা গোখলের সঙ্গে সরলার বিয়ে হতে চলেছে, এ কথাও উঠেছিল না? তারপর ডাক্তার পৈরামলকে নিয়েও কী কাণ্ডটাই না হল! রুশ-জাপান যুদ্ধ চলছে, ভারতীয়রা জাপানের প্রবল সমর্থক। এ দেশ থেকে জাপানকে সাহায্য পাঠাবার নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরলাও জড়িয়ে পড়েছিল রেড ক্রশের কাজে। রেড ক্রশের পক্ষ থেকে অনেক ওষুধপত্র দিয়ে পঞ্জাবের ডাক্তার পৈরামলকে পাঠানো হয় জাপানে। সেই সূত্রে পৈরামলের সঙ্গে সরলার পরিচয়। তারপর তাদের ঘনিষ্ঠতা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে দুএকটি সংবাদপত্রে তাদের আশু বিবাহের কথা ছাপা হয়ে গেল পর্যন্ত! তারপর সে সম্পর্কও ভেঙে গেছে। ছি ছি ছি ছি!
সরলা বিয়ে করতে রাজি হয়নি, অথচ বিভিন্ন পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতে আপত্তি নেই। সমাজ তা মেনে নেবে না। তুমি যদি বিবাহ না করতে চাও, তা হলে তোমাকে অন্তঃপুরবাসিনী, ব্রহ্মচারিণী হতে হবে। অন্তঃপুরের বাইরে যদি তুমি মুখ দেখাও, তা হলে তুমি বিবাহ করতে বাধ্য। নচেৎ তোমার সমগ্র পরিবার সমাজচ্যুত হবে।
সরলার আর আপত্তি জানাবার মুখ নেই। বাবা-মা পাত্রও ঠিক করে ফেলেছেন, সে একজন পাঞ্জাবী, নাম রামভজ দত্ত চৌধুরী, বয়েস হয়েছে যথেষ্ট, এবং সে বিপত্নীক। পাত্রের বয়েস তো বেশি হবেই। সরলারই বয়েস হয়ে গেল তেত্রিশ। তার কাছাকাছি বয়েসের অবিবাহিত পুরুষ পাওয়া যাবে কোথায়? অধিকাংশ পুরুষেরই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়, আর মেয়ে হয়েও সরলা এতদিন পর্যন্ত কুমারী। ইচ্ছে করেই বাংলার বাইরে থেকে পাত্র নির্বাচন করা হয়েছে, বিবাহের পর সরলার অনেক দূরে থাকাই ভাল। কলকাতায় থাকলে যদি বিয়ের পরেও সরলার রূপ-গুণমুগ্ধের দল প্রাক্তন প্রেমিক, ব্যর্থ প্রেমিকরা তার বাড়িতে যাতায়াত শুরু করে, তাতে আর এক কেলেঙ্কারি শুরু হবে। সেই একই কারণে কলকাতায় বিবাহ-বাসরের ব্যবস্থা করা হয়নি, সেখানে গোলমালের আশঙ্কা আছে। দেওঘরে খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে অনুষ্ঠান সেরে নেওয়া হবে, খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে শুধু।
বিদ্রোহিনী সরলা, বহু সংস্কার ভেঙে ফেলেছেন যে সরলা, তিনি আর মাথা তুলতে পারলেন না, বাবা মায়ের ইচ্ছার কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেন। যে পুরুষটিকে তিনি চোখেও দেখেননি আগে, তাকেই বিবাহ করতে সম্মতি জানালেন সরলা। নয়নমণি ফিরে এল ঘোষাল বাড়ি থেকে। সে ভেবেছিল, থিয়েটার ছেড়ে দিয়ে সরলার নির্দেশে দেশের কাছে আত্মনিয়োগ করবে। কিন্তু সরলাকে আর পাওয়া যাবে না। তিনি চলে যাবেন দূর দেশে। কলকাতায় তার সমস্ত কর্মকাণ্ড অসমাপ্ত রয়ে গেল। এখন নয়নমণিকে তার নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। নয়ণমণি নামটারই বা আর দরকার কী! এখন থেকে সে আবার ভূমিসূতা।